এখন যুদ্ধের তৃতীয় মাস
যুদ্ধের আটাশ বছর পর, মরিয়মের সাক্ষাৎকার যে গ্রহণ করে, অর্থাৎ মুক্তি, সে স্বর্গধামের পতনের রাতটির ওপর মোটা করে হলুদ মার্কারে দাগ টেনে মার্জিনে লেখে—‘দুর্ভাগ্যের সূচনা?’ প্রশ্ন চিহ্নটা শেষ পর্যন্ত থেকেই যায়। কারণ প্রশ্নগুলো জটিল আর উত্তরটা সহজ–বিষয়টা ওর কাছে এমন ছিল না। কারো কারো মনে হতে পারে, মরিয়মের দুর্ভাগ্যের শুরু মহুয়া সিনেমা হল থেকে, যেখানে ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী এক তরুণ, পর্দায় লাভসিন দেখে তার হাত চেপে ধরেছিল। কিংবা ভাবা যাক–যুদ্ধ বাধার ঠিক দুদিন আগে, সে যখন মন্টুকে বাড়ি পাঠিয়ে টিউবওয়েলের নর্দমায় আধখানা ইটের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল–সেই মুহূর্তটি। যা মরিয়ম নিজেই দুর্ভাগ্যের সূচনা হিসেবে শনাক্ত করেছিল। হয়তো আলাদা করে এসবের কোনোটাই নয়। মরিয়মের জীবন এ সমস্ত কিছুরই যোগফল। মুক্তির আরো মনে হয়, এ ক্ষেত্রে মেরি প্রকারান্তরে মরিয়ম একটি উদাহরণ মাত্র। তার দুর্ভাগ্যের কারণ হয়তো নারীর প্রজনন অঙ্গটি, যা বংশরক্ষার সূচিমুখ-এর পবিত্রতা। যা শুধু একজন পুরুষের ব্যবহারের জন্য এবং বৈধভাবে। সেটি অরক্ষণীয় হয়ে পড়ে যুদ্ধের বছর। শত্রুর পুরুষাঙ্গ তাতে ঢুকে পড়ে। বীর্য ডিম্বাশয়ে চলে যায়। জ্বণ দ্রুত বাড়তে শুরু করে। স্বাধীনতার পর বিশেষ অধ্যাদেশ জারি করে গর্ভপাত ঘটানোর পরও নারীদেহের পবিত্রতা পুনরুদ্ধার হয়নি।
এসব অবশ্য পরের কথা।
যুদ্ধের এখন তৃতীয় মাস। ফুলতলি গ্রাম আর কত দূর বা ওখানে কোনো দিন পৌঁছানো যাবে কি না মরিয়ম তখনো জানে না। সে রমিজ শেখকে সঙ্গে নিয়ে স্বর্গধামের অনুরূপ একটি বাড়ি খুঁজছে। পরিত্যক্ত, জনহীন, ঐশ্বর্যময়। তারা যেসব জনপদের ওপর দিয়ে যায়, সেখানে দু-চারটা খালি ঘরবাড়ি আছে বটে, সেসব হতদরিদ্র, বসবাসেরও যোগ্য নয়। জানালা-দরজা-বেড়ার চিহ্নমাত্র নেই, চালটুকু শুধু শূন্যে ঝুলে আছে, ভিটাবাড়ির আশপাশে আগাছার জঙ্গল, দিনের বেলা পুকুরপাড়ে শিয়াল ডাকে, বসতবাড়ির কড়িকাঠে পাচা ডিগবাজি খায়, আর উঠানে ঢোকার পথটা শ্যাওলা জমে এমন পিচ্ছিল যে, হাঁটতে গেলে হাত-পা ভাঙার উপক্রম হয়। তবু মরিয়ম আর রমিজ শেখ আশা ছাড়ে না। যুদ্ধ শুধু দু’হাতে নেয় না, দেয়ও। তা না হলে তারা স্বর্গধাম পেয়েছিল কীভাবে! তবে চলার পথে অহেতু ঝঞ্ঝাট কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই যথাসম্ভব মানুষের ছায়া এড়িয়ে চলে। ভুলক্রমে গৃহস্থবাড়ির কাছে। গেলেই ‘কিডা যায় রে, দেখ দিকিনি’ বলে মানুষজন হাঁকডাক জুড়ে দেয়। তখন একথা-সেকথা বলে ছাড়া পেতে অযথা সময় নষ্ট হয়। সেই তুলনায় ফসলের মাঠ নিরাপদ। যুদ্ধের দিনে খেতে যারা কাজ করে, পেটের দায়েই করে। সেখানে বাড়তি কথা বলার সুযোগ কম। তার মধ্যে হঠাৎ দূরের ধানখেতে প্রথম একটা মাথাল, পরে আস্ত মানুষটা মাথা তুলে দাঁড়ায়, ‘আপনেরা যাচ্ছেন কনে-এ-এ, কোথা থেইক্যে আসা হচ্ছে-এ?’ লোকটা দু-দুবার চাচানোর পর আর চুপ থাকা যখন ভালো দেখায় না, তখন রমিজ শেখ সামনের গ্রামটার নাম জানতে চায়। কৃষক দিগন্তের দিকে ঈদের চাঁদের মতো হাতের কাস্তে উঁচিয়ে বলে, ‘ওই-ওইটা হলো গে রাধানগর, মিলিটারিরা পুইড়ে ছাই করে দেছে। তার পরের গিরামের নাম নতুনগাঁও। ওই গিরামে মানুষজোন পালিও পাতি পারেন।’
নতুনগাঁও, রাধানগর নামগুলো কেমন চেনা লাগে মরিয়মের। আজ থেকে বছর তিরিশ আগে তার বড় ফুপু সাহার বানুর বিয়ে হয়েছিল রাধানগর মুন্সিবাড়ি। বিয়ের বছর ঘুরতে-না-ঘুরতে গুটিবসন্তে ফুপুটা মারা যায়। মেরি তাকে দেখেনি। সে স্কুল ফাঁকি দিলে বা পড়ালেখা করতে না চাইলে কফিলউদ্দিন আহমেদ দুঃখ করে ছোট বোন সাহার বানুর কথা বলতেন। সাহার বানুর নাকি লেখাপড়ায় খুব মাথা ছিল। বিয়ের পর ফিরানির সময় যে ট্রাংকে করে সে বইখাতা নিয়ে যায়, এক বছরে পড়ালেখা দূরে থাক, একবার এর তালা খোলারও সুযোগ পায়নি। সাহার বানুর মৃত্যুর পর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা শাড়ি-কাপড়, গয়নাগাটি রেখে তালাবন্ধ ট্রাংকটা শুধু ফুলতলি গ্রামে ফেরত পাঠিয়েছিল। কারণ সেইকালে রাধানগর মুন্সিবাড়িতে বউ ঝিদের লেখাপড়ার রেওয়াজ ছিল না।
কিছুদূর হাঁটার পর রাধানগর গ্রাম ছাড়িয়ে তারা নতুনগাঁওয়ে পৌঁছায়। সেখানকার মানুষগুলো উড় উড়। তাদের এক পা বাইরে, আরেক পা ঘরে। রমিজ শেখের কাঁধে রাইফেল দেখে তারা ইঁদুরের মতো চোঁ-চো পালাতে শুরু করে। সে মুক্তিযোদ্ধা কি রাজাকার, তাতে কিছু যায়-আসে না। মুক্তিফৌজের গন্ধ পেয়ে দু’দিন আগে পাকসেনারা পাশের গ্রাম শশ্মশান বানিয়ে রেখে গেছে। এদিকে রাজাকারের উৎপাতে তারা নিজেরাই অতিষ্ঠ। এ অবস্থায় রমিজ শেখ যে মুক্তি বা রাজাকার নয়, সমানে ডাকহক ছেড়ে জনে জনে তা বোঝতে শুরু করে।
‘তো ভাইজান,’ পনেরো-ষোলো বছরের একটি ছেলে, যার বন্দুক হাতে যুদ্ধ করার শখ, সে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে ‘রাইফেলটা কেন সঙ্গে রাখিছেন, আমারে দেন দিকি! আমি চালাই।’ বলেই থাবা মেরে নিয়ে যায়।
এমন জবরদস্ত অভ্যর্থনার জন্য মরিয়ম বা রমিজ শেখ কেউ প্রস্তুত ছিল না। যদিও অস্ত্রটা এযাবৎ তাদের কোনো কাজেই লাগেনি, তবু লোকটাকে একই সঙ্গে তা পরিচিত করেছে মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজাকার হিসেবে। পাকিস্তান জিন্দাবাদ আর জয় বাংলা স্লোগান দুটি এখন রমিজ শেখের সড়গড়। কিন্তু কোনটা কোথায় বলতে হবে-বুঝতে পারছে না। হয়তো পারত পুরো নয় মাস সময় পেলে। এখন সবে যুদ্ধের তৃতীয় মাস।
বন্দুকটা হারিয়ে রমিজ শেখ নতুনগাঁওয়ে অসহায় হয়ে পড়ে। আগের মতো সে যেন আবার জেলখানায়, হাত-পা ঝাড়া, নিজের বলতে কিছু থাকল না। পুরোনো অভ্যাসমাফিক এক কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার বলতে থাকে। মেরি কেন স্বর্গধাম থেকে তাকে নিয়ে এল, একদঙ্গল মেয়ে আর পুরুষ দুজনকে খেদিয়ে রাজা-রানির হালে তারা থাকতে পারত ওখানে। কিন্তু জেলখানার মতো লোহার গরাদ ধরে এক কেচ্ছা দশবার শোনার শ্রোতা নতুনগাঁওয়ে নেই। অস্ত্র কেড়ে নিলেও গ্রামের চৌধুরী বাড়িতে তাদের রাতের খাবার আর আশ্রয় জোটে। তারপর গ্রামের মেয়েরা মরিয়মকে নিয়ে পড়ে আর হাতে একখানা লাঠি দিয়ে রমিজ শেখকে পাঠিয়ে দেয় হাফ ডজন জোয়ান মরদের সঙ্গে গ্রাম পাহারা দিতে।
টেঁটা-বল্লম, রামদা, লাঠি হাতে হাঁক ছেড়ে নতুনগাঁওয়ের লোকেরা যেন চর দখল করতে যাচ্ছে, এমনই তাদের হাবভাব, প্রস্তুতি। বা পাকা ধানখেতের ছিঁচকে চোর ধরতে যাচ্ছে যেন। রমিজ শেখ মনে মনে হাসে-গ্রামের লোকেরা কী বোকা, পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে এসব অস্ত্র দিয়ে হবে গ্রাম পাহারা! ছয়জন পাহারাদারের মাঝখানে নিজেকে তার বেশ চালাক মনে হয়। বন্দুকটা খোয়ানোর দুঃখ সে ভুলে যায়। গড়গড়ায় টান দিতে দিতে খেতের আইলে বসে নানান কথা বলতে ইচ্ছে করে।
হাফ ডজন পাহারাদার, রমিজ শেখের শহরে মেয়ে আর মুরগি পাকসেনাদের ভেট দেওয়ার কেচ্ছাটা বিনাবাক্যে হজম করে। কিন্তু হাজি সাহেব যে দেশপ্রেমিক নাগরিক, তা তারা মানতে রাজি নয়। তারা বলে, লোকটা বেইমান-মুক্তিরা পেলে তাকে জ্যান্ত কবর দেবে। কেন? রমিজ শেখ ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। সে জানে, বিশেষত মেয়েদের জোরজবরদস্তি বা কৌশলে আর্মির হাতে তুলে দেওয়াটা খারাপ কাজ। এর কারণ হাজি সাহেবের কাছে একদিন সে জানতেও চেয়েছিল। হাজির ব্যাটা পরহেজগার মানুষ, ধর্মের পথছাড়া এক কদম চলেন না। ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘দেখ। রে বাজান, পূর্ব পাকিস্তানটা এখন শত্রুর দেশ, আর মেয়েরা হইলো গিয়া গনিমতের মাল। যুদ্ধের ময়দানে তাদের ভোগ করার কথা আল্লার কালাম পাকে বলা আছে। তাতেও যখন শ্রোতার মন গলে না, তার শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখটা নেমে আসে রমিজ শেখের মুখের কাছে। যাকে রাতের অন্ধকারে কয়েদির পোশাক পাল্টিয়ে নিজের একপ্রস্থ কাপড় পরিয়েছেন, শয্যা পেতে দিয়েছেন ত্যাজ্য পুত্রের বিছানায়-আশ্রয়দাতার অগোচরে তার কিছু থাকতে পারে না। তিনি পরপর দু’দিন জেরা করে কয়েদির অপরাধ-বৃত্তান্তের প্রায় সবটুকু জেনে নেন। তারপর যখন দেখলেন সে দাগি, তা আবার খুনের মামলার, সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলেন, সে-ই হবে এই অবিশ্বাসের দুনিয়ায় তার বিশ্বস্ত অনুচর। নিজের অপরাধ জানাজানির ভয়ে বাকি জীবন দড়ি-বাঁধা কুকুরের মতো পায়ের কাছটায় পড়ে থাকবে। ভুলেও কুঁই কুঁই করবে না। তবে এখন যুদ্ধের সময়–তিনি নিজেকে প্রবোধ দেন, সওয়াল-জবাব করতে মন চাচ্ছে যখন কুকুরটার, বাধা দিলে পালিয়ে যাবে। হাজি সাহেবের আনত মুখের লালা ছিটকে পড়ে রমিজ শেখের চোখে-মুখে। রাগ চাপতে গিয়ে তার দু’টি দাঁত প্রবল ঘর্ষণে কিড়মিড় করে, ‘কী হালার পো, নিজে বউ ছাড়া থাকতে পারলি না, বয়ে আনতে গেলি–হা-হা । অরা থাহে ক্যামনে-ক দেহি? হাজার মাইল দূরে বউ-বাচ্চা–মাইয়্যা মানুষ ছাড়া থাহে ক্যামনে, ক দেহি?’ বলে বাপের বয়সি মুরুব্বি রাগ আর গায়ের জোর মিশিয়ে লুঙ্গির ওপর দিয়ে রমিজ শেখের পুরুষাঙ্গটি খপ করে ধরেই মুচড়ে দিলেন। রমিজ শেখ চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে হাজির বাহাস্ শোনে, ‘লাঠিটা খালি তোর একলারই, অগোর নাই!’
পাহারাদারদের কথামতো এখন হাজি সাহেব যদি শাস্তি পান, তার কী হবে। সে নিজেও তো বউ বাপের বাড়ি থেকে আসতে চায়নি বলে গলা টিপে ধরেছিল-নরম তুলতুলে জানটা জিব ঠেলে তার করতলে ছটফটিয়ে বেরিয়ে আসা পর্যন্ত। জেরা করার সময় উকিল সাহেব আদালতকে জোড়হাতে বলেছিলেন, হুজুর, আমার মক্কেল নির্দোষ, সে জানত না যে, সামান্য রঙ্গ-তামাশায়, তার বিবাহিত স্ত্রী, প্রাণের পুতুলি বেঘোরে প্রাণ হারাবে। আমার মক্কেল হুজুর স্ত্রী-অন্তপ্রাণ। রাতের পর রাত ঘুমাতে না পেরে, আমার মক্কেলের হুজুর, মাথায় বায়ু চড়ে যায়। এটা ঠান্ডা মাথার খুন নয়, এর। পেছনে ভালোবাসার বাড়াবাড়ি ছাড়া অন্য কোনো মোটিভ ছিল না–আদালতের কাছে তা প্রমাণ হয়। তাই মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে, মহামান্য আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। অথচ এর দুই বছর মেয়াদ থাকতে সে পালিয়ে এল জেলখানা থেকে। যুদ্ধের মাপে রমিজ শেখ জানে, এটা কোনো অপরাধই নয় এখন। এমনকি ঠান্ডা মাথায় বউ খুন করাটাও। এসবের জন্য এখন আদালত বসে না। উকিল-মোক্তারকে পয়সা খাওয়াতে হয় না। তাদের ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে আগের মতো ভিটেবাড়ি বন্ধক দিতে হয় না। এখন বেঘোরে মানুষ মরছে, কে কাকে মারছে হিসাব নাই। অথচ এই বোকা লোকগুলো বলছে, হাজি সাহেবকে মুক্তিবাহিনী হাতের কাছে পেলে জ্যান্ত কবর দেবে, মেয়ে আর মুরগি আর্মির হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। ফের হাসি পায় রমিজ শেখের। কিন্তু সে হাসে না।
নতুনগাওয়ের লোকগুলো, যারা আর্মির হামলা থেকে গ্রাম রক্ষার জন্য টেটা-বল্লম হাতে পাহারায় নেমেছে, তারা রমিজ শেখের ওপর বিরক্ত হয়। আজকের দিনে কে মোনাফেক-বেইমান আর কে দেশপ্রেমিক, তা-ও যদি ভেঙে বলা লাগে! কী রকমের বেকুব সে? হাজি লোকটা তো এখন শহরে বসে রাজাকারি করছে, মুক্তিরা হাতের কাছে পেলে তাকে যে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে–এমন সোজা কথাটাও যে উজবুক বোঝে না, তাকে বোঝাবে কে? ছয়জন পাহারাদার অন্ধকারে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। এর মধ্যে একজন হঠাৎ খেপে উঠে বলে, ‘তোমার হাজি সাহেব হলো গিয়া মিরজাফর–বেইমান, নিমকহারাম। দেশটা যে বেচি দেছিলো ইংরেজের কাছে–সে খেয়াল আছে?’ সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন হায় হায় করে ওঠে, ‘সত্যি সত্যি বেচে তো দিল, যুদ্ধ তো সে করল না। পলাশীর আম্রকাননে কাঠের পুতুলের মতো খাড়ায় থাকল, ব্যাটা সিপাহসালার!’ তারা হাজি সাহেবকে মিরজাফরের জায়গায় ঠেলে দিয়ে কিছুটা ভারমুক্ত হয়। মনে মনে নিজেদের বুদ্ধিরও তারিফ করে। বাকি থাকেন দেশপ্রেমিক সিরাজউদ্দৌলা।
ফি-বছর শীতকালে নতুনগাঁওয়ের স্কুলমাঠে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পালা মঞ্চস্থ হয়। ভাটি অঞ্চল থেকে আসে নবরত্ন অপেরা। তারা মাটি খুঁড়ে তাঁবুর খুঁটি পেতে, প্যান্ডেল খাটায়। রাতের দ্বিতীয় প্রহরে হ্যাঁজাক জ্বেলে যাত্রা শুরু হয়। চলে সকাল পর্যন্ত। কিন্তু পুরোটা কখনো শেষ হয় না। প্যান্ডেলের ফাঁক দিয়ে সূর্যকিরণ হামা দিয়ে মঞ্চে উঠলে দর্শকরা যাত্রাপার্টির গোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে বাড়ি ফেরে। পরদিন অসমাপ্ত পালা দেখার জন্য ফের স্কুলমাঠে জড়ো হয়। ঘামে ভেজা শ্রমের টাকায় টিকিট কেনে। অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করে নবাব সিরাজউদ্দৌলার দরবারে আগমনের, গায়ের লোম কাঁটা দেওয়া সেই দৃশ্যটির, যেখানে নকিব চোঙা ফুঁকে ঘোষণা দেবে, ‘নবাব মনসুর-উল-মুলক সিরাজ-উ-দ্দৌলা শাহ্কুলি খাঁ মির্জা মুহাম্মদ হায়বতজঙ্গ বা-হা-দু-র।’ তখন তাদের বুকের ছাতি ঢোলের মতো ফুলে ওঠে নবাবের গর্বে। নামটা আরো লম্বা হলে গর্ব আরো বেশি হতো। বুকটা ফুলে হতো দ্বিগুণ। নিজেদের ছোট ছোট অকিঞ্চিৎকর নামগুলো বাষ্পের মতো বাতাসে মিলিয়ে যায়। একবার তো ‘চেয়ে দেখুন বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা’ ডায়লগটা দেওয়ার সময় নবাবের গোঁফের একপাশ খুলে ঝুলে পড়েছিল। দর্শকরা হেসে ওঠেনি, শিস দেয়নি। তারা যেন মুর্শিদাবাদ রাজপ্রাসাদের ষড়যন্ত্রের আলো-আঁধারে বন্দি। সিরাজউদ্দৌলার মতোই সংকট তাদের বাঁচা-মরার, জয়-পরাজয়ের। বা তার চেয়েও বেশি–কারণ সিরাজ তো জানতেন না, আর তারা জানে যে, তিনি যুদ্ধে পরাজিত হবেন, রাজ্য হারাবেন, নির্মমভাবে মৃত্যু হবে বাংলার শেষ নবাব, কমবয়সি, দুঃখী সিরাজউদ্দৌলার। তারা এ-ও জানে যে, রাতের পর রাত যাবে, পালা শেষ হবে না, নবাবের অবধারিত মৃত্যুদৃশ্য বুকে পাষাণ বেঁধে তাদের সইতে হবে না। যাত্রার এই পর্বে তখনো তিনি জীবিত। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝখানে দোলায়মান। দরবারে উপস্থিত–মিরজাফর, রাজবল্লভ, জগৎ শেঠ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, ইংরেজ কোম্পানির প্রতিনিধি ওয়াট্স। মঞ্চের নিচের একপাশ থেকে গুমগুম ড্রামের আওয়াজ ছুটে এসে দর্শকের বুকে বাড়ি মারছে। বেলের আঠা খুলে ঝুলে পড়া গোঁফ টেনে বসাতে বসাতে নবাব আগের সেই কম্পিত গলায় বলছেন, ‘বাংলার শ্যামল প্রান্তরে আজ রক্তের আলপনা। জাতির সৌভাগ্য সূর্য আজ অস্তাচলগামী। শুধু সুপ্ত সন্তান শিয়রে রুদ্ধমানা জননী–নিশাবসানের অপেক্ষায় প্রহর গণনায় রত। কে তাকে আশা দেবে? কে তাকে ভরসা দেবে? কে তাকে শোনাবে জাগরণের সেই অভয়বাণী? ওঠো, মা ওঠো। মোছো তোমার অশ্রুজল। সাত কোটি বঙ্গসন্তান হিন্দু-মুসলমান। আজ জীবন দিয়ে রুখব আমরণের এই অভিযান।’
মেঘের পর মেঘ জমছে। রাতের পৃথিবী মসিমাখা, তিমির বর্ণের। অদূরে শত্রুর ছাউনি। শিয়াল ডাক ছেড়ে রাতের প্রহর ঘোষণা করছে। প্যাচা অমঙ্গলের সংকেত জানাচ্ছে গাছের মগডাল থেকে। ছয়জন পাহারাদার যেন পলাশীর অন্ধকার প্রান্তরে দণ্ডায়মান। হাতে তাদের টেটা-বল্লম, রামদা। মুখে আমরণের অভিযানের দীপ্ত শপথ। বুকের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে বিদেশি শত্রুর হাত থেকে দেশটাকে রক্ষা করবে। তারা হচ্ছে দেশপ্রেমিক, অতীতের নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিশ্বস্ত অনুচর-মিরমর্দান আর মোহনলাল।
রমিজ শেখ দেশপ্রেমের গাম্ভীর্য ও শহিদি উদ্দীপনার মাঝখানে উশখুশ করে। অদ্ভুত তো এই নতুনগাঁওয়ের মানুষগুলো! সিরাজউদ্দৌলা ভর করেছে ওদের। সেই কোনকালের অদেখা অচেনা এক নবাবের শোকে সবাই যেন পাথর বনে গেছে। আগের গোয়ার্তুমি ভাবটা নেই। কেমন শান্ত মেজাজের ফেরেশতা একেকজন। কিন্তু মনে মনে তাদের এক পণ, দেশের জন্য জান দেবে, বিদেশি শত্রু তাড়াবে আর হত্যা করবে মিরজাফরদের। রমিজ শেখের ভয় ভয় লাগে। এই খুন আর পাল্টা খুনের শেষ কোথায়? এসব ঠান্ডা না গরম মাথার খুন? যুদ্ধ থামার পর আদালত যদি বসে কোন আইনে বিচার হবে তাদের!
দুনিয়াটা এক আজব জায়গা। বিদেশিরা আসবেই লোভ করে। দেশের মধ্যে একজন দেশপ্রেমিক থাকবেনই। আর মিরজাফররাও হাঁটাচলা করবে তাদের কাছাকাছি ছায়ার মতন। যেন একটা সাজানো নাটক। চরিত্রগুলোও গাধা। এর বাইরে কেউ থাকতে নেই–যে মারতে বা মরতে চায় না। কত শত বছর ধরে একই নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে আর মানুষগুলো অভিনয় করছে তাদের বাধা ভূমিকায়! রমিজ শেখ নিজে কার দলে–হাজি সাহেব, না এই ছয় পাহারাদারের? দেশপ্রেমিক যে হাজি সাহেব নন, এখন তা স্পষ্ট। তিনি মিরজাফর। কিন্তু যুদ্ধে তো সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় হয়েছিল, বাংলার মসনদে বসেছিল মিরজাফর, যে দেশপ্রেমিক নয়। রমিজ শেখ মরতে চায় না। কপালগুণে ফাঁসির দড়ি ফসকে বেরিয়ে আসা খুনের আসামি সে। জীবনটা যে হেলাফেলার জিনিস নয়, বিচারের রায় পাওয়ার আগের কয়েক মাস হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। রোজ রাতে বউয়ের বেশ ধরে আজরাইল এসে বসত তার গরাদের পৈঠায়। বিয়ের গীত গাইত কুনকুনিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে উঠে চলে যেত রাতের শেষ প্রহরে প্রহরীর হুঁশিয়ার ডাক শোনার পর। তার যাবজ্জীবন হওয়ার পর বউ আর আসেনি, অভিমানেই হয়তো!
দেখতে দেখতে জায়গাটা পলাশী হয়ে ওঠে আর সময়টাও দুই শ’ চৌদ্দ বছর পিছিয়ে চলে যায় ১৭৫৭ সালে। নতুনগাঁওয়ের পাহারাদাররা শুধু পাহারাদার থাকে না, হয়ে ওঠে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিশ্বস্ত অনুচর। কথা বলে, চলাফেরা করে ঘোরের ভেতর, যাত্রার ঢঙে। তাদের হাতের তেঁটা-বল্লম আর রামদাগুলো যেন তলোয়ার, উত্তেজনার মুহূর্তে এক টানে কোষমুক্ত করে মাথার ওপর উঁচিয়ে ধরে। গা ছমছম করে রমিজ শেখের। সে যদিও নিজের পক্ষ এখনো ঠিক করে উঠতে পারেনি, তবু মনে হয়, মানুষগুলো তাকে জোর করে মিরজাফরের দলে ঠেলে দিয়েছে। রাইফেলটা সঙ্গে থাকলে এত অসহায় লাগত না। অস্ত্রটা হাতিয়ে নিয়ে গেল কোথায় ছোকরা? এরপর তো তাকে আর দেখা গেল না। পদে পদে এত বিপদ, সে হাজি সাহেবের কাছে থেকে গেলেই পারত! লোকে যতই গালমন্দ করুক, যুদ্ধে জয়লাভ করে তো মিরজাফর, হেরে ভূত হয় সিরাজউদ্দৌলার দল। একটা মেয়েমানুষের জন্য, বিজয়ী পক্ষ ছেড়ে সে জীবন নিয়ে জুয়া খেলতে নেমেছে–দশ বছর জেল খেটে তো কোনো শিক্ষাই হলো না। অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় মা-বাপ মরল তার কয়েদবাসের সময়। জীবনের শেষ। ক’টা দিন সর্বস্বান্ত বুড়ো-বুড়ি একমুঠো ভাতের জন্য মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করে ফিরেছে। কেউ ভিক্ষা দেয়নি। খুনি পুত্রের বাপ-মায়ের না-খেয়ে মৃত্যু, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছে গাঁয়ের ধনী-গরিব সবাই। রমিজ শেখ জানে না, হাজি সাহেব জায়গা না-দিলে কয়েদির পোশাকে সে কোথায় দাঁড়াত। কে তাকে আশ্রয় দিত। যে দুনিয়ায় নির্দোষ বাবা-মায়ের ঠাই হলো না, তার হতো? দূর সম্পর্কের বড়লোক আত্মীয়, যার চৌকাঠে হাফ প্যান্ট, ছেঁড়া শার্ট আর খালি পায়ে সেই কবে মায়ের হাত ধরে ভয়ে ভয়ে একদিন দাঁড়িয়েছিল, আশ্চর্য যে, এক মুখ দাড়ি-গোঁফ আর কয়েদির পোশাক সত্ত্বেও লহমায় চিনে ফেললেন! বিমুখ করলেন না। সব জানার পর আরো আপন করে নিলেন। রেগে গিয়ে একবার অণ্ডকোষ মুচড়ে দেওয়া ছাড়া হাজির ব্যাটা তার কী ক্ষতি করেছে যে, না বলে-কয়ে সে চলে এল! এই দেশে বেইমান-বিশ্বাসঘাতক যদি কেউ থাকে, সে রমিজ শেখ।
হালে রমিজ শেখ মরিয়মের ভাবগতিকও বুঝতে পারে না। শিক্ষিত মেয়ে, স্বর্গধাম থেকে বেরিয়ে এল তার হাত ধরে, জাতকুল ছেড়ে আসার মতন। টানা দুই দিন ঘুরল পথে পথে। তারপর একটা আশ্রয় যখন পেয়ে গেল, তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল ময়লা কাপড়ের মতো দলা পাকিয়ে। দুনিয়ার এই বিচার? নতুনগাঁওয়ের লোকদের একবার সে বললে পারত, মানুষটা দুই দিন না-খাওয়া, নিধুম, তোমরা তাকে পাহারায় নিয়ো না, আজকের রাতটা অন্তত সে বিশ্রাম করুক। তা তো বললই না, মনে হলো রমিজ শেখকে চেনেই না–এমন ভাব করে মেয়েদের হাত ধরে অন্দরমহলে চলে গেল । সিরাজউদৌল্লা যাত্রার এই চৌহদ্দি থেকে জান নিয়ে ফিরতে পারলে, লাট সাহেবের বেটিকে সে দেখিয়ে ছাড়বে কত ধানে কত চাল।
কিন্তু সেই সুযোগ মনে হয়, রমিজ শেখের জীবনে আর আসবে না।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা পালা দ্রুত পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে। ছয়জন নটের অবস্থা সঙ্গিন। পলাশীর যুদ্ধে নবাবের বাহিনী হেরে গেছে, মিরজাফর ক্লাইভের শিবিরে। লুকোছাপার পর্ব শেষ। সবকিছু দিনের আলোর মতো স্পষ্ট–শত্রু-মিত্র চিনতে কারো অসুবিধা হচ্ছে না। ইংরেজ বাহিনী দ্রুত এগিয়ে আসছে নবাবকে বন্দি করতে। তার সর্বক্ষণের সহচর এখন গোলাম হোসেন। সে নবাবকে ছেড়ে যায়নি। আরেকজনও যায়নি–সে আলেয়া। পাহারাদারদের মধ্যে কোনো নারী না থাকায়, চরিত্রটি আগাগোড়া উহ্যই রেখেছে। নবাব মুখে যতই বলুক, ‘উপায় নেই গোলাম হোসেন, উপায় নেই,’ আসলে গোলাম হোসেনই এখন তার একমাত্র বল-ভরসা। তা নবাবও জানেন। গোলাম হোসেন সিরাজউদ্দৌলাকে তাড়া দিচ্ছে রাজধানীতে ফিরে গিয়ে দ্রুত সৈন্যসামন্ত জোগাড় করে পুনরায় যুদ্ধ করতে। ভগ্নহৃদয় নবাব। মুখে যদিও কথার খই ফুটছে, চলাফেরার শক্তি রহিত। গোলাম হোসেন গোঁয়ারের হদ্দ, নবাবকে কৌশলে তাতাচ্ছে—’জাহাপনা, আমরা আবার যুদ্ধ করব। আবার সৈন্য সংগ্রহ করব। এক জন্মে না পারি, জন্ম-জন্মান্তরের সাধনা দিয়ে বাংলা, বাঙালির এই লজ্জা দূর করব।’ এদিকে নবাবও হুঁশের পাগল–চিবিয়ে চিবিয়ে বলছেন, ‘কিন্তু মিরজাফর, জগৎ শেঠ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, উমিচাঁদের দল কি আর জন্মগ্রহণ করবে না গোলাম হোসেন?’
তাহলে উপায়? ছয়জনের বিভ্রান্ত দৃষ্টি পড়ে রমিজ শেখের ওপর। এক পলকে অনেকগুলো বছর দৌড়ে পিছিয়ে যায়। মিরজাফর, জগৎ শেঠরা যুগে যুগে জন্মায় এই বাংলায়, দেশটাকে শত্রুর পদানত করে রাখতে। এই তো সামনে–নবজাতক বিশ্বাসঘাতক। তাদের ঝাড়েবংশে শেষ করতে না পারলে বাঙালির মুক্তি নেই। পাহারাদাররা দ্রুত রমিজ শেখের দিকে এগিয়ে যায়। দুই শ’ বছর আগেকার বাংলা, বাঙালির লজ্জা দূর করার শপথ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাজি সাহেবের বিশ্বস্ত অনুচরের ওপর।
রমিজ শেখ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখে সে শত্ৰুবেষ্টিত। তাদের অস্ত্রগুলো তার মুখের ওপর অন্ধকারে ঝলকাচ্ছে। সে তো আর মিরজাফরদের ষড়যন্ত্রে শরিক ছিল না যে, তার প্রস্তুতি থাকবে। তবু রামদায়ের প্রথম কোপটা হাতের তালু দিয়ে ঠেকায়। দুটি তরতাজা আঙুল খসে পড়ে মাটিতে। রমিজ শেখ নিজে না চাইলেও সে একজন নট বটে এই পালার। তাই জানে, পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। অদূরে ইংরেজ শিবির, ওখানে স্বয়ং মিরজাফর আছেন। কোনোক্রমে একবার পৌঁছে গেলে প্রাণে বেঁচে যাবে। রমিজ শেখের গায়ে অসুর ভর করে। সে ছয়জনের বিরুদ্ধে খালি হাতে একা লড়ে শত্রুর বেষ্টনী ভেঙে বেরিয়ে যায়। তারপর গা ভরা রক্ত আর ক্ষত নিয়ে ছোটে একাত্তরের মিরজাফরের অনুচর শত্রুশিবিরের দিকে। আর তার পেছন পেছন দৌড়ায় ছয় পাহারাদার। তারা তখনো পালার একাগ্র নট। যে অংশটি অভিনীত হওয়ার আগে ভোর হয়ে যেত, বারবার টিকিট কেটেও কোনোদিন দেখতে পায়নি, সেই অদেখা দৃশ্যে তারা নিজেরা এখন অভিনয় করছে। কাহিনিতে আছে, পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর নবাব মুর্শিদাবাদে ফিরে গিয়েছিলেন। দেশপ্রেমিক মোহনলাল রণাঙ্গনে থেকে যায়। বুকের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সে। ইতিহাসের নির্ভুল পুনরাবৃত্তি এবারও ঘটে। আর এর সাক্ষী হয় একাত্তরের এক মেঘমেদুর রাত।
দু’দিন আগে নতুনগাঁওয়ের পার্শ্ববর্তী থানা শহর মল্লিকপুরে মিলিটারি ক্যাম্প করেছে। এলাকার মানুষ গা-ছাড়া। মিলিটারিরা বউ-ঝিদের ধর্ষণ করে জোয়ান ছেলেদের ধরে নিয়ে যায়। দেশপ্রেমিকদের রিপোর্ট অনুযায়ী আশপাশের গায়ে আর কোনো যুবক নেই। যুবতীরা মুমূর্ষ। তাতে সৈন্যরা স্বস্তি বোধ করে এবং পাহারায়। সেন্ট্রি বসিয়ে সকাল সকাল ঘুমোতে যায়। কিন্তু দেশপ্রেমিকদের চোখে ঘুম নেই। আর ঘুমাবেই-বা কোথায়। নামেই দেশপ্রেমিক, আসলে তো তাদের দেশ নেই। ঘরে ফিরলে মুক্তিফৌজ ধরবে। ক্যাম্প থেকেও আজ রাতের মতো ছুটি দেওয়া হয়েছে। তাই গাঁয়ের পথে বন্যপ্রাণী-শিকারির মতো তারা গা-ঢাকা দিয়ে চলে এবং একসময় পেয়েও যায় শিকার। বন্দুকসহ পনেরো-ষোলো বছরের একটি ছেলেকে পিছমোড়া করে বেঁধে সেন্ট্রির সম্মুখে এনে বলে, ইয়ে মুক্তি হ্যায়। বহুৎ কোশিশ করূকে ইসকো পাকড়া। ক্যাম্পের ভেতর রইরই ফুর্তির রব–-মুক্তি মিলা, মুক্তি মিলা। কিশোর বালক কিছুই বুঝতে পারে না। সন্ধ্যা রাতে সে এই বন্দুকটি হাতিয়েছে। ট্রিগার কোথায়, গুলি ছুঁড়তে হয় কীভাবে, এসব জানার জন্য রাতারাতি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে। লোকগুলো তাকে ভুল করে ধরেছে। সে নিজেও তো এদের মতো খুঁজছে মুক্তিদের। কিন্তু এ কথাগুলো বলার আগেই সান্ত্রির প্রহারে সে জ্ঞান হারায়। তারা তাকে চ্যাংদোলা করে লকআপে ফেলে দ্রুত পজিশন নেয়। কারণ সৈন্যরা ভেবেছে, এই কিশোর নিশ্চয়ই অগ্রবর্তী যোদ্ধা, পেছনে রয়েছে মূল বাহিনী। ওরা ক্যাম্প আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছে। মূল বাহিনীর জন্য সৈন্যদের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় না। রমিজ শেখ রক্তাক্ত দেহে দৌড়ে এলে তারা তাকে বন্দি করে। পেছনে খোদ নবাব সিরাজউদ্দৌলার ফৌজ। তাদের হাতের বল্লম, তেঁটা, রামদা অন্ধকারে বিদ্যুতের মতো ঝলকায়। দূর আকাশে গুড়গুঁড়িয়ে মেঘ ডেকে ওঠে। সৈন্যরা বিলম্ব করে না। যারা মোহনলালের মতো বুকের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে লড়বে ভেবেছিল, কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। নবরত্ন অপেরার পালার মতো তাদের যুদ্ধটাও থাকে অসমাপ্ত–আগামী দিনের অপেক্ষায়।
শত্রুশিবিরে রমিজ শেখের অ্যাপায়নটা হয় কল্পনাতীত। প্রথম তাকে ভোলাই দেয় দেশি বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরের চ্যালাচামুণ্ডারা। যে যেভাবে পারে–ডান্ডা ডান্ডা সই, লাখি লাথি সই, ঘুষি ঘুষি সই। তারপর তাকে আধমরা করে, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় গরাদের ভেতর ফেলে রেখে যে যার মতো চলে যায়। বাকি রাত কীভাবে কেটেছে, রমিজ শেখ বলতে পারবে না। শুধু মাঝেসাজে হুশ ফিরলে নতুনগাওয়ের কিশোর বালকের দুটি বড় বড় চোখ অন্ধকারে সে জ্বলতে দেখে। ক্ষোভে না বিস্ময়ে, তা বোঝা যায় না। সকালবেলায় সুদূর অতীতকাল থেকে ভেসে আসে নকিবের চোঙা ফোকার দীর্ঘ লয়ের আওয়াজ, ‘নবাব মনসুর-উল-মুলক সিরাজ-উ-দ্দৌলা শাহ্কুলি খাঁ মির্জা মুহাম্মদ হায়বতজঙ্গ বা-হা-দু-র-হা-জি-র।’ ঝনঝন শব্দে গরাদের দরজা খুলে গেলে রমিজ শেখ বুঝতে পারে, তার দরবারে যাওয়ার সময় হয়েছে। তাকে হাতে ধরে খাড়া করায় দুজন লোক। তারপর ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যায় একটি লম্বামতন ঘরের বারান্দায়। সেখানে পাঠান হাবিলদারের পাশে একজন রাজাকার বসা। রাজাকারটা তার মোচ ধরে টান মেরে একপাশ থেকে তুলে ফেলে। রমিজ শেখ অপারগ। হাত দুটি পিছমোড়া থাকায় নবরত্ন অপেরায় নটের মতো সেটি স্বস্থানে বসাতে পারে না। মুখ খোলা থাকা সত্ত্বেও জিহ্বায় শক্তি নেই যে, এমন চরম মুহূর্তে যথাযথ ডায়লগ দেবে।
ঘরের ভেতর দরবার বসেছে। এক ধোপদুরস্ত মেজর বিচারক। কোথা থেকে ভাঙা ট্রাংক টানতে টানতে সভাস্থলে হাজির হয় একজন। তার পেছনে আসে আরো কয়েকজন। এরা বাদী। রমিজ শেখ বিবাদী। এ নিয়ে দু’বার তার বিরুদ্ধে এজলাস বসল। প্রথমবার সে ছিল খুনি, এবার মনে হয় খুন হতে যাচ্ছে। তাকে দেখিয়ে বাদী একজন বলে, ‘এই লোক হুজুর, আমার চাচা লাল মোহাম্মদরে মার্ডার করছে।’ তারপর ভাঙা ট্রাংক হাট করে বিচারকের সামনে সে মেলে ধরে, ‘এই দ্যাখেন আমার বাড়ি লুট করছে হুজুর, এই লোক।’ পরের জন চিৎকার দিয়ে মেজরের পা জড়িয়ে ধরে, ‘মার্চ মাসের পয়লা তারিখে আমার পেটের এইখানে চাকু মারছে হুজুর, এই লোক। আপনে এর বিচার কইরেন। নাড়িভুড়ি বেরই গেছিলো আমার। ভাইগ্যক্রমে বাইচে গেছি।’ তৃতীয় ব্যক্তি মওলানা তোফাজ্জেল। ‘এই লোক স্যার আমার বন্দুক কেড়ে নেছে’ বলেই মওলানা তার গালে এমন কষে চড় মারে যে, তার আলগা হয়ে যাওয়া মোচটা উড়ে গিয়ে মেজর সাহেবের কোলে পড়ে। তিনি তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে ওঠেন, ‘তুম লোগ ভাগো ইয়াসে, ইসে ম্যায় সামালুঙ্গা।’
এবার শুরু হয় আসল জেরা। মৃত পাহারাদার ছয়জন নবাব সিরাজউদ্দৌলার ফৌজ ছিল বলাতে মেজর সাব তার খাস নফরকে হাত দিয়ে ইশারা করেন। লোকটা রমিজ শেখকে প্রথম চেয়ারে বসায়, পরে পা দুটি বেঁধে সিলিংয়ের আড়ায় ঝুলিয়ে দেয়। সোজা এবং উল্টো অবস্থায় সে যখন একই কথা বলে, তখন মেজর খাস নফরকে অর্ডার দেন, ‘লে যাও উসকো, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা কা নওয়াবকো আচ্ছা তারাসে বানা দো।’ ঘরের চৌকাঠে পা দিয়েই নফর যখন তাকে বানাতে উদ্যত, তখন পেছনে থেকে মৃদুস্বরে অর্ডার আসে, কাল ফির লে আনা।
মেজরের রুম থেকে হাজতে ফিরে ছোট ছেলেটিকে রমিজ শেখ দেখতে পায় না। দেয়ালে রক্ত দিয়ে লেখা, ‘মাগো কেঁদো না, আমি তোমার খুদিরাম। তাকে সেন্ট্রি জানায়, মাসুম বাচ্চা বাংলাদেশ মে চলা গিয়া। মগর তুম নেহি মানগে, তুম নওয়াব হ্যায় তো কেয়া, তুমহারা হালত অ্যাইসা হোগা।’
পরদিন ফের দরবার বসেছে। জেরা শুরু হবে, তখন ফোন বেজে ওঠে। রিসিভার তুলে মেজর চিৎকার করে ওঠেন, ‘ঘুরলিয়ে! সকাল সকাল ঘুরুলিয়া, নতুনগাঁও, দাউদনগর, খিদিরপুরে মুক্তিবাহিনীর ফাইট স্টার্ট হয়ে গেছে। পেছনের দেয়ালে মানচিত্র। মেজর তা টেবিলে নামিয়ে নাকে চশমা ঝুলিয়ে দেখেন, কোথায় নতুনগাঁও, কোথায় দাউদনগর, কোথায় খিদিরপুর আর কোথায় ঘুরুলিয়া। মানচিত্র দেখা শেষ হয়েছে কি হয়নি, এর মধ্যে ফিফটি সিসি মোটরসাইকেল চালিয়ে হুড়মুড় করে হাজির হয় শান্তি কমিটির জেলা সভাপতি। স্যার, স্যার, অ্যাটাক হো গিয়া, অ্যাটাক হো গিয়া।’ রমিজ শেখ লোকটাকে চেনে না, দেখেওনি কোনো দিন। তবে ভাবভঙ্গিতে বোঝে যে, সে বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরের লোক, বর্তমানে দেশপ্রেমিক নাগরিক, বিদেশি শত্রুকে যুদ্ধের খবর জানাতে ছুটে এসেছে। শুয়ার কা বাচ্চা! মেজর সাব পিস্তল উঁচিয়ে তেড়ে যান শান্তি কমিটির জেলা সভাপতির দিকে, ‘তুম কিউ চিল্লায়া থা? সারা পাবলিক কো মালুম হো গিয়া। তুমকো গোলি কর দেগা।’
ওই লোক তো নাকের ডগায় পিস্তল দেখে সঙ্গে সঙ্গে চুপ। রমিজ শেখের অবাক লাগে–এই যদি হয় দেশপ্রেমিকদের অবস্থা, কীসের আশায় তারা মিরজাফরি করছে? সিংহাসনে তো বসতে পারবে না! রমিজ শেখ যা মার খেয়েছে, তার সিংহভাগ এ লোকগুলোর হাতে। এদিকে মেজর তাড়াতাড়ি স্কোয়াড রেডি করে ফেলেছেন। তিনি সমরনায়ক। দেশপ্রেমিক নাগরিক পথপ্রদর্শক। মিলিটারিরা লাফিয়ে লাফিয়ে গাড়িতে উঠছে। রমিজ শেখ উঠতে গেলে বসার চেয়ারটাও তার সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে। তার হাত দুটি চেয়ারের হাতলের সঙ্গে পাটের দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। এ অবস্থায় সে দরজার কাছাকাছি চেয়ারসহ হেঁটে চলে আসে। মেজর গাড়িতে স্টার্ট রেখে খাস নফরকে কাছে ডাকেন, এই বাইনচোত কো কাল ফির লে আনা।’ এরপর চলে গেলেন রণক্ষেত্রে।
মেজর সাব যে যুদ্ধে জয়লাভ করে ফিরেছেন, গরাদে থেকে রমিজ শেখ তা টের পায়। সামনের চাতালটায় হাঁস-মুরগির কটর-কটর, গরুর ডাক, ছাগলের চিৎকারে। নরক গুলজার। অন্ধকারে ঝনঝন তালা খুলতেই জনা পাঁচেক লোক তার গায়ের ওপর উড়ে পড়ে। পড়েই হড়হড় করে বমি। রক্তে না বমিতে কয়েদখানা ভেসে যাচ্ছে, আলোর অভাবে তা বোঝা যায় না। পুরুষলোকরা তো এখানে, হাঁস-মুরগিরও ডাক শোনা যাচ্ছে, মেয়েরা কোথায়? নতুনগাঁও আক্রান্ত হলে মরিয়মের ধরা না পড়ে উপায় নেই। কিন্তু বিষয়টা রমিজ শেখকে আগের মতো ভাবায় না। এখন সবাই ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি করছে।
মাঝরাতে রক্ত আর দাস্তবমির মাঝখানে রমিজ শেখের ঘুম ভাঙে রান্না মাংসের সুঘ্রাণে। বিজয় উপলক্ষে ভোজ চলছে। বাতাসে ভাসতে ভাসতে গন্ধটা গরাদে ঢুকে। তার পেটে ধাক্কা দেয়। কীসের মাংস আহ্-এমন সুন্দর ঘ্রাণ! নতুনগাঁওয়ের চৌধুরী বাড়ির পাতলা খিচুড়ির পর দু’দিন দু’রাত পার হয়ে গেছে, পেটে দানাপানি কিছু পড়েনি। এই প্রথম তার খিদার উদ্রেগ হয় এবং মাংস খাওয়ার তীব্র বাসনা নিয়ে রমিজ শেখ বমি করতে শুরু করে।
পরদিন জেরা, আবারও প্রহসন। রমিজ শেখের যাওয়া-আসার পথে দৃশ্যপট ক্রমে পাল্টে যাচ্ছে। কয়েদখানা এখন থানার লকআপ ছাড়িয়ে অদূরের স্কুলঘর পর্যন্ত বিস্তৃত। যে ঘরে একসময় হেড মাস্টার বসতেন, মেজরের দরবার বসে সেখানে। কক্ষের কাঁচের আলমারি থেকে ছাত্রছাত্রীর পরীক্ষার খাতার বান্ডিল সরিয়ে আসামিদের অদৃশ্য ফাইলপত্র রাখা হয়েছে। দরবার চলাকালে মেজরের অর্ডার পেয়ে খাস নফর আলমারি খোলে বটে, তবে শূন্য তাক থেকে এক টুকরো কাগজও বের হয় না। আলমারি বন্ধ করে টেবিলে সে যা রাখে, তা-ও কিছু না। মেজর মিটিমিটি হাসেন। তার পেছনের দেয়ালে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর গুরুগম্ভীর প্রতিকৃতি। ঘরের চালায় পাকিস্তানের চাঁদ-তারা খচিত পতাকা। আগে স্কুলমাঠের দক্ষিণ প্রান্তে কৃষ্ণচূড়াগাছের তলায় যে চারকোনা শহিদমিনারটি ছিল, এখন এর ভাঙা বেদিতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কালো আলখাল্লা পরে যে বসে থাকে, সে একজন কসাই। নাম নাঈমুদ্দিন। নাঈমুদ্দিন মানুষের গলাপ্রতি কুড়ি টাকা পায়। সে বেদি থেকে বারবার সিপাহিদের কাছে উঠে আসে তদবির করতে। যুদ্ধের আগে বেশি করে গরু ভাগে পাওয়ার জন্য হাটে আসা ব্যাপারীদের সঙ্গে ঠিক এই কাজটাই করত সে। একদিন দরবার গৃহে যাওয়ার সময় কসাই নাঈমুদ্দিন রমিজ শেখকে কাগজের বিড়ি ফুঁকতে দেয়। হাত বাঁধা থাকায় রক্তের কটু গন্ধময় কসাইয়ের আঙুলে ধরা বিড়িটা সে ঘনঘন টান দিয়ে শেষ করে। জায়গাটা ভারতীয় বাহিনীর দখলে যখন চলে আসে, নাঈমুদ্দিন কালো আলখাল্লা খুলে মুজিব কোটের তলায় বেশিক্ষণ গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধারা তার এক পা চেপে ধরে, অন্য পা টান মেরে ফরফর করে ছিঁড়ে ফেলার আগে কসাই নাঈমুদ্দিন একটা বিড়ি প্রার্থনা করেছিল।
এখন একবার সোজা করে, পরের বার উল্টিয়ে ঝুলিয়ে প্রতিবার রমিজ শেখের মুখে একই জবানবন্দি শুনে মেজর অশেষ আনন্দ পান। ফাঁকে ফাঁকে নবরত্ন অপেরার সিরাজউদ্দৌলা পালাটাও বিনা টিকিটে দেখা হয়ে যায়। যুদ্ধের উৎসবহীন দিনে মেজরের জন্য এ উপরি পাওনা। তার হুকুমে রমিজ শেখ যখন নবাবের বন্দিত্বের অংশটা রোজ অভিনয় করে দেখায়, তখন নিজেকে তিনি ইংরেজ সেনাপতি ভেবে আঙুলের ডগায় মোচ মোচড়ান। এদিকে দেশপ্রেমিক নাগরিকদের তরফ থেকে রমিজ শেখের গায়ে যে উত্তম-মধ্যম পড়ে, সেসব অভিনয় নয়, সত্যিকারের।
দরবার গৃহে এভাবে অভিনয় করতে করতে রমিজ শেখ ক্রমে নবাব হয়ে ওঠে। দেশপ্রেমিক নবাব সিরাজউদ্দৌলা। শত্রু সৈন্য আর বিশ্বাসঘাতকদের যাবতীয় বিদ্রূপ, অত্যাচার-অবিচার অতিশয় মর্যাদার সঙ্গে সে গ্রহণ করে। নিজেকে সে ভাবে ভগবানগোলায় ধৃত নবাব সিরাজউদ্দৌলা, যাকে শত্রুরা মুর্শিদাবাদে বন্দি করে নিয়ে এসেছিল। যার কণ্টক আসন, ছিন্ন পাদুকা কোনোভাবে নবাবি মেজাজ থেকে টলাতে পারেনি। গভীর রাতে একদিক থেকে যখন মেয়েদের আর্তচিৎকার আর গোঙানির আওয়াজ আসে, আরেক দিকে নদীপাড়ে মৃতদেহের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে শিয়াল কুকুরে মারামারি চলে, তখন কয়েদখানায় বসে বন্দি নবাব আগামী দিনের যুদ্ধের ফন্দি আঁটেন। তার সঙ্গে যোগ দেয় ছয়জন মৃত পাহারাদার। নবাবের দীনহীন কুটিরের এক কোনায় ঘাপটি মেরে পড়ে থাকা রমিজ শেখকে তারা ঠিকই শনাক্ত করে। নবাব তাদের সাদরে গ্রহণ করেন। বসতে দেন বিষ্ঠা আর উচ্ছিষ্টের থালাবাটি সরিয়ে। তারা যেখানে গোল হয়ে বসে, সেদিকের দেয়ালে রক্তের অক্ষরে লেখা, ‘মা গো কেঁদো না, আমি তোমার খুদিরাম।’ লেখাটার দিকে তাকিয়ে পাহারাদারদের একজন বলে, ‘খুদিরামের সংখ্যা দিনকে দিন বেড়ে চলিছে।’ কথায় কথায় এলাকায় যে অসময়ে বন্যা শুরু হয়েছে সেই প্রসঙ্গ আসে। সিরাজউদ্দৌলা পালার মঞ্চস্থল এখন দশ হাত পানির নিচে। এ অবস্থায় গ্রাম পাহারা দিয়ে কোনো ফায়দা নেই। মুক্তিবাহিনীও এসে গেছে। তারা পাটখেতের চিপায় পজিশন নিয়ে বসে থাকে। কোনো দিন শিকার মেলে, কোনো দিন মেলে না। কলাগাছের ভেলায় চেপে তাদের খাবার দিয়ে আসে গ্রামের বউ-ঝিরা। ইঞ্জিনবোটের আওয়াজ কানে গেলেই মুক্তিরা ট্যাসট্যাস করে স্টেনগানের গুলি চালায়। গুলি শেষ হয়ে গেলে নৌকা নিয়ে পালিয়ে যায় গাঁয়ের পেছন দিক দিয়ে। পাকসেনারা আরেক দিক থেকে ঢুকে গাঁয়ের লোকদের মেরে-ধরে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে। ‘কিন্তু এ অবস্থা বেশিদিন চলতি দিয়া যায় না, নবাব!’ এ কথা বলে একজন প্রাক্তন পাহারাদার রমিজ শেখের ছিন্ন আঙুলসমেত করতল মুঠোয় তুলে নেয়। একে একে শূন্য জায়গাটায় সবাই হাত বোলায়, গভীর আবেগে চুম্বন করে। রমিজ শেখও তাদের বুলেট-ঝাঁঝরা বুকে-পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। তারা তখন জানতে চায়, নবাব ফের কবে শত্রু শিবির আক্রমণ করবেন। কবে তারা ফিরতে পারবে জন্মভূমি বাংলায়। তাদের একজন আবার গোলাম হোসেনের মতো ললিত ভঙ্গিতে বলে, বাংলাকে ভালোবেসে বাংলার নবাবকে আমরা ভালোবেসে ফেলেছি। রমিজ শেখ শেকলবদ্ধ টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়ায়। ঝনঝন শব্দে বাজনা বেজে ওঠে। নবাব আবেগাপ্লুত, কম্পিত কণ্ঠে বলেন, ‘গোলাম হোসেন, বাংলাকে তোমাদের মতো আমি তো ভালোবাসিনি। তবু আজ নিজের সব দুঃখ-দুর্দশা ছাপিয়ে, বাংলার কথাই বারবার মনে পড়ে কেন?’
নবাব কুটিরে পিনপতন নিস্তব্ধতা। এদিকে সাক্ষাৎকারের সময় উত্তীর্ণ। যখন সেলের দরজা খুলে দুজন সিপাহি নবাবকে মেজরের দরবারে নিতে আসে, তখন মৃত পাহারাদাররা টুটাফাটা শরীর নিয়ে পড়িমরি পালায় ।
সেদিন রমিজ শেখের নবাবি ঘোর তখনো কাটেনি। এ অবস্থায় স্কুলমাঠ পর্যন্ত সিপাহিদের সঙ্গে সঙ্গে যায় সে। তারপর হঠাৎ করেই ‘আলেয়া আলেয়া’ বলে দোতলা স্কুল বাড়িটার দিকে দৌড়াতে থাকে। যাকে সে প্রাণপণ দৌড় ভাবে, দোতলার জানালা দিয়ে মরিয়মের সেটা ঠ্যাং-বাঁধা মোরগের ছোট ছোট লাফঝাঁপ মনে হয়। রমিজ শেখকে হঠাৎ করে দেখতে পাওয়া, তার আলেয়া আলেয়া চিৎকার, ঠ্যাং-বাঁধা মোরগের মতো লম্ফঝম্প–এসব কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। মরিয়মের তখন মাথা ঠিক ছিল না। আহাম্মকটাকে এক্ষুনি থামানো দরকার, তা না হলে গুলি খেয়ে মরবে। কিন্তু বাইরে থেকে ঘরটা ছিল তালাবন্ধ। এ ছাড়া যে বিষয়টি হঠাৎ তার মাথায় আসে, সেটি হলো এক চিলতে অন্তর্বাস ছাড়া তার পরনে কোনো বস্ত্র নেই। এদিকে দৌড়াতে দৌড়াতে রমিজ শেখ পিঠে একটা ধাক্কা অনুভব করে, সেই সাথে সুচ ফোঁটার মতো চিনচিনে যন্ত্রণা। ব্যথাটা তীব্র নয়, তবে শক্তি ধরে অসম্ভব। সেকেন্ডের মধ্যে নবাবের খোলস ভেঙে আগের পরিচয়ে ফিরে যায় রমিজ শেখ। সেখানে সে একজন সামান্য প্রজা, বউ খুন করার দায়ে যার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল এবং ডামাডোলের ভেতর যে দশ বছরের মাথায় জেল থেকে পালিয়ে এসেছে। রমিজ শেখ এক হাত দূরে বিয়ের সাজ করা বউকে পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। চেঁচিয়ে সরে যেতে বললেও মেয়েটি পুরোপুরি সরে না। ঘাতক স্বামীর মাঝখানে এক হাতের মতো ব্যবধান রেখে সে নিজেও দৌড়ায়। তবে আগের মতো তাদের পথটা মসৃণ আর সোজা থাকে না। তা মোড় নেয় হেড স্যারের রুমের পাশ দিয়ে, দোতলা স্কুলবাড়ি ছাড়িয়ে, পাকিস্তানি পতাকা আর কৃষ্ণচূড়াগাছ নিচে ফেলে ওপরের দিকে–শূন্যে।