পঞ্চম পর্ব – অধ্যায়-১
স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পরেই পিয়ের পিটার্সবুর্গ যাত্রা করল। তর্ঝক ডাক-ঘাঁটিতে হয় ঘোড়া ছিল না, আর হয় তো ঘাঁটিদার তাকে ঘোড়া দিতে রাজি হল না। বাধ্য হয়ে পিয়েরকে অপেক্ষা করতে হল। পোশাক ছেড়েই সে গোল টেবিলটার সামনে একটা চামড়ার সোফায় শুয়ে পড়ল : ওভার-বুট পরা পা দুটো টেবিলের উপর তুলে দিয়ে ভাবতে লাগল।
খানসামা এসে বলল, আপনার পোর্টম্যান্টোটা ভিতরে এনে দেব কি? আর বিছানাটা ঠিক করে চা এনে দেব কি?
পিয়ের জবাব দিল না, কারো কোনো কথাই তার কানে ঢোকেনি, বা কিছুই সে চোখেও দেখেনি। শেষ ঘাঁটি থেকেই সে ভাবতে শুরু করেছে এবং সেই একই কথা এখনো ভাবছে–কথাটা এতই গুরুতর যে চারদিকের কোনো কিছুই তার খেয়াল নেই। পিটার্সবুর্গে পৌঁছতে দেরি হবে কি না, এ-ঘাঁটিতে থাকার ব্যবস্থা জুটবে কি না, সে ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ উদাসীন তো বটেই, এমন কি তার মনের মধ্যে এখন যেসব চিন্তা চলেছে তার তুলনায় তাকে এখানে আরো কয়েক ঘন্টাই থাকতে হোক আর বাকি জীবনটাই কাটাতে হোক তাতে তার সামান্যই যায়-আসে।
ঘাঁটিদার, তার স্ত্রী, খানসামা ও তঝকের সুচের কাজ-করা পোশাক বিক্রেতা একটি চাষী স্ত্রীলোকসকলেই ঘরে ঢুকে তার কিছু কাজ করে দিতে চাইল। নিজের নিস্পৃহ মনোভাবের কোনোরকম পরিবর্তন না করে পিয়ের চশমার ভিতর দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল, সে যেন বুঝতেই পারছে না তার নিজের এতবড় একটা সমস্যার মীমাংসা না হওয়া সত্ত্বেও তারা বেঁচে আছে কেমন করে। দ্বৈত যুদ্ধের পর সকোলনিকি থেকে ফিরে এসে প্রথম যন্ত্রণাদগ্ধ বিনিদ্র রাত কাটাবার পর থেকে এই একই চিন্তার মধ্যে সে ডুবে আছে। কিন্তু এখন যাত্রাপথের নির্জনতার সুযোগে সেই চিন্তা যেন আরো জোরে তাকে চেপে ধরেছে। যাই ভাবুক না কেন, বারে বারে সেই একই সমস্যায় সে ফিরে আসছে যার কোনো মীমাংসা করতে পারছে না, অথচ তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তাও ছাড়তে পারছে না। যেন যে মূল স্কুটা তার জীবনকে একত্রে ধরে রেখেছে তার খাজটা কেটে গেছে, আর তার ফলে স্কুটা না ভিতরে ঢুকছে, না বেরিয়ে আসছে, একই জায়গায় বৃথাই ঘুরে মরছে।
ঘাঁটিদার এসে সবিনয়ে জানাল, হিজ এক্সেলেন্সি আর মাত্র দুটি ঘণ্টা অপেক্ষা করুন, তাহলেই যেমন করে হোক সে তাকে দুটো ডাক-ঘোড়া জুটিয়ে দেবে। পরিষ্কার বোঝা গেল, লোকটা মিথ্যে কথা বলছে, সে শুধু চাইছে যাত্রীর কাছ থেকে আরো কিছু টাকা বাগাতে।
পিয়ের নিজেকেই প্রশ্ন করল, এটা কি ভালো, না মন্দ? আমার পক্ষে ভালো, আর অপর একটি যাত্রীর পক্ষে মন্দ, আর তার নিজের পক্ষে এটা অনিবার্য, কারণ খাদ্য-সংগ্রহের জন্য তার টাকার দরকার, লোকটি বলেছে, একবার কোনো যাত্রীকে খাদ্য-সংগ্রহের জন্য তার টাকার দরকার, লোকটি বলেছে, একবার কোনো যাত্রীকে ডাক-ঘোড়া দেওয়ার জন্য একজন অফিসার তাকে পিটুনি দিয়েছিল। অফিসার পিটুনি দিয়েছিল কারণ গন্তব্যস্থানে যাবার তার তাড়া ছিল। আবার আমি দলখভকে গুলি করেছিলাম কারণ আমার মনে আঘাত লেগেছিল, আর যোড়শো লুইকে মেরে ফেলা হয়েছিল কারণ সকলে তাকে অপরাধী মনে করেছিল, আবার এক বছর পরে যারা তাকে মেরেছিল তাদেরই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল–অথচ কারণটা একই। কি মন্দ? কি ভালো? কাকে ভালোবাসব, আর কাকে ঘৃণা করব? কিসের জন্য বেঁচে থাকা? আর আমিই বা কি? জীবন কি, আর মৃত্যু কি? কোন সে মহাশক্তি যা সকলকে শাসন করে?
একটি ভিন্ন এসব প্রশ্নের আর কোনো জবাব নেই, আর সেটাও কোনো যুক্তিসঙ্গত জবাব নয়, অথবা এসব প্রশ্নের কোনো জবাবই নয়। জবাবটা হল : তোমার মৃত্যু হবে, আর সেখানেই সব শেষ হয়ে যাবে। তুমি মরবে, আর সবকিছু জানবে অথবা সব প্রশ্ন থেমে যাবে। কিন্তু মৃত্যুও তো ভয়ংকর।
ফেরিওয়ালি কর্কশ গলায় তার মালপত্র বিশেষ করে ছাগলের চামড়ার একজোড়া চটি তাকে দেখাল। পিযেরের মন বলল : আমার একশো রুবল, আর তা দিয়ে কি করব তা আমি জানি না, আর এই মেয়েটি ছেঁড়া পোশাক পরে সভয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর কেন সে টাকা চাইছে? একচুল সুখ বা মনের শান্তিও তো এ টাকায় সে পাবে না। জগতের কোনো কিছুই কি ওকে আমাকে পাপ ও মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারে?–যে মৃত্যুতে সবকিছু শেষ হয়ে যায় এবং আজ হোক কাল হোক যে মৃত্যু আসবেই-আর যাই হোক, অনন্তকালের তুলনায় মুহূর্তের মধ্যেই আসবে। বার বার সে খাজ কেটে-যাওয়া স্কুটাকে ঘোরাতে লাগল, আর বার বার সেটা একই জায়গায় বৃথাই ঘুরতে লাগল।
মাদাম দ্য সুজার লেখা একটা উপন্যাস চাকর তাকে দিয়ে গেল। আর সেও জনৈকা এমিলি দ্য মাসফেলদের যন্ত্রণা ও সগ্রামের কাহিনীটা পড়তে শুরু করল। ভাবতে লাগল : যে প্রেমিক তাকে ভুলিয়ে এনেছিল তাকে যখন সে ভালোই বাসত তাহলে তাকে বাধা দিল কেন? ঈশ্বর নিশ্চয়ই তার অন্তরে তার ইচ্ছারবিরুদ্ধে কোনো আবেগকে ঢুকিয়ে দেননি। আমার স্ত্রী-একদিন তাই সে ছিল–কিন্তু বাধা দেয়নি, আর হয় তো সেই ঠিক কাজ করেছে।…কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি, কিছু আবিষ্কার করা যায়নি। আমরা শুধু এইটুকুই জানতে পারি যে আমরা কিছুই জানি না। মানুষের জ্ঞানের সেটাই উচ্চতম সীমা।
তার ভিতরে-বাইরে যা কিছু সবই মনে হচ্ছে গোলমেলে, অর্থহীন, পাল্টা আঘাতকারী। তবু সবকিছুর প্রতি এই ঘৃণার মধ্যেই যেন পিয়ের একধরনের আশা-নিরাশাভরা সন্তুটি খুঁজে পেল।
ঘাঁটিদার ঘরে ঢুকল, তার সঙ্গে অপর একজন যাত্রী, ঘোড়র অভাবে সেও আটকা পড়েছে। সে বলল, ইয়োর এক্সেলেন্সিকে অনুরোধ করছি, এই ভদ্রলোকের দিকে একটু মুখ তুলে তাকান।
নবাগত লোকটি ছোটখাট দেখতে, হাড়গুলো মোটা, মুখটা হলদে, বলীরেখায় ভর্তি, ঘন শাদা ভুরু উজ্জ্বল ধূসর চোখ দুটির উপর ঝুলে পড়েছে।
পিয়ের টেবিলের উপর থেকে পা নামিয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর বিছানায় শুয়ে নবাগত লোকটির দিকে মাঝে মাঝে তাকাতে লাগল। নবাগত যাত্রীটির হাড়-বেরকরা সরু পায়ে বুট পরা, গায়ে কাপড়ে ঢাকা ছাগলের চামড়ার জীর্ণ কোট, সোফার উপর বসে মস্তবড় মাথাটাকে পিছনে হেলান দিয়ে সে বেজুখভের দিকে তাকাল। তার কঠোর, তীক্ষ্ণ, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি পিয়েরকে বিচলিত করে তুলল। নবাগত লোকটির সঙ্গে তার কথা বলার ইচ্ছা হল, কিন্তু রাস্তা সম্পর্কে কিছু জানতে মুখ খুলবার আগেই সে তার চোখ দুটি বুজে ফেলল। তার পাকানো হাত দুটো ভাজ করা, এক হাতের আঙুলে যমের মুণ্ডু খোদাই করা একটা ঢালাই লোহার বড় আংটি পিয়েরের নজরে পড়ল। লোকটি চুপচাপ বসে রইল, হয় বিশ্রাম নিচ্ছে, আর না হয় তো কোনো গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। তার চাকরটিও হলদে চেহারা, বলীরেখাংকিত মুখ, দাড়ি বা গোঁফ কোনোটাই নেই, মুখটা যে কামানো তা নয়, আসলে দাড়ি-গোঁফই গজায়নি। বুড়ো চাকরটি রান্না সরঞ্জাম বের করে চা তৈরি করতে ব্যস্ত। নিয়ে এল একটা ফুটন্ত সামোভার। সব তৈরি। আগন্তুক চোখ মেলে টেবিলের কাছে এগিয়ে গেল, একটা গ্লাসে নিজের জন্য চা ঢালল, আর দাড়িগোঁফবিহীন বুড়ো মানুষটির দিকে এগিয়ে দিল আর একটা চা ভর্তি গ্লাস। পিয়ের কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগল, মনে হল এই অপরিচিত লোকটির সঙ্গে কথাবার্তা বলা শুধু দরকারিই নয়, একেবারে অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
চাকরটি তার গ্লাসটা উপুড় করে একটুকরো চিনি সহ সেটা ফিরিয়ে দিয়ে (রুশ ভূমিদাস ও চাষীদের মধ্যে এটাই প্রচলিত প্রথা) জানতে চাইল, আর কিছু চাই কি না।
আগন্তুক বলল, না। বইটা দাও।
চাকর একটা বই এগিয়ে দিল। যাত্রীটিও তার মধ্যে ডুবে গেল। পিয়েরের মনে হল বইখানা ভক্তিমূলক। সে লোকটির দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে আগন্তুক একটা পৃষ্ঠা-নির্দেশিকা রেখে বইটা বন্ধ করল, এবং সোফার উপর দুই হাত রেখে তার উপর মাথাটা হেলিয়ে আগের মতোই চোখ বন্ধ করে বসে রইল। পিয়ের তার দিকেই তাকিয়ে রইল। বুড়ো লোকটি চোখ মেলল, স্থির, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পিয়েরের মুখের দিকে তাকাল।
পিয়ের বিচলিত বোধ করল, সে-দৃষ্টিতে এড়িয়ে যেতে চাইল, কিন্তু সে দুটি উজ্জ্বল প্রবীণ চোখের দৃষ্টির আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য।
.
অধ্যায়-২
আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তো আমি নিশ্চয় কাউন্ট বেজুখভের সঙ্গেই কথা বলছি, আগন্তুক ইচ্ছা করেই উঁচু গলায় বলল।
পিয়ের নিঃশব্দে চশমার উপর দিয়ে তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।
আগন্তুক আবার বলল, আপনার কথা, আপনার দুর্ভাগ্যের কথা আমি শুনেছি স্যার। লোকটি শেষের কথাটার উপরেই জোর দিল।
পিয়েরের মুখ লাল হয়ে উঠল, তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে পা নামিয়ে জোর করে ঈষৎ হেসে বুড়োটির দিকে ঝুঁকে বসল।
নেহাৎ কৌতূহলবশেই আমি এ-কথা বলছি না স্যার, বলার গুরুতর কারণ আছে।
লোকটি থামল, তার দৃষ্টি তখনো পিয়েরের উপর নিবদ্ধ, যেন তাকে নিজের পাশে বসবার ইঙ্গিত দিতেই লোকটি সোফার এক পাশে সরে বসল। বুড়ো মানুষটির সঙ্গে আলাপ জমাবার ইচ্ছা পিয়েরের ছিল না, তবু অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার ইচ্ছামতোই উঠে গিয়ে তার পাশে বসল।
আগন্তুক বলতে লাগল, আপনি বড়ই দুঃখী স্যার। আপনি যুবক আর আমি বৃদ্ধ। সাধ্যমতো আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই।
জোর করে হেসে পিয়ের বলল, তা বেশ তো! আপনার কাছে আমি খুবই কৃতজ্ঞ। কোথা থেকে আসছেন?
আগন্তুকের মুখটা সদয় নয়, বরং নিস্পৃহ ও কঠোর, কিন্তু তা সত্ত্বেও নবপরিচিত লোকটির মুখ ও কথা পিয়েরকে দুর্বার শক্তিতে আকর্ষণ করল।
বুড়ো বলল, কিন্তু যে কোন কারণেই হোক আমার সঙ্গে আলাপ করতে যদি আপনার আপত্তি থাকে তো বলুন। সহসা তার মুখে একটা অপ্রত্যাশিত পিতৃসুলভ হাসি ফুটে উঠল।
না, না, মোটেই তা নয়! বরং আপনার সঙ্গে পরিচয় ঘটায় আমি খুব খুশি হয়েছি। পিয়ের আর একবার লোকটির আঙুলের মাথার খুলি খোদাই করা আংটিটার দিকে তাকাল-খোদাইটা ভ্রাতৃসংঘের প্রতীক।
সে বলল, মাফ করবেন, আপনি কি একজন সংঘ-সদস্য?
হ্যাঁ, স্বাধীন ভ্রাতৃসংঘের আমি একজন, পিয়েরের চোখের আরো গভীরে দৃষ্টিপাত করে আগন্তুক বলল। আর তাদের হয়ে, আমার নিজের হয়ে এই ভ্রাতৃত্বের হাত আপনার দিকে বাড়িয়ে ধরলাম।
এই লোকটির ব্যক্তিত্ব তাকে অনুপ্রাণিত করেছে, আবার ভ্রাতৃসংঘের ধ্যান-ধারণাগুলিকে উপহাস করতেই সে অভ্যস্ত, এই দুই মনোভাবের মধ্যে দোদুল্যমান অবস্থায় পিয়ের হেসে বলল, আমার ভয় হচ্ছে আপনাদের আমি ঠিক বুঝতে-কীভাবে যে কথাটা বলব–আমার ভয় হচ্ছে, জগতের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গির এতই বিপরীত যে আমরা পরস্পরকে বুঝতেই পারব না।
লোকটি বলল, আপনার দৃষ্টিভঙ্গির কথা আমি জানি, আর যে জীবনযাত্রার কথা আপনি বলছেন, যাকে আপনার মানসিক প্রচেষ্টার ফল বলে আপনি মনে করেন, অধিকাংশ মানুষ সেই জীবন-পথেরই পথিক, আর সেটা অহংকার, আলস্য ও অজ্ঞতারই অনিবার্য ফল। আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার, তবে এ-কথা নিজে না জানলে কখনো আপনাকে বলতাম না। জীবন সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিকোণ একটি শোচনীয় ভ্রান্তি মাত্র।
মৃদু হেসে পিয়ের বলল, ঠিক যেরকম আমি মনে করি যে আপনি ভ্রান্ত।
আমি সত্যকে জেনেছি এ-কথা বলার স্পর্ধা আমার নেই, লোকটি বলল, তার কথার দৃঢ়তা ক্রমেই পিয়েরের মনের উপর বেশি করে দাগ কাটতে শুরু করেছে। নিজের চেষ্টায় কেউই সত্যে পৌঁছতে পারে না। আদি পুরুষ আদমের কাল থেকে শুরু করে আমাদের এই কাল পর্যন্ত যুগ যুগ ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমবেত প্রচেষ্টায় একটার পর একটা পাথর বসিয়ে তবে তৈরি হয় সেই মন্দির যেখানে পাতা হবে মহান ঈশ্বরের যোগ্য পাদপীঠ, দুই চোখ বুজে লোকটি বলল।
সত্য কথাটা বলা উচিত মনে করেই যেন দুঃখের সঙ্গে পিয়ের বলল, আমি বলতে চাই যে ঈশ্বরে আমার বিশ্বাস নেই…আমি…।
লোকটি পিয়েরের দিকে তাকিয়ে করুণার হাসি হাসল, বলল, ঠিক কথা, আপনি তাকে জানেন না স্যার। তাঁকে জানতে আপনি পারেন না। আর তাঁকে জানেন না বলেই আপনি দুঃখী।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি দুঃখী, পিয়ের কথাটা মেনে নিল। কিন্তু আমি কি করব?
আপনি তাকে জানেন না স্যার, আর তাই আপনি এত দুঃখী। আপনি তাকে চেনেন না, কিন্তু তিনি এখানেই আছেন, আছেন আমার মধ্যে, আছেন আমার কথায়, আছেন আপনার মধ্যে, এমন কি এইমাত্র যে পাপ কথাগুলি আপনি উচ্চারণ করলেন তার মধ্যেও তিনি আছেন! কঠিন কম্পিত কণ্ঠে লোকটি ঘোষণা করল।
লোকটি থামল, নিজেকে শান্ত করবার জন্যই একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।
তারপর শান্তভাবে বলতে লাগল, দেখুন স্যার, তিনি যদি না থাকতেন তাহলে তো আপনি-আমি তার কথা বলতাম না। কি কথা, কার কথা আমরা বলছি? কাকে আপনি অস্বীকার করছেন। তিনি যদি নাই থাকবেন, তো কে তাকে আবিষ্কার করল? বুদ্ধির অতীত এরকম একটি সত্তার অস্তিত্বের কল্পনা এল কোথা থেকে? এরকম একটি বুদ্ধির অগোচর সত্তা, যিনি সর্বশক্তিমান, শাশ্বত, অসীম গুণের অধিকারী, তার অস্তিত্বের কল্পনা আপনি কেন করেছেন–কেন করেছে সারা জগৎ…
লোকটি থামল, অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
পিয়ের সে নীরবতা ভাঙতে পারল না, ভাঙতে চাইল না।
পিয়েরের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে উত্তেজনাবশে কম্পিত হাতে বইটার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে লোকটি আবার বলতে লাগল, তিনি আছেন, কিন্তু তাঁকে জানা বড় শক্ত।…আমি তো তুচ্ছ মানুষ, তাঁর সর্বশক্তিমত্তা, তার অসীমতা, অন্ধজীবের প্রতি তাঁর করুণা–এসব আমি কেমন করে দেখাব? সে আবার থামল। আপনিই বা কে? আপনি স্বপ্ন দেখছেন যে আপনি খুব জ্ঞানী, কারণ ঐ পাপ কথাগুলি আপনি উচ্চারণ করতে পারছেন। কিন্তু যে ছোট ছেলেটি সুকৌশলে তৈরি একটা ঘড়ি নিয়ে খেলা করতে করতে বলতে পারে যে যেহেতু ঘড়িটার ব্যবহার সে জানে না তাই যে ঐ ঘড়িটা তৈরি করেছে তাকে সে বিশ্বাস করে না, আপনিও তারই মতো নির্বোধ ও যুক্তিহীন। তাঁকে জানা বড় শক্ত…আদি পিতা আদম থেকে আজকের দিন পর্যন্ত যুগের পর যুগ আমরা সে জ্ঞানলাভে প্রয়াসী হয়েছি, কিন্তু আজও পড়ে আছি আমাদের লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে।…এই বুঝতে না পারার মধ্যেই তো দেখতে পাচ্ছি আমাদের দুর্বলতা আর তার বিরাটত্ব…
পিয়ের উদ্বেলিত হৃদয়ে সব শুনল, লোকটির কথায় বাধা দিল না, তাকে কোনো প্রশ্ন করল না, সমস্ত অন্তর দিয়ে তার কথাগুলিকে বিশ্বাস করল। তার কথার জ্ঞানগর্ভ যুক্তিকেই মানুষ বিশ্বাস করুক, আর শিশুর মতো বক্তার কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তা ও আন্তরিকতাকেই বিশ্বাস করুক-একটা কথা ঠিক যে সমস্ত অন্তর দিয়ে পিয়ের তার কথা বিশ্বাস করতে চাইল, বিশ্বাস করল, এবং সান্ত্বনা, উজ্জীবন ও জীবনে প্রত্যাবর্তনের একটা সানন্দ অনুভূতিতে তার মন ভরে উঠল।
লোকটি আবার বলল, তাকে বুদ্ধি দিয়ে জানা যায় না, জানতে হয় জীবন দিয়ে।
মনের মধ্যে নতুন করে সন্দেহ দেখা দেওয়ায় বিষণ্ণ গলায় পিয়ের বলল, আমি বুঝতে পারছি না, যে জ্ঞানের কথা আপনি বলছেন, মানুষের মন কেন তাকে লাভ করতে পারবে না?
পিতৃসুলভ মৃদু সস্নেহ হাসি ফুটল লোকটির মুখে।
বলল, পরমপ্রজ্ঞা ও সত্য হল বিশুদ্ধ তরল পদার্থের মতো। একটা অবিশুদ্ধ পাত্রে বিশুদ্ধ তরল ঢেলে কি তার বিশুদ্ধতা বিচার করা যায়? একমাত্র নিজের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করতে পারলে তবেই আমার মধ্যে সেই তরলের বিশুদ্ধতাকে অন্তত কিছুটা রক্ষা করতে পারব।
পিয়ের সানন্দে বলে উঠল, হা, হ্যাঁ, ঠিক তাই।
পরমপ্রজ্ঞা কেবলমাত্র বুদ্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, পদার্থবিদ্যা, ইতিহাস, রসায়ন প্রভৃতি সব জাগতিক বিজ্ঞানের উপরেও প্রতিষ্ঠিত নয়। পরমপ্রজ্ঞা এক। তার একটিমাত্র বিজ্ঞান-ভূমার বিজ্ঞানযে বিজ্ঞান গোটা সৃষ্টি ও সেখানে মানুষের স্থান নির্ণয় করে। সে বিজ্ঞানকে জানতে হলে আগে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করতে হবে, তার উজ্জীবন ঘটাতে হবে, সে জ্ঞান অর্জন করতে হলে প্রয়োজন বিশ্বাস ও আত্মশুদ্ধি। আর সে লক্ষ্যে পোঁছতে হলে প্রয়োজন সেই আলোকশিখার যাকে বিবেক বলে, যাকে ঈশ্বর আমাদের অন্তরে বপন করেছেন।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, পিয়ের স্বীকার করল।
তাহলে মনের চোখ দিয়ে নিজের অন্তরাত্মাকে দেখুন, নিজেকেই প্রশ্ন করুন, আপনি নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট কি না। কেবলমাত্র বুদ্ধির উপর ভরসা করে কি পেয়েছেন? আপনি কি? আপনি যুবক, আপনি ধনী, আপনি কুশলী, আপনি সুশিক্ষিত। এইসব সগুণ নিয়ে আপনি কি করেছেন? নিজেকে নিয়ে, নিজের জীবনকে নিয়ে কি আপনি সন্তুষ্ট?
মুখ বেঁকিয়ে পিয়ের তো-তো করে বলল, না, জীবনকে আমি ঘৃণা করি।
আপনি জীবনকে ঘৃণা করেন। তাহলে এ জীবনকে বদলে দিন, নিজেকে পরিশুদ্ধ করে তুলুন, আর পরিশুদ্ধ হলেই প্রজ্ঞা লাভ করতে পারবেন। নিজের জীবনের দিকে তাকান স্যার। কীভাবে জীবন কাটিয়েছেন? উচ্ছখল মদ্যপানে ও ব্যভিচারে, সমাজের কাছ থেকে নিয়েছেন সবকিছু, কিন্তু তাকে ফিরিয়ে দেননি কিছুই। সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। তাকে কীভাবে ব্যবহার করেছেন? আপনার প্রতিবেশীর জন্য কি করেছেন? আপনার হাজার হাজার ক্রীতদাসের কথা কখনো ভেবেছেন? শারীরিক কি নৈতিক কোনোদিক থেকে তাদের সাহায্য করেছেন? না! তাদের পরিশ্রমের ফসলকে ভোগ করে যাপন করেছেন উচ্ছল জীবন। তাই তো করেছেন। এমন কোনো কাজে কি কখনো আত্মনিয়োগ করেছেন যেখান থেকে আপনার প্রতিবেশীর উপকার করতে পারেন? না! জীবন অতিবাহিত করেছেন চরম আলস্যে। তারপর আপনি বিয়ে করেছেন স্যার-একটি তরুণীকে চালিয়ে নেবার দায়িত্ব নিয়েছেন, কিন্তু কি করেছেন? সত্যের পথ খুঁজে নিতে তাকে সাহায্য করেননি, ঠেলে দিয়েছেন প্রতারণা ও দুঃখের অতলস্পর্শ গহ্বরে। কোনো লোক আপনাকে আঘাত করলেই আপনি তাকে গুলি করেছেন, আর এখন বলছেন আপনি ঈশ্বরকে জানেন না, নিজের জীবনকে ঘৃণা করেন। এর মধ্যে তো অবাক হবার কিছু নেই স্যার!
দীর্ঘ বাক্যালাপে ক্লান্ত হয়ে লোকটি পুনরায় সোফার পিছনে মাথা রেখে চোখ বুজল। পিয়ের সেই প্রবীণ, কঠোর, নিশ্চল, মৃতবৎ মুখখানির দিকে তাকিয়ে ঠোঁট দুটি নাড়ল, কিন্তু কোনো শব্দ উচ্চারিত হল না। সে বলতে চেয়েছিল, হ্যাঁ, একটি নিচ, আলস্যপরায়ণ পাপের জীবন! কিন্তু সে নীরবতা ভাঙবার সাহস তার হল না।
বুড়োদের মতো গলা খাকারি দিয়ে লোকটি চাকরকে ডাকল।
পিয়েরের দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল, ঘোড়ার কি হল?
চাকর জবাব দিল, বদলি ঘোড়া এইমাত্র এসে গেছে। আপনি কি এখানে বিশ্রাম করবেন না?
না, ওদের ঘোড়া যুততে বলুন।
আমাকে সব কথা না বলে এবং সাহায্যের প্রতিশ্রুতি না দিয়েই কি আমাকে একলা ফেলে উনি সত্যি সত্যি চলে যাবেন? দাঁড়িয়ে মাথাটা নিচু করে পিয়ের ভাবল, মাঝে মাঝে লোকটির দিকে তাকিয়ে সে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। হ্যাঁ, এ-কথা কখনো ভাবিনি, ঘৃণ্য উচ্ছখল জীবনই আমি যাপন করেছি, যদিও সে জীবন আমার পছন্দ ছিল না, সেভাবে জীবন কাটাতে আমি চাইনি। কিন্তু এই মানুষটি সত্যকে জানে আর ইচ্ছা করলে তা আমার কাছে প্রকাশ করতে পারত।
পিয়ের এই কথাটা লোকটিকে বলতে চাইল, কিন্তু সাহসে কুলোল না। অভ্যস্ত হাতে যাত্রীটি তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে কোটের বোতাম আঁটতে লাগল। সে-কাজ শেষ করে বেজুখভের দিকে ফিরে নিস্পৃহ ভদ্রতার সুরে বলল :
আপনি এখন কোথায় চলেছেন স্যার?
শিশুর মতো দ্বিধাগ্রস্ত গলায় পিয়ের জবাব দিল, আমি?…আমি পিটার্সবুর্গ যাচ্ছি। আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার সব কথার সঙ্গে আমি একমত। কিন্তু আমাকে অতটা খারাপ ভাববেন না। আপনি আমাকে যা হতে বললেন, মনে-প্রাণে তাই আমি হতে চাই, কিন্তু কখনো কারো কাছ থেকে কোনো সহায়তা আমি পাইনি।…কিন্তু সবকিছুর জন্য আমিই দোষী। আমাকে সাহায্য করুন, শিখিয়ে পড়িয়ে নিন, তাহলে হয় তো আমি…
পিয়ের আর বলতে পারল না। ঢোক গিলে ঘুরে দাঁড়াল।
লোকটি অনেকক্ষণ চুপ করে রইল, কী যেন ভাবতে লাগল।
তারপর বলল, সাহায্য করতে পারেন একমাত্র ঈশ্বর, তবে আমাদের সংঘ থেকে যতটা সাহায্য করা সম্ভব তা আপনি পাবেন স্যার। আপনি তো পিটার্সবুর্গ যাচ্ছেন। এটা কাউন্ট উইলার্স্কির হাতে দেবেন। (নোটবইটা বের করে চার-ভাঁজ করা একখানা লম্বা কাগজে কয়েকটা কথা সে লিখল।) যদি কিছু মনে না করেন তো একটা পরামর্শ দিই। রাজধানীতে পৌঁছে প্রথমেই নির্জনে আত্মসমীক্ষায় কিছুটা সময় কাটাবেন, আর আগেকার মতো জীবনযাত্রায় ফিরে যাবেন না। আপনার যাত্রা শুভ হোক…সফল হোক।
ঘাঁটিদারের খাতা থেকে পিয়ের জানতে পারল যে এই লোকটি হচ্ছে জোসেফ আলেক্সিভিচ বাজদিভ, ভ্রাতৃসংঘের একজন বিখ্যাত সদস্য ও সুপরিচিত মার্কিনপন্থী। সে চলে যাবার পরে অনেকক্ষণ পর্যন্ত পিয়ের শুতে গেল না বা ঘোড়ার জন্যও তাগাদা দিল না, ঘরময় পায়চারী করতে করতে অতীত জীবনের কথা ভাবতে লাগল, এবং অতি সহজলভ্য একটি আনন্দময় অনিন্দনীয় পুণ্যময় জীবনের পথে নতুন করে পা ফেলার সম্ভাবিত আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠল। তার মনে হল, ধার্মিক হওয়া যে কত ভালো সেটা ভুলে গিয়েছিল বলেই এতদিন সে পাপের পথে ঘুরে মরেছে। আগেকার সন্দেহের তিলমাত্র চিহ্ন আর তার অন্তরে রইল না। তার মনে এই দৃঢ় বিশ্বাস দেখা দিল যে ধর্মের পথে পরস্পরকে সাহায্য করবার লক্ষ্যে মানব ভ্রাতৃসংঘের প্রতিষ্ঠা খুবই সম্ভব, ভ্রাতৃসংঘের এই ছবিই তার মনে আঁকা পড়েছে।
.
অধ্যায়-৩
পিটার্সবুর্গে পৌঁছে পিয়ের কাউকে তার আসার কথা জানাল না, কোথাও গেল না, কোনো অজ্ঞাত লোক কর্তৃক পাঠানো টমাস ও কেম্পিসের একখানা বই পড়ে দিনগুলো কাটাতে লাগল। বইটা পড়তে পড়তে একটি সত্য সে ক্রমেই বেশি করে উপলব্ধি করতে লাগল : পরিপূর্ণতা অর্জনের সম্ভাবনা এবং মানুষে মানুষে সক্রিয় ভ্রাতৃপ্রেমের সম্ভাবনার যে সত্য জোসেফ আলেক্সিভিচ তার কাছে প্রকাশ করেছিল তাতে বিশ্বাস করার এক অজ্ঞাতপূর্ব আনন্দের উপলব্ধি। আসার একসপ্তাহ পরে একদিন সন্ধ্যায় পিটার্সবুর্গ সমাজে পিয়েরের স্বল্পপরিচিত উইলার্স্কি নামক জনৈক তরুণ পোলিশ কাউন্ট মহাসমারোহ সহকারে তার ঘরে এল এবং দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যখন বুঝল যে ঘরে আর কেউ নেই তখন পিয়েরকে উদ্দেশ করে বলল, আমি আপনার কাছে এসেছি একটি বাণী ও একটি প্রস্তাব নিয়ে। আমাদের ভ্রাতৃসংঘের খুবই উচ্চপদস্থ কোনো লোক আপনার পক্ষ হয়ে একখানি দরখাস্ত করেছেন যাতে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই আপনাকে আমাদের সংঘে ভর্তি করে নেয়া হয় এবং আমাকেই আপনার হয়ে উদ্যোগ নেয়ার প্রস্তাবও করেছেন। সেই লোকটির ইচ্ছা পূরণ করাটাকে আমি আমার পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করি। আপনি কি আমার উদ্যোগে ভ্রাতৃসংঘে প্রবেশ করতে ইচ্ছুক?
পিয়ের ইতিপূর্বে এই লোকটিকে সব বলনাচের আসরেই দেখেছে সুন্দরী মেয়েদের মহলে হাসিমুখে ঘুরে বেড়াতে, তাই লোকটির নিস্পৃহ গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে সে অবাক হয়ে গেল।
বলল, হ্যাঁ, আমি ইচ্ছুক।
উইলাঙ্কি মাথা নোয়াল।
বলল, আর একটি প্রশ্ন আছে কাউন্ট, আমার মিনতি, সংঘের ভাবী সদস্যরূপে নয়, একজন সৎ মানুষ হিসেবে আন্তরিকভাবেই সে প্রশ্নের জবাব দিন : আপনার আগেকার প্রত্যয়কে কি আপনি পরিত্যাগ করেছেন-আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?
পিয়ের ভাবল।
হ্যাঁ… হ্যাঁ, আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি, সে বলল।
সেক্ষেত্রে..উইলার্স্কি শুরু করতেই পিয়ের তাকে বাধা দিয়ে পুনরায় বলল, হ্যাঁ, আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি।
উইলার্স্কি বলল, সেক্ষেত্রে আমরা যেতে পারি। আমার গাড়িটা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।
উইলার্স্কি চুপচাপ গাড়িতে বসে রইল। তাকে কী করতে হবে, কী বলতে হবে–পিয়েরের এই সব প্রশ্নের জবাবে সে শুধু বলল, তার থেকেও যোগ্যতর দাদারা তাকে পরীক্ষা করবে, আর পিয়েরের একমাত্র কাজ হবে সত্য কথা বলা।
একটা বড় বাড়িতে ভ্রাতৃসংঘের কার্যালয়। সে বাড়ির উঠোনে ঢুকে একটা অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে উঠে তারা একটা আলোকিত ছোট ঘরে প্রবেশ করে চাকরের সাহায্য ছাড়াই নিজেদের জোব্বাগুলো ছেড়ে ফেলল। সেখান থেকে তারা আর একটা ঘরে গেল। দ্বারপথে দেখা দিল বিচিত্র পোশাকে সজ্জিত একটি লোক। উইলার্স্কি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে ফরাসি ভাষায় কি যেন বলল, তারপর একটা ছোট সাজঘরে গেল, সেখানে পিয়ের এমন সব পোশাক দেখতে পেল যা সে আগে কখনো দেখেনি। কাবার্ড থেকে একটা রুমাল তুলে নিয়ে উইলাকিঁ পিয়েরের চোখ দুটো বেঁধে দিয়ে এমনভাবে কিছু চুলসুদ্ধ তাতে গিট দিল যে পিয়েরের বেশ কষ্ট হল। তারপর তার মুখটাকে টেনে নামিয়ে চুমো খেয়ে তার হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে চলল। চুলসুদ্ধ গিট দেয়ায় পিয়েরের বেশ কষ্ট হচ্ছে, তার মুখে ফুটে উঠেছে যন্ত্রণা ও সলাজ হাসির রেখা। অনিশ্চিত ভীরু পদক্ষেপে সে উইলার্স্কির পিছনে এগিয়ে চলল।
প্রায় দশ পা এগিয়ে লোকটি থামল।
বলল, আমাদের সংঘে যোগদান করতে আপনি যদি কৃতসংকল্প হয়ে থাকেন, তাহলে, যা কিছু ঘটুক সাহসের সঙ্গে তাকে সহ্য করবেন। (পিয়ের মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।) দরজায় একটা শব্দ শুনলেই চোখের বাঁধন খুলে ফেলবেন। আপনার সাহস ও সাফল্য কামনা করি পিয়েরের হাতে একটু চাপ দিয়ে লোকটি চলে গেল।
পিয়ের একা একা একইভাবে হাসতে লাগল। দুই একবার কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে চোখের বাঁধন খুলে ফেলার জন্য হাতও তুলল, কিন্তু আবার হাত নামিয়ে নিল। চোখ বাঁধা অবস্থায় পাঁচ মিনিট কাটাতই তার কাছে একঘণ্টা বলে মনে হল। হাত দুটো অসার হয়ে এল, পা দুটো ভেঙে পড়তে চাইছে, মনে হল সে বড়ই ক্লান্ত, অবসন্ন। নানা রকমের জটিল চিন্তা মনের মধ্যে পাক খেতে লাগল। মনে ভয়, না জানি কি হবে, তারও চেয়ে ভয় পাচ্ছে সে-ভয় ধরা পড়ে যায়। দরজায় জোর শব্দ শোনা গেল। চোখের বাঁধন খুলে পিয়ের চারদিক তাকাল। কালো আঁধারে ঘরটা ঢাকা, একটা শাদা কিছুর মধ্যে শুধু একটা ছোট বাতি জ্বলছে। কাছে গিয়ে পিয়ের দেখতে পেল, কালো টেবিলের উপর বাতিটা জ্বলছে, আর তার পাশে রয়েছে একখানা খোলা বই বইটা যিশুর উপদেশাবলি, আর যে শাদা জিনিসটার মধ্যে বাতিটা জ্বলছে সেটা একটা মানব করোটি আদিতে ছিল শব্দ, আর সে শব্দ ছিল ঈশ্বরের উপদেশাবলীর এই প্রথম কথা কটি পড়েই পিয়ের টেবিলের ওপাশে ঘুরে গিয়ে দেখল একটা বড়ো ভোলা বাক্সের মধ্যে কী যেন রয়েছে। সেটা একটা হাড়ভর্তি শবাধার। এসব দেখে সে মোটেই বিস্মিত হল না। পূর্ব জীবন থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটা নতুন জীবনে প্রবেশের প্রত্যাশায় সে ধরেই নিয়েছে যে সবকিছুই অস্বাভাবিক হবে, এমনকি যা-কিছু সে দেখছে তার চাইতেও বেশি অস্বাভাবিক। একটা করোটি, একটা শবাধার, একখানি উপদেশাবলি-তার মনে হল এসব কিছুই, এমনকি এর চাইতে বেশি কিছুই সে আশা করেছিল। মনের আবেগকে প্রখরতর করে তুলতে সে চারদিকে তাকাল। ঈশ্বর, মৃত্যু, প্রেম, মানব-ভ্রাতৃসংঘ-এই কথাগুলিকে অস্পষ্ট অথচ আনন্দময় ধারণার সঙ্গে যুক্ত করে সে মনে মনে সেগুলি আওড়াতে লাগল। দরজা খুলে গেল, কে যেন ঘরে ঢুকল।
ঘরের আবছা আলোয় একটি ছোটখাট লোককে দেখতে পেল। আলো থেকে অন্ধকারে আসার দরুন লোকটি থামল, সতর্ক পদক্ষেপে টেবিলটার কাছে গেল, তারপর চামড়ার দস্তানা পরা হোট হাত দুটি টেবিলের উপর রাখল।
শাদা চামড়ার এনে লোকটির বুক ও পায়ের কিছুটা অংশ ঢাকা পড়েছে, গলায় নেকলেসের মতো একটা জিনিস থেকে শাদা আলো বিচ্ছুরিত হওয়ায় তার লম্বাটে মুখখানা আলোকিত হয়ে উঠেছে।
পিয়েরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নবাগত জিজ্ঞেস করল, কেন এখানে এসেছ? তুমি তো আলোর সত্যে বিশ্বাস কর না, তুমি তো আলো দেখনি, তাহলে এখানে এসেছ কেন? আমাদের কাছে তুমি কী চাও? প্রজ্ঞা, সগুণ, আলো?
যে মুহূর্তে দরজা খুলে অপরিচিত লোকটি ঘরে ঢুকেছে তখন থেকেই তার প্রতি একটা ভয় ও সম্ভ্রম জেগেছে পিয়েরের মনে, তার মনে হয়েছে, সামাজিক দৃষ্টিতে লোকটি তার সম্পূর্ণ অপরিচিত, কিন্তু মানবভ্রাতৃত্ব বোধের দিক থেকে সে তার কাছের মানুষ। রুদ্ধশ্বাসে দুরু দুরু বুকে রেটরের (কোনো নবাগতকে, সংঘে অভিষেককারীকে ওই নামেই ডাকা হয়) দিকে এগিয়ে গেল। কাছে গিয়েই সে চিনতে পারল রেটর তার পূর্বপরিচিত-নাম স্মোলিয়ানিনভ। এতে সে দুঃখিত হল, কারণ সে তাকে চেয়েছিল শুধুই দাদা ও ধর্মগুরুরূপে, একজন পরিচিত মানুষরূপে নয়। অনেকক্ষণ সে কোনো কথাই বলতে পারল না, ফলে রেটর আবার সেই একই প্রশ্ন করল।
অনেক কষ্টে পিয়ের জবাব দিল, হ্যাঁ…আমি… আমি চাই নবজন্ম।
স্মোলিয়ানিনভ সঙ্গে সঙ্গে বলল, ঠিক আছে। আমাদের পবিত্র সংঘ কীভাবে তোমার মনোবাসনা পূর্ণ করতে পারে সে-বিষয়ে তোমার কোনো ধারণা আছে কি?
পিয়ের কাঁপা গলায় বেশ কষ্ট করে বলল, আমি…চাই… পথের নির্দেশ… সাহায্য… নবজন্ম।
আমাদের ভ্রাতৃসংঘ সম্পর্কে তোমার কী ধারণা?
আমার ধারণা ভ্রাতৃসংঘ ধর্মপথযাত্রী মানুষের ভ্রাতৃত্ব ও সমানাধিকারের সংঘ। পিয়ের জবাব দিল, এই মুহূর্তে তার কতায় যে গাম্ভীর্য থাকা উচিত ছিল তার অভাবের জন্য সে লজ্জা পেল। আমার ধারণা…
রেটর কিন্তু তার জবাবে সন্তুষ্ট হয়ে তাড়াতাড়ি বলে উটল, ভালো! তুমি কি ধর্মের মধ্যে তোমার অভিষ্ট লাভের পথ কখনো খুঁজেছ?
না, সে পথকে ভুল মনে করেই সে পথে যাইনি, পিয়ের বলল, এত আস্তে সে কথাগুলি বলল যে রেটর শুনতেই পেল না। তার প্রশ্নের উত্তরে পিয়ের বলল, আমি নাস্তিক ছিলাম।
একমুহূর্ত থেমে রেটর বলল, জীবনের সত্যের বিধানকে মেনে চলতে চাও বলেই তুমি সত্যের সন্ধান করছ, আর তাই প্রজ্ঞা ও সগুণের সন্ধান করছ। তাই নয় কি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ পিয়ের সম্মতি জানাল।
গলাটা পরিষ্কার করে দস্তানাপরা হাত দুটি বুকের উপর আড়াআড়িভাবে রেখে রেটর কথা বলতে শুরু করল।
আমাদের সংঘের প্রধান আদর্শের কথা এবার তোমাকে বলব, যদি সে আদর্শ তোমার আদর্শের সঙ্গে মেলে তবেই আমাদের ভ্রাতৃসংঘে প্রবেশ করে তুমি লাভবান হবে। আমাদের সংঘের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য-যে ভিত্তির উপর এই সংঘ প্রতিষ্ঠিত এবং কোনো মানুষের শক্তি যাকে কোনোদিন ধ্বংস করতে পারবে না–হল একটি নির্দিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ রহস্যকে রক্ষা করা ও অনাগত প্রজন্মের হাতে তাকে তুলে দেওয়া… সে রহস্য আমাদের কাছে এসেছে বহুদূর অতীত যুগ হতে হয় তো গোটা মানবজাতির ভাগ্যই নির্ভর করছে সেই রহস্যের উপর। কিন্তু যেহেতু সেই রহস্যের স্বরূপটিই এমন যে পরিশ্রমসাধ্য দীর্ঘ আত্মশুদ্ধির পথে নিজেকে প্রস্তুত করে তুলতে না পারলে কোনো মানুষের পক্ষেই তাকে জানা বা ব্যবহার করা সম্ভব নয়, তাই সকলেই তাকে দ্রুত আয়ত্তে আনার আশা করতে পারে না। তাই আমাদের গৌণ উদ্দেশ্য হচ্ছে যতদূর সম্ভব আমাদের সদস্যদের অন্তরে সংস্কার করা, তাদের মনকে শুদ্ধ ও আলোকিত করে তোলা এবং তাদের সেই রহস্যকে গ্রহণ করার উপযুক্ত করে গড়ে তোলা।
তৃতীয়ত, আমাদের সদস্যদের পরিশুদ্ধ করে, নবজীবনের দীক্ষা দিয়ে আমরা চেষ্টা তাদের ভিতর দিয়ে ঈশ্বর ভক্তি ও সগুণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সমগ্র মানব জাতিকে উন্নত করতে, যে অশুভ শক্তি আজ পৃথিবীকে শাসন করছে, সর্বশক্তি নিয়োগ করে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে। এই কথাগুলি ভালো করে ভেবে দেখ, আমি আবার আসব।
যে অশুভ শক্তি আজ পৃথিবীকে শাসন করছে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে… পিয়ের মনে মনে বলল, আর সঙ্গে সঙ্গে এই পথে তার ভবিষ্যৎ কর্মধারার একটা ছবি তার মনের পটে ভেসে উঠল। রেটর যে তিনটি লক্ষের কথা বলল তার মধ্যে শেষেরটি, মানবজাতির উন্নতি সাধনই তার মনকে বিশেষ করে নাড়া দিল।
আধ ঘণ্টা পরে ফিরে এসে রেটর তাকে সলোমনের মন্দিরের সাতটি সিঁড়ির অনুরূপ সাতটি সৎগুণের কথা শুনিয়ে বলল, ভ্রাতৃসংঘের প্রতিটি মানুষকেই নিজের অন্তরে এই সপ্ত সৎগুণের অনুশীলন করতে হবে। সপ্ত সগুণ হল : ১। বিচক্ষণতা, সংঘের মন্ত্রগুপ্তি। ২। সংঘের ঊর্ধ্বতন সদস্যদের প্রতি আনুগত্য। ৩। নৈতিকতা ৪। মানবপ্রেম। ৫। সাহস। ৬। উদারতা। ৭। মৃত্যুপ্রীতি।
রেটর বলল, সপ্তমত, অবিরাম মৃত্যুচিন্তার দ্বারা মনকে এমনভাবে প্রস্তুত করবে, চেষ্টা করবে যাতে মৃত্যুকে ভয়ংকর শত্রুরূপে না দেখে তাকে এমন বন্ধুরূপে দেখবে যে এই দুঃখময় পৃথিবীতে ধর্মের পথ পর্যটনে ক্লান্ত আত্মাকে মুক্ত করে তাকে উপযুক্ত পুরস্কার ও শান্তির পথে পরিচালিত করবে।
কথা শেষ করে পিয়েরকে নির্জনে আত্মসমীক্ষার সুযোগ দিয়ে রেটর ঘর থেকে চলে গেলে পিয়ের ভাবল, হ্যাঁ, তাই করতে হবে। কিন্তু আমি এখনো এতই দুর্বল যে, যে-জীবনের অর্থ একটু একটু করে আমার সম্মুখে উঘাটিত হচ্ছে তাকেই আমি ভালোবাসি।
তৃতীয়বার রেটর আরো তাড়াতাড়ি ফিরল এবং জানতে চাইল পিয়ের এখনো সংকল্পে স্থির আছে কি না।
পিয়ের বলল, আমি সবকিছুর জন্য প্রস্তুত।
রেটর বলল, তোমাকে আগেই জানিয়ে রাখি, আমাদের সংঘ কেবলমাত্র কথার মাধ্যমে তার বাণীকে প্রচার করে না, এমন আরো অনেক পন্থার আশ্রয় নেয় ধর্মপিপাসুর মনের উপর যার প্রভাব আরো অনেক বেশি হয়। আরো গুহ্য দীক্ষার পরে তুমি নিজেই উজ্জীবনের সে সব পথের সঙ্গে পরিচিত হবে। যে সব প্রাচীন সমিতি মূর্তিলিপির মূর্তিলিপি এমন কিছুর প্রতীক যাকে ইন্দ্রিয় দিয়ে জানা যায় না, অথচ তা মূর্তির অনুরূপ গুণাবলীর অধিকারী।
মূর্তিলিপির অর্থ পিয়ের খুব ভালো করেই জানে, কিন্তু সেকথা বলবার সাহস তার হল না। সে নীরবে রেটরের কথাগুলি শুনল, মনে মনে বুঝল, তার অগ্নিপরীক্ষার লগ্ন সমাগত।
পিয়েরের আরো কাছে এসে রেটর বলল, তুমি যদি কৃতসংকল্প হও তত তোমার দীক্ষার কাজ শুরু করব। উদারতার চিহ্নস্বরূপ তোমাকে বলছি, তোমার যা কিছু মূল্যবান সামগ্রী সব আমাকে দাও।
পিয়ের উত্তর দিল, কিন্তু এখানে তো কিছুই নেই।
যা তোমার সঙ্গে আছে : ঘড়ি, টাকা, আংটি…
সঙ্গে সঙ্গে পিয়ের তার টাকার থলি ও ঘড়ি বের করে দিল, কিন্তু মোটা আঙুল থেকে বিয়ের আংটিটা খুলতে কিছুটা সময় লাগল। সেটা হয়ে গেলে রেটর বলল :
আনুগত্যের চিহ্নস্বরূপ বলছি, পোশাক ছেড়ে ফেল।
রেটনের নির্দেশমতো পিয়ের কোট, ওয়েস্টকোট ও বাঁ পায়ের বুট খুলে ফেলল। গুরুভাইটি তখন পিয়েরের বাদিকের বুকের উপর থেকে শার্টটা সরিয়ে ফেলল এবং উপুড় হয়ে তার বাঁ পায়ের ট্রাউজারটাকে হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে ফেলল। লোকটিকে আর কষ্ট না দিয়ে পিয়ের এবার নিজেই ডান পায়ের বুটটা খুলে ট্রাউজারের ডান পাটাকে গুটিয়ে ফেলতে চাইল, কিন্তু লোকটি জানাল যে তার কোনো প্রয়োজন নেই, বলেই সে বাঁ পায়ের জন্য একপাটি চটি এগিয়ে দিল। বিব্রত ও সন্দিহান শিশুর মতো ঈষৎ হেসে পিয়ের হাত দুটি ঝুলিয়ে পা দুটি ফাঁক করে দাঁড়িয়ে গুরুভাইয়ের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
গুরুভাই বলল, সরলতার চিহ্ন-স্বরূপ এবার তোমাকে বলছি, তোমার প্রধান রিপুকে আমার কাছে প্রকাশ কর।
আমার রিপু! সে তো অনেক আছে, পিয়ের উত্তর দিল।
গুরুভাই বলল, সেই রিপু অন্য সকলের চাইতে যে তোমাকে ধর্মের পথে অধিকতর বিভ্রান্ত করেছে।
পিয়ের চুপ করে একটা উত্তর খুঁজতে লাগল।
মদ? ঔদরিকতা? আলস্য? শ্রমবিমুখতা? কোপনস্বভাব? ক্রোধ? নারী? নিজের সবগুলো দোষ সে মনে মনে আউড়ে গেল, কিন্তু কোনটাকে প্রাধান্য দেবে তা বুঝতে পারল না।
প্রায় অশ্রুত নিচু স্বরে বলল, নারী।
গুরুভাই একটুও নড়ল না, অনেকক্ষণ পর্যন্ত কোনো কথাই বলল না। অবশেষে পিয়েরের কাছে গিয়ে টেবিল থেকে রুমালটা তুলে নিয়ে আবার তার চোখ বেঁধে দিল।
শেষবারের মতো তোমাকে বলছি–সমস্ত মনোযোগ নিজের উপর নিবদ্ধ কর, ইন্দ্রিয়সমূহকে সংযত কর, সুখের সন্ধান কর নিজের অন্তরে, রিপুর তৃপ্তিতে নয়…
অনেকক্ষণ আগে থেকেই পিয়ের নিজের মধ্যে একটা আনন্দের উৎসকে খুঁজে পেয়েছিল, এবার সে আনন্দের অনুভূতি তার সারা অন্তরে ছড়িয়ে পড়ল।
.
অধ্যায়-৪
এর কিছু পরেই পিয়েরকে নিয়ে যেতে রেটরের পরিবর্তে সেই অন্ধকার ঘরে ঢুকল তার উদ্যোগকর্তা উইলার্স্কি, গলা শুনেই পিয়ের তাকে চিনতে পারল। তার সংকল্পের দৃঢ়তা সম্পর্কে নতুন করে প্রশ্ন করা হলে পিয়ের জবাব দিল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি রাজি, তারপর শিশুর মতো উজ্জ্বল হাসি হেসে খোলা বুকে, এক পায়ে বুট ও অন্য পায়ে চটি পরে অসমান পদক্ষেপে এগিয়ে চলল, আর উইলাৰ্কি একখানা তরোয়াল ঠেকিয়ে রাখল তার খোলা বুকে। সেই ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে একবার এগিয়ে একবার পিছিয়ে শেষপর্যন্ত তাকে সংঘ-কক্ষের দরজায় হাজির করা হল। উইলার্স্কি কাশল, ভিতর থেকে হাতুড়ির শব্দে জবাব এল, দরজা খুলে গেল। একটি অনুচ্চ স্বরে তাকে প্রশ্ন করা হল (তখনো পিয়েরের চোখ বাঁধা) সে কে, কবে কোথায় তার জন্ম হয়েছিল, ইত্যাদি। চোখ বাঁধা অবস্থায়ই আবার তাকে এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল, যেতে যেতেই তাকে শোনানো হল তার তীর্থযাত্রার পরিশ্রমের তাৎপর্যের কথা, পবিত্র বন্ধুত্বের কথা, বিশ্বের শাশ্বত সৃষ্টিকর্তার কথা, সাহসের সঙ্গে সব পরিশ্রম ও বিপদকে সহ্য করবার কথা। তারপর সকলে তার ডান হাতটা ধরে একটা জিনিসের উপর রাখল, অপর হাতে একজোড়া দিকনির্ণয় যন্ত্র বাঁ দিকের বুকের উপর চেপে ধরে একজনের উঁচু সুরে সুর মিলিয়ে সংঘের বিধানাবলির প্রতি আনুগত্যের শপথ উচ্চারণ করতে তাকে বলা হল। তারপর মোমবাতিগুলো নিভিয়ে দেওয়া হল, শুঁকেই পিয়ের বুঝতে পারল কোনো সুরাসার জ্বালানো হল, তাকে বলা হল, এবার সে ছোট আলোটা দেখতে পাবে। তার চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হল, আর জ্বলন্ত সুরাসারের আবছা আলোয় পিয়ের যেন স্বপ্নের ঘোরে দেখতে পেল, রেটরের মতো এপ্রন পরা কয়েকটি লোক হাতের তলোয়ার তার বুকের দিকে উচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে একজনের শাদা শার্টে রক্তের দাগ। তা দেখে পিয়ের তলোয়ারগুলোর দিকে বুক ফুলিয়ে এগিয়ে গেল, যেন বলতে চাইল, মারো আমাকে। কিন্তু তলোয়ারগুলো তার দিক থেকে সরিয়ে নেওয়া হল, আর সঙ্গে সঙ্গে আবার তার চোখ বেঁধে দেওয়া হল।
একটি কণ্ঠস্বরে উচ্চারিত হল, এবার তুমি ছোট আলোটা দেখতে পেয়েছ। তখন মোমবাতিগুলো আবার জ্বেলে দেওয়া হল, তাকে বলা হল, এবার সে পুরো আলোটাই দেখতে পাবে, আবার তার চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হল, আর দশের অধিক কণ্ঠ একসঙ্গে বলে উঠল : Sic transit gloria mundi. (পার্থিব গৌরব এমনি করেই শেষ হয়ে যায়)।
ধীরে ধীরে পিয়েরের সম্বিৎ ফিরে এল, ঘরের চারদিকে তাকিয়ে সে উপস্থিত লোকজনদের দেখতে লাগল। কালো কাপড়ে ঢাকা একটা লম্বা টেবিলকে ঘিরে জন বারো লোক বসে আছে, তাদের পরিধেয় আগেকার লোকগুলির মতোই। তাদের কিছু লোককে পিয়ের পিটার্সবুর্গ সমাজেও দেখেছে। সভাপতির আসনে বসে আছে একটি অপরিচিত যুবক, তার গলায় ঝুলছে একটা অদ্ভুত ধরনের ক্রুশ। তার ডাইনে বসে আছে সেই ইতালিয় মঠাধ্যক্ষ, দুই বছর আগে পিয়ের যাকে আন্না পাভলভনার বাড়িদে দেখেছিল। সেখানে আরো উপস্থিত ছিল একজন অত্যন্ত বিশিষ্ট ব্যক্তি ও জনৈক সুইস ভদ্রলোক যে একসময় কুরাগিন পরিবারে গৃহশিক্ষক ছিল। গম্ভীর নৈঃশব্দ্যের মধ্যে সকলে সভাপতির কথা শুনতে লাগল, সভাপতির হাতে একটি হাতুড়ি। দেয়ালের ভিতরে একটি তারকাকৃতি আলো জ্বলছে। টেবিলের একপাশে নানারকম মূর্তিখচিত একখানি ছোট কার্পেট পাতা, এবং অন্যপাশে একটি বেদীর উপর রাখা হয়েছে টেস্টামেন্ট ও করোটি। গির্জায় যেমন হয়ে থাকে বেদীটাকে ঘিরে সাতটা বড় মোমবাতি জ্বলছে। ভাইদের ভিতর থেকে দুজন পিয়েরকে বেদীর কাছে নিয়ে গেল, তার পা দুটিকে সমকোণে রেখে তাকে শুয়ে পড়তে বলে ঘোষণা করা হল, মন্দির দ্বারে তাকে সষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করতে হবে।
প্রথমেই ওকে খনিত্র গ্রহণ করতে হবে, এক ভাই ফিসফিস করে বলল। আঃ, চুপ, চুপ! আর একজন বলল।
বিব্রত পিয়ের কারো কথা না শুনে স্বল্পদৃষ্টি চোখ মেলে চারদিকে তাকাল। সহসা তার মন সন্দেহে দুলে উঠল। আমি কোথায় এসেছি? আমি কি করছি? ওরা কি আমাকে দেখে হাসাহাসি করছে না? ভবিষ্যতে একথা স্মরণ করে আমি কি লজ্জা পাব না? কিন্তু সন্দেহ ক্ষণিকের জন্য। পিয়ের চারদিককার গম্ভীর মুখগুলোর দিকে তাকাল, এতক্ষণ যা কিছু করেছে সব তার মনে পড়ল, বুঝল যে মাঝপথে আর থামা চলে না। এই দোলাচলচিত্ততায় ভীত হয়ে আগেকার ভক্তির ভাবটা ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় সে মন্দিরদ্বারে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। আর সত্যি সত্যি ভক্তিভাবটা আরো বেশি জোরালো হয়ে তার মনে ফিরে এল। এবার তাকে উঠতে বলা হল, অন্য সকলের মতো একটা শাদা এপ্রন তার গায়ে জড়িয়ে দেওয়া হল, একটি খনি ও তিনজোড়া দস্তানাও তাকে দেওয়া হল, আর তারপরেই মহাপ্রভু (Grand Master) তাকে উদ্দেশ করে কথা বলল। বলল, সে যেন কখনো এমন কিছু না করে যাতে শক্তি ও পবিত্রতার প্রতীক এই শ্বেত অঙ্গাবরণের গায়ে কলঙ্ক লাগতে পারে, খনিটি সম্পর্কে বলল, স্বীয় অন্তর থেকে সব পাপকে উৎপাটিত করতে এই খনি হাতে তাকে কাজ করতে হবে এবং স্বেচ্ছায় প্রতিবেশীর অন্তরকেও পাপমুক্ত করতে হবে। পুরুষের ব্যবহারের উপযোগী প্রথম দস্তানা জোড়া সম্পর্কে সে বলল, কোনো তাৎপর্য না জেনেই পিয়েরকে সে দস্তানা জোড়া রেখে দিতে হবে। পুরুষের ব্যবহার-উপযোগী দ্বিতীয় দস্তানা জোড়া পিয়েরকে পরতে হবে সভা-সমিতিতে। আর নারীর ব্যবহারের উপযোগী তৃতীয় দস্তানা জোড়া সম্পর্কে সে বলল : প্রিয় ভাই, এই নারীর দস্তানা জোড়াও তোমারই। যে নারীকে তুমি সবচাইতে বেশি সম্মান করবে তাকেই এ দুটি দেবে। ভ্রাতৃসংঘে যে নারীকে তুমি তোমার যোগ্য সহযোগিনী বলে মনে করবে এই দান হবে তার প্রতি তোমার অন্তরের পবিত্রতার প্রতিশ্রুতিস্বরূপ। একটু থেমে সে আবার বলল : কিন্তু খুব সাবধান হে প্রিয় ভাই, এইসব দস্তানা যেন কোনো অপবিত্র হাতে শোভা না পায়। মহাপ্রভুর এই শেষের কথাগুলো শুনে পিয়ের বেশ বিব্রত বোধ করতে লাগল। সে ভাব ক্রমেই বাড়তে লাগল, তার মুখটা ছোট ছেলের মতো রক্তিম হতে হতে একসময় দুই চোখ জলে ভরে উঠল, অস্বস্তির সঙ্গে সে চারদিকে তাকাতে লাগল। কেমন যেন একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এল।
জনৈক ভাই সে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল। পিয়েরকে সামনে নিয়ে গিয়ে একখানা হাতে-লেখা পুঁথি থেকে কার্পেটের উপরকার মূর্তিগুলোর ব্যাখ্যা পড়ে শোনাতে লাগল : সূর্য, চন্দ্র, হাতুড়ি, ওলন, খনি, একটা অমসৃণ পাথর, একটা চৌকো পাথর, একটা স্তম্ভ, তিনটে জানালা, ইত্যাদি। তারপর পিয়েরকে একটা আসন দেওয়া হল, সংঘ-গৃহের প্রতীক-চিহ্নটা দেখানো হল, প্রবেশ-সংকেতটা বলে দেওয়া হল, এবং শেষপর্যন্ত বসবার অনুমতি দেওয়া হল। মহাপ্রভু বিধানাবলি পড়তে শুরু করল। সেই দীর্ঘ পাঠের অর্থ বুঝবার মতো মনের অবস্থা তখন পিয়েরের ছিল না। কোনোরকমে প্রতিটি বিধানের শেষ কথাগুলি সে বুঝতে চেষ্টা করল, আর সেগুলিই তার মনের মধ্যে রয়ে গেল।
মহাপ্রভু পড়তে লাগল, আমাদের মন্দিরে পাপ ও পুণ্যের পার্থক্য ছাড়া আর কোনো পার্থক্য আমরা স্বীকার করি না। সাম্যকে লঙ্ঘন করতে পারে এ রকম কোনো পার্থক্যের কথা থেকে সর্বদা সতর্ক থাকবে। যে কোনো ভাইয়ের সাহায্যেই ছুটে যাবে, কেউ ভুলপথে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনবে, কেউ পড়ে গেলে তাকে তুলে ধরবে, কখনো কোনো ভাইয়ের প্রতি ঈর্ষা বা দ্বেষ পোষণ করবে না। সকলের প্রতি সদয় ও বিনয়ী হবে। সকলের অন্তরে জ্বালাবে পুণ্যের শিখা। নিজের সুখকে প্রতিবেশীর সঙ্গে ভাগ করে ভোগ করবে, ঈর্ষা যেন কদাপি সে আনন্দের পবিত্রতাকে নষ্ট করতে না পারে। শত্রুকে ক্ষমা করবে, তার উপকার করা ছাড়া অন্য কোনোভাবে তার প্রতি প্রতিশোধ নেবে না। এইভাবে সর্বোচ্চ বিধানকে মেনে চললে সেই প্রাচীন মর্যাদা তুমি ফিরিয়ে আনতে পারবে যা তোমরা হারিয়ে ফেলেছ।
কথা শেষ করে মহাপ্রভু দাঁড়িয়ে পিয়েরকে আলিঙ্গন করে চুম্বন করল, অশ্রুসিক্ত চোখে পিয়ের চারদিকে তাকাতে লাগল, চারদিক থেকে সকলে যেভাবে তাকে অভিনন্দন জানাতে লাগল তার জবাবে সে কি বলবে তা বুঝতেই পারল না। এখানে সকলেই তার ভাই, তাদের সঙ্গে একযোগে কাজ শুরু করতে সে অধৈর্য হয়ে উঠল।
মহাপ্রভু হাতুড়িটা ঠুকল। সব ভাই যার যা জায়গায় বসে পড়ল, আর তাদের একজন পড়ে শোনাতে লাগল বিনয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা।
মহাপ্রভু প্রস্তাব করল, এবার শেষ কর্তব্যটি পালন করতে হবে, আর ভিক্ষা সংগ্রাহক উপাধিকারী সেই বিশিষ্ট ব্যক্তিটি সব ভাইদের কাছে ঘুরতে লাগল। পিয়েরের ইচ্ছা হল তার যা কিছু আছে সব দিয়ে দেবে, কিন্তু পাছে সেটা অহংকারের মতো দেখায় তাই অন্য সকলে যা দিল সেও তাই দিল।
সভার কাজ শেষ হল। বাড়ি ফিরে পিয়েরের মনে হল, দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় অনেক অনেক বছর কাটিয়ে সে ফিরে এসেছে, সে সম্পূর্ণ বদলে গেছে, আগেকার জীবনযাত্রা ও অভ্যাসগুলিকে অনেক অনেক পিছনে ফেলে এসেছে।
.
অধ্যায়-৫
পরদিন বাড়িতে বসে পিয়ের একটা বই পড়তে পড়তে চতুষ্কোণটির তাৎপর্য বুঝবার চেষ্টা করছিল, সেটার একদিকে ঈশ্বরের প্রতীক, অন্যদিকে নীতিবিষয়ক প্রতীক, তৃতীয় দিকে জাগতিক বস্তুর প্রতীক, আর চতুর্থ দিকে এই তিনের একত্র সমাবেশ। তার মন মাঝে মাঝেই বই ও চতুষ্কোণটা থেকে সরে যাচ্ছে, কল্পনায় সে জীবনের একটা নতুন পরিকল্পনা রচনা করছে। আগের দিন রাতে সে শুনেছে যে তার দ্বৈত যুদ্ধের খবর সম্রাটের কানে পৌঁছেছে এবং তার পক্ষে এখন পিটার্সবুর্গ থেকে চলে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই সে…ভাবছে, দক্ষিণাঞ্চলের জমিদারিতে চলে যাবে এবং সেখানে তার ভূমিদাসদের কল্যাণসাধনে আত্মনিয়োগ করবে। সানন্দে এই নতুন জীবনের পরিকল্পনা করছে এমন সময় হঠাৎ প্রিন্স ভাসিলি ঘরে ঢুকল।
ঢুকতে ঢুকতেই প্রিন্স ভাসিলি বলল, দেখ বাপু, মস্কোতে তুমি কি সব কাণ্ড করেছ? তুমি ভুল বুঝেছ। এ ব্যাপারে আমি সব জানি, তাই জোর দিয়েই তোমাকে বলছি যে ইহুদিদের কাছে খৃস্ট যেরকম নির্দোষ ছিলেন, তোমার কাছে হেলেনও তেমনই নির্দোষ।
পিয়ের জবাব দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু প্রিন্স ভাসিলি তাকে বাধা দিল।
বলল, তুমি বন্ধুর মতো সোজা কেন আমার কাছে এলে না? আমি এ ব্যাপারে সব জানি, সব বুঝি। যে মানুষ নিজের সম্মানকে মূল্য দেয় তার মতো কাজই তুমি করেছ, হয়তো একটু তড়িঘড়ি করে ফেলেছ, কিন্তু সেকথা থাক। একটু নিচু গলায় বলল, কিন্তু একবার ভেবে দেখ তো, সমাজের চোখে, এমন কি আদালতের চোখে তুমি তাকে ও আমাকে কোথায় এনে ফেলেছ। সে আছে মস্কোতে, আর তুমি আছ এখানে। কিন্তু মনে রেখ বাবা, এটা নেহাৎই একটা ভুল-বোঝাবুঝির ব্যাপার। আশা করি তুমি নিজেও তা বুঝতে পেরেছ। এস না, এখনই আমরা তাকে একটা চিঠি লিখি, তাহলেই সে এখানে চলে আসবে, আর সব কথাই তাকে বুঝিয়ে বলা হবে, কিন্তু বাবা, তা যদি না কর তো আমি বলছি পরে তোমাকে এ জন্য দুঃখ পেতে হবে।
প্রিন্স ভাসিলি অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে পিয়েরের দিকে তাকাল।
বিশ্বস্তসূত্রে আমি জানতে পেরেছি, বিধবা সম্রাজ্ঞী এ ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তুমি তো জানো, হেলেনের প্রতি তিনি খুবই সদয়।
পিয়ের কয়েকবার কথা বলতে চেষ্টা করল, কিন্তু একদিকে প্রিন্স ভাসিলি যেমন তাকে কথা বলতেই দিল না, অন্যদিকে তেমনই শ্বশুরের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে তার মতের বিরুদ্ধে যাবার যে সংকল্প সে করেছে সেভাবে কথা বলতে সে নিজেও কিছুটা ভয় পেল। তাছাড়া, সকলের প্রতি সদয় ও বিনয়ী হও-ভ্রাতৃসংঘের এই বিধানটিও তার মনে পড়ে গেল। সে চোখ কুঁচকাল, তার মুখটা লাল হয়ে উঠল, উঠে দাঁড়াল, আবার বসে পড়ল। একজন লোকের মুখের উপর একটা অপ্রিয় কথা বলা, তার কাছে অপ্রত্যাশিত কিছু বলা-জীবনের এই সবচাইতে কঠিন কাজটি করার জন্য সে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগল। প্রিন্স ভাসিলির কথা মেনে চলতে সে এতই অভ্যস্ত যে তার মনে হল, তার দিক থেকে এই অপ্রিয় আপত্তিটা এখন সে সহ্য করতে পারবে না, তার আরো মনে হল, সে এখন যা বলবে তার উপরেই নির্ভর করছে তার ভবিষ্যৎ-সেই পুরনো পথেই সে চলবে, নাকি সংঘ-ভাইরা যে নতুন পথের সন্ধান তাকে দিয়েছে যা তাকে নতুন জীবন দান করবে বলে সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে সেই পথেই চলবে।
প্রিন্স ভাসিলি বলল, দেখো বাবা, তুমি হা বলে দাও, আমি নিজেই তাকে চিঠি লিখে দিচ্ছি, বাস, সব গোলমাল মিটে যাক।
কিন্তু প্রিন্স ভাসিলির কথা শেষ হবার আগেই তার দিকে না তাকিয়ে পিয়ের বাবার মতোই রুক্ষ অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠল, প্রিন্স, আমি আপনাকে এখানে আসতে বলিনি। দয়া করে চলে যান! লাফ দিয়ে উঠে সে দরজাটা খুলে দিল।
চলে যান! সে আবার বলল, প্রিন্স ভাসিলির মুখের বিচলিত, ভীতদৃষ্টি দেখে সে বেশ খুশি হয়ে হল।
তোমার কী হয়েছে, তুমি কি অসুস্থ?
চলে যান! কাঁপা গলায় সে আর একবার বলল। অগত্যা প্রিন্স ভাসিলিকে চলে যেতেই হল।
এক সপ্তাহ পরে নতুন বন্ধু ও সংঘ-ভাইদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এবং ভিক্ষা দেয়ার জন্য প্রচুর অর্থ তাদের হাতে দিয়ে পিয়ের নিজের জমিদারিতে চলে গেল। নতুন ভাইরা তার হাত দিয়ে কিয়েভ এবং ওডেসার ভ্রাতৃসংঘের কাছে চিঠি লিখে দিল, কথা দিল, তাকে চিঠি লিখবে, নতুন কর্মসাধনায় তাকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
.
অধ্যায়-৬
পিয়ের ও দলখভের দ্বৈত যুদ্ধের ব্যাপারটা মিটে গেছে, সে সময় দ্বৈত যুদ্ধ সম্পর্কে সম্রাটের যথেষ্ট কঠোর মনোভাব সত্ত্বেও দুই যোদ্ধা ও তাদের সমর্থক কারো কোনো শাস্তি হল না। কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে পিয়েরের সম্পর্ক বিচ্ছেদের দ্বারা সমর্থিত হয়ে সেই দ্বৈত যুদ্ধের গল্প সমাজের সর্বত্রই আলোচিত হতে লাগল। পিয়ের যখন অবৈধ সন্তান ছিল তখন সকলেই তাকে করুণা করত, আবার সে যখন রাশিয়ার সেরা বল হয়ে দেখা দিল তখন সকলেই তার খোশামোদ করতে শুরু করল, আবার বিয়েটা হয়ে যাবার পরে সকলের কাছেই তার দাম কমে গেল-কারণ বিবাহযোগ্য মেয়েদের ও তাদের মায়েদের আর তার কাছে কিছুই আশা করবার রইল না। যা ঘটেছে সে-জন্য এখন সকলে তাকেই দোষ দিচ্ছে, সকলেই বলছে ঈর্ষার বশে তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, বাবার মতোই রাক্ষুসে রাগ তাকেও ভর করেছে। আর পিয়ের চলে যাবার পরে হেলেন যখন পিটার্সবুর্গে ফিরে এল তখন পরিচিতজনরা তাকে সাদরে বরণ করে নিল, এমনকি তার দুর্ভাগ্যের জন্য তাকে কিছুটা সমীহও দেখাতে লাগল। স্বামীর কথা উঠলেই হেলেন এমন ভাব দেখাতে লাগল যেন কারো উপর দোষারোপ না করেই সে স্বামীর দেয়া এই দুঃখের বোঝা নীরবে বয়ে বেড়াবে। প্রিন্স ভাসিলি অবশ্য খোলাখুলিভাবেই তার মনের কথা প্রকাশ করল। পিয়েরের কথা উঠলেই দুই কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে নিজের কপাল দেখিয়ে বলতে লাগল, একটু লেগেছে–একথা তো আগাগোড়াই বলেছি।
আন্না পাভলভনা বলল, আমি তো গোড়াতেই বলেছিলাম। অন্য কেউ বলবার আগেই বলেছি, আজকের দিনের বাজে ভাবনাচিন্তাগুলোই নির্বোধ যুবকটির মাথা খেয়েছে। সকলেই যখন ওকে নিয়ে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছিল, ও যখন সবে বিদেশ থেকে ফিরে আমার বাড়ির এক মজলিসেই এমন ভাব দেখাল যেন সেও একজন মারাৎ, তখনই আমি এ-কথা বলেছিলাম। আর এখানেই কি শেষ হয়ে যাবে? আমি তো তখনই এ বিয়ের বিরুদ্ধে ছিলাম, আর আজ যা কিছু ঘটেছে সবই আগে থেকে বলে দিয়েছিলাম।
১৮০৬ সালের শেষের দিকে। জেনা ও অয়েস্টাড়ে নেপোলিয়নের হাতে প্রাশিয়ান বাহিনীর সম্পূর্ণ পরাজয় ও প্রাশিয়ার অধিকাংশ দুর্গের আত্মসমর্পণের শোচনীয় খবরগুলি যখন পুরোপুরি এসে গেছে, আমাদের বাহিনী যখন প্রাশিয়াতে ঢুকেছে এবং নেপোলিয়নের সঙ্গে আমাদের দ্বিতীয় যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে, তখন আন্না পাভলভনা আবার একটা মজলিসের ব্যবস্থা করল। সত্যিকারের উঁচু মহলের যারা সেরা মানুষ তাদের মধ্যে ছিল স্বামীপরিত্যক্তা মনোরমা হেলেন, মর্তেমার্ত, ভিয়েনা থেকে সদ্য প্রত্যাগত প্রিন্স হিপোলিৎ, দুজন কূটনীতিক, বুড়ি খালা ও আরো অনেকে।
সেদিন সন্ধ্যায় আন্না পাভলভনা যে নতুন রত্নটিকে অতিথিদের সামনে হাজির করল সে হল বরিস দ্রুবেৎস্কয়, প্রাশীয় বাহিনীর বিশেষ দূত হিসেবে সে সম্প্রতি এসেছে, কোনো একজন ভি-আই-পির সে এড ডি-কং।
অতিথিরা সকলেই এসে গেছে, আন্না পাভলভনার নেতৃত্বে আলোচনা চলছে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কে ও তার সঙ্গে মৈত্রীসূত্রে আবদ্ধ হবার বিষয় নিয়ে, এমন সময় বরিস ঘরে ঢুকল।
আন্না পাভলভনা চুমো খাবার জন্য তার কুঁচকে যাওয়া হাতটা বরিসের দিকে এগিয়ে দিল, অপরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিল, অস্ফুট স্বরে তাদের কিছু-কিছু বিবরণও শুনিয়ে দিল।
প্রিন্স হিপোলিৎ কুরাগিন-চমৎকার যুবক, এম, কংকা, কোপেনহাগেনের রাষ্ট্রদূত, প্রগাঢ় পণ্ডিত মানুষ, মি. শিতভ বহুগুণের অধিকারী।
নতুন পরিবেশে বরিস নিজেকে বেশ মানিয়ে নিল। সুন্দরী হেলেনের পাশে তার জন্য নির্দিষ্ট আসনটিতে বসে সে মন দিয়ে সকলের আলোচনা শুনতে লাগল।
ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত বলল, ভিয়েনার মতে প্রস্তাবিত সন্ধির মূল কথাগুলি এতই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে যে অবিরাম চেষ্টা চালিয়েও তাদের নাগাল পাওয়া যাবে না, আর তাই সে বিষয়ে ভিয়েনা যথেষ্ট সন্দেহ পোষণ করে। ভিয়েনা মন্ত্রিসভার এটাই আসল বক্তব্য।
মৰ্তেমার্ত বলল, ভিয়েনা মন্ত্রিসভা এবং অস্ট্রিয়ার সম্রাটের মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য আছে। অস্টিীয়ার সম্রাট কখনো এ ধরনের কথা ভাবতে পারেন না, এটা শুধুমাত্র মন্ত্রিসভার কথা।
আন্না পাভলভনা বলল, দেখুন ভাইকোঁত, য়ুরোপ (আন্না এটাকেই ইওরোপের ফরাসি উচ্চারণ বলে মনে করে এবং ফরাসিদের সঙ্গে আলোচনাকালে এই উচ্চারণই করে থাকে) কখনো আমাদের আন্তরিক মিত্র হবে না।
বরিস মনোযোগ সহকারে সকলের বক্তব্যই শুনল, সেই ফাঁকে মাঝে মাঝে পার্শ্ববর্তিনী সুন্দরী হেলেনের দিকেও নজর দিল, হেলেনের চোখ দুটিও স্মিত হাসির সঙ্গে বারকয়েক এই সুদর্শন যুবক এড-ডি কংটির চোখের উপর পড়ল।
প্রাশিয়ার অবস্থার কথা বলতে গিয়ে আন্না পাভলভনা স্বাভাবিকভাবেই বরিসকে অনুরোধ করল, তার গ্লোগাউ অভিযান ও সেখানকার তৎকালীন প্রাশীয় বাহিনীর অবস্থার কথা কিছু বলতে। বরিসও বেশ ভেবেচিন্তে সেনাবাহিনী ও দরবারের কিছু-কিছু আকর্ষণীয় বিবরণ শুনিয়ে দিল। সকলেরই মনোযোগ তার প্রতি আকৃষ্ট হল, কিন্তু সবচাইতে বেশি আগ্রহ দেখাল হেলেন। বেশ কয়েকটি প্রশ্নও সে করল। কথা শেষ হতেই সে হেসে বরিসের দিকে মুখ ফেরাল।
বলল, আপনি অতি অবশ্যই এসে আমার সঙ্গে দেখা করবেন। মঙ্গলবার আটটা থেকে নটার মধ্যে। আপনি এলে ভারি খুশি হব।
তার ইচ্ছাপূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বরিস সবে তার সঙ্গে আলাপ শুরু করেছে এমন সময় আন্না পাভলভনা খালা তাকে ডেকেছে এই অজুহাতে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল।
আন্না পাভলভনা চোখ টিপে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হেলেনকে দেখিয়ে বলল, ওর স্বামীকে তো তুমি নিশ্চয়ই চেন? আহা, বেচারির ভাগ্যটাই খারাপ! ওর সামনে স্বামীর কথা তুলো না-দয়া করে তুলো না! তাতে ও বড় ব্যথা পাবে!
.
অধ্যায়-৭
বরিস ও আন্না পাভলভনা যখন ফিরে এল তখন অন্য সকলেই প্রিন্স হিপোলিৎতের কথা শুনতে ব্যস্ত। হাতল চেয়ারে বসে সামনে ঝুঁকে সে বলল : প্রাশিয়ার রাজা! আর তারপরেই হেসে উঠল। সকলেই তার দিকে মুখ ঘোরাল।
প্রাশিয়ার রাজা? সপ্রশ্ন ভঙ্গিতে কথাটা বলেই হিপোলিৎ আর একবার হেসে উঠল, তারপর শান্ত, গম্ভীরভাবে চেয়ারে হেলান দিল। তার কথা শুনবার জন্য আন্না পাভলভনা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, কিন্তু সে যখন আর মুখ খুলল না তখন সে নিজেই বলতে শুরু করল পটসডাম-এ পাপিষ্ঠ বোনাপার্ক কর্তৃক মহান ফ্রেডেরিকের তরবারি চুরির কথা।
মহান ফ্রেডেরিকের তরবারির কথাই আমি… সে বলতে শুরু করতেই হিপোলিৎ তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল প্রাশিয়ার রাজা…তারপর সকলে তার দিকে মুখ ফেরাতেই সে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে মুখ বন্ধ করল।
আন্না পাভলভনার ভুরু কুঞ্চিত হল। হিপোলিৎতের বন্ধু মর্তেমার্ত কড়াগলায় বলল, এই যে, প্রাশিয়ার রাজার কথার কী হল?
হিপোলিৎ এমনভাবে হাসল যেন হাসিটাই লজ্জার ব্যাপার।
ও কিছু না। আমি শুধু বলতে চেয়েছিলাম… প্রাশিয়ার রাজার জন্য (ফরাসিতে কথাটাতে বোঝায় বাজে জিনিস) যুদ্ধ করাটাই আমাদের ভুল হয়েছিল।
বরিস বেশ বুদ্ধি করে ঈষৎ হাসল। অন্য সকলে হো-হো করে হেসে উঠল।
শুকনো আঙুল উঁচিয়ে আন্না পাভলভনা বলল, তোমার ঠাট্টাটা বড়ই খারাপ হল, কথাটা সরস হলেও অন্যায়।
সে আরো বলল, আমরা তো প্রাশিয়ার রাজার জন্য যুদ্ধ করিনি। করেছি ন্যায়নীতির জন্য। আঃ, প্রিন্স হিপোলিৎ কী দুষ্টু!
আলোচনাটা একসময় রাজনৈতিক সংবাদের দিকে মোড় নিল। ক্রমে সম্রাট যে-সব পুরস্কার বিতরণ করেছে সেই প্রসঙ্গ উঠল।
প্রগাঢ় পণ্ডিত লোকটি বলল, আপনারা জানেন গত বছর এন-এন-পেয়েছিলেন প্রতিকৃতিখচিত একটা নস্যিদান, তাহলে এস-এস-অনুরূপ সম্মান পাবেন না কেন?
কূটনীতিক বলে উঠল, মাফ করবেন! ম্রাটের প্রতিকৃতিখচিত নস্যিদান একটা পুরস্কারমাত্র, কোনো সম্মান নয়-একটা উপহারও বলতে পারেন।
কিন্তু এরকম দৃষ্টান্ত আছে, আমি শোয়ার্জেনবের্গের কথা উল্লেখ করতে পারি।
অপর একজন বলল, এ অসম্ভব।
বাজি রাখবে? সম্মানসূচক ফিতে একটা আলাদা ব্যাপার…
সকলে উঠে পড়ল। সারা সন্ধ্যা হেলেন সামান্যই কথা বলেছে। এবার সে বরিসের দিকে ঘুরে তাকে মঙ্গলবারের আসার কথাটা স্মরণ করিয়ে দিল।
স্মিত হেসে আন্না পাভলভনার দিকে ঘুরে হেলেন বলল, আমার কাছে এটা খুব বড় কথা। আন্না পাভলভনাও যথারীতি বিষণ্ণ হাসি হেসে তাকে সমর্থন জানাল।
কিন্তু মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হেলেনদের চমকপ্রদ বসার ঘরে এসে বরিস বুঝতেই পারল না তার এখানে আসাটা কেন এত দরকারি ছিল। আরো কিছু অতিথি উপস্থিত ছিল, আর কাউন্টেসও তার সঙ্গে সামান্য কথাই বলল। কিন্তু বিদায় নেয়ার সময় সে যখন কাউন্টেসের হাতে চুমো খেল তখন সে বিচিত্র গম্ভীর মুখে একান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে ফিসফিস করে বলল, আগামীকাল ডিনারে এস… সন্ধ্যায়। আসতেই হবে…এসো কিন্তু!
পিটার্সবুর্গে অবস্থানকালে কাউন্টেসের পরিবারের সঙ্গে বরিস বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল।
.
অধ্যায়-৮
যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠেছে, ক্রমেই এগিয়ে আসছে রুশ সীমান্তের দিকে। সকলের মুখেই মানবজাতির শত্রু বোনাপার্তের প্রতি অভিশাপ। গ্রামে গ্রামে চলেছে সামরিক ও বেসামরিক সৈন্য সংগ্রহের অভিযান, রণস্থল থেকে আসছে নানা পরস্পরবিরোধী সংবাদ, যথারীতি সেগুলি মিথ্যা, আর তাই তাদের ব্যাখ্যাও নানারকম।
বুড়ো প্রিন্স বলকনস্কি, প্রিন্স ও প্রিন্সেস মারির জীবনযাত্রা ১৮০৫ সাল থেকে অনেক বদলে গেছে।
সারা রাশিয়া জুড়ে সৈন্য সংগ্রহের যে অভিযান চলেছে তার তত্ত্বাবধানের জন্য যে আটজন প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা হয়েছে ১৮০৬ সালে, বুড়ো প্রিন্স তাদের অন্যতম। যে সময়ে সে ভেবেছিল যে ছেলে যুদ্ধে মারা গেছে তখন থেকেই তার দেহে বার্ধক্যের দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠেছে। তবু সম্রাট স্বয়ং যে কর্তব্যের ভার তাকে দিয়েছে তাকে অস্বীকার করাটাকে সে সঙ্গত মনে করেনি, বরং কাজ করার এই নতুন সুযোগ তাকে এনে দিয়েছে নতুন উৎসাহ ও শক্তি। যে তিনটি প্রদেশের ভার তার উপর পড়েছে সেখানে সে অনবরত টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে, সগর্বে নিজ কর্তব্য পালন করছে, অধীনস্থ লোকজনদের কঠোর হাতে পরিচালিত করছে, সবকিছুর উপরেই পুঙ্খানুপুঙ্খ নজর রাখছে। প্রিন্সেস মারি বাবার কাছে গণিতের পাঠ নেয়া বন্ধ করেছে, বুড়ো প্রিন্স যখন বাড়িতে থাকে তখনো দাই ও ছোট্ট প্রিন্স নিকলাসকে (ঠাকুর্দা তাকে ওই নামেই ডাকে) নিয়ে সে বাবার পড়ার ঘরে যায়। প্রিন্সেস মারি দিনের বেশির ভাগ সময় নার্সারিতেই কাটায়, যতদূর সম্ভব ছোট ভাইপোটির প্রতি মায়ের মতোই ব্যবহার করতে চেষ্টা করে। মাদময়জেল বুরিয়েও বাচ্চাটিকে খুবই ভালোবাসে, কোলে পিঠে নিয়ে আদর করে।
বল্ড হিলসের গির্জার বেদীর কাছে ছোট প্রিন্সেসের সমাধির উপর একটা প্রার্থনা কক্ষ তৈরি করে ইতালি থেকে শ্বেতপাথরের একটি স্মারক এনে সেখানে বসানো হয়েছে, যেন উড়ে যাবার ভঙ্গিতে পাখা মেলে একটি দেবদূত দাঁড়িয়ে আছে। দেবদূতের উপরের ঠোঁটটি যেন আসন্ন হাসির জন্য একটু উঁচু হয়ে আছে। একদিন প্রার্থনা কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে প্রিন্স আন্দ্রু ও প্রিন্সেস মারি দুজনই পরস্পরের কাছে স্বীকার করেছে যে দেবদূতের মুখের সঙ্গে ছোট প্রিন্সেসের মুকের একটা বিস্ময়কর মিল আছে। আরো বিস্ময়ের কথা, মুখ ফুটে বোনকে না বললেও প্রিন্স আন্দ্রু যেন সেই মুখে দেখতে পেয়েছে সেই মৃদু তিরস্কার যা তার মৃত স্ত্রীর মুখে ফুটে উঠেছিল যখন সে বলেছিল, আঃ, আমার প্রতি তুমি এ ব্যবহার করলে কেন?
প্রিন্স আন্দ্রু ফিরে আসার পরেই বুড়ো প্রিন্স বন্ড হিলস থেকে প্রায় পঁচিশ মাইল দূরে অবস্থিত বগুচারোভোর মস্ত বড় জমিদারিটা তাকে হস্তান্তরিত করে দির। বল্ড হিলসের সঙ্গে একটা বিষণ্ণ স্মৃতি জড়িয়ে থাকায়, প্রিন্স আন্দ্রু সবসময় বাবার খামখেয়ালিপনাকে বরদাস্ত করে চলতে না পারায় এবং তার পক্ষে নির্জনে থাকাটা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ায়, প্রিন্স আন্দ্রু বগুচাররাভোতে বাড়ি তৈরি করতে শুরু করে দিল, এবং সেখানেই বেশি সময় কাটাতে লাগল।
অস্তারলিজ অভিযানের পরে প্রিন্স আন্দ্রু স্থির করেছিল সামরিক চাকরিতে আর যোগ দেবে না, তাই পুনরায় যুদ্ধ শুরু হলে যখন সকলকেই তাতে যোগ দিতে হল তখন প্রত্যক্ষ যুদ্ধকে এড়াবার জন্য সে সৈন্য সগ্রহের ব্যাপারে বাবার অধীনেই একটা কাজ জুটিয়ে নিল। ১৮০৫ সালের অভিযানের পর থেকে পিতাপুত্র যেন তাদের ভূমিকাকেই পাল্টে ফেলেছে। কর্মে উদ্দীপ্ত বুড়ো মানুষটি নতুন অভিযান থেকে আশা করছে সেরা সুফল, আর প্রিন্স আন্দ্রু যুদ্ধে কোনো অংশ তো নিচ্ছেই না, বরং মনে মনে দুঃখবোধ করছে, আর এই অভিযানের শুধু খারাপ দিকটাই দেখছে।
১৮০৭-এর ২৬ ফেব্রুয়ারি বুড়ো প্রিন্স কার্যোপলক্ষে বাড়ি থেকে চলে গেল। প্রিন্স আন্দ্রু বাবার অনুপস্থিতির দরুন যথারীতি বল্ড হিলসেই থেকে গেল। চারদিন যাবৎ ছোট নিকলাস অসুস্থ। বুড়ো প্রিন্সকে শহরে পৌঁছে দিয়ে কোচয়ান প্রিন্স আন্দ্রুর জন্য কিছু কাগজপত্র ও চিঠি নিয়ে ফিরে এল।
ছোট প্রিন্সকে তার পড়ার ঘরে না পেয়ে খানসামা চিঠিগুলো নিয়ে প্রিন্সেস মারির ঘরে গেল, কিন্তু সেখানেও তাকে পেল না। শুনল, প্রিন্স নার্সারিতে গেছে।
প্রিন্স আন্দ্রু বাচ্চাদের ছোট চেয়ারে বসে ভুরু কুঁচকে কাঁপা হাতে অর্ধেক পানিভর্তি একটা মদের গ্লাসে ফোঁটা ফোঁটা করে ওষুধ ঢালছিল। জনৈকা দাসী চিঠিগুলো এনে বলল, ইয়োর এক্সেলেন্সি, পেশা এই কাগজপত্রগুলো এনেছে।
এগুলো কী? সে বিরক্ত হয়ে বলল, আর তার হাতটা কেঁপে গিয়ে কয়েক ফোঁটা বেশি ওষুধ গ্লাসে পড়ে গেল। ওষুধটা মেঝেয় ফেলে দিয়ে আরো পানি আনতে বলল। দাসী পানি এনে দিল।
ঘরে আসবাবের মধ্যে আছে একটা বাচ্চাদের খাটিয়া, দুটো বাক্স, দুটো হাতল-চেয়ার, একটা টেবিল, একটা বাচ্চাদের টেবিল, আর একটা ছোট চেয়ার যেটাতে প্রিন্স আন্দ্রু বসে আছে। পর্দাগুলো নামানো, টেবিলের উপর একটা মোমবাতি জ্বলছে, আলোটা যাতে খাটিয়ার উপর না পড়ে সেজন্য একখানা বাঁধানো গানের বই দিয়ে মোমবাতিটাকে আড়াল করে রাখা হয়েছে।
খাটিয়ার পাশে দাঁড়ানো প্রিন্সেস মারি দাদাকে উদ্দেশ করে বলল, বরং একটু অপেক্ষা কর… পরে…
যেন বোনকে আঘাত দেবার জন্যই প্রিন্স আন্দ্রু বিরক্ত গলায় ফিসফিস করে বলল, আঃ, ছাড়ো তো, তুমি তো সবসময় বাজে কথা বলো আর কাজ ফেলে রাখ–আর তার তো এই ফল হয়!
প্রিন্সেস মিনতির সুরে বলল, সত্যি বলছি দাদা… ওকে না জাগানোই ভালো… ও ঘুমিয়ে পড়েছে।
প্রিন্স আন্দ্রু উঠে দাঁড়াল, মদের গ্লাসটা হাতে নিয়েই পা টিপে টিপে ছোট খাটিয়াটার দিকে এগিয়ে গেল।
ইতস্তত করে বলল, হয়তো ওকে না জাগানোই ভালো।
প্রিন্সেস মারি বলল, তোমার যেমন ইচ্ছা… সত্যি… আমার তো তাই মনে হয়… তবে তোমার যেমন ইচ্ছা। দাসীটি ফিসফিস করে প্রিন্স আন্দ্রুকে ডাকায় প্রিন্সেস মারি সেদিকে দাদার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
আজ দুই রাত দুজনের কেউই ঘুমোয়নি, ছেলেটির জ্বর খুব বেশি থাকায় তার উপর নজর রেখেছে। পরিবারের ডাক্তারের উপর ভরসা না করে শহর থেকে অন্য ডাক্তারকে ডেকে পাঠানো হয়েছে, ইতিমধ্যে এই দুটি রাত তারা একটার পর একটা ওষুধ দিয়ে যাচ্ছে। অনিদ্রা ও উদ্বেগে ক্লান্ত হয়ে তারা একে অন্যের ঘাড়ে, কষ্টের বোঝা চাপাচ্ছে আর ঝগড়া করছে।
দাসী অস্ফুট গলায় বলল, পেশা আপনার বাবার কাছ থেকে কাগজপত্র নিয়ে এসেছে।
প্রিন্স আন্দ্রু বেরিয়ে গেল।
সব উচ্ছন্নে যাক! সে তো তো করে বলল, বাবা মুখে-মুখে যেসব নির্দেশ পাঠিয়েছে তা শুনে নিয়ে এবং বাবার চিঠি ও অন্য কাগজপত্র হাতে নিয়ে আবার নার্সারিতে ফিরে গেল।
কেমন? জিজ্ঞেস করল।
একই রকম। ঈশ্বরের দোহাই, অপেক্ষা করো। কার্ল আইনিচ সব সময়ই বলেন, ঘুমটাই সবচাইতে বড় কথা, একটা নিশ্বাস ফেলে প্রিন্সেস মারি অনুচ্চ গলায় বলল।
প্রিন্স আন্দ্রু ছেলের কাছে গিয়ে কপালে হাত রাখল। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।
তোমার আর তোমার কার্ল আইভনিচের কথা থাক! ওষুধ মেশানো গ্লাসটা নিয়ে সে আবার খাটিয়ার কাছে গেল।
আন্দ্রু, ও কাজ করো না! প্রিন্সেস মারি বলল।
প্রিন্স আন্দ্রু রেগে বোনের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে গ্লাসটা হাতে নিয়ে ছেলের উপর ঝুঁকে দাঁড়াল।
বলল, কিন্তু এটা আমার ইচ্ছা। তোমাকে মিনতি করছি–ওষুধটা খাইয়ে দাও।
কাঁধ ঝাঁকুনি দিলেও প্রিন্সেস মারি দাদার কথামতো গ্লাসটা নিল এবং নার্সকে ডেকে ওষুধটা খাওয়াতে লাগল। বাচ্চাটি কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে উঠল। প্রিন্স আন্দ্রু একটু পিছিয়ে গেল, মাথাটা চেপে ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, এবং পাশের ঘরে একটা সোফায় বসে পড়ল।
সবগুলো চিঠি তখনো তার হাতে। যন্ত্রচালিতের মতো সেগুলো খুলে সে পড়তে শুরু করল। বুড়ো প্রিন্স মাঝে মাঝে সংক্ষিপ্ত শব্দ ব্যবহার করে নীল কাগজে বড় বড় লম্বা লম্বা অক্ষরে লিখেছে : বিশেষ দূতের মারফত এইমাত্র একটা খুবই আনন্দের সংবাদ পেয়েছি–এখন সেটা মিথ্যা না হলেই হয়। আইলোতে বেনিংসেন বোনাপার্তের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ জয়লাভ করেছে। পিটার্সবুর্গে সকলেই আনন্দ করছে আর সেনাবাহিনীকে অসংখ্য পুরস্কার পাঠানো হচ্ছে। যদিও সে জার্মান-তবু তাকে আমিস অভিনন্দন জানাচ্ছি। কর্চেভোর অধিনায়ককে এক খান্দ্রিকভ-যে কী করছে কিছুই বুঝতে পারছে না, এখনো পর্যন্ত বাড়তি সৈন্য এবং খাদ্যদ্রব্য এসে পৌঁছয়নি। এই মুহূর্তে ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়ে তাকে বলে দাও, এক সপ্তাহের মধ্যে সবকিছু এখানে না এলে আমি তার মুণ্ডুটাই কেটে ফেলব। প্রাশি-আইলো যুদ্ধ সম্পর্কে আর একটা চিঠি পেয়েছি পেতেংকার কাছ থেকে–সে ওই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল–আর এ-সবই সত্যি। দুষ্কৃতকারীরা হস্তক্ষেপ না করলে একজন জার্মান পর্যন্ত বোনাপার্তকে পরাস্ত করতে পারে। সে নাকি লেজে গোবরে হয়ে পালাচ্ছে। মনে থাকে যেন, অবিলম্বে ঘোড়া ছুটিয়ে কর্চেভো চলে যাও এবং আমার নির্দেশ পালন করো!
প্রিন্স আন্দ্রু দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর একখানা খামের সিল ভাঙল। দুই পাতা ভর্তি ঠাসা লেখা বিলিবিনের চিঠি। না পড়েই সে চিঠিটা ভাঁজ করে রাখল এবং বাবার চিঠিটাই আর একবার পড়ল, একেবারে শেষে লেখা শেষ হয়েছে : অবিলম্বে ঘোড়া ছুটিয়ে কর্চেভো চলে যাও, এবং আমার নির্দেশ পালন করো!
দরজার কাছে গিয়ে নার্সারির মধ্যে দৃষ্টি ফেলে সে ভাবল, না, আমাকে ক্ষমা করো, ছেলে একটু ভালো না হওয়া পর্যন্ত আমি যাব না।
প্রিন্সেস মারি তখনো খাটিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে বাচ্চাটিকে দোল দিচ্ছে।
বাবার চিঠির কথা মনে হতে প্রিন্স আন্দ্রু ভাবল, হ্যাঁ, তিনি অপ্রীতিকর আর কী যেন বলেছেন? হ্যাঁ, বোনাপার্তের বিরুদ্ধে আমাদের জয় হচ্ছে, ঠিক যখন আমি সেনাদলে নেই। হ্যাঁ, হ্যাঁ, উনি তো সব সময়ই আমাকে ঠাট্টা করেন…তা বেশ! ঠাট্টাই করতে থাকুন! সে ফরাসি ভাষায় লেখা বিলিবিনের চিঠিটা পড়তে শুরু করল। তার অর্ধেকের অর্থ না বুঝেই পড়ে ফেলল, দীর্ঘ সময় ধরে অন্য সবকিছু ভুলে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে যে কথা সে ভাবছে অন্তত মুহূর্তের জন্যও তাকে ভুলে থাকার জন্যই সে চিঠিটা পড়তে লাগল।
.
অধ্যায়-৯
বিলিবিন এখন সেনাবাহিনীর প্রধান ঘাঁটিতে কূটনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত, যদিও সে লিখেছে ফরাসি ভাষায়, ব্যবহার করেছে ফরাসি রঙ্গরস ও ফরাসি বাকভঙ্গি, তবু গোটা অভিযানকে সে বর্ণনা করেছে খাঁটি রুশীর আত্মসমালোচনা ও আত্ম-বিদ্রুপের ভঙ্গিতে। বিলিবিন লিখেছে, কূটনৈতিক স্বাধীনতার বাধ্যবাধকতা তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে, তাই প্রিন্স আন্দ্রুর মতো এমন একজন নির্ভরযোগ্য পত্রালাপী পেয়ে সে খুশি যার কাছে সেনাবাহিনীর কাজকর্ম স্বচক্ষে দেখার ফলে পেটের মধ্যে যত পিত্ত জমা হয়েছে তাকে উদ্ধার করে ফেলে দেওয়া যায়। চিঠিটা পুরনো, লেখা হয়েছিল-প্রুশিক্ত-আইলো যুদ্ধের আগে।
বিলিবিন লিখেছে, তুমি তো জানেনা বন্ধু প্রিন্স, অস্তারলিজের যুদ্ধে আমাদের চমৎকার সাফল্যের পরে আমি কখনো প্রধান ঘাঁটি ছেড়ে যাইনি। যুদ্ধের প্রতি অবশ্যই আমার একটা আগ্রহ জন্মেছে, আর আমার পক্ষে সেটা ভালোই হয়েছে, গত তিন মাসে আমি যা দেখেছি তা অবিশ্বাস্য।
প্রথম থেকেই শুরু করছি। তুমি জান, মানবজাতির শত্ৰুটি প্রাশীয়দের আক্রমণ করল। প্রাশীয়রা আমাদের বিশ্বস্ত মিত্র হয়েও তিন বছরে তিনবার আমাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমরা তাদের পক্ষ সমর্থন করি, আর দেখা যায় যে মানবজাতির শত্রুটি আমাদের ভালো বক্তৃতায় কোনোরকম কান না দিয়ে তার নিজস্ব কঠোর, বর্বর পন্থায় প্রাশীয়দের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাদের আরব্ধ কুচকাওয়াজটা শেষ করার সময়টুকুও দেয় না, আর হাতের দুই মোচড়ে তাদের ভেঙে টুকরো টুকরো করে পটসডামের প্রাসাদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে।
প্রাশিয়ার রাজা বোনাপার্তকে লিখলেন, আমার একান্ত বাসনা যে মাননীয় মহোদয়কে আপনার পছন্দমতভাবে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে যতদূর সম্ভব ভালোভাবে আমার প্রাসাদে স্বাগত জানাই ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করি, আর সেই উদ্দেশ্যে সবরকম ব্যবস্থাই আমি গ্রহণ করেছি। আমার প্রচেষ্টা যেন সফল হয়! প্রাশীয় সেনাপতিরা ফরাসিদের প্রতি প্রদর্শিত ভদ্রতার জন্য অবশ্যই গর্ব বোধ করতে পারেন, কারণ প্রথম হুমকিতেই তারা অস্ত্রত্যাগ করেছেন।
দশ হাজার সৈন্য নিয়ে গ্লোগেট দুর্গের অধিপতি প্রাশিয়ার রাজার কাছে জানতে চাইলেন, তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হলে তিনি কি করবেন।… এ সবই সম্পূর্ণ সত্য কথা।
সংক্ষেপে, একটা যুদ্ধের মনোভাব নিয়ে, সব ব্যাপারের মীমাংসা করার আশা নিয়ে আমরা যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি, আর সে যুদ্ধ আমাদের নিজেদের সীমান্তে এবং প্রাশিয়ার রাজার সঙ্গীরূপে ও তারই জন্য। আমাদের সবকিছু ভালো, শুধু একটা ছোট জিনিসের অভাব, অর্থাৎ একজন প্রধান সেনাপতি। যেহেতু মনে করা হল যে আমাদের প্রধান সেনাপতির বয়স অত অল্প না হলে অস্তারলিজের সাফল্য আরো চূড়ান্ত হতে পারত তাই আমাদের সব অশীতিবর্ষবয়স্কদের কথা আর একবার ভাবা হল এবং প্রজরোভস্কি ও কামেনস্কির মধ্যে শেষোক্তকে বেছে নেয়া হল। আমাদের সেনাপতি সুভরভের মতোই একটা কিবিল্কাতে (পুরনো কালের কাঠের ঢাকা গাড়ি) চেপে এলেন, আর সকলে সমবেত জয়ধ্বনির সঙ্গে তাকে অভ্যর্থনা করল।
৪ তারিখে পিটার্সবুর্গ থেকে প্রথম পত্রবাহক এল। ডাক নিয়ে যাওয়া হল ফিল্ড মার্শালের ঘরে, কারণ সব কাজ নিজে করাটাই তিনি পছন্দ করেন। আমাকে ডাকা হল চিঠিগুলো ভাগ করে আমাদের চিঠিগুলো নিয়ে নিতে। ফিল্ড মার্শাল নিজের চিঠির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার চিঠি একটা পেলাম না। ফিল্ড-মার্শাল অধৈর্য হয়ে নিজেই হাত লাগালেন এবং কাউন্ট টি. প্রিন্স ভি, ও অন্যদের কাছে লেখা সম্রাটের চিঠি পেলেন। তখন তিনি সকলের প্রতি, সবকিছুর প্রতি রাগে ফেটে পড়লেন, সব চিঠি হাতে নিয়ে খুলতে লাগলেন এবং অন্যদের কাছে লেখা ম্রাটের চিঠিগুলো পড়তে লাগলেন। আচ্ছা! তাহলে আমার প্রতি এই ব্যবহার! আমার উপর কোনো আস্থা নেই! আচ্ছা, আমার উপর নজর রাখার নির্দেশ! খুব ভালো কথা! সেইভাবেই চলতে থাকুন! আর তখনই তিনি জেনারেল বেনিংসেনকে লিখলেন সেদিকার বিখ্যাত হুকুমনামা : আমি আহত, ঘোড়ায় চড়তে পারি না, ফলে সেনাবাহিনীর পরিচালনা করতে পারছি না। আপনার বাহিনীকে সরিয়ে পুলতুস্কে নিয়ে এসেছেন : সেখানে তারা অরক্ষিত, না আছে জ্বালানি না আছে রসদ, কাজেই একটা কিছু করতেই হবে এবং গতকাল আপনি নিজেই কাউন্ট বাক্সহোদেনের কাছে যে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন, তাতে মনে হয় আমাদের সীমান্তে সরে আসার কথাই আপনি ভাবছেন–সে কাজটি আজই সম্পন্ন করুন।
তিনি সম্রাটকে লিখলেন, অনবরত অশ্বারোহণের ফলে আমার জিন ক্ষত হয়েছে, আমি ঘোড়ায় চড়তেই পারছি না এবং এতবড় একটা বাহিনীর পরিচালনা ভারও নিতে পারছি না, তাই পদাধিকারবলে আমার পরবর্তী সেনাপতি কাউন্ট বাক্সহোদেনের উপর আমি সেনাধ্যক্ষের ভার অর্পণ করেছি, আমার সব কর্মচারী ও জিনিসপত্র তাকে পাঠিয়ে দিয়েছি, পরামর্শ দিয়েছি, রুটির অভাব ঘটে থাকলে তিনি যেন প্রাশিয়ার আরো ভিতরে ঢুকে যান, কারণ রুটির রেশন মাত্র একদিনের অবশিষ্ট আছে, ডিভিশন কম্যান্ডার অস্তারমান ও সেদমোরেজকির প্রতিবেদন অনুসারে কোনো কোনো রেজিমেন্টে তাও নেই, চাষীদের কাছে যা ছিল তাও খেয়ে শেষ করে ফেলেছে। ভালো না হয়ে ওঠা পর্যন্ত আমি নিজে অস্ত্রলেংকার হাসপাতালেই থাকব। আমি খবর পেয়েছি, সেনাবাহিনী যদি আরো একপক্ষকাল বর্তমান শিবিরে থেকে যায় তাহলে আগামী বসন্তকাল নাগাদ একটি মানুষও সুস্থ থাকবে না, সেই খবরের উপর ভিত্তি করেই আমার এই বিনীত প্রতিবেদন পাঠালাম।
যে মহৎ ও গৌরবময় কর্তব্য পালনের জন্য এই বৃদ্ধ মানুষটিকে বেছে নেয়া হয়েছিল তা পূর্ণ করতে না পারায় লোকচক্ষে সে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছে, তাই তাকে তার পল্লীভবনে গিয়ে অবসর যাপনের অনুমতি দিন। আপনার সানুগ্রহ অনুমতির জন্য হাসপাতালেই আমি অপেক্ষা করব, যাতে সেনাবাহিনীর কমান্ডার হয়েও সেক্রেটারির ভূমিকায় আমাকে নামতে না হয়। সেনাবাহিনী থেকে আমার অপসারণের ফলে তিলমাত্র বিক্ষোভ হবে না–চলে যাবে তো একটি অন্ধ মানুষ। আমার মতো হাজার হাজার লোক রাশিয়াতে আছে।
সম্রাটের উপর রাগ করে ফিল্ড-মার্শাল শাস্তি দিলেন আমাদের সকলকে, এটাই কি ন্যায়সঙ্গত নয়?
এ তো হল প্রথম অঙ্ক। এরপরের ঘটনা আরো আকর্ষণীয়, আরো মজাদার। ফিল্ড মার্শালের বিদায় গ্রহণের পরে মনে হল আমরা শত্রুর মুখোমুখি এসে গেছি, যুদ্ধ করতেই হবে। বাক্সহোদেন এখন প্রধান .. সেনাপতি, কিন্তু জেনারেল বেনিংসেনের সেটা মনঃপুত নয়, তিনি চান এই সুযোগে নিজের হাতে (জার্মানরা এই ভাষাই ব্যবহার করে) লড়াইটা চালিয়ে কিছুটা মুনাফা লুটে নেবেন। তাই তিনি করলেন। এটাই পুলতুস্তের যুদ্ধ, সেটাকে একটা বিরাট জয় বলে মনে করা হলেও আমার মতে সেরকম কিছু নয়। যাই হোক, যুদ্ধের পরে আমরা পশ্চাদপসরণ করলাম, কিন্তু দূত মারফৎ পিটার্সবুর্গে খবর পাঠালাম যে আমাদের জয় হয়েছে। এদিকে জয়লাভের পুরস্কারস্বরূপ পিটার্সবুর্গে থেকে প্রধান সেনাপতির পদটা পাবার আশায় জেনারেল বেনিংসেন সৈন্য পরিচালনার দায়িত্ব জেনারেল বাক্সহোদেনের হাতে ফিরিয়ে দিলেন না। ফলে দুই সেনাপতির মধ্যে রেশারেশি শুরু হল। দুজনই রেগে লাল, আর তার ফলে বাক্সহোদেন এটাকে গ্রহণ করলেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে, আর বেনিংসেন সন্ন্যাস-রোগীর মতো ক্ষেপে গেলেন। আর ঠিক সেই সংকট মুহূর্তে আমাদের দূত পিটার্সবুর্গ থেকে ফিরে এল বেনিংসনের প্রধান সেনাপতিরূপে নিয়োগের খবর নিয়ে। আমাদের প্রথম শত্রু বাক্সহোদেন পরাজিত হল, এবার দ্বিতীয় শত্রু বোনাপার্তের দিকে আমরা মন দিতে পারব। কিন্তু ঘটনাচক্রে ঠিক সেইমূহুর্তে একটি তৃতীয় শত্রু আমাদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াল-গোটা রুশ সৈন্যদল সরবে দাবি জানাল রুটি চাই, মাংস চাই, বিস্কুট চাই, ঘোড়ার দানাপানি চাই, চাই অনেক কিছু! ভাণ্ডার শূন্য পথঘাট চলাচলের অযোগ্য। গোড়ায় সৈন্যরা এমনভাবে লুঠতরাজ শুরু করে দিল যা তুমি ভাবতেও পারবে না। অর্ধেক রেজিমেন্ট ডাকাত সেজে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছুটে গিয়ে আগুন ও তলোয়ারের মুখে সবকিছু ধ্বংস করতে লাগর। অধিবাসীরা নিঃস্ব হল, হাসপাতালে রোগী উপচে পড়তে লাগল, সর্বত্র দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। দু দুবার তারা আমাদের প্রধান ঘাঁটির উপর পর্যন্ত আক্রমণ চালাল, আর তাদের তাড়াতে প্রধান সেনাপতিকে আর এক ব্যাটেলিয়ন সৈন্য ডাকতে হল। সেই আক্রমণের সময় তারা আমার শূন্য পোর্টম্যাটো ও ড্রেসিং গাউনটাও নিয়ে গেল। সম্রাট প্রস্তাব করলেন, ডিভিশন-কম্যান্ডাররা ইচ্ছা করলেই লুঠেরাদের গুলি করতে পারবে, কিন্তু আমার তো আশঙ্কা হয় তার ফলে সৈন্যদের এক অংশই অপর অংশের প্রতি গুলি চালাতে বাধ্য হবে।
চিঠিটা এই পর্যন্ত পড়ে প্রিন্স আন্দ্রু সেটাকে দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। চিঠির কথাগুলিতে সে বিরক্ত হয়নি, তার বিরক্তির কারণ–যে জীবনের সঙ্গে তার এখন আর কোনো সম্পর্কই নেই, তার কথা জেনে সে বিচলিত বোধ করছে। যেন চিঠির বক্তব্য থেকে মনটাকে সরাবার জন্যই সে চোখ বুজল, কপালটা ঘষতে লাগল। হঠাৎ তার মনে হল দরজা দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ ভেসে এল। পাছে ছেলের কিছু হয়ে থাকে এই আশঙ্কায় সে ভীত হয়ে পড়ল। পা টিপে টিপে নার্সারির দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা খুলে ফেলল।
ভিতরে ঢুকতেই তার চোখে পড়ল, ভয়ার্ত চোখে দাই যেন তার কাছ থেকে কিছু লুকিয়ে ফেলল। প্রিন্সেস মারিও তখন খাটিয়ার পাশে ছিল না।
দাদা, তার পিছন থেকে বোন অস্ফুটস্বরে ডাকল।
দীর্ঘ অনিদ্রা ও উদ্বেগের পরে প্রায়ই যেমন হয়ে থাকে, প্রিন্স আন্দ্রুর মনে একটা অকারণ আতঙ্ক দেখা দিল-তার মনে হল শিশুটি মারা গেছে। সে যা কিছু দেখল ও শুনল তাতে এই আতঙ্কই বুঝি প্রমাণিত হয়েছে।
সব শেষ, সে ভাবল, তার কপালে ঠাণ্ডা ঘাম দেখা দিল। বিচলিতভাবে সে খাটিয়ার দিকে এগিয়ে গেল, তার নিশ্চিত দারণা খাটিয়াটাকে শূন্য দেখতে পাবে, দাই মৃত শিশুটিকেই লুকিয়ে ফেলেছে। পর্দাটা সরিয়ে দিল, কিছুক্ষণের জন্য তার ভয়ার্ত অস্থির চোখ দুটি শিশুটিকে দেখতে পেল না। অবশেষে তাকে দেখতে পেল : গোলাপি শিশুটি বালিশের নিচে মাথা রেখে শুয়ে আছে, ঘুমের মধ্যে ঠোঁট চাটছে আর সমতালে শ্বাস টানছে।
ছেলেকে সেই অবস্থায় দেখে প্রিন্স আন্দ্রু এতই খুশি হয়ে উঠল যেন সে তাকে সত্যি সত্যি হারিয়েছিল। বোনের শিক্ষামতো ছেলের উপর ঝুঁকে ঠোঁট দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল জ্বর আছে কি না। নরম কপালটা ভিজে উঠেছে। প্রিন্স আন্দ্রু মাথায় হাতটা বুলাল, এত বেশি ঘেমেছে যে শিশুর চুল অবধি ভিজে গেছে। ছেলে মারা যায়নি, কিন্তু স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে সঙ্কট কেটে গেছে, এখন সে ধীরে ধীরে সেরে উঠছে। প্রিন্স আন্দ্রু পিছনে একটা খসখস শব্দ শুনতে পেল, খাটিয়ার পর্দার নিচে একটা ছায়া দেখা দিল। সে ছায়া প্রিন্সেস মারির, নিঃশব্দ পায়ে সে খাটিয়ার কাছে এসেছে। পর্দাটা একবার তুলেই আবার ফেলে দিল। না তাকিয়েই তাকে চিনতে পেরে প্রিন্স আন্দ্রু হাতটা বাড়িয়ে দিল। প্রিন্সেস মারি হাতটা চেপে ধরল।
ও ঘামছে, প্রিন্স আন্দ্রু বলল।
সে-কথা বলতেই আমি আসছিলাম।
শিশুটি ঘুমের মধ্যেই একটু নড়ে উঠল, হাসল, বালিশে কপালটা ঘষল। প্রিন্স আন্দ্রু বোনের দিকে তাকাল। পর্দার আবছা ছায়া পড়ে বোনের আনন্দাশ্রুসিক্ত উজ্জ্বল চোখ দুটি আরো জ্বলজ্বল করছে। খাটিয়ার পর্দাটায় হাত রেখে সে ঝুঁকে পড়ে দাদাকে চুমো খেল। কিছুক্ষণের জন্য পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই নির্জনতার মধ্যে তিনজনই যেন আটকা পড়ে থাকতে চাইল। পর্দার মসলিনে মাথা ঘষতে ঘষতে প্রিন্স আন্দ্রুই প্রথম সেখান থেকে সরে গেল।
দীর্ঘনিশ্বাস পেলে বলল, হ্যাঁ, এখন তো আমার এই একটিই অবলম্বন।
.
অধ্যায়-১০
ভ্রাতৃসংঘে ভর্তি হবার কিছুদিন পরেই পিয়ের কিয়েত প্রদেশে চলে গেল। সেখানেই তার ভূমিদাসের সংখ্যা সবচাইতে বেশি। জমিদারিতে গিয়ে সে কী কী কাজ করবে তার একটা পূর্ণ নির্দেশনামা সে নিজেই লিখে সঙ্গে করে নিয়ে গেল।
কিয়েভ পৌঁছেই সে সব নায়েব-গোমস্তাদের ডেকে পাঠাল এবং তার অভিপ্রায় ও ইচ্ছার কথা তাদের বুঝিয়ে বলল। বলল, অবিলম্বে ভূমিদাসদের মুক্তি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে,যতদিন তা না হয় ততদিন তাদের উপর অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপানো হবে না, যেসব স্ত্রীলোকদের কোলে শিশু আছে তাদের কাজে পাঠানো হবে না, যথাযথ সাহায্য দিতে হবে, শাস্তি হবে মুখের কথায়, দৈহিক নয়, সব জমিদারিতে হাসপাতাল, আশ্রয়শিবির ও স্কুল খুলতে হবে।
কাউন্ট বেজুখভের প্রচুর সম্পত্তি। তার হাতে এসেছে বার্ষিক পাঁচ লাখ রুবলের আয়ের অঙ্ক। তথাপি পিয়েরের মনে হল, বাবা যখন তার জন্য দশ হাজার রুবল ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল তার চাইতে আজ সে অনেক বেশি গরিব হয়ে পড়েছে। নিম্নলিখিত বাজেটের একটা খসড়া তার চোখে ভাসতে লাগল : সব জমিদারি মিলিয়ে ভূমিরাজস্ব ব্যাংকে জমা দিতে হল ৮০,০০০, মস্কোর নিকটবর্তী জমিদারি ও শহরের বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ এবং তিন প্রিন্সেসের ভাতা বাবদ প্রায় ৩০,০০০, পেন্সন বাবদ ১৫,০০০ এবং প্রায় সমপরিমাণ আশ্রয়শিবিরের দরুন, খোরপোষ বাবদ কাউন্টেসকে পাঠানো হল ১৫০,০০০, ঋণের টাকার সুদ বাবদ গেল ৭০,০০০। নির্মীয়মান নতুন গির্জাটি শেষ করতে গত দুই বছরে খরচ হল প্রতি বছরে ১০,০০০ করে, এবং আরো প্রায় ১০০,০০০ রুবল যে কিসে খরচ হল তা সে জানে না, প্রতি বছরই তাকে বাধ্য হয়ে ধারকর্জ করতে হয়।
প্রতিদিন সে বড় নায়েবের সঙ্গে জমিদারি নিয়ে আলোচনা করল, কিন্তু তাতে অবস্থার কোনো সুরাহা হল বলে মনে হয় না। সে বুঝতে পারল, এ-সব আলোচনার সঙ্গে প্রকৃত অবস্থার কোনো যোগ নেই, এতে প্রকৃত অবস্থার কোনো হেরফেরও হবে না। বড় নায়েব বলে নতুন খরচের কথা, আর পিয়ের বলে ভূমিদাসদের মুক্তির কথা। নায়েব সেটাকে অসম্ভব কাজ বলে না, তার তা করতে হলে নদীর ভাটিতে কথ্রোমা প্রদেশের জঙ্গল এবং ক্রিমিয়ার জমিদারি বেচে দিতে হবে : অথচ সে কাজের সঙ্গে এতকিছু জটিলতা জড়িত, যেমন নিষেধাজ্ঞা, আবেদন, অনুমতি, ইত্যাদি খারিজ করা–যে পিয়ের একেবারেই খেই হারিয়ে বলে ওঠে : বেশ তো, বেশ তো, তাই করুন।
কিয়েভে কিছু পরিচিত লোকের সঙ্গে পিয়েরের দেখা হল, অপরিচিত লোকরাও প্রদেশের সবচাইতে বড় জমিদার এই সম্পদশালী নবাগত লোকটির সঙ্গে পরিচয় করতে সাগ্রহে এগিয়ে এল এবং তাকে সানন্দে অভ্যর্থনা জানাল। পিয়েরের সবচাইতে বড় দুর্বলতার প্রলোভন সেখানে এত বেশি যে সেগুলিকে সে প্রতিরোধ করতে পারল না। তার জীবনের দিন, সপ্তাহ ও মাসগুলি হৈ-হৈ করে কেটে যেতে লাগল, সান্ধ্য আসর, ডিনার, লাঞ্চ ও বলনাচ নিয়ে সে এতই মেতে উঠল যে ভাবনা-চিন্তার কোনো ফুরসুতই সে পায় না। যে নতুন জীবন যাপনের আশা নিয়ে সে এসেছিল তার পরিবর্তে নতুন পরিবেশে সেই একই পুরনো জীবনই সে যাপন করতে লাগল।
১৮০৭-এর বসন্তকালে সে স্থির করল পিটার্সবুর্গে ফিরে যাবে। পথে তার ইচ্ছা হল সবগুলি জমিদারি পরিদর্শন করে নিজের চোখে দেখে যাবে তার আদেশ কতদূর কার্যকরী হয়েছে, যে ভূমিদাসদের ঈশ্বর তার হাতে তুলে দিয়েছেন এবং যাদের কল্যাণ সে করতে চায় তারা কী অবস্থায় আছে।
বড় নায়েব মনে করে যুবক মনিবের এই সব প্রচেষ্টা পাগলামিরই নামান্তর, কি তার নিজের, কি কাউন্ট ও ভূমিদাসদের, কারোই এতে কোনো লাভ হবে না, তবু মনিবের নির্দেশ মতো কিছু-কিছু কাজ সে করতে লাগল। ভূমিদাসদের মুক্তির ব্যাপারটাকে অবাস্তব মনে করলেও মনিবের আসার আগেই সে সব জমিদারিতে স্কুল, হাসপাতাল ও আশ্রয়-শিবিরের জন্য অনেক বড় বড় বাড়ি তৈরি করে ফেলল। সর্বত্র তার ভালোরকম অভ্যর্থনার আয়োজন করল।
দক্ষিণাঞ্চলের বসন্তের আবহাওয়া, ভিয়েনা-গাড়িতে আরামদায়ক দ্রুত ভ্রমণ, পথের নির্জনতা–সবকিছু মিলিয়ে পিয়েরের মনকে খুশিতে ভরে তুলেছে। একটার পর একটা নতুন জমিদারি দেখছে আর ক্রমেই সেগুলো আরো বেশি করে ভালো লাগছে, মনে হল ভূমিদাসদের অবস্থার উন্নতি ঘটছে, জমিদারের দেওয়া সুখ-সুবিধার জন্য তারা খুবই কৃতজ্ঞ। সর্বত্রই অভ্যর্থনার আয়োজন, তাতে বিব্রত বোধ করলেও মনে মনে পিয়ের বেশ খুশি হয়ে উঠল। এক জায়গায় চাষীরা তাকে উপহার দিল রুটি ও নুন এবং সেন্ট পিতর ও সেন্ট পলের মূর্তি। মনিবের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সন্তগুরু পিতর ও পলের সম্মানে নিজেদের ব্যয়ে গির্জার প্রাঙ্গণে একটা নতুন ভজনালয় নির্মাণের অনুমতিও তারা চেয়ে নিল। বাচ্চা কোলে নিয়ে স্ত্রীলোকরা এল তাকে ধন্যবাদ । জানাতে। তৃতীয় এক জমিদারিতে একজন পুরোহিত কুশ হাতে নিয়ে একদল ছেলেমেয়ে পরিবৃত হয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে এল, কাউন্টের উদারতার ফলেই সে ছেলেমেয়েদের লিখতে-পড়তে শেখাচ্ছে, তাদের ধর্মশিক্ষা দিচ্ছে। পিয়ের নিজের চোখেই দেখল সব জমিদারিতে হাসপাতাল, স্কুল ও শিক্ষাকেন্দ্রের জন্য পাকা বাড়ি তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে।
কিন্তু পিয়ের জানতেও পারল না, যেখানে চাষীরা তাকে রুটি ও নুন উপহার দিল এবং পিতার ও পলের সম্মানে একটা ভজনালয় গড়ে তুলতে চাইল সেটা গ্রামের বাজার, সেন্ট পিতর দিবস উপলক্ষে সেখানে তখন একটা মেলা চলছে, ধনীরা ও চাষীরা মিলে অনেক আগেই সেখানে একটা ভজনালয় তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছে, আর সে গ্রামের দশ ভাগের নয়ভাগ চাষী চরম দারিদ্যের মতো দিন কাটাচ্ছে। সে আরো জানল না, সেসব মায়েরা এখন তার জমিতে কাজ করতে যায় না, বাড়িতে নিজেদের জমিতে তাদের আরো অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। সে এ কথাও জানল না, যে পুরোহিতটি কুশ হাতে নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল সে চাষীদের কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায় করে, আর ছেলেমেয়েদের জোর করে পড়াতে নিয়ে যায় বলে তাদের বাবা-মা চোখের জল ফেলে, মোটা টাকা দিয়ে তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। সে জানল না, পাকা বাড়িগুলো তৈরি হচ্ছে ভূমিদাসদেরই কায়িক পরিশ্রমে, তাই কাগজপত্রে তাদের কাজের বোঝা কম দেখানো হলেও আসলে সেটা আরো বেড়ে গেছে। এইভাবে জমিদারি পরিদর্শন করে পিয়ের খুব খুশি হল, মানবপ্রেমে তার মন ভরে উঠল, এবং গুরুভাইকে (মহাপ্রভুকে সে এই নামেই ডাকে) উৎসাহভরা চিঠিপত্র লিখল।
মনে মনে বলল, কত সহজে, কত অল্প চেষ্টায় কত ভালো কাজ করা যায়, অথচ সেদিকে আমরা কত অল্প মনোযোগ দিই!
সকলের কাছ থেকে এত কৃতজ্ঞতা পেয়ে সে খুশি হল, আবার লজ্জাও পেল। এই কৃতজ্ঞতা তাকে স্মরণ করিয়ে দিল, এইসব সরল সদয় লোকগুলির জন্য আরো কত বেশি সে করতে পারত।
বড় নায়েবটি যেমন দুষ্টু তেমনই ধূর্ত। সরল বুদ্ধিমান কাউন্টটিকে সে ভালোই চিনে নিয়েছে, তাকে নিয়ে হাতের পুতুলের মতো খেলছে, মনিবের খোশ মেজাজ লক্ষ্য করে সে তাকে আরো বেশি করে বোঝাতে লাগল যে ভূমিদাসদের মুক্তি দেওয়া যেমন অসম্ভব তেমনই অদরকারি, কারণ বর্তমান ব্যবস্থাতেই তারা বেশ সুখে আছে।
মনে মনে পিয়েরও নায়েবের সঙ্গে একমত, এদের চাইতে অধিকতর সুখী লোকের কল্পনা করাও শক্ত, মুক্তি পেলে এদের অবস্থা যে কি দাঁড়াবে তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। তবু অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে যে কাজকে সঠিক বলে মনে করে তার উপরেই জোর দিতে লাগল। নায়েবও কথা দিল, কাউন্টের ইচ্ছাপূরণের জন্য সে সাধ্যমতো চেষ্টা করবে। জমি ও জঙ্গল বিক্রির সবরকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না এবং ভূমিরাজস্ব ব্যাংক থেকে জমি খালাসের চেষ্টা করা হয়েছে কি না সেটা যে কাউন্ট কোনোদিনই বুঝতে পারবে না সে কথা নায়েব ভালো করেই জানে। সে আরো জানে, এ ব্যাপারে কাউন্ট হয়তো আর কোনো খোঁজই করবে না এবং নতুন তৈরি বাড়িগুলো যে খালি পড়ে থাকবে এবং ভূমিদাসরা অন্য সব জমিদারির ভূমিদাসদের মতোই টাকা ও শ্রম দিয়ে যেতে থাকবে–অর্থা তাদের কাছ থেকে সবকিছু নিঙড়ে নেওয়া হবে, তাও সে কোনোদিনই জানতে পারবে না।