০৬. অকারণ সমালোচনা ক্ষতি ডেকে আনে
১৯২৯ সালে এমন একটা ব্যাপার ঘটে যার ফলে শিক্ষাবিদ মহলে বেশ একটা জাতীয় আলোড়ন ঘটে যায়। সারা আমেরিকার শিক্ষিত লোক ব্যাপারটা দেখার জন্যেই ছুটে যান শিকাগোয়। কয়েক বছর আগে রবার্ট হাচিনসন নামে এক তরুণ ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়েছিলেন। এই সময় তিনি ওয়েটার, কাঠুরে, শিক্ষক, কাপড়ের ফেরিওয়ালা হিসেবেই কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছিলেন। এরপর এখন মাত্র আট বছর পরে, তাঁকেই আমেরিকার চতুর্থ অর্থশালী বিশ্ববিদ্যায় শিকাগোর প্রেসিডেন্ট পদে বরণ করা হয়েছিল। তাঁর বয়স? মাত্র ত্রিশ। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। অন্যান্য শিক্ষাবিদরা মাথা ঝাঁকাতে চাইলেন। পাহাড় গড়িয়ে পড়া পাথরের স্রোতের মতোই সমালোচনার ঝড় বয়ে গেলো। সকলে নানা ভাবে তার সমালোচনা করে বলতে লাগলেন ‘সে এ-নয়’ ‘তা-নয়’ এসব–তাঁর বয়স বড় কম, অভিজ্ঞতা নেই-শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর ধারণা বাঁকা পথে চলে। এমন কি খবরের কাগজগুলো পর্যন্ত সকলের সুরে সুর মেলাল।
তাকে যেদিন প্রেসিডেন্ট পদে বরণ করা হয় সেদিনই হাচিনসনের বাবা রবার্ট মেসার্ড হাচিনসনকে তার এক বন্ধু বললেন, আজ সকালে খবরের কাগজের সম্পাদকীয়তে তোমার ছেলে বিরুদ্ধে বিষোদার দেখে আমার অত্যন্ত খারাপ লেগেছে।’
‘হ্যাঁ’, হাচিনসনের বাবা জবাব দিলেন, ‘খুবই কড়া সমালোচনা, তবে মনে রেখো, কেউ মরা কুকুরকে লাথি মারে না।
কথাটা সত্যি। কুকুর যত নামী হয়, ততই আবার লোক তাকে লাথি মেরে মানসিক আনন্দ পায়। প্রিন্স অব ওয়েলস, যিনি পরে অষ্টম এডোয়ার্ড হন (এমন ডিউক অব উইন্ডসর) বেশ ভালো রকম লাথি হজম করার কথাটা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি তখন ডেভিনশায়ারে ডার্টমুখ কলেজে শিক্ষা নিচ্ছিলেন। এই কলেজ আনাপেলিনের নৌ একাডেমিরই সমতুল্য। প্রিন্সের বয়স তখন প্রায় চৌদ্দ। একদিন জনৈক নৌ-অফিসার তাঁকে কাঁদতে দেখে তার কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। প্রথমে প্রিন্স কথাটা বলতে চান নি, পরে সত্যি কথাটা বলে ফেললেন। তাঁকে নৌ-শিক্ষার্থীরা লাথি মেরেছিল। কলেজের কমোডোর সমস্ত ছেলেদের ডাকলেন। তারপর তাদের তিনি বললেন যে প্রিন্স কোনো অভিযোগ করেন নি, তা সত্ত্বেও তিনি জানতে চান তাঁকে এরকম কড়া ব্যবহারের জন্য বেছে নেয়া হল কেন?
অনেক চেঁচামেচি, হম্বিতম্বি আর মেঝেয় পা ঠোকাঠুকির পর শিক্ষার্থীরা শেষপর্যন্ত স্বীকার করল যে তারা বড় হয়ে যখন রাজার নৌবাহিনীতে কমান্ডার আর ক্যাপ্টেন হবে তখন তাদের এ কথা বলতে পারলে বড় আনন্দ হবে যে তারা একদিন রাজাকে লাথি মেরেছিল।
তাই মনে রাখবেন, আপনাকে কেউ যখন লাথি মারে বা আপনার সমালোচনা করা হয় তখন সেই লোকটির মনে দারুণ শ্রেষ্ঠত্ব বোধ জাগে। এ থেকে প্রায়ই বোঝা যায়-আপনি এমন কিছু ভালো কাজ করতে পেরেছেন তাঁদের নিন্দা করে বেশ বন্য আনন্দ অনুভব করেন। উদাহরণ হিসেবে বলছি, আমি যখন এই পরিচ্ছেদটা লিখছিলাম তখন একজন মহিলার কাছ থেকে স্যালভেশন আর্মির জেনারেল উইলিয়াম বুথের নিন্দা করা একখানা চিঠি পাই। আমি জেনারেল বুথের সম্পর্কে প্রশংসা করে একটা বেতার ভাষণ দিয়েছিলাম। এই কারণেই মহিলা আমাকে চিঠিটা লেখেন। তিনি ওই চিঠিতে লিখেছিলেন, জেনারেল বুথ গরিব মানুষদের সাহায্যের নাম করে আশি লক্ষ ডলার তুলে সেটা তছরূপ করেছেন। এ অভিযোগ অবশ্য একেবারেই অযৌক্তিক, অসম্ভব। কিন্তু মহিলাটি তো সত্য অন্বেষণ করতে চান নি। এর আসল কারণ তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ একজন মানুষকে নিন্দা করার মধ্য দিয়ে তিনি ওই বন্য আনন্দ উপভোগ করতে চাইছিলেন। আমি চিঠিটা বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালাম-ভাগ্যিস ওই মহিলার সঙ্গে আমার বিয়ে হয় নি। তার চিঠিতে জেনারেল বুথ সম্বন্ধে আমি কিছুই জানতে পারি নি বটে তবে মহিলা সম্পর্কে অনেক কথাই জেনেছি। বহু বছর আগে সোপেন হাওয়ার বলেছিলেন : নোংরা মানুষেরা বিখ্যাত মানুষদের ভুল আর বোকামিতে আনন্দ বোধ করে।
কেউ অবশ্য ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টকে নোংরা মানুষ বলে ভাববেন না, তা সত্ত্বেও ইয়েলের একজন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট টিমোথি ডোয়াইট আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন এমন একজনকে আক্রমণ করে অপার আনন্দ উপভোগ করেছিলেন। ইয়েলের সেই প্রেসিডেন্টে বলেছিলেন সবাই সতর্ক করে যে, ওই লোকটা দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে আমাদের বৌ-মেয়েদের আইনের মধ্য দিয়ে বারবণিতায় পরিণত হতে হবে, তারা অপমানিত হবে, খারাপ হয়ে যাবে, সাধুতা আর কমনীয়তা চলে যাবে এবং আল্লাহকে আর মানুষ অসন্তুষ্ট হবেন।
এটা অনেকটা হিটলারকে নিন্দে করার মতোই শোনাচ্ছে, তাই না? কিন্তু তা নয়। এটা ছিল টমাস জেফারসনকে লক্ষ্য করে বলা। কোন্ টমাস জেফারসন? নিশ্চয়ই সেই অমর টমাস জেফারসন সম্পর্কে নয় যিনি স্বাধীনতার সনদ রচনা করেন এবং যিনি ছিলেন গণতন্ত্রের পূজারি? হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, তিনিই সেই মানুষ।
আপনার ধারণা আছে কোন আমেরিকানকে ‘ভণ্ড’, ‘প্রতারক’ আর ‘প্রায় খুনের মতো’ বলে নিন্দে করা হয়েছিল? খবরের কাগজের এক কার্টুনে তাকে গিলোটিনের তলায় দেখানো হয়–বিরাট এক ছুরির আঘাতে পরক্ষণেই তার গলা দ্বিখণ্ডিত করা হবে। জনসাধারণ তাকে দেখে হিসহিস করেছে, বিদ্রূপ করেছে তিনি যখন রাস্তায় ঘোড়ায় চড়ে যান। তিনি কে ছিলেন? জর্জ ওয়াশিংটন।
তবে এ ব্যাপার ঘটেছিল বহু বছর আগে। কে জানে মানুষের চরিত্র হয়তো তারপর অনেকটাই বদলে গেছে। আসুন, দেখাই যাক। অ্যাডমিরাল পিয়েরির ব্যাপারটাই ধরা যাক–সেই দেশ আবিষ্কারক যিনি ১৯০৯ সালের ৬ই এপ্রিল কুকুরে টানা স্লেজ গাড়িতে চড়ে উত্তর মেরু পৌঁছে দুনিয়ায় তাক লাগিয়ে দেন। যে গৌরব অর্জন করার জন্য পৃথিবীর বহু সাহসী মানুষ অনাহারে থেকে, নানা কষ্ট সহ্য করে ঠাণ্ডায় প্রায় মারা গিয়ে বহু শতাব্দী ধরেই চেষ্টা করেছেন। পিয়েরি নিজেও প্রায় ঠাণ্ডায় মারা যেতেই বসেছিলেন। তার পায়ের আটটা আঙুল ঠাণ্ডায় এমনভাবে জমে গিয়েছিল যে সেগুলো পরে কেটে ফেলতে হয়। দারুণ দুর্বিপাকে পড়ে তার এমন অবস্থা হয় যে তিনি ভেবেছিলেন হয়তো পাগল হয়ে যাবেন। তার উপরের নৌ অফিসারেরা ওয়াশিংটনে বসে ঈর্ষায় জ্বলছিলেন, কারণ লোকেরা পিয়েরিকে এত প্রশংসা আর প্রচার করছিল। তারপর সেই লোকেরা তাঁর নামে দোষারোপ করতে শুরু করল তিনি নাকি বৈজ্ঞানিক অভিয়ানের জন্য টাকা আদায় করে সেই টাকায় মেরু প্রদেশে স্মৃতি করে কাটাচ্ছেন। এমন ধরনের কথা হয়তো তারা বিশ্বাসও করতে শুরু করেছিল, কারণ আপনি যা বিশ্বাস করতে চান সেটা বিশ্বাস না করা প্রায় অসম্ভব কাজ। পিয়েরিতে হেয় প্রতিপন্ন করতে আর তাঁকে দাবিয়ে রাখতে চক্রান্তটা এমনই ভয়ানক হয়ে ওঠে যে, শেষপর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ম্যাকিনলের এক সরাসরি আদেশের বলেই পিয়েরিকে মেরু অঞ্চলে তার কাজ চালিয়ে যেতে সুযোগ দেয়।
পিয়েরির পিছনে এমন করে কেউ লাগত, তিনি যদি নৌ-বিভাগের একজন কর্মচারী হয়ে নিউইয়র্কের অফিসে ডেস্কে বসে কাজ করতেন? না। যেহেতু তিনি এমন কোন নামী মানুষ হতেন না যে, তাকে দেখে লোকে ঈর্ষাপরায়ণ হবে।
অ্যাডমিরাল পিয়েরির চেয়ে জেনারেল এ্যান্টের অভিজ্ঞতা আরো ভয়াবহ। ১৮৬২ সালে জেনারেল গ্র্যান্ট উত্তরাঞ্চলের পক্ষে সবচেয়ে কার্যকরী যুদ্ধে জয়লাভ করেন–যে জয় একটা অপরাহ্নেই সংঘটিত হয়–যে জয় রাতারাতি জেনারেল গ্র্যান্টকে জাতীয় বীরের আসনে বসিয়ে দেয়–যে ঘণ্টা–ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুরণন তুলে, আর মেইন নদীর তীর থেকে মিসিসিপির তীর বরাবর আগুন জ্বালিয়ে প্রায় উৎসব পালন করা হতে থাকে। তার সত্ত্বেও মাত্র এই বিরাট জয়লাভ করার ছ’ সপ্তাহ পরে-গ্র্যান্ট, যিনি উত্তরাঞ্চলের বীর–তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার সেনাবাহিনীকে তার হাত থেকে কেড়ে নেয়া হয়। তিনি অপমান আর হতাশায় আকুল কান্নায় ভেঙে পড়েন।
জেনারেল উই. এস. গ্র্যান্টকে তার বিজয় গর্বের মুহূর্তে গ্রেপ্তার করা হল কেন? বেশিরভাগ কারণ হল–তিনি তাঁর অহঙ্কারী উপরওয়ালাদের ঈর্ষার শিকার হন বলেই।
আমরা যদি অন্যায় সমালোচনা ব্যাপারে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার ফাঁদে পা রাখতে যাই তাহলে নিচের কার্যকর নিয়মটা মেনে চলা উচিত :
মনে রাখবেন, অন্যায় সমালোচনা অনেক ক্ষেত্রেই আড়াল করা প্রশংসাই। আরো মনে রাখবেন, মরা কুকুরকে কেউ লাথি মারে না।