০৬. কাল সারা রাত শরিফার ঘুম হয় নি

কাল সারা রাত শরিফার ঘুম হয় নি।

ইদানীং প্রায়ই এরকম হচ্ছে। সারা রাত এ-পাশ ও-পাশ করে কাটে। পাশেই মতি মিয়া গাছের মতো ঘুমায়। শরিফার অসহ্য বোধ হয়। কাল রাতে বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত গায়ে ধাক্কা দিয়ে মতি মিয়ার ঘুম ভাঙাল। মতি মিয়া ঘুম

জড়ান স্বরে বলল, কী হইছে?

বাংলাঘরে কী যেন শব্দ করে। মনে লয় চোর আইছে।

আছে কী আমার, চোর আইব? ঘুমাও।

দেইখ্যা আও না।

মতি মিয়া ঘুরে এল, কোথায়ও কিছু নেই, খা-খাঁ করছে চারদিক।

মতি মিয়া ফিরে এসেই ঘুমিয়ে পড়ল। আবার তাকে শরিফা ডেকে তুলল, আমার পিছনবাড়িত যাওন লাগব।

যাওন লাগব–যাও।

একলা যাই ক্যামনে?

দুত্তোরি মাগী। ঘুমাইতে যাওনের আগে সব শেষ কইরা আইতে পারছ না?

থাউক, যাওন লাগত না।

মতি মিয়া আবার ঘুমিয়ে পড়ল। শরিফা খুনখুন করে কাঁদতে শুরু করল। লোকটা এই রকম কেন? এমন ভাব করছে, যেন শরিফা একটা কাঠের পুতলী। ছেলেগুলিও দূরে দূরে সরে যাচ্ছে। নুরুদ্দিন তো তাকে সহ্যই করতে পারে না। রাতদিন রহিমার পিছে পিছে ঘুরঘুর করে। এক দিন সে গোসা করেছে, ভাত খায় না। কত সাধাসাধি। মতি মিয়া বলল, আজরফ বলল, এমন কি আমিন ডাক্তার পর্যন্ত সাধ্যসাধনা করল। খাবেই না, শেষটায় রহিমা গিয়ে বলল, বাপধন খাও, খালার পাতে চাইর খাও।

অমনি সুড়সুড় করে খেতে বসল। যেন কিছুই হয় নি।

এই সব কথা মনে এলে চোখে পানি আসে। শরিফা ফুঁপিয়ে উঠল।

এই, কাল ক্যান? কান্দি না। ফোসফোস করতাছ ক্যান?

শরিফা ধরাগলায় বলল, আমি বাপের বাড়িত গিয়া কয়েকটা দিন থাকতাম চাই।

বাপের বাড়িত আছে কেডা?

ভাই আছে।

ভাই?

গলা ফাটিয়ে মতি মিয়া হাসল, এই সব চিন্তা ছাড়া দেও। অত যে ঝামেলা গেছে, তোমার গুণের ভাই একটা খোঁজ নিছে? কও, নিছে খোঁজ?

শরিফা মিনমিন করে কী বলল ঠিক বোঝা গেল না।

চিল্লাচিল্লি বন্ধ কইরা কাজ-কাম কর।

আমি চিল্লাচিল্লি করি?

না, তুমি তো নয়া কইন্যা। মুখের মধ্যে একটা কথাও নাই।

শরিফা আজকাল অবশ্যি খুবই চেঁচামেচি করে। রহিমার সঙ্গে আকাশ ফাটিয়ে ঝগড়া করে। এইডা কী রানছে, ও রহিমা ওয়াক থু। হলুদের গন্ধে মুখে দেওন যায় না। হলুদ সস্তা হইছে? বাপের বাড়ির হলুদ পাইছ? ঝাঁটা দিয়া পিটাইয়া এই সব আপদ দূর করা লাগে।

সামান্য জিনিস থেকে কুরুক্ষেত্র ঘটে যায়। শুধু তাই নয়, সুযোগ পেলেই রহিমার মেয়েটাকে সে মারধোরও করে। মেয়েটাও মার মত চুপচাপ। মার খেয়েও শব্দ করে না। এক-একা পুকুর পাড়ে বসে থাকে। শরিফার অসহ্য বোধ হয়। কাউকেই সহ্য করতে পারে না। আমিন ডাক্তারের সঙ্গেও ঝগড়া করে। ঝগড়া করে ক্লান্ত হয়ে এক সময় সে কাঁদতে শুরু করে। আমিন ডাক্তার বিব্রত হয়ে বলে, কান্দনের কী হইল, ও দোস্তাইন?

আমারে বিষ আইন্যা দিয়েন।

কী ধরনের কথা কনা না দোস্তাইন, বাজে চিন্তা বাদ দেওন দরকার।

 

ধানকাটা শুরু হবার আগে মতি মিয়া মোহগঞ্জে চলে যাবে। রূপকুমারী যাত্ৰা পার্টির অধিকারী লোক পাঠিয়েছে। শরিফা আকাশ থেকে পড়ল, অখন তুমি যাইবা ক্যামনে, ধান কাটব কে?

আজরফ কাটব।

কও কী তুমি। আজরফ দুধের পুলা।

চুপ কর, খালি চিল্লায়।

মতি মিয়া গম্ভীর মুখে কাপড় গোছায়। শরিফা নুরুদ্দিনকে পাঠায় আমিন ডাক্তারকে ধরে আনতে। আমিন ডাক্তার আসতে পারে না। দীর্ঘ দিন পর তাকে নেবার জন্যে সুখানপুকুর থেকে নৌকা এসেছে। রুগী মরণাপন্ন, এখনি রওনা হওয়া প্রয়োজন।

নুরুদ্দিন, তর বাপরে ধরা-বাইন্ধা রাখ, আমি আইতাছি রাইতে–বুঝছস?

বুঝছি।

লোকটার মাথা খারাপ, এই সময় কেউ যায়? নৌকা ছাড় গো তোমরা।

নৌকা ছেড়ে দেওয়ার সময় আমিন ডাক্তার আরেক বার গম্ভীর হয়ে বলে, দুই টেকা ভিজিট, অষুধ ভিন্ন। আর নৌকা দিয়া ফিরত দিয়া যাইবা। সুখানপুকুর পৌঁছতে পেঁছতে রাত পুইয়ে যায়। নৌকা থেকে নেমে মাইল পাঁচেক হাঁটতে হয়। অসম্ভব কাদা এই অঞ্চলে। বড়োই কষ্ট হয় হাঁটতে। কোথাও থেমে যে বিশ্রাম নেওয়া হবে, সে উপায় নেই। রুগীর বাবা ঝড়ের মতো ছুটছে, বারবার বলছে, পা চালাইয়া হাঁটেন ডাক্তার সাব।

বাড়ির সামনে মুখ লম্বা করে সিরাজুল ইসলাম বসে ছিল। আমিন ডাক্তারকে দেখে গম্ভীর মুখে বলল, আপনাকেও এনেছে দেখি। হুঁ, আর কাকে আনবে?

রুগীর বাবা পা দেওয়ার পানি আনতে গেছে, এই ফাঁকে সিরাজুল ইসলাম গলা নিচু করে বলল, ডাক্তার পিষে খাওয়ালেও কিছু হবে না। শেষ অবস্থা। আর এমন চামার, বুঝলেন। দু টাকা দেওয়ার কথা দিয়েছে এক টাকা। মাছের বাজার আর কি।

রুগী দেখে আমিন ডাক্তার স্তম্ভিত। নয়-দশ বৎসরের একটা ছেলে। সমস্ত শরীর লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। চোখ ঘোর রক্তবর্ণ। শরীরে কোনো ব্যাথা বোধ নেই। মাঝে মাঝে মাথা তুলে বলছে, পেটের মইধ্যে পাক খায়।

আমিন ডাক্তার এক চামচ এলকালি মিকচার খাইয়ে শুকনো মুখে বলল, অবস্থা খুবই খারাপ। নোগামতো একটা মেয়ে ছেলেটির হাত ধরে বসে ছিল, সে কাঁদতে শুরু করল। আমিন ডাক্তার বলল, নৌকার যোগাড় দেখেন, হাসপাতালে নেওন লাগব। দিরং করন যাইত না।

ডাক্তারদের জন্যে পান-তামাক দেওয়া হয়েছে বাহির-বাটিতে। সিরাজুল ইসলাম কিছুই স্পর্শ করবে না। সে এক ফাঁকে আমিন ডাক্তারকে বলল, হাসপাতালে নেওয়ার চিন্তা বাদ দেন। এই রুগী ঘন্টা পাঁচেকের বেশি থাকবে না। টাকা-পয়সা যা দেয় নিয়ে সরে পড়েন। রুগী মরলে পয়সাও পাবেন না। আপনাকে কেউ দিয়েও আসবে না। ছোটলোকের দেশে কেউ ডাক্তারী করে?

আমিন ডাক্তার থেমে বলল, ওর হইছে কী?

কিছু বুঝতে পারছেন না?

না।

হুঁ। ওর কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। শরীরে পানি এসেছে, হাসপাতালেও কিছু করতে পারবে না।

কিছুই করণের নাই?

না।

সিরাজুল ইসলাম উঠে পড়ল। বেরুবার আগে বলল, আমি নিজের নৌকা নিয়ে। এসেছি। যদি যেতে চান যেতে পারেন।

এই রকম রুগী ফালাইয়া যাই ক্যামনে? থাকেন তাহলে।

সমস্ত দিন কাটল এইভাবে। রাত্রে অবস্থা খুব খারাপ হল। আমিন ডাক্তার বিষণ্ণ মুখে ঘরের দাওয়ায় বসে রইল। বেশ কয়েক বার ছেলের বাবাকে বলল, হাসপাতালে নেওন খুব দরকার। দিরং হইতাছে।

কেউ রুগী নাড়াচাড়া করতে রাজি হল না। নিমতলির পীর সাহেবকে আনতে নাকি লোক গিয়েছে। তিনি এসে যা বলেন, তা-ই করা হবে। পীর সাহেব মাঝরাত্রে পৌঁছলেন। ছোটখাট হাসিখুশি এক জন মানুষ। রুগীকে হাসপাতালে নেওয়া ঠিক হবে কিনা জানতে চাইতেই বললেন, ডাক্তার সাব যদি নিতে কন, তা হইলে নেন লাগব। ব্যবস্থা করেন। কিন্তু রুগী দেখে তাঁর মত বদলাল। শান্ত স্বরে বললেন, হাতে সময় বেশি নাই।

ভোরাত্রে ছেলেটি হঠাৎ সুস্থ মানুষের মত মাথা তুলে বলল, শীত লাগে বাজান।

চার-পাঁচটা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে আমিন ডাক্তার জিজ্ঞেস করল, শীত কমছে?

ছেলেটি ফিসফিস করে বলল, শীত লাগে। জর শীত লাগে। ও বাজান, শইলডার মইধ্যে খুব শীত।

 

ফজরের আজানের পরপর ছেলেটি মারা গেল। ছেলের মা খুব কাঁদছিল। কে যেন বলল, কাইলেন না। মতের সময় কান্দন হাদিসে মানা আছে।

নিমতলির পীর সাহেব শান্ত স্বরে বললেন, দুঃখের সময় না কাঁদলে কোন সময় কাঁদব? কান্দুক, খুব জুরে জুরে কান্দুক।

বাড়ির সামনে একটি কাঁঠালগাছের নিচে দুপুর পর্যন্ত বসে রইল আমিন ডাক্তার। পকেটে কিছুই নেই যে একটা কেরাইয়া নৌকা নিয়ে বাড়ি ফেরে। এমন অবস্থায় কাউকে বাড়ি ফেরার কথাও বলা যায় না। পেটে অসম্ভব খিদে, মরা বাড়িতে চুলা ধরা হবে না, কাজেই খাওয়াদাওয়া হবে কিনা বলা মুশকিল।  দুপুরের রোদ একটু পড়তেই আমিন ডাক্তার হেঁটে চলে গেল নিমতলি। নিমতলি পৌঁছাতে পৌঁছাতে এক পহর রাত হল। সেখান থেকে সোহাগী এল জলিলের নৌকায়। তখন মাঝরাত্রি, ঘরে খাবার কিছুই নেই। একটি টিনে চিড়া ছিল, সেটিও শূন্য। মতি মিয়ার বাড়িতে গেলে হত। কিন্তু এই দুপুররাত্রে যাওয়া ঠিক নয়। .

খিদের জন্য ঘুম হল না। ঘরের ভেতর অসহ্য গরম মশারিটি শতচ্ছিন্ন। ভভন করছে মশা। নতুন মশারি একটি না কিনলেই নয়। আমিন ডাক্তার শুয়ে শুয়ে কত কথাই না ভাবে। কত বিচিত্ৰ কথা মনে আসে। সুখানপুকুরের এক রুগী মরবার আগে হঠাৎ খুব আবক হয়ে বলেছিল, ঠাণ্ডা হাত দিয়া আমারে কে ছুইছে। ও ডাক্তর, বড় শীত লাগে। বড় শীত লাগে। বড় শীত।

মরবার আগে সবারই শীত লাগে কিনা, আমিন ডাক্তারের খুব জানতে ইচ্ছা করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *