অমাবস্যার রাতে নীলগঞ্জ বাজারে চুরি হবে, এটা জানা কথা। থানাওয়ালা সে জন্যেই অমাবস্যার রাতে নীলগঞ্জ বাজারে একজন পুলিশ রাখে। তবু চুরি হয়। বাজার সমিতির দারোয়ানের নাকের ডগায় চুরি হয়। দবির মিয়া অতিরিক্ত সাবধানী। সে বাজার সমিতির দারোয়ানের ওপর ভরসা না করে এক জন লোক রেখেছে, যে রাতে দোকানের ঝাঁপ ফেলে সজাগ ঘুম ঘুমায়। কিন্তু শেষরক্ষা হয় নি। গত রাতে দবির মিয়ার দোকানে চুরি হয়েছে। ক্যাশবাক্সের কোনো টাকা নিতে পারে নি, কারণ সেখানে কোনো টাকা ছিল না। দুই থান ছিটের কাপড়, দশ গজ লংক্ৰথ। এবং পপলিনের কাটা পিসগুলো নিয়ে গেছে। ক্যাশবাক্সের পাশে গাদা করা ছিল নীল এবং সাদা রঙের মশারি। সবগুলো কাঁচি দিয়ে কুচি কুচি করে কেটেছে।
দবির মিয়া দোকানে এসে কেঁদে ফেলল। ছাপ্পান্নটা নতুন মশারি পরশু দিন ময়মনসিংহ থেকে এসেছে। নাইটগার্ডকে দেখা গেল পান খেয়ে মুখ লাল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং যে-ই আসছে তাকেই মহা উৎসাহে ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ দিচ্ছে, ছাপ্পান্নটা মশারি, নটা শাড়ি, পনেরটা লুঙ্গি আর আপনের কাপড়ের থান সব মিলাইয়া…….
দবির মিয়া প্রচণ্ড একটা চড় কষিয়ে দিল নাইটগার্ডের গালে। পুলিশ এল বেলা বারটার দিকে।
দবির মিয়া তখন দোকানে ছিল না। পুলিশ খানিক জিজ্ঞাসাবাদ করে নাইটগার্ডের কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় নিয়ে গেল। নাইটগার্ডটির বিস্ময়ের সীমা রইল না। এমন একটা কিছু হতে পারে, তা তার ধারণার বাইরে ছিল। সে রাস্তায় যার সঙ্গে দেখা হল তাকেই ভাঙা গলায় বলতে লাগল, দবির চাচাজীরে এটু খবর দেন। আপনের পাওডাও ধরি।
বিকেলের মধ্যে নাইটগার্ড আধমরা হয়ে গেল। রুলের বাড়ি খেয়ে তার নিচের পার্টির একটি দাঁত নড়ে গেল। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্যে এক পর্যায়ে তার অণ্ডকোষ চেপে ধরায় সে তীব্র ব্যথায় বমি করে ফেলল এবং ক্ষীণ স্বরে অর্থহীন কথাবার্তা বলতে লাগল। জমাদার সাহেব বললেন, কি, চুরি করেছিল?
জ্বি।
একাই করেছি, না আরো লোক ছিল?
ছিল। কে কে ছিল?
জ্বি ছিল।
হারামজাদা, ছিল কে?
জ্বি?
তোর সাথে আর কে ছিল?
কয় জন ছিল?
স্যার স্মরণ নাই।
আচ্ছা, অরণের ব্যবস্থা করি, দেখ।
সন্ধ্যাবেলায় দবির মিয়া এসে দেখল থানা হাজতে এক কোণায় কুণ্ডলী পাকিয়ে সে শুয়ে আছে। দবির মিয়া ডাকল, এ্যাই মনসুর, এ্যাই।
মনসুর শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল, কিছু বলল না।
মনসুর ভয় নাই, তরে নিতে আইছি, উইঠা দাঁড়া।
মনসুর উঠে দাঁড়াল না।
হাজতের জন্য প্রান্তে লম্বা দাড়িওয়ালা যে-লোকটা দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছিল সে বলল, এই শালার পুতে কাপড়চোপড় নষ্ট কইরা দিছে, গন্ধে থাকন দায়।
দবির মিয়াও তখন একটি তীব্র কটু গন্ধ পেল। ওসি সাহেব এলেন রাত নটায়। দবির মিয়া মনসুরকে ছাড়িয়ে নিতে এসছে শুনে তিনি গম্ভীর হয়ে পড়লেন।
ডেফিনিট চার্জ আছে, ওকে ছাড়াবেন কি?
কী চার্জ আছে?
চুরির, আর কিসের? শক্ত প্যাদানি দিলে আগের চুরিগুলোরও খোঁজ পাওয়া যাবে, বুঝলেন?
আগেরগুলোও তার করা নাকি? কী যে বলেন ওসি সাহেব বোকাসোকা মানুষ।
আরে রাখেন রাখেন। ধোলাই দিলেই দেখবেন নাম-ধাম বের হয়ে যাবে। খোলাইয়ের মতো জিনিস আছে?
দবির মিয়া ফিরে আসার সময় দারোগা সাহেব অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললেন, শুনলাম আপনার ভাই ছাড়া পেয়েছে।
ভাই না। ছোট শ্যালক।
একই কথা। সে আপনার সঙ্গেই থাকবে?
জ্বি।
ভালো। খেয়ালটেয়াল রাখবেন। জেলখানা জায়গাটা খারাপ। অসৎসঙ্গ। এক বার জেলে গেলে অনেক রকম ফন্দি-ফিকির লোকজন শেখে। বুঝলেন?
দবির মিয়া কিছু বলল না। দারোগা সাহেব একটা দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে কানের ময়লা আনতে আনতে প্রসঙ্গ শেষ করলেন, খেয়ালটেয়াল রাখবেন, বুঝলেন। দিনকাল খারাপ।
মনসুরের ব্যাপারটা কী করবেন?
দেখি।
বেচারা নির্দোষ।
দেখি।
দবির মিয়া অত্যন্ত মনমরা হয়ে দোকানে ফিরে এল। দোকান খোলার পরপর আর একটি খারাপ খবর পেল। ডালের দাম পড়ে গেছে, সরসটা দু শ তিন টাকা দরে বিকোচ্ছে। চৌধুরী সাহেব সত্তর মন ডাল কিনে রেখেছেন। সেগুলো নাকি ছেড়ে দেবেন, এরকম গুজব। চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
চৌধুরী সাহেব বাজারের মসজিদে এশার নামাজ পড়তে আসেন। কিন্তু নামাজ রাত আটটায় শেষ হয়ে গেছে। আগে আসতে পারলে হত। দবির মিয়া তবু মসজিদের সামনে দিয়ে এক পাক হাঁটল।
মসজিদে ওয়াজ হচ্ছে। মৌলভী আবু নসর সাহেব টেনে টেনে বলছেন, এই দুনিয়াদারী অল্পদিনের। হাশরের ময়দানে আল্লাহ্ পাক সব মুর্দা জিলা করে তুলবেন। ভাইসব, কারো গায়ে একটা সূতা পর্যন্ত থাকবে না। পুরুষ এবং স্ত্রী উলঙ্গ অবস্থায় উঠে আসবে ভাইসব। কিন্তু কেউ কারো লজ্জাস্থান দেখবে না। তখন সূর্য থাকবে আধ হাত মাথার উপর। ভাইসব জিনিসটা খেয়াল রাখবেন……