চাহতে হৈঁ
খুবরুয়োঁ-কো অসদ;
আপ-কী সূরৎ তো দেখা চাহীয়ে।।
(সুন্দর মুখ ভালবাসেন, আসাদ;
নিজের মুখখানিও
তো একবার দেখা চাই।।)
কিস্সাটা একটু ঘুড়িয়ে দেওয়া যাক ভাইসব। কবরে শুয়ে বসে আমাদের দুজনের বকবক শুনতে শুনতে বিরক্ত লাগারই কথা। খামোখা লাগাতার আমাদের কথা শুনবেনই বা কেন। আপনারা? আপনাদের জীবনেও তো কিস্সা কিছু কম নেই, যদি কখনও বলতে চান, আমরা দুজন মন দিয়ে শুনব, খোদার কসম বলছি। তবে এখন, মির্জাসাব ও আমাকে বাদ দিয়ে অন্য একটা কিস্সাই শোনাই আপনাদের। ভারী পাথরের মত মির্জাসাবের জীবনের বাইরে এই হাল্কা-ফুল্কা কিস্যাটা আপনাদের ভালই লাগবে, কিস্যার মধ্যে মাঝে মাঝে হাওয়া খেলাতে হয়; যারা তা পারে না, তাদের আমি কিস্সা লেখকই বলি না। এদের লেখা পড়তে পড়তে দম বন্ধ হয়ে আসে, যেন একটা কয়েদখানায় ঢুকিয়ে ওরা হুকুমত চালাতে থাকে। আরে বাবা, শব্দ তো এক-একটা ফুল, তার রং-গন্ধই যদি না পাওয়া যায়, তবে সে তো মরা এক একটা হরফ। হাফিজসাব বলেছিলেন না,
রৌনকে অহাদ শবাবস্ত
দিগর বোস্তারাঁ
মী রসদ মুদ্দা-এ-গুল
বুলবুলে খুশ ইলহাঁরা।
(বাগানে বাগানে বনে উপবনে
নওজোয়ানের কাল এসে গেছে;
পেল সুকণ্ঠ বুলবুল আজ
সেই সুখবর গোলাপের কাছে)
বুলবুলের গানই যদি গোলাপের কাছে না পৌঁছয়, তা হলে পাতার পর পাতা শব্দ লেখা কেন? ভাষার ভিতরে খুবই অভিমান আছে, ভাইসব।
সেই দরবেশের কথা মনে আছে তো? যমুনা নদী থেকে উঠে তিনি আসাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। যেমন শামসউদ্দিন তাবরিজি একদিন জালালুদ্দিন রুমির জীবনে এসেছিলেন, আর তারপর তো রুমি এক অন্য জীবনের ভিতরে ঢুকে গেলেন। এই শামস এক আশ্চর্য মানুষ ছিলেন, ভাইসব। এক দিব্যোন্মাদ পুরুষ। তাঁর একটা কিস্সা জিভের ডগায় এসে গেছে, তাই বলেই ফেলি। ভাববেন না, মির্জাসাবের জীবনের সঙ্গে এই কিস্সার কোনও সম্পর্ক নেই। মির্জাসাবের জীবনটা যে কত কিস্সায় জড়িয়ে আছে, আমি ভেবে কুলকিনারা পাই না। শামসের কিস্সাটা শুনলে বুঝতে পারবেন, মির্জাসাব এর মধ্যে কোথায় লুকিয়ে আছেন।
ওয়াউদ্দিন কিরমানি ছিলেন এক সুফি শেখ। তিনি মনে করতেন, এই যে দুনিয়া-এই সৃষ্টির সব খুবসুরতির মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় আল্লাকে। একদিন এক হ্রদের জলে চাঁদের ছায়ার দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন তিনি। শামস তাঁকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, জলের দিকে কেন তাকিয়ে আছেন শেখ?
-চাঁদের ছায়া দেখছি।
-কেন, আপনার ঘাড়ে কি ব্যাথা হয়েছে?
-না।
-তা হলে আশমানে তাকালেই তো চাঁদকে দেখা যায়। নাকি, আপনার চোখ অন্ধ হয়ে গেছে? সোজা জিনিসকে তো সোজা ভাবেই দেখতে হয়।
শামসের কথা শুনে শেখ তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন।
-হুজুর, আপনি আমার পীর, আপনার পায়ে আমাকে ঠাঁই দিন।
শামস বললেন, আমার মুনাসিব হওয়ার তাক আপনার নেই।
-আছে হুজুর। আপনার পথে আমাকে নিয়ে চলুন।
শামস হা হা করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, তা হলে দারু নিয়ে আসুন। বাগদাদের বাজারে বসে আমরা একসঙ্গে বসে দারু খাব।
ইসলামে তো দারু হারাম। শেখ বাজারে বসে দারু খেলে লোকে কী বলবে? তাঁর মান-ইজ্জত ধুলোয় লুটোবে। শেখ মিন মিন করে বললেন, তা কি করে হয় পীরজাদা?
শামস চিল্কার করে উঠলেন, আপনি কখনও আমার মুনাসিব হতে পারবেন না। আল্লার দরবারে পৌঁছনোর ক্ষমতাই আপনার নেই। আমি তাঁকে খুজছি যে আলওয়াজিদের কাছে পৌঁছতে পারবে।
জালালউদ্দিন রুমির মধ্যেই সেই মানুষকে খুঁজে পেয়েছিলেন শামস। আমি মাঝে মাঝে দেখতে পাই, জামা মসজিদের সামনে বসে শামসের সঙ্গে মির্জাসাব দারু পান করে চলেছেন। তাঁদের মুখোমুখি বসে আছেন মওলা রুমি। নতুন একটা মসনবি লিখছেন তিনি, তাঁর প্রেমিক শামস আর মির্জাসাবকে নিয়ে। এইসব যদি সত্যিই হত, ভাবুন একবার, দুনিয়াটা যেন তা হলে জামেয়ার হয়ে যেত।
না, না, ওইরকম অবিশ্বাসী চোখে তাকাবেন না আমার দিকে ভাইজানেরা। আমি কিছু ভুলি নি। আমার স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। দেখুন, যে-দুনিয়ায় আমি বড় হয়েছি, দুই দেশের মোহাজিরদের যে-স্রোত আমি দেখেছি, সেখানে স্মৃতির নূরই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। এত মোহাজির-এত উদ্বাস্তু-আমার কি মনে হয় জানেন, বিংশ শতাব্দীর নাম দেওয়া উচিৎ উদ্বাস্তুদের শতাব্দী। নাম হারিয়ে যাওয়া, নাম বদলে যাওয়ার শতাব্দী। আমার ঠাণ্ডা গোস্ত গল্পটা। আপনারা কি কেউ পড়েছেন? গল্পটা লেখার জন্য অশ্লীলতার দায়ে আমার বিচার হয়েছিল। লাহোরের কোর্টে। কী বলছেন? ঠাণ্ডা গোস্ত গল্পটা শুনতে চান? কিন্তু আজ তো আমরা অন্য একটা কিস্সা শুরু করেছি ভাইসব। ঠাণ্ডা গোস্তে-এর কথা নয় পরে একদিন বলা যাবে। আরে, এই দুনিয়াটা হারিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত কত কত শতাব্দী তো কবরেই থাকতে হবে। আমাদের, ঠাণ্ডা গোস্ত-এর কিস্সা বলার ফুরসত একদিন পাওয়া যাবেই।
হ্যাঁ, সে দরবেশ এসে আসাদের হাতে একটা আয়না তুলে দিয়েছিলেন, মনে আছে তো? আয়নায় আসাদের আম্মাজানের পশমিনার মত নীল আকাশ ফুটে উঠেছিল পাখিদের উরালের নকশা। পাখিরা চলেছে তাদের রাজা সিমুর্গের খোঁজে। এ এক গভীর কিস্সা ভাইসব। আসাদকে দেওয়া দরবেশের আয়নায় কেন যে এই কিস্সার ছবি দেখা গিয়েছিল, তা একমাত্র খোদাই জানেন। আল-খালিক কখন কী পাঠাবেন, তা আমরা কতটুকু জানতে পারি? আমার কী মনে হয় জানেন, এই যে জানাতে পারি না, তাই এত এত শব্দ লিখে যেতে পারি। দস্তানের এই এক মজা, তুমি লেখো, লিখে যাও, কোন চুতিয়া সমালোচক কী বলল, তাতে তোমার কী এসে যায়? দস্তান তো দস্তানই; তারা একা একা বাঁচে, একা একা মরে যায়।
মাফ করবেন ভাইসব, কথা বলতে বলতে আমি আসলে একটা গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়ি। সারা জীবন আমি কত যে জীবিত আর মৃতদের সঙ্গে কথা বলেছি। কথা না বলতে পারলে মনে হত, আমাকে কেউ পাথরচাপা দিয়ে রেখে দিয়েছে। ইসমত আমার কথা শুনে খুব হাসত, ইসমতকে চেনেন তো, ইসমত চুঘতাই, ওকে কাছে পেলেই কথার নেশায় পেয়ে বসত আমাকে, ইসমতও খুব সুন্দর কথা বলতে পারত, চশমার আড়ালে ওর চোখ দুটো ছিল যেন হ্রদের মত। আমি সেই হ্রদের ভিতরে ডুবে কথা বলে যেতাম শুধু, ইসমত বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকত, আর আমার ইচ্ছে হত, ওর চোখ দুটো আমি একদিন গিলে খাব। ইসমতকে অবশ্য একথা বলা হয়নি কখনও। তা হলে আমার মাথার চুলগুলো খাবলে তুলে ফেলত ও।
দরবেশ বাবার দেওয়া আয়নার ভেতরে পাখিরা উড়ে যাচ্ছিল মনে আছে তো? ফরিদউদ্দিন আতরের লেখা কিস্সা ফুটে উঠল দরবেশের আয়নায়। কী আশ্চর্য ভাবুন! আয়নার ভিতরে কিস্সা। আর সব কিস্সাই তো একটা আয়না, তাই না? আয়না আর কিস্স কখন যে একাকার হয়ে যায়, আমি তো কোনওদিন বুঝতে পারিনি। যাঙ্গে। কিন্তু ওই পাখিদের কিস্সাটা বলার আগে বাবা আতরসাবের কথা একটু বলে নিতেই হবে। আল্লার দূত তিনি, সুফি সাধক, আবার কিস্সা লেখাতেও তাঁর জুড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না। একমাত্র আবদুল-রহমান জামির সঙ্গেই হয়তো কিছুটা তুলনা করা যায়। আতরসাবের জন্ম হয়েছিল পারস্যের নিশাপুরে, সে প্রায় আটশো বছর আগের কথা। দারুখানার মালিক ছিলেন তিনি; সেখানে ওষুধ তৈরি হত, আবার নানা রকমের আতরও। বেশ জমিয়েই ব্যবসা করছিলেন ফরিদউদ্দিন। একদিন একজন দরবেশ এসে হাজির তাঁর দারুখানায়। কত বড় দোকান, তিনি তো হাঁ করে দেখতে লাগলেন সব কিছু, তারপর আতরসাবের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এভাবে কেউ যদি এক নাগাড়ে কারুর দিকে তাকিয়ে থাকে, তবে অস্বস্তি হওয়ারই কথা। আতরসাব জিজ্ঞেস করলেন,
আমাকে এভাবে দেখছেন কেন হুজুর?
দরবেশ হাসলেন। -আমি ভাবছিলাম, এত ধনসম্পদ ফেলে তুমি কীভাবে গোরে যাবে?
আতরসাব একটু রেগে গিয়েই বললেন, আপনার মতই আমারও এন্তেকাল আসবে। আলাদা আর কী হবে?
-কিন্তু আমার এই ছেড়া আলখাল্লা আর ভিক্ষাপাত্র ছাড়া কিছু নেই ভাইজান। তোমার সম্পত্তি তো অনেক। তা হলে আমার মত করে কী করে মরবে তুমি?
-আপনার মতই মরব আমি।
তারপর কী হল জানেন ভাইসাব? ভিক্ষাপাত্রটি মাথার বালিশ করে শুয়ে পড়লেন দরবেশ। চোখ বুজে বললেন, বিসমিল্লাহ আর-রহমান আর – রহিম। তাঁর জিকির শেষ হতেই জিব্রাইল এসে তাঁকে নিয়ে গেলেন। আতরসাব পাথরের মতো দাঁড়িয়ে এই আশ্চর্য মৃত্যু দেখলেন। তারপর চিরদিনের জন্য কারখানা বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লেন তাঁর দীন-এর পথে। দরবেশ বাবার দেওয়া আয়নায় আসাদ যে পাখিদের দেখেছিল, তাদের জন্ম হয়েছিল আতরসাবের কিস্সায়অনেক বাখোয়শ আপনারা এতক্ষণ ধরে সহ্য করলেন, এবার তা হলে কিস্সাটাই হোক। তবে কী জানেন, এক কিস্সা থেকে আর এক কিস্সায় ঢুকে পড়তে আমার
খুব ভালো লাগে; কিস্সাগুলোর ভিতরে আমি কখনও দরবেশ হয়ে যাই, কখনও আতরসাব, কখনও কাল্লু। আর মির্জাসাব? তিনি তো আমার ভেতরেই ঢুকে বসে আছেন। মির্জাসাবের সেই শেরটা আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন:
হুয়ী মুদ্দৎ কেহ্ গালিব মর
গয়া, পর য়াদ আতা হৈ
বোহ হরেক বাত-পর কহনা কেহ্ য়ু হোতা তো কেয়া হোতা।
(কত কাল হল গালিব মারা গেছে, তবু মনে পড়ে
কথায় কথায় তার বলা-এমন যদি হত তা হলে
কী হত?)
সাদাত হাসান মান্টো যদি মির্জা আসাদুল্লা খান গালিব হয়ে যায়, তা হলে কী হত? শাফিয়া বেগমকে একবার কথাটা বলেছিলাম; বেগম কী বলেছিল জানেন, ভাইসব? সারা জীবন আপনি অন্যের চরিত্র হয়ে বেঁচে থাকলেন মান্টোসাব, কবে আপনি নিজেকে দেখাবেন? শাফিয়া বেগম তো বুঝত না, মান্টো অনেক চরিত্রের মধ্যেই বেঁচে থাকে। সেই চরিত্ররা ছাড়া মান্টো বলে আসলে কেউ নেই। শাফিয়া বেগম একবার আমাকে বলেছিল, মান্টোসাব, এইসব কিস্সা লিখে কী পেলেন আপনী? কেউ কিছু দেবে না। তার চেয়ে একটা দোকান খুলুন।
–আর আমার মাথার ভেতরের দোকানটা নিয়ে কী করব বেগম?
–মাথার ভেতরে দোকান?
–কত কিস্সার দোকান। বেগম, ওই দোকানটা বন্ধ হয়ে গেলে মান্টো মরে যাবে।
গোস্তাকি মাফ করবেন ভাইজানেরা, কথায় কথায় আমি অনেক দূর চলে এসেছি। আপনাদের চোখ জ্বলজ্বল করছে, আমি জানি, কিস্সাটা শোনার জন্যই আপনারা অপেক্ষা করে আছেন। কিন্তু আপনাদের মান্টোভাইকে একটু ক্ষমাঘেন্না করে দেখবেন। স্মৃতি, বুঝলেন ভাইসব, কত যে স্মৃতি, কথা বলতে বলতে আমাকে শুধু পিছনের দিকে টানতে থাকে, আমি সেই টান এড়াতে পারি না; যদি পারতাম, পাকিস্থানে অমন বেওয়ারিশ কুকুরের মত মরতে হত না আমাকে। কিন্তু এবার পাখিদের কথা হোক। এই দুনিয়ায় সবচেয়ে কোমল প্রাণের কথা। কী জানেন,
আমাদের হৃদয় এক একটা পাখি, কখনও খাঁচায় বন্দি থাকে, কখনও উড়ে যায় আশমানে। আমার খুব ইচ্ছে ছিল, একটা চড়ুই পাখিকে বুকে জড়িয়ে সারা রাত ঘুমিয়ে থাকব, কিন্তু ওদের তো ধরা যায় না, বড় ছটফটে, এই বসে আছে তো, এই উড়ে যাচ্ছে, এই কিচমিচ করে ঝগড়া করছে তো, পরক্ষণেই উদাস হয়ে কোথায় তাকিয়ে আছে। পাখিরা এইরকম, ওরা শুধু জানে, দুনিয়াটা আসলে বেড়ানোর জায়গা, ঘোরো, ফেরো, ওড়ো, তারপর অজান্তেই একদিন মরে যাও না।
একদিন পাখিরা সব একসঙ্গে এসে মজলিশে বসেছে। কেন? তাদের কোনও জাঁহাপনা নেই, তাঁকে খুঁজে বার করতে হবে। সব খোঁজের জন্যই তো একজন মুর্শিদ লাগে। কে হবে মুর্শিদ? সবাই মিলে ঠিক করল, হোদহোদই হতে পারে তাদের মুর্শিদ। হোদাহোদ ছিল সলোমনের প্রিয় পাখি। শেবা নগরী থেকে রানী বিলকিসের খবর সে নিয়ে আসত। তোদহোদই তো তাই একমাত্র মুর্শিদ হতে পারে; সে-ই তো তাদের রাজার কাছে পাখিদের পৌঁছে দিতে পারে।
হোদহোদের মাথায় পালকের কুঞ্জবন, তার ঠোঁটে বিসমিল্লা। তোদহোদ পাখিদের বলল, দেখো, রাজার খোঁজে তোমরা যেতেই পারো, কিন্তু সে-পথ বড় দীর্ঘ আর কঠিন। সেই পথে যেতে হলে এতদিনের জীবন ঝেড়েমুছে ফেলতে হবে; যদি পারো, সবাইকে ছেড়ে যদি ভালোবাসতে পারো, তবেই আমি তোমাদের নিয়ে যেতে পারি।
শুনে তো পাখিদের মাথায় হাত; এক এক পাখির, এক এক অজুহাত, না, না, এত দীর্ঘ যাত্রায় তারা যেতে পারবে না। বুলবুল তো প্রথমেই বলল, আমি কোথাও যেতে পারব না। আমার ভালবাসার গোপন কথা একমাত্র গোলাপই বোঝে। তাকে ছেড়ে কোথায় যাব? গোলাপের ভালবাসাতেই আমার এই জীবনটা কেটে যাবে। হোদহেদ তাকে বলল, তুমি বাইরের খুবসুরতির দিকে তাকিয়ে আছো বুলবুল। গোলাপ যে হাসে, তা তোমার জন্য নয়। মনে হয়, তোমার দিকে তাকিয়ে হাসে, তারপর ঝরে যায়। তোমার দিকে তাকিয়ে কেন হাসে জানো? ও যে একটু পরেই ঝরে যাবে, তুমি তা বোঝ না বলে।
-কিন্তু গুলবাহার ছেড়ে আমি কোথাও যাব না মুর্শিদ।
-তাহলে একটা কিস্স বলি শোনো। হোদাহোদ কয়েকবার ডানা ঝাপটে স্থির হয়ে বসে। বিড়বিড় করে বলে, বিসমিল্লা, আর-রহমান, আর রহিম। খোদা, আমাকে ভাষা দাও। কিস্সাটা যেন বুলবুলকে ঠিকঠিক বলতে পারি। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে চিৎকার করে বলে, শোন, বুলবুল, কিস্সাটা শুনে রাখ। তারপর তোর যা মনে হয় করিস।
-গোলাপ যখন ফোটে, তাঁর কাছে কোনও কিস্সার দাম নেই পীরসাব।
-তা তো বটেই। তবু শোনই না। কিস্যা শুনলে তো আর পেট গরম হবে না।
-বলো, তবে শুনি। বুলবুল কিচকিচ করে ওঠে।
-এক নবাবের ছিল এক কন্যে। কী যে তাঁর রূপ, বলে বোঝানো যাবে না। তারা না-ফোঁটা রাতের আকাশের মতো কালো চুল, সারা শরীরে যেন মৃগনাভির গন্ধ, আর সে কী চাউনি, যখন কথা বলত, মনে হত চিনির চেয়েও মিষ্টি। আর তাঁর গায়ের রং? পদ্মরাগমণিকেও হার মানাত। সত্যি বলতে কী, কন্যেকে যে দেখত, সে-ই প্রেমে পড়ে যেত। খোদার মর্জি তো বোঝা দায়, একদিন এক দরবেশ কন্যেকে দেখে প্রেমে পড়ে গেল। দরবেশ তখন রুটি খাচ্ছিল, কন্যের। খুবসুরতি দেখে তার হাত থেকে রুটি পড়ে গেল। তাই দেখে কন্যে মুচকি হাসল। ওই হাসিই হল কাল, দরবেশ একেবারে দিবানা হয়ে গেল।
-তারপর?
-সে নবাবের হাভেলির সামনে পড়ে রইল সাত বছর। রাস্তার কুকুর বেড়ালদের সঙ্গে দিন কাটাত। সাত বছর ধরে দরবেশ কেঁদেই চলল তার আশিককে পাওয়ার জন্য। তখন কন্যের পাহারাদাররা ঠিক করল, দরবেশকে খুন করতে হবে।
-খুন করল?
-দরবেশকে খুন করা হবে জেনে কন্যের মনে মায়া হল। সে একদিন লুকিয়ে লুকিয়ে বাইরে এসে দরবেশকে বলল, আচ্ছা মানুষ তো তুমি। আমি নবাবের মেয়ে, আমাকে নিকে করার কথা তুমি ভাব কী করে? দ্যাখো, এখান থেকে চলে যাও, আর কখনও এসো না। কাল এখানে থাকলে তুমি মারা পড়বে।
-দরবেশ বলল, তোমাকে যেদিন থেকে দেখেছি, আমার কাছে জীবন ও মৃত্যু সমান হয়ে গেছে। কেউ আমাকে মারতে এলেও আর ভয় পাব না। দুনিয়ার কোনও ক্ষমতা আমাকে তোমার হাভেলির দরজা থেকে সরাতে পারবে না। তোমার পাহারাদাররা তো আমাকে মারতে চায়, তাই না? তাই হবে। কিন্তু তার আগে ধাঁধাটার উত্তর দেবে আমাকে?
-কোন ধাঁধা?
-তুমি আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছিলে কেন?
-তুমি সত্যিই একটা উজবুক। তোমাকে দেখে দয়া হয়েছিল, রুটিটা পর্যন্ত হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল, হাসব না তো কী?
-তারপর? বুলবুল চোখ ছলছল করে তাকায়।
হোদহোদ বলে, তোমার গোলাপ হচ্ছে ওই কন্যের মতো। শুধু বাইরের খুবসুরতি। এইভাবে নানারকম কিস্সা শুনিয়ে পাখিদের না যাওয়ার অজুহাত উড়িয়ে দিল হোদহোদ। তখন পাখিরা জিজ্ঞেস করল, আমাদের জাঁহাপনার জন্যে তো তা নিয়ে যাওয়া উচিত। আপনিই বলুন মুর্শিদ, জাঁহাপনা সিমুর্গের জন্য আমরা কী নিয়ে যাব?
-জিকির। আত্মার জিকির। জাঁহাপনার দরবারে সব আছে। কিন্তু তিনি চান সেই আত্মা, যা আগুনে পুড়ে পুড়ে, অনেক যন্ত্রণা সহ্য করে শুদ্ধ হয়েছে।
কত বছর ধরে যে পাখিরা উড়ে চলল হোদযোদের পেছনে। সাত-সাতটা উপত্যকা পেরিয়ে যেতে হল তাদের। পথে কত পাখি মারা পড়ল, কত পাখির আর ওড়বার ক্ষমতাই রইল না। শেষ পর্যন্ত কাফ পাহাড়ে জাঁহাপনা সিমুর্গের প্রাসাদের সামনে এসে পৌঁছল তিরিশটি পাখি। দারোয়ানরা তো কিছুতেই পাখিদের ঢুকতে দেবে না। কিন্তু এত পথ পেরিয়ে এসে তারা। এতটাই শান্ত হয়েছে, দারোয়ানের গালাগালিতেও তারা কিছু মনে করল না। শুধু অপেক্ষা করতে লাগল। শেষে জাঁহাপনার নিজের নোকর এসে তাদের দরবারে নিয়ে গেল। সে এক আশ্চর্য ঘটান। যেদিকে তারা তাকায়, দেখতে পায় নিজেদেরই, তিরিশটা পাখি, একে অপরের দিকে তাকিয়ে হতবাক। জাঁহাপনা সিমুর্গ তা হলে কোথায়? ভাইসব, ফারসিতে সিমুর্গ মানে তিরিশটি পাখি। তারা এবার তাদের আত্মার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের জাঁহাপনা সিমুর্গ। পাখিরা তখন গেয়ে উঠল, তেরে নাম সে জি লু, তেরে নাম সে মর যাউঁ…।