ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
এ ধরনের কষ্ট করিতে অপু কখনও অভ্যস্ত নয়। বাড়ির এক ছেলে, চিরকাল বাপ-মায়ের আদরে কাটাইয়াছে। শহরে বড়োলোকের বাড়িতে অন্য কষ্ট থাকিলেও খাওয়ার কষ্টটা অন্তত ছিল না। তাছাড়া সেখানে মাথার উপর ছিল মা, সকল আপদবিপদে সর্বজয়া ডানা মেলিয়া ছেলেকে আড়াল করিয়া রাখিতে প্রাণপণ করিত, কোনও কিছু আঁচ লাগিতে দিত না। দেওয়ানপুরে স্কলারশিপের টাকায় বালক-বুদ্ধিতে যথেষ্ট শৌখিনতা করিয়াছে—খাইয়াছে, খাওয়াইয়াছে, ভালো ভালো জামা কাপড় পরিয়াছে,—তখন সেসব জিনিস সস্তাও ছিল।
কিন্তু শীঘ্রই অপু বুঝিল—কলিকাতা দেওয়ানপুর নয়। এখানে কেহ কাহাকেও পোঁছে না। ইউরোপে যুদ্ধ বাধিয়া গত কয়েক মাসের মধ্যে কাপড়ের দাম এত চড়িয়াছে যে কাপড় আর কেনা যায় না। ভালো কাপড় তাহার মোটে আছে একখানা, একটি টুইল শার্ট সম্বল। ছেলেবেলা হইতেই ময়লা কাপড় পরিতে সে ভালোবাসে না, দু-তিনদিন অন্তর সাবান দিয়া কাপড় কাচিয়া শুকাইলে, তাহাই পরিয়া বাহির হইতে পারে। সবদিন কাপড় ঠিক সময়ে শুকায় না, কাপড় কাচিবার পরিশ্রমে এক-একদিন আবার ক্ষুধা এত বেশি পায় যে, মাত্র দু-পয়সার খাবারে কিছুই হয় না—ক্লাসে লেকচার শুনিতে বসিয়া মাথা যেন হঠাৎ শোলার মতো হালকা বোধ হয়।
এদিকে থাকার কষ্টও খুব। সুরেশ্বর এম.এ. পরীক্ষা দিয়া বাড়ি চলিয়া গিয়াছে, তাহার মেসে আর থাকিবার সুবিধা নাই। যাইবার আগে সুরেশ্বর একটা ঔষধের কারখানার উপরে একটা ছোট ঘরে তাহার থাকিবার স্থান ঠিক করিয়া দিয়া গিয়াছে। ওই কারখানায় সুরেশ্বরের জানালোনা একজন লোক কাজ করে ও রাত্রে ওপরের ঘরটাতে থাকে। ঠিক হইয়াছে, যতদিন কিছু একটা সুবিধা না হইতেছে, ততদিন অপু ওই ঘরটাতে লোকটার সঙ্গে থাকিবে। ঘরটা একে ছোট, তাহার উপর অর্ধেকটা ভর্তি ঔষধবোঝাই প্যাকবাক্সে। রাশীকৃত জঞ্জাল বাঙ্গগুলির পিছনে জমানো, কেমন একটা গন্ধ! নেংটি ইদুরের উৎপাতে কাপড়-চোপড় রাখিবার জো নাই, অপুর একমাত্র টুইল শার্টটার দু–জায়গায় কাটিয়া ফুটা করিয়া দিয়াছে। রাত্রে ঘরময় আরশোলার উৎপাত। ঘরের সেলোকটা যেমন নোংরা তেমনই তামাক-প্রিয়, রাত্রে উঠিয়া অন্তত তিনবার তামাক সাজিয়া খায়। তাহার কাশির শব্দে ঘুম হওয়া দায়। ঘরের কোণে তামাকের গুল রাশীকৃত করিয়া রাখিয়া দেয়। অপু নিজে বার দুই পরিষ্কার করিয়াছিল। এক টুকরা রবারের ফিতার মতোই ঘরের নোংরামিটা স্থিতিস্থাপক পূর্বাবস্থায় ফিরিতে এতটুকু দেরি হয় না। খাওয়া-পরা থাকিবার কষ্ট অপু কখনও করে নাই, বিশেষ করিয়া একলা যুঝিতে হইতেছে বলিয়া কষ্ট আরও বেশি।
অন্যমনস্কভাবে যাইতে যাইতে সে কৃষ্ণদাস পালের মূর্তির মোড়ে আসিল। যুদ্ধের নূতন খবর বাহির হইয়াছে বলিয়া কাগজওয়ালা হাঁকিতেছে। শেয়ালদার একটা ট্রাম হইতে লোজন নামা-উঠা করিতেছে। একটি চোখে-চশমা তরুণ যুবকের দিকে একবার চাহিয়াই মনে হইল—চেনা-চেনা মুখ! একটু পরে সেও অপুর দিকে চাহিতে দুইজনে চোখাচোখি হইল। এবার অপু চিনিয়াছে—সুরেশদা! নিশ্চিন্দিপুরের বাড়ির পাশের সেই পোড়ো ভিটার মালিক নীলমণি জ্যাঠামশায়ের ছেলে সুরেশ।
সুরেশও চিনিয়াছিল। অপু তাড়াতাড়ি কাছে গিয়া হাসিমুখে বলিল, সুরেশদা যে!
যেবার দুর্গা মারা যায়, সে বৎসর শীতকালে ইহারা যা কয়েক মাসের জন্য দেশে গিয়াছিল, তাহার পর আর কখনও দেখাসাক্ষাৎ হয় নাই। সুরেশ আকৃতিতে যুবক হইয়া উঠিয়াছে। দীর্ঘ দেহ, সুগঠিত হাত পা। বাল্যের সে চেহারার অনেক পরিবর্তন হইয়াছে।
সুরেশ সহজ-সুরেই বলিল—আরে অপূর্ব? এখানে কোথা থেকে?
সুরেশের খাঁটি শহুরে গলার সুরে ও উচ্চারণ-ভঙ্গিতে অপু একটু ভয় খাইয়া গেল।
সুরেশ বলিল—তারপর এখানে কি চাকরি-টাকরি করা হচ্ছে?
-না—আমি যে পড়ি ফার্স্ট ইয়ারে রিপনে-
–তাই নাকি? তা এখন যাওয়া হচ্ছে কোথায়?
অপু সে-কথার কোনও উত্তর না দিয়া আগ্রহের সুরে বলিল, জেঠিমা কোথায়?
—এখানেই, শ্যামবাজারে। আমাদের বাড়ি কেনা হয়েছে সেখানে–
সুরেশের সহিত সাক্ষাতে অপু ভারি খুশি হইয়াছিল। তাহাদের বাড়ির পাশের যে পোডড়া ভিটার বনঝোপের সহিত তাহার ও দিদি দুর্গার আবাল্য অতিমধুর পরিচয়, সেই ভিটারই লোক ইহারা। যদিও কখনও সেখানে ইহারা বাস করে নাই, শহরে শহরেই ঘোরে, তবুও তো সে ভিটারই লোক, তাহা ছাড়া দশরাত্রির জ্ঞাতি, অতি আপনার জন।
অপু বলিল—অতসীদি এখানে আছে? সুনীল? সুনীল কি পড়ে?
–এবার সেকেন ক্লাসে উঠেছে—আচ্ছা, যাই তাহলে, আমার ট্রাম আসছে–
সুরেশের সুরে কোনও আগ্রহ বা আন্তরিকতা ছিল না, সে এমন সহজ সুরে কথা বলিতেছিল, যেন অপুর সঙ্গে তাহার দুইবেলা দেখা হয়। অপু কিন্তু নিজের আগ্রহ লইয়া এত ব্যস্ত ছিল যে, সুরেশের কথাবার্তার সেদিকটা তাহার কাছে ধরা পড়িল না।
—আপনি কি করেন সুরেশদা?
