০৬. আদিবাসীর সমাজ সংগঠন ও বিবাহ
আদিবাসীসমাজ সংগঠিত হয় উপজাতি বা ট্রাইবের ভিত্তিতে। প্রত্যেক ট্রাইবেরই স্বকীয় ভাষা ও কৃষ্টি আছে। প্রায়ই ট্রাইবগুলি বহু শাখায় বিভক্ত হয়। ট্রাইব ও তার শাখাগুলি সাধারণত অন্তর্বিবাহের গোষ্ঠী। যদি কেউ ট্রাইব বা তার শাখার বাইরে বিবাহ করে তা হলে তাকে ট্রাইব থেকে বহিস্কৃত করে দেওয়া হয়। ট্রাইব বা তার শাখাগুলি আবার কতকগুলি উপশাখা বা দলে বিভক্ত হয়। এই সকল উপশাখা বা দলগুলি হচ্ছে বহির্বিবাহের গোষ্ঠী। আদিবাসীর মধ্যে বহির্বিবাহেব এই গোষ্ঠীগুলি সাধাবণত টটেমভিত্তিক। তাব মানে প্রত্যেক গোষ্ঠীরই এক একটি নিজস্ব টটেম আছে। একই টটেমবিশিষ্ট গোষ্ঠীর স্ত্রী-পুরুষ পৰস্পরকে বিবাহ করতে পাবে না। তাদেব বিয়ে কবতে হয় অন্য টটেম গোষ্ঠীতে। তবে, বহির্বিবাহের এই গোষ্ঠীগুলি যে সব ক্ষেত্রেই টটেমভিত্তিক হয়, তা নয়। অনেক সময় এগুলি গ্রামভিত্তিক হয়। সেরূপ ক্ষেত্রে একই গ্রামের ছেলেমেয়েরা পরস্পবকে বিবাহ করতে পারে না। কেননা, তাদের বিশ্বাস এই যে, একই গ্রামের সকল অধিবাসীব মধ্যে একই রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে এবং সেই কারণে তাদের মধ্যে রক্তের ঐক্যতা আছে। এই রক্তের ঐক্যতাহেতু তাদের মধ্যে কখনও বিবাহ হতে পারে না। তাদের অন্ত গ্রামে বিবাহ করতে হয়। প্রায়ই দেখা যায় যে, একই টটেমের লোকেরা একই গ্রামে বাস করে। এরূপ ক্ষেত্রে টটেমনিষিদ্ধ বিবাহবিধান স্বয়ংচল হয়ে গ্রামনিষিদ্ধ বিবাহবিধানে পরিণত হয়।
অনেক জায়গায় আবার বিবাহ ব্যাপারে একটা গ্রাম-ক্রমও দেখতে পাওয়া যায়। যথা “ক” গ্রামের মেয়ের বিয়ে হয় “খ” গ্রামের ছেলের সঙ্গে আবার “খ” গ্রামের মেয়ের বিয়ে হয় “গ” গ্রামের ছেলের সঙ্গে—এরূপভাবে যেখানে বহির্বিবাহের গোষ্ঠীগুলি গ্রামভিত্তিক সেখানে এরূপ গোষ্ঠীগুলিকে আদিবাসীদের ভাষায় “খেরা”, ‘গোচী’, “খেল” ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। যেখানে আদিবাসী জীবনের উপর হিন্দু প্রভাব বিস্তারিত হয়েছে সেখানে এগুলিকে গোত’ বা ‘গোত্র’ বলা হয়। বলা বাহুল্য, এই গোত’ বা “গোত্র”গুলি টটেমভিত্তিক। যেমন—মধ্যভারতের গোণ্ডসমাজে বিশেষভাবে প্রচলিত গোত্রগুলি হচ্ছে ‘মারকাম’, ‘টেকম’, ‘নৈতাম’ ইত্যাদি। মারকাম শব্দের অর্থ হচ্ছে আম, টেকম-এর অর্থ হচ্ছে সেগুন ও নৈতাম-এর অর্থ হচ্ছে কুকুর। গোত্রের সাধারণ নিয়ম অকুযায়ী এই সকল সমাজে সগোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ। সগোত্রে বিবাহ করলে দণ্ড পেতে হয়। হিন্দুদের মত এই সকল সমাজে বিবাহের পর পুরুষদের গোত্র অপরিবর্তিত থাকে, কেবল বিবাহের পর মেয়েদের গোত্রেরই পরিবর্তন ঘটে। হিন্দুসমাজের সপিণ্ডবিধানের অনুসরণে আদিবাসীদের মধ্যেও অনেকস্থানে আবার পিতৃকুলে বা মাতৃকুলে নির্দিষ্ট পুরুষ পর্যন্ত বিবাহ নিষিদ্ধ আছে। যেমন—উত্তর প্রদেশের ভানটুদের মধ্যে বিবাহের জন্য মাতামহীর কুলে ছুই পুরুষ বর্জন করার বিধি আছে। মধ্যপ্রদেশের ভালজাতির মধ্যেও মাতৃকুলে দুইপুরুষ বর্জন করার রীতি আছে। এছাড়া তারা পিতামহীর ও মাতামহীর কুলেও তিন পুরুষ বর্জন করে।
ভৗলের ৪১টি বহির্বিবাহের দলে বিভক্ত এবং সেগুলি সবই টটেমভিত্তিক। মধ্যপ্রদেশের বালাঘাট ও মাণ্ডালা অঞ্চলের বাইগার অনেকগুলি অন্তর্বিবাহের শাখায় বিভক্ত। প্রতি শাখা আবার অনেকগুলি বহির্বিবাহের দলে বিভক্ত। এখানে প্রত্যেক লোককেই নিজ শাখার মধ্যে বিবাহ করতে হয় ; কিন্তু নিজ দলে বিবাহ করতে পারে না, অপর দলে বিবাহ করতে হয়। কেবল তাই নয়, তাদের এমন দলে বিবাহ করতে হয় যে-দল তাদের মত একই দেবদেবীর পূজা করে। অনেক স্থলে আবার কৌলীন্যপ্রথাও প্রচলিত আছে। যেমন মধ্যপ্রদেশের গোগুজাতির মধ্যে দুটি বিভাগ আছে—রাজগোও ও ধরগোও । ধরগোণ্ডের পিতার রাজগোণ্ডে কন্যা দান করে। কিন্তু রাজগোণ্ডের পিতারা কখনও ধরগোণ্ডে মেয়ে দান করে না।
বস্তার জেলার মারিয়াদের মধ্যে দলের যে সমস্ত লোক পরস্পরের সহিত দাদাভাই” সূত্রে আবদ্ধ তাদের মধ্যে বিবাহ হয় না। কিন্তু অপর যে দল তাদের সহিত “মামাভাই” সূত্রে আবদ্ধ মাত্র তাদের সঙ্গেই বিবাহ হয়।
মধ্যপ্রদেশের কোলজাতির অনেকগুলি শাখায় বিভক্ত। এই সকল শাখাগুলিকে “কুরি” বলা হয়। এদের মধ্যেও কৌলীন্যপ্রথা প্রচলিত আছে। কুরিগুলির মধ্যে সবচেয়ে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন কুরি হচ্ছে রাউতিয়া। রাউতিয়ারা কখনও পরবর্তী (কুরি ) ঠাকুরিয়া কুরিতে কন্যা দান করে না কিন্তু ঠাকুরিয়া কুরি থেকে মেয়ে নিতে তাদের কোন আপত্তি নেই। রাউতিয়ার রাউনতেল কুরি থেকেও মেয়ে নেয়। কিন্তু তাদের কখনও মেয়ে দেয় না। কাঠাওটিয়া নামে আর একটি কুরি ঠাকুরিয়াদের কুরি থেকে মেয়ে নেয়। কিন্তু কখনও মেয়ে দেয় না। তবে এক্ষেত্রে কাঠাওটিয়ারা মেয়েটিকে সাধারণত “রক্ষিতা” হিসাবে রাখে, “পরিণীতা” হিসাবে নয়। তবে একথা এখানে বলা প্রয়োজন যে, কোলেদের মধ্যে কুরিগুলি হচ্ছে অন্তর্বিবাহের গোষ্ঠী, বহির্বিবাহের গোষ্ঠী নয়। মাত্র কৌলীন্যপ্রথার জন্য এগুলি কোন কোন স্থলে বহির্বিবাহের গোষ্ঠীর রূপ পেয়েছে। যেহেতু কুরিগুলির মধ্যে কোন গোত্রবিভাগ নেই সেহেতু অনুমান করা যেতে পারে যে কোলেদের মধ্যে বিবাহ সগোত্রেই হয়। তবে যেখানে কৌলীন্তপ্রথা অবলম্বিত হয়, মাত্র সেখানেই সক্ষেত্র বিবাহ বজিত হয়। তবে কোলেদের মধ্যে এমন অনেক স্মারক চিহ্ন আছে যা থেকে পরিষ্কার প্রকাশ পায় যে, কোলেদের মধ্যে বিবাহ এক সময় গ্রামভিত্তিক ছিল।
সাঁওতালদের মধ্যে এক সময় ১২টি বহির্বিবাহের গোষ্ঠী ছিল। এর মধ্যে একটি এখন লুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে মাত্র ১১টি গোষ্ঠী আছে। এগুলি সবই বহির্বিবাহের গোষ্ঠী। তবে এদের মধ্যে কিসকু বা মুরমূগোষ্ঠীর মর্যাদা অন্য গোষ্ঠীর তুলনায় অনেক উচ্চ। এছাড়া মানভূমে কোন কোন জায়গায় ধর্মের ভিত্তিতে সাঁওতালরা দুটি প্রধান শাখায় বিভক্ত। এ দুটির নাম—দেশওয়ালী ও থেীরা। দেশওয়ালীর নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দেয়। আর থেীরার জড়োপাসনার উপর বিশ্বাস রাখে। দেশওয়ালীদের সঙ্গে থেীরাদের কখনও বিবাহ হয় না ।
রাঁচী জেলার ওরাঁওদের মধ্যে বহির্বিবাহের জন্ত যে গোত্রবিভাগ আছে সেগুলিকে “পরী” বলা হয়। পরীগুলি টটেম-ভিত্তিক । এক পরীর ছেলেকে অপর কোন পরীতে বিবাহ করতে হয়। গডাব৷ উপজাতির মধ্যেও গোত্রবিভাগকে পরী বলা হয়। একই পরীর মধ্যে তারা কখনও বিবাহ করে না । এমন কি পরীর ভেতর ব্যভিচারও গুরুতরভাবে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হয়।
মানভূমের সাঁওতালদের মত খরিয়ারাও দুটি প্রধান শাখায় বিভক্ত—শবর খরিয়া ও পাহাড়ীয়া খরিয়া। একের সঙ্গে অপরের কখনও বিবাহ হয় না। তবে এ বিষয়ে তাদের মধ্যে কোন মূর্যাদামূলক বিভেদ নেই। খরিয়াদের বিশ্বাস তারা রামায়ণ-বর্ণিত বানররাজ অঙ্গদের বংশধর ।
ওড়িষ্যার কোরাপুট জেলার পরোজাদের মধ্যেও বহিবিবাহের জন্য গোত্রবিভাগ দেখা যায়। ওড়িষ্যার পারলাকিমেদির শবরদের মধ্যেও গোত্রবিভাগ আছে। তবে এ সকল ক্ষেত্রে গোত্রগুলি টটেমভিত্তিক নয়, এগুলি গ্রামভিত্তিক। তার মানে একই গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যে কখনও বিবাহ হয় না। এক গ্রামের মেয়েকে বিবাহ করতে হয় অপর গ্রামের ছেলেকে । তাদের বিশ্বাস এই যে একই গ্রামের ছেলেমেয়ের পরস্পর ভাইবোন। সুতরাং তাদের মধ্যে কখনও বিবাহ হতে পারে না। তবে কোন নবাগন্তুক এসে যদি গ্রামে বাস করে তবে তার সঙ্গে তারা গ্রামের মেয়ের বিয়ে দেয় । তামিলনাড়র বহির্বিবাহের গোষ্ঠীগুলি হয় টটেমভিত্তিক আর তা নয় তো গ্রামভিত্তিক। কোচিনের কাদার উপজাতির মধ্যে যে বহির্বিবাহের গোষ্ঠীসমূহ আছে সেগুলি সবই গ্রামভিত্তিক। সেখানে তারা একই গ্রামের মধ্যে কখনও ছেলেমেয়ের বিবাহ দেয় না।
ত্রিবাছুরের উপজাতিসমূহের মধ্যেও বহির্বিবাহের গোষ্ঠী আছে। এগুলি দলভিত্তিক। কিন্তু পাহাড়ীয়া পান্তারামদের মধ্যে কোন দল বিভাগ নেই। তাদের মধ্যে তিন চারটি করে পরিবার নিয়ে এক একটি বহির্বিভাগের গোষ্ঠী গঠিত হয়। তবে এ সকল গোষ্ঠীর কোন স্বতন্ত্র নাম নেই।
ত্ৰিবান্দ্রমের কানিকাররা চারটি দলে বিভক্ত। এই চারটি দলের নাম হচ্ছে—মুট্টা-ইলোম,মেন-ইলোম, কায়-ইলোম এবং পাল-ইলোম। ইলোম শব্দের অর্থ হচ্ছে গোত্র। এদের মধ্যে মুট্টা-ইলোম ও মেন-ইলোম দল নিজেদের মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ মনে করে। এই দুটি দলের মধ্যে এক দলের ছেলেমেয়ের সঙ্গে অপরদলের ছেলেমেয়ের বিবাহ হয় কিন্তু অপর দুটি দলের সঙ্গে এদের কোন বৈবাহিক আদান-প্রদান নেই। তবে এ ক্ষেত্রে চারটি দলেরই বহির্বিবাহের গোষ্ঠী আছে এবং বিবাহের সময় তারা নিজেদের গোষ্ঠী বর্জন করে। ত্রিবান্দ্রমের আর এক জায়গায় কানিকাররা দুটি শাখায় বিভক্ত—আম্নন-থামবি ও মাচামবি । অল্পন-থামবিরা মেন-ইল্লোম, পেরিন-ইল্লোম ও কায়-ইল্লোম দলে বিভক্ত আর মাচামবিরা বিভক্ত মুট-ইল্লোম, বেলানট-ইল্লোম ও কুরু-ইল্লোম দলে। এদের মধ্যে এক দলের ছেলের সঙ্গে কখনও অপর দলের মেয়ের বিবাহ হয় না। এক সময় এদের মধ্যে যে মাতৃকেন্দ্রিক সমাজের প্রচলন ছিল তা তাদের সন্তানদের দলভুক্তি থেকে বোঝা যায়। যেমন—কুরু-ইল্লম দলের স্বামীর ঔরসে পেরিনইল্লম দল থেকে আনীত স্ত্রীর গর্ভে যে সস্তান হয় সে মাতার দলভুক্ত হয়, কখনও পিতার দলের লোক বলে পরিচিত হয় না। ত্রিবাঙ্কুরের মাল-আরায়নদের মধ্যেও সস্তান মাতার দলভুক্ত হয়, কখনও পিতার দলভুক্ত হয় না। আবার মল-বেদনদের মধ্যে বিবাহের পর স্ত্রী কখনও নিজের দলচু্যত হয় না এবং সস্তান মাতারই কুল পায়। উরালীদের মধ্যেও সন্তান মায়েরই কুল পায়, পিতার নয়। মান্নানদের মধ্যেও এই নিয়ম প্রচলিত।
আসামের উপজাতিসমূহ মঙ্গোলীয় মানবশাখার অন্তভূক্ত। এদের মধ্যে পিতৃকেন্দ্রিক ও মাতৃকেন্দ্রিক উভয় প্রকারের সমাজই প্রচলিত আছে। খাসিয়ার মাতৃকেন্দ্রিক। তারা পাচটি শাখায় বিভক্ত। আবার প্রতি শাখার মধ্যে অসংখ্য বহিবিবাহের দল বা উপদল আছে। আসামের মিকিরজাতির সমাজব্যবস্থা পিতৃকেন্দ্রিক। এরা পাচটি দলে বিভক্ত। প্রতিদলের মধ্যে বিভিন্ন উপদল আছে। মাত্র উপদলগুলিই বহির্বিবাহের দল হিসাবে ক্রিয়াশীল। দলের ভেতর কখনও বিবাহ হয় না। কেননা এদের বিশ্বাস যে, দলের সকলেই পরস্পরের ভাইবোন। সেই কারণে তাদের মধ্যে বিবাহ হতে পারে না। লাখেরদের মধ্যে কিন্তু এ সম্বন্ধে কোন বাধাধরা নিয়ম নেই, তারা ইচ্ছামত দলের বাইরে বা ভেতরে বিবাহ করতে পারে। কাছারের পাহাড়ী কাছারীরা ২০টি দলে বিভক্ত। এদের সাতটি দলকে “পুরুষ” দল বলা হয় আর ১৩টিকে বলা হয় “মেয়ে” দল। এদের মধ্যে ছেলেরা কখনও মায়ের দলে ও মেয়েরা কখনও বাপের দলে বিয়ে করতে পারে না। উত্তর কাছারের কুকীরা চারটি দলে বিভক্ত। এখানে দলগুলি অন্তর্বিবাহের গোষ্ঠী হিসাবে কার্যকর থাকলেও এক দলের ছেলের সঙ্গে অপর দলের মেয়ের বিবাহ বিরল নয়। যেখানে এরূপ দলের বাইরে বিবাহ হয় সেখানে বিবাহের পর নারী স্বামীর দলাখ্যা পায়। কিন্তু খেলমাকুকীদের মধ্যে স্বতন্ত্র নিয়ম পরিলক্ষিত হয়। এখানে দলগুলি অন্তর্বিবাহের গোষ্ঠী হিসাবে ক্রিয়া করে। অনেক সময় একদলের সঙ্গে অপর দলের ছেলেমেয়েদের বিবাহ হয় বটে কিন্তু এরূপ বিবাহ দূষিত বলে গণ্য হয় এবং যে ক্ষেত্রে এরূপ বিবাহ হয় সেক্ষেত্রে সেই পুরুষ পিতা-মাতার শ্রাদ্ধাদি কাজের অধিকারী হয় না। একারণে প্রতি পরিবারেরই লক্ষ্য থাকে ষে পিতামাতার শ্রাদ্ধাদির জন্ত পরিবারের অন্তত একজন যেন নিজ
দলে বিবাহ করে। তবে এরূপ দলবহিভূত বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রী কখনও স্বামীর দলাখ্যা পায় না।
আদিবাসীদের সমাজ সংগঠনের যে সমীক্ষা এই অধ্যায়ে দেওয়া হলো তা থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, আদিবাসী সমাজে বহির্বিবাহ সাধারণভাবে প্রচলিত। আদিবাসীদের মধ্যে বহির্বিবাহের গোষ্ঠীগুলি টটেমভিত্তিক বা গ্রামভিত্তিক বা যে রকম ধরণেরই হউক না কেন, তাদের বিশ্বাস যে বহির্বিবাহের জন্য নির্দিষ্ট গোষ্ঠীগুলির মধ্যে স্ত্রী-পুরুষের পরস্পর সম্পর্ক হচ্ছে ভাইবোনের সম্পর্ক এবং সেই কারণে সেই গোষ্ঠীর মধ্যে ছেলেমেয়েদের বিবাহ হতে পারে না। আদিবাসীরা কেন নিজ গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ করে না সে সম্বন্ধে তাদের প্রশ্ন করলে তাদের কাছ থেকে নিয়ত এই উত্তরই পাওয়া যায়। এটা সকলেরই জানা আছে যে জগতের সর্বত্র পরিবারই বহির্বিবাহের ক্ষুদ্রতম সংস্থা হিসাবে ক্রিয়া করে। কেননা পরিবারের মধ্যে যৌনমিলন অজাচার স্বরূপ গণ্য হয়। নৃতত্ত্ববিদগণের মধ্যে অনেকে মনে করেন যে পরিবারের মধ্যে যৌনাচার সম্পর্কে যে অলঙ্ঘনীয় বিধিনিষেধ আছে তা থেকেই দলগত বা গোষ্ঠীগত বহির্বিবাহ প্রথার উদ্ভব হয়েছে।
আদিবাসীদের মধ্যে বিবাহের জন্য যে সামাজিক সংগঠন আছে এতক্ষণ সে সম্বন্ধেই বলা হলো। এবার আদিবাসী সমাজে বিবাহের রকমফেরের কথা কিছু বলা যাক। একথা আগেই বলা হয়েছে যে প্রাচীন ভারতে রাক্ষস, আস্থর ইত্যাদি বিবাহপ্রথা আর্যগণ কর্তৃক আদিবাসী সমাজ থেকেই গৃহীত হয়েছিল। রাক্ষস বিবাহ বর্তমানে মধ্যপ্রদেশের ভালজাতির মধ্যে প্রচলিত আছে। এরূপ বিবাহকে ভীলেরা “ঘিসকরলেজানা” বলে। তার মানে যে বিবাহে মেয়েকে কেড়ে আনা হয়েছে। ৩০৪০ বছর আগে পর্যন্ত এরূপ বিবাহ সচরাচর ঘটতো । এরূপ বিবাহের প্রশস্ত সময় ছিল ভাগোরিয়া উৎসবের দিন। ভাগোরিয়া উৎসব অনুষ্ঠিত হতো হোলিপর্ব উপলক্ষে “মেড়।” পোড়ানোর আগের দিনে। সাধারণত বর বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে কোন গ্রামে প্রবেশ করতে ও মেয়েটিকে জোর করে কেড়ে নিয়ে আসতো । তারপর একটা সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহকে নিয়মানুগত করে নেওয়া
হতো । মধ্যপ্রদেশের চানডা ও বস্তাব জেলার গোগুদের মধ্যেও পূর্বে এরূপ বিবাহ প্রচলিত ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এরূপ বিবাহকে দণ্ডবিধি আইন অনুসারে অপরাধ বলে গণ্য করে শাস্তি দেওয়ার ফলে আদিবাসীরা সন্ত্রস্ত হয়ে এ সম্পর্কে এক বিকল্প পন্থা অবলম্বন করেছে। এরা প্রথমে বর-কনের মধ্যে বিবাহ স্থির করে এবং পরে বিবাহ অনুষ্ঠিত হবার সময় পুৰ্বকালেব রীতি অনুযায়ী কনেকে কেড়ে নেওয়ার একটা কপট অভিনয় কবে মাত্র। দক্ষিণ ভাবতে ত্রিবাঙ্কুরের মুড় বনদের মধ্যেও মেয়ে কেড়ে নিয়ে এবকম বিবাহেব প্রচলন আছে।
যেখানে মেয়েকে এভাবে কেড়ে নিয়ে আসা হতো সেখানে একদলের সঙ্গে অপর দলের যে দ্বন্দ্ব হতো সে দ্বন্দ্ব যে অনেক সময চিরস্থায়ী দ্বন্দ্বে পরিণত হতো সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এরূপ দ্বন্দ্ব পরিহারের জন্য উভয় দলের মধ্যে শান্তিপূর্ণ ও বন্ধুত্বভাবে কন্যাবিনিময় প্রথার উদ্ভব হয় । কন্যা-বিনিময় প্রথার পিছনে যে যুক্তি আছে তা হচ্ছে স্ত্রীলোক জননশক্তির উৎস। কোন স্ত্রীলোককে যদি কেহ দল থেকে লুণ্ঠন করে নিয়ে যায় তা হলে দলের জননশক্তির ভাণ্ডার হ্রাস পায় । সুতরাং কন্যা-বিনিময় দ্বারা ঐ ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করতে হবে। এ ছাড়া উপজাতিসমাজে মেয়েরা নিজ শ্রম দ্বারা দলের অর্থনৈতিক উৎপাদনে সাহায্য করে। সেইহেতু তারা দলের আর্থিক সম্পদ স্বরূপ। বিবাহের পর কন্যা অপর দলে চলে গেলে আর্থিক সম্পদ ভাণ্ডারের যে ক্ষয় ক্ষতি হয় তা পূরণ করাও কন্যা-বিনিময় প্রথার উদ্দেশ্য। কন্যা-বিনিময় প্রথা ত্রিবাঙ্কুরের পাহাড়িয়া পানতারাম ও উরালীদের মধ্যে এখনও প্রচলিত আছে। বস্তুত উরালীদের মধ্যে বিবাহ সম্পূর্ণভাবে বিনিময় প্রথার উপর স্থাপিত। এদের সমাজে কন্যাপণ দিয়ে স্ত্রী পাওয়া যায় না। যখন কোন যুবক বিবাহ করতে চায় তখন তাকে নিজের কোন বা অপর কোন আত্মীয়াকে অপর দলের হাতে সমর্পণ করে তবে স্ত্রী সংগ্ৰহ করতে হয়। এরূপ বোন বা আত্মীয়া যে যুবতী হতে হবে এমন কোন কথা নেই। যে-কোন বয়সের বোন বা আত্মীয়া হলেই চলে, কেবল তাকে স্ত্রীলোক হতে হবে। এই কারণে আগেকার দিনে উরালীসমাজে কোন যুবকের যতগুলি বোন থাকতো তার ততগুলি বিবাহ করবাব সম্ভাবনা ছিল ।
আর এক রকম রাক্ষস বিবাহ আদিবাসীসমাজে প্রচলিত আছে । একে বলা হয় “সিন্দুর ঘষা” বিবাহ। সিন্দুর ঘষা বিবাহ অনেক জায়গায় প্রচলিত আছে । এটা বিশেষ করে প্রচলিত আছে আমাদের ঘরের কাছে সাঁওতালসমাজে । এ বিবাহে পুরুষ হাটে বা বাজারে জোর কবে কোন মেয়ের সিথিতে সিন্দুর ঘষে দেয়। সিন্দুর ঘষে দেবার পর উভয়ের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক হয়ে যায়। মেয়ে যদি বরকে পছন্দ না করে তা হলেও তার সঙ্গে তাকে ঘর করতে হয়। তার কারণ, সিন্দুর-ঘষা মেয়েকে সমাজে আর কেউ বিবাহ করে না।
অসুর বিবাহ রাক্ষস বিবাহেরই এক অমুকৌশল মাত্র। যেস্থলে কোন কারণবশত কন্যা বিনিময় করা সম্ভবপর হতো না সেস্থলে কস্তার পরিবর্তে তার মূল্য ধরে দেওয়া হতো, যাতে অপর দল ঐ পণের বিনিময়ে অপর কোন দল থেকে কন্যা ক্রয় করে দলের ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করতে পারতো। এইভাবে কন্যাপণ প্রথার উদ্ভব হয়েছিল। কন্যাপণ যে মাত্র টাকা-পয়সাতেই দেওয়া হয়, তা নয়।
অনেক সময় কন্যাপণ অন্তরকম ভাবেও দেওয়া হয় । যেমন—শ্রমদান করে। এ সম্পর্কে মনে রাখতে হবে যে পণ দিয়ে মেয়ে কেনা ঠিক ক্রীতদাসী কেনা বা অন্ত পণ্যদ্রব্য কেনার মত নয়। কেননা ক্রীতদাসী বা ক্রীত তান্ত পণ্যদ্রব্য ক্রেতা আবার বেচতে পারে। কিন্তু যেখানে কন্যাপণ দিয়ে বিবাহ করা হয় সেখানে মেয়েকে আবার বেচা যায় না। বস্তুত যা কেনা হয় সেটা হচ্ছে কন্যার সন্তানপ্ৰসবিনী ক্ষমতা । সেই কারণে দেখতে পাওয়া যায় যে, যেখানে স্ত্রী অনুর্বরা হয় সেখানে তাকে সহজে বিচ্ছেদ করা যায়।
আদিবাসীসমাজে কন্যাপণ প্রথা বহুবিস্তৃত। বস্তুত এমন কোন উপজাতি নেই যাদের মধ্যে কোন-না-কোনভাবে কন্যাপণ প্রথা প্রচলিত নেই । কন্যাপণের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন উপজাতির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রকম। পূর্বে কন্যাপণ নামমাত্ৰ পাচ টাকা মূল্য থেকে একশত টাকা বা তার বেশী ছিল। উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের ভানটুদের মধ্যে কন্যাপণের পরিমাণ ৬০ থেকে ৮০ টাকা হতো। মধ্যপ্রদেশে কোলজাতির মধ্যে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ১২০ টাকা । বারওয়ানীর রথিয়৷ ভীলদের মধ্যে এর পরিমাণ ছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকা। মাণ্ডালা ও বালাঘাটের বাইগাদের মধ্যে কম্বাপণ ছিল ৫ টাকা থেকে ৯ টাকা। কোচিনের কাদারদেব মধ্যে এক সময় কন্যাপণ বনজ পণ্যসামগ্ৰী দিয়ে চুকানো হতো, কিন্তু এখন তা টাকাপয়সায় মেটানো হয় ।
অনেক উপজাতির মধ্যে বরকে কন্যাপণের পরিবর্তে শ্রমদান করতে হয়। এরূপ বিবাহে বরকে নির্দিষ্টকালের জন্ত শ্বশুরবাড়ীতে বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমিকের কাজ করতে হয়। এরূপ শ্রমদানের কাল সাধারণত তিন থেকে পাচ বৎসর নির্দিষ্ট হয়। কোন কারণে যদি বিবাহ না হয় তা হলে কন্যার পিতাকে বর যে সময়ের জন্ত শ্রমদান করেছে সে সময়ের নিমিত্ত প্রচলিত হারে পারিশ্রমিক অমনোনীত বরকে প্রদান করতে হয় । কন্যাপণের বিনিময়ে শ্রমদান যে সকল ক্ষেত্রে বলবৎ আছে সে সকল ক্ষেত্রে প্রায়ই লক্ষ্য করা যায় যে কন্যার কোন ভাই থাকে না। এসকল ক্ষেত্রে যুক্তি এই যে, যেহেতু মেয়েটি তার বাবাকে কাজে সাহায্য করতে সেহেতু তার পিতাকে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ বরকে শ্রমদান করতে হবে। মধ্যপ্রদেশের ভীলদের মধ্যে কন্যাপণের বিনিময়ে শ্রমদানের প্রথা প্রচলিত আছে। এদের মধ্যে আগেকার দিনে সাধারণত সাত বছর শ্রমদান করতে হতো। কিন্তু বর্তমানে শ্রমদানের কাল বাড়িয়ে দিয়ে নয় বছর করা হয়েছে। প্রায়ই দেখা যায় যে দুই তিন বছর শ্রমদানের পর যুবক তার স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যায়। শ্রমদানের সময় যুবক-যুবতী সাধারণত স্বামী-স্ত্রী রূপে বাস করে। কিন্তু শ্রমদানের নির্দিষ্ট সময় উত্তীর্ণ না হলে যুবক সাধারণত শ্বশুরালয় ত্যাগ করতে পারে না। ঝাবুয়ার পাতলিয়াদের মধ্যে শ্রমদানের নির্দিষ্ট সময় সাত বৎসর। এই নির্দিষ্ট সময় উত্তীর্ণ হবার পর যুবকযুবতী স্বতন্ত্র গৃহ স্থাপন করে এবং তারা যাতে স্বাধীনভাবে কৃষিকর্ম করতে পারে তার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সাত বৎসর উত্তীর্ণ হবার আগেই যদি তারা পালিয়ে যায় তা হলে বরকে অমৃত্তীর্ণকালের জন্য আনুপাতিক হারে কন্যাপণ দিতে হয়। বিন্ধ্য ও সাতপুর পর্বতমালা অঞ্চলের অধিবাসী ভাললা উপজাতিদের মধ্যেও কন্যাপণের বিনিময়ে শ্রমদান প্রথা প্রচলিত আছে । মাণ ডালা ও বালাঘাটের বাইগাদের মধ্যে ৫ থেকে ৯ টাকা কন্যাপণ দেবার প্রথা আছে, কিন্তু বর যদি অর্থাভাবের জন্য ওই কন্যাপণ দিতে না পারে তা হলে তাকে তিন বৎসরের জন্ত শ্রমদান করতে হয় । অনুরূপ প্রথা দক্ষিণ ভারতে উল্লাটানদের মধ্যেও প্রচলিত আছে। এদের মধ্যে সাধারণত কন্যাপণ দিয়েই কন্যা সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু বরের যদি কন্যাপণ দেবার ক্ষমতা না থাকে তা হলে তাকে শ্রমদান করে স্ত্রী সংগ্রহ করতে হয় । এরূপ শ্রমদান এড়াবার জন্য যুবক অনেক সময় যুবতীকে লুণ্ঠন করে নিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে কোন গোপন জায়গায় কিছুকাল বসবাস করে। এরূপ বসবাসের পর বিবাহ বৈধ বলে গণ্য হয় এবং সমাজে তা স্বীকৃত হয়।
প্রেম করে বিবাহ করা কিংবা প্রণয়ীকে নিয়ে গোপনে পালিয়ে গিয়ে বিবাহ করা, উভয়ই আদিবাসীসমাজে প্রচলিত আছে। তবে এরূপ বিবাহের প্রতি আদিবাসীসমাজের দৃষ্টিভঙ্গী খুব কটাক্ষপূর্ণ। মধ্যপ্রদেশের ভাললা ও পাতলিয়৷ এই উভয় জাতির মধ্যেই প্রণয়ীকে নিয়ে গোপনে পালিয়ে গিয়ে বিবাহ করার রীতি আছে। বালাঘাট ও মাণ ডাল অঞ্চলের বাইগাদের মধ্যে কখন কখনও কন্যা নিজেই বর পছন্দ করে তার পিতামাতার কাছে নিজের পছন্দের কথা জানায়। তা সত্ত্বেও যদি অপর পুরুষের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হয় তা হলে বিয়ের পর মেয়ে সাধারণত পালিয়ে যায়। উদয়পুরের পাণ্ডোদের মধ্যে যুবক-যুবতী যদি গোপনে পালিয়ে যায় এবং ওই যুবকের ঔরসে যদি যুবতী গর্ভবতী হয় তা হলে সামাজিক রীতি অনুসারে যুবককে বাধ্য করা হয় মেয়েটিকে বিয়ে করতে। মাছরার পালিয়ানদের মধ্যে যুবক-যুবতী যদি প্রেমে পড়ে পরস্পরের সহিত যৌন-সঙ্গমে লিপ্ত হয় তা হলে সমাজ সেটা মার্জন করে নেয় এবং নিয়মানুগ অনুষ্ঠান দ্বারা তাদের বিবাহ দিয়ে দেয়। মধ্যপ্রদেশের কোলজাতির সমাজ কিন্তু এ সম্বন্ধে কঠোর দৃষ্টিভঙ্গ নেয়। তারা এরূপ দুনীতি মার্জনা করে না।
অজাচার সম্বন্ধে আদিবাসীর দৃষ্টি ভঙ্গী অত্যন্ত কঠোর। নিজ দল বা গোষ্ঠীর মেয়ের সঙ্গে যৌন-সঙ্গম অজাচার বলে গণ্য হয়। মাতৃকুলের উৰ্দ্ধতন চার পুরুষের মধ্যে যৌন-সঙ্গমও অজাচার বলে পরিগণিত হয়। এরূপ ক্ষেত্রে বিবাহ তো হয়-ই না। এটা হচ্ছে উত্তর ভারতের সাধারণ রীতি। দক্ষিণ ভারতে কিন্তু এমন অনেক উপজাতি আছে যাদের মধ্যে মাতৃকুলে বিবাহই হচ্ছে বাঞ্ছনীয় বিবাহ। অন্ধ্রপ্রদেশের মহবুবনগরের চেনচুদের মধ্যে মামাতো বোন কিংবা পিসতুতো বোনকে বিবাহ করাই প্রচলিত রীতি। তবে তারা খুড়তুতে কিংবা জাঠতুতো বোনকে কখনও বিবাহ করে না। মাণ ডালা ও বালাঘাট অঞ্চলের বাইগার মাত্র পিসতুতো বোনকেই বিবাহ করে, মামাতো বোনকে নয়। মুরিয়াদের মধ্যে পিসতুতো ও মামাতো উভয় বোনকেই বিবাহ করার রীতি আছে। মাত্রার পালিয়ানদের মধ্যে বিবাহ হয় মামাতো বোন বা ভগ্নীর সহিত, পিসতুতো বোনের সঙ্গে কখনও নয়। কিন্তু কোচিনের কাদারদের মধ্যে পিসতুতো বোনের সঙ্গেও বিবাহের চলন আছে। ত্রিবাঙ্কুরের মুড় বনদের মধ্যে এরূপ বিবাহই একমাত্র রীতি। ত্রিবাছুরের মলপুলায়ণ ও মলবেদনদের মধ্যেও এরূপ বিবাহের রীতি আছে। ত্রিবাঙ্কুরের উলুড়ণরা মাত্র পিসতুতো বোনকে বিবাহ করে কিন্তু মলকুরুবনর পিসতুতো বোনকে বিবাহ করে না। তারা মাত্র মামাতে বোনকেই বিবাহ করে। পণ্ডিতেরা অনুমান করেন যে, মামাতোপিসতুতো বোনের সঙ্গে বিবাহের উৎপত্তি হয়েছে অর্থনৈতিক কারণে। এরূপ বিবাহের দ্বারা খরচপত্র এড়ানো যায় ও সম্পত্তি অক্ষত অবস্থায় রাখা যায়। এই কারণে পিতার দিক থেকে তার বোনের মেয়ের সঙ্গে এবং মাতার দিক থেকে তার ভাইয়ের মেয়ের সঙ্গে বিবাহে উৎসাহ দেওয়া হয়। আবার অনেকে অল্পমান করেন যে কন্যা বিনিময় দ্বারা “পালটি” বিবাহের রীতি থেকেই এরূপ বিবাহের উৎপত্তি হয়েছে।
একাধিক পতির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার রীতি নীলগিরি পাহাড় অঞ্চলের টোডাদের মধ্যে প্রচলিত আছে। ত্রিবাঙ্কুরেব মুড় বন, মল-পুলায়ণ ও মল-আরয়নদের মধ্যেও বহুপতিক বিবাহ একসময় প্রচলিত ছিল, কিন্তু এখন তা বিরল। উল্লাটানদের মধ্যেও ভ্রাতৃত্বমূলক বহুপতি গ্রহণ কখন কখনও দেখা যায়, যদিও ওটা তাদের মধ্যে সাধারণ রীতি নয়। হিমালয়ের সীমান্ত প্রদেশের কয়েকটি উপজাতির মধ্যেও বহুপতিক বিবাহ প্রচলিত আছে।
টোডাদের মধ্যে অস্তর্বিবাহমূলক দুটি বিভাগ আছে। এ-দুটি বিভাগের নাম হচ্ছে টারথার ও টিভালি। টারথারগণ নিজেদের টিভালি অপেক্ষা উচ্চতর মর্যাদাসম্পন্ন বলে মনে করে। দুটি বিভাগই হচ্ছে অন্তর্বিবাহের গোষ্ঠী। তার মানে টারথারদের সঙ্গে টিভালিদের কখনও বিবাহ হয় না। টারথারদের বিভাগে ১২টি ও টিভালিদের বিভাগে ৬টি গোত্র আছে। বিবাহ সব সময় নিজ গোত্রের বাহিরে হয়। টোডাদের মধ্যে মামাতে ও পিসতুতো বোনের সঙ্গে বিবাহের রীতিও প্রচলিত আছে। কিন্তু টোডাদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যমূলক বৈবাহিক আচরণ হচ্ছে বহুপতি গ্রহণ। টোডাদের মধ্যে যে বহুপতিক বিবাহের চলন আছে তা হচ্ছে ভ্রাতৃত্বমূলক। তার মানে একাধিক ভ্রাতা একজন স্ত্রীলোককে বিবাহ করে। অনেক সময় ভ্রাতৃগণ সহোদর না হয়ে দলভুক্ত ভ্রাতাও হন। টোডাদের মধ্যে সন্তানের পিতৃত্ব “পুরুসুৎ পুমি” নামে এক অনুষ্ঠানের দ্বারা নির্দিষ্ট হয়। স্ত্রীর ৭ মাস গর্ভকালে স্বামীদের মধ্যে একজন ধনুর্বান নিয়ে এই অনুষ্ঠান নিম্পন্ন করে এবং সে-ই জাতসন্তানের পিতারূপে পরিচিত হয়। যতদিন না অপর কোন স্বামী অনুরূপ অনুষ্ঠান নিম্পন্ন করছেন ততদিন অনুষ্ঠানকারী স্বামীই সমাজে সন্তানের পিতারূপে গণ্য হয় । যেক্ষেত্রে স্বামীরা সকলে একত্রে বাস করে না বা ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে বাস করে সে-ক্ষেত্রে স্ত্রী পালা করে প্রত্যেক স্বামীর সঙ্গে একমাস কাল করে বাস করে।
কাশ্মীরের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত লাডাক উপত্যকার অধিবাসী লাডাকিদের মেয়েরাও বহুপতি গ্রহণ করে । তাদের মধ্যে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী সাধারণত জ্যেষ্ঠ ভাইই বিবাহ করে কিন্তু সেই বিবাহিতা স্ত্রী তার কনিষ্ঠ ভাইদেরও স্ত্রীরূপে পরিগণিত হয়। তবে যেখানে অনেকগুলি ভাই থাকে সেক্ষেত্রে ওই সম্পর্ক মাত্র তিন চার ভাইদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়। এরূপ ক্ষেত্রে পরবর্তী ভাইয়ের কোন মঠের অন্তভুক্ত হয়ে লামার জীবনযাপন করে। তবে যেক্ষেত্রে কনিষ্ঠ ভাই এরূপভাবে মঠে প্রবেশ করে না সেক্ষেত্রে সে “মাগপা” স্বামী হিসাবে কোন মেয়েকে বিবাহ করতে পারে। *মাগপা” স্বামীর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় । তাকে সব সময় স্ত্রীর বশীভূত হয়ে থাকতে হয় এবং স্ত্রী যখন খুশী তখন তার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে আবার নূতন “মাগপা” গ্রহণ করতে পারে। তবে দ্বিতীয় স্বামীর অবস্থাও প্রথম স্বামীরই অনুরূপ। তার সঙ্গেও স্ত্রী যে কোন সময় খুশীমত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে পারে।
ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চলে লেপচাজাতির মধ্যেও বহুপতিক বিবাহ সীমিতভাবে প্রচলিত আছে। এ সম্পর্কে এদের মধ্যে প্রথার কিছু বৈচিত্র্য আছে। সাধারণত কোন ব্যক্তি যখন চাষবাসের কাজ একা করতে অসমর্থ হয় বা তাকে অন্য কাজে ব্যাপৃত থাকতে হয় তখন সে প্রতিবেশীদের মধ্য থেকে কোন অবিবাহিত যুবককে তার মাঠের কাজ করবার জন্য এবং তার দাম্পত্য শয্যার অংশীদার হতে আহবান করে নেয়। এক্ষেত্রে কোন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হয় না । এই দ্বিতীয় স্বামী কখনও নিজের বাবদে স্বতন্ত্র বিবাহ করতে পারে না। এক্ষেত্রে প্রচলিত রীতি হচ্ছে এই যে, স্ত্রী পর্যায়ানুক্রমে একান্তর রাত্রিতে প্রত্যেক স্বামীর সঙ্গে শয্যা গ্রহণ করবে। তবে যে-কোন স্বামীর দ্বারা সন্তান উৎপন্ন হউক না কেন সে সন্তান প্রথম স্বামীর ঔরসজাত বলে পরিচিত হবে। কেবল প্রথম স্বামী যদি দীর্ঘকালের জন্ত বিদেশে যায় এবং তার দ্বারা সন্তান উৎপাদন অসম্ভাব্য হয় তা হলে সে ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্বামীকেই সন্তানের পিতা বলে গণ্য করা হয়।
হিমালয়ের পাদদেশের জৌনসর বেওয়া অঞ্চলের খস জাতীয় অধিবাসীদের মধ্যেও বহুপতি গ্রহণ প্রথা প্রচলিত আছে। উত্তর ভারতের জাটজাতির দরিদ্রশ্রেণীর মধ্যে ও কেরালার নায়ারদের মধ্যে বহুপতিক বিবাহ দেখা যায়। কেরালার স্বর্ণকার বৃত্তিধারী আশরীজাতির মধ্যেও ভ্রাতৃত্বমূলক বহুপতিক বিবাহের চলন আছে। ভারতের বাইরে তিববতেও বহুপতিক বিবাহ আছে। প্রাচীন আর্যদের মধ্যেও যে বহুপতিক বিবাহের প্রথা ছিল তা তো আগেই বলা হয়েছে। এক সময় এরূপ বিবাহ ইউরোপেও প্রচলিত ছিল ।
যে-সমাজে স্ত্রীলোককে জননশক্তির আধার ও আর্থিক সম্পদ হিসাবে ধরা হয় সে-সমাজ যে বাল্যবিবাহ বরদাস্ত করবে না, তা বলাই বাহুল্য। এ কারণে আদিবাসীসমাজে বাল্যবিবাহের প্রচলন নেই। মাত্র যারা হিন্দুসমাজের প্রভাবের আওতায় এসেছে তাদের মধ্যেই কখন কখনও বাল্যবিবাহ দেখতে পাওয়া যায়। বস্তুত স্ত্রী-পুরুষের যৌবনপ্রাপ্তির পূর্বে বিবাহ আদিবাসীসমাজে খুবই বিরল। মধ্যপ্রদেশের ভীলেদের মধ্যে ১৫ থেকে ৪০ বছর হচ্ছে মেয়েদের বিবাহের প্রচলিত বয়স। ত্রিবাঙ্কুরের উপজাতি সমূহের মধ্যে ১৫ বৎসরের পূর্বে কখনও মেয়েদের বিবাহ হয় না। প্রায় সমস্ত আদিবাসীসমাজেই মেয়েদের বিবাহের বয়স পনের-র বেশী ।
বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রথা আদিবাসীসমাজেও প্রচলিত আছে। মধ্যপ্রদেশের ভীলদের মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রায়ই ঘটে থাকে। তাদের মধ্যে যে কোন কারণে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটতে পারে। তবে যেক্ষেত্রে বিবাহ-বিচ্ছেদের কারণ স্বরূপ স্ত্রীর চরিত্রের উপর দোষারোপ করা হয়, সে-ক্ষেত্রে স্বামী গ্রামের পঞ্চায়েতকে ডেকে তার সামনে নিজের মাথার পাগড়ি থেকে একখণ্ড কাপড় ছিড়ে নিয়ে. স্ত্রীকে দেয় এবং বলে যে, যেহেতু তার চরিত্রে তার আর আস্থা নেই সেইহেতু সে তাকে পরিহার করছে এবং ভবিষ্যতে সে তাকে ভগ্নীরূপে দেখবে। স্ত্রী ওই কাপড়ের টুকরাটি পিতৃগৃহে নিয়ে গিয়ে ঘরের চালের আড়ায় একমাস কাল ঝুলিয়ে রাখে। এর দ্বারা প্রচার করা হয় যে তার পূর্বস্বামী তাকে পরিহার করেছে এবং সে এখন দ্বিতীয়বার পতিগ্রহণের অধিকারিণী। একথা এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বিবাহ-বিচ্ছেদের সময় স্বামী তার দেওয়া কন্যাপণ ফেরত নিয়ে নেয় ।
ভানটুদের মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদের অনুমতি দেওয়া হয় বটে কিন্তু বিবাহবিচ্ছেদ খুব আনুকুল্যের দৃষ্টিতে দেখা হয় না। ওড়িষ্যার পরোজাজাতির মধ্যে স্ত্রী যদি স্বামীকে পছন্দ না করে বা তার সঙ্গে তার বনিবনা না হয় তবে তাকে অনুমতি দেওয়া হয় স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হবার জন্ত । এদের মধ্যে স্ত্রী যদি স্বামীকে পরিহার করে তবে তাকে বাধ্য করা হয় ৫ টাকা অর্থদণ্ড দিতে আর স্বামী যদি স্ত্রীকে বর্জন করে তবে তাকে মাত্র এক টাকা অর্থদণ্ড দিতে হয় । ত্রিবাঙ্কুরের জাতিসমূহের মধ্যেও বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রচলিত আছে। কাশ্মীরের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত লাডাক উপত্যকার অধিবাসীদের মেয়েরাও খুশীমত বিবাহ বিচ্ছিন্ন করতে পারে।
বিধবা বিবাহ আদিবাসীসমাজে খুব ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে। এ সম্পর্কে সাধারণত যে নিয়ম দেখতে পাওয়া যায় সেটা হচ্ছে—কোন বিশেষ আত্মীয়-এর সঙ্গে বিধবার বিবাহ হওয়া চাই । তবে মধ্যপ্রদেশের ভালজাতির মধ্যে এরূপ কোন বিশেষ ব্যক্তি বা আত্মীয়ের সঙ্গে বিবাহ বাধ্যতামূলক নয়। তাদের মধ্যে বিধবার সম্মতি পেলে বিবাহপ্রার্থী ব্যক্তি ৪৫ জন বন্ধু-বান্ধবসহ কিছু উপহার সামগ্রী ও বস্ত্র নিয়ে বিধবার বাড়ী যায় ও বিধবার ভাইয়ের স্ত্রীকে বা তার পিসিকে সাত পয়সা দক্ষিণা দেয়। এরূপক্ষেত্রে ভাইয়ের স্ত্রী বা পিসি সধবা হওয়া চাই। তারপর ভোজ ও মদ্য পান করে বিবাহ নিম্পন্ন করা হয় । এরূপ বিবাহ সাধারণত রাত্রিকালে হয় এবং নবপরিণীত বিধবা- কখনও দিবালোকে তার স্বামীর গৃহে যায় না। কেননা, তাদের বিশ্বাস যে দিবালোকে স্বামীগৃহে গেলে দেশে তুর্ভিক্ষ হয়। এরূপ বিবাহের পর বিধবার বা তার ছেলেদের প্রথম স্বামীর সম্পত্তিতে কোন উত্তরাধিকার থাকে না। যেক্ষেত্রে এরূপ বিবাহ দেবরের সঙ্গে হয় সেক্ষেত্রে যদি প্রথম স্বামীর ছেলে থাকে তা হলে দ্বিতীয় স্বামীর ঔরসজাত সন্তান কখনও প্রথম স্বামীর সম্পত্তি পায় না। কিন্তু যদি প্রথম স্বামীর কোন ছেলে না থাকে তা হলে দ্বিতীয় স্বামীর ঔরসজাত সন্তানরাই প্রথম স্বামীর সম্পত্তির অধিকারী হয় ৷ ভীলদের মধ্যে বিধবা বিবাহও প্রচলিত আছে ; কিন্তু এদের মধ্যে হিন্দুসমাজ দ্বারা প্রভাবান্বিত উচ্চশ্রেণীর লোকেরা এর অনুমোদন করে না। বারওয়ানির পাতলি, রথিয়া ও তারভিজাতি সমূহের মধ্যেও বিধবা বিবাহ প্রচলিত আছে। নীলগিরির কুরুস্বরাও বিধবা বিবাহ অনুমোদন করে। ওড়িষ্যার পরোজাদের মধ্যে বিধবাকে বাধ্যতামূলকভাবে দেবরকে বিবাহ করতে হয় । বিধবা যেক্ষেত্রে দেবরকে বিবাহ করতে অস্বীকৃত হয় সেক্ষেত্রে বিধবা যাকে বিবাহ করবে তাকে পঞ্চায়েত কর্তৃক নির্দিষ্ট অর্থদণ্ড দেবরকে দিতে হয়। ত্রিবাস্কুরের মুড় বুনদের মধ্যেও বিধবা বিবাহ প্রচলিত আছে তবে এদের মধ্যে দেবর বা অন্য কোন স্বজনকে বিবাহ করা সম্বন্ধে কোন বাধ্যতামূলক নিয়ম নেই। কিন্তু ত্রিবাঙ্কুরের মান্নানদের মধ্যে এই নিয়ম প্রচলিত আছে। তাবার ত্রিবাঙ্কুরের কুরুস্ব পুলায়ানদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতারও অধিকার আছে কনিষ্ঠ ভ্রাতার বিধবাকে বিবাহ করবার। কিন্তু উল্লটনরা মাত্র দেবরকেই বিবাহ করার অনুমতি দেয়। আসামের গারোদের মধ্যে জামাতা কর্তৃক বিধবা শ্বাশুড়ীকে বিবাহ করার রীতি আছে। আসামের বাগনি, দাফল ও লাখেরদের মধ্যে পিতার মৃত্যুর পর বিধবা-বিমাতাকেই সস্তান স্ত্রীরূপে গ্রহণ করে। এ সমাজে পুরুষ সাধারণত অল্পবয়স্ক মেয়েকে বিবাহ করে, যাতে তার মৃত্যুর পর তার ছেলে কন্যাপণ এড়িয়ে বিমাতাকে স্ত্রীরূপে ব্যবহার করতে পারে। মধ্যপ্রদেশের ভানটুদের মধ্যে বিধবার যদি অনেকগুলি ছেলেমেয়ে থাকে তাহলে সে বিবাহ না করে অপর পুরুষের সঙ্গে যথেচ্ছা যৌনসঙ্গমে প্রবৃত্ত হতে পারে।