উজুবট গ্রামে ঐ সময়ে একদা মায়াবতীর স্বামী বসন্তদাসের আগমন ঘটলো। শোনা যায়, সে পূর্বদেশ অঞ্চলে বাণিজ্য যাত্রায় গিয়েছিলো। তবে নিজ গ্রামে প্রত্যাবর্তন না করে, কেন শ্বশুরালয়ে তার আগমন ঘটলো সেই রহস্য উদ্ধার করা গেলো না। বিশেষত দীনদাস ঘটনাটি সহজভাবে মানতে পারলেন না।
মায়াবতী অতিশয় উফুল্লা, যোগমায়াও জামাতার শ্রীমুখদর্শনে তুষ্টা। শুকদেব জামাতাকে আপ্যায়নের জন্য এতো ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে তাঁর মনে ভিন্ন প্রশ্নের উদয় আর হলো না। কিন্তু দীনদাসের মনে চিন্তাটি থেকেই গেলো। তিনি স্বল্প বিচলিতও বোধ করলেন, যখন একদা দেখলেন যে, চারজন সদ্ধর্মী ভিক্ষু জামাতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গেলো। ভিক্ষুরা অবশ্য বিলম্ব করেনি, সামান্য কিছুক্ষণ অবস্থান করেই বিদায় নিয়েছে। কিন্তু তবু দীনদাস উদ্বিগ্ন রইলেন।
একাকী শুধু দীনদাস নয়। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ আরও দুএকজন হিতাকাক্ষী ব্যক্তি ভিক্ষুদের সংবাদ নিতে আসেন। কেউ কেউ অনুসন্ধান পর্যন্ত করে যান, সত্যি সত্যি। ভিক্ষুরা বিদায় নিয়েছে কিনা। ইতোমধ্যে শোনা যায়, দূরস্থিত জনপদগুলিতে পর্যন্ত মানুষকে নাকি সন্ত্রস্ত এবং আতঙ্কিত দিনযাপন করতে হচ্ছে। এখন সদ্ধর্মী ভিক্ষু দেখলেই মানুষ প্রমাদ গণনা করে।
ঘটনাটি এইরূপ:
সামন্ত হরিসেন তাঁর অঞ্চলের হাটগুলিতে কর ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। তাঁর উদ্দেশ্য মহত্ত্ব ছিলো–একটি মন্দির নির্মাণের বাসনা তার। প্রথমতঃ বৃহৎ বণিকদের উপরই এই কর আরোপিত হয়। কিন্তু সামন্ত প্রভুর দাস এবং কৃপাভোগীদের উৎসাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রমে এমন অবস্থার সৃষ্টি হলো যে ক্ষুদ্র বণিকদেরও আর নিষ্কৃতি রইলো না। তারা ক্ষুদ্রবিত্ত বণিকদের নিকট থেকেও কর গ্রহণ করতে লাগলো। কর অনাদায়ে সমূল পণ্য আত্মসাৎ, অহেতুক শাস্তি প্রদান, সামান্য কারণে লাঞ্ছনা গঞ্জনা–এই সকল ঘটতে আরম্ভ করলো। ফলে ক্রেতা–বিক্রেতা উভয় পক্ষেই সৃষ্টি হলো ত্রাহি ত্রাহি অবস্থার।
ঐ সময়ই অকস্মাৎ ঘটনাটি ঘটে।
ঘটনা সামান্য, কিন্তু ঐ সামান্য ঘটনাই একটি প্রচণ্ড, নিষ্ঠুর এবং ব্যাপক বিপর্যয় ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। সমিধ প্রস্তুত থাকলে ক্ষুদ্র একটি স্ফুলিঙ্গই যে দাবানল সৃষ্টি করতে পারে, এতে আর অবাক হওয়ার কি আছে?
হাটের একপ্রান্তে কর্মকারদের বিপণী। কর্মশালার অদূরে ডোম ও চণ্ডাল শ্রেণীর রমণীরা তাদের হস্তনির্মিত পণ্যাদি–যেমন চাঙাড়ি, খুচি ডুলা, টুকরি এইসব বিক্রয় করে। কয়েকটি ডোমনী যুবতী পিপ্পলী হাট অঞ্চলে বিশেষ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিলো। এতে উগ্র–ক্ষত্রিয় হরিসেনের প্রধান অনুচর বজ্রসেনের ডোমনীদের উপর বিশেষ ক্রোধ ছিলো। ঐ দিন বজ্ৰসেন তার সহচরদ্বয় সমভিব্যহারে হাটে সদম্ভে বিচরণ করছিলো। ঐ প্রকার বিচরণকালে হঠাৎ তারা লক্ষ্য করে যে দুজন সদ্ধর্মী ভিক্ষু ডোম যুবতীদের সঙ্গে হাস্যালাপে রত। দুটি যুবতী, বিশেষ করে কলহাস্যে এমনই বেপথু হচ্ছিলো যে তাদের উর্ধাঙ্গের বসন বারবার বিস্রস্ত হয়ে পড়ছিলো। সে দৃশ্যে বজ্রসেন কি দেখেছিলো ঈশ্বর জানেন, সে হুঙ্কার দিয়ে অগ্রসর হয় এবং ডোমনীদের কাছে গিয়ে তাদের পণ্যের মূল্য জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু ডোমনীদের তখনও উল্লাসঘোর কাটেনি, অঙ্গে হাস্য তখনও তরঙ্গায়িত হচ্ছে এবং কোনোদিকেই তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই। সম্ভবত বজ্রসেনের কথা তারা শুনতেও পায়নি। ঐ সময় ক্ষুব্ধ বজ্রসেন চিৎকার করে বলে ওঠে, ওরে পামরি, হট্টকর দিয়েছিস?
অধিক আর কি! ডোমনীটি যুবতী, তায় রূপসী এবং সর্ববিষয়ে পারঙ্গমা। ঊর্ধ্বাঙ্গের বস্ত্রাঞ্চল কটিলগ্ন ও দুহাতের পিত্তল বলয় চমকিত করে বলে ওঠে, কিসের কর, আমরা কেন হট্টকর দিতে যাবো?
তুই কেন শূকরপুত্রী, তোর পিতা দেবে।
অ–অ, বজ্রসেনের দিকে ঐ সময় অন্য ডোমনীরা কটিদেশে বস্ত্রাঞ্চল বন্ধন করে এগিয়ে আসে। একজন ডেকে বলে, হ্যাঁ লো কুসুম, কি বলে ঐ দগ্ধমুখ মর্কট!
কুসুম তার স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় বলে ওঠে, অরে ছিনাল পুত্র, আমরা যে তোর পিতার কর্মস্থলের দ্বারদেশ থেকে তোকে টেনে এনে জগৎ দেখাবার সময় কর দিয়ে এসেছি, সে সংবাদ কি তোর মা তোকে জানায়নি?
বজ্রসেনের ব্রহ্মতালু পূর্ব থেকেই দাহ্য হয়ে উঠেছিলো, ডোমনীর ঐ কথায় সেখানে যেন অগ্নিসংযোগ হলো। সে এক লম্ফে কি বললি, কি বললি এই কথা উচ্চারণ করে। এবং সজোর মুষ্টিতে কেশ আকর্ষণ করে কুসুম ডোমনীকে ভূমিতে নিক্ষেপ করে।
অন্য ডোমনী ও ডোমেরাও ঘটনাস্থলে ইতোমধ্যে এগিয়ে আসে। কর্মকার বিপণীগুলিতে ঠকঠক ঠনঠন শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। সকলেই বিস্ফারিত নয়নে দেখতে থাকে, অতঃপর কী ঘটে। ভিক্ষু চেতনানন্দ ঐ সময় নিকটস্থ হয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন। আবেদন জানান, মহাশয়, স্ত্রীদেহে ক্ষত্রিয়ের আঘাত শোভা পায় না, আপনি ক্রোধ সংবরণ করুন। ভিক্ষুর ঐ কথায় হিতে বিপরীত হয়। বজ্ৰসেন তার কোষবদ্ধ অসি নিষ্কোষিত করে ভিক্ষু চেতনানন্দের স্কন্ধে আঘাত করে বসে। তাতে আহত চেতনানন্দ আর্তনাদ করে ভূমিতে পপাত হন। ঐ দৃশ্য সমবেত জনতাকে স্তব্ধ করে দেয় মুহূর্তের জন্য। কিন্তু মুহূর্ত মাত্র, তারপরই কে একজন চিৎকার করে ওঠে, ধর শ্যালককে
অতঃপর যা ঘটতে থাকে তার বর্ণনা দেওয়া মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য। ভয়ানক উত্তেজিত এবং উৎক্ষিপ্ত মানুষ মার মার ধর ধর রব করতে থাকে। অচিরাৎ বজ্রসেনের দেহ ডোমনীরা ছিন্নভিন্ন করে দেয়–কেননা ধারালো অস্ত্র তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই ছিলো–ঐ অস্ত্রই তাদের পণ্য উৎপাদনের প্রধান অবলম্বন। বজ্রসেনের সহচরদ্বয় পলায়নের চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না–সমবেত জনতার মুষ্টি, পদ এবং কর্মকারদের হস্তলীর আঘাতে দুজনেরই দেহ কিমাকার মাংসপিণ্ডে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
পিপ্পলী হাটে সংঘটিত ঐ ঘটনার সময় হরিসেন গৃহে ছিলেন না। বয়স্য ও সুহৃদ দুই গ্রামপতিকে সঙ্গে নিয়ে মৃগয়ায় গিয়েছিলেন। মৃগয়াক্ষেত্রেই তিনি সংবাদটি পান। তারপর আর বিলম্ব করেননি, যথাসম্ভব দ্রুত প্রত্যাবর্তন করেন। পথিমধ্যে গ্রামপতি ও সামন্তদের যাকে পেয়েছেন তাকেই সঙ্গে নিয়েছেন। ঘটনাটি ঘটেছিলো দেববারে–তিনি পিপ্পলী হাটে তার বাহিনী নিয়ে উপনীত হলেন বুধবারে। দুদিন বিলম্ব হয় তাঁর লোক সংগ্রহের কারণে। প্রায় দ্বিশতাধিক শস্ত্রধারী যোদ্ধার দল যখন হাটে উপস্থিত হলো তখন নিকটের গ্রামগুলি হয়ে গেলো জনশূন্য!
হরিসেন প্রথমেই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সন্ধান করেন। ভিক্ষু চেতনানন্দ তখন মৃতপ্রায় সহচর শুদ্ধানন্দ তাঁর শুশ্রূষা করছেন। অন্য ভিক্ষুরা কোথায়, কেউ জানে না। যুবক ডোমেরা পূর্বেই গভীর বনভূমিতে পলায়ন করেছে। ডোম পল্লীতে কেবল বৃদ্ধ, শিশু এবং রমণী। কিন্তু হরিসেন তখন দারুণ ক্রোধে ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন। তিনি যা। করলেন, তার তুলনা হয় না। সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী কোনো মানুষের পক্ষে ঐ কাজের কল্পনা করাও অসম্ভব।
কুসুম ডোমনীকে ধরে এনে সর্বসমক্ষে দাঁড় করানো হলো এবং ঘোষণা করা হলো এই স্বৈরিণী সকল বিরোধের মূল, দেহের যে অংশের কারণে এই স্বৈরিণী পুরুষ সমাজে বিরোধ এবং লোভের বীজ বপন করে, শরীরের যে অংশ যথার্থই নরকের দ্বার, সেই অংশটি আমরা প্রজ্বলিত করে দেবো।
ঘোষণাটি সামন্ত হরিসেনের। ঘোষক কেবল বাক্যগুলি সচিৎকার উচ্চারণ করে গেলো। এবং তারপর সর্বসমক্ষে কুসুমকে নির্বস্ত্রা করে তার যোনিদেশে একটি উত্তপ্ত লৌহদণ্ড প্রবেশ করিয়ে দেয়া হলো। মৃত্যুর পূর্বেকার চিৎকার, বাঁচবার জন্য আকুলি বিকুলি, ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ–সবই কুসুম করছিলো। কিন্তু সবই তখন দেখাচ্ছিলো জীবনের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন পুত্তলীর হস্তপদ সঞ্চালনের মতো। শস্ত্রধারী সৈনিকদের দৃষ্টি হয়ে উঠেছিলো ভারী নিস্পৃহ। একজন অন্যজনের কানে এমনও মন্তব্য করেছে যে, দেখেছো, স্ত্রীলোকটির দেহে এখনও কিরূপ শক্তি?
ঐ সময় ধূম উদগীরিত হচ্ছিলো প্রবল। বাতাসে ছিলো দগ্ধ মাংস ও ভস্মীভূত কেশের গন্ধ। সূর্য ঐ সময় আবার পূর্বাকাশে একখানি পাটলর্ণের মেঘে তার সিন্দুর বর্ণটি লেপে দেয়। হরিগেনের জয়ধ্বনি দিতে আরম্ভ করে তার পদলেহী অনুচরেরা।
হরিসেন দেখছি প্রকৃতই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন!
এ মন্তব্যটি অন্য এক শস্ত্রধারী পুরুষের। ওদিকে নতুন ঘোষণা হচ্ছিলো তখন। কুসুম ডোমনীর গর্ভজাত শিশুপুত্র দুটি জারজ–পাপের সন্তান, অতএব তাদের বিনষ্ট করা হবে।
পরের দৃশ্যটিও সমবেত শস্ত্রধারী সৈনিকেরা অবলোকন করে। প্রায় প্রত্যেকের চক্ষুই রক্তবর্ণ, অত্যধিক মাদক সেবনের কারণেই সম্ভবত পদক্ষেপও অসংবৃত। তারা যা দেখছিলো তা যে মানব সম্পর্কিত কিছু–এই বোধ তখন অনেকেরই ছিলো না।
কিন্তু তথাপি কোথায় কী যেন ঘটে। ঐ জনসমষ্টির মধ্যভাগে, হয়তো গভীর কোনো তলদেশ থেকে, যেখানে দৃষ্টি ঢলে না সেইরূপ কোনো স্থান থেকে কেউ কেউ নয়ন মেলে দেখে দৃশ্যটি। আর খড়গাঘাতে দ্বিখণ্ডিত শিশুর রক্তাক্ত শব, কুণ্ডলীকৃত ধূম, অগ্নির লেলিহান শিখা এবং আকাশের পাটল মেঘে ডগডগে সিন্দুর বর্ণটি, সমস্ত একত্রিত হয়ে অদৃশ্য কোনো বন্ধন যেন ছিদ্র করে দেয়। আর তাতেই রুদ্ধবাক জনতা যেন অস্পষ্ট ভাষা পায়। একজন আর একজনকে প্রশ্ন করে, কেন? কেন? কেন?
কিন্তু ঐ প্রশ্নের উত্তরদাতা কেউ ছিলো না সেখানে।
ইতোমধ্যে মুমূর্ষ ভিক্ষু চেতনানন্দকে টেনে আনা হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে ঘোষক জানিয়েছেন–ধর্মবিরোধী অনাচারী এই পামরদের একটিই শাস্তি যা আমাদের পিতৃপুরুষদের কাল থেকে দেওয়া হচ্ছে। দেখো, তোমরা গ্রামবাসি!
গ্রামবাসীরা তখন দূরে। বনের বৃক্ষান্তরাল থেকে ঐ জনসমাগমটি দেখছিলো কেউ কেউ, কিন্তু প্রকৃত কী ঘটছে, তা বোঝা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। সুতরাং তারা দেখতে পায়নি যে ভিক্ষু চেতনানন্দকে প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে।
নরমাংস দগ্ধ হলে তার গন্ধ অসহ্য বোধ হয়। শস্ত্রধারী সৈন্য দলটি স্থান ত্যাগ করে একে একে দূরে গিয়ে দাঁড়াতে আরম্ভ করে। কেন, কেন, প্রশ্ন তখনও ছিলো। বিষ্ণুদাস মিত্র হরিসেনের অন্যতম মন্ত্রণাদাতা। তার দৃষ্টিতে সৈন্যদলের চঞ্চল আচরণ বিসদৃশ মনে হয়। সে হরিসেনের কাছে তার সন্দেহের কথাটি ব্যক্ত করে। ওদিকে তখন শুদ্ধানন্দকে সভামঞ্চে আনয়ন করা হয়েছে। ঘোষক ঘোষণা করে দিয়েছে যে, এই পামর যদি সমবেত সামন্তদের পাদুকা লেহন করে, তবে একে প্রাণ ভিক্ষা দেওয়া হবে।
ঐ কথার যে কী অর্থ, শুদ্ধানন্দের চেতনায় তার কোনো ছায়াপাতই ঘটছিলো না। সে বিমূঢ় পশুর মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার আচরণ হাস্যকর মনে হচ্ছিলো। ঐ সময় কে যে চিৎকার করে ওঠে বোঝা যায় না। শুধু চিৎকারটি শোনা যায়–ওর কি দোষ? ওর কি অপরাধ? এবং তাতেই সভামঞ্চের লোকেরা পরস্পরের মুখপানে চায়। এই মুহূর্তে কে একজন ভিক্ষু শুদ্ধানন্দের পশ্চাদ্দেশে সজোরে পদাঘাত করে। শুদ্ধানন্দ পতিত হন জনসমষ্টির মধ্যে। এমন মনে হচ্ছিলো যে লোকটিকে ক্ষিপ্ত জনতা ছিন্নভিন্ন। করে দেবে। কিন্তু তা হয় না। বরং দুজন লোক শুদ্ধানন্দকে তুলে দাঁড় করায়। একজন বলে, যা, শীঘ পলায়ন কর।
ঐ সময় সভামঞ্চ থেকে দুজন ঘাতক নেমে আসে, কিন্তু শুদ্ধানন্দকে আর নাগালে পাওয়া যায় না।
শুদ্ধানন্দকে দুটি শস্ত্রধারী তরুণ টানতে টানতে পথে এনে দাঁড় করায়। তারপর বলে, এ পথে আর কখনও আসবেন না–এবার যান, পলায়ন করুন।
ঘটনাটির সমাপ্তি কেন ঐভাবে হয়েছিলো সে রহস্য ব্যাখ্যা করা দুষ্কর। সম্ভবত তার প্রয়োজন ছিলো না। যাদের প্রয়োজন ছিলো, তারা পূর্বে অথবা পরে ঐ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেছে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। রহস্যটি কি? না সমবেত জনতা এবং দলপতির ইচ্ছার পার্থক্য। দলপতি যা চায়, জনতা তা চায় না। সেনাপতি যা চায়, সৈন্যদল। তা চায় না, গ্রামপতি যা চায়, গ্রামবাসী তা চায় না–ব্যাপারটি এইমত। এবং ঐ কারণেই ভিক্ষু শুদ্ধানন্দের প্রাণ রক্ষা পায়।
তবে প্রাণরক্ষা পাওয়ার ঘটনাটি প্রধান হয়ে উঠতে পারেনি। প্রাণনাশের ঘটনাটিই প্রধান হয়ে উঠেছিলো। এবং সেও হয়েছিলো সামন্ত হরিসেনের পরিকল্পনা মতোই। তিনিও চেয়েছিলেন, এমন শাস্তি দেবেন ব্রাত্য চণ্ডাল–ডোমদের, যেন তারা কোনোদিন। সামন্ত প্রভুর বিরোধিতা করার কথা স্বপ্নেও চিন্তা না করতে পারে।
বলা কঠিন, শুদ্ধানন্দ ঘটনাটির কী বর্ণনা দিয়েছিলেন, কিংবা আদৌ কোনো বর্ণনা দিয়েছিলেন কিনা। কিন্তু লোকমুখে ঘটনাটির নানা প্রকার বর্ণনা প্রচারিত হতে আরম্ভ করে। এবং ঐ সকল বর্ণনায় ত্রাস, উল্লাস, হতাশা, বিভীষিকা, সমবেদনা ইত্যাদি নানা প্রকার মানবিক প্রতিক্রিয়া মিশ্রিত হয়ে যায়। গ্রামপতি সামন্তপতি, এবং হরিসেনের অনুচরবর্গ ব্যাপারটির যথার্থ নিষ্পত্তি হয়েছে মনে করলেও সাধারণ গ্রামবাসী যারা, ক্ষেত্রকর, কুম্ভকার, কর্মকার, তন্তুবায়, অর্থাৎ প্রাকৃতজন, তাদের মনে স্বস্তির সঞ্চার হয় না। প্রত্যেকেই আশঙ্কা করতে থাকে–এই বুঝি ঘটনাটির পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। রাজপুরুষ দর্শনমাত্র তারা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তে লাগলো। অবস্থা এমন হলো যে, ভিক্ষু যোগীদের সঙ্গে তারা বাক্যালাপ পর্যন্ত বন্ধ রাখে। ডোম–চণ্ডালদের তারা গৃহকাজে আর ডাকে না। দিবারাত্র সন্ত্রাস, অস্বস্তি এবং দুশ্চিন্তা পিপ্পলী হাটের নিকটবর্তী গ্রামগুলিকে করে রাখলো। নীরব, নিষ্ক্রিয় এবং অন্ধকার।
উজুবট দূরের গ্রাম। কিন্তু পিপ্পলী হাটের ঐ ভয়ঙ্কর ঘটনাটির বিবরণ এই গ্রামেও এসে পৌঁছেছিলো। ব্রাহ্মণ সোমজিৎ উপাধ্যায় যদিও বোঝাচ্ছিলেন যে কাহিনীটি অলীক, যা শোনা গেছে তা দুষ্টজনের প্রচার মাত্র, কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। তার ক্ষেত্রকর ভূমি কর্ষণে যায় না, গাভীগুলির যত্ন করে না রক্ষপাল কিলোর দুটি, গৃহদাসী বালিকা দুটি সেই যে গিয়েছে, আগমনের কোনো লক্ষণ নেই।
সোমজিৎকে অগত্যা আসতে হলো ক্ষেত্রকর পল্লীতে, শুকদেবের কাছে। বললেন, তোমরা অকারণ ভীত হয়েছে, পিপ্পলী হাটের ঘটনাটি অলীক–হরিসেন কিঞ্চিৎ উগ্র হলেও তিনি প্রাণনাশের কাজ কদাপি করবেন না।
কিন্তু গ্রামের লোক উপাধ্যায় মহাশয়কে বলে, প্রভু, হরিসেনকে বলুন, তিনি যেন আমাদের উপর নিপীড়ন না করেন।
সোমজিৎ ঐ প্রার্থনা শ্রবণ করেন শুধু। করণীয় কিছু আছে বলে তার মনে হয় না। তিনি বোঝেন, তার কথা কেউ শুনবে না, তবু তিনি চেষ্টা ত্যাগ করলেন না।
হরিসেনের কাছে গেলে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে উপাধ্যায় মহাশয়ের পরামর্শ শুনলে তাঁকে সমূহ ক্ষতি স্বীকার করে নিতে হবে। বললেন, ওদের অনাহারে রাখুন, দেখবেন, ওরা বিনয়ী এবং শ্রমশীল দুই–ই হয়েছে, সুতরাং ওদের অনাহারে রাখুন।
কিন্তু ওরাও তো মানুষ!
হরিসেন হা হা স্বরে হেসে ওঠেন। বলেন, উপাধ্যায় মহাশয়, আপনি ওসব বুঝবেন না।
ওরা যদি কর্ম সম্পাদন না করতে চায়, তাহলে উপায় কি হবে, চিন্তা করেছেন? সোমজিৎ প্রশ্ন করেন।
হ্যাঁ, করেছি, কিছুই হবে না, আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না–এক সময় বাধ্য হয়ে ওরা আত্মসমর্পণ করবে।
কিন্তু ওদের যদি সহ্যের সীমা অতিক্রম করে? ওরাও তো মানুষ!
পুনরায় উচ্চরোলে হাস্য করেন সামন্ত হরিসেন। বলেন, কী যে বলেন উপাধ্যায় মহাশয়–ওরা মানুষ হলেও আপনার আমার মতো নয়। ভগবান ওদের জন্য কর্ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। ভাগবতের কর্মযোগ ও কর্মফলের ব্যাপারটি তো আপনি ভালো জানেন। এই মানবজন্মে ওরা শূদ্র–ঐ কাজ করার মধ্যেই ওদের মানবজন্মের সার্থকতা। কাজ না করা ওদের জন্য বিপথগামিতা এবং ধর্মবিরুদ্ধ–আপনি তা সমর্থন করবেন?
সোমজিৎ উপাধ্যায় হরিসেনের গৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। তাঁর আশঙ্কা হতে লাগলো একটি অশুভ পরিণাম ঘনিয়ে আসছে। রাজপুরুষেরা কিছু করছে কিনা তিনি জানেন না, সামন্তপতি ও গ্রামপতিরা একেবারেই উদাসীন। কর্মজীবী মানুষেরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে না পারলে যে সকলেরই সমূহ ক্ষতি সেটা কেউই বুঝতে চাইছে না। এই প্রকার অবস্থা যদি চলতেই থাকে, তাহলে সামাজিক উপপ্লব অবশ্যম্ভাবী–মাৎস্যন্যায় কেউ রোধ করতে পারবে না। তিনি ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অসহায় বোধ করতে লাগলেন।
বসন্তদাসের আগমন হয় পিপ্পলী হাটের ঘটনাটির অব্যবহিত পরে। জামাতার আগমনে শুকদেবের পারিবারিক জীবন আনন্দে উৎফুল্ল হলো বটে কিন্তু তার মনের নিগূঢ়ে যে অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছিলো, তা কাটলো না–বরং প্রবলতর হলো। বিশেষত দীনদাস, মায়াবতীর মাতুল, বসন্তদাসের মুখভাব ফিরে ফিরে লক্ষ্য করতে লাগলেন। একটি দুশ্চিন্তা তার মনে শলাকার মতো বিদ্ধ হয়ে রইলো। সেটি হলো, জামাতা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সঙ্গে তার সাক্ষাতের ব্যাপারটি সম্পর্কে একটি বাক্যও কখনও উচ্চারণ করছে না। তিনি বুঝতে পারেন না, তবে কি বসন্তদাস কোন গূঢ়কর্মের সঙ্গে যুক্ত? আর তাই সে জানতে দিতে চায় না বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সঙ্গে তার কি প্রকার সম্পর্ক হয়েছে?
দিন দুই পরে যখন সন্ধ্যাকালে দেখলেন বসন্তদাস নদীতীরে কয়েকজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর সঙ্গে গভীর আলাপে মগ্ন তখন আর নীরব থাকতে পারলেন না। ঘটনাটি শুকদেবের গোচরে আনলেন। শুকদেব শুনলেন। শুনে মৃদু হাসলেন, কিছু বললেন না। দীনদাস ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, আপনি ব্যাপারটি সহজ বলে মনে করছেন কিন্তু আমার সন্দেহ, ব্যাপারটি সহজ নয়। জামাতা যদি বিপদে পড়ে, তাহলে কী হবে চিন্তা করেছেন?
শুকদেব তখন শ্যালকের মুখপানে দৃষ্টি রেখে একটি ক্ষুদ্র শ্বাস মোচন করে বলেন, আমি ভবিতব্য মানি দীনদাস–যদি ভাগ্যে তোমার অশুভ কিছু লিপিবদ্ধ থাকে, তাহলে কি তুমি তা পরিহার করতে পারবে? পারবে না, সুতরাং দুশ্চিন্তা করে কি হবে! রাজার পাপে রাজ্য নাশ–এ প্রবাদটি তো জানো। রাজার পাপ রাজা একাকী বহন করেন না–তার পাপ প্রজাপুঞ্জেও বর্তায়। যদি ঐ পাপের দায় তোমার বিধিলিপি হয়ে থাকে, তাহলে কি তুমি তা খণ্ডন করতে পারবে? নিশ্চয়ই পারবে না। আমাদের জামাতাটি তো আর বালক নয়–মঙ্গলামঙ্গল জ্ঞান তার নিশ্চয়ই হয়েছে। তুমি অথবা আমি কিছু বললেও সে শুনবে না।
না ভ্রাতঃ, এভাবে নির্বিকার থাকা সমীচীন নয়–দীনদাস তাঁর উদ্বেগের কারণ ব্যাখ্যা করেন। বলেন, জলধর দত্ত এবং কায়স্থ পল্লীর লোকেরা যেখানে আপনার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন সেখানে আপনার নিস্পৃহ এবং নীরব থাকা উচিত নয়। জামাতাকে বলবেন, যেন সে। বৌদ্ধ ভিক্ষু ও যোগীদের সঙ্গ পরিহার করে।
উত্তম, বলবো, শুকদেব পুনরায় একটি শ্বাস মোচন করে জানালেন।