ইহুদীদের মিসরত্যাগ
হযরত মুসা এবং তাঁর অনুসারীদের মিসরত্যাগের ঘটনাটি ঐতিহাসিক যেকোনো বিচারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। প্রথমপর্যায়ে তারা গিয়েছিলেন কেনানে। ঘটনাটি ঐতিহাসিক এবং এ ঘটনা কমবেশি সবার জানা। যদিও এ ঘটনা নিয়ে মাঝেমধ্যে অভিযোগ উঠতে দেখা যায়, ইতিহাসের চেয়ে এ ঘটনায় উপকথার ভাগই বেশি।
বাইবেলের পুরাতন নিয়মের বর্ণনায় দেখা যায়, ইহুদীদের মিসরত্যাগের এই ঘটনাকে অবলম্বন করে রচিত হয়েছে পেন্টাটেক বা তাওরাতের দ্বিতীয় পুস্তকখানি। এতে আরো স্থান পেয়েছে–ইহুদীদের নিরুদ্দিষ্টভাবে ঘুরে বেড়ানোর কাহিনী ও তাদের নিজেদের মধ্যে রাষ্ট্র-সংঘ গঠন (চুক্তি) কাহিনী। এবং এই কাহিনী শেষ হয়েছে সিনাই পর্বতে হযরত মুসা কর্তৃক আল্লাহর দিদার বা দর্শনপ্রাপ্তির বর্ণনার মাধ্যমে।
স্বাভাবিককারণেই এই ঐতিহাসিক বিষয়টি নিয়ে কোরআনেও বিশদ আলোচনা স্থান পেয়েছে। ফেরাউনের সাথে হযরত মূসা ও তাঁর ভাই হযরত হারুনের আলোচনা এবং ইহুদীদের মিসরত্যাগের ঘটনাবলী নিয়ে দীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে কোরআনের দশটিরও বেশি সূরায় : তন্মধ্যে ৭, ১০, ২০ ও ২৬ নং সূরা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। অপরাপর সূরার মধ্যে কোনোটিতে রয়েছে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। আর কোনো কোনোটাতে এই ঘটনাগুলো শুধু স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। মিসরীয়দের পক্ষে এই ঘটনায় যিনি প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁর উপাধি ছিল ফেরাউন : এই নামটি (যতদূর সম্ভব ড. মরিস বুকাইলির জানামতে) কোরআনের ২৭টি সূরায় চুয়াত্তর বার উল্লেখ করা হয়েছে। এই ঘটনাটি সম্পর্কে বাইবেল ও কোরআনের যে বর্ণনা, তার তুলনামূলক আলোচনা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। উদাহরণস্বরূপ, শুধু মাহপ্লাবনের বর্ণনায় এই দুই ধর্মগ্রন্থের গরমিল যে কত বেশি, তা ইতিমধ্যে জানা হয়েছে। অথচ, ইহুদীদের মিসরত্যাগের কাহিনীতে উভয় ধর্মগ্রন্থের বর্ণনায় বহুবিষয়ে মিল দেখা যায়, গরমিল যে একেবারে নেই তা নয়। তবে, এটা একক্ষেত্রেই দেখা যায়, বাইবেলের বর্ণনার মধ্যেও রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব। উল্লেখ্য যে, বাইবেলের বর্ণনা থেকেই আমরা ফেরাউনের বরং বলা চলে দু’জন ফেরাউনের পরিচয় লাভ করেছি। এই যে দু’জন ফেরাউনের অস্তিত্ব, এ ধারণার সূচনা ঘটেছে বাইবেলের বর্ণনা থেকেই। আর কোরআনে বর্ণিত তথ্যের আলোকে সে ধারণা মোটামুটিভাবে সাব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। এদিকে, হালে আবিস্কৃত নানা আধুনিক তথ্য ও প্রমাণ এই দুই ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত এই ঘটনার উপর নতুন করে আলোকসম্পাত করতেও সক্ষম হয়েছে। আর এভাবেই বাইবেল, কোরআন ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সম্মিলিত অবদানে ধর্মীয় গ্রন্থে বর্ণিত একটি কাহিনীকে আজ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দাঁড় করানো সম্ভব।
বাইবেলের বর্ণনা : বাইবেলে ইহুদীদের মিসরত্যাগের ঘটনার বর্ণনা শুরু হয়েছে হযরত ইয়াকুবের মিসরে প্রবেশের ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয়ার মাধ্যমে। হযরত ইয়াকুব সেখানে হযরত ইউসুফের সাথে মিলিত হন। এরপর বাইবেলের যাত্রাপুস্তকের ১, ৮-এর বর্ণনা অনুসারে।
“পরে মিসরের উপরে এক নতুন রাজা উঠিলেন, যিনি যোসেফকে (হযরত ইউসুফ) জানিতেন না।”
এরপর চলল, নির্যাতনের পালা। ফেরাউন ইহুদীদের দুটি নগরী পিথম ও রামিষেষ নির্মাণের নির্দেশ দিলেন। বাইবেলে এই দুটি নগরীর এই নামই রয়েছে। যাত্রাপুস্তক ১, ১১) ইহুদীদের বংশবৃদ্ধি ঠেকানোর উদ্দেশ্যে ফেরাউন নির্দেশ দিলেন যে, তাদের প্রতিটি নবজাতক পুত্রসন্তানকে নদীতে নিক্ষেপ করতে হবে। এতদসত্তেও, হযরত মুসাকে তার মা মাস তিনেক লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। পরে উপায়ান্তর না দেখে তিনি শিশু মুসাকে একটি নলখাগড়ার ঝুড়িতে ভরে নদীর কিনারে রেখে এলেন। ফেরাউনের কন্যা সেখানে ওই শিশুকে দেখতে পেলেন। সেখান থেকে শিশু মুসাকে নিয়ে এসে এক ধাত্রীর কাছে রাখতে দেয়া হল : সে ধাত্রী অন্য কেউ নয়, শিশু মুসার নিজের মা। এটা এই কারণে সম্ভব হয়েছিল যে, নদীর তীরে রাখা শিশুটির ভাগ্যে শেষপর্যন্ত কি ঘটে, তা গোপনে হযরত মুসার বোন দেখছিলেন। ফেরাউনের কন্যা যখন শিশু মুসাকে উদ্ধার করেন, তখন সেই বোন শিশুটিকে না চেনার ভান করে রাজকন্যাকে এক ধাত্রীর সন্ধান দেন, যিনি আসলে হযরত মুসার মা। সেই থেকে হযরত মুসা ফেরাউনের সন্তান হিসেবেই বেড়ে উঠতে থাকেন। তাঁর নাম রাখা হয় মুসা (ইংরেজি বাইবেলে মোজেস, বাংলা বাইবেলে মোশি)।
যৌবনে হযরত মুসা অন্য এক দেশে চলে যান, দেশটির নাম মাদিয়ান (বাইবেলে মিদিয়ন)। সেখানে তিনি বিবাহ করেন এবং দীর্ঘকাল অবস্থান করেন। বাইবেলে এ বিষয়ে বিশদ বর্ণনা রয়েছে। এরপর, যাত্রাপুস্তকে বলা হয়েছে (২, ২৩) : “অনেক দিন পরে মিসররাজের মৃত্যু হইল।
তখনই আল্লাহ্ হযরত মুসাকে ফেরাউনের কাছে যাওয়ার এবং তার ভাইদের (ইহুদীদের) মিসর থেকে বের করে নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন, (এই নির্দেশদানের ঘটনাটি ঘটে প্রজ্বলিত ঝোঁপের ঘটনার মধ্যে)। আল্লাহর সেই নির্দেশ এ কাজে হযরত মুসাকে তার ভাই হযরত হারুনের সাহায্য করার কথা ছিল। সে কারণে হযরত মুসা মিসরে ফিরেই তাঁর ভাইকে সাথে নিয়ে ফেরাউনের কাছে গেলেন। এই ফেরাউন ছিলেন সাবেক সেই ফেরাউনের স্থলাভিষিক্ত, যে ফেরাউনের সময় হযরত মুসা জন্মগ্রহণ করেন।
ফেরাউন ইহুদীদের মুসার সাথে মিসর ত্যাগ করতে দিতে রাজি হলেন না। আল্লাহ্ পুনরায় হযরত মুসাকে দেখা দিলেন এবং মুসাকে নির্দেশ দিলেন হযরত মুসা যেন আবারও ফেরাউনকে অনুরোধ জানায়। বাইবেলের মতে, তখন হযরত মুসার বয়স ছিল আশি বছর। অলৌকিক কার্যকলাপের মাধ্যমে হযরত মুসা ফেরাউনকে জানিয়ে দেন যে, তিনি অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ না হওয়ায় আল্লাহ্ মিসরের উপর গ্লেগের গজব নাজিল করেন। সমস্ত নদীর পানি রক্তে পরিণত হয়। এরপর প্রাদুর্ভাব ঘটে ব্যাঙ, পতঙ্গ ও উঁশ মাছির। গবাদিপশুগুলো মারা যেতে থাকে; মারাত্মক ধরনের ফোঁড়া দেখা দেয়, মানুষজন ও জন্তু-জানোয়ারের দেহে। অবিরাম শিলাবৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। দেখা দেয়, পঙ্গপালের আক্রমণ। অন্ধকার নেমে আসে গোটা মিসরের বুকে। প্রতিটি পরিবারের প্রথম সন্তান মৃত্যুমুখে পতিত হতে শুরু করে। কিন্তু এতকিছুর পরেও ফেরাউন ইহুদীদের মিসর ত্যাগ করতে দিতে রাজি হলেন না।
এরপর ইহুদীরা ‘রামিষেষ নগরী’ থেকে জোট বেঁধে একযোগে বেরিয়ে পড়ে (যাত্রাপুস্তক ১২, ৩৭)। “মহিলা ও শিশুদের ছাড়াই তাদের সংখ্যা ছিল ৬,০০,০০০। এই পর্যায়ে ফেরাউন “আপন রথ প্রস্তুত করাইলেন ও আপন লোকদের সঙ্গে লইলেন।… মিসররাজ ফেরাউন … ইস্রায়েল সন্তানদের পিছু পিছু ধাবমান হইলেন, তখন ইস্রায়েল-সন্তানেরা উর্বহস্তে বহির্গমন করিতেছিল।” (যাত্রাপুস্তক ১৪, ৬ এবং ৮)।
মিসরীয়রা সমুদ্রের পাড়ে হযরত মুসার লোকজনদেরকে ধরে ফেলার উপক্রম করল। হযরত মুসা তাঁর লাঠি তুলে ধরে নির্দেশ দিলেন সমুদ্র দু’ভাগ হয়ে গেল। তাঁর অনুসারীরা হেঁটে সমুদ্র অতিক্রম করল। তাদের পা পর্যন্ত ভিজল না।
“পরে মিস্রীয়েরা, ফেরাউনের সকল অশ্ব ও রথ, এবং অশ্বারূঢ়গণ ধাবমান হইয়া তাহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ সমুদ্রে প্রবেশ করিল।” (যাত্রাপুস্তক ১৪, ২৩)।
“জল ফিরিয়া আসিল ও তাহাদের রথ ও অশ্বারূঢ়দিগকে আচ্ছাদন করিল। তাহাতে ফেরাউনের সে-সকল সৈন্য তাহাদের একজনও অবশিষ্ট রহিল না। কিন্তু ইস্রায়েল-সন্তানেরা শুষ্ক পথে সমুদ্রের মধ্য দিয়া চলিল, এবং তাহাদের দক্ষিণে ও বামে জল প্রাচীরস্বরূপ হইল।” (যাত্রাপুস্তক ১৪, ২৮-২৯)
যাত্রাপুস্তকের এই বর্ণনা খুবই স্পষ্ট : যারা ইহুদীদের তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তাহাদের পুরোভাগে ছিল স্বয়ং ফেরাউন। সুতরাং, এই ধ্বংসলীলায় ফেরাউনও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। যাত্রাপুস্তকে বলা হয়েছে, “তাহাদের একজনও অবশিষ্ট রহিল না।” বাইবেলের গীত-সংহিতায় (সাম) এই ঘটনা পুনরায় বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। যথা : গীত-সংহিতা ১০৬, বাণী ১১; ১৩৬ বাণী ১৩ ও ১৫। এগুলো হচ্ছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে শোকরিয়া-জ্ঞাপনের গীত :
“তিনি সুফ সাগরকে (হিব্রু ভাষায়–ইয়াম সুফ, ইংরেজিতে রাশ, বাংলায় নলখাগড়া) দ্বিভাগ করিলেন… এবং তাহার মধ্যেদিয়ে ইস্রায়েলকে পার করিলেন… কিন্তু ফেরাউন ও তাহার বাহিনীকে সুফ সাগরে ঠেলিয়া দিলেন।”
সুতরাং, বাইবেলের মতে, ইহুদীদের পশ্চাদ্ধাবনকারী ফেরাউন যে সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু, পরে ফেরাউনের লাশের কি হল, বাইবেলে সে সম্পর্কে কিছু নেই।
কোরআনের বর্ণনা : ইহুদীদের মিসরত্যাগ-সংক্রান্ত কোরআনের বর্ণনা বৃহত্তর পরিসরে বাইবেলের অনুরূপ। তবে, কোরআনের বর্ণনাগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হয়, কেননা, সেসব বর্ণনা গোটা কিতাবে রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।
বাইবেলের মত কোরআনেও মিসররাজ ফেরাউনের এমন কোনো নাম উল্লেখ নেই যা দিয়ে ইহুদীদের মিসরতাগের প্রাক্কালে কোন ফেরাউন মিসরে রাজত্ব করতেন, তা নির্দিষ্ট করা আমাদের পক্ষে সম্ভব। কোরআনের বর্ণনা থেকে শুধু এতটুকু জানা যাচ্ছে, তৎকালীন ফেরাউনের হামান’ নামে একজন উপদেষ্টা ছিলেন। কোরআনে এই হামানের নাম ছয়বার উল্লেখ করা হয়েছে। (১৮ নং সূরার ৬, ৮ ও ৩৮ নং আয়াত, ২৯ নং সূরার ৩৯ নং আয়াত এবং ৪০ নং সূরার ২৪ ও ৩৬ নং আয়াতে)।
কোরআনের মতে, ফেরাউন ছিলেন ইহুদী-উৎপীড়ক :
“যখন মুসা তাঁহার লোকজনদের বললেন : স্মরণ কর, আল্লাহর সেই অনুগ্রহ–তোমাদের প্রতি। এই অনুগ্রহ তিনি দিয়েছিলেন ফেরাউনের লোকজনের হাত থেকে তোমাদের মুক্ত করতে। তারা তোমাদের উপর নিদারুণ নিপীড়ন চালাতো; তোমাদের পুত্রসন্তানদের হত্যা করতে এবং জীবিত রাখতো তোমাদের মহিলাদের।”-সূরা ১৪, আয়াত ৬।
একই ভাষায় এই ফেরাউনী নিপীড়নের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে ৭ নং সূরার ১৪১ নং আয়াতে। কোরআনে অবশ্য বাইবেলের মত বন্দী ইহুদীদের দ্বারা দুটি শহর নির্মাণের কথা নেই।
শিশু মুসা নবীকে যখন নদীর তীরে রেখে আসা হয়েছিল, সে কাহিনী কোরআনের ২০ নং সূরার ৩৯-৪০ নং আয়াতে এবং ২৮ নং সূরার ৭ থেকে ১৩ নং আয়াতে বর্ণিত আছে। কোরআনের বর্ণনামতে, শিশুনবী মুসাকে গ্রহণ করেছিলেন ফেরাউনের পরিবার। এ বিষয়ে ২৯ নং সূরার ৮ ও ৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে :
“ফেরাউনের পরিবার তাহাকে তুলিয়া লইল। (ইহাই ছিল অভিপ্রায়) যে (মুসা) তাহাদের বিরুদ্ধবাদী হইবে এবং তাহাদিগকে আজাবে ফেলিবে। ফেরাউন, হামান এবং তাহাদের লোকজনেরা ছিল পাপাচারী। ফেরাউনের স্ত্রী কহিলেন, (সে হইবে) চোখের আনন্দ আমার ও তোমার জন্য। তাহাকে হত্যা করিও না। সে আমাদের কাজে লাগিতে পারে; অথবা আমরা তাহাকে পুত্র হিসেবেও গ্রহণ করিতে পারি। তাহারা ধারণা করিতে পারে নাই (সামনে কি হইবে)।”
মুসলিম সমাজে প্রচলিত কাহিনী থেকে জানা যায়, ফেরাউনের স্ত্রী বিবি আছিয়া শিশুনবী মুসাকে লালন-পালন করেছিলেন। কোরআনের মতে, ফেরাউনের পরিবারের লোকজন মুসা নবীকে কুড়িয়ে পেয়েছিল।
হযরত মুসার যৌবনকাল, মাদিয়ানে তার অবস্থান এবং তার বিবাহ-সংক্রান্ত বর্ণনা রয়েছে কোরআনের ২৮ নং সূরার ১৩ থেকে ২৮ নং আয়াতে। বিশেষত ‘প্রজ্বলিত ঝোঁপ-সংক্রান্ত বর্ণনা দেখা যায় ২০ নং সূরার প্রথম রুকুতে এবং ২৮ নং সুরার ৩০ থেকে ৩৫ নং আয়াতে। যদিও কোরআনে বাইবেলের মত দীর্ঘ বর্ণনা দিয়ে বলা হয়নি যে, আল্লাহ্ গজব হিসেবে মিসরে দশ ধরনের প্লেগ নাজিল হয়েছিল। কোরআনে সংক্ষিপ্তাকারে মাত্র পাঁচ ধরনের প্লেগের কথা বর্ণিত হয়েছে। (সূরা ৭, আয়াত ১৩৩) যথা : বন্যা, পতঙ্গ, উকুন, ব্যাঙ এবং রক্ত।
কোরআনেও মিসর থেকে ইহুদীদের পালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। যেমনটি বাইবেলে রয়েছে। তাদের পলায়নপথের কোনো বিবরণ সেখানে নেই কিংবা নেই পলায়নপর ইহুদীদের সংখ্যাও। এটা ধারণা করা সত্যি মুশকিল যে, কিভাবে ৬ লক্ষ মানুষ এবং তাদের পরিবারবর্গ এত দীর্ঘসময় ধরে মরুভূমিতে অবস্থান করছিল। অথচ, বাইবেল সেকথাই বিশ্বাস করতে বলছে। ইহুদীদের পশ্চাদ্ধাবনকারী ফেরাউনের মৃত্যু কিভাবে ঘটেছিল, কোরআনে তার বর্ণনা নিম্নরূপঃ
“ফেরাউন তাহাদের ধাওয়া করিতেছিল নিজের লোকলশকরসহ এবং সমুদ্র তাহাদের ঢাকিয়া ফেলিল।”সূরা ২০, আয়াত ৭৮।
এভাবে ইহুদীরা রক্ষা পেল, ধ্বংস হয়ে গেল ফেরাউন। কিন্তু তার মৃতদেহটা পাওয়া গেল : অতি গুরুত্বপূর্ণ এই ঘটনার কোনো বর্ণনা কিন্তু বাইবেলে নেই।
“আমরা পার করাইয়া নিলাম বনী ইসরাইলকে সমুদ্রের মধ্যদিয়া। ফেরাউন ও তাহার লোকলশকর তাহাদিগকে ধাওয়া করিতেছিল–বিদ্রোহ ও আক্রোশবশত–শেষপর্যন্ত যখন সে ডুবিয়া যাইতে বসিল, বলিল : আমি ঈমান আনিলাম আর কোনো মাবুদ নাই সেই আল্লাহ্ ছাড়া যাহার উপরে বনী ইসরাইল বিশ্বাসী। আমিও তাহাদের শামিল–যাহারা তাহার প্রতি আত্মসমর্পণকারী। –সূরা ১০, আয়াত ৯০ থেকে ৯২।
“আল্লাহ্ বলিলেন, কি? তুমি বিদ্রোহ করিয়াছ, নীতিভ্রষ্টতার কারণ হইয়াছ। এখন আমরা তোমাকে টিকাইয়া রাখিব তোমার লাশের মাধ্যমে। যাহাতে তুমি নিদর্শন হইতে পার তাহাদের জন্য যাহারা তোমার পরে আসিবে। তবে, নিশ্চয় মানবজাতির অনেকেই আমার নিদর্শনাবলী সম্পর্কে গাফেল।”
এই বক্তব্যের দুইটি বিষয় ব্যাখ্যার দাবিদার :
(ক) ফেরাউনের বিদ্রোহ ও শক্রতার যে কথাটা এখানে বলা হয়েছে, তা বুঝতে হবে হযরত মুসা কর্তৃক ফেরাউনকে সৎপথে ফেরাবার প্রয়াস-প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে; এবং
(খ) ফেরাউনকে উদ্ধার করা বা টিকিয়ে রাখার কথাটির দ্বারা বুঝতে হবে তার লাশের সংরক্ষণ। কেননা, কোরআনে (১১ নং সূরার ৯৮ নং আয়াতে) স্পষ্টভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ফেরাউন ও তার সঙ্গীদের চরম পরিণতি হবে জাহান্নাম।
“কেয়ামতের দিন (ফেরাউন) তাহার লোকজনের পুরোভাগে থাকিয়া অগ্রসর হইবে; এবং দোজখে যাওয়ারকালে তাদের নেতৃত্ব দিবে।” সূরা ১১, আয়াত ৯৮।
এতক্ষণ যেসব ঘটনা ও কাহিনীর উল্লেখ করা হল, এবারে আধুনিক যুগের আবিস্কৃত ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যজ্ঞানের আলোকে সেসবের সত্যাসত্য নির্ণয় করা যেতে পারে। সে বিচারে প্রথমেই ধরা পড়ে ইহুদীদের মিসরত্যাগের ঘটনা সম্পর্কে কোরআন ও বাইবেলের বর্ণনার পার্থক্য। ওই পার্থক্য নিম্নরূপ:
হযরত মুসার অনুসারী ইহুদীদের দ্বারা যে দুটি নগরী নির্মিত হয়েছিল, কোরআনে সে দুটি নগরী নির্মাণের কিংবা নগরী দুটির নামের কোনো উল্লেখ নেই। যেমনই, উল্লেখ নেই ইহুদীরা কোন পথে মিসর ত্যাগ করেছিল।
–হযরত মুসা যখন মাদিয়ানে অবস্থান করছিলেন, তখন যে একজন ফেরাউন (তল্কালীন মিসরের শাসকবর্গের উপাধি ছিল : ফেরাউন) মারা যান, কোরআনে তারও কোনো উল্লেখ নেই।
–হযরত মুসা কত বছর বয়সে ফেরাউনের কাছে গিয়ে তাকে সৎপথে ফিরবার এবং ইহুদীদের মিসরত্যাগের অনুমতিপ্রদানের আবেদন জানিয়েছিলেন,–তাও কোরআনে অনুল্লিখিত।
–কোরআনে হযরত মুসার অনুসারীদের কোনো উল্লেখ করা হয়নি। ওদিকে বাইবেলে এই সংখ্যাকে অবিশ্বাস্যভাবে বেশি করে দেখানো হয়েছে (বলা হয়েছে, পুরুষ ছিল ৬,০০,০০০ জন এবং তাদের পরিবারবর্গ মিলে মোট ইহুদীদের সংখ্যা ছিল ২০ লক্ষাধিক)।
–সমুদ্রে ডুবে মারা যাওয়ার পর ফেরাউনের লাশ যে উদ্ধার করা হয়েছিল, বাইবেলে সে সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি।
আলোচ্য ঘটনার বিশ্লেষণের বেলায় উল্লিখিত পার্থক্যগুলো অবশ্যই আমাদের মনে রাখতে হবে। কেননা, পার্থক্যের পাশাপাশি এই বিষয়ে উভয় ধর্মগ্রন্থের বর্ণনায় কিছু কিছু মিলও রয়েছে। যেমন :
–ফেরাউন যে হযরত মুসার অনুসারী ইহুদীদের উপর উৎপীড়ন চালাত, কোরআন তা সমর্থন করছে।
–উভয় ধর্মগ্রন্থে তৎকালীন কোনো মিসরীয় শাসকের অর্থাৎ ফেরাউনের আসল নামের কোনো উল্লেখ নেই।
–ইহুদীদের মিসরত্যাগের সময় যে ফেরাউন ডুবে মারা গিয়েছিল, কোরআনের বর্ণনায় তার সমর্থন রয়েছে।