৬. এম্পিডক্লিস
ইতোপূর্বে পিথাগোরাসের মধ্যে দেখা গেছে দার্শনিক, ভবিষ্যদ্বক্তা, বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকের মিশ্রণ। আর এসব বিদ্যার মিশ্রণের এক চমৎকার পরিপূর্ণ দৃষ্টান্ত ছিলেন এম্পিডক্লিস। তার আবির্ভাব আনুমানিক ৪৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। সে দিক থেকে তিনি ছিলেন পারমিনাইডিসের একজন অনুজ সমসাময়িক, কিন্তু তার মতবাদ কিছু দিক থেকে হেরাক্লিটাসের মতবাদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। তিনি ছিলেন সিসিলির দক্ষিণ উপকূলবর্তী আরকাগাস নগরীর নাগরিক, একজন গণতন্ত্রী রাজনীতিক, যিনি একইসঙ্গে নিজেকে একজন দেবতা বলেও দাবি করতেন। অধিকাংশ গ্রিক নগরীতে, বিশেষ করে সিসিলির গ্রিক নগরীগুলোতে, সে সময় গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে অবিরাম সংঘাত লেগে থাকত। যে পক্ষ পরাজিত হতো তার নেতাদের পরিণতি হতো মৃত্যুদণ্ড অথবা নির্বাসন। যারা নির্বাসনদণ্ড পেত তারা গ্রিসের শত্রুদের-পূর্বে পারস্য এবং পশ্চিমে কার্থেজ-এর সঙ্গে কোনো প্রকার সমঝোতা বা আলাপ-আলোচনায় যাবার তাগিদ বোধ করত না। একসময় এম্পিডক্লিসও নির্বাসিত হয়েছিলেন, তবে মনে হয় নির্বাসনের পর তিনি ষড়যন্ত্রপরায়ণ উদ্বাস্তু-জীবনের বদলে একজন ঋষির জীবন বেছে নেওয়াই শ্রেয় ভেবেছিলেন। এটা সম্ভবপর মনে হয় যে তিনি তরুণ বয়সে কমবেশি অর্ফিক মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন; নির্বাসনের আগের পর্বে তিনি একইসঙ্গে রাজনীতি ও বিজ্ঞানচর্চা করেছেন এবং পরবর্তী জীবনে, অর্থাৎ নির্বাসনকালেই কেবল একজন ভবিষ্যদ্বক্তা হয়েছিলেন।
এম্পিডক্লিস সম্বন্ধে অনেক কাহিনি-উপকথা প্রচলিত আছে, ধারণা করা হয় যে, তিনি নানা করম অলৌকিক কাজ-কারবার করতে পারতেন। কখনো এসব করতেন জাদুর সাহায্যে, কখনো বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সাহায্যে। বলা হয় তিনি বায়ুপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। তিনি নাকি তিরিশ দিনের মৃত এক মহিলাকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন। আর বলা হয় যে, নিজেকে দেবতা প্রমাণ করার জন্য তিনি ইটনার একটি অগ্নিগিরির জ্বালামুখে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। কবির ভাষায়–
মহান এম্পিডক্লিস, ব্যাকুল আত্মা,
ঝাঁপ দিলেন ইটনায়, ভস্ম হলেন পুরোটাই।
এ বিষয় নিয়ে ম্যাথিউ আরনল্ড একটি কবিতা লিখেছিলেন, কিন্তু সেটি ছিল তার কবিতাগুলোর মধ্যে অন্যতম নিকৃষ্ট এবং তাতে উপরের চরণ দুটি ছিল না।
পারমিনাইডিসের মতো এম্পিডক্লিসও লিখতেন পদ্যাকারে। তার দ্বারা প্রভাবিত লুক্রোটিয়াস কবি হিসেবে তার উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু এ বিষয়ে অভিমতগুলোর মধ্যে বিভাজন ছিল। এম্পিডক্লিসের রচনার অধিকাংশই হারিয়ে গেছে, কেবল সামান্য কিছু খণ্ডাংশ আমাদের কাল অবধি টিকে রয়েছে। তাই তার কবি প্রতিভা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।
এম্পিডক্লিসের বিজ্ঞানচিন্তা ও ধর্মচিন্তা পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে সেগুলোর আলোচনা করা প্রয়োজন পৃথকভাবে। আমি প্রথমে তার বিজ্ঞান, তারপর তার দর্শন এবং সবশেষে তার ধর্মচিন্তা নিয়ে আলোচনা করব। বিজ্ঞানে তার সবচেয়ে বড় অবদান এই যে, তিনি আবিষ্কার করেছিলেন বায়ু একটি পৃথক পদার্থ। এটা তিনি প্রমাণ করেছিলেন এই পর্যবেক্ষণ থেকে যে, একটি বালতি বা যেকোনো পাত্রকে উলটা করে পানিতে রেখে দিলে তার মধ্যে পানি প্রবেশ করে না। তিনি বলেন : একটি বালিকা চকচকে পিতলের তৈরি একটি জলঘড়ি নিয়ে খেলা করছিল। জলঘড়ির পাইপের নলটি সে তার শান্ত হাতে নিলে, তারপর সেটি ঢুকিয়ে দিল জলঘড়ির রুপালি জলের ভেতরে, কিন্তু জল তখন পাত্রে প্রবেশ করল না, ভেতরের ঘনীভূত বায়ু জলকে প্রবেশ করতে দিল না। কিন্তু যখন সে ঢাকনাটি তুলল তখন বায়ু বেরিয়ে গেল এবং সমপরিমাণ জল প্রবেশ করল। শ্বাসক্রিয়ার ক্ষেত্রে যে ঘটনা ঘটে এই অনুচ্ছেদটি তার ব্যাখ্যা হতে পারে।
এম্পিডক্লিস কেন্দ্রাভিমুখী শক্তির অন্তত একটি দৃষ্টান্তও আবিষ্কার করেছিলেন। সেটা হচ্ছে সুতোয় বাঁধা একটি পানিভর্তি কাপ যদি ঘোরানো হয়, তাহলে তা থেকে পানি পড়ে না। এম্পিডক্লিস জানতেন উদ্ভিদের লিঙ্গ আছে। বিবর্তন সম্পর্কে এবং যোগ্যতমের টিকে থাকা সম্পর্কে তার একটি তত্ত্ব ছিল (মানতেই হবে যে তা ছিল কাল্পনিক)। তিনি বলেন, এটা খেয়াল করার মতো একটি তাজ্জব ব্যাপার যে, আদিতে নানা আকারের নশ্বর জীবজন্তু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাস করত। ঘাড়বিহীন মাথা ছিল, কাঁধবিহীন বাহু ছিল, কপালবিহীন চোখ ছিল; একেকটা বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একত্রে মিলিত হবার চেষ্টা করত। এসব জিনিস যে যেমনটি সুযোগ পেত, একে অপরের সঙ্গে মিলিত হতো। মাটি-ঘেঁষে-চলা অনেক প্রাণী ছিল যাদের ছিল অসংখ্য হাত। বিভিন্নমুখী একাধিক মুখমণ্ডল ও একাধিক বক্ষবিশিষ্ট অনেক প্রাণী ছিল। এমন প্রাণী ছিল যার দেহ ষাড়ের আর মুখমণ্ডল মানুষের। আবার এমন প্রাণীও ছিল যার দেহ মানুষের আর মুখমণ্ডল ষাঁড়ের। নারী ও পুরুষের প্রকৃতির সমন্বয়ে গঠিত উভলিঙ্গ জীব ছিল, কিন্তু তারা ছিল বন্ধ্যা। তবে শেষ পর্যন্ত কেবল নির্দিষ্ট কিছু আকারের প্রাণীই টিকে যায়।
জ্যোতির্বিদ্যার ব্যাপারে বলতে গেলে, তিনি জানতেন যে চাঁদের আলো তার নিজস্ব নয়, বরং প্রতিফলিত আলো এবং যদিও এ কথা সূর্যের ক্ষেত্রেও সত্য, তিনি বলেন যে, আলোর ভ্রমণের জন্য সময় লাগে, কিন্তু তা এত অল্প সময় যে আমরা তা খেয়াল করতে পারি না। তিনি জানতেন সূর্যগ্রহণ ঘটে চাঁদের স্থান পরিবর্তনের কারণে। মনে হয় তিনি এটা জেনেছিলেন অ্যানাক্সাগোরাসের কাছ থেকে। এম্পিডক্লিস ছিলেন ইতালীয় ধারার চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রবর্তক। তার থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের যে ধারার জন্ম হয়েছিল তা প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলকে প্রভাবিত করেছিল। বার্নেটের মত অনুসারে তা পুরো বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক চিন্তার প্রবণতাকেই প্রভাবিত করেছিল। এসব থেকে এম্পিডক্লিসের যুগের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের শক্তিমত্তার প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায়, পরবর্তী যুগের গ্রিসে যার সমকক্ষতা মেলে না।
এখন আসছি তার সৃষ্টতত্ত্ব সম্পর্কে। ইতোমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনিই এই মত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে, মাটি, বায়ু, আগুন ও পানি হচ্ছে সৃষ্টির চারটি আদি উপাদান (অবশ্য উপাদান শব্দটি তিনি ব্যবহার করেননি। তার মতে এই উপাদানগুলোর প্রত্যেকটি চিরন্তন, তবে সেগুলো বিভিন্ন অনুপাতে পরস্পরের সঙ্গে মিশ্রিত হতে পারে এবং সেই-সব যৌগিক পদার্থ উৎপন্ন করতে পারে যা আমরা পৃথিবীতে দেখতে পাই। এই উপাদানগুলো মিশ্রিত হয় প্রেম দ্বারা এবং বিচ্ছিন্ন হয় দ্বন্দ্ব দ্বারা। এম্পিডক্লিসের কাছে মাটি, বায়ু, আগুন ও পানির মতো প্রেম এবং দ্বন্দ্বও আদি উপাদান। কখনো প্রেম শক্তিশালীরূপে দেখা দেয়, আবার কখনো দ্বন্দ্ব অধিকতর শক্তিশালী হয়। একটি সোনালি যুগ ছিল, যখন পরিপূর্ণ বিজয় লাভ করেছিল প্রেম। সেই যুগে মানুষ শুধু সাইপ্রাসের আফ্রোদিতির পূজা করত। বিশ্বে যেসব পরিবর্তন ঘটে তা কোনো লক্ষ্য দ্বারা পরিচালিত হয় না, বরং তা ঘটে শুধু ঘটনাক্রমে এবং অনিবার্য কারণে। পরিবর্তনের একটি চক্র রয়েছে : উপাদানগুলো যখন প্রেম দ্বারা সম্পূর্ণরূপে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তখন দ্বন্দ্ব সেগুলোকে আবার ক্রমে বেছে বেছে আলাদা করে। দ্বন্দ্বের এই বিচ্ছিন্নকরণের প্রক্রিয়াটি যখন সম্পূর্ণ হয়ে যায়, অর্থাৎ উপাদানগুলো যখন সম্পূর্ণরূপে আলাদা হয়ে যায়, তখন প্রেম সেগুলোকে আবার ক্রমে একত্রিত করে। এভাবে সৃষ্ট প্রত্যেকটি যৌগিক পদার্থ অস্থায়ী। শুধু আদি উপাদানগুলো এবং প্রেম ও দ্বন্দ্ব চিরস্থায়ী। এম্পিডক্লিসের এই তত্ত্বের কিছুটা সাদৃশ্য আছে হেরাক্লিটাসের তত্ত্বের সঙ্গে। তবে এম্পিডক্লিসের তত্ত্বটি একটু নমনীয় কারণ এতে শুধু দ্বন্দ্ব নয়, তার সঙ্গে প্রেমও আছে। পরিবর্তন সাধন করে দ্বন্দ্ব এবং প্রেম একত্রে মিলে। প্লেটো তার সফিস্ট গ্রন্থে হেরাক্লিটাস ও এম্পিডক্লিসকে একত্রে জুড়েছেন এভাবে : আয়োনীয় এবং অতি অধুনা কিছু সিসিলীয় কাব্যদেবীর দেখা মেলে যারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। যে, দুই নীতির (একের এবং বহুর) মিলন ঘটানো অধিকতর নিরাপদ, নিরাপদ এই কথা বলা যে, সত্তা হচ্ছে এক এবং বহু, এ দুটি একত্রে বাঁধা থাকে শত্রুতা ও বন্ধুত্ব দ্বারা, তারা এই বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, এই মিলিত হচ্ছে, যেমনটি বিচ্ছিন্নকারী দেবীরা বলে থাকেন। আর অধিকতর স্র দেবীরা নিরন্তর দ্বন্দ্ব ও শান্তির কথাটার ওপরে জোর দেন না, বরং তাদের শৈথিল্য ও পর্যাক্রমিক আবর্তন স্বীকার করেন; আফ্রোদিতিরি শাসনে শান্তির ঐক্য প্রকট হয়ে ওঠে, তারপর দ্বন্দ্বের এক নিয়মহেতু জয়ী হয় বহুত্ব ও যুদ্ধ।
এম্পিডক্লিস মনে করতেন বস্তুজগৎ একটি গোলক; স্বর্ণযুগে দ্বন্দ্ব ছিল এর বাইরে আর প্রেম ছিল ভেতরে। তারপর ক্রমে দ্বন্দ্ব প্রবেশ করে এবং প্রেম বহিষ্কৃত হয়। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না দ্বন্দ্ব সম্পূর্ণরূপে ভেতরটা দখল করে নেয় এবং প্রেম সম্পূর্ণরূপে বহিষ্কৃত হয়। তারপর কী এক অস্পষ্ট কারণে-একটি বিপরীতমুখী গতি শুরু হয়, কিন্তু সেটা চিরকাল চলে না, স্বর্ণযুগ ফিরে না আসা পর্যন্ত চলতে থাকে। কেউ মনে করতে পারে যে, দ্বন্দ্ব বা প্রেম যেকোনো একটির চূড়ান্ত রূপ স্থায়ী হতে পারে, কিন্তু এম্পিডক্লিসের মতো তা নয়। তিনি গতির বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন কেবল তখনই যখন পারমিনাইডিসের যুক্তি প্রসঙ্গে কিছু বলতে গেছেন; কিন্তু কোনো পর্যায়েই তিনি এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চাননি যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অপরিবর্তনশীল।
ধর্ম সম্বন্ধে এম্পিডক্লিসের অভিমতগুলো প্রধানত পিথাগোরীয়। একটি অনুচ্ছেদে তিনি এই কথাগুলো যে ব্যক্তি সম্বন্ধে বলেছেন তিনি খুব সম্ভবত পিথাগোরাস : তাদের মধ্যে বিরল জ্ঞানসম্পন্ন একজন মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন সব ধরনের জ্ঞানদীপ্ত কাজের ক্ষেত্রে সবচেয়ে দক্ষ, তিনি অর্জন করেছিলেন প্রভূত জ্ঞানসম্পদ, কেননা যখন তিনি সর্বান্তকরণে চেষ্টা করেছেন তখন খুব সহজেই মানুষে দশ-কুড়িটি জীবনের সমুদয় কিছু দেখতে পেয়েছেন। যেমনটি বলা হয়েছে, স্বর্ণযুগে মানুষ কেবল আফ্রোদিতির পূজা করত এবং তার বেদি ষাঁড়ের রক্তে সিক্ত হতো না, বরং মানুষ মনে করত প্রাণ হরণের পর প্রাণীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভক্ষণ করা সবচেয়ে ঘৃণ্য কাজ।
একসময় তিনি নিজের সম্বন্ধে এমন উচ্ছ্বসিতভাবে কথা বলেন যেন তিনি একজন দেবতা : আরকাগাসের হলুদ পর্বতরাজির দিকে তাকিয়ে তোমরা যারা এই মহান নগরীতে বাস করো, যারা নগরদুর্গের পাশে শুভকর্মে লিপ্ত থাকো, অতিথিদের সম্মান করো, সেই বন্ধুরা এবং সেই-সব অদক্ষ ও হীন মানুষেরা, তোমাদের সবাইকে স্বাগতম। তোমাদের মধ্যে আমি আছি-এক অবিনশ্বর দেবতা। যারা আমার সাক্ষাৎ লাভ করে তারা সবাই আমার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে, চৌকো জালিকা ও পুষ্পমাল্যে আমাকে ভূষিত করে। সোজা কথা, আমি যখন নারী ও পুরুষ উভয় শ্রেণির লোকজনসহ বর্ধিষ্ণু নগরীগুলোতে প্রবেশ করি তখন আমাকে গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। অসংখ্য মানুষ দলে দলে আমার অনুগামী হয়, তারা জানতে চায় সাফল্যের পথ; কেউ কেউ ঐশী প্রত্যাদেশ পেতে চায়, আবার কেউ কেউ, যারা বহু দিন ধরে নানা ধরনের রোগে-শোকে ভুগছে, তারা আমার কাছে আরোগ্যের বাণী শুনতে চায়…কিন্তু কেন আমি এসব নিয়ে এত চিন্তা করি, যেন এটা কোনো বিরাট একটি ব্যাপার যে আমাকে নশ্বর মানুষদের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে?
অন্য এক জায়গায় দেখা যায়, তিনি নিজেকে একজন বড় পাপী বলে মনে করছেন যার পাপের প্রায়শ্চিত্ত চলছে : অনিবার্যতার একটি প্রত্যাদেশ আছে, সেটা দেবতাদের এক প্রাচীন অধ্যাদেশ যা শাশ্বত এবং বড় বড় শপথে বাঁধা। সেই অধ্যাদেশটি হচ্ছে, শয়তানদের মধ্যে যখন কেউ নিজের হাত রক্তে রঞ্জিত করে পাপী হয়, অথবা সংঘর্ষের পথে যায় অথবা মিথ্যা শপথ করে, তাকে অবশ্যই আশীর্বাদপুষ্টদের আবাসভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে দশ হাজার বছরের তিনগুণ কাল ধরে ঘুরে বেড়াতে হয়। এই সময়ের মধ্যে নশ্বরদের যাবতীয় রূপে তার বারবার জন্ম হয়, এক জীবনের কষ্টকর পথ বদলে আরেক কষ্টকর জীবনের পথে তাকে অবিরাম ঘুরে ফিরতে হয়ে। মহাশক্তিধর বায়ু তাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে আর সমুদ্র তাকে ছুঁড়ে দেয় শুষ্ক ভূপৃষ্ঠের দিকে; মাটি তাকে জ্বলন্ত সূর্যের কিরণরশ্মিতে নিক্ষেপ করে এবং সে পুনরায় বায়ুর ঘূর্ণিমধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়। একে অন্যের কাছ থেকে তাকে গ্রহণ করে এবং সবাই তাকে প্রত্যাখ্যান করে। এখন তাদের মধ্যকার একজন হলাম আমি, দেবতাদের কাছ থেকে নির্বাসিত একজন ভবঘুরে, কারণ আমি এক কাণ্ডজ্ঞানহীন সংঘর্ষে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। কী তার পাপ ছিল তা আমরা জানি না। সম্ভবত এমন কিছু নয় যা খুব গুরুতর ছিল। কারণ তিনি বলেন : হায়, আমার এ দুই ঠোঁট দিয়ে গোগ্রাসে ভক্ষণ করার মতো মন্দ কাজে মেতে ওঠার আগেই নিষ্করুণ মৃত্যুর দিন এসে কেন আমায় ধ্বংস করল না।…
লরেল পাতা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থেকো…
হতভাগার দল, শিম থেকে তোমাদের হাত দূরে রাখো।…
তাহলে দেখা যাচ্ছে, তিনি লরেল পাতা চিবানো বা শিম গলাধঃকরণের চেয়ে গুরুতর খারাপ কিছু করেননি।
প্লেটোর রচনাবলির মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো সেই অংশটি যেখানে তিনি এই জগৎকে একটি গুহার সঙ্গে তুলনা করেছেন, যে গুহার মধ্যে বসবাসরত আমরা বাস্ত বকে দেখতে পাই না, বরং ঊর্ধ্বালোকে অবস্থিত উজ্জ্বল জগতের বাস্তবতার ছায়া দেখতে পাই। এ রকম রূপকের ধারণা প্লেটোর আগে এডিক্লিসের মধ্যে ছিল; এর উৎস অর্ফিকদের শিক্ষা। এমন কিছু লোক আছে যারা সম্ভবত কয়েক জনম ধরে পাপ থেকে বিরত থাকার ফলে অবশেষে দেবতাদের সান্নিধ্যে অনন্ত শান্তি লাভ করে : কিন্তু অবশেষে তারা নশ্বর মানুষদের মধ্যে ভবিষ্যদ্বক্তা, গীতি-রচয়িতা, চিকিৎসক এবং রাজকুমাররূপে আবির্ভূত হয় এবং সেখান থেকে তারা মর্যাদাবান দেবতা হয়ে ওঠে, যাদের আত্মা ও আসন দেবতাদের সমতুল্য হয়, তারা মানবীয় অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়, নিয়তি থেকে নিরাপদ থাকে এবং তাদের ওপর কোনো আঘাত আসতে পারে না। মনে হয়, এই সবকিছুর মধ্যে এমন কিছু খুব অল্প আছে যা ইতোপূর্বে অর্ফিজমের শিক্ষা ও পিথাগোরীয় মতবাদের মধ্যে দেখা যায়নি। বিজ্ঞানের বাইরে এম্পিডক্লিসের মৌলিকত্ব রয়েছে চারটি আদি উপাদানের তত্ত্বে এবং পরিবর্তনের ব্যাখ্যায় প্রেম ও দ্বন্দ্ব-এই দুই নীতির ব্যবহারের মধ্যে। এম্পিডক্লিস অদ্বৈতবাদ নাকচ করেছেন, তিনি বিশ্বাস করতেন প্রকৃতির গতি নিয়ন্ত্রিত হয় কোনো উদ্দেশ্য দ্বারা নয়, বরং আকস্মিকতা ও অনিবার্যতা দ্বারা। এসব বিবেচনায় তার দর্শন ছিল পারমিনাইডিস, প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের দর্শনের চেয়ে অধিক মাত্রায় বিজ্ঞানভিত্তিক। সত্য যে, অন্যান্য দিকে সে যুগের প্রচলিত কুসংস্কারের প্রতি তার সায় ছিল; কিন্তু তাতে তিনি বর্তমানকালের অনেক বিজ্ঞানীর চেয়েও উন্নত ছিলেন।