০৬. আগলি ডাকলিং

০৬. আগলি ডাকলিং

রাত ১টা ২২ মিনিট।
হিমালয়।

মাঝরাত পার হয়ে গেছে, প্রাকৃতিকভাবে গরম হওয়া মিনারেল পানিতে গোসল করছে লিসা। ও চাইলে চোখ বন্ধ করে নিজেকে ইউরোপের কোনো একটি বিলাস বহুল স্পা তে আছে বলে কল্পনা করতে পারে। রুমের সরঞ্জামাদি চটকদার। পুরু ইজিপশিয়ান কটন তোয়ালে ও আলখাল্লা, চার জনের জন্য থাকা বিশাল খাট, তাতে কম্বল রাখা আর বিছানা তুলতুলে নরম। দেয়াল থেকে ঝুলছে মধ্যযুগীয় চিত্রকলা, পাথুরে মেঝের ওপর। পায়ের নিচে বিছানো আছে তুর্কী গালিচা।

পেইন্টার আছে বাইরের রুমে। ওদের ছোট ফায়ারপ্লেসে কাঠ দিচ্ছে।

 ছোট্ট একটি প্রিজন সেলে (জেলখানার কামরা) আছে ওরা।

পেইন্টার অ্যানা পোরেনবার্গকে বলেছিল, ওরা দুজনে একটু পূর্ব পরিচিত। মিথ্যে কথা। আসলে দুজন যেন একসাথে থাকতে পারে তাই চালাকি করে কথাটা বলেছে।

লিসাও আপত্তি করেনি।

ও এখানে একা থাকতে চায় না।

এখানকার পানির তাপমাত্রা অস্বস্তিকর গরমের চেয়ে কয়েক ডিগ্রি কম। গরম পানির কারণে লিসার শরীর কেঁপে উঠল। নিজে ডাক্তার হওয়ায় লিসা ওর শরীরের শক পাওয়া চিহ্নগুলো বুঝতে পারল। আর একটু হলেই ওখানে জার্মান মহিলাটির সাথে ওর হাতাহাতি লেগে যেত। ওর এই আচরণের কারণে পেইন্টারসহ ওকেও হয়তো মরতে হতো গুলি খেয়ে।

পেইন্টার বরাবরই শান্ত-শিষ্ট। এমনকি এখনও ও শুনতে পাচ্ছে, ধীরচিত্তে ফায়ারপ্লেসে কাঠ দিয়ে যাচ্ছে পেইন্টার। সুন্দর সাবলীলভাবে আছে সে। তবে ও নিশ্চয়ই একদম খালি হয়ে গেছে। একটু আগে গোসল সেরেছে পেইন্টার। না পরিষ্কার হওয়ার জন্য নয় বরং ফ্রস্টবাইট থেকে বাঁচার জন্য ওকে গোসল করতে হয়েছে। ওর কানের লতিতে সাদা সাদা দাগ দেখে লিসা-ই ওকে আগে গোসল করতে পাঠিয়েছিল।

গরম কাপড়ে বেশ ভাল অবস্থাতেই ছিল লিসা।

এই মুহূর্তে লিসা নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বাথটাবে ডুবিয়ে রেখেছে। পানির নিচে ওর মাথা, চুলগুলো আলগোছে পানিতে ভাসছে। পানির তাপমাত্রা ওর শরীরের প্রত্যেকটি কোষে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল। বিস্তৃত হলো ওর অনুভূতি। এখন ওকে শুধু একটি কাজ করতে হবে-~~-পানির নিচে নিঃশ্বাস নিতে হবে। ব্যস, তাহলেই সব শেষ। কয়েক মুহূর্ত ছটফট করে সবকিছু চিরতরে শেষ হয়ে যাবে। এত ভয়, দুশ্চিন্তা সব। নিজের ভাগ্যকে নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে লিসা… ওকে যারা বন্দি করে রেখেছে এভাবে তাদের কাছ থেকে নিজের মুক্তি আদায় করে নিতে পারবে।

দরকার শুধু একবার নিঃশ্বাস নেয়া…

তোমার গোসল কী প্রায় শেষ? পানির ভেতরে কথাগুলো শুনতে পেল ও, মনে হলো শব্দগুলো অনেক দূর থেকে আসছে। ওরা আমাদের জন্য গভীর রাতের খাবার এনে দিয়েছে।

 পানির নিচ থেকে উঠল লিসা, ওর চুল, মুখ বেয়ে পানি চোয়াচ্ছে। আর এক মিনিট।

ঠিক আছে, তাড়াহুড়ো নেই, সময় নাও। মেইন রুম থেকে বলল পেইন্টার।

 লিসা শুনতে পেল পেইন্টার আরেকটি কাঠ আগুনের ভেতরে দিয়ে দিল।

 পেইন্টার এখন নড়ছে কীভাবে? বিছানায় পড়ে ছিল তিন দিন, ভূগর্ভস্থ সেলারের হাতাহাতি, বরফের ভেতর দিয়ে এপর্যন্ত আসা… তারপরও ওর ভেতরে কোনো ক্লান্তি নেই। ব্যাপারটা লিসার মনে আশা যোগাল। হয়তো এটা স্রেফ বেপরোয়া ভাব তবে ও ঠিকই পেইন্টারের ভেতরে একটি মজবুত শক্তির ছাপ দেখতে পেল, যেটা শারীরিক শক্তির চেয়ে বেশি কিছু।

ওর কথা ভাবতে ভাবতে লিসার কাঁপুনি কমে এলো।

বাথটাব থেকে উঠে দাঁড়াল ও, গায়ে পানি ঢেলে ভোয়ালে জড়িয়ে নিল। হুক থেকে একটি পুরু আলখাল্লা ঝুলছিল, কিন্তু আপাতত ওটা নিল না ও। পুরোনো বেসিনের পাশে মেঝের দৈর্ঘ্য বরাবর আয়না আছে, আয়নার তল একটু ঘোলা হয়ে গেলেও ওর নগ্ন শরীর ঠিকই দেখা যাচ্ছে ওতে। পা নড়াল ও। আত্মঅনুভূতি কিংবা তৃপ্তির জন্য নয়, কোথায় কোথায় আঁচড় লেগেছে সেটা দেখল। ওর জরায়ুর ভেতরে একটু গভীর ব্যথা ওকে জরুরি কিছু একটা মনে করিয়ে দিল।

ও এখনও বেঁচে আছে।

 টাবের দিকে তাকাল।

ও ওদেরকে তৃপ্তি পেতে দেবে না। ব্যাপারটার মোকাবেলা করবে।

আলখাল্লা গায়ে চড়িয়ে নিল। কোমড়ের অংশে ফিতে টাইট করে বাঁধার পর বাথরুমের ভারী ছিটকানি খুলে বাইরে বেরোল। পাশের রুম আরও বেশি গরম। গরম বাস্প রুমকে উষ্ণ করে রেখেছে। তবে ফায়ারপ্লেসে আগুন দেয়ায় আরও সুন্দর হয়েছে রুমের তাপমাত্রা। ফায়ারপ্লেসে ঘোট ঘোট আগুনের শিখা লাফাচ্ছে, পট পট শব্দ হচ্ছে, রুমে একধরনের উজ্জ্বলতা এনে দিয়েছে ওটা। বিছানার পাশে থাকা কয়েকটি মোমবাতি এই প্রিজন সেলারে একধরনের ঘরোয়া পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। যোগ হয়েছে। বাড়তি আলো।

এই রুমে কোনো কারেন্ট নেই।

এখানে ওদের পুরে রাখার সময় অ্যানা পোরেনবার্গ বেশ গর্বের সাথে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছিল কীভাবে এখানে ১০০ বছর পুরোনো রুডলফ ডিজেলের তৈরি জেনারেটর থেকে তাপমাত্রার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। রুডলফ ডিজেল একজন ফরাসী বিজ্ঞানী ছিলেন, ডিজেল ইঞ্জিনের আবিষ্কারকর্তা তিনিই। তবে এখানে বিদ্যুৎ অপচয় করা হয় না। ক্যাসলের শুধু নির্দিষ্ট কিছু অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা আছে।

এখানে নেই।

রুমে লিসা ঢুকতেই পেইন্টার ওর দিকে ফিরল। লিসা খেয়াল করল পেইন্টারের চুলগুলো শুকিয়ে এলোমেলো হয়ে গেছে। একটু লম্পট ছোকরার মতো লাগছে ওকে। পা নগ্ন আর গায়ে একটি আলখাল্লা পরে আছে পেইন্টার। দুটো পাথরের মগে করে ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে এলো।

 জেসমিন চা, লিসাকে ফায়ারপ্লেসের সামনে থাকা একটি ছোট সোফায় বসার ইঙ্গিত করল ও।

নিচু টেবিলে কিছু খাবার রাখা আছে। শক্ত পনির, পাউরুটি, রোস্ট করা গরুর মাংস, সরিষা ও এক বাটি ব্ল্যাকবেরি। সাথে ঘোট এক বাটি ক্রিম।

আমাদের জীবনের শেষ খাওয়া? একটু হালকাভাবে কথাটা বলতে চেয়েছিল লিসা কিন্তু পারল না, ভারী-ই হয়ে গেল। সকাল হতেই ওদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হবে।

পাশে থাকা জায়গায় বসল পেইন্টার।

 লিসাও বসল।

পেইন্টার পাউরুটি কাটছে, এই ফাঁকে এক খণ্ড পনির তুলে নিল লিসা। নাক কুঁচকে আবার রেখে দিল। ক্ষিধে নেই।

খাওয়া উচিত। বলল পেইন্টার।

 কেন খাব? যাতে ওরা যখন আমাকে ড্রাগ দেবে তখন শক্ত হয়ে থাকতে পারি?

এক টুকরো মাংস মুড়িয়ে মুখে পুরল ক্রো। ওটা চিবুতে চিবুতে বলল, কোনো কিছুই নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে হ্যাঁ, আমি যদি জীবনে কিছু শিখে থাকি অন্তত এটা শিখেছি।

লিসা পটেনি। মাথা নাড়ল। তাহলে তুমি কী বলছ? ভাল কিছু হবে এই আশায় বসে থাকবে?

ব্যক্তিগতভাবে আমার প্ল্যান পছন্দ।

 ওর দিকে তাকাল লিসা। কোনো প্ল্যান আছে তোমার?

সাদা-সিধে একটা আছে। গোলাগুলি করে, বোমা-টোমা মেরে হুলস্থুল কারবার করব না। একদম সহজ।

কী সেটা?

 মাংসটুকু গিলে লিসার দিকে ফিরল পেইন্টার ক্রো। আমি এমন একটা জিনিস খুঁজে পেয়েছি যেটা অনেক সময় যোগাতে কাজে দেয়।

উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে আবার প্রশ্ন করল লিসা। কী?

সততা।

১৪৫

লিসা কাঁধ ঝুলিয়ে ধপ করে পেছনে হেলান দিল। দারুণ।

একটি পাউরুটির টুকরো তুলে ওতে একটু সরষে, এক খণ্ড মাংস আর পনির দিয়ে লিসার দিকে এগিয়ে ধরল ক্রো। খাও।

শুধু ক্রোকে খুশি করার জন্য শ্বাস ফেলে লিসা খাবার হাতে নিল।

একই জিনিস নিজের জন্যেও বানাল ক্রো। ধরো, আমি তো ডারপার অধীনে থাকা সিগমা ডিভিশনের ডিরেক্টর। আমেরিকার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে এরকম বিষয় নিয়ে আমরা গবেষণা করি। সাবেক স্পেশাল ফোর্সের সৈন্যরা আমাদের হয়ে কাজ করে। ডারপার সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষেত্র হলো সিগমা ফোর্স যেটা সরোজমিনে কাজ করে থাকে।

পাউরুটির এক প্রান্তে একটু কামড় দিয়ে একটু সরষে মুখে পুরল লিসা। তো আমরা কী সেই সৈন্যদের দ্বারা উদ্ধার হওয়ার কোনো আশা করতে পারি?

নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আমাদের হাতে যতটুকু সময় আছে এতে হবে না। আমার লাশ যে ওই মঠের ধ্বংসস্তূপের ভেতরে নেই সেটা ওদের বের করতে কয়েকদিন লেগে যাবে।

তাহলে আমি তো কোনো আশা দেখতে পা…।

হাত উঁচু করল ক্রো। পাউরুটি মুখে নিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল, সততাই সব। খোলামেলাভাবে সৎ হতে হবে। তারপর দেখা যাক, কী হয়। এখানকার অদ্ভুত ঘটনাগুলোর ওপর সিগমার নজরে পড়েছে। অসুখের খবরটা ওখানে পৌঁছে গেছে অনেক আগেই। পাহাড়ের ভেতরে এতগুলো বছর ধরে সবকিছু গোপনে চলতে চলতে হঠাৎ গত কয়েকমাস ধরে এসব গড়বড় কেন শুরু হলো? আমি এই ঘটনাগুলোকে কাকতালীয় মানতে রাজি নই। অ্যানা সেই সৈন্যকে কী বলছিল সেটা আমি শুনেছি। কোনো একটা সমস্যার কথা বলছিল অ্যানা। সমস্যাটা ওদের ভোগাচ্ছে। আমার মনে হয়, আমাদের দুই পক্ষের লক্ষ্য এক ও অভিন্নই হবে। তাতে আমরা একে অপরকে সাহায্য করতে পারব।

সেই সাথে আমাদেরকে যদি বাঁচতে দেয়? একটু অবহেলা করে বলল লিসা, যদিও মনে মনে আশা ছাড়েনি। নিজের বোকামি ঢাকার জন্য একটু পাউরুটি মুখে পুরল।

 তা বলতে পারছি না, সত্তাবে বলল ক্রো। আমরা যতক্ষণ আমাদেরকে উপকারী ও কার্যকরী হিসেবে প্রমাণ করতে পারব ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের হাতে সময় থাকবে। যদি কয়েকটা দিন বাড়িয়ে নিতে পারি… তাহলে সেটা আমাদের উদ্ধার কিংবা এখানকার পরিস্থিতি বদলে দেয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেবে।

গভীর চিন্তা করতে করতে খাবার চিবুচ্ছে লিসা। ও টেরই পেল না ওর হাত ফাঁকা হয়ে গেছে। অথচ ওর ক্ষিধে শেষ হয়নি। ব্ল্যাকবেরির ওপরে ক্রিম ঢেলে দিয়ে ওরা দুজনে ভাগাভাগি করে খেলো।

পেইন্টারের দিকে নতুন দৃষ্টিতে তাকাল লিসা। এই ব্যক্তির অদম্য জেদ। ওই নীল চোখগুলোর পেছনে বুদ্ধির ঝিলিক আর সাধারণ জ্ঞানে ভরপুর। লিসার নিরীক্ষা বুঝতে পেরেই হয়তো পেইন্টার ওর দিকে তাকাল। চট করে দৃষ্টি ঘুরিয়ে খাবারের ওপর বসাল লিসা।

চুপচাপ খাবার শেষ করে ওরা চায়ে চুমুক দিল। পেটে খাবার পরার পর পরম প্রশান্তি ওদের ওপর ভর করল। কথা বলতেও ইচ্ছে হলো না ওদের। পেইন্টারের পাশে চুপচাপ বসে থাকতেই লিসার ভাল লাগছে। ক্রোর শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পেল ও। সদ্য গোসল করে আসা একটু ভেজা ত্বকের ঘ্রাণও পাচ্ছে।

চা শেষ করে লিসা খেয়াল করল ক্রো কপালের এক অংশ ডলছে, বাঁকা হয়ে গেছে এক চোখ। ওর মাথাব্যথা আবার বাড়তে শুরু করেছে। ডাক্তারি করে ক্রোকে দুশ্চিন্তায় ফেলতে চায় না লিসা। চুপচাপ ওর আচরণ খেয়াল করল। কেঁপে উঠল আরেক হাতের আঙুলগুলো। প্রায় নিভে আসা আগুনের দিকে ও চোখ মেলতেই দেখা গেল ওর চোখের পাতা একটু একটু কাঁপছে।

পেইন্টার সতোর ব্যাপারে কথা বলল। কিন্তু সে কি নিজের অবস্থার ব্যাপারে সঠিক তথ্যটুকু জানতে চায়? মাথাব্যথা তো দেখা যাচ্ছে বেশ ঘনঘন ফিরে আসছে। লিসার ভেতরের একটি অংশ স্বার্থপরের মতো ভয় পেল। না, ক্রোর স্বাস্থ্যের কথা ভেবে নয়, ক্রোর কিছু হয়ে গেলে বাঁচার যে ক্ষীণ আশাটুকু আছে ওটা নিভে যাবে, সেই কারণে। ক্রোকে ওর প্রয়োজন।

উঠল লিসা। আমাদের একটু ঘুমিয়ে নেয়া উচিত। ভোর হতে খুব বেশি দেরি নেই।

 একটু গোঙাল পেইন্টার, মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল। একটু টলমল করে উঠতেই ওর কনুই ধরল লিসা।

আমি ঠিক আছি। বলল পেইন্টার।

এই হচ্ছে সতোর নমুনা।

 লিসা ওকে বিছানা পর্যন্ত নিয়ে কম্বল ঠিক করে দিল।

আমি সোফায় ঘুমিয়ে নেব। বাধা দিয়ে বলল ক্রো।

ঢং বাদ দাও। বিছানায় ওঠো। এখন এসব করতে হবে না। আমরা নাৎসিদের খপ্পরে আছি।

সাবেক নাৎসি।

হ্যাঁ, ওটা খুবই খুশির সংবাদ।

অগত্যা বিছানায় উঠল ক্রো। বিছানার পাশ ঘুরে গিয়ে লিসাও উঠল। নিভিয়ে দিল মোমবাতিগুলো। অন্ধকার হয়ে গেলেও ফায়ারপ্লেসের নিভু নিভু আলো রুমকে একটু আসোময় করে রাখল। লিসা এই যাবতীয় অন্ধকার একা সামাল দিতে পারত কিনা সে-ব্যাপারে ওর নিজেরই সন্দেহ আছে।

কম্বলের নিচে ঢুকে ওটাকে থুতনি পর্যন্ত টেনে নিল লিসা। দুজনের মাঝখানে একটু জায়গা ফাঁকা রেখেছে ও। পেইন্টার ওর দিকে পিছ দিয়ে আছে। ক্রো হয়তো ওর ভয় অনুভব করতে পেরে এদিক ঘুরল।

যদি আমরা মারা যাই, বিড়বিড় করল ক্রো, তাহলে আমরা একসাথে মরব।

 লিসা ঢোঁক গিলল। পেইন্টারের কাছ থেকে এরকম কিছু শুনবে বলে মোটেও আশা করেনি। তবে একটু ভড়কে গেলেও অদ্ভুত স্বস্তি পেল। কথা বলার ভেতরে একধরনের সুর ছিল, ওতে থাকা সততা, প্রতিজ্ঞা লিসাকে মুগ্ধ করল। নিজেদের বাঁচানোর জন্য বলা দুর্বল যুক্তিগুলোর চেয়ে এই কথাটি মন ছুঁয়ে গেল লিসার।

পেইন্টারকে বিশ্বাস করল ও।

একটু কাছাকাছি এসে ক্রোর হাত ধরল। একে অপরকে জড়িয়ে ধরল দুজনের। আঙুলগুলো। কোনো যৌনতা নয়, স্রেফ দুজন মানুষের ছোঁয়া। পেইন্টারের এক হাত নিজের শরীরের ওপর টেনে নিল লিসা।

ক্রো লিসার হাতে চাপ দিয়ে ভরসা দেয়ার চেষ্টা করল।

ওর আরও কাছে চলে গেল লিসা। ক্রো ওকে ভাল করে জড়িয়ে ধরার জন্য আরও একটু এদিকে ঘুরল।

চোখ বুজল লিসা। ঘুমানোর কোনো আশা নেই।

কিন্তু ক্রোর বাহুডোরে ও ঠিকই ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল।

.

রাত ১০টা ৩৯ মিনিট।
কোপেনহ্যাগেন, ডেনমার্ক।

ঘড়ি দেখল গ্রে।

দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ওরা গা ঢাকা দিয়ে আছে। মাইন নামের রাইডের একটি সার্ভিস শ্যাফটের ভেতরে লুকিয়ে আছে ওরা। একধরনের ভূগর্ভস্থ খনির ভেতর দিয়ে এই আদিকালের রাইড ঘুরে বেড়ায়। আশেপাশে বিভিন্ন কার্টুনের মজাদার অবয়ব থাকে। একই মিউজিক বারবার বাজতে বাজতে রাইড এগিয়ে চলে। এই মিউজিক কানের জন্য বেশ বেদনাদায়ক, অনেকটা চীনা ওয়াটার টর্চারের কাছাকাছি।

 টিভোলি গার্ডেনসের লোকজনের ভেতরে ঢুকেই গ্রে আর ফিওনা পুরোনো এই রাইডে চড়ে বাবা-মেয়ে সেজেছে। কিন্তু প্রথম বাক আসামাত্র রাইডের কার থেকে নেমে বিদ্যুৎসংযোজক বিপজ্জনক চিহ্ন দেয়া একটি সার্ভিস দরজার পেছনে চলে গেল। রাইড শেষ না করেই গ্রে কল্পনা করল রাইডের শেষ অংশে কী থাকতে পারে : ফুসফুসের রোগে ভুগে হাসপাতালের বেডে শুইয়ে আছে কার্টুনগুলো।

ভাবল গ্রে।

ডাচ ভাষায় সেই একঘেঁয়ে মিউজিক হাজারবার পুনরাবৃত্তি করে বেজেই চলেছে। ডিজনিল্যান্ডের ইটস-অ্যা-স্মল-ওয়াল্ড রাইডের মিউজিকের মতো অত খারাপ না। হলেও কাছাকাছি আরকী।

 ভেতরে ঢুকে ডারউইন বাইবেলটিকে নিজের কোলের ওপর খুলল গ্রে। পেনলাইট জ্বেলে এক এক করে পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছে ও, যদি কোনো কু পাওয়া যায়। মিউজিকের শব্দে ওর মাথা দপদপ করছে।

 তোমার কাছে অস্ত্র আছে? এক কোণায় গুটিসুটি মেরে জিজ্ঞেস করল ফিওনা। থাকলে আমাকে এখনি গুলি করে দাও।

শ্বাস ফেলল গ্রে। আমাদের হাতে মাত্র ১ ঘণ্টা সময় আছে।

আমি পারব না। আমার দ্বারা হবে না।

প্ল্যান হলো, পার্ক বন্ধ হওয়া পর্যন্ত ওরা অপেক্ষা করবে। এই পার্ক থেকে বের হওয়ার জন্য অফিসিয়াল গেইট আছে মাত্র একটি। তবে গ্রে জানে পার্কের সব গেইটেই এখন নজরদারি করা হচ্ছে। গভীর রাতে যখন পার্কের ময়লা সরাতে গাড়ি আসবে শুধু তখনই পালানো সম্ভব। মনক কোপেনহ্যাগেন এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছেছে কি-না সেটা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করল গ্রে কিন্তু লোহা আর তামার এই পুরোনো স্থাপনা ওর ফোনের নেটওয়ার্কের দফারফা করে দিয়েছে। ওদেরকে এয়ারপোর্ট যেতে হবে।

বাইবেল থেকে কিছু জানতে পারলে? ফিওনা জানতে চাইল।

মাথা নাড়ল গ্রে। ডারউইন পরিবারের বংশক্রম সুন্দর করে একদম সামনের কভারে দেয়া আছে। দারুণ লাগছে দেখতে। কিন্তু তারপর অনেক পৃষ্ঠা উল্টে যাওয়ার পরও ওগুলো থেকে তেমন কোনো কু পাওয়া গেল না। যা পেল সবই হিজিবিজি রেখা। একই চিহ্ন বারবার এদিক ওদিক করে ব্যবহার করা হয়েছে।

চিহ্নগুলোকে নিজের নোটপ্যাডে টুকে নিল গ্রে। বাইবেলের মার্জিন অংশে ওগুলো লেখা আছে। হয়তো ওগুলো চার্লস ডারউইন নিজে লিখে গেছেন কিংবা পরবর্তীতে কেউ লিখেছে। কিন্তু কে লিখেছে সেটা তো আর গ্রে জানে না।

ঘে ফিওনাকে নোটপ্যাড দেখাল।

পরিচিত মনে হচ্ছে?

 সামনে বুকল ফিওনা। চিহ্নগুলোকে ভালভাবে দেখল।

ҚА УКУТ Күн

পাখির আঁচড়, বলল ও। এরজন্য খুনোখুনি কেন হলো বুঝলাম না।

গ্রে নিজের চোখ চালু রাখলেও মুখ বন্ধ রাখল। ফিওনার মুড অফ হয়ে গেছে। ওর সেই প্রতিহিংসাপরায়ণ, রাগী স্বভাবটাই বরং ভাল ছিল। এখানে ঢোকার পর থেকে মেয়েটির মন-মেজাজ অন্যরকম হয়ে গেছে। গ্রে সন্দেহ করল, এই মেয়ের যাবতীয় ঘৃণা, রাগ, জেদ ছিল বাইবেলটিকে হাত করা পর্যন্ত। ওর নানুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়া, এইটুকুই। আর এখন এই অন্ধকারে ফিওনার মনের আসল অবস্থা দেখা যাচ্ছে।

গ্রের কী করার আছে?

কাগজ, কলম তুলে নিয়ে বেচারির মনোযোগ এদিকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করল ও। আরেকটি চিহ্ন আঁকল ও। নিলামে অংশ নেয়া সেই পুরুষ লোকটির হাতে থাকা ট্যাটু।

ও দিকে এগিয়ে দিল গ্রে। এটা পরিচিত মনে হয়?

আগের চেয়েও নাটকীয় ভঙ্গিতে সামনে ঝুঁকল ফিওনা। মাথা নাড়ল। চার পাতা। না, জানি না। কী হতে পারে…. দাঁড়াও… নোটপ্যাড হাতে তুলে নিয়ে আরও কাছ থেকে দেখল। বড় বড় হয়ে গেল ওর চোখজোড়া। এর আগে আমি এটা দেখেছি!

কোথায়?

একটা বিজনেস কার্ডে, বলল ফিওনা। ওটা অবশ্য এরকম ভরাট করা ছিল না। স্রেফ আউটলাইন আঁকা ছিল। গ্রের হাত থেকে কলম নিয়ে আঁকতে শুরু করল ও।

কার বিজনেস কার্ড?

ওই যে দুই মাস আগে এক বজ্জাত এসে আমাদের বিভিন্ন রেকর্ড ঘাঁটাঘাঁটি করে গিয়েছিল তার কার্ডে দেখেছিলাম। ব্যাটা আমাদেরকে ভুয়া ক্রেডিট কার্ড দিয়েছিল। ফিওনা আঁকছে। তুমি এই জিনিস কোথায় দেখলে?

 যে লোক বাইবেলের নিলামে জিতেছিল, তার হাতে দেখেছি।

গর্জে উঠল ফিওনা। আমি জানতাম! তাহলে এই সবকিছুর পেছনে এক হারামি কলকাঠি নেড়ে আসছে। প্রথমে চুরি করার চেষ্টা করেছিল। তারপর নিজের কৃতি আড়াল করার জন্য মাটিকে খুন করে দোকান পুড়িয়ে ছাই করে দিল।

বিজনেস কার্ডের নাম মনে আছে? প্রশ্ন করল গ্রে।

ফিওনা মাথা নাড়ল। শুধু চিহ্ন-ই মনে আছে। কারণ এটা আমার পরিচিত।

এতক্ষণ ধরে আঁকা ছবিটি গ্রের দিকে এগিয়ে দিল ও। ট্যাটুর চেয়ে আরও বিস্তারিত রেখার মাধ্যমে আঁকা হয়েছে এখানে। কোথায় কোথায় কীভাবে মোচড় খেয়েছে সেটা। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

৯ বি?

পৃষ্ঠায় টোকা দিল এ। তুমি এটা চিনতে পেরেছ? তোমার পরিচিত?

মাথা নাড়ল ফিওনা। আমি পিন সংগ্রহ করি। যদিও এই পোশাকের সাথে পরতে পারিনি।

হুডঅলা জ্যাকেটের কথা মনে পড়ল গ্রের। তখন মেয়েটিকে চোখে পড়েছিল। প্রতিটি বোতামে বিভিন্ন সাইজের এটা সেটা লাগানো ছিল তখন।

কেলটেক, বলল ফিওনা। আমি এই শুধু এই ব্যান্ডের গান-ই শুনি। আমার অধিকাংশ পিন কেলটেক ডিজাইনের।

 আর এই চিহ্ন?

এটাকে আর্থ স্কয়ার কিংবা সেইন্ট হেন্স ক্রস বলা হয়ে থাকে। এটা একধরনের রক্ষাকবচ। পৃথিবীর চার কোণা থেকে শক্তি আনে, এই আরকী। ফিওনা চার পাতার বৃত্তগুলোতে টোকা দিল। সেজন্য এগুলোকে রক্ষাকারী বাঁধনও বলা হয়। ব্যক্তিকে রক্ষা করে।

গ্রে বেশ মন দিয়ে শুনলেও প্রয়োজনীয় কোনো ক্লু পেল না।

এজন্যই আমি মাঠিকে বলেছিলাম ওই বজ্জাতকে যেন বিশ্বাস করে, ফিওনা বলল। একটু পেছনে হেলল ও। একদম খাদে নামিয়ে ফেলল গলা। যেন কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। নানু লোকটাকে প্রথমে পছন্দ করছিল না। কিন্তু আমি যখন তার কার্ডে ওই চিহ্ন দেখলাম, ভাবলাম লোকটা ভালই হবে।

তুমি তো আর জানতে না।

মাট্টি জানতো, চট করে বলল ফিওনা। আমার জন্যই ও মারা গেছে। ওর শব্দগুলোতে অপরাধবোধ আর যন্ত্রণা ফুটে উঠল।

 বাজে কথা। ফিওনার কাছে গিয়ে এক হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল গ্রে। এরা যে-ই হোক না কেন প্রথম থেকে কাছা দিয়েই মাঠে নেমেছিল। তুমিও তো জানোনা। তোমাদের দোকানে ঢুকে তথ্য বের করার কোনো না কোনো রাস্তা ওরা বের করে ফেলতই। রেকর্ড দেখানোর ব্যাপারটায় নানুকে যদি তুমি না রাজি করাতে তাহলে হয়তো তোমাদের দুজনকে ওরা তখুনি মেরে ফেলত।

ওর দিকে ঝুঁকল ফিওনা।

তোমার নানু…

ও আমার নানু ছিল না, ফিওনা ফাপা কণ্ঠে বাধা দিল।

এটা আগেই বুঝতে পেরেছিল গ্রে, তবে কিছু বলল না। ফিওনাকে বলতে দিল।

আমি ওঁর দোকান থেকে কিছু জিনিস চুরি করছিলাম তখন ওঁর হাতে ধরা পড়ি। কিন্তু নানু পুলিশকে খবর না দিয়ে উল্টো আমাকে স্যুপ খেতে দিল। চিকেন বার্লি।

কথাটা বলতে গিয়ে হেসে ফেলল ফিওনা। অন্ধকারে ওর দিকে না তাকিয়েও গ্রে সেটা বুঝতে পারল।

ও ওইরকম-ই। পথশিশুদের সাহায্য করত। আশ্রয় দিত।

 বার্টেল।

সাথে আমাকেও। বলে অনেকক্ষণ চুপ মেরে রইল ও। একটি গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে আমার বাবা-মা মারা গিয়েছিল। পাকিস্তানি ছিল তারা। পাঞ্জাবি। লন্ডনের ওয়ালম ফরেস্টে আমাদের একটা ছোট বাড়ি ছিল, বাগান ছিল। আমরা একটা কুকুর পোষার কথা ভাবছিলাম। কিছু ওরা… ওরা মরে গেল।

আমি দুঃখিত, ফিওনা।

 খালা-খালু আমার দায়িত্ব নিল… ওরা অল্পকিছু দিন হলো পাঞ্জাব থেকে এখানে শিফট হয়েছিল। আবার নীরবতা। এক মাস পর থেকে খালু আমার কাছে আসতে শুরু করল, রাতে।

চোখ বন্ধ করল গ্রে। হায় খোদা…

তাই আমি পালালাম… প্রায় দুই বছর লন্ডনের রাস্তাঘাটে জীবন কাটিয়েছি। তারপর খারাপ মানুষদের খপ্পরে পড়ে আবার পালালাম। ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে এলাম ইউরোপে। তারপর তো এই যে, এখানে।

গ্রিট্টি তোমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন।

হ্যাঁ, সে-ও নেই। কণ্ঠে অপরাধবোধের শ্লেষ। আমি হয়তো পোড়া কপালি।

ফিওনাকে আরও কাছে টেনে নিল গ্রে। আমি দেখেছি তিনি তোমার খেয়াল কীভাবে রাখতেন। তুমি তার জীবনে খারাপ কিছু আনননি। তোমাকে তো তিনি ভালবাসতেন।

আ… আমি জানি। অন্যদিকে মুখ ঘোরাল ফিওনা। ফোঁপাতেই ওর কাঁধ কেঁপে উঠল।

ওকে ধরে রইল গ্রে। আস্তে করে ঘুরে গ্রের কাঁধে ফিওনা মাথা রাখল। এবার গ্রের অপরাধবোধে ভোগার পালা। গ্রিট্টি একজন দারুণ মহিলা ছিলেন। শিশুদের ভালবাসতে, মনে দয়া-মায়া ছিল। অথচ আজ তিনি বেঁচে নেই। এই ব্যাপারে গ্রে নিজেই শাস্তিযোগ্য। যদি ও আরও সতর্কতা অবলম্বন করত… এত বেপরোয়াভাবে তদন্ত না চালাতে…

ওর খামখেয়ালিপনার কারণেই আজ এই অবস্থা।

ফিওনা ফুঁপিয়ে চলেছে। যদিও এই খুনোখুনি আর আগুন লাগার বিষয় দুটো গ্রের তদন্ত শুরু করার আগেই পরিকল্পনা করে রাখা হয়েছিল তারপরও কথা থেকে যায়। আগুন লাগার পর ঘটনাস্থলে ফিওনাকে একা ফেলে চলে গিয়েছিল গ্রে। ওর মনে পড়ল, মেয়েটি প্রথমে… রাগ করে ডাকলেও পরে অনুনয় করেছিল।

কিন্তু গ্রে পাত্তা দেয়নি।

আমার আর এখন কেউ নেই, গ্রের স্যুটে মাথা রেখে আস্তে আস্তে কাঁদছে ফিওনা।

আমি আছি তো।

 ভেজা চোখে মুখ তুলল ও। কিন্তু তুমিও তো চলে যাচ্ছো।

 হুঁ, তুমিও আমার সাথে যাচ্ছ।

কিন্তু তুমি তো বলেছিলে…

যা বলেছিলাম ভুলে যাও। গ্রে জানে এই মেয়ে আর এখানে নিরাপদ নয়। একেও পরপারে পাঠিয়ে দেয়া হবে। বাইবেল পাক বা না পাক মেয়েটিকে চিরতরে চুপ করিয়ে ওরা দেবেই। এই মেয়ে অনেক বেশি জানে। যেমন… তুমি বলেছিলে বাইবেলের বিলে থাকা ঠিকানাটা জানোবা।

সন্দেহ নিয়ে গ্রের দিকে তাকাল ও। ফোঁপানো বন্ধ হয়ে গেছে। বিবেচনা করে দেখছে ওর প্রতি গ্রের সহানুভূতি কী এই তথ্যের জন্য জেগেছে নাকি অন্য কিছু। গ্রে ও ফিওনার মনের ভেতরে চলা চিন্তা অনুভব করতে পারল, পথশিশুদের চিন্তাধারা এরকমই হয়।

তবে গ্রে পরিস্থিতিকে খুব ভালভাবে পরিচালনা করতে জানে। প্রাইভেট জেটে করে আমার এক বন্ধু আজ মাঝরাতে এখানে আসছে। আমরা ওর সাথে যোগ দিয়ে যে-কোনো জায়গায় চলে যেতে পারি। আমরা জেট প্লেনে ওঠার পর তুমি ঠিকানা বোলো ডিল ফাইনাল করার জন্য এক হাত বাড়িয়ে দিলে গ্রে।

এক চোখ বাঁকা করে ফিওনা কিছুক্ষণ সন্দেহ করল। তারপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ওকে, ডিল।

গ্রে গতকাল যে ভুলগুলো করেছে সেগুলোর একটা প্রায়চিত্ত হলো মাত্র। সামনে আরও করতে হবে। জেট প্লেনে তুলে দিতে পারলেই এই মেয়ের বিপদ থেকে রক্ষা করা সম্ভব। এখান থেকে চলে গেলে ও নিরাপত্তার মধ্যে থাকবে। অন্যদিকে এখানে কোনো পিছুটান ছাড়া আরও তদন্ত চালিয়ে যেতে পারবে গ্রে আর মনক।

গ্রের নোটবুক গ্রে-কে ফেরত দিল ফিওনা। তোমাকে জানিয়ে রাখছি… আমাদেরকে সেন্ট্রাল জার্মানির প্যাডেরবর্ন-এ যেতে হবে। জায়গামতে গিয়ে আমি তোমাকে বিস্তারিত ঠিকানা দেব।

 গ্রে বুঝতে পারল মেয়েটি ওকে একটু হলেও বিশ্বাস করেছে। ঠিক আছে। চলবে।

মাথা নাড়ল ফিওনা।

ডিল মজবুত হয়ে গেছে।

এখন এই মাথা ধরে যাওয়া মিউজিকটাকে বন্ধ করা যায় কি-না দেখ, কাতর কণ্ঠে জানাল ও।

ফিওনার কথা শুনতে পেয়েই যেন বিভিন্ন মেশিনের গুঞ্জন আর সেই মিউজিক দুম করে থেমে গেল। হঠাৎ করে নীরবতা নেমে এলো চারিদিকে। সরু দরজার এদিকে কে যেন আসছে।

গ্রে উঠে দাঁড়াল। আমার পেছনে থাকো, ফিসফিস করে বলল ও।

 বাইবেল তুলে নিয়ে নিজের পার্সে ভরল ফিওনা।

একটু আগে একটি রিবার পেয়েছিল গ্রে, ওটাকেই হাতে তুলে নিল।

দরজা খুলে যেতে উজ্জ্বল আলো এসে পড়ল ওদের চোখে।

লোকটি চমকে গেছে। ডেনিশ ভাষায় বলল, তোমরা দুইজন এখানে কী করছ?

সোজা হয়ে হাতের দণ্ডকে নিচু করল গ্রে। আর একটু হলেই মেইনটেন্যান্স ইউনিফর্ম পরা এই লোকটিকে আঘাত করে ফেলতো।

রাইড শেষ, ভেতরে ঢুকল সে। সিকিউরিটিকে ডাকার আগে এখান থেকে বেরিয়ে যাও!

নির্দেশ পালন করল গ্রে। ওকে পাশ দিয়ে যেতে দেখে–কুটি করল লোকটি। গ্রে জানে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের সাথে একটি টিনেজ মেয়ে পার্কের এরকম একটা ছোট রুমে…

 মা, তুমি ঠিক আছে তো? লোকটি প্রশ্ন করল। ফিওনার ফোলা ফোলা চোখ আর ছিঁড়ে যাওয়া স্কার্ট নিশ্চয়ই লোকটির চোখে পড়েছে।

আমরা একদম ঠিক আছি। গ্রের এক হাত জড়িয়ে ধরে একটু পা ফাঁক করল ফিওনা। এই রাইডের জন্য ইনি আমাকে বাড়তি পয়সা দিয়েছেন।

মুখ বিকৃত করল লোকটি। পেছনের দরজা ওদিকে। বাইর লেখা একটি নিয়ন সাইন দেখাল সে। এখানে যেন আর কখনও না দেখি। এখানে ঢোকা বিপজ্জনক।

বাইরের অবস্থা তো আরও বিপজ্জনক। ফিওনাকে নিয়ে দরজার দিকে এগোল গ্রে। ঘড়ি দেখল। পার্ক বন্ধ হতে আরও ১ ঘন্টা লাগবে। একবার বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করা যেতে পারে।

রাইড ভবনের এক কোণা আসার পর ওরা দেখল পার্কের এই অংশ প্রায় জনমানব শূন্য হয়ে গেছে। রাইড চলা শেষ। সব বন্ধ।

পার্কের লেকের ওদিক থেকে আসা মিউজিকের আওয়াজ শুনতে পেল গ্রে।

 ইলেকট্রিক্যাল কুচকাওয়াজের জন্য জড়ো হচ্ছে সবাই। ফিওনা বলল। আতসবাজি ফুটিয়ে পার্ক বন্ধ করা হবে।

গ্রে প্রার্থনা করল আজকের আতসবাজি যেন ভালই ভালই শেষ হয়ে যায়। কোনো রক্তারক্তি যেন না ঘটে। পার্কের ভূমিতে নজর দিল গ্রে। হারিকেন রাতের আলোকে দূর করার চেষ্টা করছে। ফুল বাগানে টিউলিপ ফুলের বহর। ওদের যে রাস্তা ধরে এগোতে হবে ওতে কোনো লোকজন নেই। একদম উদোম, ফাঁকা।

দুজন সিকিউরিটি গার্ডকে একটু তাড়াহুড়ো করে এদিকে আসতে দেখল গ্রে। ওই লোক গিয়ে সিকিউরিটিদের সতর্ক করে দিয়েছে নাকি?

 আবার হারিয়ে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। গ্রে বলল। ফিওনাকে নিয়ে গার্ডদের ঠিক বিপরীত দিকে রওনা হয়ে গেল ও। লোকজন যেখানে কুচকাওয়াজের জন্য জড়ো হচ্ছে ওরা সেদিকেই যাচ্ছে। গাছের ছায়ার ভেতর দিয়ে দ্রুত এগোল ওরা। কুচকাওয়াজ দেখতে দর্শনার্থী বলতে শুধু ওরা দুজন।

বাগানের পথ পেরিয়ে সেন্ট্রাল প্লাজায় ঢুকল ওরা। বিভিন্ন লাইট আর হারিকেনের আলোতে এখানটা বেশ আলোকিত হয়ে আছে। প্লাজার ভেতরে কুচকাওয়াজের প্রথম দল ঢুকতেই একটু সমস্বরে হওয়া হই হই আওয়াজ ভেসে এলো। প্লাজা ৩ তলা। পাথরে একটি মৎস্যকন্যা আঁকা আছে। পান্না ও উজ্জ্বল নীল আলো দিয়ে অলংকার করা হয়েছে ওটার। একটি হাত স্বাগতম জানাচ্ছে। ওটার পেছন দিয়ে যাচ্ছে অন্যরা। মনোরম সুরে বাঁশি বাজছে, ড্রাম বাজছে।

দ্য হ্যানস ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেন প্যারেড, বলল ফিওনা। এই লেখকের ২০০-তম জন্মবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে এখানে। এই শহরের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি।

সেন্ট্রাল লেকের পাশ দিকে এগোনোলোকদের দিকে এগোল গ্রে। লেকের পানিতে প্রতিফলন ফেলে একটি বড় আতসবাজি আকাশে বিস্ফোরিত হলো। রাতের আকাশ জুড়ে আতসবাজির বিভিন্ন উজ্জ্বল শিখা দাপাদাপি করে হুটোপুটি খেল।

কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণ করা লোকদের কাছাকাছি থাকলেও চারদিকে নজর বুলাচ্ছে গ্রে। কালো পোশাক পরিহিত ফ্যাকাসে চেহারা খুঁজছে ও। কিন্তু এই কোপেহ্যাগেনে প্রতি ৫ জনে ১ জনের চুল সাদা। আর ডেনমার্কে তো এখন কালো পোশাক পরা হালের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ড্রামের তালে তালে গ্রের বুকও লাফাচ্ছে। উত্তেজনায় তালা লেগে গেছে ওর কানে। অবশেষে ওরা লোকজনের কাছে পৌঁছুল।

ওদের মাথার ঠিক ওপরেই আতসবাজি ফুটলো। আগুনের শিখায় উজ্জ্বল হলো রাতের আকাশ, ফটফট করে শব্দ হলো।

হোঁচট খেল ফিওনা।

গ্রে ওকে ধরে ফেলল, ওর কানে ভোঁ ভোঁ আওয়াজ হচ্ছে।

আতসবাজির বিস্ফোরণ মিলিয়ে যেতে ওর দিকে তাকাল ফিওনা, চমকে গেছে। এক হাত বের করে গ্রেকে দেখাল ও।

ওর হাত রক্তে লাল হয়ে গেছে।

.

ভোর ৪টা ০২ মিনিট।
হিমালয়।

অন্ধকারে জেগে উঠল ক্রো। আগুন নিভে গেছে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে ও? জানালা নেই, সময়ও বুঝতে পারছে না। কিন্তু ওর মন বলছে বেশিক্ষণ হয়নি।

কিছু একটা ওকে জাগিয়ে দিয়েছে।

 কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠল ও।

বিছানার অপর পাশে লিসাও জেগে গেছে, দৃষ্টি দরজার দিকে। তুমি টের পেয়েছ…?

বেশ ভয়াবহভাবে রুম কেঁপে উঠল। দূর থেকে গুরুগম্ভীর ভারী শব্দ এসে পৌঁছুল ওদের কাছে।

কম্বল সরিয়ে ফেলল ক্রো। বিপদ।

জার্মানদের দেয়া কয়েকটি পরিষ্কার পোশাকের দিকে ইঙ্গিত করল ও। চটপট পরে নিল ওরা: লম্বা আন্ডারওয়্যার, ভারী জিন্স আর মোটা সোয়েটার।

রুমের অন্যপাশে মোমবাতিগুলো জ্বালাল লিসা। গাট্টাগাট্টো এক জোড়া লেদার বুট পায়ে দিল, যদিও এটা ছেলেদের জন্য। চুপচাপ অপেক্ষা করল ওরা… প্রায় ২০ মিনিট। আওয়াজ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।

ওরা দুজন আবার বিছানায় গেল। তোমার কী মনে হয়, কী হলো? ফিসফিস করে বলল লিসা।

হাঁক-ডাকের আওয়াজ শোনা গেল।

 জানি না… তবে আমরা বোধহয় জেনে যাব।

পুরু ওক কাঠের দরজার ওপাশ থেকে পাথুরে প্যাসেজ ধরে বুটের শব্দ ভেসে আসছে। উঠে দাঁড়াল ক্রো। কান সজাগ।

এদিকেই আসছে। বলল ও।

 ওর কথা সত্য প্রমাণ করতে দরজায় কড়া আওয়াজ হলো। এক হাত উঁচু করে লিসাকে পেছনে থাকতে বলল ক্রো। নিজেও পেছালো এক কদম। দরজার বাইরে থাকা একটি ভারী লোহার দণ্ডের খসখসে আওয়াজ শোনা গেল।

খুলে গেল দরজা। চারজন অস্ত্রধারী রুমে ঢুকল, অস্ত্রগুলো ওদের দুজনের দিকে তাক করা। পাঁচ নম্বর ব্যক্তি ঢুকল এখন। এই ব্যক্তিকে দেখতে অনেকটা গানথারের মতোবিশাল দেহ, মোটা ঘাড়, হাল ধূসর রঙের চুলগুলো খাটো খাটো। পরনে বাদামি প্যান্ট, কালো বুট আর প্যান্টের সাথে ম্যাচ করা বাদামি শার্ট।

কালো অস্ত্র আর স্বস্তিকা ছাড়া তাকে দেখতে নাৎসি স্ট্রম ট্রুপারের মতো লাগছে।

কিংবা সাবেক নাৎসি স্ট্রম ট্রুপারও বলা যেতে পারে।

গানথারের মতো এর চেহারাও ফাঁকাসে, তবে একটু সমস্যা আছে। স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর মতো তার চেহারা বাম পাশ একটু গেছে, দরজার দিকে সে তার বাম হাত তুলে দেখাতেই ওটা কেমন যেন কেঁপে উঠল।

Kommen mit mir! বলল সে।

ওদেরকে রুম থেকে বেরোনোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিশালদেহি লোকটি নির্দেশ দিয়ে ঘুরে চলে গেল। সে জানে, তার আদেশ অমান্য করার মতো পরিস্থিতি নেই। তার ওপর রাইফেলের ব্যবস্থা তো আছেই।

 লিসার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল ক্রো। সবাই বেরোল রুম থেকে। হলওয়ে বেশ সরু, দুজন মানুষ একসাথে যাওয়া কঠিন। গার্ডদের অস্ত্রের সাথে থাকা ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় পথ দেখে এগোল ওরা। রুমের চেয়ে এই হলওয়েতে বেশি ঠাণ্ডা। তবে সেটা হিমশীতল নয়।

ওদেরকে বেশিদূর নেয়া হবে না। পেইন্টার ক্রো আন্দাজ করল ওদেরকে হয়তো ক্যাসলের সামনের অংশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওর ধারণাই সত্য। বাতাসের হিস হিস আওয়াজও শুনতে পেল ও। বাইরে নিশ্চয়ই ঝড় আবার হামলা করেছে।

সামনে থাকা গার্ড কাঠের দরজায় নক করল। চাপা শব্দে অনুমতি দেয়া হলো ভেতর থেকে। উষ্ণ আলোয় হল আলোকিত হলো, উষ্ণ হাওয়াও এলো সাথে।

গার্ড ভেতরে ঢুকে দরজা ধরে রইল।

লিসাকে নিয়ে এগোল পেইন্টার রুমে চোখ বুলাল। লাইব্রেরি আর স্টাডি রুম বলে মনে হচ্ছে। দোতলা, চার দেয়ালে খোলা বুকশেলফ। উপরের তলার পুরোটা লোহার বেলকুনি দিয়ে ঘেরা, বেশ ভারী, তবে সাজ-সজ্জা নেই। উপরে যেতে হলে মই ছাড়া গতি নেই।

রুমের এক পাশে বড় ফায়ারপ্লেস আছে, উষ্ণতার উৎস ওটা। ওখানে ছোটখাটো দাবানল জ্বলছে। জার্মান ইউনিফর্ম পরা এক ব্যক্তির ওয়েল পেইন্টিং তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

 আমার দাদু, বললেন অ্যানা পোরেনবার্গ। পেইন্টারকে সেভাবে উদ্দেশ্য করে বলেননি। একটি বিরাট ডেস্কের পেছন থেকে উঠে এলেন তিনি। তার পরনেও কালো জিন্স আর সোয়েটার। এটাই এই ক্যাসলের ড্রেস-কোড। যুদ্ধের পর তিনি এই ক্যাসল অধিকার করে নিয়েছিলেন।

ফায়ারপ্লেসের সামনে গোল করে বসানো চেয়ারে বসতে ইশারা করলেন তিনি। পেইন্টার তার চোখ খেয়াল করে দেখল ওখানে কালি জমেছে। মনে হচ্ছে তিনি একটুও ঘুমাননি। তার শরীর থেকে একধরনের সুগন্ধি বেরোচ্ছে।

ইন্টারেস্টিং।

তিনি ভারী চেয়ারের দিকে এগোতেই পেইন্টারের সাথে তাঁর চোখাচোখি হলো। ঘাড়ের পেছনে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেল ক্রোর। চোখের নিচে কালি জমলেও অ্যানার চোখ দুটো বেশ উজ্জ্বল ও তীক্ষ্ণ। পেইন্টার তার চোখে ধূর্ত, দানবীয় ও হিসেবি দীপ্তি দেখতে পেল। ওকে খুব কাছ থেকে দেখে তিনি কী যেন হিসেব করছেন।

হচ্ছেটা কী?

 setzen Sie, bitte মাথা নেড়ে চেয়ারগুলো দেখালেন তিনি। বসতে বলছেন।

পাশে থাকা দুটো চেয়ারে বসল লিসা ও ক্রো। অ্যানা ওদের বিপরীতে বসলেন। গার্ডটি দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে। হাত দুটো আড়াআড়িভাবে রাখা। পেইন্টার জানে বাকি গার্ডগুলো দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। এই রুম থেকে পালানোর পথ খুঁজল গ্রে। পুরু কাঁচের এক জানালা ছাড়া এখান থেকে পালানোর আর কোনো উপায় নেই। ঠাণ্ডার কারণে কাঁচ ঘোলা হয়ে রয়েছে, এছাড়াও পুরো জানালায় লোহার দণ্ড দিয়ে গ্রিল দেয়া।

এদিক দিয়ে পালানো চলবে না।

অ্যানার দিকে মনোযোগ দিল ক্রো। হয়তো অন্য কোনো উপায় আছে। অ্যানার ভাবভঙ্গি একটু বিপজ্জনক হলেও ওদেরকে তো একটি কারণে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। ক্রো এখান থেকে যত সম্ভব তথ্য জেনে নিতে চায়। তবে ওকে খুব চতুরভাবে পা ফেলতে হবে। অ্যানার পরিবারের এক ব্যক্তিকে তো ও ওয়েল পেইন্টিং থেকে দেখে নিয়েছে। এটা দিয়েই শুরু করা যাক।

আপনি বললেন, আপনার দাদু এই ক্যাসল অধিকার করে নিয়েছিলেন, বলল পেইন্টার। মনে মনে জবাব আশা করছে। পা ফেলছে নিরাপদে। এই ক্যাসল তার আগে কার দখলে ছিল?

চেয়ারের পেছনে হেলান দিলেন অ্যানা। আগুনের সামনে বসে একটু রিল্যাক্স করা যেতে পারে। তবে তার দৃষ্টি এখনও তীক্ষ্ণ, হাত দুটো কোলের ওপর রাখা, লিসার ওপর দিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ক্রোর ওপর থামলেন। GranitschloB–এর এক লম্বা অন্ধকার ইতিহাস আছে, মিস্টার ক্রো। আচ্ছা, আপনি হেনরিক হিমল্যারের নাম শুনেছেন?

হিটলারের সেকেন্ড ইন কমান্ড?

হ্যাঁ। এসএস-এর প্রধান। সেইসাথে কসাই ও উন্মাদ।

এরকম শব্দে ভূষিত করায় পেইন্টার বিস্মিত হলো। এটা কী কোনো ছলনা? খেলা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু কীভাবে পা ফেলে খেলতে হবে সেটা ও জানে… অন্তত এখনও পর্যন্ত জানতে পারেনি।

বলছেন অ্যানা, হিমল্যার নিজেকে রাজা হেইনরিচ-এর পুনর্জন্ম ব্যক্তি হিসেবে বিশ্বাস করতেন। দশম শতাব্দীতে স্যাক্সন অঞ্চলের রাজা ছিলেন হেইনরিচ। এমনকি তার ধারণা ছিল তিনি নাকি হেইনরিচের কাছ থেকে দৈববাণী পেতেন!

মাথা নাড়ল পেইন্টার। আমি শুনেছিলাম অতিপ্রাকৃত ব্যাপার-স্যাপারে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি।

একদম অন্ধ ছিলেন তিনি। পুরোপুরি বদ্ধমূল ধারণা ছিল তার। শ্রাগ করলেন অ্যানা। অনেক জার্মানির অনুরাগ ছিল এটার ওপর। ম্যাডাম বালাভাস্কি থেকে শুরু করি… আর্যজাতি নিয়ে তিনি সর্বপ্রথম হুজুগ তুলেছিলেন। দাবি করলেন, বুদ্ধ মঠে দীক্ষা লাভ করতে গিয়ে তিনি নাকি কোনো এক গোপনবিদ্যা অর্জন করেছেন। গোপন গুরু তাকে জানিয়েছেন কীভাবে মানবজাতি ধীরে ধীরে এত উন্নত হয়েছে এবং একদিন অবনতিও হবে।

প্রচলিত ধারণা, বলল পেইন্টার।

একদম। ঠিক তার ১০০ বছর পর, গুইডো ভন লিস্ট নামের একজন ম্যাডামের সেই বিশ্বাসের সাথে জার্মান মিথলজিকে মিশিয়ে একটু পরিমার্জন উত্তরদেশীয়দের পূর্বপুরুষ হিসেবে এই কাল্পনিক আর্যজাতিকে উপস্থাপন করেন।

তারপর জার্মানের লোজন সেই গল্পে একদম মজে গেল। একটি টোপ ফেলল ক্রো।

 তা তো মজবেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমাদের হারের পর এরকম একটা ধারণা খুব জনপ্রিয়তা পেয়ে গেল। পুরো ব্যাপারটা জার্মানির অতিপ্রাকৃত বিভিন্ন কেন্দ্রে গিয়ে ঠাই পেল। দ্য গুলি সোসাইটি, দ্য ড্রিল সোসাইটি, দ্য অর্ডার অফ দ্য নিউ টেম্পলারস… ইত্যাদি।

আর আমার যতদূর মনে পড়ে, হিমল্যার নিজে খুলি সোসাইটিতে যুক্ত ছিলেন।

 হ্যাঁ, তিনি এই মিথলজি পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন। এমনকি স্ক্যান্ডেনেভিয়ানদের প্রাচীন অক্ষরগুলোর জাদুতেও তার বিশ্বাস ছিল। সেজন্য ডাবল sig প্রাচীন অক্ষর আর জোড়া বজ্রপাত ব্যবহার করে তিনি তাঁর নিজের যোদ্ধা যাজকদের পরিচয় তুলে ধরতেন, দ্য Schutzstafel, দ্য SS। ম্যাডাম বালাভাস্কির কাজ পর্যালোচনা করে তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন, এই হিমালয় থেকে আর্যজাতিদের যাত্রা শুরু হয়েছিল আর ঠিক এখান থেকেই তাদের পুনরুত্থান হবে।

প্রথমবারের মতো মুখ খুলল লিসা। তাই হিমল্যার হিমালয়ে অভিযান পাঠিয়ে ছিলেন। একটু পেইন্টারের দিকে তাকাল ও। এই বিষয়টি নিয়ে ওরা আগে কথা বলেছে। দেখা যাচ্ছে ওদের চিন্তা-ধারায়ও খুব বেশি ভুল ছিল না। তবে পেইন্টার এখনও অ্যানার সেই দুর্বোধ্য কথার মর্মার্থ খুঁজে বেড়াচ্ছে।

আমরা নাৎসি না। আমরা আর নাৎসি নেই।

 কিছু একটা ঠিক করে রাখা হয়েছে, ক্রো টের পেল ঠিকই কিন্তু ওটা যে ওদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারল না। এরকম অন্ধকারে থাকা ওর মোটেও পছন্দ নয় তবে সেটা সামনাসামনি প্রকাশ করল না।

আচ্ছা, হিমল্যার এখানে কী খুঁজছিলেন? প্রশ্ন করল ক্রো। আর্যদের কোনো হারানো গোত্র? শুভ্র-সাদা সাংরি-লা?

না ঠিক তা নয়। নৃ-তাত্ত্বিক ও প্রাণিবিজ্ঞান সম্পর্কিত গবেষণার মোড়কে তিনি এখানে তার এসএস সদস্যদের পাঠিয়ে ছিলেন। অনেক বছর আগে হারিয়ে যাওয়া আর্যদের শেকড়ের সন্ধান করছিলেন তিনি। প্রমাণ খুঁজছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল তিনি এখান থেকে সূত্র পাবেনই। কিন্তু কিছু না পেয়ে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছিলেন। বেপরোয়া পাগলামো যাকে বলে! জার্মানি এসএস-এর জন্য উইউইলসবার্গ নামের একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ নির্মাণের সময় ঠিক ওটার মতো দেখতে আরেকটি দুর্গ এখানেও নির্মাণ করতে শুরু করেন। জার্মান থাকা হাজার খানেক যুদ্ধবন্দীকে এই হিমালয়ে উড়িয়ে নিয়ে এসে শ্রমিকের কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এক মেট্রিক টন সোনার বার এনেছিলেন জাহাজে করে। নিজেদের জন্য যথেষ্ট রসদ জুগিয়েছিলেন তিনি। বেশ ভাল বিনিয়োগ ছিল ওটা।

কিন্তু এখানে কেন নির্মাণ করতে গেলেন? লিসা জানতে চাইল।

কিছুটা আন্দাজ করতে পারছিল পেইন্টার। তার বিশ্বাস ছিল এই পর্বতমালা থেকে আর্যদের আবার পুনরুত্থান ঘটবে। সেই আর্যদের কথা ভেবেই এই দুর্গ তৈরি করছিলেন।

মাথা নেড়ে সায় দিলেন অ্যানা। গোপন গুরুদেরকেও বিশ্বাস করতেন তিনি, গুরুগণ তাকে জানিয়েছিল, ম্যাডাম বালাভাস্কি এখনও বেঁচে আছে। তাদের সবার জন্য দুর্ভেদ্য দুর্গ নির্মাণ করছিলেন। যাবতীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্রীভূত করার ইচ্ছে ছিল তার।

গোপন শুরু কী কখনও দেখা দিয়েছিলেন? ক্রো মজা করে জানতে চাইল।

না। তবে আমার দাদা যুদ্ধের শেষে একটা জিনিস করে দেখিয়েছিলেন। এমন এক অলৌলিক কাজ করেছিলেন যেটা হিমল্যারের স্বপ্নকে বাস্তবে আনতে সক্ষম ছিল।

কী সেটা? পেইন্টারের প্রশ্ন।

মাথা নাড়লেন না। ওদিকে কথা বলার আগে আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই। আশা করি আপনি মিথ্যা বলবেন না।

হঠাৎ করে কথার মোড় ঘুরতে দেখে ক্রো ভ্রু কুঁচকাল। আমি কোনো কথা দিতে পারব না, সেটা আপনি ভাল করেই জানেন।

প্রথমবারের মতো অ্যানার মুখে হাসি দেখা গেল। যাক, মিস্টার ক্রো, আপনি এতটুকু তো সত্য বলেছেন?

আপনার প্রশ্নটা শুনি। বেশ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল ক্রো। আসল ঘটনা হয়তো এবার বোঝা যাবে।

ওর দিকে তাকালেন অ্যানা। আপনি কী অসুস্থ? আমি অনেক কিছুই শুনতে পেরেছি। তবে আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনার মাথা বেশ পরিষ্কার।

ক্রোর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। এরকম প্রশ্ন সে আশা করেনি।

পেইন্টার কিছু বলার আগেই লিসা জবাব দিল, হ্যাঁ। ও অসুস্থ।

লিসা…ক্রো বাধা দিতে চাইল।

তিনি এটা কোনো না কোনোভাবে ঠিকই বুঝতে পারতেন। তোমার অসুখ হয়েছে। এটা বোঝার জন্য কোনো মেডিক্যাল ডিগ্রি নেয়ার প্রয়োজন নেই।

অ্যানার দিকে ফিরল লিসা। চোখের সমস্যাসহ কয়েকটি জিনিসে ভুগছে ও।

প্রচণ্ড মাথাব্যথার সাথে চোখের সামনে আলোর দপদপানি আছে?

 লিসা মাথা নেড়ে সায় দিল।

আমিও এরকমটাই ভেবেছিলাম। পেছনে হেলান দিলেন অ্যানা। তথ্যগুলো তাকে নিশ্চিত করল।

ভ্রু কুঁচকাল পেইন্টার। কেন?

লিসা কথা বের করতে চাইল। কী হয়েছে ওর? আমার মনে হয়, আমরা… মানে ওর সেটা জানার অধিকার আছে।

ওটা জানতে হলে আরও আলোচনা করতে হবে। তবে আমি আপনাকে তার সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে জানাতে পারি।

কী সেটা?

আগামী তিন দিনের মধ্যে সে মারা যাবে। মৃত্যুটা হবে খুব ভয়াবহ।

 কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখানোর জন্য নিজের সাথে রীতিমতো যুদ্ধ করল ক্রো।

লিসাও বেশ স্বাভাবিক রইল, নিরপেক্ষ কণ্ঠে বলল, এর কোনো চিকিৎসা আছে?

না।

.

রাত ১১ টা ১৮ মিনিট।
কোপেনহ্যাগেন, ডেনমার্ক।

ফিওনাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। জখমের স্থান থেকে রক্ত গড়িয়ে বেচারির শার্ট ভিজে যাচ্ছে, টের পেল গ্রে। ওর নিচে হাত দিয়ে সাহায্য করল।

ওদের দুজনের চারদিকে অনেক লোকজন। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ দেখতে দেখতে গ্রে বিরক্ত হয়ে গেল। মিউজিক ও গান বন্ধ হয়ে গেল ওদের পাশ দিয়ে কুচকাওয়াজ চলে যেতেই। সচল বিশালাকৃতির পুতুলগুলো লোকজনের মাথার ওপর দিয়ে ইচ্ছেমতো নড়াচড়া করছে, মাথা নাড়ছে।

 লেকের উপরের আকাশে আতসবাজি ফুটছে এখনও। গ্রে এসব কিছু এড়িয়ে গেল। ফিওনাকে যে গুলি করেছে তাকে খুঁজছে ও।

 গ্রে ফিওনার জখমস্থান চট করে দেখে নিল। স্রেফ ছড়ে গেছে, চামড়া পুড়েছে একটু, রক্ত বেরোচ্ছে, গুলিবিদ্ধ না হলেও ওকে ডাক্তার দেখানো দরকার। ব্যথায় বেচারির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।

গুলি ছোঁড়া হয়েছে পেছন থেকে। অর্থাৎ স্নাইপার গাছ আর ঝোঁপঝাড়ের ভেতরে পজিশন নিয়েছিল। কপাল ভাল ওরা দুজন লোকজনের ভেতরে পৌঁছুতে পেরেছে। যেহেতু ওদেরকে এখানে দেখে ফেলে… শত্রুপক্ষ হয়তো এতক্ষণে কাছাকাছি চলেও এসেছে। এই লোকজনের ভেতরেই কোথায় ঘাপটি মেরে আছে তারা।

গ্রে ঘড়ি দেখল। পার্ক বন্ধ হতে আর ৪৫ মিনিট বাকি।

প্ল্যান দরকার… নতুন প্ল্যান। এই লোকগুলো মাঝরাতে পার্ক থেকে বেরোবে। কিন্তু ওদের তো অতক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না। মাঝরাতের আগেই ওরা শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়ে যাবে। এখুনি কেটে পড়তে হবে ওদের।

কিন্তু পার্কের বের হওয়ার পথ থেকে এই কুচকাওয়াজের মাঠে অবস্থা একদম জনশূন্য মরুভূমির মতো। কারণ সব অতিথিরা লেকের চারপাশে ভিড় করেছে। তাই এদিকটা ফাঁকা। যদি ওরা দুজন এ-পথ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে তাহলে ফাঁকা অংশে নির্ঘাত চোখে পড়ে যাবে। আর পার্কের গেইটও নিশ্চয়ই শত্রুপক্ষের নজরদারিতে আছে।

নিজের জখমস্থানকে এক হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে ফিওনা। রক্ত চুঁইয়ে বেরোচ্ছে ওর আঙুলের ফাঁক দিয়ে। গ্রের চোখে চোখ পড়ল ওর, আতঙ্কিত।

ফিসফিস করে বলল, আমরা কী করতে যাচ্ছি?

 ওকে সাথে নিয়ে গ্রে লোকজনের ভেতরে এগোচ্ছে। একটা উপায় পেয়েছে ও, যদিও সেটা বুঝুঁকিপূর্ণ তবে সাবধানতা অবলম্বন করার কারণে ওরা পার্ক থেকে বেরোতে পারবে না। ফিওনাকে নিজের সামনে নিল গ্রে।

আমার হাতে রক্ত মাখাতে হবে।

কী?

গ্রে ফিওনার শার্টের দিকে ইঙ্গিত করল।

 ভ্রু কুঁচকে ব্লাউজের কিনারা উঁচু করল ফিওনা। সাবধানে…

জখম থেকে নেমে আসা রক্তধারাটুকু গ্রে সাবধানে মুছে নিল। ব্যথায় কুঁচকে উঠে ছোট্ট করে শ্বাস ফেলল ফিওনা।

দুঃখিত, গ্রে বলল।

 তোমার আঙুল তো অনেক ঠাণ্ডা, বিড়বিড় করল ফিওনা।

তুমি ঠিক আছে তো?

আমি বাঁচব।

হা, ওটাই তো লক্ষ্য।

একটু পরেই তোমাকে তুলে নেব… বলে গ্রে উঠে দাঁড়াল।

 তুমি কোথায়… কী…?

আমি যখনই বলব সাথে সাথে চিৎকার দেবে। রেডি থাকো।

 কিছুই বুঝতে না পেরে নাক কুঁচকাল ফিওনা। তবে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করল গ্রে। দূরে বাঁশি আর ড্রামের আওয়াজ শুরু হলো। ফিওনাকে পাশ কাটিয়ে মেইন গেইটের দিকে এগোল ও। স্কুল ছাত্রদের মাথার ওপর দিয়ে গ্ৰে দেখল, একজন লোকের পরনে ট্রেঞ্চ কোট, তার এক হাত ঝোলানো অবস্থায় আছে। গ্রিট্টির খুনি।

ছোটবাচ্চাদের ভেতর দিয়ে অনেক কষ্টে এগোচ্ছে সে, চোখ বুলাচ্ছে চারিদিকে।

বাঁশি আর ড্রামের তালে তালে প্রাচীন গান গেয়ে ওঠা একদল জার্মানদের ভেতরে ভিড়ে ফিওনার কাছে ফিরে এলো গ্রে। গান শেষ হওয়ার পর আতসবাজির বিস্ফোরণের শব্দও বন্ধ হলো।

এবার… বলল গ্রে, নিচু হয়ে ঝুঁকেছে। সারামুখে রক্তের প্রলেপ মেখে ফিওনাকে নিজের দুহাতে তুলে নিল। ডেনিশ ভাষায় চিৎকার করে বলল, বোম!

আতসবাজি বিস্ফোরণের শব্দ এখনও বাতাসে পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি, তাই ওর চিৎকার সেভাবে কাজে এলো না।

 চিৎকার করো, ফিসফিস করে ফিওনাকে বলল ও।

রক্তের প্রলেপ দেয়া নিজের মুখখানা উপরে মেলে ধরল গ্রে। ফিওনা ওর হাতের উপরে থেকে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল।

বোম! আবার গলা ফাটাল গ্রে।

অনেক মুখ ঘুরল ওর দিকে। আকাশে আবার আতসবাজি তার যাত্রা শুরু করেছে। তাজা রক্তে গ্রের গাল চিকচিক করছে। প্রথমে কেউ-ই নড়ল না। কিন্তু তারপর জলোচ্ছ্বাসের মতো সবাই মেইন গেইটের দিকে যাত্রা শুরু করল। একজন আরেকজনকে ধাক্কা মারছে, ঠেলা দিচ্ছে। ভয় পেয়ে অনেকেই চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করায় লোকের চল আরও বেড়ে গেল।

যারা পালিয়ে যাচ্ছে তাদের ঠিক পেছনেই আছে গ্রে। ওর আশেপাশে যারা আছে এরা সবাই খুবই আতঙ্কিত।

তীক্ষ্ণস্বরে চিৎকার করছে ফিওনা। এক হাত নাড়াল, আঙুলে রক্ত চোয়াচ্ছে।

দাবানলের মতো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। লন্ডনে আর স্পেনে আক্রমণ হয়ে যাওয়ায় গ্রের চিৎকার বেশ কাজে লাগল। অনেকেই বোম বলে চিৎকার করছে। একজন আরেকজনের কাছ থেকে শুনে নিজেও চেঁচাচ্ছে।

তাড়া খাওয়া পশুপালের মতো একে অন্যকে ঠেলা-ধাক্কা মেরে এগোচ্ছে সবাই। ওরা এই আবদ্ধস্থান থেকে বেরিয়ে যেতে মরিয়া। আকাশে ওঠা আতসবাজির দম ফুরিয়েছে। এখানকার আতঙ্ক এবার প্যারেড গ্রাউন্ডেও গিয়ে পৌঁছুল। একজন দৌড় দিলে তার দেখাদেখি আর দুইজন দৌড়ায়। এভাবে বেড়েই চলেছে। কত পায়ের থপথপানি চলছে পার্কের পথের ওপর দিয়ে। বাহির-এর দিকে ছুটছে সবাই।

একটি কৌশল রীতিমতো জনতার ঢলে পরিণত হলো।

 বের হওয়ার জন্য ছুটছে সবাই।

এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এগোল গ্রে। ফিওনা আছে ওর হাতে। গ্রে প্রার্থনা করল কেউ যেন কারও পায়ের নিচে চাপা না পড়ে। তবে এই ঢলে শুধু নিখাদ আতঙ্ক নয়, আতসবাজির শব্দ মিলিয়ে যেতেই সেটা ভয়ঙ্কর বিষয়ে পরিণত হলো। লোকজনের ঢল ছুটে চলেছে মেইন গেইটের দিকে।

ফিওনাকে নিজের হাত থেকে নামিয়ে দিল গ্রে। আরমানি জ্যাকেটের হাতায় নিজের রক্তমাখা চেহারা মুছল। গ্রের বেল্টে এক হাত দিয়ে নিজের ভারসাম্য বজায় রেখে দাঁড়াল ফিওনা।

সামনে গেইট উদয় হলো।

মাথা নেড়ে এগোল গ্রে। যদি কোনো কিছু হয়ে যায়… দৌড়াবে। থামবে না, যেতেই থাকবে।

আমি জানি না, পারব কিনা। এপাশটা খুব হারামির মতো ব্যথা করছে।

 খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে ফিওনা। একটু ভর দিয়েছে গ্রের ওপর।

সামনে, জনতার ঢল সামলাতে ব্যস্ত সিকিউরিটি গার্ডরা। কেউ যেন কারও গায়ের ওপর গিয়ে না পড়ে সেদিকে নজর রাখছে তারা। ওদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গ্রে খেয়াল করল দুজন গার্ড একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আছে। জনতা সামলাচ্ছে না ওরা, সন্দেহজনক। একজন পুরুষ, আরেকজন নারী। দুজনের চামড়া সাদা। নিলাম ভবনে এরাই জিতেছিল। এখন গার্ডের ছদ্মবেশ ধরে গেইটে দাঁড়িয়ে আছে। পিস্তল শোভা পাচ্ছে দুজনের হাতেই।

এক মুহূর্তের জন্য গ্রের দিকে চোখ পড়ল নারী গার্ডের।

কিন্তু স্রেফ চোখ বুলিয়ে দৃষ্টি সরে গেল।

 ফিরল আবার।

চিনতে পেরেছে।

জনতার স্রোতের উল্টো দিকে রওনা হলো যে! একদম উজান পাড়ি দিচ্ছে।

কী? ফিওনা প্রশ্ন করল।

ফিরে চল। অন্যকোনো রাস্তা দেখতে হবে।

কীভাবে?

জনতার ভিড় ঠেলে একটু পাশে সরল গ্রে। সোজাভাবে এরকম উজান পাড়ি দেয়া অনেক কঠিন। একটু পরে পরিবেশ একটু হালকা হলো। বড় স্রোত চলে গেছে, অল্পকিছু লোক আছে এখন।

তবে ওদের লুকোনোর জায়গা দরকার।

যে দেখল ওরা জনশূন্য প্যারেড গ্রাউন্ডে চলে এসেছে। কোনো কুচকাওয়াজের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না এখানে। মিউজিকও নেই, তবে আলো জ্বলছে। কুচকাওয়াজে অংশ নেয়া বিভিন্ন রথ পড়ে আছে মাটিতে। রথ ফেলে চালকেরা জান নিয়ে পালিয়েছে যে যার মতো। এমনকী এখানকার সিকিউরিটি গার্ডরাও গেইটের দিকে চলে গেছে।

রথের ভেতরে থাকা একটি ক্যাবের দরজা খোলা দেখে ওদিকে এগোল গ্রে।

চলো।

ফিওনাকে প্রায় টেনে নিয়ে ক্যাবের কাছে গেল ও। ক্যাবের উপরে খেলনা হাঁসের একটি বিশালাকৃতির মাথা শোভা যাচ্ছে। যে চিনতে পারল। হ্যানস ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডেরসেন-এর রূপকথার গল্প দ্য আগলি ডাকলিং অবলম্বনে এটা তৈরি করা হয়েছে।

হাসের খোলা পাখনার নিচ দিয়ে এগোল গ্রে। পাখনায় আলো জ্বলছে। খেলনা হলেও এই পাখনা ডানার মতো ঝাপটাতে পারে। যে ফিওনাকে ক্যাবে উঠতে সাহায্য করল। মনে মনে ভাবছে, এই বুঝি পেছন থেকে গুলি লাগল। ফিওনার পর নিজেও ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। দরজা বন্ধ করার সময় যতটুকু সম্ভব শব্দ না করার চেষ্টা করল ও।

উইনশিন্ড (যানবাহনের সামনের কাঁচ) দিয়ে সামনে তাকাতেই বুঝল ওর সতর্কতা। মাঠে মারা যায়নি।

জনতার ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে আসছে একজন। গ্রিট্টির খুনি। কাছে থাকা শটগান লুকোনোর কোনো চেষ্টাই করছে না সে। সবাই পার্কের সামনের দিকে ব্যস্ত। লেক আর প্যারেড সার্কিটের দিকে কারও নজর নেই।

ফিওনাকে সাথে নিয়ে মাথা নিচু করল গ্রে।

 কয়েক ফুট দূর দিয়ে গেল লোকটা। পড়ে থাকা রথগুলোর পাশ দিয়ে এগোচ্ছে।

আর একটু হলেই হয়েছিল, ফিওনা ফিসফিস করল। আমাদের উচিত…

শশশ। গ্রে ফিওনার ঠোঁটের ওপর আঙুল চেপে ধরল। এই কাজ করতে গিয়ে একটি লিভারে ছুঁয়ে গেল ওর কনুই। ড্যাশবোর্ডে কীসের যেন ক্লিক শব্দ হলো।

এই সেরেছে!

ক্যাবের ওপরে থাকা ঢাউস মাথার ভেতরে স্পিকার বসানো আছে।

 … কোয়াক, কোয়াক, কোয়াক… কোয়াক, কোয়াক, কোয়াক…

জেগে উঠেছে আগলি ডাকলিং।

 সবাই জেনে গেল ব্যাপারটা।

সোজা হলে গ্রে। ৯০ ফুট দূরে শটগানধারী পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল।

 লুকোচুরি শেষ।

 হঠাৎ ক্যাবের ইঞ্জিন গর্জে উঠল। গ্রে তাকিয়ে দেখে, ফিওনা ক্লাচ নাড়াচাড়া করছে।

চাবি দেয়াই ছিল, গিয়ার বদলাতে বদলাতে বলল ফিওনা। লাইন ছেড়ে রথ সামনে এগোল।

ফিওনা, আমাকে দাও…

শেষবার তুমি চালিয়েছিলে। দেখো, কোথায় এনে ফেলেছ আমাদের। শটগানধারী লোকটির দিকে ক্যাব তাক করল ও। তাছাড়া, এই হারামজাদার সাথে আমার বোঝাপড়া আছে।

আচ্ছা, তাহলে সে-ও আততায়ীকে চিনতে পেরেছে। এই লোক ওর নানুকে খুন করেছিল। ২ নম্বর গিয়ার দিল ও, ওদিকে শটগানধারী অস্ত্র উঁচিয়েছে। কোনো পরোয়া না করে আগলি ডাকলিং-কে তার দিকে নিয়ে চলল ও।

কিছু একটা করতে চাইল গ্রে, ক্যাবের ভেতরে হাতড়াল।

এত এত লিভার…

গুলি করল শটগানধারী।

নিজেকে গুটিয়ে নিল গ্রে, তবে ফিওনা ইতোমধ্যে ক্যাবের হুইল ঘুরিয়ে নিয়েছে। উইনশীল্ডের এক কোণায় মাকড়সার জালের মতো জখম তৈরি হলো। হুইল আবার ঘুরাচ্ছে ফিওনা, আততায়ীকে পিষে ফেলতে চায়।

হঠাৎ করে দিক পরিবর্তন করে হুইল ঘোরানোয় ক্যাব দুই চাকার ওপর উঠে এলো।

ধরে থাকো! চিৎকার করল ফিওনা।

চার চাকায় অবতরণ করল ক্যাব। কিন্তু এই সুযোগে আততায়ী বাড়তি কিছু সময় পেয়ে গেল। বাম দিকে সরে গেল সে। লোকটার হাত খুব চালু। আবার গুলি ছোঁড়ার জন্য ইতোমধ্যে শটগান রেডি করতে শুরু করেছে। এবার তার মতলব, ক্যাব যখন ওর পাশ দিয়ে যাবে তখন জানালায় একদম পয়েন্ট ব্ল্যাক রেঞ্জ (একেবারে কাছ থেকে, প্রায় কোনো দূরত্ব ছাড়া) থেকে গুলি করবে ও।

ফিওনা এবার আর কোনো দিক পরিবর্তন করার কোনো সুযোগ পেল না।

সারি সারি লিভারগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে একদম বাম পাশের লিভারে হাত দিল গ্রে। অনেকটা আন্দাজেই করল কাজটা। লিভার নিচে নামাল। একটু আগে ডাকলিঙের বাম পাখনা উপরে তোলা ছিল ওটা এখন ঝাপটা মেরে নিচে নেমে এসেছে। আততায়ীর গলায় গিয়ে আঘাত করল ওটা। লোকটির কশেরুকায় আঘাত করে একদম উড়িয়ে নিয়ে একপাশে ফেলে দিলো।

গেইটের দিকে চলল! তাগাদা দিল গ্রে।

 দ্য আগলি ডাকলিং প্রথমবারের মতো রক্তের স্বাদ পেয়েছে।

 … কোয়াক, কোয়াক, কোয়াক… কোয়াক, কোয়াক, কোয়াক…

সাইরেনের মতো ডাকাডাকি করে রাস্তা পরিষ্কার করল ডাকলিং। সামনে থাকা লোকজন ভড়কে গিয়ে জায়গা করে দিতে বাধ্য হলো। জনতার ঢলের তোপে রীতিমতো নাকানি-চুবানি খেলো গার্ডরা। ছদ্মবেশি দুই গার্ডও বাদ গেল না। লোকজনের ধাক্কায় একটু আগে মেইন গেইটের পাল্লা বড় করে খুলে দেয়া হয়েছে। জনতা ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে ওটা দিয়ে।

ফিওনাও ওটার দিকে লক্ষ্য স্থির করল।

ক্ষত-বিক্ষত বাম পাখনা নিয়ে ছুটল ডাকলিং। ঝাঁকি খেয়ে রাস্তায় উঠল ওরা। ফিওনা ডাকলিং চালিয়ে গেল।

প্রথম কোণায় চলল, হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল গ্রে।

ফিওনা দক্ষ পেশাদারদের মতো গিয়ার নামিয়ে গ্রের আদেশ পালন করল। কোণার দিকে এগোল ডাকলিং। দুই মোড় পার হওয়ার পর গ্রে ক্যাব থামাতে বলল।

আমরা এই জিনিস আর চালিয়ে নিতে পারি না, বলল ও। এটা দেখতে অদ্ভুত দেখায়। দৃষ্টিআকর্ষণ করে সবার।

তোমার তা-ই মনে হয়? রেগে মাথা নাড়ল ফিওনা।

 টুল কিটের ভেতরে গ্রে একটি লম্বা রেঞ্জ পেল। রাস্তার পাশে পাহাড়ের চূড়োয় ক্যাব থামিয়ে ফিওনাকে নামিয়ে দিল ও। গিয়ার বাড়িয়ে ক্লাচ সরাল গ্রে, অ্যাক্সেলেটরের উপরে রেঞ্জ দিয়ে চাপ দিয়ে রেখে আটকে দেয়ার পর ক্যাব থেকে লাফ দিলো।

পাখনায় আলো নিয়ে পাহাড়ের নিচের দিকে রওনা হলো আগলি ডাকলিং। যেখানে গিয়ে এটা ক্রাশ (দুর্ঘটনা, দুমড়ে যাওয়া) করবে সবার দৃষ্টি ওদিকে থাকায় একটু সুবিধে পাবে ওরা।

এখান থেকে ঠিক উল্টো দিকে এগোল গ্রে। আপাতত কয়েক ঘন্টার জন্য নিরাপদ। ঘড়ি দেখল ও এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় আছে। মনক-ও খুব শীঘ্রিই পৌঁছে যাবে।

খুঁড়িয়ে এগোতে এগোতে পেছনে ফিরে তাকাল ফিওনা। ওদের পেছনে ডাকলিং ডেকে চলেছে।

… কোয়াক, কোয়াক, কোয়াক… কোয়াক, কোয়াক, কোয়াক…

 আমি ওকে মিস করব। ফিওনা বলল।

আমিও।

.

ভোর ৪ টা ৩৫ মিনিট।
 হিমালয়।

ফায়ারপ্লেসের পাশে দাঁড়িয়ে আছে পেইন্টার। নিজের মৃত্যুদণ্ডের সংবাদ শুনে চেয়ার থেকে উঠে পড়েছে।

ওকে উঠতে দেখে বিশালদেহি এক গার্ড তিন পা এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু অ্যানা এক হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেন। Nein, Klaus. Alles 1st ganz recht.

কালাউস নামের গার্ডটি তার নিজের পজিশনে ফিরে যাওয়ার আগপর্যন্ত পেইন্টার অপেক্ষা করল।

তাহলে এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই?

 মাথা নাড়লেন অ্যানা। যেটা সত্য সেটাই বলেছি।

তাহলে সন্ন্যাসীরা যেরকম পাগলামো করছিল পেইন্টার ওরকম করছে না কেন? লিসা প্রশ্ন করল।

পেইন্টারের দিকে তাকালেন না। আপনি মঠ থেকে দূরে ছিলেন, তাই তো? গ্রামে থাকার ফলে তুলনামূলক কম আক্রান্ত হয়েছেন। দ্রুত স্নায়বিক অধঃপতনের বদলে আপনার শরীর ধীরে ধীরে খারাপের দিকে এগোচ্ছে। তবে এটারও শেষ পরিণতি হলো-মৃত্যু।

অ্যানা নিশ্চয়ই পেইন্টারের চেহারা দেখে কিছু একটা বুঝতে পেরেছিলেন।

চিকিৎসা না থাকলেও অবস্থার অবনতির গতিকে ধীর করার আশা আছে। কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন প্রাণীর ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে আমরা কিছু মডেল উদ্ভাবন করেছি যেগুলো বেশ আশাব্যঞ্জক। আমরা আপনার জীবন দীর্ঘায়িত করতে পারি। মানে পারতাম আরকী।

মানে কী? লিসা প্রশ্ন করল।

উঠে দাঁড়ালেন অ্যানা। এজন্যই আপনাদেরকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। দেখাব আপনাদের। কালাউসের দিকে মাথা নাড়লেন তিনি, সে দরজা খুলে দিল। আমার সাথে আসুন। হয়তো আমরা একে অপরকে সাহায্য করার রাস্তা পেয়ে যাব।

অ্যানা সামনে পা বাড়ানোর পর লিসার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল পেইন্টার। কৌতূহলে মরে যাচ্ছে ও। একই সাথে ফাঁদ এবং আশার আলো দেখতে পাচ্ছে।

টোপটা কী?

 লিসা উঠে দাঁড়িয়ে পেইন্টারের দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাস করল, কী হচ্ছে এসব?

আমি ঠিক জানি না। কালাউসের সাথে কথাবলায়রত অ্যানার দিকে তাকাল ও।

হয়তো আমরা একে অপরকে সাহায্য করার রাস্তা পেয়ে যাব।

পেইন্টার নিজেও অ্যানাকে এইরকম কিছু বলে প্রস্তাব দেবে বলে ভাবছিল। এমনকি ব্যাপারটি নিয়ে কথাও বলেছিল লিসার সাথে। নিজের জীবন নিয়ে কীভাবে দর কষাকষি করা যায়, কিছু সময় পাওয়া যায়… এসব। ওদের কথাগুলো কী কেউ আড়িপেতে শুনে ফেলেছে? নাকি রুমে ছাড়পোকা (গোপনে কথা পাচার করার ইলেকট্রনিক ডিভাইস) ছিল? নাকি এখানকার ঘটনা আসলেই খুব খারাপ, ওদের সাহায্য সত্যি সত্যিই প্রয়োজন আছে?

দুশ্চিন্তায় পড়ল ক্রো।

আমরা যে বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনেছি, ওটা নিয়েই কিছু একটা হবে হয়তো, লিসা বলল।

মাথা নাড়ল ক্রো। ওর আরও তথ্য প্রয়োজন। কিন্তু আপাতত ওর শারীরিক অবস্থার বিষয়টি প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার ব্যথা শুরু হয়েছে চোখের পেছনে। ওর মাঢ়ির পেছনের অংশেও ব্যথা পৌঁছে গিয়ে জানিয়ে দিল ক্রো আসলেই অসুস্থ।

ওদের দিকে তাকিয়ে চোখ বুলালেন অ্যানা। পিছু হটল কালাউস। তার মুখ গোমড়া হয়ে আছে। অবশ্য পেইন্টার এখনও এই ব্যক্তিকে খুশি হতে দেখেনি। দেখতে চায়ও না। কারণ এই লোকের খুশির সাথে আর্তনাদ আর রক্তারক্তির সম্পর্ক আছে।

আসুন আমার সাথে, ঠাণ্ডা ভদ্রস্বরে বললেন অ্যানা। দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন, তার সাথে সাথে দুজন গার্ডও এগোল। কালাউস রইল পেইন্টার আর লিসার পেছনে। ওর সাথেও দুজন গার্ড আছে।

প্রিজন সেল থেকে ভিন্ন দিকে এগোল ওরা। কয়েক বাঁক পার হওয়ার পর সোজা টানেল উদয় হলো। পাহাড়ের ভেতরে থাকা বিভিন্ন টানেলের চেয়ে এই টানেল বেশি চওড়া। একসারি ইলেক্ট্রিক বা দিয়ে টানেলের ভেতরে আলোর ব্যবস্থা করা আছে। তারের খাঁচা চলে গেছে দেয়ালের গা বেয়ে। এগুলোর মাধ্যমে এখানে এই প্রথম আধুনিকতার নিদর্শন মিলল।

করিডোর ধরে এগোচ্ছে ওরা।

পেইন্টার খেয়াল করে দেখল ওরা যত সামনে এগোচ্ছে বাতাসে ঘন বাস্পের পরিমাণ তত বাড়ছে। তবে বাষ্প ছেড়ে ও আবার অ্যানার দিকে মনোযোগ দিল।

তাহলে আপনি জানেন, কোন জিনিসটা আমাকে অসুস্থ করেছে, বলল ক্রো।

আগেই বলেছি, ওটা একটা দুর্ঘটনা ছিল।

কীসের দুর্ঘটনা? একটু জোর করল ও।

উত্তরটা খুব সহজ নয়। এর ইতিহাস জড়িয়ে আছে।

ওর দিকে তাকালেন অ্যানা। এই পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তির ইতিহাস থেকে শুরু করে…

তাই নাকি? ক্রো বলল। তো এই কাহিনি কত লম্বা? মনে রাখা ভাল, আমার হাতে মাত্র তিন দিন সময় আছে।

ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন অ্যানা। সেক্ষেত্রে আমি আমার দাদুর ইতিহাস থেকে শুরু করতে পারি। যুদ্ধ শেষে উনি GranitschloB–এ প্রথমবারের মতো এসেছিলেন। ওই সময়ের গণ্ডগোল সম্পর্কে আপনার জানা আছে। জার্মানির পতন হতেই ইউরোপে যে তুলকালাম শুরু হয়েছিল?

সবকিছু যে যার মতো লুটেছে তখন।

 শুধু জার্মানির ভূখণ্ড আর সম্পদ নয়, আমাদের গবেষণা-রিসার্চও লুট হয়েছিল। মিত্রপক্ষ থেকে বিজ্ঞানী ও সৈনিকের দল পাঠিয়ে জার্মান ভূখণ্ডে থাকা গোপন টেকনোলজিগুলো লুট করা হয়েছিল তখন। একদম বিনে পয়সায় সবাই তখন ওসব বাগিয়ে নিয়ে গেছে। ভ্রু কুঁচকে ওদের দিকে তাকালেন অ্যানা। ঠিক বললাম তত?

লিসা ও ক্রো দুজনই মাথা নেড়ে সায় দিল।

 টি-ফোর্স কোড নাম দিয়ে ৫ হাজার সৈনিক ও সিভিলিয়ানকে পাঠিয়েছিল ব্রিটেন। টি-ফোর্স মানে, টেকনোলজি ফোর্স। তাদের কাজ ছিল জার্মানির বুকে থাকা বিভিন্ন তথ্য-প্রযুক্তির হদিস বের করা ও সেগুলো লুটে নেয়া। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল আমেরিকান, ফ্রেন্স আর রাশিয়ানরা। আচ্ছা আপনি জানেন ব্রিটিশ টি-ফোর্সের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিল?

মাথা নাড়ল পেইন্টার, জানে না। নিজের সিগমা ফোর্সের সাথে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার তথ্য-প্রযুক্তি লুটকারী একটি দলের সাথে কোনোভাবেই তুলনা করতে পারছে না ও। এই ব্যাপারে সিগমা ফোর্সের প্রতিষ্ঠাতা শ্যেন ম্যাকনাইট-এর সাথে আলাপ করা যেতে পারে। যদি ও অতদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে আরকি।

প্রতিষ্ঠাতা কে ছিল? লিসা জানতে চাইল।

 ভদ্রলোকের নাম কমান্ডার ইয়ান ফ্লেমিং।

 নাক দিয়ে ঘোঁতঘোত করল লিসা। জেমস বন্ডের রচয়িতা?

হ্যাঁ। বলা হয়ে থাকে, তিনি তার সেই ফোর্সের কিছু চরিত্রের ওপর ভিত্তি করে জেমস বন্ডের স্বভাব-চরিত্র তৈরি করেছিলেন। জেমস বন্ড পড়া থাকলে তাদের সুট পাট করার তেজ, সাহস আর বেপরোয়াপূর্ণ আচরণ সম্পর্কে কিছু ধারণা পাবেন।

 যুদ্ধে জয়ী পক্ষ সব লুটে নেয়, শ্রাগ করে বলল পেইন্টার।

হয়তো। তবে আমার দাদুর দায়িত্ব ছিল যতদূর সম্ভব নিজেদের টেকনোলজিগুলো রক্ষা করা। sicherheitsdienst–এর অফিসার ছিলেন তিনি। অ্যানা পেইন্টারের দিকে তাকালেন, পরীক্ষা করে দেখছেন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে খেলা শেষ হয়নি। ওকে চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।

দ্য sicherheitsdienst ছিল এসএস কমান্ডোর একটি দল। জার্মানের গুপ্তধন যেমন : শিল্প, সোনা, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও টেকনোলজি ইত্যাদি রক্ষা করাই ছিল তাদের কাজ।

 সায় দিয়ে মাথা নাড়লেন অ্যানা। যুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে পূর্বাঞ্চল দিয়ে রাশিয়ানরা যখন এগোচ্ছিল তখন আমার দাদুকে একটি দায়িত্ব দেয়া হয়। যেটাকে আপনারা আমেরিকানরা ডিপ ব্ল্যাক মিশন বলে থাকেন। জবরপযংভবৎ ধরা পড়ে আত্মহত্যা করার আগে সরাসরি হেনরিক হিমল্যারের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছিলেন তিনি।

 তার দায়িত্ব কী ছিল? পেইন্টার জানতে চাইল।

 কোড নেম ক্রোনস নামের একটি প্রজেক্টের যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ ধ্বংস করে দিতে হবে। die Glocke নামের একটি ডিভাইস বানানোর প্রজেক্ট ছিল সেটা। ওটার আরও একটা নামও আছে : দ্য বেল। সাডেটেন পাহাড়ের কোনো এক পরিত্যক্ত খনিতে রিসার্চ ল্যাবটাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। এই প্রজেক্টের উদ্দেশ্য সম্পর্কে দাদুর কোনো ধারণাই ছিল না। পরে হয়েছিল হয়তো। সবকিছু তিনি প্রায় নষ্টই করে ফেলেছিলেন… কিন্তু দায়িত্ব তো দায়িত্বই।

 তাহলে দ্য বেল নিয়ে পালালেন। কীভাবে?

তার হাতে দুটো পরিকল্পনা ছিল। এক, নরওয়ে হয়ে উত্তরদিকে চলে যাওয়া। দুই. অ্যাড্রিয়াটিক হয়ে দক্ষিণে। দুই পথেই তাকে সাহায্য করার জন্য এজেন্টরা তৈরি ছিল। আমার দাদু উত্তর দিকে রওনা হলেন। সম্পর্কে হিমল্যার তাকে জানিয়ে ছিলেন। এক দল নাসি বিজ্ঞানী আর কিছু ইতিহাস নিয়ে পালালেন তিনি। লুকোনোর দরকার ছিল। তার ওপর দাদু একটা প্রজেক্ট শুরু করলেন, যেটা থেকে লোভ-সংবরণ করা বিজ্ঞানীদের জন্য কঠিন ছিল।

দ্য বেল, বলল পেইন্টার।

 একদম। ওই সময়ের অধিকাংশ বিজ্ঞানীর মনের চাওয়া পূরণ করেছিল সেটা।

 কী?

শ্বাস ফেলে কালাউসের দিকে পেছন ফিরে তাকালেন অ্যানা। পারফেকশন। নিখুঁত, সর্বোৎকৃষ্ট। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তিনি। ব্যক্তিগত দুঃখে ডুবে গেছেন।

সামনের প্যাসেজ অবশেষে শেষ হলো। লোহা ও কাঠ দিয়ে তৈরি এক জোড়া বিশালাকার দরজা উদয় হলো সামনে। দরজার ওপাশে একটি বেহালদশাঅলা সিঁড়ি প্যাচিয়ে প্যাচিয়ে পাহাড়ের আরও গভীরে নেমে গেছে। সিঁড়িটি পাথর কেটে বানানো হলেও গাছের গুঁড়ির মতো মোটা স্টিলের একটি পিলারকে কেন্দ্র করে নেমে গেছে। নিচে। এই সিঁড়ি দিয়েই ওদের নামতে হবে।

উপরে তাকাল পেইন্টার। পিলারটি ছাদ পর্যন্ত ওঠার পর সেটা ছাড়িয়ে আর উপরে চলে গেছে… পাহাড় ফুড়ে গেছে সম্ভবত। বজ্রনিরোধক রঙ, ভাবল পেইন্টার। ও অনুভব করল বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে গেছে। ধোয়ার চেয়ে এখন অক্সিজেন বেশি।

পেইন্টারকে তাকাতে দেখে বললেন অ্যানা, প্রয়োজনের অতিরিক্ত এনার্জী আমরা এই শ্যাফট দিয়ে পাহাড়ের বাইরে পাঠিয়ে দেই। উপরের দিকে নির্দেশ করে দেখালেন।

 ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল পেইন্টার। এই অঞ্চল থেকে ভূতুড়ে আলো আকাশে ওঠে। এটা কী সেই আলোর উৎস? আলো আর অসুস্থতা হয়তো এই একই উৎস থেকে নির্গত হয়েছে?

 নিজের রাগে লাগাম টেনে সিঁড়ির দিকে মনোযোগ দিল পেইন্টার। ওর মাখার ভেতরে আবার দপদপ করে শুরু করায় কেমন যেন দুলে উঠতে চাইল সবকিছু। মনোযোগ অন্যদিকে সরাতে ও কথা বলতে শুরু করল। দ্য বেল-এর কাহিনিতে ফিরে যাই। তারপর?

চিন্তা থেকে বেরিয়ে এলেন অ্যানা। প্রথমে কেউ কিছুই জানত না। রিসার্চের মাধ্যমে বেরিয়ে এলো এটা একধরনের এনার্জী সোর্স। কেউ কেউ ভাবল এটা হয়তো কোনো একধরনের টাইম মেশিন হবে। আর সেজন্যই হয়তো এটার কোড নেম দেয়া হয়েছিল ক্রোনস।

টাইম ট্রাভেল? প্রশ্ন করল পেইন্টার।

আপনাকে মনে রাখতে হবে, অ্যানা বললেন, তথ্য-প্রযুক্তির দিক দিয়ে নাৎসিরা অন্য সব জাতি থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। আর সেকারণেই জার্মানি থেকে পাইকারী হারে টেকনোলজি চুরির হিড়িক পড়েছিল যুদ্ধের পর। একটু পেছন থেকে বলি… শতাব্দীর শুরুর দিকে দুটো তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে বেশ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। এক, দ্য থিওরি অব রিলেটিভিটি অর্থাৎ আপেক্ষিক তত্ত্ব। দুই, দ্য কোয়ান্টাম থিওরি। শুরু হয়ে গেল এই দুই থিওরি নিয়ে ঠেলাঠেলি। এমনকি আপেক্ষিক তত্ত্বের জনক আইনস্টাইন স্বয়ং বলেছিলেন, এই দুই থিওরি পরস্পরবিরোধী। থিওরি দুটো পুরো বিজ্ঞান জগৎকে দুই ভাগে ভাগ করে দেয়। আর আপনি খুব ভাল করেই জানেন পশ্চিমা বিশ্ব কোন থিওরিকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিল।

আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব।

অ্যানা মাথা নাড়লেন। সেই থিওরি থেকে অ্যাটম বোম্ব ও নিউক্লিয়ার এনার্জীর মতো জিনিসের জন্ম হয়েছিল। ম্যানহ্যাটেন প্রজেক্ট-এ পরিণত হয়ে গেল পুরো পৃথিবী। সবকিছুর পেছনে ছিল আইনস্টাইনের সেই থিওরি। এদিকে ভিন্ন পথ বেছে নিল নাসিরা। তাঁরাও তাদের নিজস্ব ম্যানহ্যাটেন প্রজেক্ট তৈরি করল। তবে সেটার ভিত্তি হলো কোয়ান্টাম থিওরি।

ভিন্ন পথ, ভিন্ন থিওরি বেছে নেয়ার কারণ জানতে চাইল লিসা।

খুব সহজ কারণ। অ্যানা ওর দিকে ফিরলেন। কারণ আইনস্টাইন ইহুদি ছিলেন।

কী?

ওই সময়কার পরিস্থিতির কথা মনে করে দেখুন। আইনস্টাইন ইহুদি ছিলেন। তাই নাৎসিদের চোখে তার আবিষ্কারের গুরুত্বও ছিল কম। আর সেজন্য নাৎসিরা একজন খাঁটি জার্মান বিজ্ঞানীর কাজের কদর করতে শুরু করল। জার্মান বিজ্ঞানীর আবিষ্কার অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাদের কাছে। ওয়ার্নার হেইন্সবার্গ ও এরউইন স্করডইঙ্গার-এর মতো বিজ্ঞানীদের কর্মের দিকে মনোযোগ দিল। বিশেষ করে নজর দিল ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক-এর দিকে। কারণ ম্যাক্স হলেন কোয়ান্টাম থিওরির জনক। তো নাৎসিরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ওপর ভিত্তি করে হাতে-কলমে কাজ করতে শুরু করল, তাদের কাজ এই আজকের দিনে এসেও ব্যাপক মর্যাদা লাভ করেছে। নাৎসি বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস ছিল কোয়ান্টাম মডেল ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শক্তির উৎসের মুখে ছিপি আটকে দেয়া সম্ভব। আর তাদের সেই চিন্তাধারা সবেমাত্র কিছুদিন হলো মানুষজন অনুধাবন করতে পারছে। আজকের আধুনিক বিজ্ঞান ওটার নাম দিয়েছে জিরো পয়েন্ট এনার্জী।

জিরো পয়েন্ট পেইন্টারের দিকে তাকাল লিসা।

মাথা নেড়ে সায় দিল পেইন্টার। বিজ্ঞানের এই অংশ ওর জানা আছে। যখন কোনো বস্তুকে শূন্য ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের চেয়ে আর ৩ হাজার ডিগ্রি নিচে ঠাণ্ডা করা হয়, ওটার ভেতরে থাকা সকল পরমাণুর নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায় তখন। সবকিছু একদম স্থির। দ্য জিরো পয়েন্ট অব নেচার। কিন্তু তখনও এনার্জী বা শক্তি থাকে। একটা ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন থাকে যেটা থাকার কথা নয়। প্রচলিত থিওরিগুলো দিয়ে ওই এনার্জীর উপস্থিতির ব্যাখ্যা দেয়া অসম্ভব।

কিন্তু কোয়ান্টাম থিওরি দিয়ে সম্ভব, দৃঢ় কণ্ঠে বললেন না। পরমাণুগুলোকে এই থিওরি নড়াচড়া করতে দেয়, এমনকি একদম ঠাণ্ডা স্থবির তাপমাত্রাতেও।

সেটা কীভাবে সম্ভব? লিসা জানতে চাইল।

 অ্যাবসুলেট জিরো অর্থাৎ পরম শূন্য তাপমাত্রায় পরমাণুগুলো উপরে, নিচে, ডানে কিংবা বামে নড়তে পারে না ঠিকই কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুসারে ওগুলো নিজ অবস্থানে থেকে গায়েব হয়ে গিয়ে এনার্জী বিকিরণ করতে পারে। ওটাকে জিরো পয়েন্ট এনার্জী বলা হয়।

গায়েব হয়ে গিয়ে এনার্জী বিকিরণ করতে পারে? মনে হচ্ছে লিসা একটু সন্তুষ্ট।

বলার দায়িত্ব নিল পেইন্টার। কোয়ান্টাম ফিজিক্স একটু উদ্ভট গোছের। সাদা চোখে এটাকে পাগলামো বলে মনে হলেও এনার্জী কিন্তু সত্যি সত্যিই পাওয়া যায়। ল্যাবে রেকর্ডও করা হয়েছে। পুরো পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা সবকিছুর ভেতরে এই এনার্জীর উৎস বসাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এটার মাধ্যমে অফুরন্ত, অসীম শক্তি বা পাওয়ার পাওয়া যেতে পারে।

মাথা নাড়লেন অ্যানা। আর নাৎসিরা আপনাদের ম্যানহ্যাটেন প্রজেক্টের বিপরীতে এই এনার্জী নিয়েই কাজ করতো।

লিসার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। শক্তির অফুরন্ত উৎস। যদি এটা আবিষ্কার করা। সম্ভব হলে তো তাহলে যুদ্ধের মোড়ই ঘুরে যেত।

এক হাত উঁচু করে লিসাকে শুধরে দিলেন অ্যানা। কে বলল তারা সেটা আবিষ্কার করতে পারেনি? ইতিহাসে আছে যুদ্ধের শেষ কয়েক মাসে নাৎসিরা বেশ ভাল এগোচ্ছিল। তাদের দুটো প্রজেক্ট ছিল। নাম : Feuerball আর Kuselblitz, এগুলো সম্পর্কে বিশ্লেষণধর্মী রেকর্ড ব্রিটিশ টি-ফোর্সে পাওয়া যেতে পারে। তবে আবিষ্কারটা হতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। ফ্যাসিলিতে বোমা হামলা, বিজ্ঞানীদের খুন, রিসার্চ চুরিসহ নানান ঘটনার পর যতটুকু বাকি ছিল সেগুলো বিভিন্ন জাতির ডিপ ব্ল্যাক প্রজেক্টের করাল গ্রাসে হারিয়ে গেছে।

কিন্তু দ্য বেল তো হারায়নি, বলল পেইন্টার। আলোচনাকে মূল প্রসঙ্গে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। ও এই কথাবার্তাকে অযথা ভিন্ন প্রসঙ্গে যেতে দেবে না।

ঠিক, দ্য বেল হারায়নি। অ্যানা সায় দিলেন। আমার দাদু ক্রোনস প্রজেক্টের মূল জিনিস নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি প্রজেক্টের নতুন নাম রেখেছিলেন: Schwarze Sonne.

অর্থাৎ-কালো সূর্য, জার্মান থেকে অনুবাদ করল পেইন্টার।

 Sehr gut.

 কিন্তু এই বেল জিনিসটা কী? ক্রো জানতে চাইল। কী করে এটা?

এটাই আপনাকে অসুস্থ করে দিয়েছে, বললেন না। আপনার কোয়ান্টাম লেভেলে ক্ষতিসাধন করেছে ফলে কোনো ওষুধ আর ওখানে পৌঁছে আরোগ্য এনে দিতে পারবে না।

আর একটু হলেই হোঁচট খাচ্ছিল পেইন্টার। কথাটুকু হজম করতে কিছু সময় দরকার। কোয়ান্টাম লেভেলে ক্ষতিসাধন করেছে। এর মানে কী?

সিঁড়ির শেষ ধাপে চলে এসেছে ওরা। কড়িকাঠ দিয়ে বেষ্টনী দেয়া। এছাড়াও দুজন রাইফেলধারী গার্ডও আছে। অবাক হয়ে ক্রো খেয়াল করল, ছাদের দিকে থাকা সর্বশেষ বাঁকের পাথর কেমন যেন দগ্ধ হয়ে রয়েছে।

 গুহার মতো দেখতে ভল্টের পেছনের একদম শেষ পর্যন্ত পেইন্টারের দৃষ্টি পৌঁছুল না তবে ও ঠিকই তাপমাত্রা অনুভব করতে পারল। এখানকার প্রত্যেকটি তল কেমন যেন কালচে হয়ে আছে। একসারি বকানন-কুঁজানো দেহ ঢেকে রাখা হয়েছে তেরপল দিয়ে। সবকটি মৃত।

একটু আগে হয়ে যাওয়া বিস্ফোরণ তাহলে এখানেই হয়েছিল।

 বিস্ফোরণ এলাকার ভেতর থেকে ছাইয়ে কালো হয়ে যাওয়া একজনকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। কালো হয়ে গেলেও তাকে বেশ ভাল করেই চেনা যাচ্ছে। গানথার। এই বিশালদেহি লোক সন্ন্যাসীদের মঠে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে তারা তাদের কর্ম ফল পেতে শুরু করেছে।

বিস্ফোরণের বদলে বিস্ফোরণ।

বেষ্টনী পার হলো গানথার। অ্যানা ও কালাউস ওর সাথে যোগ দিল। গানথার আর কালাউসকে পাশাপাশি দেখে এই দুই বিশালদেহির মধ্যে মিল খুঁজে পেল পেইন্টার। শারীরিক মিল নয়, দুজনের কঠিন মনোভাব আর বিদেশিভাবে মিল আছে।

কালাউসের দিকে মাথা নাড়ল গানথার।

কিন্তু কালাউস কোনো পাত্তা দিল না।

গানখারের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে হড়বড় করে জার্মান ভাষায় কথা বলছেন অ্যানা। পেইন্টার অতগুলো কথার ভেতর থেকে মাত্র একটি শব্দ বুঝতে পারল। জার্মান আর ইংরেজিতে শব্দটির মানে একই।

স্যাবোটাজ।

আচ্ছা, তাহলে এই ক্যাসলের সবকিছু ঠিকঠাকভাবে চলছে না। কোনো বিশ্বাসঘাতক আছে নাকি? যদি থাকে তাহলে কে সে? কী চায়? উদ্দেশ্য কী? সে কী ওদের বন্ধু নাকি শত্রু?

পেইন্টারের দিকে তাকাল গানথার। তার ঠোঁট নড়ছে, কিন্তু ও কী বলছে সেটা পেইন্টার ধরতে পারল না। মাথা নাড়লেন অ্যানা, গানরের কথার সাথে একমত নন। গানথার চোখ সরু করলেও শেষমেশ মাথা ঝাঁকাল।

পেইন্টার জানে, ওকে আশ্বাস দেয়া হচ্ছে।

শেষবারের মতো ক্রোর ওপর একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে যেদিক থেকে এসেছিল আবার সেদিকে চলে গেল গানথার।

 আমি আপনাদেরকে এটাই দেখানোর জন্য নিয়ে এসেছি। ধ্বংসলীলার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন অ্যানা।

দ্য বেল, ক্রো বলল।

 ধ্বংস হয়ে গেছে। স্যাবোটাজ করে ধ্বংস করে দিয়েছে।

ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকাল লিসা। এই বেল-ই তাহলে পেইন্টারকে অসুস্থ করেছে।

এবং সেই অসুস্থ থেকে সুস্থ হওয়ার একমাত্র উপায় ছিল এটা।

পেইন্টার ধ্বংসস্তূপ পর্যবেক্ষণ করল।

আপনাদের কাছে বেল-এর কোনো প্রতিলিপি কিংবা কপি আছে? জানতে চাইল লিসা। কিংবা আপনারা কি আরেকটা বেল বানাতে পারবেন?

অ্যানা মাথা নাড়লেন। গুরুত্বপূর্ণ একটা উপাদানের কোনো কপি পাওয়া সম্ভব নয়। জেরাম-৫২৫। আজ এই ৬০ বছর পর এসেও আমরা ওটার কোনো কপি কিংবা নতুন করে তৈরি করতে পারিনি।

তাহলে বেল নেই তো চিকিৎসাও নেই, বলল ক্রো।

 কিন্তু একটা সুযোগ হয়তো আছে… যদি আমরা একে অপরকে সাহায্য করি। অ্যানা তার একটি হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমরা যদি একসাথে কাজ করি… তাহলে আমি প্রতিশ্রুতি রাখব।

ক্রো তার সাথে হাত মেলালেও এখন মনে মনে দ্বিধায় ভুগছে। এখানে কেমন যেন একধরনের কৌশল, চাতুরীর গন্ধ পাচ্ছে ও। কিছু একটা আছে যেটা অ্যানা ওকে এখনও বলেনি। তার সব কথা… ব্যাখ্যাগুলো যেন ওদের ভুল দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ভ্রান্ত করছে। আর ওকে-ই বা এখন ডিল করার জন্য প্রস্তাব দেয়া হলো কেন?

তারপর মনে পড়ল ওর।

ও জানে।

 দুর্ঘটনা… বলল ক্রো।

ওর হাতের ভেতরে থাকা অ্যানার আঙুল কেঁপে উঠল।

ওটা তাহলে দুর্ঘটনা ছিল না, তাই তো? মাথার ভেতরে ঘুরতে থাকা কথাগুলো মনে করল ক্রো।

স্যাবোটাজও ছিল। মাথা নাড়লেন অ্যানা। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম ব্যাপারটা দুর্ঘটনা। আমরা বিভিন্ন সময় তরঙ্গ সম্পর্কিত সমস্যায় পড়ে থাকি। বেল-এর আউটপুট হিসেবে সেগুলোকে বের করে দেই। খুব বড় কিছু নয়। এনার্জী বাইরে বের করে দেয়ার ফলে কিছু রোগ হয়। কিছু মৃত্যু হয়, এই তো।

মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল পেইন্টার, কিন্তু নিজেকে সামলে নিল। তেমন কিছু নয়। রোগ আর মৃত্যুগুলোর কারণে আং গেলু আন্তর্জান্তিক পরিমণ্ডলে ফোন করেছিলেন, যার ফলে পেইন্টার আজ এখানে।

অ্যানা বলে যাচ্ছেন, কিন্তু কয়েক রাত আগে কেউ একজন আমাদের রুটিন সেটিংস বদলে বেল-এর আউটপুটের মান অনেক বাড়িয়ে দেয়।

আর সেটার প্রভাব পড়ে মঠ ও গ্রামের ওপর।

 ঠিক বলেছেন।

অ্যানার হাত শক্ত করে ধরল ক্রো। মনে হলো তিনি বোধহয় হাত ছাড়িয়ে নিতে চাচ্ছেন। কিন্তু পেইন্টার ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয়। অ্যানা পুরো বিষয়টি খোলাসা করা এড়িয়ে যেতে চাইছেন। কিন্তু পেইন্টারও জানে আসল ঘটনা ওকে জানতেই হবে। তাহলে একে অপরকে সাহায্য করার প্রস্তাবটি সম্পর্কেও পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে।

মঠের সন্ন্যাসী আর গ্রামবাসীরাই শুধু আক্রান্ত হয়নি, বলল পেইন্টার। তাদের সাথে এখানকার সবাই আক্রান্ত হয়েছে। আপনারা সবাই আমার মতো অসুস্থ। মঠের মতো অত গভীর লক্ষণ প্রকাশ পায়নি, তবে আপনারাও আমার মতো ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে এগোচ্ছেন।

চোখ সরু করলেন না। ক্রোকে পর্যবেক্ষণ করে মেপে নিলেন কতখানি বলবেন… অবশেষে মাথা নাড়লেন তিনি। আমরা এখানে… কোনমতে নিরাপদ আছি। বেল-এর ক্ষতিকারক রেডিয়েশনের অধিকাংশই শ্যাফট দিয়ে উপরে পাঠিয়ে বাইরে বের করে দেয়া হয়েছে।

পাহাড়ের উপরে ভূতুড়ে আলোর কথা মনে পড়ল পেইন্টারের। নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্য জার্মানিরা বিপজ্জনক রেডিয়েশন পুরো এলাকায় ছড়িয়ে দিয়েছে। যদিও এখানকার বিজ্ঞানীরা এত চেষ্টা করেও পুরোপুরি রক্ষা পায়নি।

কোনোরকম কুণ্ঠা ও অপরাধবোধে না ভুগে অ্যানা বললেন। আমরা সবাই এখন একই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত।

হাতে অন্যকোনো রাস্তা খোলা আছে কিনা ভাবল পেইন্টার। নেই। দুই পক্ষের কেউই কাউকে বিশ্বাস করছে না, কিন্তু দুই পক্ষ এখন একই নৌকার যাত্রী। সে হিসেবে মিলেমিশে থাকাই ভাল। অ্যানার হাত ঝাঁকিয়ে দিয়ে ডিল পাকা করল ক্রো। সিগমা ও নাৎসি এখন একদল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *