যখন আঁখিকে দেখেশুনে রাখার কথা অথচ উল্টো তাকে নিয়ে একটা মহাবিপদের মাঝে পড়ে গেলাম
অঙ্ক ক্লাসে সুমি একটা হাঁচি দিল, হাঁচি এমন কিছু অবাক ঘটনা না–যে কেউ হাঁচি দিতে পারে। সুমির হাঁচি কিন্তু একটা অবাক ঘটনা হয়ে গেল। কারণ একটু পর সে আরেকটা হাঁচি দিল, তারপর আরেকটা তারপর আরেকটা তারপর দিতেই লাগল।
অঙ্ক স্যার বিরক্ত হয়ে বললেন, “তোর হয়েছেটা কী?”
সুমি একটা হাঁচি দিয়ে বলল, “এলার্জি।”
“কীসের এলার্জি?”
সুজন ফিসফিস করে বলল, “জ্যামিতি ক্লাসের।” কেউ সেই কথাটা শুনতে পেল না, সুমি বলল, “জানি না স্যার। আমার মাঝে মাঝে হয়।” কথা শেষ করে সুমি আরেকটা হাঁচি দিল।
অঙ্ক স্যার বললেন, “যা বাথরুম থেকে নাক ধুয়ে আয়।”
সুমি মিনমিন করে বলল, “লাভ হবে না স্যার।” তারপর আরেকটা হাঁচি দিল।
স্যার বললেন, “যা বলছি।”
কাজেই সুমি বাথরুমে নাক ধুতে গেল। কিছুক্ষণ পর সে ফিরেও এল, নাক চোখ-মুখ পানি দিয়ে ধুয়ে এসেছে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। একটু পর পর হাঁচি দিচ্ছে, নাকটা টমেটোর মতো লাল। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “হাঁচি কমে নাই?”
সুমি মাথা নাড়ল, “না স্যার।” তারপর একটা হাঁচি দিল।
”কী করবি তা হলে?”
“এলার্জির একটা ট্যাবলেট আছে সেটা খেলে কমে যাবে।”
“কোথায় সেই ট্যাবলেট?”
“ব্যাগের মাঝে থাকে। এখন আছে কি না জানি না। আবার হাঁচি।”তা হলে দেখ আছে কি না। থাকলে বের করে খা।” সুমি তার ব্যাগ আতিপাতি করে খুঁজল, ব্যাগের মাঝে নাই। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “ট্যাবলেটের নাম জানিস?”
“জানি স্যার।”
তা হলে টিফিনের ছুটিতে কাউকে পাঠিয়ে কিনে আনিস।
সুজন তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বলল, “আমি কিনে আনব স্যার।”
স্যার সুজনের দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললেন, “একা যাবি না। সাথে আরো দুই একজনকে নিয়ে যাস।”
সুজন মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে স্যার।”
ঠিক তখন টিফিনের ঘণ্টা পড়ল। অঙ্ক স্যার বের হবার পর সুজন জিজ্ঞেস করল, “আমার সাথে কে যাবি ওষুধ কিনতে?”
আমি বললাম, “আমি।”
“আয় তা হলে।”
সুমির কাছ থেকে ওষুধের নামটা লিখে নিয়ে আমরা ক্লাস থেকে বের হলাম। যখন হেঁটে হেঁটে স্কুলের গেটের কাছে এসেছি তখন শুনলাম কে যেন পিছন থেকে ডাকছে, “এই সুজন, তিতু দাঁড়া।”
তাকিয়ে দেখি রিতু আর আঁখি। রিতু হাঁটছে তার থেকে একটু পিছনে আঁখি, রিতুর কনুইটা আস্তে করে ধরে রেখেছে, দেখে বোঝাই যায় না যে ধরে রেখেছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম”কী হল?”
“আমরাও যাব।”
“কোথায় যাবি?”
“ওষুধ কিনতে।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “ওষুধ কিনতে?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
রিতু চোখ মটকে বলল, “এমনি একটু বাইরে থেকে হেঁটে আসি।”
“আঁখিকে নিয়ে?”
“আঁখির জন্যেই তো যাচ্ছি! বাইরে থেকে হেঁটে আসি।”
“স্যার যদি জানেন?”
“স্যার জানলে সমস্যা কী? স্যারই তো সুজনকে বলেছেন কয়েকজনকে নিয়ে যেতে। আমরা হচ্ছি কয়েকজন।”
সুজন দাঁত বের করে হাসল, বলল, “চল!” যে কোনো বেআইনি কাজে সুজনের সবসময় উৎসাহ।
আমরা যখন গেটের কাছে পৌঁছে গেছি তখন মামুন আমাদের কাছে ছুটে এলো, জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাস?”
রিতু বলল, “সুমির ওষুধ কিনতে।”
“এতো জন?”
“সমস্যা কী? এই তো রাস্তার ওপাশে ফার্মেসি। যাব আর আসব।”
“আমিও যাব।”
সুজন মুখ ভেংচে বলল, “তুই একা কেন? আরো চৌদ্দজনকে গিয়ে ডেকে নিয়ে আয়! তারপর সবাই মিলে মিছিল করতে করতে যাই!”
রিতু বলল, “আমি স্লোগান দিয়ে বলব, যাচ্ছি কোথায় যাচ্ছি কোথায়। সবাই বলবে সুমির ওষুধ কিনতে! সুমির ওষুধ কিনতে!”
মামুন মুখ শক্ত করে বলল, “আমি সাথে গেলে তোদর সমস্যা আছে?”
আমি বললাম, “নাই।”
“তা হলে চল।”
কাজেই আমরা পাঁচজন গেটে হাজির হলাম। দারোয়ান ভুরু কুঁচকে বলল, “কী চাও?”
রিতু বলল, “বাইরে যাব।”
“বাইরে যাবে? কেন?”
“আমাদের এক ফ্রেন্ডের জন্যে ওষুধ কিনতে। খুব সিরিয়াস অবস্থা।”
“কী হয়েছে?”
“এলার্জি।”
“সেটা কী?”
সুজন বলল, “খুব ভয়ংকর অসুখ। সারা শরীরে চাকা চাকা লাল দাগ। চোখ-মুখ ফুলে গেছে। নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।”
এই হচ্ছে সুজনের কথা বলার ধরন। যেখানে সত্যি কথা বললেই কাজ হয় সেখানেও মিথ্যা কথা বলে ফেলে। দারোয়ান সুজনের কথা বিশ্বাস করল বলে মনে হয় না, মুখ শক্ত করে বলল, “টিফিনের ছুটিতে কোনো ছেলেমেয়ের বের হবার পারমিশান নাই।”
সুজন চোখ লাল করে বলল, “আপনি চান আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যাক?”
মারা যাবার কথা শুনেও দারোয়ানের কোনো ভাবান্তর হল না। সে একটা হাই তুলে ম্যাচের কাঠি দিয়ে দাঁত খুঁটতে খুঁটতে বলল, “সেইটার দায়িত্ব আমার না। আমার দায়িত্ব গেট খোলা আর গেট বন্ধ করা।”
সুজন গরম হয়ে বলল, “আমার কথা বিশ্বাস না করলে জালাল স্যারকে জিজ্ঞেস করেন।”
আমাদের অঙ্ক স্যারের নাম জালালউদ্দিন, স্কুলে এই স্যারকে সবাই গুরুত্ব দেয়। দারোয়ানও গুরুত্ব দিল, পকেট থেকে তার মোবাইল টেলিফোন বের করে সে কোনো একটা নম্বরে ডায়াল করল, অন্য পাশে ফোন ধরার পর বলল, “স্যার কিছু ছেলেমেয়ে বলছে তাদের না কি ওষুধ কিনার জন্যে বাইরে যাওয়া দরকার”
দারোয়ানের কথা শেষ হবার আগেই স্যার নিশ্চয়ই সেটা সত্যি বলে জানিয়েছেন। কাজেই দারোয়ান খুবই বিরস মুখে টেলিফোনটা পকেটে রাখল। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গেটের ছিটকানি খুলে আমাদের বের হতে দিল। সুজন মুখ শক্ত করে বলল, “আপনার জন্যে আমাদের দেরি হল। যদি সুমির কিছু হয় তা হলে কিন্তু আপনি দায়ী থাকবেন।”
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজে দেরি হয়ে গেলে চোখে-মুখে যেরকম গম্ভীর ভাব রাখতে হয় আমরা সেরকম গম্ভীর ভাব করে গেট দিয়ে বের হলাম। বের হবার পরই অবশ্যি আমাদের মুখে হাসি ফুটে উঠল। আমরা রাস্তাটা পার হয়ে ফার্মেসিতে ঢুকলাম। ফার্মেসির মানুষটা একটা খবরের কাগজ পড়ছে, আমাদের দেখে চোখ তুলে তাকাল। সুমির ওষুধটার নাম কাগজে লিখে এনেছিলাম সেটা মানুষটার হাতে দিয়ে বললাম, “এইটা আছে?”
মানুষটা দেখে বলল, “আছে। কয়টা নিবে?”
সুজন জিজ্ঞেস করল, “দাম কত?”
“এক পাতা দুই টাকা।”
এক পাতায় অনেকগুলো ট্যাবলেট থাকে, এতোগুলো ট্যাবলেটের দাম মাত্র দুই টাকা। আমি পকেট থেকে টাকা বের করছিলাম কিন্তু সুজনের কথা শুনে থেমে গেলাম। সে দরদাম শুরু করে দিল, “কম করে বলেন। এক টাকা।”
মানুষটা সুজনের কথা শুনে কেমন যেন অবাক হয়ে গেল, জিজ্ঞেস করল, “এক টাকা?”
“হ্যাঁ। এক টাকা।”
মানুষটা খবরের কাগজটা ভাঁজ করে রেখে আলমারি খুলে একটা ওষুধের বাক্স থেকে এক পাতা ট্যাবলেট বের করে কেমন যেন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিল। আমি পকেট থেকে টাকা বের করলাম, লোকটা বলল, “টাকা দিতে হবে না। যাও। এক পাতা ওষুধের জন্যে যে দুই টাকা দিতে পারে না তার কাছ থেকে আমার টাকা নিতে হবে না। তোমার দুই টাকার জন্যে আমার লাল বাতি জ্বলবে না।”
আমার অসম্ভব অপমান হল, কিন্তু সুজনের কোনোই ভাবান্তর হল না। সে ট্যাবলেটের পাতাটা নিয়ে আমাদেরকে বলল, “চল।”
আমরা ফার্মেসি থেকে বের হয়ে এলাম, রিতু বলল, “কী লজ্জা। কী লজ্জা।” সু
জন বলল, “লজ্জার কী আছে?”
আমি রেগে বললাম, “লজ্জার কী আছে তুই বুঝিসনি। গাধা কোথাকার? আমরা কী ফকির না কি যে ভিক্ষে দেবে।”
মামুন বলল, “ওষুধের ডেট নিশ্চয়ই শেষ, ফেলে না দিয়ে আমাদেরকে দিয়ে দিয়েছে।”
আমরা তখন ট্যাবলেটের পাতাটা ওলটপালট করে দেখার চেষ্টা করলাম কোথাও তারিখ দেওয়া আছে কি না। তারিখ দেওয়া নেই তাই বোঝা গেল না বাতিল হয়ে যাওয়া ওষুধ আমাদের ধরিয়ে দিয়েছে কি না। আঁখি বলল, “বাতিল ওষুধ না। ওষুধ ঠিকই আছে।”
রিতু বলল, “তুই কেমন করে জানিস?” প্রথম প্রথম কয়েকদিন ভদ্রতা করে আঁখির সাথে সবাই তুমি করে কথা বলেছে এখন আমরা তুইয়ে নেমে এসেছি।
আঁখি বলল, “না জানার কী আছে? দুই টাকার ওষুধ ফ্রি দেওয়ার জন্যে বাতিল ওষুধ খুঁজতে হয় না।”
আমি বললাম, “চল তা হলে যাই।”
সুজনকে স্কুলে ফিরে যাবার ব্যাপারে খুব উৎসাহী দেখা গেল না। সে বলল, “আয় আরেকটা ফার্মেসি দেখে যাই।”
ওষুধটা যেহেতু হয়েই গেছে এখন স্কুলে ফিরে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ কিন্তু ঠিক কী কারণ জানা নেই আমরা সবাই সুজনের কথায় রাজি হয়ে গেলাম। পাঁচজন মিলে কথা বলতে বলতে হাসাহাসি করতে করতে হাঁটতে থাকি। পরের ফার্মেসির সামনে দাঁড়িয়ে ভিতরে উঁকি দিয়ে সুজন বলল, “নাহ্। এখান থেকে ওষুধ কেনা যাবে না।”
রিতু জানতে চাইল, “কেন?”
“যে মানুষটা ওষুধ বিক্রি করছে তার চেহারাটা ভালো না।”
একজন মানুষের চেহারা ভালো না হলে তার থেকে ওষুধ কেনা যাবে না এরকম যুক্তি এর আগে কেউ কখনো দিয়েছে বলে মনে হয় না কিন্তু আমরা যুক্তিটা মেনে নিলাম। এর পরে বড় একটা জেনারেল স্টোর ধরনের দোকান পাওয়া গেল যেটা দেখে সুজনের খিদে পেয়ে গেল। আমরা তখন টাকা-পয়সা ভাগাভাগি করে দুইটা চিপসের প্যাকেট কিনলাম-এখানেও সুজন খারাপভাবে দরদাম করল। এবারে অবশ্যি কোনো লাভ হল না, মানুষটা রেগেমেগে আমাদের ফ্রি দিয়ে দিল না। আমরা চিপস খেতে খেতে হাঁটতে থাকি তখন আরেকটা ফার্মেসি পেলাম, সেটা রাস্তার অন্যপাশে কাজেই সেখানে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তখন মামুন বলল আমরা যদি এক কিলোমিটার হাঁটতে রাজি থাকি তা হলে শহরের সবচেয়ে বড় ফার্মেসি থেকে ওষুধটা কিনতে পারব। আমরা রাজি হয়ে হাঁটতে লাগলাম তখন মামুন রিকশা করে যাওয়ার প্রস্তাব দিল। আমরা তখন আবার টাকা-পয়সা ভাগাভাগি করে দেখলাম যে ইচ্ছে করলে রিকশা করে যেতে পারি।
আমরা তখন দরদাম করে দুইটা রিকশা ভাড়া করলাম, একটা রিকশায় উঠল রিতু আর আঁখি অন্যটাতে আমি মামুন আর সুজন। আমরা গল্প করতে করতে যাচ্ছি, ফাঁকা রাস্তায় রিকশা গুলির মতোন ছুটছে। হঠাৎ করে সামনের রিকশাটি থেমে গেল আর সেখান থেকে রিতু আমাদের চিৎকার করে ডাকল। আমরা আমাদের রিকশা থেকে নেমে রিতুর কাছে গেলাম। রিতু বলল, “আঁখি বলছে। অবস্থা ভালো না।”
আমরা জিজ্ঞেস করলাম, “কার অবস্থা ভালো না?”
আঁখি বলল, “এই এলাকার।”
“কী হয়েছে এই এলাকার?”
“কোনো একটা গোলমাল হয়েছে এখানে।”
“গোলমাল?” আমরা অবাক হয়ে চারিদিকে তাকালাম এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম আঁখি সত্যি কথা বলছে। এটা মোটামুটি বড় রাস্তা। অনেক গাড়ি যাবার কথা কিন্তু এখন কোথাও কিছু নেই। দোকানপাট বন্ধ এবং মানুষজন এদিকে-সেদিকে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং চিন্তিত মুখে কথা বলছে। দূরে অনেকগুলো পুলিশ।
আমি বললাম, “চল ফিরে যাই।”
সুজন বলল, “আগে দেখি কী হয়েছে।”
আমরা কিছু বলার আগে হঠাৎ করে কোথা থেকে অনেকগুলো মানুষ হইচই করতে করতে ছুটে আসতে থাকে, তাদের হাতে লাঠিসোটা।”একশান একশান ডাইরেক্ট একশান” বলতে বলতে তারা ঢিল ছুঁড়তে ছুঁড়তে একদিক থেকে এগিয়ে আসতে থাকে এবং অন্যদিক থেকে পুলিশ তাদের দিকে ছুটে আসতে থাকে। পুলিশ আর এই মানুষগুলো দেখতে দেখতে একদল আরেকদলের ওপর চড়াও হল এবং প্রচণ্ড মারামারি শুরু হয়ে গেল। আমরা ঠিক মাঝখানে রিতু আর আঁখি রিকশা থেকে নেমে পড়ে আর আমরা প্রাণপণে ছুটতে থাকি। ছুটতে ছুটতে আঁখি রাস্তায় আছড়ে পড়ল, মানুষজন তার ওপর দিয়ে ছুটতে থাকে পুলিশ লাঠি দিয়ে লোকজনকে পেটাতে থাকে। আমি কোনোমতে আঁখির কাছে ছুটে গেলাম, তাকে টেনে দাঁড়া করিয়ে অন্যদের খুঁজতে লাগলাম, কাউকে দেখতে পেলাম না। আঁখির চোখে-মুখে আতঙ্ক, সে আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। আমার মনে হল দূরে গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। মানুষ আর্তনাদ করতে লাগল এবং তার মাঝে কয়েকটা বিস্ফোরণ হল। ক্যামেরা নিয়ে সাংবাদিকেরা ছোটাছুটি করছে এবং ছবি তুলছে। আমি আঁখিকে ধরে দৌড়াতে লাগলাম এবং মনে হল তখন সাংবাদিকেরা আমাদের ছবি তুলতে শুরু করেছে।
একটা দোকানের বন্ধ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমি অন্যদের খুঁজলাম, আশেপাশে কেউ নেই কে কোন দিকে গিয়েছে জানি না। রাস্তায় একজন মানুষ পড়ে আছে, মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। অন্য একজন মানুষ ভয়ে পুলিশের দিকে তাকাচ্ছে। পুলিশ তাকে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে পিটাতে থাকে।
হঠাৎ করে চারপাশে একটু ফাঁকা হয়ে যায় এবং শিলাবৃষ্টির মত ঢিল পড়তে থাকে। ঠিক আমার কানের কাছে দিয়ে বড় একটা ঢিল উড়ে গিয়ে নিচে পড়ে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেল। আমি আতঙ্কিত হয়ে তাকালাম–দূর থেকে অনেক মানুষ ঢিল ছুড়ছে, এর যে কোনো একটা ঢিল মাথায় লাগলে মাথা ফেটে ঘিলু বের হয়ে যাবে। আমি দূর থেকে উড়ে আসা ঢিলগুলো দেখতে পাই, একটু সরে যেতে পারি কিন্তু আঁখি তো পারবে না-সে তো কিছু দেখছে না।
“আঁখি!”
“কী?”
“তুই আমাকে ধরে থাকিস–আমি যেদিকে সরি তুই সেদিকে সরে যাবি।”
আঁখি কাঁপা গলায় বলল, “ঠিক আছে।”
ঠিক তখন একটা গাড়ি সাইরেন বাজাতে বাজাতে গেল, আর দূরের মানুষগুলো আরো দূরে সরে গেল। ঢিল একটু কমে এল আর আমি রিতুকে দেখতে পেলাম, সে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে আমাদের কাছে ছুটে এল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”
“পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি।”
আঁখি জিজ্ঞেস করল, “বেশি?”
“না। ঠিক হয়ে যাবে।”
আমরা তখন আমাদের বাকি দুজনকে দেখতে পেলাম, তারাও দৌড়ে আমার কাছে এল, সুজনের চোখে একটা ঢলঢলে সানগ্লাস। আমাদের দেখিয়ে বলল, “দেখেছিস? রাস্তায় পেয়েছি, ফাটাফাটি সানগ্লাস।”
আমার বিশ্বাস হল না এরকম সময়ে কেউ রাস্তা থেকে কুড়িয়ে একটা সানগ্লাস তুলে নিতে পারে। সানগ্লাসটা ফাটাফাটি হতে পারে কিন্তু সেটা পরার পর সুজনকে দেখাচ্ছে অদ্ভুত! আমাদের রাস্তার মোড়ে একজন অন্ধ ফকির ভিক্ষে করে, বসন্ত হয়ে তার চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, সে এরকম একটা সানগ্লাস পরে থাকে। সুজনকে আমি সেটা এখন আর বললাম না, সেটা বলার সময়ও এটা না, এখন আমাদের কোটি টাকার প্রশ্ন আমরা কেমন করে স্কুলে ফিরে যাব। এরকম ভয়ংকর মারামারির মাঝে হাজির হওয়ার খবরটা বাসায় কিংবা স্কুলে পৌঁছে গেলে আমাদের কপালে দুঃখ আছে। সাংবাদিকেরা আমাদের ছবি তুলছিল, যদি সেই ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়ে যায় তা হলে কী হবে? আমাদের কথা ছেড়ে দিলাম, এরকম একটা জায়গায় আমরা আঁখিকে টেনে নিয়ে এসেছি সেটা যখন স্যার ম্যাডাম জানতে পারবেন তখন কী হবে? মাত্র এক সপ্তাহ আগে নতুন ম্যাডাম বলেছেন আমরা যেন আঁখিকে ভালো করে দেখেশুনে রাখি-এটা কি দেখেশুনে রাখার নমুনা? যদি একটা ঢিল এসে আঁখির গায়ে লাগত তা হলে কী হত?
সুজন বলল, “রাস্তায় একটা মানিব্যাগ পড়ে ছিল, তোলার আগেই আরেকজন তুলে নিল। ইস!”
রিতু চোখ পাকিয়ে বলল, “তোর মানিব্যাগের খেতাপুড়ি। এখন ফিরে যাব কেমন করে?”
মামুন বলল, “হেঁটে। আবার কীভাবে?”
আমি দূরে মানুষের জটলার দিকে তাকিয়ে বললাম, “মারামারি কি বন্ধ হয়েছে?”
আঁখি বলল, “হ্যাঁ বন্ধ হয়েছে।”
আমরা চোখ দিয়ে দেখে যেটা বুঝতে পারি না আঁখি কান দিয়ে শুনে সেটা বুঝে ফেলে। আমি বললাম, “চল তা হলে যাই।”
ঠিক যখন রওনা দিব তখন একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামল, অনেকগুলো পুলিশ সেখান থেকে নেমে আমাদের দিকে ছুটে আসে। সবার সামনে পাহাড়ের মতো বড় একজন পুলিশ, হাত-পা নেড়ে চিৎকার করে বলল, “এই! এই পোলাপান! তোমরা এইখানে কী কর?”
আমরা কিছু বলার আগেই আরেকজন বলল, “কথা বলার দরকার নাই। লাঠি দিয়া দুইটা বাড়ি দেন।”
একজন সত্যি সত্যি মোটা একটা লাঠি নিয়ে এগিয়ে এল, তখন আরেকজন থামিয়ে বলল, “দাঁড়াও। এরা কী করে এইখানে? আমরা যেখানে থাকার সাহস পাই না সেখানে এরা কী করে?”
একজন সুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এটাই হচ্ছে পালের গোদা। বদমাইশ। আমি দেখেছি এইটা ঢিল ছুড়ছে।”
সুজন মিনমিন করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তখন পাহাড়ের মতো পুলিশটা ধমক দিয়ে বলল, “চুপ কর বদমাইশ। মাথা ভেঙে ফেলব।”
রিতু এতো সুন্দর করে কথা বলতে পারে সে একটু চেষ্টা করল কিন্তু পাহাড়ের মতো লোকটা ধমক দিয়ে তাকেও থামিয়ে দিয়ে বলল, “সবগুলোর কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাই। এক রাত হাজতে থাকুক তারপর চালান দিয়ে দিব। তখন বুঝবে মজা।”
আরেকজন বলল, “বাপ-মায়েরও একটু শিক্ষা হওয়া দরকার। ছেলেপিলেরে মানুষ করতে পারে না, একেকটা বড় হচ্ছে যেন ইবলিসের বাচ্চা হয়ে।”
রিতু আরেকবার কথা বলার চেষ্টা করল, মানুষটা চিৎকার করে বলল, “খবরদার একটা কথা না। গাড়িতে উঠ।”
আমরা কিছু বলার সুযোগ পেলাম না, পুলিশগুলো ধাক্কা দিয়ে আমাদেরকে পুলিশ ভ্যানের পিছনে তুলে নিল। বেচারি আঁখি কোথায় কোনদিকে যাচ্ছে বুঝতে না পেরে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, তখন পাহাড়ের মতো মানুষটা খেঁকিয়ে উঠল, “কানা না কি? চোখে দেখতে পাও না?”
আঁখি কিছু বলল না।
ভ্যানের পিছনে তোলার পর দুইজন আমাদের পাশে বসল। তখন গাড়িটা ছেড়ে দিল। আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে। বলেছে হাজতে নিয়ে রাখবে, তারপরে না কি চালান দিবে। কেমন করে চালান দেয়? কোথায় চালান দেয়? যখন সবাই খবর পাবে যে পুলিশ আমাদের অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে তখন তারা কী করবে? আব্বু আম্মু কী করবেন? নতুন ম্যাডাম কী করবেন? আমাদের নিশ্চয়ই টি সি দিয়ে স্কুল থেকে বের করে দিবে। তখন আমি কী করব? অন্যেরা কী করবে?
চিন্তা করে যখন কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছি না তখন শুনলাম সুজন ফিসফিস করে বলছে, “পালাতে হবে।”
আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, “পালাতে হবে?”
“হ্যাঁ।”
“কেমন করে?”
“যখন গাড়িটা থামবে, তখন লাফিয়ে নামব। তারপর দৌড়।”
“আঁখি? আঁখি কী করবে?”
“আঁখিও দৌড়াবে।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “কেমন করে?”
“একজনকে ধরে।” আমি বুঝতে পারলাম না সেটা কেমন করে সম্ভব। কিন্তু দেখা গেল সুজন ফিসফিস করে সবাইকে এই কথাই বলে দিচ্ছে। আঁখিকেও বলা হল এবং আমি দেখলাম সেটা শুনে সে কেমন যেন চমকে উঠল। তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে উঠল কিন্তু সে আপত্তি করল না। আমরা ফিসফিস করে কথা বলছি সেটা হঠাৎ করে পাহাড়ের মতো পুলিশটা লক্ষ করল, সাথে সাথে সে খেঁকিয়ে ওঠে, “কী হচ্ছে এইখানে? গুজগুজ ফুসফুস কীসের? এক বাড়ি দিয়ে মুখ ভেঙে ফেলব।”
কাজেই আমরা সবাই চুপ করে গেলাম। গাড়ি করে আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তখনো বুঝতে পারছি না হঠাৎ সেটা থেমে গেল। তাকিয়ে দেখলাম রাস্তার পাশে কয়েকজন পুলিশ অফিসার, একজন হাত তুলে গাড়িটা থামিয়েছেন। এখন আমাদের লাফ দিয়ে নামতে হবে তারপর দৌড় দিতে হবে। আঁখির হাতে ভাজ করা লাঠিটা সে ছেড়ে দিল, সাথে সাথে সেটা লম্বা হয়ে যায়, সেটা হাতে নিয়ে সে শক্ত হয়ে বসে থাকে। পুলিশ অফিসারটি গাড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে ভিতরে তাকালেন। পাহাড়ের মতো পুলিশটি নেমে অফিসারকে একটা সেলুট দিল। অন্যজনও হাড়পাঁচড় করে নেমে পড়ে। পুলিশ অফিসারটি আমাদের দিকে তাকালেন, তারপর একটু অবাক হয়ে পাহাড়ের মতো পুলিশটাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এরা কারা?”
পাহাড়ের মতো পুলিশটা বলল, “স্পটে ধরা পড়েছে। ঢিল ছুড়ছিল।”
অফিসারটা আঁখির দিকে তাকালেন, তার হাতের সাদা লাঠিটার দিকে তাকালেন। তারপর সুজনের দিকে তাকালেন তারপর তার অন্ধ ফকিরের মতো সানগ্লাসের দিকে তাকালেন তারপর আমাদের দিকে তাকালেন, তারপর পাহাড়ের মতো পুলিশটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি কি জান এরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বাচ্চা?”
পাহাড়ের মতো পুলিশটা বলল, “জে?”
“ঐ মেয়েটার হাতে সাদা লাঠিটা দেখেছ? দ্য হোয়াইট কেইন? তুমি কি জান পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশে ঐ সাদা লাঠিটা দেখামাত্র পুরো সিস্টেম তাকে সাহায্য করার জন্যে এলার্ট হয়ে যায়? তার যেন কোনো অসুবিধা না হয় সেই জন্যে সবাই এগিয়ে আসে। আর এই আনফচুনেট দেশে তুমি তাদেরকে মিসক্রিয়েন্ট বলে ধরে নিয়ে যাচ্ছ?” পুলিশ অফিসারটি ধমক দিয়ে বললেন, “আর ইউ ক্রেজি? আর ইউ স্টুপিড?”
পাহাড়ের মতো মানুষটা একেবারে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল, দুর্বলভাবে বলল, “আমি দেখলাম ঢিল ছুড়ছে”
পুলিশ অফিসারটা বললেন, “ডোন্ট টক ননসেন্স। এই মুহূর্তে ওদেরকে ওদের জায়গায় পৌঁছে দিয়ে আস।”
“জি স্যার।”
আঁখি বলল, “থ্যাংকু। আপনাকে অনেক থ্যাংকু।”
পুলিশ অফিসারটি বললেন, “তুমি কিছু মনে কোরো না মা।”
আবার গাড়ি ছেড়ে দিল, এবারে অবস্থা পুরোপুরি অন্যরকম। পাহাড়ের মতো মানুষটা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “তোমরা সবাই অন্ধ?”
মামুন বলল, “হ্যাঁ।–”
আমি সুজনকে দেখিয়ে বললাম, “অন্ধ না হলে কি কেউ এইরকম কালো চশমা পরে?”
“কিন্তু, দেখে বোঝা যায় না।”
সুজন বলল, “আমরা যেহেতু চোখে দেখি না তাই বেশিরভাগ কাজকর্ম করি কানে শুনে। আমাদের কান খুব ভালো। সবকিছু আমরা শুনি। শুনে বুঝে ফেলি।”
রিতু বলল, “যেমন আপনার নিশ্বাসের শব্দ আমরা শুনতে পাচ্ছি। সেই শব্দ শুনে বুঝতে পারছি আপনার সাইজ পাহাড়ের মতো।”
“তাজ্জব ব্যাপার।”
মামুন বলল, “আপনার চেহারাটাও ভালো না।”
পাহাড়ের মতো মানুষটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল, “সেইটা তুমি কেমন করে বললে?”
মামুন উত্তর দেবার আগেই আঁখি বলল, “যে মানুষ যত সুন্দর করে কথা বলে তার চেহারা আমাদের কাছে তত সুন্দর মনে হয়। আপনি তো আমাদের সাথে সুন্দর করে কথা বলেন নাই।”
পাহাড়ের মতো মানুষটাকে কেমন জানি বিপর্যস্ত দেখাল। আমাদের স্কুলের গেট আসার আগে পর্যন্ত সেই মানুষটা আর একটা কথাও বলল না।
.
০৬.
যখন আমি বড় বড় গোঁফের একজন মুচির সাহায্যে ঝুনঝুন বল আবিষ্কার করলাম
ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছি তখন ভাইয়া জিজ্ঞেস করল, “তোদের ক্লাসের কানা মেয়েটার কী খবর?”
আমি প্রশ্নটা না শোনার ভান করে খেতে থাকলাম। ভাইয়া আবার জিজ্ঞেস করল, “কী হল? কথার উত্তর দিস না কেন?”
“কোন কথা?”
“কানা মেয়েটার কথা?”
“আমি কোনো কানা মেয়েকে চিনি না।”
“আমার সাথে ঢং করিস, তাই না?”
“আমি মোটেও ঢং করছি না।”
“তা হলে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিস না কেন?”
“তুমি সুন্দর করে প্রশ্ন কর আমি উত্তর দেব।”
ভাইয়া কেমন যেন খেপে উঠল, আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আম্মু দেখেছ, তিতা কেমন বেয়াদপ হয়ে উঠছে?”
আম্মু কিছু বলার আগেই আমি বললাম, ”আমার নাম তিতা না। আমার নাম তিতু।”
ফুলি খালা ডাল নিয়ে আসছিলেন, টেবিলে রেখে ভাইয়াকে বললেন, “মানুষের নাম নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করা ঠিক না। তিতু যখন পছন্দ করে না তখন তুমি কেন তারে তিতা ডাক?”
ভাইয়া ফুলি খালার ধমক খেয়ে কেমন যেন চিমসে গেল। আব্বু বললেন, “ফুলি ঠিকই বলেছে টিটু। তুমি তিতুকে কেন তিতা ডাক?”
আম্মু বললেন, “আর কখনো ডাকবে না।”
ভাইয়া তখন মুখটা গোঁজ করে খেতে লাগল। তখন আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “তোদের ক্লাসের ঐ মেয়েটা কেমন আছে?”
“আঁখি?”
“হ্যাঁ।”
“ভালো আছে। আমাদের পুরো ক্লাসকে জন্মদিনের দাওয়াত দিয়েছে।”
“পুরো ক্লাসকে?”
“হ্যাঁ।”
আম্মু বললেন, “খুব বড়লোক ফ্যামিলি?”
“মনে হয়।”
ভাইয়া মুখ বাঁকা করে বলল, “বড়লোক হয়ে লাভ কী? টাকা দিয়ে কি আর কানা চোখ ভালো করতে পারবে?”
আমি ভাইয়ার কথা না শোনার ভান করে আম্মুকে জিজ্ঞেস করলাম, “আঁখির জন্মদিনে কী উপহার দেওয়া যায় আম্মু?”
ভাইয়া বলল, “একটা লাঠি।” তারপর হা হা করে হাসতে লাগল যেন খুব মজার কথা বলেছে।
আম্মু বললেন, “অন্য বন্ধুদের কী দিস?”
“বই। গল্পের বই।”
আম্মু বললেন, “আঁখিকেও তাই দে।”
আব্বু বললেন, “বাসার কেউ একজন পড়ে শোনাবে।”
“কয়েকজন কী ঠিক করেছে জান?”
“কী?”
“একটা গল্পের বই না দিয়ে সেটা পড়ে রেকর্ড করে ক্যাসেটটা দিবে।”
আব্বু বললেন, “ভেরি গুড আইডিয়া। হাউ ক্লেভার।”
আম্মু বললেন, “অন্য কিছু না পেলে খাবার জিনিস দে। খাবার জিনিস সবাই পছন্দ করে।”
“উঁহু।” আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “নাহ্! আঁখি কিছু খেতে চায় না। তার টিফিনগুলো অন্যেরা ভাগাভাগি করে খেয়ে ফেলে।”
ভাইয়া বলল, “আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।”
আমি ভাইয়ার দিকে তাকালাম, “কী আইডিয়া?”
“একটা সুন্দর দেখে আয়না দে।” কথা শেষ করে আবার হা হা করে হাসতে লাগল, আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। ভাইয়া চোখের সামনে আস্তে ‘আস্তে কেমন যেন বোকা হয়ে যাচ্ছে। বেশি মুখস্থ করলেই মনে হয় মানুষ বোকা হয়ে যায়।
.
দুপুরবেলা আমরা স্কুলের মাঠে সাতচাড়া খেলছি-তখন হঠাৎ করে আমার মাথায় আইডিয়াটা এলো। অন্যান্য দিনের মতো আমরা দৌড়াদৌড়ি করছি, আঁখি বসে বসে আমাদের খেলাটা উপভোগ করছে। মামুন মাত্র চাড়াটা ভেঙে দৌড়াচ্ছে আমি বল দিয়ে তাকে মারার চেষ্টা করলাম, তাকে লাগাতে পারলাম না, বলটা আঁখির খুব কাছে ড্রপ খেয়ে তার কানের কাছে দিয়ে গেল, আঁখি তখন বলটা ধরার চেষ্টা করল। আরেকটু হলে ধরেই ফেলত–একটুর জন্যে পারল না। আঁখি না দেখেই বলটা প্রায় ধরে ফেলেছিল শব্দ শুনে। বলটা খুব কাছে ড্রপ খেয়েছে বলে সে শব্দটা শুনেছে। তার মানে যদি সবসময় বলটার ভিতরে একটা শব্দ হতে থাকে তা হলে আঁখি বলটা কোথায় বুঝতে পারবে। এরকম একটা বল যদি কিনতে পাওয়া যেত তা হলে আঁখিও আমাদের সাতে সাতচাড়া খেলতে পারত।
.
আর সেই বলটা হত আঁখির জন্যে একেবারে সত্যিকারের উপহার।
পরদিন আমি মার্কেটের দোকানগুলোতে গেলাম খোঁজ নেওয়ার জন্যে। আমার কথা শুনে তারা মনে হয় আকাশ থেকে পড়ল, অবাক হয়ে বলল, “বলের ভেতরে ঘণ্টা?”
“আমি বললাম ঘণ্টা কিংবা অন্য কিছু। ঘুঙুরও হতে পারে।”
দোকানের মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল, সে ভাবছে আমি তার সাথে ঠাট্টা করছি। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
“যারা চোখে দেখতে পায় না তারা খেলতে পারবে।”
মানুষটা মুখ বাঁকা করে বলল, “যারা চোখে দেখতে পায় না তারা খেলবে লুডু, বল কেন খেলবে?”
আমি মানুষটার সাথে তর্ক করে একটা টেনিস বল কিনে আনলাম। যদি এরকম বল কিনতে পাওয়া না যায় তা হলে সেটা বানাতে হবে।
রাস্তার মোড়ে বড় বড় গোঁফের একজন কমবয়সী মুচি কাজ করে। আমি একদিন তার কাছে গিয়ে হাজির হলাম। আমি আগেই লক্ষ করেছি একজন মুচির সামনে দিয়ে যখন কেউ হেঁটে যায় তখন সে কখনো মানুষটার মুখের দিকে তাকায় না, সবসময় তার পায়ের দিকে তাকায়। কাজেই কমবয়সী মুচিটিও আমার পায়ের দিকে একবার তাকিয়ে তার কাজ করে যেতে লাগল। আমি যেহেতু চলে যাইনি তাই শেষ পর্যন্ত মুচিটি আমার মুখের দিকে তাকাল। তখন আমি বললাম, “আমি কি আপনার সাথে একটা জিনিস নিয়ে কথা বলতে পারি?”
“কী জিনিস?”
আমি তখন তার সামনে বসে টেনিস বলটা দেখিয়ে বললাম, “এই টেনিস বলটা কেটে একটা জিনিস ঢুকিয়ে আবার কি সেটা ঠিক করে দেওয়া যাবে?”
“কী জিনিস ঢুকাতে চাও?” আমি পকেট থেকে কয়েকটা ঘুঙুর বের করে দিলাম, “এই যে এগুলো।”
মানুষটি ঘুঙুরগুলো পরীক্ষা করে দেখল, তারপর টেনিস বলটা দেখে বলল, “এটা কেটে তারপর ঢোকাতে হবে। আমার কাছে খুব চিকন সুঁই আছে সেটা দিয়ে সেলাই করে দিতে পারি, কিন্তু শুধু সেলাই দিয়ে হবে না।”
“কেন হবে না?”
“বাতাস বের হয়ে গেলে তো বল লাফাবে না।”
আমি জিজ্ঞেস করি, “তা হলে কীভাবে করা যাবে?”
“খুব ভালো আঠা দরকার। বিদেশী আঠা আছে খুব দামি। রবার পাস্টিক চামড়া সব জোড়া দিতে পারে।”
“আছে আপনার কাছে সেই আঠা?”
মানুষটা মাথা নাড়ল, “নাই। দেখি জোগাড় করতে পারি কি না।”
দামি আঠা কতো দামি সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, “কতো খরচ পড়বে?”
মানুষটা হাসল, বলল, “খরচ তো পরের কথা! আগে দেখতে হবে এটা সম্ভব কি না।”
“আমার কাছে তো টাকা বেশি নাই সেই জন্যে জানতে চাচ্ছিলাম।”
“পোলাপানের কাছে টাকা থাকার কথা না। আমি জানি।” মানুষটা গম্ভীর হয়ে বলল, “আমার কাছে রেখে যাও, দেখি কী করা যায়।”
“কবে আসব?”
“কাল-পরশু।”
কাজেই আমি মুচির কাছে টেনিস বলটা রেখে গেলাম। কমবয়সী মানুষটা সেটা নিয়ে গবেষণা করল, দুইদিন পর সত্যি সত্যি সে টেনিস বলটা আমাকে ফিরিয়ে দিল। ভিতরে চারটা ঘুঙুর-বলটা নাড়ালেই ঝুনঝুন শব্দ করে। আমার কানেই খুব স্পষ্ট শোনা যায় আঁখি নিশ্চয়ই আরো অনেক ভালো শুনতে পাবে! মুচির হাতের কাজ খুবই ভালো, সেলাইটা প্রায় দেখাই যায় না। তার উপরে এক ধরনের আঠা লাগিয়েছে। আমি টেনিস বলটা মাটিতে ড্রপ দিয়ে দেখলাম, ড্রপ খেয়ে উপরে উঠে এল, সাথে ঝুনঝুন শব্দ। এক কথায় একেবারে ফাটাফাটি।
মুচি আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল, আমার খুশি খুশি ভাব দেখে সেও খুশি হয়ে উঠল। জিজ্ঞেস করল, “এইটা দিয়ে কী করবে?”
“আমার এক বন্ধুকে দিব। জন্মদিনের উপহার।”
“অ।” মুচি মাথা নাড়ল, “তোমার বন্ধু ঝুনঝুন শব্দওয়ালা বল দিয়ে কী করবে?”
“চোখে দেখতে পায় না তো তাই তাকে খেলায় নিতে পারি না। এই বলটা থাকলে খেলায় নিতে পারব।”
“অ” মুচি মাথা নাড়ল।
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, “কত দিতে হবে?” আমার বুকটা ভয়ে ধুকধুক করতে লাগল। যদি অনেক বেশি টাকা চেয়ে বসে তা হলে কেমন করে দিব?
মুচি বলল, “কিছু দিতে হবে না।” বলে সে একটা পুরোনো জুতায় পেরেক ঠুকতে শুরু করল।
আমি অবাক হয়ে বললাম, “কিছু দিতে হবে না?”
“না। তুমি তোমার বন্ধুরে দেও। সে খেলুক।”
“কিন্তু—কিন্তু–আপনার খরচ হয়েছে না? দামি বিদেশী আঠা কিনতে হয়েছে, কতো সময় লেগেছে।”
“ওইগুলা কিছু না। তোমার বন্ধু এইটা দিয়ে খেলবে চিন্তা করলেই আমার আনন্দ হবে। ধরে নাও এই আনন্দটাই আমার মজুরি।”
এইরকম একটা কথা বলার পরে তো আমি তাকে আর টাকা সাধতে পারি। আমি তারপরেও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললাম, “আপনার নাম কী?”
মুচি মানুষটি জুতায় পেরেক ঠোকা বন্ধ করে আমার দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, “নাম দিয়ে কী করবে?”
“না মানে ইয়ে-” আমি নিজেও জানি না নাম দিয়ে কী করব!
মুচি মানুষটি আবার জুতায় পেরেক ঠোকা শুরু করে বলল, “আমাদের নাম থাকা না থাকা সমান কথা। আমার বউ আমাকে ডাকে, হ্যাঁগা, ছেলেমেয়ে ডাকে বাবা, পাবলিক ডাকে এই মুচি। কোনটা চাও, বল?”
আমি তখন বুঝতে পারলাম এই মানুষটা অন্যরকম, তাকে ঘাঁটানো ঠিক হবে না। তাই তখন যেটা সহজ সেটাই করলাম, বললাম, “আপনাকে অনেক থ্যাংকু।–”
মানুষটা তখন মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে তার বড় বড় গোঁফের ভিতর দিয়ে একটু হাসল।
.
আঁখির জন্মদিনে আমরা দল বেঁধে তার বাসায় হাজির হলাম, আমরা সবাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ভালো কাপড় পরে এসেছি। সুজন পর্যন্ত মাথায় তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে এসেছে, হঠাৎ দেখলে চেনা যায় না। আমরা সবাইকে সবসময় স্কুলের ভিতরে স্কুলের পোশাকে দেখি, এখানে কেউ স্কুলের পোশাক পরে নেই তাই সবাইকে অন্যরকম লাগছে। সবচেয়ে বেশি অন্যরকম লাগছে মেয়েদের-তারা মনে হয় সেজেগুঁজে এসেছে, কাউকেই চিনতে পারি না। আমরা সবাই কিছু না কিছু উপহার নিয়ে এসেছি, কেউ কেউ আমার মতো আলাদা কেউ কেউ রিতু শান্তা সুমির মতো একসাথে। সবাই চেষ্টা করেছে উপহারটাকে সুন্দর করে রঙিন কাগজ দিয়ে সাজিয়ে আনতে শুধু সুজনের উপহারটা খবরের কাগজ দিয়ে মোড়ানো। তার যুক্তিটা ফেলে দেবার মতো না–যত সুন্দর কাগজ দিয়েই মোড়ানো হোক আঁখি তো আর সেটা দেখতে পাবে না।
আঁখিদের বাসাটি বিশাল, বাসার ভেতরে অনেক জায়গা। আঁখি দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল, আমাদের কেউ একজন এলেই সে আনন্দে চিৎকার করে উঠছে। আমি আসামাত্রই সে একটা চিৎকার দিল, “ও তিতু তুই এসেছিস! থ্যাংকু থ্যাংকু।”
পাশে হালকা পাতলা একজন মহিলা দাঁড়িয়েছিলেন, আঁখি তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আম্মু, এই হচ্ছে তিতু। আমাকে প্রথম দিন স্কুলে যখন অপমান করছিল আমি যখন রেগেমেগে বের হয়ে আসছিলাম তখন তিতু সবার আগে লাফ দিয়ে উঠে বলেছিল দাঁড়াও!”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “তুই সেটা জানিস?”
“জানব না কেন?” আঁখি হি হি করে হাসল, “আমি না চাইলেও সবকিছু শুনি! সবকিছু মনে থাকে!”
আঁখির আম্মু বললেন, “এসো বাবা। ভেতরে এসো।”
বাসাটা খুব সাজানো গোছানো। এটা সবসময়ই এরকম সাজানো গোছানো থাকে না কী আঁখির জন্মদিনের জন্যে এভাবে সাজানো হয়েছে বোঝা গেল না। বিশাল বড় একটা ডাইনিং টেবিলের উপর খুব বড় একটা কেক। পিছনে একটা জন্মদিনের ব্যানার। ঘরের চারপাশে অনেক বেলুন। বাসায় অনেক মানুষ, বেশির ভাগেরই বয়স কম। যাদের বয়স একটু বেশি কম তারা ছোটাছুটি করছে। আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা একটু ভদ্র হয়ে বসে থাকার চেষ্টা করছে। আঁখির আত্মীয়স্বজন, চাচাতো মামাতো খালাতো ফুপাতো ভাইবোনেরাও এসেছে। স্কুলের ছেলেমেয়েরা এক পাশে বসে নিজেরা নিজেরা গল্প করছি শুধু রিতু অপরিচিত ছেলেমেয়েদের সাথেও ভাব করে ফেলছে! আমি জানি আজকে জন্মদিনের শেষে যখন আমরা সবাই ফিরে যাব তখন এই বাসার সবাই শুধু রিতুর কথা মনে রাখবে।
এরকম সময় একজন মানুষ একটা গ্লাসের মাঝে চামুচ দিয়ে ঠুন ঠুন শব্দ করতে লাগলেন, আর সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়াল, আমরাও গেলাম। মানুষটাকে আমরা চিনতে পারলাম, আঁখির আব্বু, প্রথম দিন আঁখিকে নিয়ে আমাদের স্কুলে এসেছিলেন। আঁখির আব্বু তখন গ্লাসে ইন ইন শব্দ বন্ধ করে বললেন, “আঁখির জন্মদিনে আসার জন্যে সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। এখন আমরা জন্মদিনের কেক কাটব তারপর আমাদের লাঞ্চ। লাঞ্চের পর জন্মদিনের উপহার খোলা হবে।”
সুজন হাত তুলে বলল, “কেকটা খালি কাটব? খাব না?”
সবাই হেসে উঠল, আঁখির আব্বুও হাসলেন, বললেন, “খাব, অবশ্যই খাব। এতো ভালো একটা কেক আনা হয়েছে সেটা আমাদের খেতে হবে। যখন জন্মদিনের উপহার ভোলা হবে তখন কেকও খাওয়া হবে।”
কোনো কারণ ছাড়াই সবাই তখন আনন্দে চিৎকার করে উঠল। আঁখির আব্বু বললেন, “কেক খেতে খেতে জন্মদিনের উপহার খোলার পর আমরা বড়রা সরে যাব। তখন তোমরা ছোটরা যেভাবে খুশি সময় কাটাতে পার। বাইরে খালি জায়গা আছে খেলতে পার, ভেতরে নাচানাচি করতে পার, লাফালাফি করতে পার। তোমাদের বাসা থেকে পারমিশান দেওয়া থাকলে যতক্ষণ খুশি থাকতে পার। কীভাবে বাসায় যাবে সেটা নিয়ে চিন্তা কোরো না, আমি সবাইকে বাসায় পৌঁছে দেব।”
সবাই তখন আবার আনন্দের একটা শব্দ করল। আঁখির আম্মু হাত তুলে সবাইকে বললেন, “আমি জানি তোমাদের বয়সী ছেলেমেয়েদের বেশি বেশি খিদে পায়–তাই একটু পরে পরেই এই টেবিলে নাস্তা দেওয়া হবে। তোমরা খাবে।”
সুজন আবার হাত তুলে জিজ্ঞেস করল, “কী কী নাস্তা দেওয়া হবে?”
সুজনের প্রশ্ন শুনে সবাই আবার হেসে উঠল, শুধু আঁখির আম্মু হাসলেন না, বললেন, “চানাচুর, চিপস, বিস্কুট, স্যান্ডউইচ, শিঙ্গাড়া, সমুচা, চিকেন নাগেট, মিষ্টি, ফলমূল, কোল্ড ড্রিংকস। তুমি যদি এর বাইরে আর কিছু চাও আমাকে বলতে পার।”
আঁখির আম্মুর লিস্ট শুনে সুজনের মতো মানুষও একটু লজ্জা পেয়ে গেল, বলল, “না খালাম্মা আর কিছু লাগবে না।”
আঁখির আব্বু বললেন, “তা হলে সবাই এসো, আমরা কেক কাটি।” আমরা ছোটাছুটি করে আঁখির পাশে দাঁড়ালাম, সাধারণত এরকম সময়ে অনেক মানুষ ছবি তোলে কিন্তু এখানে কেউ ছবি তুলছে না। আঁখি ছবি দেখতে পারে না সেই জন্যেই মনে হয় ছবি তোলায় কারো উৎসাহ নেই। একজন মানুষ শুধু চুপচাপ একটা ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে ভিডিও করছে। কেকের উপর মোমবাতি লাগানো হল সেই মোমবাতি জ্বালানো হল তারপর হঠাৎ একজন সুর করে হ্যাপি বার্থ ডে গাইতে শুরু করল। আমরা সবাই তখন গলা মিলিয়ে হ্যাপি বার্থ ডে গাইতে লাগলাম। কেউ একজন বলল, “ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভাও।”
আরেকজন চিৎকার করে বলল, “এক ফুঁয়ে নিতে হবে কিন্তু।”
এক ছুঁয়ে যদি নিভানো না যায় কেউ সেই ঝুঁকি নিল না। সবাই মিলে চারিদিক দিয়ে ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দিল। তখন আঁখির হাতে একজন কেক কাটার ছুরি ধরিয়ে দিল, আঁখি বলল, “ওয়ান টু থ্রি”, তারপর কেকটার মাঝখান দিয়ে কেটে ফেলল। সবাই চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে আর তখন একজন কেকটা ভিতরে নিয়ে টেবিলে খাবার দিতে থাকে। কতো রকম খাবার, দেখে আমাদের চোখ একেবারে ছানাবড়া হয়ে গেল। খাবার দেখেই কি না জানি না আমাদের হঠাৎ করে সবার একসাথে খিদে লেগে গেল। আমরা তখন রীতিমতো কাড়াকাড়ি করে প্লেটে খাবার নিতে থাকি গপগপ করে খেতে থাকি! একজন এর মাঝে টেবিলে মাংসের বাটি উল্টে ফেলল, একজনের হাত থেকে চপ নিচে পড়ে গেল, একজনের খাবার বোঝাই প্লেট মেঝেতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল, কোল্ড ড্রিংকসের বোতল থেকে ভুর ভুর করে ফেনা বের হয়ে এলো, কিন্তু কেউ সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামালো না।
আমাদের খাওয়া শেষ হবার পর বড়রা খেতে বসে। তখন লালচে চুলের একটা মেয়ে বলল, “সবাই বাইরের ঘরে এসো। এখন আঁখির গিফট খোলা হবে।”
সবাই হইহই করে বাইরের ঘরে হাজির হয়। আঁখি দেয়ালে হেলান দিয়ে একটা কার্পেটের উপর বসে আর সবাই তখন তার উপহারগুলো তার সামনে এনে রাখতে থাকে। কতো রকম উপহার, ছোট বড় মাঝারি বাক্স, চকচকে রঙিন কাগজ দিয়ে মোড়ানো। লাল চুলের মেয়েটা সামনে বসে বড় একটা বাক্স তুলে উপরে লেখাগুলো পড়ে বলল, “এটা দিয়েছেন বড় খালাম্মা। হ্যাপি বার্থডে লেখা গিফট র্যাপ দিয়ে র্যাপ করেছেন।”
সবাই চিৎকার করে বলল, “বড় খালাম্মী। বড় খালাম্মা।”
আঁখি বাক্সটা খোলার চেষ্টা করে, আশেপাশে বসে থাকা ছোট ছোট কয়েকটা বাচ্চা টানাটানি করে তাকে সাহায্য করে, বাক্সটা খোলর পর ভেতর থেকে একটা টেডিবিয়ার বের হয়ে আসে। আঁখি নরম তুলতুলে টেডিবিয়ারটি বুকে চেপে একটু আদর করে বলল, “থ্যাংকু বড় খালা। থ্যাংকু।”
বড় খালা কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন, বললেন, “তোকে যে কী দেব বুঝতে পারি। তুই টেডিবিয়ার পছন্দ করিস তাই প্রতি বছর একই জিনিস দিয়ে যাচ্ছি।”
আঁখি বলল,”বড় খালা এটাই আমার পছন্দ। থ্যাংকু।”
লালচে চুলের মেয়েটা আরেকটা বাক্স আঁখির হাতে তুলে দিল। আঁখি বাক্সটা খুলতেই ভেতর থেকে একটা ইলেকট্রনিক গেম বের হয়ে এলো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা দশ-বারো বছরের ছেলে উত্তেজিত গলায় বলল, “আঁখি আপু এইটা মেমোরি গেম। তুমি একটা বাটন চাপ দিবে তখন একটা শব্দ হবে। সেটা মনে রেখে আরেকটা চাপ দিবে।”
আঁখি বলল, “থ্যাংকু লিটন।”
“আব্বু সিঙ্গাপুর থেকে এনেছে।”
“হাউ নাইস। মামাকে থ্যাংকু দিস লিটন।”
ছেলেটি গম্ভীর গলায় বলল, “দিব আঁখি আপু।”
আঁখির আত্মীয়স্বজনেরা সবাই নিশ্চয়ই খুব বড়লোক-প্রত্যেকটা বাক্স থেকেই খুব দামি দামি উপহার বের হতে থাকল। কোনোটা এমপি থ্রি প্লেয়ার, কোনোটা মোবাইল ফোন, কোনোটা ইলেকট্রনিক গেম, কোনোটা দামি কাপড়, কোনোটা সুন্দর জুতো, কোনোটা মুক্তার মালা-এমন কিছু নেই যেটা সে উপহার হিসেবে পায়নি।
বাক্সগুলো খুলতে খুলতে হঠাৎ করে আমাদের একটা প্যাকেট বের হল। লালচে চুলের মেয়েটা প্যাকেটের উপর লেখা দেখে পড়ল, “আঁখি আপু এটা দিয়েছে তোমার স্কুলের তিনজন বন্ধু–রিতু, শান্তা, আর সুমি। প্যাকেটটা খুব সুন্দর লাল কাগজ দিয়ে সাজিয়েছে।”
আঁখি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে খুলতেই ভেতর থেকে অনেকগুলো সিডি বের হল। আঁখি হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কীসের সিডি, তখন রিতু বলল, “আঁখি আমরা দশটা গল্পের বই রেকর্ড করে দিয়েছি। একটা ভূতের, দুইটা সায়েন্স ফিকশান অন্যগুলো অ্যাডভেঞ্চার!”
আঁখি আনন্দে চিৎকার করে বলল, “থ্যাংকু থ্যাংকু তোদের। থ্যাংকু।” তারপর সিডিগুলো খানিকক্ষণ বুকে চেপে রেখে বলল, “তোরা কখন এগুলো করলি?”
রিতু বলল, “আস্তে আস্তে করেছি। আমার ভাইয়া সিডিতে রাইট করে দিয়েছে।”
শান্তা বলল, “আমরা নিজেরা পড়েছি তো তাই উচ্চারণগুলো কিন্তু আমাদের মতোন।”
আঁখি বলল, “সেটাই তো সবচেয়ে ভালো। আমি যখন শুনব তখন মনে হবে তোরা পাশে বসে আছিস!”
আরো কয়েকটা প্যাকেট খোলার পর আঁখি আমার ছোট বাক্সটা হাতে নিল। সেটা একটু ঝুনঝুন শব্দ করে উঠল, আঁখি তখন সেটা কানের কাছে নিয়ে ঝাঁকায়, তারপর জিজ্ঞেস করে, “এটা কী?”
লালচে চুলের মেয়েটা বলল, “এটা দিয়েছে তিতু।”
আঁখি জিজ্ঞেস করল, “এটা কী তিতু?”
আমি ইতস্তত করে বললাম, “খুবই হাস্যকর একটা জিনিস! তোর এতো সুন্দর সুন্দর গিফটের সাথে এটা না খুলে পরে খুলিস।”
লালচে চুলের মেয়েটা বলল, “না না! সব এখনই খুলতে হবে।”
আঁখি বাক্সটা খুলতেই টেনিস বলটা বের হয়ে এলো। আঁখি বলটা হাতে নিয়ে নাড়াতেই সেটা ঝুন ঝুন শব্দ করে উঠল, সাথে সাথে আঁখি ইলেকট্রনিক শক খাওয়ার মতো চমকে ওঠে, “এটা কোথায় পেয়েছিস?”
“পাইনি। তৈরি করেছি।”
“তৈরি করেছিস?” আঁখি উত্তেজিত গলায় বলল, “তুই তৈরি করেছিস?”
“আমি নিজে তৈরি করিনি–একজন আমাকে তৈরি করে দিয়েছে।”
“কী আশ্চর্য!” আঁখি বলটা দুই হাতে ধরে বুকে চেপে রাখল। তাকে দেখে মনে হয় সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। যারা আঁখিকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল তারা এখনো ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছে না। দামি দামি উপহার পেয়ে আঁখি ভদ্রতার কথা বলে সেগুলো পাশে রেখে দিয়েছে–আর এই অতি সাধারণ টেনিস বল পেয়ে সে কেন এতো উত্তেজিত হয়ে উঠেছে কেউ বুঝতে পারছে না।
আঁখি উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, “আম্মু আব্বু দেখে যাও আমি কী পেয়েছি!”
আঁখির আম্মু আর আব্বু কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে এলেন, “কী পেয়েছিস মা?”
“এই দেখো, ঝুনঝুনি টেনিস বল।” কেন এই টেনিস বলটা পেয়ে সে উত্তেজিত সেটা বোঝানোর জন্যে বলটা উপরে ছুঁড়ে দেয়, সেটা ঝুনঝুন শব্দ করে উপরে উঠে যখন আবার ঝুনঝুন শব্দ করে নেমে আসে সে শব্দটা লক্ষ করে বলটা খপ করে ধরে ফেলল!
হঠাৎ করে সবাই এই বলটার গুরুত্বটা ধরতে পারে আর সবাই একসাথে বিস্ময়ের শব্দ করল। আঁখিকে ঘিরে থাকা ছেলেমেয়ের ভেতরে একজন বলল,
“বলটা আমার দিকে ছুঁড়ে দাও আপু!”
আঁখি বলটা ছুঁড়ে দিল। ছেলেটা বলটা ধরে বলল, “এখন তুমি ধরো।”
ছেলেটা বলটা আঁখির দিকে ছুঁড়ে দেয়, আঁখি সত্যি সত্যি বলটাকে ধরে ফেলল। সবাই তখন আনন্দে চিৎকার করে উঠল! আঁখি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি এখন তোদের সাথে সাতচাড়া খেলতে পারব!”
আমি মাথা নাড়লাম, “হ্যাঁ। সেই জন্যেই তো তৈরি করেছি।”
আঁখি বলল, “তিতু তুই একটা জিনিয়াস!” তারপরে সে আমাকে আনন্দে জাপটে ধরল।
.
আঁখির আম্মু ডাইনিং টেবিলে একটু পর পর অনেক রকম খাবার রেখে যেতে লাগলেন কিন্তু আমরা খাওয়ার জন্যে ভেতরে এলাম। আঁখিকে নিয়ে সাতচাড়া খেলোম। সে যে খুব সাংঘাতিক প্লেয়ার তা না, কিন্তু জীবনে এই প্রথমবার সে একটা বল নিয়ে ছোটাছুটি করে খেলছে!