০৬. আলিমুর রহমান বড় একটা কাঠের চেয়ারে

আলিমুর রহমান বড় একটা কাঠের চেয়ারে পা তুলে জবুথবু ভঙ্গিতে বসে আছেন। তার পরনে শাদা রঙের হাফ-পাজামা হাফ প্যান্ট জাতীয় একটা জিনিস। খালি গা। চেয়ারটা নিমগাছের নিচে বসানো। তিনি নিমগাছের পাতা ভেদ করে আসা রোদ গায়ে মাখছেন। তিনি আগ্রহ নিয়ে তার সামনে দাঁড়ানো যুবকটির কাণ্ডকারখানা দেখছেন। যুবকটি তাঁর পোট্রেট আঁকছে।

বেশ বড়-সড় একটা ইজেল তার সামনে। থালার মতো একটা বাটিতে রঙ। যুবকের হাতে ব্রাশ। সে দ্রুত বোর্ডে রঙ ঘষছে। আলিমুর রহমান বললেন, তোমার নাম কী?

যুবক তার দিকে না তাকিয়েই বলল, স্যার! আমার নাম জহির।

নামের আগে আহম্মদ, মুহম্মদ এইসব কিছু নাই?

জি না।

তুমি তো আমার দিকে তাকাচ্ছই না। না তাকিয়ে কি কাকের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং আঁকছু।

যুবক মুখ তুলে তাকাল। আবার রঙ লাগাতে লাগাতে বলল, মাঝে মাঝে আপনাকে দেখছি।

আমি যেভাবে বসেছি তাতে কি তোমার সমস্যা হচ্ছে?

জি না।

আমাকে দেখে মনে হচ্ছে না চেয়ারে একটা শাদা ব্যাঙ বসে আছে? সামনেই পুকুর। শাদা ব্যাঙটা এক্ষুনি লাফ দিয়ে পুকুরে পড়বে।

এ রকম মনে হচ্ছে না।

আমাকে বসে থাকতে দেখলে আমার নাতনীর এ রকম মনে হয়। মৃন্ময়ীর কথা বলছি।

জি বুঝতে পারছি।

এতক্ষণ কী আঁকলে আমাকে দেখাও।

যুবক বোর্ড উল্টে দেখাল। গাঢ় হলুদ রঙ। লম্বা লম্বা রঙের কিছু টান। আলিমুর রহমান বললেন, এই সব কী?

স্যার রঙ। ইয়োলো ওকার।

আমার ছবি কোথায়?

ছবি আসবে। প্রথমে রঙ আনছি।

ঠিক আছে আঁকতে থাক। মাঝে মাঝে আমাকে দেখাবে।

জি স্যার। দেখাব। আপনি যখনই বলবেন তখনই দেখাব। স্যার আমি কি একটা সিগারেট খেতে পারি?

আলিমুর রহমান বললেন, না। আমি তোমার বাপের চেয়েও বেশি বয়সের একজন বৃদ্ধ। আমার সামনে সিগারেট কেন খাবে? তোমার কি ছবি আঁকার সময় সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস?

জি।

বদঅভ্যাস দূর কর। বাবা-মা আছেন?

জি না।

ভাই-বোন কী?

একটাই বোন।

বোনের বিয়ে হয়েছে?

জি।

বাচ্চা-কাচ্চা আছে?

একটা মেয়ে আছে।

আমি যে কথা বলছি তোমার ছবি আঁকতে অসুবিধা হচ্ছে?

জি না।

কতটুকু আঁকা হয়েছে দেখাও।

জহির আবার দেখাল। আলিমুর রহমান তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন। নতুন কিছু করা হয়নি। আরও কিছু রঙ ঘসা হয়েছে। এই যুবক কি আসলেই ছবি আঁকা জানে? এতক্ষণ ধরে রঙ লাগানো হচ্ছে। চোখ নাক মুখ কিছু-একটা তো আসবে।

তোমার বোনের স্বামী কী করেন?

খুলনার এক কারখানায় কাজ করত, এখন করে না।

বেকার?

সারি সে এখন পলাতক।

পলাতক কেন?

সে আরো কয়েক জন মিলে একটা মেয়েকে রেপ করেছিল। মেয়েটা মারা গেছে। পুলিশে মামলা চলছে। সে পালিয়ে গেছে ইন্ডিয়া।

তোমার বোন কোথায়?

আমার সঙ্গে থাকে।

বোনের মেয়েটার বয়স কত?

তিন বছর।

তার নাম কী?

টুনটুনি।

তোমার বোনের নাম কী?

মীনা।

তোমার বোনের নাম মীনা।

জি স্যার।

আমার মায়ের নাম ছিল মীনা। আমার বাবা অবশ্য আমার মাকে মিনু। ডাকতেন। তোমার বোনের স্বামী তার স্ত্রীকে কী ডাকে? মীনা ডাকে নাকি মিনু ডাকে।

আদর করে ময়না ডাকে।

তোমার নাম জহির তাই না?

জি স্যার।

ইচ্ছা করলে তুমি সিগারেট খেতে পার।

জহির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। কোনো রকম সঙ্কোচ ছাড়া সিগারেট ধরাল। তার কাজ সে বন্ধ করল না। ঠোঁটে সিগারেট রেখেই সে ব্রাশ টানছে। আলিমুর রহমান বললেন, তোমাকে সিগারেট খাবার অনুমতি কেন দিলাম জান?

জি না।

তুমি তোমার পারিবারিক একটা লজ্জার কাহিনী কোনো রকম সঙ্কোচ ছাড়া বলেছ দেখে আমার ভালো লেগেছে। তোমার বোনের নাম মীনা শুনেও ভালো লেগেছে। মীনা নাম শুনে আমার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ল। মার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তোমার বোনের স্বামী বদমাইশটার নাম কী?

সবুজ।

সবুজ কি তার স্ত্রীকে মারধোর করত?

জি না।

আমার বাবা আমার মাকে মারতেন। ছেলে-মেয়েদের চোখের সামনেই মারতেন। আমি আমার মাকে শেষ মার খেতে দেখি যখন আমার বয়স তের। বাবা মার চুলের মুঠি ধরে মারছেন। ছেচড়াতে ছেচড়াতে উঠানে নিয়ে এসেছেন। মার শাড়ি খুলে গেছে। তিনি তিনি… সেই যে আমি ঘর থেকে বের হলাম। আর ফিরে যাই নি।

জহির বলল, আপনার বাবা-মার সঙ্গে আর আপনার দেখা হয় নাই?

আলিমুর রহমান জবাব দিলেন না। জহির দেখল বৃদ্ধের দুই চোখ ভিজে উঠেছে। কঠিন চোখ হঠাৎ ভিজে গেলে অন্য এক ধরনের কোমলতা চলে আসে। জহির তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। তাকে এই চোখ আঁকতে হবে। মমতায় আর্দ্র চোখ।

জহির!

জি স্যার!

তুমি চলে যাও। আজ আর না।

জহির বলল, স্যার কি একটা সিগারেট খাবেন?

আলিমুর রহমান ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, দাও একটা খাই।

আমার কিন্তু সস্তা সিগারেট।

আলিমুর রহমান বললেন, আমিও সস্তা মানুষ, অসুবিধা নেই। আমার পুত্র দামী। দামী এবং মহাজ্ঞানী শিল্পবোদ্ধা। সব সময় মুখের সামনে বই।

জহির, তোমার মাছ মারার শখ আছে?

জি না।

তোমার কীসের শখ?

আমার কোনো শখ নেই।

আলিমুর রহমান বললেন, আমার বাবার শখ ছিল খাওয়ার। খেতে পলেই হলো। আর কিছু না। মা মাঝে-মধ্যে মুরগি রান্না করতেন। বাবা কী করতেন শোন। খেতে বসার সময় পুরো পাতিলটা নিয়ে বসতেন। তার খাওয়া শেষ হবার পর যদি কিছু থাকতো আমরা খেতাম। বেশির ভাগ সময় কিছু আলু আর ঝোল থাকতো। ঠিক আছে আজ যাও। এখন আমি আমার মহাজ্ঞানী পুত্রকে একটা চিঠি লিখব। তুমি ঢাকায় যাবে কীভাবে?

বাসে যাব।

ম্যানেজারকে বল গাড়ি দিয়ে যেন পৌঁছে দেয়। আবার যখন আসবে ম্যানেজারকে টেলিফোন করবে। সে গাড়ি পাঠিয়ে তোমাকে নিয়ে আসবে। পাঁচটা মিনিট কি অপেক্ষা করতে পারবে?

অবশ্যই পারব।

তাহলে পাঁচটা মিনিট অপেক্ষা কর। গাড়ির ড্রাইভার আমার মহাজ্ঞানী পুত্রের কাছে একটা চিঠিও নিয়ে যাবে। চিঠি লিখতে লাগবে এক মিনিট।

 

আলিমুর রহমান এ ফোর সাইজ একটা কাগজে বড় বড় করে লিখলেন— গাধা। খামের উপর ছেলের নাম ঠিকানা সুন্দর করে লিখলেন। তার মুখে বিজয়ীর হাসি। চিঠি পড়ার পর পুত্রের মুখের ভাব কী হয় এই ভেবেই তাঁর আনন্দ হচ্ছে।

 

শাহেদুর রহমান লাইব্রেরি-ঘরে পড়ার চেয়ারে বসে আছেন। তার এই বিশেষ পড়ার চেয়ারের ডিজাইন তিনি নিজে করেছেন। একবার তৈরি হবার পর কয়েক দফা সংস্কার করতে হয়েছে। কিছু কাজ এখনো বাকি আছে। এই চেয়ারটা অনেকটা ডেন্টিস্টদের চেয়ারের মতো। হাত দিয়ে বই ধরতে হয় না। বই রাখার আলাদা স্ট্যান্ড আছে। স্ট্যান্ডে বল বিয়ারিং লাগানো। চোখে আরাম হয় এমন অবস্থায় বইকে রাখা যায়। বসার অবস্থানও বদলানো যায়।

শাহেদুর রহমান এখন পড়ছেন পপুলার সায়েন্সের বই। বইয়ের লেখকের মতে পুরো বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড একটা হলোগ্রাফিক ছবি ছাড়া কিছুই না। মানুষ হচ্ছে হলোগ্রাফিক ইমেজের অবজারভার। ভারতীয় মুণি-ঋষিরা জগৎকে মায়া বলতেন। পদার্থবিদ্যার এই অধ্যাপকও জগৎকে মায়া বলছেন। তবে একটু অন্যভাবে।

শাহেদুর রহমানের কঠিন নির্দেশ আছে পড়াশোনার সময় তাকে কেউ বিরক্ত করতে পারবে না। Extreme Emergency-তেও না। পড়াশোনা ব্যাপারটাই Extreme Energency. এরচে বড় ইমার্জেন্সি হতে পারে না।

বিপদে পরেছে ফরিদ। একটা ঘটনা ঘটেছে। স্যারকে ঘটনা জানানো উচিত। কীভাবে জানাবে বুঝতে পারছে না। ব্যাংক থেকে দু লাখ টাকার একটা চেক ফেরত এসেছে। চেকে সীল দেয়া, পর্যাপ্ত অর্থ জমা নেই। এটা যে কত বড় দুঃসংবাদ সে জানে। স্যার কি জানেন?

ফরিদ চেয়ারের কাছে এসে কাশল। শাহেদুর রহমান বিরক্ত চোখে। তাকালেন। ভুড় কুঁচকে বললেন, কী চাও?

ফরিদ হড়বড় করে বলল, সকালে যে চেকটা নিয়ে ব্যাংকে গিয়েছিলাম সেই চেক ফেরত দিয়েছে।

শাহেদুর রহমান বললেন, সিগনেচার মিলে নাই? দুই দিন পর পর আরেক যন্ত্রণা। আরেকটা চেক লিখে আন। সাইন করে দেই।

ফরিদ ভীত গলায় বলল, ব্যাংক বলছে ফান্ড নেই।

শাহেদুর রহমান অবাক হয়ে বললেন, ফান্ড নেই মানে কী? ফান্ড গেল কোথায়? গত ছয় মাসের স্টেটমেন্ট নিয়ে এসো।

স্টেটমেন্ট এনেছি স্যার। দেখবেন?

এখন দেখব না, পরে।

টেবিলে রেখে যাব?

তোমার কাছে রাখ, আমি পরে দেখব। আর দয়া করে একটা জিনিস মনে রাখবে— আমি যখন পড়তে বসব তখন আমার ঘরেই ঢুকবে না।

স্যার ভুল হয়েছে।

শাহেদুর রহমান পড়ায় মন দিলেন। লেখক বলছেন যখন ইলেকট্রনকে অবজাৰ্ভ করা হয় তখন সে পার্টিকেল। যখন তাকে অবজার্ভ করা হয় না তখন সে তরঙ্গ। ইলেকট্রনের এই দ্বৈত সত্তা।

ম্যানেজার ফরিদ মৃন্ময়ীর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এখানেও আরেক সমস্যা দরজা যখন বন্ধ থাকবে তখন দরজায় টোকা দেয়া যাবে না। দরজা খোলা থাকলেই টোকা দেয়া যাবে। দরজা বন্ধ।

ফরিদ দরজায় টোকা দিল। মৃন্ময়ী বলল, কে?

ফরিদ বলল, আপা আমি ম্যানেজার ফরিদ। কী চান?

একটা বড় সমস্যা হয়েছে আপা! স্যার বই পড়া ধরেছেন স্যারকে বলতেও পরিছি না।

আমাকে বললে কি লাভ হবে?

ফরিদ জবাব দিল না। কী জবাব দেবে বুঝতেও পারছে না। মৃন্ময়ী বলল, আসুন। ভেতরে আসুন।

ফরিদ আরও হকচকিয়ে গেল। সত্যি কি তাকে ভেতরে যেতে বলছে? নাকি সে ভুল শুনছে। আপার ঘরে সে আগে কখনও ঢুকে নি।

আপা ভেতরে আসতে বলছেন?

হ্যাঁ।

ফরিদ অতি সাবধানে ঢুকল। মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। নিজের শোবার ঘরে মানুষের পোষাক-আষাকের ঠিক থাকে না। আপা কী অবস্থায় আছেন কে জানে।

মৃন্ময়ী বলল, বলুন আপনার সমস্যা। আগের ব্যাপার না তো? আর্টিস্টকে ক্যাশ টাকা দিতে হবে?

সে রকম কিছু না। ব্যাংকে স্যারের কোনো টাকা নেই। চেক ফেরত এসেছে।

একদিন না একদিন চেক ফেরত আসবেই, এটা তো জানতেন। জানতেন না? দাদাজান সাপ্লাই লাইন অফ করে দিয়েছেন। তিনি যে এই কাজটা করবেন তাও তো আপনার জানা থাকার কথা।

ফরিদ এখনও মাথা নিচু করেই আছে। মৃন্ময়ী বলল, আমাকে এসব বলে কী হবে? যাকে বলার তাকে বলুন।

জি আচ্ছা।

মৃন্ময়ী শান্ত গলায় বলল, আচ্ছা ফরিদ সাহেব প্রতিদিন নিয়ম করে রাত সাড়ে এগারোটার সময় আপনি কি একবার আমাকে টেলিফোন করেন?

ফরিদ চমকে মুখ তুলে তাকাল। তার দৃষ্টি ঘোলাটে। কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে। পা সামান্য কাঁপছে।

মৃন্ময়ী খাটে আধশোয়া হয়ে আছে। তার হাতে বই, আগামীকাল একটা পরীক্ষা আছে। প্রিপারেশন খুবই ভালো। আর না পড়লেও হয়। তারপরেও একবার চোখ বুলিয়ে যাওয়া। মৃন্ময়ী বইয়ের পাতা উল্টাতে-উল্টাতে বলল, রাত সাড়ে এগারোটায় আমার টেলিফোন বেজে উঠে। আমি কয়েকবার হ্যালো হ্যালো বলতেই লাইন কেটে যায়।

ফরিদ বিড়বিড় করে বলল, আপা আমার এত সাহস নাই।

তাহলে ঠিক আছে। কিছু মনে করবেন না।

আমি কিছু মনে করি নাই।

Thats good, আচ্ছা আপনি যান।

ঘর থেকে দ্রুত বের হবার সময় দরজার চৌকাঠে মাথা লেগে ফরিদের কপাল ফুলে গেল। চারতলায় উঠার সময় একবার সিঁড়িতে পায়ের সঙ্গে পা জড়িয়ে পড়ে গেল।

 

মৃন্ময়ীদের বাড়ির নিয়ম হলো রাতের খাবার সবাই এক সঙ্গে খাবে। গল্প করতে করতে খাওয়া। এমন যদি হয় একজন কেউ খাবে না। শরীর খারাপ। তাকেও উপস্থিত থাকতে হবে। খাবার টেবিলে দেয়ার পর শাহেদুর রহমান গম্ভীর ভঙ্গিতে বলবেন—Oh God! Thank you for the food.

আমেরিকায় পড়াশোনা করতে গিয়ে শাহেদুর রহমান এই জিনিস শিখে এসেছেন। তার কাছে মনে হয়েছে God-এর অসীম করুণার কথা প্রতিদিন একবার হলেও মনে করা মানসিক স্বাস্থের জন্যে দরকার।

আজকের খাবার টেবিলে শায়লা বসেন নি। তিনি নিয়ম ভঙ্গ করে তার ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছেন। চায়নিজ হার্বাল মেডিসিন শেষপর্যন্ত কাজ করে নি। শায়লার অ্যালার্জিক অ্যাটাক হয়েছে। মুখের উপর নেবুলাইজার নিয়ে তিনি আধশোয়া হয়ে আছেন। তার দেখাশোনা করছে একজন নার্স। নার্সের নাম মালতী রাণী। তাকে প্রায়ই এ-বাড়িতে আসতে হয়।

শাহেদুর রহমান প্রার্থনাপর্ব শেষ করে বললেন, কী খবর বিবি?

মৃন্ময়ী বলল, আমার খবর ভালো। তোমার খবর কী?

শাহেদুর রহমান বললেন, দারুণ একটা বই পড়ছি। Holographic Universe, ওয়ান থার্ড পড়ে ফেলেছি। বইটা এত ইন্টারেস্টিং যে ভাত খেতে আসার ইচ্ছাও হচ্ছিল না।

মৃন্ময়ী বলল, ব্যাংকে তোমার না-কি কোনো টাকা নেই?

শাহেদুর রহমান বললেন, খাওয়ার টেবিলে ব্যাংকের আলোচনাটা না করলে হয় না?

হ্যাঁ হয়।

শাহেদুর রহমান বললেন, খাওয়ার টেবিলে আলোচনা হবে হালকা। জোকস চলতে পারে। তুই একটা জোক বল তো।

মৃন্ময়ী বলল, তুমি বল আমি শুনি।

শাহেদুর রহমান খাওয়া বন্ধ করে জোকস মনে করার চেষ্টা করতে লাগলেন। মৃন্ময়ীও খাওয়া বন্ধ করে অপেক্ষা করছে।

শাহেদুর রহমান বললেন, জোকস-এর সমস্যা হলো একজন একটা বললে অন্য আরেকটা মনে পড়ে। এক ধরনের চেইন রিএকশান।

মৃন্ময়ী বলল, বাবা শোন দাদাজান কিন্তু তোমার জন্যে ভালো একটা জোকের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন।

কী রকম?

সেটা এখন বলব না। খাবার টেবিলে ভারী আলোচনায় যাব না। তবে তুমি তোমার বাবার জোকে খুবই আনন্দ পাবে!

শাহেদুর রহমানের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মজার একটা জোক মনে পড়েছে। সামান্য অশ্লীলতা আছে তবে মেয়ের সামনে বলা যায়। তিনি চেষ্টা করতে লাগলেন আরেকটা মনে করতে যেটা কোনো দ্বিধা ছাড়াই মেয়েকে শুনানো যায়।

 

মৃন্ময়ী ঘুমুতে যাবার আগে মার সঙ্গে দেখা করতে গেল। তিনি অনেকটা সামলে উঠেছেন। নার্স মালতী রাণী রাতে থেকে যাচ্ছে, যদি রাতে সমস্যা হয়।

শায়লা বললেন, বিন্তি মেয়েটা কেমন কাজ করছে?

মৃন্ময়ী বলল, ভালো। মেয়েটা বুদ্ধিমতী।

শায়লা বললেন, মেয়েটাকে বিদায় করে দে।

মৃন্ময়ী বলল, আচ্ছা।

শায়লা বললেন, কালই বিদায় কর।

মৃন্ময়ী বলল, কারণটা বল।

শায়লা বললেন, কারণ তুই ভালো করেই জানিস।

আমি জানি না।

শায়লা বিছানায় উঠে বসলেন। তাঁর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রাগ সামলানোর চেষ্টা বুঝা যাচ্ছে। শায়লা চাপা গলায় বললেন, কারণ তুই জানিস না।

না।

তুই নিজে তোর দাদাজানের সঙ্গে বসে শলাপরামর্শ করে এই মেয়েকে বাড়িঘর লিখে দিতে বলিস নি। আমি ম্যানেজার কালামের থেকে খবর পেয়েছি।

মৃন্ময়ী স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ও এই কথা!

শায়লা বললেন, তোর কাছে এটা খুবই স্বাভাবিক কথা!

দাদাজান তার নিজের টাকা নিজের জায়গা-জমি কাকে কী দেবেন সেটা তাঁর ব্যাপার।

শায়লা বললেন, একটা কাজের মেয়ে তার জন্যে বারিধারায় চারতলা বাড়ি?

মৃন্ময়ী বলল, জিনিসটা অন্যভাবে দেখ। মনে কর এই মেয়েটা হঠাৎ একটা লটারির টিকেট পেয়ে গেছে। অনেকেই তো লটারির টিকেট পায়। পায় না?

তোর দাদাজান একটা আধাপাগল মানুষ। তোর দায়িত্ব বুঝিয়ে-সুজিয়ে পাগলামী সহনীয় পর্যায়ে রাখা। তুই করছিস উল্টোটা। তোর লাভটা কী হচ্ছে?

মৃন্ময়ী বলল, আমার Fun হচ্ছে। আমার জীবনটা খুবই শুকনা ধরনের। এ রকম Fun আমার জন্যে দরকার।

ফুটপাথে ফুটপাথে যখন ঘুরবি তখন ফান থাকবে?

অবশ্যই থাকবে তখনকার ফান অন্য ধরনের হবে। সারাদিন খাওয়া নেই হঠাৎ একবেলা খাওয়া জুটল। মা তুমি কি জান হোটেল সোনারগাঁওয়ের সিস্টেম হচ্ছে গেস্টদের উচ্ছিষ্ট খাবার তারা ফেলে দেয় না। সব জড় করে ভিখিরিদের দিয়ে দেয়। ভিখিরিরা খুব আনন্দ নিয়ে সেই সব খাবার খায়। আমি প্ল্যান করে রেখেছি একদিন ঐ খাবারও খাব।

শায়লা বললেন, ঘর থেকে বের হ!

মৃন্ময়ী বলল, আরও কিছুক্ষণ গল্প করি। আজ আমি গল্প করার মুডে আছি। বাবার কাছ থেকে খুবই ফানি একটা জোক শুনে এসেছি। তুমি শুনবে? হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা হয়ে যাবে।

শায়লা হাত দিয়ে ইশারা করলেন যেন মৃন্ময়ী চলে যায়।

মৃন্ময়ী নিজের ঘরে চলে এল। রাত বাজছে এগারোটা। তার ঘুম পাচ্ছে। তবে সে এখন ঘুমাবে না। সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। আজও টেলিফোনটা আসে কি-না দেখা দরকার, তার ধারণা আজ আর আসবে না। কোনো রাতেই আর আসবে না।

বিন্তি চা নিয়ে এসেছে। হালকা লেবু চা। ঘুমুতে যাবার আগে মৃন্ময়ীর চা খাবার অভ্যাস আছে। এখন এক কাপ খাবে। বারোটার সময় বাতি নিভিয়ে এক কাপ খাবে।

বিন্তি বলল, ম্যানেজার সাহেবের কী জানি হইছে।

মৃন্ময়ী বলল, কী হয়েছে?

খুব কানতাছে।

কান্না তো ভালো। বেশি কাঁদলে চোখ সুন্দর হয় এটা জান?

জি না আপা।

বাংলাদেশের মেয়েদের চোখ এত সুন্দর কেন? তারা বেশি কাঁদে এই জন্যেই সুন্দর। আমাকে টেলিফোনটা দাও।

মৃন্ময়ী ছন্দাকে টেলিফোন করল। টেলিফোন ধরলেন ছন্দার বাবা ইয়াকুব। গম্ভীর গলায় বললেন, হ্যালো।

মৃন্ময়ী বলল, চাচা স্লামালিকুম। আমি মৃন্ময়ী।

ইয়াকুব বললেন, গলা শুনেই বুঝতে পেরেছি। মা কেমন আছ?

ভালো আছি।

ছন্দার সঙ্গে কথা বলবে তো। ও ঘুমায়ে পড়েছে। ডেকে তুলে দেই?

ডেকে তুলতে হবে না। এত সকাল-সকাল ঘুমিয়ে পড়ল কেন চাচা? কাল পরীক্ষা।

আর পরীক্ষা। সকাল থেকেই কান্নাকাটি। চোখে পানি নাকে পানি।

কেন?

আমাকে ভেঙ্গে কিছু বলছে না। আমার মেয়েরা এবং আমার স্ত্রী— এরা কেউ কখনও আমাকে ভেঙ্গে কিছু বলে না। কিছুটা বলে বাকিটা অনুমান করে। নিতে হয়।

অনুমান করে কী পেলেন? ছন্দার এত কান্নাকাটি কীসের?

ছেলে পছন্দ হয় নাই। এরচে ভালো ছেলে আমি পাব কোথায়? আমার কি ভালো ছেলের কারখানার সঙ্গে যোগাযোগ আছে? যে অর্ডার দিব, সেই অর্ডার মতো পাত্র ডেলিভারী হবে।

মৃন্ময়ী বলল, সেটা তো সম্ভব না।

ইয়াকুব বললেন, এখন মা তুমি বিবেচনা কর, ছেলের একটাই দোষ আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। স্ত্রী গত হয়েছে। সেই পক্ষের একটা মেয়ে আছে। এই মেয়েকে তো ছন্দার পালাতে হবে না। মেয়ে থাকে তার নানীর বাড়িতে।

মৃন্ময়ী বলল, পালতে হলে পালবে। সংসারে সৎ ছেলে-মেয়ে থাকতেই পারে, সব কিছু মানিয়ে নিয়েই সংসার।

ইয়াকুব বললেন, তুমি এখন যে কথাটা বললে এমন কথা কেউ বলে না। এটা হলো জ্ঞানের কথা। মাগো তোমাকে যে আমি মা ডাকছি, অন্তর থেকে ডাকছি এটা বুঝতে পারছ?

পারছি।

এই যে তোমার সঙ্গে কথা বলছি খুবই ভালো লাগছে। মা তুমি শুনলে অবাক হবে কেউ আমার সঙ্গে কথাও বলে না। অফিস থেকে এসে ইজিচেয়ারে বসে থাকি। যে যার মতো ঘুরে বেড়ায়। আমার সঙ্গে দুটা কথা বলার সময় কারোর নাই।

ইয়াকুবের গলা ধরে এসেছে। তার চোখে সত্যি সত্যি পানি। তিনি শার্টের হাতায় চোখ মুছলেন। মৃন্ময়ী বলল, চাচা আমি কি আপনাকে একটা অনুরোধ করতে পারি?

ইয়াকুব বললেন, অবশ্যই পার। তোমাকে আমি মেয়ের মতো বিবেচনা করেই মা ডাকি। মেয়ে বাবাকে অনুরোধ করবে না, করবে আদেশ। বল মা তোমার আদেশ কী?

মৃন্ময়ী বলল, ছন্দার এই বিয়েটা ভেঙ্গে দিন। তার পছন্দ হয় এমন একটা ছেলের সঙ্গে আমি বিয়ের ব্যবস্থা করব। পরীক্ষার মাঝখানে বিয়ের যন্ত্রণায় ও পরীক্ষায় খারাপ করবে। ছন্দার ভালো রেজাল্ট করা দরকার।

ইয়াকুব বললেন, মা তুমি যখন দায়িত্ব নিয়েছ তখন আমার কোনো কথা নাই।

 

বিন্তি রাতের শেষ চা নিয়ে এসেছে। মৃন্ময়ী বলল, চা খাব না।

বিন্তি বলল, আপনার চুলে তেল দিয়ে দিব আপা?

মৃন্ময়ী বলল, না। আমি চুলে তেল দেই না।

একদিন দিয়া দেখেন খুব আরাম পাইবেন।

খুব আরামের কি দরকার আছে?

অবশ্যই আছে। আরামের জন্যই তো দুনিয়া।

মৃন্ময়ী বলল, যাও তেল নিয়ে আসো। দেখি কী রকম আরাম!

ঘরের বাতি কমিয়ে দেয়া হয়েছে। একটা টেবিল ল্যাম্প ছাড়া সব বাতি নেভানো। মৃন্ময়ী বিছানায় শুয়ে আছে। বিন্তি চুলে তেল দিয়ে চুল টেনে দিচ্ছে।

বিন্তি বলল, আপা একটা গফ শুনবেন?

মৃন্ময়ী বলল, গফ না গল্প। যদি ভাষা শুদ্ধ করে বলতে পার তা হলে শুনব।

বিন্তি বলল, আমার গ্রামে আপনের মতো সুন্দরী একটা মেয়ে ছিল। বারো–তেরো বছর বয়স হইতেই এই মেয়ের জন্য ভালো ভালো সম্বন্ধ আসা শুরু হইল। এর মধ্যে একজনের সঙ্গে বিবাহ ঠিক হয়ে গেল। তখন মেয়েটারে ধরল জিনে।

জিনে ধরল মানে কী?

সুন্দরী মেয়েদের জীনে ধরে। তারার শরীরে জীনের ভর হয়।

আমিও তো সুন্দর। আমার সঙ্গে জীন আছে?

বিন্তি বলল, অবশ্যই আছে। আপনে যে উল্টা-পাল্টা কাজ-কাম করেন জিনের কারণে করেন।

উল্টা-পাল্টা কাজ কী করলাম?

আপনের নাক ফুল দিয়া কী করলেন আপনার মনে নাই?

মৃন্ময়ীর টেলিফোন বেজে উঠেছে। সে ঘড়ি দেখল। সাড়ে এগারোটা বাজে। মৃন্ময়ী টেলিফোন কানে নিয়ে দুবার হ্যালো বলতেই ও পাশ থেকে লাইন কেটে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *