অভিযান-পথে ইসলাম
মধ্যযুগের প্রথমভাগে দুইটি বিরাট ঘটনা লক্ষীভূত হয়। একটি হচ্ছে, টিউটন জাতির দেশ ত্যাগ করে অন্যত্র গমন–যার ফলে প্রাচীন রোমক সাম্রাজ্যে ফাটল ধরে। অন্যটি হচ্ছে, আরব জাতির বিজয় অভিযান। এ অভিযানের ফলে একদিকে পারস্য-সাম্রাজ্য খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়ল, অন্যদিকে বাইজেন্টাইন শক্তির ভিত্তিমূল পর্যন্ত কেঁপে উঠল। যদি খৃষ্টীয় সপ্তম শব্দাব্দীর প্রথম-তৃতীয়াংশে কোন দুঃসাহসী ভবিষ্যদ্বক্তা ঘোষণা করত যে, অল্পাধিক একযুগ-কাল মধ্যে এতকালের এই অল্প পরিচিত বর্বর আরবের বুক হতে এক অপূর্ব শক্তি উদ্ভূত হয়ে তৎকালীন জগতের দুইটি প্রধান সাম্রাজ্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেতে উঠবে এবং পরিণামে সে শক্তি সাসানীয় সাম্রাজ্যের হবে উত্তরাধিকারী আর বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য হতে তার শস্য-শ্যামল অঞ্চলগুলি কেড়ে নিবে, তবে নিঃসন্দেহে সবাই তাকে পাগল বলত। অথচ ঠিক এই-ই ঘটেছিল।
হযরত মুহম্মদ (সঃ) মৃত্যুর পর যেন কোন যাদু-মন্ত্র বলে উষর আরব হয়ে উঠল–বীরদের সূতিকাগার : সেও এমন বীর সংখ্যা ও দক্ষতায় যাদের সমকক্ষ অন্যত্র পাওয়া ছিল দুষ্কর। ইরাক, সিরিয়া এবং মিসরের বুকে খালিদ বিন-ওয়ালীদ এবং আমর ইবনুল আস যে অসাধারণ রণ-দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, তাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বিজয় অভিযানের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। আলেকজান্ডার, হানিবল বা নেপোলিয়নের রণ-চাতুর্যের তুলনায় তা কোন অংশেই হীন নয়।
বাইজেন্টাইন ও সাসানীয় সাম্রাজ্য এ সময় সত্যই হীনবল হয়ে পড়েছিল। বহুকাল পর্যন্ত তারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহে মত্ত ছিল। যুদ্ধের রসদ জোগানোর জন্যে উভয় রাজ্যেই কর-ভার বৃদ্ধি হয়েছিল। ক্রমবর্ধিত কর-ভারে নিপীড়িত প্ৰজামণ্ডলীর মনে রাজ-ভক্তি ক্রমে শিথিল হয়ে পড়েছিল। আরব জাতির একাংশ আগেই সিরিয়া ও মেসোপটেমীয়ায় বসতি স্থাপন করেছিল। খৃস্টান ধর্মে দলাদলির অন্ত ছিল না; ধর্মের নামে অহরহ অত্যাচার হত। এই সব অবস্থা মিলে আরব জাতির বিজয় অভিযানকে অমন অপূর্ব সাফল্যমণ্ডিত করেছিল। সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের সিমাইট ও মিসরের হেমাইট বংশীয় বাসিন্দাগণ তাদের ঘৃণ্য, জালিম পরদেশী প্রভুদের চেয়ে নবাগত আরবগণকে রক্তের দিক দিয়ে নিকটতর জ্ঞাতি মনে করত। বাস্তবিক, মুসলিম-বিজয় দ্বারা প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্য তার পূর্ব-প্রভুত্বই পুনরুদ্ধার করেছিল। ইসলামের প্রেরণায় মধ্যপ্রাচ্যের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং হাজার বছরব্যাপী পাশ্চাত্য অধীনতায় থাকার পর পুনরায় আত্ম-প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। এ ছাড়া, তাদের নব বিজেতারা যে খাজনা ধার্য করেছিল, পরিমাণে তা তাদের পূর্ব-প্রভুদের চেয়ে কম ছিল; আর তারা এ নব-বিধানের অধীনে অধিকতর স্বাধীনতার সঙ্গে তাদের ধর্ম ও আচার পালন করতে পারত। আরবগণ নিজেরা এক নব–জীবনের স্পন্দনে উদ্বেলিত ছিল? বিজয় লাভের জন্য তাদের সংকল্প ছিল অটল। আর তাদের নতুন ধর্ম তাদের যে শিক্ষা দিয়েছিল, তার ফলে তারা মৃত্যুকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে অসম সাহসী হয়ে উঠেছিল।
আরবদের এই যে অত্যদ্ভূত সাফল্য, এর এক মস্ত কারণ ছিল তাদের বিশিষ্ট রণকৌশল। পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার বৃক্ষহীন সমতল প্রান্তরের জন্য এই রণ-নীতি বিশেষ উপযোগী ছিল। এ রণ-নীতির মূলকথা ছিল, যুদ্ধে অশ্ব বাহিনী ও উট-বাহিনী ব্যবহার। এ কাজে রোমকরা কোন কালেই দক্ষতা অর্জন করে নাই। সৈন্যদলকে পাঁচভাগে বিভক্ত করা হত কেন্দ্র, দুই বাহু, অগ্ররক্ষী ও পশ্চাত্ৰক্ষী। অশ্বারোহীরা দাঁড়াত দুই বাহুতে। সৈন্য-সংস্থাপন ব্যাপারে কওমী ঐক্য রক্ষা করা হত। প্রত্যেক কওমের স্বতন্ত্র ঝাণ্ডা : বর্শার আগায় একখণ্ড কাপড়। কওমের যে সবচেয়ে সাহসী যোদ্ধা, সে-ই এ পতাকা বহন করত। শোনা যায়, মহানবীর পতাকায় ঈগল-চিহ্ন ছিল। পদাতিকরা প্রধানতঃ তীর, ধনুক ও ফিঙ্গা ব্যবহার করত; কখনো-বা তারা ঢাল-তলোয়ারও ব্যবহার করত। বর্শার ব্যবহার প্রবর্তিত হয় পরে –আবিসিনীয়া হতে। অশ্বারোহীদের প্রধান অস্ত্র ছিল বর্শা; তার সঙ্গে থাকত তীর আর ধুনক : এই মিলে ছিল তাদের জাতীয় অস্ত্র। জেরা ও ঢাল ছিল এদের বর্ম। বাইজেন্টাইনদের বর্মের চেয়ে এ বর্ম ওজনে হালকা ছিল।
প্রাচীনকালের রীতি মোতাবেক ময়দানে সৈন্যরা সারিবদ্ধ অবস্থায় ঘন হয়ে দাঁড়াত । আসল লড়াই শুরু হওয়ার আগে দ্বন্দ্ব যুদ্ধ শুরু হত। বিশেষ বিশেষ যোদ্ধারা দল ছেড়ে ময়দানের মাঝখানে এসে প্রতিপক্ষকে যুদ্ধে আহ্বান করত। পারসিক বা বাইজেন্টাইন উভয় রাজ্যের যোদ্ধাদের চেয়ে মুসলিম যোদ্ধাদের মাসোহারার হার উচ্চতর ছিল। এ ছাড়া তারা গণিমতে হিস্যা পেত। লড়াই আল্লাহর চোখে মহত্তম পেশা ছিল তো বটেই, তাছাড়া ইহা সবচেয়ে লাভজনক পেশাও ছিল। মুসলিম আরব-বাহিনীর শক্তির উৎস তাদের উন্নততর অস্ত্র-শস্ত্রও ছিল না, দৃঢ়তার সংগঠন প্রণালীও ছিল না; তাদের সে শক্তির উৎসমূলে ছিল তাদের অটল আত্মবিশ্বাস। আর এই আত্মবিশ্বাসকে দৃঢ়তর করেছিল তাদের দুর্জয় ঈমান। মরু-জীবন সুলভ অপূর্ব সহনশক্তি এবং উটের সাহায্যে অত্যন্ত দ্রুত চলাচল–এ দুটিও তাদের শক্তির অন্যতম কারণ ছিল।
আরব ঐতিহাসিকেরা ইসলামের অগ্রগমণকে প্রধানতঃ ধর্মীয় ব্যাপার হিসেবেই বিচার করেছেন। এর পেছনে যে-সব অর্থনৈতিক কারণ সক্রিয় ছিল, তার উপর তাঁরা মোটেই জোর দেন নাই। অন্যপক্ষে, অনেক খৃস্টান লেখক এক অবিশ্বাস্য কাহিনী প্রচার করে বলেছেন যে, আরবীয় বিজেতারা বিজিতদের সামনে তুলে ধরতেন দুই বস্তু হয় কোরআন, না হয় কৃপাণ। আরব উপদ্বীপের বাইরে–বিশেষ করে ইহুদী ও খৃষ্টানদের বেলায়, বিজেতাদের পক্ষ হতে আরো একটি লাভজনক পথ খুলে দেবার ছিল এবং সেটি হল-খাজনা। যুদ্ধ কর…কিতাবীদের সঙ্গে, যে পর্যন্ত তারা নতমস্তকে স্ব-হস্তে খাজনা দেয় (৯ : ২৯)। আরব যোদ্ধাদের ইসলাম একটি যুদ্ধ-ধ্বনি দিয়েছিল, এ কথাও সত্য। যে বিচ্ছিন্ন জনগণ ইতিপূর্বে কোন কালে ঐক্যবদ্ধ হয় নাই, ইসলাম তাদের ঐক্য দান করেছিল। তাদের অদ্ভুত প্রাণশক্তিও অনেকাংশে ইসলামেরই অবদান ছিল। কিন্তু ইসলামের বিজয়াবলীর কারণ নির্ণয়ের জন্য এসব অবস্থা যথেষ্ট নয়। বিজয়ী-বাহিনীর বেশীর ভাগ সৈন্যই বেদুঈন সমাজ হতে সংগৃহীত হত। বেদুঈনদের আর্থিক দুর্গতির অন্ত ছিল না। কাজেই বেদুঈন যোদ্ধাদল যে দিগ্বিজয়ে বের হত, তার কারণ ধর্মোন্মত্ততা ছিল না; তার কারণ ছিল, তাদের উষর বাসভূমির ওপারের উত্তর অঞ্চলের শস্য-শ্যামলা ভূমি অধিকারের অর্থনৈতিক তাগিদ। বেহেশতের স্বপ্ন অনেক যোদ্ধাকে নিঃসন্দেহ রকমে অনুপ্রাণিত করেছিল; কিন্তু সভ্যতায় অগ্রসর সমৃদ্ধিশালী অঞ্চলের বিলাস বৈভবের আকাঙ্ক্ষাও বহুজনকে প্রলুব্ধ করেছিল। যুগ যুদান্তর হতে মরুর ঊষর বক্ষ নির্গত বুভুক্ষ জনগণ ধীরে ধীরে তাদের পার্শ্বস্থ ‘উর্বর-হেলাল’ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছিল। ইসলামের বিস্তার উপলক্ষে সিমাইটদের দেশান্তর গমনের শেষ পর্যায় এভাবে পূর্ণ হল।
এ আমলের ঐতিহাসিকেরা কেউই ইসলামের বিজয় সংক্রান্ত ঘটনাবলীকে স্বাধীনভাবে বিচার করেন নাই–তাঁদের পরবর্তী বিকাশের আলোকে বিচার করেছেন। তারা বলতে চান, বিজয়ের অভিযানগুলি খোলাফা-এ রাশেদীন–বিশেষ করে আবু বকর ও ওমরের সুচিন্তিত পরিকল্পনা মোতাবেক পরিচালিত হয়েছিল। যাদের কার্যকালে বিরাট ঘটনাবলী সংঘটিত হয়েছে, তারা সে ঘটনাবলীর প্রবাহ-পথ পূর্ব হতেই সুস্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন, এরূপ নজীর ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া কঠিন। ইসলামের প্রভাবে এ সময়ে আরবে অন্তর্বিরোধ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়, এই অবরুদ্ধ সগ্রাম স্পৃহার বহির্পথ হিসেবেই আক্রমণ-অভিযানগুলির প্রথম আরম্ভ হয়। এ সব আক্রমণের উদ্দেশ্য অধিকাংশ স্থলেই ছিল লুণ্ঠন, স্থায়ী রাজ্য স্থাপন নয় । কিন্তু লুণ্ঠনের মতলবে যারা এসব অভিযান শুরু করেছিল, কিছুকাল পর এসব অভিযান তাদের নাগালের বাইরে চলে গেল। যোদ্ধারা বিজয়ের পর বিজয় লাভ করে চল্প; তাদের অভিযানেরও শক্তি ও মর্যাদা বাড়তে শুরু করল। এই সময় হতে আরম্ভ হল সুসংবদ্ধ বিজয় অভিযান এবং এর অনিবার্য ফল হিসেবে আরব-সাম্রাজ্যের উদ্ভব ঘটল। সুতরাং, আরব-সাম্রাজ্য কোন সুপরিকল্পিত বিজয় অভিযানের ফল নয়; ইহা উপস্থিত অবস্থাবলীর কার্য-কারণ ঘটিত অনিবার্য পরিণতি।
ইহুদী ঐতিহাসিকেরা দাবী করেছেন যে, ইহুদীদের শক্তির বিকাশ ও বিস্তার ওল্ড টেস্টামেন্টের বাণী মোতাবেকই সংঘটিত হয়েছিল। মধ্যযুগীয় খৃস্টান দার্শনিকেরাও অনুরূপ দাবী করেছেন। ইসলামের শাস্ত্রবিদগণেরও কেউ কেউ দাবী করেছেন যে, ইসলামের অভ্যুদয় ও বিস্তার বিধাতার ইচ্ছা অনুসারেই হয়েছে। (এ দাবীর ভিত্তিতে ভাষাগত ভুল আছে)। ইসলাম’ এই শব্দকে তিনটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা চলে : মূলতঃ ইসলাম ধর্ম, তারপর ইসলামী রাষ্ট্র, সবশেষে ইসলামী তমদ্দুন। ইসলাম ইহুদী ও বৌদ্ধ ধর্মের পথে চলে নাই (খৃস্টান ধর্মের মত ইসলাম প্রচারমূলক ধর্ম হয়ে ওঠে)। পরে ইসলাম রাষ্ট্র গড়ে তোলে। যে ইসলাম উত্তর দেশসমূহ জয় করে, সে ইসলাম আসলে ইসলাম ধর্ম নয়, ইসলামী রাষ্ট্র। একটি জাতীয় ধর্ম-রাজ্যের প্রতিনিধি হিসেবে আরবরা অতর্কিতভাবে পার্শ্ববর্তী পৃথিবীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা প্রথম যে বিজয় লাভ করে, কারও কারও মতে সে ছিল আরব জাতির বিজয় ইসলামের বিজয় নয়। ইসলামের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীর আগে সিরিয়া, মেসোপটেমীয়া ও পারস্যের অধিকাংশ বাসিন্দাই ইসলাম গ্রহণ করে নাই। এসব রাজ্যের সামরিক বিজয়ের অনেককাল পর বাসিন্দারা মুহম্মদের (সঃ) ধর্ম অবলম্বন করে। আর যখন তারা ইসলাম গ্রহণ করল, তখন তারা ইসলাম ধর্মের মায়ায় যতখানি আকৃষ্ট হল, তার চেয়ে অনেক বেশি আকৃষ্ট হল জিজীয়ার হাত থেকে অব্যাহতি লাভ করে শাসক শ্রেণীর গণ্ডীভূত হওয়ার জন্য। তারপর আসছে, তমদ্দুন হিসেবে ইসলামের কথা। সামরিক বিজয়ের পর ধীরে ধীরে ইসলামী তমদ্দুনের উদ্ভব হয় এবং ইসলামের পূর্বগামী সিরীয়-আরমেনীয়, পারসিক ও গ্রীক তমদ্দুনের আংশিক ভিত্তির উপর এ নব তমদ্দুন গড়ে ওঠে। ইসলামের সাহায্যে নিকট-প্রাচ্য কেবল যে তার হৃত-রাজনৈতিক শাসনাধিকার ফিরে পেল এমন নয়, তমদ্দুনের ক্ষেত্রেও তার সুমহান প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠা পুনঃস্থাপন করল।
কিন্তু বাইরের দেশ জয় করার আগে আরবের নিজস্ব সংহতির প্রয়োজন। ছিল। এই ঐক্য-বিধানের পথের সন্ধানকালে উত্থাপিত হল মহানবীর উত্তরাধিকার অর্থাৎ খিলাফত সমস্যা।
মহানবী যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনি পয়গম্বর, আইনের বিধানকর্তা, ধর্মীয় ইমাম, প্রধান কাজী, সেনাপতি এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু আজ মুহম্মদ (সঃ) বেঁচে নাই। পয়গম্বরীর কাজ ছাড়া অন্যান্য ব্যাপারে কে তার স্থলাভিষিক্ত খলীফা হবেন? গয়গম্বর হিসেবে তিনি ইসলামের শেষ বাণী দিয়ে গিয়েছেন। কাজেই সে পদে কারো অধিষ্ঠিত হওয়ার কথাই ওঠে না।
মহানবী কোন পুরষ-সন্তান রেখে যান নাই। তাঁর ওফাতের পর বেঁচেছিলেন তাঁর একমাত্র কন্যা–ফাতিমা। আলীর সহধর্মিণী। কিন্তু আরবে শেখ বা আমীরের পদ বরাবর ঠিক উত্তরাধিকার-সূত্রে পরিচালিত হয় নাই; এ-পদ প্রধানতঃ নির্বাচনের উপর নির্ভর করত এবং কওমের মধ্যে যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ সাধারণতঃ তাঁরই ইহা প্রাপ্য ছিল। কাজেই মহানবীর পুত্র-সন্তানেরা তার আগে মারা না গেলেও সমস্যার স্বতঃস্ফূর্ত সমাধান হত না। মুহম্মদ (সঃ) নিজে তার উত্তরাধিকারীর কথা কিছুই স্পষ্ট করে বলে যান নাই। কাজেই খিলাফতের সমস্যা মুসলিম-জগতের প্রাচীনতম সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। আজো এ-প্রশ্নের চূড়ান্ত মীমাংসা হয় নাই। সুলতানের শাসন-ব্যবস্থা বাতিলের মোল মাস পর ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে কামালপন্থী তুর্করা ওসমানীয় খলীফার পদ তুলে দিল। এ সময় দ্বিতীয় আবদুল মজীদ ইস্তাম্বুলে খলীফার পদে আসীন ছিলেন। এরপর কায়রো ও ইস্তাম্বুলে একাধিক প্যান-ইসলামী সম্মেলন হয়ে গেছে–মহানবীর সত্যিকার উত্তরাধিকারী কে, তার নির্ণয়ের জন্যে কিন্তু কোনও ফায়দা হয় নাই। খিলাফতের মত ইসলামের কোন ধর্মীয় সমস্যাই এত রক্তপাত ঘটায় নাই।
জনসাধারণের নির্ধারণের জন্য কোন গুরুতর সমস্যা তাদের সামনে ছেড়ে দিলে তক্ষুণি কতকগুলি পরস্পর বিরোধীদলের আবির্ভাব ঘটে থাকে। মহানবীর ইন্তিকালের পরও তা-ই ঘটল। মুহাজিররা মিলে এক দল গঠন করল। তারা দাবী পেশ করল যে, তারা মহানবীর কওমের মানুষ এবং তারাই প্রথম ইসলাম কবুল করে। মদীনার আন্সারেরা গঠন করল অন্য দল। তারা দাবী পেশ করল যে, তারা মহানবী ও শিশু ইসলামকে আশ্রয় দিয়েছিল। এরপর এ দুইদল মিলে হল সাহাবীদল। তারপর এল আর এক দল। তারা যুক্তি পেশ করল যে, আল্লাহ ও মহানবী মুসলিম-সমাজকে নির্বাচনের খামখেয়ালীর উপর ছেড়ে দিতে পারেন না; কাজেই মহানবী নিশ্চয় কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে এ নেতৃত্বের জন্য মনোনীত করে গেছেন। আর এই মনোনীত উত্তরাধিকারী আলী ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না। কারণ, আলী মহানবীর আপন চাচাতো ভাই, আর তার একমাত্র জীবিত কন্যার স্বামী এবং সর্বপ্রথম যে দুই বা তিন জন ইসলাম কবুল করেন, তাঁদের অন্যতম। এ দল দাবী করল যে, তাদের শাসন-শক্তি পরিচালনার অধিকার বিধি-দত্ত-নির্বাচনের উপর নির্ভরশীল নয়। সর্বশেষে দাবী নিয়ে হাজির হল কোরায়েশের অভিজাত দল–উমাইয়ারা। ইসলামের অভ্যুদয়ের অব্যবহিত আগে এদেরই হাতে ছিল শাসন-কর্তৃত্ব, শক্তি ও সম্পদ। তারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল সবার শেষে; কিন্তু এ মুহূর্তে তারাও মহানবীর উত্তরাধিকার পদ দাবী করে বসল।
প্রথম দলই জয়লাভ করল। হযরত আবুবকর (রাঃ) বয়সে প্রবীণ, স্বভাবে ধর্মনিষ্ঠ, সর্বপ্রথম ইসলাম কবুলকারীদের এ জন এবং মহানবীর অন্যতম মৃণ্ডর–উপস্থিত প্রধানেরা তারই হাত ধরে বয়েত গ্রহণ করল। খোলাফা-এ রাশেদীনের মধ্যে আবুবকরই সর্বপ্রথম খলীফা। অবশিষ্ট তিন খলীফা হলেন, পর্যায়ক্রমে ওমর (রাঃ), ওসমান (রাঃ), আলী (রাঃ)। তখনো মহানবীর জীবনের মহান প্রভাব খলীফাদের চিন্তা ও কাজের উপর সক্রিয় ছিল। এ চারজন খলীফাই পরস্পর ঘনিষ্ঠ এবং আত্মীয় ছিলেন। নবীন রাষ্ট্রে নবীন রাজধানী হল মদীনা।
আরব ঐতিহাসিকেরা বলেন যে, হযরত মুহম্মদের (সঃ) মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে হেজাজের বাইরের সমস্ত আরব নবপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের বন্ধন হতে সরে পড়ল। প্রকৃত কথা হল এই যে, আরবে রাস্তা-ঘাটের ছিল নিতান্ত অভাব, সুশৃঙ্খলভাবে ধর্ম-প্রচারের কোনই ব্যবস্থা ছিল না–তারপর মহানবী প্রচারের সময়ও পেয়েছিলেন অল্প। ফলে মহানবীর জীবন-কালে আরব উপদ্বীপের এক তৃতীয়াশের বেশি লোক ইসলাম গ্রহণ করে নাই, আর তার শাসন-প্রভুত্ব স্বীকার করে নাই। হেজাজ ছিল তার প্রধান কর্ম-কেন্দ্র। হেজাজের লোকেরাও তার ইন্তিকালের মাত্র এক কি দুই বৎসর আগে ইসলাম কবুল করে?
নতুন রাষ্ট্র হতে যারা সরে পড়েছিল–কয়েকটি ছোট কিন্তু তীব্র যুদ্ধ দ্বারা আবুবকর (রাঃ) তাদের ফিরে আসতে বাধ্য করলেন। খালিদ-বিন-ওলীদ এসব যুদ্ধে তাঁর অসাধারণ সামরিক প্রতিভার পরিচয় দিলেন। অল্পকাল মধ্যেই ইসলাম সুসংহত হয়ে নব অভিযানের জন্য তৈরি হল।
এ অভিযান পথে প্রথম পড়ল সিরিয়া। বাইজেন্টাইনরা রোমক ও আলেকজান্ডারের নিকট হতে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রায় হাজার বছর যাবত এই অঞ্চল শাসন করে আসছিল। আরবরা এই সময় মাঝে মাঝে সিরিয়ার সীমান্ত পার হয়ে ভিতরে প্রবেশ করছিল। এরা সাময়িক লুণ্ঠনকারী ছাড়া আর কিছু হতে পারে, বাইজেন্টাইন সেনাপতিরা তা কল্পনাও করে নাই। কিন্তু অচিরেই তারা দেখতে পেল যে, তাদের দুশমনেরা এক নব বলে উদ্দীপ্ত আর তাদের আয়ত্তে রয়েছে এক মারাত্মক অস্ত্র–উন্নততর চলাচল ব্যবস্থা। আরবের উট সামরিক ক্ষেত্রে এক দুর্বার-শক্তিরূপে আবির্ভূত হল। বাইজেন্টাইন সৈন্যরা সিরিয়ায় আরব যোদ্ধাগণকে পিষে মারার উপক্রম করছিল। আল্লাহর তলোয়ার’ (সায়ফুল্লাহ্) খালিদের উপর হুকুম হল, এদের সাহায্য করার জন্যে। খালিদ ইরাকের দক্ষিণ ভাগ হতে তক্ষুণি তাঁর সুদক্ষ উট-বাহিনী সহ পথহীন মরুভূমির ভিতর দিয়ে অশ্রান্ত-গতিতে সিরিয়ার দিকে ছুটলেন এবং একান্ত আকস্মিকভাবে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের নিকট আবির্ভুত হলেন। সৈন্যদের জন্য পানি মশকে ভরে সঙ্গে নেওয়া হল। কিন্তু সঙ্গীয় ঘোড়ার জন্য পানির অন্য ব্যবস্থা হল। বুড়ো উটগুলি জবে করে সৈন্যরা তার গোশত খেত, আর সে উটের পেটের পানি ঘোড়াকে খেতে দেওয়া হত। এর দুই হতা পর সমস্ত আরব বাহিনীকে তার নিজ নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ করে খালিদ দামেস্কের দুয়ারে হাজির হলেন।
অতি প্রাচীনকাল হতে কিংবদন্তী প্রচলিত ছিল যে, দামেস্ক এ-দুনিয়ার সবচেয়ে পুরোনো শহর। এই দামেস্কের দেয়াল হতে সেই স্মরণীয় ‘পলায়ন নিশীথে’ পলকে ঝুড়িতে ভরে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অল্পকাল মধ্যেই দামেস্কের মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজধানী হওয়ার সময় আসন্ন হয়ে উঠল। ছয় মাস অবরোধের পর দামেস্ক আত্মসমর্পণ করল। বিজয়ীদের দৃপ্ত পদক্ষেপের সম্মুখে অন্যান্য নগরও তাসের ঘরের মত ধসে পড়ল। আর একটি লড়াই তখনো লড়বার বাকী ছিল। পূর্ব-সাম্রাজ্যের শাসনকর্তা হিরাক্লিয়াস আরবদের মোকাবিলার জন্য ৫০ হাজার সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। জর্দানের উপনদী ইয়ারমুকের উপত্যকায় খালিদ ২৫ হাজার সৈন্য নিয়ে ৬৩৬ খৃস্টাব্দে ২০ আগস্ট হিরাক্লিয়াসের সৈন্যের সম্মুখীন হলেন। দিনটি ছিল অত্যন্ত গরম আর ভীষণতম দুর্যোগপূর্ণ। ঝাঁপটা-বাতাস সেই উপত্যকা হতে ধূলি উড়িয়ে নিয়ে আকাশময় ছড়িয়ে দিচ্ছিল। আরব সেনাপতি নিতান্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেই এই দিনটি বেছে নিয়েছিলেন মনে হয়। বাইজেন্টাইন সেনাপতিরা তাদের সঙ্গে পাদ্রী-পুরোহিত নিয়ে এসেছিলেন; তারা ক্রুশ উঁচু করে ধরে বাইবেল হতে বাছা বাছা শ্লোক ও মন্ত্র আওড়াচ্ছিলেন। কিন্তু দুর্দম মরু সন্তানদের নিমর্ম আক্রমণের সামনে কিছুই টিকল না; বাইজেন্টাইনরা ভীষণভাবে পরাজিত হল। তাদের আহত ও নিহতরা ময়দানের বুক ছেয়ে ফেলল। অতঃপর আর কোন বাধা-বিপত্তি আরব-বাহিনীর সম্মুখে উপস্থিত হল না। তাদের দুর্নিবার গতি সিরিয়ার উত্তরতম সীমা টরস পর্বতের পাদমূলে গিয়ে প্রহত হল।
তৎকালীন জগতের শ্রেষ্ঠতম শক্তির নিকট হতে এত দ্রুত এবং এত সহজে এই সামরিক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলটি অধিকার করে নেওয়ায় দুনিয়ার চোখে এ নব গঠিত রাষ্ট্রের মর্যাদা বহুল পরিমাণে বেড়ে গেল। আর তারো চেয়ে বড় কথা এই যে, নবীন রাষ্ট্র তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নিশ্চিত ও নির্ভয় হয়ে উঠল। সিরিয়াকে অবলম্বন করে অতঃপর আরমেনীয়া, উত্তর মেসোপটেমীয়া, জর্জীয় ও আজারবাইজানের উপর হামলা করা সম্ভব হয়ে পড়ল। এখান হতেই পরবর্তীকালে এশিয়া মাইনরে বহু অভিযান পরিচালিত হয়।
এরপর আল্লাহর যোদ্ধারা যখন পারস্যের দিকে ফিরে দাঁড়াল, তখন সেই একই দুর্দম-সাহস ও রণ-কৌশল বলে তারা বিজয়ের পর বিজয় লাভ করতে লাগল। ৬৩৭ খৃস্টাব্দে এক বিরাট সাসানীয় সৈন্যদল বালির তুফান দেখে পালিয়ে গেল; ফলে তাইগ্রীস নদীর পশ্চিমদিকস্থ ইরাকে সমগ্র নিম্ন-ভূভাগ আরব-হামলার মুখে এসে পড়ল। তাদের স্বাভাবিক উদ্যম ও উৎসাহের সঙ্গে মুসলিম-বাহিনী এগিয়ে চল্প এবং একটিও সৈন্য-ক্ষয় না করে তারা বন্যা-স্ফীত তাইগ্রীসের এক সুবিধাজনক স্থান দিয়ে পার হয়ে গেল। সিরিয়ার বাসিন্দাদের মত ইরাকের বাসিন্দারাও আক্রমণকারীগণকে সাদর অভ্যর্থনার সঙ্গে গ্রহণ করল। ইরাক, সিরিয়া উভয় দেশের বাসিন্দারাই তাদের শাসকগোষ্ঠীকে পুর মনে করত এবং ঘৃণার চোখে দেখত। গ্রীক ও পারসিক প্রভুরা তাদের মন উপর হতে জোর করে প্রজা-সাধারণের ঘাড়ে চাপাতে চেষ্টা করেছে; কিন্তু দেশের জনসাধারণ কোনদিনই সে সংস্কৃতিকে আপন বলে আত্মস্থ করে নাই। পারস্যের ম্রাট ও তাঁর সৈন্যদল বিনা যুদ্ধে তাদের রাজধানী টিসিফন ছেড়ে পালিয়ে গেল। বিজয় মুসলিম-বাহিনী বিজয়-গৌরবে এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নগরীতে প্রবেশ করল। ম্রাটের পলায়িত অবস্থায় তাঁর শাহী-মুকুটের জহরতের লোভে তার এক প্রজা তাকে নিহত করে। বারোশ’ বছরকাল পর্যন্ত যে শাহী বংশ মহাপরাক্রমে পারস্য-সাম্রাজ্য শাসন করে, এইরূপে তার শেষ নরপতি জীবনাবসান ঘটে। পরবর্তী আটশ’ বছরের মধ্যে আর এ-সাম্রাজ্যের পুনরুত্থান। ঘটে নাই।
ঊষর আরবের সন্তানেরা এই প্রথম বিলাস ও আরামের সাক্ষাৎ সংস্পর্শে এল। বিশাল শাহী মজিল, বিরাট দরবার কক্ষ, অপূর্ব-সুন্দর তোরণ-সমূহ, সৌন্দর্যের বৈচিত্র্যে-ভরা মনোহারী প্রাসাদ-সমূহ আর মনোরম দ্রব্য-সামগ্রী আরব উপদ্বীপের কাদার-মাটির কুঁড়ে ঘরের সঙ্গে কি অচিন্তনীয় পার্থক্য। আরবদের শিক্ষা শুরু হল এবং এমন অবস্থায় অনেক সময় যেমন ঘটে থাকে, এ ক্ষেত্রেও মাঝে-মাঝে তেমনি খানিকটা কৌতুক এবং রস-সৃষ্টি হতে লাগল। কর্পূর এরা আগে কখনো দেখে নাই; দুই-চার জনে রান্নায় কর্পূর ব্যবহার করে বসল। একটি সৈন্যের ভাগে একজন আমীরের কন্যা পড়েছিল। সে কন্যাটিকে এক হাজার দিরহামে বিক্রি করল। একজন বল্প–এত অল্প দামে এই সুন্দরী মেয়েটাকে ছাড়লে সৈন্যটি বন্ধু–এক হাজারের উপর যে আরো সংখ্যা আছে, তা আমার মোটেই জানা ছিল না।’
ইরাকের সীমা পার হয়ে পারস্যের ভিতরে প্রবেশ করে কিন্তু আরব-বাহিনী অনেক বেশি কঠিন বাধার সম্মুখীন হল এবং বিজয় সম্পূর্ণ করতে তাদের আরো বারো বছরব্যাপী যুদ্ধ করতে হয়েছিল। পারসিক্রা সিমাইট নয়–তারা আর্য। তাদের সুসংবদ্ধ সামরিক শক্তি ছিল এবং চারশ’ বছর-কাল পর্যন্ত তারা রোমকদের সঙ্গে তলোয়ার-বাজী করেছে। কিন্তু পরিণামে আরব-অভিযানের সম্মুখে এ শক্তিও টিকতে পারল না। ৬৪৩ খৃস্টাব্দে আরবরা পাক-ভারতের সীমান্তে এসে হাজির হল।
প্রাচ্যে যেমন এই বিজয়-বাহিনী দুর্বার-বেগে অগ্রসর হচ্ছিল, প্রতীচ্যেও তেমনি মুসলমানদের বিজয়-তরঙ্গ সমস্ত ভাসিয়ে নিয়ে চলছিল। সামরিক দিক দিয়ে মিসরে অবস্থান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিরিয়া ও হেজাজের ছিল এ বিপজ্জনকভাবে নিকটবর্তী। এর ভূমি ছিল অত্যন্ত উর্বরা; ফলে মিসর ছিল কন্সট্যাটিনোপলের (ইস্তাম্বুল) শস্য-ভার। মিসরের রাজধানী আলেকজান্দ্রিয়া বাইজেন্টাইন নৌ-বাহিনীর এক মস্ত ঘাঁটি ছিল। আর উত্তর আফ্রিকার বাকী অংশের জন্য মিসর ছিল প্রবেশদ্বার। এই সব বিবেচনায় নীলনদের উপত্যকার উপর অনেককাল আগেই মুসলমানদের প্রলুব্ধ দৃষ্টি পড়েছিল। সেনাপতি আমর ইবনুল-আস তার বিখ্যাত প্রতিদ্বন্দ্বী খালিদকে নিজ বিজয় ঝলকে নিষ্প্রভ করে দেওয়ার সংকল্প নিয়ে ৬৩৯ খৃস্টাব্দে ৪ হাজার অশ্বারোহী সহ ফিলিস্তিন হতে সেই বহু-বিত পুরাতন উপকূল-পথে যাত্রা করলেন যে পথে তার আগে পদাঙ্ক রেখে গেছেন হযরত ইব্রাহীম, ক্যামবিসেস, আলেকজান্ডার, এটিওকাস, “পবিত্র পরিবার এবং তারপরে এ-পথে যাত্রা করেন নেপোলিয়ন ও এলেনবী। এ ছিল প্রাচীন জগতের আন্তর্জাতিক রাজ-পথ।
আবার সেই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি ও পরাজয়, অবরোধ, বিজয় হুঙ্কার–আল্লাহু আব্বর। এইবার মিসরের ব্যাবিলনের পতন ঘটল।
ইতিমধ্যে আরব হতে নতুন নতুন সৈন্য এসে যোগ দিল। একদিন প্রভাতে ২০ হাজার সৈন্য নিয়ে আমার চেয়ে দেখলেন, তাঁর সম্মুখে দুর্ভেদ্য দেয়াল ও প্রাসাদ-বেষ্টিত মিসরের রাজধানী আলেকজান্দ্রিয়া। তার একদিকে উঠেছে গগণ স্পর্শী সিরাপিয়াম : এককালে এরই মধ্যে অবস্থিত ছিল সিরাপিস মন্দির আর আলেকজান্দ্রিয়ার সুবিশাল লাইব্রেরী। অন্যদিকে উঠেছে সেন্টমার্কের সুদৃশ্য গীর্জা ও এককালে এই-ই ছিল সেই সিজারীয় মন্দির, রাণী ক্লিওপেট্রা জুলিয়াস সিজারের স্মৃতির সম্মানার্থে যা নির্মাণ করতে শুরু করেছিলেন–আর শেষ করেছিলেন অগাস্টাস। আরো পশ্চিমে দেখা যায় দুটি লোহিত বর্ণের আসোয়ান-পাথরে সঁচ, লোকে বলে ক্লিওপেট্রার নির্মিত, কিন্তু আসলে তৃতীয় থামোসের কীর্তি (১৪৫০ খৃঃ পূর্ব)। আজ এই দুটি কীর্তি লণ্ডনে টেস নদীর বাঁধ ও নিউইয়র্কে সেন্ট্রাল পার্কের শোভা বর্ধন করছে। আর সবার পশ্চাতে মাথা উঁচু করে আছে ফ্যার। দিনের বেলায় এর উপর সূর্য-কিরণ ঝলমল করে, রাত্রিতে এর নিজের আলোই ভাস্বর হয়ে ওঠে। যথার্থই লোকে একে বলে, পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম। আজকের কোন বিদেশী ভ্রমণকারীর বিস্ময় বিমুগ্ধ চোখে নিউইয়র্কের গগণচুম্বী প্রাসাদ-মণ্ডলী যেমন প্রতিভাত হয়, মরুবাসী আরবের চোখেও সেদিন আলেকজান্দ্রিয়ার দৃশ্য নিশ্চয় তেমনিভাবে প্রতিভাত হয়েছিল।
আলেকজান্দ্রিয়ার কেল্লা। সৈন্যসংখ্যা ছিল ৫০ হাজার। এর পেছনে ছিল বাইজেন্টাইনের সমগ্র নৌ-শক্তি। আক্রমণকারী সৈন্যদল সংখ্যায় ছিল নগণ্য অস্ত্র-শস্ত্র ছিল তাদের অনুন্নত ও তাদের সঙ্গে ছিল একটি জাহাজ, না ছিল কোন অবরোধ সরঞ্জাম, না ছিল রসদ সরাহের কোন ব্যবস্থা।
প্রায় এক বছর পর খলীফা ওমরের নিকট মদীনায় নিমোক্ত ভাষায় সংবাদ গেল : আমি এমন একটি শহর দখল করেছি, যার বর্ণনা হতে আমি বিরত রইলাম। এই বল্লেই যথেষ্ট হবে যে, আমি যে শহর দখল করেছি, তাতে ৪ হাজার গোসলখানা সহ ৪ হাজার বাগান বাড়ী, ৪০ হাজার জিজিয়া-দানকারী ইহুদী এবং রাজপুরুষদের ব্যবহারের জন্য তৈরি ৪ শত প্রমোদ-উদ্যান রয়েছে। খলীফা সংবাদবাহীকে রুটি ও খেজুর খেতে দিলেন এবং মসজিদ-এ-নববীতে একটি অনাড়ম্বর কিন্তু সমমণ্ডিত শুকরীয়া মজলিস করলেন। আল্লাহু আকবর!
ব্যাবিলনের নিকট যে স্থানে আমর তাঁবু গেড়েছিলেন, ‘আল-ফুস্তাত’ নামে তা-ই হল নতুন রাজধানী। পুরাতন কায়রো’ নামে এখনো সে শহর বেঁচে আছে। এখানে মিসর বিজয়ী বীর আমর একটি অনাড়ম্বর মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন সে দেশে এই প্রথম সমজিদ। মেরাত-সাহায্যে মসজিদটি আজো সেখানে বিরাজ করছে।
একটা গল্প প্রচলিত আছে যে, আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরীর গ্রন্থরাশি দ্বারা আমর দীর্ঘ ছয়মাস পর্যন্ত গোসলখানার চুলার আগুন জ্বালিয়েছিলেন। গল্পটি কাহিনী হিসেবে চমৎকার; তবে এর ঐতিহাসিক মূল্য কিছুই নাই। এই বিরাট টলেমীয় লাইব্রেরীটি খৃস্টপূর্ব ৪৮ অব্দে জুলিয়াস সিজার ভস্মসাৎ করেন। এখানে দুহিতা লাইব্রেরী’ নামে পরে একটি লাইব্রেরী স্থাপিত হয়। তা-ও রোমক-ম্রাট থিউড়োসিয়াসের আদেশ মোতাবেক ৩৮৯ খৃস্টাব্দে ধ্বংস করা হয়। সুতরাং, আরবদের বিজয়কালে আলেকজান্দ্রিয়াতে কোন উল্লেখযোগ্য লাইব্রেরী বর্তমান ছিল না এবং সমসাময়িক কোন লেখকই আমর বা ওমরের বিরুদ্ধে এ লাইব্রেরী ধ্বংসের অভিযোগ আনয়ন করেননি।
মিসরের পতনের ফলে বাইজেন্টাইন-সাম্রাজ্যের পশ্চিমাংশের অঞ্চলগুলির আত্মরক্ষা অসম্ভব হয়ে উঠল। আলেকজান্দ্রিয়ার পতনের পর এর পশ্চাৎভাগ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে আমর তার স্বাভাবিক তীব্রবেগে একদল অশ্বারোহী-সহ পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলেন। তাঁর এই অভিযানের ফলে মহানবীর পতাকা উত্তর-আফ্রিকার উপকূল বেয়ে বেয়ে ত্রিপলীর বার্বার-ভূমি পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছল।