ইংরেজের প্রভুত্ব
পলাশী যুদ্ধের পরই মীরজাফর ক্লাইভের সঙ্গে দাউদপুরে দেখা করে। ১৭৫৭ খ্ৰীস্টাব্দের ২৯ জুন তারিখে ক্লাইভ, মীরজাফরকে নবাবের মসনদে বসান। এই সময় থেকেই ইংরেজরা বাঙলার প্রকৃত অধিপতি হয়ে দাঁড়ায়, যদিও শাসনভার নবাবের হাতেই থাকে।
ইংরেজরা নবাবের কাছ থেকে অনেক কিছু সুযোগ-সুবিধা সংগ্ৰহ করে। তারা ২৪ পরগণার জমিদারী স্বত্ব পায়, বিনাশুল্কে ব্যবসা করবার অধিকার লাভ করে, এবং বাঙলার অভ্যন্তরস্থ অঞ্চলে কুঠি নির্মাণের অধিকার পায় কলকাতায়। তারা একটা টাকশালও স্থাপন করে, যেখানে ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দের ১৯ আগস্ট তারিখ থেকে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির নিজ নামে মুদ্রা নির্মাণ হতে থাকে।
নবাব ইংরেজদের হাতে খেলার পুতুল হয়ে দাঁড়ায়। এই সময় নবাব বুদ্ধিহীনের মত দুর্লভরাম, রামনারায়ণ সিং প্রভৃতির ন্যায় বিচক্ষণ হিন্দু কর্মচারীদের বরখাস্ত করে। এর ফলে রাজ্যের সর্বত্র অসন্তোষ ও বিদ্বেষ প্রকাশ পায়। পাটনা, পূর্ণিয়া, মেদিনীপুর, ঢাকা প্ৰভৃতি স্থানে গণবিদ্রোহ দেখা দেয়। নবাব ক্লাইভকে তা দমন করতে বলে। নবাবের এই উপকার সাধনের জন্য ইংরেজরা বিহারের সোরা বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার পায়।
১৭৫৯ খ্রীষ্টাব্দে দিল্লীর বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলম বাঙলা আক্রমণ করবার উদ্দেশ্যে বিহারের সীমান্তে এসে আবির্ভূত হন। নবাব তখন ইংরেজদের কাছ থেকে আবার সাহায্য প্রার্থনা করে। এর বিনিময়ে ইংরেজরা কলকাতার পার্শ্ববর্তী সমস্ত অঞ্চলের খাজনা আদায়ের অধিকার পায়।
ইংরেজদের এ রকম উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধি দেখে ওলন্দাজরা ঈৰ্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠে। তারা নিজেদের নিরাপত্তা, সম্বন্ধে ভীতিগ্ৰস্ত হয়ে ১৭৫৯ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজদের বিরুদ্ধে এক অভিযান চালায়। এ সময় নবাবও ইংরেজদের ক্ৰমবধমান প্ৰভাবে অসন্তুষ্ট হয়ে ওলন্দাজদের উৎসাহিত করে। নবাবের প্রকৃত মনোভাব যাই থাকুক না কেন, চুঁচুড়া ও চন্দ্রনগরের অন্তবর্তী বেদার নামক স্থানের যুদ্ধে, নবাব ইংরেজদেরই পক্ষ অবলম্বন করে। বেদারার যুদ্ধে ওলন্দাজরা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়, এবং ইংরেজদের, ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু, এই পরাজয়ের পরমুহুর্ভেই মীরজাফরের পুত্র মীরণ ওলন্দাজদের শান্তি দেবায় জন্য চুঁচুড়ায় এসে হাজির হয়। কিন্তু ইংরেজদের মধ্যস্থতায় ওলন্দাজরা মীরণের রোষের হাত থেকে রক্ষা পায়, তবে তাদের প্রতিশ্রুতি দিতে হয় যে তারা ভবিষ্যতে আর যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হবে না, সৈন্যসামন্ত সংগ্ৰহ করবে না, এবং নিজ অঞ্চলে আর কোনরূপ দুৰ্গ নির্মাণ করবে না। বস্তুতঃ এর পর থেকেই বাঙলা দেশে ওলন্দাজদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে ইংরেজদের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। ১৭৯৫ খ্রীস্টাব্দে ওলন্দাজদের ঘাটি বরানগর ইংরেজদের হাতে চলে আসে। চুঁচুড়া আসে ১৮২৪ খীস্টাব্দে।
দুই
১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দে ক্লাইভ বিলাত চলে যান। বাঙলায় কোম্পানির পরিচালনার ভার হলওয়েলের ওপর ন্যন্ত হয়। এই সময় কোম্পানির বোর্ড অভ ডিরেকটরসায়া লিখে পাঠান যে কোম্পানির সাহায্যার্থে তারা বিলাত থেকে কোন অর্থ পাঠাবেন। না, কেননা কোম্পানি বাঙলায় যথেষ্ট অর্থ অর্জন করছে। অর্থের অভাবে হলওয়েল নবাবের ওপর চাপ দিয়ে ১৭৫৭ খ্ৰীস্টাব্দের চুক্তি ‘অনুযায়ী কিস্তির টাকা চেয়ে পাঠান। কিন্তু নবাবের খাজাঞ্চীখানা তখন শূন্য। নিজ সৈন্যদেরই তখন তিনি মাহিনী দিতে পারছিলেন না এবং তারা বিদ্রোহ করবার জন্য প্ৰস্তুত হচ্ছিল। নবাবের তখন না আছে অর্থ, না আছে সামর্থ্য। নিজ প্রজাদের তখন তিনি কোম্পানির কর্মচারিগণ কর্তৃক ‘দস্তক’ আদায়ের জুলুম থেকে রক্ষা করতে পারছিলেন না। তাছাড়া, কোম্পানির কর্মচারীদের জুলুমের ফলে দেশীয় বণিকরাও ক্ষতিগ্ৰন্ত হছিল। একজন ইংরেজ লেখক বলে গেছেন।–Bengal by this time had fallen into a state of anarchy and misery’
এই পরিস্থিতির জন্য হলওয়েল নবাবকেই দায়ী করলেন, এবং চক্রান্ত করে নবাবকে গদিচ্যুত করে ১৭৬০ খ্ৰীস্টাব্দে তার জামাতা মীরকাশিমকে গদিতে বসালেন।
তিন
চরিত্র এবং দক্ষতায় সীরকাশিম তীর শ্বশুর মীরজাফরের একেবারে বিণীত ছিলেন। বস্তুতঃ তিনি দৃঢ় চৰিত্র ও অসাধারণ শাসনক্ষ্মতায় অধিকারী ছিলেন। ইংরেজদের অনুসৃত সুশৃঙ্খল কায়দায় নিজ সৈন্যবাহিনীকে পুনর্বিন্যাস করে তিনি নিজেকে শক্তিমান করেন। তারপর তিনি রাজকোষের উন্নতির – দিকে মন দেন। অবাধ্য জমিদারদের তিনি দমন করেন, এবং প্ৰবীণ কর্মচারীরা খাজিরি-জমা নামে যে রাজস্ব লুকিয়ে রাখত, তা প্ৰত্যাৰ্পণ করতে বাধ্য করেন। রাজকোষ বৰ্ধিত করে, তিনি কোম্পানির নিকট নবাবের যে বকেয়া ঋণ ছিল তা পরিশোধ করেন। সৈন্যবাহিনীর বকেয়া মাহিনাও তিনি প্ৰদান করেন। রাজ্যের সর্বত্র তিনি তার প্রভাব বিস্তার করেন। কর্মপটুতায় তিনি মুরশিদকুলি এখানের সমকক্ষ ছিলেন। তার সম্বন্ধে গোলাম হুসেন সলীম তার ১৭৮৮ খ্রীষ্টাব্দে রচিত ‘রিয়াজ-উস্-সালাতীন’ গ্রন্থে লিখেছেন—“In unravelling the intricacies of affairs of government and especially the knotty mystefies of finance, in examining and determining private differences, in establishing regular payment for his troops and for his household; in honouring and rewarding men of merit and men of learning, in conducting his expenditure exactly between the extremities of parsimony and prodigality; and in knowing intuitively where he must spend and where with moderationin all these qualifications he was an incomparable man indeed and the most extraordinary prince of his age” (Ghulam Husain Salim, Riyat-us-salatin translated by Abdus Salam, quoted in A. K. Sur’s “History and Culture of Bengal”, 1963 page 173)। তাঁর গুণের জন্য দিল্লীর বাদশাহ তাঁকে ‘আলীজাহ নশীর-উল-মুলক এমতাজদ্দৌলা কাশিম আলি খান নশরৎ জঙ্গ’ উপাধি দিয়েছিলেন।
মীরকাশিমের মত সুদক্ষ ও সুযোগ্য নবাবের পক্ষে তার প্রজাবৃন্দের ওপর কোম্পানির কর্মচারীদের অত্যাচার ও লোভাতুর আচরণ সহ করা অসম্ভব ছিল। কোম্পানির কর্মচারীরা এ সময় বিনাতকে বাণিজ্য করত। মালি কেনাবেচা সম্পর্কে লোকদের ওপর অত্যাচার ও দুর্দান্ত জুলুম করত। এই অত্যাচায়ের বিরুদ্ধে যেখানে নবাবের কর্মচারীরা হস্তক্ষেপ করত, তা তারা পদদলিত করত। আভ্যন্তরীন বাণিজ্যে ইংরেজ কর্মচারীদের এরূপ আচরণ নিবারণ করতে না পেরে, মীরকাশিম নিজ প্ৰজাবৃন্দকে ইংরেজদের সঙ্গে সমান পর্যায়ে ফেলবার জন্য ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যের সর্বত্র বাণিজ্য শুষ্ক রহিত করেন। ইংরেজরা বাণিজ্য শুষ্ক পুনরায় ন্যন্ত করবার দাবী জানায়। নবাব সে দাবী গ্ৰাহ করতে অস্বীকৃত হন। এই সকল বিবাদ-বিসংবাদের ফলে নবাবের সহিত ইংরেজদের শত্রুত। ঘটে। ইংরেজরা যখন নৌপথে পাটনায় অন্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাচ্ছিল, নবাবের কর্মচারীরা তখন তা আটক করে। এর ফলে কোম্পানির পাটনা কুঠির অধিকর্তা এলিস নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং পাটনা দখল করে নেয়। মীরকাশিমের সৈন্যবাহিনী শীঘ্রই পাটনা পুনরুদ্ধার করে ও এলিস সমেত অন্যান্য ইংরেজদের বন্দী করে। কিন্তু গিরিয়া, সুতি ও উদয়নালার যুদ্ধে (১৭৬৩) নবাববাহিনী পরাজিত হয়। ক্রুদ্ধ হয়ে নবাব ইংরেজ বন্দীদের হত্যা করে। (ওয়ালটার রাইনহার্ট ওরফে সম্বর’ নামে নবাবের একজন জার্মান কর্মচারী নবাবের আদেশে এই কাজ করে)। উদয়নালার যুদ্ধের পূর্বে নবাব রাজা রামনারায়ণকেও হত্যা করেন এবং রাজা রাজবল্লভকে মুঙ্গেরে গঙ্গায় ডুবিয়ে মারেন। পাটনার পথে নবাব জগৎশেঠ, মহাতপরায় ও তাঁর ভ্রাতা স্বরূপচাঁদ। এবং রাজা উনিদরায়কেও খতম করেন।
ইংরেজরা যখন পাটনা পুনঃদখল করে, মীরকাশিম তখন পালিয়ে গিয়ে অযোধ্যার নবাৰ শুজাউদ্দৌলার কাছে আশ্ৰয় নেয়। অযোধ্যার নবাব, সম্রাট শাহ আলম ও কয়েকজন দুঃসাহসিক ফরাসীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান করে। অযোধ্যা ও বিহারের উপপ্ৰান্তে কয়েকটি অমীমাংসিত সংঘর্ষের পর, বকসারের যুদ্ধে (১৭৬৪) ইংরেজদের হাতে মীরকাশিমের যুক্তবাহিনী পরাজিত হয়। মীরকাশিম দিল্লীতে পালিয়ে যায়, এবং দিল্লীর নিকট পাশোয়ান গ্রামে দুরবস্থার মধ্যে উদারী রোগে তার মৃত্যু ঘটে।
চার
ইংরেজরা মীরজাফরকে আবায় বাঙলার মসনদে বসায় (১৭৬৩)। এই সময় ইংরেজরা মীরজাফরের সঙ্গে এক নূতন সন্ধি করে। এই সন্ধি অনুযায়ী মীরজাফর বর্ধমান, 4 মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম জেলা ইংরেজদের দিয়ে দেয়। তাছাড়া ইংরেজর লবণ ব্যতীত বাঙলাদেশে আর সব পণ্যের বাণিজ্য বিনাশুকে করবার অনুমতি পায়। মীরজাফর ইংরেজদের ত্ৰিশ লক্ষ টাকা দিতে রাজি হয় ও মুরশিদাবাদে ইংরেজদের একজন আবাসিক প্রতিনিধি রাখবার অনুমতি দেয়।
১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে কুষ্ঠরোগে মীরজাফরের মৃত্যুর পর, ইংরেজরা মীরজাফরের পুত্র নজম-উদ-দৌল্লাকে নবাবের মসনদে বসায়। নবাব হবার পর নজম-উদ-দৌলা ইংরেজদের সঙ্গে এক চুক্তি করে। ওই চুক্তির বলে নবাব ইংরেজদের হাতে নিজামত (রাষ্ট্রশাসন, সৈন্যবাহিনী, প্রতিরক্ষণ, পুলিশ ইত্যাদি) তুলে দেয়, এবং নিজের সম্মান ও রাজস্ব আদায়ের জন্য যে স্বল্পসংখ্যক সৈন্যের প্রয়োজন, তা নিজ হাতে রাখেন। ইংরেজদের অনুমতি ব্যতীত নিজ কৰ্মচারী নিয়োগের অধিকারও তিনি হারান। ইংরেজদের বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত থাকে, এবং নূতন নবাবের কাছ থেকে তারা ১৫ লক্ষ টাকা উপঢৌকন পায়। উপঢৌকনটা আর কিছুই নয়, ঘুষ মাত্র। এখানে এই উপঢৌকন সম্বন্ধে বিশদভাবে কিছু বলা দরকার। সিরাজউদ্দৌলার বদলে মীরজাফরকে নবাব করবার সময় ক্লাইভ ঘুষ পেয়েছিল ২১১,৫০০ পাউণ্ড, ওয়াটস। ১১৭,০০০ পাউণ্ড, কিলপ্যাট্রিক ৬০,৭৫০ পাউণ্ড, ওয়ালিশ ৫৬,২৫০ পাউণ্ড, ড়েক ৩১,৫০০ পাউণ্ড, ম্যানিংহাম ও বেশীর প্রত্যেকে ২৭,০০০ পাউণ্ড, ফ্ৰাফটন। ২২,৫০০ পাউণ্ড, বোডোম, ফ্রাঙ্কল্যাণ্ড, ম্যাকেট, কোলেট, অমিয়ট ও মেজর গ্ৰাণ্ট প্ৰত্যেকে ১১,০০০ পাউণ্ড করে। লুশিংটন পেয়েছিল ৫,৬২৫ পাউণ্ড। আর মীরজাফরের বদলে মীরকাশিমকে নবাব করবার সময় ভ্যানসিটাট নিয়েছিল ৫৮,৩৩৩ পাউণ্ড, হলওয়েল ৩০,৯৩৭ পাউণ্ড, ম্যাকগুইয়ার ২৯,৩৭৫ পাউণ্ড, সামনার ২৮,০০০ পাউণ্ড, কেল্যান্ড ২২,৯১৬ পাউণ্ড এবং স্মিথ ও ইয়র্ক প্ৰত্যেকে ১৫,৩৫৪ পাউণ্ড। আর নজম-উদ-দৌল্লাকে নবাবের গদিতে বসাবার সময় ক্লাইভ দক্ষিণা পেয়েছিল ৫৮,৩৩৩ পাউণ্ড, কার্নাক ৩২,৬৬৬ পাউণ্ড, জনস্টোন ২৭,৬৫০ পাউণ্ড, স্পেনসার ২৩,৩৩৩ পাউণ্ড, সিনিয়র ২০,১১৫ পাউণ্ড, মিডলটন ১৪,২৯১ পাউণ্ড, লেসেস্টার ১৩,১২৫ পাউণ্ড, প্লেডেল, বার্ডেট ও গ্ৰে প্ৰত্যেকে ১১,৬৬৭ পাউণ্ড করে, ও জি, জনস্টোন ৫,৮৩৩ পাউণ্ড। এছাড়া মেজর মুনরো ও তার সহকারীরা সকলে মিলে ১৬,০০০ পাউণ্ড পেয়েছিল। এ তো গেল নবাব অদল-বদলের সময়ের প্রাপ্তিযোগ। এ ছাড়া, জমিদারী বিলি-ব্যবস্থার সময়ও তারা যথেষ্ট ঘুষ নিত। এক কথায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ইংরেজদের ঘুষ নেবার কোন সীমা ছিল না। অবশ্য, মাত্র সাহেবরাই যে ঘুষ নিত তা নয়। তাদের এদেশী সহকারী দেওয়ানরাও ঘুষ নিত। তাদের এদেশী সহকারীরা এইভাবে লক্ষ লক্ষ টাকা উপায় করে কলকাতায় সভ্রান্ত পরিবারসমূহের পত্তন করে গেছে।
পাঁচ
বস্তুতঃ বকসারের যুদ্ধের পর বাঙলার নবাব মাত্র সাক্ষীগোপালে পরিণত হয়। প্রকৃত ক্ষমতা কোম্পানির কর্মচারীদের হাতে চলে যায়। তাদের অত্যাচার, স্বার্থাদ্ধতা ও জুলুম দেশের মধ্যে এক নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। অবহিত হয়ে কোম্পানির বিলাতে অবস্থিত কোর্ট অভ ডিরেকটরসরা ক্লাইভকে পুনরায় বাঙলার গভর্নর করে পাঠান (১৭৬৫)। এখানে পৌঁছে ক্লাইভ যে পরিস্থিতি দেখেন, তা তাঁর নিজের ভাষায়—“A presidency divided, headstrong and licentious, a government without subordination, discipline or public spirit. . . . amidst a general stagnation of useful industry and of licensed commerce, individuals were accumulating immense riches, which they had ravished from the insulted prince and his helpless people who groaned under the united pressure of discontent, poverty and oppression. . . . . . Such a scene of anarchy, confusion, bribery, corruption and extortion was never seen or heard of in any country but Bengal; nor such and so many fortunes acquired in so unjust and rapacious a manner. The three provinces of Bengal, Bihar and Orissa, producing a clear revenue of £3,000,000 sterling had been under the absolute management of the company’s servants, ever since Mirjafar’s restoration to the subaship; and they exacted and levied contributions from every man of
power and consequence, from the Nawab down to the lowest zemindar.” (Quoted in A. K. Sur’s “History & Culture of Bengai’, 1963, page 175)
এই শোচনীয় পরিস্থিতির সংশোধনে ক্লাইণ্ড জানিয়োগ করেন। তিনি কোম্পানির কর্মচারীদর দিয়ে চুক্তিসূত্র স্বাক্ষর কবিয়ে নেন যে তারা ব্যক্তিগতভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত থাকতে পারবে না ও কোনরূপ উপঢৌকন গ্ৰহণ করবে না। এই সংস্কারের জন্য ক্লাইভ এদেশবাসী ইংরেজদের কাছ থেকে ঘৃণাব্যঞ্জক নিন্দা অর্জন করেন। কিন্তু তাদের সন্তুষ্ট করবার জন্য তিনি এদেশের লোকরা যে সকল সামগ্ৰী ব্যবহার করত, যেমন–লবণ, আফিম, পান ইত্যাদির আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার তাদের দেন। যখন বিলাতের কোর্ট অভ ডিরেকটরসর আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য সম্পর্কে কোম্পানির কর্মচারীদের এরূপ একচেটিয়া অধিকার বিতরণ সম্বন্ধে বিরূপ মনোভাব প্ৰকাশ করে, তখন তিনি তার প্রতিবাদও জানান।
ক্লাইভ সৈন্যবিভাগেরও সংস্কার করেন। সৈন্যবিভাগে তিনি যুগল-বাট্টা প্রণালী রহিত করেন। সৈন্যবাহিনীর গঠনেরও তিনি পুনর্বিন্যাস করেন। তিনি সৈন্যবিভাগকে তিনটি ব্রিগেডে বিভক্ত করেন। প্ৰত্যেক ব্রিগেড়ে থাকে একদল ইংরেজ পদাতিক, একদল গোলন্দাজ, ছয়দল এদেশী সিপাহী ও একদল এদেশী অশ্বারোহী সৈন্য। মারাঠাদের আক্রমণ প্ৰতিহত করবার জন্য এই তিনটি ব্রিগেডকে তিনি যথাক্রমে মুঙ্গের, বঁকিপুর ও আলাহাবাদে অবস্থিত করান। অযোধ্যার নবাব ও সম্রাট শাহ আলমের সঙ্গে তিনি এক বন্দোবস্ত করেন। এই বন্দোবস্ত অনুযায়ী ২৬ লক্ষ টাকা বার্ষিক বৃত্তি প্ৰদানের পরিবর্তে তিনি সম্রাটের কাছ থেকে বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার দেওয়ানী (রাজস্ব শাসন) সংগ্ৰহ করেন। দেওয়ানী লাভের ফলে এখন থেকে ইংরেজরাই এই তিন প্রদেশের রাজস্ব আদায় করবে, সম্রাট মাত্র একটা বার্ষিক বৃত্তি পাবেন। এর ফলে ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকে নিজামত (যা ইংরেজরা নবাব নজম-উদ-দৌল্লার কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিল) ও দেওয়ানী, এ দুই-ই ইংরেজদের হাতে এসে পড়ে, এবং তারাই এদেশের প্রকৃত শাসক হয়ে দাঁড়ায়।
দেওয়ানী লাভের পর আরও সাত বছর পর্যন্ত আগেকার ভূমিরাজস্ব প্ৰশাসনই বলবৎ থাকে। (পরে দেখুন) এবং কোম্পানির নায়েব-দেওয়ানরূপে মহম্মদ রেজা খা বাঙলার ভূমিরাজস্বের পরিচালনা করতে থাকেন। এর ফলে দ্বৈতশাসনের প্রবর্তন হয় (নীচে দেখুন)। কিন্তু অত্যধিক রাজস্ব দাবী, বাৎসরিক ইজারা দান ইত্যাদির ফলে দেশের মধ্যে এক স্বৈরতান্ত্রিক অরাজকতার আবির্ভাব ঘটে।
ছয়
দেওয়ানী পাবার পর ইংরেজরাই যে প্রকৃতপক্ষে ভারতের অধীশ্বর হলেন, এটা অন্যান্য ইওরোপীয় জাতিগণের কাছে গোপন রাখবার জন্য, ক্লাইভ আনুষ্ঠানিকভাবে দেশশাসনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্ৰহণ করেন নি। নবাবই দেশশাসন করছেন, এটা বাহত দেখাবার জন্যই তিনি নবাবের নিযুক্ত দুই পূর্বতন প্ৰতিভুকে-মুরশিদাবাদে মহম্মদ রেজা খান ও পাটনায় রাজা সিতাব রায়কেতাদের রাজস্ব আদায়ের কাজে বহাল রাখেন। তারাই রাজস্ব আদায় করবে, মাত্র রাজস্ব আদায়ের জন্য একটা নির্দিষ্ট টাকা পাবে, এরূপ স্থিরীকৃত হয়। এর ফলে দেশের মধ্যে দ্বৈতশাসনের প্রবর্তন হয়। কিন্তু দ্বৈতশাসন হয়ে দাঁড়ায় প্ৰজাপীড়ন ও নির্মম অত্যাচারের এক যন্ত্র। এ সম্পর্কে দেবীসিংহ-এর অমানুষিক অত্যাচার বিশেষভাবে উল্লেখনীয়। দেবীসিংহ ছিলেন পাঞ্জাবের লোক। ১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দ নাগাদ তিনি বাঙলা দেশে আসেন। মহম্মদ রেজা খাঁ তাকে পূৰ্ণিয়ার ইজারাদার করেন। অর্থ সংগ্রহের জন্য দেবীসিংহ কোন রকম অত্যাচার, অবিচার ও অন্যায় করতে দ্বিধা করত না, তার অত্যাচার ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের অন্যতম কারণ। ১৭৮১ খ্রীস্টাব্দে সে বেনামীতে রঙপুর, দিনাজপুর ও এন্দরাকপুর ইজারা নেয়। ইটাকুমারীর রাজা শিবচন্দ্র রায়ের ওপর সে অমানুষিক অত্যাচার করে। তাঁর শোষণের ফলে ১৭৮৩ খ্রীস্টাব্দে রঙপুরের জনগণ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এই বিদ্রোহের নেতা ছিল নুরুলুদ্দিন। তিনি নিজেকে ‘নবাব’ ঘোষণা করেন ও দয়াশীল নামে এক প্ৰবীণ কৃষককে তাঁর দেওয়ান নিযুক্ত করে দেবীসিংহকে কর না দেবার আদেশ জারি করেন। তাঁর অনুচররা দেবীসিংহ ও ইংরেজদের ঘাঁটি মোগলহাট বন্দরের ওপর আক্রমণ চালায়। এক ভীষণ যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে নুরুলুদ্দিন জখম ও বন্দী হন ও কয়েক দিন পরে মারা যান।
দেবীসিংহের বিরুদ্ধে প্ৰকাশ্য বিচার হয়। কিন্তু প্ৰমাণাভাবে সে মুক্তি পায়। এই দেবীসিংহই নসীপুর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।
১৮৬৭ খ্রীস্টাব্দে ক্লাইভ বিলাতে ফিরে যান। সেই সময় থেকে ১৭৭২ খ্রীস্টাব্দে ওয়ারেন হেষ্টিংসের নিয়োগ পৰ্যন্ত ভারতে ইংরেজদের বিষয়-ব্যাপার ভেরেলস্ট ও কাটিয়ারের হাতে ছিল। তাদের শাসনকালে দেশের মধ্যে দুর্নীতির আবার পুনঃ প্ৰকোপ হয়, যার ফলে দেশ ধ্বংসের পথে ক্রমাগত এগিয়ে যেতে থাকে। রিচার্ড বেচার নামে কোম্পানির একজন কর্মচারী ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে এই পরিস্থিতি সম্বন্ধে কোর্ট অভ ডিরেকটরসদের এক গোপন কমিটির কাছে লিখে পাঠান—“It must give pain to an Englishnan to have reason to think that since the accession of the Company to the Diwani, the condition of the people of the country has been worse than it was before; and yet I am afraid the fact is undoubted the fine country which flourished under the most despotic and arbitrary government, is verging towards ruin… when the English received the grant of the Diwani, their consideration seems to have been the raising of as large sums from the country as could be collected to answer the pressing demands from home and to defray large expenses here.” (Richard Becher’s letter to the Select Committee of the Directors in 1769 quoted in A. K. Sur’s “History & Culture of Bengal” 1963; page 177)
বেচারের চিঠির ভিত্তিতে ১৭৬৯ খ্রীস্টাব্দে এদেশী কর্মচারীদের ওপর নজর রাখবার জন্য সুপারভাইজার অভ্ রেভেন্যু নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু এরই পদাঙ্কে বাঙলায় আসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর।
সাত
অষ্টাদশ শতাব্দীর ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মত মর্মান্তিক ঘটনা, আর দ্বিতীয় ঘটেনি। মন্বন্তর বাঙলা দেশকে এমনভাবে বিধ্বস্ত করেছিল যে পরবর্তী কালে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বাঙলার লোকের কাছে এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নরূপ কিংবদন্তীতে দাঁড়িয়েছিল। সমসাময়িক দলিলসমূহের ওপর প্রতিষ্ঠিত নিজ অনুশীলনের ভিত্তিতে লিখিত ডবলিউ. ডবলিউ. হাণ্টার তার ‘অ্যানালস অভ্যু রুরাল বেঙ্গল’ বইতে এর এক বিশ্বস্ত বিবরণ দিয়েছেন। হাণ্টারের বর্ণনা—‘১৭৭০ খ্রীস্টাব্দে গ্রীষ্মকালে রৌদ্রের প্রবল উত্তাপে মানুষ মরিতে লাগিল। কৃষক?” গরু বেচিল, লাঙ্গল-জোয়াল বেচিল, বীজধান খাইয়া ফেলিল, তারপর ছেলেমেয়ে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর ক্রেতা নাই, সকলেই বেচিতে চায়। খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল। ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল। তারপর মৃতের মাংস খাইতে লাগিল। সারাদিন সারারাত্র অভুক্ত ও ব্যাধিগ্রন্ত মানুষ বড় বড় শহরের দিকে ছুটিল। তারপর মহামারী দেখা দিল। লোকে বসন্তে মরিতে লাগিল। মুরশিদাবাদের নবাবপ্রাসাদও বাদ গেল না। বসন্তে নবাবজাদা সইফুজের মৃত্যু ঘটিল। রাস্তায় মৃত ও নির্ধনীর শবে পূর্ণ হয়ে পাহাড়ে পরিণত হইল। শৃগাল কুকুরের মেলা বসিয়া গেল। যাহারা বাচিয়া রহিল, তাহাদের পক্ষে বাঁচিয়া থাকাও অসম্ভ হইয়া দাঁড়াইল।‘ অনুরূপ বর্ণনা বঙ্কিমও তাঁর ‘আনন্দমঠ’-এ দিয়েছেন। বঙ্কিম লিখেছেন- ‘১১৭৬ সালে গ্ৰীষ্মকালে একদিন পদচিকু গ্রামে রৌদ্রের উত্তাপ বড় প্রবল। … সম্মুখে মন্বন্তর …লোক রোগাক্রান্ত হইতে লাগিল। গোরু বেচিল, লাঙ্গল বেচিল, জোয়াল বেচিল, বীজধান খাইয়া ফেলিল, ঘরবাড়ি বেচিল, জোতজমা বেচিল। তারপর মেয়ে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর ছেলে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর স্ত্রী বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর মেয়ে, ছেলে, স্ত্রীকে কেনে খরিদ্দার নাই, সকলেই বেচিতে চায়। খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল, ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল, আগাছা খাইতে লাগিল। অনেকে পলাইল, যাহারা পলাইল তাহারা বিদেশে গিয়া অনাহারে মরিল, যাহারা পলাইল না, তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া রোগে পড়িয়া প্ৰাণত্যাগ করিল। বসন্তের বড় প্ৰাদুৰ্ভাব হইল, গৃহে গৃহে বসন্তে মরিতে লাগিল।‘
লর্ড মেকলেও তাঁর বর্ণাঢ্য ভাষায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের এক করুণ চিত্র দিয়েছেন–
“In the summer of 1770 the rains failed; the earth was parched up; and a famine, such as is known only in the countries where every household depends for support on its own little patch of cultivation filled the whole valley of the Ganges with misery and death. Tender and delicate women, whose veils had never been lifted before the public gaze, came forth from their inner chambers in which Eastern zealousy had kept watch over their beauty, threw themselves on the earth before the passerby, and, with loud wailings, implored a handful of rice for their children. The Hooghly everyday rolled down thousands of corpses close to th portieos and gardens of the Englisn conquerors. I ne very streets or Valcutta were blocked up by the dying and dead. The lean and feeble survivors had not energy enough to bear the bodies of their kindred to the funeral pile or to the holy river or even to scare away jackals and vultures who fed on human remains in the face of the day . . . It was rumoured that the Company’s servants had created the famine by engrossing all the rice of the country”. (Macaulay in essay on “Clive” quoted in A. K. Sur’s “History & Culture of Bengal” 1963, pages 177-178)
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ঘটেছিল অনাবৃষ্টির জন্য। তার আগের বছরেও বৃষ্টির স্বল্পতার জন্য ফসল কম হয়েছিল। তার জন্য চাউল মহার্ঘ্য হয়েছিল। কিন্তু লোক না খেয়ে মরেনি। কিন্তু ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় লোক না খেয়ে, মরেছিল। তার কারণ, যা চাউল বাজারে ছিল, তা কোম্পানি আকালের আশঙ্কায় সিপাইদের জন্য বাজার থেকে কিনে নিয়েছিল। কোম্পানি যখন চাউল কিনতে শুরু করল, তখন তারই পদাঙ্কে কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে যারা গোপন ব্যবসায়ে লিপ্ত থাকত, তারাও লাভের প্রত্যাশায় চাউল কিনে মজুত করল। সমসাময়িক এক বৰ্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি যে কোম্পানির যে কর্মচারীর এক বৎসর পূর্বে ১০০ পাউণ্ডেরও সংস্থান ছিল না, পর বৎসর সে, ৬০,০০০ পাউণ্ড দেশে পাঠাল।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের প্রকোপে বাঙলা দেশের এক-তৃতীয়াংশ লোক মারা গিয়েছিল। আর কৃষকদের মধ্যে মারা গিয়েছিল শতকরা ৫০ জন। জনবহুল গ্রামসমূহ জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল। বীরভূমের বহু গ্রাম এমন জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল যে এই ঘটনার দশ বছর পরেও সৈন্যদের পক্ষে সে সকল স্থান অতিক্রম করা সম্পূর্ণভাবে দুষ্কর হয়ে উঠেছিল। এত কৃষক মরে গিয়েছিল যে মন্বন্তরের পর নিজ নিজ জমিতে চাষী বসাবার জন্য জমিদারদের মধ্যে এক প্ৰতিদ্বন্দিতা ঘটেছিল। তখন থেকেই বাঙলা দেশে খোদবন্ত রায়ত অপেক্ষা পাইকন্ত রায়তের সংখ্যা বেড়ে যায়।
মন্বন্তয়ে সবচেয়ে বেশী বিপৰ্যন্ত হয়েছিল জমিদাররা। কেননা এই সময় বাঙলার নায়েব দেওয়ান মহম্মদ রেজা খাঁ শতকরা দশটাকা হারে রাজস্ব বাড়িয়ে দিয়েছিল। তার ফলে বাঙলায় কান্নার কোলাহল পড়ে গিয়েছিল। একে তো মন্বন্তরের বছর। লোক না খেতে পেয়েই মরে যাচ্ছে। জমিদারকে তারা খাজনা দিবে কি করে? জমিদারও প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা না পেলে সরকারে রাজস্ব জমা দেবে কেমন করে? জমিদারদের ওপরই গিয়ে পড়ল চূড়ান্ত নিৰ্যাতন। তাদের উলঙ্গ করে বিছুটির চাবুক মেরে সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত করে দেওয়া হল। তারপর অচৈতন্য অবস্থায় তাদের অন্ধকার কারাগারে নিক্ষেপ করা হল। শুধু তাই নয়। স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ও পিতার সামনে কন্যাকে বিবস্ত্রা করে শুরু হল নিষ্ঠুর নির্যাতন। বর্ধমানের মহারাজা, নদীয়ার মহারাজা, নাটোরের রানী ভবানী, বীরভূম ও বিষ্ণুপুরের রাজাদের যে কি দুৰ্গতি হয়েছিল, সে সব হাণ্টার তাঁর ‘অ্যানালস অভ রুরাল বেঙ্গল’ বইয়ে লিখে গেছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় জনগণ যে ক্ষিপ্ত হয়ে একটা সমাজ বিপ্লব ঘটবে তা বলাই বাহুল্য মাত্র। হাণ্টার বলেছেন—‘অরাজকতা প্ৰসব করে অরাজকতা এবং বাঙলার দুর্দশাগ্ৰস্ত কৃষক সম্প্রদায় আগামী শীতকালের খাদ্যফসল থেকে বঞ্চিত হয়ে ও দস্যুদ্বারা বিধ্বস্ত হয়ে, নিজেরাই দস্যুতে পরিণত হল। যাঁরা প্ৰতিবেশীর নিকট আদর্শ চরিত্রের লোক বলে পরিগণিত হত, সে সকল কৃষক ও পেটের দায়ে ডাকাতে পরিণত হল এবং সন্ন্যাসীর দল গঠন করল। তাদের দমন করবার জন্য যখন ইংরেজ কালেকটররা সামরিকবাহিনী পাঠাল, তখন এক এক দলে পঞ্চাশ হাজার সন্ন্যাসী, সিপাইদের নস্যাৎ করে দিল। মন্বন্তর এবং তার পরবর্তী কয়েক বছর এরূপই চলল। পরে অবশ্য ইংরেজদের হাতে তারা পরাভূত হল।‘ এটা সবই হাণ্টারের কাহিনী। এই কাহিনীকেই পল্লবিত করে বঙ্কিম তার উপন্যাসকে ‘আনন্দমঠ’-এর রূপ দিয়েছিলেন।
মন্বন্তর মাত্ৰ এক বছরেরই ঘটনা। কিন্তু তার জের চলেছিল বেশ কয়েক বছর। মন্বন্তরের পরের দু’বছরে বাঙলা আবার শস্যশ্যামলা হয়ে উঠেছিল। লোক “পেট ভরে খেতে পেল বটে, কিন্তু লোকের আর্থিক দুৰ্গতি চরমে গিয়ে পৌঁছাল।। অত্যধিক শস্য ফলনের ফলে কৃষি পণ্যের দাম এমন নিয়ন্তরে গিয়ে পৌঁছাল যে হাণ্টার বলেছেন—‘হাটে শস্য নিয়ে গেলে বেচে গাড়ীভাড়া তোলাও দায় হল।‘ সুতরাং বাঙলার কৃষক নিঃস্বই থেকে গেল। এদিকে খাজনা আদায় পুরোদমে চলতে লাগল, এবং তার জন্য নিৰ্যাতনও বাড়তে লাগল। কিন্তু নিৰ্যাতনের পরেও আধা রাজস্ব আদায় হল না। এটা পূৰ্ববতী কয়েক বছরের খাজনা আদায়ের পরিমাণ থেকে বুঝতে পারা যাবে—
বৎসর | দেয় রাজস্ব (পাউণ্ডে লিখিত) | আদায়ীকৃত রাজস্ব |
১৭৭২ | ৯৯,৪১০ | ৫৫,৯৩৭ |
১৭৭৩ | ১০৩,০৮৯ | ৬২,৩৬৫ |
১৭৭৪ | ১০১,৭৯৯ | ৫২,৫৩৩ |
১৭৭৫ | ১০০,৯৮০ | ৫৩,৯৯৭ |
১৭৭৬ | ১১১,৪৮২ | ৬৩,৩৫০ |
যেখানে উৎপন্ন শস্য হাটে নিয়ে গিয়ে বেচিতে গেলে, গাড়ীভাড়াই ওঠে না, সে ক্ষেত্রে নিঃস্ব কৃষক খাজনা দেবে কি করে? উপরে যে আদায়ীকৃত খাজনার’ পরিমাণ দেখানো হয়েছে, তা হচ্ছে নিৰ্যাতন-লব্ধ খাজনা। সুতরাং নিৰ্যাতনলন্ধ খাজনা সন্ন্যাসীরা লুঠ করতে লাগল। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন, এই ছিল এদের ধর্ম। সন্ন্যাসীদের এরূপ সংগঠন ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের অনেক আগে থেকেই ছিল। এরূপ এক মঠাধ্যক্ষই রক্ষা করেছিল রানী ভবানীর বাল্যবিধবা, সুন্দরী কন্যা তারাসুন্দরীকে সিরাজের কুৎসিত কমলালসা থেকে।
সন্ন্যাসীদের একজন মঠাধ্যক্ষ কৃপানাথ এক বিরাট বাহিনী নিয়ে রংপুরের বিশাল বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গল অধিকার করেন। তাঁর ২২ জন সহকারী সেনাপতি ছিল। রংপুরের কালেকটর ম্যাকডোয়াল পরিচালিত বিরাট সৈন্যবাহিনী দ্বারা, জঙ্গল ঘেরাও হলে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের খণ্ডযুদ্ধ হয়। বিদ্রোহিগণ বিপদ বুঝে নেপাল ও ভুটানের দিকে পালিয়ে যায়।
‘সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’ নামে অভিহিত হলেও এতে ফকির সম্প্রদায়ও যোগ দিয়েছিল। সন্ন্যাসী বিদ্রোহে সক্রিয় অংশ গ্রহণের জন্য আরও যাঁরা প্ৰসিদ্ধ হয়ে। আছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন ইমামবাড়ী শাহ, জয়রাম, জহুরী শাহ, দর্পদেব, বুদ্ধু শাহ, মজনু শাহ, মুসা শাহ, রামানন্দ গোঁসাই, ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণী ও সোভান আলি। (‘সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য)।
আট
কিন্তু ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের এই দুৰ্যোগের সময় ইংরেজরা ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্নবিলাসে মত্ত হয়ে, দক্ষিণ ভারতের যুদ্ধসমূহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। বস্তুত ১৭৭০ খ্রীস্টাব্দে বাঙলার আর্থিক সঙ্গতি নিয়দিকে এমনই স্তরে গিয়ে পৌঁছায় যে এক সমসাময়িক প্রতিবেদনে বলা হল-“the company seemed on the verge of ruin”। কিন্তু দেশের এই শোচনীয় অবস্থা হলেও, কোম্পানির কর্মচারীরা (তাদের ‘নবাব’ আখ্যা দেওয়া হত) স্বদেশে ফেরবার সময় প্রচুর অর্থ সঙ্গে করে নিয়ে যেত। এটা বিলাতের কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়ালো না, এবং তারা বিলাতের শাসনতন্ত্রের সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের জন্য পার্লামেণ্টে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ আইন পাশ করলেন।