০৬. কিন্নর কণ্ঠ
মাসখানেক পরের কথা। রাত দশটা বেজে গিয়েছে বলে সবাই বিছানায় শুয়ে পড়েছে এবং শোওয়ার পর হঠাৎ করে মনে পড়েছে ঘরের আলো নেবানো হয় নি। রেবেকা বলল, কী হল, লাইট না নিবিয়ে শুয়ে পড়লি যে বড়।
রুনু বলল, যে সবার শেষে শুকে তার নেবানোর কথা।
ঝুনু বলল, আমি সবার আগে শুয়েছি।
রেবেকা বলল, আমিও সবার আগে শুয়েছি।
তাহলে সবার শেষে কে শুয়েছে?
নিতু তার ভোটকা মিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি।
রেবেকা বলল, তাহলে বাতি না নিৰিয়ে শুয়ে পড়লি যে?
যাচ্ছি বাবা যাচ্ছি। তোরা সবাই দেখি খোরাসানী ম্যাডাম হয়ে গেলি?
নিতু বিছানায় উঠে বসে তখন মিতুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আগে আমি বিছানায় শুয়েই লাইট নেবাতে পারতাম।
কী ভাবে? বেড় সুইচ?
উঁহু। গান গেয়ে।
গান গেয়ে?
হ্যাঁ। মিতুল কয়েকমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমার গলার স্বর খুব তেজী ছিল। ঠিকভাবে সুরে টান দিয়ে গ্লাস, বোতল, লাইট বাল্ব ভেঙ্গে ফেলতে পারতাম!
নিতু অবাক হয়ে মিতুলের দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, গুল মারছিস, তাই না?
না। গুল মারব কেন? একসিডেন্টে মারা যাবার আগে আমার বাবা মা দুজনেই বড় গায়ক গায়িকা ছিলেন। আমি এক বছর বয়স থেকে রেওয়াজ করতাম। বাবা বলতেন আমার গলা নাকি খুব ভালো ছিল— কথা শেষ করতে গিয়ে হঠাৎ মিতুলের গলা ধরে এল।
নিতু বিছানা থেকে নেমে বলল, এখন পারবি?
এখন?
হ্যাঁ, পারবি?
অনেকদিন তো চেষ্টা করি নি জানি না পারব কিনা?
দ্যাখ না চেষ্টা করে।
মিতুল মাথা নেড়ে বলল, চেষ্টা করি আর হোস্টেল সুপার এসে কান ধরে ঘর থেকে বের করে দিক।
নিতু বলল, দরজা জানালা তো সব বন্ধ, আর হোস্টেল সুপারের ঘর তো একেবারে অন্য মাথায়, এত দুরে শব্দ যাবে না। দেখ চেষ্টা করে।
ঠিক আছে। মিতুল বিছানায় উঠে বসে মুখটা উপর দিকে তুলে ধীরে ধীরে গলায় গানের সুরের মতো মধুর একটা ধ্বনি বের করে আনে। ধীরে ধীরে শব্দের ধ্বনি তীক্ষ্ণতর হতে শুরু করে এবং শব্দের তীব্রতাও বাড়তে থাকে। নিতু অবাক হয়ে একবার মিতুলের দিকে আরেকবার লাইট বাল্বের দিকে তাকায়। সত্যি সত্যি লাইট বাল্বটি থর থর করে কাঁপতে শুরু করেছে। মিতুল ঠিক কম্পনটি ধরে নেয়ার পর শব্দের তীক্ষ্ণতাকে সমান রেখে হঠাৎ তার তীব্রতা বাড়িয়ে দিল মনে হল, কেউ বুঝি মিতুলকে আঘাত করেছে আর সে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠেছে—সাথে সাথে ফটাশ শব্দ করে লাইট বাল্বটা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে সারা ঘরে ভাঙ্গা কাচের গুড়ো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল সাথে সাথে।
নিতু বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠেছিল কিন্তু ঠিক তখন শুনতে পেল হোস্টেলের অন্য মাথায় হোস্টেল সুপার তার দরজা খুলে লম্বা পা ফেলে হেঁটে আসছে। মিতুলের গলার আওয়াজটা শুনতে পেয়েছে মনে হল।
মেঝেতে খাস খ্যাস শব্দ করে পা ঘষে ঘষে হোস্টেল সুপার তাদের ঘরের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে বলল, কে চিৎকার করেছে?
ব্যাপারটা চেপে যাওয়া সম্ভব কি না মিতুল কিন্তু ভেবে দেখল, কিন্তু মনে হল। তাতে বিপদের ঝুঁঝি আরো বেশি। সে নিচু গলায় বলল, আমি ম্যাডাম।
কেন চিৎকার করেছিস?
মিতুল দ্রুত চিন্তা করতে থাকে, বিশ্বাসযোগ্য কোনো কিছু বলা যায় কি না। সেরকম কিছু ভেবে পেল না তখন নিতু তাকে উদ্ধার করল, বলল, ইঁদুর ম্যাডাম।
ইঁদুর! হোস্টেল সুপার বিকট আর্তনাদ করে বললে সর্বনাশ! কোথায়?
এই ঘরের ভিতরে ছিল, ফুটো দিয়ে বের হয়ে গেছে।
সর্বনাশ! হোস্টেল সুপার প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে নিজের ঘরের দিকে ছুটে যেতে থাকে। সব মানুষেরই মনে হয় যেরকম ভালবাসার একটা জিনিস থাকে সেরকম ভয়ের একটা জিনিস থাকে। হোস্টেল সুপারের ভালবাসার জিনিস কী কেউ জানে না। কিন্তু ভয়ের জিনিস হচ্ছে ইঁদুর সেটা তারা কিছুদিন হল আবিষ্কার করেছে।
হোস্টেল সুপারের পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাবার পর নিতু গলা নামিয়ে মিতুলকে বলল, তুই কেমন করে পারিস রে মিতুল?
তানিয়া বলল, আমি ম্যাগাজিনে পড়েছি যারা অপরায় গান গায় তারা পারে। আমাদের মিতুল অপেরা গায়িকাদের থেকেও ভালো।
হ্যাঁ। নিতু উৎসাহে বিছানা থেকে নেমে বলল, তোর গলাটা সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিতে হবে।
মিতুল লজ্জা পেয়ে বলল, থাক, এখন খালি পায়ে বিছানা থেকে নামিস। পা কেটে যাবে।
তা ঠিক। নিতু আবার বিছানায় উঠে বসে বলল, তোর এত সুন্দর গলা তোকে তো গান গাইতে শিখতে হবে।
মিতুল কোনো কথা বলল না, হঠাৎ করে তার চোখে পানি এসে গেল। তার যে কী গান গাইতে ইচ্ছে করে, কিন্তু এখানে সে কি কখনো গান শিখতে পারবে?
পরদিন বিকেল বেলা স্কুল থেকে ফিরে এসে নিতু খুব একটা সাহসের কাজ করে ফেলল। যখন তার বিছানায় লম্বা হয়ে ঘুমানোর ভান করার কথা তখন সে হোস্টেল সুপারের সাথে দেখা করতে গেল। হোস্টেল সুপার একটা বঁটা নিয়ে তার ঘরে কী যেন করছিল নিতুকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল, বলল, তুই? তুই কী করছিস এখানে? নিতু—৪
ম্যাডাম— নিতু যতটুকু সম্ভব মুখ কাচু মাচু করে বলল, আপনাকে একটা জিনিস বলতে এসেছিলাম।
হোস্টেল সুপার ঝাঁটা দিয়ে ঘরের ভিতর কী একটা জিনিসকে পিটাতে পিটাতে খ্যাকিয়ে উঠে বলল কী জিনিস?
নিতু মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, আমাদের মাঝে একজন আছে যে খুব সুন্দর গান গাইতে পারে।
হোস্টেল সুপার যে জিনিসটাকে ঝাঁটা পেটা করছিল সেটাকে লাথি দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে বলল, কী বললি?
নিতু দেখল জিনিসটা একটা ছোট নেংটি ইঁদুরের বাচ্চা একেবারে আধ আঙুল লম্বা ঝাঁটা পেটা খেয়ে মরে থেঁতলে গেছে। হোস্টেল সুপার ঝাঁটা হাতে আরো কি যেন খুঁজতে খুঁজতে আবার বলল, কী বললি তুই?
বললাম, যে আমাদের মাঝে একজন আছে সে খুব সুন্দর গান গাইতে পারে।
হোস্টেল সুপার ঝাঁটা হাতে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একটু অবাক হয়ে বলল, গান? গান গাইতে পারে?
জি ম্যাডাম। খুব সুন্দর গান গাইতে পারে।
তাহলে?
আমি বলছিলাম কী—
কী বলছিলি?
সে যদি গান গাওয়া শিখতে পারে তাহলে খুব বড় গায়িকা হবে।
হোস্টেল সুপার মুখ বাঁকা করে বলল, তাই নাকি?
জি ম্যাডাম। গলাটা খুব সুন্দর আর তেজী।
তেজী? বলেই হঠাৎ হোস্টেল সুপার কেমন যেন ক্ষেপে গেল, ঝাঁটা দিয়ে দমাদম করে কী একটা মারার চেষ্টা করতে লাগল, তার মুখ বিকৃত হয়ে যায় চোখগুলি ঠেলে বের হয়ে আসতে চায়, ঘরের মাঝে সে ছোটছুটি করে লাফাতে থাকে, দেখে মনে হয় হঠাৎ করে যেন পাগল হয়ে গেছে। নিতু মাথা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করল, মনে হল একটা নেংটি ইঁদুরকে মারছে। ইঁদুরটা নিশ্চয়ই মরে ভূত হয়ে গেছে কিন্তু তবু হোস্টেল সুপারের রাগ যায় না। ঝাঁটা দিয়ে মারতে মারতে ঘরের বাইরে এনে দমাদম পিটাতে থাকে, ছোট নেংটি ইঁদুরের নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে থেঁতলে একটা বিচ্ছিরি অবস্থা হয়ে গেল।
নিতু হোস্টেল সুপারের খেপে যাওয়া ভাবটুকু কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর বলল, তাই ম্যাডাম, আমি বলছিলাম কী–
হোস্টেল সুপার ঝাঁটা হাতে নিয়ে চোখ লাল করে বলল, কী বলছিলি?
বলছিলাম, তাকে কী গানের মাস্টার দিয়ে গান শেখানো যাবে?
হোস্টেল সুপার এমনভাবে নিতুর দিকে তাকাল যেন নিতুর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, গানের মাস্টার দিয়ে?
নিতু খুব আশা নিয়ে বলল, জি ম্যাডাম।
মেয়েটা কে?
আমাদের রুমে থাকে। নাম মিতুল।
মিতুল?
জি ম্যাডাম।
নিতু আশা নিয়ে হোস্টেল সুপারের দিকে তাকিয়ে রইল। হোস্টেল সুপার ঠাণ্ডা চোখে বলল, খা ঘরে যা।
গানের মাস্টার–
হোস্টেল সুপার চিলের মতো চিৎকার করে বলল, ঘরে যা বলছি।
নিতু নিশ্বাস ফেলে নিজের ঘরের দিকে ফিরে আসতে শুরু করতেই হঠাৎ মেঝেতে চোখ পড়ল, দেওয়াল ঘেষে একটা ছোট্ট ইঁদুরের বাচ্চা পড়ে আছে। বাচ্চাটা মরে নি, আঁকুপাঁকু করছে। নিতু নিচু হয়ে ইঁদুরের বাচ্চাটা তুলে নিল, এত ছোট বাচ্চা যে এখনো চোখ ফোটে নি। হাতের তালুতে রেখে সে বাচ্চাটার পিঠে সাবধানে হাত বুলিয়ে দিতেই শুনতে পেল হোস্টেল সুপার ঘরের ভিতরে আবার খেপে উঁদুরকে আঁটা পেটা করতে করতে চিৎকার করছে, স্মার! মার! মেরে শেষ করে দে ইঁদুরে চৌদ্দগুষ্ঠি। খবিস গিদ্ধর ময়লার ঝাড়। মার! মার হারামির বাচ্চা হারামিকে!
ঝাঁটা দিয়ে মারতে মারতে হোস্টেল সুপার চিৎকার করতে করতে লাফাতে থাকে। ইঁদুরের উপরে এত খ্যাপা কোনো মানুষ নিতু এর আগে কখনো দেখে নি। নিতুর হাতের তালুতে এই ছোট ইঁদুরের বাচ্চাটা দেখতে পেলে হোস্টেল সুপার কী করবে কে জানে! নিতু হাত মুঠি করে ইঁদুরের বাচ্চাটাকে লুকিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে এল। অন্য সবাই খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে নিতুর জন্যে অপেক্ষা করছিল, তাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই রেবেকা বলল, কোথায় ছিলি তুই?
হোস্টেল সুপারের কাছে গিয়েছিলাম একটা কাজে।
কী কাজে।
আছে একটা কাজ।
নিতু তার হাত তুলে নেংটি ইঁদুরের বাচ্চাটা টেবিলের উপর রাখতেই সেটি আঁকুপাঁকু করে হাটতে থাকে, মনে হয় তার মাকে খুঁজছে। বেচারা জানে পর্যন্ত না যে হোস্টেল সুপার মেরে তার মাকে থ্যাতলা করে ফেলেছে। নিতু বাচ্চাটার পিঠে হাত বুলিয়ে একটু আদর করে দিল, বাচ্চাটী তখন গুটিশুটি মেরের কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে গেল।
রেবেকা অবাক হয়ে বলল,ওমা! ওটা কী?
ইঁদুরের বাচ্চা!
ইশ! কী সুইট! দেখেছিস?
তানিয়া তার বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে চাপা গলায় বলল, তোরা কী করছিস? তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়। ম্যাডামরা আসছে শুনতে পাচ্ছিস না?
নিতু তাড়াতাড়ি তার ইঁদুরের বাচ্চাটা হাতে নিয়ে কোথায় লুকাবে বুঝতে না পেরে তার জুতোর ভেতরে রেখে দিল। তারপর তার বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণের মাঝেই এক জোড়া পায়ের শব্দ শুনতে পায়, একটা গুম গুম করে, যেটা নিশ্চিতভাবে খোরাসানী ম্যাডামের অন্যটা খ্যাস খ্যাস করে যেটা হচ্ছে হোস্টেল সুপারের। দুজনের পায়ের শব্দ তাদের ঘরের সামনে এসে থেমে যায়, নিতু শুনতে পেল হোস্টেল সুপার বলছে, এই রুম।
দড়াম করে তাদের ঘরের দরজা খুলে গেল এবং নিতু চোখ বন্ধ করেই টের পেল দুইজন হেঁটে হেঁটে তাদের ঘরের মাঝামাঝি এসে হাজির হয়েছে। নিতু শুনতে পেল খোরাসানী ম্যাডাম মেঘের মতো গর্জন করে বলল, কোন বদমাইসটা?
হোস্টেল সুপার ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, এইটা।
নিতু চোখের ফাঁক দিয়ে দেখার আগেই হঠাৎ করে মনে হল একটা দানব তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং চুলের মুঠি ধরে হ্যাচকা টানে তাকে একেবারে বিছানা থেকে তুলে এনে প্রায় শূন্যে ঝুলিয়ে মেঝেতে দাঁড়া করিয়ে দিয়েছে। খোরাসানী ম্যাডাম নিতুর চুল ধরে এত জোরে হ্যাচকা টান দিয়ে মাথাটা সোজা করল যে সে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। নিতু দেখতে পেল খোরাসানী ম্যাডামের বাঘের মতো মাথাটা নিচে নেমে এসেছে, লাল ভাটার মতো চোখ দুটি তার দিকে তাকিয়ে আছে, কোনটা গায়িকা?
গা-গা-গায়িকা?
হ্যাঁ খোরাসানী ম্যাডাম চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, যার গলার সুর শুনে তোর দিল ফানা ফানা হয়ে গেছে?
নিতু কী বলবে বুঝতে পারল না। হোস্টেল সুপার তার চিমশে মুখে বিদঘুটে এক ধরনের হাসি ফুটিয়ে বলল, ঐটার নাম হচ্ছে মিতুল।
মিতুল? খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিল, কোন বদমাইসটা মিতুল?
মিতুল ফ্যাকাসে মুখে তার বিছানায় উঠে বসল, বলল, আমি।
তার কথা শেষ হবার আগেই খোরাসানী ম্যাডাম মিতুলের চুল ধরে একটা হ্যাচকা টান দিয়ে বিছানা থেকে মেঝেতে নামিয়ে আনে। তারপর মাথা নামিয়ে এনে মিতুলের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই তাহলে সেই গায়িকা যার গলার স্বর সাইরেনের মতো?
মিতুল কোনো কথা বলল না, নিতু দেখল তার চোখে পানি এসে গেছে, যন্ত্রণায় না অপমানে ঠিক বলতে পারল না।
খোরাসানী ম্যাডাম নিতুর গলা চেপে এক টান দিয়ে শূন্যে তুলে নিয়ে বলল, মামদোবাজীর আর জায়গা পাস না? স্কুলের মাঝে গান বাজনা? গলার মাঝে সুর? ছারপোকার ডিম, ইঁদুরের বাচ্চা, টিকটিকির লেজ কোথাকার? তোর গলা দিয়ে গান গাওয়া আমি বের করছি। টেনে আমি জিরাফের গলার মতো লম্বা করে ফেলব। গিটটু দিয়ে ছেড়ে দেব দেখি গলা দিয়ে আওয়াজ কীভাবে বের হয়। আমার সাথে মামদোবাজী? তোর গলা আমি ছিঁড়ে ফেলব আজকে।
মিতুলের গলা চেপে শন্যে ঝুলিয়ে রাখার জন্যে সে নিশ্বাস নিতে পারছিল, প্রাণপণে হাত পা ছুড়ে কোনোভাবে নিজেকে ছাড়াতে না পেরে যখন হাল ছেড়েদিল তখন খোরাসানী ম্যাডাম তাকে নিচে ছুড়ে ফেলে দেয়। মিতুল দেওয়াল ধরে বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে অতিংকিত চোখে খোরাসানী ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে থাকে।
খোরাসানী ম্যাডাম এবারে নিতুর দিকে তাকাল, নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, আর আমাদের সংগীত বিশেষজ্ঞ কী বলে? গায়িকার জন্যে ভালবাসায় যার বুক ফেটে যাচ্ছে, দিল ফানা ফানা হয়ে যাচ্ছে? খোরাসানী ম্যাডাম এসে খপ করে দুই হাত দিয়ে নিতুর দুইটা কান ধরে ফেলে। বলল, এত সুন্দর গান তুই কী দিয়ে শুনেছিস? এই কান দিয়ে? কান দুইটা কী যথেষ্ট বড়? ঠিকমতো শুনতে পেয়েছিস চামচিকার বাচ্চা? মনে হয় শুনতে পাস নি। কান দুইটা টেনে আরেকটু বড় করে দিতে হবে তাহলে শুনতে পাবি। আরো ভালো করে শুনতে পাবি। এই বলে খোরাসানী ম্যাডুমি হ্যাচকা টান দিয়ে নিতুর দুই কান ধরে তাকে শূন্যে ঝুলিয়ে ফেলল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় নিতু চিৎকার করে উঠে কিন্তু খোরাসানী ম্যাডাম তাতে ক্ষেপ করে না, নিতুকে দুই কানে ধরে ঝুলিয়ে রাখে। যখন নিতুর মনে হল তার দুই কান ছিঁড়ে আলাদা হয়ে যাবে তখন খোরাসানী ম্যাডাম তাকে ময়লা জঞ্জালের মতো নিচে ফেলে দিল। মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়তে পড়তে নিতু দেখল তাদের হোস্টেল সুপার পেট চেপে ধরে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, এত মজার দৃশ্য মনে হয় সে আগে কখনো দেখে নি।।
নিতু আর মিতুল ভাবল তাদের শাস্তি বুঝি শেষ হয়েছে কিন্তু দেখা গেল সেটা শেষ হয় নি। খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিয়ে বলল, সবাই ঘুম থেকে ওঠ।
ঘরে অন্য চারজন দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল, এবার তারা ফ্যাকাশে মুখে বিছানায় উঠে বসল।
খোরাসানী ম্যাডাম বলল, সবাই জুতা মোজা পর। পরে বাইরে আয়।
জুতো পরতে গিয়ে নিতুর মনে পড়ল সে তার জুতোর মাঝে চোখ না ফোটা ছোট নেংটি ইঁদুরের বাচ্চাটাকে রেখেছে। সে এখন জুতো পরবে কেমন করে? সে সাবধানে লুকিয়ে ভেতর থেকে ইঁদুরের বাচ্চাটাকে বের করার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না, কোনো একটা বিচিত্র কারণে খোরাসানী ম্যাডাম আর হোস্টেল সুপরি দুজনেই তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। নিতু কোনো উপায় না দেখে পা দিয়ে উঁদুরের বাচ্চাটাকে জুতোর সামনে ঠেলে দিয়ে জুতো পরে নিল। নেংটি ইঁদুরের বাচ্চাটা এত ছোট যে জুতোর সামনে ফাঁকা জায়গাটাতে বেশ আরামেই থাকতে পারবে, তবু নিতু পায়ের আঙুলগুলো ভাজ করে রাখল যেন তার কোনো অসুবিধে না হয়।
ছয়জন জুতো মোজা ঘরে রেডি হওয়ার পর খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিল, কুইক মার্চ।
সবাই ঘর থেকে বের হয়ে আসে, নিতু আর মিতুল বের হল সবার শেষে কারণ খোরাসানী ম্যাডাম তাদের দুইজনের ঘাড় ধরে আলাদাভাবে টেনে টেনে বের করে আনল। তাদের কপালে আরো কিছু দুঃখ কষ্ট এবং অপমান রয়েছে এবং সেটা হবে মাঠে, সব মেয়েদের সামনে।
হোস্টেল থেকে মেয়েরা বের হয়ে মাঠে ইতস্ততঃ হাঁটাহাটি করছিল, খোরাসানী ম্যাডামকে এক হাতে নিতু অন্য হাতে মিতুলকে ধরে আনতে দেখে সবাই কেমন জানি ঠাণ্ডা মেরে গেল। খোরাসানী ম্যাডাম নিতু এবং মিতুলকে নিয়ে হোস্টেলের বারান্দায় দাঁড়াল এবং মাঠে দাঁড়ানো সব মেয়ে ভয়ার্ত মুখে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের পিছনে হোস্টেল সুপার তার চিমশে মুখে আধা আধা একটা হাসি মাখিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখে মনে হতে থাকে সে যেন খুব মজার একটি দৃশ্য দেখছে।
খোরাসানী ম্যাডাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা হুংকার দিল। এটেনশান।
মাঠের সবগুলি মেয়ে পা ঠুকে এটেনশান হয়ে দাঁড়াল। খোরাসানী ম্যাডাম গলা পরিষ্কার করে বলল, ইঁদুরের বাচ্চারা, এই যে দ্যাখছিস দুটি বদমাইস এদের একজন নাকি গায়িকা— এই পর্যন্ত বলে খোরাসানী ম্যাডাম মিতুলের ঘাড় ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে শূন্যে ঝুলিয়ে ফেলল। মিতুল সেভাবে হাত পা ছুঁড়তে থাকে তখন তাকে নামিয়ে এনে নিতুকে হ্যাচকা টান দিয়ে উপরে তুলে আনে।
অরি এটা হচ্ছে সেই গায়িকার সমঝদার। গান শুনে তার দিল ফানা ফানা হয়ে গেছে। শূন্যে ঝুলে থেকে নিতু তার হাত পা ছুঁড়তে থাকে তখন খোরাসানী ম্যাডাম তাকে নিচে নামিয়ে আনে। পুরো ব্যাপারটা দেখে হোস্টেল সুপার খিক খিক করে হাসতে থাকে, যেন সে টেলিভিশনে হাসির নাটক দেখছে।
খোরাসানী ম্যাডাম নিতু আর মিতুলের চুল ধরে দুজনের মাথা কাছাকাছি নিয়ে এসে নাক দিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলল, এখন এই দুইজন তোদের গান গেয়ে শোনাবে। যে গায়িকা সে গান গাবে, অন্যজন তাল ঠুকবে। খোরাসানী ম্যাডাম এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, রেডি-ওয়ান-টু-থ্রী কথা শেষ করেই সে দুজনের মাথা প্রচণ্ড জোরে ঠুকে দিল। নিতু অর মিতুল দুজনেই আর্ত চিৎকার করে উঠে, তাদের মনে হয় বুঝি মাথা ফেটে মগজ বের হয়ে এসেছে। দুজনেরই চোখ অন্ধকার হয়ে আসে এবং চোখের সামনে বিচিত্র রং, খেলা করতে থাকে—এটাকেই নিশ্চয়ই চোখে সর্ষে ফুল দেখা বলে!
খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিল, শুরু কর ছাগলের বাচ্চারা।
মিতুল হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ দুটো মুছে নেয়। তারপর সামনে মাঠের দিকে তাকাল, সেখানে প্রায় শখানেক মেয়ে চুপ করে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। মিতুল নিতুর দিকে তাকাল, নিতুল চোখ নামিয়ে নিল সাথে সাথে। মিতুল তখন উপরের দিকে তাকাল এবং হঠাৎ করে সে চমকে উঠল। খোরাসানী ম্যাডাম যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার উপরে দোতলার জানালা, জানালা দুটি খোলা জানালার কাচ যদি কোনোভাবে ভেঙ্গে যায় সেই কাচ এসে পড়বে খোরাসানী ম্যাডাম আর হোস্টেল সুপারের মাথায়। গলায় সুর এনে মিল কাচের গ্লাস ভেঙ্গেছে, লাইট বা ভেঙ্গেছে, কখনো জানালার কাচ ভাঙ্গে নি। কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে তো ক্ষতি নেই। আজ সে চেষ্টা করে দেখবে।
খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিয়ে বলল, শুরু কর মাকড়সার ডিম, গর্ধবের লেজ।
মিতুল শুরু করল। প্রথমে হালকাভাবে সে গলায় একটা সুরের ঝংকার তুলল, তার সমস্ত মনপ্রাণ ঢেলে দিল সেখানে। তার মিষ্টি গলার সুরে চারিদিক হঠাৎ যেন মায়াময় হয়ে উঠে, মনে হয় স্বর্গ থেকে বুঝি কোনো কিন্নরী এসে গান গাইছে। মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা শখানেক মেয়ে হতবাক হয়ে মিতুলের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারা বিশ্বাস করতে পারে না, এটা কী মানুষের গলার সুর না কী স্বপ্ন!
মিতুল তার গলার স্বর উঁচু করতে থাকে সাথে সাথে সে কাপন নিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করে দেয়। সে দেখতে চায় ঠিক কোন্ কম্পনে জানালার কাচ কাঁপিয়ে তুলতে পারবে। যে রকম অনুমান করেছিল ঠিক সে রকম নিচু একটা কাপনে জানালার কাচ থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। মিতুল একটি হাত তার কানের উপর নিয়ে এসে চোখ বন্ধ করে গলার স্বর উঁচু করতে থাকে, মনে হয় আকাশে বাতাসে বুঝি তার কণ্ঠস্বর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সে আরো উঁচু করে তার গলার স্বর, সমস্ত স্কুল প্রাঙ্গন গম গম করে উঠে তার ভরাই গলার সুরে। আরো উঁচু করে তার কণ্ঠস্বর। তারপর আরো উঁচু, মিতুলের সমস্ত মুখ টকটকে লাল হয়ে ওঠে, মনে হয় নিশ্বাস আটকে সে বুঝি এই মুহূর্তে হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে যাবে, তবু সে নিরস্ত হয় না।
নিতু আরো উঁচু করে আনে তার গলার স্বর, মনে হয় তার গলা থেকে বুঝি ঝলক দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসবে এক্ষুনি। সমস্ত প্রাঙ্গণ তার গমগমে তেজী গলার স্বরে কাঁপতে থাকে এবং হঠাৎ ঝনঝন শব্দ করে জানালার কাচ ভেঙ্গে পড়ল। মাঠে দাঁড়ানো শখানেক মেয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখল দোতালার জানালা থেকে কাচ ভেঙ্গে পড়ছে নিচে, খোরাসানী ম্যাডাম আর হোস্টেল সুপারের মাথায়।
বিকট আর্তনাদ করে দুজনে মাথায় হাত দিয়ে লাফ দিয়ে সরে যাবার চেষ্টা করল। হোস্টেল সুপারের পায়ের সাথে পা বেধে প্রায় আছাড় খেয়ে পৃড়তে কোনোভাবে নিজেকে সামনে নিল দুজনে কিন্তু মেয়েরা সেটি ভালো করেও লক্ষও করল না তারা অবাক বিস্ময়ে মিতুলের দিকে তাকিয়ে রইল। নিতু মিতুলের দিকে তাকিয়ে নিজের চোখের থেকে দুই ফোঁটা পানি মুছে হাত তালি দিতে শুরু করে, তার দেখাদেখি মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় শখানেক মেয়েও যোগ দেয়। এরকম অভূতপূর্ব দৃশ্য তারা তাদের জীবনে কখনো দেখে নি। খোরাসানী ম্যাডাম আর হোস্টেল সুপার রক্ত চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল, কিন্তু তারা ক্ৰক্ষেপ করল না, হাত তালি দিয়ে যেতেই লাগলো সবাই মিলে।।
খোরাসানী ম্যাডাম আর হোস্টেল সুপার যখন নিজেদের ঘরে ফিরে গেল তখন তারা ছিল হেরে যাওয়া মানুষ। বাচ্চা দুটি মেয়ের কাছে আজ তারা হেরে গেছে।