আমার মুখের উপর রোজির দরজা বন্ধ হয়ে গেলেও, আমার চোখের সামনে পৃথিবীর জানলা সেইদিনই খুলে গিয়েছিল। ওইদিনই বোসদা আমাকে কাউন্টারের কাজে হাতেখড়ি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, দুপুরের লাঞ্চ পার্টিটা তোমার দেখা হল না, অনেক কিছু শিখতে পারতে। যা হোক, অমন সুযোগ আরও অনেক আসবে। খাওয়ার ব্যাপারে কলকাতার নামডাক আছে। খেয়ে এবং খাইয়েই তো এখানকার লোকরা ফতুর হয়ে গেল।
কাউন্টারের কাজকর্ম বুঝিয়ে দিয়ে বোসদা একদিন বলেছিলেন, ঘন্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করতে, আর হাজার রকম লোকের দেড় হাজার রকম অভিযোগ শুনতে সবসময় হয়তো ভালো লাগবে না। কিন্তু আমার যখনই ওইরকম মানসিক অবস্থা হয়, তখনই মনকে বোঝাবার চেষ্টা করি, পৃথিবীর জানলার সামনে আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি। শাজাহানের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে পৃথিবীকে দেখবার এমন আশ্চর্য সৌভাগ্য কজনের কপালে জোটে?
পৃথিবী? আমি প্রশ্ন করেছিলাম।
পৃথিবী নয়তো কী? বোসদা বলেছিলেন। এই কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আমিই একশ দেশের পাশপোর্ট দেখেছি। জঙ্গলের উলঙ্গ আদিমরা ছাড়া এমন কোনো জাতের মানুষ এই পৃথিবীতে নেই যাদের সঙ্গে না এই শাজাহান হোটেলের স্যাটা বোসের সংযোগ হয়েছে।
কিন্তু এই কি পৃথিবী? আমি প্রশ্ন করে বসেছিলাম।
বোসদা আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, সাবধান! এখানে শুধু দেখে যাবে, কখনও প্রশ্ন করবে না। প্রশ্ন করলেই অশান্তি। পৃথিবীতে যারা চুপচাপ শুনে যায় তারা অনেক সুখে থাকে। কিন্তু যাদেরই মনে হয়েছে এটা কেন হয়? কেন মানুষ ওটা সহ্য করে? তারাই বিপদে পড়েছে। তাদের অনেকের হাড়ে দুব্বো গজিয়ে গিয়েছে।
আমি কাউন্টারের রেজিস্টারগুলো গুটোতে গুটোতে হাসলাম। বোসদা বললেন, তা বলে তোমার কোশ্চেনের উত্তর দেব না এমন নয়। আমি তো ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি আসল পৃথিবী যেন অন্যরকম হয়। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা যাঁদের দেখি তারা যেন নিয়মের ব্যতিক্রম হন। করবী গুহ বেচারী একবার আমাকে বলেছিলেন, ঘর দিয়ে বাইরের বিচার করা যায় না। ঘরের ছাগলই হোটেলে এলে বাঘ হয়ে যায়। তা করবী গুহ বলতে পারেন। ভদ্রমহিলার তো আর বই-পড়া বিদ্যে নয়। হোটেল সম্বন্ধে তার প্রত্যেকটা কথারই দাম লাখ টাকা।
করবী গুহ ভদ্রমহিলাটি কে তা আমার জানা ছিল না। বোসদা আমার মুখের ভাব দেখে বললেন, করবী গুহকে তুমি এখনও চেনোনি? এটা খারাপ খবরও বটে, আবার ভালোও বটে। অবশ্য করবী দেবী আজকাল একদম বেরোন না। বেরোলেও পিছনের সিঁড়ি দিয়ে লুকিয়ে চলে যান। ওঁর লাউঞ্জে এসে বসে থাকা বারণ—মিস্টার আগরওয়ালা জিনিসটা মোটেই পছন্দ করেন না।
আমি বোসদার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বোসদা বললেন, দু নম্বর সুইট। অর্থাৎ মিস্টার আগরওয়ালার অতিথিশালা—ইংরিজিতে গেস্ট হাউস। পার্মানেন্ট খদ্দের আমাদের। ও সুইট কস্মিকালে বাইরের কাউকে ভাড়া দেওয়া হয় না। তারই চার্জে আছেন শ্রীমতী করবী গুহ। আমাদের সহকর্মীদেরই একজন বলতে পার।
করবী সম্বন্ধে বোসদা আর কিছুই প্রকাশ করতে রাজি হলেন না। বললেন, সময়মতো সব জানতে পারবে। দু নম্বর সুইট যা-তা জায়গা নয়। আমাদের অনেকেরই উন্নতি অবনতি দু নম্বর সুইটের মেজাজের উপর নির্ভর করে।
শুনলাম, করবী গুহ একদিন বোসদাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ঘর-সংসার ছেড়ে মানুষ কবে হোটেলে থাকতে শিখল বলতে পারেন? বাড়ির বাইরে এমন বাড়ি বানাবার বুদ্ধি কবে তার মাথায় এল?
সে-প্রশ্নের উত্তর বোসদা দিতে পারেননি। কিন্তু সংসারের অনেক সেরা নাটকই যে তারপর থেকে দিনের আলোয় এবং রাত্রের অন্ধকারে পান্থশালায় অভিনীত হতে আরম্ভ করেছে, বোসদা করবী দেবীকে তা জানাতে ভোলেননি।
বোসদা পুলিসের রিপোর্টটা তৈরি করতে করতে আমাকে বললেন, হোটেল নিয়ে এদেশে প্রতিবছর ডজনখানেক উপন্যাস লেখা হয়। তার কিছু কিছু আমি পড়েছি। কিন্তু পড়তে পড়তে আমার প্রায়ই হাসি এসে যায়। দু দিন হোটেলে থেকে, তিনদিন বারে বসে এবং চারদিন পুলিস রিপোর্ট ঘাঁটাঘাঁটি করেই যদি হোটেলের অন্তরের কথা জানা যেত, তাহলে আর ভাবনার কী ছিল? হয়তো বললে বিশ্বাস করবে না, এমন একটা বই পড়েই আমার হোটেলের রিসেপশনিস্ট হবার লোভ হয়েছিল।
সায়েবগঞ্জ থেকে সবে কলকাতায় এসে হোস্টেলে রয়েছি। কলেজের খাতায় নাম লেখানো আছে, বাবার কাছ থেকে মনি-অর্ডারও আসে; কিন্তু পড়াশোনা কিছুই করি না। সবসময় নাটক-নভেল পড়ি; সিনেমা দেখি, আর বিলিতি রেকর্ডের গান শুনি। সেই সময়েই একটা হোটেল-উপন্যাস একবার হাতে এসে গিয়েছিল। সে উপন্যাসের নায়ক একজন লক্ষপতি আমেরিকান। মধ্যপ্রাচ্যের এক শেখের রাজত্বের তলায় কোটি কোটি গ্যালন তেল জমা হয়ে রয়েছে, এ-খবর তিনি কোথা থেকে পেয়েছিলেন। কিন্তু শেখ সায়েব লোকটি তেমন সুবিধের নন। বিদেশিদের তিনি তেমন সুনজরে দেখেন না। এদিকে আর একজন তৈল চুম্বক তোমরা যাকে বলল অয়েল-ম্যাগনেটশেখকে আরও বেশি পয়সার লোভ দেখিয়ে তেল সন্ধানের লাইসেন্স চাইছেন। আলোচনা চালাবার জন্যে শেষ তঁার দুজন সহকারী নিয়ে আমেরিকার এক বিশাল শহরের বৃহত্তম হোটেলে উঠেছেন। সেই হোটেলের আরও দুটি সুইট দখল করেছেন দুই দলের দুই আমেরিকান। এঁদের একজন শেখের ঘরে ঢুকলে, আর একজনের মন খারাপ হয়ে যায়। মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে ওঠে। আবার ইনি যখন তার ঘরে ঢোকেন, তখন অন্য ভদ্রলোকের রক্তচাপ ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। শক্তির এই টাগ-অফ-ওয়ারে কারুর যদি লাভ হয়ে থাকে, তিনি হোটেলের রিসেপশনিস্ট, আর তার অনুগত হল্-পোর্টার। সমস্ত হোটেলটাতে শেখ এবং এই দুই কোম্পানির প্রতিনিধি ছাড়া আর কেউ নেই। এঁদেরই ছোটাছুটি, কাঁদাকাঁদি, হাসাহাসিতে হোটেলটা বোঝাই হয়ে রয়েছে।
বোসদা বলেছিলেন, একজন কোম্পানির মালিকের একটি সুন্দরী মেয়ে ছিল। বাবার ব্লাডপ্রেসার বেড়ে যাওয়াতে, জোর করে বাবাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে, সে বাবার ঘরে রাত্রিদিন ডিউটি দিতে আরম্ভ করল। রিসেপশনিস্টের সঙ্গে তার ভাব হতে দেরি হল না। তারপর দুজনের যুক্ত বুদ্ধিতে শেখ শেষ পর্যন্ত কীভাবে এদের দিকে চলে গেলেন, কীভাবে তার মন গলে গেল তারই গল্প।
একটু থেমে বোসদা বললেন, ভেবো না, গল্পের এইটুকু পড়েই আমার হোটেলে ঢোকবার লোভ হল। এরপরেও একটা চ্যাপটার ছিল। সেই চ্যাপটারে ওদের দুজনের বিয়ে হয়ে গেল, বিয়ের দিন রাত্রে লম্বা আলখাল্লা পরে শেখসায়েব নিজে ডিনার পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং তারপর জোর করে তার নিজের রাজ্যে নববিবাহিত দম্পতিকে হনিমুন যাপন করার জন্যে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। হনিমুনের পরও রিসেপশনিস্ট ছোকরা এবং সেই ধনীকন্যা আর হোটেলে ফিরে আসেননি। কারণ শেখ সোজাসুজি জানিয়েছিলেন যে, নবগঠিত তৈল কোম্পানির রেসিডেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে এই ছোকরাটি ছাড়া আর কাউকে নিয়োগ করা চলবে না।
বোসদা এবার হেসে ফেলে বললেন, ভাবলাম, সহজে রাজত্ব আর রাজকন্যা পেতে হলে, হোটেলে চাকরি করাই বুদ্ধিমানের কাজ। হয়তো কোনো শেখের নজরে পড়ে যেতে পারি। কতদিন, কতবার তখন কলকাতার বড় বড় হোটেলগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছি। পয়সা জমিয়ে এক আধদিন ভিতরেও ঢুকেছি। পোর্টার সোজা রেস্তোরাঁর পথ দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু রেস্তোরাঁয় খাবার জন্যে তো আর আমি হোটেলে ঢুকিনি। যাঁর সঙ্গে কথা বলবার জন্যে ঢুকেছি, তিনি দেখেছি একমনে কাজ করে যাচ্ছেন। বাইরের কোনো দিকেই যেন তার আগ্রহ নেই। একদিন এক বুড়ো ভদ্রলোককে দেখেছিলাম। রিসেপশনে কাজ করছেন। দেখে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। যৌবন ও প্রৌঢ়ত্ব পেরিয়ে ভদ্রলোক আজও কাউন্টারে পড়ে রয়েছেন। কোনো তৈলচুম্বকের কন্যার নজর কি তার দিকে এই এতদিনেও পড়েনি? কিন্তু একটু পরেই নিজেকে সামলে নিয়েছি। ভেবেছি, ভদ্রলোকের হয়তো তেমন বুদ্ধি নেই; কিংবা হয়তো ভদ্রলোক বিয়ে করেই চাকরিতে ঢুকেছিলেন-ফলে জলের মধ্যে বাস করেও তৃষ্ণায় শুকিয়ে মরছেন। আমার জানাশোনা এক মামাকে ধরে হোটেলে ঢোকবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু মামা শুনেই আমাকে মারতে এসেছিলেন। বাবাকে তখনি টেলিগ্রাম করে দেবেন ভয় দেখিয়েছিলেন।
মামাকে বোঝাবার জন্যে বোসদা যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন। মামা বলেছিলেন, জেনেশুনে কোনো ভালো ছেলে কখনও হোটেল লাইনে আসে? এখানে ছুটি নেই, ভবিষ্যৎ নেই এবং সত্যি কথা বলতে কি আত্মসম্মানও নেই।
মামাকে ভেজাবার জন্যে বোসদা বলেছিলেন, মানুষকে দেখতে চাই আমি; মানুষের সেবা করতে চাই।
তাহলে এই হোঁতকা সুস্থ সবল লোকদের সেবা করে মরতে যাবি কেন? আই-এস-সিটা পাস করে মেডিক্যাল কলেজে ঢুকে পড়। রোগীর সেবা কর, পুণ্য হবে এবং মানুষের উপকার হবে।
বোসদা মামাকে সব বোঝাতে পারেননি। সুযোগ বুঝে একদিন সোজা শাজাহান হোটেলে চলে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিল হবস সায়েবের একখানা চিঠি। হবস সায়েবের সঙ্গে একদিন হঠাৎ আলাপ হয়ে গিয়েছিল। বাসের আগ্রহ দেখে চিঠি লিখে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, মাই ডিয়ার বয়, তুমি দেখতে সুন্দর, তোমার সুপারিশের দরকার হবে না। অ্যারিস্টটল বলেছেন—a beautiful face is better than all the letters of recommendation in the world–দুনিয়ার সমস্ত সুপারিশপত্রের চেয়ে সুন্দর মুখের কদর অনেক বেশি।
আমাদের কথার মধ্যেই হঠাৎ হ-পোর্টার কাউন্টারের কাছে ছুটে এল। চোখ তুলে দেখলাম, কালো চশমা পরে নিজের ব্যক্তিত্বকে যথাসম্ভব ঢাকা দিয়ে এক মধ্যবয়সী বাঙালি ভদ্রমহিলা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। তাঁর হাতেও একটা কালো রংয়ের ভ্যানিটি ব্যাগ। ভদ্রমহিলার বয়স নিশ্চয়ই অর্ধশতাব্দীতে ছুই ছুঁই করছে। কিন্তু মেজেন্টা রংয়ের ঢলঢলে সিল্কের শাড়ি, বগলকাটা ব্লাউজ এবং দেহের চলচপলার-চকিত-চমক যেন এই অর্ধ-শতাব্দীর অস্তিত্ব কিছুতেই স্বীকার করতে রাজি হচ্ছে না। বোসদা ফিসফিস্ করে বললেন, মিসেস পাকড়াশী।
চটুল-জঙ্ঘিনী মিসেস পাকড়াশী কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালেন। হাজার জনের আনাগোনার এই কেন্দ্রে আসতে তিনি যে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না, তা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এখানে না দাঁড়িয়ে তিনি যদি সোজা কোনো ঘরে চলে যেতে পারতেন, তা হলে বোধহয় খুবই খুশি হতেন। আরও খুশি হতেন যদি সামনের দরজা দিয়ে তাকে যেতে না হত। যদি পিছনে অন্য কোনো স্বল্পালোকিত পথে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকত তাহলে তো কথাই ছিল না।
কোনোরকম ভণিতা না করে মিসেস পাকড়াশী ফিসফিস করে বোসদাকে প্রশ্ন করলেন, আজ রাত্রে একটা ঘর পাওয়া যাবে?
বোসদা অভিবাদন জানিয়ে বললেন, দয়া করে একবার ফোন করে দিলেন না কেন? আমি সব ব্যবস্থা করে রেখে দিতাম।
মিসেস পাকড়াশী বললেন, আপনাকে বলতে আপত্তি নেই। ভেবেছিলাম আসাই হবে না। খুকু আর সব্যসাচীর আসবার কথা ছিল। তা মেয়ে আমার এই দেড়ঘণ্টা আগে ফোন করে জানালেন, জামাইয়ের সর্দি হয়েছে, আসবেন না।
মিসেস পাকড়াশী এবার নখটা দাঁতে খুঁটতে খুঁটতে বললেন, রবার্ট তা হলে এখনও আসেনি। আমি ভেবেছিলাম, এতক্ষণে ও চলে আসবে।
বোসদা বললেন, না, আসেননি তো। কোনো খবরও পাঠাননি।
মিসেস পাকড়াশী যেন একটু লজ্জিতভাবে বললেন, রবার্ট কমনওয়েলথ সিটিজান। আপনার পুলিসের হাঙ্গামা পোয়াতে হবে না।
আরে, মিসেস পাকড়াশী যে! হোটেলের ভিতর থেকে স্যুটপরা এক ভদ্রলোক বেরোতে গিয়ে ওঁকে দেখেই কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
মিসেস পাকড়াশীর মুখ যেন মুহূর্তের মধ্যে নীল হয়ে উঠল। কী উত্তর দেবেন বুঝতে পারছেন না। কোনোরকমে তিনি বললেন, আপনি এখানে!
ভদ্রলোক বিনয়ে গলে গিয়ে বললেন, আর বলবেন না। আজ যে ড্রাই-ডে আমার খেয়ালই ছিল না। আপিসে একমনে কাজ করে গিয়েছি। তারপর ওখান থেকে সোজা এখানে চলে এসেছি। এসে বার-এর দরজা বন্ধ দেখে খেয়াল হল, হিসেবে গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছে। গবরমেন্টের এই সিলি নিয়মের কোনো মানে হয়? শুধু শুধু কতকগুলো শুচিবাইগ্রস্ত লোকের পাল্লায় পড়ে গবরমেন্ট নিজেদের আয় কমাচ্ছে। অথচ ন্যাশনাল ডেভলপমেন্টের জন্যে এখন টাকা চাই। এক্সাইজ রেভিনিউ বাড়ানো চাই। বাড়িতে যে একটু ব্যবস্থা করব, তারও উপায় নেই। গৃহিণী বলেন, ছেলে-মেয়েরা বড় হয়ে উঠছে।
ভাবা গিয়েছিল ভদ্রলোক এবার নিজের কথাতেই মেতে থাকবেন। মিসেস পাকড়াশীকে আর প্রশ্ন করতে পারবেন না। কিন্তু ভদ্রলোক এবার বললেন, আমাদের কথা ছেড়ে দিন। রাত্রে এখানে আপনি?
মিসেস পাকড়াশী আমতা আমতা করে বললেন, একটা এনকোয়ারি।
বোসদা যেন ইঙ্গিতটা লুফে নিলেন। বললেন, আপনাকে তো বললাম, ব্যাংকোয়েট রুম ওই দিন পাওয়া শক্ত হবে। আপনাদের মহিলা সমিতির মিটিং-এর দিনটা পিছিয়ে দিন।
ভদ্রলোক এগিয়ে এসে আবার মিসেস পাকড়াশীর ব্রিফ গ্রহণ করলেন। বলছেন কী? আপনি কার সঙ্গে কথা কইছেন জানেন? মাধব পাকড়াশীর ওয়াইফ ব্যাংকোয়েট হল পাবেন না?
বোসদা বললেন, দেখছি, স্যরি। আমি চেষ্টা করে দেখছি।
ভদ্রলোক বললেন, চলুন, মিসেস পাকড়াশী, একসঙ্গে ফেরা যেতে পারে।
বোসদা গম্ভীরভাবে বললেন, ম্যাডাম, এতই যখন দেরি করলেন, তখন আর একটু অপেক্ষা করুন। আমাদের ম্যানেজার মিস্টার মার্কোপোলো এখনই এসে পড়বেন।
মিসেস পাকড়াশী বললেন, অসংখ্য ধন্যবাদ, মিস্টার চ্যাটার্জি। আমি আর একটু অপেক্ষা করে যাই। আপনিও তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যান—একদিন না হয় ড্রিঙ্ক না-ই করলেন।
ওই আপনাদের স্বভাব। সব মেয়ের এক রা—ড্রিঙ্ক করো না, ড্রিঙ্ক করো। ভদ্রলোক শুভরাত্রি জানিয়ে গটগট করে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলেন।
মিসেস পাকড়াশী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, কৃতজ্ঞ নয়নে বোসদার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু কোনো কথা বলতে পারলেন না। খাতাপত্তর পরীক্ষা করে বোসদা বললেন, ম্যাডাম, আপনি এক নম্বর সুইটে চলে যান। রবার্টসন নিশ্চয়ই একটু পরেই চলে আসবেন।
মিসেস পাকড়াশী ইতস্তত করতে লাগলেন। খাতায় সই?
বোসদা বললেন, আপনি ও-নিয়ে চিন্তা করবেন না। রবার্টসনকে দিয়ে আমি সই করিয়ে নেব।
মিসেস পাকড়াশী এবারও কথা বলতে পারলেন না। তার কালো চশমার মধ্যে দিয়ে আর একবার বোসদার দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিপাত করলেন। বোসদা জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের সাপার?
হলে মন্দ হত না। মিসেস পাকড়াশী বললেন।
আপনারা কি ডাইনিং রুমে আসবেন?
না, ঘরেই সার্ভ করুক। আমি একটু সলিটিউড় চাই, একস্ট্রা সার্ভিস চার্জ বিলে ঢুকিয়ে দেবেন।
বোসদা বললেন, একটু অপেক্ষা করুন, মেনু কার্ডটা আনিয়ে দিচ্ছি। মিসেস পাকড়াশী বললেন, কিছু নয়, শুধু একটু হট চিকেন সুপ।
সে কি! সামান্য একটু ফিশ প্রিপারেশন?
পাগল! এতেই যেভাবে ওজন বেড়ে যাচ্ছে। বলে মিসেস পাকড়াশী কাউন্টার থেকে এগিয়ে গেলেন।
বোসদা কিছুক্ষণ গম্ভীর থেকে পূর্ববঙ্গীয় কায়দায় বললেন, হায় রে, স্লিম-হওন-প্রয়াসী! আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বোসদা বললেন, হয়তো তোমার বিশ্বাস হবে না। কিন্তু জানো, মিসেস পাকড়াশী অত্যন্ত গোঁড়া ছিলেন। খুব গরিব ঘরের মেয়ে কিনা উনি।
রবার্টসন নামের ইংরেজ ছোকরা পনেরো মিনিট পরেই আসরে অবতীর্ণ হলেন। খাতায় সই করে দিয়ে রবার্টসন যখন উপরে চলে যাচ্ছিলেন, তখন বোসদা জিজ্ঞাসা করলেন, সাপার পাঠিয়ে দিতে হবে নাকি? মিসেস পাকড়াশী হট চিকেন স্যুপের অর্ডার দিয়েছেন।
রবার্টসন বললেন, আমার সাপার চাই না। কোনো অ্যালকহলিক ড্রিঙ্কের ব্যবস্থা সম্ভব কিনা তাই বলুন। যদি সামান্য একটু বেশি খরচ লাগে তা বলতে যেন দ্বিধা করবেন না।
বোসদা দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, কোনো উপায় নেই। একসাইজের নিয়মভঙ্গ করা শাজাহানের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন হোটেলের পক্ষে সম্ভব নয়।
ভদ্রলোক হতাশ মনে লিফটে উপরে উঠে গেলেন। আমি বোসদাকে প্রশ্ন করলাম, ড্রাই-ডেতে মিসেস পাকড়াশী এমন অ্যাপয়েন্টমেন্ট না-করলেই পারতেন।
তুমিও যেমন। উনি তো দেখে দেখে ড্রাই-ডে পছন্দ করেন। ড্রাই-ডেতে হোটেলগুলো ঝিমিয়ে পড়ে। লোকজনের যাতায়াত একরকম থাকে না বললেই চলে। ওইদিনই তো ওঁর পক্ষে নিরাপদ। ড্রাই-ডে এখন সপ্তাহে একদিন। শুনছি ওটা ক্রমশ বাচ্চা পাড়তে আরম্ভ করবে। এক দুই হবে; দুই চার হবে। এমনি করে একদিন সপ্তাহের সাতটা দিনই শুকনো হয়ে যাবে। তখন কী যে হবে!
শুকনো দিনের পরেই ভিজে দিন। সেই ভিজে দিনের ভোরেই অর্থাৎ রাত চারটে থেকে আমার স্পেশাল ডিউটি ছিল। কাউন্টারে চুপচাপ একা দাঁড়িয়ে ছিলাম। কাজের মধ্যে কেবল জাপান থেকে আসা কয়েকজন আকাশযাত্রীকে স্বাগত জানানো। তাদের থাকবার ব্যবস্থা কলকাতার এক খ্যাতনামা ট্রাভেল এজেন্সি আগে থেকেই করে রেখেছিল। ট্রাভেল এজেন্সির এক ছোকরাও সঙ্গে ছিল।
ট্রাভেল এজেন্সি আমাদের বহু অতিথি পাঠান। কিন্তু ম্যানেজার মনে মনে তাদের খুব পছন্দ করেন না। কারণ খুবই সহজ। আমাদের হোটেলে যে তারা খদ্দের পাঠালেন, তার পরিবর্তে বিলের শতকরা দশভাগ তাদের পাওনা। তাছাড়া চেকটা প্রায়ই খদ্দেরদের কাছে পাওয়া যায় না। অতিথিরা খাওয়া-দাওয়া, হই হই হট্টগোল আর স্ফুর্তি করে বিদায় নেন। আমরা হিসেব রেখে ট্রাভেল এজেন্টের কাছে বিল পাঠাই। তারা তখন নিজেদের অংশটি কেটে রেখে চেক দেন।
ট্রাভেল এজেন্সির ছোকরা যখন বিদায় নিল, তখন চারটে বেজে কয়েক মিনিট। তার ঠিক পরেই সিঁড়ি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যিনি নেমে এলেন তিনি মিসেস পাকড়াশী। ঘুম থেকে উঠে মিসেস পাকড়াশী বোধহয় চুলগুলো ঠিক করে নেননি। অথচ কালো চশমাটা পরে ফেলেছেন।
ধীর পদক্ষেপে এগোতে এগোতে মিসেস পাকড়াশী একবার কাউন্টারের দিকে তাকালেন। বোধহয় বোসদার খোঁজ করলেন। আমি বললাম, গুড মর্নিং, ম্যাডাম। মিসেস পাকড়াশী যেন শুনতেই পেলেন না। আপন মনে হাতের ব্যাগটা জড়িয়ে ধরে বাইরে চলে গেলেন। রাত্রের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে শাজাহান হোটেলের দারোয়ানজির হুইসলের আওয়াজ শুনতে পেলাম। এই হুইসলের শব্দেই দারোয়ানজি ট্যাক্সি ডেকে পাঠান।
মিসেস পাকড়াশীর পরই যার সঙ্গে আমার দেখা হল সে নিউ মার্কেটের এক ফুলের দোকানের কর্মচারী। হাতে একগোছা বিভিন্ন রকমের ফুল। তখন বুঝিনি, পরে জেনেছিলাম ওগুলো ফুলের নমুনা। সে দু নম্বর সুইটের মেমসায়েবের সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। লোকটাকে করবী দেবীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। তিনি ফুল পছন্দ করে দিয়েছেন।
ও ঘরের ওই প্রাত্যহিক সূচি পরে আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। আমাদের কাছে সুইটের অন্য খাতির। যে ঘরে শুধু বিছানা আছে, তার নাম রুম। আর রুমের সঙ্গে একটা বসবার ঘর থাকলেই সেটা হয়ে গেল সুইট। হাসপাতালে জেনারেল বেডের সঙ্গে কেবিনের মর্যাদার যা তফাত, হোটেলের রুম এবং সুইটেরও সেই পার্থক্য। কেবিনেরও যেমন জাতিভেদ আছে, সুইটেরও তেমনি। দু নম্বর সুইটেরও জাত আলাদা। দু নম্বরের আলাদা ফোন আছে, এবং ঘরের মধ্যে একাধিক ঘর আছে। ঘর সাজাতে প্রতিদিন অনেক ফুল লাগে। করবী দেবী নিজে ফুল পছন্দ করেন। ফুল পছন্দর পরই লিনেন ক্লার্ক নিত্যহরি ভট্টাচার্য পেন্সিল আর কাগজ নিয়ে করবী দেবীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। শাজাহান হোটেলে যত চাদর লাগে, পর্দা লাগে, টেবিলক্লথ লাগে, তার রাজাধিরাজ হলেন নিত্যহরিবাবু। সবাই বলে, নিত্যহরিদা ভাগ্যবান লোক।
নিত্যহরিদা বলেন, তা নয়! বাউনের ছেলে হয়ে ধোপর কাজ করছি, এর থেকে ভাগ্য আর কী হবে! বাবা তখন কতবার বলেছিলেন, নেত্য, মন দিয়ে পড়াশোনা কর। তা নেত্যর সে-কথা কানে গেল না। নেত্য তখন ফুটবল, যাত্রা, গান, পান, বিড়ি নিয়ে পড়ে রইল। এখন নেত্য বুঝছে। দুনিয়ার লোকের পরা কাপড় বয়ে বেড়াচ্ছে। হিসেব করছে। ময়লা কাপড় ফরসা করে আবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে।
নিত্যহরিদা আরও বলেন, গুরুবাক্যি অমান্য করলে এই হয়। একেবারে হাতেহাতে ফল। কে জানে গত জন্মে বোধহয় ধোপার কাপড় চুরি করেছিলাম। নইলে এমন শাস্তি ভগবান কেন দেবেন?
বেয়ারারা ওঁকে দেখতে পারে না। তারা বলে, পরের জন্মে তাহলে তোমার কী যে হবে জানিনে। চুরি করে তো ফাঁক করে দিলে। বাপের দূরদৃষ্টি ছিল। নামটা ঠিকই দিয়েছিল—নিত্য হরণ করে যে সে নিত্যহরি।
সায়েবরা বলেন, ন্যাটা। স্যাটা এবং ন্যাটা দুজনেই কর্তাদের প্রিয়। মার্কোপোলো মাঝে মাঝে আদর করে বলেন, স্যাটাহারি ও ন্যাটাহারি। গুপ্ত সংবাদ পরিবেশনে ন্যাটাহারির প্রতিপত্তি মাতাহারির থেকেও বেশি। ন্যাটাহারিবাবু কানে পেন্সিলটা গুঁজে করবী দেবীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে প্রথমেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন। করবী দেবী সভয়ে পিছিয়ে যান। কী করেন, কী করেন!
ন্যাটাহারিবাবু দমবার পাত্র নন। বলেন, না মা। তুমি সাক্ষাৎ জগজ্জননী। হাঁপের টানে কতদিন ভুগলাম। তারপর, ভাগ্যে বাবা তারকেশ্বর স্বপ্নে বললেন, তোর হোটেলেই চিকিচ্ছে রয়েছে। আর মা, তোমাকে সেই প্রণাম করার পর থেকেই বেশ ভালো আছি। হাঁপানি নেই বললেই চলে।
করবী গুহ বিষণ্ণ মুখটা হাসিতে ভরিয়ে বলেন, আজ যে ফুল আনতে দিয়েছি, তার সঙ্গে ম্যাচ করবে হালকা বাসন্তী রং। পর্দা, টেবিলক্লথ, বেডশিট, টাওয়েল সব ওই রংয়ের চাই। আপনার স্টকে আছে তো?
কান থেকে পেন্সিলটা বার করতে করতে ন্যাটাহারিবাবু বললেন, কী যে বলেন মা লক্ষ্মী। নিত্যহরি যতক্ষণ আছে ততক্ষণ সব পাবেন। প্রতিমুহূর্তে খিটখিট করি বটে। কিন্তু না করলে এই আড়াইশো ঘর কি সাজিয়ে রাখতে পারতাম? তবে মা, সে রামও নেই, সে অযোধ্যা নেই। তখন সায়েসুবোরা আসত, এ-সবের কদর বুঝত। প্রতিদিন বেড়শিট চেঞ্জ হত। এখন একদিন ছাড়া ছাড়া।
করবী দেবীর এ-সব শুনতে ভালো লাগে না। কিন্তু সকৌতুক প্রশ্রয় দিয়ে ন্যাটাহারিবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর মৃদু হেসে বলেন, জিনিসগুলো তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দেবেন।
এখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমার তো সব মুখস্থ, কোথায় রেখেছি। এখন এরা বুঝবে না। যদি কোনোদিন পালাই, কিংবা কামাই করি তখন এরা আমার কদর বুঝবে।
নিত্যহরিবাবু তার প্রাত্যহিক ইন্টারভিউ সেরে আমার চোখের সামনে দিয়ে উপরে চলে গেলেন। হোটেলের কাজকর্ম ইতিমধ্যে জমে উঠেছে। রোজি নিচেয় নেমে এসে জিমির ব্রেকফাস্টের মেনুকার্ডগুলো টাইপ করতে আরম্ভ করেছে।
এক নম্বর সুইটের রবার্টসন তখনও বোধহয় নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। আমি আন্দাজ করেছিলাম, ভদ্রলোকও মিসেস পাকড়াশীর সঙ্গেই হোটেল থেকে সরে পড়বেন।
ভদ্রলোক যে বহুকাল বাঁচবেন তা পরমুহূর্তেই বুঝলাম। বেয়ারা এসে বলল, এক নম্বর সুইটের সায়েব আপনাকে ডাকছেন।
কাউন্টার ছেড়ে রেখে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু রোজি আজ আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে। আমি যে সত্যিই মিস্টার ব্যানার্জির ব্রাদার-ইন-ল নই তো যেন সে ক্রমশ বিশ্বাস করছে।
রোজি বললে, ম্যান, এখানে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকো না। এক নম্বর সুইটের গেস্ট কমপ্লেন করলে আর চাকরি করে খেতে পারবে না।
আমি বললাম, আপনার তো তাতে সুবিধেই হবে।
মুখ রাঙা করে রোজি বললে, আমি অনেকদিন বেকার ছিলাম। আমার দুটো বোন বেকার বসে রয়েছে। আমার বাবার চাকরি নেই। চাকরি না থাকা কি জিনিস তা আমি বুঝি, ম্যান। যেহেতু আমি কিন্তলী, যেহেতু আমি একটা হাফ-নো লোকের সঙ্গে পালিয়েছিলাম, সেহেতু আমার অনুভব-শক্তি থাকতে পারে না?
রোজি হাসল। ভোরবেলার সেই হাসির মধ্যে প্রচ্ছন্ন বেদনা ছড়িয়ে ছিল। কেন জানি না, সেই প্রসন্ন প্রভাতে রোজিকে আমার হঠাৎ সুন্দর বলে মনে হল।
রোজি আমাকে সরিয়ে দিয়ে বললে, যাও, ওখানে দেখা করে এসো ততক্ষণ আমি কাউন্টার পাহারা দিতে পারব।
বেয়ারাকে সঙ্গে করে, আমি এক নম্বর সুইটের সামনে এসে যখন দাঁড়ালাম, তখন করিডরে বসে বেয়ারারা জুতো পরিষ্কার করছে। জুতোর তলায় সাদা খড়ি দিয়ে দাগ দিচ্ছে। দাগ দেওয়ার উদ্দেশ্য তখনও জানতাম না। দাগ দিয়ে ঘরের নম্বর না-দিলে জুতো গোলমাল হয়ে যায়, দুশো নম্বর ঘরের জুতো দুশো দশ-এ গিয়ে হাজির হয়। নিজের সু পায়ে গলাতে গিয়ে, হোঁতকা সায়েব দেখেন সেখানে কোনো ক্ষীণকায়া মহিলার হাইহিল জুতো পড়ে রয়েছে। আর সুন্দরী মেমসায়েব ঘুম থেকে উঠে নিঃসঙ্গ বিছানার পাশে রবারসোল ভারী বুট দেখে আঁতকে ওঠেন। আমাদেরই হোটেলে একবার ঘরের মধ্যে বুটজোড়া দেখে এক কুমারী মেম-সায়েব হেলপ হেলপ বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, বুটের মালিকও বোধহয় ঘরের মধ্যে কোথাও লুকিয়ে রয়েছেন। বেয়ারা ছুটে আসে। ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে ব্যাপারটা বুঝতে পারে। তাড়াতাড়ি গোলমালটা শুধরে নেয়। না-হলে হয়তো গণ্ডগোলটা অনেকদূর গড়াত, এবং গড়াতে গড়াতে মার্কোর কানে পৌঁছলে নিশ্চয়ই চাকরি যেত। এই গণ্ডগোলের পর থেকেই জুতো বার করবার সময় তলায় খড়ি দিয়ে ঘরের নম্বর লিখে রাখার ব্যবস্থা চালু হয়।
বাইরে থেকে এক নম্বর সুইটের দরজায় নক্ করে আমরা দুজন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। ভিতর থেকে শব্দ হল—কাম ইন। ভিতরে ঢুকে যাকে সুপ্রভাত জানালাম তিনি একটা ফর্সা হাতকাটা গেঞ্জি এবং একটা খর্বাকৃতি জাঙিয়া পরে বিছানার উপর বসেছিলেন। আমাদের দুজনকে দেখে তাঁর কোনোরকম চাঞ্চল্য দেখা দিল না। ঠিক সেইভাবেই বসে থেকে বললেন, মিস্টার বোস কোথায়?
বললাম, তিনি এখনও ডিউটিতে আসেননি।
একটু লজ্জা পেয়ে, আস্তে আস্তে বললেন, গতরাত্রে এ-ঘরে সারারাত দুজনে আমরা ছটফট করেছি। বালিশ কম ছিল। ডবল বেডে রুমে মাত্র একটা বালিশ। আমি রাত্রেই কমপ্লেন করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার কমপ্যানিয়ন বারণ করলেন।
বললাম, অত্যন্ত দুঃখিত। আপনি বললে তখনই বালিশের ব্যবস্থা করে দিতাম। আমি এখনই বালিশ আনিয়ে দিচ্ছি।
ভদ্রলোক উঠে পড়ে আলমারি থেকে একটা ট্রাউজার বার করতে করতে বললেন, তার দরকার নেই। আমার কমপ্যানিয়ন অনেকক্ষণ চলে গিয়েছেন। আমিও এখনি বেরিয়ে যাচ্ছি। আমি ডেকেছি অন্য কারণে। এই খামটা উনি আপনাদের মিস্টার বোসের হাতে দিতে বলে দিয়েছেন। ওঁকে মনে করে দিয়ে দেবেন।
জানতে চাইলাম, সুইটটা আজও ওঁদের জন্যে রিজার্ভ থাকবে কিনা। সায়েব বুশশার্টটা পরতে পরতে বললেন, এখনও ঠিক জানি না। পরে মিস্টার বোসকে ফোন করতে বলবেন।
ঘর থেকে বেরিয়ে, কাউন্টারে এসে দেখলাম সত্যসুন্দরদা ইতিমধ্যে শাজাহান হোটেলের হাল ধরেছেন। তাকে বললাম, ভদ্রমহিলা আপনাকে এই খামটা দিয়ে গিয়েছেন। আর ঘরে বালিশের সংখ্যা কম ছিল। ওঁদের বেশ অসুবিধে হয়েছে।
খামটা খুলে ভিতরে উঁকি মেরে বোসদা বললেন, ভদ্রমহিলা আমাকে সত্যিই লজ্জায় ফেলছেন। যার যা খুশি দুনিয়াতে করছে। মিসেস পাকড়াশীও বাদ যাবেন কেন? আমি এত ইতর নই যে, এই কুড়ি টাকা না পেলে রেজিস্টারে ভদ্রমহিলার নাম বসিয়ে দেব।
এবার আমাকে বললেন, গেস্টদের অভিযোগগুলো এনকোয়ারি করাটা খুব প্রয়োজনীয় কাজ। মার্কোপোলোকে বললে, এখনি নিত্যহরিবাবুকে তাঁর ফোর্টিনথ জেনারেশনের নাম ভুলিয়ে ছাড়বেন। তুমি ওঁকে একটু বলে এসো। আফটার অল্ মিসেস পাকড়াশীর স্বামীর এই হোটেলটার উপর নজর আছে। যে-কোনোদিন বোর্ডে ঢুকতে পারেন।
ন্যাটাহারিবাবু যে কোথায় থাকেন, কোথায় তার স্টোর রুম আমার জানা ছিল না। সামনে পরবাসীয়া ঘোরাঘুরি করছিল। তাকে সঙ্গে করেই আবার উপরে উঠতে আরম্ভ করলাম। যাবার পথে মিসেস পাকড়াশীর সঙ্গীকে খালি হাতে নেমে আসতে দেখলাম। ভদ্রলোক গতকাল রাত্রে কিছু না নিয়েই হোটেলে এসে উঠেছিলেন।
এই বাড়িটা যেন একটা শহর। এখানে এত ঘর আছে, এত বারান্দা আছে। এবং এত গলিখুঁজি আছে যে, চিনে নিতে বহু সময় লাগে। চেনার যেন শেষ হয় না। তিন তলায় উঠে লম্বা করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দুদিকে কেবল বন্ধ ঘরের দরজা ও পিতলের নম্বর দেখে মনে হচ্ছিল, ঘরগুলোতে যেন কেউ নেই। থাকলেও তারা সবাই অঘোরে ঘুমিয়ে রয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় কার্পেটের পথ শেষ হয়ে গেল। ডানদিকে একটা বন্ধ দরজা রয়েছে। ভেবেছিলাম, ওটাও হয়তো ঘর। কিন্তু পরবাসীয়া হাতলটা ঘুরোতে বুঝলাম আর একটা পথ শুরু হল। দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে আমরা হেঁটে চলেছি। দুধারে আবার ঘরের সারি। এই ঘরগুলো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত নয়। পথটাও যেন হঠাৎ একটু নিচু হয়ে গিয়েছে।
পরবাসীয়ার কাছে শুনলাম, এইটাই হোটলের সবচেয়ে পুরানো অংশ। সিম্পসন সায়েব নিজে এই দিকটা তৈরি করেছিলেন। আজও তিনি এই দিকটায় বেশি ঘোরাঘুরি করেন।
দুএকটা ঘরে দরজা সামান্য খোলা রয়েছে। তার ফাঁক দিয়ে হাঁটবার পথে বিশেষ কিছুই দেখা যায় না। শুধু মাথার উপর যে পাখা ঘুরছে তা দোদুল্যমান ছায়া থেকে বোঝা যাচ্ছে। রেডিওর চাপা শব্দও দু একটা ঘর থেকে কানে আসছে। একটা ঘরে দুজন জাপানি ভদ্রলোক দুমগ বিয়ার নিয়ে বসে আছেন। তার পাশের ঘরেই এক আমেরিকান পরিবার। তার পরের ঘরে পাঞ্জাবের সর্দারজী পাগড়ি এবং দড়ির জাল খুলে মাথায় হাওয়া লাগাচ্ছেন। তার পাশের ঘরে নিশ্চয় বার্মার লোক—পরনে লুঙি। বিভিন্ন ভাষায় বাক্যালাপের কয়েকটা ভাঙা টুকরো আমার কানের কাছে ঠিকরে এল। যেন একটা অল ওয়েভ রেডিও নিয়ে আমি ছেলেমানুষের মতো চাবিটা ঘুরিয়ে যাচ্ছি এবং মুহূর্তের জন্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভাষার ভগ্নাংশ কানে পৌঁছতে না পৌছতেই অন্য ভাষার স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে।
এরই মধ্যে হঠাৎ যেন জীবনের সামান্য সন্ধান পেলাম। একটা বাচ্চা ছেলে দার্শনিকের মতো নিস্পৃহভাবে নিজের দেহের বস্ত্রের ভার সংক্ষেপ করবার চেষ্টা করছে। জামাটা খুলে ফেলেছে। প্যান্টটা খোলবার চেষ্টা করেও সে পেরে উঠছে না। চিনে বাচ্চা। সে হঠাৎ টলতে টলতে এসে আমার হাতটা চেপে ধরল। একটু হাসল। তার কথা বুঝি না। কিন্তু ইঙ্গিতেই সমস্ত ব্যাপারটা বোঝা গেল। বেচারা প্যান্টটা ভিজিয়েছে। কার্পেটের খানিকটাও সপসপে করে ফেলেছে।
পরবাসীয়া হাঁ হাঁ করে উঠল। বললে, কার্পেটটা এই সব পাজি ছেলেদের জন্যে থাকবে না। একবার এক জার্মান খোকা নাকি কার্পেটের উপরই প্রকৃতির বৃহত্তর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ফেলেছিল। এই পরবাসীয়াকেই আবার নাক টিপে সুইপারকে ডাকতে হয়। সেই থেকেই পরবাসীয়া বাচ্চা ছেলেদের ভয় পায়।
বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিতে যাচ্ছিলাম। পরবাসীয়া আমাকে এমনভাবে টেনে ধরল যেন আমি একটা তাজা বোমাকে মাথায় তুলে নিতে যাচ্ছিলাম। বললে, বাবু, এই চিনা বাচ্চাদের রকমসকম আমি বুঝি না। ওর আরও দুষ্টুবুদ্ধি আছে। এখনই হয়তো আবার জমাদারকে ডাকতে হবে।
বাচ্চাটা তখন টলতে টলতে নিজের ঘর খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ঠিক বুঝতে পেরে সে হঠাৎ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। পরবাসীয়াকে নিয়ে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে এক চিনা ভদ্রলোক আর মহিলাকে পাওয়া গেল।
তারা ইংরেজি জানেন না। বাচ্চাটাকে না পেয়ে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। শ্রীমান যে কখন দরজা খুলে হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের এই কোণে হাজির হয়েছেন বুঝতে পারেননি। তারা চিনে ভাষায় আরও কীসব ধন্যবাদ জানাতে লাগলেন। পরবাসীয়া আন্দাজে সেসব বুঝে নিয়ে, নিজস্ব উৎকল ভাষায় মাকে প্রচুর বকুনি দিতে লাগল। এবং এই কলকাতা শহরটা যে সুবিধের নয়, এখানে ছেলেধরার যে অভাব নেই তা বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগল।
ঘর থেকে বেরিয়ে পরবাসীয়া বললে, আমার লেনিনবাবুকে সন্দেহ হয়। কলকাতার এই শাজাহান হোটেলে কমরেড লেনিন আবার কোথা থেকে হাজির হলেন? কিন্তু পরবাসীয়ার পরের কথায় বুঝলাম, লেনিনবাবু আর কেউ নন, লিনেন ক্লার্ক নিত্যহরিবাবু।
নিত্যহরিবাবুর নাকি ছেলেদের উপর খুব লোভ। সুযোগ পেলেই বাচ্চাদের ঘর থেকে নিয়ে গিয়ে নিজের ঘরে বসিয়ে রাখেন। তাদের সঙ্গে আড্ডা দেন। এমন আচ্ছা, যাতে কোনো ভাষা দরকার হয় না। নিজের চাদর, বালিশ, বিছানা, ন্যাপকিনের হিসেব করতে করতে নিত্যহরিবাবু মুখভঙ্গি করেন, ছেলেদের কাতুকুতু দেন; উপর থেকে বিছানার উপর লাফিয়ে পড়েন, আর ছেলেরা হই হই করে ওঠে। এর জন্যে দু-একবার নিত্যহরিবাবু বকুনিও খেয়েছেন।
আমাকে দেখেই নিত্যহরিবাবু রেগে উঠলেন, দাঁড়ান মশায়। আমার এদিকে বাইশখানা তোয়ালে কম পড়ছে, আর আপনি এখন এলেন কথা বলতে।
চোখে একটা চশমা লাগিয়ে ভদ্রলোক কাপড়ের পাহাড়ের মধ্যে বসে রয়েছেন। একদিকে কাচা কাপড়। আর মেঝেতে ময়লা কাপড়।বুঝুন মশায়, আমার অবস্থাটা বুঝুন। বাইশটা তোয়ালে গাঁটের পয়সায় কিনতে গেলে, আমাকে তো ডকে পাঠাতে হবে।
পরবাসীয়া বললে, আপনার নামে কমপ্লেন আছে।
কমপ্লেন? আমার নামে? এত বড় আস্পর্ধা? কে? তিরিশ বছর আমি এই হোটেলে কাটিয়ে দিলাম। লাটসায়েবের বালিশ, বিছানার চাদরের হিসেব আমি করেছি, তারা কিছু বলেননি; আর কিনা আমার নামে কমপ্লেন?
বললাম, এক নম্বর সুইটে গতকাল রাত্রে বালিশ কম ছিল।
কিছুতেই নয়, ন্যাটাহারিবাবু চিৎকার করে উঠলেন।
আমি চলে আসতে যাচ্ছিলাম। নিত্যহরিবাবু হঠাৎ সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে, হাতে খাতাটা নিয়ে বললেন, এক নম্বর সুইট। বালিশ কম। হতে পারে না। নিত্যহরি ভটচাযের এমন ভীমরতি ধরেনি যে স্পেশাল সুইটে বালিশ কম দেবে। চলুন তো দেখি।
হাফ শার্ট, ধুতি আর কে এম দাশের ছেঁড়া চটি পরে নিত্যহরিবাবু আমাকে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে চললেন এক নম্বর সুইটের দিকে।
যেতে যেতে বলতে লাগলেন, আপনার তো সাহস কম নয়। আপনি নিত্যহরির ভুল ধরতে এসেছেন! এই হোটেলের প্রত্যেকটা ঘরে কটা করে বালিশ আছে, কটা তোষক আছে, কটা তোয়ালে আছে, তা এ-শর্মার মুখস্থ। ম্যানেজার সায়েবের ঘরে আছে ছখানা বালিশ। তার মধ্যে দুটো পালকের বালিশ, খোদ সিম্পসন সায়েব যা মাথায় দিতেন। দুনম্বর সুইটে আছে আটটা। এক নম্বরে চারটে। আর আপনি বলছেন বালিশ নেই?
এক নম্বর সুইটের চাবি খুলে ভিতরে ঢুকে দেখা গেল একটা মাত্র বালিশ পড়ে রয়েছে। দেখে নিত্যহরিবাবু প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলেন। পরমুহূর্তেই চিৎকার করে বলে উঠলেন, অসম্ভব! নিশ্চয়ই নেশার ঘোরে মেঝেতে খেলাধুলো করেছে, তারপর ভুলে গিয়েছে।
আমি বললাম, গতকাল ড্রাই-ডে ছিল।
নিত্যহরিবাবু কিন্তু আমল দিলেন না। হ্যাঁ। ড্রাই-ডেতে কলকাতা একেবারে বাউনের ঘরের বিধবা হয়ে যায়!
নিত্যহরিবাবু হঠাৎ মেঝেতে বসে পড়ে খাটের তলায় উঁকি মারলেন। তারপর আবিষ্কারের আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন। হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলায় ঢুকে পড়ে তিনটে বালিশ বার করে বললেন, দেখুন স্যার। একটু হলেই আমার চাকরি যাচ্ছিল। কেউ বিশ্বাস করত না যে, আমি বালিশ দিয়েছি এবং সেই বালিশ ওঁরা মেঝেতে নিয়ে খেলাধুলা করছিলেন। লাটসায়েবের বালিশ সাপ্লাই করেও, এই আটটি ইয়ার সার্ভিসের পর নিত্যহরি ভটচায্যির চাকরি যাচ্ছিল।
আমি দেখলাম, সত্যিই ঘরের মধ্যে খাটের তলায় বালিশ ছিল। আমার মুখের অবস্থা দেখে নিত্যহরিবাবুর বোধহয় একটু দয়া হল। বললেন,
আপনার বয়স কম। হোটেলের কিছুই দেখেননি আপনি। নেশা কি শুধু মদে হয়! একদম বাজে কথা! বেশি বয়সের মেয়েমানুষের মাথায় যখন ভূত চাপে তখন চোখে নেশা লেগেই থাকে। তা বাপু, পয়সা দিয়ে হোটেলের ঘর ভাড়া করেছ। বালিশ নিয়ে খেলা করো। নিত্যহরিবাবু ঢোক গিললেন। কিন্তু বালিশও নিচেয় ফেলে দেব, আবার ন্যাটাহারিকে বাম্বু দেব, সে কি কথা!
গতিক সুবিধে নয় বুঝে পরবাসীয়া কখন আমাকে একলা ফেলে রেখে কেটে পড়েছে। এবার আমিও অ্যাবাউট টার্ন করে পালাবার চেষ্টা করব ভাবছিলাম।
নিত্যহরিবাবু তখন বলছেন, আপনি হয়তো ভাবছেন ধেড়ে। মোটেই নয়। রং লাগলে ধেড়েরাও খোকাখুকু হয়ে যায়। ন্যাটাহরির এই স্টেটমেন্ট সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত চলবে, জেনে রাখবেন। ন্যাটাহারি পরের মুখে ঝাল খায় না, সে নিজের হাতে তিরিশ বছর ধরে বালিশ সাপ্লাই করছে।
এবার পালানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু নিত্যহরিবাবু হাতটা চেপে ধরে বললেন, যাচ্ছেন কোথায়?
আমি বললাম, নিচেয়।
অত সহজে নয়। অত সহজে আমার হাত থেকে কেউ ছাড়া পায় না। মনে হল সেই ভোরবেলাতেও নিত্যহরিবাবুর চোখ-দুটো ধক ধক করে জ্বলছে।
কেন, কী করতে হবে? নিত্যহরিবাবুকে আমি প্রশ্ন করলাম।
তার দুটো চোখের তেজ এবার কমে এল। মনে হল, নিত্যহরিবাবু নিজেকে শান্ত করবার চেষ্টা করছেন। আস্তে আস্তে তিনি বললেন, আমার হাতে একটু জল দিন।
বললাম, জল কী করবেন?
পাপ! পাপ ধুয়ে ফেলতে হবে না?
বাথরুমে বেসিন রয়েছে। কল রয়েছে। কিন্তু নিত্যহরিবাবু এক নম্বর সুইটের কলে হাত দেবেন না। যেন এ-ঘরের সর্বত্র পাপ ছড়ানো রয়েছে। বাথরুমে গিয়ে একটা মগ আবিষ্কার করলাম এবং সেই মগে জল বোঝাই করে নিত্যহরিবাবুর হাতে ঢালতে লাগলাম। বেসিনের উপরেই একটা পাত্রে লিকুয়িড সোপ ছিল। কিন্তু নিত্যহরিবাবু সেদিকে হাত বাড়ালেন। না। পকেট থেকে একটা সাবানের টুকরো বার করলেন। কোথায় কখন বালিশ ঘেঁটে হাত ধুতে হবে ঠিক নেই; তাই পকেটে কয়েক টুকরো সাবান নিত্যহরিবাবু সব সময়েই রেখে দেন। কার্বলিক সাবানে হাতটা ভালো করে ধুতে ধুতে নিত্যহরিবাবু বললেন, গত জন্মে নিশ্চয় হাজার হাজার ধোপার লাখ লাখ কাপড় আমি চুরি করেছিলাম।
নিত্যহরিবাবু আমার হাতটা চেপে ধরে বললেন, এই হোটেলের স্ট্যাটিসটিকস জানেন? বলুন তো কটা বালিশ আছে?
আমি বললাম, আমি কী করে জানব?
উনি ফিস্ফিস্ করে বললেন, সাড়ে নশ। আগে হাজারটা ছিল। পঞ্চাশটা ছিড়ে গিয়েছে। তার তুললাগুলো আমার ঘরের এক কোণে জমা হয়ে আছে। পাপ! আমার কানের কাছে এগিয়ে এসে নিত্যহরিবাবু মুখটা ভেংচে বললেন, হাজারটা পাপ!
নিত্যহরিবাবু যেন আমার মনের মধ্যে ক্রমশ গেঁথে বসছেন। নিজের অজ্ঞাতেই প্রশ্ন করে বসলাম, কেন? পিপ কেন?
আপনার বাবা কি আপনাকে লেখাপড়া শেখাননি? তিনি কি মাস্টারের মাইনে বাকি রাখতেন? নিত্যহরিবাবু আমাকে ধমক দিয়ে প্রশ্ন করলেন।
বললাম, মাইনে তিনি সময়মতো দিয়েছেন। তাঁর সাধ্যমতো কাউকে তিনি ফাঁকি দেননি।
তবে? আপনার মাস্টার তাহলে কী শিখিয়েছে আপনাকে? জানেন না, হোটেলে, সরাইখানায়, শুড়িখানায় প্রতিমুহূর্তে হাজার হাজার লাখ লাখ পাপ সৃষ্টি হচ্ছে?
এখানে হাজার হাজার লোক আসেন নিজের কাজে। তারা কী পাপ করছেন? আমি ছেলেমানুষের মতো প্রশ্ন করলাম।
আলবত করছে। পাপ না করলে কাউকে কি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয়? না, ঘরের বাইরে রাত কাটাতে হয়? নিত্যহরিবাবুর চোখ দুটো আবার জ্বলতে আরম্ভ করেছে। বললেন, কদ্দিন চাকরি করছেন?
এই দিনকতক হল। আমি উত্তর দিলাম।
বয়ে গিয়েছেন? ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন।
মানে?
রোজির সঙ্গে আলাপ হয়েছে? নিত্যহরিবাবু নিজের প্রশ্নটি সরল ভাষায় উত্থাপন করলেন।
চিনি, কিন্তু তেমন কোনো পরিচয় নেই।
ও ছুঁড়িও আমার কাছে একবার একস্ট্রা বালিশ চেয়েছিল। আমি স্রেফ না বলে দিয়েছিলাম। তারপর ভাবলাম, আমি না বলার কে? যে বালিশ চাইবে, তাকে বালিশ দাও। যত খুশি চাইবে, ততো দাও। আমার কী? আমি নিজে হাতে করে ওর ঘরে বালিশ দিয়ে এসেছিলাম। তা ছুঁড়ি পরের দিন ভোরবেলাতে বালিশ দুটো ফেরত দিয়েছিল।
দুটো লোককে আপনাদের বুঝলাম না। আপনাদের সত্যসুন্দর বোস। একবার ভুল করেও একস্ট্রা বালিশ চাইল না। আর মার্কো সায়েব। রসিক লোক মাল টেনে টইটম্বুর হয়ে থাকেন। কিন্তু ওই পর্যন্ত—কোনোদিন বাড়তি বালিশ নিলে না। মেয়েমানুষ যেন বাঘ।
আমি অবাক হয়ে নিত্যহরিবাবুর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। বালিশ বেশি চাইতে হলে আগে চাই ড্রিঙ্কস্-আমাদের মুনি-ঋষিরা যাকে বলেন মাল। শাজাহানের শুড়িখানায় যাতায়াত করেন তো?
বললাম, ওখানে এখনও আমার ডিউটি পড়েনি।
উনি বললেন, মেয়েদের বলি, মা লক্ষ্মী, কর্তাদের সব স্বাধীনতা দেবে। কিন্তু বাড়ি ছাড়তে দেবে না। খুঁটি থেকে ছাড়া পেলেই বিপদ। কার বেড়া ভাঙবে, কার ক্ষেতে ঢুকবে কিছুই ঠিক নেই।
নিত্যহরিবাবুর মধ্যে আমি এক অদ্ভুত মানুষকে দেখতে পাচ্ছি। আস্তে আস্তে তিনি বললেন, সাপ! আমি এতদিনে বুঝেছি, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একটা কেউটে সাপ ঘুমিয়ে আছে। কারুর মধ্যে সেই চিরকালই ঘুমিয়ে থাকে। আর কারুর কারুর বাড়ি ছাড়লেই ভিতরের সেই সাপটা ফোস করে ওঠে। লক লক করে ওঠে জিভটা।
আমার কেমন ভয় ভয় করছিল। ওই ঘরে আর থাকতে ইচ্ছে করছিল। নিত্যহরিবাবুরও বোধহয় ভালো লাগছিল না। তাই এক নম্বর সুইটের বিছানা থেকে উঠে পড়ে বললেন, চলুন, আমার ঘরে যাওয়া যাক।
বালিশ, বিছানা, চাদর-এর পাহাড়ের এক কোণে নিত্যহরিবাবু শুয়ে থাকেন। বললেন, এইখানেই আমি থাকি; আর ছোটো শাজাহানে খাই।
ছোট শাজাহান! সে আবার কোথায়? আমি প্রশ্ন করলাম।
বড় শাজাহানের পিছনে। বলুন তো, শাজাহানের একটা ডিনারের সবচেয়ে বেশি চার্জ কত? নিত্যহরিবাবু প্রশ্ন করলেন।
আমি বললাম, এ তো সবাই জানে। পঁয়ত্রিশ টাকা।
আর ছোট শাজাহানে চোদ্দ পয়সা। চোদ্দ পয়সায় ফুলকোর্স ডিনার। ভাত, ডাল, তরকারি। মধ্যিখানে দাম বাড়িয়ে চার আনা করবে বলেছিল। শাজাহানের স্টাফরা একসঙ্গে প্রতিবাদ করি। চার আনা আমরা কোথা থেকে দেব? তখন বাধ্য হয়ে চোদ্দ পয়সায় রেখেছে, শুধু ডালটা একটু পাতলা হয়েছে; আর থালাটা যে-যার ধুয়ে দিতে হয়। নিত্যহরিবাবু বললেন, আপনার কথাই আলাদা। গাছে না উঠতেই এক কাদি। চাকরিতে না-ঢুকতেই বড় শাজাহানের ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ আর ডিনার।
আমি চুপ করে রইলাম। কী উত্তর দেব? ন্যাটাহারিবাবু নিজেই বললেন, আপনাদের অবশ্য জুনো সায়েব অনেক কম দেয়। গেস্টরা লাঞ্চের সময় যা খান, তার বাড়তিগুলো দিয়ে আপনাদের ডিনার। আর ডিনারের বাড়তি দিয়ে আপনাদের পরের দিনের লাঞ্চ। আজ লাঞ্চে সায়েব আপনাদের কী খাওয়াবে জানেন?
নিত্যহরিবাবুর খবর সংগ্রহের ক্ষমতা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম।
ম্যাড্রাস কারি। খেতে চমৎকার, কিন্তু খবরদার খাবেন না। আপনার পেট কেমন? লোহা খেলে হজম হয়ে যায়?
মোটেই না, পেটটা একেবারেই আমার ওবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট নয়।
তা হলে ম্যাড্রাস কারিটা একদম বাদ দিয়ে খাবেন। ওটা লন্ডনের বীরস্বামী সায়েবের আবিষ্কার। বীরস্বামী, গোল্ড মেডালিস্ট, অনারারি কুকিং অ্যাডভাইসার টু দি সেক্রেটারি অফ্ স্টেট ফর ইন্ডিয়া। ১৯২৪ সালে ব্রিটিশ এম্পায়ার এগজিবিশনে গিয়েছিলেন, তারপর লন্ডনে রেস্টুরেন্ট খুলেছিলেন। তার কাছেই তো জুনো ইন্ডিয়ান রান্না শিখেছিল বলে। কিন্তু আসলে বীর স্বামী ওকে ঘাড় ধরে বার করে দিয়েছিলেন। আমাদের দেবেন কুক না থাকলে, জুনোর জারিজুরি এতদিনে বেরিয়ে পড়ত। যা বলছিলাম—প্রথম দিন মাংস কিনে এনে হয় কোল্ড মিট। দ্বিতীয় দিনেও তাই। তৃতীয় দিনে বিরিয়ানি। আজকে সেই মাংসই ম্যাড্রাস কারি ফর দি স্টাফ।
নিত্যহরিবাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসছিলাম। উনি বললেন, একটু থামুন। আপনি ছেলেমানুষ। আপনাদের মনে যাতে দাগ না পড়ে, আর একটু দাগ পড়লেই যাতে ধরা পড়ে, তার ব্যবস্থা করছি। রোজি তো আপনার ঘর অকুপাই করে নিয়েছে। আপনার মালপত্তর সব পাশের ঘরে চালান হয়ে গিয়েছে। ওখানে আমি সবকিছু সাদার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
এক বান্ডিল কাপড়-চোপড় নিয়ে উনি জোর করে ছাদে আমার সঙ্গে চলে এলেন। রোজি নিজের ঘরে বসে তখন দাঁত বার করে হাসছে। আমাকে দেখেই বললে, আমার কাজকর্ম সব শেষ। এখন ছাদে বসে বসে শরীরটাকে সূর্যের আগুনে মচমচে টোস্ট করব। তারপর লাঞ্চ খাব। তারপর জানো কী করব? ম্যাটিনি শোতে সিনেমায় যাব। জিমিরও যাবার কথা ছিল। কিন্তু ব্যাংকোয়েটে কাজ পড়ে গিয়েছে! ওর টিকিটটা রয়েছে। তুমি যাবে?
আমি অবাক হয়ে গেলাম, রোজি আমাকে সিনেমায় নেমন্তন্ন করছে। বললাম, অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমারও ডিউটি রয়েছে।
রোজি বললে, অল রাইট, তাহলে আমার বোনকে নিয়ে যাই। তবে বিনা নোটিশে ওকে সিনেমায় নিয়ে গেলে ওর বয়ফ্রেন্ডরা দুঃখিত হয়, ডাকতে এসে তারা ফিরে যাবে।
আর-এক দফা ধন্যবাদ জানিয়ে, নিজের ঘরে ঢুকলাম। নিজের মুখভঙ্গিকে ন্যাটাহারিবাবু এতক্ষণ বোধহয় কোনোরকমে চেপে রেখেছিলেন। ঘরে ঢুকেই তিনি নিজমূর্তি ধারণ করলেন। বললেন, অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছেন মনে হল! কিন্তু মনে রাখবেন, অতিবাড় বেড়ো না ঝড়ে ভেঙে যাবে। আরও মনে রাখবেন, চারদিকে বিষ। সবসময় ভালো করে হাত না ধুলে মরবেন।
ঘরের চারদিক খুঁটিয়ে দেখে বললেন, আপনার এ-ঘরে সব সাদা করে দিচ্ছি। সাদা পর্দা, সাদা চাদর, সাদা তোয়ালে, সাদা টেবিলক্লথ। দরকার হয়, আমি রোজ পাল্টাবার ব্যবস্থা করব। পাঁচটা ধোপ এই নিত্যহরির কথায় ওঠে বসে। একটু বসেই নিত্যহরিবাবু আবার উঠে পড়লেন।আমি চলি। অনেক কাজ। ব্যাংকোয়েটে তিনশ গেস্ট। তিনশ ন্যাপকিনের ফুল তৈরি করতে হবে।
ন্যাপকিনের ফুল কাকে বলে জানতাম না। ওঁর কাছেই শুনলাম, আগে শাজাহান হোটেলে প্রতি কোর্সে ন্যাপকিন পাল্টানো হত। এখন একবারই হয়। অতিথিরা হ-এ ঢোকবার আগেই গেলাসের মধ্যে ন্যাপকিন সাজিয়ে রাখা হয়। নিত্যহরিবাবু বললেন, কত রকমের ন্যাপকিন মুড়েছি-পাখা, বিশপ, নৌকো, পদ্মফুল, ফণিমনসা। এবারে অন্য একভাবে মুড়ব। তাতে আমার পরিশ্রম বেশি, তবু করব। কেবল নামটির জন্যে। ইংরিজিতে বলে দি বোরস হেড। শুয়োরের মাথা-হোটেলের ব্যাংকোয়েটে প্রতিবারই এবার থেকে আমি শুয়োরের মাথা ছাড়া আর কিছু করব না। আপন মনে বকতে বকতে নিত্যহরিবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।