ইন্সপেক্টরবাবুর কথা চঞ্চল যতই শুনছিল ততই হতাশ হচ্ছিল। এর বেশি কি সামন্ত সায়েবের কিছুই বলবার নেই? এ যে নেহাৎ ধরা বাঁধা মামুলি কথাবার্তা, এর মধ্যে সেই চমক কোথায়, গল্পের ডিটেকটিভদের কার্যকলাপ পদে পদেই যা পাওয়া যায়? সে লক্ষ করল যে মহিমবাবু যা যা বলছেন তারই উপর নির্ভর করে ইন্সপেক্টরবাবু কাজ করে যাচ্ছেন, এর বাইরে কিছুই বোধহয় তিনি ভাবতে পারেননি। মনে হয়, মহিমবাবুর পরামর্শ নিতেই যেন এসেছেন, মহিমবাবুর মুখের দিকে কেমন দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে থাকেন, ছাত্রের মতো তাঁর কথা শোনেন।
এ থেকে চঞ্চলের মনে দুটো ধারণা হল। প্রথমত, অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন মহিমবাবু সম্বন্ধে তার মন গর্বে ভরে উঠল, দ্বিতীয়, পুলিশকে ডিঙিয়ে, সমস্ত দেশীর লোককে অবাক করে দিয়ে এ রহস্যের সমাধান হয়তো সে-ই করতে পারবে, এমন একটা অসম্ভব দুরশা প্রবল হয়ে উঠল তার মনে। কী করে কী করবে কিছুই জানে না, শুধু একটা অস্পষ্ট উদ্যমের প্রেরণায় ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হয়ে উঠতে লাগল।
রণজিৎবাবু বললেন, “আপনার সময় আর নষ্ট করব না – এখন উঠি।”
মহিমবাবু অমায়িকভাবে বললেন, “আসুন আর দুটো মিনিট।”
“আপনি নিশ্চয়ই ব্যস্ত – আজ আবার বিকেলে আপনার কাগজ বেরোবে।”
“ব্যস্ত আমি সব সময়েই, কিন্তু আপনি তো আজ আমার চেয়েও ব্যস্ত। এত বড় একটা কেস হাতে!”
“চট করে কিছু হবে বলে মনে হয় না – আমার তাড়া নেই।” রণজিৎবাবু হাতের কাছে সেদিনের ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ পড়ে ছিল, সেখানা তুলে নিয়ে বললেন, “কী লিখেছে আজকের ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ?’“
“দেখেন নি?”
“না। সকাল থেকে তো ঘুরছিই।”
“দেখুন দেখুন, ভারি মজার। তৃতীয়পৃষ্ঠার পঞ্চম কলম দেখুন।”
“ওঃ, আপনার দেখছি মুখস্থ,” বলে রণজিৎবাবু নির্দেশমতো পাতা উল্টালেন।
“যার যা কাজ। তাছাড়া আমার স্মরণশক্তি একটু ভালোই।”
‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ পরীক্ষিত জয়ন্তীর উদ্যোক্তাদের তীব্র সমালোচনা করে লিখেছে যে পরীক্ষিৎবাবুর মতো শান্তিপ্রিয় মানুষকে নিয়ে এই হৈ চৈ করতে গিয়েই কাণ্ডটা হল।
তিনি নিশ্চয়ই এটা এড়াবার জন্যেই গৃহত্যাগী হয়েছেন, হয়তো সন্ন্যেসী হয়েছেন, হয়তো বিদেশে পালিয়েছেন। “আমরা যে প্রথম হইতেই এই অনুষ্ঠানের বিরোধী ছিলাম তাহার যৌক্তিকতা কি এখন প্রমাণ হইল না?” শেষে লিখেছে যে এই জয়ন্তী অবিলম্বে বাতিল করে দেওয়া হোক, পরীক্ষিত ভক্তরা ঘোষণা করুক যে এ রকম অনুষ্ঠানের কল্পনা তারা আর কখনো মনে স্থান দেবে না, তাহলে মজুমদারমশাই নিজে থেকেই হয়তো ফিরে আসবেন, পুলিশের সাহায্য কি পুরস্কার ঘোষণা কিছুই দরকার হবে না।
রণজিৎবাবু পড়ে বললেন, “হুঁ।”
“কেমন বুঝলেন?”
“প্যারাগ্রাফটা বোধহয় আমাদের বৃন্দাবনবাবুর লেখা? বেচারা! এখন হাজতে বসে হাত কামড়াচ্ছে। বড় কষ্ট হচ্ছে ভদ্রলোকের জন্যে, ওঁকে ছেড়েই দিতে হবে।”
মহিমবাবু বললেন, “আপনার মতো দয়াশীল লোক পুলিশের মধ্যে খুবই কম, এ কথা বলতেই হয়। আচ্ছা প্যারাগ্রাফটা পড়ে আপনার কী মনে হল?”
“লেখাটা বড়ই মোটা রকমের। যেন ওঁরাই পরীক্ষিৎবাবুকে সরিযেছেন, জয়ন্তী বন্ধ করে দিলেই বার করে দেবেন, এ রকম একটা ভাব আছে বটে।”
“আমাদেরও তাই মনে হচ্ছিল। আপনার মতো সতর্ক অফিসার না হলে হয়তো শুধু বৃন্দাবনকে নয়, ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’-এর স্বত্বাধিকারীকেও এর মধ্যে জড়িয়ে ফেলত। ভারি কাঁচা হয়েছে লেখাটা।”
“তা, আমাদের সতর্কতা মানেই চারিদিকে চোখ কান খোলা রাখা। আপনাকে তো বলেছি – সকলকেই আমরা সন্দেহ করি, যতক্ষণ উল্টোটা প্রমাণিত না হয়।”
“শশাঙ্কবাবুর সঙ্গে পরীক্ষিতের কিছুদিন আগে একটা মামলাও হয়ে যায় তা তো জানেন।”
“শশাঙ্কবাবু কে?”
“শশাঙ্ক বক্সি – ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপে’র প্রোপ্রাইটর।”
“কি নিয়ে মামলা?”
“ওর একটা গ্রন্থাবলী ওরা পাব্লিশ করেছিল, রয়ালটি ঠিক মতো দিচ্ছিল না। হাইকোর্টে পরীক্ষিতের জিৎ হয়।”
“এখন ওঁর পাব্লিশর কে বলতে পারেন?”
“নব সাহিত্য ভবন নমে একটা নতুন ফার্ম। যদ্দুর জানি ওর নতুন বই, নতুন এডিশন আর গ্রন্থাবলী ইত্যাদি বই এখন থেকে নব সাহিত্যই বার করবে। কন্ট্র্যাক্ট হয়ে গেছে।”
“ফার্মটা কার?”
“একটা লিমিটেড কোম্পানি – ম্যানেজিং ডিরেক্টর জয়রাম শীল।”
“কী নাম বললেন?”
“জয়রাম শীল।”
“তাহলে ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপে’র গাত্রদাহ হবার নানারকম কারণই আছে দেখছি।”
“তা আছে। অবশ্য প্রমাণ না পেলে বলা শক্ত, কিন্তু আমার প্রথম থেকে মনে হযেছে যে এ রহস্যের চাবি – মানিকতলা অঞ্চলেই আছে।” (মানিকতলায় ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপে’র আপিস।)
“সেই তো আমাদের মুশকিল মহিমবাবু, প্রমাণ না পেলে কিছুই করবার উপায় নেই। আস্তে আস্তে, অতি সাবধানে এগোতে হয়।”
“আপনারা তো আস্তে আস্তে এগোচ্ছেন, এদিকে নানারকম আজগুবি গুজবে শহরে তো কান পাতা যায় না। এ পর্যন্ত কটা থিওরি হয়েছে, জানেন?”
রণজিৎবাবু বললেন, “আমি যদ্দুর জানি, সাতটার বেশি নয়। যথা: এক নম্বর – শান্তিপ্রিয পরীক্ষিৎবাবু জয়ন্তীর ভয়ে দেশত্যাগী হয়েছেন -”
মহিমবাবু বাধা দিয়ে বললেন, “এ থিওরি তো আপনার মগজেই প্রথম গজায়। জাপানি জাহাজের কথা মনে আছে?”
এ কথার কোনো জবাব না দিয়ে রণজিৎবাবু বললেন, “দুই নম্বর – পরীক্ষিৎবাবুর হঠাৎ স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে; তিনি যে কে, সে কথাটাই মনে করতে পারছেন না, হয়তো এতক্ষণে খিদিরপুর ডকে কি ঝরিয়ার কয়লাখনিতে কুলিগিরিতে ভর্তি হয়েছেন।”
“বাহ, চমৎকার থিওরি তো! তারপর?”
“তিন নম্বর – তিনি পাগল হয়ে গেছেন।”
“তা তো বুঝলাম – কিন্তু কোথায় গেছেন সেটাই ও প্রশ্ন।”
“চার নম্বর – তিনি আত্মহত্যা করেছে, কিংবা তাঁকে খুন করা হয়েছে।”
“একেবারে গুম খুন। মৃতদেহ শুদ্ধু হওয়া হয়ে গেল!”
“পাঁচ নম্বর – টাকা আদায় করবার ফিকিরে গুণ্ডার দল তাঁকে সরিয়েছে। ছয় নম্বর – তাঁর সাহিত্যিক শত্রুরাই এটা ঘটিয়েছে, জয়ন্তী কাণ্ড লণ্ডভণ্ড করবার জন্য।”
“এই শেষেরটাই সম্ভব বলে আমার মনে হয়।”
“এটা তো বলতে গেলে আপনারই থিওরি। এ পর্যন্ত সন্দেহের জোরটাও এদিকেই পড়েছে। যাই হোক, আরও একটা আছে, সেটা আপনি শুনেছেন কিনা জানি না। সাত নম্বর – এটা বিজয়কৃষ্ণবাবুরই কারসাজি, কারণ দাদার অনুপস্থিতিতে সম্পত্তি টম্পত্তি সব তাঁরই।”
কথাটা শুনে মহিমবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন। “এরকম একটা থিওরি হয়েছে নাকি? তাহলে আট নম্বর থিওরিটা আমি বলছি শুনুন, পরীক্ষিৎবাবুকে – মহিম চাটুয্যেই সরিয়েছে।”
রণজিৎবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, “হাসির কথা নয়। আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে অল্পদিন আগেই পরীক্ষিৎবাবু উইল করেছেন, তাতে তাঁর সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী ভাইকেই করে গেছেন। মানুষের কখন কী মনে হয় তা তো বলা যায় না।”
মহিমবাবু একটা বেল টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে বেয়ারা এল। তার হাতে একটা কাগজ দিয়ে বললেন, “টাইপ।” তারপর রণজিৎবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার কি সত্যি সত্যি মনে হয় যে বিজয় – “
কিন্তু তাঁর কথা শেষ হতে পারল না। গুড়ুম করে একটা শব্দ হল, বারুদের গন্ধে ঘর গেল ভরে অর মহিবাবুর কামরার কাঠের পার্টিশনের একটা অংশে হঠাৎ চুরমার হয়ে ভেঙে গেল।
সমস্ত আপিসে হুলস্থূল, ছুটে এল বেয়ারা দারোয়ান কেরানি যে যেখানে ছিল, রণজিৎবাবু রাস্তায় দুজন কনেস্টবল দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছিলেন তারাও এল। কিন্তু মহিমবাবুর হল কী! তাঁর জন্যে অবশ্য বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হল না, চঞ্চল তাঁকে টেনে বার করলে টেবিলের তলা থেকে। কাঁপতে কাঁপতে চেয়ারে বসে পড়ে তিনি শুধু বললেন, “উঃ!”