০৬. কল্পনার কারাগার

মানব ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত বিষয় হল কৃষিবিপ্লব। কেউ কেউ মনে করে, এই কৃষিবিপ্লব মানবজাতির প্রগতি ও সমৃদ্ধির দুয়ার খুলে দিয়েছিল, আবার কারও মতে মানুষের সকল দুর্গতির শুরু সেখানেই। এই দ্বিতীয় দলের মতে, ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার সেই সময়টাতেই প্রকৃতির সাথে মানুষের নিবিড় সম্পর্কের সুতোটা ছিঁড়তে শুরু করে, শুরু হয় বিচ্ছিন্নতা আর লোভের আধিপত্য। সেখান থেকে আগের জীবনে ফিরে যাবারও আর কোনো পথ ছিল না, কারণ কৃষিকাজের ফলশ্রুতিতে মানুষের সংখ্যা এত দ্রুত বেড়ে গেল যে, আগের মত খাদ্য সংগ্রহ কিংবা শিকার করে অন্নসংস্থান করাটা তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ল। দশ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে এই পৃথিবীতে প্রায় ৫০ থেকে ৮০ লাখ যাযাবর শিকারি মানুষের বসবাস ছিলো। খ্রিস্টীয় প্রথম শতক পার হতে না হতেই তাদের সংখ্যা কমে হয়ে গেলো ১০ থেকে ২০ লাখের মত (যাদের অধিকাংশই ছিলো অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও আফ্রিকায়)। শতকরা হিসেবে সেটা খুবই সামান্য, কারণ তখন পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ছিল ২৫ কোটি।

এরপর বেশিরভাগ কৃষকই স্থায়ী বসতি গেড়ে বসবাস করা শুরু করে দিল; অল্প কিছু পশুপালকই কেবল যাযাবর থেকে গেল। স্থায়ী বসতি তৈরি করার সাথে সাথে মানবগোষ্ঠীগুলোর আকার অনেকটা ছোট হয়ে এলো। প্রাচীন শিকারি মানুষেরা বিশাল এলাকা জুড়ে থাকতো, ক্ষেত্রবিশেষে যার আকার হতো কয়েকশ বর্গকিলোমিটার। ‘বাসা’ বলতে তারা বুঝতো সেই পুরো এলাকাটাকেই – সেখানকার পাহাড়, নদী, বন, আকাশ – সবকিছুই। অন্যদিকে কৃষকদের দিনের বেশিরভাগই কাটতো এক টুকরো জমিতে কাজ করে, আর বাকি সময়টা কাটতো কাঠ, পাথর আর মাটির তৈরি ছোট্ট ঘরে। নিজের ঘরের প্রতি কৃষক মানুষের সেই যে প্রবল আকর্ষণ জন্মালো তারই সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে মানুষের স্থাপত্য ও মনস্তত্ত্বে। ‘নিজের বাসা’র প্রতি আকর্ষণ আর প্রতিবেশীদের সাথে ক্রমবর্ধমান দূরত্ব সেই প্রাগৈতিহাসিক আত্মকেন্দ্রিকতারই ছাপ।

কৃষক মানুষের বসতিগুলো প্রাচীন শিকারি মানুষদের এলাকা থেকে যেমন ছিলো অনেক ছোট, তেমনি ছিলো নানারকম কৃত্রিমতায় পূর্ণ। শিকারি মানুষেরা তাদের থাকার জায়গাতে তেমন কোনো পরিবর্তন করেনি – এক আগুন জ্বালানো ছাড়া। কিন্তু কৃষক মানুষ বিপুল শ্রম ব্যয় করে সেই বুনো পরিবেশের মাঝে দ্বীপের মত করে তৈরি করে নিলো নিজেদের আবাস। তারা বনের গাছ কেটে, খাল কেটে, মাঠ পরিষ্কার করে বানালো নিজেদের ঘর, চাষের জমি আর ফলের বাগান। এই জায়গার ভিতরে বসবাসের অধিকার ছিলো কেবল মানুষের, আর মানুষের ‘অনুমোদিত’ প্রাণী ও উদ্ভিদের। সেটা নিশ্চিত করতে মানুষকে তাদের এলাকার চারদিকে বেড়াও দিতে হলো। কৃষক মানুষের অনেকটা সময় লেগে যেত বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত আগাছা আর বুনো প্রাণী দূর করতে। এদের কেউ ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে বাঁচতো, আর কেউ গোঁয়ার্তুমি করতে গিয়ে মারা পড়তো মানুষের হাতে। সেই কৃষিযুগের আরম্ভে যার শুরু, তারই রেশ ধরে আজকের দিনেও পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষ লাঠি, চপ্পল কিংবা কীটনাশক নিয়ে পিঁপড়া, তেলাপোকা আর মাকড়সার বিরুদ্ধে চালিয়ে যাচ্ছে সেই একই যুদ্ধ।

অনেকদিন পর্যন্ত মানুষের বসবাসের এলাকাগুলো ছিলো খুব ছোট ছোট। পৃথিবীতে মোট জায়গা আছে ৫১ কোটি বর্গ কিলোমিটার, যার মধ্যে ডাঙা প্রায় সাড়ে ১৫ কোটি বর্গ কিলোমিটার। ১৪০০ খ্রিস্টাব্দেও পৃথিবীর কৃষকেরা তাদের যাবতীয় গাছপালা আর পশুপাখি নিয়ে মাত্র ১.১ কোটি বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ছিলো, যা কিনা পুরো পৃথিবীর মাত্র ২ শতাংশ।২ বাকি জায়গাগুলো ছিলো খুব গরম, খুব ঠাণ্ডা বা অন্য কোনো কারণে কৃষিকাজের অনুপযোগী। আর সেই ২ শতাংশ জায়গা থেকেই ইতিহাসের যাত্রা শুরু হয়।

নিজের তৈরি বসতি ছেড়ে চলে যাওয়াটা ক্রমেই মানুষের জন্য কঠিন হয়ে পড়লো। নিজেদের ঘরবাড়ি, ফসলের ক্ষেত আর খাবারের গোলা ত্যাগ করার ঝুঁকি মানুষ নেয়নি। আর একই জায়গায় অনেকদিন বাস করতে করতে মানুষের স্থাবর সম্পদের পরিমাণও বাড়তে লাগলো। সেই সম্পদের মাঝে বাঁধা পড়লো যাযাবর মানুষ। কৃষক সমাজ সম্পদে খুব সমৃদ্ধ মনে না হলেও একটা কৃষক পরিবারের মোট সম্পদ ছিলো পুরো একটা শিকারি-সংগ্রাহক সমাজের মোট সম্পদের চেয়েও বেশি।

ভবিষ্যতের হাতছানি

কৃষিভিত্তিক সমাজে মানুষের বিচরণক্ষেত্র কমে গেলো, কিন্তু কৃষিকাজের জন্য আগের চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করতে হলো তাদের। সামনের মাসে, এমনকি সামনের সপ্তাহে কী খাবো – এমন চিন্তা শিকারি মানুষের মাথায় কখনো আসেইনি। কিন্তু কৃষক মানুষের ভবিষ্যৎ চিন্তার সীমারেখা দিন, সপ্তাহ, মাস ছাড়িয়ে বছরের কোঠাও পেরিয়ে গেলো।

শিকারি মানুষ ছিলো দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ, পরবর্তী সময়ের জন্য কিছু বাঁচিয়ে রাখাটা তাদের জন্য কঠিন ছিলো। ভবিষ্যতের চিন্তা তাই তাদের খুব একটা ছিলো না। তবে ভবিষ্যত নিয়ে তারা যে একেবারেই চিন্তা করতো না এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। শভে (Chauvet), লাস্কো (Lascaux) আর আলতামিরার (Altamira) গুহার দেয়ালের ছবিগুলো যারা এঁকেছিলো তারাও নিশ্চয়ই চেয়েছিলো ছবিগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে যাক। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিরোধ আর সন্ধিগুলোও ছিলো দীর্ঘমেয়াদী। কোনো কোনো ঋণ শোধরাতে কিংবা কোনো অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতেও অনেক সময় কয়েক বছর লেগে যেতো। তার পরেও, শিকার কিংবা সংগ্রহ করে খাবার জোটানো এই মানুষগুলোর পক্ষে ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশিদূর চিন্তা করা সম্ভব ছিলো না। মজার ব্যাপার হলো, এই অপারগতা তাদের ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত মানসিক দুশ্চিন্তা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছিলো। যে ভবিষ্যতের উপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই তাকে নিয়ে চিন্তা করে আমার কী লাভ?

কৃষিবিপ্লব মানুষের কাছে ভবিষ্যতের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিলো। কৃষকদের সবসময় ভবিষ্যতের চিন্তা মাথায় রেখে কাজ করতে হতো। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ছিল ঋতুচক্রের পালাবদলের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল – দীর্ঘ সময় উৎপাদন আর স্বল্প সময় ফসল সংগ্রহের চক্রে বছর কেটে যেতো। মাঠভরা ফসল ঘরে তুলে যে কৃষক আজ রাতে মত্ত হচ্ছে উৎসবে, কাল ভোরেই তাকে আবার ছুটতে হবে মাঠে – কারণ তার ঘরে আগামী দিন, আগামী সপ্তাহ, এমনকি আগামী মাসের খাবার থাকলেও তাকে এখন পরের বছরের কথাও ভাবতে হয়।

এই ভবিষ্যৎ চিন্তার মূল কারণ ছিলো ঋতুচক্রের উপর নির্ভরশীলতা, আর ফসল ফলার চিরন্তন অনিশ্চয়তা। যেসব গ্রামে অল্প কিছু ফসল চাষ আর পশু পালন করা হতো, খরা বন্যা আর মহামারীর ভয় তাদের পিছু ছাড়তো না। কাজেই কৃষকদের সবসময় নিজের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাবার মজুদ করে রাখতে হতো। আগে হোক বা পরে, কোনো না কোনো বছর খারাপ সময় আসবেই – আর সেই খারাপ সময়টাতে পর্যাপ্ত খাবারের মজুদ না থাকলে না খেয়ে থাকতে হবে। এই দূরদর্শিতার অভাবে অনেক কৃষককেই অকালে মরতে হয়েছে।

সেই কৃষিযুগের শুরু থেকেই অনাগত ভবিষ্যতের জন্য দুশ্চিন্তা হয়ে গেলো মানুষের চিরসঙ্গী। যেসব কৃষক ফসলের ক্ষেতে পানির জন্য বৃষ্টির উপর নির্ভর করতো, তাদের প্রতি বর্ষাকাল শুরু হতো নতুন দুশ্চিন্তা নিয়ে। তাদের অনেকটা সময় যেতো আকাশের দিকে তাকিয়ে আর বাতাসের গন্ধ শুঁকে। সময়মত বৃষ্টি হবে কিনা, হলেও পরিমাণমত হবে কিনা, ঝড় এসে ফসল উড়িয়ে নিয়ে যাবে কিনা – এসবই ছিলো তাদের নিত্যদিনের চিন্তা। আবার ইউফ্রেটিস, সিন্ধু আর হোয়াংহো নদীর অববাহিকার কৃষকদের চিন্তার বিষয় ছিলো নদীর পানির উচ্চতা। এসব নদীর পানি বেড়ে দুকূল ভাসিয়ে দিতো বন্যায়, তাতে সব ফসলের ক্ষেতে পৌঁছতো পানি, আর উপরে জমতো উর্বর পলিমাটির স্তর। কিন্তু কখনো বন্যাটা সময়মত না হলে, কিংবা খুব বেশি হলেই হত সর্বনাশ।

শুধু এটুকুই না, কোনো দুর্যোগ আসলে কীভাবে সেটা সামাল দেওয়া যাবে সেই দুশ্চিন্তাও কৃষকদের দিশেহারা করে ফেলতো। সেজন্যই তারা আরো বেশি জমি চাষ করতো, খাল কাটতো আর বেশি বেশি বীজ বুনতো। গ্রীষ্মকালের কর্মী পিঁপড়ের মতই উদয়াস্ত পরিশ্রম করতো একজন কৃষক। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে সে জলপাই গাছ লাগাতো মাঠে, আর সেই জলপাই পিষে তেল বের করতো তার ছেলেপুলে আর নাতি-নাতনিরা। সেই জমিয়ে রাখা জলপাইয়ের তেল কাজে লাগতো শীতকালে কিংবা পরের বছরে।

মানুষের এই কৃষিকাজের প্রভাব ছিলো ব্যাপক। এখান থেকেই বড় আকারের সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার পত্তন হয়। তবে দুঃখের বিষয় হল, এই পরিশ্রমী কৃষকেরা কখনোই তাদের আকাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দেখা পায়নি। সব জায়গাতেই দেখা গেছে কৃষকের উদ্বৃত্ত ফসল ভোগ করতে আবির্ভূত হয়েছে নানান শোষক ও অভিজাতগোষ্ঠী, আর কৃষক আটকা পড়েছে তার চিরন্তন দুশ্চিন্তার আবর্তে।

এই উদ্বৃত্ত ফসলই পরবর্তীতে রাজনীতি, যুদ্ধ, শিল্পকলা ও দর্শনের বিকাশে ইন্ধন যোগায়। ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে প্রাসাদ, দুর্গ, সৌধ আর মন্দির। এই আধুনিক যুগের শুরুর দিকেও মানুষের ৯০ শতাংশই ছিলো কৃষক, যাদের সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির ফল ভোগ করেছে বাকি ১০ শতাংশ – রাজা, রাজকর্মচারী, সৈন্য, যাজক, শিল্পী ও দার্শনিকের মত অভিজাত শ্রেণী। এরাই ভরেছে ইতিহাসের পাতা, আর বাকিদের জীবন কেটে গেছে ফসলের মাঠে।

কাল্পনিক কাঠামো

কৃষকের ফলানো অতিরিক্ত খাবার আর আবিষ্কৃত নতুন পরিবহন ব্যবস্থা – এ দুইয়ের ফলশ্রুতিতে অনেক মানুষ একসাথে বড় আকারের গ্রাম তৈরি করে বসবাস করতে শুরু করল। কালক্রমে বড় গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে নগর, আর এ সবকিছু মিলে তৈরি হল বিশাল সব রাজ্য আর ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র।

এই সব বড় নগর ও রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর যেসব নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হল, তার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার মানুষ করতে পারেনি, কারণ শুধু উদ্বৃত্ত খাদ্য ও পরিবহন ব্যবস্থাই এর জন্য যথেষ্ট ছিলো না। একটা রাজ্যের লাখ লাখ মানুষের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ খাবার থাকলেও তাতে জমি ও পানির বণ্টন, নানা রকম বিরোধ নিষ্পত্তি কিংবা যুদ্ধকালীন কর্তব্যের মত বিষয়গুলোতে মানুষ ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি। খাদ্যের অভাবে নয়, বরং এই ঐক্যের অভাবেই মানুষের মাঝে নানা রকম দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ফরাসি বিপ্লবের শুরু করেছিলো ধনাঢ্য উকিলেরা, ক্ষুধার্ত কৃষক নয়। ভূমধ্যসাগরের চারদিক থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে রোমান সাম্রাজ্য কল্পনাতীত অর্থ ও ক্ষমতার অধিকারী হয়, অথচ ঠিক সেই সময়েই সেখানকার রাজনৈতিক কাঠামোতে ভাঙন ধরছিলো নানা রকম অন্তর্ঘাতে। ১৯৯১ সালের যুগোস্লাভিয়াতেও খাদ্যাভাব ছিলো না, তবু এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে দেশটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

এসব অনর্থের মূলে ছিলো মানুষের যথাযথ বিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের অভাব। মানুষের লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তন হয়েছে ছোট ছোট গোষ্ঠীতে। কৃষিকাজ শুরু করার পর থেকে রাজ্য গঠন পর্যন্ত বিবর্তনের জন্য যে কয়েক হাজার বছরের সময় মানুষ পেয়েছে সেটা এত বড় গোষ্ঠী গঠন করার মানসিকতা তৈরির জন্য যথেষ্ট ছিলো না।

সেই খাবার সংগ্রহ করার যুগে কয়েকশ অপরিচিত মানুষ কোনোরকম জৈবিক তাড়না ছাড়াই দল বাঁধতে পারত। আর এটা সম্ভব হত কিছু মিথে (প্রচলিত গল্পে) তাদের বিশ্বাসের ফলে। অবশ্য এই ধরনের গোষ্ঠীতে পারস্পরিক সহযোগিতার সুযোগ খুব বেশি ছিল না। এই ছোট আকারের মানবগোষ্ঠীগুলো ছিলো স্বয়ংসম্পূর্ণ, নিজেদের প্রায় সব প্রয়োজন তারা নিজেরাই মেটাত। কৃষিবিপ্লব পরবর্তী সময়টাকে না জানা বিশ হাজার বছর আগের কোনো সমাজতাত্ত্বিক হয়তো বলতেন মিথের ক্ষমতা খুব বেশি নয়- এই বড়জোর শ পাঁচেক মানুষ মিথের প্রভাবে কড়ি বিনিময় করতে, অদ্ভুত কিছু উৎসবে অংশ নিতে কিংবা নিয়ান্ডার্থালদের একটা দলকে ধরে পেটাতে পারে, এর বেশি কিছু নয়। তাই বলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে দিয়ে একই রকম চিন্তা বা কাজ করিয়ে নেওয়াটা মিথের পক্ষে অসম্ভব।

কিন্তু ইতিহাস তেমনটা বলে না। মানুষের মাঝে একবার ভালোমত ছড়িয়ে পড়তে পারলে মিথের ক্ষমতা হয়ে যায় অকল্পনীয়। কৃষিবিপ্লবের পর যখন নগর আর রাজ্য প্রতিষ্ঠার উপক্রম হচ্ছিলো, সে সময়েই মানুষের মধ্যে ক্ষমতাধর দেবদেবী কিংবা মাতৃভূমির মত বিষয়গুলো নিয়ে নানারকম গল্প-কাহিনী তৈরি হয়। এই গল্পগুলোই মানুষের মধ্যকার সামাজিক সম্পর্ককে আরো দৃঢ় করে। বিবর্তন এগোচ্ছিলো আগের মতই খুব ধীরে, কিন্তু মানুষের কল্পনার দৌড় এবারে তাকে হারিয়ে দিলো। এই কল্পনাশক্তির জোরেই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মত এত এত মানুষ সহযোগিতার সম্পর্কে আবদ্ধ হলো।

৮৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানববসতি ছিলো জেরিকো গ্রাম, যার লোকসংখ্যা ছিলো কয়েকশ। ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আনাতোলিয়ার চাতালিয়ুক শহরের জনসংখ্যা ছিলো ৫ থেকে ১০ হাজারের মধ্যে। সেটাও ছিল তখনকার পৃথিবীর বৃহত্তম বসতি। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম ও চতুর্থ সহস্রাব্দে নীল নদের অববাহিকা ও বদ্বীপের উর্বরভূমিতে যে শহর গড়ে উঠেছিলো তার লোকসংখ্যা ছিল আরও বেশি, আর সে শহরের আওতায় ছিলো আশপাশের অনেক গ্রাম। ৩১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যেই সম্পূর্ণ নীলনদ অববাহিকা প্রথম মিশরীয় সাম্রাজ্যের অধীন হয়। তখনকার ফারাওরা শাসন করতেন হাজার হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার লক্ষ লক্ষ মানুষকে। ২২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে মহান সার্গন পত্তন করেন পৃথিবীর প্রথম সাম্রাজ্যের – আক্কাদীয় সাম্রাজ্য। সে সাম্রাজ্যে প্রজার সংখ্যা ছিলো নিযুতের ঘরে, আর সেনাবাহিনীতে স্থায়ী সদস্য ছিলো ৫৪০০ জন। আর ১০০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে বৃহৎ সাম্রাজ্যের উদ্ভব হয়, যার মধ্যে ছিলো আসিরীয়, ব্যাবিলনীয় ও পারস্য সাম্রাজ্য। এসব সাম্রাজ্যে প্রজার সংখ্যা ছিলো কোটির কাছাকাছি, আর সৈন্য ছিলো দশ হাজারের মত।

২২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সমগ্র চীন জুড়ে গঠিত হয় চীন (Qin) সাম্রাজ্য, আর তার কিছুকাল পরেই রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে আসে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল। চীন সাম্রাজ্যের হাজার হাজার স্থায়ী সৈন্য আর লক্ষাধিক রাজকর্মচারীর বেতন আসত প্রায় ৪ কোটি প্রজার দেওয়া কর থেকে। ওদিকে রোমান সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে প্রায় ১০ কোটি প্রজার কাছ থেকে কর আদায় করা হতো। সেই করের অর্থই একদিকে আড়াই থেকে পাঁচ লক্ষ সৈন্যের খোরাক যোগাতো, অন্যদিকে সেই অর্থেই তৈরি হয় প্রায় ১৫০০ বছর ধরে ব্যবহৃত রাস্তা। আজ আমরা ওখানে যেসব থিয়েটার আর অ্যাম্ফিথিয়েটার দেখতে পাই সেগুলোও তৈরি হয়েছে তখনই।

 

১৬। ১৭৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শিলালিপিতে খোদাই করা হামুরাবির আইন

প্রাচীন মিশরীয় আর রোমান সাম্রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মানুষের সহযোগিতায় গড়া সমাজের গল্পটা যতটা দারুণ মনে হয় আসলে ব্যাপারটা তেমন নয়। ‘সহযোগিতা’ শব্দটা অনেকটা নিঃস্বার্থ শোনালেও সেটা সবসময় স্বাধীনতা ও সাম্যের কথা বলে না। মানুষের বড় বড় সংগঠনের বেশির ভাগই এক সময় অত্যাচার আর শোষণের পথে এগিয়ে গেছে। এমন সংগঠন গড়ার মূল্য কৃষকেরা চুকিয়েছেন তাদের উদ্বৃত্ত খাদ্যটুকু দিয়ে। কর সংগ্রাহকের কলমের একটি খোঁচায় কৃষককে তার সারা বছরের কঠোর পরিশ্রমের ফসলটুকু হারাতে হতো। রোমান সাম্রাজ্যের বিখ্যাত অ্যাম্ফিথিয়েটার গড়েছিল যে ক্রীতদাসের দল, সমাজের অলস ধনীদের আনন্দ দিতে সেই ক্রীতদাসেরাই সেখানে লড়াই করে মরতো গ্ল্যাডিয়েটর রূপে। জেলখানা আর বন্দী শিবিরগুলোকেও একরকম সহযোগিতার সমাজ বলা যায়, কারণ সেখানেও অনেকগুলো অজানা-অচেনা মানুষ পারস্পরিক সহযোগিতায় একসাথে একই রকম জীবন যাপন করে।

১৭। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, ৮ জুলাই ১৭৭৬

সেই প্রাচীন মেসোপটেমীয় শহর থেকে চীন বা রোমান সাম্রাজ্য – এই সবগুলোই দাঁড়িয়ে ছিল এক কাল্পনিক কাঠামোর উপর। যেসব সামাজিক রীতিনীতি সেসব জায়গায় চালু ছিলো তা মানুষের ভিতর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসেনি, এসেছে সেখানে প্রচলিত মিথগুলোর উপর মানুষের সম্মিলিত বিশ্বাস থেকে।

মিথ কীভাবে পুরো একটা সাম্রাজ্যকে ধরে রাখে? এমন একটা উদাহরণ আমরা ইতোমধ্যেই পেয়েছি – পিউজো। ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি পরিচিত দুটো মিথ থেকে এর উত্তর খোঁজা যাক। একটা হল হামুরাবির আইন, যেটা প্রাচীন ব্যাবিলনে সেই ১৭৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লক্ষ মানুষের সমাজ গড়েছিল, আর অন্যটা হল ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা, যা আজও লক্ষ লক্ষ আমেরিকানের পারস্পরিক সহায়তার ভিত্তি হিসেবে টিকে আছে।

১৭৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনই ছিলো পৃথিবীর বৃহত্তম নগর। আর ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য, যার লোকসংখ্যা ছিলো দশ লক্ষেরও উপরে। এলাকাটা ছিলো মেসোপটেমিয়া, যার মধ্যে ছিলো আজকের সিরিয়া আর ইরানের কিছু অংশ আর ইরাকের প্রায় পুরোটাই। ব্যাবিলনের রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যার নাম শোনা যায়, তিনি হামুরাবি। তাঁর এই খ্যাতির মূল কারণ হল তাঁর প্রণীত আইন। এই আইনগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিলো হামুরাবিকে একজন আদর্শ রাজা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা, ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যে আইনগত সমতা আনা আর ভবিষ্যতের রাজাদের জন্য একটা দৃষ্টান্ত রেখে যাওয়া।

উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছিল। পরবর্তী প্রজন্মের বুদ্ধিজীবী ও অভিজাত সমাজ এটাকে গ্রহণ করেছিল প্রায় দৈববাণীর মতই, আর তাদের অনুসারীরা হামুরাবির মৃত্যুর পরেও যতদিন সাম্রাজ্য টিকে ছিলো ততদিন এই আইনের অনুলিপি তৈরি করে গেছে। তাই মেসোপটেমিয়ার মানুষের সামাজিক রীতিনীতি বোঝার জন্য হামুরাবির আইন একটা চমৎকার উপকরণ।৩

হামুরাবির আইনের ভাষ্য শুরু হয়েছে মেসোপটেমিয়ার মন্দিরের প্রধান দেবতা আনু, এনলিল ও মারডুকের (Anu, Enlil and Marduk) নামে, যাঁরা হামুরাবিকে নিযুক্ত করেছেন ‘বিচার প্রতিষ্ঠা, দুষ্টের দমন ও দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচারকে প্রতিহত করতে’।৪ এর পরেই আছে প্রায় ৩০০ টি আইনের তালিকা, যার প্রত্যেকটিতে কোন কাজের জন্য কেমন বিচার হবে তা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এমন কয়েকটা আইন দেখা যাকঃ

১৯৬। যদি কোনো উঁচু শ্রেণীর মানুষ আরেক উঁচু শ্রেণীর মানুষকে অন্ধ করে দেয়, তবে তাকেও অন্ধ করে দেওয়া হবে।

১৯৭। সে যদি কোনো উঁচু শ্রেণীর মানুষের হাড় ভেঙে দেয়, তবে তারও হাড় ভেঙে দেওয়া হবে।

১৯৮। সে যদি কোনো সাধারণ মানুষের চোখ অন্ধ করে দেয় বা হাড় ভেঙে দেয়, তবে তাকে ৬০ শেকেল রূপা জরিমানা দিতে হবে।

১৯৯। সে যদি আরেকজন উঁচু শ্রেণীর মানুষের কোনো দাসের চোখ অন্ধ করে দেয় বা হাড় ভেঙে দেয়, তবে তাকে ঐ দাসের মূল্যের অর্ধেকের সমান রূপা দিতে হবে।৫

২০৯। যদি কোনো উঁচু শ্রেণীর মানুষ উঁচু শ্রেণীর কোনো নারীকে আঘাত করে এবং এতে ঐ নারীর গর্ভস্থ ভ্রূণের মৃত্যু হয়, তবে তাকে ১০ শেকেল রূপা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

২১০। এতে যদি ঐ নারীর মৃত্যু হয়, তাহলে তার কন্যাকে হত্যা করা হবে।

২১১। সে যদি সাধারণ শ্রেণীর কোনো নারীকে আঘাত করে এবং এতে ঐ নারীর গর্ভস্থ ভ্রুণের মৃত্যু হয়, তবে তাকে ৫ শেকেল রূপা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

২১২। এতে ঐ নারীর মৃত্যু হলে তাকে ৩০ শেকেল রূপা জরিমানা দিতে হবে।

২১৩। সে যদি কোনো উঁচু শ্রেণীর মানুষের দাসীকে আঘাত করে এবং এতে ঐ দাসীর গর্ভস্থ ভ্রুনের মৃত্যু হয়, তবে তাকে ২ শেকেল রূপা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

২১৪। এতে ঐ দাসীর মৃত্যু হলে তাকে ২০ শেকেল রূপা জরিমানা দিতে হবে।৬

এই তালিকার পরে হামুরাবি বলেছেন,

“এগুলোই হল জীবনে সত্য ও সঠিক পথে চলার জন্য রাজা হামুরাবির প্রতিষ্ঠিত ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত… আমি, মহান রাজা হামুরাবি, সেসব মানুষের প্রতি উদাসীন নই, যাদেরকে আমার দায়িত্বে সোপর্দ করেছেন দেবতা এনলিল, আর যাদের পথ দেখাবার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন দেবতা মারডুক।৭”

হামুরাবির আইন অনুযায়ী ব্যাবিলনের সমাজ ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে সর্বজনীন ও চিরন্তন ঈশ্বর নির্দেশিত ন্যায়বিচারের উপর। সামাজিক স্তরবিন্যাস এ আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই আইন অনুযায়ী মানুষ দুই লিঙ্গ ও তিন শ্রেণীতে বিভক্ত। শ্রেণী তিনটি হল উঁচু শ্রেণীর মানুষ, সাধারণ মানুষ আর দাস। ভিন্ন ভিন্ন লিঙ্গ ও শ্রেণীর মানুষের মূল্যও ভিন্ন। একজন সাধারণ নারীর জীবনের মুল্য যেখানে ৩০ শেকেল রূপা, সেখানে একজন দাসীর জীবনের মূল্য ২০ শেকেল রূপা। আবার একজন সাধারণ পুরুষের চোখের মূল্যই ৬০ শেকেল রূপা।

এই আইন পরিবারের ভিতরেও মানুষের অধিকারক্রম নির্দিষ্ট করে দেয়। এখানে সন্তানদেরকে আলাদা মানুষ হিসাবে নয়, বরং তাদের মা-বাবার সম্পত্তি হিসাবে বিবেচনা করা হত। এ কারণেই, কোনো উচ্চতর মানুষ আরেকজন উচ্চতর মানুষের মেয়েকে হত্যা করলে শাস্তিস্বরূপ তার মেয়েকেও হত্যা করা হত। হত্যাকারীকে শাস্তি না দিয়ে তার নিরপরাধ কন্যাকে হত্যা করাটা আমাদের কাছে খাপছাড়া মনে হলেও হামুরাবি ও ব্যাবিলনের বাসিন্দাদের কাছে এটাই ছিলো ন্যায়সঙ্গত। হামুরাবির আইন প্রণয়নের আগে ধরে নেওয়া হয়েছিলো যে প্রজারা সবাই যদি যার যার সামাজিক অবস্থান মেনে নেয় তাহলেই সাম্রাজ্যের লক্ষ লক্ষ অধিবাসীদের মধ্যে একটা সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরি হবে। তখন সমাজে খাদ্যের উৎপাদন ও বণ্টন সুষ্ঠু হবে, শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যাবে এবং সাম্রাজ্যকে আরো বিস্তৃত করে আরও বেশি সম্পদ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে।

হামুরাবির মৃত্যুর প্রায় ৩৫০০ বছর পরে, উত্তর আমেরিকায় ব্রিটিশদের তেরোটি উপনিবেশের মানুষদের মনে হতে লাগল যে ব্রিটিশ রাজা তাদের প্রতি সুবিচার করছেন না। এইসব মানুষের কয়েকজন মুখপাত্র ফিলাডেলফিয়ায় একত্রিত হলেন, আর ১৭৭৬ এর জুলাইয়ের ৪ তারিখে ঘোষণা করলেন যে এই তেরোটি উপনিবেশের মানুষ আর ব্রিটিশ রাজ্যের প্রজা নয়। তাদের স্বাধীনতার এই ঘোষণাতেও ছিল সর্বজনীন ও চিরন্তন ন্যায়বিচারের কথা, আর ঠিক হামুরাবির আইনের মতই সেগুলোও ছিল ঈশ্বরনির্দেশিত। তবে আমেরিকার ঈশ্বরের প্রদত্ত নীতিগুলো ব্যাবিলনের ঈশ্বরের নীতি থেকে ছিল ভিন্ন। আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা বলেঃ

“এ কথা আমরা স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলে ধরে নিচ্ছি যে, সকল মানুষকেই সৃষ্টি করা হয়েছে সমানভাবে এবং প্রত্যেকেই সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে লাভ করেছে কিছু অবিচ্ছেদ্য অধিকার, যার মধ্যে আছে জীবন, স্বাধীনতা আর সুখের সাধনা।”

হামুরাবির আইনের মত আমেরিকার স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রও বলে যে, এই পবিত্র নীতিমালা মেনে চললে লাখো মানুষের মাঝে গড়ে উঠবে সহযোগিতার সম্পর্ক, একটি ন্যায়সঙ্গত ও প্রগতিশীল সমাজে তারা পাবে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ জীবন। হামুরাবির আইনের মত আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাও স্থান-কালের সীমা অতিক্রম করেছে – পরবর্তী প্রজন্মগুলোর কাছেও তা সমান গ্রহণযোগ্য। ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমেরিকার স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীরা এটা শিখছে।

পাশাপাশি তুলনা করে দেখলে এই দুটো নিয়ম-নীতি আমাদের দ্বিধায় ফেলে দেয়। হামুরাবির আইন ও আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা – দুটোই নিজেকে সর্বজনীন ও চিরন্তন ন্যায়ের পথ বলে দাবি করে। অথচ যেখানে আমেরিকার মানুষেরা বলে সব মানুষই সমান, সেখানে ব্যাবিলনের মানুষেরা আগেই স্বীকার করে নিচ্ছে যে সব মানুষ সমান নয়। এক্ষেত্রে আমেরিকানরা অবশ্যই বলবে তারাই ঠিক, হামুরাবির আইন ঠিক নয়। একইভাবে হামুরাবিও বলবেন তিনিই ঠিক, আমেরিকানরা নয়। আসলে উভয়েই ভুল। হামুরাবি ও আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতারা ন্যায়ের সর্বজনীন ও অপরিবর্তনীয় ভিত্তি হিসেবে দুটো কাল্পনিক বাস্তবতার কথা কল্পনা করেছিলেন যার একটির ভিত্তি ছিল আধিপত্য আর অপরটির ভিত্তি ছিল সমতা। কিন্তু বাস্তবে এই দু’রকম সর্বজনীন নীতি মানুষেরই মস্তিষ্কপ্রসূত, এর সূচনা হয় তাদের কল্পনায়, আর এসব বেঁচে থাকে তাদের বানিয়ে তোলা নানা কাল্পনিক গল্পগাথার মাধ্যমে। এসকল রীতিনীতির আসলে কোন বস্তুগত ভিত্তি নেই।

মানুষকে উচ্চতর ও সাধারণ শ্রেণীতে ভাগ করার ধারণাটা যে কল্পনাপ্রসূত সেটা নাহয় সহজেই মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু ‘সব মানুষই সমান’ এই কথাটা? আসলেই কি সব মানুষ সমান? মানুষের কল্পনার বাইরে এসে কোন নিরপেক্ষ বাস্তব ভিত্তির উপর সব মানুষকে সমান বলে দাবি করা যায়? শারীরিকভাবেও কি সব মানুষ সমান হয়? আসুন, আমরা আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণার সবচেয়ে বিখ্যাত লাইনটিকে জীববিজ্ঞানের ভাষায় প্রকাশ করার চেষ্টা করিঃ

“এ কথা আমরা স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলে ধরে নিচ্ছি যে, সকল মানুষকেই সৃষ্টি করা হয়েছে সমানভাবে এবং প্রত্যেকেই সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে লাভ করেছে কিছু অবিচ্ছেদ্য অধিকার, যার মধ্যে আছে জীবন, স্বাধীনতা আর সুখী হওয়ার প্রচেষ্টা।”

জীববিজ্ঞান বলে মানুষের ‘সৃষ্টি’ হয়নি, ‘বিবর্তন’ হয়েছে। আর বিবর্তন মোটেই সবার জন্য সমান হয় না। সমতার ধারণা সৃষ্টিতত্ত্বের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। আমেরিকানরা এই ধারণা পেয়েছে খ্রিস্টধর্ম থেকে – যেখানে বলা হয় প্রত্যেক মানুষ পবিত্র আত্মার অধিকারী এবং ঈশ্বরের চোখে সকল আত্মাই সমান। এখন, আমরা যদি ঈশ্বর, সৃষ্টি, আত্মা – এই খ্রিস্টধর্মীয় শব্দগুলোকে বাদ দিয়ে চিন্তা করি, তাহলে ‘সব মানুষ সমান’ – এ কথার অর্থ কী দাঁড়ায়? বিবর্তন পার্থক্য তৈরি করে, সমতা নয়। প্রত্যেক মানুষের ভিন্ন ভিন্ন জিন সংকেত আছে, যা জন্মের পর থেকেই পরিবেশের দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত হয়। এভাবেই মানুষের মধ্যে নানা রকম বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটে আর তার ফলে টিকে থাকার সম্ভাবনাও হয় এক একজনের এক একরকম। কাজেই ‘সকল মানুষকেই সৃষ্টি করা হয়েছে সমানভাবে’ না বলে বলা উচিত ‘মানুষ ভিন্ন ভিন্নভাবে বিবর্তিত হয়েছে’।

জীববিজ্ঞানে যেমন মানুষের ‘সৃষ্টি হওয়ার’ কথা কোথাও বলা হয়নি, তেমনি বলা হয়নি কোনো ‘ঈশ্বর’ এবং ঈশ্বরের কাছ থেকে কোনো কিছু ‘লাভ করার’ কথাও। সেখানে মানবজন্মের পিছনে শুধু একটা প্রক্রিয়াই চলমান আছে, তা হলো অন্ধ-উদ্দেশ্যহীন বিবর্তন। তাই ‘সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে লাভ করেছে’ না বলে বলা উচিত মানুষ ‘জন্মেছে’।

একইভাবে বলা যায়, জীববিজ্ঞানে ‘অধিকার’ বলেও কিছু নেই। আছে শুধু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, দক্ষতা ও বৈশিষ্ট্য। পাখির ওড়ার অধিকার আছে বলে সে ওড়ে না, পাখি ওড়ে তার ডানা আছে তাই। আর এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, দক্ষতা ও বৈশিষ্ট্যও ‘অবিচ্ছেদ্য’ নয়, কারণ এগুলোরও পরিব্যক্তি (mutation) ঘটে, ফলে এদের পরিবর্তন হয়, আবার কখনো হারিয়েও যায়, যেমন উটপাখি হারিয়েছে তার ওড়ার ক্ষমতা। কাজেই ‘অবিচ্ছেদ্য অধিকার’ এর জায়গায় বলা উচিত ‘পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্য’।

এখন, বিবর্তনের মাধ্যমে উদ্ভূত বৈশিষ্ট্যগুলোর দিকে নজর দেয়া যাক। ‘জীবন’ ব্যাপারটা ঠিক আছে, কিন্তু ‘স্বাধীনতা’? জীববিজ্ঞানে স্বাধীনতা বলেও কিছু নেই। সমতা ও অধিকারের মতো স্বাধীনতাও মানুষের কল্পনাপ্রসূত একটা ধারণা। জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখলে গণতান্ত্রিক সমাজের মানুষেরা স্বাধীন আর স্বৈরশাসনে থাকা মানুষেরা পরাধীন – এরকম কিছু বলা যায় না। আর ‘সুখ’? আজ পর্যন্ত কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা সুখের একটা পরিষ্কার সংজ্ঞা দিতে পারেনি, কিংবা সুখের কম-বেশি নির্ধারণের কোনো উপায়ও খুঁজে পায়নি। গবেষণায় যা পাওয়া গেছে তা হলো আনন্দ, যাকে আরো সহজে সংজ্ঞায়িত বা পরিমাপ করা যায়। কাজেই ‘জীবন, স্বাধীনতা আর সুখী হওয়ার প্রচেষ্টা’ এর বদলে আমরা বলতে পারি ‘জীবন ও আনন্দলাভ’।

তাহলে জীববিজ্ঞানের চোখে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণার আলোচ্য লাইনটি দাঁড়াচ্ছে এমনঃ

“এ কথা আমরা স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলে ধরে নিচ্ছি যে, সকল মানুষই ভিন্ন ভিন্নভাবে বিবর্তিত হয়েছে এবং প্রত্যেকেই জন্মেছে কিছু পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্য নিয়ে, যার মধ্যে আছে জীবন ও আনন্দলাভের চেষ্টা।”

বিষয়টিকে এভাবে দেখলে সমতা ও সমানাধিকারের পক্ষের লোকেরা হয়ত ক্ষেপে যাবেন। বলবেন, ‘সব মানুষ যে শারীরিকভাবে সমান নয় তা তো আমাদের জানাই আছে, কিন্তু আমরা যদি মেনে নিই যে ভিতরে ভিতরে সবাই সমান, তাহলে সবাই মিলে একটা স্থিতিশীল সমাজ গড়ে তোলা যায়।’ সেক্ষেত্রে আসলে আর কিছু বলার নেই। এটাই হল একটু আগে বলা সেই ‘কাল্পনিক ভিত্তি’। ‘সবাই সমান’ – এটা ধরে নেওয়ার কারণ এই নয় যে তা সত্য, বরং কারণটা হল এই যে এটা মেনে নিলে মানুষের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্কটা আরো দৃঢ় হয়, যা দিয়ে একটা সুন্দর সমাজ গড়ে তোলা যায়। এই কাল্পনিক ভিত্তি কোনো ষড়যন্ত্র কিংবা মিথ্যে মোহ নয়, এটা হল অনেক মানুষকে সহযোগিতার সম্পর্কে আবদ্ধ করার একটা কার্যকর উপায়। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, এই একই রকম যুক্তি কিন্তু হামুরাবিও তাঁর শ্রেণীবিভক্ত সমাজব্যবস্থাকে সঠিক প্রমাণ করতে ব্যবহার করতে পারতেন।

প্রকৃত বিশ্বাসী

এ পর্যন্ত পড়ে কিছু পাঠক নিশ্চয়ই একটু নড়েচড়ে বসেছেন। এটাই স্বাভাবিক, কারণ আমাদের শিক্ষাই আমাদের এভাবে তৈরি করেছে। হামুরাবির আইনকে মিথ বলে মেনে নিতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু সব মানুষের সমানাধিকারকে মিথ হিসেবে মেনে নিতে পারি না আমরা। আসলেই, মানুষ যদি বুঝতে পারে যে মানুষের সমানাধিকারের ব্যাপারটা এমন কৃত্রিম আর কাল্পনিক, তাহলে সেটা কি আমাদের এই সমাজ কাঠামোর প্রতি একটা হুমকি হয়ে দাঁড়াবে না? ঈশ্বর সম্পর্কে ভলতেয়ার বলেছেন, “ঈশ্বর বলে কেউ নেই, কিন্তু আমার চাকরকে আবার কথাটা বলতে যেও না, রাতের বেলায় ও ব্যাটা যদি আমাকে খুন করে ফেলে”। ঠিক একই রকম কথা হয়তো হামুরাবিও বলতেন তাঁর শ্রেণীবিভক্ত সমাজ নিয়ে, আর আমেরিকার সংবিধানের লেখক থমাস জেফারসন বলতেন মানবাধিকার নিয়ে। মাকড়সা, হায়েনা কিংবা শিম্পাঞ্জির মত হোমো সেপিয়েন্স প্রাণীটিরও প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত বিশেষ কোনো অধিকার নেই। কিন্তু এ কথা তো অন্ধবিশ্বাসীদের বলা যাবে না, পাছে রাতে খুন হয়ে যাই।

এরকম আশঙ্কা অমূলক নয়। প্রাকৃতিক সম্পর্ক হলো একটা স্থিতিশীল সম্পর্ক। মানুষ যদি মাধ্যাকর্ষণের অস্তিত্বে আর বিশ্বাস না করে, তাহলে কাল সকাল থেকে মাধ্যাকর্ষণ উধাও হয়ে যাবে না। অন্যদিকে, একটা কৃত্রিম শৃঙ্খলাবদ্ধ সম্পর্ক সবসময় ভেঙে পড়ার ঝুঁকির মাঝে থাকে। কারণ, এরকম সম্পর্কগুলো দাঁড়িয়ে থাকে কিছু মিথের উপর, আর মিথগুলো টিকে থাকে মানুষের বিশ্বাসে। এ ধরনের শৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখা রীতিমত শ্রমসাধ্য কাজ। এই শৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখার জন্য মানুষ অনেকসময় সহিংসতার পথও বেছে নেয়। সেনাবাহিনী, পুলিশ, আদালত আর জেলখানাগুলো মানুষকে এই শৃঙ্খলায় বেঁধে রাখতে কাজ করে যায় নিরন্তর। প্রাচীন ব্যাবিলনে কেউ কাউকে অন্ধ করে দিলে ‘চোখের বদলা চোখ’ নীতিতে তার শাস্তিবিধান হতো। আবার ১৮৬০ সালে যখন আমেরিকার বেশিরভাগ মানুষ বুঝতে পারলো তাদের আফ্রিকান দাসেরাও মানুষ এবং মানুষের সব স্বাধীনতা তাদের জন্যও প্রযোজ্য, তখন বাকিদেরকে সেটা বোঝাতে তো রীতিমত গৃহযুদ্ধই বেধে গেল।

তবে এমন কাল্পনিক শৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখতে শুধু সহিংসতাই যথেষ্ট নয়। এর সাথে প্রয়োজন হয় এই শৃঙ্খলার ধারনায় বিশ্বাসী কিছু আন্তরিক অনুসারী। প্রিন্স ট্যালির‍্যান্ড এর কথা ধরা যাক। তিনি তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে কাজ করেছেন রাজা ষোড়শ লুইয়ের অধীনে, অংশ ছিলেন ফরাসি বিপ্লবের, কাজ করেছেন নেপোলিয়নের অধীনে। শেষ জীবনে তাঁর আনুগত্যটা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রের দিকেই ছিল। কয়েক দশক ধরে সরকারের সাথে তাঁর কাজের অভিজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁরই একটি উক্তি থেকে- “বেয়োনেট দিয়ে অনেক কিছুই করা যায়, তবে ওটার উপর বসে পড়াটা খুব সুখকর নয়”। অনেক সময় একশ সৈনিকের কাজ একজন যাজক করে ফেলতে পারেন অনেক সস্তায় আর সহজে। আর বেয়োনেট যতই কার্যকর হোক না কেন, ওটা ব্যবহারের জন্য মানুষও তো চাই। সৈনিক, কারারক্ষী, বিচারক আর পুলিশেরা কি একটা কাল্পনিক শৃঙ্খলা ধরে রাখতে চেষ্টা করবে যদি তারা নিজেরাই সেটা বিশ্বাস না করে? মানুষের যতরকম যৌথ কর্মকাণ্ড আছে তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হল সন্ত্রাস। যদি বলি সমাজকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখে সেনাবাহিনী, তবে সাথে সাথেই প্রশ্ন ওঠে, সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা নিশ্চিত করে কে? শুধু ভয়ভীতি দেখিয়ে পুরো একটা সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা আনতে হলে বাহিনীর সবাই না হোক, অন্তত উচ্চপদস্থ সৈনিকদের একটা কিছুর উপরে বিশ্বাস রাখতে হয় – সেই একটা কিছু হতে পারে ঈশ্বর, হতে পারে মর্যাদা, হতে পারে মাতৃভূমি, পৌরুষ কিংবা অর্থ।

এই সামাজিক পিরামিডের উপরতলায় থাকা লোকদের নিয়ে আরেকটা প্রশ্ন চলে আসে। তারা কি এমন একটা শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে চাইত যদি তারা নিজেরাই সেটা বিশ্বাস না করত? সবার প্রথমে যে উত্তরটা মাথায় আসে সেটা হল, তারা তাদের উদাসীন মনের নিতান্ত ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা বা খেয়াল থেকেই এমন কাজ করে। যদিও একজন অবিশ্বাসী, যার কোন কিছুতেই বিশ্বাস নেই, কোন কিছুর জন্যই তার ব্যক্তিগত কোন আকাঙ্ক্ষা বা লোভ থাকার কথা নয়। জীবনধারনের জন্য অপরিহার্য জৈবিক চাহিদাগুলো পূরণ করার জন্য একজন মানুষের খুব বেশি কষ্ট করার দরকার পড়ে না। সেসব চাহিদা পূরণ হলে মানুষ টাকা খরচ করে পিরামিড বানায়, ছুটিতে বিশ্ব ভ্রমণে বের হয়, নির্বাচনী প্রচারণায় টাকা ঢালে, প্রিয় সন্ত্রাসী সংগঠনকে টাকা পাঠায়, শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে এবং আরও আরও টাকা কামায়- এসব কিছুই একজন প্রকৃত খেয়ালী বা নৈরাশ্যবাদী মানুষের কাছে পুরোপুরি অর্থহীন কাজ। নৈরাশ্যবাদী দর্শনের জনক বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক ডায়োজিনিস একটি কাঠের তৈরি পিপের ভিতর বসবাস করতেন। একদিন ডায়োজিনিস যখন সূর্যের আলোয় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, বিখ্যাত সম্রাট আলেকজান্ডার তাঁর কাছে এসে উপস্থিত হলেন এবং তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কোনভাবে ডায়োজিনিসের উপকারে আসতে পারেন কিনা। উত্তরে নৈরাশ্যবাদী ডায়োজিনিস মহান সম্রাট আলেকজান্ডারকে বললেন- ‘অবশ্যই পারেন। একটু পাশে সরে দাঁড়ান। আপনি সামনে এসে দাঁড়ানোর কারণে সকালের রোদটা ঠিকমত গায়ে লাগছে না।’

এই কারণেই অনেকগুলো নৈরাশ্যবাদী লোক কখনও একটি সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পারে না। সামাজিক কাঠামো বা সামাজিক স্তরবিন্যাস কেবল তখনই গড়ে ওঠে যখন সমাজের অধিকাংশ লোক, বিশেষ করে অভিজাত সম্প্রদায় এবং নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের অধিকাংশ মানুষ সেই স্তরবিন্যাসের কাল্পনিক বাস্তবতায় বিশ্বাস করে। খ্রিস্টধর্ম দুই হাজার বছর টিকে থাকত না যদি অধিকাংশ বিশপ এবং ধর্মযাজক যিশুখ্রিস্টকে বিশ্বাস না করতেন, আমেরিকার গণতন্ত্র দুইশত পঞ্চাশ বছর ধরে টিকে থাকত না যদি অধিকাংশ প্রেসিডেন্ট এবং সাংসদ মানুষের সমানাধিকারে বিশ্বাস না করতেন। বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা এক দিনও টিকত না, যদি বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী এবং ব্যাংকারগণ ক্যাপিটালিজম বা ধনতন্ত্রে বিশ্বাস না করতেন।

এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে

মানুষকে এমন একটা কাল্পনিক শৃঙ্খলায় বেঁধে ফেলার উপায় কী? কীভাবে খ্রিস্টধর্ম, গণতন্ত্র কিংবা পুঁজিবাদ সফল হলো এ কাজে? প্রথম শর্ত হলো কোনোভাবেই স্বীকার করা যাবে না যে ব্যাপারটা কাল্পনিক বা আরোপিত। মানুষকে বোঝাতে হবে যে, সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য এ নিয়মগুলো মানুষের তৈরি নয় বরং ঈশ্বরসৃষ্ট প্রাকৃতিক নিয়ম। সব মানুষ যে সমান নয়, তার কারণ এই নয় যে, হামুরাবি তা বলেছেন, বরং এর কারণ হলো এটা দেবতা এনলিল ও মারডুকের কথা। আবার সব মানুষই যে সমান, সেটা থমাস জেফারসনের কথা নয়, এর কারণ ঈশ্বর তাদের সমান করেই সৃষ্টি করেছেন। অ্যাডাম স্মিথের কথায় মুক্ত বাজার সেরা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হয়নি, হয়েছে প্রকৃতির অপরিবর্তনীয় নিয়মে।

শৃঙ্খলা তৈরি করা এবং বজায় রাখার জন্য এসব শৃঙ্খলার সাথে ঈশ্বর বা অতিপ্রাকৃত শক্তিকে সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি এসব নিয়মের ব্যাপারে মানুষকে শিক্ষা দেওয়াও প্রয়োজন। জন্মের পরমুহূর্ত থেকে প্রতিটি বস্তু, প্রতিটি ঘটনার মাঝে একজন মানুষকে এইসব নিয়মের কথাটা মনে করিয়ে দেওয়া হয়। প্রত্যেক রূপকথায়, নাটকে, ছবিতে, গানে, সামাজিক আচরণে, রাজনৈতিক বক্তৃতায়, স্থাপত্যে, রন্ধনপদ্ধতিতে, পোশাকের নকশায় মিশে থাকে এই কাল্পনিক সামাজিক শৃঙ্খলার উপাদান। যেমন, আজকের দিনে মানুষ সমতায় বিশ্বাস করে, তাই শ্রমিকদের পোশাক জিন্স আজ ধনীদের জন্যও কেতাদুরস্ত। মধ্যযুগের মানবসমাজ ছিলো শ্রেণীবিভক্ত, তাই অভিজাত পরিবারের সদস্যদের গায়ে কৃষকের আলখাল্লা উঠত না কখনোই। সেসময় ‘স্যার’ কিংবা ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন উচ্চবংশীয় মানুষদের জন্যই বরাদ্দ ছিলো। আজ যে কোনো আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ শুরু হয় সেই একই সম্বোধনে।

এই কাল্পনিক শৃঙ্খলা কীভাবে সমাজের সর্বত্র মিশে আছে, মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে তারই ব্যাখ্যা। খুব অল্প কথায় বলতে গেলে, মানুষ কেন ব্যাপারটাকে কাল্পনিক বলে ধরতে পারে না তার তিনটা কারণ পাওয়া যায়।

ক। কাল্পনিক শৃঙ্খলা আমাদের চারপাশের বস্তুগত পৃথিবীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকে। জিনিসটা কাল্পনিক আর তার অস্তিত্ব কেবল আমাদের কল্পনায়, কিন্তু তার পরেও সেটা সকল বস্তুর মাঝে খুব ভালভাবে মিশে যেতে পারে। বর্তমান পশ্চিমা দেশগুলোর মানুষ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী। তাদের কাছে প্রত্যেক মানুষ কেবলই একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি, যার সামাজিক মূল্য নির্ধারণ করে সে নিজেই। অন্যরা তার বিষয়ে কী ভাবছে তার কোন ভূমিকা সেখানে নেই। প্রতিটি মানুষের কাছে জীবনের অর্থ তার নিজের মতো করে সংজ্ঞায়িত। পশ্চিমা দেশের স্কুলগুলোও একটা শিশুকে শেখায় তাকে নিয়ে সহপাঠীদের হাসি-তামাশায় কান না দিতে।

এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মিথটা আমাদের কল্পনা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তব রূপ নিয়েছে আমাদের ঘরের নকশায়। আজকের দিনে একটা বাড়িতে অনেক ছোট ছোট ঘর থাকে। পরিবারের প্রত্যেক শিশুসদস্য নিজের একটা করে ঘর পায় যেখানে তার একচ্ছত্র রাজত্ব। অনেক বাড়িতে এমন একটা শিশুর পক্ষে তার ঘরের দরজাটা আটকে দেওয়া, এমনকি ভিতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দেওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। অনেক ক্ষেত্রে তার বাবা-মাকেও দরজায় টোকা দিয়ে অনুমতি নিয়ে তার ঘরে ঢুকতে হয়। ঘর সাজানোও হয় ওই শিশুটির পছন্দমতো। এরকম বাড়িতে এমন পরিবেশে বেড়ে ওঠা যেকোনো মানুষই ব্যক্তিসত্ত্বা-সচেতন হবে, এটাই স্বাভাবিক। তার সামাজিক মূল্যও নিরূপণ করবে সে নিজেই।

মধ্যযুগের অভিজাত সমাজে এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধারণাটা ছিলো না। মানুষের সামাজিক মূল্য নির্ধারিত হত সমাজে তার অবস্থান আর তার সম্পর্কে অন্যদের ধারণা থেকে। মানুষের হাসির পাত্র হওয়াটা ছিলো চরম অপমানজনক ব্যাপার। যেকোনো মূল্যে পরিবারের মান রাখতে হবে- এটাই ছিলো তাদের পারিবারিক শিক্ষা। এখনকার মতো তখনও এই মূল্যবোধের নিদর্শন দেখা যেত তাদের বাসস্থান দূর্গগুলোতে। সেখানে কোনো শিশুর একার একটা ঘর থাকাটা ছিলো বিরল ঘটনা। মধ্যযুগের কোনো ব্যারনের কিশোর ছেলে বাবা-মায়ের প্রবেশাধিকারবিহীন নিজের মতো করে সাজানো নিজের ঘরের কথা কল্পনাও করতে পারত না। তাকে থাকতে হতো তার সমবয়সী ছেলেদের সাথে কোনো একটা বড় হলঘরে। একান্ত ব্যক্তিগত স্থান বা সময় কোনোটাই তার ছিলো না, সারাদিন তার ওঠাবসা ছিল আর দশজনের সাথেই। তাই শুধু নিজের কথা ভাবলেই চলত না, অন্যরা কী দেখছে কী ভাবছে সেটাও তাকে মাথায় রাখতে হত। এভাবে বেড়ে ওঠার কারণেই মানুষের সামাজিক মূল্য নির্ধারিত হত তার সামাজিক অবস্থান ও অন্যদের কাছে তার ভাবমূর্তি থেকে।৮

খ। আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলোও তৈরি হয় এই কাল্পনিক সামাজিক শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে। বেশিরভাগ মানুষই তার আঁকড়ে ধরা বিশ্বাসগুলোকে কাল্পনিক বলে মানতে চায় না, কিন্তু তাদের জন্মই হয় একটা প্রতিষ্ঠিত কল্পনার উপস্থিতিতে। তার সব আশা-আকাঙ্ক্ষা গড়ে ওঠে এই মিথগুলোকে ঘিরে। তারপর একসময় মানুষের ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষাগুলোই সমাজের কাল্পনিক ভিত্তির রক্ষক হয়ে দাঁড়ায়।

আজকের পশ্চিমা দেশগুলোর মানুষের মনের ইচ্ছাগুলো যেভাবে গড়ে উঠেছে তার পিছনে আছে তাদের কয়েক শতাব্দী আগে থেকে তৈরি হওয়া বৈচিত্র্যপিয়াসী, জাতীয়তাবাদী, পুঁজিবাদী ও মানবিক কিছু মিথ। যেমন, অনেকেই তার বন্ধুকে পরামর্শ দেয়, ‘মন যা চায় তাই করো’। কিন্তু কী চাইতে হবে, আমাদের মন সেই নির্দেশনা পায় প্রচলিত শক্তিশালী মিথগুলোর কাছ থেকেই। ‘মন যা চায় তাই করো’ – এরকম একটা চিন্তা আমাদের মনে গেঁথে দিয়েছে ঊনবিংশ শতকের কিছু বৈচিত্র্যপিপাসু আর বিংশ শতকের কিছু ভোগবাদী মিথ। ‘ডায়েট কোক খাও। যা মন চায় কর।’ – এই স্লোগান সাথে নিয়ে কোকাকোলা কোম্পানি সারা পৃথিবীতে বাজারজাত করেছে তাদের পণ্য।

মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত চাওয়াগুলোও ঠিক করে দেয় আমাদের সমাজের অন্তর্নিহিত এই কাল্পনিক ভিত্তি। ইদানিং ছুটি কাটানোর একটা জনপ্রিয় উপায় হল দেশের বাইরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া। এটাকে স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক কর্মকাণ্ড বলার কোনো সুযোগ নেই। একটা শিম্পাঞ্জি গোষ্ঠীর প্রধান কখনই আরেকটি গোষ্ঠীতে গিয়ে তার অবসর সময় কাটাতে চাইবে না। প্রাচীন মিশরের অভিজাত সমাজের মানুষ পিরামিড বানিয়ে কিংবা মমি করে মৃতদেহ সংরক্ষণে প্রচুর অর্থব্যয় করেছে, কিন্তু কেনাকাটা করতে ব্যাবিলনে বা স্কি করতে ফিনিশিয়ায় যায়নি। আজকের দিনে মানুষ যে ছুটিতে প্রচুর টাকা খরচ করে বিদেশ যাচ্ছে, তার পিছনে আছে বৈচিত্র্যপিয়াসী, ভোগবাদী মিথ।

বৈচিত্র্যপ্রবণ এই মিথ মানুষকে বোঝায় যে জীবনকে সম্পূর্ণ উপভোগ করতে চাইলে তাকে যত বেশি সম্ভব বৈচিত্র্যের স্বাদ নিতে হবে। খোলা মনে তাকে গ্রহণ করতে হবে সবরকম মানবীয় আবেগ-অনুভূতি, বৈচিত্র্যময় সব সম্পর্ক, নানা স্বাদের খাবার, বিভিন্ন সুরের গান। সেটা করার একটা ভালো উপায় হলো দূরে এমন কোথাও চলে যাওয়া যেখানকার সংস্কৃতি, রং-রূপ-স্বাদ-গন্ধ আর সামাজিক রীতিনীতি বাঁধাধরা জীবন ও পরিচিত পরিবেশ থেকে পুরোপুরি আলাদা। ভ্রমণ শেষে ‘কীভাবে এই ভ্রমণ জীবনকে বদলে দিল’ এই শিরোনামের গল্পটাও যুক্ত হবে বৈচিত্র্যপ্রবণতার এই মিথের সাথে।

এদিকে ভোগবাদী চিন্তাধারা আমাদের শেখায় সুখী হতে হলে আমাদের যথাসম্ভব বেশি পণ্য ও সেবা ভোগ করতে হবে। যখনই কোনো কিছুর অভাব বোধ হবে, বা মনে হবে কিছু একটা ঠিকমতো চলছে না, সেটা পূরণ করতে হবে কোনো পণ্য বা সেবা কিনে। ভোগ্যপণ্যগুলো কীভাবে আমাদের জীবনকে আরও উন্নত করে তার বর্ণনা তো টেলিভিশনের পর্দায় প্রত্যেক বিজ্ঞাপনেই আমরা দেখতে পাই।

বিচিত্র জিনিসের স্বাদ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার এই ধারণার সাথে খুব চমৎকারভাবে মিশে যায় ভোগবাদী দর্শন। বৈচিত্র্যপ্রবণতা ও ভোগবাদিতা মিলে সৃষ্টি করেছে এক ‘অভিজ্ঞতার বাজার’, আর তার উপরে দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান পৃথিবীর পর্যটন শিল্প। পর্যটন শিল্প টিকেট বিক্রি করে না, হোটেলের ঘরও ভাড়া দেয় না, বিক্রি করে নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা। এ শিল্পে প্যারিস কোনো শহর নয়, ভারতও কোনো দেশ নয়, কেবলই অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। অভিজ্ঞতা এমন এক পণ্য যা ভোগ করে মানুষের দৃষ্টি প্রসারিত হয়, মানুষ সুখী হয়। একজন কোটিপতি যখন তার স্ত্রীর সাথে ঝগড়া মিটিয়ে ফেলতে তাকে নিয়ে প্যারিসে যায়, সে আসলে তার ব্যক্তিগত স্বাধীন আকাঙ্ক্ষা থেকে যায় না, যায় এই বৈচিত্র্যপ্রবণতা ও ভোগবাদিতার মিথের উপর বিশ্বাস রেখে। এমন পরিস্থিতিতে প্রাচীন মিশরের কোনো ধনী ব্যক্তি বেড়াতে যাওয়ার কথা চিন্তাও করত না, বরং হয়তো তার স্ত্রীর ইচ্ছানুসারে তার জন্য তৈরি করত এক বিরাট সমাধিস্তম্ভ।

১৮। গিজার বিশাল পিরামিড। প্রাচীন মিশরের ধনীদের অর্থব্যয়ের একটি খাত।

মিশরীয়রা যেমন পিরামিড বানিয়েছে, তেমনি অন্যান্য অনেক সভ্যতার মানুষও তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে পিরামিডের মতো কিছু একটা গড়তে। সংস্কৃতিভেদে শুধু তাদের নাম, আকার আর চেহারাই বদলায়। কারো জন্য সেটা হয় বিরাট পিরামিড, কারো জন্য সুইমিংপুল আর উঠানসহ শহরে একটা ছোট্ট বাড়ি। কিন্তু সভ্যতার গভীরে প্রোথিত কোন মিথের প্রভাবে সেটা করছে মানুষ, তার কথা কজন জানতে চায়?

গ। সমাজের এই কাল্পনিক ভিত্তি টিকে আছে বহু মানুষের সামষ্টিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে। হুট করে একজন পণ্ডিত মানুষ যদি খুব চেষ্টা করে ব্যক্তিগতভাবে এইসব কাল্পনিক ধারণা থেকে বের হয়ে আসতেও পারে, তাতে সমাজের কিছুই আসবে-যাবে না। বড় কোনো পরিবর্তন আনতে হলে আরও লক্ষ লক্ষ মানুষকে সেটা বোঝাতে হবে। এ কারণেই এই কাল্পনিক ভিত্তি কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয়, বরং একটি আন্তর্ব্যক্তিক বিষয়।

ব্যাপারটা ভালোভাবে বুঝতে হলে আগে আমাদের ‘নৈর্ব্যক্তিক’ (objective), ‘ব্যক্তিক’ (subjective) ও ‘আন্তর্ব্যক্তিক’ (inter-subjective)- এই তিনটি শব্দ ও তাদের পার্থক্য জানতে হবে।

নৈর্ব্যক্তিক ঘটনাগুলো মানুষের চিন্তা বা বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল নয়। উদাহরণ হিসাবে তেজস্ক্রিয়তার কথা বলা যায়। তেজস্ক্রিয়তা কোনো মিথ নয়। মানুষ তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের আগেও তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছিলো। এই বিকিরণ মানুষের জন্য বেশ বিপদজনক, মানুষ সেটা জানুক বা নাই জানুক। তেজস্ক্রিয়তার আবিষ্কারক মেরি কুরি সুদীর্ঘ সময় তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে কাজ করলেও তিনি জানতেন না এটা তাঁর শারীরিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। তেজস্ক্রিয়তা মৃত্যু ঘটাতে পারে – এ কথায় তিনি বিশ্বাস না করলেও তাঁর মৃত্যু হয় অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া রোগে, যার কারণ ছিলো অতিরিক্ত তেজস্ক্রিয় বিকিরণ।

ব্যক্তিক বিষয়গুলো ব্যক্তিনির্ভর। এগুলো নির্ভর করে একজন ব্যক্তির চিন্তাধারা ও বিশ্বাসের উপর। বিশ্বাস পরিবর্তন হলে এই ব্যক্তিক ধারণাগুলোও বিলুপ্ত হয়। অনেক শিশুর মুখেই কাল্পনিক বন্ধুর কথা শোনা যায় যে বন্ধু তার সাথে খেলে কিংবা কথা বলে। বাকি সব মানুষের কাছে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। কারণ সেই বন্ধুর অস্তিত্ব আছে কেবল ওই শিশুটির কল্পনার জগতে, যে জগৎ তার একান্তই ব্যক্তিগত। শিশুটি বড় হওয়ার সাথে সাথে তার এই বিশ্বাসও হারিয়ে যায়, সাথে হারিয়ে যায় সেই কাল্পনিক বন্ধুও।

আন্তর্ব্যক্তিক বিষয়গুলোও বিশ্বাসনির্ভর, কিন্তু একজন ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল নয়। এগুলো টিকে থাকে একই সাথে অনেক মানুষের বিশ্বাসে ও তাদের সম্পর্কে। এক্ষেত্রে যদি সেই অনেক মানুষের একজনের বিশ্বাস পরিবর্তন হয়, কিংবা একজন যদি মারাও যায়, তবু তাতে ওই সম্মিলিত বিশ্বাসের কিছু যায় আসে না, সেটা টিকে থাকে আগের মতোই। কিন্তু যদি ওই বিশ্বাসের অনুসারী বেশিরভাগ লোক মারা যায় বা বিশ্বাস পরিবর্তন করে, তবে ওই ধারণায় পরিবর্তন আসতে পারে, এমনকি সেটা বিলুপ্তও হয়ে যেতে পারে। এগুলো কোনো স্বার্থ হাসিলের জন্য বলা মিথ্যে বা রূপকথার মতো কিছু নয়। এগুলোর অস্তিত্ব ঠিক নৈর্ব্যক্তিক ধারণাগুলোর মতো স্পষ্ট না হলেও মানব সমাজে এগুলোর প্রভাব ব্যাপক। মানব সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার পথে যা কিছু চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করেছে, তার মধ্যে অনেকগুলোই আন্তর্ব্যক্তিক। আইন, অর্থ, ঈশ্বর ও জাতির মত ধারণাগুলো এর মধ্যেই পড়ে।

আবারও পিউজোর উদাহরণে ফিরে যাই। পিউজো শুধু তার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কল্পনার ফসল নয়। পিউজোর অস্তিত্ব টিকে আছে অসংখ্য মানুষের কল্পনায়। এই প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন তার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি বিশ্বাস করেন কারণ তাঁর সাথে এই ধারণায় বিশ্বাস করে এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ, প্রতিষ্ঠানের উকিল, ব্যাংকের কর্মচারীরা, শেয়ার বাজারের লোকেরা আর ফ্রান্স থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত নানান দেশের গাড়ি ব্যবসায়ীরা। একদিন হঠাৎ করেই যদি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলে বসেন যে পিউজোর অস্তিত্বে তিনি আর বিশ্বাস করেন না, সম্ভবত পরদিনই তিনি নিজেকে দেখবেন নিকটস্থ পাগলাগারদে, আর তাঁর অফিসের চেয়ারে দেখবেন অন্য কাউকে।

একইভাবে বলা যায়, ডলার, মানবাধিকার এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্ব আছে কোটি কোটি মানুষের বিশ্বাসে। সেকারণে কোনো একজন মানুষের অবিশ্বাসে এসবের অস্তিত্ব বিলীন হবার সম্ভাবনা নেই। এগুলো আন্তর্ব্যক্তিক বিষয়, তাই এগুলোকে পাল্টে দিতে হলে অসংখ্য মানুষের বিশ্বাস ও চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। ব্যাপারটা মোটেই সহজ নয়, আর একজন ব্যক্তির পক্ষে তা অসম্ভব। এ ধরণের পরিবর্তন আসতে পারে বড় এবং জটিল কোনো প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে। সেটা হতে পারে কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় দল কিংবা কোনো বিপুল আদর্শিক আন্দোলন। আবার এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়তে হলে অনেকজন মানুষকে এই পরিবর্তনের জন্য পরস্পরকে সহযোগিতা করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আর সেটা তখনই সম্ভব হবে যখন তারা নতুন কোনো মিথের উপর তাদের সম্মিলিত বিশ্বাস স্থাপন করবে। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এমন, সমাজের একটা কাল্পনিক ভিত্তি পালটে দিতে হলে সেখানে আরেকটা কাল্পনিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

পিউজোকে নির্মূল করতে হলে তার চেয়ে শক্তিশালী কিছু প্রয়োজন, সেটা হতে পারে ফ্রান্সের আইনব্যবস্থা। ফ্রান্সের আইনকে অকার্যকর করতে পারে আরও বড় কিছু, যেমন ফ্রান্স রাষ্ট্রটি স্বয়ং। আর ফ্রান্স নামক রাষ্ট্রটিকেই আমরা যদি অস্বীকার করতে চাই? তাহলে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে আরও বড়, আরও শক্তিশালী কোনো ধারণায়।

এই সম্মিলিত কল্পনা ও বিশ্বাসের হাত থেকে মানুষের মুক্তি নেই। এই বিশ্বাসের খাঁচার গরাদ কেটে যতবারই আমরা ছুটে যাব মুক্তির আশায়, ততবারই আমাদের পথরোধ করবে আরও বড় কোনো খাঁচার অদৃশ্য দেয়াল।

————–

তথ্যসূত্র

1 Angus Maddison, The World Economy, vol. 2 (Paris: Development Centre of the Organization of Economic Co-operation and Development, 2006), 636; ‘Historical Estimates of World Population’, U.S. Census Bureau, accessed 10 December 2010, http://www.census.gov/ipc/www/worldhis.html.

2 Robert B. Mark, The Origins of the Modern World: A Global and Ecological Narrative (Lanham, MD: Rowman & Littlefield Publishers, 2002), 24.

3 Raymond Westbrook, ‘Old Babylonian Period’, in A History of Ancient Near Eastern Law, vol. 1, ed. Raymond Westbrook (Leiden: Brill, 2003), 361–430; Martha T. Roth, Law Collections from Mesopotamia and Asia Minor, 2nd edn (Atlanta: Scholars Press, 1997), 71–142; M. E. J. Richardson, Hammurabi’s Laws: Text, Translation and Glossary (London: T & T Clark International, 2000).

4 Roth, Law Collections from Mesopotamia, 76.

5 Ibid., 121.

6 Ibid., 122–3.

7 Ibid., 133–3.

8 Constance Brittaine Bouchard, Strong of Body, Brave and Noble: Chivalry and Society in Medieval France (New York: Cornell University Press, 1998), 99; Mary Martin McLaughlin, ‘Survivors and Surrogates: Children and Parents from the Ninth to Thirteenth Centuries’, in Medieval Families: Perspectives on Marriage, Household and Children, ed. Carol Neel (Toronto: University of Toronto Press, 2004), 81 n.; Lise E. Hull, Britain’s Medieval Castles (Westport: Praeger, 2006), 144.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *