এখানে এনো না কোনও ঋণ…
২৯ এপ্রিল।
বাবা? কিচেনে ট্র্যাশ-ক্লোজেটের ওপর ঝুড়িতে আপেল আছে কয়েকটা। বড় দেখে একটা এনে রাখবে?
সকালবেলা। বাথরুমে শাওয়ারের শব্দ। নন্দিন স্নান করে নিচ্ছে। সাড়ে ৭টায় ইয়াস আন্টি তার দুই ছেলে নিয়ে আসবে। তাদের স্কুলে এবং নন্দিনকে কলেজে নিয়ে যাবে। এ-ঘরে যেদিকে তাকাও, অনেকগুলো ছোট-বড় কোয়ার্টজ ঘডি; দেওয়ালে তো বটেই, আলমারিতে, ড্রয়ারে, ডিশওয়াশারে, ওয়াশিং মেশিনে, টয়লেটে, মায় স্টিলের ডট পেনেও—সর্বত্র একটা-না-একটা ঘড়ি সাঁটা। হঠাৎ দেখলে মনে হবে নিশ্চল আমেরিকান আরশোলা সব। শুধু শুড় দুটো নড়ছে। হুশ করলেই এখুনি পালাবে।
তারই একটিতে চোখ রেখে আমি একটু চেঁচিয়ে বললাম, ৭টা ২৫ এখন।
–শ্-শ্-শ্স। আস্তে, বাবা। আই অ্যাভ টোল্ড ইউ দ্যাট অলরেডি। নন্দিন আবার দরজা একটু ফাঁক করে বলল, এখানে কেউ চেঁচিয়ে কথা বলে না বাবা।
আমরা পৌঁছেছি কাল রাত নটা নাগাদ। তাড়াতাড়ি একটু কিছু খাইয়ে দিয়ে, বাড়িটাও ভাল করে না দেখিয়ে, দুজনকে নিজের ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে, কাল অধিক রাত পর্যন্ত নন্দিন আমাদের দুজনকে আমেরিকান সহবত সম্বন্ধে অনেক তালিম দিয়েছে, যে-সব উপদেশের অধিকাংশের শুরু এখানে কেউ দিয়ে। যেমন,
এখানে ভদ্রলোকরা কেউ সিগারেট খায় না। বিশেষ করে পুরুষরা কেউ খেলে এরা গার্ডেনারফার্ডেনার ভাবে। বুঝলে বাবা? বিশেষ করে ব্ল্যাকরা খেলে। তোমরা পিছনে সুইমিং পুলে গিয়ে খেয়ে আসবে।
এখানে কেউ সবার সামনে হাঁচে না। খুব অভদ্রতা। আর অন্য কেউ যদি হেঁচে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে বলবে গড় ব্লেস ইউ। বুঝলে বাবা?
তারপর ধরো, কেউ ছোটকাকা-কাকিমার ব্যাপারে সমবেদনা জানাল তোমাকে, সঙ্গে সঙ্গে বলবে আই অ্যাপ্রিসিয়েট, বুঝলে বাবা?,থ্যাঙ্ক ইউ বোল না, গ্রেটফুল এখানে কেউ বলে না, কাউকে প্রাণে বাঁচালেও। চাকর ভাববে। বুঝলে বাবা?
আর খবর্দার, ফোনে বা সাক্ষাতে কাউকে মিঃ বা মিসেস বলবে না। বলবে, হাই জনি। বা, হাই কিটি। যার যা নাম। বুঝলে বাবা? তা সে যত বুড়ো-বুড়ি বা ছোঁড়াছুঁড়িই হোক।
কাল রবিবার। কাল সকাল থেকেই অনেক মোনার আসবে। তাদের সঙ্গে ঠিকমত কথা বলবে, নইলে, কী ইম্প্রেশন হবে তাদের ছোটকাকার ফ্যামিলি সম্বন্ধে, বল তো?
এতগুলো ব্যাপার একসঙ্গে পয়লা রাতে না বুঝতে পারলেও একটা ব্যাপার বুঝতে অসুবিধে হয় ন! ৷ এক বছর বলার চান্স পায়নি। চুটিয়ে বাবা বলে নিচ্ছে নন্দিন। কারণে, অকারণে।
লেদুনন্দিনের থেকে বছর ছয়েকের বড়। কিন্তু নন্দিনের সঙ্গে ওর ব্যবহার সমবয়সীর। বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে। তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়েছে। বাবার ব্যবসা কন্ট্রাক্টরি করে। লেদু বলল, থাম তো তুই। আর শেখাতে হবে না। এখন এক গ্লাস জল দে দেখি।
ঘরের মধ্যে ওর প্রায় দ্বিগুণ উঁচু একটা ফ্রিজ খুলল নন্দিন। ফুট জুস আর কোল্ড ড্রিঙ্কে ঠাসা। পেপসি কোলার একটা জ্যারিকেন বের করে সে টেবিলের ওপর এনে রাখে। এক গ্লাস গড়িয়ে লেদুর সামনে রেখে গম্ভীরভাবে বলে, এখানে কেউ জল খায় না। মিনারেল ওয়াটার খায়। জল চাইলে, গাঁইয়া ভাববে। ভূত ভাববে। সে দাদার টাকে একটা আদুরে চাঁটি মেরে বলে, বুঝলে লেদধুস!
তাই নাকি! জল খায় না, শুধু পেপসি আর সেভেন আপ? চোখ বড় বড় করে লেদু ওর দিকে সপ্রশংস চোখে তাকিয়ে। আমি বুঝতে পেরেছি, আসলে লেদু এসেছে আমেরিকায় তার স্বপ্নের দেশে। তাদের বড়লোকী দেখতে। প্লেনে ওঠার পর থেকেই তার হাবভাব বদলাতে শুরু করেছে। প্লেনে চিজ-মাখন-প্যাস্ট্রি যখন যা দিয়েছে ছোটখাটো প্যাকেজে, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখেছে আর উচ্ছ্বসিতভাবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে গেছে, দ্যাখো, দ্যাখো খাঁটি ডেনিস প্যাস্ট্রিজেনিভার মাখন—একটু টেস্ট করে দ্যাখোনকাকা! হুইস্কির ছোট্ট উপহার-বোতলগুলো চেয়ে নিয়েছে। বারবার। প্লেন যত এগিয়েছে, তত তার উত্তেজনা বেড়েছে। এয়ার ইন্ডিয়ায়, সে যখন গীত গাতা চল দেখার জন্য সামনের দিকে ভাল সিটে উঠে গেল, তখনও কিছু বলিনি আমি। ভেবেছিলাম, আহা, বয়স কম, প্রথম জেট প্লেন, প্রথম আমেরিকা—এমনটা তো হবেই কিছুটা। তবু, টোকিও থেকে জাপান এয়ারলাইন্সে উঠে সে যখন ডিনারের পর সিটে লাগানোইয়ারফোনে ছয়-চ্যানেলের গান শুনবে বলে আড়াই ডলার পে করতে যাচ্ছে, তখন তাকে মনে না করিয়ে দিয়ে পারিনি, শুনবে শুনুক, কিন্তু সে যেন ভুলে না যায় যে সে বা তারা কী জন্যে, কী উপলক্ষে কোথায় যাচ্ছে। তখনকার মতো গান শুনল না বটে লেদু, কিন্তু লাঞ্চের পর বেভার্লি হিল কপ-টু দেখবে বলে সামনের ব্লকে সোজা চলে গেল। আমাকে না বলে। কপ-ওয়ান তার কলকাতায় দেখা। সেই টোকিও এয়ারপোর্টে যা এককাপ কফি আড়াই ডলার দাম দিয়ে, তারপর বা আগে আমি একদিন দুরাত্রি জল ছাড়া কিছু খাইনি। খেতে পারিনি। পাশে বসে কেউ যদি খচর-কচর করে চিবিয়ে যায়, একটু অশ্লীল বা জান্তব আমার লাগারই কথা। প্লেনে লেদু আগাগোড়া তাই করে গেছে। কপ-টু দেখতে দেখতে সোৎসাহে উঠে এসে লেদু যখন বলল, নকাকা, ইন্টারন্যাশনাল ডেট লাইন ক্রশ করছে। ঘড়ি মেলাও, ঘড়ি মেলাও… শোক অথবা ঘুমের আচ্ছন্নতা থেকে জেগে উঠে, জল ছেড়ে অনেক দূর ডাঙার ভিতরে চলে আসা শামুকের মতো খোল থেকে বিষাদমাখা মুণ্ডু বের করে আমি তাকে না বলে পারিনি, লেদু, তুই কি শোকের টিকিট কেটে ডগমগপুরে যাচ্ছিস..
সত্যি কে বলবে এই সেই লেদু, কঘণ্টা আগেও যে ওভাবে হামাগুড়ি দিয়ে আমাদের ফ্ল্যাটে উঠে এসেছিল! লেদু বলল, আরে, শোক-ফোকের ব্যাপার নয়। এটা ইন্টারন্যাশনাল ডেট লাইন! একটা দিন হারিয়ে যাচ্ছে তোমার সারা জীবন থেকে… বলে সে অপ্রস্তুতভাবে কেন এমন হয় তা বোঝাতে বোঝাতে সিকোর মস্ত ঘড়ি দেখে নিজেরটার কাঁটা ঘোরাতে লাগল। এক্কেবারে ভুল। ডেটলাইন ব্যাপারে হাস্যকর তার ধারণা। এ বিষয়ে কিছু জানা না থাকলেও আমি বুঝতে পারলাম। যেমন বুঝতে পারলাম, সার্ভেন্টিসের মূল বইটি পড়া না থাকলেও, বিবেকবান দ্বিধাগ্রস্ত ডন কুইকজোটের সঙ্গে আসলে চলছে মাঠো, নির্বোধ অথচ প্র্যাগম্যাটিক এক সাঙ্কো পাঞ্জা। পারলে, একটা চড় কষাতাম তখন লেদুর গালে।
গত এপ্রিলে হায়ার সেকেন্ডারি দিয়ে নন্দিন আমেরিকা বেড়াতে যায়। আমার আর নন্দিনের টিকিট এসেছিল। চিনুর আসেনি বলে আমি যাইনি। ওখানে ৮ মাসে টেথ গ্রেড পাস করে, মাস দুই হল সে নিউট্রিশন মেজর নিয়ে মার্সে কাউন্টি কলেজে ঢুকেছে। রঞ্জনের ইচ্ছে ছিল নন্দিন ডায়াটিসিয়ান হয়ে ওর অলিভ মেডিকেল সেন্টারে ঢোকে।
অঞ্জন পাবলিক স্কুলে পড়ে। স্কুল যায় সকাল ৭টায়। সে পড়ছে টেন্থ গ্রেডে। যাওয়ার আগে দরজায় টোকা মেরে বাংলায়, নন্দিন তোমার সাতটার সোময় হয়েছে বলে জাগিয়ে দিয়ে গেছে। অর্থাৎ, তার কলেজ যাওয়ার সময়।
আজই প্রথম ও স্কুলে আর আমি কলেজে যাচ্ছি বাবা। গত সপ্তাহেও কাকিমা ডেকে তুলেছিল। বাথরুমের দরজা বন্ধ করার আগে দাঁত মাজতে মাজতে নন্দিন আমাকে জানাল।
সত্যি, মস্ত ঘরখানা নন্দিনের। উঁচুতে, তিন দেওয়াল জুড়ে ক্লোজেট। একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো। বহুদিন ব্যবহার হয়নি বোঝা যায়। বেকার দাঁড়িয়ে থেকে থেকেই বুঝি পা চারটি অমন বেঁকে গেছে। বিশাল ডালার ওপর নন্দিনের বইপত্র থেকে কালার এবং হোয়াট নট। এমনকি, একটি হেয়ার-কন্ডিশনার। ড্রায়ার ও ওয়াশিং মেশিনও এ-ঘরেই। এত বড় ঘরে জানালার ধারে মাত্র একটা ছোট্ট সিঙ্গল বেড দেখে লেদু আমরা শোব কোথায় জানতে চাওয়া মাত্র কেন, এইখানে বলে ছুটে গিয়ে চার-পাঁচজনে বসার সোফাটার নিচে একটা রড ধরে টানতে টানতে, সোফা গদিটদি সাজিয়ে, মায় চাদর-ব্ল্যাঙ্কেট-বালিশ সব পেতে মিনিট দুয়েকের মধ্যে নন্দিন একা-একাই সেটাকে পরিণত করেছিল একটি আকর্ষণীয় ডাবল বেডে। লেদু এখনও সেখানেই ঘুমুচ্ছে।
মেয়ের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় কাল থেকে অনবরতই পাচ্ছি। বুঝছি যে, সেনন্দিন আর নেই যার এক-একটি হাই তুলতে লাগত ৩০ সেকেন্ড। ঘড়ি দেখে তবু বললাম, কীরে, পারবি তো? এখন ৭টা ২৫।
পারতেই হবে বাবা। কালো জিনসের স্কার্ট আর কালো সিফনের ফ্রিল-দেওয়া জামা পরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে নন্দিন বলল, সাড়ে সাতটা মানে এখানে সাতটা ঊনত্রিশ, সাতটা একত্রিশ কখনওই নয়। সাত ঊনত্রিশে ওই চায়না বেরি গাছটার নিচে আমাকে দাঁড়াতে হবে।
এর মধ্যে পারবি?
আন্টি ড্রাইভওয়ের ওই দিক দিয়ে ঢুকবে আর এই দিক দিয়ে বেরিয়ে যাবে। মাঝখানে একবার শুধু আমার জন্যে দরজা খুলবে। পারতেই হবে বাবা।
রাস্তার দিকে বিশাল গ্লাস প্যানেল। দুদিকে নস্যি-রঙের প্রগাঢ় পর্দা টানা। পর্দা দুদিকে সরে যাওয়ার পর গ্লোব সিনেমার প্যানোরামিক স্ক্রিনে যেমন, জানালার কাচে এখন ফুটে রয়েছে একটি মূলত সবুজ, রোদ ঝলমলে চলচ্ছবি। দূরে, বেয়ারক্রিক খালের (নন্দিন বলেছে নদী) ওপর সেতুর এপারে সাদা রঙের কাঠের গেট পর্যন্ত দেখা যায়। সেখান থেকে শুরু হোয়াইট গেট ড্রাইভের। দু লেনের লম্বা রাস্তা জুড়ে সাদা ফুলে ভরা এখনও নাম-না-জানা বিদেশি গাছের সারি দুধারে। মাঝে মাঝে একটা গাড়ি বাঁক নিচ্ছে, ব্রিজ থেকে নেমে এই দিকে ছুটে নিঃশব্দে আসছে। বাড়ি সাউন্ড প্রুফ। ড্রাইভারের সিটে নারী-পুরুষ যেই বসে থাক, তখন থেকে দেখছি সকলেই এই বাড়িটার দিকে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছে। লাল কস্টিউম পরে স্বর্ণকেশী শ্বেতাঙ্গিনী এক জগ করতে করতে বাড়ির সামনে দিয়ে ছুটে গেল, শুধু সে কেন, তার সঙ্গী পোলকা-ডট গ্রেট-ডেনটাও, ছোটা অব্যাহত রেখে, এদিকে কয়েকবার ভীতভাবে তাকায়। যেন সেও জানে মাত্র ৪ দিন আগে কী ভীষণ ভূমিকম্পে ভেঙে গেছে এই বাড়িটা, যদিও আপাতদৃষ্টিতে অটুট দাঁড়িয়েও রয়েছে।
এই সেই হোয়াইট গ্রেট ড্রাইভ, ২৮৫৬ নং। ক্যালিফোর্নিয়া-৯৫৩৪০। গত ১২ বছরে এই ঠিকানায় কত চিঠি, কত কার্ড যে পাঠিয়েছি তার হিসেব নেই। এক বছরে সপ্তাহে দুটো করে নন্দিনের কাছেই শখানেক চিঠি এসেছে। এই সেই ২৮৫৬ হোয়াইট গেট, যে ঠিকানায় সুমিতাকে পাঠানো হারমোনিয়ামটা, হায়, শেষ পর্যন্ত পৌঁছল না।
পোল থেকে একটা গাড়ি নামতে দেখেই ওই আসছে বলে ব্যাগ কাঁধে তুলে নিয়ে, আপেলহাতে নন্দিন ছুটতে শুরু করল, আমি ফোন করব তোমাকে। কলেজ থেকে।
হাই আন্টি, হাই আঙ্কল বলতে বলতে সে ছুটে কিচেন পেরোচ্ছে, আমি শুনতে পেলাম। ছন্দা-অমিয় তাহলে উঠে পড়েছে। আমার এবার বাইরে বেরনো উচিত। কাল রাতে ওদের সঙ্গে আলাপ ছাড়া বিশেষ কোনও কথা হয়নি। ওরাই তাড়াতাড়ি শুতে বলেছিল।
গাড়ির কাচ খুলে নন্দিন হাত নাড়ল। হাত নাড়ল ইয়াসও। ওই যে ওদের ছেলেমেয়েরাও হাত নাড়ছে। গাড়িটা হোয়াইট গেটের মুখে বাঁক নেওয়ার আগে পর্যন্ত আমি জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। বোধহয় ক্যাডিল্যাক।