আবার বাল্মীকি প্রতিভার কথাতেই ফিরে আসা যাক। একবার বেশ বড় মাপের বাল্মীকি প্রতিভা অভিনয়ের আয়োজন করা হল। ১৮৯৩ সালে লেডি ল্যান্সডাউনের সম্বধনা উপলক্ষে। এর আগে এক যুগ ধরে (১৮৮১-১৮৯২) বাল্মীকি প্রতিভার বহু মঞ্চাভিনয় হয়ে গেছে। প্রতিবারই সরস্বতী সেজেছেন প্রতিভা এবং বাল্মীকি রবীন্দ্রনাথ। এবার আমন্ত্রণ জানানো হল বহু গণ্যমান্য ইংরেজ দর্শকদের। স্টেজ সাজাবার ভার দেওয়া হল দ্বিজেন্দ্রনাথের অন্যতম পুত্র নীতীন্দ্রনাথকে। তিনি প্রাণপণে স্টেজে ন্যাচারাল এফেক্ট আনবার চেষ্টা করলেন। বারান্দা থেকে টিনের নল লাগিয়ে বৃষ্টির জল পড়ার ব্যবস্থাও হল। সাহেবরা খুব খুশি। এবার হাত-বাঁধা বালিকা সাজলেন প্রতিভার সেজ বোন অভিজ্ঞা আর লক্ষ্মী সাজলেন সত্যেন্দ্র-দুহিতা ইন্দিরা। সরস্বতীর ভূমিকা তো প্রতিভার বাঁধা। সাদা সোলার পদ্ম ফুলে শুভ্র সাজে প্রতিভা যখন অস্টিচ পাখির ডিমের খোলা দিয়ে তৈরি বীণাটি হাতে নিয়ে বসেছিলেন তখন প্রথমে সবাই ভাবলে বুঝি মাটির প্রতিমা। তাই শেষে প্রতিভা যখন উঠে এসে বীণাটি কবির হাতে তুলে দিলেন তখন অডিয়েন্স মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল। এই অভিনয়টির সাফল্য প্রমাণ করল ঠাকুরবাড়ির শিল্পরুচির শুচিতা এবং মাধুর্য। নাটক এবং অভিনয় বললেই যে আদিরসাত্মক একটি প্রণয় কাহিনী বা ভক্তিরসাশ্রিত পৌরাণিক কাহিনী বেছে নেবার দরকার নেই সেকথাও সকলেই বুঝল।
প্রতিভা পরবর্তী জীবনেও গানের জন্যে অনেক সাধনা করেছেন। সৌভাগ্যক্রমে এঁকে কোন বাধা পেতে হয়নি। সরোজার স্বামীর মতো প্রতিভার স্বামীও ছিলেন বিখ্যাত ব্যক্তি, রবীন্দ্র-সুহৃদ আশুতোষ চৌধুরী। দ্বিতীয়বার বিলেত যাবার সময় রবীন্দ্রনাথ আশুতোষের সঙ্গে পরিচিত হন। পাবনার বিখ্যাত চৌধুরী পরিবারের সন্তান আশুতোষ এসেছিলেন ভিন্ন পরিবেশ থেকে। বন্ধনমুক্ত উদার সমাজ-পরিবেশ বা সংস্কৃতির আলো কোনটাই তিনি প্রথম থেকে পাননি কিন্তু যা করেছিলেন তারও নজির মেলে না। তারা সাত ভাই-ই বিবিধ গুণের অধিকারী ছিলেন। বিশেষ করে আশুতোষ ও প্রমথ-র তো কথাই নেই। বাংলা সাহিত্যের আসরে আশুতোষকে পাওয়া যায় সমালোচকরূপে। রবীন্দ্রনাথের কড়ি ও কোমলকে যথোচিত পর্যায়ে সাজিয়ে তিনিই প্রকাশ করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বছরে বি. এ. ও এম. এ পাশ করা (১৮৮০)। আশুতোষ বিলেত যাচ্ছিলেন বেশ কাঠখড় পুড়িয়ে। তাঁর দিদি প্রসন্নময়ীর লেখা পূর্বকথা পড়ে জানা যায় আশুতোষের পথ মোটেই সুগম ছিল না। চৌধুরীবংশের মধ্যে আশুতোষই প্রথম বিলেত গেলেন। তার আগে তাদের জেলার আর কেউ বিলেত যাননি। ফলে জাত গেল, জাত গেল রব উঠল চারদিকে। চৌধুরীরা কেউ প্রায়শ্চিত্ত করে সমাজে ওঠবার চেষ্টা না করাতে সমাজপতিরা আক্রমণ করলেন আশুতোষের বাবা পিসীদের। তাদের প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা হল। প্রত্যেকে পাঁচ কাহন কড়ি দিয়ে মাথা মুড়িয়ে তবে অব্যাহতি পেলেন। প্রসন্নময়ী লিখেছেন, তাঁহারা তো বালবিধবা, আশৈশব ব্রহ্মচর্য প্রতিপালন করিয়া চলিতেন, অকারণ কেন তাহাদিগের জাতি লইয়া টানাটানি পড়িয়া গেল, সেটা বুঝিবার ক্ষমতা কাহারও ছিল না ও নাই। আসলে এই ছিল বাংলা দেশের খাঁটি ছবি। সে সময় হিন্দুর ছেলে বিলেত গেলেই বাড়িশুদ্ধ সকলকে এমনি সামাজিক অত্যাচার সহ্য করতে হত। অথচ সময়ের দিক থেকে ১৮৮১ সাল খুব পুরনো নয়। এর আগে জ্ঞানদানন্দিনী দুটি অবোধ শিশু নিয়ে বিলেত ঘুরে এসেছেন। চন্দ্রমুখী পাশ করে গেছেন এনট্রান্স। কাদম্বিনীর সঙ্গে গ্র্যাজুয়েট হবার তোড়জোড় করছেন। প্রসন্নময়ীর পিসীরাও অক্ষর পরিচয়হীনা নন। প্রতিভা নেমেছেন অভিনয় করতে।
রবীন্দ্রনাথের সেবার বিলেত যাওয়া হল না। কিন্তু আশুতোষের সঙ্গে বন্ধুত্ব ক্ষুন্ন হয়নি। পরে বিলেত থেকে ফিরে আশুতোষ ঠাকুরবাড়ির অন্যান্যদের সান্নিধ্যে আসেন। তাঁর সরল স্বভাব ও সাহিত্যানুরাগ ঠাকুরবাড়ির সকলেরই খুব ভাল লাগল। আলাপ হল প্রতিভার সঙ্গে! রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী প্রতিভার সঙ্গে এমন সোনার টুকরো ছেলেকে সুন্দর মানাবে, সুতরাং বিয়ের সানাই বাজতেও দেরি হল না। এই বিয়েতে অত্যন্ত সুখী হয়েছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বলেছিলেন, আশু আমার একটা অর্জন। অনেক সাধনায় প্রতিভা এমন পাত্রে পরিণীতা হয়েছে। এ সময় একটা ঘটনা ঘটেছিল। আমরা জেনেছি ইন্দিরার লেখা শ্রুতি ও স্মৃতির পাণ্ডুলিপি পড়ে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কোন সভায় বুঝি যাচ্ছিলেন ইন্দিরা, একই গাড়িতে উঠেছিলেন আশুতোষ। এ ঘটনায় কারুর কোন হাত ছিল না। কিন্তু ভয়ে কাঠ হয়ে নীপময়ী ভাবলেন, জ্ঞানদানন্দিনী বুঝি তার মেয়ের সঙ্গেই আশুতোষের বিয়ে দিতে চান। প্রগতিসম্পন্ন জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গে মনের মিল অনেকেরই হয়নি। তাই সন্দেহ। জ্ঞানদানন্দিনী তো হেসে আকুল। তার মেয়ের বয়স কম, এর মধ্যে বিয়ে দেবেন কি? তবু সন্দেহ ঘোচে না। এরই মধ্যে মৃত্যু হয় হেমেন্দ্রনাথের। কিছুদিন পরে প্রতিভার সঙ্গে আশুতোষের বিয়ে হয়ে গেল। অনেকের মনেই প্রশ্ন। জেগেছিল আশুতোষের বাকি ছয় ভাইয়ের সঙ্গে প্রতিভার ছয় বোনের বিয়ে। হবে কিনা? এঁদের মধ্যে তিন ভাইয়ের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির আরো তিনজন মেয়ের বিয়ে হয়েছিল কিন্তু তারা কেউই প্রতিভার নিজের বোন ছিলেন না। এই বিয়ে উপলক্ষে দুটি পরিবারের যুবক-যুবতীদের অনেকেই গভীর মেলামেশা করেছিলেন। অনেকে মনে করেন এর কারণ ঠাকুরবাড়ির শিল্প-সংস্কৃতির আহ্বান, আবার কেউ কেউ বলেন এর পেছনে ছিল ঠাকুরবাড়ির রূপবতী-গুণবতী শিক্ষিতা মেয়েদের সঙ্গে পরিচিত হবার বাসনা। কারণ যাই হোক না কেন, বাংলা দেশের সমস্ত শিক্ষিত সমাজই ঠাকুরবাড়ি সম্বন্ধে, বিশেষত এ বাড়ির বিদুষী সঙ্গীতজ্ঞ মেয়েদের সম্বন্ধে, সচেতন হয়ে উঠছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। ইন্দিরা জানিয়েছেন, ঠাকুর এবং চৌধুরী-পরিবারে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা সব সময়েই যে সুখ পরিণতি লাভ করেছিল তা নয়। এই সব ছোটখাট ঘটনার ফাঁক দিয়ে আমরা মাঝে মাঝে সমাজেরও ছবিটা যেন দেখতে পাই।
সঙ্গীতের ক্ষেত্রে প্রতিভার সত্যিকারের অবান হল স্বরলিপি রচনার সহজতম পন্থাবিষ্কার। তিনি দ্বিজেন্দ্রনাথ এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্বরলিপি পদ্ধতি এবং স্বরসন্ধি প্রয়োগ পদ্ধতিতে যেমন নতুনত্ব এনেছিলেন তেমনি তাকে করে তুলেছিলেন সকলের ব্যবহারের উপযোগী। প্রতিভার আগে কোন মহিলা স্বরলিপি নির্মাণের ব্যাপারে এগিয়ে আসেননি।
জ্ঞানদানন্দিনীর বালক পত্রিকায় প্রতিভার স্বরলিপি পদ্ধতি প্রকাশ হতে থাকে। বাল্মীকি প্রতিভা ও কালমৃগয়ার গানগুলিরও প্রথম স্বরলিপিকার হচ্ছেন প্রতি। শোনা যায়, এ সময় হেমেন্দ্রনাথের নির্দেশে তিনি বহু ব্ৰহ্মসঙ্গীত ও হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের স্বরলিপি তৈরি করেন। সংখ্যা আমরা গুণে দেখিনি তবে প্রতিভার এক ভাই হিতেন্দ্রনাথ ১৩১১-র আষাঢ় সংখ্যা পুণ্যে জানাচ্ছেন যে এই সংখ্যা প্রায় তিনশ-চারশ। কিন্তু শুধু স্বরলিপি নির্মাণ করলেই তো হবে না, গাইবে কে?
প্রতিভা না হয় প্রকাশ্যে গান গেয়ে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করলেন, তাকে নিত্য নতুন রস সিঞ্চন করে বাঁচিয়ে রাখতে হবে তো। সে। ওর ও নিলেন প্রতিভাই। স্বরলিপি নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে চলল গান শেখাবার চেষ্টা। তারও হাতে খড়ি বালকে। সেখানে তিনি কাগজে কলমে খুললেন একটি গানের ক্লাস সহজ-গানশিক্ষা। বালক ছোটদের কাগজ, ছোটদের দিয়ে শুরু করা ভাল তাই তিনি প্রথমে তাদের বলে নিলেন গান কাকে বলে। সেই বয়সেই প্রতিভা গানের সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছেন, গান মানুষের স্বাভাবিক। হাসি-কান্নার সময় মানুষের কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন হয়। তাই বোঝা যায় নানা ভাবের নানা সুর আছে, সেই সুরের চর্চা করেই গানের উৎপত্তি হয়েছে। সঙ্গীতের সম্বন্ধে প্রতিভার এই সংজ্ঞা নির্ণয় তার একান্ত নিজস্ব। পরিণত বয়সে তিনি আরও মৌলিক সঙ্গীত চিন্তার পরিচয় দিয়েছিলেন।
গান এমন একটা জিনিষ যার জন্য শুধু জ্ঞান নয় রীতিমত চর্চার প্রয়োজন আছে। প্রতিভা সেই চেষ্টায় নিজের বাড়িতে প্রথমে আনন্দসভা পরে সঙ্গীতসংঘ স্থাপন করেন। গান শেখার স্কুল হিসাবে সঙ্গীত-সংঘ খ্যাতিলাভ করে। এখানে প্রতিভা শেখাতেন খাটি ওস্তাদী হিন্দুস্থানী গান। যদিও বিদেশী সঙ্গীতেও তার ছিল অবাধ অধিকার। শিখেছিলেন Nicolini-এর কাছে। বাঙালী মেয়েরা এখানে ভাল করে গান শেখার সুযোগ পেল। অবশ্য সঙ্গীত-সংঘের সঙ্গে সঙ্গীত-সম্মিলনী নামটাও অনেকেরই চেনা মনে হবে। সেটিও গানের স্কুল স্থাপন করেছিলেন মিসেস বি. এল. চৌধুরী, অর্থাৎ বনোয়ারীলাল চৌধুরীর স্ত্রী প্রমদা চৌধুরী। এই দুটি স্কুলের সুযোগ হওয়ায় বাঙালী মেয়েরা অনেকেই গান শিখতে শুরু করেন। প্রতিভার স্কুলটির দেখাশোনার কাজে ইন্দিরাও এসে যোগ দিয়েছিলেন, ঘটনাস্থত্রে তখন তিনিও এসেছেন চৌধুরীবাড়ির বৌ হয়ে।
গান শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিভা একটা সঙ্গীত বিষয়ক পত্রিকার কথাও ভাবছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গীত প্রকাশিকা অনেকদিন আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু গানের চর্চার জন্য ঐরকম একটা পত্রিকা থাকা খুবই প্রয়োজন। তাই আনসভার নামে প্রতিভা নতুন পত্রিকার নাম দেন আনন্দ সঙ্গীত পত্রিকা। তবে কোন কিছু একা করায় প্রতিভার বড় সংকোচ তাই এবারও দলে টানলেন ইন্দিরাকে। যুগ্ম সম্পাদনায় আনন্দ সঙ্গীত আট বছর সগৌরবে প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় প্রতিভা শুধু নিয়মিত ভাবে স্বরলিপি প্রকাশ করতেন তা নয়, সেইসঙ্গে চলত লুপ্ত সঙ্গীত পুনরুদ্ধারের চেষ্টা। শুধু কি সঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীতের পুনরুদ্ধারের চেষ্টা? প্রতিভা প্রাচীন সঙ্গীত শিল্পীদেরও বিস্মৃতির অন্তরাল থেকে উদ্ধার করতে লাগলেন—তানসেন, স সদারঙ্গ, বৈজু বাওয়া নায়ক, মহারাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর ও আরো অনেক সঙ্গীতস্রষ্টার জীবনী রচনা তার সঙ্গীত সম্পর্কিত চিন্তার বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছে। আজ যখন কোন প্রাণহীন যান্ত্রিক কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনি তখন বুঝতে পারি প্রতিভা কেন সঙ্গীতচর্চার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীতজ্ঞদের কথা ভাবতেন, তাদের সঙ্গীত সাধনাকে আদর্শের মতো তুলে ধরতে চাইতেন। শিল্প ও শিল্পী উভয়কে না জানলে যে সাধনা অপূর্ণ থেকে যায়। তাঁর চেষ্টায় বহু সঙ্গীতজ্ঞের জীবন ও সাধনার লুপ্ত ইতিহাস সংগৃহীত হয়েছে। গানের ক্ষেত্রে প্রতিভা তার কাকা-জ্যাঠাদের মতো খ্যাতি পাননি বটে কিন্তু সঙ্গীত জগতে তিনি তার গুরুজনদের মতোই সমান কৃতিত্বের অধিকারিণী। প্রতিভার মৃত্যুর পরে সঙ্গীত-সংঘের পুরস্কার বিতরণ সভায় তার কাকা রবীন্দ্রনাথ যে কথা বলেছিলেন তার মধ্যেই প্রতিভার প্রকৃত পরিচয় লুকিয়ে রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেন, সঙ্গীত শুধু যে তার কণ্ঠে আশ্রয় নিয়েছিল তা নয়, এ তার প্রাণকে পরিপূর্ণ করেছিল। এরই মাধুর্য প্রবাহ তার জীবনের সমস্ত কর্মকে প্লাবিত করেছে।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে প্রতিভার প্রধান কৃতিত্ব স্বরসন্ধিসহ কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি রচনা করা। এর সার্থক উদাহরণ কোন আলোকে প্রাণের প্রদীপ গানের স্বরলিপি। সংস্কৃত স্তোত্রে সুর দিয়ে গাওয়ার পরিকল্পনা রবীন্দ্রনাথের একান্ত নিজস্ব। তার দেওয়া সুরে বেদগানের স্বরলিপিও তৈরি করেন প্রতিভা। মাঘোৎসবের সূচনা হত একটি বেদগানের ভাবগম্ভীর পরিবেশ দিয়ে। কখনও যদেমি প্রস্ফুন্নিব কখনও তমীশ্বরাণাং আবার কখনও গীতা স্তোত্র দিয়ে। প্রতিবাই প্রতিভা স্বরলিপি তৈরি করে অন্যদের গান শেখাতেন। তিনি নিজেও যে দু-একটা গানে সুর দেননি তা নয়, ত্বমাদিদেব পুরুষপুরাণ স্ত্রোত্রে তিনি কেদারা রাগিণীর সুর বসান। সংখ্যায় কম হলেও প্রতিভার নিজের লেখা গানও দুর্লভ নয়, বিশেষ করে সাঁঝের প্রদীপ দিনু জ্বালায়ে এবং দীনদয়াল প্রভু ভুলো না অনাথে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
প্রতিভার জীবনে গানের সঙ্গে মিশে ছিল আরো দুটি জিনিস—ধর্ম ও জ্ঞানস্পৃহা। মহর্ষির অধ্যাত্মসাধনা এবং হেমেন্দ্রর উগ্র ধর্মানুরাগ সঞ্চারিত হয়েছিল প্রতিভার জীবনে। তাঁর ভক্তিগীতি বা নববর্ষের বক্তৃতাগুলোর ওপর নজর বোলালেই বোঝা যাবে ব্রাহ্মধর্ম প্রতিভার মনে কী গভীর ভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। ঠিক সাহিত্যচর্চা না করলেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ওপর প্রতিভার বেশ দখল ছিল। তিনি ইংরেজী, ফরাসী, ল্যাটিন, সংস্কৃত প্রভৃতি নানা ভাষা যেমন শিখেছিলেন, তেমনি ইতিহাস-ভূগোল ও অন্যান্য বিদ্যাচর্চাতেও আগ্রহী ছিলেন। ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য মেয়েদের দু-চারটে লেখা যেমন ইতস্তত চোখে পড়ে প্রতিভার লেখা সেরকম দেখা যায় না। তার একটি বক্তৃতা সংগ্রহ আলোক ছাপা হয়েছিল অনেকদিন আগে। সেখান থেকে তার একটি প্রবন্ধের কিছু অংশ আমরা উদ্ধৃত করছি। সে অংশটির মধ্যেই প্রতিভার রচনারীতির বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। প্রতিভা লিখছেন :
ভাল চিন্তা হৃদয়কে অধিকার না করিলে ভাল হইবার দিকে অগ্রসর হওয়া যায় না। চিন্তার ভালমন্দ গতি আমাদের আচার ব্যবহারের গতি নিয়মিত করে। চিন্তা সংযত না হইলে আমাদের স্বভাব যথেচ্ছাচারী ও শিথিল হইয়া পড়ে। কিন্তু কাহার চালনায় এই চিন্তাকে আমরা সংযত করিতে পারি? কুপথ হইতে ফিরাইয়া লইতে পারি? সে সারথি কে? সে আর কেহ নয়-জ্ঞান।
এই সংক্ষিপ্ত উক্তিই বিদুষী প্রতিভার জ্ঞানতৃষ্ণা ও সংযত চিন্তার প্রতি আগ্রহ প্রমাণ করে। নববর্ষের প্রীতি উপহার হিসেবে তিনি মাঝেসাঝে ছোট ছোট কবিতাও লিখতেন। একবার লিখেছিলেন বর্ষপ্রবেশ :
বর্ষ এল বর্ষ গেল নিয়তি তোমার,
সুমঙ্গল পাঞ্চজন্য বাজিল আবার
প্রকৃতির ঘরে ঘরে নব অনুরাগে
ভরিয়া উঠিল বিশ্ব নবীন সোহাগে।
কবিতা প্রসঙ্গে প্রতিভার পুত্রবধূ লীলার কথাও সেরে নেওয়া যাক। লীলা পাথুরেঘাটার রণেন্দ্রমোহন ঠাকুরের মেয়ে। বিদুষী কবি। বিয়ে হয়েছিল প্রতিভার বড় ছেলে আর্যকুমারের সঙ্গে। তার কাব্যগ্রন্থ কিশলয়, ঝরার ঝর্ণা, রূপহীনা ও সিঞ্চন বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পরে রণেন্দ্রমোহন তার নামে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর একটি পুরস্কার দেবার ও একটি বক্তৃতামালার ব্যবস্থা করেন। প্রথম লীলা পুরস্কার পান হেমলতা দেবী (১৯৪৪)। আর এই বক্তৃতামালার প্রথম বক্ত-অনুরূপা দেবী। তার বিষয় ছিল সাহিত্যে নারী-স্রষ্টী ও সৃষ্টি (১৯৪৫)। আপাতত আমরা প্রতিভার অন্যান্য বোনেদের কথায় আসি।
প্রতিভা যখন সংগীত চিন্তায় বিভোর, লুপ্ত সঙ্গীত শিল্পীদের পরিচয় উদ্ধারে তৎপর, ঠিক সেই সময় তার মেজ বোন প্রজ্ঞসুন্দরী ব্যস্ত ছিলেন আর একটা চিরপুরনো অথচ চিরনতুন জিনিষ নিয়ে। দিদির মতো তিনিও লেখাপড়া শেখা, গান শেখ, স্কুল যাওয়া, ছবি আঁকা দিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন কিন্তু নদী যেমন এক উৎস থেকে বেরিয়েও ভিন্নমুখী হতে পারে তেমনি প্রজ্ঞাও ধরলেন একটি নতুন পথ ঠাকুরবাড়িতে সব রকম শিল্পচর্চার সুযোগ ছিল। মেয়েরাও শিখতেন নানারকম কাজ। কিন্তু প্রজ্ঞার মন টেনেছিল রান্নাঘর। এমন আর নতুন কি? ঠাকুরবাড়িতে সব মেয়ে-বৌই অল্পবিস্তর রাধতে শিখতেন; তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে গেছেন কাদম্বরী ও মৃণালিনী। শরৎকুমারী ও সরোজাসুন্দরীরও এ ব্যাপারে সুনাম ছিল। সৌদামিনীদের প্রতিদিন একটা করে তরকারি রাধা শিখতে হত। তবে আর প্রজ্ঞার নতুনত্ব কোথায়? বলতে গেলে উত্তরাধিকারসুত্রেই তিনি রান্না শিখেছিলেন। তা শিখেছিলেন ঠিকই। প্রজ্ঞার মা নীপময়ীও ভাল রাঁধতেন। মহর্ষিরও এ ব্যাপারে কম উৎসাহ ছিল না। অথচ তাদের বাড়িতে রোজকার ব্যঞ্জন ছিল ডাল—মাছের ঝোল—অম্বল, অম্বল—মাছের ঝোল-ডাল। বড়ি ভাজা, পোর ভাজা, আলু ভাতে ছিল ভোজের অঙ্গ। আসলে এ ব্যবস্থা ছিল বারোয়ারি। তবে ব্যঞ্জনে মিষ্টি দেবার প্রচলন শুরু হয় ঠাকুরবাড়ি থেকেই। মহর্ষি নিজে মিষ্টি তরকারি খুব ভালবাসতেন। বৌয়েরা ঘরে নানারকম তরকারি ও মিষ্টি তৈরি করতেন। প্রজ্ঞার বৈশিষ্ট্য এই যে তিনি শুধু নিজের হাতে রাধা খাবার প্রিয়জনদের মুখে তুলে দিয়ে নিরস্ত হননি। ঠাকুরবাড়ির চিরকেলে রেওয়াজ ছেড়ে নিজেদের আবিষ্কার করা পিঠে-পুলিপোলাও-ব্যঞ্জন তুলে দিতে চেয়েছেন সকলের মুখে। এখানেই তার অনন্যতা।
বাস্তবিকই রান্না এবং রান্নাঘর নিয়ে, কেতাবী ভাষায় রন্ধনতত্ত্ব ও রন্ধনবিদ্যা নিয়ে তিনি যত মাথা ঘামিয়েছেন তত চিন্তা আর কোন মহিলা করেছেন বলে মনে হয় না। ঘরের কোণে বসে রান্নার পরীক্ষা চালাবার সময় তিনি সেগুলো লিখে রেখেছিলেন ভাবীকালের আগন্তুকদের জন্যে। তাই তাঁর আমিষ ও নিরামিষ আহার-এর বইগুলি এত নতুন হয়ে দেখা দিয়েছিল। আধুনিক যুগে গার্হস্থ্য বিজ্ঞানের বহু বই লেখা হয়েছে ও হচ্ছে, কিন্তু পঁচাত্তর বছর আগে প্রজ্ঞার বইগুলি হাতে নিয়ে অবাক হয়ে যেতে হয়। অবশ্য এ ব্যাপারে আরো দু একজনের নাম করা যায়। কিরণলেখা রায়ের বরেন্দ্র বন্ধন ও জলখাবার, নীহারমালা দেবীর আদর্শ রন্ধন শিক্ষা ও বনলতা দেবীর লক্ষ্মীও রান্নার বই হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছিল, তবে সে পরের কথা! পুরুষেরাও এ ব্যাপারে দক্ষতা দেখিয়েছিলেন, সংস্কৃত পাকরাজেশ্বর অনুবাদ করিয়েছিলেন বর্ধমানরাজ। বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের রান্নার বইও অনেক আগেই প্রকাশিত হয়েছিল কিন্তু প্রজ্ঞা ভেবেছিলেন বেশি। তার রান্নার বই দুটির ভূমিকাদুটিকে আমরা একাধারে রন্ধনতত্ত্ব ও গার্হস্থ্য বিদ্যার আকর বলে ধরে নিতে পারি। বিয়ের পরে বেশ গিন্নীবান্নি হয়েই প্রজ্ঞা এ কাজে হাত দিয়েছিলেন।
প্রতিভার মতো প্রজ্ঞারও বিয়ে হয়েছিল এক বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে। অসমিয়া সাহিত্যের জনক লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়া তার স্বামী। বিয়ের আগে লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে তার কোন রকম সাক্ষাৎ হয়নি। লক্ষ্মীনাথ তার আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন যে ঠাকুরবাড়ির এই গুণবতী, শিক্ষিত, সুশীলা ও ধর্মপ্রবণা মেয়েটির ছবি দেখেই তিনি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন এবং বিবাহে সম্মত হন। যদিও তার নিজের বাড়ি থেকে এসেছিল প্রচণ্ড বাধা। কারণ তখনকার দিনে ঠাকুরবাড়িতে বিয়ে হওয়া মানেই ছেলেকে হারানো। তাই একমাসের মধ্যে বহু টেলিগ্রাম কলকাতা ও গৌহাটিতে আসা যাওয়া করলেও বিধির লিখন বদলাল না। ১৮৯১ সালের ১১ মার্চ, স্বপ্নরঙিন বাসন্তী-সন্ধ্যায় সপ্তপদী গমনের পর শুভদৃষ্টি। বেজবড়ুয়া। দেখলেন প্রজ্ঞা তার দিকে তাকিয়েই ফিক করে হেসে ফেললেন। হাসি ফুটল লক্ষ্মীনাথেরও ঠোটের কোণে। পরে অবশ্য তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন প্রজ্ঞাকে, শুভদৃষ্টির সময় ঐরকমভাবে হেসেছিলে কেন? প্রজ্ঞার উত্তর, বিয়ের অনেকদিন আগেই তোমাকে আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম। স্বপ্নে দেখা মুখটার সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের মুখের হুবহু মিল দেখে হেসেছিলেন প্রজ্ঞা। লক্ষ্মীনাথের আঁকা এই সব ছোট কথার-ছবি দেখে, ধরে নিতে অসুবিধে হয় না দাম্পত্যজীবনে প্রজ্ঞা কতখানি সুখী ছিলেন। নিজের জীবনে পর্যাপ্ত সুখের সন্ধান পেয়ে তিনি বুঝেছিলেন গৃহকে সুখের আগার করে তুলতে হলে গৃহিণীকে কোন দিকে নজর দিতে হবে। তাকে মায়ার খেলাতে অভিনয় করতে দেখা গেছে, ছবি আঁকতে দেখা গেছে কিন্তু সব ছেড়ে তিনি আঁকড়ে ধরেছিলেন আপাত অবহেলিত রান্নাঘরখানিকে।
রান্নাঘর নিয়ে প্রজ্ঞা ভাবতে শুরু করেন পুণ্য পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে সঙ্গে। হেমেন্দ্রনাথের পুত্রকন্যাদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই প্রকাশিত হত পুণ্য পত্রিকা। লিখতেন প্রজ্ঞার ভাইবোনেরা, প্রথম সম্পাদিকা ছিলেন প্রজ্ঞা নিজে। প্রথম থেকেই এর পাতায়-পাতায় হরেক রকম আমিষ ও নিরামিষ ব্যঞ্জনের পাকপ্রণালী ছাপা হতে থাকে। সুগৃহিণীর মতো তিনি আবার তৎকালীন বাজারদরটিও পাঠিকাদের জানিয়ে দিতেন যাতে কেউ অসুবিধেয় না পড়েন। কালের সীমানা পার হয়ে আজ সে বাজারদর আমাদের মনে শুধু সুখস্মৃতি জাগায়। মাছের দাম ছিল অবিশ্বাস্য রকমের সন্তা—আধসের পাকা রুই তিন বা চার আনা, চিতল মাছ তিন পোয়া ছয় আনা, বড় বড় ডিমওয়ালা কৈ আট নটার দাম নয় দশ আনা, একটি ডিম এক পয়সা, ঘি এক সের এক টাকা, দুধ এক সে চার আনা, টমেটো কুড়িটি দুই আনা—না, অকারণে মন খারাপ করে লাভ কি? শুধু এটুকু মনে রাখলেই হবে, এই দামগুলো সঠিক বাজারদর কিনা ধনী গৃহিণী প্রজ্ঞা যাচিয়ে নেননি। দরদাম করলে জিনিষপত্রের দাম হয়ত আরো একটু কমত।
আমিষ ও নিরামিষ আহার-এর তিনটি খণ্ড বেরিয়েছিল। প্রজ্ঞা ভেবেছিলেন পাকপ্রণালীর পরে লিখবেন গৃহবিজ্ঞানের বই। কিন্তু সে আর হয়ে ওঠেনি। এর ফলে অপূরণীয় ক্ষতি রয়ে গেল গৃহবিজ্ঞানের। প্রজ্ঞার মত এত যত্নে রান্নার বই লেখার কথা হোমসায়েন্সের শিক্ষিকারাও ভাবেন বলে মনে হয় না। তিনি বইয়ের প্রথম দিকে খাদ্য, পথ্য, ওজন, মাপ, দাসদাসীর ব্যবহার, পরিচ্ছন্নতা সব ব্যাপারেই প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তৈরি করেছেন রান্নাঘরে ব্যবহৃত শব্দের পরিভাষা। হয়ত শব্দগুলো আমাদের অজানা নয় তবু এ ধরনের শব্দের সংকলন এবং পরিভাষা থাকা যে সত্যিই খুব প্রয়োজনীয় তাতে সন্দেহ নেই। কতখানি উৎসাহ এবং নিষ্ঠা থাকলে একাজ করা সম্ভব পরিভাষার দীর্ঘ তালিকা দেখলেই বোঝা যাবে। প্রজ্ঞা চলিত এবং অপ্রচলিত কোন শব্দকেই অবহেলা করেননি। অধিকাংশই আমাদের পরিচিত শব্দ। যেমন :
বাখর=পাপড়ি
চুটপুট = ফোড়ন ফাটার শব্দ
হালসে=কাঁচাটে বিস্বাদ গন্ধ
রুটিতোষ= সেঁকা পাউরুটি
পিট্নী= যাহার দ্বারা মাংসাদি পেটানো হয়
বালিখোলা=কাঠ খোলায় বালি দিয়া জিনিষ ভাজা
সিনা=বুক
চমকান= শুকনা খোলায় অল্প ভাজা
তৈ= মালপোয়া ভাজিবার মাটির মাত্র
তিজেল হাঁড়ি= ডাল বঁধিবার চওড়া মুখ হাঁড়ি
তোলো হাঁড়ি=ভাত রাঁধিবার বড় হাঁড়ি
খণ্ড কাঁটা = ডুমা ডুমা টুকরো কাঁটা
চিরকাটা=লম্বাভাবে ঠিক অর্ধেক করিয়া কাঁটা
ছুঁকা=ফোড়ন দেওয়া
রান্না ঘরে যে এত রকম শব্দ প্রচলিত আছে প্রজ্ঞার আগে তা কে জানত? এখনও এসব শব্দ নিত্যব্যবহার্য, তবু গার্হস্থ্যবিজ্ঞান লেখার সময় এ জাতীয় পরিভাষার প্রয়োজন অস্বীকার করা চলে না।
এছাড়াও আছে নানারকম প্রয়োজনীয় কথা—গৃহিণীদের জ্ঞাতব্য নানারকম তথ্য—বিনা পেঁয়াজে পেয়াজের গন্ধ করা কিংবা ধরা গন্ধ যাওয়ার মতো আরো অনেক কথা আছে। কজন আর জানে, আদার রসে হিং ভিজিয়ে রেখে সেই হিংগোলা নিরামিষ তরকারিতে দিলে পিয়াজের গন্ধ হয় কিংবা ডাল-তরকারি হাড়িতে লেগে গেলে তাতে কয়েকটা আস্ত পান ফেলে দিলে পোড়া গন্ধ কমে যায়? তরিতরকারি রোদে শুকিয়ে কি ভাবে অনেকদিন রেখে দেওয়া যায় সেকথা জানাতেও প্রজ্ঞা ভোলেননি। তবে এসব ছোটখাট জিনিষ ছাড়া প্রজ্ঞা আরও একটা নতুন জিনিষ বাংলার ভোজসভায় এনেছিলেন। সেটি হল বাংলা মেনু কার্ড বা তার নিজের ভাষায় ক্রমণী। বিলিতি ধরনের রাজকীয় ভোজে মেনু কার্ডের ব্যবস্থা আছে। প্রজ্ঞা স্থির করলেন তিনিও নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের জন্যে ক্ৰমণীর ব্যবস্থা করবেন। ছাপা ক্রমণী যদি হাতে হাতে বিলি করা না যায় তাহলে সুন্দর করে লিখে খাওয়ার ঘরের দেওয়ালে ঝুলিয়ে দিলেও চলবে। শুধু নামকরণ করেই প্রজ্ঞা কর্তব্য শেষ করেননি। বাংলা ক্ৰমণী কেমন হবে, এক একবারের ভোজে কি কি পদ থাকবে, কোন্ পদের পরে কোষ্টা আসবে, কিংবা কেমন করে লিখলে শিল্পসম্মত হয়ে উঠবে সে কথাও ভেবেছেন। কয়েকটা ক্রমণী দেখলেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা। প্রথমে একটা নিরামিষ ক্ৰমণী :
জাফরণী ভুনি খিচুড়ি
ধুঁধুল পোড়া শিম বরবটি ভাতে
পাকা আম ভাতে
পটলের নোনা মালপোয়া
পাকা কাঁঠালের ভূতি ভাজা
কাঁকরোল ভাজা
ভাত
অরহর ডালের খাজা
লাউয়ের ডালনা
বেগুন ও বড়ির সুরুয়া
ছোলার ডালের ধোঁকা
বেগুনের দোল্মা
আলুবখরা বা আমচুর দিয়ে মুগের ডাল
পাকা পটলের ঝুরঝুরে অম্বল
ঘোলের কাঁঢ়ি
রামমোহন দোল্মা পোলাও
নীচুর পায়স
নারিকেলের বরফি।
যেন একটা আস্ত কবিতা। হঠাৎ চোখে পড়লে সেরকম ভুল হবারই সম্ভাবনা। যদিও নিরামিষ তবু সরস হয়ে ওঠে রসনা। সেকালের ভোজসভা সম্বন্ধেও একটা ধারণা গড়ে ওঠে। প্রজ্ঞা প্রতিটি রান্না নিজে হাতে বেঁধে তবে সেগুলি খাদ্যতালিকাভুক্ত করতেন। অনেক রান্নার আবিষ্কী তিনি নিজেই। মাঝে মাঝে সেগুলোর সঙ্গে যোগ করে দিতেন প্রিয়জনের নাম। যেমন, রামমোহন দোলা পোলাও, দ্বারকানাথ ফির্নিপোলাও, সুরভি—তার অকালমৃত মেয়ের নাম।
আবার অনেক রকম উদ্ভট এবং নতুন ব্যঞ্জনও আছে। খেজুরের পোলাও, লঙ্কা পাতার চড়চড়ি, রসগোল্লার অম্বল, বিটের হিঙ্গি, পানিফলের ডালনা, ঝিঙাপাত গোড়া, মিছা-দই মাছ, ঘণ্ট-ভোগ, কচি পুই পাতা ভাজা, কঁচা তেঁতুলের সরস্বতীঅম্বল, আমলকী তে, পেঁয়াজের পরমানু, কই মাছের পাততোলা, কাকড়ার খোলা পিঠে, মাংসের বোম্বাইকারী—আরো কত কী। ক্লাসে ওঠার মতো রান্না শেখারও ক্লাস আছে, হিঙ্গি করতে শিখিলেই বুঝিতে পারিবে ইহা ঠিক যেন ডালনার এক ধাপ উপরে উঠিয়াছে অথচ কালিয়াতে উঠিতে পারে নাই। আরো দু-একটা ক্ৰমণী দেখা যাক। আমিষ ক্ৰমণীর আকার খুব বড় নয়। যেমন :
এস্পারোগাস স্যাণ্ডুইচ
শসার স্যাণ্ডুইচ
মাংসের স্যাণ্ডুইচ
মাছের স্যাণ্ডুইচ
পাউণ্ড কেক
স্পঞ্জ কেক
বিস্কুট
সিংয়াড়া
ডালমোট
ঝুরি ভাজা
আইসক্রীম।
আরেকটা :
পাতলা পাউরুটির ক্রূটোঁ।
জারক নেবু
বাদামের সুপ
ভেটকী মাছের মেওনিজ
মুরগীর হাঁড়ি কাবাব
মটনের গ্রেভি কাটলেট
শবজী ও বিলেতী বেগুনের স্যালাড
স্নাইপ রোস্ট
আলুর সিপেট
উফস আলানিজ
ডেজার্ট
কফি।
সে তুলনায় নিরামিষ ক্ৰমণীর আকার বেশ বড়। আর গৃহিণীর কৃতিত্বও যেন বেশি :
ভাত
আলু পোড়া, দুধ দিয়ে বেগুন ভর্তা, মূলা সিদ্ধ, আনারস ভাজা
মোচা দিয়া আলুর চপ
মুগের ফাঁপড়া
ডুমুরের হেঁচকি মোচা হেঁচকি
কুমড়া দিয়া মুগের ডালের ঘণ্ট
পালম শাকের ঘণ্ট
উচ্ছা দিয়া মসুর ডাল
ওলার ডালনা
ঢ়্যাঁড়সের ঝোল
ছানার ফুপু পোলাও
নিরামিষ ডিমের বড়ার কারী
করলার দোল্ম আচার
আলুর দমপক্ত
কচি কাঁচা তেঁতুলের ফটকিরি ঝোল
নারিকেলের অম্বল
পাকৌড়ী
খইয়ের পরমান্ন
কমলী।
আজকাল খুব বড় ভোজসভাতেও পদের সংখ্যা এত বেশি হয় না। নিরামিষ ভোজসভাও আজকের দিনে অচল। যত রকম তরকারি, পিঠে, পায়েস খালার পাশে সাজিয়ে দেওয়া যেত ততই সুগৃহিণীত্ব প্রমাণিত হত। বাঙালী জীবনের শান্ত নিরুদ্বেগ স্বচ্ছলতার প্রতীক এই সব ভোজসভা। বাঙালী কোনদিনই ভোজনবীর ছিল না, ছিল ভোজনরসিক। তাদের শিল্পবোধ স্থায়ী জিনিষগুলোকে ছাড়িয়ে অস্থায়ী তাৎক্ষণিকতার মধ্যেও রসের সন্ধান করেছে। আর বাঙালী মেয়েরা রান্নাঘরকে করে তুলেছে শিল্পমন্দির। প্রজ্ঞা যে সব রান্নার কথা বলছেন এত না হলেও অধিকাংশের সঙ্গেই তখনকার গৃহিণীরা পরিচিত ছিলেন এবং নিজেরাও রাঁধতেন। তবে তারা কেউ সেসব পাকপ্রণালী প্রজ্ঞার মতো লিখে অন্যের রান্না শেখার পথ সুগম করে যাননি। এক একটি বড় ক্ৰমণীতে ফুটে, উঠেছে প্রজ্ঞার শিল্পবোধ ও সৌন্দর্যরুচি :
কলাইশুটি দিয়া ফেনসা খিচুড়ি
পলতার ফুলুড়ি
বেশন দিয়া ফুলকপি ভাজা
কাঁচা কলাইশুটির ফুলুড়ি
পেঁয়াজ কলি ভাজা
ভাত
ছোলার ডালের দুধে মালাইকারী
বাঁধাকপির ছেঁচকি
তেওড়া শাকের চড়চড়ি
কচি মূলার ঘণ্ট
লাল শাকের ঘণ্ট
বাঁধাকপির ঘণ্ট
গাছ ছোলার ডালনা
মটর ডালের ধোঁকা
কমলানেবুর কালিয়া
ওলকফির কারী
পেঁয়াজের দোলা আচার
ফুলকপির দমপোক্ত
বেগুন দিয়া কাঁচা কুলের অম্বল
আনারসী মালাই পোলাও
ফুলিয়া।
কিন্তু সব সময়েই কি এত বড় বড় মাপের আয়োজন হত? ছোটখাট ক্ৰমণীও আছে। এখনকার তুলনায় সেও খুব ছোট নয় :
ডিম দিয়া মুলুকস্তানী সূপ
ভাত
আলু ফ্রেঞ্চ স্টু
চঁওচঁও, বড় রুই মাছের ফ্রাই
মাংসের হুশনী কারী
পোলাও
ফ্রুট স্যালাড
ফল।
কিংবা
অলিভ রুটি
নারিকেলের সূপ
ধুম পক্ক ইলিশ
মুরগী বয়েল, হ্যাম।
মটনের কলার
ঠাণ্ডা জেলী ও ব্লাঁমজ
নারিকেল টফি, আদার মোরব্বা
কফি।
আর নিরামিষ :
ভাত
মাখন মারা ঘি, নেবু, নুন
নিমে শিমে ছেঁচকি ছোলার ডাল ভাতে
বেগুন দিয়া শুল্ফা শাক ভাজি
ছোলার ডালের কারী কুমড়ো এঁতোর ফুলুরি
পুন্কো শাকের শশ্শরি।
ভর্তাপুরী
পালম্ শাকের চড়চড়ি
থোড়ের ঘণ্ট
তিলে খিচুড়ি
ছানার ডালনা পাকা শসার কারী
পটলের দোল্মা
তিল বাঁটা দিয়ে কচি আমড়ার অম্বল
পাকা পেঁপের অম্বল
লক্ষ্ণৌ কড়ই কাঁচা আমের পায়স।
এখনকার দিনে প্রজ্ঞার বইটি দুষ্প্রাপ্য। সেজন্যই গর কয়েকটি ক্রমণীর উদাহরণ তুলে দেওয়া হল। এই ক্ৰমণী দেখে মনে হয় তখনও ভোজসভায় ফরাসী কায়দায় ইচ্ছা নির্বাচনের সুযোগ ছিল, না হলে এত ব্যঞ্জন এবং একই সঙ্গে ভাত, খিচুড়ি এবং পোলাওয়ের ব্যবস্থা থাকত না।
প্রজ্ঞার রান্নার বই দুটি আমাদের মনে যে কৌতূহল জাগায়, সেটি হল ভাইঝির এই রন্ধন নৈপুণ্যে রবীন্দ্রনাথ কতখানি খুশি হয়েছিলেন! রান্না এবং নতুন খাদ্যদ্রব্য সম্বন্ধে তার উৎসাহ তো কম ছিল না। বহু মহিলাই তাঁদের স্মৃতিকথায় এ কথা বলেছেন। কবি কি তাদের কাছে কখনো প্রজ্ঞার রান্নার গল্প করেননি? না, প্রজ্ঞা তাঁর কাকাকে কিছু বেঁধে খাওয়াননি? ভাইঝির ক্রমণী আবিষ্কারে কাকার উৎসাহ ছিল কিনা কিছুই জানা গেল না। প্রজ্ঞা বিবাহসূত্রে অসমিয়া, স্বামীগৃহে যাওয়ায় তাঁর সঙ্গে কি কবির যোগ একেবারে ছিন্ন হয়েছিল? নয়ত উভয়ে উভয়ের সম্বন্ধে আশ্চর্যভাবে নীরব থেকে গেলেন কেন কে জানে! এবার অন্য প্রসঙ্গে যাওয়া যাক।
হেমেন্দ্রনাথের মেয়েদের মাঝখানে আমরা আরেকজনকে পেয়েছি। তিনি শার কেউ নন সর্বজন-পরিচিত সত্যেন্দ্র-জ্ঞানদানন্দিনীর একমাত্র মেয়ে ইন্দিরা। সময়ের দিক থেকে তিনি হেমেরে সেজ মেয়ে অভিজ্ঞার বোন দিদি অর্থাৎ পনেরো দিন আগে জন্মেছেন। সৌভাগ্যবশতঃ তিনিও দীর্ঘ জীবনের অধিকারিণী হওয়ায় ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের আর একটি উজ্জ্বলতম রত্নকে আমরা পেয়েছি। ছোটবেলা থেকেই তিনি রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ছিন্নপত্রাবলীর প্রাপক। অন্য কোন ক্ষেত্রে যদি তার কিছুমাত্র দান নাও থাকত তাহলেও ক্ষতি ছিল না। কেননা, রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে যিনি এই অসাধারণ চিঠিগুলি লিখিয়ে নিতে পেরেছিলেন তার অসামান্যতা সম্পর্কে সন্দেহ জাগতেই পারে না। আর কেউই কবির সমস্ত লেখাটা আকর্ষণ করে নিতে পারেন। কিন্তু ইন্দিরার পরিচয় এখানেই শেষ নয় বরং শুরু।
ইন্দিরার সমস্ত কাজকর্মের মধ্যেও বড় হয়ে উঠেছিল তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। অপরূপ লাবণ্যময়ী ইন্দিরা তাই অনন্যা হয়েও সবার অতি আপন বিবিদিতে পরিণত হয়েছিলেন। মনে হয় তিনি সেই জাতের মানুষ যারা শুধুমাত্র তাদের জীবনযাপনের মধ্যেই সংসারকে মধুময় করে তোলেন। প্রতিদিনের জীবনযাত্রা পথে তাদের হৃদয়ের মর্য আর পবিত্রতাই অপরের পথের দিশারী হয়ে ওঠে। মাথা তখন আপনিই নত হয়ে আসে সেই পরমতমার। উদ্দেশ্যে। কিন্তু শুরুতেই এ কথা কেন? ইন্দিরার সমগ্র জীবন যে ভরা। অশেষের ধনে সুতরাং আবার পেছন ফিরে তাকানো যাক।
১৮৭৩ সাল। সন্তানসম্ভবা জ্ঞানদানন্দিীর ইচ্ছে এবার মেয়ে হোক। ঘর আলো করা, কোলজোড়া। খুব সুন্দর দেখতে হবে। প্রাণভরে তাকে সাজাবেন। মায়ের ইচ্ছে অপূর্ণ রইল না। মহারাষ্ট্রের কালাগি শহরে ভূমিষ্ঠ হল ঠাকুরবাড়ির একটি মেয়ে, আকাশ থেকে যেন নেমে এল একটি তারা। কাঁটা কাঁটা ধারাল মুখশ্রী, সুন্দর গায়ের রঙ, বড় বড় দুটি উজ্জ্বল চোখ, রজনীগন্ধার মতো সতেজ সুন্দর দেহলতার অধিকারিণীর নাম রাখা হল ইন্দিরা। কলকাতায় ইন্দিরার রূপের খ্যাতি কেমন ছড়িয়ে পড়েছিল তার একটি সমসাময়িক সাক্ষী উপস্থিত করি। বোধহয় ১৮৮৪ সাল হবে। সরস্বতী পুজোর দিন রবীন্দ্রনাথ এসেছেন এ্যালবার্ট হলে বক্তৃতা দিতে, সঙ্গে ইন্দিরা।
প্রমথ চৌধুরী তখন ছাত্র। অনেকখানি হেঁটে প্রেসিডেন্সী কলেজের মাঠে বন্ধু নারায়ণ চন্দ্র শীলের সঙ্গে দেখা। বন্ধুকে নারায়ণ সোৎসাহে জানালেন রবীন্দ্রনাথ এ্যালবার্ট হলে বক্তৃতা দিচ্ছেন, সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তার ভ্রাতুস্পুত্রীকে। চল না, রাস্তাটা পেরিয়ে আমরা এ্যালবার্ট হলে যাই। প্রমথ রাজী হলেন না বক্তৃতা শুনতে যেতে। বন্ধু বললেন, রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা না। শুনতে চাও, অন্তত তার ভ্রাতুস্পুত্রীটিকে দেখে আসি চল। শুনেছি মেয়েটি নাকি অতি সুন্দরী। রেগে উঠে গাছতলায় শুয়ে পড়ে প্রমথ বলেছিলেন, পরের বাড়ির খুকি দেখবার লোভ আমার নেই। কিন্তু অনেকেরই সেদিন সে আগ্রহ এবং কৌতূহল ছিল। পরে এই প্রমথর সঙ্গেই বিয়ে হয়েছিল ইন্দিরার। প্রমথ চৌধুরী তাঁর আত্মকথায় এই ঘটনাটির উল্লেখ করায় ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের সম্পর্কে সমসাময়িক কালের আগ্রহ এবং কৌতূহলের একটা ছোট্ট ছবি আমরা দেখতে পেয়ে যাচ্ছি।
শুধু কি রূপ? ইন্দিরার গুণের সংখ্যাও কম ছিল না। আরো একটা কাজ করেছিলেন তিনি। ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের মধ্যে ইন্দিরাই সর্বপ্রথম বি. এ. পাশ করেন। এই পরিবার বাঁধাধরা শিক্ষাকে কোনদিন মূল্য দেননি। কিন্তু ডিগ্ৰীলাভ? তারও একটি মূলা আছে বৈকি। বিশেষ করে সেযুগে। যখন গ্র্যাজুটে মেয়েদের দেখবার জন্যে রাস্তায় ভিড় জমে যেত। চন্দ্র মুখী ও কাদম্বিনী কিছুদিন আগেই ঠেলাঠেলি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধ দরজা খুলে ফেলেছেন। এবার সেই পথে অগণিত মেয়ের ভিড়। অবশ্য ইন্দিরারও আগে গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন স্বর্ণকুমারীর মেয়ে সরলা ঘোষাল। এবার খোদ ঠাকুরবংশের মেয়ে ইন্দিরা। তিনি লরেটো থেকে এনট্রান্স পাশ করে বাড়িতেই বি. এ. পড়েছিলেন ইংরেজীতে অনার্স ও ফরাসী ভাষা নিয়ে। ১৮৯২ সালে বি. এ. পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্থান লাভ করে ইন্দিরা পান পদ্মাবতী স্বর্ণপদক। তার আগে আরো এক ডজন মহিলা গ্র্যাজুয়েট কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছেন তবে তারা কই ফরাসী ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করেননি। ইন্দিরার আট বছর পরে যাবার ফ্রেঞ্চ পড়েছিলেন তারকনাথ পালিতের মেয়ে লিলিয়ান পালিত, ভাররতবর্ষে প্রথম বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা এনে যিনি খুব চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো কাগজপত্র দেখে জানা গেছে ১৮৮২ থেকে ১৮৯১ সাল পর্যন্ত মাত্র বারোজন মহিলা গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন। ইন্দিরা তেরো নম্বর। তিনজনের মধ্যে একজন মাত্র ডবল এম. এ. পাশ করেন তার নাম নির্মলবালা সোম। তিনি ১৮৯১-এ ইংরেজী ও ১৮৯৪-এ মর্যাল ফিলসফিতে এম, এ. পাশ করেন। তবে এই সংখ্যা যে হু হু করে বাড়ছিল তাতে সন্দেহ নেই। নাহলে ১৮৯২-এর এই সংখ্যা ১৯১০-এ সাতান্ন জন মহিলা গ্র্যাজুয়েটে পৌঁছবে কি করে? ১৮১৮ থেকে ১৯১০-এর মধ্যে এম. এ. পাশ করেছিলেন আটজন মহিলা, এঁদের কেউই ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।
ইন্দিরা খুব ভাল ফরাসী জানতেন। ভাগ্যক্রমে তার স্বামী প্রমথ চৌধুরীও ছিলেন ফরাসী ভাষায় সুপণ্ডিত। তাঁর লেখায় ফরাসী রুচির ছাপ আছে। তাঁদের প্রাকবিবাহ পর্বের চিঠিপত্রের প্রিয় সম্ভাষণটিও ছিল ফরাসী Mon ami. ভাল করে লক্ষ্য করলে ইন্দিরার লেখাতেও প্রাথমিক গদ্যরীতির কারুকর্ম চোখে পড়বে। গল্প-উপন্যাস না হলেও তার যে কোন লেখা সরস-সহাস্য ও সুমিত লাবণ্যে সমুজ্জ্বল। প্রমথ চৌধুরীর অসামান্য ব্যক্তিত্বের প্রভাব ইন্দিরার ওপর পড়াও অসম্ভব নয় তবে যাকে বলে প্রসাদ গুণ, ইন্দিরার নিজস্বতায় সেটি প্রচুর মাত্রায় ছিল। প্রবন্ধ-গান-সমালোচনা-স্মৃতিকথা—বিষয় যাই হোক না কেন, সর্বত্র মিশে আছে তার রম্য ব্যক্তির স্বাদ।
নিরপেক্ষভাবে ইন্দিরার কাজের বিচার করতে বসলে মনে হয় যেন থৈ পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ স্মৃতি-বিস্মৃতির মায়াজাল ছাড়িয়ে যেখানে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আমাদের নিজের স্বার্থেই সেই বিষয়গুলিকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। তিনি যে শুধু কযেকটা বই লিখেছিলেন কিংবা গানের স্বরলিপি তৈরি করেছিলেন তা তো নয়, বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতকে তিনি যেভাবে সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন তাতে তার তুলনা মেলা ভার। বাংলায় যে কয়েকটি হাতে গোনা স্বল্পসংখ্যক মহিলা সত্যিকারের ভাল মননশীল প্রবন্ধ লিখতে পেরেছেন ইন্দিরা তাদের অন্যতম। ভাবতে অবাক লাগে, লেখার আশ্চর্য ক্ষমতা, কলমে অভাবনীয় জাদু থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁর পিসীমা স্বর্ণকুমারীর মতো গল্প-উপন্যাস রচনায় হাত দেননি। কেন? কেন লেখেননি। গল্প-উপন্যাস? প্রবন্ধ, সঙ্গীতচিন্তা, স্মৃতিকথা ও অনুবাদ এই চারটি শাখাতেই ইন্দিরার সাহিত্যকীতি চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
অনুবাদের কাজটা বেশ কঠিন। অচেনা ভাষাকে রক্তে চেনা ভাষায় রূপান্তরিত করলেও তাতে প্রাণের রস আনা যায় না। কবির ভাষায় তর্জম মরা বাছুরের মূর্তি, তা সেই মরা বাছুরকেই প্রাণ দিতেন ইন্দিরা। রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতা তিনি অনুবাদ করেছেন। কবি নিজেও স্বীকার করেছেন সে কথা। ইন্দিরা অনুবাদের ভার নিলে তিনি যতটা নিশ্চিন্ত হতেন ততখানি ভরসা আর কারুর ওপর ছিল না। চিঠিতে লিখেছেন, তোর সব তর্জমাগুলিই খুব ভাল হয়েছে। এইমাত্র তের তর্জমালি অপূর্বকে দেখালুমসে বললে আমার কবিতার এত ভাল তর্জমা সে আগে আর দেখেনি। [৬. ১. ১৯২৯ ] আবার। দেখা যাবে জাপান যাত্রী অনুবাদের ভার কবি ইন্দিরাকে দিয়েই নিশ্চিন্ত হতে চান।
কবে থেকে অনুবাদ করা শুরু করেছিলেন ইন্দিরা? ১২৯২ সালের বালকে রাস্কিনের ইংরেজী বুচনা তুলে দিয়ে এক প্রতিযোগিতা আহ্বান করেছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী। পৌষ সংখ্যায় পুরস্কার পেলেন যোগেন্দ্রনাথ লাহা। তার অনুবাদের সঙ্গে আর একটা অনুবাদও ছাপা হল। অনুবাদিকার নাম দেখা গেল শ্ৰীমতী ইঃ–। সম্পাদিকা জানালেন একটি অল্পবয়স্কা বালিকার রচনা? অনেকের মতে এই শ্ৰীমতী ইঃ যে ইন্দিরা তাতে সন্দেহ নেই। তখন থেকেই ইন্দিরার আত্মগোপনের চেষ্টা শুরু হয়েছে। ফলে আজকের এই নিজের ঢাক পেটানোর কোলাহলে ইন্দিরা ঠিক কি করেছিলেন তা জানা যাচ্ছে না। এমনকি তার সমস্ত রচনার একটি তালিকাও বোধহয় এখনো তৈরী হয়নি। সাময়িক পত্রের পাতা থেকে সেসব সংগ্রহ করে একটা অখণ্ড গ্রন্থাবলী প্রকাশের চেষ্টা তো অনেক দূরের কথা।
রবীন্দ্র-রচনার অনুবাদ ছাড়াও ইন্দিরা অনুবাদ করেন প্রমথ চৌধুরীর চার ইয়ারী কথার। টেল অব ফোর ফ্রেণ্ডস্ বেশ উল্লেখযোগ্য অনুবাদ। এছাড়া তিনি সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে যুগ্মভাবে অনুবাদ করেন মহর্ষির আত্মজীবনী দি অটোবায়োগ্রাফী অব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ টেগোর। এ তো গেল বাংলা থেকে ইংরেজী অনুবাদের কথা। ইন্দিরা ফরাসী থেকে বাংলায় অনুবাদের ক্ষেত্রেও অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ফরাসী ভাষা সকলে জানেন না। ইন্দিরা ফরাসী ভালই জানতেন। প্রমথ চৌধুরীর সান্নিধ্য তাকে আরও শাণিত করে তুলেছিল। তার যে চারটি অনুবাদের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত সেগুলি হল রেনে গ্রুসের ভারতবর্ষ, পিয়ের লোতির কমল কুমারিকাম, মাদাম লেভির ভারত ভ্রমণ কাহিনী (কলম্বো থেকে শান্তিনিকেতন) এবং আঁদ্রে জীদের লেখা ফরাসী গীতাঞ্জলির ভূমিকা।
ইন্দিরা প্রথম প্রেমে পড়লেন কবে? সে এক মজার ব্যাপার। সেকথা তিনি জানিয়েছেন একেবারে জীবনের শেষপর্বে নিজের আত্মকাহিনী শ্রুতি ও স্মৃতিতে। বিশেষ করে তার আবদারেই রবীন্দ্রনাথ তাঁহার দুই ভাইবোনকে নিয়ে গিয়েছিলেন হাজারিবাগে। কারণ, তখনকার দিনে কনভেন্টের এক একজন মেয়ের এক একজন সিস্টারের প্রেমে পড়ার রেওয়াজ ছিল। বোধহয়। ভবিষ্যৎ জীবনের মকস স্বরূপ তা যাই হোক, ইন্দিরা লিখেছেন তাঁর প্রেয়সী ছিলেন সিস্টার এ্যালাইসি। তাঁকে হাজারিবাগের কনভেন্টে বদলি করা হয়েছিল বলেই ইন্দিরার এ অভিযান।
প্রেমের কথা যখন উঠলই তখন ইন্দিরার জীবনের কথাও এক ফাঁকে সেরে নেওয়া যাক। পূর্ণিমা ঠাকুরের লেখা ইন্দিরার জীবনকথা থেকে জানা যায়, তিনি যখন স্কুলে যেতেন তখন ফটকের বিপরীত দিকের মাঠে এক দর্শনপ্রার্থী যুবক দাঁড়িয়ে থাকত। কোন রকম আলাপ পরিচয় হয়নি। বাড়িতে হাসির ধুম পড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ এই ঘটনাটিকে নিয়েই লিখেছিলেন একটা গান–সখি প্রতিদিন হায় এসে ফিরে যায় কে। ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা বাইরে বেরোতেন বা অভিনয় করতেন ঠিকই কিন্তু তারা কোন অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে কথা বলতেন না। বেশ পরবর্তীকালে জসীমউদ্দীন যখন ঠাকুরবাড়ির ছেলেদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন তখনও এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছিলেন। যাইহোক, ইন্দিরার এই নীরব দর্শনপ্রার্থীর সঙ্গে আকস্মিকভাবে দেখা হয়েছিল বহুকাল পরে। দুজনেরই বয়স তখন আশি পেরিয়ে গেছে। শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্র সদনে সেই ভদ্রলোক এসেছিলেন তার ছেলের কাজের আবেদন নিয়ে। গল্পের মতো ঘটনা! তবু! কতদিন কেটে গেছে। দুজনেই অস্বস্তি বোধ করেছিলেন। হয়ত কেঁপে উঠেছিল চোখের পাতা কিংবা গলার স্বর। দুজনেরই। হায়! সেদিন কি আর ফেরে? কোনরকমে দরকারি কথা তাড়াতাড়ি সেরে উঠে পড়েছিলেন ইন্দিরা। গল্পটা তার আত্মকাহিনীতেও আছে।
ইন্দিরার পাণিপ্রার্থীর অভাব ছিল না। তার মধ্যে ছিলেন প্রমথ চৌধুরী এবং তাঁর দাদা যোগেশ চৌধুরীও। কয়েক বছর আগে আশুতোষের সঙ্গে প্রতিভার বিয়ে হয়েছে। দুই পরিবারের মধ্যে সৌহার্দ্য গড়ে উঠলেও এই মেলামেশার ফল সব সময় ভাল হয়নি। কোন অজ্ঞাত কারণে উভয় পরিবারের সম্পর্কে চিড় ধরে। চৌধুরীদের কোন কোন ছেলে ব্রাহ্ম হয়ে যাওয়ায় এই তিক্ততা স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে ওঠে। ইন্দিরা ও প্রমথর বিয়েতেও নানা রকম বাধা আসে। কিন্তু কোন বাধাই টেকেনি। বিয়ের প্রস্তাব প্রথমে জানান প্রমথ তাতে সমর্থন ছিল ইন্দিরার, ঠাকুরবাড়ির আপত্তি তো ছিল না। তাদের সকলেই খুশি হলেন। কিন্তু বাধা এসেছিল চৌধুরীবাড়ি থেকে সম্ভবত যোগেশ চৌধুরীর জন্যেই। নাহলে প্রতিভার বিয়েতে আপত্তি হয়নি, এখন হবে কেন? প্রসন্নময়ী তার পূর্বকথায় জানিয়েছেন, ঠাকুর পরিবারে ভাতার বিবাহকালে দেশে আর নৃতন কোন আন্দোলন উপস্থিত হয় নাই, বরং বুদ্ধিমতী পিসিমাতারা এ কার্য অনুমোদনই করিয়াছিলেন ও সুশীল সুলক্ষণা ভ্রাতুস্পুত্রবধূ দেখিয়া পরম পরিতুষ্ট হইয়াছিলেন। পয়মন্ত ধুর আগমনে আমাদিগের গৃহের সর্বাংশে মঙ্গল হইয়াছে।
এ ঘটনা আশুতোষ ও প্রতিভার বিয়ের সময়কার। তখন বিয়েতে কোন বাধা আসেনি। ইন্দিরাকে নিয়ে পারিবারিক মনান্তরের সূচনা হয়েছিল বলে বিয়ের পর নববধু শ্বরবাড়ির পরিবর্তে গিয়ে উঠলেন ছোট ননদ মৃণালিনীর বাড়িতে। তারপর তার নিজের বাড়ি কমলালয়ে। এরপরে তো একটানা কাজের ইতিহাস!
বাংলার নারী জাগরণের অন্যতম নেত্রী ইন্দিরাকে তার মায়ের মতো পদে পদে বাধা পেতে হয়নি। তাই খ্রীশিক্ষা, নারীজাগরণ, স্বাধীনতা, স্বেচ্ছাচার, মেয়েদের অধিকার ও কর্তব্য, আত্মরক্ষাসমিতি, সুবিধে-অসুবিধে, কাজকর্ম, এককথায় বলতে গেলে মেয়েদের সামগ্রিক ভূমিকার কথা নিরপেক্ষভাবে ভাববার অবকাশ ইন্দিরা পেয়েছিলেন। সেটা জ্ঞানদানন্দিনী, কাদম্বরী কিংবা অন্য কেউ পাননি। কোনটা সত্যি ভাল আর কোনটার সত্যি প্রয়োজন আছে আকস্মিক উত্তেজনাটা থিতিয়ে না গেলে সেটা ভাল বোঝা যায় না। ইয়ংবেঙ্গল গ্রুপকে যেমন নিছক সংস্কার ভাঙ্গার জন্যে কতকগুলো অর্থহীন কাজ করতে হয়েছিল তেমনি প্রথম যুগের মেয়েদেরও কিছু সাহস দেখাবার প্রয়োজন ছিল। দরকার। ছিল কয়েকটি অমূল্য আত্মাহুতির। মেয়েদের চোখের সামনে নতুন নজির সৃষ্টি করবার জন্যে কাদম্বরীর অশ্বারোহণ, জ্ঞানদানন্দিনীর একলা বিলেত যাওয়া, কাদম্বিনীর ডাক্তারি পড়া, সরলা রায় ও অবলা বসুর শিক্ষা, চন্দ্রমুখীর এম. এ. পড়া, ব্রাহ্ম সমাজে চিকের বাইরে এসে উপাসনা করা, জামা জুতো পরে খোলা গাড়ি চড়ে বেড়ানোর দরকার ছিল বৈকি। খুবই দরকার ছিল। নইলে অন্য মেয়েদের মন থেকে অবরোধের, পাহাড় নামবে কেমন করে? কিন্তু ইন্দিরা এঁদের পরের যুগের মানুষ। তিনি সেকেলে রক্ষণশীলতা আর একেলে উগ্র আধুনিকতা দুই-ই বর্জনের পক্ষপাতী ছিলেন। সব জায়গাতেই তিনি উগ্রতাবিরোধী এবং মধ্যপন্থাবলম্বী। তাঁর নিজস্ব মত :
সেকালের ধীর-স্থিরাদের সঙ্গে একালের বীৰা হতে হবে; অথবা সেকালের শ্রী ও হ্রীর সঙ্গে একালের ধী মেলাতে হবে-বঙ্কিমবাবু হলে যাকে বলতেন প্রখরে-মধুরে মেশা! এই সামঞ্জস্যই নারীজীবনের মূলমন্ত্র।
ইন্দিরার প্রতিটি লেখার স্টাইল ঋজু ও স্বচ্ছ। তাঁর কাকার ভাষায় সমুজ্জ্বল। তিনি ইন্দিরার লেখা প্রবন্ধ পড়েও বুঝতে পারেননি এই স্টাইল ইন্দিরার। কারণ খুব স্বাভাবিক। প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে এখনও পুরুষের অগ্রাধিকার সর্বজনস্বীকৃত। মেয়েরা যতই এগিয়ে যাক না কেন, গভীর মনন ও চিন্তার ফসল ফলেছে পুরুষের কলমেই একথা অস্বীকার করে লাভ নেই। বিশ্ব সাহিত্য সম্পর্কেই একথা প্রযোজ্য। বাংলা দেশে তো হবেই। তবে এদেশ বড় আশ্চর্য দেশ। এখানে অসম্ভব বলে কিছু নেই। তাই পর্দার আড়ালে, নিতান্ত অন্দরমহল থেকেও মাঝে মাঝে এমন একটি কূট বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া গেছে যাতে তাবৎ পুরুষ সমাজের ও তাক লেগে গেছে। মননের ক্ষেত্রেও কোন কোন মেয়ে এমন পাণ্ডিত্যের পরিচয় দিতে পেরেছেন যে তাকে শ্রেষ্ঠ আসনে বসাতে কেউ দ্বিধা করেননি। ইন্দিরা সেই বিরলতমাদের একজন। তার লেখা নারীর উক্তির ছটি নারী সংক্রান্ত প্রবন্ধ, রাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
আবার ইন্দিরা যখন স্মৃতিকথা লিখতে বসতেন তখন তাতে মিশত গল্পের রস। প্রখর স্মৃতিশক্তির সাহায্যে তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের বহু গান উদ্ধার করেছেন। না হলে অনেক গানেরই সুর যেত হারিয়ে। স্মৃতিকথা হিসেবে ইন্দিরার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা রবীন্দ্রস্মৃতি। পাঁচ ভাগে ভাগ করে তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জড়িত সঙ্গীত, সাহিত্য, নাট্য, ভ্রমণ ও পারিবারিক স্মৃতির কথা বলেছেন। এতে রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের অনেক কথাই জানা। যায়। স্মৃতিকথা লেখবার সময় ইন্দিরা সবসময় একটি বিশেষ রীতি মেনে চলতেন, যাতে যার কথা বলতেন, তাঁর ঘরোয়া ব্যক্তিত্বের ছবি ফুটে উঠত। এই ছোট ছোট ব্যক্তিত্বের সমষ্টিকে তিনি বলতেনছোট ফুলের শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁর শেষ রচনা শ্রুতি ও স্মৃতি যেন রূপকথার ঝাপি। এটি ইনিরার নিজের কথা—শুরু হয়েছে তার জন্ম থেকে আর শেষ হয়েছে দাদা সুরেন্দ্রনাথের পৌত্র সুপ্রিয়ের জন্মবৃত্তান্তের সঙ্গে সঙ্গে। ঠাকুরবাড়ির এবং চৌধুরীবাড়ির বহু খবর এতে পাওয়া যাবে। গ্রন্থটি এখনও প্রকাশিত হয়নি, ফাইলবন্দী হয়ে বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে পড়ে আছে।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে ইন্দিরার ভূমিকা যে কী এক কথায় তা বলা যাবে না। তাঁর দিদি প্রতি গানের জগতে মেয়েদের মুক্তি দিয়েছিলেন। আর ইন্দিরা উদ্ধার করেছিলেন প্রায় লুপ্ত প্রথম দিকের রবীন্দ্রসঙ্গীতকে। তার চেয়ে পনের দিনের ছোট অভিজ্ঞার কণ্ঠেও রবীন্দ্রসঙ্গীত নতুন রূপ পেতে শুরু করেছিল কিন্তু অকালে মৃত্যু হওয়ায় অভিজ্ঞা স্থায়ীভাবে কিছু রেখে যেতে পারেননি। সে অভাব পূরণ করেছিলেন তার বোনদিদি ইন্দিরা! দেশী ও বিলিতি উভয় সঙ্গীতে তিনিও তালিম নিয়েছিলেন শৈশবেই। এমন কি যন্ত্রসঙ্গীতেও তার হাত ছিল পাকা। সেন্ট পলস্-এর অর্গানিস্ট স্লেটার সাহেবের কাছে পিয়ানো ও সিনর ম্যাটোর (Signor Manzato) কাছে তিনি শিখেছিলেন বেহাল। ওস্তাদি হিন্দুস্থানী গান শেখেন বদ্রীদাস মুকুলের তত্ত্বাবধানে। হেমেন্দ্রর মেয়েরা গান নিয়ে মেতে থাকলেও অভিজ্ঞ ছাড়া আর কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা বেশি করেননি। তাই ইন্দিরাকে একাই সব ভার নিতে হয়েছিল। তিনি নিজেও পরিহাসতরল কণ্ঠে বলতেন, আমার জীবনের যতদূর পর্যন্ত দেখতে পাই যেন সামনে এক বিস্তীর্ণ স্বরলিপির মরুভূমি পড়ে রয়েছে, তার মাঝে ম ঝ রেফ ও হসন্তের কাঁটাগাছ।
বাস্তবিকই ইন্দিরা যে কত গানের স্বরলিপি করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। শুধু সুর এবং স্বরলিপি রক্ষা করা নয়, তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের তথ্য ও তত্ত্ব দুটোকেই সমৃদ্ধ করেছেন। একদিক থেকে স্বরলিপি উদ্ধার করে ও গান শিখিয়ে অপর দিকে সঙ্গীত সংক্রান্ত প্রবন্ধ লিখে। রবীন্দ্রসঙ্গীতে ত্রিবেণী সঙ্গম এমনই একটি ছোট্ট বই। এতে ইন্দিরা দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ অপরের সুরে নিজের কথা গেঁথে গেঁথে কত নতুন গান সৃষ্টি করেছেন, আবার পরের কথায় তার সুর দেওয়ার সংখ্যাও যে একেবারে নেই তা নয়। কবির যাবতীয় ভাঙা গানের একটি লিস্ট তৈরি করে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, সামান্য অদলবদলের মধ্যে কবি কি অসাধ্য সাধন করেছিলেন। সঙ্গীত জগতে এই পুস্তিকাটি অমূল্য সংযোজন। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে এ যুগের অনেকেই নানারকম আলোচনা করেছেন। এ ব্যাপারে মহিলাদের সংখ্যা কম হলেও পুরুষদের সংখ্যা নগণ্য নয়। কিন্তু কেউই ইন্দিরার মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে এত ব্যাপক আলোচনা বোধহয় কেরেননি। যারা করেছেন তাদের আলোচনারও আকর হিসেবে গৃহীত হয়েছে ইন্দিরার সঙ্গীত চিন্তা! যাইহোক, ইন্দিরার দেওয়া হিসেব থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের দুশ সাতাশটা ভাঙা গানের বারোটির সুর নেওয়া হয়েছে স্কচ ও আইরিশ গান থেকে। রবীন্দ্রসঙ্গীতে হিন্দুস্থানী গানের দানও কম নয়। ভাবতে অবাক লাগে, আমাদের চির পরিচিত বিদায় করেছ যারে নয়ন জলের উৎস বাজে ঝননন। মোরে পায়েলিয়, তুমি কিছু দিয়ে যাও-এর উৎস কৈ কছু কহরে কিংবা শূন্য হাতে ফিরি হে নাথ-এর উৎস রুমঝুম বরষে হতে পারে। অপরের কথায় কবির সুর দেবার কথাও আছে। বিদ্যাপতির পদ কিংবা বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম্-এর প্রথম স্তবক ছাড়াও কবি অক্ষয় বড়াল, সুকুমার রায়, হেমলতা ঠাকুরের গানে সুর দিয়েছিলেন।
ইন্দিরার লেখা রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ক প্রবন্ধের সংখ্যা অনেক। বহু পত্রিকায় তিনি এ নিয়ে আলোচনা করেছেন। এদের মধ্যে সঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষা, রবীন্দ্রসঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতপ্রভাত, স্বরলিপি পদ্ধতি, শান্তিনিকেতনে শিশুদের সঙ্গীতশিক্ষা, হারমনি বা স্বরসংযোগ, রবীন্দ্রসঙ্গীতে তানের স্থান, রবীন্দ্রনাথের গান, বিশুদ্ধ রবীন্দ্রসঙ্গীত, হিন্দুসঙ্গীত, আমাদের গান, স্বরলিপি, দি মিউজিক অব রবীন্দ্রনাথ টেগোর, ইন্দিরার সঙ্গীত চিন্তার পরিচয় বহন করে।
শুধু কাজ দিয়ে বোধহয় ইন্দিরার বিচার করা যায় না। তিনি সারাজীবন নানারকম কাজ, মহিলা সমিতি, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। কিছুদিনের জন্যে বিশ্বভারতীর উপাচার্যের পদও তাকে গ্রহণ করতে হয়েছিল। পেয়েছিলেন দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া সর্বোচ্চ সম্মান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবনমোহিনী স্বর্ণপদক এবং বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তমা। কিন্তু যারা তার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত ছিলেন তারা জানতেন ইন্দিরার তুলনায় এসব সম্মানউপাধি-স্বর্ণপদক কত সামান্য। মর্ত্যের কুসুম দিয়ে কি স্বর্গের লক্ষ্মীকে সাজানো যায়?
এইখানেই ইন্দিরা প্রকৃত বৈশিষ্ট্য। কোন কাজ করে নয়, কোন কাজের মধ্যে নয়, শুধু উপস্থিতি দিয়েই তিনি ভরে দিতে পারতেন সব শূন্যতাকে। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র-প্রয়াণের পর রবীন্দ্র ভাবধারাকে একটানা কুড়ি বছর ধরে ধচিয়ে রেখেছিলেন তিনি। সঙ্গে নিশ্চয় আরো অনেকে ছিলেন কিন্তু তাঁরা সঙ্গীমাত্র, তার বেশি কিছু নয়। ইন্দিরা একাই সব।
ইন্দিরার কমনীয় ব্যক্তিত্বে যে কমল হীরের দীপ্তি ফুটে উঠেছে তাকেই বলা যায় কালচার। এই কালচারের ছাপ ইন্দিরার সাজসজ্জায়-বাক্যবিন্যাসেঘরসজানোয়-আচার-ব্যবহারে-প্রেমপত্রে-সাহিত্যচর্চায় স্বামীসেবায়-গৃহিণীপনায় -সবুজপত্রে-কমলালয়ে-শান্তিনিকেতনের আশ্রম-কুটিরে সর্বত্র পড়েছিল। এই বিশিষ্টতাই তার সবচেয়ে বড় দান। বাংলার নারীদের সামনে তিনি তার প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত আদর্শ জীবনটিকে তুলে ধরেছিলেন। তারই মধ্যে ফুটে উঠেছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের নিজস্ব সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ পরিচয়।