আরণ্যিক নির্বোধের ভ্রান্ত দুঃস্বপন
বহুদেবতারা আজ পরাজিত, জয়ী আজ সর্বশক্তিধর একদেবতা; এখন চলছে একদেবতার কাল। এমনকি যারা পুজো করে বহুদেবতার, তারাও মনে করে বা যখন স্রষ্টা কে নিয়ে তর্ক দেখা দেয়, তারাও নিদ্বিধায় বলে স্রষ্টা বা বিধাতা একজনই। বহুদেবতায় বিশ্বাস করা আজকাল গৌরবজনক নয়; এটা অত্যন্ত অনাধুনিক ব্যাপার, আধুনিক হচ্ছে একদেবতায় বিশ্বাস। আমি বলেছি। একদেবতা, . এটা কোনো কোনো ধর্মের বিশ্বাসীদের কাছে মনে হ’তে পারে আপত্তিকর, কারণ তারা বিশ্বাস করে তারা দেবতায় বিশ্বাস করে না, বিশ্বাস করে বিধাতায়, স্রষ্টায়, একেশ্বরে, পরমসত্তায়, বা অন্য কোনো নামের স্রষ্টায়। তাদের প্রত্যেক ধর্মের স্রষ্টার রয়েছে বিশেষ নাম ধর্মের প্রবর্তকের ভাষায়। তবে বিধাতা বা ঈশ্বর, বা যে-নামই হোক তাদের স্রষ্টার, তিনি দেবতাই। এসব বিশ্বাসে বহুদেবতা পরাজিত হয়ে জয়ী হয়েছেন। একজন দেবতা। দেবতারা কি করেছেন কোনো মহাজাগতিক মহাযুদ্ধ, আর ওই মহাযুদ্ধে কি জয়ী হয়েছেন একজন দেবতা, যার শক্তির কোনো সীমা নেই? তিনি কি জয়ী হয়ে মহাজগত জুড়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন তার রাজত্ব, এবং মহাজগত জুড়ে প্রচার করেছেন তার বিজয়ীসংবাদ? তিনি কি সবাইকে বাধ্য করেছেন তাঁর প্রতি আনুগত হ’তে? না, এতে তাঁর কোনো ভূমিকা নেই, এতে সব ভূমিকা মানুষের; মানুষই অজস্র দেবতাদের বর্জন ক’রে সাম্রাজ্য স্থাপন করেছে। বিশেষ একটি দেবতার। ঘটনাটি অবশ্য আধুনিক নয়, ঘটনাটি অত্যন্ত অনাধুনিক, ঘটেছিলো তিন হাজার বছর আগে। অগ্নি-উপাসক জুরথুস্ত্রীয়রাই প্রথম কল্পনা করেছিলো একদেবতা, একদেবতা কল্পনা করেছিলো ব্যাবিলনীয়রাও, এমনও হতে পারে তারা একদেবতা ধার করেছিলো অগ্নিপূজারী পারস্য থেকেই; আর প্যালেস্টাইনের ইহুদিরা প্রথম আবিষ্কার করে এক প্রচণ্ড হিংস্র প্রতিহিংসাপরায়ণ একদেবতা। হিব্রুদের একদেবতা সম্পূর্ণ মৌলিক নয়, তারা পারস্য আর ব্যাবিলন থেকে একে ধার করে, এবং ক’রে তোলে প্রচণ্ড। আরো দুটি ধর্ম গ্রহণ করে একদেবতা; তারা প্রবর্তকের ভাষায় তার নাম দেয়।
তারা আর তাকে দেবতা বলে না, দেবতাদের তারা প্ৰচণ্ড বিরোধী। তবে তার নাম অভিন্ন নয়, বিভিন্ন। তাঁকে আর দেবতা বলা হয় না, বলা হয়। স্রষ্টা বা বিধাতা। কিন্তু যে-ধর্মগুলো বিশ্বাস করে একদেবতা বা একবিধাতায়, তারা কি নির্দিষ্ট অভিন্ন একটি বিধাতায়ই বিশ্বাস করে? না; তাদের বিশ্বাস অভিন্ন নয়, বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাস করে বিভিন্ন বিধাতায়; ইহুদি বা খ্রিস্টান বা মুসলমানের বা হিন্দুর বা অন্য কোনো ধর্মের বিধাতা অভিন্ন সত্তা নন; তাদের প্রত্যেকের বিধাতার সত্তা ও গুণাবলি বিভিন্ন। ইহুদি যে-বিধাতার আরাধনা করে সিনেগাগে, মুসলমান তার উপাসনা করে না; খ্রিস্টান যার উপাসনা করে, হিন্দু তাঁর পুজো করে না। তাদের প্রত্যেকের বিধাতা ভিন্ন। তাই দেখতে পাই পৃথিবীর ধর্মগুলো একটি-একটি ক’রে বিশ্বাস করছে বেশ কয়েকটি বিধাতায়; আর ওই বিধাতারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। বহুদেবতাবাদ চ’লে গেলেও আজো পৃথিবীকে শাসন করছেন। কয়েকটি বিধাতা, যাদের মধ্যে মিল থাকলেও বিশ্বাসীরা ওই মিলগুলো মানতে অস্বীকার করে। বিশ্বাসীরা কিছুতেই মানবে না যে তাদের বিধাতার ধারণাটি এসেছে অন্য একটি ধর্মের বিধাতার ধারণা থেকে; বরং তারা মনে করে তাদের বিধাতাই একমাত্র বিধাতা, অন্য বিধাতারা মিথ্যে। কিন্তু বিশ্বাসের যে-পরিস্থিতি তাতে দেখা যায় পৃথিবীর মানুষেরা বিশ্বাস করে বেশ কয়েকটি বিধাতায়।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যাদের বলেছেন আরণ্যিক নির্বোধ, তারা অজস্র দেবতা উদ্ভাবনা করেছিলো; এবং যুগে যুগে নিজেদের রুচি আর স্বাৰ্থ অনুসারে স্বৰ্গচ্যুত করেছিলো অজস্র দেবতাকে। কোনো দেবতাই অবিনশ্বর নয়; দেবতারা জন্ম নিয়েছে। আর রাজত্ব করেছে তাদের ভক্ত বা উদ্ভাবকদের পরিকল্পনা অনুসারে। মানুষের দেবতা চিন্তায় দুটি প্রবণতা চোখে পড়ে। একটি হচ্ছে : প্রথম তারা কল্পনা করেছিলো দেবী; বোঝা যায় তখন সমাজে প্রধান ছিলো নারীরা; তাই তারা উদ্ভাবন করেছিলো নিজেদেরই লিঙ্গের দেবতা, অর্থাৎ দেবী। পরে যখন প্রধান হয়ে ওঠে। পুরুষ, বন্দী ক’রে ফেলে নারীদের, তখন দেবীদের হটিয়ে তারা উদ্ভাবন করে পুরুষ দেবতা। সমাজে পুরুষতন্ত্রের উত্থানের সাথে আকাশেও উত্থান ঘটে পুরুষতন্ত্রের। দেবতা।চিন্তায় দ্বিতীয় প্রবণতাটি হচ্ছে বহুদেবতার বদলে একদেবতা উদ্ভাবন। একদেবতা বা বিধাতা কি উৎকৃষ্ট বহুদেবতার থেকে? এদের কোনোটি উৎকৃষ্ট নয় অন্যটির থেকে; দুটিই সমান আদিম অপকল্পনার ফল। তবে বহুদেবতা বাদ দিয়ে একদেবতা বা বিধাতা কল্পনা নির্দেশ করে মানুষের প্রকৃতির একটি ভয়ঙ্কর প্রবণতা; মানুষ এতে বহুবচনতা থেকে এগোয় একবচনতার দিকে, তার চিন্তা হয়ে ওঠে। স্বৈরাচারপরায়ণ। একদেবতাবাদ বা বিধাতাবাদ নিয়ন্ত্রণাপরায়ণ, তা মানুষকে দিতে চায় না কোনো স্বাধীনতা; ব্যক্তির জীবনের প্রতিটি তুচ্ছ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে। ব্যক্তির সঙ্গমও স্বাধীন থাকে না, প্রার্থনায়ও স্বাধীনতা থাকে না। বহুদেবতা এতোটা নিয়ন্ত্রণ করে না। ইহুদিরাই প্রথম কল্পনা করেছিলো প্ৰচণ্ড স্বৈরাচারী প্রতিহিংসাপরায়ণ একদেবতা, আর তাদের প্রভাব রয়েছে যে-সব বিধাতাকল্পনায়, তাতে দয়াময়তা নয়, নির্মমতাই বিধাতার প্রধান গুণ। মানুষ কেনো বেশ গণতান্ত্রিক বহুদেবতা ছেড়ে গ্রহণ করলো স্বৈরতান্ত্রিক একদেবতাবাদ বা বিধাতাবাদ? বহুদেবতাবাদ কল্পিত হয়েছিলো মুক্ত সমাজে, যেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রধান আনন্দ হয়ে ওঠে নি। সমাজপতিদের, যেখানে মানুষ যাপন করতো তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীন জীবন; আর একদেবতাবাদ বা বিধাতাবাদ কল্পিত হয় স্বৈরাচারপরায়ণ পুরুষপ্রধান পিতৃতান্ত্রিক সমাজে, যেখানে কোনো কিছুই পিতা বা পুরুষের কঠোর মুঠোর বাইরে নয়, তাই কোনো কিছুই বিধাতার নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। পিতৃতন্ত্রের সবচেয়ে শক্তিমান স্বৈরাচারী পিতা বিধাতা।
বিধাতা কেনো হবেন প্রচণ্ড, হিংস্র, ক্রুদ্ধ, প্রতিহিংসাপরায়ণ; কেনো তিনি উত্তেজিত থাকবেন তাঁর সৃষ্টিতে শাস্তি দেয়ার জন্যে? তিনি কেনো উদ্ভাবন করবেন নরকের পর স্তরে স্তরে নরক, এবং তাতে দগ্ধ করবেন তাঁর সৃষ্টিকে? তিনি কেনো হবেন। এতো পীড়নকামী? শান্তি দেয়াই কি তার চরম সুখ? মনোবিজ্ঞান কীভাবে করবে তার মনোবিশ্লেষণ? তাকে কি বিবেচনা করা হবে সুস্থ স্বাভাবিক? মানুষের নির্মমতার কয়েকটি উদাহরণ হচ্ছে কালিগুলা, হিটলার, স্তালিন, ইয়াহিয়া; তিনি কি তাদেরই চূড়ান্ত মহাজাগতিক আদিরূপ? আমরা কি সুখ পাই প্রিয়দের শাস্তি দিয়ে? আমরা কি সারাক্ষণ ব্যগ্র পুত্রকন্যাদের, প্রিয় বেড়াল বা কুকুরটিকে, শাস্তি দেয়ার জন্যে? সারাক্ষণ হিশেবে নিই। তাদের ক্রিয়াকলাপের? আজ থেকে তিন দশক আগের পিতারা সন্তানদের যতোটা শাস্তি দিতো, এখনকার পিতারা তাতোটা দেয় না; দিলে প্রতিবেশীরা তা মেনে নেয় না। বিধাতাকে যারা হিংস্র প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ প্রতিহিংসাপরায়ণ সত্তারূপে কল্পনা করেছে তাদের মানসিক জগত ভরে রাজত্ব করছিলো কোন দুঃস্বপ্ন? হিংস্রতা প্ৰচণ্ডতা প্রতিহিংসাপরায়ণতাই কি দরকার ছিলো তাদের? ইহুদিরা হিংস্ৰ বিধাতার দরকার বোধ করেছিলো প্ৰথম। তাদের দরকার ছিলো চোখের বদলে চোখ, দাতের বদলে দাত; তাদের বিধাতা মিটিয়েছে তাদের অভিলাষ। আদি বাইবেল-এ বলা হয়েছে যে পরাজিত জাতিদের নির্মূল করতে হবে, মেষ আর গাভীও রক্ষা পাবে না। বিধাতাকে হিংস্ররূপে কল্পনা করেছে যে-সমাজ বা যে-প্রবর্তক, তার কাছে হিংস্রতাই মানুষকে দমন করার উপায় ব’লে মনে হয়েছে। আমরা ওই সমাজ ও প্রবর্তকদের মনোবিশ্লেষণ করতে পারি। রাসেল অপ্রিয় প্ৰবন্ধাবলিতে বলেছেন :
বিষাদগ্ৰস্ত যে-সন্তরা নিজেদের বিরত রাখতেন ইন্দ্ৰিয়ের সমস্ত সুখ থেকে, বাস করতেন। মরুভূমির জনহীনতায়, বর্জন করতেন মাংস ও মদ্য ও নারীসাহচর্য, তারা অবশ্য সব ধরনের সুখ থেকে নিজেদের বিরত রাখতেন না। মনের সুখকে বিবেচনা করা হতো দেহের সুখের থেকে অনেক উৎকৃষ্ট, আর মনের সুখের মধ্যে উচ্চস্থানে ছিলো চিরশাস্তি সম্পর্কে নিরন্তর চিন্তাভাবনা, যা দেয়া হবে সৰ্বেশ্বরবাদী ও নাস্তিকদের।
রাসেল বলতে চান যে প্রচণ্ড বিধাতা বিকৃত মনোব্যাধিগ্রস্ত কামঙ্গুধার্ত সন্তদের কল্পনা। ইন্দ্ৰিয়সুখ থেকে বঞ্চিত মানুষ সুস্থ হ’তে পারে না; তাই ‘বিধাতার মুক্তোখচিত’ সন্তরা নিজেদের অপরিতৃপ্ত কামের ক্ষতিপূরণের জন্যে কল্পনা ক’রে চলতেন প্রচণ্ড নরক। তাদের অতৃপ্ত কাম জ্বলে উঠেছে প্রচণ্ড নরকরূপে।
বিধাতাকল্পনায় হিংস্রতার পর বড়ো ক’রে তোলা হয়েছে তাঁর স্তুতিপ্রিয়তা। সব ধর্মেই বিধাতার প্রিয় স্তাবকতা, স্তুতি; তিনি পছন্দ করেন নিরর্থক বন্দনা: প্রহরে প্রহরে তার বন্দনা করতে হয়, নইলে তিনি সুখী হন না। তাকে স্তুতি করার জন্যে রচিত হয়েছে মানবভাষার বিপুল বাক্যসম্ভার। ওই স্তাবকতা বা বন্দনার শ্লোকগুলো খুব উৎকৃষ্ট নয়; নারীর উদ্দেশে এগুলোর থেকে অনেক বেশি উৎকৃষ্ট শ্লোক লিখেছে পুরুষ। আদি বাইবেল-এই দেখতে পাই অজস্র ঈশ্বরস্তুতির থেকে অনেক উৎকৃষ্ট ও অবিস্মরণীয় শলোমনের পরমগীতি, যাতে বন্দনা করা হয়েছে দায়িতাকে। মহাজগতের মতো অনন্ত অসীমের স্রষ্টা যিনি, তিনি কী ক’রে উপভোগ করতে পারেন তুচ্ছ মানুষের তুচ্ছ স্তাবকতা, তুচ্ছ স্তুতি: কী ক’রে তিনি সুখী হ’তে পারেন। এই সব তুচ্ছ কানাকড়িতে? সামারসেট মম সামিং আপ বইটিতে তার এক পুরোহিত বন্ধুর কথা বলেছেন, যিনি তার ভাষণ থেকে বাদ দিয়েছিলেন বিধাতার সমস্ত স্তুতি। মম বিস্মিত হয়ে জানতে চান কেনো বিধাতাকে একবারও প্রশংসা করা হলো না? পুরোহিত বন্ধু বলেন মহান বিধাতা তুচ্ছ ভূস্বামীর মতো স্তাবকতা পছন্দ করতে পারেন না ব’লেই তার বিশ্বাস, তাই তিনি কখনো বিধাতার স্তুতি করেন না। তবে বিভিন্ন ধর্মে বিধাতাকে পরিণত করা হয়েছে এক ক্রুদ্ধ হিংস্র। স্তাবকতাপ্রিয় ভূস্বামীতে। আমরা কি এমন মানুষ কল্পনা করতে পারি, যে পছন্দ করে দিনরাত বন্দনা বা স্তুতি বা স্তাব কত? নিরন্তর নিরর্থক স্তাবকতায় যেখানে অন্তঃসারশূন্য মানুষও ক্লান্তি ও ঘেন্না বোধ করবে, সেখানে কী ক’রে তা সহ্য ও উপভোগ করেন বিধাতা? বিশ্বাসীরা বিধাতার ওপর মহত্ত্ব আরোপ করতে গিয়ে, তাকে বিশাল ক’রে সৃষ্টি করতে গিয়ে তাকে ক’রে তুলেছে নিজেদের মতোই ক্ষুদ্ৰ ও মহত্ত্বহীন। বিধাতা যদি সত্যিই বন্দনা চাইতেন, তাহলে তিনি শূন্য রাখতেন না। মহাজগতকে; শুধু একটি ছোটো গ্রহে মানুষ সৃষ্টি করতেন না; মহাজগত ভ’রেই সৃষ্টি করতেন মানুষ, শুনতেন তাদের উচ্চকণ্ঠ বন্দনা। মানুষের বন্দনায় তাঁর কী দরকার? তিনি নক্ষত্রদের দিয়ে বন্দনা করাতে পারতেন, বন্দনা করাতে পারতেন। নক্ষত্রপুঞ্জ দিয়ে। মহাজগতে সূর্য এক তুচ্ছ তারা, পৃথিবী এক তুচ্ছ গ্রহ, মানুষ এক তুচ্ছ প্রাণী। মহাজগতের স্রষ্টা এতো তুচ্ছকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর স্তুতির জন্যে? এটা যুক্তিসঙ্গত নয়। বিধাতাকল্পনা করতে গিয়ে মানুষ বিধাতাকে নিজের মতোই তুচ্ছ আর ক্ষুদ্ৰ ক’রে তুলেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তিনি কি আদৌ আছেন, বা তারা কি সত্যিই আছেন? থাকলে কার কল্পনারটি আছেন? ইহুদির? খ্রিস্টানের? মুসলমানের? হিন্দুর? না কি আছেন সকলেরই কল্পনার বিধাতা? না কি তিনি সুধীন্দ্রনাথের আরণ্যিক নির্বোধের ভ্রান্ত দুঃস্বপন? তিনি আছেন কি নেই, এটা ইহুদি বা মুসলমান তাত্ত্বিকদের বিবেচনার কোনো বিষয় হয় নি, তারা ধ’রে নিয়েছেন তিনি আছেন। তাকে প্রমাণ করার কোনো দরকার নেই। তাদের প্রশ্নহীনতা একদিকে ভালোই, কেননা বিধাতাকে প্রমাণ করতে যাওয়া পণ্ডশ্ৰম। বই বলেছে তিনি আছেন, তাই তিনি আছেন। তারা বিধাতার উক্তি দিয়েই প্রমাণ করেন যে তিনি আছেন। তবে খ্রিস্টান কোনো কোনো সন্ত প্রমাণ করতে চেয়েছেন বিধাতা আছেন। কিন্তু বিধাতা কি প্রমাণের বস্তু, তিনি কি দর্শনের বিষয়? পদার্থবিজ্ঞান বা জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাহায্যে কি প্রমাণ করতে হবে বিধাতাকে, বা আবিষ্কার করতে হবে তাকে? খ্রিস্টীয় কোনো কোনো সন্ত প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন খ্রিস্টীয় বিধাতাকে; যেমন সন্ত আনসেলম (১০৩৩-১১০৯), টমাস আকুইনাস (১২২৫-১২৭৪); সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছিলেন কেউ কেউ, যেমন, ডেভিড হিউম (১৭১১-১৭৭৬); এবং বিধাতাকে বাতিল ক’রে দিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর সংবাদ জানিয়েছিলেন নিটুশে (১৮৪৪-১৯০০)।
আনসেলম বিশ্বাসী ছিলেন, এবং ছিলেন ক্যান্টারবেরির মহাপুরোহিত; এবং তিনি অসম্ভবকে সম্ভব ক’রে তুলতে চেয়েছিলেন মাত্র একটি যুক্তি দিয়ে। বিধাতার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্যে তিনি বের করতে চেষ্টা করেছিলেন মাত্র একটি যুক্তি, যেটি নিজেই প্রমাণ করবে নিজেকে, যেটিকে প্রমাণের জন্যে দরকার হবে না। আর কোনো যুক্তি; আর ওই যুক্তিটিই প্রমাণ করবে। যে বিধাতা সত্যিই আছেন। খুবই অসাধারণ তাঁর অভিলাষ। দু-দুটি বাইবেল ও আরো অজস্র গীতা আর সংহিতা যা প্রমাণ করতে পারছে না, আনসেলম এক স্বপ্রমাণিত যুক্তির সাহায্যেই প্রমাণ করবেন তাকে। তার যুক্তিকে বলা হয় অস্তিত্বস্বরূপযুক্তি; কেননা এতে কোনো বাইরের প্রমাণ দরকার হয় না, এ-যুক্তি শুরু ও সমাপ্ত হয় বিধাতার স্বরূপ দিয়ে। তবে তাঁর যুক্তি বিশ্বাসীর বাজে যুক্তি। আনসেলমের যুক্তি হচ্ছে বিধাতার প্রকৃতি বা স্বরূপ ভালোভাবে বিচার করলে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বিধাতা অবশ্যই আছেন। তিনি বিধাতার সংজ্ঞা দেন : বিধাতা এমন সত্তা, যার থেকে মহত্তর আর কিছু উপলব্ধি করা যায় না। বিধাতাকে দেখা যায় না, আমরা চাইলেই তাকে দেখতে পাই না; কারণ তিনি জাগতিক সব কিছু থেকে ভিন্ন। কিন্তু তিনি কেমন? আমরা যারা সাধারণ, তারা তার প্রমাণ পেতে চাই; কিন্তু আনসেলমের মতো অসাধারণের প্রমাণ চান না, চিন্তাভাবনাই যথেষ্ট তাদের জন্যে; এবং আনসেলম বিধাতার স্বরূপ সম্পর্কে ভাবনা চিন্তা ক’রেই সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে অবশ্যই বিধাতা আছেন। শুধু ভাবনা ক’রেই কি আমরা কোনো কিছুর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারি? আমরা তো অনেক কিছুই ভাবি, কল্পনা করি, যা ছিলো না, নেই, এবং থাকবে না। আমাদের ভাবনার ফলে কি সে-সব জিনিশ সত্য হয়ে ওঠে? ভাবনায় অস্তিত্বশীল বিধাতা বলতে কী বোঝায়? আমরা বুঝি যে তিনি কারো কারো ভাবনায় আছেন, তাদের মনে তিনি অস্তিত্বশীল; কিন্তু বাস্তবে বা মহাজগতে তিনি কোথাও নেই। এর উত্তরে কী বলেন আনসেলম? তিনি যা বলেন, তা খুবই হাস্যকর বাজেকথা। বিধাতা সত্যিই আছেন, এটা প্রমাণ করেন। তিনি এ-যুক্তি দিয়ে যে বিধাতা নেই একথা আমরা কল্পনাও করতে পারি না, তাই বিধাতা আছেন। রাসেলের একটি প্রবন্ধ রয়েছে ‘অ্যান আউটলাইন অফ ইন্টেলেকচুয়াল রাবিশ’-‘বুদ্ধিবৃত্তিক আবর্জনার রূপরেখা’ নামে; আনসেলমের যুক্তিকেও বলতে পারি বুদ্ধিজাত আবর্জনা। আনসেলম বলেন, বিধাতা এমন সত্তা, যার থেকে মহত্তর আর কিছু উপলব্ধি করা যায় না, তাই বিধাতা শুধু উপলব্ধিতেই থাকতে পারেন না; তাই তিনি আছেন বাস্তবেও। তার মতে বিধাতা ছাড়া আর সব কিছুকেই আমরা নেই ব’লে বোব করতে পারি, কিন্তু বিধাতার সংজ্ঞা-বিধাতা এমন সত্তা, যার থেকে মহত্তর আর কিছু উপলব্ধি করা যায় না-অৰ্থপূর্ণ হয় না। যদি বিধাতা না থাকেন। তাই তার মতে যারা বিধাতার স্বরূপ উপলব্ধি করে তাদের পক্ষে বিধাতা নেই এটা উপলব্ধি করা অসম্ভব। খুবই বাজে যুক্তি, বিশ্বাসীরা সাধারণত দিয়ে থাকেন। এ-ধরনের যুক্তিই।
আনসেলমের যুক্তির ভেতরে একটা মজা আছে—মজাটি হচ্ছে যে আমি দাবি করতে পারি যে বিধাতার স্বরূপ আমি বুঝি না; তবে আমি যদি দাবি করি যে বিধাতা কী জিনিশ তা আমি বুঝি, তখন আর আমি তার অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারি না। তার বিধাতার সংজ্ঞা হচ্ছে বিধাতা এমন সত্তা, যার থেকে মহত্তর আর কিছু উপলব্ধি করা যায় না; আর আমি যদি এ-সংজ্ঞাটি বুঝি তাহলে বিধাতা নেই এটা আর আমি উপলব্ধি করতে পারি না। বিধাতা কি বিরাজ করতে পারেন। বিশেষ স্থানে ও কালে? না, তিনি পারেন না; অর্থাৎ স্থান ও কালের পক্ষে বিধাতাকে ধারণ করা সম্ভব নয়, কেননা তিনি এসবের থেকে মহত্তর। আনসেলমের বিধাতার অস্তিত্বাচক যুক্তি যতোটা যুক্তি তার চেয়ে অনেক বেশি ধাঁধা; তাই তার প্রমাণ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছিলো শুরুতেই। তিনি যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন বিধাতার অস্তিত্ব। শুধু যুক্তি দিয়েই যদি আমরা কোনো কিছুর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারি, তাহলে আমরা এমন অনেক কিছু আছে ব’লে প্রমাণ করতে পারি, যা আসলে নেই। কোনো কিছু কল্পনা করা আর তার অস্তিত্বের মধ্যে রয়েছে মৌল পার্থক্য। মানুষ অস্তিত্বহীন অনেক কিছুই কল্পনা করতে পারে, কিন্তু তাতে তা অস্তিত্ত্বশীল হয়ে ওঠে না। আমি কল্পনা করতে পারি যে আমাদের পরিচারিকাটির চারটি লাল ডানা আছে, রবীন্দ্রনাথ কল্পনা করেছেন যে, ওই মহামানব আসে, কিন্তু তাতে চার ডানার পরিচারিকা ও মহামানব অস্তিত্বশীল হয়ে ওঠে না। সত্য বস্তু আর তার ভাবনা এক নয়।
টমাস আকুইনাস, উপাধিপ্রাপ্ত সন্ত, ছিলেন রোমীয় ক্যাথলিক গির্জার দর্শনগুরু ও ধর্মতাত্ত্বিক: তিনি আরিস্ততলের দর্শনের সাথে মিলিয়েছিলেন খ্রিস্টধর্মকে। ধর্মতাত্ত্বিকদের দায়িত্ব তাদের ধর্মের বিশ্বাসগুলো প্রতিষ্ঠিত করা, এবং প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অজস্র অপযুক্তি উদ্ভাবন। আকুইনাস তাই করেছিলেন দার্শনিকের বেশে। তার দায়িত্ব ছিলো বিধাতার অস্তিত্ব প্রমাণ, তাই নানা যুক্তি তিনি বের করেছিলেন। কিন্তু ধর্মতত্ত্ব কি দর্শন? এটা ভাবিয়েছিলো আকুইনাসকে। তিনি স্বীকার ক’রে নিয়েছিলেন যে দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে: দার্শনিক সত্য উদঘাটন করেন যুক্তির মাধ্যমে, আর ধর্মতাত্ত্বিক শুধু যুক্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকেন না, তিনি মেনে নেন প্রত্যাদেশকে, বিধাতার প্রেরিত বাণীকে, এবং তার ধর্মের বিশ্বাসগুলো। তাঁকে শুধু যুক্তিই সাহায্য করে না, তাকে সাহায্য করার জন্যে রয়েছেন ধর্মপ্রবর্তক, রয়েছে ধর্মগ্রন্থ। তার রয়েছে মহান অভিভাবক। তার মতে কিছু কিছু সত্য সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাদেশের অন্তর্ভুক্ত; যেমন খ্রিস্টধর্মের ত্রিত্ব বা পিতা-পুত্র-পবিত্র আত্মার ব্যাপারটি। এ-ব্যাপারটিকে যুক্তি দিয়ে দেখানো যেতে পারে যে এটা অযৌক্তিক নয়, তবে যুক্তি দিয়ে এদের সত্যতা প্রমাণ অসম্ভব। ধর্মে রয়েছে আরো কিছু সত্য, যা প্রমাণ করা সম্ভব যুক্তি দিয়ে; এবং রয়েছে আরো একগুচ্ছ সত্য, যা দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব উভয়েরই সীমার মধ্যে পড়ে—যেমন বিধাতার অস্তিত্ব। বিধাতা নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন তিনি আছেন, তাই তিনি আছেন; তবে যুক্তির সাহায্যেও প্রমাণ করা যায় যে তিনি আছেন। ভেতরে ভেতরে তিনি বিশ্বাস করেন যে দর্শন ধর্মতত্ত্বের থেকে অনেক উৎকৃষ্ট জ্ঞান; তবু যেহেতু তিনি ধর্মতাত্ত্বিক, তার মনে হয় যে দর্শন একলা মানুষের সব প্রয়োজন মেটাতে পারে না। যুক্তির সাথে দরকার প্রত্যাদেশ ও বিশ্বাস। রাসেল বলেছেন আকুইনাসের মধ্যে দার্শনিকের স্বভাব রয়েছে খুবই কম; কেননা তিনি যুক্তির পর যুক্তি দিয়ে সত্যে পৌঁছেন না; তিনি এমন কোনো অনুসন্ধানে ব্যাপৃত নন, যার ফল আগে থেকে জানা অসম্ভব। আকুইনাস আগে থেকেই জানেন তার ফলটি কী, তিনি পৌঁছবেন কোন সত্যে। তার সত্য আগে থেকেই প্রচারিত হয়ে আছে ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসে; আকুইনাসের কাজ হচ্ছে নানা যুক্তি অবতরণা ক’রে তা প্রমাণ করা। রাসেল বলেছেন আকুইনাস যা করেছেন, তা দর্শন নয়, ওকালতি।
আকুইনাস বিধাতার অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেন। পাঁচটি উপায়ে। তাঁর উপায়। বা যুক্তিগুলো শুরু হয় বাস্তব জগতে, শেষ হয় গিয়ে অবাস্তবে। তিনি শুরু করেন। আমাদের পরিচিত গতি বা পরিবর্তন নিয়ে; এবং অনুসরণ করেন আরিস্ততালকে যে কোনো বস্তু চলতে বা গতিশীল হ’তে পারে না, যদি না তার থাকে গতিশীল হওয়ার শক্তি। তাঁর প্রথম যুক্তিটিই ভুল। আরিস্ততলের অনুসরণে তিনি বলেন কোনো কিছুর গতিশীল হওয়ার গুণ থাকলেও সে গতিশীল হ’তে পারে না। যদি না সত্যিকার কোনো কিছু তাকে গতিশীল না করে। তার, ও আরিস্ততলের, মতে কোনো কিছুই নিজে গতিশীল হ’তে পারে না; অন্য কিছু তাকে গতিশীল করে। মনে করতে পারি, যে একটি গতিশীল বস্তু অন্য একটি বস্তুকে করে গতিশীল, তাকে গতিশীল করে অন্য একটি বস্তু; অর্থাৎ এটা চলতে থাকে অন্তহীন রূপে। কিন্তু আকুইনাসের কাছে চালকের পর চালক, অন্তহীন চালক অকল্পনীয়; তিনি মনে করেন যে চালক অন্তহীন নয়, রয়েছেন। একজন আদিচালক, যিনি নিজে চলেন না, অন্যদের চালান। তিনি অচল চালক বা অনড় চালক। তিনি বিধাতা। খুবই হাস্যকর, অযৌক্তিক, এবং বাঙলায় যাকে বলে-কষ্টকল্পিত, যুক্তি। তাঁর চিন্তায় সব কিছুই অপর এক সত্তার ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু সে-সত্তাটি অন্য কারো ওপর নির্ভরশীল নন, তিনি আচল চালক; তিনি আদি বা প্রথম, অর্থাৎ বিধাতা। তবে তিনি শুধু আরিস্তাতলীয় যুক্তির ওপরই নির্ভর করেন না, নির্ভর করেন। খ্রিস্টধর্মীয় বিশ্বাসের ওপরও যে বিশ্ব চিরকাল ধ’রে অস্তিত্বশীল নয়, এক সময় ছিলো যখন বিশ্ব ছিলো না। আরিস্তাতল যেমন এক আচল চালক প্রস্তাব করেছিলেন তার বিশ্বযন্ত্রকে সচল রাখার জন্যে, আকুইনাসও তাই করেন;-আরিস্ততলের বিশ্বকাঠামো ধার ক’রে আরিস্তাতলীয় আচল চালকের সাহায্যে তিনি চালান সমস্ত সচল বস্তুকে।
আকুইনাসের দ্বিতীয় যুক্তি কার্যকরণবিষয়ক। প্রাকৃতিক জগতে যা কিছু আছে বা ঘটে, তার সব কিছুর পেছনে রয়েছে কোনো-না-কোনো কারণ: কোনো কিছুই কারণহীন নয়; তবে, তার মতে, রয়েছেন এক আদি বা প্রথম কারণ, যা অন্য কোনো কারণের ফল নয়। ওই আদিকারণ হচ্ছেন বিধাতা, যিনি জাগতিক সব কার্যকরণের আদি ও উৎস। তৃতীয় যুক্তিতে তিনি পার্থক্য করেন। অনিবার্য বা প্রয়োজনীয় ও আকস্মিক অস্তিত্বের মধ্যে। তার মতে জগত জুড়ে কতো কিছুই অস্তিত্বশীল হয় ও ধ্বংস হয়; তাদের অস্তিত্ব অনিবার্য নয়, তারা আকস্মিক; কিন্তু রয়েছেন এক সত্তা, যার অস্তিত্ব অনিবার্য, কেননা তিনিই অস্তিত্বশীল করেছেন অন্য অস্তিত্বদের। আমরা দেখি কোনো অস্তিত্বের জন্যে দরকার পূর্ব কারো অস্তিত্ব, তবে তার কাছে অন্তহীন পূর্বচক্র বা পূর্বঅস্তিত্ব গ্রহণযোগ্য নয়; তিনি মনে করেন এক জায়গায় গিয়ে অবশ্যই থামতে হবে। তিনি গিয়ে থামেন বিধাতায়, যিনি সমস্ত অস্তিত্বের কারণ, কিন্তু নিজে কোনো কারণের পরিণতি নন। তিনি আদি, তার থেকে উদ্ভূত অন্যরা। আকুইনাসের চতুর্থ যুক্তি ও মহাজাগতিক যুক্তি; এতে তিনি সমস্ত সদগুণের উৎসরূপে দেখতে পান বিধাতাকে। তার মতে বিভিন্ন আকস্মিক সত্তার মধ্যে যে-সমস্ত গুণ দেখতে পাই, সেগুলো তারা পেয়েছে কোনো পরমসত্তা থেকে, কেননা পরমসত্তার মধ্যে ওই গুণাগুলো আছে পরামরূপে। তাই সমস্ত সদগুণের আছেন এক পরম আধার বা উৎস: তিনি হচ্ছেন বিধাতা।
বিধাতার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্যে যে-সব মহাজাগতিক যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন আকুইনাস, সেগুলো দাঁড়িয়ে আছে এক মৌল বিশ্বাসের ওপর যে বিশ্বজগতের অস্তিত্বের মূলে অবশ্যই রয়েছেন এক আদিকারণ বা পরম কারণ। বিধাতার অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্যে সবশেষে তিনি দেন মহৎ লক্ষ্যমূলক বা মহাপরিকল্পনামূলক যুক্তি। তার এ-যুক্তি মাতিয়ে রেখেছিলো নানা ধর্মের বিশ্বাসীদের, যার এক শিকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জগতে, আকুইনাস বিশ্বাস করেন, সব কিছু কাজ ক’রে চলছে সুন্দর বিন্যাস বা সুষমা রক্ষা ক’রে; তারা এক বিশেষ মহৎ উদ্দেশ্যপূরণের জন্যে কাজ ক’রে চলছে এভাবে। তিনি মনে করেন জগতের সুষমা কোনো আকস্মিক ব্যাপার হতে পারে না; নিশ্চয়ই এসবের মূলে রয়েছে এক অলৌকিক মহাশক্তির মহাপরিকল্পনা। জগতে রয়েছে নানা তুচ্ছ বস্তু, যাদের কোনো বুদ্ধি নেই, তারাও পূরণ করছে একই মহৎ লক্ষ্য, যা তাদের কাছে। আশা করা যায় না। তারা কেনো মহৎ লক্ষ্য চরিতাৰ্থ করার জন্যে কাজ করে চলছে? আকুইনাস বলেন এর পেছনে রয়েছেন এক মহাসত্তা, যিনি সব কিছুকে চালাচ্ছেন এক পরম পরিণতির দিকে; ওই মহাসত্তা হচ্ছেন বিধাতা। জগতে সুষমা আর মহৎ লক্ষ্য বা মহাপরিকল্পনা দেখা বিশ্বাসীদের একটি দুরারোগ্য ব্যাধি। বিধাতার মহাপরিকল্পনা সম্পর্কে মনে পড়ছে রাসেলের দুটি স্মরণীয় ব্যাখ্যা :
[ক] আমি বুঝতে পারি না প্রকৃতির কোথায় পাওয়া যায় ‘সৌন্দর্য ও সুষমা’। সারা পশুরাজ্য জুড়ে পশুরা একে অন্যকে শিকার করে নৃশংসভাবে। তাদের অধিকাংশই অন্য পশুদের দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয় বা ক্ষুধায় ধীরে ধীরে মারা যায়। আমি ফিতাক্রিমির মধ্যে কোনো মহৎ সৌন্দর্য ও সুষমা দেখতে পাই না। এটা বলবেন না যে এটিকে আমাদের পাপের শান্তি ভোগ করার জন্যে পাঠানো হয়েছে। আমার মনে হয় ‘সৌন্দৰ্য আর ‘সুষমা’র ধারণা এসেছে নক্ষত্ৰখচিত আকাশের সৌন্দৰ্য-সুষমার বোধ থেকে। তবে মনে রাখা দরকার যে নক্ষত্রগুলো যখন-তখন বিস্ফোরিত হচ্ছে, আর তাদের চারপাশকে পরিণত করছে ঘোলাটে কুয়াশায়।
[খ] বিবর্তনবাদ ফ্যাশন হয়ে ওঠার পর থেকে মানুষের ওপর মহত্ত্ব আরোপ নিয়েছে এক নতুন রূপ। আমাদের বলা হয় যে বিবর্তনের পেছনে কাজ করছে এক মহৎ লক্ষ্য : লাখ লাখ বছর ধ’রে যখন ছিলো শুধু আঠালো কাদা, বা ট্রিলোবাইট, যুগ যুগ ধ’রে যেখানে ছিলো ডাইনোসর আর দানবিক উদ্ভিদ, মৌমাছি আর বন্য ফুল, তার মধ্য দিয়ে বিধাতা প্রস্তুত করছিলেন এই মহাপরিণতি। পরিশেষে তিনি তৈরি করেছেন মানুষ, যার মধ্যে রয়েছে নিরো ও কালিগুলা, হিটলার ও মুসোলিনির মতো প্রজাতি, যাদের অসামান্য মহিমা এই দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়ার ন্যায্যতা প্রতিপাদন করে। বিধাতার পরম পরিকল্পনার পরিণতির এই খোড়া ও নপুংসক ব্যাখ্যায় মুগ্ধ হওয়ার থেকে আমি চিরশাস্তিকেও অনেক কম অবিশ্বাস্য ও কম হাস্যকর মনে করি।
সমাজ ও রাষ্ট্রের দিকে তাকালেই চোখে পড়ে ঘটছে এমন সব আশ্ৰীল ঘটনা, যা কোনো মহাপরিকল্পনার ফল নয়। একটি দূৰ্বত্ত একনায়ক দেখা দিয়েছে, এটা কোন মহাপরিকল্পনার অংশ? দেশ জুড়ে অনাহার, বন্যা, মহামারী? এটা কোন মহাপরিকল্পনার অংশ? ধৰ্ষিত হচ্ছে নারীরা, গর্ভবতী হয়ে পড়ছে পরিচারিকারী: এটা কোন মহাপরিকল্পনার অংশ? প্রকৃতির নিয়মগুলো চলে প্রকৃতির স্বভাব অনুসারে, কোনো মহাপরিকল্পনা অনুসারে নয়। আকুইনাস পাঁচটি যুক্তি বের ক’রে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন বিধাতা আছেন; কিন্তু তার দুর্ভাগ্য ধাৰ্মিকেরা মানে না। তাঁর আবিষ্কৃত বিধাতাকে। তাদের মতে, যেমন পাস্কাল দাবি করেছেন, ‘দার্শনিকের বিধাতা’ আর ‘আব্ৰাহাম, আইজাক ও জ্যাকবের বিধাতা’ এক জিনিশ নয়। ধার্মিকেরা যুক্তি দিয়ে বোঝে না বিধাতাকে, তারা অন্ধ অযৌক্তিক মানুষ; তারা বিশ্বাস করে, তাদের ধর্মের বিধান অনুসারে, বিশেষ বিধাতায়। তাই বিভিন্ন ধর্মের বিধাতা বিভিন্ন, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একই বিধাতায় বিশ্বাস করে না; কিন্তু দার্শনিক যুক্তিতে আবিষ্কৃত হয় যে-বিধাতা—যদি আন্দীে আবিষ্কৃত হয়, তা এক অভিন্ন ভাবনা। বিধাতা আছেন এবং তিনি বাণী বা প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছেন বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে, এটা অনেকেই বিশ্বাস করে না; ডেভিড হিউমও এটা বিশ্বাস করেন নি। প্রতিটি ধর্ম দাঁড়িয়ে আছে অলৌকিক অবিশ্বাস্য প্রত্যাদেশের ওপর। প্রত্যাদেশ প্রাকৃতিক নিয়মের বিরোধী; প্রত্যাদেশে বিশ্বাস করতে হ’লে অস্বীকার করতে হয় প্রাকৃতিক নিয়মকে। যে-সব অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে ব’লে মনে করা হয়, হিউমের মতে সেগুলো ওই ব্যক্তিদের বোঝার ভুল মাত্র। তার মতে ধর্ম ও যুক্তি পরস্পরবিরোধী; ধর্ম দাঁড়িয়ে আছে অযৌক্তিক ভিত্তির ওপর।
প্রথা ও ধর্মকে সবচেয়ে শাণিতভাবে আক্রমণ করেছেন বাট্র্যান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯৭০)। সভ্যতায়. ধর্মের কিছুটা দান রয়েছে—তিনি স্বীকার করেন; তবে তাঁর কাছে ধর্ম হচ্ছে ভয় থেকে উৎপন্ন রোগ এবং মানবজাতির শোচনীয় দুর্দশার উৎস।’ তিনি নিজেকে নাস্তিক না ব’লে বলতেন সন্দেহবাদী; এবং প্রচার করতেন গোত্ৰমুক্ত মানবতাবাদ। তিনি চাইতেন মানুষ হবে আত্মবিশ্বাসী, যাপন করবে: নিজের জীবন, ভয় পাবে না চিরশাস্তির, লোভে পড়বে না কোনো পারলৌকিক পুরস্কারের। তিনি কেনো আমি খ্রিস্টান নাই নামে একটি বই লিখেই ছেড়ে দেন প্রথা থেকে পাওয়া ধর্ম। ওই ধর্মের বিরুদ্ধে তার বড়ো আপত্তি হচ্ছে নরক। তিনি বলেছেন, ‘ক্রাইস্টের নৈতিক চরিত্রে রয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি, তা হচ্ছে তিনি বিশ্বাস করতেন নরকে।’ তিনি জেসাসের থেকে মহৎ মনে করেন। সক্রেটিসকে, আবার সক্রেটিসের মহত্ত্বেও তার সন্দেহ ছিলো: সক্রেটিসের হেমলক পানকে তিনি মহৎ মনে করেন না, কেননা সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন স্বর্গে তিনি থাকবেন। দেবতাদের সাথে। তিনি মনে করেন প্রথাগত ধর্মবিশ্বাসগুলো লোপ পাবে। তিনি দেখিয়েছেন সব ধর্মই একটি শক্তির ওপর আরোপ করে বিপুল সম্মান, যে মানুষের প্রতি অনীহ; মানুষ যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তার মতে বিধাতায় বিশ্বাস খর্ব করে মানুষের স্বাধীনতা। ধর্ম, তার মতে, উপকারের থেকে অপকার করেছে অনেক বেশি; কেননা ধর্ম দাঁড়িয়ে আছে। অপরীক্ষিত অভিজ্ঞতার ওপর, এবং ধর্ম বুদ্ধির শত্রু। আমরা আরো মুক্ত হবো, আমাদের সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারবো নিজেরাই, যদি আমরা নিজেদের মুক্ত করতে পারি বিধাতায় বিশ্বাস থেকে, এবং বিশ্বাস আনতে পারি মানুষের বিজ্ঞানসন্মত বুদ্ধিতে। তখন মুক্ত হবো মোহ থেকে, নিজেদের আর প্রবোধ দেবো না; দাঁড়াবো সম্পূর্ণরূপে নিজেদের পায়ের ওপর, নিজেরাই হবো নিজেদের জীবন ও মৃত্যুর অভিভাবক। মেনে নেবো যে জীবন তা ৎপর্যহীন, তবে তাৎপর্যহীন জীবনকে আমরা তাৎপর্যপূর্ণ ক’রে তুলতে পারি নিজেদের সৃষ্টিশীলতা দিয়ে।
একদেবতা বা বিধাতা কল্পনার আগে এসেছিলো যে দীর্ঘ এক যাদু বা ইন্দ্ৰজালের কাল, সব ধর্মের ভেতরে যা আজো সংগোপনে পবিত্র বিশ্বাস ও আচরণ রূপে টিকে আছে, আমি একটু সেকালে যেতে চাই। বাঙলায় যাদু ও যাদুকর সম্পর্কিত শব্দের সংখ্যা প্রচুর : ইন্দ্রজাল, যাদু, ভোজবাজি, ভেলকি, ভানুমতীর খেল, কুহক, সম্মোহন, তুকতাক, বাণমারা, মায়া, গুণাকরা, মন্ত্র, মন্ত্রকরা, বশীকরণ, শাম্বরী; এবং আদি বাঙলা সাহিত্য ভ’রে আছে যাদুটোনায়। আমার ছেলেবেলায়ও গ্রামে আমরা বাস করতাম যাদুটোনা, ভূতপ্ৰেত, আর বিধাতার অনন্ত ভয়ের মধ্যে। আদিম সমাজে দেখা দিয়েছিলো যাদুকর বা ঐন্দ্রজালিকেরা, তাদের উদ্দেশ্য ছিলো অলৌকিক শক্তি দেখিয়ে সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা, এমনকি রাজা হওয়া। যাদুকরের লক্ষ্য ছিলো প্রাকৃতিক শক্তিকে বশ করা, কিন্তু তারা প্রকৃতির শক্তির স্বরূপ বুঝতে পারে নি, তাকে বশ করতে পারে নি; কিন্তু সম্মোহিত করতে পেরেছে মানুষকে। যাদু ও বিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য একই, কিন্তু যাদু ভুল পথে গিয়ে হয়ে উঠেছে বিজ্ঞানের অবৈধ বোন-যেমন বলেছেন জেমস ফ্রেজার। ধর্মের মূলকথা হচ্ছে একাধিক/এক অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস, যারা/যে মানুষের থেকে উন্নততর, এবং চালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে প্রকৃতি ও মানুষের জীবন। ওই শক্তিতে বিশ্বাস তাত্ত্বিক ব্যাপার, তবে শুধু তত্ত্বেই ধর্মের চলে না; তার একটি প্রয়োগগত। দিকও থাকতে হয়। প্রয়োগগত ব্যাপারটি হচ্ছে ওই শক্তিগুলোকে পরিতৃপ্ত করা দরকার; শুধু আদিম নয়, আধুনিক সব ধর্মেই রয়েছে অলৌকিক শক্তিগুলোকে তৃপ্ত করার নানা রীতি। কিন্তু যদি বিশ্বাস করি যে রয়েছে অলৌকিক শক্তি, যারা নিয়ন্ত্রণ করে জগত, আর আমরা যদি তাদের কাছে চাই সুযোগসুবিধা, তার অর্থ দাঁড়ায় প্রাকৃতিক নিয়ম শিথিল করা সম্ভব; প্রার্থনা ক’রে বা পশুবলি দিয়ে ওই শক্তিদের সাহায্যে বদলে দিতে পারি প্রাকৃতিক নিয়ম। অলৌকিক শক্তিদের কাছে মানুষের অধিকাংশ প্রার্থনাই স্কুল; বাইবেল থেকে দুটি উদাহরণ দিচ্ছি :
হে সদাপ্ৰভু, আমার ঈশ্বর, আমি তোমার শরণ লইয়াছি;
আমার সকল তাড়নাকারী হইতে আমাকে নিস্তার কর, আমাকে উদ্ধার কর।
পাছে [শত্রু] সিংহের ন্যায় আমার প্রাণ বিদীর্ণ করে,
খণ্ড খণ্ড করে, যখন উদ্ধারকারী কেহ নাই।…
হে সদাপ্রভু, ক্রোধভরে উত্থান কর,
আমার বৈরীদের কোপের প্রতিকূলে উঠ [গীতসংহিতা ৭]
আমার শক্রগণের হইতে, আমার তাড়নাকারিগণ হইতে, আমাকে উদ্ধার কর।
দুষ্টগণ লজ্জিত হউক, পাতালে নীরব হউক।
সেই মিথ্যাবাদী ওষ্ঠাধর সকল বোবা হউক,
যাহারা ধাৰ্ম্মিকের বিপক্ষে দৰ্পকথা কহে,
অহঙ্কার ও তুচ্ছ জ্ঞান সহকারে কহে। [গীতসংহিতা ৩১]
প্রার্থনায় অবশ্য কখনোই কাজ হয় না, নির্বোধেরা শুধু একটু সাময়িক শান্তি পায়। প্রার্থনা সম্বন্ধে বাৰ্ট্যান্ড রাসেলের কথা শোনার মতো :
প্রার্থনা বা বিনয়ের সাহায্যে আপনি নিজের ইচ্ছেমতো কিছুই বদল করতে পারেন না, কিন্তু পারেন প্রাকৃতিক নিয়ম সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করে। এভাবে আপনি যে-শক্তি অর্জন করেন, তা প্রার্থনার-সাহায্যে-অর্জন-করা-যায়-ব’লে-বিশ্বাস-করা শক্তির থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী ও অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য; কেননা আপনি জানেন না। স্বর্গে আপনার প্রার্থনা সদয়তার সাথে বিবেচিত হবে কি না। তাছাড়া প্রার্থনার রয়েছে বিশেষ সীমা; খুব বেশি চাওয়া অধাৰ্মিকতা ব’লে বিবেচিত হবে। কিন্তু বিজ্ঞানের শক্তির কোনো সীমা নেই। আমাদের বলা হয়েছে বিশ্বাস পর্বত স্থানান্তরিত করতে পারে, কিন্তু কেউ তা বিশ্বাস করে না; এখন আমাদের বলা হয় আণবিক বোমা পর্বত স্থানান্তরিত করতে পারে, এবং সবাই তা বিশ্বাস করে।
হায়, প্রার্থনা;–আত্মসম্মানবোধহীন দুর্বলের লোলুপবাণীবিন্যাস।
প্রার্থনায় প্রকৃতির অমােঘ নিয়ম বদলে দেয়া যেতে পারে, এটা যাদুকর ও বিজ্ঞানী কেউ বিশ্বাস করেন না; তাঁরা জানেন প্রকৃতির নিয়মগুলো অপরিবর্তনীয়, অবিচল, ওগুলোর কাছে প্রার্থনা বা অভিযোগ বৃথা’। বিজ্ঞান কোনো পরমসত্তায়ই বিশ্বাস করে না; তবে ধর্ম বিশ্বাস করে এক/একাধিক লোকোত্তর শক্তিতে; মনে করে ওই শক্তিগুলো যদিও স্বেচ্ছাচারী, তবু আবেদননিবেদন ক’রে তাদের তুষ্ট। ক’রে ফল পাওয়া যেতেও পারে। ফল না পাওয়া গেলেও ক্ষতি নেই, যদি পাওয়া যায় তাহলে অনেক লাভ। এটা সৎ মানুষের স্বভাব নয়, বস্তুবাদী চতুর মানুষের স্বভাব। যাদুতে অনেক সময় নানা ধরনের প্রেতের সাহায্য নেয়া হয়; তবে ওই প্ৰেত দেবতা নয়, তাকে পুজো করা হয় না, নানা মন্ত্র দিয়ে তাকে নিয়ন্ত্ৰণ ক’রে তাকে দিয়ে কাজ উদ্ধার করা হয়। যাদু পুজো না ক’রে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় অলৌকিক শক্তিদের। যাদু ও ধর্মের মধ্যে বড়ো পার্থক্য এখানেই; যাদু যা করতে চায় নিয়ন্ত্রণ ক’রে ধর্ম তা করতে চায় প্রার্থনা ক’রে। যাদুকর ধর্মের চোখে বিধাতাদ্রোহী, তাই ধৰ্মপ্রবর্তক ও পুরোহিতেরা চিরকালই চেষ্টা করেছে যাদুকরদের নিৰ্মল করতে। এর মূলে ছিলো একটা স্বার্থগত প্রতিযোগিতাও; ধর্মপ্রবর্তক ও পুরোহিত নিজেদের মনে করে বিধাতার সাথে যোগাযোগের মাধ্যম, সেখানে যদি ভাগ বসায় যাদুকর, তাহলে নষ্ট হয় তাদের স্বার্থ। প্যালেস্টাইন অঞ্চলের ধর্মগুলোতে যাদুকরদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আক্রোশ চোখে পড়ে।
ধর্মবিষয়ক জনপ্রিয় নিম্নমানের বই পেলেই আমি উলটেপালটে দেখি, কেননা এগুলোই তৈরি করে অধিকাংশ বিশ্বাসীর ধর্মবোধ, যারা ধর্মের মূল বইগুলো পড়তে পারে না, যদিও এগুলোর কোনো কোনো অংশ ধর্মের মূল বিশ্বাসবিরোধী। কিছু দিন আগে ‘বাংলাদেশ হুকুমতের ভূতপূর্ব প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট’ মৌলবী মোহাম্মদ শামছুল হুদা বি.এ.বি.এল সাহেবের নেয়ামুল-কোরআন (ত্ৰয়োবিংশ সংস্করণ, ১৯৮৯, রহমানিয়া লাইব্রেরী, ঢাকা) বইটির ১৫১ পৃষ্ঠাটি খুলে আমি চমকে উঠি। এটি একটি জনপ্রিয় ধর্মবিষয়ক বই; বইটিতে আয়াতের সাহায্যে কীভাবে চাকরীচাকরাণী বাধ্য রাখা যায়, নষ্ট চাকুরি ফিরে পাওয়া যায়, যাদু নষ্ট করা যায়, স্বামীকে বশীভূত করা যায়, ধ্বজভঙ্গ ও প্রমেহ রোগ সারানো যায়, গর্ভপাত নিবারণ করা যায়, স্ত্রীলোকের প্রসব কষ্ট দূর করা যায়, স্বপ্নদােষ বন্ধ করা যায়, বিচারকের দয়া আকর্ষণ করা যায়, সঙ্গম শক্তি বাড়ানো যায়, সাপ ও কুকুরের বিষ নষ্ট করা যায়, প্রস্রাব খোলাসা করা যায়, পরীক্ষায় পাশ করা যায়, এমন অজস্র জরুরি বিষয়ে তদবীরের রীতি বর্ণনা করা হয়েছে। এতো উপকারী বই কমই আছে পৃথিবীতে। বইটির ১৫১ পৃষ্ঠাটি আমাকে শিউরে দেয়। এ-পাতায় তিনি বর্ণনা করেছেন দুইজনের মধ্যে শক্রতা ও মতান্তর সৃষ্টি করার তদবীর’। দুজনের মধ্যে শক্ৰতা সৃষ্টির ব্যাপারটি নৈতিকভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় আমার কাছে, কিন্তু ধাৰ্মিকদের কাছে বেশ গ্রহণযোগ্য। লেখক পরামর্শ দিয়েছেন : ‘দুই ব্যক্তির মধ্যে শক্ৰতা ও মতান্তর সৃষ্টি করিতে হইলে এই আয়াত গাছের পাতার উপর লিখিবে :-আরবিতে আয়াতটি লেখা হয়েছে, উৎস নির্দেশ করা হয়েছে; (৬ পারা, সূরা আলমায়েদা, ৬৪ আয়াতের অংশ); অর্থ দেয়া হয়েছে; এবং তাহাদর মধ্যে আমি কিয়ামত পর্যন্ত শক্রতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করিয়াছি।’ লেখক এখানেই থামেন নি; পরামর্শ দিয়েছেন, ‘তৎপর উপরোক্ত আয়াতের নীচে এই নকশা লিখিবো।’ তিনি নকশার ছবিও দিয়েছেন, যাতে আরবিতে চারবার লেখা আছে আল্লাহ’, এবং মাঝখানে নিচ থেকে ওপর দিকে তিনবার লেখা আছে ‘সোহরা’, যার অর্থ হচ্ছে ‘যাদু’। তিনি নকশাটি বর্ণনা করেছেন এভাবে :
নকশার বর্ণনা :- যাদুকরের কুফরী কালামের কিছু কিছু শক্তি বর্তমান আছে, কিন্তু আল্লাহর পাক কালামের শক্তির নিকট ইহাদের শক্তি কিছুই নহে। পূর্বকালে লোকেরা যাদুমন্ত্রের দ্বারা মানুষের মধ্যে শক্রতা সৃষ্টি করিত। এই নকশায় আল্লাহর নামের নীচে ‘সোহর’ (যাদু) শব্দটি দ্বারা প্রতীয়মান করা হয় যে, যাদুমন্ত্র আল্লাহর অসীম শক্তির নিকট অকিঞ্চিৎকর। এই নকশায় উক্ত ভাবের বর্ণনা থাকায় ইহার বরকতে উপরোক্ত ফল লাভ হয়। তৎপর এই নকশার নীচে লিখিবে অমুক ও অমুকের মধ্যে শক্রতা সৃষ্টি হউক। অমুক অমুকের স্থলে দুইজনের নাম লিখিবে এবং ইহা তাবীয় করিয়া পুরাতন দুই কবরের মাধ্যস্থলে পুতিয়া রাখিলে তাঁহাদের মধ্যে শত্রুতা আরম্ভ হইবে। (অন্যায়ভাবে এই আমল করিলে কবীরাহ গোনাহ হইবে)।
ন্যায়সঙ্গতভাবে কীভাবে দুজনের মধ্যে শক্ৰতা সৃষ্টি করা যায়, তা আমি বুঝে উঠতে পারছি না-ধার্মিকদের নৈতিকতা বড়োই বিস্ময়কর; তবে এ-নকশার বর্ণনায় এটা স্পষ্ট যে ধর্ম ও যাদু পরস্পরের বিরোধী। এর আরো গভীর ব্যাখ্যাও সম্ভব, নকশাটি তাই দাবি করছে, তবে তাতে আমি যাচ্ছি না। ধর্ম ও যাদুর বিরোধ অবশ্য ধর্মগুলোর সূচনাকালেই ঘটে নি, ঘটেছে বেশ পরে; আগে পার্থক্য ছিলো না পুরোহিত ও যাদুকরের মধ্যে, একই ব্যক্তি ছিলো পুরোহিত ও যাদুকর। পুরোহিত-যাদুকর একই সাথে পালন করতো ধর্মীয় ও ঐন্দ্রজালিক আচার, একই সাথে সে প্রার্থনাও করতো মন্ত্রও আবৃত্তি করতো, যাতে সে পেতে পারে তার ঈন্সিত ফল। ধর্ম ও ইন্দ্ৰজালের মিশ্রণ সব ধর্মেই দেখা যায়। প্রাচীন ভারত, মিশর, প্যালেস্টাইনে ধর্ম ও যাদু মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো। ভারতীয় ধর্মের শ্লোকগুলোকে যে মন্ত্র বলা হয়, তার কারণ হয়তো এগুলো মূলত ছিলো যাদুকরদের অভিচারশ্লোক। আজকাল যাদু বা ইন্দ্ৰজাল তার গৌরব হারিয়েছে, কিন্তু আদিতে ইন্দ্ৰজােলই ছিলো ধর্মের ভিত্তি। যখন কেউ দেবদেবীর কাছে সুযোগসুবিধা চাইতো, তখন দরকার হতো দেবদেবীকে বশীভূত করা; এবং বশ করার জন্যে দরকার হতো বলি, প্রার্থনা, মন্ত্র; অর্থাৎ ইন্দ্ৰজাল।
ধর্মের থেকে ইন্দ্ৰজাল অনেক পুরোনো; প্রকৃতিকে বশ করার জন্যে ধর্মের অনেক আগেই উদ্ভূত হয়েছিলো যাদু, এবং ধর্মে এখনো তা মিশে আছে। এখনো অনেক জনগোষ্ঠি আছে যাদের মধ্যে ধর্মের বিকাশ ঘটে নি, বা আধিপত্যশীল ধর্মগুলো গিয়ে পৌঁছে নি, কিন্তু সেখানে যাদু ও যাদুকরের কোনো অভাব নেই। এক সময় আমাদের দেশে বিশ্বাস করা হতো যে আসামের সবাই, বিশেষ ক’রে নারীমাত্রই, যাদুকর; তারা পুরুষ পেলেই তাকে ভেড়া বানায়; এ-শতকের প্রথম দিকে দেখা গেছে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের সবাই যাদুকর, কিন্তু তাদের কোনো পুরোহিত নেই, অর্থাৎ বিধিবদ্ধ ধর্ম নেই। সেখানে সবাই মনে করতো তারা যাদু দিয়ে অন্যদের বশ করতে পারে, বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে প্রকৃতিকে, কিন্তু কেউ সেখানে কোনো দেবতার পুজো করতো না। ফ্রেজার মনে করেন একদা পৃথিবী জুড়েই এসেছিলো এক ইন্দ্ৰজাল বা যাদুর যুগ। ধর্মের উত্থানের ফলে যাদুর অবসান ঘটে নি, ঐন্দ্রজালিকভাবেই সে বদল করেছে তার রূপ, বিভিন্ন ধর্মের ভেতরে এখনো গোপনে বেঁচে আছে। মানুষের কাছে এখনো ধর্মের কঠোর বিধানের থেকে ইন্দ্ৰজালের আবেদন বেশি। এর প্রকাশ পৃথিবী জুড়েই দেখা যায়। পৃথিবী ভীরে ধর্মের যুগের আগে দেখা দিয়েছিলো যাদুর যুগ; কিন্তু মানুষ কেনো যাদু ছেড়ে আশ্রয় নিলো ধর্মের? এর কারণ যাদুর ব্যর্থতা; মানুষ দেখতে পায় যাদু কাম্য ফল দিচ্ছে না; পালন করা হলো অনেক আচার, আবৃত্তি করা হলো অনেক মন্ত্র, কিন্তু কোনোই ফল ফলছে না। মানুষ একদিন বুঝতে পারে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি নেই ইন্দ্ৰজালের। যা ব্যৰ্থ, তা মানুষ ধ’রে রাখে না; মানুষ পুজো করে সফলতার, সফলতা মানুষের বিধাতা।
যাদুতে এক সময় বিশ্বাস ছিলো মানুষের; যেদিন সে-বিশ্বাস নষ্ট হয়, সেদিন তাদের দরকার পরে নতুন শক্তির, যা যাদুর থেকে শক্তিমান, যা তাদের দিতে পারে তাদের কাম্য ফল। আমরা কল্পনা করতে পারি। সেই সংকটকালের উদ্বিগ্ন চিন্তাবিদদের, আরণ্যিক নির্বোধদের, যারা খুঁজছিলো নতুন পথ, নতুন উপায়, নতুন শক্তিদের, যারা তাদের উদ্ধার করতে পারে, দিতে পারে তাদের কামনার বস্তু। ওই শক্তিকে অবশ্যই হ’তে হবে ইন্দ্ৰজালের থেকে শক্তিমান, কেননা ইন্দ্ৰজালের ব্যর্থতা তারা দেখেছে। তারা তখন প্রকৃতির নিরন্তর আক্রমণে পর্যুদস্ত; তাদের মনে হয় নিশ্চয়ই রয়েছে এমন বহু শক্তি, যারা প্রবাহিত করে ঝড়, বিদ্যুতে ফেড়ে ফেলে আকাশ, বজ্রপাত করে চারদিক কাঁপিয়ে, আকশে জ্বেলে দেয় আলোকমালা, ফলবতী করে নারী ও ভূমিকে ইত্যাদি। নিশ্চয়ই যাদুর থেকে শক্তিমান ওই শক্তিসমূহ। তারা এক ভুল থেকে আরেক ভুলে পৌঁছে—দেখে ভ্রান্ত দুঃস্বপন; যাদু ছেড়ে তারা নিজেদের সমর্পণ করে কল্পিত ওই শক্তিরাশির পায়ে। যাদুকর। যেমন বোঝে নি। প্রকৃতিকে, তারাও বোঝে না; তবে যাদুর ব্যর্থতা এর মাঝেই প্রমাণিত হয়ে গেছে ব’লে নতুন শক্তি কল্পনা করতে তাদের বাধে নি। ওই কল্পিত শক্তিগুলোকে তারা ক’রে তোলে দেবতা; তাদের কাছে চায় সম্পদ, চায় আশীৰ্বাদ, প্রার্থনা করে অভয়। এভাবেই একদিন মানুষ যাদু ছেড়ে আশ্রয় নেয় কল্পিত অতিমানবিক শক্তিরাশির; যাদু থেকে উত্তীর্ণ হয় ধর্মে। যাদু থেকে মানুষ অবশ্য এক দিনে উঠে আসে নি ধর্মে, লেগেছে হাজার হাজার বছর, এমনকি আজো পুরোপুরি উঠে আসে নি। তবে ধর্মে-বহুদেবতায়, বহুদেবতা থেকে একদেবতায়-উঠে এসে লাভ হয় নি মানুষের, বরং যাদুকরের মধ্যে যে-ঔদ্ধত্য ছিলো, তা সে হারিয়েছে; সে হয়ে উঠেছে কল্পিত অতিমানবিক শক্তির পুতুল। ধর্ম হয়ে উঠেছে অবাস্তব অতিমানবিক শক্তির কাছে নিজেকে সমর্পণ করা, বিসর্জন করা সমস্ত নিজস্বতা ও মর্যাদা। কিন্তু ধর্মের কাছে মানুষ যা চায় তা কি তারা পায়? যা চায়, মানুষ তা পায় না; যেমন এক সময় পেতো না যাদুর কাছে। যাদু যদি তার কামনা পূরণ করতে পারতো, তাহলে মানুষ যাদুকে ছাড়তো না; ধর্মের কাছে মানুষ যা চায়, তা না পেয়ে মানুষ একদিন ধর্মও ছেড়ে দেবে। মানুষের বিধাতা আসলে সফলতা।
প্রশ্ন হচ্ছে বিধাতা বা বিধাতারা আছেন কি না? আমরা দেখেছি দার্শনিকের বিধাতাকে মানে না ধাৰ্মিকেরা, কেননা তাতে বিধাতা হয়ে ওঠেন বিমূর্ত ভাব, যা সব ধর্মেই অভিন্ন। কিন্তু পৃথিবীতে ধর্ম অনেক, ও সেগুলো পরস্পরবিরোধী; সেগুলোর প্রতিপালকরুপে রয়েছেন একান্ত নিজস্ব বিধাতা। তাহলে এমন হ’তে পারে বিধাতা একজন নন, অনেক; আর যদি তিনি একলা হন, তাহলে একটি বাদে সবগুলো ধর্মই অসত্য। আজকাল মানুষ বেশ সাবধান হয়ে গেছে, তারা বেশি। ঘাটাঘাটি করতে চায় না; তাই তারা যখন কারো কাছে জানতে চায়—’আপনি কি বিধাতায় বিশ্বাস করেন, তখন তারা বিশেষ ধর্মের বিধাতার কথা জানতে চায় না। কেই বিধাতায় বিশ্বাস করে এটুকু জানলেই ধাৰ্মিকেরা কাজ-চালানোর-মতো সন্তুষ্ট হয়। এমন একটি ঘটনা ঘটেছিলো আইনস্টাইনের জীবনে। পঞ্চাশপূর্তি উপলক্ষে যখন তাকে সংবর্ধনা দেয়ার আয়োজন চলছিলো নানা দিকে, তখন বস্টনের এক যাজক ক্রমশ তাকে জড়িয়ে ফেলছিলো ধমীয় বিতর্কে। ওই যাজকের মতে আপেক্ষিকতত্ত্ব হচ্ছে ‘মুখোশপরা নাস্তিকতার প্রেত’, যা ‘বিশ্বজনীন সন্দেহ সৃষ্টি করেছে বিধাতা ও তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে’। নাস্তিককে কি সংবর্ধনা দেয়া যায়? তখন এক ধর্মযাজক টেলিগ্রাম ক’রে জানতে চান, আপনি কি বিধাতায় বিশ্বাস করেন?’ আইনস্টাইন উত্তর দেন : ‘আমি বিশ্বাস করি স্পিনোৎসার বিধাতায়, অস্তিত্বশীল বস্তুরাশির সুষমার মধ্যে যিনি নিজেকে প্রকাশ করেন; তবে ওই বিধাতায় বিশ্বাস করি না যে ভাগ্য ও মানুষের কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত।’ তাঁর উত্তর পেয়ে ওই যাজক সকলকে বোঝাতে সমর্থ হন যে স্পিনোৎসাকে বলা হয় বিধাতামাতাল মানুষ, যিনি প্রকৃতির সবখানে দেখতে পেতেন বিধাতার প্রকাশ, তাই তাঁকে আমরা নাস্তিক বলতে পারি না। আর আইনস্টাইন নির্দেশ করেন। ঐক্য। আইনস্টাইনের তত্ত্বকে যদি যৌক্তিক পরিণতিতে নেয়া হয়, তাহলে তা উপস্থিত করবে: একেশ্বরবাদের এক বৈজ্ঞানিক সূত্র। তিনি দ্বৈতবাদী ও বহুত্ববাদী সমস্ত চিন্তা বিনষ্ট করেছেন।’ তাঁর উত্তরে সবাই উৎফুল্ল হয় যে আইনস্টাইন বিধাতায় বিশ্বাস করেন। তাই তাকে সংবর্ধনা দিতে হবে। কিন্তু আইনস্টাইন বিশ্বাস করেন ‘স্পিনোৎসার বিধাতায়’, ইহুদির বিধাতায় নয়; ওই বিধাতা ধর্মীয় বিধাতা নন, তিনি হয়ে ওঠেন প্রকৃতির সৃশ্যঙখল সূত্রের সমষ্টি। ‘আপনি কি বিধাতায় বিশ্বাস করেন?’-এ-লঘু প্রশ্নের উত্তর বারবার দিতে হয়েছে তাকে; এবং তিনি ঘুরিয়ে পেচিয়ে যে-সব উত্তর দিয়েছেন (তার দুটি বিখ্যাত উক্তি : ‘বিধাতা বিশ্ব নিয়ে পাশা খেলেন না’; বিধাতা সূক্ষ্ম, তবে তিনি বিদ্বেষপরায়ণ নন), সেগুলোর অর্থ দাঁড়ায় তিনি বিধাতায়-যে-বিধাতা মানুষের পাপপুণ্য স্বৰ্গনারক নিয়ে ব্যস্ত-, ও প্রত্যাদেশের মধ্য দিয়ে পাওয়া ধর্মে বিশ্বাস করেন না।
আইনস্টাইন মহাবিজ্ঞানী; কিন্তু কোনো মহাবিজ্ঞানী বিধাতায় বিশ্বাস করলেই কি প্রমাণিত হয়ে যান বিধাতা? বিজ্ঞানীরাই কি বিধাতার অস্তিত্ব সম্পর্কে চূড়ান্ত বিশেষজ্ঞ? বিধাতা সম্পর্কে শেষকথা কি শুনতে হবে বিজ্ঞানীদেরই কাছে? বিজ্ঞানীদের মুখে বিধাতা আছেন? শুনে যারা মনে করে প্রমাণিত হয়ে গেছেন বিধাতা, আর কোনো সন্দেহ নেই তাঁর অস্তিত্ব সম্বন্ধে, তারা আসলে অবিশ্বাসী; গোপনে গোপনে তারা সন্দেহ পোষণ করে তাদের ধর্মপ্রবর্তকে ও ধর্মগ্রন্থে। বিজ্ঞানীমাত্রই মুক্ত মনের মানুষের নন, বহু বিজ্ঞানী ছিলেন ও আছেন, যাঁরা অত্যন্ত কুসংস্কারগ্রস্ত; যেমন-নিউটন, ও সাম্প্রতিক সালাম। নিউটন মাধ্যাকৰ্ষণতত্ত্ব আবিষ্কার ক’রে বিধাতাকে পরিণত করেছিলেন এক অন্ধ ঘড়িপ্রস্তুতকারীতে, যে ঘড়ি তৈরি ক’রে দম দিয়ে দিয়েছে, তার আর কিছু করার নেই; কিন্তু নিজে কয়েক হাজার পাতা লিখেছিলেন ধর্মের পক্ষে; তবে তা প্রকাশ করেন নি। সালামের জন্যে আমার মায়া হয়, তাকে আমার এক করুণ প্রহসনের নায়ক ব’লেই মনে হয়। মুসলমানেরা তাকে মুসলমান ব’লে স্বীকার করতো না, কিন্তু তিনি নিজেকে মনে করতেন অন্ধ মুসলমান। খুবই সংকীর্ণ এলাকায় আজকাল কাজ করেন বিজ্ঞানীরা, কোনো এলাকায় নোবেলপ্রাপ্ত অন্য এলাকা সম্পর্কে অজ্ঞ হ’তে পারেন চৌরাস্তার মুদিটির মতোই। বিধাতা মহাজগত ঘেঁটে প্রমাণ করার বস্তু নন, তিনি ধরা পড়বেন না হাবেল টেলিস্কোপে, তাঁর ছবি ওই দূরবীক্ষণযন্ত্রের ক্যামেরা তুলতে পারবে না। বিধাতাকে মহাজগতে খুঁজতে হবে না, খুঁজতে হবে মানুষের ইতিহাসে; খুঁজে দেখতে হবে তাঁকে/ তাদের কখন সৃষ্টি করেছে মানুষ; মানুষের কোন দুঃস্বপ্ন থেকে উৎপত্তি হয়েছে তার/তাদের।
ধার্মিকেরা মনে করে আকাশমণ্ডল, ওই গ্ৰহতারাচাঁদ, প্রকাশ করছে বিধাতার গৌরব; আর ধূলোবালিপাথরজলের পৃথিবী হচ্ছে বিধাতার হস্তকর্ম। পুরোনো বাইবেল-এ এমন একটি গীত রয়েছে, ওই গীত কোনো সত্যের প্রকাশ নয়, ওই গীত জেগেছিলো মহাজগতকে বুঝতে না পারা মানুষের মনে। ওই তারকাপুঞ্জ, ওই নতুন একফালি বা পূর্ণিমার ধবধবে চাঁদ, ওই সোনালি সূর্য বিধাতার গৌরব গাইছে না, ওগুলো আমাদের চারপাশের ধুলোবালির থেকে সামান্যতম পরিমাণেও পবিত্র নয়। চাঁদে বেশ আগেই মানুষ ফেলে এসেছে তার পায়ের ছাপ। বিজ্ঞানীরা, বিশেষ ক’রে এ-বিষয়ে ভাবেন যে-বিজ্ঞানীরা, তারা কী মনে করেন বিধাতা ও বিধাতার সৃষ্টি বা হাতের কাজ সম্পর্কে? তারা মনে করেন যদি আবিষ্কার করা যেতো এমন কোনো প্রাকৃতিক সূত্র, যা বিধাতার কাজ সম্পর্কে আমাদের দিতো বিশেষ ধারণা, তাহলে ওই সূত্র হতো প্রকৃতির চূড়ান্ত সূত্র। প্রকৃতির ওই শেষসূত্র যদি বের করা যেতো, তাহলে আমরা জানতাম সে-সূত্রগুলো, যা চালাচ্ছে মহাজগতের সব কিছু। স্টিফেন হকিং এ-সূত্রগুলোকেই বলেছেন ‘বিধাতার মন’ বা ‘দণ বধভঢ় মত ঐমঢ়’। বিজ্ঞানীরা ঐমঢ় শব্দটি মাঝেমাঝে ব্যবহার করেন; তবে ওই বিধাতা কোনো বিশেষ ধর্মের বিধাতা নন; ওটি রূপক, প্রাকৃতিক চূড়ান্ত সূত্রগুলোর রূপক হচ্ছে ‘বিধাতার মন’। অনেক মানুষের মনেই বিধাতার ধারণা অত্যন্ত বিস্তৃত। ও নমনীয়: তারা সবখানেই দেখতে পেতে পারে তাদের বিধাতাকে। তাদের প্রয়োগে বিধাতা এক অস্পষ্ট ধারণা, সেটি বহুঅর্থময়। স্টিভেন হেবইনবার্গ বলেছেন, ‘আপনি যদি বলেন যে ‘বিধাতা হচ্ছেন শক্তি’, তাহলে আপনি একতাল কয়লার মধ্যে বিধাতাকে পেতে পারেন।’
বিভিন্ন ধর্মের বিধাতারা একতাল। কয়লার মধ্যে থাকেন না, পারমাণবিক ঘর্ষণের মধ্যে পাওয়া যাবে না তাঁকে/তাঁদের; তিনি/তাঁরা ছড়িয়ে থাকেন না বিশ্বের কল্পিত শৃঙ্খলা সুষমার মধ্যে। তিনি/তাঁরা নির্বিকার প্রাকৃতিক শেষসূত্র নন। তাঁকে/তাঁদের বুঝতে হবে ঐতিহাসিকভাবে, যেভাবে তাঁকে/তাঁদের কল্পনা করেছে মানুষ, যেভাবে আছেন তিনি/তাঁরা বিভিন্ন ধর্মে ও ধর্মগ্রন্থে। ওই বিধাতারা নির্বিকার নিরাসক্ত উদাসীন নন তাদের ভক্তদের সম্বন্ধে, বরং অত্যন্ত বেশি, কখনো কখনো বিরক্তিকররূপে, আগ্রহী ও আসক্ত মানুষের সব কিছুতে; আর ভক্তদের বিশ্বাসে তারা বিশ্বজগতের স্রষ্টা, বিধানকর্তা, শেষ বিচারক। তারা মানুষের অন্তরঙ্গতম ব্যাপারের ওপরও তীক্ষ্ণ চোখ রাখেন; এমনকি স্নানাগারেও নগ্ন স্নান করা যায় না, তারা উকি দেন। সেখানেও। বিজ্ঞানীরা মাঝেমাঝেই ঐমঢ় বা বিধাতা শব্দটি এমনভাবে প্রয়োগ করেন যে তার সাথে কোনো পার্থক্য থাকে না প্রাকৃতিক ধ্রুব সূত্রগুলোর। কিন্তু বিধাতা/বিধাতারা বিভিন্ন ধর্মের বিধাতা, যাদের রয়েছে বিশেষ বিশেষ নাম। ওই বিধাতাদের, যারা মানুষের জন্মমৃত্যু বিবাহ একবিবাহ বহুবিবাহ ভালোমন্দ পাপপুণ্য সঙ্গম জেনা বিহার বিপরীত বিহার প্রার্থনা উপবাস স্বৰ্গ নরক নিয়ে ভাবছেন নিরন্তর, যারা আগ্রহী আসক্ত, তাদের কি পাওয়া যেতে পারে প্রকৃতির শেষসূত্রগুলোতে? বিজ্ঞানীরা বলেন তাকে/তাঁদের পাওয়া যাবে না। প্রাকৃতিক শেষসূত্রে। বিজ্ঞানের সূত্রগুলো শীতল অবিচল নির্বিকার; মানুষ সম্পর্কে সেগুলোর কোনো আগ্রহ আসক্তি নেই, ওগুলো কোনো পাপপুণ্য স্বৰ্গনরক স্বকীয়া পরকীয়া পুজো আরাধনা উপবাস তীর্থযাত্রা জানে না। প্রতিবেশীকে ভালোবাসলে বা না বাসলে সেগুলোর কিছু যায় আসে না।
বিজ্ঞানহীন আদিম মানুষ করেছিলো মহাজগতের রহস্যীকরণ; আর বিজ্ঞান যতোই এগিয়েছে ততোই করেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ:-আকাশমণ্ডলকে উদ্ধার করেছে রহস্যজাল থেকে, করেছে মহাজগতের বিরহসীকরণ। কোপারনিকাস দাবি করেছেন। পৃথিবী মহাজগতের কেন্দ্র নয়; গ্যালিলিও প্রমাণ করেছেন কোপারনিকাস। সত্য; ব্রুনো জানিয়েছেন যে অজস্র নক্ষত্রের মধ্যে সূর্য একটি নক্ষত্ৰমাত্ৰ; নিউটন দেখিয়েছেন গতি ও মাধ্যাকর্ষণের একই সূত্র কাজ করে পৃথিবীতে ও সৌরলোকে, যে-সূত্রে গ্রহউপগ্রহ ঘোরে সেই একই সূত্রে আপেল পড়ে মাটিতে। এর ফলে ঘটতে থাকে আকাশমণ্ডলের বিরহস্যীকরণ। হাবেল এই বিরহস্যীকরণপ্রবণতাকে বেশ এগিয়ে দেন, দেখান যে মহাজগতে রয়েছে আরো অজস্ৰ নক্ষত্রমণ্ডল (১৯২৯), বাড়ছে মহাজগত। আরিস্তাতল, টলেমি ও ধর্মগ্রন্থের জগতের সীমা ছাড়িয়ে বহু দূরে চ’লে গেছেন হাবেল; কিন্ত কোথাও দেবদূত, বিধাতা, স্বর্গ নরক নামের বিখ্যাত ব্যাপারগুলো দেখতে পান নি। কোনো দিন দেখা যাবে না।
বিজ্ঞান শুধু মহাজগতকেই আদিম রহস্যজাল থেকে উদ্ধার করে নি, জীবন বা প্রাণকেও উদ্ধার করেছে। লাইবিগ, উনিশ শতকেই, দেখিয়েছিলেন যে গবেষণাগারে প্রাণের উদ্ভব ঘটানো খুবই সম্ভব। তবে চার্লস ডারউন ও আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস ঘটান কালান্তর, উল্টেপাল্টে দেন। ধর্মীয় বিশ্বাস; তাঁরা দেখােন প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলে, কোনো বিধাতার নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই, বিকশিত হ’তে পারে জীবন। জীবনকে রহস্যের জাল থেকে মুক্ত করা ধর্মীয় অনুভূতিকে অনেক বেশি আহত করে আকাশমণ্ডলকে রহস্যমুক্ত করার থেকে। ধর্মগুলো তাই পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে কোলাহল করে না, করে জীববিজ্ঞানের বিরুদ্ধে। তবে ধর্ম, বিশেষ ক’রে খ্রিস্টধর্ম বারবার নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে বিজ্ঞানের সাথে খাপ খাওয়াতে তার বিশেষ অসুবিধা হয় না, কেননা ধর্মকে টেনে নানা দিকে সুবিধা মতো ছড়ানো যায়। খ্রিস্টীয় যাজকেরা এক সময় বাধা দিতে চেষ্টা করে ডারউইনি বিবর্তনবাদকে, কেননা তা ধর্মবিরোধী; শেষে না পেরে বিবর্তনবাদকে ঘোষণা করে পরম বিধাতার মহাপরিকল্পনারূপে। বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের তাল মেলানোর এটা এক করুণ হাস্যকর উদাহরণ। সত্যিই বিরোধ রয়েছে বিবর্তনবাদ ও বিধাতার মধ্যে। বিবর্তনবাদ মেনে নিলে স্বীকার করতে হয় যে বিধাতা আদিকারণমাত্র, তিনি সূচনা করেছেন প্রাকৃতিক সূত্রগুলো, সচল করেছেন মহাজগতের সব কিছু থেকে। কিন্তু ধর্মগুলো অবসরপ্রাপ্ত বিধাতায় বিশ্বাস করে না। বড়ো কথা হচ্ছে ধর্মগুলো প্রথম দেখা দেয় নি আদিকারণ সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিদের মধ্যে, দেখা দিয়েছিলো এমন ব্যক্তিদের মনে, যারা কল্পনা করেছিলেন মানুষের সমস্ত ব্যাপারে প্রচণ্ডভাবে উৎসাহী ও আসক্ত বিধাতাদের। কিছু কিছু কপট মানুষ, বিশেষ ক’রে রাজনীতিবিদেরা ও সুবিধাবাদী বিখ্যাত ব্যক্তিরা, ব’লে থাকেন যে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই; তবে এটা মিথ্যেকথা-ধর্ম ও বিজ্ঞান সম্পূর্ণরূপে পরস্পরবিরোধী: বিজ্ঞান সত্যের সাধক আর ধর্ম মিথ্যের পূজারী।
বিজ্ঞানের সূত্রগুলোর রয়েছে সৌন্দর্য; কোনো দিন যদি আবিষ্কৃত হয় প্রকৃতির শেষসূত্র, যা ব্যাখ্যা করবে মহাজগতের সব কিছু, তাও হবে সুন্দর। তবে ওই সূত্রগুলোতে কোনো বিশেষ মর্যাদা পাবে না জীবন, মানুষ, বুদ্ধি। তাতে মিলবে না। কোনো মূল্যবোধ বা নৈতিকতা বা ধর্ম তাতে পাওয়া যাবে না কোনো বিধাতা, যিনি/যারা মানুষ সম্পর্কে সর্বদা ভাবিত চিন্তিত উদ্বিগ্ন বিনিদ্ৰ আসক্ত। বিজ্ঞান আজকাল মনে করে না যে বিধাতার অস্তিত্বের কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ রয়েছে। কোনো কোনো বিজ্ঞানী মনে করেন যে মহাজগত ভ’রে ছড়িয়ে আছে জৈব উপাদান, যার ফলে মহাজগত ভ’রেই জন্মাতে পারে বুদ্ধিমান প্রাণী। এটা এখনো অনুমান; এটা ঠিক হ’লেও তা কোনো বিধাতার পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেয় না। যতোই আবিষ্কৃত হচ্ছে মৌলিক ভৌত সূত্র, ততোই স্পষ্ট হচ্ছে যে, ওগুলোর সাথে মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই; ওগুলো মানুষের সংবাদ জানে না। প্রাকৃতিক সূত্রে মানুষ সম্পর্কে আগ্রহী কোনো বিধাতার উপস্থিতি নেই, পরিচয় নেই তার কোনো পরিকল্পনার; ওই সূত্রে মানুষের বিশেষ মূল্য নেই। ওই সূত্রের কাছে ‘অমৃতের পুত্র’, ‘সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ’ নিরর্থক। বিজ্ঞানীরা এখন ধর্ম ও বিধাতা সম্পর্কে ভাবেনই না, যদিও দু-একটি গোড়াও মিলবে। তাঁদের অধিকাংশ ধর্ম সম্পর্কে এতো অনীহ যে তাদের নাস্তিকও বলা যায় না। আজকাল যেমন রয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদীরা, তেমনি আছে ধর্মীয় উদারতাবাদীরা। ধর্মীয় মৌলবাদীরা আদিম, তারা তাদের বিশ্বাসে অবিচল, এবং অত্যন্ত ক্ষতিকর: উদারতাবাদীরা বিভ্ৰান্তিকর। উদারতাবাদীরা মনে করে মানুষ পোষণ করতে পারে নানা বিশ্বাস, এবং তাদের সবার বিশ্বাসই চম ৎকার। তারা কেউ বিশ্বাস করতে পারে পুনর্জন্মে, কেউ অপুনর্জন্মে; কেউ বিধাতার ত্ৰিত্,ে কেউ নিঃসঙ্গ একাকীত্বে; এবং সবাই বিশ্বাস করতে পারে তাদের বিধাতাই সত্য। এসবই চমৎকার তাদের কাছে। কিন্তু একটি গোলমাল রয়েছে : ধাৰ্মিকদের বিশ্বাস অবশ্যই ভুল; কিন্তু ধর্মীয় উদারতাবাদীদের এমনকি ভুলও বলা যায় না, তারা ভুলের থেকে বেশি ভুল।
১৯৮১তে স্টিফেন হকিং গিয়েছিলেন ভাটিকানের এক সম্মেলনে, যাতে ক্যাথলিক গির্জা স্বীকার করে যে গ্যালিলিওকে শাস্তি দেয়া ঠিক হয় নি; তারা অনুতপ্ত। পোপ উপদেশ দেন যে বিগ ব্যাংয়ের পর মহাজগতের বিবর্তন নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে পারেন; তবে বিগ ব্যাং নিয়ে গবেষণা করা উচিত হবে না, কেননা সেটি ছিলো সৃষ্টির মুহুর্ত, তাই সেটি ছিলো বিধাতার কাজ। পোপ বিগ ব্যাংয়ের কথা শুনেছেন, কিন্তু ওই দিন হকিং যে-বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তা শোনেন নি। তাঁর মূল বক্তব্য ছিলো স্থান-কাল সসীম, তবে তার সীমারেখা নেই: অর্থাৎ মহাজগতের শুরু নেই, কোনো সৃষ্টির মুহুর্ত নেই; তাই কোনো বিধাতাও নেই। মহাজগত সম্পর্কে নিজের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে হকিং বলেছেন :
যতোদিন আমরা মনে করেছি। মহাজগতের একটা শুরু আছে, ততোদিন আমরা মনে করতে পেরেছি যে এর একজন স্রষ্টাও আছেন। কিন্তু মহাজগত যদি হয় স্বয়ংসম্পূর্ণ, যার কোনো সীমানা নেই, তখন তার কোনো শুরু থাকে না, শেষও থাকে না; তখন শুধু থাকে মহাজগত। তখন স্রষ্টার/বিধাতার কী দরকার?
এভাবেই নষ্ট হলো আরণ্যিক নির্বোধের ভ্রান্ত দুঃস্বপন।