অতীনের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও সিদ্ধার্থ তাকে প্রায় জোর করেই নিয়ে গেল শান্তাবৌদির বাড়িতে।
শান্তাবৌদি ইলিশ মাছ খাওয়াবার নেমন্তন্ন করেছেন, ইলিশ মাছের নাম শুনেও যেতে রাজি হয় না, অতীন কি এমনই পাষন্ড? বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে থাকা অতীনের গায়ে একটা জামা ছুঁড়ে দিয়ে সিদ্ধার্থ বললো, আর কিছুদিন থাক তারপর বুঝবি। এদেশে আমাদের বাঙালীত্ব বলতে টিকে থাকে শুধু ইলিশ মাছ, দুর্গা পুজো আর রবীন্দ্রনাথ। এই নিউ ইয়র্কে একমাত্র শান্তাবৌদির বাড়িতেই ঐ তিনটে জিনিস পাবি!
বাঙাল পরিবারের ছেলে হলেও অতীনের ইলিশ মাছের প্রতি লোভ নেই। সপ্তাহের পর সপ্তাহ কোনোরকম মাছ না খেলেও তার কিছু আসে যায় না, ভাতের বদলে স্যাণ্ডুইচ বা হ্যামবার্গার খেয়ে সে দিব্যি চালিয়ে দিতে পারে। তাছাড়া নতুন কারুর সঙ্গে আলাপ করতে সে একেবারেই আগ্রহ বোধ করে না। শান্তাবৌদি নামে এক অচেনা মহিলার বাড়িতে সে কেন। যাবে?
সিদ্ধার্থ এসব ওজর আপত্তিতে কানই দিল না। শান্তাবৌদিকে সে জানিয়ে দিয়েছে যে তার সঙ্গে একজন বন্ধু থাকে, শান্তাবৌদি বিশেষ করে বলে দিয়েছেন সেই বন্ধুটিকে নিয়ে আসতে।
গজগজ করতে করতে উঠে বসে অতীন বললো, শনিবার দিনটা শুধু শুয়ে শুয়ে কাটাবো তারও উপায় নেই? গাদা গুচ্ছের প্যান্ট-শার্ট-কোট–জুতো-মোজা পরে বেরুতে কারুর ভালো। লাগে?
সিদ্ধার্থ হাসতে হাসতে বললো, তুই গ্যেটের ‘পোয়েট্রি অ্যান্ড লাইফ পড়েছিস?
–না, আমি কবিতা-টবিতা কিছু পড়িনি ভাই!
–এটা কবিতা নয়, প্রবন্ধ। তাতে গ্যেটে এক জায়গায় বোরডমের একটা উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেছেন, একজন ইংরেজ একদিন ঝোঁকের মাথায় আত্মহত্যা করে ফেললো, তার কারণ প্রত্যেকদিন নিয়মমাফিক জামা কাপড় পরা আর খোলা তার সহ্য হচ্ছিল না। সভ্যতার এই তো এক জ্বালা ভাই? তাও তো আমরা ইংরেজদের মতন নেমন্তন্ন বাড়ি যেতে হলে ফর্মাল ইভনিং ড্রেস পরি না, গলায় কালো বো বাঁধি না। তুই ইচ্ছে করলে তোর পাজামা পাঞ্জাবির।
ওপর ওভারকোটটা চাপিয়ে নিতে পারিস!
সিদ্ধার্থ অবশ্য একটু বেশী সাজ পোশাকই করলো। একটা সিল্কের সার্টে লাগালো ঝুটো মুক্তোর কাফ লিংক। টাইয়ের বদলে গলায় কায়দা করে জড়িয়ে নিল একটা বাটিকের কাজ করা স্কার্ফ।
রাস্তায় বেরিয়ে সিদ্ধার্থ অতীনকে দশটা ডলার দিয়ে বললো, কারুর বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গেলে সঙ্গে কিছু নিয়ে যাওয়া উচিত। তুই লিকার স্টোর থেকে এক বোতল ওয়াইন কিনে নিয়ে আয়, আমি সামনের দোকান থেকে কিছু ফুল কিনে নিচ্ছি।
অতীন পেছন ফিরে পা বাড়াতেই সিদ্ধার্থ ডেকে বলল, এই, কী ওয়াইন আনবি বল তো? অতীন নির্বিকার মুখে জিজ্ঞেস করলো, কী ওয়াইন? দশ-ডলারের মধ্যে যা পাওয়া যায়।
সিদ্ধার্থ হেসে বললো, বাঙাল আর কাকে বলে! এতদিন ইংলন্ডে কাটিয়ে এলি, ওখানে ওরা তোকে কিছু শেখায়নি? একটা যে-কোনো ওয়াইন নিলেই হলো? ইলিশ মাছের নেমন্তন্ন না? সাদা আমিষের জন্য সাদা মদ। এক বোতল বোদো হোয়াইট ওয়াইন নিয়ে আয়।
সিদ্ধার্থ কিনলো এক গুচ্ছ লালগোলাপ। ওয়াইনের বোতলের চেয়েও তার দাম বেশী। দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়ালো এইটথ স্ট্রিটের মোড়ে। সিদ্ধার্থের এক বন্ধু সমীর তাদের এখান থেকে তুলে নেবে।
অতীন একটা সিগারেট ধরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোর ঐ শান্তাবৌদির স্বামী কী করেন? সিদ্ধার্থ বললো, শান্তাবৌদির হাজব্যান্ড হলেন পাঁচুদা। একেবারে নিপাট ভালোমানুষ। পাঁচুদা আমাদের শিবপুর থেকে পাস করা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু আমি প্রায়ই ভাবি, ঐ গোবেচারা মানুষটি শিবপুরের হোস্টেলে পাঁচটি বছর কাটালেন কী করে! পাঁচুদা এক ঘণ্টায় একটার বেশী কথা বলেন না। ওদের বাড়িটাকে কেউ পাঁচুদার বাড়ি বলে না, সবাই বলে শান্তাবৌদির বাড়ি। শান্তাবৌদি গান গাইতে পারেন। এখানে বাঙালীদের থিয়েটার হলে শান্তাবৌদি বাঁধা হিরোইন। আবার লোককে ডেকে ডেকে খাওয়াতেও ভালোবাসেন! ওঁদের বাড়ি তো কুইন-এ, শান্তাবৌদিও এখনকার বাঙালীদের কুইন, মক্ষিরানীও বলতে পারিস।
–আমি ওখানে গিয়ে কী করবো বল ত, সিদ্ধার্থ? নিশ্চয়ই আরও অনেক লোক থাকবে, কারুকে চিনি না…
–এইভাবেই তো চোনাশুনো হয়।
–আমার শরীরটা সত্যি ভালো লাগছে না রে! আমি বাড়ি ফিরে যাই। আমার শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।
–একটা থাপ্পড় খাবি, অতীন। বলছি না, শান্তাবৌদির ওখানে গেলেই তোর জড়তা কেটে যাবে।
অতীন সিদ্ধার্থর চোখের দিকে চোখ রেখে অদ্ভুতভাবে হাসলো। কলকাতার কফি হাউসে তার বন্ধুদের মধ্যে সে ছিল স্বাভাবিক নেতা গোছের, তার মেজাজের জন্য সবাই তাকে ভয় পেত, এই সিদ্ধার্থ কোনোদিন তার মুখের ওপর একটাও কথা বলেনি।
সিদ্ধার্থ অতীনের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললো, চিয়ার আপ মাই বয়!
সমীর এসে পৌঁছলো কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে সাতটায়। দরজা খুলে দিয়ে বললো, চটপট উঠে পড়ো, এক্ষুনি টিকিট দিয়ে দেবে!
নো পার্কিং এলাকায় গাড়ি কয়েক মুহূর্ত থামানোই দারুণ অপরাধ, সিদ্ধার্থ দৌড়ে উঠে পড়লো সামনের সীটে, অতীন পেছনে।
আরও খানিকটা দূরে এসে সমীর একটা ড্রাগ স্টোরের সামনে থেকে তুললো তার স্ত্রী বাসবীকে। অতীনের সঙ্গে বাসবীর দেখা হয়নি আগে। সিদ্ধার্থ পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো, আমার বন্ধু অতীন, ব্রিলিয়ান্ট স্টুডন্ট, কয়েক মাস আগে এসেছে…
অতীন শুধু একটা শুকনো নমস্কার করলো, সারা রাস্তা একটাও কথা বললো না অন্যদের সঙ্গে।
শান্তাবৌদিদের বাড়িটা একটা সুন্দর নির্জন রাস্তায়, সামনে এক টুকরো বাগান। গাড়ি থেকে নেমে অতীন প্রথমেই লক্ষ করলো, সেই বাগানে অনেকগুলো বেশ বড় বড় গোলাপ ফুটে আছে। সিদ্ধার্থও গোলাপ ফুলই এনেছে।
বেল বাজাবার পর দরজা খুললেন শান্তাবৌদি নিজে। বেশ লম্বা ও বড় চেহারার মহিলা, মাথায় অনেক চুল, দেবী প্রতিমার মতন মুখের গড়ন। প্রথমেই তিনি বকুনির সুরে বললেন, তোমরা এত দেরি করলে, সমীর নিশ্চয়ই লেট করেছে? এই বাসবী, তোমায় বলেছিলুম না। আগে এসে আমায় একটু হেল্প করবে!
বাসবী বললো, আমার যে আটটায় ছুটি, তবু আমি পনেরো মিনিট আগে অফ নিয়েছি!
অতীনের দিকে চেয়ে শান্তাবৌদি বললেন, আপনিই বুঝি সিদ্ধার্থর বন্ধু? এ কী, আপনি ওয়াইন এনেছেন কেন? প্রথম দিন আমার বাড়িতে-না না এটা খুব অন্যায় হয়েছে, এত ওয়াইন জমে গেছে আমাদের…
সিদ্ধার্থর হাত থেকে গোলাপের গুচ্ছ নিয়ে তিনি বললেন, আঃ কী সুন্দর! ঠিক এই পারল কালারটা আমার বাগানে কিছুতেই ফোঁটাতে পারি না!
শান্তাবৌদিকে দেখেই অতীনের মনে হলো, এই মুখখানা যেন তার পরিচিত। কোথায় দেখেছে আগে? ।
ড্রয়িংরুমে ছ’সাতজন নারী পুরুষ আগে থেকেই উপস্থিত। পুরুষরা বাসবীর জন্য উঠে দাঁড়ালো, শান্তাবৌদি বললেন, তোমরা নিজেরা পরিচয় করে নাও, আমি চট করে একবার কিচেন থেকে ঘুরে আসছি! বাসবী, একটু এসো না আমার সঙ্গে!
এ বাড়িতে ফায়ার প্লেস আছে, তারমধ্যে কাঠের আগুনের বদলে জ্বলছে একটা ইলেকট্রিক হীটার। তার এক পাশে সাদা পাঞ্জাবি ও পাজামা পরে বসে আছেন এই পরিবারের কর্তা পাঁচুদা, মুখে পাইপ। সিদ্ধার্থ বসলো একটি কিশোরী মেয়ের পাশে। একজন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক অতীনকে ডেকে বসালেন নিজের কাছে। হাত তুলে নমস্কার করে তিনি বললেন, আমার নাম অমিয় মিত্র। আপনি দেশ থেকে নতুন এসেছেন বুঝি? দেশের খবর কী বলুন?
উল্টোদিক থেকে সিদ্ধার্থ বললো, অমিয়দা, ও হচ্ছে আমার কলেজের বন্ধু অতীন, এখানে। আসবার আগে বছর খানেক ইংল্যান্ডে কাটিয়ে এসেছে।
অমিয় মিত্র বললেন আঁ, ইংল্যান্ড! আমিও সেখানে ছিলাম, সেভেন ইয়ার্স, ওখানকার ওয়েদার আমার সুট করলো না, রোদ্দুর এত কম দেখা যায়, এত ঠান্ডা বরফ তো এখানেও পড়ে, কিন্তু ইংল্যান্ডে একেবারে ওয়েট কোল্ড…তা ছাড়া ব্রিটিশ জাতটা এখনো এত কনসিটেড, ওদের সঙ্গে মানিয়ে চলা…
সিদ্ধার্থ বললো, আসল কথাটা বলছেন না কেন অমিয়দা? ইংল্যান্ডের চেয়ে এখানে টাকা রোজগারের স্কোপ বেশী। অনেকেই এখন চান্স পেলে আটলান্টিক পাড়ি দিচ্ছে!
অমিয় মিত্র বললেন, যব স্যাটিসফ্যাকশান এখানে অনেক বেশী। ইফ ইউ ক্যান পুভ ইয়োর মেরিট অ্যান্ড এফিসিয়েন্সি, এখানে তুমি কাজ করার অনেক সুযোগ পাবে। রিসার্চের কাজ করতে গেলেও এখানে এতরকম সুবিধে আছে…
সিদ্ধার্থ আবার বললো, জব স্যাটিসফ্যাকশনের চেয়েও বড় কথা হচ্ছে টাকা! আমি অন্তত তাই বুঝি! পাউন্ডের থেকে ডলার অনেক স্ট্রং টনিক!
সমীর এসেই বার টেন্ডারের দায়িত্ব নিয়েছে। কার কী লাগবে, কার গেলাস খালি, এই সব দেখতে দেখতে সে অতীনের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, তোমাকে কী দেবো? স্কচ না বার্বন?
অতীন বললো, কিছু না!
কিশোরী মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে বলতে চমকে মুখ তুলে সিদ্ধার্থ তাকালো তার বন্ধুর দিকে। কয়েক সপ্তাহ ধরে অতীন খুব বেশী মদ্যপান করছে, বাড়িতে একা একা বসে বোতল শেষ করে, তার হঠাৎ মদ্যপানে অরুচি! পাঁচুদার বাড়িতে সিভাস রিগ্যাল থাকে, ঐ বোতল কেনার সাধ্য তার বা অতীনের নেই। পাঁচুদার বাড়িতে যত ইচ্ছে খাওয়া যায়।
সিদ্ধার্থ বললো, অতীন তুই বীয়ার নিবি? ভালো ডাচ বীয়ার আছে।
অতীন আবার দুদিকে মাথা নাড়লো। এমনকি কোকাকোলা নিতেও সে রাজি হলো না। তার ইচ্ছে করছে না। এই সব পার্টিতে মদই হোক বা ঠান্ডা নরম পানীয়ই হোক, হাতে একটা গেলাস ধরে থাকাই রীতি, অতীন শুধু সিগারেট টানতে লাগলো। কারুর সঙ্গে আলাপ করার বদলে সে টেবিল থেকে তুলে নিল নিউজউইক।
সব পার্টিতেই একজন কেউ প্রধান বক্তা থাকে। এখানে সেই ভূমিকা নিয়েছেন অমিয় মিত্র। ইনি অন্যদের কথা বলার বিশেষ সুযোগই দেন না। এর কায়দাটি বিচিত্র। ইনি অন্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা কিছু প্রশ্ন করেন, তারপর উত্তরটি শোনার আগেই সে বিষয়ে নিজে বলতে শুরু করে দেন।
এখন তিনি বলতে শুরু করেছেন প্রবাসীদের একটি অতি প্রিয় বিষয় নিয়ে। দেশের নিন্দে! অমিয় মিত্র দু’বছর আগে মাত্র তিন সপ্তাহের জন্য দেশে ঘুরে এসে এমনই শিহরিত হয়েছেন যে সেই সম্পর্কেই বলে যাচ্ছেন অনবরত। কলকাতায় গেলে ইংরিজি উচ্চারণ পর্যন্ত ভুলে যেতে হয়। ওখানকার ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় ফ্যার হয় না, ফাস্ট হয়! অমিয় মিত্রর এক খুড়তুতে ভাই হিস্ট্রি অনার্স পড়ে, তার যা ইংরিজি উচ্চারণের বহর! কলকাতার রাস্তাঘাটের যা অবস্থা, শিক্ষারও সেই একই রকম দুরবস্থা! নকশাল ছেলেরা স্কুল-কলেজ পোড়াচ্ছে, মাস্টারদের মারছে। লেখাপড়ার আর দরকার নেই।…কলকাতার বাতাসে নিশ্বাস নিতে পর্যন্ত কষ্ট হয়…
সিদ্ধার্থ দু’একবার প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে তারপর কিশোরী মেয়েটির প্রতি বেশী মনোযোগ দিল। অন্য মহিলারা এক পাশে উঠে গিয়ে সুপার মার্কেটে কী কী জিনিসের সেল দিচ্ছে সেই বিষয়ে আলোচনা করছেন। পাঁচুদা পাইপ টানতে টানতে হাসছেন মুচকি মুচকি।
অতীন কোনো কথাই শুনছে না। সে যেন পৃথিবীর লাজুকতম ব্যক্তি।
শান্তাবৌদি আবার এ ঘরে এসে ঢুকতেই অতীনের মনে পড়লো, এই মুখখানা সে দেখেছিল অনেকদিন আগে, দেওঘরে। তখন অতীন খুব ছোট, একটা বেশ বড় বাড়িতে থাকতেন। বুলামাসি, শান্তাবৌদির মুখখানা অবিকল সেই বুলামাসির মতন। কিন্তু সেই বুলামাসিই এই শান্তাবৌদি হতে পারেন না, এতদিনে বুলামাসির অনেক বয়েস হয়ে যাবার কথা–একবার ত্রিকূট পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে দেখা হয়েছিল বুলামাসিদের সঙ্গে। অতীনের মনে পড়ে যাচ্ছে, দাদা খুব মুগ্ধভাবে তাকিয়ে থাকতে বুলামাসির মুখের দিকে, তখন বুঝতে পারেনি, অতীন এখন বুঝতে পারছে, দাদা বুলামাসির প্রেমে পড়ে গিয়েছিল, দাদার কবিতার খাতায় দেওঘরের পটভূমিকায় দুটো কবিতা বোধ হয় বুলামাসিকে নিয়েই। কোথায় গেল সেই কবিতার খাতা?
অতীন কি সেটা শিলিগুড়ি নিয়ে গিয়েছিল? নাকি ফুলদির কাছেই রয়ে গেছে? ঠিক মনে পড়ছে না। শিলিগুড়িতে নিয়ে গেলে, সেটা আর কোনোদিনই পাওয়া যাবে না। ফুলদির। কাছেই রাখা উচিত ছিল।
শান্তাবৌদি বললেন, খাবার কিন্তু রেডি। তোমরা গরম গরম খেয়ে নাও, ঠান্ডা হলে একেবারে ভালো লাগবে না।
অমিয় মিত্র তখন একটা লম্বা গল্পের মাঝখানে, তাঁকে থামিয়ে দেওয়া হলো প্রায় জোর করে। ডাইনিং রুমে চলে এলো সবাই। টেবিলে এক সঙ্গে এতজন বসতে পারবে না, প্লেটে তুলে নিতে হবে। ধপধপে সাদা গরম ভাত থেকে ধোঁয়া উড়ছে। ইলিশ মাছ ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি পদ টেবিলে সাজানো।
এদেশে এই ইলিশের নাম শ্যাড মাছ। সাহেবদের দেশে সব কিছুই বড় বড়, পদ্মা-গঙ্গার ইলিশের চেয়ে এই শ্যাডও আকারে বড় হয়, তিন কেজি সাড়ে তিন কেজি ওজনেরও পাওয়া যায়। শান্তাবৌদি জানালেন যে একটি ইটালিয়ান মাছওয়ালা তার দোকানে এই শ্যাড় মাছ এলেই শান্তাবৌদিকে ফোন করেন। এই মাছ যে বাঙালীদের অতি প্রিয় তা ইটালিয়ানরাও জেনে গেছে।
ভাতের সঙ্গে খানিকটা ডাল নেওয়ার পর হঠাৎ অতীন ঠিক করে ফেললো, সে ঐ মাছ খাবে না!
শান্তাবৌদি একটু পরেই অতীনের প্লেটের দিকে নজর দিয়ে বললেন, এ কী, আপনি মাছ নিলেন না? দাঁড়ান আপনাকে আমি পেটির মাছ তুলে দিচ্ছি।
অতীন প্লেটটা সরিয়ে নিয়ে বললো, আমি ইলিশ মাছ খাই না। আমার গন্ধ লাগে।
শান্তাবৌদির মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তাঁর নিজের হাতে রান্না করা মাছকে প্রত্যাখ্যান। করা যেন তাঁর প্রতি ব্যক্তিগত অপমান।
তিনি সিদ্ধার্থর দিকে তাকিয়ে বললেন, এ কী, সিদ্ধার্থ, তুমি একথা আমাকে আগে বলোনি? আমি ইচ্ছে করে আজ মাংস করিনি, উনি কী দিয়ে খাবেন? ফ্রিজে স্যামন মাছ আছে, একটু দাঁড়ান, কয়েকখানা ভেজে দিচ্ছি!
সিদ্ধার্থও অবাক হয়ে গেছে। কলকাতায় অতীনদের বাড়িতে সে তিন-চারদিন ভাত খেয়েছে, অতীনকে সে ইলিশ মাছ খেতে দেখেছে। তবু অতীনের হঠাৎ মত পরিবর্তনে সে কোনো জোর করলো না। সে বললো, শান্তাবৌদি, আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলুম। অতীন। নিরামিষ খাওয়া প্র্যাকটিস করছে। ঐ তো ফুলকপির তরকারি, বেগুন ভাজা, পটল ভাজা রয়েছে, এতেই ওর হয়ে যাবে। আপনি পটল কোথা থেকে জোগাড় করলেন?
অন্যদের চেয়ে আগে খাওয়া শেষ করে প্লেট নামিয়ে রেখে অতীন চলে এলো লিভিংরুমে। তাড়াতাড়ি সে একটা সিগারেট ধরালো, সে বুঝতে পারছে, কারুর সঙ্গে আলাপ না করা, কথা না বলা, খাওয়ার জায়গায় দাঁড়িয়ে গল্প-হাসি-ঠাট্টায় যোগ না দেওয়া, শান্তাবৌদির রান্নার প্রশংসা না করে চলে আসা, এসবই অস্বভাবিক ও অভদ্রতা। তবু কিছুতেই সে মন খুলতে পারছে না।
খাওয়ার ঘরে হঠাৎ সব শব্দ থেমে গেছে। বোধ হয় সিদ্ধার্থ ফিসফিস করে অতীন সম্পর্কেই ওঁদের বলছে অনেক কিছু। যা খুশী বলুক।
… বাবা একদিন অনেক রাত্তিরে একজোড়া ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছিলেন বাড়িতে। তা নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল মায়ের সঙ্গে। অতীনের তখন পরীক্ষা চলছে, না, পরীক্ষা আরম্ভ হয়নি বোধ হয়, দু’একদিন বাকি ছিল, কিন্তু অত রাতে ইলিশ-টিলিশ খেতে একদম ইচ্ছে করেনি তার, সে রাগারাগি করেছিল বাড়িতে ফ্রিজ নেই, সেই মাছ রেখে দেবার উপায় ছিল না, বাবা সব ফেলে দিয়েছিলেন–বাবা মনে দুঃখ পেয়েছিলেন…এখনও তো বাড়িতে ফ্রিজ নেই, বাবা অনেক টাকা ধার করেছেন তারজন্য–তিন-চার শো ডলার পাঠাতে পারলে একটা ফ্রিজ কেনা যায়-যতদিন না কলকাতার বাড়িতে একটা ফ্রিজ কিনে দেবার ক্ষমতা তার হবে, ততদিন সে ইলিশ মাছ কেন, আর কোনো মাছই খাবে না!
হাত থেকে জ্বলন্ত সিগারেটটা পড়ে গেল নরম পুরু কার্পেটে। তক্ষুনি নিচু হয়ে সিগারেটটা তুলে নেওয়া উচিত, কিন্তু সে তুলছে না, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে। কার্পেটে আগুন ধরে যেতে দেরি হলো না, ধোঁয়া উঠছে, এক্ষুনি যে-কেউ এঘরে এসে পড়তে পারে, ধোঁয়া দেখে আঁতকে উঠবে, এদেশে সাংঘাতিক আগুন-ভীতি। শান্তাবৌদিকে খারাপ লাগেনি অতীনের, পাঁচুদার মুখেও একটা স্নিগ্ধ ভাব আছে, তবু কেন সে এদের বাড়ির দামি কার্পেট পোড়াচ্ছে?
পাশের ঘরে হঠাৎ সবাই একসঙ্গে হেসে উঠতেই অতীন চমকে উঠলো। এবারে সে তাড়াতাড়ি সিগারেটটা তুলে পা দিয়ে নেবাতে লাগলো আগুন। অনেকটা পুড়েছে, একটা আধুলির সাইজের কালো গোল গর্ত হয়ে গেছে। চোখে পড়বেই। অতীন তার সোফাটা টেনে এনে পোড়া জায়গাটা চাপা দিল। তারপর নিজে গিয়ে বসলো উল্টো দিকে।
সবচেয়ে আগে এ ঘরে এলেন পাঁচুদা। একেবারে অতীনের কাছে এসে নরম গলায় বললেন, এখনও হোম সিকনেস কাটেনি? আমারও মাঝে মাঝে…
অতি সাধারণ একটা কথা। তবু অতীনের মাথায় দপ করে জ্বলে উঠলো রাগ। বাড়ির কথা মনে পড়া, নিজের দেশের কথা মনে পড়া একটা অসুখ? সিকনেস?
কিছু উত্তর দিতে গেলেই অতীনের মুখ দিয়ে কঠিন কথা বেরিয়ে আসবে, তাই সে চুপ করে চেয়ে রইলো। পাঁচুদাও যেন উত্তর চাননি, চলে গেলেন নিজের আসনে।
অন্যরা এসে বেশ কিছুক্ষণ ধরে প্রশংসা করতে লাগলো মাছ রান্নার ও স্বাদের। শান্তাবৌদি ছাড়া আর কেউ অতীনের সঙ্গে যেচে কথা বললো না। অন্য মাছ বা মাংস রান্না করেনি বলে শান্তাবৌদির আফসোসের শেষ নেই, তরকারিও সেরকম কিছু ছিল না। অতীন যদি নিরামিষ পছন্দ করে তাহলে তিনি আর একদিন অতীনকে শুধু নিরামিষই রান্না করে খাওয়াবেন। অতীনকে আবার আসতেই হবে।
এরপর শান্তাবৌদি পর পর তিনখানা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেন সকলের অনুরোধে।
অতীন খুব একটা গানের সমঝদার নয়, তবু সে বুঝতে পারলো, মহিলা ভালই গান জানেন। অনেকটা রাজেশ্বরী দত্তের মতন গলা। গান শুনতে শুনতে হঠাৎ অতীনের একটা কথা মনে পড়ে গেল। খাবার শেষ করার পর সে তার প্লেটটা টেবিলের নিচে রেখে দিয়েছিল। সেটা একটা অপরাধ হয়েছে। এ দেশে খাওয়ার পর নিজের বাসনটা মেজে দেওয়াই নিয়ম। ঝি-চাকর তো নেই, কে অন্যের এঁটো বাসন মাজবে?
তার প্লেটটা কি এখনো টেবিলের নীচে রয়ে গেছে? তাহলে এই বেলা মেজে দেওয়া উচিত। গানের মাঝখানে অতীন উঠে গেল ডাইনিং রুমে, না টেবিলের নিচে তার প্লেটটা নেই, এমনকি সিংকেও নেই। কে ধুয়েছে, শান্তাবোদি না সিদ্ধার্থ?
ডাইনিং রুমটা বেশ গরম। পাশের ঘরে গিয়ে গান শোনার বদলে এই ঘরে থাকাটাই তার কাছে আরামপ্রদ মনে হলো। এ বাড়িতে বসবার ঘরের বাইরে জুতো খুলতে হয়। সেই সময় অতীন মোজাও খুলে ফেলেছে বলে তার পায়ে শীত লাগছে।
খানিকবাদে বাসবী এসে দেখলো, সেই ঘরের ঠিক মাঝখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে অতীন। সোজা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে।
বাসবী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, আপনি এখানে কী করছেন?
অতীন কড়াগলায় বললো, দেখতেই তো পারছেন, এমনিই দাঁড়িয়ে আছি।
বাসবীর ভুরু কুঁচকে গেল। এরকম উত্তর পেতে সে অভ্যস্ত নয়। সে বললো, আমরা এখন বাড়ি যাবো, আপনি যদি আমাদের সঙ্গে যেতে চান–
শুধু মাত্র যদি কথাটার জন্যই অতীন বললো, না, আমি আপনাদের সঙ্গে যাবো না। পরক্ষণেই সিদ্ধার্থ দরজার কাছ থেকে মুখ বাড়িয়ে বললো, এই অতীন, চল!
সিদ্ধার্থর কাছে অবশ্য জেদাজেদি করতে পারলো না অতীন, তাকে সমীরের গাড়িতেই উঠতে হলো। এবার সে বসলো সামনের সীটে। কিশোরীর মতন চেহারার মেয়েটি ঠিক কিশোরী নয়, তার নাম নীতা, সে পি-এইচ ডি’র ছাত্রী। তাকেও পথে নামিয়ে দিতে হবে, সিদ্ধার্থ বাসবী আর নীতার সঙ্গে পেছনে বসেছে, সিভাস রিগ্যাল অনেকটা পান করে বেশ ফুরফুরে নেশা হয়েছে তার। সে নীতার কাঁধে মৃদু চাপড় দিতে দিতে গান গাইছে, দেয়ার ইজ আ গোল্ড মাইন ইন দা স্কাই ফার অ্যাওয়ে, উই উইল ফাঁইন্ড ইট…
অন্যসময় সিদ্ধার্থ নানারকম বাংলা গান গায় কিন্তু বিলিতি মদের নেশা হলেই তার গলা দিয়ে ইংরিজি গান ছাড়া অন্য কিছু বেরোয় না।
নীতার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার দরকার হলো না, সে নিজে থেকেই অতীনকে বললো, আপনি খুব অহংকারী, তাই নয়? কারুর সঙ্গে কথা বলছিলেন না!
সিদ্ধার্থ নীতার কাঁধে চাপ দিয়ে ইঙ্গিত করলো চুপ করতে। নীতা তবু বললো, আপনি সবার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিলেন, আপনার চোখ দেখে মনে হচ্ছিল, আমরা সবাই বোকা, আপনিই একমাত্র বুদ্ধিমান!
সিদ্ধার্থ বললো, আরে, তুমি জোর করে আমার বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া বাধাচ্ছো কেন? লিভ হিম আলোন!
নীতা ফস করে ঝেঝে উঠে বললো, হি হ্যাঁজ নো রাইট টু ইনসাল্ট শান্তাবৌদি? সাচ আ নাইস লেডি, এত যত্ন করে খাওয়ান…আপনার বন্ধুটি খাবার নামে একটা ফার্স করলেন, তারপর শান্তাবৌদির গানের মাঝখানে ঐ ভাবে উঠে যাওয়া কেউ কখনো যায়? শান্তাবৌদি দুঃখ পেলেও মুখে কিছু বললেন না!
বাসবী বললো, উনি গানের মাঝখানে ডাইনিং রুমে উঠে চলে গেলেন, আমি ভাবলুম, বুঝি আবার খিদে পেয়ে গেছে! যদি ওকে কিছু হেল্প করতে পারি, সেইজন্যে গিয়ে দেখি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি কেন দাঁড়িয়ে আছেন, জিজ্ঞেস করতেই এমন ধমকে দিলেন আমাকে!
সিদ্ধার্থ বলল, হ্যাঁরে অতীন, তুই অতক্ষণ ডাইনিংরুমে কী করছিলি? সত্যি খিদে পেয়েছিল নাকি?
সমীর জিজ্ঞেস করলো, তুমি আমাদের সঙ্গে এসেছো, ফেরার সময় আমার গাড়িতে যাবে না। বলছিলে কেন?
অতীনের মনে হলো, এই গাড়ির অন্য চারজন এভাবে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে, তাকে উত্তর দিতেই হবে? ডাইনিং রুমে সে কেন গিয়েছিল তার মনে পড়ছে না এখন। কোনো ঘরের মাঝখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকাটা কি অপরাধ? সে উত্তর না দিলে এরা তাকে ছাড়বে না। সারা রাস্তা প্রশ্নবাণ দিয়ে তাকে খোঁচাবে। সত্যি সত্যি যেন ঐ চারজনের হাতে ধারালো অস্ত্র, তারা অতীনকে খোঁচাচ্ছে, অতীনের হাত-পা বাঁধা
সিদ্ধার্থ, বাসবী, সমীর, নীতা চার রকম গলায় বলতে লাগলো, কেন? কেন? কেন? কেন? অতীন, তুমি কেন ওটা করো নি? তুমি কেন ওটা করেছো?
অতীন ছটফট করতে লাগলো, দু’ হাতে কান চাপা দেবার চেষ্টা করলো। কোনো উত্তর দিতে পারছে না সে, প্রশ্নও সহ্য করতে পারছে না!
ঝট করে অতীন খুলে ফেললো সীটবেল্ট, তারপর গাড়ির দরজাটাও খুলে এক লাফ দিল রাস্তায়।
মেয়েটি আর্তনাদ করে উঠলো!
সিদ্ধার্থ পাংশু মুখে, ফ্যাসফেসে গলায় বললো, মিরাকল! মিরাকল!
অতীন গাড়ির দরজার হ্যাঁন্ডেল খোলার চেষ্টা করতেই সমীরের পা যান্ত্রিকভাবেই চলে গিয়েছিল ব্রেকে। দরজাটা খুলে যেতেই সে পুরো ব্রেকে চাপ দেয়।
এরপর অনেকগুলি দৈবাৎ যোগাযোগে তারা বড় রকম দুর্ঘটনা থেকে বেঁচেছে। এরকম হঠাৎ ব্রেক কষায় গাড়ি উল্টে যেতে পারতো, তা না করে খানিকটা এদিক ওদিক বেঁকেছে। মাত্র। সমীরের গাড়ির ঠিক পেছনেই কোনো গাড়ি ছিল না, থাকলে সেই গাড়ি নির্ঘাৎ এসে ধাক্কা মারলে তাকে।
অতীন গড়িয়ে গেছে পাশের লেনে। সেখানে পর পর তিনটি গাড়ি, চাপা পড়ে ছাতু হয়ে যাবার কথা ছিল তার। কিন্তু প্রথম গাড়িটি শেষ মুহূর্তে ব্রেক কষেছে, দ্বিতীয় গাড়িটা কিছুটা। দূরত্বে ছিল। সে ব্রেক কষলেও সামান্য ধাক্কা মেরেছে এসে প্রথম গাড়িতে, তৃতীয় গাড়ি মেরেছে তাকে।
সিদ্ধার্থ আর সমীর দু’জনেই দৌড়ে গেল অতীনের কাছে। একটা ক্যাডিলাক গাড়ির সামনের চাকা থেকে মাত্র দু’হাত দূরে পড়ে আছে অতীন। তার কোনো অঙ্গেরই কিছুমাত্র ক্ষতি হয়নি। সমীর ঠিক সময় ব্রেকে পা দিয়ে গতি কমিয়ে দিয়েছিল, নইলে ষাট-সত্তর মাইল গতিতে চলন্ত গাড়ি থেকে পড়ার আঘাতেই সে মরে যেতে পারতো।
সিদ্ধার্থ তার বন্ধুকে হাত ধরে টেনে দাঁড় করালো, কপালের একটা পাশ সামান্য ছড়ে যাওয়া। ছাড়া আর কিছুই হয়নি অতীনের।
ক্যাডিলাক গাড়ির ড্রাইভার নেমে এসে গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করলো, কী হলো ব্যাপারটা? আমি প্রথমে ভাবলাম, তোমরা বুঝি একটা ডেডবডি ডিসপোজ অফ করছো!
সমীর তাকে প্রচুর ধন্যবাদ জানিয়ে বললো, আমাদের গাড়ির সামনের দরজাটা হঠাৎ খুলে গিয়েছিল, সেইজন্যই এই দুর্ঘটনা।
ক্যাডিলাক গাড়ির প্রৌঢ় ড্রাইভার এপাশে এসে সমীরের সেকেন্ড হ্যাঁন্ড ফোর্ড গাড়িটা দেখলো। সামনের দরজার লকটা পরীক্ষা করলো তিন চারবার। পুরোনো গাড়িতে একটু লড়ঝরে ভাব থাকেই। সে অতীনের দিকে তাকিয়ে বললো, ঈশ্বর আজ আমাকে খুনী হওয়ার দায় থেকে বাঁচালেন। তোমাকে মারলে আমার কোনো শাস্তি হতো না, কিন্তু মনে একটা দাগ তো থেকে যেত!
রাত পৌনে বারোটা হলেও রাস্তায় পর পর জমে যেতে লাগলো গাড়ি। পুলিশের গাড়িও এসে গেল অবিলম্বে। কোনো রকম চ্যাঁচামেচি, রাগারাগি, অন্যকে দোষারোপের ব্যাপার নেই, সবাই চুপচাপ। সমীরের গাড়ির ইনসিওরেন্স কম্পানির নাম ও নম্বর টুকে নিল পুলিশ। সমীর মাত্র দু পেগ হুইস্কি খেয়েছে, তাকে ড্রাংক ড্রাইভারও বলা যাবে না, অতীনের মুখেও মদের গন্ধ নেই। অতীনের বয়েসী একটি যুবক ইচ্ছে করে চলন্ত গাড়ির দরজা খুলে লাফ মারবে, এটা ওদের কাছে অকল্পনীয়। একটুবাদেই পুলিশ ওদের ছেড়ে দিল।
মেয়ে দুটি আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে। গাড়ি ছাড়ার পরও কেউ কোনো কথা বললো না।
একটু বাদে সিদ্ধার্থ বললো, তুই কী করে বেঁচে গেলি, অতীন, সেটাই মহা আশ্চর্য ব্যাপার। মিরাকুলাস এসকেপ ছাড়া আর কী বলা যায়? নেক্সট টাইম তোর যখন এরকম নাটক করার ইচ্ছে হবে, তুই ওয়াশিংটন ব্রীজ থেকে ঝাঁপ দিস, আমাদের এরকম বিপদে ফেলিস না।
সমীর বললো, এখন এসব কথা থাক, প্লীজ।
সিদ্ধার্থ তবু বললো, আমার মাথা গরম হয়ে গেছে! পুলিশ দেখলেই আমার…অতীন, তোকে আর একটা কথা বলে দিচ্ছি, এই সবার সামনে। আমি তোকে সাত দিনের নোটিস দিলাম, তুই আমার অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে অন্য জায়গা খুঁজে নিবি। অনেক ঝাট সহ্য করেছি ভাই, আর না। তোকে আর আমি জায়গা দিতে পারবো না।
অতীন মুখ ঘুরিয়ে সিদ্ধার্থের দিকে চেয়ে হাসলো।