রাধা তাঁহার মনের অবস্থা কাহাকে বলিবেন? কেউ বা তাহা বিশ্বাস করিবে? কেন অহেতুক দিন-রাত্র অঙ্গ শিহরিত হয়–আনন্দ হৃদয়ে উথলিয়া উঠে, চক্ষুকে সামাল দিব কিরূপে? আনন্দ-ঘন অশ্রু কি করিয়া বোধ করিব? যাহা ভাবি, তাহাতেই হর্ষোজ্জ্বল চক্ষে অশ্রু বহিয়া যায়। লজ্জায় গুরুজনের কাছে দাঁড়াইতে পারি না–
“গুরুজন আগে দাঁড়াইতে নারি।
সদা ছল-ছল আঁখি।” (চ)
যেদিকে তাকাই, সেইদিকেই তাঁহার প্রকাশ–পুলকে চিত্ত ভরিয়া যায়ঃ
“পুলকে আকুল, দিক্ নেহারিতে, সব শ্যামময় দেখি।” (চ)
কিন্তু একটা সময় আছে, যখন আর আর আমাতে থাকিতে পারি না। সন্ধ্যায় যখন–
“রবি যায় নি পাটে,”
অস্তচূড়াবলম্বী সূর্য্য যখন পশ্চিম আকাশে স্বর্ণাক্ষরে কি লিখিয়া যান, কলসীকক্ষে সখীরা যমুনাতীরে যায়, তখন রাধার যে অবস্থা হয়, তাহা অবর্ণনীয়।
“সখীর সহিতে জলেরে যাইতে
সে কথা কহিবার নয়।” (চ)
যমুনায় সখীদের সঙ্গে যাইবার পথে রাধার মন কেমন করে, তাহা বলিবার নহে। রাধিকা অত্যধিক মনের উচ্ছ্বাসে সে কথা বলিতে পারিতেছেন না, তাহা বলিতে যাইয়া ভাবাবেগে কণ্ঠরোধ হয়, কেবল মাত্র দুটি কথায় মনের সেই অব্যক্ত অনির্ব্বচনীয় কথা আভাসে বুঝাইতেছেন–
“সে কথা কহিবার নয়।”
চৈতন্যদেব গয়া হইতে ভাগবত পাদ-পদ্ম দর্শন করিয়া নদীয়ায় ফিরিয়া আসিয়া প্রিয় গধাধরের কাঁধে হেলাইয়া কি দেখিয়াছেন, বলিতে পারেন নাই, বলিতে যাইয়া মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িয়াছেন। রাধা এখনো যাহা বলিতেছেন, তাহা নিবিড় ও অস্পষ্ট,–
“সখীর সহিতে জলেরে যাইতে সে কথা কহিবার নয়।
যমুনার জল করে ঝল্মল তাহে কি পরাণ রয়।।” (চ)
এইখানেই শেষ, যমুনার জল ঝল্মল্ করে, তাহাতে প্রাণে এত ব্যথা কেন? এ ব্যথা, আনন্দের ব্যথা–আনন্দের আতিশয্যে বাক্রোধ যমুনার জলে সূর্য্যাস্তের রক্তিম আভা পড়িয়া ঝল্মল্ করিয়া উঠে, রাধা কি তাহাই বলিতেছেন? সন্ধ্যানিলে স্বর্ণচূড় যমুনাতরঙ্গ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে, রাধিকা কি সেই কথা বলিতেছেন? যমুনার জলে সখীদের নীল শাড়ীর আভা মিশিয়া যে ঔজ্জ্বল্য খেলিতে থাকে, রাধা কি সেই কথা বলিতেছেন? রাধা তো কিছু খুলিয়া বলেন নাই; তবে কি সে ভাব, যাহাতে তাঁর প্রাণ এমন আকুল হয়?
তরুশাখে স্থিত ময়ুরপুচ্ছালঙ্কৃত কৃষ্ণের প্রতিবিম্ব পড়াতে যমুনার জল ঝল্মল্ করিয়া উঠে, তাহাই তিনি দেখিতে যাইতেছেন; যমুনার পথে সেই কথা মনে হওয়াতে রাধার আনন্দে বাক্রোধ হইতেছে। সেই অবর্ণনীয় সুখের কথা–যমুনার নীল জলে প্রতিবিম্বিত কৃষ্ণরূপের কথা–বলিতে যাইয়া ভাবের উদ্বেলের আতিশয্যে তিনি আর কিছু বলিতে পারেন নাই, শুধু বলিতেছেন,
“যমুনার জল, করে ঝল্মল্, তাহে কি পরাণ রয়?”
এইভাবে অর্দ্ধ-প্রকাশ–অর্দ্ধ-অপ্রকাশ কণ্ঠের ভাষায় চণ্ডীদাস তাঁহার রাধাকে চিত্রিত করিয়াছেন, এই স্তব্ধ চিত্র দেখিলে মনে হয় যেন কুবের তাঁহার ভাণ্ডার আগলাইয়া দাঁড়াইয়াছেন–তাহার বাহ্য প্রকাশ নাই। কৃষ্ণপ্রেমের এই “অনভিব্যক্ত রত্বোৎপত্তিরিবার্ণবঃ” ছবির তুলনা নাই। পরবর্ত্তী কবিরা এই কথার ব্যাখ্যা করিয়া বলিয়াছেনঃ–
“ঢেউ দিও না জলে বলে কিশোরী।
দরশনে দাগা দিলে হবে পাতকী।।”
চণ্ডীদাস কথা বলিয়ে বলিতে থমকিয়া যায়; বলিবার থাকে অনেক, কিন্তু বলেন অল্প। পাঠকের মনে ইঙ্গিতমাত্রে একটা তোলপাড় জাগাইয়া, তিনি অল্প কথায় শেষ করেন। তিনি কৃষ্ণ-রূপ মনে মনে ধায় করিয়া আবিষ্ট হইয়া পড়েন, তখন অন্য কোন ব্যাখ্যা না দিয়া আপন মনে নিজের শেষ সঙ্কল্পের কথা বলিয়া ফেলেন–
“কুলের ধরম নারিনু রাখিতে, কহিনু তোমার আগে।
চণ্ডীদাস কহে শ্যাম-সুনাগর সদাই হিয়ায় জাগে।।”
রাধিকা বলেন নাই, কিন্তু চণ্ডীদাস তাহা বলিয়া দিয়াছেন।
সমস্ত পদটি এইঃ–
কাহারে কহিব মনেরই মরম, কেবা যাবে পরতীত।
(আমার) হিয়ার মাঝারে মরম-বেদন সদাই শিহরে চিত।।
গুরুজন আগে দাঁড়াইতে নারি, সদা ছল-ছল আঁখি।
পুলকে আকুল, দিক্ নেহারিতে সব শ্যামময় দেখি।।
সখীর সহিতে জলেরে যাইতে সে কথা কহিবার নয়।
যমুনার জল করে ঝল্মল্ তাহে কি পরাণ রয়।।
(আমি) কুলের ধরম নারিনু রাখিতে কহিলাম তোমার আগে।
কহে চণ্ডীদাস শ্যাম সুনাগর সদাই হিয়ায় জাগে।।”
এই গীতটি বাহ্য দৃশ্যে কতকটা অসম্পূর্ণ মনে হইবে, কিন্তু ইহা নিগূঢ় অর্থব্যঞ্জক।
রাধিকা বলিতেছেন, তাঁহার মনের অবস্থা কেহ বিশ্বাস করিবে না; কিন্তু কি বিশ্বাস করিবে না, তাহা বলেন নাই। গুরুজনের কাছে দাঁড়াইতে চোখে জল পড়ে বলিয়াছেন; কিন্তু কেন জল পড়ে, তাহা বলেন নাই। সখীর সঙ্গে জলে যাইবার সময়ে যে অবর্ণনীয় ভাব হয়, তাহা বলেন নাই। সখীর সঙ্গে জলে যাইবার সময়ে যে অবর্ণনীয় ভাব হয়, তাহা “সে কথা কহিবার নয়” বলিয়াচি ছাড়িয়া দিয়াছেন, এবং যমুনার জল ঝল্মল্ করিয়া উঠে, তাহাতে প্রাণ থাকে না কেন, তাহা তো মোটেই বলেন নাই; আভাষ যাহা দিয়াছেন, তাহাও অস্পষ্ট; কূলধর্ম্ম যে কেন রাখিতে পারেন না, তাহাও বলেন নাই। মোট কথা, এই কবিতাটিতে অনেক ফাঁক আছে, যাহা পাঠক নিজের মর্ম্ম দিয়া পূরণ করিবেন। যাঁহার সে মর্ম্মের আবেগ নাই, তিনি বুঝিতে পারিবেন না। সেক্ষপীয়র লিখিয়াছেন, কবি ও পাগল এক সম্প্রদায়-ভুক্ত। পাগলের কথায় কথায় কতকগুলি শব্দ উচ্ছ্বাস আছে, কিন্তু সমস্তটার কোন অর্থ হয় না (“Mere sound and fury, signifying nothing”); বড় কবির কথাও মাঝে মাঝে অসম্বন্ধ বলিয়া ঠেকিবে, কিন্তু ভাবুক তাহার ফাঁকে ফাঁকে গূঢ় অর্থ পাইবেন, কাঠুরিয়া যেরূপ কোন খনির কাছে আসিয়া হঠাৎ মাণিক কুড়াইয়া পায়।
আমি সর্ব্বদাই বলিয়া আসিয়াছি, বিদ্যাপতি ও গোবিন্দদাসের পদে কাব্য-লক্ষ্মী যেরূপ নিজ কৌটা খুলিয়া নানা জহরৎ ও মণিমুক্তা দেখান, চণ্ডীদাসের কবিতায় কাব্য-লক্ষ্মীকে তেমন করিয়া পাওয়া যাইবে না। এখানে তিনি রহস্যময়ী, ভাবাবিষ্টা,–কাব্যলোকের ঊর্দ্ধে যে ধ্যানলোক, তিনি সেই ধ্যানলোকের দিকেই ইঙ্গিত করেন বেশী। তিনি স্বল্পভাষী; কিন্তু তাহার কথার মূল্য খুব বেশি, মহাজনের কষ্টি-পাথরে তাহা ধরা পড়ে।
কৃষ্ণরূপ-দর্শনের পর রাধা নিজের আনন্দে নিজে মগ্না। তিনি জগৎ হইতে স্বতন্ত্র হইয়া পড়িয়াছেন, তিনি আনমনা, আবিষ্টা; তিনি একেলা বসিয়া থাকেন, সখীগণের সঙ্গও আর ভাল লাগে না। কেহ কিছু বলিলে শুনিয়াও তাহা শোনেন না, স্বীয় আনন্দে বিভোর, ধ্যানমূর্ত্তি। ধ্যানের সার বস্তু কৃষ্ণরূপ তিনি দেখিয়াছেন, চক্ষু চারিদিকে সেই রূপের সন্ধান করে; আবেশে নীলাভ কৃষ্ণমেঘের দিকে চাহিয়া ধ্যানস্থ হইয়া যান–সেই কৃষ্ণবর্ণ-মাধুর্য্যে তাঁহার নিশ্চল চক্ষুর তারা যেন ডুবিয়া যায়। কখনও বা মেঘের কাছে তিনি কাতরোক্তি করিতেছেন; কি বলিতেছেন, কে বলিবে? কিন্তু যক্ষ যেরূপ মেঘকে দূত নিযুক্ত করিয়া প্রেমের বার্ত্তা পাঠাইয়াছিল–ইহা সেরূপ মেঘদূরের কথা নহে; এখানে রাধা কৃষ্ণের–কৃষ্ণ-রূপের–কৃষ্ণবর্ণের নমস্য প্রতীক-স্বরূপ নব মেঘের উদয় দেখিয়া হৃষ্টা হইয়াছেন, তখন যে কথা মুখে আসে, তাহা পৃথিবীর ভাষা নহে–সে ভাষা দেবলোকের ভাষা। কোন মল্লিনাথের (?) সাধ্য নাই যে, সে ভাষার টিকা করে, স্বয়ং চৈতন্য তাঁহার জীবন দিয়া তাহার টীকা করিয়াছেন। রাধা–
“আকুল নয়নে চাহে মেঘপানে
কি কহে দু’হাত তুলে।” (চ)
মেঘের দিকে দু’হাত তুলিয়া তিনি কি যেন কি কথা বলেন!
এ ‘কি জানি কি কথা’ বুঝাইতে চাহিয়া কৃষ্ণকমল দুইটি মর্ম্মস্পর্শী গান রচনা করিয়াছেন, তাঁহার “রাই-উন্মাদিনী” নাটকে তাহা আছে। একটির আরম্ভ এইরূপঃ– (মেঘ-সম্বোধনে)
“ওহে তিলেক দাঁড়াও দাঁড়াও, হে এমন করে যাওয়া উচিত নয়।
যে যার শরণ লয়, নিঠুর বঁধু, তারে কি বধিতে হয়।”
অপরটি–
“কি ভাবিয়া মনে দাঁড়িয়া ওখানে, একবার নিকুঞ্জকাননে কর পদার্পণ।
একবার আসিয়া সমক্ষে দেখিলে স্বচক্ষে,
জান্বে,–কত দুঃখে রক্ষে করেছি জীবন।” (কৃ)
রাধিকার এই ধ্যানাগারের নিস্তব্ধতায় অপর সকলের প্রবেশ নিষেধ এখানে চাঁপা ফুলের মালা খুলিয়া ফেলিয়া তিনি স্বীয় নিবিড় আলুলায়িত কুম্বলের বর্ণশোভা দেখিতেছেন, সেই শোভায় আবিষ্ট হইয়া পড়িয়াছেন–“না চলে নয়নের তারা।” নবোদিত কৃষ্ণমেঘের স্নিগ্ধ বর্ণে কাহার দেহ-প্রভা দেখিয়া মুহুর্মুহু চক্ষু অশ্রুসিক্ত হইতেছে, এবং একদৃষ্টে ময়ূর-ময়ূরীর নীলমণি-খচিত কণ্ঠে কাহার বর্ণাভাসের সন্ধান করিতেছেন? এই অনধিগম্য ধ্যানের কক্ষে চণ্ডীদাস প্রবেশ করিয়া রাধার যে চিত্রটি আঁকিয়াছেন, তাহা এইরূপঃ–
“রাধার কি হৈল অন্তর-ব্যথা,
সে যে বসিয়া একলে থাকয়ে বিরলে
না শুনে কাহার কথা।
এলাইয়া বেণী, ফুলের গাঁথুনি, খসায়ে দেখয়ে চুলে।
আকুল নয়নে, চাহে মেঘপানে, কি কহে দু’হাতে তুলে।।
বিরতি আহারে–রাঙ্গা বাস পরে, যেমন যোগিনী পারা।
সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘ পানে, না চলে নয়নের তারা।।
এক দিঠি করি, ময়ূরময়ূরী, কণ্ঠ করে নিরীক্ষণে।
চণ্ডীদাস কয় নব পরিচয়, কালিয়া বঁধুর সনে।”
ইহার পরঃ–
“সদাই চঞ্চল, বসন অঞ্চল সম্বরণ নাহি করে।
বসি থাকি থাকি, উঠয়ে চমকি–ভূষণ খসিয়া পড়ে।” (চ)
কাহার বাঁশীর সুরের আভাষ শুনিয়া, কাহার নূপুর-সিঞ্চিত পদ-স্পর্শের পুলকে, জগতের প্রতি রেণুতে রেণুতে বিন্দিত কাহার কৃষ্ণবর্ণের মাধুরিমা লক্ষ্য করিয়া রাধিকা চমকিত হইয়া উঠিতেছেন! চঞ্চল শাড়ীর অঞ্চল শরীর-মুক্ত হইয়া মাটিতে লুটাইতেছে এবং ভূষণ খসিয়া পড়িতেছে, তিনি তাহা সংবরণ করিতে পারিতেছেন না। এই উন্মাদভাব লক্ষ্য করিয়া চণ্ডীদাস বলিতেছেন, রাধিকাকে “কোথা বা কোন্ দৈব পাইল?” গায়েন এই গান গাহিবার সময়ে ঊর্দ্ধে অঙ্গূলী নির্দ্দেশ করিয়া আখর দিয়া জিজ্ঞাসা করিয়া থাকে, “সে কোন্ দেবতা, রাধিকাকে যিনি এমন করিয়া পাইয়াছেন?” পরবর্ত্তী সময়ে সে দেবতা নদীয়ার সোনার মানুষটিকে এমন করিয়া পাইয়াছিল, এজন্য তাঁহার জীবন-কথার দ্বারা চণ্ডীদাসের কবিতার টীকা হইয়াছে; নতুবা চণ্ডীদাসের কবিতার এই চিত্র, অন্ধের কাছে মহা-মাণিক্যের ন্যায়, সাধারণ নিকট মাটির ডেলার মত হইয়া পড়িয়া থাকিত।
চণ্ডীদাসের রাধা ও চৈতন্যের মূর্ত্তি পাশাপাশি রাখিয়া দেখিবেন একই ছবির দুটি দিক্ মাত্র।
চণ্ডীদাস লিখিয়াছেনঃ–
“ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার তিল তিল আসে যায়।
মন উচাটন, নিশ্বাস সঘন, কদম্ব-কাননে চায়।।
রাধার এমন কেন বা হৈল।
সদাই চঞ্চল বসন অঞ্চল,–সংবরণ নাহি করে।।
বসি’ থাকি’ থাকি’, উঠয়ে চমকি’, ভূষণ খসিয়া পড়ে।।”
রাধামোহন চৈতন্য-সম্বন্ধে লিখিয়াছেনঃ–
“আজু হাম কি পদনু নবদ্বীপ-চন্দ।
কর-তলে করই বয়ান অবলম্ব।
পুনঃ পুনঃ গতাগতি করু ঘর-পন্থ।
ধেনে ধেনে ফুলবনে চলই একান্ত।
ছল-ছল নয়নে কমল সুবিলাস।
নব নব ভাব করত পরকাশ।”
এক জন “ফুল বনে চলই একান্ত” অপরে কদম্বকাননের দিকে দৃষ্টিপাত করিতেছেন। একজন তিল তিল দণ্ডে দশবার ঘর-বাহির হইতেছেন, অপরে পুনঃ পুনঃ ঘর ও পথে যাতায়াত করিতেছেন না, অপরে করতল দ্বারা বদন অবলম্বন করিয়া আছেন–ইহা একই চিত্রপট।