—মেডিকেল কলেজে পড়ি, এবার থার্ড ইয়ার—
–আপনাদের ওখানে একদিন যাব সুরেশদা-জেঠিমার সঙ্গে দেখা করে আসব–
সুরেশ ট্রামের পা-দানিতে পা দিয়া উঠিতে উঠিতে অনাসক্ত সুরে বলিল, বেশ বেশ, আমি আসি এখন
এতদিন পর সুরেশদার সহিত দেখা হওয়াতে অপুর মনে এমন বিস্ময় ও আনন্দ হইয়াছিল যে, ট্রামটা ছাড়িয়া দিলে তাহার মনে পড়িল—সুরেশদার বাড়ির ঠিকানাটা তত জিজ্ঞাসা করা হয় নাই। সে চলন্ত ট্রামের পাশে ছুটিতে ছুটিতে জিজ্ঞাসা করিল—আপনাদের বাড়ির ঠিকানাটাও সুরেশদা, ঠিকানাটা যে
সুরেশ মুখ বাড়াইয়া বলিল—চবিবশ-এর দুই সি, বিশ্বকোষ লেন, শ্যামবাজার—
পরের রবিবার সকালে স্নান করিয়া অপু শ্যামবাজারে সুরেশদার ওখানে যাইবার জন্য বাহির হইল। আগের দিন টুইল শার্টটা ও কাপড়খানা সাবান দিয়া কাচিয়া শুকাইয়া লইয়াছিল, জুতার শাচনীয় দুরবস্থা ঢাকিবার জন্য একটি পরিচিত মেসে এক সহপাঠীর নিকট হইতে জুতার কালি চাহিয়া নিজে বুরুশ করিয়া লইল। সেখানে অতসীদি ইত্যাদি রহিয়াছেন, দীনহীন বেশে কি যাওয়া চলে?
ঠিকানা খুঁজিয়া বাহির করিতে দেরি হইল না। ছোটখাটো দোতলা বাড়ি, আধুনিক ধরনের তৈয়ারি। ইলেকট্রট লাইট আছে, বাহিরে বৈঠকখানা, দোলায় উঠিবার সিড়ি। সুরেশ বাড়ি ছিল না, ঝিয়ের কাছে সে পরিচয় দিতে পারিল না, বৈঠকখানায় তাহাকে বসাইয়া ঝি চলিয়া গেল। ঘড়ি, ক্যালেন্ডার, একটা পুরোনো রোল-টপ ডেস্ক, খানকতক চেয়ার। ভারি সুন্দর বাড়ি তো! এত আপনার জনের কলিকাতায় এরকম বাড়ি আছে, ইহাতে অপু মনে মনে একটু গর্ব ও আনন্দ অনুভব করিল। টেবিলে একখানা সেদিনের অমৃতবাজার পড়িয়া ছিল, উলটাইয়া পালটাইয়া যুদ্ধের খবর পড়িতে লাগিল।
অনেক বেলায় সুরেশ আসিল।
তাহাকে দেখিয়া বলিল, এই যে অপূর্ব, কখন এলে?
অপু হাসিমুখে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল—আসুন সুরেশদা—আমি, আমি অনেকক্ষণ ধরে বেশ বাড়িটা তো আপনাদের
—এটা আমার বড়োমামা—যিনি পাটনার উকিল, তিনি কিনেছেন; তারা তো কেউ থাকেন, আমরাই থাকি। বসো, আমি আসি বাড়ির মধ্যে থেকে–
অপু মনে মনে ভাবিল—এবার সুরেশদা বাড়ির ভেতর গিয়ে বললেই জেঠিমা ডেকে পাঠাবে, এখানে খেতে বলবে
কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সুরেশ বাড়ির ভিতর হইতে বাহির হইল না। সে যখন পুনরায় আসিল, তখন বারোটা বাজিয়া গিয়াছে। চেয়ারে হেলান দিয়া বসিয়া পড়িয়া নিশ্চিন্তি সুরে বলিল, তারপর?…বলিয়াই খবরের কাগজখানা হাতে তুলিয়া চোখ বুলাইতে লাগিল। অপু দেখিল সুরেশ পান চিবাইতেছে। খাওয়ার আগে এত বেলায় পান খাওয়া অভ্যাস, না-কি খাওয়া হইয়া গেল!
দুই চারিটা প্রশ্নের জবাব দিতে ও খবরের কাগজ পড়িতে পড়িতে একটা বাজিল। সুরেশের চোখ ঘুমে বুজিয়া আসিতেছিল। সে হঠাৎ কাগজখানা টেবিলে রাখিয়া দিয়া চেয়ার হইতে উঠিয়া পড়িয়া বলিল, তুমি না হয় বসে কাগজ পড়ো, আমি একটুখানি শুয়ে নি। একটা ডাব খাবে?
ডাব খাইবে কি রকম, এত বেলায়, এ অবস্থায়? অপু ভালো বুঝিতে না পারিয়া বলিল, ডাব? থাক, এত বেলায়–ইয়ে–না।
সেই যে সুরেশ বাড়ি ঢুকিল—একটা-দুইটা—আড়াইটা, আর দেখা নাই। ইহারা কত বেলায় খায়! রবিবার বলিয়া বুঝি এত দেরি? কিন্তু যখন তিনটা বাজিয়া গেল, তখন অপুর মনে হইল, কোথাও কিছু ভুল হইয়াছে নিশ্চয়। হয় সে-ই ভুল বুঝিয়াছে, না হয় উহারা ভুল করিয়াছে। তাহার এত ক্ষুধা পাইয়াছিল যে, সে আর বসিতে পারিতেছে না। উঠিবে কিনা ভাবিতেছে, কেমন সময় সুরেশের ছোট ভাই সুনীল বাড়ির ভিতর হইতে বাহিরে আসিল। অপু ডাকিবার পূর্বেই সে সাইকেল লইয়া বাড়ির বাহিরে কোথায় চলিয়া গেল।
সেই সুনীল-যাহাকে সঙ্গে লইয়া নিমন্ত্রণে ঘঁদা বাঁধিবার দরুন জেঠিমা তাহাকে ফলারেবামুনের ছেলে বলিয়াছিলেন! ইহাদের যে এতদিন পর আবার দেখিতে পাওয়া যাইবে, তাহা যেন অপু ভাবে নাই। সুনীলকে দেখিয়া তাহার বিস্ময় ও আনন্দ দুই-ই হইল। এ যেন কেমন একটা ঠিক বুঝানো যায় না।
ইহাদের সঙ্গে দেখা করিতে আসিবার মূলে অপুর কোন স্বার্থসিদ্ধি বা সুযোগসন্ধানের উদ্দেশ্য ছিল না, বা ইহা যে নিতান্ত গায়ে পড়িয়া আলাপ জমাইবার মতো দেখাইতেছে—একবারও সেকথা তাহার মনে উদয় হয় নাই। এখানে তাহার আসিবার মূলে সেই বিস্ময়ের ভাব—যাহা তাহার জন্মগত। কে আবার জানিত, খাস কলিকাতা শহরে এতদিন পরে নিশ্চিন্দিপুরের বাড়ির পাশের পোড়ো ভিটাটার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেখা হইয়া যাইবে। এই ঘটনাটুকু তাহাকে মুগ্ধ করিবার পক্ষে যথেষ্ট। এ যেন জীবনের কোন্ অপরিচিত বাঁকে পত্রপুষ্পে সজ্জিত অজানা কোন কুঞ্জবন-বাঁকের মোড়ে ইহাদের অস্তিত্ব যেন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত।
বিস্ময় মনের অতি উচ্চ ভাব এবং উচ্চ বলিয়াই সহজলভ্য নয়। সত্যকার বিস্ময়ের স্থান অনেক উপরে-বুদ্ধি যার খুব প্রশস্ত ও উদার, মন সব সময় সতর্কনূতন ছবি নূতন ভাব গ্রহণ করিবার ক্ষমতা রাখে—সে-ই প্রকৃত বিস্ময়-রসকে ভোগ করিতে পারে। যাদের মনের যন্ত্র অলস, মিনমিনে পরিপূর্ণ, উদার বিস্ময়ের মতো উচ্চ মনোভাব তাদের অপরিচিত থাকিয়া যায়।
বিস্ময়কে যাঁহারা বলিয়াছেন Mother of philosophy, তাহারা একটু কম বলেন। বিস্ময়ই আসল Philosophy, বাকিটা তাহার অর্থসংগতি মাত্র।
তিনটার পর সুরেশ বাহির হইয়া আসিল। সে হাই তুলিয়া বলিল–কাল রাত্রে ছিল নাইটডিউটি, চোখ মোটে বোজে নিতাই একটু গড়িয়ে নিলাম—চলো, মাঠে ক্যালকাটা টিমের হকি খেলা আছে—একটু দেখে আসা যাক–
অপু মনে মনে সুরেশদাকে ঘুমের জন্য অপরাধী ঠাওর করিবার জন্য লজ্জিত হইল। সারারাত কাল বেচারি ঘুমায় নাই—তাহার ঘুম আসা সম্পূর্ণ স্বাভাবিকই তো!…
সে বলিল—আমি মাঠে যাবো না সুরেশদা, কাল এগজামিন আছে, পড়া তৈরি হয় নি মোটে—আমি যাই ইয়ে-জেঠিমার সঙ্গে একবার দেখা করে গেলে হতো
সুরেশ বলিল—হ্যাঁ হ্যাঁ—বেশ তো—এসো না—
অপু সুরেশের সঙ্গে সংকুচিত ভাবে বাড়ির মধ্যে ঢুকিল। সুরেশের মা ঘরের মধ্যে বসিয়াছিলেন–সুরেশ গিয়া বলিল-এ সেই অপূর্ব মা–নিশ্চিন্দপুরের হরিকাকার ছেলে–তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে
অপূর্ব পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিল—সুরেশের কথায় ভাবে তাহার মনে হইল, সে যে এতক্ষণ আসিয়া বাহিরের ঘরে বসিয়া আছে সে কথা সুরেশ বাড়ির মধ্যে আদৌ বলে নাই।
জেঠিমার মাথার চুল অনেক পাকিয়া গিয়াছে বলিয়া অপুর মনে হইল। অপুর প্রণামের উত্তরে তিনি বলিলেন, এসো-এসো–থাক, থাক্-কলকাতায় কি করো?
অপু ইতিপূর্বে কখনও জেঠিমার সম্মুখে কথা বলিতে পারিত না। গম্ভীর ও গর্বিত (যেটুকু সে ধরিতে পারিত না) চালচলনের জন্য জেঠিমাকে সে ভয় করিত। আনাড়ি ও অগোছালো সুরে বলিল, এই এখানে পড়ি, কলেজে পড়ি।
জেঠিমা যেন একটু বিস্মিত হইলেন। বলিলেন, কলেজে পড়? ম্যাট্রিক পাশ দিয়েছ?
—আর বছর ম্যাট্রিক পাশ করেছি-
-তোমার বাবা কোথায়?—তোমরা তো সেই কাশী চলে গিয়েছিলে, না?
–বাবা তো নেই—তিনি তো কাশীতেই…
তারপর অপু সংক্ষেপে বলিল সব কথা। এই সময়ে পাশের ঘর হইতে একটি বাইশ-তেইশ বছরের তরুণী এ ঘরে ঢুকিতেই অপু বলিয়া উঠিল, অতসীদি না?…
অতসী অনেক বড়ো হইয়াছে, তাহাকে চেনা যায় না। সে অপুকে চিনিতে পারিল, বলি, অপূর্ব কখন এলে?
আর একটি মেয়ে ও-ঘর হইতে আসিয়া দোরের কাছে দাঁড়াইল। পনেরো যোল বৎসর বয়স হইবে, বেশ সুশ্রী, বড়ো বড়ো চোখ। কথা বলিতে বলিতে সেদিকে চোখ পড়াতে অপু দেখিল, মেয়েটি তাহার মুখের দিকে চাহিয়া আছে। খানিকটা পরে অতসী বলিল—মণি, দেখে এসে তো দিদি, কুশিকাটাগুলো ও-ঘরের বিছানায় ফেলে এসেছি কি না?
মেয়েটি চলিয়া গেল এবং একটু পরেই আবার দুয়ারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল-না বড়দি, দেখলাম না তো?
জেঠিমা অল্প দুই চারিটা কথার পরই কোথায় উঠিয়া গেলেন। অতসী অনেকক্ষণ কথাবার্তা কহিল। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করিল। তারপর সেও চলিয়া গেল। অপু ভাবিতেছিল, এবার সে উঠিবে কিনা। কেহই ঘরে নাই, এ সময় ওঠাটা কি উচিত হইবে?…ক্ষুধা একবার উঠিয়া পড়িয়া গিয়াছে, এখন ক্ষুধা আর নাই, তবে গা ঝিম্ ঝিম্ করিতেছে। যাওয়ার কথা কাহাকেও ডাকিয়া বলিয়া যাইবে?…
দোরের কাছে গিয়া সে দেখিল সেই মেয়েটি বারান্দা দিয়া ও-ঘর হইতে বাহির হইয়া সিঁড়ির দিকে যাইতেছে—আর কেহ কোথাও নাই, তাহাকেই না বলিলে চলে না। উদ্দেশে ডাকিয়া বলিল—এই গিয়ে—আমি যাচ্ছি, আমার আবার কাজ–
মেয়েটি তাহার দিকে ফিরিয়া বলিল—চলে যাবেন? দাঁড়ান, পিসিমাকে ডাকি—চা খেয়েছেন?
অপু বলিল-চা তা-থাক্, বরং অন্য একদিন—
মেয়েটি বলিল—বসুন, বসুন-দাঁড়ান চা আনি—পিসিমাকে ডাকি দাঁড়ান।
কিন্তু খানিকটা পরে মেয়েটিই এক পেয়ালা চা ও একটা প্লেটে কিছু হালুয়া আনিয়া তাহার সামনে বসিল। অপু ক্ষুধার মুখে হালুযাটুকু গোগ্রাসে গিলিল। গরম চা খাইতে গিয়া প্রথম চুমুকে মুখ পুড়াইয়া ফেলিয়া ঢালিয়া ঢালিয়া খাইতে লাগিল।
মেয়েটি বলিল—আপনি বুঝি ওদের খুড়তুতো ভাই? থাক প্লেটটা এখানেই–আর একটু হালুয়া আনব?
—হালুয়া? …না–ইয়ে তেমন ক্ষিদে নেই, সুরেশদার বাবা আমার জ্যাঠামশাই হতেন, জ্ঞাতি-সম্পর্ক
এই সময় অতসী ঘরে ঢোকাতে মেয়েটি চায়ের বাটি ও প্লেট লইযা চলিয়া গেল।
সন্ধ্যার পর ঠাকুরবাড়িতে খাইয়া অনেক রাত্রে সে নিজের থাকিবার স্থানে ফিরিয়া দেখিল আরও একজন তোক সেখানে রাত্রের জন্য আশ্রয় লইয়াছে। মাঝে মাঝে এরকম আসে, কারখানার লোকের দু-একজন আত্মীয়স্বজন মাঝে মাঝে আসে ও দু-চার দিন থাকিয়া যায়। একে ছোট ঘর, থাকিবার কষ্ট, তাহাতে লোক বাড়িলে এইটুকু ঘরের মধ্যে তিষ্ঠানো দায় হইয়া উঠে। পরনের কাপড় এমন ময়লা যে, ঘরের বাতাসে একটা অপ্রীতিকর গন্ধ। অপু সব সহ্য করিতে পারে, এক ঘরে এ-ধরনের নোংরা স্বভাবের লোকের ভিড়ের মধ্যে শুইতে পারে না, জীবনে সে তা কখনও করে নাই ইহা তাহার অসহ্য। কোথায় রাত্রে আসিয়া নির্জনে একটু পড়াশুনা করিবে-না, ইহাদের বকবকের চোটে সে ঘর ছাড়িয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। নতুন লোকটি বড়োবাজারের আলুপোস্তায় আলুর চালান সইয়া আসে—হুগলী জেলার কোন জায়গা হইতে, অপু জানে, আরও একবার আসিয়াছিল। লোকটি বলিল, কোথায় যান, ও মশায়? আবার বেরোন না-কি?
অপু বলিল, এইখানটাতে দাঁড়িয়ে-বেজায় গরম আজ…
একটু পরে লোকটা বলিয়া উঠিলা, হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বিছানাটা কি মহাশয়ের? আসুন, আসুন, সরিয়ে ন্যান্ একটু—এঘঁকোর জলটা গেল গড়িয়ে পড়ে—দুত্তোর-নাঃ–
অপু বিছানা সরাইয়া পুনরায় বাহিরে আসিল। সে কি বলিবে? এখানে তাহার কি জোর খাটে? উহারাই উপরোধে পড়িয়া দয়া করিয়া থাকিতে দিয়াছে এখানে। মুখে কিছু না বলিলেও অপু অন্যদিন হয়তো মনে মনে বিরক্ত হইত, কিন্তু আজ সে সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক ছিল। বাহিরের বারান্দায় জীর্ণ কাঠের রেলিং ধরিয়া অন্ধকারের দিকে চাহিয়া ভাবিতেছিল-সুরেশাদের কেমন চমৎকার বাড়ি কলকাতায়। ইলেকট্রিক পাখা, আলো, ঘরগুলি কেমন সাজানো, মেয়েটির কেমন সুন্দর কাপড় পরনে। চারটা না বাজিতে চা, জলখাবার, চারিদিকে যেন লক্ষ্মীশ্রী, কিছুরই অভাব নাই।
তাহাদেরই যে কি হইয়াছে, কোথায় মা আছে একটেরে পড়িয়া, কলিকাতা শহরে, এই রকম ছন্নছাড়া অবস্থায় সে পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, পেট পুরিয়া আহার জোটে না, পরনে নাই কাপড়!…
দিন তিনেক পরে জগদ্ধাত্রী পূজা। কলিকাতায় এত উৎসব জগদ্ধাত্রী পূজায়, তা সে জানিত। দেশে কখনও এ পূজা কোথাও হইত না—কোথাও দেখে নাই। গলিতে গলিতে, সর্বত্র উৎসবের নহবত বাজিতেছে, কত দুয়ারের পাশে কলাগাছ বসানো, দেবদারুর পাতার মালা টাঙানো।
কাঠের কারখানার পাশের গলিটার মধ্যে একজন বড়োলোকের বাড়িতে পূজা। সন্ধ্যার সময় নিমন্ত্রিত ভদ্রলোকেরা সারি বাঁধিয়া বাড়িটার মধ্যে ঢুকিতেছে—অপু ভাবিল, সেও যদি যায়!…কতকাল নিমন্ত্রণ খায় নাই! কে তাহাকে চিনিবে?…খুব লোভও হইল, ভয়ও হইল।