আজ বিকেলে খানিকক্ষণ বৃষ্টি হল।
বৃষ্টি নামার সঙ্গে সঙ্গে তাকালাম ক্যালেন্ডারের দিকে। কত তারিখ? দিন তারিখ সব এলোমেলো হয়ে গেছে। এ বাড়িতে কেউ বোধহয় আজকাল আর দিন-তারিখ দিয়ে মাথা ঘামায় না। বড় আপার মেয়ে দুটি পর্যন্ত চুপ। তারাও কোনো-না-কোনোভাবে জেনে গেছে–এ বাড়ির সবকিছু ঠিকমতো চলছে না। কোথাও ঝামেলা হয়েছে। শিশুদের বাড়তি একটি ইন্দ্ৰিয় থাকে। তারা অনেক কিছুই টের পায়। না বললেও বুঝতে পারে।
সন্ধ্যাবেলা আমি কী মনে করে যেন ছাদে গেলাম। বৃষ্টি হওয়ায় ছাদ ভিজে আছে। জায়গায় জায়গায় শ্যাওলা। পিচ্ছিল হয়ে গেছে। যে কোনো সময় পা হড়কে যাবার সম্ভাবনা। ছাদে রেলিং নেই। পা হাড়কালে আর রক্ষা নেই। এই সম্ভাবনা নিয়েও হেঁটে বেড়াতে ভালো লাগছে। অনেকদিন পর এ বাড়ির ছাদে উঠলাম। আমার মধ্যে তেমন কাব্যভাব নেই। ছাদ আমার ভালো লাগে না। তবে মা প্রায়ই আসেন বলে আমি জানি। এই অসুস্থ শরীরেও আসেন। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে আসেন।
আমি যে আজ ছাদে এসেছি তার কারণ একটিই–মার সঙ্গে নিরিবিলিতে কিছুক্ষণ কথা বলতে চাই। মা এখনো আসছেন না। হয়তো বেছ বেছে আজই তিনি আসবেন না। মার সঙ্গে নিরিবিলি কথা বলা কোনো সমস্যা নয়। তার ঘরে প্রায় সময়ই কেউ থাকে না। কিন্তু আমি অন্য ধরনের নিরিবিলি চাচ্ছিলাম।
সন্ধ্যা মিলিয়ে অন্ধকার হয়ে গেল। আকাশে মেঘ জমছে। আবার বৃষ্টি শুরু হবে।
আমি সিড়ি দিয়ে নামছি। তখনই মার সঙ্গে দেখা হল। তিনি আমাকে দেখে অসম্ভব চমকে উঠলেন। যেন ভূত দেখেছেন।
আমি বললাম, কেমন আছ, মা?
মা বললেন, ও তুই? চমকে উঠেছিলাম।
কী ভেবেছিলে, ভূত?
মা আর জবাব না দিয়ে বললেন, তুই কি প্রায়ই ছাদে আসিস?
না। আজ এসেছিলাম।
বৃষ্টি-বাদলার সময় আসবি না। পিছল ছাদ। একটা অঘটন ঘটতে কতক্ষণ?
তুমি তো প্রায়ই আস।
আমার কথা বাদ দে।
মা আমাকে পাশ কাটিয়ে উপরে উঠতে যাচ্ছেন। তখন হঠাৎ বললাম, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম।
কী কথা?
বাড়ির প্রসঙ্গে একটা কথা। বুনোভাই আমাকে বলেছেন। তিনি শুনেছেন বাবার কাছে। কথাটি সত্যি কিনা আমি জানতে চাই।
মা কিছু বলতেন না। আমাকে পাশ কাটিয়ে ছাদে উঠে গেলেন। আর তখন বৃষ্টি নামল। আমি দেখলাম, মা ছাদের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন। সাদা চাদর গায়ে দিয়ে এসেছিলেন। সেই চাদরে তিনি মাথা ঢেকে দিলেন।
আমি মার কাছে এগিয়ে গেলাম। কোমল গলায় বললাম, বৃষ্টিতে ভিজছ কেন মা? চল ঘরে যাই।
তুই যা।
মা গলার স্বর কঠিন এবং কান্না-ভেজা। আমি চলে এলাম। বুনোভাইয়ের ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখি–বুনোভাইয়ের খাটে বাবা জবুথুবু হয়ে বসে আছেন। বাবার পিঠে হাত রেখে বুনোভাইও বসে আছেন। আমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখ বললাম, কেমন আছ বাবা?
তিনি অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, জ্বি, ভালো আছি। আপনার শরীর ভালো?
বাবা আমাকে চিনতে পারেন নি। ইদানীং কাউকেই প্ৰথম দর্শনে বাবা চিনতে পারেন না।
আমি বললাম, এখানে কী করছ, বাবা?
ও আচ্ছা, তুই! রঞ্জ। অন্ধকারে চিনতে পারি নি। বাইরে কি বৃষ্টি হচ্ছে?
হুঁ।
ভালো, ভালো। বৃষ্টি হওয়া ভালো।
এখানে কী করছেন?
বুনোর সঙ্গে গল্প করছি। আয়, তুইও আয়।
আমি বাবার পাশে বসলাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে অল্প হাসলেন। সেই হাসিতে স্নেহ ছিল, প্রশ্রয় ছিল। বাবা নরম স্বরে বললেন, রঞ্জু, বাড়িটা নিয়ে সমস্যায় পড়েছি।
সমস্যার কী আছে, বাবা?
আছে, সমস্যা আছে। জটিল সমস্যা। তুই ছেলেমানুষ, সমস্যা বুঝবি না। জানালা দিয়ে দেখ তো বৃষ্টি এখনো হচ্ছে কিনা।
জানালা দিয়ে দেখার কিছু নেই। বুম বৃষ্টি হচ্ছে। মা কি এখনো ছাদে দাড়িয়ে ভিজছেন?