০৬. এস ডি ওর অফিসে

এস ডি ওর অফিসে ফিরে যাওয়ার কথা আর মনে আসেনি। সোজা বাস স্ট্যান্ডে চলে এসেছিল রিক্সা নিয়ে। জানলার ধারে জায়গাও পেয়েছিল। বাস ছাড়তে ছাড়তেই অন্ধকার উঠে এল পৃথিবীর তলা থেকে উঠে আকাশ ছুঁতে চাইল।

এখন ওই তপ্ত অন্ধকার, বাসের খুঁড়িয়ে চলা, যাত্রীদের কথাবার্তা কিছুই যেন স্পর্শ করছিল না দীপাবলীকে। সেই দৃশ্যটি দেখার পর থেকেই বুকের ভেতর যেন হাজারমনি পাথর, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সমস্ত শিরায় শিরায় ঝিমুনি। এও কি সম্ভব? সতীশবাবুর মুখ বারংবার মনে পড়ছিল। মৃতা স্ত্রীর পাশে পাথরের মত বসে থাকা সতীশবাবু। কোন আন্দোলন নেই। একটি মানুষ কখন পৃথিবী থেকে চলে গিয়েছেন, হয়তো তিনি যাওয়ার মুহূর্তেও সাক্ষী ছিলেন কিন্তু তারপরও দীর্ঘ সময় সেই মানুষটির পাশে স্থির হয়ে সঙ্গ দিচ্ছিলেন। শুধুই কি দিচ্ছিলেন? সতীশবাবু স্ত্রীর জীবদ্দশায় যা পাননি তাই কি পেতে চাইছিলেন। আর একেও কি ভালবাসা বলে?

দীপাবলী চোখ খুলে অন্ধকার দেখল। চলন্ত বাসে অন্ধকারও কি দুলে দুলে ছোট? আর তখনই রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ল। বাঙালির সব শেষ আশ্রয় রবীন্দ্রনাথ। একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষের বেঁচে থাকা এবং না থাকার সময়ে সমস্ত অনুভূতি এবং স্মৃতির কথা তিনি ঈশ্বরের চেয়েও আন্তরিক হয়ে বলে গেছেন। সত্যি, কি আশায় বসেছিলেন সতীশবাবু? সে কি শুধুই দুঃখের খাস? না, দুখের আশ? আর ওই চোখের জল কি সুখের সন্ধান? সবই ঠিক কিন্তু তারপরও, তবুও কী নাই? বাঙালির গীতা উপনিষদ তার নিজস্ব ভাষায় লেখা নয়। কিন্তু বাঙালির গীতবিতান আছে। একটি মানুষের যা সমস্ত জীবনের আশ্ৰয়। যেখানে দেবতা মানুষ আর প্রকৃতি একাকার হয়ে পরস্পরের বন্ধু হয়ে যায়। বুকের মধ্যে এত চাপ, দীপাবলী ছটফট করছিল বাড়িতে ফিরতে। কলকাতা থেকে কর্মস্থলে ঘোরার সময় সে কিছু বই সঙ্গে রাখতে পেরেছে, গীতবিতান তো অবশ্যই।

বাস থেকে নেমে সে বুঝতে পারল মনের চাপ শরীরকে আক্রমণ করেছে। হাঁটতেই। যেন কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু খবরটা দেওয়া দরকার। প্রৌঢ় মানুষটি মৃতা স্ত্রীকে আঁকড়ে বেশীক্ষণ বসে থাকতে পারেন না।

ব্লক অফিস তৈরী হবার সময় সরকারি জমিতে কিছু বাড়ি ঘর তৈরী হয়েছিল। পরবর্তীকালে কর্মচারীরা সেগুলোই বাড়িয়ে নিয়েছেন। যদিও বদলির চাকরি তাহলেও একবার এখানে এলে সচরাচর এই স্তরের কর্মচারীদের আর সরানো হয় না। এদিকটায় কখনও আসেনি সে, আসা হয়নি এই পর্যন্ত।

খবর দেওয়ামাত্র শোকের ঢল নামল। সবাই ওই মুহূর্তে শহরে যেতে চান। শেষ বাসের দেরি আছে শহরে ফিরে যাওয়ার। দীপাবলী আর দাঁড়াল না। ফিরে আসার পথে অন্ধকার মাঠে দাঁড়িয়ে পড়ল সে হঠাৎ। চারপাশে কোথাও এক ফোঁটা আলো দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার যেন সমস্ত বিশ্বচরাচর গ্রাস করে নিয়েছে শুধু আকাশ ছাড়া। মুখ তুলল সে। যখন সতীশবাবু স্ত্রীকে চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন তখন তো কেউ সঙ্গে যায়নি। যেন সেটা স্বামীর কর্তব্য ছিল। এখন কেন সবাই ব্যস্ত সহযোগী হতে? শুধু শরীরে প্রাণ নেই বলে? প্ৰাণহীন শরীর কি কারো নিজস্ব আত্মীয় নয়? চোখ মেললো সে আকাশে। আর হঠাৎই তাকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে একটি লাইন যেন নিঃশ্বাসের মত ধাক্কা দিতে লাগল বুকের ঘরের দেওয়ালে, দেখো আমার হৃদয়তলে সারারাতের আসন মেলা।

মুখ নামাল দীপাবলী। এমন একটা লাইন কেন মনে এল?

সে দ্রুত হাঁটতে লাগল। ধীরে ধীরে তিরির জ্বালানো হ্যারিকেন চোখে এল। সে সিঁড়িতে পা রাখতেই দরজা খুলে প্রায় ছিটকে বেরিয়ে এল তিরি, তুমি চলে যাওয়ার পরে দাদাবাবু আর আসেনি।

দীপাবলী এক মুহূর্ত শক্ত হল, নিচু গলায় বলল, আসেনি!

না। সারা দিন নিশ্চয়ই না খেয়ে আছে। তিরি যেন খুবই চিন্তিত।

দীপাবলী আর পারছিল না। বাইরের ঘরের চেয়ারে বসে বলল, আমায় এক কাপ চা করে দে তিরি।

তিরি তবু দাঁড়িয়ে রইল। বলল, একটু খোঁজ করবে না?

আঃ। তোকে যা বলছি তাই কর। স্পষ্টতই বিরক্তি বোঝাল সে। তিরি চলে গেল ভেতরে। গুম হয়ে বসে রইল দীপাবলী। এই ঘরের এক কোণে শমিতের আনা জিনিসপত্র পড়ে রয়েছে। কিন্তু এরকম পাণ্ডববর্জিত জায়গায় সে যাবেই বা কোথায়? নাকি সত্যিই ফিরে গেল কলকাতায়? হয়তো সারাদিন রোদে ঘুরে সহ্য করতে পারেনি, পড়ে আছে কোথাও অসুস্থ হয়ে। এলোমেলো নানান চিন্তা মাথায় জট পাকালো। দীপাবলী বুঝতে পারছিল না তার কি করা উচিত। সতীশবাবুর ভাবনার পাশে শমিতের তৈরী করা সমস্যা যেন একই মাত্রায় উঠে এল। শমিত যদি চলে যায়? একটা খেলা খেলে যাওয়ার জন্যেই। কি এই আসা? ও কিছু চায়নি, দ্বিধাও দেখায়নি কিন্তু একটু আগে মাঠের মাঝখানে মনে আসা লাইনটাকে যেন সত্যি করে দিল, নীরব চোখে সন্ধ্যালোকে খেয়াল নিয়ে করলে খেলা। এবং এই কথাগুলো তো পৃথিবীর জন্মের মত সত্যি, দেখা হল, হয়নি চেনা—প্রশ্ন ছিল, শুধালে না। এই অবধি মনে হতেই অদ্ভুত শান্তি পেল দীপাবলী। সে শমিতের কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে উঠল। মনের আকাঙ্ক্ষাকে হেলায় সরিয়ে দিয়ে শমিত যেন তাকে বাঁচিয়ে গেছে।

তিরি চা করে আনল। চুমুক দিতেই গাড়ির আওয়াজ কানে এল। অন্ধকার কাটতে কাটতে হেডলাইট দুটো ছুটে আসছে এদিকে। ক্রমশ সেটা শব্দ করে থেমে গেল। চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল সে কিন্তু উঠে দাঁড়াল না।

দরজা খোলা। বাইরে গাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে। ড্রাইভার গাড়ি থামাবার পরেও হেডলাইট অফ করেনি। সেই আলোয় একটি মানুষকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। দরজার সামনে এসে কপালে হাত ছুঁইয়ে নমস্কার করল লোকটা, মেমসাহেব!

লোকটাকে চিনতে পারল না দীপাবলী। সে চুপচাপ বসে রইল।

লোকটা বলল, বাবু জিপ পাঠিয়ে দিয়েছেন।

কোন বাবু? ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল সে।

অৰ্জুনবাবু। লাস্ট বাস খারাপ হয়ে গিয়েছে। আপনাদের শহরে যাওয়ার কথা ছিল, তাই জিপ পাঠিয়ে দিয়েছেন। লোকটি খুব বিনীত ভঙ্গীতে বলল।

এবার দীপাবলী উঠে দাঁড়াল, তোমার সাহেবকে কে খবরটা দিল?

বাড়িতে ফেরার সময় রাস্তায় বাবুদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

তা আমার এখানে কেন গাড়ি নিয়ে এসেছেন।

বাবু যে আপনার কাছেই নিয়ে আসতে বললেন।

তোমার বাবুকে বলবে আমার গাড়ির দরকার নেই। যাও।

লোকটা এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে ফিরে যাচ্ছিল গাড়ির দিকে। এটা অর্জুন নায়েকের আর একটা চালাকি। ঘুষ দিয়ে হাতে রাখতে চাইছে। কিন্তু সেই সঙ্গে ওর মনে হল, শহরে সতীশবাবু একা রয়েছেন। বাস যদি আজ রাত্রে না যায় তাহলে এখান থেকে কেউ সাহায্য করতে যেতে পারবে না। সে তড়িঘড়ি দরজার বাইরে নেমে এল, এই যে, শুনুন।

লোকটা ঘুরে দাঁড়াল। দীপাবলী বলল, আমাদের অফিসের লোকজন কি এখনও বড় রাস্তায় অপেক্ষা করছে? আপনি জানেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ। লোকটি মাথা নাড়ল।

তাহলে ওঁদের কাছে গাড়ি নিয়ে যান। ওরা যদি শহরে যেতে চান, মানে যে কজন আপনাদের জিপে যেতে পারেন, নিয়ে গেলে ভাল হয়।

ঠিক আছে মেমসাহেব। লোকটি আবার মাথা নেড়ে জিপে উঠে বসে ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল অন্ধকার কাটতে কাটতে।

দরজা বন্ধ করল দীপাবলী। সোজা শোওয়ার ঘরে এসে খাটে শরীর এলিয়ে দিল। এবং তখনই তার মনোরর কথা মনে এল। এইভাবে বাইরের জামাকাপড়ে বিছানায় শুলে তিনি নিশ্চয়ই কুরুক্ষেত্র করতেন। একসময় ব্যাপারটা মানত সে, বাধ্য হয়েই মানত। এখন তো সব ছন্নছাড়া। কোন কিছুই আর বেশীদিন আঁকড়ে ধরা যাচ্ছে না।

এই যেমন তাকে শেষপর্যন্ত অৰ্জুন নায়েকের সাহায্য নিতেই হল। প্রথমে সাহায্যটাকে ঘুষ বলে মনে হলেও সেটাকে এড়ানো গেল না বলেই সাহায্য হিসেবে ভাবতে ভাল লাগছে। সতীশবাবুকে আজ রাত্রে হাসপাতালে একা ফেলে রাখা খুব অন্যায় হত। আবার এমনও হতে পারে, অর্জুন সম্পর্কে নানান কুকথা শুনে তার প্রতি বিরূপ হয়েছে সে, হয়ত লোকটা তার সঙ্গে সত্যি সত্যি ভাল ব্যবহার করতে চায়!

মনোরমা বলতেন, ঘরে থাকবি ঘরের মত, বাইরে বাইরের মত। এ দুটোকে কখনই এক করবি না। শোওয়ার আগে নিজে বিছানায় বসবি না, কাউকে বসতে দিবি না। রাত্রে ঠিকঠাক করে রাখা নরম বিছানায় শুয়ে যে আরাম পাবি সেই একই বিছানা ব্যবহার করার পরে ভোরবেলায় তোক শুতে দিলে কি সেই আরাম লাগবে? তার মানে সব কিছু তোর কাছে আলাদা যত্ন চায়। যত্ন করলে সে-ও তোক খুশী করবে, বুঝলি।

মনোরমা এককালে রাত্রে শুয়ে শুয়ে এমন অনেক কথা বলতেন। তখন শুনতে ভাল লাগত না। অন্যমনস্ক হয়ে প্রায়ই সে ঘুমিয়ে পড়ত। এখন তার কিছু কিছু বড় সত্যি বলে মনে হয়। মনোরমা হয়তো একটা মানে ভেবে ওসব বলতেন এখন সেটা আর একটা অর্থ তৈরী করে। আজ এই মুহূর্তে মনোরমাকে খুব মনে পড়ছিল দীপাবলীর। এখন অবশ্য। মনোরমা তাকে মাসে একখানা হলেও চিঠি দেন। চাকরি পাওয়ার খবরে উল্লসিত। হয়েছিলেন। দীপাবলী লিখেছিল, কে বলতে পারে তাকে হয়তো জলপাইগুড়ি জেলায়। কখনও বদলি করতে পারেন সরকার। সেরকম হলে মনোরমা বেশী খুশী হবেন বলে। জানিয়েছিলেন। চাকরি পাওয়ার পর দীপাবলী মনোরমাকে লিখেছিল, তিনি যদি ইচ্ছে করেন তাহলে তার কাছে এসে থাকতে পারেন। মনোরমা জবাবে লিখেছিলেন, বউমা তাঁকে কিছুতেই ছাড়তে রাজি নন। অমরনাথের বড় ছেলে স্কুল ফাইন্যাল পাশ করামাত্র কোম্পানি চাবাগানে ডেকে নিয়ে চাকরি দিয়েছে। এখন বউমাও তাঁর সেবাযত্ন করে। এই অবস্থায়, তাদের ছেড়ে তাঁর পক্ষে অন্য কোথাও গিয়ে থাকা সম্ভব নয়। মনোরমাকে আমন্ত্রণ জানানোর সময় সে নিশ্চয়ই আন্তরিক ছিল কিন্তু পরে মনে হয়েছে তার কাছে এলে মনোরমা নিশ্চয়ই খুব স্বস্তি পেতেন না। তাঁর যাবতীয় শুচিবায়ুতা এখানে এসে প্রতি পদে আঘাত পেত।

রাত দশটায় দুজন গ্রাম্য মানুষ এসে ডাকাডাকি করতে লাগল।

বিছানায় শুয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল দীপাবলী নিজেই জানে না। তিরিও তাকে খেতে ডাকেনি। ঘুম ভাঙার পর মনে হল, মধ্যরাত। ঘরে হ্যারিকেন জ্বলছে। ডাক শুনেছিল তিরিও। সে শুয়েছিল মেঝেতে, ধড়মড় করে উঠে বসল। দীপাবলী তাকে জিজ্ঞাসা করল, কে ডাকছে রে?

দরজা খুলে দেখব? তিরি উঠে দাড়াল।

না, ভেতর থেকে জিজ্ঞাসা কর।

তিরি বাইরের ঘরে গিয়ে পেঁচিয়ে পরিচয় জানতে চাইলে দেশীয় গলায় জবাব মিলল। নেখালির দুজন মানুষ এসেছে। নাম শোনামাত্র ছুটে এল তিরি দীপাবলীর কাছে, ওরা এসেছে, নিশ্চয়ই ঝামেলা করবে!

ঝামেলা করবে কেন?

আমার জন্যে।

দীপাবলীর খুব রাগ হয়ে গেল। এই মেয়েটা এখানে থেকেও মাঝেমাঝেই আতঙ্কিত হয়। গ্রামের মানুষ এসে তাকে সুখের জগৎ থেকে টেনে নিয়ে যাবে এইরকম ধারণা ওর মন থেকে সরছে না। আর লোকদুটো যদি সত্যি ঝামেলা করতে আসে তাহলে ওদের শায়েস্তা করার ক্ষমতা দীপাবলীর আছে। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে সে-ও অসহায়। পুলিশের সাহায্য তো আগামীকালের আগে পাওয়া যাবে না।

সে সোজা বাইরের ঘরে গিয়ে দরজা খুলে হ্যারিকে উঁচিয়ে ধরতেই দুটো লোক কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার করল। দীপাবলী উঁচু গলায় প্রশ্ন করল, কি চাই?

একজন বলল, একজন বাবু আমাদের গ্রামে মাঠের ওপর শুয়ে আছে। বাবু বলছে আপনার সঙ্গে জানাশোনা আছে।

মাঠের ওপর শুয়ে আছে? চমকে উঠল দীপাবলী।

হ্যাঁ। দিনভর হাঁড়িয়া খেয়েছে, খাইয়েছে সবাইকে। এখন আর উঠতে পারছে না। আপনার নাম শুনে খবর দিতে এলাম।

এখনও মাঠেই শুয়ে আছে?

হ্যাঁ। নেশা মাথায় উঠে গিয়েছে, হাঁটতে পারছে না।

ঠোঁট কামড়াল দীপাবলী। তারপর শেষ সংশয় থেকেই প্রশ্ন করল, কিরকম দেখতে?

লম্বা, পাজামা পাঞ্জাবি পরেছে।

নিঃশ্বাস ফেলল দীপাবলী। তারপর বলল, এতদূরে তো এই রাত্রে ওকে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। তোমরা যদি ওকে কোন ঘরে রাতটা থাকতে দাও তাহলে ভাল হয়?

এবার দ্বিতীয় লোকটি বলল, এখন গ্রামের কেউ ঘরে থাকতে দেবে না।

কেন? মাতাল হয়ে বাবু একজনের সঙ্গে মারপিট করেছে।

মারপিট? সে কি?

হুঁ। যাদের সঙ্গে হাঁড়িয়া খাচ্ছিল তাদের একজন খারাপ কথা বলে, বাবুও তাই খারাপ কথা বলে, তারপর মারপিট আরম্ভ হয়ে যায়।

ও। আমার কাছে লোকজন এখন নেই। আমি কি করতে পারি বল? তোমরা কি ওকে এখানে নিয়ে আসতে পারবে?

লোকদুটো নিজেদের মধ্যে কিছু কথা বলল। তারপর জানালে যে চেষ্টা করবে। নেখালির মানুষদের দীপাবলী যে সাহায্য করছে তার জন্যেই চেষ্টা করবো বলে ওরা চলে গেল।

দরজা বন্ধ করে সোজা বাথরুমে চলে গেল দীপাবলী। সারাদিনের ঘাম, ক্লান্তি আধাঘুম ভেঙে যাওয়ার জড়তার সঙ্গে আর একটা গা ঘিনঘিন করা অনুভূতি জুড়ে গেল। শমিত এত নিচে নেমে গেছে সে ভাবতেই পারছিল না। যে শমিত এককালে সুস্থ শিল্পের কথা বলত, মানুষের প্রতিভার নামে যা-ইচ্ছে তাই করবে স্বাধীনতায় বিশ্বাস করত না, সে সারাদিন ওই গরিব মানুষদের গ্রামে মদ খেয়ে এবং খাইয়ে পড়ে রইল একটা সাধারণ মাতালের মত মারপিট করল? মগের জল শরীরে ঢালতে ঢালতেও কাঁটা হয়ে রইল দীপাবলী।

স্নান সেরে সে তিরিকে বলল খাবার দিতে। বেশীক্ষণ না খেয়ে থাকলে এবং সেইসঙ্গে উত্তেজনা মিশলে পেটে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়ে যায়। সে খেতে চাইছে দেখে তিরি যেন অবাক। কিন্তু মুখে কিছু না বলে খাবার দিল। কোন কোন সময় খাওয়াটা যে কতখানি বিরক্তিকর হয় তা এখন টের পেল দীপাবলী। খেয়ে দেয়ে বলল, ওরা যদি শমিতকে নিয়ে আসে তাহলে বাইরের ঘরটা খুলে দিবি। ওখানেই শুইয়ে ওরা চলে গেলে দরজা বন্ধ করে তুই শুয়ে পড়বি। শোওয়ার সময় এই দরজাটাও বন্ধ করে রাখবি। যা, খেয়ে নে। আর শোন, ওরা এলে আমাকে ডাকাডাকি করার কোন দরকার নেই। আমার শরীর ভাল না।

মশারি খাটিয়ে দিল তিরি। শুয়ে পড়ল দীপাবলী। বিছানায় গা এলিয়েই বুঝতে পারল আজ সহজে ঘুম আসবে না। একবার ভেঙে যাওয়া ঘুম এখন উধাও হয়ে গিয়েছে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল ঘুম আনতে দুই চোখে। কিন্তু বন্ধ চোখের পাতায় শমিতের মুখ। বারংবার। সে নিঃসাড়ে পড়ে রইল।

নিঝুম হয়ে যাওয়া চরাচরে একসময় কিছু লোকের কথাবার্তা শোনা গেল। শেষপর্যন্ত। দরজায় ধাক্কা, মানুষজনের গলার আওয়াজ। দীপাবলী বিছানায় স্থির হয়ে রইল। তিরির গলা শোনা গেল, কে?

বাইরে থেকে জবাব ভেসে এল, বাবুকে নিয়ে এসেছি।

দীপাবলী শুনল, তিরি দরজা খুলছে। লোকগুলো শমিতকে নিয়ে সম্ভবত ভেতরে ঢুকল। শুইয়ে দেওয়ার শব্দ হল। হঠাৎ একটা লোক বলে উঠল, মেমসাহেব কোথায়?

শরীর খারাপ, শুয়ে পড়েছে। তিরি অন্যরকম গলায় কথা বলল।

তোর জন্যে, তার জন্যে বাবু মারপিট করল। হুঁ।

তারপরেই লোগুলোর চলে যাওয়ার শব্দ পাওয়া গেল। গলার স্বর অন্ধকারে একসময় মিলিয়ে গেল। তিরি দরজা বন্ধ করল আরও কিছুক্ষণ বাদে। দীপাবলী বুঝতে পারছিল না এতক্ষণ দরজা খুলে তিরি কি করছিল! আরও খানিকটা সময় পার করে তিরি এঘরে এল। এবার ও বিছানা করে শুতে যাচ্ছে। দীপাবলী গম্ভীর গলায় বলল, মাঝখানের দরজাটা বন্ধ করে দিতে বলেছিলাম তোকে।

বাবুর শরীরে জ্বর এসেছে। কাতর গলায় বলল তিরি।

তোকে যা বলছি তাই কর।

তিরি উঠল। দরজাটা ভাল করে বন্ধ করতে একটু শব্দ হল। দীপাবলীর মনে হল শব্দটা যেন তিরি ইচ্ছে করেই করল। শমিত আসার পর থেকে যেন তিরি তার সঙ্গে অন্যরকম ব্যবহার করছে। একটা প্রতিবাদী ভঙ্গী সবসময় ওর আচরণে চোখে পড়ছে। দীপাবলীর কিছুতেই ঘুম আসছিল না। সারাদিন মাঠেঘাটে পড়ে মদ গিললে জ্বর আসতেই পারে, কিন্তু তাকে জ্বালাতন করা কেন?

তবু শেষাতে তা এসেছিল কিন্তু রাত ফুরোবার আগেই সেটা গেল সরে। উঠে বসল দীপাবলী। ঘড়িটা চোখের সামনে টেনে এনে সময় দেখল। অন্যদিন আরও আধঘণ্টা সে স্বচ্ছন্দে ঘুমায়। আজ ঘুম এল কখন? চট করে পাশের বন্ধ দরজার দিকে তাকাল সে। ঘরের এক কোনায় নিবন্ত হ্যারিকেন থেকে ফ্যাকাশে হলুদ আলো বের হচ্ছে। মাটিতে অঘোরে ঘুমাচ্ছে তিরি। দীপাবলী বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে গেল।

দাঁত মাজতে মাজতে, প্ৰায়ান্ধকার বাথরুমে দাঁড়িয়ে অন্য চিন্তা মাথায় এল তার। শমিতের ঘটনাটা নেখালির মানুষেরা নিশ্চয়ই গল্প করবে। এধরনের ব্যাপার রোজ ঘটে না। আর যেখানে সে জড়িত তখন গল্পের গতি বাড়বে। সে এর আগে দেখেছে, এক অল্পবয়সী মেয়ে চাকরি করতে এসেছে, তা যে পোস্টেই হোক, আশেপাশের মানুষ তার মধ্যে গল্প খোঁজে। শমিত অন্তত এই ক্ষতিটুকু করতে পারল। অবশ্য নিজে যতক্ষণ অন্যায় না করছে ততক্ষণ সে কাউকে পরোয়া করে না, তবু এসব কার ভাল লাগে?

অভ্যেসমত স্নান সেরে সে যখন ঘরে ফিরে এল তখনও তিরির ঘুম থেকে ওঠার সময় হয়নি। বাইরের ঘর দিয়ে বেরুবার প্রবৃত্তি হল না। সে ভেতরের উঠোন পেরিয়ে খিড়কির দরজা খুলে মাঠে এসে দাঁড়াল। অন্ধকার আকাশ থেকে নেমে আসছে পৃথিবীর ওপর। আর একটু বাদেই তারা ঢুকে যাবে মাটির ভেতরে। এ বড় সুসময়। অন্যদিন এই মুহূর্তে মন মাজা কাঁসার থালার মত ঝকঝকে হয়ে যায়।

দীপাবলী অন্যমনস্ক হাঁটতে লাগল। সতীশবাবুর বাড়ির দিকে যাওয়ার কথা ভাবল একবার। নিশ্চয়ই যারা গিয়েছিল কাল শহরে তারা এতক্ষণে শ্মশানেই আটকে আছে। সে পূবমুখে দাঁড়াল। সূর্য দেখা যাচ্ছে না, তিনি এখনও দিগন্তের নীচে। কিন্তু তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে তার উঠে আসার। হঠাৎ দূরে, ঝাপসা হয়ে থাকা একটি মানুষের মূর্তি চোখে পড়ল। লোকটি গুনগুন করে গান গাইছে। বিস্মিত দীপাবলী কয়েক পা এগোল। তখনই কানে এল, আকাশ পানে হাত বাড়ালেম কাহার তরে?

গলার স্বর কাঁপছে, সুর সব জায়গায় চেনা নয়। শরীর দুলছে। শমিত। ও কি করে তার আগে এখানে এল? দীপাবলী অনুমান করল শমিত তার অনেক আগেই বেরিয়েছে। গতরাত্রে সম্পূর্ণ মাতাল একটা লোককে শুইয়ে দেওয়ার পর এই ভোর না হওয়া সময়ে সে কোন পুলকে বাইরে বেরিয়ে গান ধরে?

দীপাবলী লক্ষ করল, গান থামল, ধীরে ধীরে উবু হয়ে বসল মাঠের ওপর। এই বসার ভঙ্গী চোখে খারাপ ঠেকল। স্বাভাবিক মানুষ এইভঙ্গীতে সচরাচর বসে না। মাথা ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে। নিতান্ত অনিচ্ছায় দীপাবলী এগিয়ে গেল। একজন কেউ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এই বোধও যেন শমিতের নেই। একটু বাদেই বাবুরা কাজে আসবেন। তারা যদি শমিতকে এই ভাবে বসে থাকতে দ্যাখেন তাহলে গতরাত্রের গল্প আরও জোরদার হবে। কালকের মদের প্রতিক্রিয়া কি এখনও চলছে ওর শরীরে?

দীপাবলী ডাকল, শমিত।

শমিত অনেক কষ্টে মুখ তুলল যেন। তার মুখচোখ দেখে আঁতকে উঠল সে। হাত। বাড়িয়ে কপাল স্পর্শ করতেই আগুনের ছোঁয়া পেল। আতঙ্কিত দীপাবলী বলল, ওঠো, বাড়িতে গিয়ে শোবে চল। এরকম অসুস্থ হয়ে কেন বাইরে এসেছ?

শমিত হাসতে চেষ্টা করল কিন্তু পারল না।

ওকে একা তোলা দীপাবলীর পক্ষে অসম্ভব। সে দ্রুত ফিরে গেল। তিরিকে ডেকে এনে দুজনে মিলে কোনরকমে শমিতকে নিয়ে এল বাইরের ঘরে। সেখানে ঢুকেই শরীর গুলিয়ে উঠল। সমস্ত ঘরে বমি করে রেখেছে শমিত। দুৰ্গন্ধ সেখানে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। এরকম একটা নরকে কোন মানুষকে শোওয়ানো যায় না। দীপাবলী তিরিকে ভেতরের দরজাটা খুলতে লল। সেটা যেহেতু বন্ধ ছিল ওপাশ থেকে তাই তিরিকে খিড়কির দরজা ঘুরে যেতে হল। শমিতকে দুহাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে দীপাবলী। টলছে শমিত। আর টলতে টলতে বলছে, আই অ্যাম সরি দীপা, লেট মি গো। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।

ভেতরের ঘরে দ্বিতীয় বিছানা নেই। মাটিতেও শোওয়ানো যায় না। অতএব নিজের বিছানাতেই শুইয়ে দিতে বাধ্য হল দীপাবলী। দেখা গেল ওর পাঞ্জাবির হাতাতেও কিঞ্চিৎ বমি শুকনো হয়ে লেগে আছে। নতুন পাঞ্জাবি শমিতের ঝোলা থেকে এনে সেটা পরিয়ে দিতে প্রচণ্ড কসরৎ করতে হল।

তিরি বলল, কি হবে দিদি। শরীর যে পুড়ছে।

মাথা ধুইয়ে দেওয়া দরকার। তুই এক বালতি জল নিয়ে আয়।

শমিতের মাথা বিছানার একপাশে নিয়ে এসে ধীরে ধীরে মাথা ধুইয়ে দিল দীপাবলী। শরীরের ছোঁয়া পাওয়া মাত্র জল গরম হয়ে যাচ্ছে। জলের স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলল শমিত। লাল টকটকে চোখ মেলে কি দেখল সে-ই জানে।

তিরি ততক্ষণে চলে গিয়েছে বাইরের ঘরটাকে পরিষ্কার করছে। জল এবং ঝাঁটার শব্দ হচ্ছে সেখানে। একবার দরজায় এসে বলল, কাল সারাদিন কিছু খায়নি দিদি, যেখানে বমি পড়েছে সেখানেই কালো দাগ হয়ে গিয়েছে।

দীপাবলী চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকা শমিতের দিকে তাকাল। সেই শমিত এমন কাণ্ড কেন করল? আর এই শমিত সারাজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত সমস্ত জ্ঞান, অহঙ্কার, আকাঙ্ক্ষা হারিয়ে কি অসহায় হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু এভাবে কাউকে ফেলে রাখা যায় না। একজন ডাক্তারকে ডেকে আনা দরকার। তিরি ফিরে এলে তাকে শমিতের ওপর নজর রাখতে বলে সে তৈরী হয়ে অফিস ঘরে চলে গেল।

হরিপদবাবু নেই। বাবুদের মধ্যে মাত্র একজনই এসেছেন। তিনি এত সামন্য কাজ করেন যে দীপাবলীর প্রয়োজন পড়ে না কথা বলার। তাঁকেই ডাকতে হল। লোকটির যথেষ্ট বয়স হয়েছে। প্রথমদিন দেখেই মনে হয়েছিল বয়স ভাঁড়িয়ে কাজ করে যাচ্ছে। দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, সতীশবাবুর কোন খবর পেয়েছেন?

না। দ্রুত মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক, দুপুরে আগে কি করে ফিরে আসবে। সকালের আগে তো বডি শ্মশানে নিয়ে যেতে পারবে না।

এত স্বাভাবিক গলায় কথাগুলো বললেন ভদ্রলোক যে দীপা অবাক হয়ে তাকাল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, সবাই গেল আপনি গেলেন না কেন?

আমি আর কি করতাম ওখানে। জিপে জায়গা বেশী হত না। তাছাড়া আমি সি এল নষ্ট করতে চাই না এখন।

সি এল?

হাঁ ম্যাডাম। ক্যাজুয়াল লিভ। আপনি তো ওদের ছুটি কাটবেন। আমি বছরের শেষে ওই সি এলগুলো নিয়ে দেশের বাড়িতে যাই। আমি তো আপনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাই না তাই আপনি জানেন না।

হুঁ! আচ্ছা বলুন তো, এখানে ভাল ডাক্তার কী কেউ আছেন?

ডাক্তার? না। কেউ নেই। থাকলে সতীশবাবুর বউ মারা যায়?

কেউ নেই?

আছে। তিন ক্রোশ দূরে মতি হালদার। ব্যাটা চামার।

আপনি একটা কাজ করুন। এখন অফিসে কাজ করতে হবে না। ওরা যখন নেই তখন কি কাজই বা আপনি করবেন। আপনি দয়া করে ওই মতি হালদারকে আমার নাম করে ডেকে আনুন।

ডেকে আনব? কিন্তু সতীশবাবুর স্ত্রী তো মারা গিয়েছেন?

আপনাকে যা বললাম তাই করুন।

ঠিক আছে, যাচ্ছি। কিন্তু কে অসুস্থ জিজ্ঞাসা করলে কি বলব?

আমার বাড়িতে একজন আত্মীয় এসেছেন তিনি অসুস্থ। এই নিন দুটো টাকা, আপনাদের বাস ভাড়া।

টাকাটা নিয়ে ভদ্রলোক আর দাঁড়ালেন না। দীপাবলী একটু স্বস্তি পেল। এই লোকটির সঙ্গে সে আগে কথা না বলে ভালই করেছে। মতি হালদার যত চামারই হোন ডাক্তার তো বটে। এইসময় তিরি চা নিয়ে এল।

দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, হ্যাঁরে, তোদর এখানে কারো অসুখ হলে কি করিস?

শুয়ে থাকি।

শুয়ে থাকলে অসুখ সেরে যায়?

সেরে যায়, কেউ কেউ মরে যায়।

চিকিৎসা হয় না?

মাথা নেড়ে না বলল তিরি।

দীপাবলী বলল, মতি হালদার নামে একজন ডাক্তার আছেন, তাঁকে ডাকতে পাঠালাম।

তুমি পাগলাবাবাকে খবর দেবে?

পাগলা বাবা?

ওই শিবমন্দিরে থাকে। শেকড় পাতা দিয়ে অসুখ সারায়।

চায়ে চুমুক দিল দীপাবলী। কথা ঘোরাবার জন্য বলল, বাবু কি একই রকম ভাবে শুয়ে আছে?

শরীরের রক্ত যতক্ষণ ফুটবে ততক্ষণ হুঁস থাকবে না।

দশটা নাগাদ মতি হালদারকে নিয়ে ভদ্রলোক ফিরে এলেন। মতি হালদার মধ্যবয়সী। পোশাক এবং চেহারায় দুর্দশার ছাপ স্পষ্ট। হাতের ব্যাগটি জরাজীর্ণ। তিনি এসেই ঝুঁকে নমস্কার করলেন দীপাবলীকে, অনেক আগেই এসে আলাপ করা উচিত ছিল কিন্তু গুরুর নিষেধ থাকায় পারিনি। মার্জনা করবেন।

গুরুর নিষেধ?

আজ্ঞে হ্যাঁ। গুরু বলেছিলেন বিনা কলে কারও বাড়িতে যাবে না। সেই থেকে আমি যাই না। আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতেও না। কার অসুধ? কি অসুখ?

আপনি ভেতরে আসুন। দীপাবলীর বলার ধরন দেখে বৃদ্ধ কর্মচারি আফিস ঘরে ফিরে গেলেন। মতি হালদারকে নিয়ে সে শোওয়ার ঘরে চলে এল। খাটের ওপর পা তুলে বসে মতি হালদার মিনিট তিনেক শমিতকে পরীক্ষা করলেন। তারপর বাক্স খুলে দুটো বড়ি বের করে বললেন, একটা এখন খাইয়ে দিন। ঘন্টায় ঘণ্টায় মাথা ধোয়াবেন। জ্বর না কমলে চার ঘণ্টা বাদে দ্বিতীয় বড়ি। তাতেও না কমলে হাসপাতালে চিকিৎসার কিছু থাকবে না।

কি হয়েছে?

সমস্ত শরীর, ভেতরে বাইরে উত্তপ্ত। কেস খুব সিরিয়াস।

আপনি কী এখনই হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলছেন?

দুটো বড়ি ফেল করলে।

আপনার ফি কত?

পাঁচ টাকা, বড়ির দাম আট আনা।

টাকা এবং খুচরো পকেটে পুরে দরজা পর্যন্ত গিয়ে মতি হালদার ঘুরে দাঁড়ালেন, ইনি কে?

আমার আত্মীয়।

মুখে এখনও মদের গন্ধ। লিভার থেকেও হতে পারে। চলি।

মতি হালদার চলে যাওয়ার পর দীপাবলী ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। তার এতক্ষণ মনে হচ্ছিল শমিত তাকে ইচ্ছে করে বিপদে ফেলার জন্যে এখানে এসেছে। এখন মনে হল, শমিত কি আত্মহত্যা করতে এসেছিল, একটা জলজ্যান্ত মানুষ তার কাছে এসে যদি দুম করে মারা যায়। সে কেঁপে উঠল। মুখ ফিরিয়ে দেখল তিরি পরম যত্নে শমিতের মুখ তুলে বড়ি খাওয়াচ্ছে। সে চুপচাপ শমিতের মুখে গ্লাসের জলের ধারা পড়তে দেখল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *