০৫-৬. রাত অনেক হয়েছিল

০৫.

রাত অনেক হয়েছিল। গানুবাবুদের বাড়ির পেটাঘড়িতে একটা বাজল। জিষ্ণুদের গলিতে গানুবাবুদের বাড়ি আর পেটাঘড়ি এখনও মধ্যযুগীয় আবহাওয়াকে মরতে দেয়নি। বেশ লাগে।

জানলার পাশে লেখার টেবিলে বসেছিল জিষ্ণু। টেবিললাইটের পাশেই ওর শোয়ার খাট। বইপত্র, তানপুরা, হারমোনিয়ম, ছবি আঁকার সাজ-সরঞ্জাম সমস্তই সারাঘরে ছড়ানো ছিটেনো। হাঁটতে গেলে বই সরিয়েই হাঁটতে হয়। আর শ্ৰীমন্তদা শুচিবাইগ্রস্ত মানুষ। সব কিছুই ঝকঝকে তকতকে করে পরিষ্কার না করতে পারলে তার খিদে হয় না। রোজ ডাঁই করা কাপড় কেচে ইস্তিরি না করলেও। এই ঘর পরিষ্কার করা নিয়ে বহু পুরোনো কাজের লোক শ্ৰীমন্তদার সঙ্গে মারামারি লাগে। জিষ্ণু তাকে ঘরে হাত দিতে দেয় না পাছে সব জিনিস এলমেলো হয়ে যায়। কিন্তু শ্ৰীমন্তদা হাত দেবেই দেবে। তার গোছানো মানেই সব এলমেলো করে রাখা। ইনকরিজিবল।

জিষ্ণু লিখছিল। এমন সময়ে কাকিমা ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকলেন ওর ঘরে।

কী কাকিমা? ঘুমোওনি?

পরি যে এখনও ফিরল না।

এখনও ফেরেনি?

না। তুই তো বাইরে খেয়ে এসেছিস আজ। নইলে খাওয়ার টেবিলেই জানতিস।

গেছে কোথায়?

কোনো দিনও কি বলে যায়? অন্য লোকের কথা ভাবা তার চরিত্রেই নেই। অফিস থেকে গেছে নিশ্চয়ই কোথাও। তবে মনে হচ্ছে রিহার্সালেই গেছে। তাদের অফিসের অফিসার্স ক্লাব থিয়েটার করছে না!

পুরো পাড়াটা নিঝুম। কুকুরগুলো মাঝে মাঝেই চিৎকার করে উঠছে। ট্রাম-বাসের আওয়াজও আর নেই। এই কলকাতাকে কলকাতা বলে চেনা যায় না।

 লেখা বন্ধ করে চেয়ারটা ঘুরিয়ে বসে জিষ্ণু বলল, বোসো কাকিমা! চিন্তা কোরো না। এসে যাবে। কোথায় রিহার্সাল তার ঠিকানা জানা থাকলেও না হয় হত।

কী করে বলব বল? আমাকে জানালে তবে না জানব।

আর একটু দেখে তার পর বেলিকে ফোন করে দেখব। এত রাতে মিছিমিছি ফোন করা ঠিক নয়।

কাকিমা বললেন, যা ভালো মনে করিস কর। এই মেয়ের চিন্তা আমি আর করতে পারি না। দিনে দিনে যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে।

জিষ্ণু কাকিমাকে অন্যমনস্ক করার জন্যে বলল, বলল, আজ সারাদিনের খবর বলল।

বহুদিন পর আজ পতু এসেছিল ওর মেয়ে ফুলকিকে নিয়ে।

পতু কে?

 আরে তোর কাকার কোয়ার্টারের উলটোদিকে থাকত না নীলুবাবুরা? তাঁর স্ত্রী পতু। আর মেয়ে ফুলকি। ফুলকি এম এ পড়ছে এখন। ভারি চমৎকার মেয়ে হয়েছে।

তাই?

হ্যাঁ। ওদের অবস্থাও ভালো হয়েছে এখন। বড়ো কষ্ট করে থাকত সেই সময়ে।

ভালো। আজকে মুড়িঘণ্টটা বড়ো ভালো খেলাম।

আমিই রেঁধেছিলাম।

কাকিমা বললেন।

সে তো আমি খেয়েই বুঝেছিলাম। মোক্ষদাদির হাতের রান্না ভালো কিন্তু তোমার মতো ভালো নয়।

শ্ৰীমন্তদা কবে আসবে?

আরও দিন সাতেক পর। দেশে গেলে তো মাস শেষ করেই আসে।

 আর মোক্ষদাদি?

সে তো কাল ফিরবে। তার পর বললেন, রান্না-বান্না আজকাল ভালো করে করা যাবে কী করে? মোদার কী দোষ? মাপা জিনিসে ভালো রান্না হয় না। আমিও পারতাম না। সে দিনকাল কি আর আছে। সেই মাছ নেই, সেই তেল নেই, সেই মনই নেই যে-রাঁধে তার এবং যে-খায় তারও।

একদিন ভেটকি মাছের কাঁটা-চচ্চড়ি কোরো তো কাকিমা। তোমার হাতের কাঁটা-চচ্চড়ি বহুদিন খাইনি। সেদিন হীরুকাকাকেও খেতে বোলো।

বাঁধানো দাঁতে আর কাঁটা-চচ্চড়ি কী খাবে? দু-পাটি দাঁতই তো বাঁধানো। শুনেছি ওঁর মা বাবা কারোরই দাঁত ভালো ছিল না। করলে তোর একার জন্যেই করতে হবে। পরিটা তো কাঁটা খায়ই না। মাছের মধ্যে এক রুই আর পাবদা। আর সব মাছেই নাকি তার কাঁটা লাগে। মেয়েরা বেড়ালের মতো কাঁটা ভালোবাসে। খাওয়ার ব্যাপারে এ-বাড়িতে তুই-ই মেয়ে আর পরিই পুরুষ। কই মাছের কাঁটা-মাথা খায় না কুড়মুড়িয়ে, পাবদা বা ট্যাংরা মাছের কাঁটা মাথাও খায় না, সে তোর তেলকই-ই রাঁধি কি পেঁয়াজ বেগুন কাঁচালঙ্কা দিয়ে ট্যাংরার চচ্চড়িই। অদ্ভুত মেয়ে হয়েছে এক। আমার ভালো লাগে না। বিয়ে-থাও করল না। চোখ বোজার আগে শান্তিতে চোখ বুজতে পারব না। শান্তির কপাল করে তো আসিনি।

 অনেক দেরি আছে তোমার চোখ বোজার। তা ছাড়া পরি শুধু স্বাবলম্বীই নয়, একজন কেউ-কেটাও, তোমার চিন্তা কী?

না রে। মানুষ যখন এখানে আসে তখনই হিসেব হয় শুধু। আগে পরের যাওয়ার বেলা কোনো হিসেব থাকে না। সবচেয়ে ছোটো যে, সে-ই সবচেয়ে আগে যেতে পারে। বড়ো সবচেয়ে পরে। মেয়েমানুষ। স্বাবলম্বী হলেও বিয়ে না হলে পূর্ণতা পায় না।

জিষ্ণু চুপ করে থাকল। পুষির কথা মনে পড়ল ওর।

পুষিদের বাড়িতে গেছিলি?

কাকিমা শুধোলেন।

না।

পুষির মায়ের কথা মনে হতেই মনটা বড়ো খারাপ হয়ে যায়।

জিষ্ণু চুপ করে রইল।

এমন সময়ে গলিতে একটি গাড়ি ঢোকার শব্দ হল। এ-গলিতে গাড়ি আছে শুধু ভড়বাবুদের। তেলের কলের মালিক। তাঁর গাড়ি অনেকক্ষণ গ্যারেজ-বন্ধ হয়ে গেছে। গানুবাবুদের অবশ্য অনেকইগাড়ি। অনেকরকম। তবে সেসব গাড়ি যতটা দেখাবার জন্যে, চড়ার জন্যে ততটা নয়। গাড়ি সাজানো থাকে দিশি-বিদিশি। কখনো-কখনো অ্যান্টিক শোয়ের জন্যে অ্যান্টিক হয়ে যাওয়া গাড়ি বের হয়। নানা বিচিত্র সাজে সেজে বেরোন বাবু-বিবিরা। গানুবাবুদের দেখে এ-রাজ্যে যে মন্বন্তর, দেশবিভাগ, নকশাল আন্দোলন, দার্জিলিং-এর অশান্তি, মিছিল-মিটিং বনধ-এর প্রভাব আছে কোনো, তা বোঝার উপায় নেই। ছেলেদের ধাক্কা পাড়ের ধুতিতে কাছা দেওয়ার রকমটা বদলায়নি একটুও এবং বদলায়নি মেয়েদের প্রমাণ সাইজের গামছা পরে দিনের মধ্যে বার পাঁচেক মার্বেলের চওড়া বারান্দা দিয়ে বাথরুমে চান করতে যাওয়া।

এই গলির চাঁপাবউদির স্বামী ছোটুদার আছে এনফিল্ড মোটরসাইকেল। সকালে গলি গমগমিয়ে বেরিয়ে যায়। সন্ধে আটটা নাগাদ আবার গলি কাঁপিয়ে ঢোকে। লেদ মেশিন আছে কয়েকটা ছোটুদার। হাওড়ার কদমতলাতে। এক সময়ে মণি খাঁর রাইস মিলে কাজ করত। হরিমতী রাইস মিলে। মেদিনীপুর জেলার ডেবরাতে। কলেজের ছাত্র ছিল যখন তখন সেখানে একবার মাছ ধরতে গেছিল জিষ্ণু ছোটুদার সঙ্গে। মণি খাঁ ফিনফিনে গা দেখা যাওয়া আদ্দির পাঞ্জাবি, চুনোট ধুতি, হালকা নীলাভ রিমলেস চশমা, আর চকচকে পাম্প-শু পরতেন। ঠোঁটে সবসময়ে থাকত স্টেট এক্সপ্রেস সিগারেট। খুব রসিক মানুষ ছিলেন। খাদ্য-পানীয় এবং জীবন-রসিক। অনেক যত্ন-আত্তি করেছিলেন জিষ্ণুদের।

নকশালরা তাঁকে নৃশংসভাবে মারে কদমতলাতেই, সকালে যখন হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। চিঠি দিয়েছিল আগে। পকেটে রিভলবার ছিল। কিন্তু রিভলবারে হাত দেওয়ার আগেই ভোজালির এক কোপে ডান হাতের কবজির কাছ থেকে আধখানা হাত কেটে দেয়। তার পর…

ওঁর ডেডবডি দেখেছিল জিষ্ণু ছোটুদার সঙ্গে মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে। নকশালদের হুমকিতে রেসিডেন্ট সার্জন মণিবাবুকে বাঁচাবার কোনো চেষ্টা করেননি বলে শুনেছিল। সে বড়ো বীভৎস মৃতদেহ।

গাড়িটা এসে দাঁড়াল মনে হল জিষ্ণুদের বাড়িরই সামনে।

কাকিমা উঠছিলেন।

জিষ্ণু বলল, আমি যাচ্ছি। তুমি বোসো।

দরজা খুলতেই দেখল, গাড়ি থেকে পরিকে দুজন ভদ্রলোক হাত ধরে নামালেন। পরি বেঁকে দাঁড়িয়ে কাঁপা হাত নাড়িয়ে বলল, গুড নাইট।

গাড়ি থেকে কে যেন বললেন, স্লিপ টাইট।

.

০৬.

গাড়িটা আর না দাঁড়িয়ে জোরে ব্যাক করে চলে গেল গলি থেকে। হেডলাইটের তীব্র আলোটা জিষ্ণুর দু-চোখ ধাঁধিয়ে দিল। আলোটা সরতেই জিষ্ণু দেখল পরি ভেতরে না ঢুকে দরজার সামনে রক-এর ওপরেই বসে পড়েছে। দেওয়ালে হেলান দিয়ে।

জিষ্ণু নীচু গলায় ডাকল, পরি।

পরি জড়ানো গলায় বলল, ঠিক আছি, ঠিক আচি।

জিষ্ণু ব্যাপারটা আঁচ করেই, পাছে গলির জানালাগুলির পেছনে গভীর রাতের কৌতূহলী চোখগুলি সব জেগে ওঠে, সেই ভয়ে পরিকে তাড়াতাড়ি পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে ভেতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করল।

পরি হাঁটতে পারছিল না। প্রচন্ড মদ খেয়েছিলই, মানসিক ভারসাম্যও ছিল না ওর। হুইস্কির গন্ধ বেরোচ্ছিল মুখ থেকে।

কাকিমা দোতলার সিঁড়িতে দাঁড়িয়েছিলেন।

 মুখে কালি ঢেলে দিয়েছিল কাকিমার। বললেন, কী হয়েছে? জিষ্ণু? কী হয়েছে ওর?

 জিষ্ণু বলল, কিছু নয়। তুমি একটু লেবু দিয়ে শরবত করে দিতে পারো কাকিমা ওকে? সঙ্গে একটু নুনও দিয়ো।

কীসের গন্ধ এমন বিটকেল?

 কাকিমা বললেন।

ওষুধ-টষুধের হবে।

জিষ্ণু মিথ্যে বলল।

ওষুধ? কীসের ওষুধ? ও মদ খেয়ে এসেছে। রাত সোয়া একটার সময়ে অচেনা লোক ওকে গাড়ি থেকে মাতাল অবস্থায় নামিয়ে দিয়ে গেল! এ-মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দে। বের করে দে জিষ্ণু।

আঃ কাকিমা। রাত হয়েছে। কেন চেঁচামেচি করছ। শরবতটা খাইয়ে ওকে শুইয়ে দাও।

 ওকে মারব আমি।

 তিরিশ বছরের মেয়েকে মারবে তুমি, ছি :

ও আমার মেয়ে নয় জিষ্ণু। ওর মুখ দেখতে চাই না আর আমি। দুশ্চরিত্রা। ছিঃ।

আঃ! কী বলছ কাকিমা! সরো, সরো, ওকে ওর ঘরে নিয়ে যাই। তুমি শরবতটা করে নিয়ে এসো।

ঘরে পৌঁছোবার আগেই পরি জিষ্ণুর গায়ের ওপরেই ওয়াক ওয়াক করে বমি করে দিল। জিষ্ণু হাতকাটা গেঞ্জি পরেছিল একটা। তারমধ্যে দিয়ে গলে সারা বুক-পেট গা বমিময় হয়ে গেল।

তার পর বেসিনের সামনে নিয়ে যেতেই হুইস্কি, মাংসর কাবাব এবং পরোটার টুকরো মাখামাখি করে আবার ওর গায়েরই ওপরে উগড়ে দিল পরি। জিষ্ণু লক্ষ করল যে, পরির শাড়ি-ব্লাউজ বিস্রস্ত। চুলও। ব্লাউজের একটিমাত্র বোতাম লাগানো। ভেতরের ব্রেসিয়ার খোলা। তারমধ্যে থেকে পুষ্ট সোনা-রঙা একটি স্তন যৌবনের সব যন্ত্রণার প্রতিভূর মতো ঠেলে বেরিয়ে আসছে। বড়ো, পাকা কাবুলি আঙুরের কালো বোঁটা।

শরীরটার মধ্যে কীরকম যেন করে উঠল জিষ্ণুর। চোখ সরিয়ে নিল। তার পর নিজে বাথরুমে গেল পরিষ্কার হতে। পরিকে মুখ-ধোওয়া বেসিনটার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে।

যাওয়ার সময়ে বলল, কাকিমা, ওকে ধরো। ও অসুস্থ। কিছু বোলো না। আরও বমি করতে এল গলায় আঙুল দিয়ে। শরীর ভালো লাগবে। আমি জানি, এমন হলে শরীর খারাপ লাগে। একদিন রাউরকেল্লায় এরকম হয়েছিল আমার একবার অফিসের পার্টিতে।

আরে তুই ছেলে জিষ্ণু। এসব মাঝে মাঝে তোদের অফিসের ডিউটি হিসেবেই না করলে নয়। তোর বাবা-কাকারাও করেছে। কিন্তু ও যে মেয়ে। ছিঃ ছিঃ। এর চেয়ে সোনাগাছিতেই ঘর নিক না। বেশি দূরও তো নয় এ-বাড়ি থেকে।

ছিঃ কাকিমা। কী যা-তা বলছ তুমি! ওকে ধরো। আমি পরিষ্কার হয়ে আসছি। বাথরুমে যেতে যেতে বিরক্তির গলায়, বলল, ও-ও তো চাকরি করে। আমার চেয়ে বড়ো চাকরি। ছেলেদের বেলাই দোষ হয় না। আর মেয়েদের বেলাই যত দোষ?

বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখল বেসিনটা একেবারে ভরে গেছে পরির বমিতে। নানা রঙা জিনিস থকথকে হয়ে ভাসছে। তাতে। আর প্রচন্ড দুর্গন্ধ। কাকিমা মুখ বিকৃত করে পরির মুখে-চোখে এক হাতে জল দিচ্ছেন এবং অন্য হাতে কপালের কাছে ধরে আছেন। সন্তান তো!

পরি বলল, মা! ও মা!

পরিকে কোনো দিন বাবা ডাকতে শোনেনি জিষ্ণু। হয়তো বাবাকে মনে নেই বলেই ডাকে না।

কাকিমা মুখ ঘুরিয়ে বললেন, তুই গিয়ে শুয়ে পড় জিষ্ণু। ভাগ্যিস আজ শ্ৰীমন্ত নেই আর মোক্ষদাও ডায়মণ্ডহারবারে গেছে। নইলে ওদের সামনে! কী কেলেঙ্কারিটাই…

বলেই, এবার রাগের স্বরে বললেন, তুই যা জিষ্ণু। কী দেখছিস তোকে যেতে বলছি আমি এখান থেকে। আমি সব পরিষ্কার-টরিষ্কার করে তার পরে শোবো।

ঠিক আছে।

বলেই, জিষ্ণু নিজের ঘরে চলে গেল।

কী দেখছিস? কথাটা দ্ব্যর্থক কি না ভাবছিল।

মায়ের চোখ! কিন্তু জিষ্ণুর চোখে বিস্ময় ছাড়া আর কিছু তো ছিল না।

একবার ভাবল, নিজের ঘরের বারান্দাতে গিয়ে বসে। তার পরই ভাবল, এই গ্রীষ্মে গানুবাবুদের গাছগাছালির পাতা অনেকই ঝরে গেছে। যদি অন্য কেউ দেখে ফেলে জিষ্ণুকে? যারা গাড়ির শব্দ শুনেছে? সেইসব বাঙালিদের মধ্যে কারো কারো উৎসাহ চেগে উঠতেও বা পারে। কেউ কি পরিকে নামতেও দেখেছে গাড়ি থেকে? রক-এ বসে পড়তে? নাঃ। কিছুই বলা যায় না। বারান্দাতে আজ রাতে যাবে না।

টেবিল-লাইটটা নিবিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল জিষ্ণু।

অনেক কথা ভিড় করে এল ওর মাথাতে। পরি যখন ছোটো ছিল তখনকার কথা। তখন ওরা কাকার কোয়ার্টারে থাকত। হাওড়ার মধ্যেও অতখানি বাগানঅলা মস্ত কোয়ার্টার তখনও দেখা যেত না বেশি। জিষ্ণুর বাবা চিরব্রত বিয়ের তিন বছর পরই ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। ওঁর মাও মারা যান জণ্ডিসে। ঠিক তার দু-বছর বাদেই। তখন জিষ্ণুর বয়স মাত্র আড়াই। কাকা স্থিরব্রতকে জিষ্ণুর বাবাই চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়ে যান। কাকার চাকরি টাকরিতে মন ছিল না। নাটক করতে খুব ভালোবাসতেন। হংসেশ্বরী নামের একটি দলে ভিড়ে তিনি বছরের মধ্যে তিন মাস যাত্রা করে বেড়াতেন। যে-বছর বাবা মারা যান, সে বছরই কাকার বিয়েও দিয়ে যান। পিতৃমাতৃহীন জিষ্ণুকে কাকিমা হেমপ্রভা নিজের সন্তানের মতোই মানুষ করে তোলেন। পরি জিষ্ণুর চেয়ে তিন বছরের ছোটো।

 চাকরিটা ওর কাকা স্থিরব্রত টিকিয়ে রাখতে পারতেন কি না সন্দেহ ছিল ঘোরতর। কিন্তু মাত্র তিরিশ বছর বয়েসে তিনিও তিন দিনের জ্বরে মারা যান। মরে গিয়ে নিজে বেঁচে যান। কিন্তু মেরে রেখে যান কাকিমাকে। তখন থেকেই এই অভিশপ্ত পরিবারের হাল ধরেন শক্ত হাতে সুন্দরী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হেমপ্রভাই। যদিও খুব বেশিদিনের কথা নয়, তবুও একজন যুবতীর পক্ষে দুটি ছোটো ছেলে-মেয়ে জিষ্ণু আর পরিকে নিজের স্বামী ও ভাসুরের সঞ্চিত অর্থের ওপর ভর করে মানুষ করে তুলতে কম বেগ পেতে হয়নি কাকিমাকে। যখন ওঁরা সঞ্চয় করেছিলেন তখন হয়তো তার কিছু দাম ছিল। কিন্তু যখন শুধুমাত্র সেই সঞ্চয়ের ওপরই নির্ভর করতে হয়েছিল তখন ইনফ্লেশানের কল্যাণে তার মূল্য কিছুই ছিল না আর। সেসব ভারি কষ্টর দিন গেছে। তখনই এই বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন তিনি, মাসে তিরিশ টাকাতে। আর ছাড়েননি। ভাড়া অবশ্য তিরিশ বছরে বেড়ে একশো তিরিশ হয়েছে। বাড়িওয়ালা এক সহায়-সম্বলহীন বৃদ্ধ। তাকে ঠকানো কঠিন হয়নি হেমপ্রভার পক্ষে।

 হেমপ্রভা নিখুঁত সুন্দরী বলতে যা-বোঝায় তা ছিলেন না। কিন্তু যৌবনে কুকুরিও সুন্দরী হয়। কাকিমার মুখে একটি আলগা শ্ৰী ছিল, যার কিছু আজকেও অবশিষ্ট আছে। তা ছাড়া, আর যা ছিল তা ব্যক্তিত্ব। খুব কম নারীর মধ্যেই অমন ব্যক্তিত্ব দেখেছে জিষ্ণু।

কাকার এক বন্ধু হীরুকাকাও অনেক করেছিলেন ওদের জন্যে। হীরুকাকা না থাকলে কাকিমার নিজের পক্ষেও হয়তো ভেসে যাওয়াটা ওই বয়েসে, ওই অসহায়তায় পড়ে বিচিত্র কিছুই ছিল না।

আজকে হীরুকাকার বয়েস বাষট্টি। রিটায়ার করেছেন। কিন্তু আজও কাকিমা যে তাঁর ওপরে অনেকখানি নির্ভর করেন তা জিষ্ণু জানে। হীরুকাকু বিয়ে করেননি। রাজা নবকৃষ্ণ লেনে নিজের ছোট্ট পৈতৃক বাড়িতেই থাকেন। পুষির সঙ্গে জিষ্ণুর বিয়ের রেজিস্ট্রেশানের বন্দোবস্তও যা-করার তা হীরুকাকাই কাকিমার সঙ্গে বসে করেছিলেন। পুষির দুর্ঘটনার খবর শোনামাত্রই দৌড়ে এসেছিলেন হাসপাতালে। তার পর মর্গে। পোস্টমর্টেম করার সময়ে সমস্তক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন। শ্মশানেও উপস্থিত ছিলেন এবং পুষির অদগ্ধ নাভি আর সাদা সাদা হাড়ের টুকরো-টাকরা পুষির ছোটো ভাই নিমতলার পাশের গঙ্গাতে বিসর্জন দেওয়া পর্যন্ত নীরবেই দাঁড়িয়েছিলেন জিষ্ণুর পাশে। হীরুকাকার এক ছেলেবেলার বন্ধু, পুলিশের ডি আই জি সাহায্য না করলে অনেকেরই মতো পুষির শরীরও পচে গলে যেত মর্গ থেকে বেরোতে বেরোতে। সেদিন হীরুকাকার প্রতি কৃতজ্ঞতা আরও একটি কারণে গভীরতর হয়েছিল জিষ্ণুর। শ্মশানযাত্রী পুষির আত্মীয়রা কেউই শুধোননি যে, ভদ্রলোক কে? স্বল্পজন অবশ্য জানতেন যে উনি জিষ্ণুর কাকা। আপন কাকা যে নন, তাও জানতেন। আপনের চেয়েও যে, অনেক বেশি আপন, সেটা কিন্তু জানতেন না।

শিশুকাল থেকেই দেখে আসছে জিষ্ণু, হীরুকাকার চিরদিনই একই পোশাক। পায়ে কলেজ স্ট্রিটের রাদু কোম্পানির পাম্প-শু আজকাল খুব কম লোকই পরেন। মিলের সস্তা ধুতি এবং ফুলহাতা পপলিনের শার্ট। তাও একই রঙের। ফিকে হলুদ। অনেকটা বাফতার রঙের মতো দেখতে। বুক-পকেটে একটি পুরোনো রং-জ্বলে-যাওয়া কালো-রঙা পার্কার ডুওফোল্ড কলম। ডান পকেটে পানের বাটা, পেতলের। বাঘের মতো চওড়া কবজিতে পুরোনো মডেলের একটা ওমেগা ঘড়ি। স্টিলের ব্যাণ্ড লাগিয়েছিলেন সম্প্রতি। সাদা ডায়ালের নীচে বড়ো বড়ো রোমান অক্ষরে এক থেকে বারো অবধি লেখা। চোখে গোলাকৃতি নিকেল ফ্রেমের চশমা। তাও দেখছে জিষ্ণু জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই। ক্ষয়ে গেছিল সেটা ব্যবহারে ব্যবহারে। চুল মাঝখান দিয়ে সিঁথি করা। আজকাল পাম্প-শু যেমন কেউ পরে না, চুলের মাঝখান দিয়ে সিথিও কেউ করে না। আতরও আজকাল কেউ মাখেন না। কিন্তু হীরুকাকা আতরও মাখতেন। বসন্ত থেকে বর্ষা খসস। শরৎ এবং শীতে অম্বর। বর্ষায় হাতে থাকত একটি পশুপতি পাল কোম্পানির লম্বা ডাঁটির ছাতা, শীতে শেয়াল-রঙা একটি র‍্যাপার চড়ত গায়ে। কোনো ব্যাপারেই কোনোরকম আধিক্য বা উচ্ছ্বাস ছিল না হীরুকাকার। চাকরি করতেন একটি সাহেব কোম্পানিতে। বড়োবাবুর। অনেক রাত অবধি খাটতে হত। যতদিন কাজ করেছেন। হীরুকাকার কথা আজ গভীর রাতে বার বার মনে পড়ছে এইজন্যেই যে, এই রাতের সংকটে হীরুকাকা পাশে থাকলে নিশ্চিন্ত হত জিষ্ণু এবং শান্ত থাকতেন কাকিমাও।

কাকাকে বা বাবাকে মনেই নেই জিষ্ণুর। কিন্তু ওদের এই ছোট্ট এবং একসময়কার সহায় সম্বলহীন পরিবারে হীরুকাকাই তার এবং পরির বাবা-কাকা-জ্যাঠার অভাব একসঙ্গে পুরিয়েছেন। কাকিমাকেও একদিনের জন্যেও বুঝতে দেননি যে, তিনি একা।

 পরি এবং জিষ্ণুর মামার বাড়ি ছিল মধ্যপ্রদেশের উমেরিয়াতে। মা ও কাকিমা দুটি মেয়েই তাঁদের বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তখনকার দিনে এমন বড়ো একটা দেখা যেত না। সব কথা, ঘটনা-পরম্পরা এখন ভাবলে মনে হয় বানানো গল্পই বুঝি। কিন্তু জিষ্ণুদের পারিবারিক ইতিহাসের দুর্বলতা এবং বল দুই-ই গল্প হলেও সর্বাংশে সত্যি ছিল।

হীরুকাকা কাকিমাকে ভালোবাসতেন কি বাসেন কি না, তা জানে না জিষ্ণু। তবে এটুকু এখন বোঝে যে, কাকিমা আর হীরুকাকার মধ্যে এক ধরনের একটা সম্পর্ক নিশ্চয়ই ছিল এবং আছে। কিন্তু আধুনিকার্থে প্রেম বলতে যা বোঝায় ওই একটিমাত্র শব্দ দিয়ে, হীরুকাকা আর কাকিমার সম্পর্কর ব্যাখ্যা করা হয়তো যায় না।

 জিষ্ণুর সঙ্গে পুষির প্রেম ছিল, যে-প্রেম পরিণতি পায় বা পেত ওদের বিয়েতে। হীরুকাকা আর কাকিমার সম্পর্কটা যদি কখনো কোনো পরিণতি পায় তবে হয়তো পাবে শুধুমাত্র দুজনের মধ্যে একজনের মৃত্যুতেই।

সমাজের হাতে, নিজেদের বিবেকের হাতে, নিজেদের সংস্কারের হাতে, নিজেদের সংযমের হাতে বড় নির্মমভাবেই নিগৃহীত হতেন ওঁরা। হয়তো কিছুটা স্বেচ্ছা এবং কিছুটা উপায়হীনতাতেও। সেই নিগ্রহর স্বরূপ উপলব্ধি করার মতো গভীরতা হয়তো জিষ্ণু বা পরিদের প্রজন্মর আদৌ নেই।

মাঝে মাঝে কাকিমা আর হীরুকাকাকে খুব বোকা বলেও মনে হয় জিষ্ণুর। ওঁদের দুজনের সমস্ত সুখের মধ্যে দেওয়াল হয়ে ও আর পরিই যে দাঁড়িয়েছিল সে-কথাও বুঝতে পারত ও বড়ো হওয়ার পর থেকেই ভারি অবাক লাগত এবং এখনও লাগে। হীরুকাকা আর কাকিমার সম্পর্কর প্রকৃতিটা বোঝার চেষ্টা করে।

দেওয়ালের দু-পাশে সারাটাজীবন দুজনে দাঁড়িয়ে থেকেও সুখের ঘরে একটুও কম পড়েনি বুঝি দুজনের কারোর। শরীর ছাড়া প্রেম যে হয়, থাকতে পারে; সে-কথা ভাবতে কষ্ট হয়। ভাবতে কষ্ট হলেও থাকে।

ভাবছিল জিষ্ণু।

 কিন্তু অবিশ্বাস হয় না। অল্প কদিন আগেই একটি পত্রিকাতে একজন বর্ষীয়ান কবিও ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন এই বিষয়ে। উনি বলেছিলেন, যাঁরা বলেন যে, শরীর ছাড়া প্রেম হতে পারে তাঁদের তিনি ঘৃণা করেন।

পরিই দেখিয়েছিল কাগজটি জিষ্ণুকে।

 জিষ্ণু বলেছিল, পৃথিবীতে কোনো মানুষের অভিজ্ঞতাই তো সার্বিক হতে পারে না। এখানে অভিজ্ঞতামাত্রই খন্ডিত। সর্বজ্ঞ কেউই নন। তা ছাড়া সকলের বিশ্বাসও যে একইরকম হতে হবে তারই বা মানে কী? উনি যা-বিশ্বাস করেন অথবা তাঁর অভিজ্ঞতা ওঁকে যা শিখিয়েছে উনি তাই লিখেছেন।

পরি বলেছিল, তা নয় বোঝা গেল। কিন্তু ঘৃণা শব্দটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায়? যিনি নিজে একজন কবি। শব্দ ব্যবহারের আগে তার তাৎপর্য সম্বন্ধে নিশ্চয়ই ভাবনা-চিন্তা করেছেন।

 জিষ্ণুর কিছুতেই ঘুম আসছিল না। তাই নানা এলমেলো ভাবনা মাথাতে ভিড় করে আসছিল। স্লিপিং ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমোয় বলে ঘুমের মধ্যে কোনো স্বপ্ন বা ভাবনা ওকে আর ছোঁয় না। সব কিছু থেকেই ছুটি তখন, সেই ক-ঘণ্টা। গানুবাবুদের বাড়ির পেটা ঘড়িতে আড়াইটে বাজল। জিষ্ণুর ঘর থেকে গানুবাবুদের মস্ত বাড়ি এবং বাগানটা দেখা যায়। পুরো পাড়ার এইটুকুই সম্পদ। গাছগাছালি, পাখি; সবুজ। বসন্তে ও গ্রীষ্মে কৃষ্ণচূড়া আর অমলতাসের সমারোহ, কোকিলের দাপাদাপি, বর্ষায় মহানিম গাছের ফিসফিসে বৃষ্টি-ভেজা পাতার আড়ালে মাথাবাঁচানো কাকেঁদের কলরোল। শীতের প্রকৃতির রুক্ষ মলিন খড়ি-ওঠা রূপ। পুরো গলিটা যেন বেঁচে আছে গানুবাবুদের বাড়ির এই বাগানটুকুরই জন্যে। তার মুখ চেয়ে। চতুর্দিকের ঘুমিয়ে পড়া ধুলো-নোংরা-দারিদ্র্য ও সাধারণ্যর মধ্যে মাথা উঁচিয়ে স্নোসেম রং-করা সৌধটি চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে আছে ব্যতিক্রমের সংজ্ঞা হয়ে।

বিকেলের রোদ পড়লেই দেখা যায় ময়দার বস্তার মতো ফর্সা গোলগাল স্থূলকায়া মহিলারা পাছাপেড়ে শাড়ি পরে বাগানে ও মার্বেলের চওড়া বারান্দায় গজেন্দ্রগমনে চলাফেরা করছেন। এক-একজন তে-কোনা চারকোনা পাঁচকোনা বাবুদের পেছনে এক একজন করে খিদমদগার ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্টিভেডরিং আর শিপচ্যালোরিং-এর পয়সায় কোনো দিনও টান পড়েনি। কখনো খিদমদগারদের হাতে রঙিন ছাতা, কখনো বেহালা, কখনো পানের বাটা, কখনো বা ট্রের ওপরে বসানো জিন এবং বরফ; অ্যাঙ্গোস্টার্স-বিটার্স। গরমের বিকেলে পেস্তা দিয়ে বাটা সিদ্ধির, নয়তো কাগজি লেবু পাতা-ফেলা কাঁচা-আম-পোড়া শরবত, শীতের সন্ধ্যায় স্কচ-হুঁইস্কি। সান-ডাউনার। বেনারস থেকে আনানো অম্বুরি তামাকে-সাজা আলবোল। অথবা ডান হিলের পাইপে ডান হিল টোব্যাকোর ধোঁওয়া।

 এখনও গানুবাবুদের বাড়িতে সবুজ যেমন অনেকই আছে, পয়সাও অনেক আছে। আছে শখও। বুঝুন আর না বুঝুন (হয়তো কেউ কেউ বোঝেন) ওঁরা গান-বাজনারও মস্ত সমঝদার। এখনও প্রায়ই ম্যায়ফিল বসে। কখনো ক্লাসিক্যাল, কখনো পুরাতনি বাংলা গান, কখনো কর্তামার অনুরোধে কীর্তন। পাড়ার লোকে বিনেপয়সাতে শোনে। অবশ্য বাইরে থেকে। শীতের রোদ, চাঁদের আলো, বর্ষায় ভেজা স্নিগ্ধ চেকনাই-এর পুরো ভাগ পায় এ-গলির প্রত্যেক বাসিন্দা গানুবাবুদের বাড়ি-বাগানেরই কল্যাণে। ময়না, কাকাতুয়া ডাকে; বলো গোবিন্দ, বলো রাধে। ম্যাকাও ডাকে কর্কশ স্বরে। একটা কাকাতুয়া মাঝে মাঝে বলে; ক টা বাজে রে? তার দোসর সাড়া দেয়: ক-টা চাই?

তবে গানুবাবুদের বাড়ির কেউই প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলেন না। মনুষ্যেতর প্রাণী বলে গণ্য করেন ওদের বোধ হয়। তাতেই সকলে খুশি। তবু তো গানুবাবুরা আছেন। ওই বাড়িটার জন্যেই এখনও নিঃশ্বাস ফেলা যায়, প্রশ্বাস নেওয়া যায়।

পুষি একদিন জিষ্ণুর ঘরের লাগোয়া বারান্দায় বসে বলেছিল, আমরা চাঁদনি রাতে সারারাত বসে থাকব এই বারান্দাতে, হ্যাঁ? ঘুমোব না কিন্তু।

 শ্রাবণের পর থেকে শীতের শেষ অবধি এই বারান্দার আব্রু পুরো থাকে, গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো অস্পষ্ট হয়ে বারান্দায় পৌঁছোয় যেন পরিশ্রুত হয়ে। তখন বারান্দায় বসে থাকলে পাশের বাড়ি বা গানুবাবুদের বাড়ি থেকে দেখাই যায় না কিছুমাত্র। অথচ বাইরের সব কিছুই দেখা যায় এখানে বসে।

পুষি বলেছিল, এই বারান্দায় বসে থাকবে সারারাত। ভীষণ রোমান্টিক ছিল ও।

এখন জিষ্ণুদের বাড়িতে ভেতরের সব শব্দও মরে গেছে। পরির বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ হয়েছিল অনেকক্ষণ আগে। কিন্তু তার পর তার ঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দটা আর হল না। কাকিমা সম্ভবত পরির কাছেই আজ শুলেন। অনেকক্ষণ একটানা প্রলাপের মতো নীচুগলার স্বগতোক্তি ভেসে আসতে লাগল। পরির, না কাকিমার তা বোঝা গেল না। তার পর আরও নীচু গলার স্বগতোক্তির মতো কিছু।

পরির?

ভুল শুনল হয়তো।

তার পর পুরোবাড়ির আলো নিভে গেল। কাকিমার চাপা গলার ধমক। পরি আর একবার বাথরুমে গেল। এবারে আলো না জ্বেলেই।

 প্রত্যেক নারীর জীবনে কিছু কিছু জমি বা এলাকা থাকে, অন্য কোনো পুরুষ, সে যত কাছেরই হোক না কেন কখনোই পৌঁছোতে পারে না। এমনকী ঔৎসুক্য প্রকাশ করতে পারে না। এইজন্যেই হয়তো একজন পুরুষ ও নারীর মধ্যে পূর্ণ-বন্ধুত্ব হওয়া অসুবিধের। মানে বন্ধুত্ব যতই নিবিড় হোক না কেন বিবাহিত না হলে মধ্যে এক অদৃশ্য ফাঁক থেকে যায়ই। আমাদের এ-দেশে অন্তত। এখনও। না থাকলে জিষ্ণুকে এখন তার নিজের অন্ধকার ঘরে শুয়ে পরি সম্বন্ধে আশঙ্কা আর অনুমানের পাশবালিশ জড়িয়ে এপাশ-ওপাশ করতে হত না।

গানুবাবুদের পেটাঘড়িতে তিনটে বাজল। ভোজপুরি দারোয়ান হাঁকল : সাবধান।

 কাল অফিস আছে। এক বার বাথরুমে গেল জিষ্ণু। তার পর ঘুমোবার চেষ্টা করল। কিন্তু ঘুম কিছুতেই আর এল না। পরি তার সহোদরারই মতো। তবু পরির বোম-খোলা, ব্লাউজ আর খোলা ব্রেসিয়ার ঠেলে বেরিয়ে আসা সোনা-রঙা বুকের কথা বার বার মনে হল জিষ্ণুর। পাকা কাবুলি আঙুরের মতো কালো বোঁটাটির কথাও। এবং মনে পড়ে যেতেই, পুষির বুকের কথাও মনে হল অবশ্য। একদিনই দেখতে দিয়েছিল পুষি। বলেছিল, আর নয় এখন। সব তোলা রইল। আজ বাদে কাল বিয়ে, তর সইছে না ছেলের।

 বিছানা ছেড়ে উঠে টেবিল-লাইটটা জ্বালল। স্লিপিং ট্যাবলেটটা খেল। অ্যালার্মটা সেট করল আটটাতে। সকালে বিছানা ছেড়ে উঠেই এককাপ চা খেয়েই বাথরুমে যাবে সোজা। কাগজও পড়বে না। সাড়ে আটটার মধ্যে অফিসের গাড়ি রোজই এসে দাঁড়িয়ে থাকে। পনেরো মিনিটে পৌঁছে যাওয়া উচিত অফিসে। বেঁচে গেছে স্কুটারে চড়তে হয় না বলে। মিনিবাসেও।

গাড়িতে যখন অফিসে যাওয়া-আসা করে তখন পাশ দিয়ে যাওয়া অথবা ইদানীং উলটোদিক থেকে আসা মিনিবাসের মধ্যে নির্বিকার-মুখে যেসব যাত্রী বসে থাকেন, যাঁরা ড্রাইভার কনডাক্টরদের বেনিয়মি বা অভদ্রতা করতে দেখেও কিছুমাত্রই বলেন না, তাঁদের প্রতিও এক গভীর অসূয়া জন্মেছে ওর। মানুষ নিজেরটা ছাড়া বোধ হয় আর কিছুই বোঝে না। যেদিন যে-মিনিতে যিনি যাতায়াত করেন সেই মিনিরই নীচে তাঁর ভাই-বা স্ত্রী বা মেয়ে যেদিন চাপা পড়ে মরবে সেদিনই শুধু সৎ-নাগরিকের দায়িত্ব-কর্তব্য চেগে উঠবে। যাঁরা নির্বিকার মুখে মিনিবাসের ড্রাইভার এবং কনডাক্টরদের তাঁদের নীরবতা এবং অপ্রত্যক্ষ সায়ে যা-খুশি করাতে প্রশ্রয় দেন শুধুমাত্র নিজে সময়ে অফিসে পৌঁছোবার বা বাড়ি ফেরার জন্যে, তাদেরও কলার ধরে নামিয়ে এনে মিনিবাসের ড্রাইভার কনডাক্টরদেরই মতো ভালো করে মার দেওয়া উচিত।

কিছুদিন হল জিষ্ণুর কেবলই মনে হয়, মার ছাড়া এখন আর এ-দেশে কিছুই হবে না। মানুষ সব গণ্ডারের চামড়া পরে বেড়াচ্ছে।

 খিদিরপুরে যে-স্মাগলড মালের দোকান আছে তাদেরই একটি দোকানে বিশেষ একজনকে দিয়ে খোঁজ করিয়েছে একটি আন-লাইসেন্সড পিস্তলের জন্যে। পয়েন্ট থ্রি-টু। এলে, হাতটা ঠিক করে নিয়ে নিজের হিসাব-কিতাব নিজেই করে নেবে। দোরে দোরে ঘুরে, সম্পাদকীয় স্তম্ভে জ্বালাময়ী কিন্তু অফলপ্রসূ চিঠি লিখে, মিনিস্টারদের পি-এ দের, সেক্রেটারিদের, পাড়ার এম এল এ-দের পায়ে তেল মাখাবার মধ্যে ও আর নেই। পুষির অ্যাকসিডেন্টের পর ওর মোহই ভঙ্গ হয়ে গেছে। এই গণতন্ত্রের স্বরূপ, প্রশাসনের পরিকাঠামো, পুলিশের কর্মধারা এসবের কোনো কিছুর ওপরই আর ভরসা নেই জিষ্ণুর। ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। দিনকে দিন হচ্ছে। কোথায় গিয়ে থামবে জানা নেই। জিষ্ণু এখন সত্যিই বিশ্বাস করে যে, বন্দুকের নলই হচ্ছে সমস্ত শক্তির উৎস–বিশেষ করে যেখানে অন্য সমস্ত সভ্য উপায়ই বিফল হয়। দেখতে পাচ্ছে চোখের সামনেই এ-পথ যারাই নিচ্ছে তারাই জিতে যাচ্ছে। এখানে সকলেই- শক্তের ভক্ত নরমের যম।

গানুবাবুদের বাড়ির আলো-ছায়া ঘেরা রহস্যময় বাগানের গভীর থেকে পেঁচা ডাকল দুরগুম দুরগুম।

ঘুমিয়ে পড়ল জিষ্ণু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *