হাসপাতাল থেকে আমি সবটা পথ হেঁটেই বৌবাজারের হোস্টেলে এলাম। ট্রাম-বাসে চড়ার ইচ্ছেও মনের মধ্যে জাগ্রত হয়নি। মনে হচ্ছে আমি একেবারে কাঙাল বনে গেছি। আমার চিন্তা করার কিছু নেই, আকাক্ষা করারও কিছু নেই, ভরসা করার কিছু নেই। তবু হোস্টেলে আসতে পারলাম কেমন করে, সে আমি বলতে পারবো না। গেটের গোড়ায় এসে দেখি ভূড়িঅলা দারোয়ানটির বদলে দুবলা পাতলা দারোয়ানটি দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে বসে খৈনি টিপছে। আমাকে দেখতে পেয়ে পান খাওয়া গ্যাটগ্যাটে দাঁত দেখিয়ে হেসে বললো, বাবু কোটিমে যাইয়ে আজ, হাওয়া বুহুত গরম আছে। কোনো উত্তর না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলাম।
যে রুমে আমরা থাকি, সেখানে মাঝারি রকমের একটা কনফারেন্স বসে গেছে। বাংলাদেশের ছেলেদের অধিকাংশই হাজির আছে। তাছাড়া আছেন কোলকাতার সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। ইনি পোস্টাফিসে চাকরি করেন। ফর্সাপনা সুন্দর চেহারার সদানন্দ মানুষটি। সবসময় পরিষ্কার পাজামাপাঞ্জাবি পরেন এবং দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কেটে থাকেন। অবসর সময়ে কবিতা লিখেন, কিন্তু কোলকাতার কাগজগুলো, এমন কি লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকেরাও তাঁর প্রতি এমন নির্দয় যে কবিতা কেউ ছাপতে চান না। বিশ্বাসের দিক দিয়ে তিনি বিপ্লবীও বটেন। কি কারণে বলতে পারবো না, কোনো বিপ্লবী পার্টির সদস্য হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। কথাবার্তা বলে দেখেছি পশ্চিমবাংলার বিপ্লবী পার্টিগুলোর নীতি আদর্শের প্রতি তার ভীষণ রকম অনাস্থা এবং নেতৃবৃন্দের প্রতি সুমন্তবাবুর ভয়ানক রাগ। কথায় কথায় তিনি অবজ্ঞা প্রকাশ করেন। অবশ্য ইদানীং সুমন্তবাবুর বেশ পুষিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের এইসব ভাসমান কর্মহীন উদ্দেশ্যহীন ঘরহারা লক্ষ্মীছাড়া ছেলেদের সঙ্গে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত মার্কামারা সত্যিকার একটি গণবিপ্লবের তাত্ত্বিকভিত্তি নিয়ে হামেশা আলাপ আলোচনা করে থাকেন। তার ধারণা পশ্চিমবাংলা হেজেমজে গেছে। সমাজকে নিয়ে কিছু যদি করার থাকে, তা বাংলাদেশের ছেলেদের দিয়েই সম্ভব। তত্ত্বের জঙ্গলে ওদের ধ্যান ধারণা এখনো পথ হারিয়ে ফেলেনি। বাংলাদেশের প্রতিটি ছেলেকেই সুমন্তবাবু তার আকাঙ্ক্ষিত গণবিপ্লবের একেকজন সৈনিক হিসেবে দেখেন। এরই মধ্যে উদ্যোগী হয়ে বাংলাদেশের ছেলেদের নিয়ে তিন তিনটে কবিতার সংকলন প্রকাশ করে ফেলেছেন। তিনটিতেই সুমন্তবাবুর তিনটি কবিতা সগৌরবে স্থান করে নিয়েছে। মানুষটি রসগোল্লার মতো। মনে হয় টিপলেই রস বেরুবে। কি কারণে বলতে পারবো না, আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয়টা মামুলিপনা অতিক্রম করে হৃদ্যতার স্তরে পৌঁছুতে পারেনি। আমার পরনে ধুতি দেখে মাসুমই প্রথম ফোড়ন কাটলো। দানিয়েল ভাই, বলুন দেখি কোলকাতার হাওয়া এখন কার গায়ে লাগছে? মাসুম কোলকাতার মানুষের মতো টানটোন লাগিয়ে ঢাকার বাংলা ভাষাটি বলতে চেষ্টা করছে আজকাল। একবার সেদিকে ইঙ্গিত করেছিলাম। আজ আমার পরনে ধুতি দেখে মাসুম তার শোধ দিতে চেষ্টা করছে। মাসুমের কথার পিঠে কথা বলার মতো মনের অবস্থা ছিলো না। নীরবে নরেশদার পাশে গিয়ে একটা বালিশ টেনে নিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলাম। নরেশদা জিগগেস করলেন, কি খবর? আমি বললাম, ভালো নয়। কি রকম বলো দেখি। এসব শেষ হোক, পরে বলবো। আমি চোখ দুটো বন্ধ করে রইলাম। মনে হচ্ছিলো একটা প্রচণ্ড সংজ্ঞাহীনতা আমাকে এখুনি গ্রাস করে ফেলবে। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়তে পারছিলাম না। এক ভদ্রলোক যিনি আমার সম্পূর্ণ অচেনা, অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে ঘরভর্তি মানুষের সামনে কথা বলছিলেন। বোধকরি তিনি আগের থেকেই কথা বলছিলেন। আমার আগমনে হঠাৎ করে তাঁর কথায় ছেদ পড়ে থাকবে। বাংলাদেশের ফ্রিডম ওঅরের কথা শুনে লেখাপড়া ছেড়ে ইংল্যাণ্ড থেকে কোলকাতা এসেছি আজ পঁচিশ দিন। কিন্তু এখানে এসে কি দেখেছি? দেখেছি থিয়েটর রোডে যারা বসে আছে তাদের অধিকাংশই এ বাঞ্চ অফ রাস্কেলস। খাচ্ছে দাচ্ছে মজা করছে এভাবে নাকি ফ্রিডম ওয়রের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ভয়ঙ্কর ডিজ-ইলুশনড হয়ে গেছি। মাও সে তুংও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আপনারা নিশ্চয়ই লংমার্চের খবর জানেন!
আপনার মাও সে তুং এখন বাংলাদেশের ব্যাপারে কি করছেন, সে খবর রাখেন? পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশে খুন, জখম, হত্যা, ধর্ষণ সবকিছু অবলীলায় চালিয়ে যাচ্ছে। আর আপনার মাও সে তুং সে ইয়াহিয়ার জল্লাদসৈন্যদের ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য জাহাজ ভর্তি করে বোমা, কামান, অস্ত্রশস্ত্র পাঠাচ্ছে। লংমার্চ তো অতীতের ঘটনা, হালের খবর বলুন। আমার মনে হলো, প্রশ্নকারীর কণ্ঠস্বরটি আমার পরিচিত। ওহ মনে পড়েছে। গান্ধী পিস ফাউণ্ডেশনের মনকুমার সেন একবার যিনি এখানে এসেছিলেন, এই ভদ্রলোক তাঁরই বড়ো ছেলে। নামটি মনে আসছে না। অমর্তসেন না কি একটা হবে। তার বাড়িতে একবার খেতে গিয়েছিলাম। সকলেই কথা বলছে। কোনো আগামাথা নেই। কোথায় শুরু এবং শেষ কোথায় হচ্ছে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। বাংলাদেশের সালাম এবার মুখ খুললো। মাওলানা ভাসানী মাও সে তুং এবং চৌ এন লাইয়ের কাছে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন, যাতে চীন পাকিস্তানের এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে কোনো রকম সহায়তা না করে। আরে থোন ফালাইয়া, আপনার মাওলানা ভাসানীর টেলিগ্রাম দুইখান চৌ এন লাই আর মাও সে তুং যতন কইর্যা ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে থুইয়া রাখছে। মাওলানা এখন ইন্ডিয়া কেনো আইছে হেইডা কইবার পারেন? তাবিজ দেয়ার মৌলবী, আপনেরা তারে বিপ্লবী লিডার বানাইছেন। কথাগুলো খুরশিদের। খুরশিদ সম্পর্কে একটু পরিচয় দিতে হয়। সে সব জায়গায় ঘটা করে আওয়ামী লীগের লোক বলে প্রচার করে। জায়গা বুঝে মাঝে মাঝে হাই কম্যাণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, একথা বলতেও পেছ পা হয় না। তবে মুশকিল হলো আওয়ামী লীগের লোকেরা তাকে পাত্তা দেয় না। সত্যিকার আওয়ামী লীগের কাছে ঘেঁষতে না পেরে খুরশিদ আমাদের ডেরায় এসে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের মুণ্ডুপাত করে। ইংল্যান্ড প্রত্যাগত ভদ্রলোক জিগ্গেস করলেন, বাই দ্যা বাই, ক্যান এ্যনি ওয়ান অব ইউ টেল মি হোয়ার মাওলানা ইজ নাউ। উয়ি হিয়ার দ্যাট হি ওয়াজ আন্ডার অ্যারেস্ট। মাওলানা ভাসানীকে ধরে লাল কেল্লায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আরেকজন বললো, অ্যারেস্ট করা হয়েছে একথা সত্যি নয়। তবে তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। আমি নিজে অবশ্য শুনেছি পয়লা মাওলানাকে বালিগঞ্জের একটা বাড়িতে রাখা হয়েছিলো। মাওলানা সন্ধ্যে হলেই সে বাড়ির ছাদের ওপর পায়চারি করতেন। তাঁর লম্বা দাড়ি, পাঞ্জাবি, বেতের টুপি এসব দেখেই আশেপাশের মানুষের সন্দেহ হতে থাকে যে, এ মাওলানা ভাসানী না হয়ে যান না। তাছাড়া মাওলানার আরেকটা একগুয়ে স্বভাবের জন্য ভারত সরকার তাঁকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। আর তা এই, সন্ধ্যেবেলা সব সময়ে আজান দিয়ে ছাদে চাদর বিছিয়ে মাগরেবের নামাজ পড়তেন।
এক সময় মাওলানা ভাসানী প্রসঙ্গ চাপা পড়ে গেলো। আলোচনা শুরু হলো শেখ মুজিবকে নিয়ে। খুরশিদ বললো, থিয়েটর রোডের যে সকল মাস্তান আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙ্গিয়ে সব কিছু লুটপাট করে খাচ্ছে, এখানে বঙ্গবন্ধু হাজির থাকলে পেঁদিয়ে তাদের পিঠের ছাল তুলে ফেলতেন। সালাম ঠোঁট উল্টে জবাব দিলো, আরে রাখো তোমার বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানীদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেই ধরা দিয়েছে। পৃথিবীর কোনো বিপ্লবী সংগ্রামে নেতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তোমার ওই বঙ্গবন্ধুর মতো শক্রর কাছে সগৌরবে আত্মসমর্পণ করেছে তার কোনো নজীর আছে কি? শেখ মুজিব সব সময় স্যুটকেশ গুছিয়ে রাখতেন। আন্দোলন শুরু হওয়ার পূর্বেই জেলে চলে যেতেন, আর আন্দোলন শেষ হয়ে গেলে বিজয়ী বীরের বেশে জেলখানা থেকে বেরিয়ে ক্রেডিটটুকু নিতেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে। শেখ পাকিস্তানের জেলে আর আমরা এখানে কোলকাতার পথে পথে ভেরেণ্ডা ভেজে চলছি। এই অবস্থাটার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী তোমার ওই শেখ মুজিব এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ। শেখের মতো এতো বড়ো জাতীয় বেঈমান আর দ্বিতীয়টি নেই। খুরশিদ হুঙ্কার দিয়ে উঠলো, খবরদার সালাম, ছোটো মুখে বড়ো কথা বলবে না। অন্য লোকের নাম বললে কিছু মনে করতাম না। বঙ্গবন্ধুর নামে কিছু বললে মুখের বত্রিশটি দাঁতের একটিও আস্ত রাখবো না। সালাম এবং খুরশিদ উঠে দাঁড়িয়ে পরস্পর শক্তি পরীক্ষার মাধ্যমে একটা মীমাংসায় পৌঁছার উপক্রম করলে সকলে ধরাধরি করে দু’জনকে থামিয়ে দিলো।
এ ধরনের ঘটনা হামেশাই ঘটে থাকে। এ রকমের একটা বিস্ফোরণের পর আলোচনা আর স্বাভাবিক খাতে এগুচ্ছিলো না। ইংল্যান্ড প্রত্যাগত ভদ্রলোক বললেন, সরি, আমার একটা এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। সুতরাং এখুনি আমাকে উঠতে হবে। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে সুমন্তবাবুও উঠে গেলেন। বোঝা গেলো, ইংল্যান্ড প্রত্যাগত ভদ্রলোকটি সুমন্তবাবুই সংগ্রহ করে এনেছিলেন। আসরের একেকজন করে উঠে যাচ্ছিলো। ওমা এমনি করে সবাই উঠে গেলে চলবে কেনো? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এখনো তোলাই হয়নি। মাসুমকে কথা বলতে শুনলাম। ‘গুরুত্বপূর্ণ’ শব্দটি মনে হয় সকলের মনে একটু দাগ কাটলো। মাসুম খোঁচা খোঁচা কাঁচা পাকা দাড়িঅলা এক ভদ্রলোকের দিকে ইঙ্গিত করে বললো, নাহিদ ভাই, এবার আপনার কাহিনীটা একটু বলুন। তিনি যে দুঃখে পড়েছেন চেহারাসুরত দেখলেই মনে হয়। উড্রান্তের মতো চোখের দৃষ্টি। জামার একটি হাতা গুটানো, অন্যটি ছেড়ে দেয়া। ভদ্রলোক কথা শুরু করতে গিয়ে একটু একটু করে কাঁপছিলেন। গলার স্বরটিও কাঁপছিলো। যাহোক তিনি তাঁর কাহিনীটা বলতে আরম্ভ করলেন। বগুড়া দখল করার পর আমরা দেড় মণ সোনা স্টেট ব্যাংকের স্ট্রং রুমের সেফটি ভল্ট ভেঙ্গে এখানে নিয়ে আসি। আমরা তিনজন সোনাসহ নৌকোতে করে বর্ডারে এসে পৌঁছোই। সেখান থেকে গাড়িতে করে কোলকাতা এসে দু’টো স্যুটকেশ কিনে সোনাগুলো ভাগাভাগি করে রাখি। তারপর তিনজন শেয়ালদার কাছে একটা হোটেলে উঠি। একদিন না যেতেই অন্য দু’জন বললো, আমাদের পেছনে ভারত সরকারের স্পাই লেগেছে। যদি কোনো রকমে জানতে পারে সোনা আছে, সবকিছু কেড়েকুড়ে নেবে এবং আমাদের জেলে পুরে রাখবে। পরামর্শ দিলো মাল সরিয়ে দেয়া প্রয়োজন। দু’জন হোটেল ছেড়ে স্যুটকেশ দুটো নিয়ে অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলো। আমাকে বলেছিলো, তিনজন এক সঙ্গে গেলে কেউ সন্দেহ করতে পারে। আমি সরলভাবে তাদের কথা বিশ্বাস করেছি। তারা কোনো সেফ জায়গায় ওঠার পর আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে।
সেই যে গেলো আর কখনো তাদের দেখা আমি পাইনি। নরেশদা বললেন, এই সোনা তো বাংলাদেশের জনগণের সম্পত্তি। আপনারা এখানে নিয়ে এলেন কেনো। থিয়েটর রোডের কর্তাব্যক্তিদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো নালিশ টালিশ করেননি। নাহিদ সাহেব বললেন, থিয়েটর রোডে অনেক ঘোরাঘুরি করেছি। কেউ আমার কথা কানেও তুলতে চান না। যে তিনজন আমরা সোনা নিয়ে এসেছিলাম, তার মধ্যে একজন এমপি-র আপন ছোটো ভাই। আরেকজন স্থানীয় আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্টের শালা। তারা এখন কোথায় আছে, কি করছে কিছু জানিনে। অথচ এদিকে শুনতে পাচ্ছি সেই সোনা ইতিমধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়ে গেছে। দেখছেন তো এই অবস্থায় আমার কথা কে গ্রাহ্য করে তিনি নিজের দীনদশার প্রতি ইঙ্গিত করলেন। সত্যিই তো এরকম একজন মানুষ দেড় মণ সোনা বয়ে নিয়ে এসেছে, শুনলে এখন কে বিশ্বাস করবে। ভদ্রলোক বললেন, এখন আমি কি করি বলুন তো, পথে-ঘাটে বের হওয়া এক রকম অসম্ভব হয়ে পড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই কোলকাতার এবং বাংলাদেশের চেনা অচেনা মানুষ ভয় দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি যদি কোলকাতা শহর ছেড়ে না যাই, তাহলে আমাকে খুন করা হবে। অথবা পাকিস্তানের গুপ্তচর বলে ভারতের পুলিশের কাছে তুলে দেয়া হবে। আমি এখন কি করবো বুঝতে পারছিনে। আপনারা কি আমাকে কোথাও আশ্রয় দিতে পারেন? তার গল্পটি কেউ অবিশ্বাস করলো না। কেনোনা এরকম ঘটনা এই একটি নয়। আকছার ঘটছে। মুখে মুখে অনেক সহানুভূতিও প্রকাশ করা হলো। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। খুরশিদ কিন্তু নাহিদ সাহেবকে একটা পাকা আশ্বাস দিয়ে ফেললো। কাল এই সময়ে আপনি এখানে আসবেন। থিয়েটর রোডে নিয়ে গিয়ে তাজুদ্দীন সাহেবকে সব কিছু খুলে বলে বদমায়েশদের শায়েস্তা করার ব্যবস্থা করবো। আজ বাড়ি চলে যান। নাহিদ সাহেব বললেন, এখানে আমার বাড়ি কোথায় যে যাবো? খুরশিদ বললো, যেখানে থাকেন, চলে যান। আমার তো থাকার কোনো জায়গা নেই। খুরশিদ বিরক্ত হয়ে বললো, কাল কোথায় ঘুমিয়েছিলেন। কালতো গোটা রাত শেয়ালদা স্টেশনে কাটিয়েছি। দূর মশায় আপনাকে নিয়ে আর পারা গেলো না। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলো। আমার চোখ দুটো ঘুমে ঢুলে আসছিলো। এতে ক্লান্তশ্ৰান্ত অবস্থায় কি করে যে এতোসব কথাবার্তা নীরবে শুনে আসছিলাম, তার কারণ কি ঠিক বলতে পারবো না। সবাই চলে গেলে নরেশদা জিগগেস করলেন, গতরাতে কি তোমার ঘুম হয়নি? আমি বললাম, না। এখন কি ঘুমোবে? বললাম, হ্যাঁ। কিছু খাবে না। ঘুম জড়ানো অস্পষ্ট গলায় জবাব দিলাম, খেয়ে এসেছি।
বেলা তিনটের দিকে আমার ঘুম ভাঙলো। দেখি রুমে আর কেউ নেই। নরেশদা বসে বসে সুবলচন্দ্র মিত্র এবং হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের অভিধান দুটো নিয়ে কিসব করছেন। অভিধান পাঠ করা এবং একটার সঙ্গে একটা মিলিয়ে দেখা তাঁর দীর্ঘদিনের অভ্যেস। ঢাকায় থাকার সময়ে আমরা তো ধরেই নিয়েছিলাম, বছর তিনেকের মধ্যে তিনি নিজে একখানা অভিধান জন্ম দিতে যাচ্ছেন। জিগ্গেস করলেন, দানিয়েল গতরাতে কোথায় ছিলে? আমি বললাম, তায়েবার ডাক্তার মাইতিবাবুর কোয়ার্টারে। তায়েবার রোগ সম্পর্কে ডাক্তার কিছু বললেন? বললাম, হ্যাঁ লিউক্যামিয়া। ওটা নাকি ক্যান্সারের একটা ভ্যারাইটি। ডাঃ মাইতি বললেন, এ ধরনের রোগির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তাই নাকি? গলার স্বরটা চমকে গেলো। তিনি অভিধান দুটো বন্ধ করে গালে হাত রেখে কি সব ভাবলেন। এখন তুমি কোথায় যাবে? আমি বললাম, গোল পার্কের কাছে অর্চনাদের বাড়ি আছে না সেখানেই যাবো। অর্চনা তো চাকরি করে কলেজে। তিনি কি কলেজে যাননি? এখন গেলে পাবে? আমি বললাম, আজ অফিসে আসবে না। গিয়ে দেখি পেলেও পেতে পারি। সেকি খাবে না? আপনি খেয়েছেন? হ্যাঁ, আমাকে খেতে হয়েছে। রাজার মঠ থেকে দাদা এসেছিলেন। তাঁকে সহ খেয়ে নিয়েছি। মা বাবার কোনো খবর টবর পেলেন? হ্যাঁ, মা বাবা আজ তাঁর বাড়িতে এসে পৌঁছেছেন। আমি বললাম, ভালো খবর। তিনি এখন কোথায়? খবরটা দিয়েই চলে গেছেন আবার। কাপড় চোপড় পরে আমি জিগগেস করলাম, নরেশদা আপনার কাছে টাকা আছে? বললেন, কতো? এই ধরুন পনেরো বিশ। তিনি আমার হাতে বিশ টাকার একখানি নোট দিলেন। আমি বেরিয়ে আসছি, তিনি ডাক দিলেন, একটু দাঁড়াও তায়েবার হাসপাতালের ওয়ার্ড নম্বর এবং বেড নম্বরটি লিখে দিয়ে যাও। আমি কাগজ নিয়ে লিখে দিলাম।
.
০৬.
অর্চনার সঙ্গে আমার পরিচয় অনেকদিনের। চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছিলো। উনিশশো আটষট্টির দিকে অর্চনা একখানি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলো। ওতে আমার একটি গল্প ছাপা হয়েছিলো; আমি এমন আহামরি লেখক নই। তথাপি কি কারণে বলতে পারবো না, লেখাটি অর্চনার মনে ধরেছিলো। তখন থেকেই সম্পর্ক। অবশ্য চোখের দেখা হয়নি। এখানে আসার পূর্বে পশ্চিমবঙ্গে অর্চনাই ছিলো একমাত্র পরিচিত ব্যক্তি। বাড়ির ঠিকানা খোঁজ করে তাকে পেতে বিশেষ অসুবিধে হয়নি। বড়ো আশ্চর্য মেয়ে অর্চনা। এখানকার একটি কলেজে ফিলসফি পড়ায়। এক সময় নকসাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলো। অধ্যাপক সুশীতল রায় চৌধুরী, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের মূর্তি ভাঙ্গার প্রতিবাদ করে দলের লোকদের হাতে নিহত হওয়ার পর থেকেই অর্চনা নিজেকে আন্দোলন থেকে গুটিয়ে নিয়েছে। দলের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত নয়, কিন্তু অনেকের সঙ্গে ওঠাবসা আছে। ছাত্র পড়িয়ে দিন কাটাচ্ছে বটে, কিন্তু একটা অস্থিরতা সর্বক্ষণ মনের মধ্যে ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে। তা আমি অনুভব করতে পারি। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই ভোলামেলা। আমরা পরস্পরকে তুমি সম্বোধন করি। মাঝে মাঝে আমার অবস্থা যখন খুবই অসহ্য হয়ে ওঠে, কয়েক ঘণ্টা ওদের ওখানে কাটিয়ে মনটাকে ঝরঝরে করে তুলি।
আজও প্রাণের ভেতর থেকে একটা গভীর তাগিদ অনুভব করছিলাম। পা দু’টো আপনা থেকেই চলতে আরম্ভ করলো। বাসে গড়িয়াহাটা পর্যন্ত এসে বাকি পথটা টানা রিকশায় গেলাম। এ অবস্থায় এটা একটা বিলাসিতা বটে, কিন্তু হাঁটার মতো পায়ে কোনো জোর পাচ্ছিলাম না।
গোল পার্কের বাড়িতে গিয়ে বেল টিপতেই অর্চনা নিজে এসে দরোজা খুলে দিলো। আমাকে দেখে তার চোখ জোড়া খুশীতে চকচক করে উঠলো। জানো দানিয়েল, আজ ভেবেছিলাম বৌবাজার গিয়ে তোমাকে খুঁজে বের করবো। হোস্টেলটা চিনিনে বটে। তবে ঠিকানাতো ছিলোই। খুঁজে বের করতে কতোক্ষণ। বাংলাদেশের ছেলেদের একটা সারপ্রাইজ দিতাম। আমি বললাম, যাওনি যখন সে কথা বলে আর লাভ কি? সে বললো, আমি তো প্ল্যান করেছিলাম যাবোই। মাঝখানে বৌদি পাকড়ে ফেলে তার বোনের বাড়িতে নিয়ে গেলো। সেখান থেকে এসেই দেখি মা রামকৃষ্ণ মিশনে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বসে আছেন। যেই আমি বাড়িতে পা দিয়েছি, অমনি মা ঘরের মধ্যে বন্দি করে নিজে বেরিয়ে গেলেন। মিশনে অক্ষরানন্দ নামে এক মহারাজ এসেছেন। আর তাঁর মুখের বচন নাকি ভারী মিষ্টি। তা কি আর করা। আমি বেচারি বাড়িতে বসে বসে ভেরেণ্ডা ভাজছি। অর্চনা নিতান্ত আটপৌরে কথাও সুন্দর করে বলতে জানে। আমি বললাম, অর্চনা এক কাপ চা খাওয়াবে? ওমা চা তো খাবেই। সে অনুচ্চস্বরে ডাকলো, শোভা, এই শোভা। কাজের মেয়েটি এলে বললো, দুকাপ চা করে নিয়ে আয়। আর দেখো খাবার কিছু আছে কিনা। আমি বললাম, অর্চনা শুধু চা আর কিছুর প্রয়োজন নেই। অর্চনা বুদ্ধিমতী মেয়ে। বললো, দানিয়েল নিশ্চয়ই তোমার একটা কিছু হয়েছে। মুখটা ভয়ানক শুকনো দেখাচ্ছে। জবাবে বললাম, কিছু একটা না হলে শুধু শুধু তো আর তোমার কাছে আসিনে। সে বললে, বাপু কথা না বাড়িয়ে সেটা বলে ফেললো না। আমার সে পরিচিতা বান্ধবী যার কথা তোমাকে বলেছি, গত পরশু তার দেখা পেয়েছি। তাহলে তো পেয়েই গেছো, আমাদের এখানে এসেছো কেনো? আচ্ছা যাক, তোমার সে ভদ্র মহিলার গল্প শুনি। আমি বললাম, বলার মতো আর কোনো গল্প নেই। সেকি, দেখা না হতেই ঝগড়া বাধিয়ে বসে আছো নাকি। আমাকে বুঝি মধ্যস্থতা করতে হবে। আমাকে বলতেই হলো, তার মারাত্মক অসুখ। ডাক্তার বলছে ক্যান্সার। ওমা সেকি! এখন কোথায় আছে। আমি বললাম, পিজি হাসপাতালে। তুমি কেমন করে খুঁজে বের করলে? সে কথা থাকুক অর্চনা। খুঁজে বের করে কি লাভটা হলো। সে ফোঁস করে উঠলো, তোমরা বেটাছেলেরা ভয়ানক নেমকহারাম। সব সময় লাভ খুঁজে বেড়াও। এরই মধ্যে চা এসে গেলো। চুমুক দিতে দিতে টুকটাক কথাবার্তা হলো। অর্চনা জিগগেস করলো, তুমি এখন কি করবে? কি করবো সেটাই প্রশ্ন। ওসব হেয়ালী রাখো। বাস্তবে কি করবে সেটাই বলো। আমি বললাম, যা ঘটবার ঘটে যাবে, আমাকে শুধু দেখে যেতে হবে। বাস এর বেশি আর কিছু না। দানিয়েল তুমি ভয়ানক ভেঙ্গে পড়েছে। বেটাছেলেদের একটু শক্ত হতে হয়। এসময় শক্ত হওয়াই প্রয়োজন। ঠাণ্ডা মাথায় স্থির করো কি করবে। আমি বললাম, স্থির করাকরির আর কিছু নেই। তার পার্টির লোকেরা হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। সেখানে চিকিৎসা হচ্ছে। ডাক্তার বলেছে চিকিৎসাতে ফল হবে না। সে মারা যাবেই। অর্চনা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো। তুমি নেগেটিভ সাইডটা সব সময় বড়ো করে দেখো। মাথা ঠাণ্ডা করো একটু। আগে রোগি দেখি। তারপর স্থির করা যাবে, কি করতে হবে। আমি অনেক কষ্টে হাসতে চেষ্টা করালাম। বললাম, অর্চনা তোমাকে ধন্যবাদ। সব রকমের বিপদে আপদে সব সময়ে তোমার মুখ থেকে চমৎকার সান্ত্বনার বাণী বেরিয়ে আসে।
এ সময়ে আবার কলিং বেল। অর্চনা উঠে দরোজা খুলে দিলো। দুজন ভদ্রলোক ঘরে প্রবেশ করলেন। তাদের একজন হ্যাংলা মতো। গায়ের রঙ ফর্সা, তবে কিছুটা জ্বলে গেছে। পরনে ধুতি আর সাদা সার্ট। ভদ্রলোকের চেহারার একটা আকর্ষণ আছে। মাথার চুল লম্বা কোঁকড়ানো। সঙ্গের অন্য ভদ্রলোকটি বেটে খাটো। চকোলেট রংয়ের প্যান্ট এবং নীল হাওয়াই সার্ট পরনে। প্রথম দৃষ্টিতেই মনে হবে, এ ভদ্রলোক অত্যন্ত গোছালো। ওঁরা দুজন সোফায় বসলে অর্চনা বললো, এসো দানিয়েল তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে সত্যব্রত আমার কলিগ এবং বন্ধু। আমি ধুতি পরা হ্যাংলাপনা ভদ্রলোকের সঙ্গে হাত মেলালাম। আর উনি হলেন অনিমেষদা। আশা করি দেখে চিনে নিতে তোমাদের অসুবিধে হবে না।
এ হচ্ছে দানিয়েল, আমার বাংলাদেশের বন্ধু। তার সম্পর্কে তো তোমাদের অনেক বলেছি। সত্যব্রতবাবু উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, আরে দানিয়েল সাহেব, আপনার সম্পর্কে অৰ্চনার কাছে এতো শুনেছি যে বলতে গেলে আপনার সমস্ত কিছু মুখস্ত হয়ে গেছে। তাঁর কথায় হাসলাম। তিনি ফের জিগগেস করলেন, আপনি কেমন আছেন, এখানে কোথায় উঠছেন, আর আপনাদের মুক্তিসংগ্রামের সংবাদ কি? আমি আমার নিজের কথা বলতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সম্বন্ধে জানতে চাইলে কেমন নার্ভাস এবং অপ্রস্তুত বোধ করতে থাকি। মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে আমি কতোটুকু বলতে পারি। দেশের ভেতরে কি হচ্ছে কিছু জানিনে। সীমান্তে যা ঘটছে তারও খবর ঠিকমতো পাইনে। থিয়েটর রোডের কর্তাব্যক্তিরা কি আমার সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন? আমি সমস্যাতাড়িত অস্তিত্বের ভারে পীড়িত একজন অতি অসহায় মানুষ। আমার কাছে মানুষ জানতে চাইলে জবাব দিতে গিয়ে কেমন বাধো বাধো ঠেকে। অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশে একটি মুক্তিযুদ্ধ চলছে এবং এই যুদ্ধের কারণেই কোলকাতা মহানগরীর নাভিশ্বাস উঠছে। ভারত পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের জন্য সাজো সাজো রব উঠছে। আমি সেই বিরাট কর্মকাণ্ডের একটা ছিটকে পড়া অংশ। যতোই বিব্রত বোধ করি না কেন, এ জাগ্রত জ্বলন্ত সত্যকে এড়িয়ে যাই কেমন করে। সত্যব্রতবাবু পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা আমাকে দিলেন এবং একটা নিজে ধরালেন। তারপর একটুখানি হেসে বললেন, আমরা আশা করেছিলাম, আপনারা অন্য রকমের একটা ঘটনা ঘটাবেন। মার্চ মাসের প্রাথমিক দিনগুলোতে পশ্চিমবাংলার হাজার হাজার ছেলে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে বাংলাদেশে গিয়ে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলো। আপনারা যুদ্ধের সমস্ত মাঠটা পাকিস্তানী সৈন্যদের ছেড়ে এককেবারে চূড়ান্ত নাজুক অবস্থায় ইন্দিরা সরকারের অতিথি হয়ে ভারতে চলে এলেন, এটা আমরা আশা করিনে। কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো না, কিন্তু কিছু না বলাটাও অশোভন। তাই আমাকে বলতে হলো, পাকিস্তানী আর্মির ক্র্যাক ডাউনের এক সপ্তাহ আগেও আমরা ধারণা করতে পারিনি যে আমাদের এভাবে এখানে চলে আসতে হবে। কিন্তু দেখতে পারছেন তো এসে গেছি। এখন করার বেশি কিছু কি আছে? সত্যব্রতবাবু অনেকটা আফশোসের ভঙ্গিতে বললেন, আপনাদের দেশ এবং জনগণের ভাগ্য এখন আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মধ্যে আটকা পড়ে গেছে। দুনিয়ার সমস্ত দেশ চাইবে আপনাদের উপলক্ষ করে দাবায় নিজের চালটি দিতে। মাঝখানে আপনারা চিড়ে চ্যাপটা হয়ে যাবেন। আমার মনে হয় কি জানেন, আপনাদের ওই শেখ মুজিব মানুষটি হাড়ে হাড়ে সুবিধেবাদী অথবা আস্ত একটা বোকারাম। কি সুবর্ণ সুযোগই না আপনাদের হাতে ছিলো। একটা চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো, সেটা বুকের ভেতর জমিয়ে রাখলাম। অর্চনা বললো, তোমরা আলাপ করো, আমি দেখি চা দেয়া যায় কিনা। সে বাড়ির ভেতর চলে গেলো।
অনিমেষবাবু মুখ খুললেন, আচ্ছা দানিয়েল সাহেব, একটা কথা বলুন তো। আমি শুনেছি শেখ মুজিব নাকি বলেছিলেন, বাংলাদেশে কমিউনিস্ট বিপ্লব ঠেকাতে হলে সবাইকে তার ওপর নির্ভর করতে হবে। কথাটা কতদূর সত্যি। বললাম, কথাটা আমিও শুনেছি। নিশ্চয়ই সত্যি হবে। তিনি বললেন, আমার অনুমানটা সত্যি হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হবে। বাংলাদেশ হয়তো স্বাধীনতা পাবে, কিন্তু কোন্ স্বাধীনতা? আখেরে জনগণের কোনো লাভ হবে না। দোদুল্যমান বিপথগামী নেতৃত্ব দেশের জনগণকে সম্পূর্ণ একটা অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। অর্চনা ট্রেতে করে চা নিয়ে এলো। সকলে চায়ের কাপ তুলে নিয়েছে, এই সময়ে অর্চনা কথা বললো, বাংলাদেশের কথা বাদ দাও। পশ্চিমবাংলার কথা চিন্তা করে দেখো। তোমাদের গলাকাটা এবং মূর্তিভাঙ্গা প্রোগ্রামটার কি হাল হয়েছে কখনো কি তলিয়ে দেখেছো? অনিমেষদা আমার তো ইচ্ছা হয়, তোমাদের সবাইকে একটা করে আয়না কিনে দেই। যাতে করে নিজেদের চেহারা নিজেরা ভালো করে দেখতে পারো। দিনে দিনে যে অবস্থা দাঁড়াচ্ছে পশ্চিমবাংলায়ও কি শ্বাস নিতে কষ্ট হয় না? ভুল শুধু বাংলাদেশের নেতারা করেছে আর তোমরা করোনি, এটা কি সত্যি?
সত্যব্রতবাবু বললেন, বাংলাদেশ সেন্টিমেন্ট এক্সপ্লয়েট করে শাসক কংগ্রেস এখানকার পরিস্থিতি এমন ঘোলাটে করে তুলেছে যে সত্যিকার বিপ্লবীদের চেহারা দেখানোই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ঠং করে পেয়ালাটা পিরিচের ওপর রেখে অর্চনা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো, সত্যব্রত তুমি সত্যিকার বিপ্লবী কাদের বলছো! যারা মূর্তি ভেঙ্গেছে, গ্রাম গঞ্জের জোতদার মহাজনের গলা কেটেছে, চীনের চেয়ারম্যানকে আমাদের চেয়ারম্যান বলেছে, তারাই কি সত্যিকারের বিপ্লবী? আজকে তোমরা বাংলাদেশের ছেলেদের দায়ী করছো। তোমাদের বন্ধুরা কি অবগত আছেন, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার জন্য তাঁরা কম দায়ী নন। পশ্চিমবাংলার বিপ্লবী আন্দোলন বাংলাদেশের বামপন্থী দলগুলো একটা সময় পর্যন্ত জাতীয় সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেনি। তোমাদের নেতাদের মতো তারাও বলেছে চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান! যেহেতু পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের বন্ধুত্ব আছে তাই বামপন্থী কতিপয় দল এখনো পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে আসতে তোমাদের ভ্রান্তনীতি কি সহায়তা করেনি? আগে নিজেদের দোষগুলো দেখো তারপর বাংলাদেশের দোষ ধরতে যেয়ো। দুঃখ এই জায়গায় যে কেউ সহজ বিষয় সহজভাবে দেখছে না।
বাহ্ চমৎকার আড্ডা হচ্ছে দেখছি। সুনীলদা ঘরে ঢুকলেন। দরোজা খোলাই ছিলো। তিনি অর্চনার বড় ভাই। একটি বিদেশী কোম্পানীতে এক্সিকিউটিবের চাকরি করেন। সব সময়ে হাসিখুশি থাকার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে সুনীলদার । তিনি ঘরে ঢুকতেই মনে হলো, দক্ষিণের জানালাটা খুলে দিয়েছে কেউ। অনিমেষ, সত্যব্রত, দানিয়েল সবাই একসঙ্গে, বাহ্ চমৎকার। তিনি হাতের ব্যাগটা রেখে এক সঙ্গে বসে গেলেন। কি নিয়ে কথা হচ্ছিলো তোমাদের। অর্চনা বললো, দাদা তুমি তো অফিস থেকে এই মাত্র এলে। কাপড়চোপড় বদলে মুখহাত ধুয়ে তারপর বসো না। এখনতো তুমি ক্লান্ত। আরে রাখো, ক্লান্ত হবো কেননা । আমার নার্ভের মধ্যে জীবনযাপনের ঝকমারী ছাড়া অন্য কোনো ট্যানশন নেই। তাই আমি ক্লান্ত হইনে। তোদের মতো অতো পঁাচগোচ তো আমি বুঝিনে। আমার ওই একটাই কথা, যে কেউ নিজের শরীরের চাইতে বড় কোনো কিছুর জন্য আত্মদান করবে, যতো ভুলই করুক, আলবত একটা ফলবে। এই ধরো না বাংলাদেশের কথা, সেখানে এতো মানুষ প্রাণ দিচ্ছে তার একটা সুফল আসবেই। আবার ধরো শয়ে শয়ে নকশাল ছেলে সিআরপি এবং পুলিশের হাতে প্রতিদিন খুন হচ্ছে তারও একটা ফল হবে। হয়তো তুমি আমি যেভাবেই চাই সেভাবে হবে না, কিন্তু ফল একটা অবশ্যই হবে। সত্যব্রতবাবু বললেন, সুনীলদা আপনার একটা সুবিধে কি জানেন? আপনি সমস্ত জাগতিক এবং সামাজিক দ্বন্দ্ব আকাশে টেনে নিয়ে একটা সমাধান টেনে আনতে পারেন। এ ব্যাপারে আপনি হেগেলেরও এক কাঠি ওপরে। পরম সত্তার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে সমস্ত জাগতিক দ্বন্দ্বের অবসান করে ফেলতে পারেন। সুনীলদা বললেন, তোমার ওই হেগেল টেগেল বুঝিনে। আমি অত্যন্ত সহজ মানুষ এবং সাদা চোখে দুনিয়াটা দেখি। সুনীলদা অন্য রকমের মানুষ। উনাদের সঙ্গে আলোচনায় তিনি বেমানান এ কথাটা দু’পক্ষই বুঝতে পারে। তাই সত্যব্রতবাবু বললেন, চলুন অনিমেষদা যাই। সুনীলদা বললেন, সে কি তোমরা এরই মধ্যে চলে যাবে? তা কেমন করে হয়। বসো গল্প করি। চা খাও। অনিমেষ বাবু বললেন, চা খেয়েছি। আরেকদিন না হয় আসবো আজ চলি। সুনীলদা বললেন, রোববার ছুটির দিন আছে, সকাল বেলা এসো, চুটিয়ে গল্প করা যাবে।
উনারা দু’জন চলে গেলে সুনীলদা আমার কাছে ঘেঁষে বসলেন। ধরো দানিয়েল, তোমাকে একটা ভালো সিগারেট দেই। টেনে দেখো যদি ভালো লাগে আস্ত একটি প্যাকেটই প্রেজেন্ট করবো। আজ এক পার্টি আমাকে আস্ত একটা কার্টুন গিট করেছে। তিনি সিগারেটে টান দিয়ে আরাম করে ধোয়া ছেড়ে বললেন, দুনিয়াতে বিস্তর ভালো জিনিস আছে, মাঝে মাঝে চেখে না দেখলে জীবনটাই বিস্বাদ হয়ে যায় বুঝলে দানিয়েল। তারপর তিনি জুতো জোড়া এবং গায়ের জামাটি খুলে টেবিলের ওপর পা দুটি তুলে দিয়ে বললেন, কিছু মনে করো না দানিয়েল। ইচ্ছে হলে তুমিও তুলে দাও। এখন বলো তোমার যুদ্ধের সংবাদ। আমি বললাম, চলছে। সুনীলদা আসলে কথা বলার একটা উপলক্ষ চাইছিলেন। তারপর বলতে থাকলেন। দেখবে একদিন তোমাদের জয় হবেই। এ তোমাদের ন্যায়যুদ্ধ। জানো তাৈ, যথা ধর্ম তথা। জয়। ধর্ম তোমাদের পক্ষে। একদিন আমি তোমাকে বিজয়দার কাছে নিয়ে যাবো। এসব কথা তিনি আমার চাইতে আরো ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে পারবেন। বিজয়দা এখন রামকৃষ্ণ মিশনে থাকেন। মনে করো না, তিনি ধর্মকর্ম নিয়ে ডুবে থাকেন। মোটেই সত্যি নয়। দেখবে কি রকম বিচক্ষণ মানুষ। জগৎ-সংসারের সব খবর রাখেন। আধুনিক ফিজিক্সের জটিল সব তত্ত্ব ক্যাট মানে বেড়ালের মতো করে বুঝিয়ে দিতে পারেন। দেখে বিশ্বাসই হবে না এই মানুষটি যৌবনে বাঘা যতীনের সঙ্গে বালেশ্বরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বললেন, মানুষের মনের এই যে ট্যানশন তার পেছনে দু’টি কারণ, একটি হলো লোভ, অন্যটি অনিশ্চয়তা। মনের ভেতর থেকে এই দু’বস্তুর অবসান ঘটাতে পারলে দেখবে জীবন অনেক ফলবান এবং পৃথিবী অনেক সুন্দর হয়ে উঠবে। সুনীলদার বক্তৃতাটি আরো দীর্ঘ হতে পারতো। কাজের মেয়েটি খবর দিয়ে গেলো, কে একজন তাঁকে টেলিফোনে ডাকছে। আমি বললাম, সুনীলদা আজ আমার একটু কাজ আছে, সুতরাং চলি। আরেকদিন না হয় আসবো। তিনি জোর করলেন না।
আমার সঙ্গে অর্চনা বড়ো রাস্তার গোড়া পর্যন্ত এলো। বললো, কোনো কথা হলো । দানিয়েল, আমি খুবই দুঃখিত। বললাম, অর্চনা, দুঃখিত হওয়ার কারণ নেই। যা ঘটবার ঘটে যাবে, সত্যিকার অবস্থাটি ভুলে থাকতে পারলে আমি খুশি হই। কিন্তু পারি কই? অর্চনা আমার কাঁধে হাত রেখে বললো, এক কাজ করো। তোমার বান্ধবীর নাম এবং হাসপাতালের ওয়ার্ড নাম্বারটি লিখে দাও। কলেজ থেকে আসার পথে একবার দেখে আসবো। একটা কাগজ নিয়ে আমি তায়েবার ওয়ার্ড নাম্বার লিখে দিলাম। বাইরে পা বাড়িয়ে আমার বুকের ব্যথাটি মোচড় দিয়ে উঠলো। এই অবস্থার সঙ্গে একটি ঘটনা আমার মনে আছে। একবার দাঁতের খুব ব্যথা হয়েছিলো, যন্ত্রণায় চিৎকার করছিলাম। এই সময়ে দেখি পাশের বাড়িতে মারামারি লেগেছে। থামাতে গিয়ে তিন ঘণ্টার মতো প্রাণান্তকর যন্ত্রণা ভুলে গিয়েছিলাম। বড়ো রাস্তার ধারে ধারে টিউব লাইটগুলো জ্বলে উঠেছে। গাড়িগুলো তীব্রবেগে ছুটছে। আমি ফুটপাত ধরে হাঁটছি। কোনো কিছুর প্রতি খেয়াল নেই। ছাড়া ছাড়াভাবে নানা কিছু আমার মনের মধ্যে হানা দিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে তায়েবার মুখখানা ভেসে উঠলো। কিছুদিনের মধ্যে সে জগৎ-সংসারের হিসেব চুকিয়ে নেই হয়ে যাবে। তার মায়ের কথা মনে হলো। ওঁরা কি এখনো দিনাজপুরে আছেন? আমার মা, গ্রামের বাড়িঘর, আত্মীয় পরিজন, ঢাকার বন্ধুবান্ধব কখনো কি আবার সকলের সঙ্গে দেখা হবে? আমার সমস্ত স্মৃতির পেছনে আপনা থেকেই মুক্তিযুদ্ধটি এসে দাঁড়িয়ে থাকে। এই যুদ্ধের জয়পরাজয়ের সঙ্গে আমার অস্তিত্বও যেনো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ কোলকাতা শহরে যে আমি ছায়ার মতো বেড়াচ্ছি, তা যেনো আমার সমগ্র সত্তার একটি প্রক্ষিপ্ত টুকরো মাত্র। সেই সংগ্রামের মূল শরীরটির সঙ্গে আমি যুক্ত হতে পারছিনে কেনো? ঘুরে ঘুরে কথাগুলো মনে বেজে যেতে থাকলো। কিন্তু জবাব দেবে কে?