০৬. আফাগো আফা

কে যেন চাপা গলায় ডাকছে, আফাগো আফা।

তস্তুরী বেগমের গলা। বালিশের নিচে আমার হাতঘড়ি। রেডিয়াম ডায়ালের চল উঠে গেছে। রেডিয়াম স্বাস্থ্যের জন্যে হানিকর। সময় দেখতে হলে বাতি জ্বালাতে হবে। বাতি জ্বালাতে ইচ্ছা করছে না। ঘড়ি না দেখেই বুঝতে পারছি অনেক রাত। আমি ঘুমুতে গেছি রাত একটায়। অনুমান করছি দুঘণ্টার মতো ঘুমিয়েছি, কাজেই রাত তিনটা হবে। রাত তিনটায় তস্তুরী বেগম আমাকে কেন ডাকবে? কোনো ইমার্জেলি? বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন? কিছুদিন পর পর বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি নিঃশ্বাস নিতে পারেন না। বিছানায় ছটফট করতে থাকেন। তখন চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। বারান্দার সব বাতি জ্বালানো হয়। কয়েকজন ডাক্তারকে খবর দেয়া হয়। এ্যাম্বুলেন্স চলে আসে। অক্সিজেন চলে আসে। তখন বাবা সুস্থ হয়ে ওঠেন। বিছানায় উঠে বসে স্বাভাবিক গলায়। বলেন, এক গ্রাস পানি দেখি। নরমাল পানির সঙ্গে এক টুকরা বরফ দিও।

ডাক্তাররা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেন। তখন বাবা বলেন, দেখি একটা সিগারেট।

আজকেও এরকম কিছু কি হয়েছে?

তস্তুরী বেগম আবার ডাকল, আফাগো আফা। দরজা খুলেন।

আমি দরজা খুললাম না। ব্যাপার আঁচ করতে চাচ্ছি। বারান্দায় হাঁটার শব্দ পাচ্ছি। চটি পায়ে হাঁটা। বাবা হাঁটছেন। তার অর্থ হলো তিনি সুস্থ আছেন। আমার ঠিক ঘরের সামনে চেয়ার টেনে কে যেন বসল। সম্ভবত মা। মা বসার আগে চেয়ার একটু সরাবেন। চেয়ারটা যেখানে আছে ঠিক সেখানে বসবেন না।

বাবা-মা দুজনই জেগে আছেন। ব্যাপার কী? আমি দরজা খুললাম। তস্তুরী বেগম বলল, বাড়ি ভর্তি পুলিশ আফা। চেকিং হইতেছে।

মা চেয়ারে শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন। বাবা বারান্দায় নেই। মনে হয় নিচে গেছেন।

মা আমাকে দেখে আঁৎকে ওঠার মতো করে বললেন, তোর গালে এটা কি মশার কামড় না পিম্পল?

বাড়ি পুলিশ ঘিরে আছে। প্রতিটি ঘর সার্চ করা হচ্ছে। এসব যেন কোনো বিষয়ই না। আমি বললাম, পুলিশ কেন মা?

মা হাই তুলতে তুলতে বললেন, আমি কী জানি পুলিশ কেন? তোর বাবা জানে। তোর বাবার সঙ্গে পুলিশ অফিসারের কথা হয়েছে।

বাবাকে জিজ্ঞেস করো নি?

না।

ভাইয়ার কোনো বন্ধুর খোঁজ করছে?

জানি না।

ভাইয়া কোথায় সেটা জানো? নাকি সেটাও জানোনা?

টগরকে তো পুলিশ আগেই নিয়ে গেছে।

আগেই নিয়ে গেছে মানে কী? কখন নিয়ে গেছে?

দশ-পনের মিনিট হলো নিয়ে গেছে। বেশ ভদ্রভাবেই নিয়েছে। পুলিশ এরেস্ট করার সময় হাতকড়া পরায়, কোমরে দড়ি বাঁধে। সেসব কিছুই করে নি।

আমি নিচে নামলাম। বাবা একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলছেন। তিনি ইশারায় আমাকে চলে যেতে বললেন। বাবাকে খুব বিচলিত মনে হলো না। তিনি কোনো বড় ঝামেলায় পড়েছেন এমন কোনো ছাপ তার মুখে নেই। আমি আবারও দোতলায় উঠে এলাম। মা শুকনো মুখ করে বললেন, রাতের ঘুমটা আমার দরকার ছিল। কাল শুটিং। না ঘুমালে মুখ চিমসা হয়ে থাকবে। আমি বরং তোর ঘরে শুয়ে থাকি।

শুয়ে থাকো।

ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে থাকি। শুয়ে থাকলাম– ঘুম হলো না, এটাতো কাজের কথা না। কী বলিস।

তোমার যা ইচ্ছা করো মা। বিরক্ত কোরো না। প্লিজ।

তুই জেগে থেকে কী করবি? তুইও শুয়ে পড়। যা করার তোর বাবাই করবে। পুলিশকে টাকা খাওয়াতে হবে।

মা তুমি ঘুমাও। আমি বাবার জন্যে অপেক্ষা করব।

যা ইচ্ছা কর। আমাকে ঘুমাতেই হবে।

তস্তুরী বেগম খুব ভয় পেয়েছে। সে একটু পর পর বারান্দায় এসে আমাকে দেখে যাচ্ছে। ভীতু মানুষরা সাহসী মানুষদের আশেপাশে থাকতে পছন্দ করে। সে হয়তো আমাকে খুব সাহসী ভাবছে। একবার একটা বই পড়েছিলাম, বইটার নাম Anatomy of fear, ভয় কত রকম কী তার ব্যাখ্যা। বইটার লেখক বলছেন, সব মানুষের ভেতর কিছু আদিম ভয় লুকিয়ে থাকে। সে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই ভয় লালন করে। খুব অল্প সংখ্যক মানুষই সেই আদিম ভয়ের মুখোমুখি হয়।

আফাগো, চা কফি কিছু খাইবেন?

চা খাব, আমার জন্যে আর বাবার জন্যে বানিয়ে নিয়ে এসো। তুমি কি খুব ভয় পেয়েছ?

পাইছি আফা। ভয়ে আমার শ‍ইল কাঁপতেছে। ভয় পাবার কিছু নেই। তোমাকে তো পুলিশ কিছু বলবে না।

পুলিশের কি কিছু ঠিক আছে আফা? এরা জালিম এরা করতে পারে না। এমন কাম নাই।

যাও চা নিয়ে এসো। পুলিশ কি এখনো আছে না চলে গেছে?

পুলিশের বড় সাব অখনো আছে। খালুজানের সঙ্গে কথা বলতেছে। উনারেও কি চা দিব আফা?

না। তুমি এখন যাও।

তস্তুরী বেগমের মনে হয় যেতে ইচ্ছা করছে না। সে নিতান্ত অনিচ্ছায় বারান্দা থেকে বের হলো।

রাত তিনটা চল্লিশ। এর মধ্যেও খবর হয়ে গেছে। বাড়ির চারপাশে লোক জমে গেছে। হৈচৈ হচ্ছে। প্রচুর রিকশা জড়ো হয়েছে। কয়েকজন আবার দেয়ালে চড়ে বসেছে। আমাদের দারোয়ান লাঠি উচিয়ে তাদেরকে নামাচ্ছে।

আমি জানি পুলিশ চলে যাবার পরও এই ভিড় কমবে না। বাড়তে থাকবে। নানান ধরনের গুজব মুখে মুখে ছড়িয়ে যাবে। সকাল নটা দশটা বাজতেই পত্রিকার লোকজন চলে আসবে।

বাবা সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছেন। আমি বাবাকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বাবা বললেন, কী-রে জেগে আছিস।

হ্যা, জেগে আছি। হয়েছে কী বাবা?

তেমন কিছু না। পুলিশ টগরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। ওর বন্ধু-বান্ধব তো ভয়ঙ্কর। বন্ধুদের কেউ হয়তো ধরা পড়েছে। টগরের নামে কিছু বলেছে।

তোমার মধ্যে কোনো টেনশন নেই কেন বাবা?

বাবা চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, এ রকম ঘটনা যে ঘটবে তাতে আমি অনেক দিন থেকেই জানি। কাজেই বিস্মিত হই নি।

মৃত্যু যে ঘটবে তা কিন্তু আমরা সবাই জানি। তারপরেও মৃত্যু যখন ঘটে তখন কিন্তু আমরা খুবই বিস্মিত হই। তোমার মধ্যে বিস্ময়ও নেই।

বিস্ময় নেই?

না নেই, বরং তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুশি হয়েছ।

বাবা অবাক হয়ে বললেন, আমাকে দেখে মনে হয়েছে আমি খুশি হয়েছি?

হ্যাঁ, সে রকমই মনে হচ্ছে। তোমার পরিকল্পনামতো একটা কাজ শেষ হয়েছে। সেই আনন্দে তোমাকে আনন্দিত মনে হয়েছে।

বাবা পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরালেন। তস্তুরী বেগম চা নিয়ে এসেছে। বাবা বিরক্ত মুখে বললেন–চা খাব না। বলেই মত বদলালেন। তস্তুরী বেগমকে বললেন, আচ্ছা এনেছ যখন রাখো। বরফ আর গ্লাস আমার ঘরে দিয়ে এসো।

আমি তাঁর সামনেই বসে আছি। তিনি আমাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেন। এমনভাবে সিগারেট টানছেন যেন তার আশেপাশে কেউ নেই। চায়ের। কাপটাকে তিনি ছাইদানি হিসেবে ব্যবহার করছেন। এই কাজও তিনি কখনো করেন না। একজন গোছানো মানুষ চায়ের কাপে সিগারেটের ছাই ফেলবে না। সে নিজে উঠে ছাইদানি নিয়ে আসবে কিংবা কাউকে আনতে বলবে।

বাবা আমার ওপর রাগ দেখাচ্ছেন। রাগ দেখানোর পদ্ধতির মধ্যেও ছেলেমানুষি আছে। রাত প্রায় শেষ হতে যাচ্ছে এই সময়ে তিনি তাঁর ঘরে বরফ দিতে বললেন। এটিও রাগ দেখানোর অংশ। মেয়েকে বুঝিয়ে দেওয়া আমি তোমার কথায় আহত হয়েছি। এখন মদ্যপান করব। যদিও এই কাজটা তিনি কখনো করবেন না। তার সব কিছুই পরিমিতির মধ্যে। মদ সপ্তাহে একদিন খাবেন। কখনো দু পেগের বেশি খাবেন না। কখনো হৈচৈ করবেন না। মাতাল হওয়া তো অনেক পরের ব্যাপার। বাবার মতো মানুষরা সীমা অতিক্রম করার আনন্দ জানে না।

বাবার সিগারেট খাওয়া শেষ হয়েছে। তিনি ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় হনহন করেই ঘরে ঢুকে গেলেন। আমি একা বারান্দায় বসে রইলাম। আমার কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। আমাদের বাসায় ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটেছে। আমার ভাইকে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেছে এ জাতীয় কথা না। অন্য ধরনের কথা। আমি জেগে আছি, একা বারান্দায় বসে আছি— এই খবরটা কাউকে জানানো। অন্তত একজন কেউ জানুক আমার মন ভালো নেই। কী জন্যে ভালো নেই সেটা জানানোর কোনোই প্রয়োজন নেই। মন ভালো নেই এই খবরটা শুধু জানান। কিছু অর্থহীন কথা বলা। কী বলা হচ্ছে তা জরুরি না, গলার শব্দ শোনানোটা জরুরি। কথা বলা-কথা বলা খেলা।

তস্তুরী আবারো এসেছে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে প্রায় ফিসফিস করে বলল, আফা ঘুমাইবেন না?

না ঘুমাব না। তুমি শুয়ে পড়।

ভাইজানরে নিয়া মারধোর করতেছে কি-না কে জানে!

না মারধোর করবে না। বাবা অবশ্যই এই ব্যবস্থা করেছেন। তুমি ঘুমুতে যাও।

আফনেরে একটা কথা বলব আফা। বলতে ভয় লাগতেছে। না বইল্যাও পারতেছি না।

বলো।

পুলিশ যখন বাড়ি ঘেরাও দিছে তখন ভাইজান কাপড় দিয়া পেঁচাইয়া একটা জিনিস রাখতে দিছে। জিনিসটা কী করব আফা?

কী জিনিস?

তস্তুরী বেগম চুপ করে আছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আমি বললাম, বোমা পিস্তল জাতীয় কিছু? তস্তুরী বেগম জবাব দিল না। এখন সে আমার দিকে তাকাচ্ছে না। মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে।

রেখেছ কোথায়?

চাউলের টিনের ভিতরে।

থাকুক সেখানেই। সকাল হোক তখন একটা ব্যবস্থা হবে।

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আমি আগের জায়গাতেই বসে আছি। বাবা যে জেগে আছেন সেটা বুঝতে পারছি। বাবার ঘরে আলো জ্বলছে। তিনি আমার সব ধারণা ভেঙে দিয়ে প্রায় মাতাল অবস্থায় ঘর থেকে বের হলেন। আমাকে জেগে বসে থাকতে দেখে খুবই অবাক হলেন। কাছে এসে কোমল গলায় বললেন, এখনো জেগে আছিস না-কি রে মা! দুশ্চিন্তা করছিস। দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। সব আমার হাতের মুঠোর মধ্যে আছে। যা দেখছিস সবই পাতানো খেলা।

পাতানো খেলা মানে!

বাবা আমার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, পুলিশকে আমিই খবর দিয়ে এনেছি। আমার কথামতোই তারা টগরকে ধরে নিয়ে গেছে। তুই যে বলেছিলি, আমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি আনন্দিত। আসলেই আমি আনন্দিত। বুঝলি মৃ, তোর বুদ্ধি ভালো। শুধু ভালো বললে কম বলা হয়–খুব ভালো। আমি তোর বুদ্ধি দেখে খুবই অবাক হয়েছি। বলতে গেলে চমকেই গেছি।

আমি সহজ গলায় বললাম, পুলিশ ডেকে ভাইয়াকে এরেস্ট করিয়েছ কেন?

বাবা গলা নিচু করে বললেন, ও যেন নিরাপদে থাকতে পারে। এইজন্যেই কাজটা করিয়েছি। ষাট হাজার টাকা সে চেয়েছে–তার মানে সে বিরাট বিপদে আছে। হাজতে ঢুকিয়ে তাকে আমি বিপদ থেকে আলাদা করে ফেললাম।

আমি কিছু বুঝতে পারছি না বাবা।

সব তোর বোঝার দরকার নেই। নানান ধরনের খেলা এই পৃথিবীতে চলে। সব খেলা বুঝতে হবে এমন কোনো কথা আছে? সব খেলা বোঝার চেষ্টাও করতে নেই।

বাবা তৃপ্তির হাসি হাসছেন। নেশাগ্রস্ত মানুষরা অল্পতেই তৃপ্তি পায়। তৃপ্তি প্রকাশ করে ফেলে। চেষ্টা করেও গোপন রাখতে পারে না। বাবা আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, কিছু খেলা থাকে সাধারণ। উদাহরণ হলো তোর মা। ছোটখাট খেলা সে খেলে–খুবই নিম্ন মানের।

তুমি খুব উঁচু মানের খেলা খেল?

অবশ্যই।

খেলাটা তুমি কার সঙ্গে খেলছ? নিজের সঙ্গে নিশ্চয়ই খেলছ না। তোমার একজন প্রতিপক্ষ আছে। সেই প্রতিপক্ষটা কে? আজহার চাচা?

বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ঠিকই ধরেছি। আজহার খুবই ওস্তাদ খেলোয়াড়। তবে সে বোকা। আসলেই বোকা।

বোকা হলেও তুমি কিন্তু বাবা তার হাতের মুঠোয়।

বুঝলি মা এটাও আমার খেলার একটা স্ট্রাটেজি। আমি ইচ্ছা করে তার হাতের মুঠোয় চলে গিয়েছি।

মার কাছে শুনলাম আজহার চাচা তার ছেলের বিয়ের তারিখ ঠিক করতে এসেছিলেন। খেলার স্ট্রাটেজি হিসেবে তুমি নিশ্চয়ই তারিখও ঠিক করেছ। তারিখটা কী?

বাবা চুপ করে গেলেন। সিগারেট ধরালেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, তারিখ ঠিক করার কথা ভোকে কে বলেছে? নিশ্চয়ই তোর মা। সে আর কী বলেছে?

না। আর কিছু বলেন নি। আরো কিছু কী বলার আছে?

বাবা কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ব্যাপারটায় সামান্য জটিলতা আছে। খুবই সামান্য।

বলো শুনি।

তোর মা তোক কিছু বলে নি?

না।

আচ্ছা তোক ব্যাপারটা বলি–ইউনিভার্সিটির চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় নেমে পড়লাম। ভয়াবহ রিস্ক নিলাম। এই সময় আজহার আমাকে সাহায্য করল। বোকা হলেও ওর ব্যবসা বুদ্ধি ভালো। এই লাইনে তার চিন্তা-ভাবনা খুবই পরিষ্কার। একবার ব্যবসার একটা বড় ঝামেলা থেকে সে আমাকে বাঁচাল। আমি বললাম, আজহার তুমি বিরাট বিপদ থেকে বাঁচিয়েছ আমি তোমার জন্যে কী করতে পারি বলো। আজহার বলল, তোমার মেয়েটাকে আমার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দাও। মেয়েটাকে আমার বড়ই পছন্দ। আমি বললাম, কোনো সমস্যা নেই। এই মেয়ে তোমার। এই হলো ঘটনা।

আমি বললাম, বড় কোনো ঘটনা তো না। সব বাবা মা-ই ছেলেমেয়ে ছোট থাকলে বিয়ে বিয়ে খেলা খেলে। তুমি এটাকে এত গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছ কেন?

গুরুত্বের সঙ্গে তো নিচ্ছি না। গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছি তোকে কে বলল?

বলার ভঙ্গি থেকে মনে হচ্ছে তুমি গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছ।

বাবা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আজহার যেটা ধরে সেটা ছাড়ে না। বিয়ের ব্যাপারটা সে ছাড়ল না। যখনই বড় কোনো বিপদে পড়ি সে আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করে তারপর তার ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ের ব্যাপারটা মনে করিয়ে দেয়। আমি বলি, সব ঠিক আছে কোনো সমস্যা নেই। তারপর একদিন। আজহার বলল, এক কাজ করি মওলানা ডাকিয়ে বিয়ে পড়িয়ে দেই। আমি বললাম, তা কী করে হয়? দুজনই শিশু–এদের বিয়ে হবে কীভাবে? সে বলল, বাপ-মায়ের ইচ্ছায় বিয়ে হবে। বাবা-মার জন্যেই এরা পৃথিবীতে এসেছে। বাবা-মার অধিকার আছে তাদের বিয়ে দেবার। ফালতু যুক্তি।

আমি শান্ত গলায় বললাম, তারপর কী হলো? মওলানা এসে বিয়ে পড়িয়ে দিল।

অনেকটা সেরকমই। বিয়ে বিয়ে খেলা। বিড়ালের বিয়ে হয় না? সে রকম আর কি?

মা বিয়েটা মেনে নিল?

তোর মা খুবই চিঙ্কার চেঁচামেচি করেছে। বিয়েটাকে আমি তেমন গুরুত্ব দেই নি। তার মার চেঁচামেচিকেও গুরুত্ব দেই নি।

এখন বিয়েটাকে গুরুত্ব দিচ্ছ?

পাগল হয়েছিস না-কি? গুরুত্ব দেব কী জন্যে? আইনের চোখে এ বিয়ে অসিদ্ধ। আজহার একটা খেলা আমার সঙ্গে খেলেছে। ব্যাপারটা আমার বুঝতে সময় লেগেছে। একেবার যে মহাবিপদে পড়েছি বিপদগুলিও তারই তৈরি করা। সে আমাকে ফেলেছে, আবার সে-ই টেনে তুলেছে। দাবা খেলায় হারজিৎ কোথায় ঠিক হয় জানিস? এন্ড গেম-এ। মিডল গেমে আমি ধরা খেয়েছি। এন্ড গেমে আজহার ধরা খাবে। তুই কি ভেবেছিস সে শুধু শুধু আমাকে কাফনের কাপড় দিয়েছে? কবরের জন্যে জায়গা কিনে দিয়েছে। সে একটা ম্যাসেজ আমাকে দেবার চেষ্টা করছে। সে আমাকে একটা ওয়ার্নিং দিল।

বাবা আরেকটা সিগারেট ধরালেন। আমি বাবার সামনে থেকে উঠে গেলাম। ছাদে যাব। অনেক দিন ভোর হওয়া দেখা হয় নি। আজ সুযোগ পাওয়া গেছে।

এই মুহূর্তে কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। খুব কাছের কোনো মানুষ— Sentinental friend.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *