অনেকক্ষণ ধরে দরজার কড়া নড়ছে। জয়নাল উঠতে পারছে না। কড়াইয়ে তেল গরম হচ্ছে, ডিমের ওমলেট হবে। কাঁচা তেলে ডিম ঢেলে দিলে তেলের গন্ধ থাকবে। তেল বেশি গরম হয়ে গেলে আবার ধক করে তেলে আগুন জ্বলে উঠবে। এই কড়াইটার হয়তো কোনো সমস্যা আছে। তেল সামান্য গরম হলেই আগুন লেগে যায়।
জয়নাল বলল, কে?
যে কড়া নাড়ছিল সে জবাব দিল না। আরো জোরে কড়া নাড়তে লাগল। মনে হচ্ছে বাড়িওয়ালা কেয়ারটেকারকে পাঠিয়েছে। মাত্র দুমাসের বাড়ি ভাড়া বাকি, ব্যাটার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ঘন্টায় সুন্টায় লোক পাঠাচ্ছে। জয়নাল মনে মনে বলল, দূর কুত্তা। তেল মনে হয় গরম হয়েছে। সে ধীরেসুস্থে ডিম চলল। আজকের ওমলেটটা মনে হয় অসাধারণ হবে, কারণ ডিমে দুই চামচ দুধ দেয়া হয়েছে। ওমলেটটা সোনালি বর্ণ ধারণ করে ফুলে উঠছে।
এখন শুধু যে কড়া নড়ছে তা-না, দরজায় ধাক্কাও পড়ছে। জয়নাল তেমন পাত্তা দিল না। ওমলেট কড়াই থেকে নামিয়ে দরজা খোলার জন্যে রওনা হলো। কেয়ারটেকার ব্যাটাকে কী বলতে হবে মনে মনে ঠিক করে ফেলল। তাকে বলতে হবে – সোমবার সন্ধ্যাবেলায় এসে টাকা নিয়ে যাবেন। পাওনাদারদের নির্দিষ্ট দিনক্ষণ বলে বুঝ দিতে হয়। পরে এসে টাকা নিয়ে যাবেন বললে এরা বুঝ মানে না। নির্দিষ্ট দিনক্ষণ বললে বুঝ মানে।
দরজা খোলার পর জয়নালের মাথা চক্কর দিয়ে উঠল, তার মনে হচ্ছে এক্ষুণি মাথা ঘুরে হুড়মুড় করে সিড়িতে পড়ে যাবে। গড়াতে গড়াতে নেমে যাবে এক তলায়। কড়া নাড়ছে ইতি। ইতি না হয়ে যদি পিঠে ডানা লাগানো সত্যিকার কোনো পরী দেখত তাহলেও এত অবাক হতো না।
ইতি বলল, আপনি কি এই গুহায় বাস করেন? এতক্ষণ ধরে কড়া নাড়ছি দরজা খুলছিলেন না কেন?
জয়নাল বলল, আমরি এই ঠিকানা কোথায় পেয়েছ?
আলম ভাইয়ের কাছ থেকে জোগাড় করেছি। আপনি কি আমাকে দূরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখবেন না ভেতরে ঢুকতে দেবেন?
এসো, ভিতরে এসো।
দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ান। আমি কি আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকব না-কি?
জয়নাল এক পাশে সরল। তার মাথার চর এখনো ধামে নি। মাথা ঘুরে পড়ে যাবার সম্ভাবনা এখনো আছে। ইতি ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে চারদিক দেখছে।
বেলা সাড়ে এগারোটার সময় ডিম ভাজছেন কেন? এটা আপনার সকালের নাশতা না-কি দুপুরের লাঞ্চ
জয়নাল বলল, ওমলেট খাবে ইতি?
ইতি বলল, কী আশ্চর্য কথা, দুপুর সাড়ে এগারোটার সময় আমি ওমলেট খাব কেন? আপনি আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না, একটা সার্ট গায়ে দিন। খালি গায়ে ঘুরছেনকুৎসিত লাগছে। লুঙ্গি এত উচু করে পরেছেন কেন? টেংরা টেংরা পা দেখা যাচ্ছে। লুঙ্গি তো আর হাফপ্যান্ট না। লুঙ্গি পরতে হয় লুঙ্গির মতো।
জয়নাল খুবই অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে। কী অবস্থা! পরীর চেয়ে দশগুণ সুন্দরী একটা মেয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর সে কিনা খালি গায়ে হাঁটু পর্যন্ত উচু একটা লুঙ্গি পরে হাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছে। লুঙ্গি নামাতে যাওয়াও এখন ঠিক হবে না। হাত যেভাবে কাপছে লুঙ্গির গিট খুলতে গিয়ে অঘটন ঘটে যেতে পারে। আগে লম্বা একটা পাঞ্জাবি পরা দরকার। ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি দুটা থাকার কথা। এখন হয়তো পাঞ্জাবিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটা বিপদ যখন আসে তখন সেই বিপদের লেজ ধরে আরেকটা বিপদ আসে। দেখা যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িওয়ালা কেয়ারটেকারকে পাঠাবে। সেই কুত্তা কেয়ারটেকার ইতির সামনেই বাড়িভাড়া নিয়ে ঘেউ ঘেউ শুরু করবে।
জয়নাল বলল, দাঁড়িয়ে আছ কেন ইতি, বসো। চা খাবে?
ইতি বসতে বসতে বলল, না।
কোক পেপসি এইসব কিছু খাবে? আনিয়ে দিই?
কিছু আনিয়ে দিতে হবে না। আপনি আমাকে দেখে এত নার্ভাস হয়ে পড়েছেন কেন?
তুমি আসবে ভাবি নি তো।
ইতি বসতে বসতে বলল, আপনার গুহা খুবই অদ্ভুত, কিন্তু সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছেন। সুন্দর একটা পেইন্টিংও দেখি আছে। পেইন্টিংটা কার?
আমার এক বন্ধুর আঁকা। আর্ট কলেজে পড়ত, থার্ড ইয়ারে উঠে পড়া ছেড়ে দিল।
কেন?
মাথা খারাপের মতো হয়ে গেছে। এখন গাঁজা-টাজা খায়, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ওর নাম আবদুর রহমান।
উনার ছবিটা তো অসম্ভব সুন্দর। আমি ছবি থেকে চোখ ফেরাতে পারছি। ছবির মেয়েটা কে?
ইতি একদৃষ্টিতে ছবি দেখছে এটা একটা ভালো সুযোগ। জয়নাল ইতির পেছনে দাঁড়িয়ে অতি দ্রুত কাপড় বদলাচ্ছে। তার ভাগ্য ভালো, মেরুন রঙের ইস্ত্রি-করা পাঞ্জাবিটা পাওয়া গেছে। এই পাঞ্জাবিটাতেই তাকে সবচে সুন্দর মানায়। কালো প্যান্টের সঙ্গে মেরুন কালারের পাঞ্জাবি।
ছবির মেয়েটা কে আমি জানি না। রহমানের কাছ থেকে ছবিটা কিনেছিলাম।
কত দিয়ে কিনেছেন?
রহমানের মাথা খারাপ তো! ছবির দাম উল্টা-পাল্টা লিখে রেখেছিল। পনেরো হাজার লেখা ছিল। আমি তাকে দুপ্যাকেট বেনসন সিগারেট দিয়ে ছবি নিয়ে চলে এসেছি।
কী বলেন আপনি!
বন্ধু মানুষ তো! কিছুক্ষণ কাউ কাউ করে বলেছে- যা ছবি নিয়ে ভাগ। একদিন দেখবি এই ছবিই আট-দশ লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারবি। ছাগলটা নিজেকে কী যে ভাবে!
যে এত সুন্দর ছবি আঁকে সে নিজেকে কিছু একটা ভাবতেই পারে।
ইতি এখনো ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। জয়নালও এবার আগ্রহের সঙ্গে তাকাল। রহমানের ছবি নিয়ে এসে সে তার ঘরে টানিয়ে রেখেছে ঠিকই কোনোদিন এইভাবে দেখা হয় নি। জঙ্গলের ছবি। শীতকালের জঙ্গল। গাছের পাতা বিবর্ণ। বেশিরভাগ গাছেরই পাতা ঝরে গেছে। আবার কুয়াশাও আছে। পনেরো-ষােল বছরের এক গেঁয়ো মেয়ে জঙ্গলে এসেছে শুকনা পাতা এবং খড়ি টোকাতে। তার হাতে ভারি খড়ির বোঝা। তার মুখটা এমনভাবে আঁকা যেন মনে হয় সে তার সামনের একজনকে বলছে, বোঝাটা খুব ভারি। কষ্ট করে আমার মাথায় তুলে দিন তো!
ইতি বলল, আবদুর রহমান সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেবেন।
জয়নাল বলল, তার সাথে অনেক দিন দেখা হয় না। যদি দেখা হয় ধরে তোমাদের বাসায় নিয়ে যাব।
এটা জয়নালের মুখের কথা। আবদুর রহমানকে সে কোনোদিনও ইতির বাসায় নিয়ে যাবে না। ইতি চ্যান বেঙ টাইপ মেয়ে, যে-কোনো ছেলের সাথে তার ইয়ে হয়ে যেতে পারে।
ইতি বলল, আমি খুঁজে খুঁজে আপনার ঠিকানা বের করে কেন এসেছি বলুন তো?
কেন এসেছ?
আপনাকে দুটা খবর দিতে এসেছি। একটা খারাপ খবর একটা ভালো খবর। কোনটা আগে বলব?
খারাপ খবরটাই আগে বলে।
আগে খারাপ খবর শুনলে ভালো খবর শুনতে চাইবেন না। খারাপ খবরটা আগে বলব?
হুঁ।
খারাপ খবর হচ্ছে আমাদের ফ্যামিলিতে আপনাকে নিয়ে ডিসকাশন হয়েছে। ফ্যামিলির সবার সিদ্ধান্ত আপনার কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়া যায় না।
ও, আচ্ছা!
আমার খালু সাহেব আপনার সম্পর্কে কী বলেছেন জানেন? উনি বলেছেন–ঐ ছেলে বিরাট ধান্ধাবাজ। আমেরিকায় পৌঁছে হয় সে গ্যাস স্টেশনে কাজ নিবে, গাড়িতে তেল ভরবে, আর নয়তো হোটেলে থালাবাসন মাজবে। দেশে চিঠি লিখবে আমি ডিসি পোস্ট পেয়েছি। অর্থাৎ ডিস ক্লিনার। এই ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়া আর মেয়ে কেটে টুকরা টুকরা করে ইছামতি নদীতে ফেলে দেয়া এক জিনিস।
জয়নাল বলল, এত নদী থাকতে ইছামতি নদীর কথা আসল কী জন্যে?
ইতি বলল, খালু সাহেবের বাড়ি ইছামতি নদীর পাড়ে, এই জন্যে ইছামতি নদীর কথা এসেছে।
ও, আচ্ছা!
আর আমার মা বলেছেন, বাপ-মা মরা এতিম ছেলে। এতিমকে সাহায্য করা যায়, এতিমের কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়া যায় না।
ও, আচ্ছা!
আর আমার বাবা আপনার সম্পর্কে বলেছেন–ফাজিল টাইপ ছেলে, সারাক্ষণ কথা বলে, এমন ভাব ধরে কথা বলে যেন দুনিয়ার সব কিছু জানে। এর কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। চালবাজ জামাই আমার পছন্দ না। এই হলো খারাপ সংবাদ। এখন ভালো সংবাদটা শুনবেন?
এর পরে ভালো সংবাদ আর কী থাকবে?
এরপরেও ভালো সংবাদ আছে। ভালো সংবাদটা হলো পারিবারিক সব আলোচনা হবার পর আমি আমার মাকে ছাদে ডেকে নিয়ে বলেছি–মা, আমাকে কেটে টুকরা টুকরা করে ইছামতি নদীতে ফেলে দেয়ার ব্যবস্থা কর। আমার কথার মানে বুঝতে না পেরে মা হা করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বইলেন। আমার ধারণা আপনিও আমার কথার মানে বুঝতে পারছেন না। কারণ আপনিও হা করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। আপনি কি . আমার কথার মানে বুঝতে পেরেছেন?
না।
থাক মানে বোঝার দরকার নেই। আপনি আপনার চাচা শামসুদ্দিন সাহেবকে আমাদের বাসায় পাঠাবেন। বাবা বিয়ের তারিখ নিয়ে কথা বলবেন।
ও, আচ্ছা।
বিয়ে যে করবেন সে রকম টাকা-পয়সা কি আছে? বিয়ের শাড়ি, গয়না তো লাগবে। লোকজন খাওয়াতে হবে। আপনার অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে আপনার টাকা-পয়সা আছে। আমার তো মনে হচ্ছে আমেরিকা যাবার টিকিটের টাকাও আপনি এখনো জোগাড় করতে পারেন নি।
জয়নাল চুপ করে রইল। তার কাছে সব কিছু কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। অপরূপ রূপবতী একটি মেয়ে তার ঘরের খাটে বসে আছে, পা দুলিয়ে দুলিয়ে এইসব কী বলছে? জয়নালের গলার কাছটা শক্ত হয়ে আসছে। খুব খারাপ লক্ষণ। চোখে পানি এসে যাবার সম্ভাবনা আছে। সম্ভাবনা নষ্ট করতে হবে। চোখে পানি এসে গেলে বিরাট বেইজ্জতি ব্যাপার হবে। জয়নাল মনে মনে বলল, হে আল্লাহপাক, হে পরওয়ারদেগার। চোখে যেন পানি না আসে। এই মেয়েটার সামনে চোখে পানি আসলে আমি বিরাট বেইজ্জতি হব। যদি পানি না আসে তাহলে আমি দশ রাকাত নফল নামাজ পড়ব। একটা ফকিরকে চা নাশতার পয়সা দেব। তোমার কাছে ওয়াদা করলাম।
ইতি পা নাচাতে নাচাতে বলল, আপনি আমার পেছনে লুকিয়ে আছেন কেন? আপনার চোখে কি পানি এসেছে নাকি?
আরে না, পানি আসবে কেন। একটা জিনিস খুঁজছি। কোথায় যে রাখলাম।
জিনিসটা কী?
জয়নাল জবাব দিতে পারল না। আগে থেকে ঠিকঠাক করে না রাখলে মিথ্যা বলা বেশ কঠিন। ইতি বলল, আপনাকে একটা ব্যাপার বলা দরকার। আমার কিন্তু খুব বুদ্ধি। আমাকে বিয়ে করে আপনি মহাবিপদে পড়বেন, কাজেই আনন্দে চোখের পানি ফেলার মতো কোনো ঘটনা ঘটে নি।
বিপদে পড়ব কেন?
বিপদে পড়বেন কারণ আমি খুবই বুদ্ধিমতী একজন মেয়ে। প্রেম করার জন্যে বুদ্ধিমতী মেয়ে ভালো। বিয়ে করার জন্য বুদ্ধিমতী মেয়ে ভালো না। বিয়ে করার জন্যে ভালো জি জনাব টাইপ মেয়ে! স্বামী যা বলবে মেয়ে ঘাড় কাত করে বলবে–জি জনাব। স্বামী যদি নামাজি হয় সে সঙ্গে সঙ্গে বোরকা পরা শুরু করবে। স্বামীর যদি মদ খাওয়ার অভ্যাস থাকে সেও মদ ধরবে।
জয়নাল মুগ্ধ হয়ে ইতির কথা শুনছে। তার কাছে মনে হচ্ছে, এই মেয়ে চ্যাঙ বেঙ টাইপ মেয়ে না। এ হলো সিরিয়াসিং কন্যা। যে কন্য সব বিষয়ে সিরিয়াস সেই কন্যাই সিরিয়াসিং কন্যা।
ইতি বলল, এখন আপনি ঝেড়ে কাশুন। আয়োজন করে বিয়ে করার মতো টাকা পয়সা কি আপনার আছে?
না।
ধারটার করে জোগাড় করতে পারবেন?
টিকিটের টাকার জোগাড় এখনো হয় নি।
আমার কাছে বুদ্ধি চান?
চাই।
আমার দায়িত্ব হলো–বিয়েতে সবাইকে রাজি করানো। সেটা আমি করাব।
কীভাবে?
আমি শুধু আমার মাকে রাজি করবি। আমার মাও আমার মতোই বুদ্ধিমতী। তিনি রাজি হলে বাকি সবাইকে তিনিই রাজি করাবেন। তখন আপনাদের খবর দেওয়া হবে পান-চিনির অনুষ্ঠানে। আপনি একটা আংটি নিয়ে উপস্থিত হবেন। আংটি কেনার পয়সা কি আছে?
আছে।
আংটি প্রদান অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হবার পর আপনার চাচা শামসুদ্দিন সাহেব কথায় কথায় বলবেন বিয়ে বাকি রেখে লাভ কী? একটা কাজি ডেকে নিয়ে বিয়ে পড়িয়ে দিলে কেমন হয়। আপনার চাচার এই কথার পর আমাদের তরফ থেকে একজন বলবে, মন্দ কী? তারপর কাজি আনতে লোক চলে যাবে।
এত সহজ?
অবশ্যই সহজ। আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?
না।
আপনাকে যেভাবে বলেছি পুরো ঘটনা আমি এইভাবে ঘটাব। কোনো রকম উনিশ-বিশ হবে না।
জয়নাল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মেয়েটির আহ্লাদি ধরনের কথার সঙ্গে তার পরিচয় আছে। এই রূপের সঙ্গে পরিচয় নেই। ইতি মাখা দোলাতে দোলাতে বলল, এই কাজটা আমি কেন করছি জানতে চান? আপনার মনে যাতে কোনো ভ্রান্ত ধারণা না থাকে সে জন্যেই আমার বলে দেওয়া উচিত কাজটা কেন করছি। আপনি মজনু না, আমিও লাইলি না যে আপনার প্রেমে দিওয়ানা হয়ে এই কাজ করছি। আমার দিক থেকে কারণটা সহজ। খুবই সহজ। আপনি বোকা টাইপের হলেও মানুষ হিসেবে ভালো। যে-কোনো মেয়ে ভালো মানুষ মন্দ মানুষ ব্যাপারটা ধরতে পারে। যে-কোনো মেয়ের চেয়ে আমি আরো তাড়াতাড়ি ধরতে পারি।
ও, আচ্ছা।
আংটি প্রদান অনুষ্ঠানকে বিয়ের অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা কেন করেছি সেটাও বলি। আপনার প্রতি মমতাবশত এই কাজটা কিন্তু আমি করছি না। আমার বাবার প্রতি মমতাবশত কাজটা করছি।
জয়নাল বলল, তুমি কী বলছ বুঝতে পারলাম না।
বাবা সরকারি চাকরি করেন। আগামী বছর রিটায়ার করবেন। সরকারি বাসা ছেড়ে আমাদের একটা ভাড়া বাড়িতে উঠতে হবে। সেই বাড়ির ভাড়া বাবা কীভাবে দেবেন তা তিনি জানেন না। প্রভিডেন্ট ফান্ডে কোনো টাকা নেই। আমার বড় বোনের বিয়ের সময় এক লাখ টাকা ধার নিয়েছিলেন, সেই ঋণ এখনো শোধ হয় নি। বাবার যা অবস্থা আমার বিয়েতে দশ হাজার টাকা খরচ করার সামর্থ্যও তার নেই। ফাঁকতালে আমার বিয়ে হয়ে গেলে বাবার জন্যেও সুবিধা। টাকা-পয়সা ছাড়া আমার বিয়ে হয়ে গেলে বাবার উচিত কবি নজরুলের বিখ্যাত গানটা গাওয়া–রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
জয়নাল মুগ্ধ গলায় বলল, তুমি দেখি খুবই আশ্চর্য মেয়ে!
ইতি বলল, আমি মোটেই আশ্চর্য মেয়ে না। আমি সাধারণ মেয়ে, তবে বুদ্ধিমতী মেয়ে। আমার বুদ্ধি নিয়ে চললে আপনার জীবনটা অন্যরকম হয়ে যাবে। তবে আমি কোনো বুদ্ধি আপনাকে দেব না।
কেন?
যে সব স্বামীরা স্ত্রীর বুদ্ধিতে চলে তারা কেমন ভিজা বিড়ালের মতো হয়ে যায়। তাদের দেখলেই মনে হয় দুবলা পাতলা শিং ভাঙা কালো রঙের একটা গরু। গরুর গলায় দড়ি বাধা আছে। তার সামনে কিছু প্রকনা খড়। মাঝে মাঝে সে খড় খাচ্ছে আর করুণ চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার ক্ষিধে লেগে গেছে। ডিম ভাজাটা দিন আর একটা চামচ দিন। আমি ডিম ভাজা খাব। দেখি আপনার রান্নার হাত কেমন।
ইতি বেশ আয়োজন করে ডিম ভাজা খাচ্ছে। জয়নালের আফসোস হচ্ছে। ইতি ভিম খাবে জানলে এক বোতল টমেটো সস কিনে রাখত। মিষ্টি ছাড়া যে. কোনো জিনিস মেয়েরা সস দিয়ে খায়। জয়নাল বলল, আমি একটা বিপদে পড়েছি। বিপদ থেকে উদ্ধারের কোনো বুদ্ধি কি তোমার কাছে আছে?
ইতি বলল, বিপদটা কী রকম?
আমার চাচা আমার দেশের বসত-বাড়ি দখল করে বসে আছেন। চাচার কাছে আমি একটা চিঠি লিখেছি। চিঠিটা পড়লে বুঝবে।
আপনি পড়ে শোনান। জয়নাল চিঠি বের করে পড়তে শুরু করল।
জনাব মুখলেসুর রহমান,
চাচাজি আমার সালাম নিবেন। কুরিয়ারে পাঠানো আপনার আগের চিঠি পেয়ে আমি খুবই অবাক হয়েছি। আপনি হঠাৎ করে এখন বলছেন যে আমাদের বসত-বাড়ি আপনি নগদ টাকায় বাবার কাছ থেকে কিনেছেন। আপনার কাছে কাগজপত্র আছে। আপনার কাছে খাজনার রশিদও আছে। আপনার কথা পুরোপুরি মিথ্যা। এটা যে মিথ্যা তা আপনি যেমন জানেন, গ্রামবাসীও জানে। বাংলাদেশ মগের মুল্লুক না। এখানে আইন-কানুন আছে। আপনি আমার আপন চাচা, মুরব্বি মানুষ, তারপরেও আমি অবশ্যই থানা পুলিশ করব। ইতিমধ্যে আমি উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করেছি। আদালতে দেওয়ানি মামলা রুজু করার সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। তারপরেও মিটমাটের সুযোগ আছে। বিদেশ যাত্রার আগে আগে আমার টাকা-পয়সা প্রয়োজন। আপনি জমি বিক্রির ব্যবস্থা করে টাকাটা আমাকে দিয়ে দিলে আমার বিরাট উপকার হয়। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য বাঞ্ছনীয় নয়। চাচিকে আমার সশ্রদ্ধ সালাম ও কদমবুসি। অন্যদের শ্রেণীমতো সালাম ও দোয়া।
ইতি
আপনার স্নেহের জয়নাল
ইতির ডিম খাওয়া শেষ হয়েছে, সে পানি খেল, শাড়ির আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বলল, চিঠিটা ছিড়ে ফেলে দিন। এই চিঠিতে কাজ হবে না। আরেকটা চিঠি লিখুন—
চাচাজি, আমার সালাম নিন। পত্রে জানলাম বাবার কাছ থেকে আপনি বসত-বাড়ি কিনে নিয়েছিলেন। খবরটা জানা ছিল না বলে আপনাকে এমন একটি চিঠি লিখেছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন। জমির দলিল এবং খাজনার রশিদ দেখাতে চেয়েছেন। চাচাজি, তার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনার মুখের কথাই যথেষ্ট। এখন চাচাজি আমি বিপদে পড়েছি। আমেরিকা যাবার ভাড়া জোগাড় করতে পারছি না। আপনি যদি আমেরিকা যাবার টিকিটের টাকা আমাকে ধার দেন তাহলে খুব উপকার হয়। চাচাজি, আপনি আমার এই উপকারটা করুন। আমি অবশ্যই তিন থেকে চার মাসের মধ্যে টাকাটা ফেরত দেব। চাচিজিকে আমার সালাম।
ইতি
আপনাদের স্নেহের জয়নাল
ইতি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, যেভাবে বললাম, ঠিক সেইভাবে চিঠি লিখে দেখুন উনি যদি কিছু পাঠান সেটাই হবে আপনার লাভ। অন্য কোনোভাবে কিছু করতে পারবেন না।
জয়নাল মুগ্ধ চোখে ইতির দিকে তাকিয়ে আছে। এমন এক আশ্চর্য মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হতে যাচ্ছে ভাবতেই কেমন লাগছে।