০৬. উত্তরের দস্যুদল

০৬. উত্তরের দস্যুদল

আওরঙ্গজেব চাদর টেনে তুলে নাক-মুখ ঢাকলেন। উত্তর দিক থেকে বয়ে আসা দমকা হাওয়ার সাথে ধূলি আর কাঁকর চাবুকের মতো মুখে এসে পড়ছিল। পারস্যের সহায়তায় আফগান এলাকায় যে বিদ্রোহ চলছে, তা দমন করার জন্য তিনি সেনাবাহিনী নিয়ে অমসৃণ পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া একটি গিরিপথ দিয়ে সামনে এগোচ্ছিলেন। অন্তত এখনকার মতো তিনি পাঞ্জাবের লড়াকু শিখদের হুমকি শেষ করে এসেছেন। তাদের প্রধান নেতা তেগবাহাদুর এখন দিল্লিতে তাঁর লাল কেল্লার মূল ফটকের শোভাবর্ধন করছে। অবশ্য এখনও বাকি আছেন শিবাজি। তবে জানমালের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির পরও মোগল সেনারা মারাঠিদের হুমকি-ধামকি দাক্ষিণাত্যের মাঝে সীমিত করে রেখেছে।

 ধূলিময় বাতাস বেশ ঠাণ্ডা ছিল, আওরঙ্গজেব পশমি আলখাল্লাটা শক্ত করে গায়ে জড়িয়ে নিলেন। এসময় মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা পূর্বপুরুষ বাবরের কয়েকটি কথা তার মনে পড়লো, যা তিনি ছোটবেলায় পড়েছিলেন। হিন্দুস্তানের গরমের প্রতি অপছন্দ আর ওক্সাস নদীর ওপারে তাঁর নিজদেশ ফারগানার শীতল পর্বত আর বরফে ঢাকা নদীর জন্য তাঁর আকুলতার কথা বাবর লিখেছিলেন। সেই তখনকার দিনে কি সুদীর্ঘ পথ মোগলরা পাড়ি দিয়েছিলেন… তারপর কিরকম বদলে গেলেন। রুক্ষ, হাওয়ায় উড়িয়ে নেওয়া এই পাহাড়গুলো যেমন তাঁর কাছে ভিনদেশী মনে হচ্ছিল, ঠিক তেমনি দেড়শো বছর আগে হিন্দুস্তানের উষ্ণ সমতলভূমিও বাবরের কাছে তাই মনে হয়েছিল।

তন্ময় হয়ে আওরঙ্গজেব এসব ভাবছিলেন, তারপর হঠাৎ বাস্তবে ফিরে এসে দেখলেন তাঁর সামনের ঘোড়সওয়ারীদের চলার গতি ধীর হয়ে এসেছে। আরো সংকীর্ণ দুই ধার উঁচু একটি গিরিপথে ঢোকার চেষ্টা করতে গিয়ে ওরা একে অপরের সাথে ধাক্কাধাক্কি শুরু করেছে। এই গিরিপথটিতে চারজনের বেশি অশ্বারোহী চলার মতো জায়গা নেই। আধঘণ্টা পর তাদেরকে অনুসরণ করে যখন তিনি রাজকীয় হাতির পিঠে চড়ে ছায়াঘেরা গিরিপথের মাঝে ঢুকলেন– সেনাবাহিনীর পূর্বেকার বিন্যাসে ফিরে আসার জন্য একটু সময় লেগেছিল আর অগ্রগামী দলটিও তাঁর আগে প্রায় এক মাইল দূরে চলে গিয়েছিল। মাঝখানে একা পড়ে গিয়ে আওরঙ্গজেব একটু শীতলতা অনুভব করলেন। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন পাথর আর ছোট ছোট নুড়িপাথরে ঢাকা পাহাড়ের চূড়ার আড়ালে শরতের সূর্য ঢাকা পড়েছে। একচিলতে যে আকাশ দেখা যাচ্ছিল সেখানে হঠাৎ প্রচণ্ড চিৎকার করতে করতে কতগুলো কালো প্যাচা এসে অন্ধকারে ঢেকে দিল। একটি মুহূর্ত তার মনে হল উপরের পাথরের মাঝে কিছু একটা নড়াচড়া করছে। ওটা কি গাদা বন্দুকের গুলি চালানোর ক্রমাগত পট পট শব্দ? নাকি শুধু ছুটে চলা মেঘ ছায়া সৃষ্টি করেছে আর অনেক দূরে বাজ পড়ার মৃদু গুড়গুড় শব্দ? তারপর হঠাৎ তার সমস্ত দেহরক্ষী তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে তাদের ঘোড়ার রাশ টেনে ধরলো। ঘোড়াগুলো তখন মৃদু হেষাধ্বনি করে বিপদসঙ্কেত দিল।

সামনে কি হয়েছে দেখার জন্য আওরঙ্গজেব তার দেহরক্ষীবাহিনীর একজন সেনা কর্মকর্তাকে বলতে যাবেন, এমন সময় তিনি একটি চিৎকার শুনতে পেলেন, “আমার পথ ছাড়। আমাকে জাঁহাপনার কাছে গিয়ে খবর পৌঁছাতে হবে। তারপর দেখলেন সামনের একটু হট্টগোলের মধ্য থেকে একজন তরুণ অশ্বারোহী বেরিয়ে এসে তাঁর সামনে দাঁড়ান দেহরক্ষীদের সারির সামনে থামলো। আওরঙ্গজেব আদেশ করলেন, “ওকে আসতে দাও। সাথে সাথে দেহরক্ষীরা দুপাশে সরে দাঁড়াল। একমুহূর্ত পর তিনি হাত তুলে তরুণটিকে প্রথানুযায়ী সম্রাটকে কুর্ণিশ করা থেকে বিরত করে বললেন, ‘ঐসব লৌকিকতা এখন থাক। সামনে কি হয়েছে? কেউ হামলা করেছে?

 ‘হা জাহাপনা। আমার বাবা ইউসুফ খান আজ অগ্রগামী দলের নেতা। সামনের বাঁক ঘুরে গিরিপথের সবচেয়ে সংকীর্ণ পথে ঢুকতেই পাহাড়ের চূড়া থেকে একপশলা গুলিবৃষ্টি হল। সামনের সারির কয়েকজন ঘোড়সওয়ার ঘোড়ার উপর থেকে পড়ে গেল। আমার মনে হয় দু-তিনজন আহত হয়েছিল–ওদের ঘোড়াগুলো ভয় পেয়ে সওয়ারিসহ দ্রুত গিরিপথের উপরের দিকে কিছুটা পথ ছুটে গেল। আমার বাবা দলের পরবর্তী সারির রক্ষী সেনাদেরকে ঘোড়া থেকে নেমে আক্রমণ মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। বিশেষত তিনি বরকন্দাজদের বললেন গাদা বন্দুকে গুলি ভরে প্রস্তুত হতে। গুলিগুলো কোথা থেকে এসেছিল তা দেখার জন্য তারপর আমরা উপরের দিকে তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। তবে কাউকে দেখা গেল না–তারপর হামলাকারীরা দ্বিতীয়বার গুলিবর্ষণ করে আমাদের কয়েকজনকে হতাহত করলো। হট্টগোলের মধ্যে আরো কয়েকটা ঘোড়া ছুটে পালাল।

 ‘পরেরবার আমাদের শত্রুরা গুলি ছোঁড়ার সময় যেসব জায়গা থেকে ধোঁয়া বের হয়েছিল, সেদিকে লক্ষ্য করে বাবা আমাদের বন্দুকধারী সেনাদেরকে গুলি ছুঁড়তে বললেন। উপরে উঠে শত্রুপক্ষের গতিবিধি সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য তারপর তিনি চারজন গুপ্তদূতকে খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে বললেন। যাইহোক ওরা পাথুরে পাহাড়ের গায়ে পা রাখার জায়গা খুঁজে কোনোমতে উঠার চেষ্টা করতেই উল্টোদিকের চূড়া থেকে আবার গুলি বর্ষণ হল। দুইজন দুই হাত দুই দিকে ছুঁড়ে নিচে পড়ে গেল। একজন নিচে গিরিপথের পাথুরে পথে পড়ে গিয়ে মাথা ফাটাল। অন্যজনের দেহটি পাহাড়ের পাথুরে গা বেয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে স্থির হয়ে রইল। আমার বাবা চিৎকার করে বাকি গুপ্তদূতদের ফিরে আসতে বললেন, তারপর রক্ষীবাহিনীর বাকি সদস্যদের পিছু হটে বাঁক পেরিয়ে নিরাপদে অবস্থান নিতে বললেন। তারপর তিনি আমার কাছে এসে বললেন দ্রুত ছুটে গিয়ে আপনাকে খবরটা জানাতে। ‘ওখানে কয়জন হামলাকারী আছে?’

 ‘আমি ঠিক জানি না। তবে এক একবার গুলিবর্ষণের সময় মনে হয়েছিল একসাথে অনেক গাদা বন্দুক ব্যবহার করা হয়েছিল। আর প্রত্যেকবার বিশ থেকে ত্রিশজন মানুষ কিংবা ঘোড়া আহত হয়ে পড়ে গিয়েছিল। যে দূরত্ব থেকে হামলাকারীরা গুলি ছুঁড়ছিল তাতে আমার ধারণা, দশটির মধ্যে একটা গুলি লক্ষ ভেদ করার কথা। সে হিসেবে শত্রুর সংখ্যা তিনশোর কম হবে না।’

 ‘তুমি যা বললে, তাতে আমার মনে হচ্ছে সংখ্যাটা আরো বেশি হবে। গিরিপথটি ওরা বন্ধ করে দিয়েছে?

 ‘আমারও তাই মনে হয়। এখানে আসার ঠিক আগে আমি একজন সেনাকে উপরে উঠে দেখতে বলেছিলাম। সে উপরের ঢাল থেকে চিৎকার করে জানাল সামনের আরেকটি বাঁকের কাছে পথের উপর গাছের গুঁড়ি-ডালপালা আর বড় বড় পাথর ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। তবে তার দেখার ভুলও হতে পারে।

 ‘আমার তা মনে হয় না।’ এই কথাটি বলে আওরঙ্গজেব থেমে কিছুক্ষণ ভাবলেন। অজানা সংখ্যক তবে যথেষ্ট পরিমাণে হামলাকারী আর সামনে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ থাকার অবস্থায় পিছু হটাই এখন বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তিনি তরুণটিকে বললেন, তুমি তোমার বাবার কাছে ফিরে যাও। তাকে বল পিছু হটে আসতে। তারপর সম্রাট তার দেহরক্ষীদেরকে বললেন, সৈন্যসারি ধরে পেছনে গিয়ে অন্য অধিনায়কদেরকে বল পেছনে ফিরে যেতে, তবে সতর্ক করে দেবে ওরা যেন সামনে আর পেছনের দলের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করে শৃঙ্খলা মেনে চলে। সেনাদলের কোনো অংশ যেন অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে।

*

সেদিন সন্ধ্যায় গিরিপথের ঢোকার মুখে একটি সমতল জায়গায় তবু স্থাপন করা হল। আগুন জ্বালাবার পর আওরঙ্গজেব একটি সমরসভা ডেকে অধিনায়কদের আসার অপেক্ষা করছিলেন। যেরকম আশা করা হয়েছিল, সেনা প্রত্যাহার সেরকম হলেও তিনি প্রায় একশো সেনা হারিয়েছিলেন। বেশিরভাগ পাহাড়ের উপর থেকে গাদা বন্দুকের গুলি লেগে নিহত হয়েছিল। এছাড়া হঠাৎ দু একজন উন্মত্ত হামলাকারী চিৎকার করতে করতে তাদের লুকোনো জায়গা থেকে বের হয়ে আফগান তলোয়ার হাতে সৈন্যদলের উপর হঠাৎ হামলা করেছিল। কয়েকজনকে হতাহত করার পর ওরাও যথারীতি নিহত হল।

 ইউসুফ খানের নেতৃত্বে অগ্রগামী বাহিনীর শেষদলটি যখন গিরিপথ থেকে বের হয়ে আসছিল, তখন তিনটি ঘোড়া গিরিসঙ্কট ধরে ওদের দিকে ছুটে আসছিল। প্রতিটি ঘোড়ার জিনের উপর সবুজ পোশাকপরা মোগল সৈন্যের দেহ শোয়া অবস্থায় ছিল। ওদের হাত-পা একসাথে ঘোড়ার পেটের সাথে রশি দিয়ে বাঁধা ছিল। ইউসুফ খানের সেনারা রশি কেটে দেহগুলো আতঙ্কিত ঘোড়াগুলোর পিঠ থেকে নামিয়ে দেখতে পেল ওরা তাদেরই লোক, প্রথম আক্রমণের সময় যাদের ঘোড়াগুলো সামনের দিকে ছুটে গিয়েছিল। ওদেরকে ভয়ঙ্করভাবে বিকলাঙ্গ করা হয়েছে। একজনের লিঙ্গ কেটে তার মুখে পুরে দেওয়া হয়েছে। অন্য দুজনের চোখ খুবলে নেওয়া হয়েছে, নাকের ছিদ্র কেটে ফাঁক করে দেওয়া হয়েছে আর কান আর জিহ্বাও কেটে নেওয়া হয়েছে। মৃতদেহগুলোর সাথে কোনো বার্তা ছিল না, তবে এর অর্থ পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে। এই পাহাড়ি এলাকার বন্য মানুষের মাঝে মোগল আইন চলবে না।

সেনাপতিরা এগিয়ে আসছিলেন। সবার আগে ছিলেন মারওয়ারের শাসক, রাজা যশবন্ত সিং। কমলা রং-এর যুদ্ধবেশপরা তার একজন যোদ্ধা আগে আগে একটি অগ্নিশিখার প্রতীক সম্বলিত পতাকা বয়ে নিয়ে আসছিল। তাকে দেখার সাথে সাথে আওরঙ্গজেবের আরেকজন রাজপুত সেনাপতি–আম্বারের অশোক সিং-এর কথা মনে পড়ে গেল। কয়েকবছর আগে যখন বলখ আর সমরকন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান হয়েছিল, তখন একই রকম পরিস্থিতিতে সেনা প্রত্যাহার করার নির্দেশ তিনি অমান্য করেছিলেন। বরং তিনি এবং তার অনেক সৈন্য অদ্ভুত এক ধারণার বশবর্তী হয়ে নিজেদের সম্মান রাখার উদ্দেশ্যে শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে প্রাণ দিয়েছিলেন।

যেসব অঞ্চল সরাসরি মোগল শাসনে রয়েছে, কেবল সেসব জায়গার আওরঙ্গজেব হিন্দু প্রজাদের উপর বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন। তার অধীনস্থ সামন্ত রাজ্যগুলো এর আওতার বাইরে ছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল রাজস্থান, যারা আগের নিয়মেই চলতো। দূরদর্শিতা দেখিয়ে তিনি এই পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন, তবে সব সময়ের জন্য নয়। সময় সুযোগ এলে তিনি এই তেজস্বী রাজপুতদের উপরেও তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন। দীর্ঘদিন থেকে এদের উপর তার আস্থা নেই। এদের পরিবর্তনশীল ব্যক্তিত্বের তল পাওয়া বেশ কঠিন। কেননা এদের মৃত্যু অথবা বিজয়’–এই কৌশলটি সামরিক বা যুদ্ধবিদ্যা সংক্রান্ত কৌশলের সাথে খাপ খায়। আর ওদের কুফরি ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে বলার কিছুই নেই, এদের ধর্মীয় প্রথানুযায়ী নারীরা স্বামীর সাথে জলন্ত চিতার আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণবিসর্জন দেয়।

কোন রাজপুত রাজা অবশ্য এ পর্যন্ত তাদের স্বধর্মের লোকদের প্রতি তিনি যে আচরণ করছেন, সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিবাদ করে নি। তবে তাঁর গুপ্তচরেরা তাদের আশঙ্কা সম্পর্কে তাঁকে জানিয়েছিল। সেকারণেই উত্তরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধাভিযানে সাধারণত যা করা হত তার চেয়ে অনেক বেশি রাজপুত সৈন্য এবং সেনাপতি তিনি তাঁর সেনাদলে সংযুক্ত করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এদের দেহমনকে অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত রাখা, আর কোথাও হিন্দু কোনো সশস্ত্র বিদ্রোহ দেখা দিলে তা থেকে ওরা যেন দূরে থাকে। বিশেষত যশবন্ত সিং-এর বিশ্বস্ততা নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে তাঁর সন্দেহ ছিল। গৃহযুদ্ধের সময় তিনি অতিদ্রুত, বেশ সহজভাবে পক্ষবদল করে আওরঙ্গজেবের পক্ষে চলে এসেছিলেন।

আওরঙ্গজেব এবার বললেন, তাঁবুর ভেতরে আসুন যশবন্ত সিং রাজপুত রাজা মাথা নুইয়ে অভিবাদন করে ভেতরে ঢুকলেন, তাকে অনুসরণ করে অন্যান্য সেনাপতিও ঢুকলেন। সবাই ভেতরে ঢোকার পর আওরঙ্গজেব ঘুরে নিজেও ঢুকে তারপর বললেন, আপনারা সবাই বসুন। আমাদেরকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে সামনে এগোবার সবচেয়ে ভাল উপায় কোনটি। তবে সবার আগে জানতে হবে, আজ রাতে আমাদের এই শিবিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট প্রহরী আর পাহারা-চৌকির ব্যবস্থা করা হয়েছে কি-না।

যশবন্ত সিং উত্তর দিলেন, অবশ্যই করা হয়েছে, জাঁহাপনা। আমরা প্রহরীর সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে তিনগুণ বৃদ্ধি করেছি আর সীমানা রেখার চারপাশ ঘিরে অশ্বারোহী সেনাদল টহল দিচ্ছে।’

 ‘বেশ ভাল। আর আগামীকালের জন্য আপনাদের মতামত কী?

যশবন্ত সিং আবার উত্তর দিলেন, পাহাড়ি এই উপজাতিদের সম্পর্কে আমার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। তা থেকে আমি বলতে পারি, রাতের বেলা ওরা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাবে। আর তা যদি ওরা নাও করে, তাসত্ত্বেও জোর করে গিরিপথ পার হওয়ার চেষ্টা করা বোকামি হবে। আমাদেরকে ওদের পাশ কাটিয়ে বা এড়িয়ে যেতে হবে। এটা খুব একটা কঠিন হবে না। এখানে ইতোপূর্বেকার আমার কয়েকটি সফল অভিযানের কথা মনে পড়ে, এই পাহাড়গুলোর মধ্য দিয়ে আরো অনেক গিরিপথ আছে।

 আওরঙ্গজব মৃদু হাসলেন। যশবন্ত সিং-এর উপদেশটি বেশ ভাল। সামরিক দক্ষতা আর অভিজ্ঞতা নিয়ে তার বেশ গর্ব রয়েছে। তার এই আত্মতৃপ্ত মতামতটি সম্রাটকে একটি ধারণা দিয়েছে যা এই রাজপুত রাজাটি পছন্দ করবেন না। তবে এতে ক্ষতিকর কিছু করা থেকে তিনি দূরে থাকবেন আর কয়েক বছরের জন্য সম্রাটের ক্ষমতার কেন্দ্র থেকেও দূরে থাকবেন। এই অভিযানটি বিজয় লাভের পর তিনি এই পার্বত্য এলাকায় যশবন্ত সিং-এর নিজ দাবিকৃত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তাকে জানাবেন, নতুন এই পদের জন্য তিনিই একমাত্র উপযুক্ত প্রার্থী আর সেজন্য যশবন্ত সিংকেই তিনি বিদ্রোহীসুলভ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সুবেদার নিযুক্ত করছেন।

*

খাইবার গিরিপথের কাছেই তাঁবুতে যশবন্ত সিং শুয়ে রয়েছেন, তার চোখে ঘুম নেই। তাঁবুর চারপাশ ঘিরে শীতের হাওয়ার গর্জন শোনা যাচ্ছে, বাতাসে তাঁবুর ক্যানভাসের দেয়াল কাঁপছিল। পারস্যের মদদে যে বিদ্রোহী আর দস্যুদল উত্তরের গিরিপথ দখল করেছিল আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনী অতিদ্রুত তাদেরকে হটিয়ে দিয়ে গিরিপথগুলো মুক্ত করলো। তবে একাজে সহায়তার জন্য রাজপুতরা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে তাকে এখানকার সুবেদার নিযুক্ত করায় বিস্মিত হওয়ার সাথে সাথে তিনি বেশ হতাশও হয়েছিলেন। তবে সম্রাট যখন তার অভিজ্ঞতার গদগদ প্রশংসা করছিলেন আর জোরালোভাবে বলেছিলেন যে এই পদের জন্য তিনিই শ্রেষ্ঠ, তখন তাঁর সম্রাটের এই সিদ্ধান্তে প্রশ্ন করার কোনো কারণ তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না।

এটা বেশ কয়েকমাস আগের কথা। এখানকার শাসনকর্তৃত্ব পাওয়ার পর তার পূর্বসুরিদের মতো তিনিও আবিষ্কার করলেন যে, এই পার্বত্য উপজাতিদের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা কি কঠিন ব্যাপার। উপজাতিরা তার সীমান্তবর্তী দুর্গে আক্রমণ চালাতো, আর তার রসদ সরবরাহ ব্যবস্থার উপর অতর্কিত হামলা করতো। প্রতিটি হামলার পর তাদেরকে ধরার আগেই ওরা অদৃশ্য হয়ে যেত। তাদের গাদা বন্দুকের পাল্লা তার নিজের সেনাদের চেয়ে বেশি ছিল আর পাহাড়ি ছাগলের মতো ওরা খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে উঠানামা করতো। এছাড়া কোনো মোগল সৈন্য তাদের হাতে ধরা পড়লে ওরা বন্দী সেনার উপর অত্যন্ত জঘন্যভাবে বর্বর নৃশংসতা চালাত। আর এতে অন্যদেরকে বাধ্য করতো দলে ভারী হয়ে তাদের পিছু করতে। কেবল যে কোনো ছুতায় ওদের নিজেদের মধ্যে লড়াই করার স্বাভাবিক প্রবণতাই ওদেরকে সম্পূর্ণ প্রদেশে ছড়িয়ে পড়া ও দখল করা থেকে বিরত রেখেছে। বিশেষত তার রাজপুত সেনারা পার্বত্য অঞ্চল, এর আবহাওয়া আর স্থানীয় অধিবাসীদেরকে সমানভাবে ঘৃণা করে। সমতল এলাকার অন্যদের মতো তিনি নিজেও বেশ কয়েকবার সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হয়েছেন আর দিন দিন এটা এখন ঘন ঘন হচ্ছে।

 নতুন করে ঝড়ো হাওয়ার ঝাঁপটায় তাঁবুটি আবার কেঁপে উঠলো। যশবন্ত সিং কেঁপে উঠলেন। এক গাদা ভেড়ার চামড়ার কম্বল শরীরে জড়িয়ে আর তাঁবুর এক কোণে পিতলের পাত্রে কাঠ-কয়লার আগুন জ্বলা সত্ত্বেও ঠাণ্ডায় তার হাড় পর্যন্ত কেঁপে উঠতে লাগলো। চোখ বুজে তিনি মুখে রোদের উত্তাপের কথা মনে করার চেষ্টা করতে লাগলেন। তার মনে পড়লো সেই বহুদূর চলে যাওয়া অপূর্ব সুন্দর রাজস্থানি মরুভূমিতে সূর্যাস্তের সময় তার বিশাল বেলে পাথরের দুর্গ মেহরানগড় কিরকম লাল হয়ে যেত। আর কি কখনও তিনি তার স্বদেশ দেখতে পাবেন? কোন কারণে তার এতে সন্দেহ হচ্ছে। এখানকার আবহাওয়া আর অসুখবিসুখ তাকে কাবু করে ফেলছে। সূর্য, চন্দ্র আর আগুনের অধিবাসীর একজন পুত্রের কি পরিণতি হয়েছে, এই ঠাণ্ডা, রুক্ষ দেশে অরাজক উপজাতিদের সাথে লড়াই করার জন্য তাকে দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। এমন একজন সম্রাট এই দণ্ডাদেশ দিয়েছেন, যাকে তিনি কখনও ভালোবাসেন নি, শুধু নিজের স্বার্থ বা সুবিধার কারণে তাঁর কাজ করছেন। অথচ তাকে এখানে ফেলে রেখে তিনি নিজে দিল্লি চলে গেছেন। হয়তো দেবতারা তাকে এই শাস্তি দিয়েছেন, কেননা শাহজাহান জীবিত থাকতেই তিনি আওরঙ্গজেবের প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছেন। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হল তিনি অনুভব করতেন যে, সম্রাট তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেন না–তবে তার মানে এই নয় যে সম্রাট কাউকে বিশ্বাস করেন। আর বিশেষত যশবন্তের নিজের জাতি বা ধর্মের কাউকেই বিশ্বাস করেন না।

আর যদি তিনি এই শীতল সুদূর পাহাড়ি অঞ্চলে মারা যান তাহলে মারওয়ারের কি হবে? তার একমাত্র পুত্র জগত সিং তার সাথে উত্তরের যুদ্ধাভিযানে এসেছিল, সেও ছয়মাস আগে নিহত হয়েছে। শত্রুদের অতর্কিত আক্রমণে তার ঘোড়াটি আহত হয়ে তাকে গভীর খাদে ফেলে দেয়। তার বংশের অনেক রাজপুত্র সিংহাসনে বসতে চাইবে। তিনি কোনো একটি ব্যবস্থা না করলে সেখানে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যাবে আর সেই সুযোগে মোগলরা তার রাজ্য দখল করে নেবে। ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি আবার কাশতে শুরু করলেন, কাশির সাথে ফেনার মতো রক্ত বের হয়ে এল। সাথে সাথে ভেজা একটা কাপড়ের টুকরা দিয়ে ঠোঁট মুছলেন। এই কাপড়টা আজকাল সব সময় তার কাছেই থাকে। আর দেরি করা যাবে না। তিনি পরিচারককে ডেকে বললেন, একটা কাগজ আর কলম নিয়ে এস।’

 ভেড়ার চামড়ার কম্বল গায়ে জড়িয়ে বসে তিনি কাঁপা কাঁপা হাতে তার মুখ্য মন্ত্রীর উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখতে শুরু করলেন। তার উত্তরাধিকার কে হবে সে বিষয়ে তার ইচ্ছার কথা লিখলেন। তার দুইজন স্ত্রী এখন সন্তানসম্ভবা। যদি একজনের ছেলে হয় তবে সে হবে পরবর্তী রাজা। দুজনেরই ছেলে হলে, প্রথম যার জন্ম সে হবে উত্তরাধিকারী। আর যদি কারও পুত্র সন্তান না হয়, তবে তার ভাইয়ের ছেলে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবে। চিঠি লেখা শেষ করার পর কাগজে গরম মোমের প্রলেপ দিয়ে তার সীলমোহর দিয়ে ছাপ মেরে দিলেন। তারপর যশবন্ত সিং শুয়ে পড়লেন, বাইরে ঝড়ো বাতাস প্রচণ্ড শো শো শব্দ করে চললো। পরিশেষে এখন মৃত্যু যদি শীঘ্রই চলেও আসে তিনি তার রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পেরেছেন, অবশ্য তার মনে হচ্ছে মৃত্যু আসলেই সন্নিকটে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *