এইটা কোথ থেকে আসছে জানি না—কিন্তু আমাদের মধ্যে “আমরা ভার্সেস তোমরা” বলে একটা ব্যাপার আছে। এইটা জর্জ বুশ আমাদের মধ্যে ইনজেকশন দিয়া পুশ করে নাই। সুপ্রাচীন কাল থেকেই এটা আমাদের মধ্যে আছে।
আমরা নিজেদের সেইভাবেই ডিফাইন করি—যেটা আমরা না। স্যামুয়েল হান্টিংটন একটা চমৎকার উদাহরণ দিসেন। একজন কর্মজীবী নারী যখন তার দশজন গ্হিনী বান্ধবীর সাথে গল্প করেন, তখন তার মাথায় থাকে যে এই গ্রুপে তিনিই একমাত্র কর্মজীবী। সেই নারীই যখন অফিসে তার পুরুষ কলিগদের সাথে মিটিং করেন, তখন কিন্তু তার মাথায় থাকে না যে তিনি একই কোম্পানিতে একই পোস্টে জব করনে। তিনি যে একজন নারী—এই পরিচয়টাই প্রধান হয়ে ওঠে তখন।
চাইলে এরকম হাজারটা উদাহরণ দেয়া যাবে। চিটাং কলেজের যে ছেলেটা ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসে, তার নন-চিটাং বন্ধুদের সামনে হয়তো সে গর্বভরে বলে ‘আঁরা চিটাইঙ্গা। আঁরাই বেস্ট’। সেই ছেলেটাই যখন বৈদেশ পড়াশোনা করতে যায়, তখন তার সুর পালটে হয়ঃ “আঁরা বাংলাদেশী। আঁরাই বেস্ট”।
এইভাবেই মানুষ নিজেদের মধ্যে ভাই-বেরাদরসশিপ তৈরি করে। নিজের অস্তিত্বের প্রয়োজনেই তৈরি করে। আর এটা করতে গিয়েই আরেকদল মানুষকে সে অনায়াসে ‘তোমরার’ দলে ফেলে দেয়। প্রতিটা সভ্যতাই তাই গর্বভরে অন্য সভ্যতার মানুষদের বর্বর ঘোষণা করেছে। মিশরের ফারাওরা অ-মিশরীয় মাত্রকেই বর্বর ভাবতো। রোমানরা ভাবতো অ-রোমানদের। খালি গায়ে ঘোরাফেরা করে বলে ভারতীয়দের বর্বর ভাবতো ব্রিটিশরা। স্বামী-স্ত্রী প্রকাশ্যে চুমু খায় বলে আবার ব্রিটিশ সভ্যতাকে বর্বর ভাবতো ভারতীয়রা।
তবে এই “আমরা বনাম তোমরা” দ্বন্দ্বের মধ্য থেকেও আমাদের মধ্যে কিছু কমন ব্যাপারে বিশ্বাস তৈরি হয়েছে। প্রথম বিশ্বাসটা আসছে টাকায়। তারপর পলিটিক্যাল সিস্টেমে। যে আমাদের কাউকে না কাউকে দরকার আমাদের শাসন করার জন্য। সর্বশেষ আসছে ধর্ম।
ব্যবসায়ী, রাজ-রাজড়া আর ধর্মপ্রচারকরা তাই এই দুনিয়া সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ এলিমেন্ট। গুরুত্বপূর্ণ যদি নাও মানেন, এটা মানতে হবে—এই তিন দল হল সমাজ পরিবর্তনের মূল ফোর্স। আমরা বনাম তোমরা’র যে বাইনারীতে আমরা সাধারণ মানুষ আটকে থাকি, এরা আমাদের সেই বাইনারী থেকে বের করে নিয়ে আসে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ক্ষক, শ্রমিক—বাদবাকি সবার দরকার সমাজকে ফাংশনাল রাখার জন্য। সমাজ বদলে এরা কোন ভাইটাল ফোর্স না। সমাজে যে র্যাডিকাল পরিবর্তনগুলো আসে, তা ঐ বণিক, রাজা আর পয়গম্বরের হাত দিয়েই আসে।
একজন ব্যবসায়ীর কাছে যেমন গোটা দুনিয়াটাই একটা বাজার। আর সব মানুষ তার পটেনশিয়াল কাস্টোমার। কোন বয়বসায়ীকে এইজন্য দেখবেন না তার ব্যবসা নিয়া সন্তুষ্ট থাকতে। দেখা হলেই বলবে, ভাই, আগের মত আর ব্যবসাপাত্তি নাই। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, সে তার ব্যবসা বাড়িয়েই চলেছে। ওষুধ থেকে জুতা, জুতা থেকে কসমেটিক্স, কসমেটিক্স থেকে রিয়েল এস্টেট। একই কথা খাটে রাজ-রাজড়াদের জন্যও। গোটা দুনিয়াটাই তার টেন্ট্যাটিভ সাম্রাজ্য। আর দুনিয়ার মানুষ তার পটেনশিয়াল প্রজা। এদিকে ধর্মপ্রচারক মনে করেন, দুনিয়া জুড়ে কেবল একটা সত্যই থাকবে। সবাই দল বেঁধে এই সত্যের অনুসারী হবে।
এই যে গ্লোবাল ভিশন, দুনিয়ার সব মানুষকে এক ফিলোসফির শামিয়ানায় আনার যে চেষ্টা–তাতে কিন্তু দিন শেষে জয়ী হয় টাকাই। পলিটিক্যাল সিস্টেম নিয়া মানুষের মধ্যে মতবিরোধ আছে। গণতন্ত্রই বেস্ট কিনা—এই নিয়া মানুষের মনে এখনো সন্দেহ আছে। অনেককেই বলতে শুনবেন, এর চেয়ে আর্মি ভালো ছিল। কিংবা আগের দিনের জমিদাররাই ভালো ছিল। কিংবা এরশাদের একনায়কতন্ত্রই ভালো ছিল।
ধর্ম নিয়া তো কথাই নাই। আমার গডে হয়তো আপনি বিশ্বাস করেন না। কিংবা আপনার গডে আমি বিশ্বাস করি না, টাকার গডে কিন্তু আমরা সবাই বিশ্বাস করি। আমেরিকান টাকার উপর লেখা থাকেঃ “In God We Trust”. এই গড অবশ্যই খ্রিস্টান গড। যে লোকটা টিপিক্যাল গডে বিশ্বাস করে না কিংবা ভিন্ন গডে বিশ্বাস করে, সেও কিন্তু এই টাকা স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করে। টাকার উপর গডের কথা লেখা আছে দেখে সে ভারতীয় পণ্য বর্জনের মত এই টাকাও বর্জন করে না। কিংবা আমেরিকান সরকারের কাছে পিটিশনও দাখিল করে না যেঃ তোমার টাকার উপর গডের কথা লেখা আছে। তোমার টাকা আমি আর ইউজ করবো না।
এই একটা স্রোতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ এক হয়ে মিশে যায়। টাকাকে আমি-আপনি যতোই গালি দিই না কেন, দুনিয়ার মানুষকে কেউ যদি এক করতে পারে, তবে এই টাকাই।
আমেরিকা ছিল লাদেনের এক নম্বর শত্রু। আমেরিকান ক্ষ্টি- কালচার, পলিটিক্স—সব কিছুতেই তার ছিল ভয়ানক বিত্ষ্ণা। সেই লাদেনও কিন্তু আমেরিকান ডলারকে প্রিয়তমার মতোই বুকে আগলে রাখতো।
আমাদের শিকারী পূর্বপুরুষদের মধ্যে টাকা-পয়সার কোন ধারণা ছিল না। এরা দল বেঁধে শিকার করতে যেতো। যা পেতো, তাই ভাগাভাগি করে খেতো। কেউ হয়তো শিকারে বেশি দক্ষ। তাই বলে যে মাংসের ভাগটা বেশি পেত—তা না। যে লোকটা শিকার ভালো জানে না, কিন্তু গাছগাছড়ার রস দিয়ে ক্ষত সারাতে পারে, তাকেও সে সমান ভাগই দিত। এইভাবে একটা অঘোষিত বিনিময় প্রথা গড়ে উঠেছিল তাদের মধ্যে।
ক্ষিভিত্তিক সমাজও কমবেশি একইরকম ছিল। বনেজঙ্গলে ঘোরা মানুষগুলো একটা নির্দিষ্ট গ্রামে এসে থিতু হল। এদের মধ্যেই কেউ ছিল ক্ষত সারানোয় ওস্তাদ, কেউ কাপড় বোনায়, কেউ বা হাতুড়-বাটাল দিয়ে মিস্তিরিগিরিতে। আমরা যাকে বলি ‘স্বনির্ভর অর্থনীতি’–ঠিক সেইটা ছিল তাদের। বাইরের মানুষের সাথে যোগাযোগ করা লাগতোই না বলা যায়। ফুলটাইম ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা দর্জির তাই তখনো প্রয়োজন হয় নাই।
নগর ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা এসে সব কিছু ওলট পালট করে দেয়। শহর মানেই কুটি কুটি লোক। যাদের কেউ কাউকে চেনে না। কাজেই, আমার প্রতিবেশী, যে কিনা দাবি করে সে গাছগাছড়ার রস দিয়ে এক চুটকিতে আমার ক্ষত সারায়ে দিতে পারবে—তার এই দাবির সত্যমিথ্যা আমি জানি না। এই অবিশ্বাস থেকে জন্ম হল স্পেশালাইজেশনের। জন্ম নিল স্পেশালাইজড ডাক্তার, মিস্তিরি আর দর্জি।
স্পেশালাইজেশনের প্রভাব পড়লো গ্রামেও। একটা গ্রামে হয়তো পুইঁশাকের ফলন ভালো হয়। শহরের লোকে ভাবলো, কী দরকার কষ্ট করে বাড়ির পেছনে পুঁইশাক ফলানোর? এর চেয়ে ঐ গ্রাম থেকে কিনলেই তো হয়। ধীরে ধীরে এই গ্রামের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। অন্য গ্রামগুলোও বসে রইলো না। যে ফসলটা তারা অতো ভালো ফলায় না, সেই ফসল তারা ফলানোই ছেড়ে দিল। সমস্ত মনোযোগ দিল যেই ফসল ভালো ফলে, তার উপর। এইভাবে আরেকটা গ্রাম হয়তো টমেটোর দিক দিয়ে, আরেকটা গ্রাম আলুর দিক দিয়ে নিজেকে স্পেশালাইজ করে নিল।
স্পেশালাইজেশনের ফলে কনজ্যুমার হিসেবে শহরের মানুষের সুবিধা হল। কিন্তু ওভারঅল অর্থনীতি হয়ে পড়লো জটিল। আর অর্থনীতি যতো কমপ্লেক্স হয়, বিনিময় প্রথা ততো অকার্যকর হতে থাকে। আগে গ্রামে থাকতে পাশের বাড়ির বৌদির কাছ থেকে কলাটা-মূলাটা আনা যেত। জানা কথা যে, সেও একদিন তার কাছ থেকে মাছের কুটোটা বিনিময়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু শহরে তো এই সুবিধা নাই। যে ধনঞ্জয় আমার ধরা ইলিশ মাছের বিনিময় কাল দেবে বলে নিয়ে গেলো, কাল কেন— সারা জীবনেও তার সাথে আমার আর দেখা নাও হতে পারে।
বিনিময় প্রথার অসুবিধা বোঝানোর জন্য একটা উদাহরণ দিই।
ধরা যাক, আপনার আমের বিরাট বাগান। সেইখানে ল্যাংড়া, ফজলি, মোহনভোগ—নানা স্বাদের আম ফলে। একদিন আপনার জুতা গেছে ছিঁড়ে। আপনার প্রতিবেশীর কাছে আপনি শুনলেন, নদীর ঐপারে বাজারে এক মুচি আছে। তাকে দিয়া সে জুতা ঠিক করাইসিলো। আজ পাঁচ বছর হইসে, সেই জুতার কিচ্ছু হয় নাই। তো আপনি নাচতে নাচতে মুচি ভদ্রলোকের কাছে গেলেন। আশা, কয়টা আমের বিনিময়ে তার জুতা ঠিক করায়ে নিবে।
মুচি বেচারা পড়লো বিপদে। গত সপ্তাহেই সে তিনটা ফজলি আমের বিনিময়ে একজনের জুতা ঠিক করে দিসিলো। তিনটা নাকি চারটা? তার এখন ঠিক মনে পড়তেসে না। প্রতিদিন তো সে কতো কিছুর বিনিময়ে কতোজনের জুতাই ঠিক করে দেয়। ধান, গম, মাংস, কাপড়-চোপড়—দ্যা লিস্ট গোজ অন। এতো কিছুর ভীড়ে আমের হিসাব মাথায় থাকে নাকি?
ধরা যাক, তিনটাই আম। এইখানেও সমস্যা। তিনটা আমের বিনিময়ে সে এক কিশোরীর জুতা ঠিক করে দিসিলো। আর এটা পূর্ণবয়স্ক পুরুষের বুট। এর জন্যও কি তিনটা আম চাওয়া ঠিক হবে? কয়টা চাইলে সে ঠকবে না? বেশি আম না হয় নিল। বেশি আম নিয়ে সে করবেটা কী? বাসায় খালি সে আর তার বউ। ফ্রীজও নাই যে আম প্রিজার্ভ করে রাখবে। বেশি নিলে শুধু শুধু এটা পচবে।
আরেকটা কনসার্ন আছে তার। অতি সম্প্রতি দেশে একটা ছোঁয়াচে রোগের আমদানি হইসে। কাতারে কাতের গরু-ছাগল সেই রোগে আক্রান্ত হইতেসে। কাজেই, চামড়ার সাপ্লাই গেছে কমে। আগে এক জোড়া জুতার বিনিময়ে সে যতোটুকু চামড়া পাইতো, এখন তার অর্ধেক পায়। এই ব্যাপারটাও তো কনসিডার করতে হবে।
এতো কিছু বিবেচনায় আনতে গিয়ে তার মাথামোথা গরম হয়ে গেল। নিজের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য সে আপনাকে ‘ভাংতি নাই’ বলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। এই সমস্যা যে খালি ঐ মুচি ভদ্রলোকই ফেস করছে—তা না। গোটা বাজারে যদি ১০০টা পণ্যের ১০০ জন বিক্রেতা থাকে, তবে তাদের মধ্যে ৪৯৫০ রকম এক্সচেঞ্জ রেট থাকবে। পণ্যের সংখ্যা বেড়ে যদি ১০০০ হয়, তবে এই এক্সচেঞ্জ রেটের সংখ্যা হবে ৪৯৯৫০০। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এই রেট মনে রাখা সম্ভব না।
অবস্থা আরো খারাপ হইতে পারে যদি মুচি ভদ্রলোক বা তার স্ত্রী—কারোরই আমের প্রতি ভালোলাগা না থাকে। হয়তো দু’জনের মধ্যে বেশ খটাখটি চলছে এখন। মুচি ভদ্রলোকের এখন আম্র দরকার না, দরকার একজন ডিভোর্স লইয়ার। এক্ষেত্রে যেটা হতে পারে—আপনি এক ডিভোর্স লইয়ারকে খুঁজে বের করবেন, যার কিনা আম পছন্দ। আপনার আমের বিনিময়ে সে মুচির ডিভোর্স করায়ে দিবে। মুচি তার বিনিময় দিবে আপনার জুতা ঠিক করে। ডিরেক্ট বিনিময় না হয়ে এটা হল ইনডিরেক্ট বিনিময়। তিনধারী লেনদেন। কিন্তু আপনি যে ঐদিনই একজন আমখোর ডিভোর্স লইয়ার খুঁজে পাবেন–তার গ্যারান্টি কী?
সুতরাং, এইভাবে সমস্যার সমাধান হবে না। কিছু সমাজ একটু অন্যভাবে এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করসিলো। তারা স্পেশালিস্টদের কাছ থেকে সমস্ত রকম পণ্য আর সার্ভিস কিনে রাখতো। তারপর যার যেটা দরকার, তাকে তার উৎপাদিত পণ্য বা সার্ভিসের বিনিময়ে সেটা দিয়ে দিত। এর সমস্যা হল এই যে, সেন্ট্রালি কালেক্ট করলে আপনি কখনোই ভালো দাম পাবেন না। ভালো দাম না পেলে আপনার মধ্যে কাজ করার বা ভালো জিনিস বানানোর আর উৎসাহ থাকবে না। আপনি চাইবেন, মিনিমাম স্পেসিফিকেশনটুকু মিটায়া কোনমতে পণ্য বা সার্ভিস সাপ্লাই দিতে। সোভিয়েত ইউনিয়নে যেটা হইসিলো।
সমস্যার সমাধান করার জন্য দরকার একটা কমন জিনিস যেটা দিয়ে সবকিছু বিনিময় করা যাবে। সব শ্রেণির এক্সপার্টকে কানেক্ট করার জন্য একটা কমন গ্রাউন্ডের প্রয়োজন হল। আর সেই কমন গ্রাউন্ড তৈরি করলো টাকা। কীভাবে? সেইটা না হয় পরেই বলি।
ছোটবেলায় একটা ব্যাপার নিয়ে আমি বেশ টেনশনে পড়ে গেছিলাম।
আমার আব্বু প্রতিদিন অফিস যেতো টাকা আনতে। কিন্তু অফিসের লোকজন তো খারাপ। এরা আব্বুকে প্রতিদিন টাকা দিতো না। মাসের শুরুতে কোন একদিন হয়তো কিছু টাকা আনতে দিত।
টাকার অভাবে আমরা যখন যা খুশি—তাই কিনতে পারতাম না। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হত। টাকা যে কেউ ছাপায়–এই ধারণা আমার ছিল। আব্বুকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, সরকার এই টাকা ছাপায়। তখন আমার মনে আইডিয়া এলো, সরকারই যদি টাকা ছাপায়, তাইলে তো সে বেশি বেশি করে টাকা ছাপালেই পারে। তাইলেই তো আর কারো ঘরে কোন অভাব-অনটন থাকবে না।
যে ভুলটা আমি করেছিলাম, সেই একই ভুলটা করেছিল মধ্যযুগে স্পানিশরা। এরা আমেরিকা এসে পিনিকগ্রস্তের মত স্বর্ণ লুটেপুটে নিয়ে গিয়েছিল। এদের এই পিনিক দেখে মেক্সিকোর তৎকালীন অধিবাসী এ্যাজটেকরা খুব অবাক হয়েছিল।
এমন না যে এ্যাজটেকরা কখনো সোনা ব্যবহার করেনি। তারাও এটা দিয়ে গহনা বানাতো, মূর্তি বানাতো। ব্যস, এইটুকুই। সোনা খাওয়া যায় না, পরা যায় না, পান করা যায় না। মোটামুটি আকামের একটা জিনিস। এই আকাইম্যা জিনিস নিয়া ইউরপিয়িদের এতো পিনিক কেনো? এ্যাজটেকরা ইউরোপীয়দের নেতা হার্নান কোর্তেকে একবার জিজ্ঞেসও করেছিলঃ সোনা নিয়া তোমাদের এতো পাগলামো কেনো? কোর্তের উত্তরটা ছিল চমৎকারঃ “I and my companions suffer from a disease of the heart which can be cured only with gold।”
রহস্যটা হচ্ছে এই যে, স্প্যানিশরা স্বর্ণকে বিনিময়ের কমন মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতো। তাই তারা ভেবেছিল, যতো বেশি স্বর্ণ হবে তাদের, ততো তারা বড়লোক হয়ে যাবে। কিন্তু স্বর্ণ তো আসলে টাকা না। ইন ফ্যাক্ট, ‘টাকা’-ও কোন টাকা না। টাকা তাই—যার বিনিময়ে আরেকজন আমাকে কিছু দিবে। সেটা স্বর্ণমুদ্রা না হয়ে কাদামাটিও হতে পারে। দেশের সমস্ত মানুষ যদি এই কাদামাটির বরকতে বিশ্বাস আনে, তবে বিয়েতে হয়তো স্বর্ণ নয়, কাদামাটির ওজন নিয়ে মুরুব্বিদের মধ্যে বাহাস হবে।
বুঝতেই পারছেন, কিছুদিনের মধ্যেই স্পেন দেশে স্বর্ণের ইনফ্লেশন হয়। আগে যে স্বর্ণ দিয়ে পাঁচ কেজি গম কেনা যেত, আজ তা দিয়ে এক কেজিও কেনা যায় না। স্বর্ণ বেড়েছে, সমাজে সম্পদের পরিমাণ তো আর বাড়েনি। আর এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই বাংলাদেশ সরকার স্রেফ একটা অবুঝ শিশুকে খুশি করার জন্য ইচ্ছেমত টাকা ছাপাতো না।
স্বর্ণ্মুদ্রা আসার আগেও নানাভাবে টাকার প্রচলন ছিল। কখনো শস্যের দানা, কখনো গরু-ছাগলের চামড়া, কখনো বা লবণকে টাকা হিসেবে ব্যবহার করা হত। অনেকে বলেন, ইংরেজি Salt শব্দটা থেকেই Salary শব্দের উৎপত্তি। মধ্যযুগে যুদ্ধের সময় সৈন্যদের বেতন হিসেবে যে লবণ দেয়া হত। সুবে বাংলাতেও যে স্যালারি হিসেবে লবণ দেয়া হত না—তাই বা কে বলতে পারে? ‘নুন খাই যার, গুণ গাই তার’—কথাটা তো আর আকাশ থেকে এসে পড়েনি!
প্রিজন ব্রেক মুভিগুলোতে দেখবেন, সিগারেটকে এখানে টাকা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যার কাছে যতো বেশি সিগারেট, জেলখানার সে ততো বড় হেডম। এমনকি যারা স্মোক করে না, তাদেরও জেলখানায় এই সিগারেট দিয়েই সব কিছু বিনিময় করে। এক প্যাকেট পাউরুটির দাম হয়তো দুইটা সিগারেট, একটা চলনসই ঘড়ি দশটা সিগারেট, এক বোতল বিদেশী মদ বিশটা সিগারেট।
আমরা অবশ্য টাকা বলতে বুঝি ব্যাংকনোটরূপী টাকা। যদিও দুনিয়ার সমস্ত টাকার একটা খুব ক্ষুদ্র অংশ জুড়ে আছে এই ব্যাংকনোট। আজকের দুনিয়ায় টাকা আছে প্রায় ৬০ ট্রিলিয়নের মত। তার মধ্যে ব্যাংকনোট আর কয়েন রূপে আছে মাত্র ৬ ট্রিলিয়ন। প্পরো টাকার মাত্র ১০%। বাকি টাকাটা আছে আমাদের কম্পিউটার সার্ভারগুলোতে। আমাদের দৈনন্দিন কেনাকাটা, বিদ্যুৎ বিল, মোবাইল বিল—সবই আজকাল ইলেকট্রনিক হয়ে যাচ্ছে। বিরাট ক্রিমিনাল ছাড়া আজকাল আর কেউ স্যুটকেস ভর্তি টাকা নিয়ে ঘোরাফেরা করে না
ইলেকট্রনিক ফর্মেই হোক আর ব্যাংকনোট রূপেই হোক, কোন কিছু টাকা হতে হলে সবার আগে যেটা লাগবে—সেটা হল কনভার্টিবিলিটি। রূপান্তরযোগ্যতা। আমি বাদাম বিক্রি করে আপনার কাছ থেকে সার্কিটের ডিজাইন শিখি না। কারন, সেটা আমার কোন কাজে লাগবে না। আমি নিই টাকা। কেননা এই টাকা দিয়ে আমি আবার মুদি দোকানীর কাছ থেকে তেল কিনতে পারবো। টাকা এইভাবে এক পণ্যকে আরেক পণ্যে কনভার্ট করে দিচ্ছে। আপনি হয়তো ঘূষ খাচ্ছে। সেই ঘূষের টাকায় দানখয়রাত করে মানুষের দোয়া কিনে নিচ্ছেন। একজনের সার্ভিস এখানে আরেকজনের দোয়ায় কনভার্ট হচ্ছে।
খালি কনভার্টিবল হলেই হবে না। এর আরো দুটো গুণ থাকা লাগবে। এক, একে সহজে স্টোর করা যাবে। আর দুই, একে সহজে ট্রান্সপোর্ট করা যাবে। শস্যকে টাকা হিসেবে ব্যবহার করলে দুটো সমস্যাই হয়। একে তো একে স্টোর করলে হয় ইঁদুরে খেয়ে ফেলবে নয়তো গুদামে আগুন লেগে যাবে। আর এটা সহজে পরিবহণযোগ্যও না। ধরা যাক, আপনি বাড়ি বিক্রি করবেন। এখন বাড়ি বিক্রির বিনিময় হিসেবে কি কয়েক মণ ধান বা লবণ নিয়ে দুই ক্রোশ পথ পাড়ি দবেন? পেইনটা একটু বেশিই হয়ে গেলো না?
কয়েন আর নোট্রূপী টাকা এসে এই সব সমস্যার সমাধান করেছে। নিজের কাছে রাখতে ভয় পাচ্ছেন? অকা। বাড়ির কাছে ব্যাঙ্কে গিয়ে রেখে আসেন। টাকা নিয়ে দুই ক্রোশ দূরে যাওয়া দরকার? আপনাকে গরুর গাড়ি বোঝাই করে টাকা নেয়া লাগবে না। লুংগির গিঁটে বেঁধে নিলেই চলবে।
গুণীজনেরা তাই টাকাকে সকল সমস্যার মূল বললেও টাকাই আবার সকল সমস্যার সমাধানও।
আগেই বলেছিলাম, মানুষের গল্প করতে গেলে মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের বার বার ফিরে আসতেই হবে। এখন যেমন আমরা আছি সুমেরীয়ানদের সাথে সুমেরে। আজকের ইরাকের দক্ষিণ প্রান্তে।
টাকার গল্পটাও এইখান থেকেই শুরু। যীশুর জন্মেরও তিন হাজার বছর আগে এখানেই প্রথম বার্লির দানাকে টাকা হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়।
এই দানা দিয়েই সমস্ত কিছু কেনাবেচা করা হত। বার্লির দানা ঠিকঠাক ওজন করা জন্য প্রায় এক লিটারের একটা স্ট্যান্ডার্ডাইজড বাটি তৈরি করা হল। স্যালারি দেয়া হত এই বাটিতে বার্লি ওজন করে।
এক লিটারের এই স্ট্যান্ডার্ডাইজড বাটিকে বলা হত এক সিলা। একজন পুরুষ শ্রমিক হয়তো মাসে ষাট সিলা কামাতে পারতো। নারী শ্রমিক কামাতো ত্রিশ সিলার মত। এদের যে ফরম্যান ছিল তার কামাই ছিল মাসে ১২০০-৫০০০ সিলার মত। ৫০০০ সিলা বার্লি খেয়ে নিশ্চয়ই সে শেষ করতে পারতো না। যেটুকু বেঁচে যেত, সেটা সে পরিবারের জন্য মাছ, মাংস, দুধ-ডিম কিনতো।
শুরু শুরুতে মানুষকে কনভিন্স করা আসলেই টাফ ছিল—যে তোমার বার্লি খালি বার্লি না, এটা হল টাকা। আপনি যদি এই ইতিহাসে অনুপ্রাণিত হয়ে বাসার চালের বস্তাটা পিজা হাটে নিয়া পিজা কিনতে চান, পিজা হাটের লোক হয় আপনাকে পাগল ভাববে নয়তো পুলিশ ডাকবে। সেই সময় তো কাগুজে টাকার ধারণা ছিল না। আর বার্লি যেহেতু খাওয়া যায়, এর একটা নিজস্ব ভ্যালু আছে। কাজেই, শুরুটা খুঁড়িয়ে হলেও আস্তে আস্তে বার্লি আস্তিক মানুষের সংখ্যা ঠিকই বেড়ে গেলো।
বার্লির সমস্যা ছিল, এটা স্টোর করে রাখা যায় না অনেকদিন। কাজেই, এমন কিছুর দরকার হল টাকা হিসেবে যাকে ইঁদুরে খেয়ে ফেলবে না বা সহজেই আউনে পুড়ে যাবে না। ব্রেকথ্রু টেকনোলজি হিসেবে এলো রুপার ব্লক। ৮.৩৩ গ্রাম রুপার একটা ব্লক। এই ব্লককে বলা হত শেকেল।
হামুরাবির সংবিধানে যখন বলা হত, কোন অভিজাত পুরুষ যদি কোন দাসীকে হত্যা করে, তবে ক্ষতিপূরণ হিসেবে সেই দাসীর মালিককে ২০ শেকেল দিতে হবে। এই ২০ শেকেল মানে ২০টা রুপার মুদ্রা না। ২০*৮.৩৩= ১৬৬ গ্রাম রুপার কথা বলা হচ্ছে এখানে। বাইবেলেও এই ‘শেকেল’ এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ইউসুফ নবীকে তার ভাইয়েরা এই ২০ শেকেলের বিনিময়েই ইসমায়েলীদের কাছে বেঁচে দিয়েছিল।
কালের বিবর্তনে নির্দিষ্ট ওজনের ধাতুকে যে বিনিময়ের কমন মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যায়—এই আইডিয়া আমাদের গ্রেট গ্রেট নানা-দাদাদের মাথায় পাকাপোক্ত হয়ে গেড়ে বসলো।
আমরা যাকে কয়েন বা মুদ্রা বলি, তার আবির্ভাব হয় আজকের তুরস্কে। ৬৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। আগের মতই নির্দিষ্ট ওজনের সোনা/রুপা দিয়ে তৈরি হত এই মুদ্রাগুলো। নতুনত্বটা ছিল অন্য জায়গায়। ইতিহাসে প্রথমবারে মত মুদ্রার উপর রাজ-রাজড়ার নাম খোদাই করা শুরু হয়। এর মানে, স্বয়ং রাজা আমাকে কথা দিচ্ছেন— বৎস, আমার এরিয়ায় তুমি নিশ্চিন্তে এই মুদ্রা ইউজ করতে পারো। কেউ এই মুদ্রার বিনিময়ে তোমাকে কিছু দিতে না চাইলে আমাকে খালি বলবা। আমি তার চৌদ্দপুরুষকে দেখে নিব।
সোনা/রুপার ব্লকে একটা সমস্যা ছিল। ধরা যাক, আপনি আমাকে বাদাম বিক্রির জন্য দুই শেকেল রুপা দিলেন। এখন এই দুই শেকেল রুপা যে পিউর, তার গ্যারান্টি কে দিবে? দিনে আমার একশো জন কাস্টোমার। এখন একশো জনের দেয়া শেকেলের বিশুদ্ধতা যাচাই করতে গেলে আমার আর বাদাম বেচা লাগবে না। রুপার কয়েন যখন চালু হইলো, তখন আমার এই টেনশন রাজামশাই নিজ কাঁধে নিয়ে নিল। কয়েনের উপুর রাজার খোমাখানা প্রিন্ট করার মানে, এইখানে আর যা কিছু প্রিন্ট করা আছে সব কিছুর দায় রাজার। কয়েনের উপর দুই শেকেল লেখা আছে মানে, এইখানে দুই শেকেলই আছে। বা না থাকলেও ক্ষতি নাই। দুই শেকেলের বিনিময়ে বাজারে যা পাওয়া যায়, আমি ঠিক তা-ই পাব।
দেশের রাজার সাথে আমার সরাসরি কোন সম্পর্ক নাই। কোনকালে ছিলও না। যেটুকু সম্পর্ক— তা এই টাকা-পয়সার মাধ্যমে। টাকা-পয়সার তাই যেমন একটা অর্থনৈতিক ন্যারেটিভ আছে। তার পাশাপাশি আছে একটা রাজনৈতিক ন্যারেটিভ। আধ্যাত্নিক ন্যারেটিভ।
যুগে যুগে তাই টাকা জাল করাকে বিরাট অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হইসে। টাকা জাল করা মানে সরাসরি রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা। সোজা কথা, দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা।
তবে টাকা জাল করে বড়লোক হতে চাইলে আমি একটা ছোট্ট সাজেশান দিতে পারি। কখনোই বাজারে বড় নোট ছাড়বেন না। বড় নোট সবাই চেক করে। পাঁচশো বা এক হাজার টাকার নোট জাল করে ধরা খাওয়া চান্স তাই অনেক বেশি। জাল করবেন একশো বা পঞ্চাশ টাকার নোট। ধরা খাওয়া চান্স ৯৯% যাবে।
যা বলছিলাম, লোকে আসলে টাকায় বিশ্বাস করে না। টাকাটা যেই লোক বা অথরিটি ইস্যু করসে, বিশ্বাসটা আসলে তার উপর। আমেরিকান ডলারে আমাদের বিশ্বাস বাংলাদেশি টাকার চেয়ে বেশি কেন? কারণ, আমেরিকান সিস্টেমের উপর আমাদের বিশ্বাস। এখানকার স্ট্রাকচার আর সিকিউরিটির উপর বিশ্বাস। আমাদের এলিট সমাজ কেন বাংলাদেশে ইনভেস্ট না করে মালয়েশিয়ায় বাড়ি বানায়? কারণ সে জানে এখানকার টাকার কোণ ভ্যালু নাই। আজ সরকার বদল হলে ব্যাঙ্কে তার হাজার কোটি টাকার কানাকড়িও ভ্যালু থাকবে না। বাধ্য হয়ে সে তাই টাকা সরিয়ে মালয়েশিয়া/সিঙ্গাপুর রাখে। যেখানে তার টাকার আজকে যেই ভ্যালু, কালকেও সেই একই ভ্যালু থাকবে।
এইজন্যই রোমান দিনারিয়াস কয়েনের এতো ভ্যালু ছিল পুরো আফ্রো-এশিয়ায়। রোমান সম্রাটের উপর বিশ্বাস এতোই প্রবল ছিল যে ভারতে পর্যন্ত এই দিনারিয়াসে কেনাবেচা হত হামেশাই। আরব মুদ্রার নাম যে দিনার, সেও এসেছে এই ‘দিনারিয়াস’ থেকেই।
আর টাকার সর্বগ্রাসী ক্ষমতার কথা কে না জানে? যে আরব মুসলিম বিশ্বাস করে, যীশু আল্লাহর নবী, সন্তান নয়, তার কাছেও যদি প্রবল পরাক্রমশালী কোন মুদ্রা আসে, যার উপর লেখা—যীশু আল্লাহর সন্তান—সে খুশিমনে সেই মুদ্রা ব্যবহার করবে। তার ধর্মের অপমান হয়েছে বলে এই মুদ্রা সে বর্জন করবে না।
টাকার সাফল্য যদি কিছু থেকে থাকে—এটাই। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সম্পূর্ণ অপরিচিত দুইটা মানুষের মধ্যে বিশ্বাস স্থাপন করা। আমাদের বিশ্বাসের যদি কোন স্তম্ভ তৈরি হয়ে থাকে, সেই স্তম্ভের সবচেয়ে উঁচু আসনটায় থাকবে এই টাকা।