০৬. একটা চিরকুট

শুভ্রর বাসায় কেউ একজন একটা চিরকুট পাঠিয়েছে। কে পাঠিয়েছে শুভ্র ধরতে পারছে না। চিরকুটটা ইংরেজিতে লেখা। টাইপ রাইটারে টাইপ করা। কোনো নাম সই করা নেই। হাতের লেখা হলো- লেখা থেকে প্রেরক কে আন্দাজ করা যেত। যে পাঠিয়েছে সে নিশ্চয়ই চায় না— শুভ্র তার নাম জানুক। চিরকুট লেখা— Please come to the department, tomorrow.

শুভ্র ডিপার্টমেন্টে এসে প্রথম যে কথাটা শুনল তা হচ্ছে — রেজাল্ট হয়েছে। ফার্স্ট হয়েছে মীরা। শুভ্ৰর লজ্জা লজ্জা করতে লাগল। মীরা প্ৰথম হয়েছে শুনে তার নিজের ভাল লাগছে। এতটা ভাল যে করবে তা ভাবা যায় নি। পড়াশোনা নিয়ে মীরাকে কখনো সিরিয়াস মনে হয় নি। তার নজর ছিল হুজুগের দিকে। হৈচৈ এর দিকে। নাটকের একটা দলও পরীক্ষার আগে আগে করে ফেলল। নাটক লেখাও হল। নাটকের নাম নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসের ভেতরের প্রোটন এবং নিউট্রন নিয়ে গল্প। ইলেকট্রনের সঙ্গে প্রোটনের প্ৰেম। প্রোটন হচ্ছে মেয়ে, ইলেকট্রন ছেলে। প্রেমের জটিল পর্যায়ে মেয়েটি হঠাৎ ছেলে হয়ে যায়। তাদের প্রেম তাতে নষ্ট হয় না। অন্যরূপ নেয়; সব নিয়ে ভয়াবহ ধরনের জটিলতা নিয়ে ভয়াবহ নাটক। নিউক্লিয়াস-এর গল্প মীরার লেখা। নাটকের পরিচালকও সে। এই মেয়ে পরীক্ষায় ফার্স্ট হবে ভাবা যায় না।

শুভ্ৰ তার নিজের রেজাল্ট এখনো জানে না। কাউকে জিজ্ঞেস করতেও অস্বন্তি লাগছে। নোটিশ বোর্ডে রেজাল্ট টানানো হয় নি। চেয়ারম্যান স্যারের ঘরে ঢুকে পড়া যায়। ঢুকতে ইচ্ছা করছে না। নিজের রেজাল্ট জানার জন্যে যে প্রচণ্ড আগ্ৰহ হচ্ছে তাও না। তবে কেন জানি খুব হৈচৈ করতে ইচ্ছা করছে। রেজাল্টের পরপর সব ছেলেমেয়েরা মিলে খানিকক্ষণ খুব চেচামেচি করে। দল বেঁধে চাইনীজ খেতে যায়। এমন দলের সঙ্গে মিশে যেতে পারলে ভাল হত। মীরা যে নাটকটা করছে। সেই নাটকের একটা পাট পাওয়া গেলে মন্দ হত না। মূল চরিত্র সে করতে পারবে না। পার্শ্ব চরিত্র- যেমন হাই এনার্জি গামা রশ্মি। কিংবা আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক।

এই শুভ্ৰ।

শুভ্র চমকে তাকাল।

চেয়ারম্যান স্যারের ঘর থেকে মীরা বের হয়ে আসছে। সে কি জানত আজ তার রেজাল্ট হবে? চিরকুটটাকি সেই পাঠিয়েছে? আগুন রঙ শাড়ি পরে এসেছে। তাকে লাগছে ইন্দ্রনীর মত। শুভ্র বলল, ডিপার্টমেন্টে আসার জন্যে চিরকুটটা কি তুমি পাঠিয়েছিলে?

মীরা বলল, না। আমি কাউকে চিরকুট পাঠাই না। সরাসরি উপস্থিত হই। শুভ্র শোন, এত ভাল রেজাল্ট করলাম, কই তুইতো এখনো আমাকে কনগ্রাচুলেট করলি না।

শুভ্ৰ বলল, কনগ্রাচুলেশান্স।

মীরা বলল, থ্যাংকস। আমরা ঠিক করেছিলাম দল বেঁধে সবাই তোর বাসায় যাব। চেয়ারম্যান স্যারও বলছিলেন যাবেন। এই নিয়েই কথা হচ্ছিল। আমরা খুব মন খারাপ করেছি।

কেন?

তোর জন্যে খুব ভাল খবর আছে। আমি খবরটা তোকে দিতে পারতাম। কিন্তু চেয়ারম্যান স্যার খবরটা দিতে চাচ্ছেন।

তোমার কাছ থেকে একবার শুনি- তারপর স্যারের কাছ থেকে শুনব।

তুই এখন কে এন এস। কালী নারায়ণ স্কলার। তুই রেকর্ড নাম্বার পেয়েছিস। চেয়ারম্যান স্যারের ধারণা তোর এই রেকর্ড কেউ ভাঙ্গতে পারবে না।

শুভ্র একটু হকচাকিয়ে গেল। এতক্ষণ যে শুনছে। মীরা ফার্স্ট হয়েছে সেটা তাহলে কী?

মীরা বলল, আমি আজ ইউনিভার্সিটিতে এসেই শুনি আমি ফার্স্ট হয়েছি। আমিতো। হতভম্ব। চেয়ারম্যান স্যারের কাছে গেলাম। স্যার বললেন— মীরা মিষ্টি খাওয়াও। প্রথম হবার মিষ্টি। আমি বললাম, শুভ্ৰ! শুভ্ৰর রেজাল্ট কী? তখন স্যার বললেন— ওকে হিসাবের বাইরে রেখে তুমি ফার্স্ট। স্যারের কথা শুনে আমার খুশি হওয়া উচিত ছিল। আমি খুশি হই নি। বরং আমার রাগ লাগছে।

রাগ লাগছে?

অবশ্যই রাগ লাগছে। ছাত্রদের মধ্যে কেউ পড়াশোনায় ভাল হবে, কেউ মন্দ হবে। এই ভাল মন্দের মধ্যেও একটা মিল থাকবে। কিন্তু যদি দেখা যায় এমন কেউ আছে যাকে দলের মধ্যেই ফেলা যাচ্ছে না। তাকে বাদ দিয়ে হিসেব করতে হচ্ছে। তখন মন খারাপ হয়। শুভ্ৰ তুই কি জানিস কেউ তোকে পছন্দ করে না?

না জানি না।

একদল পাতি হাঁসের মাঝে যদি একটা রাজহাঁস থাকে তখন সেই রাজহাঁসটাকে কেউ পছন্দ করে না। তুই হচ্ছিস রাজহাঁস। তাও সাধারণ রাজহাঁস না, সাইজে বড় রাজহাঁস। যে ময়ূরের মত পেখম ধরতে পারে।

ও আচ্ছা। আমি যে রাজহাঁস সেটা কিন্তু আমি জানি না।

আমরা যতটা না জানি- তুই তারচে বেশি জনিস। আমরা ক্লাসের ছেলেমেয়েরা সবাই সবাইকে তুই করে বলি। তুই নিজে কিন্তু সবাইকে তুমি বলিস।

তাতেই প্রমাণিত হল আমি রাজহাঁস?

এটা একটা পয়েন্টতো বটেই। এটা ছাড়াও আমার হাতে আরো নটা পয়েন্ট আছে। আজ না, আরেক দিন বলব।

আরেক দিন কখন?

আজ রাতে। সিদ্দিকের বাসায়তো আজ রাতে আমরা সবাই যাচ্ছি। সারারাত জেগে হৈচৈ করছি। হৈচৈ এর কোনো এক ফাঁকে বাকি নটা পয়েন্ট বলব।

শুভ্ৰ চুপ করে আছে। ইউনিভার্সিটিতে পা দিয়েই সিদ্দিকের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। সিদ্দিকই তাকে মীরার ফার্স্ট হবার খবর দিয়েছে। কিন্তু সিদ্দিক রাতে তার বাড়িতে খাবার কথা কিছু বলে নি। নিশ্চয়ই ভুলে গেছে। ভুলটা কি সে জেনেশুনে করেছে?

অনেকদিন পর যখন আবার সিদ্দিকের সঙ্গে দেখা হবে, সে চোখ মুখ কুঁচকে বলবে— আচ্ছা শুভ্ৰ, রেজাল্টের দিন রাতের ডিনারে সবাই এল তুই এলি না। ব্যাপারটা কী বলতো? আমি সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছি বলে কি আমার কুণ্ঠ রোগ হয়েছে? না-কি এইডস হয়েছে যে আমাকে এভায়োড় করতে হবে? ফর ইওর ইনফরমেশন কুণ্ঠ এবং এইডস এর কোনোটাই ছোঁয়াছে না। শুভ্ৰ যদি বলে, তুমি আমাকে যেতে বল নি। তাহলে সিদ্দিক খুবই বিস্ময়ের সঙ্গে বলবে, তোকে বলি নি! মানে? কী বলছিস তুই! একবার না পরপর দুইবার বললাম। আশ্চর্য! আমি সবাইকে বলব। আর তোকে বলব না? তুই আমাকে এত ছোট ভাবলি?

বাধ্য হয়ে শুভ্ৰকে তখন বলতে হবে- তুমি নিশ্চয়ই বলেছ। আমি অন্যমনস্ক ছিলাম। শুনতে পাই নি।

সিদ্দিক বলবে, এইতো পথে এসেছিস। ঝেড়ে কাশছিস। তোর ভাবভঙ্গি দেখে আমারইতো মনে ভয় ঢুকে গিয়েছিল। আমি ভাবছিলাম— হয়তো আমিই বলতে ভুলে গেছি।

মীরা বলল, শুভ্ৰ তুই চেয়ারম্যান স্যারের সঙ্গে দেখা করে আয়। স্যার তোর কথা খুব বলছিলেন। আরেকটা কথা- তুই কিন্তু অবশ্যই সিদ্দিকের বাসায় আসবি। আমরা খুব ফান করব। একজন আধ্যাত্ত্বিক ক্ষমতাসম্পন্ন মিডিয়ামকে আনা হচ্ছে।

তাই না-কি?

হ্যাঁ। ভদ্রলোক চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ধ্যান করে তারপর অতীত বলে দেয়। তুই সিদ্দিকের বাসা কোথায় জানিস?

না।

আমার বাড়িতে চলে আসিস। আমি নিয়ে যাব।

শুভ্ৰ চেয়ারম্যান স্যারের সঙ্গে কথা বলতে গেল। ফলিত পদার্থবিদ্যার চেয়ারম্যান আলতাফুর রহমান সাহেব খুবই গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। গম্ভীর এবং রাগী। তার সম্পর্কে প্রচলিত রসিকতা হচ্ছে তিনি ছাত্রজীবনে যে মেয়েটির সঙ্গে প্রেম করছেন তাকে প্রেমের কথাগুলি বলেছেন ধমকের সঙ্গে। মেয়েটিকে বিয়ের জন্যে প্রপোজ করার পর সেই মেয়ে না-কি বলেছে, আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান শুনে ভাল লাগছে। কিন্তু আপনি আমাকে ধমকাচ্ছেন কেন? ধমক দেবার মত কিছুতো আমি করি নি।

আলতাফ সাহেব শুভ্রকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বিদেশে স্ট্যান্ডিং অভেসন দেবার নিয়ম আছে। আমি তোমার জন্যে নিয়মটা চালু করলাম। উঠে দাঁড়ালাম।

শুভ্র লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল।

তোমাকে যে আমি কতটুক পছন্দ করি তা কি তুমি জান?

জানি।

না, জান না। তবে আমার স্ত্রী জানে। ফিজিক্সের বাইরে আমি কোনো গল্প করতে পারি না। ফিজিক্সের বাইরে একটি বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে গল্প করি— সেই বিষয়টা হচ্ছে তুমি। তুমি কি আমার কথায় লজ্জা পাচ্ছ?

জ্বি পাচ্ছি।

আমি তোমার জন্যে সব ব্যবস্থা করে রেখেছি! তুমি ডিপার্টমেন্টে জয়েন করবে। এডহক ভিত্তিতে জয়েন করবে। আমি পরে সব রেগুলারাইজ করে নেব। তুমি আজই জয়েন কর।

শুভ্ৰ তাকিয়ে রইল। আলতাফ সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন- তুমি আজ জয়েন করবে। এবং বিকেলে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নেবে। যাতে আমরা পরে বলতে পারি শুভ্ৰ নামে আমাদের এমন একজন ছাত্র ছিল যে যেদিন রেজাল্ট হয় সেদিনই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করে— ও আচ্ছা আসল কথা বলতে ভুলে গেছি— তুমি কি জান তুমি কালি নারায়ণ স্কলার?

শুভ্ৰ কিছু বলল না; চুপ করে রইল। আলতাফ সাহেব বললেন, তুমি মন খারাপ করে বসে আছ কেন? ইজ এনিথিং রং?

শুভ্র বলল, স্যার আমি ডিপার্টমেন্টে জয়েন করতে পারব না।

আলতাফ সাহেব অবাক হয়ে বললেন, কেন?

আমাকে আমার বাবার ব্যবসা দেখতে হবে।

সেই ব্যবসা দেখার আর লোক নেই? তোমাকেই দেখতে হবে? ব্যবসাই যদি করতে হয় তাহলে এত পড়াশোনা করার মানে কী?

শুভ্ৰ নিচু গলায় বলল, জ্বি স্যার আমাকেই দেখতে হবে। বেশ কিছু লোকজন আমার বাবার ব্যবসায় উপর নির্ভর করে আছে। ওরা তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

কী ব্যবসা?

আমি পুরোপুরি এখনো জানি নী— একটা শুধু জানি— ঢাকা শহরের সবচে বড় যে পতিতালয় আছে, তার একটা অংশের আমি মালিক। সেখানে তিনটা বাড়ি আছে। তিনটা বাড়িতে বাহান্নজন মেয়ে থাকে। আমাদের অর্থ বিত্তের সবই এসেছে এইসব মেয়েদের রোজগার থেকে। ওরা যা আয় করে তার পঞ্চাশ পারসেন্ট আমরা নিয়ে নেই।

আলতাফ সাহেব শুভ্ৰর দিকে তাকিয়ে আছেন। শুভ্ৰও তার স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনের কেউই চোখ নামিয়ে নিচ্ছে না।

 

চেয়ারম্যান স্যারের ঘর থেকে বের হতেই মীরা তাকে ধরল। ঝলমলে মুখে বলল, স্যার তোকে কী বলল?

শুভ্ৰ বলল, তেমন কিছু না।

তেমন কিছু না-টা কী?

শুভ্ৰ হাসছে। মীরা বলল, তোর হাসি দেখতে ভালো লাগছে না। তোর কি কোনো সমস্যা হয়েছে? এরকম করে হাসছিস কেন?

সামান্য সমস্যা হয়েছে।

আমি কি শুনতে পারি?

না।

না কেন?

শুভ্ৰ শান্ত গলায় বলল, আমাদের সমস্যাগুলি পরীক্ষার মত। নিজের পরীক্ষা নিজেরই দিতে হয়। পরীক্ষার হলে যখন বসি তখন একজন নিশ্চয়ই অন্যজনের পরীক্ষা দেয় না।

তুই বলতে চাচ্ছিস আমরা কখনো কোনো সমস্যায় অন্যের কাছে থেকে সাহায্য নেব না? এই মহাজ্ঞান তুই পেয়ে গেছিস?

হ্যাঁ।

মীরা বলল, তোর সম্পর্কে আমার নিজের ধারণা হল, তুই অহঙ্কারী এবং বোকা। তোর অহঙ্কারটা প্রকাশিত হয় বিনয়ে এবং বোকামীটা প্ৰকাশিত হয়। জ্ঞানে। মিথ্যা জ্ঞানে।

রেগে যাচ্ছ কেন মীরা?

রাগ উঠছে এই জন্যে রেগে যাচ্ছি। তুই কি হৈচৈ করার জন্যে আজ আমাদের সঙ্গে যাবি?

না।

তুই কী করবি? বাড়িতে চলে যাবি? কোনো বই মুখের সামনে ধরে থাকবি?

তা করতে পারি।

কী বই পড়বি জানতে পারি? Octavio Paz-এর কবিতা না-কি String theory of Universe.

শুভ্ৰ আবারো হাসল। মীরা বলল, তোর বইপত্র আজকের দিনটার জন্যে তোলা থাক। আয় আজ আমরা হৈ চৈ করি। তুই তোর ব্যক্তিগত পরীক্ষণ দে। কিন্তু আজকের দিনটা বাদ থাক। মনে কর আজ পরীক্ষা হচ্ছে না। হরতালের কারণে ছুটি হয়ে গেছে।

শুভ্ৰ বলল, না। আজ আমার অন্য কাজ আছে। আজ আমি রাস্তায় রাস্তায় হাঁটব।

 

আজ কোনো ছুটির দিন না। আওয়ামী লীগ, বিএনপিদের কেউ হরতালও ডাকে নি। তবু রাস্তাঘাট ফাঁকা ফাকা লাগছে। শুভ্র ফুটপাত ছেড়ে পিচের রাস্তায় নেমে গেল। ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে ভাল লাগছে না। রাজপথই ভাল। মাঝে মাঝে ঝড়ের মত কিছু ট্রাক অবিশ্য গা ঘেষে যাচ্ছে। ড্রাইভাররা বিরক্ত চোখে শুভ্ৰকে দেখছে। এ ছাড়া অন্য কোনো সমস্যা নেই। শুভ্ৰর মনে হল রাস্তার রঙ সব সময় কালো কেন? নীল রঙের রাস্তা হল না কেন? পিচের সঙ্গে নীল রঙ মিশিয়ে রাস্তা নীল করাটা খুব কঠিন কিছুতো না! নীল রঙের রাস্তা মানেই নদী নদী ভাব। ভবিষ্যতের পৃথিবীর রাস্তার রঙ কেমন হবে? কালোই থাকবে না, নীল হলুদ গোলাপি হবে?

শুভ্রর ইচ্ছা করছে তার কোনো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হতে। দরজার কড়া নাড়বে। অনেকক্ষণ পর একজন কেউ দরজা খুলে অবাক হয়ে বলবে, আরো কে, শুভ্ৰ না? তারপর সেই মানুষটা ভেতরের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলবে, দেখে যাও কে এসেছে! দেখে যাও।

তার সে ধরনের আত্মীয়স্বজন নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তাদের ঠিকানা শুভ্ৰ জানে না। শুভ্ৰ তাদের কাউকেই চেনে না। তারাও হয়ত শুভ্ৰকে চেনে না।

একদিন আলতাফুর রহমান স্যার ক্লাস নিচ্ছিলেন। তিনি মাঝপথে লেকচার থামিয়ে হঠাৎ বললেন তোমরা কেউ কি বলতে পারবে মানুষ তার সমগ্র জীবনে সবচে বেশি কোন শব্দটা বলে? কেউ উত্তর দিল না। স্যার চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ড বড় বড় করে লিখলেন– না।

না শব্দটা মানুষ সবচে বেশিবার বলে।

তুমি ভাল আছ?

না।

মন ভাল?

না।

বেড়াতে যাবে?

না।

মানুষের পৃথিবী হচ্ছে না—ময় অথচ মানুষকে তৈরি করা হয়েছে হ্যাঁ বলার মত করে।

Listen my boy, মানুষ যেন কখনো হ্যাঁ ছাড়া না বলতে না পারে প্রকৃতি সেই ব্যবস্থা। কিন্তু করে রেখেছে। তোমরা একটু ভেবে দেখ— নিচের প্রশ্নগুলির উত্তর ভাব।

হে মানব সম্প্রদায়, তোমরা কি ক্যানসারের ওষুধ বের করতে পারবে?

হ্যাঁ পারব।

এইডস এর ওষুধ?

হ্যাঁ পারব।

তুমি নক্ষত্রমন্ডল জয় করতে পারবে?

হ্যাঁ পারব।

জরা রোধ করতে পারবে?

হ্যাঁ পারব।

মৃত্যু। মৃত্যু রোধ করতে পারবে?

হ্যাঁ পারব।

মজার ব্যাপার দেখ, কোনো প্রশ্নের উত্তরে মানুষ কিন্তু না বলছে না। অথচ সেই মানুষই তার ব্যক্তি জীবন না বলে বলে কাটিয়ে দিচ্ছে। মানুষের ভেতর যত কনট্রাডিকশন আছে– আর কোনো কিছুতেই এত কনট্ৰডিকশন নেই। এইটা মনে রেখা। দেখবে জীবনযাত্রা সামান্য হলেও সহজ হবে।

শুভ্রর জীবনযাত্রা সহজই ছিল। এখন থাকবে কি-না সে বুঝতে পারছে না। দ্রুত গতিতে একটা ট্রাক আসছে। ট্রাকের ড্রাইভার একবার অবহেলার দৃষ্টিতে শুভ্রর দিকে তাকাল। শুভ্ৰর হঠাৎ ইচ্ছা করুল— আচমকা ট্রাকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। আচ্ছা এই রকম একটা চিন্তা কি শুরু থেকেই তার মাথায় ছিল? হয়ত ছিল। না হলে ফুটপাত ছেড়ে সে রাস্তায় নেমে হাঁটছে কেন?

ট্রাক ড্রাইভার হর্ন দিচ্ছে। সেই হর্নের শব্দ বিকট। শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে মাথা ধরে যায়। শুশ্রীর মাথা ধরে গেছে।

এই শুভ্র! এই!

শুভ্র চমকে তাকাল। বুড়োমত এক ভদ্রলোক ফুটপাত থেকে তাকে ডাকছে। বুড়োর গায়ে ময়লা পাঞ্জাবি। মুখ ভর্তি পান। পানের রস গড়িয়ে থুতনিতে পড়েছে। বুড়ো দুহাত উঁচিয়ে শুভ্রকে ডাকছেন। শুভ্র ফুটপাতে উঠে এল।

আমাকে চিনেছ?

জ্বি না।

আমি তোমার শিক্ষক ছিলাম। যখন ছোট ছিল তখন তোমাদের বাসায় প্রাইভেট পড়াতে যেতাম। আমার নাম আহমেদ উল্লাহ। আমারে চিনতে পার নাই?

জ্বি না।

আমি তোমারে দেখেই চিনেছি। তোমার চেহারা বদলায় নাই। আগে যেমন ছিল এখনও তেমন আছ। তোমারে দুই মাস পড়ায়েছি। তারপর জানি না। কী কারণে তোমার বাবা আমারে পছন্দ করল না। থাক এইসব ইতিহাস। আছ কেমন বল?

জ্বি ভাল।

রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ায়ে ছিলা কেন? রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকবা না। একসিডেন্ট হবে। যাই হোক বাবা শোন— খুবই খারাপ অবস্থায় আছি, পঞ্চাশটা টাকা দিতে পারবো? না পারলে বিশ পঁচিশ যা পার দাও। শিক্ষককে সাহায্য করা সোয়াবের ব্যাপার। এবং কর্তব্যও বটে। শিক্ষক জাতির মেরুদণ্ড।

শুভ্ৰ মানিব্যাগ খুলল। আহমদ উল্লাহ মানিব্যাগের দিকে তাকিয়ে বললেন, আর একটু বেশি দিতে পারলে খুবই ভাল হয়। বাবা। দুইশ টাকা দাও।

শুভ্ৰ দুটা একশ টাকার নোট দিল। আহমদ উল্লাহ সাহেব নোট দুটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এখনো তার চোখ শুভ্ৰর মানিব্যাগের দিকে। মানিব্যাগে বেশ কিছু পাঁচশ টাকার নোট দেখা যাচ্ছে। প্রথমবার পঞ্চাশ টাকা না চেয়ে পাঁচশ টাকা চাওয়া দরকার ছিল। শুভ্র বলল, স্যার যাই।

আহমদ উল্লাহ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। তার দিনটাই নষ্ট হয়ে গেছে। শুভ্র আবারো ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় নামল। দ্রুতগামী কোনো গাড়ির সামনে দাঁড়াতে ইচ্ছা করছে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও কাজটা করতে হবে। এটা না করলে ইচ্ছাটা মনের ভেতর থেকে যাবে। এবং ইচ্ছাটা বাড়বে। যে-কোনো ইচ্ছা মনের ভেতর পুষিলেই দ্রুত বাড়ে। এক সময় মানুষ তার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। তখন মানুষ ইচ্ছার পিঠে চাপে না। ইচ্ছা মানুষের পিঠে চাপে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *