০৬. ও আমার ছোট্ট পাখি চন্দনা

ও আমার ছোট্ট পাখি চন্দনা

আবাসিক আদর্শ বালিকা বিদ্যায়তনে সপ্তম শ্রেনী থেকে প্রতিটি শ্রেণীতেই বৃত্তি পেয়েছি আমি, সে বৃত্তির একটি টাকাও কোনওদিন নিজের জন্য রাখতে দেননি বাবা, গুনে গুনে তুলে নিয়ে গেছেন। মা বলেছেন, তর বাবা তর ভবিষ্যতের জন্য জমা রাখতাছে টাকা। তুই বড় হইলে দিব। মার কথা বিশ্বাস হত আমার। বাবার হাতে চলে যাওয়া টাকাকে নিজের টাকা ভেবে একধরণের স্বস্তি হত। বড় হয়ে ওই টাকায় ঘর বোঝাই বই কেনার স্বপ্ন দেখতাম। ইয়াসমিন পঞ্চম শ্রেণীতে দুবার থেকে একটি কাণ্ড ঘটিয়েছে, ওকে ইশকুল বোর্ডের বৃত্তি পরীক্ষায় বসিয়েছিলেন বাবা, পরীক্ষায় ভাল করে ও দিব্যি বৃত্তি পেয়ে গেছে। এখন ইয়াসমিনকে ডাকতে হলে বাবা বলেন, কই বৃত্তিধারী ছাত্রী কই! পঞ্চম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষা আমার দেওয়া হয় নি, অষ্টম শ্রেণীরটি দেওয়া হলেও কপালে কিছু জোটেনি। কপালে কিছু জোটেনি বলেই আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ইয়াসমিনকে বৃত্তিধারী ছাত্রী বলে ডাকেন বাবা। কেবল তাই নয়, বাবা আমাকে নর্দমার কীটের সঙ্গে তুলনা করেছেন অনেক। শুনে নিজেকে অনেকবারই সত্যিইনর্দমার কীট বলে মনে হয়েছে। তারকাখচিত প্রথম বিভাগ জোটেনি বলেও আবার নিজেকে নর্দমার কীট বলে মনে হতে থাকে। চন্দনা দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেছে। এ নিয়ে তার কোনও দুশ্চিন্তা নেই। দ্বিতীয় বিভাগেই পাশ করেছে বেশির ভাগ ছাত্র ছাত্রী। দ্বিতীয় বিভাগ যদি আমার জুটত, তবে বাবা চাবকে আমাকে রক্তাক্ত করে বাড়ি থেকে সত্যি সত্যি তাড়িয়ে দিতেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস। সে দুর্ঘটনা ঘটেনি বলে স্বস্তি জোটে, প্রথম বিভাগ পাওয়ার ফলে কলেজে বৃত্তি পাব, বিনে পয়সায় কলেজে পড়ব, বাবা বৃত্তি জিনিসটি খুব পছন্দ করেন, খানিকটা হলেও ভারমুক্ত হই। অন্তত এ ব্যাপারটি না ঘটলে উঠতে বসতে বাবার দাঁত খিঁচোনো দেখতে হত। এখনও যে হয় না তা নয়। আমি নিশ্চিত, বৃত্তি না জুটলে আরও হত।

কলেজে ভর্তি হতে কোনও পরীক্ষার দরকার হয়নি। মেট্রিকের ফল দেখেই ভর্তি করে নিয়েছে কলেজে। খামোকা আমাকে মেট্রিক পরীক্ষার পরও সেই ইশকুলের বইগুলো পড়তে হয়েছে, ভেবে আফসোস হয়। সময়গুলো অযথা উড়ে গেছে, হাওয়ায় উড়েছে। আর কি কখনও ফিরে আসবে অমন অবসর!সময় হয়ত অনেক আসবে, মেট্রিকের পরের সময় আর আসবে না।

আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে ছিল, ও কলেজে আবার ছেলেরাও পড়ে, ছেলেদের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে বসে ক্লাস করতে দিতে আর যিনিই দিন না কেন, বাবা দেবেন না। ঘাড় ধরে, আনন্দমোহনের ভাল কলেজ হিসেবে নাম থাকলেও, মুমিনুন্নিসার কোনও নাম না থাক, যেহেতু এটি মেয়েদের কলেজ, এটিতে আমাকে ঢুকিয়ে, অনেকটা হাঁসের খোঁয়াড়ে যাবার বায়না নাকচ করে দিয়ে মুরগিকে আর দশটা মুরগির সঙ্গে এক খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দেওয়ার মত, স্বস্তি পেলেন তিনি। যতটা অখুশি হওয়ার দরকার ছিল এ কলেজে এসে, ততটা হইনা, এর কারণ চন্দনা। ওর বাবাও ওকে ধরে বেঁধে মুমিনুন্নিসা কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। চন্দনাকে পেয়ে প্রতিদিন একশ ছেলের সঙ্গে দেখা না হওয়ার দুর্ভাগ্যের জন্য কপাল চাপড়ানো তো দূরের কথা, মন কালো করে যে দুদণ্ড একলা বসে থাকব, তা হয়না। আনন্দমোহন আমাদের কাছে আকাশপারের কোনও রহস্যময় সপ্তম স্বর্গ হয়ে রইল, ওটিকে আপাতত মাচায় তুলে রেখে আরও আরও স্বপ্ন তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমি আর চন্দনা। মুমিনুন্নিসা কলেজটি শহরের পশ্চিম কোণে বিশাল এক মাঠের ওপর। ক্লাস হয় একটি লম্বা টিনের ঘরে, গঞ্জের ইশকুলঘরের মত ঘরটি। আরেকদিকে নতুন ওঠা দালানঘর। এই দালানঘরে বিজ্ঞানের ছাত্রীদের বেশির ভাগ ক্লাস হয়। ইশকুলের মত এক ঘরেই সমস্ত ক্লাস নয়। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে দৌড়ে যেতে হয় বিভিন্ন ক্লাসে। এই নিয়মটি আমার পছন্দ হয়। ইশকুলে সেই সকালে একটি ঘরের একটি বেঞ্চে বসা হল তো সারাদিন ওখানেই বসে থাকতে হয়। কলেজের আরও একটি নিয়ম আমার ভাল লাগে। তুমি যদি কোনও ক্লাসে না যাও, মাঠে বসে থাকো বা পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে বান্ধবীর সঙ্গে গপ্প কর, কেউ তোমার চুলের মুঠি ধরে নিয়ে বসিয়ে দেবে না ক্লাসে, এক ক্লাস মেয়ের সামনে কান ধরে এক ঠ্যাংএ দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি তোমাকে পেতে হবে না। ক্লাসে ক্লাসে নাম ডাকা হচ্ছে। ইশকুলের মত এক ক্লাসে নাম ডাকা হল তো সে নিয়ে সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা অবদি থাকা নয়। কলেজের নতুন নিয়মে চমৎকৃত হই, কিন্তু কলেজ থেকে যখন ইচ্ছে তখন বেরোতে পারব না, এ নিয়মটি আমার মোটেও ভাল লাগে না। চন্দনার তো লাগেই না। কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে ও অনেকবার বলেছে, কলেজে পড়ার মজা কি জানস? ইচ্ছা হইলে ক্লাস করবি, ইচ্ছা না হইলে করবি না। যখন ইচ্ছা কলেজ থেইকা বাইর হইয়া পড়া যাইব। ঠিক কলেজ ছুটির টাইমে বাড়িতে আইয়া পড়লেই হইল। এই স্বপ্ন আমাকে বিভোর কম করেনি। কিন্তু কলেজে যেতে শুরু করে ছফুট লম্বা সাপের মত কালো মিশমিশে শরীরের চুলহীন দাঁতহীন গগনকে দেখে আমার পিলে চমকে ওঠে। কি রে বাবা, দারোয়ান কেন? ইশকুলের গেটে দারোয়ান থাকে। ইশকুলের বাচ্চাদের জন্য। কলেজে পড়া বড় মেয়েদের জন্য, যারা নিজের দায়িত্ব নিজেই নিতে পারে, তাদের জন্য পাহারা বসানোর তো কোনও যুক্তি নেই! চন্দনা একমত। সকাল দশটায় কলেজে এসেছি। দুটো ঘন্টা কোনও ক্লাস নেই। চন্দনা বলে চল বাইরে যাই। বাইরে কোথায় তার কোনও সিদ্ধান্ত নিই না। বাইরে। এই সীমানার বাইরে। বাড়ির সীমানার বাইরে যেতে যেমন উতলা হই, এই কলেজ সীমানার বাইরে যেতেও। কিন্তু চল বললেই কি যাওয়া হয়, গেটের দিকে যেতে নিলেই গগন আমাদের খপ করে ধরে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়, দুঘন্টা আমাদের করার কিছু নেই। না থাক। তবু গেটের বাইরে এক পা ও ফেলা যাবে না। যাবে না তো যাবেই না। গগনকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করি, আমরা আর ছোট নেই, বড় হয়েছি. আমরা হারিয়ে যাব না, বা কোনও ছেলেধরা আমাদের বস্তায় পুরে কোথাও নিয়েও যাবে না। গগনে তবু গনগনে আগুন, কোনও মেঘবৃষ্টির ছিটেফোঁটা নেই। গগন আমাদের স্বপ্নের লেজ ধরে ছুঁড়ে দেয় দূরের নর্দমায়। মেয়েদের কলেজের নিয়ম হচ্ছে, একবার ঢুকে গেলে দরজা বন্ধ হয়ে গেল, সেই বিকেলে ছুটির ঘন্টা পড়বে তো বেরোতে পারবে। ইশকুলের দশটা পাঁচটা নিয়মের মধ্যে এত বছর বন্দি থাকার পর কলেজে এসে যদি পাখা না মেলতে পারি, তবে আর কলেজে আসা কেন! আনন্দমোহন কলেজে ছেলেমেয়েরা যখন খুশি ঢোকে, যখন খুশি বেরোয়। আর মুমিনুন্নিসার মেয়েরা, যেহেতু এরা মেয়ে, এরা বড় হয়ে গেলেও এদের বড় বলে জ্ঞান করা হয়না, তাই আবারও দশটা পাঁচটার হিশেব, আবারও ইউনিফমর্, শাদা পাজামা, শাদা জামা, লাল ওড়না। ইশকুল ছেড়ে কলেজে নাম লিখিয়েছি, দালান পালটেছে, মাস্টার পালটেছে, বইপত্র পালটেছে কিন্তু নিয়ম ওই একই আছে। কলেজ চত্বরেই বিমর্ষ ঘোরাঘুরি করে আমাদের সময় পার করতে হয়।

ওড়না বস্তুটি আমার যেমন অপছন্দ, চন্দনারও। ও বস্তুটি ধারণ না করেই আমরা মাঝে মধ্যে উদয় হই কলেজে। কলেজের ছাত্রী শিক্ষকদের ছানাবড়া চোখের সামনে বুঝি যে এমন অবশ্য-জরুরি বস্তুটিকে নির্বাসন দিয়েছি বলে সকলেই মর্মাহত। কারও মর্মের প্রতি উদার হওয়া আমাদের চমের্ তত নেই। কলেজ শুরু হওয়ার পর শিক্ষক শিক্ষিকা সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি তাতে অন্তত এইটুকু বুঝি যে অংকের শিক্ষক দেবনাথ চক্রবর্তীর ক্লাস জগত উল্টো গেলেও ফাঁকি দেওয়া চলবে না। বাকি শিক্ষক শিক্ষিকাদের ক্লাস খুব প্রয়োজন না হলে বাদ। বাংলার শিক্ষক আবদুল হাকিম যিনি মোর বলতে গিয়ে মুর বলেন, একই রকম চোরকে চুর, তোরাকে তুরা, জোড়াকে জুড়া—তাঁর ক্লাসে গিয়ে চিরকুট চালাচালি কর, হাকিমবাবুর ছবি আঁকো, চঞ্চুনাশা, কদমছাঁট চুল, নাকে ঝোলা চশমা; পুস্তকি পদ্যে মন বসানোর কোনও কারণ নেই যেহেতু মন আমাদের অনেক আগেই পদ্যাক্রান্ত। শ্রীমতী সুমিতা নাহাও বাংলা পড়ান, তিনি যখন বাংলা গদ্য পদ্যের বর্ণনা করেন, প্রথম সারির মেয়ে ছাড়া আর কারও সাধ্য নেই তাঁর কণ্ঠস্বর শোনে, কণ্ঠস্বরটিকে মাটির কাছাকাছি রেখে একরকম বাঁচিয়ে চলেন তিনি, যথেষ্ট উঁচুতে উঠলে সে স্বরের ভপূাতিত হওয়ার আশংকা আছে বলেই হয়ত। তিনি নামী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী,তাঁর স্বামী আলোকময় নাহাও শিল্পী। শিল্পী আবার রাজনীতিবিদও। একবার ভোটে দাঁড়ালেন তো পাশ করে গেলেন। ভাল রাজনীতিবিদ তিনি, সে কারণে নয়। ভাল গায়ক তিনি, সে কারণেই। রসায়নবিজ্ঞানের শিক্ষিকা নাক সবসময় কুঁচকে রাখেন, যেন পৃথিবীর প্রতিটি ববস্তু থেকে দগুর্ ন্ধ বেরোচ্ছে। নাকি সুরে রসায়ন পড়ান। কি পড়াচ্ছেন ক্লাসের মেয়েরা কেউ বুঝুক না বুঝুক, তিনি পড়িয়ে যান। ঘন্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কুঞ্চিত নাক নিয়েই বেরিয়ে যান। হঠাৎ একদিন রসায়ন ক্লাসে হাসির দমক থামাতে না পেরে আমি আর চন্দনা শাস্তি হিসেবে ক্লাসঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে আহলাদে বাঁচি না। পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক ঠোঁটে যে বঙ্কিম হাসি ঝুলিয়ে ক্লাসে ঢোকেন, তাতে কোন কোন মেয়ের হৃদয়ে উষ্ণ হাওয়া বয় তা অনুমান করতে চেষ্টা করি আমি আর চন্দনা দুজনই। জীববিজ্ঞান ক্লাসে খানিকটা ঢেউ ওঠে, ব্যাঙ ধরে মোমের ট্রেতে ব্যাঙকে চিৎ করে শুইয়ে বুকপেট কেটে দেখাতে হবে পাকতন।্ত্র মোটা শাদা কাগজে আঁকতে হবে নানারকম জীবজন্তুর ছবি। ছবি মানেই আমার রাজত্ব। সারাদিনই এইচবি, বি, থ্রিবি ইত্যাদি নানা নামের পেনসিল দিয়ে কারুকাজ করে ছবি আঁকি, যেন ছবি আঁকার ইশকুলে ভর্তি হয়েছি। দেখে বাবা বলেন, ফালতু কাম রাইখা বইয়ের পড়া মখু স্ত কর। বাবার কাছে জীববিজ্ঞানের ছবি আঁকাও ফালতু। ব্যাঙ নিয়ে যেতে হবে কলেজে, ব্যাঙএর পেছনে উঠোন জুড়ে দৌড় শুরু হয়। ব্যাঙ দৌড়োয়, পেছনে আমরা দৌড়োই। আমি, ইয়াসমিন, মা। শেষ অবদি ঘরের কোণে ঘাপটি মেরে বসে থাকা একটি সোনাব্যাঙ কাগজের ঠোঙায় ভরে কলেজে নিয়ে ব্যাঙএর হাত পা টেনে পেরেক লাগিয়ে কেটে পাকতন ্ত্র দেখাই বটে, কিন্তু ব্যাঙএর মায়ায় আমি এমনই উদাস বসে থাকি যে চন্দনা এসে গা ধাক্কা দিলে চেতন ফেরে, চেতন ফেরা মানে বেরিয়ে যাওয়া। ক্লাসঘরের দমবন্ধ আবহাওয়ায় যত কম থাকা যায়, তত মঙ্গল। বেরিয়ে যাই জীববিজ্ঞানের ল্যাবরটরি থেকে। আমাদের পাখা মেলতে ইচ্ছে করে। বন্ধন ভাঙার জন্য ভেতরে প্রবল তৃষ্ণার জন্ম হয়। সেই তৃষ্ণা নিয়ে, যেহেতু সীমানা ডিঙোনো চলবে না, মাঠের শেষমাথার শিমুলতলায় বসে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে কবিতা পড়ি দুজন দুজনের। পুরো কলেজের ছাত্রীরা আমাদের পলকহীন চোখে দেখে, আমরা নাকি অন্যরকম, ঠিক স্বাভাবিক নই। চন্দনা কলেজে আসার পথে এক ছেলের প্রেমে তখন পড়ছে পড়ছে, ওর পড়ছে পড়ছের গল্প শুনে আমারও ইচ্ছে হয় এই শাদামাটা জীবনে তরঙ্গ তুলতে। কিন্তু তরঙ্গ তোলার কেউ তো নেই হাতের কাছে। আমার কোনও পড়ছিপড়ছির গল্প নেই। আমার জীবন জুড়ে কেবল ধু ধু করে ভরদুপুরের নিস্তব্ধতা আর তপ্ত বালুময় লু হাওয়া। বড় নিঃস্ব মনে হয় নিজেকে। একদিন ইয়াসমিনকে দিয়ে শাদা শার্টের কাছে লুকিয়ে একটি চিরকুট পাঠিয়ে, সেই শাদা শার্ট ছাদ থেকে যাকে দেখে বুক ঢিপঢিপ করত একসময়, সাড়ে দশটায় কলেজ গেটে থাকতে বলে, পরদিন কলেজে না ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকা শাদা শার্টকে রিক্সায় তুলে নিয়ে সোজা মুক্তাগাছা চলে যাই। রিক্সা করে এত দূরের পথ মুক্তাগাছা যাওয়ার পদ্ধতি ছোটদার কাছ থেকে শেখা। তিনি গীতাকে নিয়ে তাই করতেন। কিন্তু সারা পথ আমি গ্রাম দেখতে দেখতে কৃষকের হালচাষ দেখতে দেখতে রাস্তার কিনারে বসে থাকা শীণর্ গরু দেখতে দেখতে মুক্তাগাছা যাই, গিয়ে বিখ্যাত গোপাল মণ্ডার দোকান থেকে দুটো মণ্ডা কিনে খেয়ে আবার সেই রিক্সা করেই ফিরে আসি কলেজ গেটে। পথে শাদা শার্টের কিছু কিছু অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বা না ছাড়া আমার আর কিছু বলা হয় না। ঘটনাটি ঘটিয়ে আমার পুলক লাগে বটে, সাংঘাতিক একটি কাণ্ড করে চন্দনাকে সেই কাণ্ডের আদ্যেপান্ত বর্ণনা করে সাহসী বনে যাই বটে, কিন্তু শাদা শার্টের জন্য আমি লক্ষ করি, আমার মন কেমন করছে না। ইচ্ছে করছে না আরও একদিন তাকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে হাওয়া খেতে যেতে।

এর মধ্যে একটি দুর্ঘটনা ঘটে। আমাকে বাড়ি এসে পড়িয়ে যাওয়ার জন্য দেবনাথ চক্রবর্তীকে নিয়োগ করেছেন বাবা। দেবনাথ চক্রবর্তীর বাড়িতে ছাত্র ছাত্রীরা দল বেঁধে পড়তে যায় আর আমাকে তাঁর মত পণ্ডিত লোক রাজি হয়েছেন বাড়ি এসে পড়াতে,চাট্টি খানি কথা নয়, সীমা ছাড়ানো সৌভাগ্য! কিন্তু এর একটি বিপদ লক্ষ করি, কলেজের ক্লাসে আমার শ্রীমখু খানা তাঁর দর্শন করা চাই। কেবল দর্শন করা নয়, যত প্রশ্ন তাঁর, সব আমাকেই করা চাই, এবং সঠিক উত্তর আর কারও নয়, আমার কাছ থেকেই তাঁর শোনা চাই। খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার পক্ষে উত্তর দেওয়া সম্ভব হয় না, এবং তিনি প্রতি ক্লাসে আমার মাথায় চড় ঘুসি ডাস্টার সব কিছুরই বষর্ণ ঘটান। বিকেলে যখন তিনি অবকাশে উদয় হন, শরীর আমার অবশ হয়ে আসে। গোলআলুর মত শরীর, পরনে চিরাচরিত নীল শার্ট কালো প্যান্ট, শার্টের পকেটে একটি মোটা কালো কলম, পকেটের নিচে কালির দাগ, পায়ে রাবারের কালো জুতো, সিঁথি করে চুল আঁচড়ানো, মখু ভর্তি পান,হেলে দুলে হাঁটেন, মানুষটি রাস্তায় হেঁটে যাওয়া কলিমুদ্দিন সলিমুদ্দিন যে কেউ হতে পারত, কিন্তু তিনি দেবনাথ চক্রবতীর্, বিশাল মাথা জুড়ে জটিল বিজ্ঞানের জ্ঞান, তাঁর কাছে না পড়ে কোনও ছাত্র ছাত্রীর পক্ষে সম্ভব নয় ভাল ফল করা পরীক্ষায়। দেবনাথ পণ্ডিতের কারণে আমার প্রতিটি বিকেল ধং্ব স হতে থাকে। আমি অংকে ভুল করলাম কি পদার্থবিজ্ঞানের স−ূ ত্র তিনি সঙ্গে সঙ্গে খাতা বই দলামোচা করে ছুঁড়ে ফেলে দেন মেঝেয়। ইয়াসমিন আশে পাশেই থাকে ওগুলো আবার টেবিলে তুলে দেওয়ার জন্য। শক্ত শক্ত কিল ঘুসি থাপ্পড় বিরামহীন চলতে থাকে আমার মাথা লক্ষ করে। বাড়ির মানুষেরা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমার করুণ অবস্থা দর্শন করে। মা দয়াপরবশ হয়ে ইয়াসমিনের হাতে একদিন কাঁঠাল গাছের একটি ডাল ভেঙে পাঠালেন, যেন এটি দিয়ে আমার পিঠে মারা হয়। পিঠে যেন মারা হয়, মাথাটি যেন বাঁচে। মাথায় যেইভাবে উল্ডা পাল্ডা মারে, কবে না জানি মাথাডাই যায়! মা আমার মাথার চিন্তায় চিন্তিত। দেবনাথ পণ্ডিতের রাগ যখন ওঠে, তখন আর ডালের দিকে তাঁর চোখ পড়ে না, ডাল পড়ে থাকে ডালের মত, আগের মত আমার মাথায় কিল ঘুসি মেরেই যেতে থাকেন তিনি, আবারও আগের মত দলামোচা করে ছুঁড়ে ফেলতে থাকেন বইখাতা। আমার বিকেল কেবল নয়, জীবন অতিষ্ঠ করে তোলেন দেবনাথ পণ্ডিত।

 

অতিষ্ঠ জীবনে তারপরও উত্তেজনা কম নয়। বিচিত্রায় ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন নামে একটি বিভাগ শুরু হওয়ার পর আমি আর চন্দনা সিদ্ধান্ত নিই এতে লিখব। একটি শব্দের জন্য আটআনা খর্চা, চারটে শব্দে দুটাকা। দুতিনটাকার বেশি আমার পক্ষে যোগাড় করা সম্ভব নয়, কলেজের রিক্সাভাড়ার পয়সা বাঁচিয়ে কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে পোস্টাপিসে নেমে মানিঅর্ডার ফরমে বিজ্ঞাপন লিখে পাঠাই, চন্দনাও। সিনে পত্রিকায় চলচিত্রের চালচিত্র আর বিচিত্রায় দেশ-কাল-সমাজ নিয়ে থোড় বড়ি খাড়া খাড়া বড়ি থোড়এর বাইরে যা ইচ্ছে তাই লেখার একটি মোক্ষম সুযোগ জোটে আমাদের। আমরা যা ইচ্ছে তাই করার জন্য ছটফট করা দুজন মানুষ। কবি রফিক আজাদ ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, একটি চুমু দিলে একটি কবিতা দেব, দেখে উৎসাহ ক্যাঙারুর মত লাফায়। চন্দনা আর আমি দুজন মিলে লিখি, আমরা এক আত্মা এক প্রাণ। আমি লিখি আমি দুরন্ত দুর্বার, চন্দনা লেখে আই এম দ্যা গ্রেটেস্ট। আবারও চিত্রালীর পাতার মত কাণ্ড ঘটে, আমি একটি লিখি তো আমাকে নিয়ে কুড়িজন লেখে, কেউ পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। মাত্র দুটো তিনটে শব্দ দিয়ে গড়া একটি বাক্য মরা পুকুরে পাথর ছোঁড়ার মত, পুকুর জুড়ে ঢেউ ওঠে। পাড়ে বসে ঢেউ দেখার আনন্দ আমি আর চন্দনা দুজনই উপভোগ করি। আমাদের গণ্ডির জীবন, চারদিকে বেড়াজাল, পায়ে পায়ে নিষেধ, গায়ে গায়ে না, এই না নিষেধ অমান্য করার শক্তি বা সাহস আমরা শব্দ দিয়ে অর্জন করি। আমাদের শব্দগুলো এমন সগবের্ সদম্ভে উচ্চাজ্ঞরত যে পড়লে যে কেউ ভেবে বসে অহংকারি, অবিনীত, উদ্ধতমনা, উন্নাসিক দুটো উগ্র কিশোরী, বাধঁ ন মানে না, নীতিরীতির থোড়াই তোয়াক্কা করে;যদিও বাস্তব সম্পূর্ণই বিপরীত, বাধঁ ন না মানা জীবনটি কেবল আমাদের স্বপ্নের জীবন। অনেকে আবার এও ভাবে, এক মানুষের আড়ালে দুটি নাম, চন্দনা আর তসলিমা ভিন্ন কোনও অস্তিত্ব নয়। রিক্সাভাড়া থেকে শীতের পিপঁ ড়ের মত দুআনা চারআনা সঞ্চয় করে শিশিবোতলকাগজ থেকে আর বাপদাদার পকেট থেকে তাঁদের জ্ঞাতসারে অজ্ঞাতসারেও যে পয়সা কামাই করি, তা ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনের খর- স্রোতে ভেসে যেতে থাকে।

চন্দনা আর আমার কখনও শুদ্ধ বাংলায় কথা হয়নি, সবসময়েই ময়মনসিংহের গ্রামঅঞ্চলের ভাষায়। আমার চেয়ে এ ব্যাপারেও চন্দনা এক কাঠি দু কাঠি নয়, চার কাঠি ওপরে। আমি বলি, গোসলটা কইরা আসি, চন্দনা বলে, গুসুলডা কইরা আহি। চন্দনার ভাষা শুনে আমার হাসি পেত প্রথম প্রথম, কিন্তু অচিরে নিজেই আমি পতিত হই ওই ভাষার জালে। কে কত বেশি আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করতে পারে, তারই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় আমাদের মধ্যে। বরাবরই আমি হেরে যাই ওর কাছে। ইশকুল কলেজে যেতে যেতে ছেলে মেয়েরা আঞ্চলিকতা যতদূর সম্ভব কমাতে চেষ্টা করে। চন্দনা পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি অঞ্চল থেকে এসেছে, বাড়িতে চাকমা ভাষায় কথা বলে, কিন্তু বাড়ি থেকে বেরোলে ওর মত শুদ্ধ বাংলা যেমন লোকে কম জানে, ওর মত আঞ্চলিক সূরে এবং শব্দে কথা বলা জন্ম থেকে এ শহরে বেড়ে ওঠা লোকও জানে কম। চন্দনা আমাকে মুগ্ধ করে তো বটেই, অবাকও করে। চন্দনার সঙ্গে কথা যেমন বলেছি ময়মনসিংহের অজ পাড়া গাঁর ভাষায়, চিঠি লেখাও সে ভাষাতেই হয়েছে। লোকে, এ জানি, মুখে যে রকম ভাষাতেই কথা বলে, চিঠির বেলায় শুদ্ধ ভাষা চাই। চন্দনা এ জিনিসটি মানেনি কোনওদিন। যার সঙ্গে যে ভাষায় ও কথা বলেছে সে ভাষাতেই চিঠি লিখেছে। ময়মনসিংহে আসার আগে ও ছিল কুমিল্লায়, কুমিল্লার বান্ধবীকে চিঠি লিখেছে কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায়, কুমিল্লা আসার আগে ছিল চট্টগ্রামে, ওখানকার বান্ধবীকে চট্টগ্রামের ভাষায়। আর আমার সঙ্গে পরিচয়ের পর সব বান্ধবী বাতিল করে দিয়ে এক আমাকে নিয়েই মেতে থাকল। এদিকে আমার জগতে চন্দনা ছাড়া বাকিরা ধীরে ধীরে ফিকে হতে শুরু করেছে। আমার হাত ছিল না এতে, চন্দনার ব্যক্তিত্ব, অভিনবত্ব, অসাধারণত্ব আমাকে অভিভূত করে রাখে, আচ্ছত করে রাখে সকল সময়। মেট্রিকের পর এবং কলেজ শুরু হওয়ার আগে খুব সঙ্গত কারণেই আমাদের দেখা হওয়ার সুযোগ ছিল কম। ঘরে বসে থাকতে আমাকে যেমন হত, চন্দনাকেও। বান্ধবীর বাড়ি বেড়াতে যেতে পারব যখন তখন, প্রশ্নই ওঠে না। বাইরে বের হওয়া মানে মার সঙ্গে নানিবাড়ি বেড়াতে যাওয়া, পীরবাড়ি যাওয়া তো অনেক আগে বাদই দিয়েছি, মার কাছ থেকে অনুমতি পুরো না নিতে পারলেও অন্তত নিমরাজি করিয়ে ছোটদার সঙ্গে অনুষ্ঠানাদিতে যাওয়া, দাদার সঙ্গে সিনেমায় যাওয়া। সিনেমায় সবসময় দুপুরের শোএ যেতাম, বাবা যেন টের না পান। শো শেষ হত বিকেলে, তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরে আমি দাদা ইয়াসমিন এমন মুখ করে বসে থাকতাম যেন কস্মিন কালেও সিনেমা কাহাকে বলে জানি না। চন্দনাকে নিয়েও কদিন গিয়েছি সিনেমায়, তবে সে দাদারই আয়ত্তাধীন হয়ে। আলমগীর কবীরের সীমানা পেরিয়ে ছবিটি দেখে আসার পর দেখে আসার পর ছবিতে বুলবুল আহমেদের সংলাপ আমাদের মুখে মুখে ফিরত। বোকা সোকা তোতলা লোকের ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে এক নির্জন দ্বীপে বুলবুল বলেছিলেন জয়শ্রীকে, ত তর লা লাইগা আমি কি না করছি, ত তরে আমি বুকে রাখছি, পিঠে রাখছি .. ! বুলবুলের এই সংলাপ আমার আর চন্দনার মুখে মুখে ফিরত। মূলত চন্দনাই শুরু করেছিল, ওর ছোটভাই সাজুর সঙ্গে ওর এক দফা যুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর। সাজুর হাতে কিলচড় খেয়ে ক্ষুব্ধ চন্দনা আমার সঙ্গে দেখা হতেই ঘটনার বর্ণনা করে বলল, ও ওর লাইগা আমি কি না করছি, ও ওরে আমি বুকে রাখছি, পে পেটে রাখছি, মা মাথায় রাখছি, কান্ধে রাখছি। ভাই দুটোর সঙ্গে যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে আহত হওয়ার কোনও কষ্ট চন্দনা পুষে রাখত না, কিন্তু একটি কষ্ট ও জীবনভর পুষে রেখেছে। মলিনা চাকমা যখন জন্ম দিয়েছিলেন কন্যা সন্তান, সুব্রত চাকমা বড় একটি দা নিয়ে নিজের কন্যাকে আঁতুর ঘরে হত্যা করতে এসেছিলেন, কন্যা তাঁর পছন্দ নয় বলে। আঁতুরঘরে আত্মীয়দের হস্তক্ষেপে চন্দনা বেঁচে গেছে ঠিকই, মলিনা চাকমা এরপর দুটো পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়ার পর চন্দনার ওপর ত্রে²াধটিও সুব্রত চাকমার কমেছে, কিন্তু চন্দনা কখনই ওর বাবাকে ক্ষমা করতে পারেনি, এখনও দুঃস্বপ্নের মত দৃশ্যটি দিবসরজনী ওর মনের ভেতর নাছোড়বান্দার মত বসে থাকে।

ছোটদা খবর আনলেন, চিপাচসের অনুষ্ঠান হচ্ছে, ঢাকা থেকে অভিনেতা বুলবুল আহমেদ আসছেন। সেই বুলবুল আহমেদ, ভাল অভিনেতা হিসেবে যাঁর খ্যাতি, অদ্ভুতুড়ে মারদাঙ্গা ছবিতে আর যে অভিনেতাই থাকুন বুলবুল আহমেদ নেই সেই বুলবুল। সূর্যকন্যা ছবির বুলবুল।সীমানা পেরিয়ের বুলবুল। চন্দনার সুযোগ হয়নি অনুষ্ঠানে যাওয়ার, বাড়ি থেকে ওর অনুমতি মেলেনি। ছোটদার সঙ্গেও বাইরে বেরোনো সহজ কথা নয়, ছোটদা বখে যাওয়া ছেলে, তাঁর সঙ্গে ঘুরে আমাকে নষ্ট হতে দিতে বাড়ির কেউ রাজি নন। কিন্তু তারপরও অনুমতি জোটে, চলμচিত্রের অভিনেতা অভিনেষনীর জন্য মার এক ধরনের পক্ষপাত আছে, যতই তিনি ধার্মিক হোন না কেন। চোখের সামনে সিনেমার নায়ককে দেখব, উত্তেজনায় ছটফট করছি। ছোটদা বললেন অটোগ্রাফ খাতা লইতে ভুলিস না। অটোগ্রাফ খাতা বলতে কোনও খাতাই আমার নেই। যাবার পথে একটি লাল নীল সবুজ রঙের কাগজঅলা খাতা কিনে দিলেন ছোটদা। বুলবুল আহমেদ বসেছিলেন বিশাল এক টেবিলের এক কোণে, আর সেই টেবিলের কিনার ঘেঁসে লোক ছিল বসে, দাঁড়িয়ে। সহজ ভঙ্গিতে তিনি কথা বলে যাচ্ছিলেন সবার সঙ্গে যেন এরা তাঁর জন্ম জন্ম চেনা। যাঁর যা প্রশ্ন ছিল, হেসে উত্তর দিচ্ছিলেন। যখন অটোগ্রাফ নেবার সময় হল, বুক কাঁপছিল, কি বলব তাঁকে? আপনার অভিনয় খুব ভাল লাগে। অভিনয় নিশ্চয় খুব ভাল লাগে, তা না হলে এখানে আসা কেন, অটোগ্রাফ নেওয়াই বা কেন! অটোগ্রাফ দেওয়ার সময় নাম যখন জিজ্ঞেস করলেন, আমি মৃদু কণ্ঠে নামটি উচ্চারণ করলাম, তিনি পুরো নাম জানতে চাইলেন!বলার পর প্রাণোচ্ছল হাসিতে আমাকে অভিভূত করে বললেন, তুমি তসলিমা নাসরিন? তুমি আমার অটোগ্রাফ নেবে কি! আমি তো নেব তোমার অটোগ্রাফ। তুমি তো আমার চেয়ে বিখ্যাত হে! আমি মখু লুকোলাম ছোটদার আড়ালে। সিনেমার লোকেরা যে আর সাধারণ মানুষের মতই মানুষ, তারাও যে হাসে কাঁদে গাল দেয় গাল খায়, তারাও যে পেচ্ছাব পায়খানা করে, তাদেরও যে সর্দি হয়, গা ম্যাজম্যাজ করে আগে আমার বিশ্বাস না হলেও বুলবুল আহমেদকে কাছ থেকে দেখার পর হল। রাজ্জাক, কবরী, আজিম, সুজাতা, জাফর, ববিতা, আলমগীর শাবানা সকলে যে আমাদের মত মানুষ, তাতে বিন্দুমাত্র সংশয় রইল না।

চন্দনা পাড়ার এ বাড়ি ও বাড়ির ছেলে ছোকড়াদের ছুঁড়ে দেওয়া চিঠি বা চিরকুটের খুচরো প্রেম ছেড়ে হঠাৎ জাফর ইকবালে নিমজ্জিত হয়। জাফর ইকবাল চলμচিত্র জগতের সবচেয়ে সুদর্শন নায়ক। নায়ক জাফর ইকবাল আর নায়িকা ববিতার প্রণয় নিয়ে নানা কথা লেখা হয় পত্রিকায়। ওসব আমরা মোটেও পরোয়া করি না। সুদর্শন বলে কথা। চারদিকে সুদর্শনের এমন অভাব যে জাফর ছাড়া আমাদের গতি নেই সে আমরা দুজনই বুঝি। একদিন চিপাচসের হয়ে ছোটদা ঢাকায় গিয়ে জাফর ইকবালের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে এলেন, আমি আর চন্দনা দুজনই ছোটদার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ি আদ্যোপান্ত শুনতে। শুনে আগ্রহের আগুনে আরও সেরখানিক ঘি পড়ে। ছোটদার কাছ থেকে জাফর ইকবালের পাঁচ নয়াপল্টনের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে সে ঠিকানায় একটি চিঠি পাঠাই। দুদিন পরই জাফর ইকবালের উত্তর। জাফ লেখা সুন্দর কাগজে ভুল বানানে বন্ধু সম্বোধন করে লেখা ছোট চিঠি। আত্মহারা বিকেল কাটে। পরদিন সকালে চন্দনাকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে অন্য দিনের মত কলেজে যাই বটে, তবে আমাদের পুরো দিন জুড়ে জাফর ছাড়া আর কিছু থাকে না। না পড়া,না লেখা,না অন্য কিছু চিঠির বানান ভুল আপাতত আমরা ক্ষমা করে দিই, সে জাফর ইকবাল বলেই দিই। পত্রমিতা হওয়ার অনুরোধ করে যারাই ভুল বানানে চিঠি পাঠায়, তাদের কিন্তু রীতিমত উপেক্ষা করি। চন্দনাকে জাফরের কাছে লিখতে ইন্ধন যোগাই। কিছুদিন পর ওর কাছেও চিঠি আসে জাফরের। সে চিঠি নিয়ে ও পরদিন কলেজে আমার সঙ্গে দেখা না হওয়ার অপেক্ষা করে প্রায়-উড়ে অবকাশে চলে আসে। জাফরের স্বপ্নে আমাদের দুজনেরই সময় শিমুল তুলোর মত উড়তে থাকে। দাদার সঙ্গে গিয়ে দুজন দুটো ইংরেজি ছবি দেখে আসার পর আমার তেমন প্রতিক্রিয়া না হলেও, চন্দনা উঁচু জুতো কিনে জাফরের ছবি সে জুতোয় সেঁটে ছবির ওপর আই লাভ ইউ লিখে দিব্যি কলেজে আসতে লাগল। কেবল তাই নয়, বিদেশি ফ্যাশন ম্যাগাজিনএর ডিজাইন দেখে একটি লম্বা স্কার্ট বানিয়ে, পরে, মাথায় একটি বড় হ্যাট লাগিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াতে লাগল, লোকে চোখ গোল করে চন্দনাকে দেখে, যেন ও এ শহরের তো নয়ই, এ জগতেরও কেউ নয়। আমিও ঠিক একই রঙের একই রকম কাপড় কিনে চন্দনার স্কার্টের মত একটি স্কার্ট বানাই। ফ্যাশনের কোনও বোধ আমার ভেতর আগে ছিল না, বীজটি চন্দনাই বপন করে। এর মধ্যে আমার প্রাচীনপন্থী বাবা একটি কাণ্ড ঘটান যা আমাদের যগু পৎ বিস্মিত ও মগ্ধু করে। তিনি বাড়িতে একটি টেলিফোন আনেন। টেলিফোনটি তালা দেওয়া সুতরাং বাড়ি থেকে কোথাও কথা বলার সুবিধে নেই। টেলিফোন আনার মূল উদ্দেশ্য বাবা আরোগ্য বিতান থেকে ফোন করে বাড়ির মানুষ সব যে যার জায়গামত আছে কি না, যে যার কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালন করে যাচ্ছে কি না খবর নেবেন। বাড়িতে ফোন আসায় সবচেয়ে খুশি ছোটদা। তিনি তারকাঁটা বাঁকিয়ে ফোনের তালা খুলে ঢাকায় গীতার কাছে প্রতিরাতে ফোন করা শুরু করেছেন। আঁচ পেয়ে বাবা তালাবন্ধ টেলিফোন তাঁর ঘরের সেত্রে²টারিয়েট টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে ড্রয়ারে তালা দিলেন। এই সমস্যাটির সমাধান আর কারও মাথায় না খেলুক ছোটদার মাথায় খেলে। তিনি দিব্যি টেবিলের ঢাকনা সরিয়ে ড্রয়ার থেকে ফোন বের করে আগের মতই বাঁকা তারকাঁটায় ফোনের তালা খুলে কথা বলতে লাগলেন। এদিকে বাড়িতে টেলিফোন আসার আনন্দে আমি দিকে দিকে বিলি করে যাচ্ছি নম্বর। তারপর সেই সন্ধেটি আসে, যে সন্ধেয় স্বয়ং জাফর ইকবাল ফোন করেন আমাকে। ছোটদা ফোন ধরে আমাকে দিলেন। এর আগে টেলিফোনে আমি কারও সঙ্গে কথা বলিনি। হ্যালো বলার পর আমার আর স্বর ফোটে না। এক ঠাণ্ডা নিস্তব্ধতায় আমি ডুবে যেতে থাকি। মরিয়া হয়ে শব্দ খুঁজি। অন্তত একটি বা দুটি শব্দ। যত খুঁজি, ততই যেন শব্দ সব আমার ত্রিসীমানা থেকে পালায়। ওদিক থেকে জাফর একা কথা বলতে বলতে এপাশে কোনও প্রাণী নেই ভেবে ফোন রেখে দেয়। আবারও ফোন বাজে, আমি দৌড়ে অন্য ঘরে চলে যাই বলতে বলতে জাফর ইকবাল ফোন করলে আমারে দিও না। পরদিন রাতেও ওই হয়। ফোন বেজে চলে। ছোটদা ধরেন, আমাকে জানান জাফর ইকবাল আবার ফোন করেছিল। কিন্তু আমার কি করার আছে! চিঠিতে আমি তুমি লিখি জাফর ইকবালকে, তার কণ্ঠস্বরের সামনে পেটে বোমা মারলেও আমার মখু থেকে তুমি বেরোবে না। শেষে হ্যালো বলা, তুমি বলা, কেমন আছো ভাল আছি ইত্যাদি কথা ঘন্টাখানিক চর্চা করার পর যখন ফোন এলে ধরব বলে প্রস্তুতি নিই, ফোন বাজে, ধরে শুনি বাবার কণ্ঠ, ফোন কি কইরা ধরলি!ফোন ত তালা দেওয়া ড্রয়ারে। দেবনাথ পণ্ডিত যেমন চোখ্যে ভাসাইতে বলেন কোনও জটিল অংকের সমাধান, এই ফোন ধরার পরিণাম কি হতে পারে তা চোখ্যে ভাসিয়ে আমি ভাষা হারিয়ে ফেলি আমার মাতৃভাষা বাংলা। এর পরের ফোনটি সাহস করে ছোটদা ধরেন, ওটি জাফর ইকবালের। আমাকে রিসিভার দিয়ে চাপা স্বরে বলেন, ক হ্যালো, হ্যালো ক। আমার হ্যালো বলা হয়, কেমন আছর উত্তরে ভাল আছি বলা হয়, চিঠি পেয়েছোর উত্তর পেয়েছি বলা হয় কিন্তু আমার দিক থেকে কোনও প্রশ্ন করা হয় না যেহেতু প্রশ্ন করতে গেলেই তুমি সম্বোধনটির প্রয়োজন হয়। কি পড় তুমি? প্রশ্নটি শোনার পর আমাকে যেন জাফর ইকবাল নিতান্তই বেণী দোলানো কিশোরী না ভাবে, বলি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বলি ঠিক এ জগতে দাঁড়িয়ে নয়, টেবিলের ঢাকনা সরিয়ে চুরি করে তারকাঁটা দিয়ে তালা খোলা টেলিফোন সেটের পাশে দাঁড়িয়ে নয়, বাইরের ল্যাম্পপোস্ট থেকে জানালার লাল নীল কাচ বেয়ে যে আলো এসে পড়ে আমার গায়ে সেটিকে চাঁদের মনোরম আলো বলে ভুল করতে করতে, জাফর ইকবালের সঙ্গে নির্জন সমুদ্রতীরে হাত ধরে মনে মনে হাঁটতে হাঁটতে।

এর পরেই আমাকে অবাক করে জাফর ইকবাল বলে, না। তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড় না। আমি জানি।

ধরায় ফিরে এসে জিজ্ঞেস করি, কি করে?

কি করে তা না বলে ভারি গলায় বলে, বন্ধুর সঙ্গে মিথ্যে কথা বলতে হয় না।

আমাকে গ্রাস করে রাখে মিথ্যে বলার লজ্জা। ফোন রেখে বিছানায় লেপের তলায় মুখ লুকোই গিয়ে। এরপর চন্দনার সঙ্গে দেখা হতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে মর্মান্তিক ঘটনাটি বলি, সব্বনাশ করছি, বয়সে বড় হইতে গিয়া একটা মিছা কথা কইয়া ফেলছি। জাফর ইকবাল জানে যে চন্দনা আমার বান্ধবী। একজন মিথ্যুক হলে আরেকজনও হতে পারে! চন্দনা অনেকক্ষণ দুঃখগ্রস্ত বসে থেকে হঠাৎ দুঃখ ঝেড়ে বলে ঠিকই তো কইছস তুই, আমরা কি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি না? পড়িই তো। মনে মনে পড়ি। বাবা পরদিনই ড্রয়ার খুলে টেলিফোনটি বগলতলায় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি একরকম। ফোনের ছেঁড়া তার অনেকদিন ঝুলে থাকে। ছোটদা কোত্থেকে যেন একটি পুরোনো টেলিফোন এনে ঝুলে থাকা তারে জোড়া দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন শব্দ টব্দ নেই কোনও। এদিকে লজ্জায় জাফরের চিঠির আর কোনও উত্তর দিই না আমি। চন্দনা চিঠি পেতে থাকে জাফরের। সেসব চিঠিতে বন্ধুত্ব পেরিয়ে প্রেম উঁকি দিচ্ছে দিচ্ছে। চন্দনার চিঠিতেও। আমি দুপক্ষের চিঠিরই শ্রোতা। শ্রোতা হওয়াই আমাকে মানায়। এ ছাড়া আমি টের পাই আমার সাধ্য নেই অন্য কোনও ভূমিকা গ্রহণ করার।

ছোটদা চিপাচসের অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করেন আবার। ঢাকা থেকে আসবেন শাহনাজ রহমুতল্লাহ, বিখ্যাত গায়িকা, আর তাঁরই ভাই আমাদের সবেধন প্রেমিকপ্রবর জাফর ইকবাল। অনুষ্ঠান হবে টাউন হলে,শনিবার সন্ধেবেলা। চন্দনা আর আমি কলেজের শিমুল তলায় দোদুলদোলায় দুলি, যাবো কি যাবো না জাফর ইকবালকে দেখতে। শনিবার সারাদিন দুলি, সন্ধের অনুষ্ঠানে যাওয়া হয় না আমার, ওই মিথ্যেটির কারণেই আমি গুটিয়ে থাকি, চন্দনা যাবে বলেও শেষ অবদি যায় না। অনুষ্ঠান শেষে জাফর ইকবালের আকুল আবদারে ছোটদা তাকে চন্দনার সবুজ টিনের বাড়িতে নিয়ে যান। ওখানে চা বিস্কুট খেতে খেতে চন্দনার সঙ্গে কথা বলে জাফর। চন্দনা ওই মাথা নুয়ে যতক্ষণ জাফর ছিল, ছিল। কিছু হ্যাঁ, না, কিছু অপ্রতিভ হাসিই ছিল ওর সম্বল। ঢাকা ফিরে জাফর কোনওদিন আর ওকে চিঠি লিখবে না এ ব্যাপারে ও একশ ভাগ নিশ্চিত ছিল, কিন্তু জাফরের পরের চিঠিতে থৈ থৈ করে প্রেম। এই থৈ থৈ প্রেম শেষে বিয়ের প্রস্তাবে গড়ায়। চন্দনা প্রেম করতে পারে, কিন্তু বিয়ে নৈব নৈব চ। অন্ধকার উতল সমুদ্র পাড় থেকে দেখতে ভাল লাগে, কিন্তু ঝাপঁ দেবার মত দুঃসাহস চন্দনার নেই।

 

চন্দনা এর মধ্যে নাকচ করে দিয়েছে বেশ কটি প্রেমের আবেদন। পাশের বাড়ির ম্যাজিস্ট্রেট আখতার হোসেনকে বুড়ো ধামড়া বলে গাল দিয়ে, গান গায় ছেলে অন্টুকে একদিন খালি গায়ে ছাদে হাঁটতে দেখে ওয়াক থু বলে, আর সন্দিপন চাকমা নামের যে ছেলেটি পেয়িং গেস্ট ছিল ওদের বাড়িতে ক’মাস, ওকে খেতে দেখে। ছেলেদের খালি গা দেখলে বা খাবার চিবোনো দেখলে চন্দনার বিচ্ছিজ্ঞর লাগে, রোমান্স বাপ বাপ করে পালায়। চন্দনা মাঝে মাঝে বলেওছে তুই কি জানিস মানুষকে সবসময় বিশ্রি দেখায় কখন? কখন? তারা যখন খায়। মুখ নামের একখানা ছিদ্র আছে শরীরে, মানুষ ওতে নানা কিছু ঢুকিয়ে কী অশ্লীল ভাবে দুদাঁতের পাটি ঘষতে থাকে…. ছি!! আমি যার সঙ্গে প্রেম করব, আমার সামনে সে যেন না খায়, যেন গায়ের জামা না খোলে, যেন পেশাব পায়খানায় না যায়। ব্যস সোজা হিশেব। ছুটিতে একবার রাঙামাটি বেড়াতে গেল চন্দনা। চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় তখন তার বিয়ের জন্য পাষনী খুঁজছে। এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে চন্দনাকে দেখার পর হাঁ হয়ে গেল, এমন যোগ্য পাষনী আর সে কোথায় পাবে! এরকম সুন্দরী বুদ্ধিমতী রাঙামাটিতে আর আছে কে!চন্দনাকে তার চাই। চাই তো চাইই। চন্দনার এক খুড়তুতো দাদার সঙ্গে দেবাশীষ রায়ের বন্ধুত্ব ছিল, সেই দাদাকে ধরে চন্দনার সঙ্গে দেখা হওয়া, কথা হওয়ার সুযোগ চাইল দেবাশীষ। সুব্রত চাকমার আনন্দ আর ধরে না, মেয়ে তাঁর রাণী হতে যাচ্ছে। খুড়তুতো দাদার অনুরোধে চন্দনা গেল দেবাশীষের সঙ্গে ঝিলের পাড়ে বেড়াতে। য়চ্ছ জলে শাদা মসৃণ গ্রীবা উঁচু করে ঝাঁক ঝাঁক রাজহাঁস সাঁতার কাটছে, পাশে ঘাসে বসে দেবাশীষ প্রেমিকের মত তার চটচটে ঘামে ভেজা হাতটি চন্দনার দিকে বাড়িয়ে গলা গম্ভীর করে প্রেমের কথা যখনই বলতে শুরু করেছে, চন্দনা ফক করে হেসে ফেলল। বাড়ি ফিরে ও উৎসাহী দাদাকে বলে দিল, রাজা হোক আর যেই হোক দেবাশীষ প্রেম করতেই জানে না, তার সঙ্গে হবে না। সুব্রত চাকমা প্রথম নরম স্বরে, তারপর কড়া স্বরে দেবাশীষের বিয়ের প্রস্তাবে চন্দনাকে রাজি হওয়ার জন্য বলেন, ও রাজি হয়নি। চড় থাপড় লাগিয়েও কাজ হয়নি। বিয়েতে চন্দনার ভীষণ আপত্তি, ওর পক্ষে এ কল্পনা করা অসম্ভব যে একটি লোক খালি গায়ে ওর বিছানায় এসে শোবে, তারপর কী কী সব করবে, কী কী সব করায় আর যে মেয়েই রাজি হোক, চন্দনা রাজি নয়। দিব্যি রাজার প্রস্তাবে গুল্লি মেরে ছুটি শেষে চলে এল ময়মনসিংহে। ওর এমনিতেও ভাল লাগে না নাক বোঁচা কোনও চাকমা লোক, সে যত বড় রাজাই হোক। চন্দনার এরকম পটাপট প্রেমে পড়া আর হুটহাট ফিরিয়ে দেওয়া সবকিছুই আমাকে মগ্ধু করে। আমার কাউকে ফিরিয়ে দেওয়ার নেই, কারও সঙ্গে প্রেমও হয় না আমার।

ছোটদার মিনতিতে তাঁর বাচপুান কা দোস্তকে চিঠি লেখে চন্দনা। ধীরে ধীরে হাসান মনসুর খোকন চন্দনার এক নম্বর পত্রমিতা হিসেবে যোগ্যতা অর্জন করে। খোকন নামের মধ্যে খোকন খোকন করে মায় খোকন গেল কাদের নায় গন্ধ আছে বলে চন্দনা খোকন নাম বাতিল করে সম্বোধনের জন্য হাসান বেছে নিল।না সজনী না জানি জানি সে আসিবে না গানটি শুনতে শুনতে সজনী নামটি সবে নিজের নামের লেজে জুড়েছে ও।চন্দনা নামটি ওর ভাল লাগে না, চাকমা নামটি তো নয়ই। কিন্তু এ দুটোকে ফেলতে পারে না নিজের নাম বলে। ভূতনি যার নাম, তাকে তার ভূতনি নামটিই রাখতে হয় নিজের নাম বলে। হাসানের চমৎকার চমৎকার চিঠি পড়ে চন্দনা সজনী হাসান নামটি কাগজে লিখে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে মন্দ লাগে না দেখতে। জাফর ইকবাল সুদর্শন বটে, কিন্তু তার চিঠির বানান ভুল ভাষার ভুল একদিন দুদিন ক্ষমা করে দেওয়া যায়, প্রতিদিন যায় না। চন্দনা হাসানে মগ্ন হয়। হাসান যেমন কাব্য করে অরণ্য আর সমুদ্রের কথা, কোনও এক অচেনা দ্বীপে কোনও একদিন হারিয়ে যাওয়ার কথা লেখে, চন্দনাও রঙিন আকাশে পালকের মত উদাসীন ভেসে ভেসে লেখে ওর সুচারু সুন্দর স্বপ্নের কথা। চন্দনা হাসানকে কি লিখছে, হাসানই বা চন্দনাকে কি, সব আমাকে পড়ে শোনায়। চন্দনা আর আমার মধ্যে এক বিন্দু গোপন কিছু নেই। চন্দনা, আমার বিশ্বাস হয় না, যাকে ও লেখে, তাকে কখনও বাস্তবে দেখতে চায়। ওর শব্দ নিয়ে স্বপ্ন নিয়ে খেলতে ভাল লাগে, ও খেলে। হাসানের বাঁকা হাসিটি দেখলে বুকের ভেতর কেমন জানি করত, চন্দনাকে সে কথা বলি। বলি যে হাসান দেখতে সুন্দর, বলি যে সেই শৈশবেই আমার মনে হত জগতে বুঝি হাসানের চেয়ে সুদর্শন আর কেউ নেই। চন্দনা আমার কথা মন দিয়ে শোনে,শুনতে শুনতে দূর এক অরণ্যে ও হাসানের হাত ধরে হাঁটে, মনে মনে। সেই হাসান চন্দনার চিঠি পড়েই প্রেমে অর্ধউন্মাদ হয়ে একদিন ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ চলে এল চন্দনাকে দেখবে বলে। কিন্তু দেখা হবে কি করে, হাসান দেখা করতে এসেছে শুনেই তো ও শামুকের মত গুটিয়ে গেল। মেঘলা আকাশ থেকে একটি রঙিন নরম পালক একটি বোধহীন পাথরের সঙ্গে শুকনো মাটিতে এসে সশব্দে পড়ে চন্দনার নিমগ্নতা নষ্ট করে। এই রুখো বাস্তবতা চন্দনাকে বিবণর্ করে তোলে। ছোটদার পীড়াপীড়িতে আমি নিরাসক্ত নিস্তেজ বিবর্ণকে যে করেই হোক হাসানের সঙ্গে অন্তত একটিবার দেখা করতে বলি। রাজি হলে ছোটদা আমাদের দুজনকে নিয়ে ময়মনসিংহ প্রদর্শনীতে যান, সঙ্গে গীতা, বার্মা কোরিয়া থেকে ফিরে ময়মনসিংহে থিতু হয়ে বসা গীতা। প্রদর্শনীতে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য হাসানের সঙ্গে চন্দনার অনানুষ্ঠানিক দেখা হওয়া। হাসান আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল প্রদর্শনীতে। প্রদর্শনী মানে যাত্রা সার্কাস, জলহীন কুয়োর ভেতর মোটর সাইকেলের চক্কর, দোকানপাট, ঝলমল আলো, হাউজি নামের জুয়ো। মাঠে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে গীতার হঠাৎ হাউজি খেলার শখ হয়। গীতার শখ মেটাতে ছোটদা পাঁচ পায়ে খাড়া। তিনি দল নিয়ে হাউজিতে ঢোকেন। ওখানে আর কোনও মেয়ে নেই, আমরাই কেবল। হাউজিতে পঁচাত্তর টাকা জিতে গীতা হৈ হৈ রৈ রৈ করে খুশিতে নেচে ওঠে। রেস্তোরাঁয় পরোটা মাংস খেয়ে পঁচাত্তর টাকার অনেকটাই নাশ করা হয়। চন্দনাকে দেখার পর হাসান আর চোখ ফেরাতে পারেনি চন্দনা থেকে। চন্দনা কিন্তু আড়চোখে একবার হাসানকে দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। হাসানের দএু কটি প্রশ্নের উত্তরে কেবল হ্যাঁ বা না বলেছে। ভাল আছ? হ্যাঁ। শরীর ভাল? হ্যাঁ। মন ভাল? হ্যাঁ। পড়াশোনা ভাল হচ্ছে? না। কিছু কিনবে? না। সাভার গেছ কোনওদিন? না। চন্দনার লাজুক লাজুক হাসি দেখে সবাই অনুমান করে যে হাসানকে চন্দনার খুব পছন্দ হয়েছে। প্রেমে হাবুডুবু খেলে এমন লাজুকই তো দেখতে লাগে মেয়েদের। চন্দনা সারাক্ষণই আমার হাত ধরে ছিল, হাতে বার বার চাপ অনুভব করছিলাম ওর হাতের। চাপের অনুবাদ করছিলাম, দেখ দেখ হাসানের চোখ দুইটা কি সুন্দর! হাসিটা দেখ, এমন সুন্দর হাসি কি কেউ হাসতে পারে! পকেটে হাত রেখে হাঁটছে, কী চমৎকার হাঁটার ভঙ্গি!আহ, মরে যাই! সে রাতে ধুলোয় ভিড়ে চন্দনার উচ্ছঅ!স দেখার সুযোগ হয়নি। পরদিন ঝাঁপিয়ে পড়ি ওর থরথর আবেগের শব্দাবলী শুনতে।

তরে ত আগেই কইছিলাম হাসান খুব সুন্দর,দেখলি তো!

চন্দনা সশব্দে হেসে ওঠে।

ক। তাড়াতাড়ি ক।

কি কইতাম?

হাসানরে কিরম লাগল, ক।

ধুর বেডা পচা! বেডার ভুড়ি আছে।

হাসান বাদ। আমি নিজেও আবার হাসানকে লক্ষ করে দেখি, বেডার ঠিকই ভুড়ি আছে। চন্দনা আমার চোখ খুলে দেয়, মন খুলে দেয়। আমি স্পষ্ট বুঝি, আমার আর চন্দনার সবাইকে ভাল লাগে, আবার কাউকেই লাগে না। আমরা প্রেমে পড়তে চাই, আবার চাইও না। প্রেম জিনিসটি ঠিক কি, সে সম্পর্কে আমরা জানি,পড়েছি, দেখেছি, কিন্তু নিজের জীবনে এ জিনিসটির উপস্থিতি আমাদের সয়, আবার সয়ও না। ভাল লাগা আর না লাগায় আমরা দুলি। আমি আর চন্দনা।

ক্লাস ফাঁকি দিয়েও গগন দারোয়ানকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয়নি বলে কলেজ মাঠের শেষ কোণে কাঁটা ঝোপঁ আবিষ্কার করে তার তল দিয়ে গা কাঁটায় ছিঁড়ে হলেও আমি আর চন্দনা একদিন বেরিয়ে পড়ি রাস্তায়। বেরিয়েছি, এবার যাব কোথায়? আগুনে রোদ্দুর হাতে নিয়ে থমকে আছে নির্জন দুপুর। চন্দনা পার্কে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। পার্কের কথায় বুক ঢিপঢিপ করে। আবার যদি পাল পাল ছেলের পাল্লায় পড়ি! হাত ধরে আমাকে সামনে টানে চন্দনা, ওর স্পর্শই যথেষ্ট আমাকে আরও চঞ্চল, চপল, আরও চলমান করার। চন্দনার সাহসের ডানায় বসে আপাতত ছেলের পালের কথা ভুলে সেই লেডিস পার্কে যাই। অশ্বত্থ গাছের তলে দুজন বসি পা ছড়িয়ে, ব্রহ্মপুত্র তার জল থেকে শীতল স্নিগ্ধতা তুলে আমাদের স্নান করাতে থাকে। একটি ডিঙি নৌকো ডেকে নৌকোওলাকে গলুইয়ে বেকার বসিয়ে রেখে চন্দনা নিজে বৈঠা বাইতে থাকে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে, জলের সঙ্গে বৈঠার এই শব্দ যেন আদৌ কোনও শব্দ নয়, যেন এক ধ্রুপদী সঙ্গীত। আমি জলে পা ডুবিয়ে আকাশ জুড়ে মেঘ ও রোদের খেলা দেখতে থাকি, দেখতে দেখতে আর ওভাবে ভাসতে ভাসতে বিকেল হয়ে আসে। বিকেলের সপ্তবণর্ রং দেখি কেবল আকাশে নয়, আমাদের সর্বাঙ্গে। আমারও চন্দনার মত নৌকো বাইতে ইচ্ছে হয়, ইচ্ছে হয় জলে ভেসে বেড়াই, সঙ্গীতের তালে নৌকো দুলুক সারাজীবন, কোথাও না পৌঁছুক, কোনও পারে, এভাবেই ভেসে যাক জীবন। ইচ্ছে হয় আলটপকা দুটো পাখাও গজিয়ে যাক আমার, পাখির মত উড়ে বেড়াই আকাশ জুড়ে, ওই রংগুলোর খুব কাছে চলে যাই, একটু একটু করে মিশে যাই ওই রঙে। চন্দনা, তোর কি কখনও পাখি হতে ইচ্ছা করে রে? ইচ্ছে করে চন্দনাকে প্রশ্নটি করি। ওরও নিশ্চয় পাখি হতে ইচ্ছে করে, ওর ইচ্ছেগুলো আমার ইচ্ছের মত। তবু মনে হয়, চন্দনা যা চায় তার অনেকটাই ও করে ফেলে, অবাক করে দেয় সব্বাইকে। ও হয়ত সত্যিই একদিন আকাশে উড়ে উড়ে সূর্যাস্তের রঙের অনেক কাছে চলে যেতে পারবে। ব্রহ্মপুত্রের জল ছেড়ে আমাদের উঠে আসতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু উঠে আসতেই হয়। তার চেয়ে আমাদের যদি কোথাও দ্বীপান্তর হত, আমি আর চন্দনা দুজনই ভাবি, বুঝি সুখের সমুদ্রে সত্যিকার অবগাহন হত।

 

কলেজ প্রাঙ্গণে আমাদের অন্যরকম জগত নিয়ে আমরা একা হতে থাকি, আমি আর চন্দনা। কখনও কখনও মেয়েদের আড্ডায় যে নাক গলাতে চাই না, তা নয়। একবার ক্লাস নেই,একদঙ্গল মেয়ের আড্ডায় বসে শুনি কোন মেয়ের কবে বিয়ে হচ্ছে, কবে কাকে দেখতে আসছে কোন ছেলে, ছেলের নাম ধাম, ছেলে কোথায় থাকে, কি করে ইত্যাদি কথা। চন্দনা আর আমার দুজনের ঠোঁটের কোণে ঝিলিক দেয় ফুলকি ফুলকি হাসি। হাসিটি কোনও মেয়েরই পছন্দ হয় না। হাসছি কেন এই প্রশ্নের উত্তর ওদের একজন জানতে চায়।

হাসছি এই বিচ্ছিজ্ঞর জিনিসটি নিয়ে তোমরা কথা বলছ বলে।

বিচ্ছিজ্ঞর জিনিস? মেয়েদের কারও চোখ কপালে, কারও নাকে, কারও চোখ বেরিয়ে এসেছে চোখের কোটর থেকে। যেন আমি আর চন্দনা মোটেই মানুষ নামের পদার্থ নই, অন্য গ্রহ থেকে অন্য কোনও কিম্ভূত জীব এসেছি।

একজন বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, বিচ্ছিজ্ঞর কেন হবে?

বিচ্ছিজ্ঞরই তো। চন্দনা বলে।

ভাবটা এমন যেন তোমাদের কোনওদিন বিয়ে হইব না।

হইবই ত না। বিয়ে করলে তো হইব বিয়ে! করতাছে টা কে! আমি বলি।

চন্দনা বলে, ফুঁ:, পাগল হইছি নাকি যে বিয়ে করতাম!পাগল আর বোকা ছাড়া কেউ বিয়ে করে না।

কোনওদিন বিয়ে করব না—আমাদের এ ঘোষণাটি শুনে মেয়েরা জানতে চেয়েছে, বিয়ে না করার পেছনে আমাদের যুক্তিটি কি।

বিয়ে করার কি কোনও যুক্তি আছে, যদি থাকেই, যুক্তিটা কি?

সংসার হবে। সংসারের তো দরকার আছে।

সংসারের দরকার কি? সংসার না হইলে কি মানুষ বাঁচে না?

বাচ্চাকাচ্চা হবে।

বাচ্চাকাচ্চা না হইলে কি হয়!

খাওয়াবে কে? পয়সা দেবে কে?

লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করব। টাকা পাব। একলা থাকব। খাব দাব। ঘুইরা বেড়াবো। আনন্দ করব। যা মন চায় তা করব।

তাই কি হয় নাকি!

হবে না কেন! নিশ্চয় হবে, ইচ্ছে থাকলে সবই হয়।

আমরা সরে আসি, একসঙ্গে অনেকগুলো চোখ আমাদের দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে, টের পাই। চন্দনা আমার হাতটি হাতের মুঠোয় নিয়ে শিমুল তলার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলে, পিছনে তাকাইস না। আমরা এভাবেই হাঁটি দুজন, হাত ধরে, কোমর জড়িয়ে ধরে, কাঁধে হাত রেখে পরস্পরের, পেছনে না তাকিয়ে। কলেজে এ কোনও নতুন দৃশ্য নয়, বান্ধবীরা এভাবেই কথা বলে অবসর কাটায়। কিন্তু চন্দনা আর আমার গ্রীবায় অদৃশ্য এক অহঙ্কার, মেয়েরা বলে, বসে থাকে।

চন্দনা আর আমার কাছে প্রেমের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে কবিতা। প্রতিদিন কবিতা লিখতে থাকি, প্রতিদিন গল্প। যা কিছুই লিখি না কেন, চন্দনার লেখার কাছে আমার সব লেখাই মলিন ঠেকে, ও যদি একটি কৃষ্ণচূড়া তৈরি করে তো আমি নিতান্তই একটি হেলে পড়া পত্রপুষ্পহীন চারাগাছ। এত মগ্ধু আমি ওর সৌন্দর্যে, ওর রঙে, রসে, ওর অসম্ভব বৈচিত্রে যে এতটুকু যদি ঈর্ষার লেশ জন্মে কখনও মনে, নিমেষে হাওয়া হয়ে যায়। আমার আর চন্দনার চিপাচসের সদস্য হওয়া হয় না, কোনও সভা সমিতিতে যাওয়া হয় না, আমরা ও কাজের জন্য নই, আমাদের জগত আলাদা। নিরবধি নিরুদ্বেগে নিরিবিলি শব্দের নিরঞ্জন খেলায় মাতি, শব্দ নিয়ে মিছিলে নামি না, রাজনীতিও করতে জানি না। ওই ধুমসে কবিতা লেখার সময়ই একদিন শফিকুল ইসলাম নামের এক মোটা কাচের চশমা পরা, শরীরের চেয়ে মাথাটি বড়, তারের মত শক্ত চুল মাথা ভরা, দেখলে মনে হয় দঞ্চু বছর গোসল করেনি, জামাও পাল্টায়নি, অনর্গল আঞ্চলিক সুরে এবং স্বরে কথা বলা বাচালকে বাড়ি নিয়ে এলেন ছোটদা, আমাকে দেখেই বলে সে, কি ব্যাপার তুমি তো বিখ্যাত হইয়া গেছ! আমি একটা লিটল ম্যাগাজিন বাইর করি। একটা কবিতা লিইখা দেও তো। শফিকুল ইসলামের অনুরোধে এক বিকেলে বসে নতুন একটি কবিতা লিখে ফেলি, নাম মুক্ত বিহঙ্গ। অনেকটা এরকম, জানালাটি খুলে দাও, আমি যাব, আকাশ জুড়ে উড়ব আমি। সম্ভবত মার হঠাৎ হঠাৎ বাড়ির বারান্দায় বসে গেয়ে ওঠা আমি মুক্ত বলাকা, মেলে দিই পাখা ওই দূর নীল আকাশে গানটি শুনতে শুনতে এই হয়। দুসপ্তাহ পর শফিকুলের কবিতা পত্রিকা বেরোল, আমার কবিতা ওতে। পদ্মরাগ মণিও কবিতা লিখেছে। পদ্মরাগ মণি মাঝে মধ্যে ছোটদা আর গীতার সঙ্গে দেখা করতে অবকাশে আসে। চোখকাড়া সুন্দরীটির সঙ্গে আমার দূর থেকে কিছুটা চোখাচোখি, মিটিমিটি হাসাহাসি, দুচারটে কথা ছোঁড়াছুঁড়ি হয়েছে। শফিকুলের কবিতা পত্রিকাটি হাতে আসার পর আরও আরও কবিতা-পত্রিকা আমার কাছে উড়ে, দৌড়ে, হামাগুড়ি দিয়ে আসতে থাকে। শহরের কবিদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে নানা রকম ছোট পত্রিকা নিয়ে বাড়ি ফেরেন ছোটদা। প্রায়ই আমাকে তাগাদা দেন, দে তো লেইখা বাংলার দর্পনের জন্য একটা কবিতা। লিখে দিই, ছাপা হয়ে যায়। চন্দু মাস্তানরে ক একটা কবিতা দিতে। চন্দনাও লেখা দিতে থাকে ছোটদার হাতে, ছাপা হতে থাকে। সেই যে এক ভোরবেলা চন্দনা সাইকেল নিয়ে চলে এসেছিল অবকাশে, সেই থেকে ছোটদা ওকে চন্দু মাস্তান ডাকে, চন্দনা অখুশি হয় না। দৈনিক জাহান থেকেও ছোটদার কাছে বলা হয় আমি যেন কবিতা পাঠাই, চন্দনাও। কবিতার পার্থিব জগতে সেই আমার হাঁটি হাঁটি পা পা প্রবেশ। চন্দনারও। আমাদের কবিতার খাতা উপচে পড়তে থাকে শব্দে। ফিকে হয়ে যায় চিত্রালী পূর্বাণী। ওসবে লেখা তো হয়ই না, ওসব কেনাও হয় না। বিচিত্রায় ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন দেওয়ার কথা ভুলেও মনে পড়ে না। বিজ্ঞাপনের প্রসঙ্গ উঠলে চন্দনা বলে, বিজ্ঞাপনে বিপদ আছে। চব্বিশ বছর বয়স্কা বীরাঙ্গনা ছাপার ভুলে হয়ে যেতে পারে বিয়াল্লিশ বছর বয়স্কা বারাঙ্গনা। সুতরাং বিজ্ঞাপন বাদ। পাঠাতেই যদি হয় কিছু কবিতা পাঠাবো, পাঠাবো রোববার অথবা সন্ধানীর সাহিত্যপাতায়।

 

কলেজে বছর শেষে প্রথম বর্ষ শেষ করে দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার একটি পরীক্ষা হবে। দেবনাথ পণ্ডিত বাড়ি এসে পড়তে বসিয়ে কিল ঘুসি চড় আমার মাথায় মুখে পিঠে ইচ্ছেমত ঢেলে মনের সাধ মিটিয়ে চলে যান। চন্দনার দেবনাথ পণ্ডিতের ঝামেলা নেই। দিব্যি আছে সে। লেখাপড়া জাতীয় বিষয়ের ওপর চন্দনার বরাবরই বড় অনাসক্তি। আমারও হত, কিন্তু বাবার কারণে হওয়ার উপায় নেই। বাবার ইচ্ছেয় আমাকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়তে হচ্ছিল। ছোটদা এই মাধ্যমে পড়েছেন, তাঁর কিছু বই পড়ে ছিল বাড়িতে, ঝেড়ে মুছে সেগুলোই সাজিয়ে রেখেছিলাম টেবিলে। দেবনাথ বাবু পরীক্ষার আগে আগে বাবাকে জানিয়ে দিলেন, বাংলায় পড়াই ভাল, এর দ্বারা ইংরেজি পোষাবে না। ইংরেজি বাদ দিয়ে বাংলায় বই কেনা হল। তাড়াহুড়ো করে বই শেষ করতে হবে, পরীক্ষা সামনে। দেবনাথ পণ্ডিত, আমি জানি না কি কারণে, পরীক্ষার আগে আগে হঠাৎ অসময়ে এসে—উস্কোখুস্কো চুল, পকেটের কালো কলম থেকে কালি চুইয়ে শার্ট প্রায় অর্ধেক ভিজে গেছে- আমাকে কিছু প্রশ্ন লিখে রাখতে বলেন, বলেন এইসবের উত্তরগুলা ঠাইস্যা পড়বা। ব্যস, ঠাইস্যা পড়ে গিয়ে দেখি পরীক্ষায় প্রায় ওই প্রশ্নগুলোই এসেছে। পরীক্ষা হল, ফল বেরোল, আমি প্রথম হলাম। কলেজে আমার নাম হয়ে গেল। প্রধান শিক্ষিকা আমাকে তাঁর ঘরে ডেকে নিয়ে বললেন তুমি হলে কলেজের গবর্, ভাল করে পড়াশুনা করতে থাক, ফাইনালে খুব ভাল রেজাল্ট চাই। খবরটি শুনে বাবা কিন্তু আদৌ তুষ্ট নন আমার ওপর। বাড়ির ঠিকানায় আমার নামে মেলা চিঠি আসে তিনি লক্ষ করেন। দাদাকে জিজ্ঞেস করেন, নাসরিনের কাছে চিঠি কারা লেখে?

পেনফ্রেন্ডরা।

পেনফ্রেন্ড মানে কি?

দাদা নিরাসক্ত কণ্ঠে বলেন, চিঠিতে ফ্রেন্ডশিপ।

চিঠিতে ফ্রেন্ডশিপ মানে?

দাদা কোনও উত্তর দেন না।

কি লেখে চিঠিতে? বাবার সর্বাঙ্গে বিস্ময়।

কি জানি আমি ত জানি না।

জানি না মানে?

আমারে তো দেখায় না চিঠি।

দেখায় না কেন? কি আছে চিঠিতে?

দাদা চপু ।

কার কাছে চিঠি লেখে?

জানি না।

এই মেয়ে কার কাছে চিঠি লেখে, কি লেখে, কেন লেখে, এইসব জানতে হবে না?

তেমন কিছু না। এই নরমাল ফ্রেন্ডশিপ!

বাবার ক্রমে উত্তপ্ত হতে থাকা মেজাজে দাদা অনুত্তপ্ত পরশ বুলোতে চেষ্টা করেন, কাজ হয় না। বাবার গলার স্বর ধাই ধাই করে ওপরে ওঠে।

নরমাল ফ্রেন্ডশিপ মানেটা কি?

শাদা দেয়ালের দিকে বোধবুদ্ধিহীন তাকিয়ে থাকেন দাদা।

মেয়ে না পুরুষলোক, কার সাথে?

দুই ধরনেরই আছে।

ও কি পুরুষলোকের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করে নাকি?

দাদার কোনও উত্তর না পেয়ে তিনি হাপাঁতে হাপাঁতে বলেন, বিয়া বইতে চায় নাকি ও?

দাদা বলেন, না, বিয়া না।

তাইলে কি?

এমনি।

এমনি মানে? এমনি কি?

এমনি লেখে।

এমনি কেন লেখে? কি দরকারে লেখে?

না, কোনও দরকারে না।

দরকার না থাকলে লেখে কেন?

জানি না।

জানস না কেন?

বাবা রক্তচোখে বিস্ফারিত চোখে গিলে খাবেন-চোখে দাদাকে প্রশ্ন করে যান। প্রশ্নের অত্যাচার থেকে বাঁচতে দাদা পায়খানার বেগের কথা বলে গোসলখানায় গিয়ে বসে রইলেন। বাবা তাঁর চশমা ঘন ঘন খুলে, পরে; ঘন ঘন ঘরের বারান্দার এমাথা ওমাথা হেঁটে আমার টেবিলে এসে বইখাতা ঘাঁটেন। প্রতিটি বই, প্রতিটি খাতা। টেবিলের তলে পড়ে থাকা প্রতিটি টুকরো কাগজ। এমনকি বিছানার চাদরের তল, বালিশের তল, তোশকের তল। তিনি খোঁজেন কিছু।

এই ঘটনার পর বাড়িতে আমার চিঠিপত্তর আসা বন্ধ হয়ে গেল। চিঠি চলে যেতে থাকে নতুন বাজারে আরোগ্যবিতানের ঠিকানায়। ডাকপিয়নকে বাগিয়ে নিয়েছেন বাবা। নিশ্চিত হই ছোটদা যেদিন আরোগ্য বিতানে ঢুকে যেই কি না বাজারের দিকে বাবা পা বাড়িয়েছেন, ড্রয়ার খুলতেই অবকাশের ঠিকানায় আমার নামে আসা অনেকগুলো চিঠি খামখোলা পড়ে আছে দেখে এসে আমাকে খবর দেন। একটি জিনিসই আমার তখন মনে হয়েছে, এ অন্যায়। বাবা না হয় বাবা হওয়ার কারণে কোনও অন্যায়কে অন্যায় মনে করেন না। কিন্তু ডাকপিয়ন এই অন্যায়টি করবে কেন! সমস্যাটি কারও কাছে জানিয়ে আমি যে উপকার পাবো না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই চিঠিটি লিখি। বিচিত্রার পাঠকের পাতায় লেখাটি আমার ছাপা হয় পরের সপ্তাহে। অবকাশ, আমলাপাড়ার ঠিকানায় আসা চিঠিগুলো ৬৯, রামবাবু রোডের ঠিকানায় যাচ্ছে, ডাকবিভাগের অসততা সীমা ছাড়িয়ে গেছে ইত্যাদি ..। চিঠি ছাপা হওয়ার দুদিন পর আমার খোঁজে ডাকবিভাগের একজন কর্তা আসেন অবকাশে। তিনি একটি বাধাঁনো লম্বা খাতায় আমার অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে এসেছেন। এসে কিন্তু নিজের অভিযোগের কথাই বর্ণনা করলেন। তাঁর অভিযোগটি আমার অভিযোগ নিয়ে। আমার চিঠি কোনও অচেনা দুর্বৃত্তের কাছে যাচ্ছে না, আমার আপন পিতার কাছেই যাচ্ছে। অবকাশের মালিক এবং আরোগ্য বিতানের মালিক এক ব্যক্তি। সুতরাং মালিকের আদেশে এক ঠিকানার চিঠি আরেক ঠিকানায় যেতেই পারে। এর উত্তরে আমি বলি, কিন্তু চিঠি তো আমার বাবার নামে আসছে না। আসছে আমার নামে। আমি তো পোস্টমাস্টাররে বলি নাই আমার চিঠি অবকাশে না দিয়া আরোগ্য বিতানে দিতে।

যেইখানেই দিক, তিনি তো আপনার বাবা।

মৃদু কণ্ঠে ভুল শুধরে দিই, হ্যাঁ তিনি আমার বাবা, তিনি আমি নন। আমি এবং আমার বাবা এক এবং অভিন্ন নই। লোকটি চলে গেলেন। সমস্যার কোনও সমাধান হল না। এই অবস্থা থেকে ছোটদা আমাকে উদ্ধার করেন তাঁর এক বন্ধুর খাতা কলমের দোকানের ঠিকানা আমাকে ব্যবহার করতে দিয়ে। পত্রমিতাদের জানিয়ে দিই আমার নতুন ঠিকানা। ছোটদা নিষ্ঠ ডাকহরকরার মত কর্তব্য পালন করেন। তাঁর সঙ্গে আমার বেশ ভাব। আমরা ঈদসংখ্যা বিচিত্রার গল্প উপন্যাস একসঙ্গে পড়ি, পড়া মানে আমি সশব্দে পড়ি আর ছোটদা শোনেন। গল্পের বইগুলোও প্রায়ই ওভাবেই পড়া হয়। কিছু কিছু বই আবার ছোটদার পছন্দ হয় না, সেগুলো আমি নিভৃতে পড়ি। ছোটবেলার দস্যু বনহুরের পাট চুকেছে, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, ফাল্গুনি মুখোপাধ্যায়, নিমাই ভট্টাচার্য, বিমল মিত্র, জরাসন্ধকে বিদেয় দিয়েছি অনেক আগে। বঙ্কিম শরৎচন্দ্রের আর কিছু বাকি নেই। রবীন্দ্রনাথ নজরুল অনেক হয়েছে। মাইকেল হয়েছে, জীবনানন্দও হয়ে গেছে। বিভূতিভুষণ, মানিক বন্দোপাধ্যায়ও। শক্তি, সুনীল, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ থেকে শুরু করে হালের নির্মলেন্দু গুণেরও যে বইগুলো এ অবদি বেরিয়েছে পড়া হয়ে গেছে। নতুন রকম বই চাই। আঁতি পাঁতি করে খুঁজি নতুন কিছু। কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে গাঙ্গিনার পাড় মোড়ের বইয়ের দোকানগুলোয় থেমে বই খুঁজি। গদ্যপদ্যপ্রবন্ধের নানারকম বই আমাকে টানে। কিন্তু বই কেনার পয়সা যথেষ্ট নেই। এ দুরবস্থা থেকেও ছোটদা আমাকে উদ্ধার করেন। এক বিকেলে পাবলিক লাইব্রেরিতে নিয়ে যান। লাইব্রেরির ভেতর ঢুকেই পঈচ্ছত প্রশান্তি আমাকে আলিঙ্গন করে। ঘরের মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত উঁচু তাকে বই। চারদিকে বই। মাঝখানে পড়ার টেবিল, পিন পতনের শব্দ নেই কোথাও, দএু কজন মন দিয়ে পড়ছে। ইচ্ছে করে সারাদিন মন্দিরের মত পরিচ্ছত বইএর এই নিরুপদ্রব ঘরটিতে কাটিয়ে দিই। লাইব্রেরির সব বই যদি বাড়ি বয়ে এনে পড়ে ফেলা যেত আজই! সেদিনই সদস্য হয়ে দুহাতে যত বই ধরে, নিয়ে আসি। বইগুলো আমার হাত থেকে যেতে থাকে চন্দনার হাতে, চন্দনার হাত থেকে আবার আমার হাতে। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, শওকত ওসমান, হাসান আজিজুল হক শেষ হলে সতীনাথ ভাদুড়ি, নরেন মিত্র, জগদীশ গুপ্তে। ফেরত দিয়ে আরও বই। গোগ্রাসে পড়তে থাকি দুজন। যেন অতি শীঘ্র পাবলিক লাইব্রেরির বইগুলোর ওপর একটি জরুরি পরীক্ষা দিতে বসব।

 

পরীক্ষা সামনে। সাধুতে যদি হায়ার সেকেন্ডারি, চলতিতে ইন্টারমিডিয়েট, আর পুস্তকি বাংলায় উচ্চ মাধ্যমিক। দেবনাথ পণ্ডিত সপ্তাহে তিনদিনের বদলে পাঁচদিন আসতে শুরু করেন। তিনি তো পড়াতে আসেন না, আসেন কিলিয়ে আমাকে মানুষ বানাতে। বাবার মত দেবনাথ পণ্ডিতেরও চোখ যায় ছোটখাট কাগজপত্রে। কোনও এক পত্রমিতাকে লেখা শেষ না হওয়া চিঠি অঙ্ক বইয়ের ভেতর থেকে একদিন টুপ করে পড়ে। পড়ে যাওয়া চিঠিটি সরাতে গেলেই দেবনাথ পণ্ডিত খাবলা মেরে চিঠিটি নিয়ে নেন, আগাগোড়া পড়েন চিঠি, পড়ে শার্টের বুক পকেটে রেখে দেন। এ কি! তিনি ঠিক বাবার মতই আচরণ করছেন, এই চিঠির কারণে কি এখন উঠোনের খড়ি ভাঙবেন আমার পিঠে! খানিক পর পর তিনি নিজের বুক পকেটে হাত দিয়ে অনুভব করছেন আধলেখা চিঠির অস্তিত্ব, চিঠিটি কোথাও উড়ে না গিয়ে যে পকেটেই আছে, তা জেনে একধরণের আনন্দ হচ্ছিল দেবনাথ পণ্ডিতের। সেই আনন্দ জ্বালা ধরানো, পেচ্ছাব পাওয়া কিন্তু ঠিক পাওয়া নয়, লোমকপূ অনেকটা দাঁড়িয়ে যাওয়া, অনেকটা বসে যাওয়া, মাথা ঝিমঝিম করেও না করার আনন্দ। দেবনাথ পণ্ডিতের পড়ানো হয় না, ডানে বামে নড়েন, সামনে পেছনে নড়েন। মন উতলা। আমাকে যে অঙ্ক করতে দিলেন, তা সারা হল আমার, অঙ্কে কোনও ভুল নেই। হঠাৎ দশ আঙুলে পদার্থবিজ্ঞান বইটি আঁকড়ে ধরে, যেন বইটির পাখা আছে, আঙুল ঢিলে করলেই উড়ে যাবে, পাতা উল্টো কঠিন কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন, সেসবেরও, কার কপৃায় জানি না, সঠিক উত্তর দিই। রসায়নএও একই ভাগ্য আমার। এরপর অঙ্ক,রসায়ন পদার্থবিজ্ঞান বই তিনটে দুহাতে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে হঠাৎ কোনও কারণ ছাড়াই প্রচণ্ড এক ঘুসি মারলেন মাথায়, কপালের ডানে। কেন! না কোনও কারণ নেই। বললেন কাইল যে অঙ্কগুলা দিয়া গেসিলাম করতে, তা করছ না কেন!

করছি তো।

করছ তো দেহাও না কেন? মন কই থাহে?

এই মোক্ষম সুযোগ আধচিঠির শাস্তি দেওয়ার। আমি অঙ্কের খাতা সামনে মেলে ধরলাম। মেলে ধরার পরও পিঠে আচমকা একটি কিল। ফুসফুস ক্যাৎঁ করে ওঠে। মার্জিন রাইখা অঙ্ক করার কথা আর কত কইয়া দিতে হইব?

মার্জিন রেখে অঙ্ক করার কথা এই প্রথম বললেন তিনি। যা হোক। এবার আসল কথা পাড়লেন।

চিঠি কারে লিখছ?

কোন চিঠি?

এবার একটি চড় উড়ে এল গাল বরাবর।

কোন চিঠি যেন জানো না? এই চিঠি।

বুক পকেট থেকে বের করলেন অর্ধেক পাতায় লেখা চিঠিটি।

জুয়েল কেডা? কই থাকে? কী করে?

ঢাকায় থাকে। কী করে জানি না।

জানো না? আমার সাথে ফাতরামি কর?

ফাতরামি আমি দেবনাথ পণ্ডিতের সঙ্গে করতে যাব, এমন সাহস আমার নেই। দেবনাথ পণ্ডিত তাঁর বিশাল শরীর, বিশাল বপু কলাগাছের গায়ের মত বাহু, আর শক্ত সাগর কলার মত আঙুল সামনে নিয়ে বসে থাকেন, আর আমি যতটা সম্ভব মৃত তৃণের মত পড়ে থাকি তাঁর পায়ের কাছে। চিঠিটি ছিঁড়ে টুকরো করে আমার মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে তিনি বেরিয়ে যান। দেবনাথ পণ্ডিতের কিল চড়, বাবার ধমক, মার ঘ্যানঘ্যান, ছোটদার নিরানন্দ, গীতার অভিমান, দাদার দাদাগিরি এসবের মধ্যে আমি একা বসে থাকি। মুখ গুঁজে রাখি বইয়ে। পরীক্ষা সামনে। পরীক্ষা সামনে তা জানি, কিন্তু ছোটদার বন্ধুরা বাড়িতে বেড়াতে আসে, জ্যোতির্ময় দত্তের ছেলে বাবুয়া দত্ত, তকবীর পত্রিকার সম্পাদকের ছেলে পলক ফেলা যায় না এমন সুদর্শন তফসির আহমেদ, লেডিকিলার বলে খ্যাত সাহেব কোয়ার্টারে থাকা ডিসির ছেলে সোহান, যাকেই দেখি তার প্রেমে পড়ে যাই মনে মনে, মনে মনে তার মনের কথা শুনি,কোথায় পাব কলসি কন্যা কোথায় পাব দড়ি, তুমি হও গহীন গাঙ, আমি ডুইবা মরি। অথচ আমার দিকে ফিরে তাকায় না কেউ, নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে কৎু সিত মেয়ে বলে মনে হতে থাকে।

চিত্রালী পুর্বাণী যেমন বন্ধ হয়, পত্রমিতাদের কাছে চিঠি লেখাও ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে। কেবল ভাল কিছু সুন্দর হাতের লেখার, কাব্যময় ভাষার চিঠিগুলোর উত্তর দিই। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র কামরুল হাসান সেলিম চিঠি লেখে আশ্চর্য সুন্দর, যেন আকাশপার থেকে স্বপ্নের কথা বলছে। বাছাইয়ে সেলিমকে রাখি, চিঠি লিখতে থাকি কোনওদিন সমুদ্র না দেখা মেয়ে সমুদ্রপার থেকে। যেন এ জগতের নয়, অন্য কোনও জগতে আমরা আপন দুজন মানুষ মুখোমুখি বসে স্বপ্নের কথা বলছি। ওই স্বপ্নের জগতে কোনও মানুষ নেই, ঘরবাড়ি নেই, কেবল আকাশ আর সমুদ্র, সমুদ্রের ধারে নানার রঙের ফুল, প্রজাপতি, আকাশ জুড়ে কেবল সপ্তবণর্ রং, তুলোর মত মেঘ আর লেজঅলা পাখি। এভাবেই চলতে পারত, কিন্তু একদিন হঠাৎ, হঠাৎই কলেজ গেটের কাছে এক দীর্ঘাঙ্গ যুবক এসে সামনে দাঁড়ায়, আমার মাথার চুল তেলে চোবানো, শক্ত করে বেণী গাথাঁ, নিশ্চিত শাকচুন্নির মত দেখতে লাগছে আমাকে। সামনে দাঁড়ানো দুজন ছেলের মধ্যে একজন সেলিম। কাছে এসে নিজের পরিচয় দেওয়ার পর ছিটকে সরে গিয়ে দ্রুত একটি রিক্সা নিয়ে ধুকপুক বুক নিয়ে বাড়ি ফিরি। সেলিম সেদিন ঢাকা ফিরে গিয়ে চিঠি লেখে ময়মনসিংহে তার এক বন্ধুর কাছে সে এসেছিল, আমার সঙ্গে একবার দেখা হলে মন্দ হয় না বলেই বন্ধুকে নিয়ে সে কলেজ গেটে দাঁড়িয়েছিল আমার অপেক্ষায়, কথা বলিনি বলে মন খারাপ করে ফিরে গিয়েছে। দেখা না করার কি আছে, শব্দের সাহসী মেয়েটি বুক ফুলিয়ে বলে দেয়, এসো দেখা হবে। কোথায় দেখা হবে? এ এক সমস্যা বটে। স্টেশন রোডের তাজমহল রেস্তোরাঁয় শহরের কবিকুল আড্ডা দেয়, অবশ্য কোনও মেয়ে ওখানে একা যায় না, প্রশ্ন ওঠে না, ওখানেই সেলিমের সঙ্গে আমার দেখা হবে জানিয়ে দিই। ছোটদা এক বিকেলে গীতা আর আমাকে নিয়ে সেই রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন। যেহেতু ছোটদার সঙ্গে মেয়েমানুষ আছে, আমাদের বসতে দেওয়া হয়েছিল পর্দার আড়ালে। মেয়েমানুষ এলে এরকমই নিয়ম, দূরে যাও,আড়ালে যাও। তাজমহলের লোকেরা উঁকি দিয়ে বারবারই দেখেছে আমাদের। সেলিম আমার চিঠি পেয়েই ময়মনসিংহে কবে কখন আসছে জানিয়ে চিঠি লিখল। দেখা হওয়ার দিন আমি সেজেগুজে চন্দনার জন্মদিনে যাচ্ছি বলে বেরিয়ে যাই। তাজমহলের দরজায় সেলিম দাঁড়িয়ে আছে। বুকের কাপঁুনি সমস্ত শক্তিবলে থামিয়ে আমি ঢুকি রেস্তোরাঁয়, পর্দার আড়ালে কেবিনে বসতে হয়। সেলিমের মুখোমুখি বসি যদিও, চা খাব বলে দুজনের জন্য দুটো চা চাই যদিও, তার চোখের দিকে আমার তাকানো হয় না, তার কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরে কয়েকটি নীরবতা, হ্যাঁ, হুঁ, না, নেই আর দুএকটি ভাববাচ্যে বাক্য ছাড়া আর কিছু উচ্চাজ্ঞরত হয় না, কেবল মৌনতার সঙ্গেই বাচাল হয়ে উঠি। যদিও চিঠিতে তুমি লিখি, সামনে তুমি বলা, লক্ষ করি, অসম্ভব। ওই চা পর্যন্তই, চা শেষ হলে আমি উসখুশ করি। চা তো শেষ হল, এবার কি, এবার উঠে পড়া ছাড়া আর কি হতে পারে! জিভের ডগায় যাই শব্দটি আসে আর যায়। আমার কোনও এক চিঠিতে অহল্যা শব্দটি ছিল। সে কারণেই কি না জানি না, হঠাৎ একটি প্রশ্ন সেলিম করে অহল্যা শব্দের মানে কি জানো?

আমি রা করি না।

হেসে বলে, ন্যাংটো।

যে যাই শব্দটি আমার জিভের ডগায় আসে আর যায় করছিল, সেটি এবার এসে যায়।

আমি যাই বলে য়চ্ছন্দে চলে যাই। পেছনে হতভম্ব বসে থাকে সেলিম।

ছোটদা সেদিনই খবর নিয়ে এলেন,তুই নাকি তাজমহলে গেসিলি?

কে কইল তুমারে?

কোন বেডার সাথে নাকি বইয়া আলাপ করছস? শহরে রইটা গেছে খবর। সীমা ছাড়াইয়া যাইতাছস।

সীমা ছাড়িয়ে গেছি তা বুঝি। কিন্তু সীমা ছাড়ানো মেয়েটিকে একটি গণ্ডমূখর্ বলে মনে হয়। কেন সেলিমের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি সে! রেস্তোরাঁ থেকে হঠাৎ চলে গিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছে? সে কি বোঝাতে চেয়েছে যে সে বাজে মেয়ে নয়, সে ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দেয় না!বড় ভদ্র ঘরের মেয়ে, ভাল মেয়ে, তাই ছেলেপিলের সঙ্গ এড়িয়ে চলে! সেলিমের সঙ্গে নিতান্তই বসতে হয়েছে সে ঢাকা থেকে এতদূর এসেছে বলে, নয়ত এতদূর পা বাড়াত না! এই কী! নাকি ওই ন্যাংটো শব্দটি শুনে তার গা ঘিনঘিন করেছে! পরদিন দুটো টাকা খামে ভরে একটি চিঠি পাঠিয়ে দেয় সে সেলিমকে—আমি খুব দুঃখিত, চায়ের পয়সা মিটিয়ে আসতে ভুলে গিয়েছিলাম, এই নাও পয়সা। বোধহয় এ বোঝাতেই যে সে পরখাওয়ইয়্যা নয়! না হলে দুটো টাকা এমন কোনও টাকা নয় যে সেলিমের পকেট থেকে গেলে সেলিম সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে, আর তাকে ডাকে টাকা পাঠাতে হবে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায়!

দেখা হওয়ার পর সেলিমের চিঠিতে আকস্মিক ভাবে আবেগ বেড়ে ওঠে। সমুদ্রে আরও ঢেউ ওঠে। আমি পিছু হটছি, কারণ তার ঠোঁটকে ঠোঁট বলে মনে হয়নি, মনে হয়েছে আস্ত না হলেও আধখানা তন্দুরের রুটি। সেলিমকে লেখা কমিয়ে দিতে থাকি, একদিন সেলিমও লেখা বন্ধ করে দেয়। কোনও চিঠি নেই, নেই তো নেইই। অনেকদিন পর হঠাৎ সুইৎজারল্যান্ড থেকে লেখা একটি চিঠি পাই সেলিমের, যদি কোনওদিন পারি যেন জুরিখ যাই, পৃথিবীতে নাকি আশ্চর্য সুন্দর এক শহর জুরিখ। জুরিখ নামটি দেশবিদেশ-লুডুর কথা মনে করিয়ে দেয়। জুরিখ আসিলে জুরিখ হাসপাতাল দর্শনে যাইতে হইবে, পাঁচ না পড়িলে গুটি বাহির হইবে না, আমার গুটি প্রায়ই জুরিখ গিয়ে পৌছত, আর পাঁচ পড়ার অপেক্ষায় থাকত। চিঠি কেবল সেলিমকে নয়, অনেককেই কমিয়ে দিয়েছিলাম। তবে কমানোর আগে চিঠির ওপারের মানুষটিকে বরাবরই রাজপুত্র মনে হয়েছে, রূপে গুণে এক নম্বর মনে হয়েছে। হাতে গোনা কিছু পত্রমিতা তখনও আছে আমার,কারও সঙ্গে বন্ধুত্বের বাইরে কোনও সম্পর্কে গড়ে ওঠেনি। কেউ লাফ দিয়ে ময়মনসিংহে আমাকে দেখতে চলে আসার বায়না ধরে না। ওই তাদেরই একজনকে রাতের পড়া সেরে খাওয়া সেরে বাবার বিছানায় বুকের নিচে বালিশ দিয়ে শুয়ে,একটি শাদামাটা কেমন আছ ভাল আছি জাতীয় কিছু লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দরজায় বাবার আসার শব্দ পেয়ে ঘুম- চোখে বাবার বিছানা ছেড়ে নিজের বিছানায় শরীরটিকে ছুঁড়ে দিই। চিঠি বাবার বিছানার ওপর ওভাবেই পড়েছিল। বাবা মধ্যরাতে আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে মেঝেয় ধাক্কা দিয়ে ফেললেন। ফেলেই তাঁর জুতো খুলে পেটাতে শুরু করলেন, কেন পেটাচ্ছেন কী অন্যায় আমি করেছি তার কিছু আমাকে না জানিয়ে। আমার বোঝার ক্ষমতা নেই কী কারণে বাবা এমন উন্মাদ হয়েছেন। আমার অস্ফুট বাক্য কী করছি আমি, কী হইছে? হারিয়ে যায় বাবার তর্জনের তলে। আস্ত একটি দৈত্য হয়ে উঠলেন তিনি। চুলের মুঠি ধরে শূন্যে ছুঁড়ে মারলেন, উড়ে গিয়ে আবার বাটার শক্ত জুতো পিঠে, ঘাড়ে, মাথায়, বুকে, মুখে। বাবা পেটান আমাদের, ঘুমের মেয়েকে তুলে এভাবে মধ্যরাতে আগে কখনও পেটাননি। বাবাকে ফেরাতে গিয়েছিলেন মা, মাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ফেলে দিয়ে আমাকে খামচে ধরেছেন আবার। হাতে পায়ে শক্তি ফুরোলে তিনি থেমেছেন। আমাকে মেঝে থেকে তুলে মানুষটার আন্দাজ বরাদ্দ কিচ্ছু যদি থাকত! মাথায় মারলে মাথা যে নষ্ট হইয়া যাইব তা জানে না। এইভাবে মারার চেয়ে একেকবারে মাইরা ফেলায় না কেন। মাইরা ফেললেই তো ঝামেলা যায় বলতে বলতে বিছানায় শুইয়ে দিলেন মা। সারারাত পাশে বসে ইস্ত্রির তলে কাপড় রেখে গরম করে করে আমার শরীরের নানা জায়গায় স্যাঁকা দেন। ঘুম চোখে ছিল না আমার, এক ফোঁটা জলও কিন্তু ছিল না। বিছানায় পড়ে থাকা আমার চিঠিটিই এসবের কারণ, ঠিক বুঝি। বাবা মেরে আমার চামড়া তুলে ফেলুন, আমার হাড়গোড় সব ভেঙে ফেলুন, তবু এতে আমার এই ধারণা মরে যায়না যে ছেলে মেয়েতে বন্ধুত্ব হয়, ছেলেদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্কে বা প্রেমের সম্পর্কে ছাড়াও কেবল বন্ধুত্বের সম্পর্কে হতে পারে, মেয়েতে মেয়েতে অথবা ছেলেতে ছেলেতে যেমন হতে পারে।

আমার ঠিকানা এখন আর ছোটদার বন্ধুর কাগজকলমের দোকান নয়, পোস্ট বক্স নম্বর ছয়। তাঁর নিজের চিঠি কাগজকলমের দোকান থেকে মার যাচ্ছে আশংকা করে ছোটদা পোস্টাপিসে একটি বাক্স নিয়েছেন, ওটিই আমি আর ছোটদা ব্যবহার করতে শুরু করেছি। বিচিত্রা থেকে আমার কাছে ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বিভাগীয় সম্পাদকের চিঠি আসে। অনুরোধটি পুলকিত করে আমাকে কিন্তু বিজ্ঞাপনের পথ মাড়ানোর কোনওরকম ইচ্ছে আমার জাগে না। যদিও ভুলে থাকি বিজ্ঞাপনের জগত, জগতের আর লোকেরা আমাকে ভোলে না। আমি নেই, তবু আমাকে আছে করে রাখে বিজ্ঞাপনের পাতায়। নববর্ষের নামকরণের সময় হারিয়ে যাওয়া আমার জন্যও একটি নাম বরাদ্দ থাকে। কেউ নাম দেয় সুগন্ধী গোলাপ, কেউ দেয় গোলাপ তো নয়, গোলাপের কাঁটা। ঘণৃা এবং ভালবাসা দুটোতেই ওরা দোলায় আমাকে, যদিও ওদের কারও সঙ্গেই আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমার উল্লেখ না হলে অনেকের চলে না। বিস্তর চিঠি আসে আমার ঠিকানায়। বেশির ভাগই চিঠিতেই বন্ধুত্বের আহবান। কিছু অন্ধ অনুরাগীরও আবির্ভাব ঘটেছে। কলেজে আমার এক ক্লাস নিচে পড়া শাহিন প্রতিদিন ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আমার অপেক্ষায়। ফুলের সঙ্গে চিঠি, আমাকে সে দেবী বলে মানে। মেয়েটি বড় লাজুক, নতমুখে নতচোখে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, এক হৃদয় উষ্ণতা আর এক শরীর শৈত্য নিয়ে আমি নিশ্চপু , মেয়েটি কি জানে তার চেয়েও বেশি লজ্জাবতী তার দেবী! চট্ট গ্রাম থেকে পাহাড়ি কুমার নামে এক ধনকুবের চিঠি লেখে সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে, সগু ন্ধে ডোবানো নীলাভ কাগজে। চন্দনা সেদিন অবকাশে, পাহাড়ি কুমারের উপহারের প্যাকেটটি যেদিন দিয়ে যায় ডাকপিয়ন। আমরা দুজন মাঠে বসে গল্প করছিলাম, প্যাকেট আমাদের গল্প থামিয়ে দেয়। যেহেতু এটি প্যাকেট, যেহেতু এটি আমার হাতে দিয়ে আমার সই নিতে হবে, তাই ডাকপিয়ন আরোগ্য বিতানে না নিয়ে প্যাকেট বাড়িতে এনেছে। বড় প্যাকেটের ভেতরে ছোট প্যাকেট, ছোট প্যাকেটের ভেতর আরও ছোট প্যাকেট, সেই প্যাকেটের ভেতর আরেক, শেষ প্যাকেটের ভেতর থেকে প্রাণভ্রমরাটি বেরিয়ে আসতেই চন্দনা লাফিয়ে উঠে এক হাত দূরে ঝটিতি সরে গিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ফালা এইটা।

ফালাইতাম কেন? কি হইছে?

ফালা। ফালা। এক্ষুনি ফালা।

কি এইটা?

হারামজাদা কুত্তা বেডা পচা জিনিস পাডাইছে, ফালা।

কি ফেলব তা না বুঝে আমি বিমূঢ় বসে থাকি। কৌতূহল আমাকে এমন গিলে খায় যে জিনিসটির দিকে আমি না চাইলেও আমার হাত চায় যেতে। চন্দনা ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার হাত সরিয়ে নেয় জিনিসটি থেকে। জিনিস আমার হাত থেকে কোলে, কোল থেকে মুখ থুবড়ে পড়ে মাটিতে।

কি এইটা?

বোকা চোখদুটো একবার মাটির জিনিসে, আরেকবার চন্দনায়, চন্দনার বিবমিষায়। বুঝস না কি এইটা?

না তো!কি এইটা?

এইটা প্যান্টি। শিগরি ফালাইয়া দিয়া আয়।

দৌড়ে গিয়ে আবর্জনার স্তূপে প্যাকেটসহ উপহারটি ফেলে দিই। বিবমিষা আমার দিকেও হাঁটি হাঁটি পা পা করে আসতে থাকে। চন্দনা মাঠের কিনারে বসে সত্যি সত্যি উগলে আসা বমন ত্যাগ করে।

চন্দনার এমন হয়।কামনা বাসনা শ্রীমতী নামের পর্নো ম্যাগাজিনগুলো সম্পর্কে ও বলে, আরে শালা একদিন পড়ছিলাম, ঘেন্নায় বমি করলাম। তারপর বাংলা সাবান দিয়া হাত ধুইয়া আবার লাক্স সাবান দিয়া হাত ধুইলাম। খাওয়ার সময় মনে হইতাছিল পেটে না আবার ঢুইক্যা যায়। সেই হাতে আর কোনওদিন ওসব নোংরা জিনিস ওঠেনি। আমরা যে জীবনের স্বপ্ন দেখি, সে জীবনে ন্যাংটো হওয়া নেই। পুরুষের শরীর চন্দনার কাছে বড় কদাকার একটি জিনিস। তবে ভালবাসায় ভীষণ রকম বিশ্বাসী সে।

 

চন্দনা প্লেটোনিক লাভ এর কথা বলতে শুরু করেছে। জিজ্ঞেস করেছি, এইটা আবার কি?

এইটা হইল লাভ, ভালবাসা, যেই ভালবাসায় শয়তানি নাই, নোংরামি নাই।

চন্দনার উজ্জ্বল দুটি চোখে আমার মুগ্ধ দুটি চোখ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *