2 of 3

০৬৩. ইরফান নামে যে লোকটা

ইরফান নামে যে লোকটাকে বিপিন লাঠির তালিম দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছে সে লোকটা যে ওস্তাদ এক নজরেই বোেঝা যায়। চওড়া ধরনের চ্যাপটা মেদহীন পেটানো শরীর। এক বিন্দু ঢিলেমি নেই শরীরে। পাখসাট মেরে লাঠি ঘোরায় বিদ্যুতের গতিতে।

বার-বাড়ির মাঠের ধারে কাঠের চেয়ারে বসে নিবিষ্টভাবে দেখছিলেন হেমকান্ত। ইরফান তালিম দিচ্ছে কৃষ্ণকান্তকে। কৃষ্ণকান্তর পায়ের কাজ চমৎকার। বয়সের অনুপাতে তার গ্রহণক্ষমতা অনেক বেশি। হেমকান্ত দেখলেন, ঘণ্টাখানেকের তালিমে চমৎকার পাল্লা দিয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণকান্ত। তার বুকটা ভরে যায়। গা গরম হয়ে ওঠে।

ইরফান ঘেমো শরীরে লাঠিটা নামিয়ে রেখে হেমকান্তকে একটা সেলাম দিয়ে বলল, এ তো তৈরি আছে কর্তা। বেশি সময় লাগবে না।

হেমকান্তর রক্ত চনমন করছিল অনেকক্ষণ। কিন্তু চক্ষুলজ্জায় মুখ ফুটে বলতে বাঁধছিল, একটু হবে নাকি আমার সঙ্গে? ওস্তাদ লোক দেখলে কার না ইচ্ছে হয় তার সঙ্গে তাল ঠুকতে!

কৃষ্ণকান্ত ধপাস করে হেমকান্তর চেয়ারের পাশে মাটিতে বসে বলল, বাবা, আপনি একটু লাঠি ধরুন না। ইরফানদাদা ভাল লড়ে।

হেমকান্ত লাজুক গলায় বললেন, না, না। থাক।

বলেন বটে, কিন্তু চেয়ারে ঠেস দিয়ে রাখা লাঠিটা হাতে তুলে নেন তিনি।

ইরফান একটু হেসে বিনীতভাবে বলে, ধরেন না কর্তা। ধরেন।

হেমকান্তকে আর বলতে হল না। উঠে কাপড়টা মালকেঁচা মেরে নিলেন। তারপর নেমে পড়লেন।

ইরফান ভালই লড়ে। কিন্তু হেমকান্তর বিস্মৃতপ্রায় কলাকৌশল সবই কৃষ্ণকান্তকে শেখাতে গিয়ে আবার আয়ত্তে এসেছে। আধ ঘণ্টা লাঠি ঠোকাঠুকি করলেন ওস্তাদের মতোই। ইরফান হয়তো তেমন গা ঘামাল না। একটু ছেড়ে এবং বাঁচিয়ে লড়ল। তা হোক। হেমকান্তর তৃপ্তি এটুকুই যে, তিনি ততটা বুড়িয়ে যাননি।

লড়াইয়ের শেষে হেমকান্ত খুব চওড়া মুখে হাসছিলেন। মনটা বড় ভাল লাগছে। শরীরটা লাগছে পালকের মতো হালকা আর ঘোড়ার মতো তেজি।

কৃষ্ণকান্ত বাবার কৃতিত্বে মুগ্ধ। বড় বড় চোখে হেমকান্তর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, বাবা, আপনি ইরফানদাদার চেয়েও ওস্তাদ।

ইরফানও বিনীতভাবে বলে, কর্তার হাত বড় সজুত।

হেমকান্ত লজ্জায় রাঙা হলেন।

ভেজা গামছায় গা মুছে ছেলেকে নিয়ে ঘরে এসে বসলেন হেমকান্ত। মিছরির জলে লেবু দেওয়া সরবতের গ্লাস হাতে তুলে নিয়ে বললেন, শুনলাম তুমি নাকি ধ্যান-ট্যান করো!

কৃষ্ণকান্ত বলে, করি।

ধ্যানট্যান গুরু ছাড়া করা বিপজ্জনক। অধীরবাবুব ছেলে ওইসব করতে গিয়ে পাগল হয়ে গেল। তা তোমার এই বয়সেই ধ্যানের ইচ্ছে হল কেন?

আমি একটা বইতে পড়েছি ধ্যান করলে মনের জোর বাড়ে।

সে তো বটেই। শরীরের চেয়ে মনের শক্তি অনেক বেশি। মনের জোর যার আছে সেই প্রকৃত শক্তিমান। আর একথাও ঠিক, ধান মনের শক্তি বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তার জন্য একজন গুরু চাই। গুরুতে চাই ভক্তি ও বিশ্বাস।

পইতে হলে ধ্যানে অধিকার জন্মায়, বাবা?

তা জন্মায়। আচার্যও একরকম গুরু। তবে পুরুতমশাইয়ের তো বয়স হয়েছে, তাকে দিয়ে খুব বেশি কিছু হওয়ার নয়।

আমাদের কুলগুরু আছেন না, বাবা?

হেমকান্ত একটু হাসলেন। মৃদু স্বরে বললেন, আছেন তো বটেই। তবে বাবার আমল থেকেই তাদের সঙ্গে সংযোগ নেই। কোথায় আছেন তাও জানি না। জানলেও লাভ ছিল না। কুলগুরুরা আজকাল আর আচরণসিদ্ধ নন।

তা হলে কি ধ্যান করব না?

করবে না কেন? তবে খুব বেশি নার্ভের ওপর চাপ যেন না পড়ে। তুমি যাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসো তাকে ভেবো। দুর্গা, কালী, শিব। যাকে পছন্দ।

আমার কালীকে পছন্দ।

তবে তাকেই ভেবো। কিন্তু বেশি নয়। আমি নিজে অবশ্য খুব বেশি ধর্মাচরণ করিনি। মনু বোধহয় জানে। ওর কাছে শুনে নিয়ো।

মনুপিসির কাছেই তো আমি শুনি।

আর-একটা কথা।

কী বাবা?

তুমি নাকি আজকাল একবেলা মোটে ভাত খাও?

হ্যাঁ, বাবা।

কেন?

ব্রাহ্মণরা তো তাই করতেন।

উপনয়ন না হলে তো প্রকৃত ব্রাহ্মণের মতো আচরণ করার দরকার নেই। তাতে বরং শরীর-টরীর খারাপ হতে পারে। তোমার মা নেই, ঠিকমতো যত্নআত্তি হয় না। তার ওপর আবার ওসব করলে—

কৃষ্ণকান্ত বাবার দিকে চেয়ে বলে, তা হলে কী করব আপনি বলে দিন।

হেমকান্ত পড়ে পড়ে যান। নিজের ইচ্ছেমতো ছেলেকে পরিচালিত করতে তার ঠিক সাহস হয় না। বিশেষ করে কৃষ্ণকান্ত যখন ঠিক সাধারণ স্তরের ছেলে নয়। আরও একটা কথা হল, কৃষ্ণকান্ত অতিশয় পিতৃভক্ত। যারা পিতৃভক্ত এবং প্রতিভাবান তাদের কী করে পরিচালনা করা যায় তা হেমকান্ত কখনও ভেবে দেখেননি। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র তাকে বেশ জটিলতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

হেমকান্ত কৃষ্ণকান্তর মাথায় সস্নেহে হাত রেখে বললেন, আমি তোমার ভালমন্দ যে খুব ভাল বুঝি তা নয়। কীসে যে তোমার ভাল হবে তা আমি ভেবে দেখব। তবে শুধু এইটুকু বলি, বেশি কৃচ্ছসাধন করার খুব একটা দরকার নেই।

কৃসাধন নয়। ব্রহ্মচর্য।

ও বাবা! সে তো অনেক বড় কথা।

করব না বাবা?

ভেবে দেখি। একজন পণ্ডিতের বিধান নিতে হবে।

সরবত শেষ করে হেমকান্ত উঠলেন। তার মনটা আজ স্বচ্ছন্দ নয়। ভিতরে-ভিতরে একটা অস্বস্তি কাজ করছে। জীবনটা নানা সমস্যায় কণ্টকিত। নানা ভাবনায় মন আক্রান্ত।

বর্ষণশেষে শরৎঋতুর আবির্ভাবে চারদিকের প্রকৃতিতে একটা সাজো-সাজো ভাব। বৃষ্টির দেবতা আকাশকে ধুয়ে মুছে ফটফটে নীল ফুটিয়ে তুলেছেন। তাতে ভাসছে খণ্ড-মেঘের কাশফুলি সৌন্দর্য। তার সঙ্গে মানিয়েই বুঝি নদীর ওধারে অফুরান মাঠে কাশফুলের বন্যা এসেছে। আজকাল সকালের বাতাসে একটু হিম থাকে। শিশির জমে থাকে ঘাসের ওপর। হেমকান্তর বড় প্রিয় এই ঋতু। দোতলার বারান্দায় বসে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন নদীর দিকে। মনটা যে ভাল হয়ে উঠল, তা নয়। তবে অন্যমনস্ক রইলেন।

আচমকাই রঙ্গময়ী আজ অপ্রত্যাশিত হানা দিল।

এই বয়সে যদি হাতে পায়ে চোট লাগে তবে কে দেখবে তোমাকে বলো তো! অত বাহাদুরি করতে কে তোমাকে বলেছে?

হেমকান্তর মুখে আনন্দের একটা ছটা ফুটে ওঠে। হাসিমুখে বলেন, আরে, হঠাৎ নিষিদ্ধ এলাকায় যে? কী ব্যাপার?

ঠাকুরবাড়ির দালান থেকে দেখতে পেলাম তুমি ওই ডাকাতে চেহারার লেঠেলটার সঙ্গে তাল ঠুক। দেখে ভয়ে মরি। কী জোরে লাঠি ঘোরাচ্ছিল লোকা, আর কী ঠোকাঠুকির শব্দ! এখনও বুক দুরদুর করছে।

হেমকান্ত উদারভাবে হাসলেন, তোমার এত ভয় কেন বলো তো! আমার লাগলে সেবা করতে হত সেই ভয়?

না। বরং উলটোটা। তোমার চোট লাগলে আমি এসে সেবাটুকুও করতে পারতাম না। যতদিন বড়বউ আছে।

কেন পারতে না? এত মনের অসুখে মরো কেন বলো তো।

সে কথা পুরুষমানুষেরা বুঝবে না। কিন্তু বাহাদুরিটা কাকে দেখানোর জন্য হচ্ছিল শুনি!

হেমকান্ত খুব তরল হেসে বললেন, বুড়ো বয়সের খোঁটা দিচ্ছ তো! বুঝেছি। যদি বলি তোমাকে দেখানোর জন্য?

আমাকে! রঙ্গময়ী চোখ বড় বড় করে বলে, আমাকে বীরত্ব দেখিয়ে লাভ কী? নতুন করে মজতে হবে নাকি?

হেমকান্ত খুব রাঙা হয়ে গেলেন লজ্জায়। রঙ্গময়ী একটু ঠোঁটকাটা বরাবরই। ওর সঙ্গে টক্কর দিতে যাওয়া বৃথা।

রঙ্গময়ী ছিটেগুলির মতো তীব্র গলায় ফের বলে, আর বুড়ো বয়সের খোঁটা কখন দিলাম বলো তো! তোমার কি ধারণা আমি তোমাকে বুড়ো ভাবি?

নইলে একটু লাঠি চালাচালির জন্য অত চিন্তা হবে কেন? ভাবছিলে বুড়ো বয়সে লেগে-টেগে গেলে হাড়ে বাত সেঁদোবে। তাই না?

তোমাকে বুড়োবাতিকে পেয়েছে। সব কথার মধ্যে খোঁটা দেখছ।

হেমকান্ত মৃদু হেসে বলেন, ঝগড়ার মাথাটি তো বেশ পাকা। ওদিকে বড়বউয়ের ভয়ে মেচি বেড়াল।

রঙ্গময়ী অপলক চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, ঝগড়া করি খুব, তাই না! আচ্ছা সে কথার জবাব পরে দেব। কিন্তু বুড়ো বয়সের কথাটা আগে শেষ করো।

হেমকান্ত হাতজোড় করে বলেন, ঘাট হয়েছে। মাপ চাইছি।

তা হলে কখনও ভাববে না তো যে মনু আমাকে বুড়ো বলেছে!

তার জন্য তোমার অত দুশ্চিন্তা কেন বলো তো, মনু?

দুশ্চিন্তা আমার হবেনা তো কার হবে? শেষে এই নিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে বসবে। তা হলে কি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি! তা হলে কি শিগগির মরে যাব? তা হলে কি সংসার করা বৃথা? হাঁ করে এইসব ভেবে ভেবে সত্যিই বুড়োটে হয়ে যাবে।

হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সে চিন্তা কি সহজে ছাড়ে, মনু? বুড়ো হচ্ছিই তো, মরতেও হবে।

আবার ওসব কথা!

ভয় পেয়ো না। সেবার আচমকা কুয়োর বালতি জলে পড়ে যাওয়ায় একটা কেমন লেগেছিল। আজ আর সেরকম নয়। আসলে এই যে এতকাল বেঁচে রইলাম, একদিন মরেও যাব, এর অর্থটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। কেন জন্ম হল, কেন বেঁচে থাকা, এর একটা অর্থ থাকবে তো!

সেসব ভাববার লোক আছে। তোমাকে ভাবতে হবে না।

খুব হাসলেন হেমকান্ত। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, ভালবাসা কি এরকমই যুক্তিহীন?

কাল থেকে আর ওই ডাকাতটার সঙ্গে লাঠি খেলো না কিন্তু। বলে গেলাম।

এখুনি যেয়ো না, মনু। তোমার সঙ্গে কথা আছে।

কী কথা? তাড়াতাড়ি বলো।

অত তাড়া কেন?

বড়বউ কালীবাড়ি গেছে পুজো দিতে। এসে পড়বে।

কথাটা কৃষ্ণকে নিয়ে। তোমার কি মনে হয় ও একটু অস্বাভাবিক?

রঙ্গময়ী ভ্রু কুঁচকে বলে, ও আবার কী অলুক্ষনে কথা? অস্বাভাবিক হবে কেন?

একটু অন্যরকম মনে হয় না?

না তো! অন্যরকম কেন হবে?

ও যে একা থাকে, ব্রহ্মচর্য করে, এক বেলা খায় এসব তুমি জানো?

জানব না কেন? আমিই তো বলেছি।

তুমি বলেছ? আশ্চর্য! কেন?

তোমার আর সব ছেলে যেরকম সেরকমই ও হোক তা আমি চাইনি। তাই।

এরকম করে লাভ কী?

সহ্যশক্তি বাড়বে। মনটা ঝরঝরে হবে।

তাই বলো! আমি ভাবছিলাম, ওর মাথায় এসব পোকা ঢোকাল কে! গোপনে গোপনে স্বদেশি করছে নাকি তাই বা কে জানে! স্বদেশিওলাদের তো কাণ্ডজ্ঞান নেই। এইটুকু ছেলেকেও হয়তো হাতে বোমা দিয়ে সাহেব মারতে পাঠাবে।

রঙ্গময়ীর মুখটা সামান্য বিমর্ষ হয়ে গেল। গলাটা এক পর্দা নামিয়ে বলল, ও যদি নিজে থেকে স্বদেশি করতে চায় তবে কি তুমি বাধা দেবে?

দেব না? কী সব বলছ?

রঙ্গময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সব কিছু কি তোমার আর আমার ইচ্ছেয় চলবে গো! এ যা যুগ পড়েছে, এর হাওয়া বাতাস গায়ে লাগবেই। কৃষ্ণ তোমার অন্য ছেলেদের মতো আঁচলধরা নয়। হয় মায়ের আঁচল, নয় তো বউয়ের আঁচল ধরে যারা টিকে আছে তাদের থেকে ওর ধাত আলাদা। স্বদেশির হাওয়া থেকে ওকে বাঁচাতে হলে তোমাকে ছেলে নিয়ে কাশীবাসী হতে হয়।

হেমকান্ত চিন্তিত মুখে রঙ্গময়ীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, তোমার ভিতরেও একটু স্বদেশি পোকা আছে মনু, আমি অনেকদিন আগেই টের পেয়েছি।

থাকলে আছে। কী করব বলো।

হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আমি পৃথিবীর ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, মনু। যা হওয়ার তা তো হবেই। শুধু তোমাকে বলি, কৃষ্ণ তোমার খুব বাধ্যের ছেলে। ওকে নিজের ছেলে বলে ভেবে ওর ভালমন্দ যা হয় ঠিক কোরো।

একথার মানে কী? আমি ওকে ছেলে বলে ভাবি না নাকি?

হয়তো ভাবো। তবু বললাম। আজ কৃষ্ণ আমার কাছে জানতে চেয়েছিল কীভাবে চলবে। আমি বলতে পারিনি। যদি পারো তো তুমি বোলো।

কৃষ্ণকে নিয়ে তুমি অত ভেবো না। একটু শক্ত হও।

শক্ত হওয়া আর এ জন্মে হবে না, মনু। তাই আমি চেষ্টা করছি নিস্পৃহ হতে। কোনওরকমে চোখ কান বুজে যদি আয়ুটা পার করে দেওয়া যায়। তারপর যা হয় তোক।

বাঃ, বেশ বীরপুরুষের মতো কথা তো! সকালের সেই লাঠিয়াল কোথায় গেল? মালকোঁচা মেরে খুব যে বীরত্ব ফলাচ্ছিলে এখন সেই লোকটা কোথায়?

লাঠিবাজি কি সর্বত্র চলে, মনু? লাঠি এখন নিজের মাথায় মারতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে।

আতঙ্কিত মনু বলে, কেন গো ! ও কী কথা?

হেমকান্ত অনুত্তেজিত কণ্ঠেই বলেন, আমার মনে বড় অশান্তি। চারদিকে কী যে সব হচ্ছে!

রঙ্গময়ী কিছুক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে থাকে। তারপর গাঢ় স্বরে বলে, তুমি ভেবো না। তোমার মনে অশান্তি হতে পারে এমন কিছু আমি হতে দেব না।

হেমকান্ত একটু হাসলেন। বললেন, আমি কি বাচ্চা ছেলে মনু, যে আমাকে ভোলাচ্ছ!

বাচ্চার বেশিও তো কিছু নও।

তাই নাকি?

তুমি সাবালক হলে আমার আর চিন্তা ছিল কী?

আমাকে নিয়ে যে ভাবছ তার তো প্রমাণ পাই না। আমার এমন অশান্তির সময়টায় দিব্যি হেঁয়াচ বাঁচিয়ে দূরে দূরে আছ।

তা হলে কী করব? অন্দরমহলে এসে খুঁটি গাড়ব নাকি?

তাই কি বলেছি?

বড়বউ কবে যাবে?

যাবে না বলছে। কৃষ্ণর পইতের পর যেতে চায়।

তার তত ঢের দেরি।

হুঁ। কী আর করা! শচীনের খবর-টবর রাখো নাকি?

নাঃ! সে আজকাল আমার সঙ্গে কথা বলে না। তবে বড়বউ কী কারণে জানি না তার ওপর খুশি নয়।

বলো কী? এটা তো মস্ত খবর!

তোমার কাছে মস্ত খবর বটে, আমার অন্য ভয়।

কীসের ভয়?

শচীনের মুখ-চোখে একটা হন্যে ভাব। বেহিসেবি কিছু করে না বসে। বড়বউ বুদ্ধিমতী বটে, কিন্তু পুরুষ পাগল হলে তাকে সামাল দিতে পারবে কি?

শচীন কী করবে?

ওর বাপ রাজেনবাবু সাংঘাতিক রাগী লোক। জানো বোধহয়।

জানি না। তবে জানলাম।

খুব অহংকারীও। শচীনের মধ্যেও সে ভাবটা আছে। বড়বউ এতদিন নাচিয়ে যদি আর পাত্তা দিতে না চায় তবে শচীন একদম বেহেড হয়ে যাবে। একদিন দোতলায় উঠে বড়বউয়ের ঘরে হানা দিয়েছিল সন্ধেবেলায়। জাপটে ধরারও চেষ্টা করে।

হেমকান্ত মেরুদণ্ডে হিমশীতল স্পর্শ অনুভব করে বিবর্ণ মুখে বলেন, তাই নাকি? তারপর কী হল?

কিছু হয়নি। বড়বউ সামলে নিয়েছিল বিপদটা। কিন্তু শচীনের মধ্যে আমি একটা পাগলামি দেখছি।

কী করব, মনু?

করার অনেক আছে। শশিভূষণের মামলা উঠতে দেরি নেই। শচীনকে বরিশালে পাঠানোর কথা ছিল। তার কী হল?

ভাল কথা মনে করেছ।

শোনো, কথা ভাল হলেও প্রস্তাবে শচীন মাথা নাও পাততে পারে। বললাম তো, ওর অবস্থা ভাল দেখছি না।

তা হলে?

ওকে সঙ্গে নিয়ে তুমি নিজে যাও। আমি?

হ্যাঁ। তুমি গেলে হয়তো চক্ষুলজ্জায় আপত্তি করবে না। ওর ওপর ছেড়ে দিলে যাব-যাচ্ছি করে সময় কাটাবে, অজুহাত দেবে।

কিন্তু শশিভূষণ আমাদের কে বলল!

এমনিতে কেউ নয়। কিন্তু তোমার বাড়িতে ছিল। পুলিশ তো তোমাকে ছাড়বে না।

হেমকান্ত অনেকক্ষণ ভাবলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তোমার বাস্তববুদ্ধি আমার চেয়ে বেশি। আমি তোমার প্রস্তাব মেনে নিলাম। যাব।

গেলে দেরি কোরো না।

কেন? এত তাড়া কীসের?

তুমি যখন থাকবে না তখন আমি বড়বউকে কলকাতায় পাঠাননার চেষ্টা করব। এখন পাঠালে গণ্ডগোল হবে। আমার বিশ্বাস, বড়বউ কলকাতায় গেলে শচীন তার পিছু নেবে।

না, আমি কালই যাব। শচীনকে ডেকে পাঠাচ্ছি আজ বিকেলে।

তবে আমি যাই?

এসো গিয়ে।

রঙ্গময়ী চলে গেলে হেমকান্ত অনেকটা সময় কাটালেন প্রচণ্ড অস্থিরতার মধ্যে। বিকেলে শচীন কাছারিতে এলে ডেকে পাঠালেন।

শচীন, শশিভূষণের কেসটার জন্য আমাদের একবার বরিশাল যাওয়া দরকার।

শচীন ভ্রু কুঁচকে বলল, বরিশাল! কিন্তু আমার যে এখানে অনেকগুলো মামলা হাতে রয়েছে।

শশিভূষণের মামলায় উকিল তো দিতেই হবে।

শচীন একটু ভেবে বলে, আমি আর-একজনকে ঠিক করে দেব।

আর একজন! সেটা কি ভাল হবে?

কেন হবে না? ভাল উকিলের কি অভাব আছে?

হেমকান্ত কী বলবেন ভেবে পেলেন না। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোমার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল, শশীর মামলা তুমিই লড়বে। নতুন উকিলকে ব্যাপারটা বোঝাননা সময়সাপেক্ষ। একটু ভেবে দেখো যদি সম্ভব হয়। কালই আমার যাওয়ার ইচ্ছে।

আমি আপনাকে কাল জানাব। মনে হচ্ছে যাওয়া সম্ভব হবে না।

হেমকান্ত অসন্তুষ্ট হলেন। কিন্তু কিছু করারও তো নেই! বললেন, ঠিক আছে। যাও।

শচীন চলে গেল।

হেমকান্ত বুঝলেন, ব্যাপারটা সহজ হবে না। রঙ্গময়ী যত বুদ্ধিমতীই হোক, ব্যাপারটা এত সহজ সরল নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *