০৫.
রোদ উঠে গেছে।
বৈশাখ মাস—অল্প সময়েই রোদ ঝাঁঝাল হয়ে ওঠে।
ছোট্ট দলটি, যার নেতৃত্ব দিচ্ছে আজিজ মাস্টার, রোদে দাঁড়িয়ে ঘামছে। তাদের মুখ রক্তশূন্য। তারা বুকের মাঝে এক ধরনের কাঁপুনি অনুভব করছে।
রাস্তার ওপাশে চার-পাচটা জারুল গাছ। গাছের নিচে গেলে ছায়া পাওয়া যায়। কিন্তু সেখানে যাওয়া ঠিক হবে কি না আজিজ মাস্টার বুঝতে পারছে না। তারা জড়াজড়ি হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ধ্বনি দেয়। আড়চোখে মিলিটারিদের দিকে তাকায়। সরাসরি তাকাতে সাহসে কুলোয় না। সমস্ত বারান্দা জুড়ে মিলিটারিরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কেউ বসে আছে। কেউ মাথার নিচে হাভারস্যাক দিয়ে ঘুমের মতো পড়ে আছে। পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে এগিয়ে আসা দলটির প্রতি তাদের কোনো উৎসাহ দেখা গেল না। তাদের দৃষ্টি সন্ন্যাসীদের মতো নির্লিপ্ত। যেন জগতের কোনো কিছুতেই তাদের কিছু আসেযায় না।
পাকিস্তানের ফ্ল্যাগটি মতি মিয়ার হাতে। সে হাত উঁচু করে ফ্ল্যাগটি দোলাচ্ছিল—হাত ব্যথা হয়ে গেছে, কিন্তু নামাবার সাহস হচ্ছে না। আজিজ মাস্টার খুকখুক করে কয়েক বার কাশল। সেই শব্দে বারান্দায় বসা কয়েক জন তাকাল তার দিকে। আজিজ মাস্টার প্রাণপণে কাশি চাপতে চেষ্টা করল। সময় খারাপ। এ-রকম সময়ে কাউকে অযথা বিরক্ত করা ঠিক না। কিন্তু ক্রমাগত কাশি উঠছে। আজিজ মাস্টার লক্ষ করল উঠোনে চেয়ার পেতে যে-অফিসারটি বসে আছেন, তিনি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার দিকে।
অত্যন্ত রূপবান একজন মানুষ। মিলিটারি পোশাকেও তাঁকে রাজপুত্রের মতো লাগছে। এঁর চোখে-মুখে কোনো ক্লান্তি নেই। তবে বসে থাকার ভঙ্গিটি শ্রান্তির ভঙ্গি। তিনি তাঁর সামনের টেবিলে পা তুলে দিয়েছেন। পায়ে খয়েরি রঙের মোজা। মানুষটি প্রকাণ্ড, তবে সেই তুলনায় পায়ের পাতা দুটি ছোট।
তাঁর কাছাকাছি যে-রোগা লোকটি দাঁড়িয়ে আছে তাকে দেখতে বাঙালিদের মতো লাগছে। তার গায়ে চকচকে নীল রঙের একটা শার্ট। এই লোকটি খুব ঘামছে। ময়লা একটা রুমালে ক্রমাগত ঘাড় মুছছে। অফিসারটি মৃদু স্বরে কী যেন বলল নীল শার্ট পরা লোকটিকে। নীল শার্ট তীক্ষ্ণ গলায় বলল, আপনাদের মধ্যে হেডমাস্টার সাহেব কে?
আজিজ মাস্টারের বুকের মধ্যে শিরশির করতে লাগল।
কে আপনাদের মধ্যে হেডমাস্টার?
মতি মিয়া আজিজ মাস্টারের পিঠে মৃদু ধাক্কা দিল। আজিজ মাস্টার কাশির বেগ থামাতে-থামাতে বলল, জ্বি আমি।
আপনি থাকেন। অন্য সবাইকে যেতে বলেন। যান ভাই, আপনারা সবাই যান। ভয়ের কিছুই নাই।
আজিজ মাস্টার একা দাঁড়িয়ে রইল। অন্যরা মনে হল হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। তবে তারা চলে গেল না। জুম্মাঘরের কাছে ছাতিম গাছের নিচে বসে রইল চুপচাপ। ব্যাপারটা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মাস্টার ফিরে না আসা পর্যন্ত কিছু পরিষ্কার হবে না।
মতি বিড়ি ধরিয়ে টানতে লাগল। সে জয়নাল মিয়ার সামনে বিড়ি খায় না। এই কথা তার মনে রইল না। সময়টা খারাপ। এই সময় কোনো কিছু মনে থাকে না। ছোট চৌধুরীও সিগারেট ধরালেন। তিনি সকাল থেকেই ঘামছেন।
মতি মিয়া বলল, ভয়ের কিছু নাই, কি কন?
নাহ্, ভয়ের কি? এরা বাঘও না, ভাল্লুকও না।
একেবারে খাঁটি কথা।
অন্যায় তো কিছু করি নাই। অন্যায় করলে একটা কথা আছিল।
একেবারে খাঁটি কথা। অতি লেহ্য কথা।
জয়নাল মিয়া উৎসাহিত বোধ করে। মতি বলল, নীলু চাচার বাড়িত যাই চলেন। কথাটা তার খুব মনে ধরে। কিন্তু আজিজ মাস্টার ফিরে না-আসা পর্যন্ত নড়তেও ইচ্ছে করে না। রোদ চড়তে শুরু করে। ছাতিম গাছের নিচে একটি দুটি করে মানুষ জমতে শুরু করে। সবার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা। ঝাঁ-ঝাঁ করছে রোদ।
উত্তর বলে বোরো ধান পেকে আছে। কাটতে হবে। কিছু-কিছু জমিতে পাট দেওয়া হয়েছে। খেত নিড়ানির সময় এখন। দক্ষিণ বন্দে আউশ বোনা হবে। কিন্তু আজ মনে হয় এ-গ্রামের কেউ কোথাও যাবে না। আজকের দিনটা চাপা উত্তেজনা নিয়ে সবাই অপেক্ষা করবে। এ-গ্রামে বহুদিন এ-রকম ঘটনা ঘটে নি।
বদিকে দেখা গেল ফর্সা জামা গায়ে দিয়ে হনহন করে আসছে। তার বগলে ছাতা। ছাতিম গাছের নিচে একসঙ্গে এতগুলি মানুষ দেখে হকচকিয়ে গেল।
বিষয় কি?
মতি মিয়া ঠাণ্ডা গলায় বলল, জান না কিছু?
কী জানুম?
আরে মুসিবত! জান লইয়া টানাটানি, আর—কিছুই জান না?
বদি চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকায়। কিছু বুঝতে পারে না। জয়নাল মিয়া ঠাণ্ডা গলায়। লে, গেরামে মিলিটারি আইছে।
এইটা কী বল? এইখানে মিলিটারি আইব ক্যান?
স্কুলঘরে গিয়া নিজের চউক্ষে দেখ। আজিজ মাস্টাররে রাইখ্যা দিছে।
এ্যাঁ!
আজ মধুবনে গিয়া কাম নাই, বাড়িত যাও।
বদি রাস্তার উপর বসে পড়ে। ফিসফিস করে বলে, কী সর্বনাশ!
জয়নাল মিয়া বিরক্ত হয়ে বলে, সর্বনাশের কী আছে? আমরা কী করলাম? কিছু করছি আমরা?
বদি মুখ লম্বা করে বসে থাকে। একসময় মৃদু স্বরে বলে, মুসলমানের জন্যে ভয়ের কিছুই নাই। এরা মুসলমানদের খুব খাতির করে। তবে পাক্কা মুসলমান হওয়া লাগে। চাইর কলমা জিজ্ঞেস করে।
সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। চার কলেমা কারো জানা নেই। বদি উৎসাহিত হয়ে বলে, সুন্নত হইছে কি না এইটাও দেখে। কাপড় খুইলা দেখে।
তুমি জানলা ক্যামনে?
নান্দাইল রোডে হুনছি। সুন্নত না থাকলেই দুম। গুল্লি।
কও কী তুমি!
মিলিটারি মানুষ, রাগ বেশি। আমরার মতো না। রাগ উঠলেই দুম।
বদি একটি বিড়ি ধরিয়ে দ্রুত টানতে থাকে। তার মধুবনে যাওয়া অত্যন্ত দরকার। কে জানে হয়তো মধুবনেও মিলিটারি এসে দোকানপাট জ্বালিয়ে দিয়েছে। সে উঠে দাঁড়াল। মতি মিয়া বলল, যাও কই? বদি তার উত্তর না দিয়ে উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করল। ইস্কুলঘরকে পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। হাঁটতে হবে অনেকটা পথ।
কড়া রোদ উঠছে। আকাশে মেঘের লেশমাত্র নেই। চারদিকে ঝাঁ-ঝাঁ করছে রোদ। বদি হনহন করে ছুটছে।
০৬.
রোগা নীল শার্ট পরা লোকটি বাঙালি।
সে আজিজ মাস্টারের দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলল, ইনি মেজর এজাজ আহমেদ, ইনারে সালাম দেন। আজিজ মাস্টার যন্ত্রের মতো বলল, স্নামালিকুম। মেজর এজাজ পরিস্কার বাংলায় বললেন, আপনার নাম কি?
জ্বি, আমার নাম আজিজুর রহমান মল্লিক।
সে ইট এগেইন।
আজিজ মাস্টার নীল শার্ট পরা লোকটির দিকে তাকাল। সে ঠাণ্ডা গলায় বলল, নামটা আরেকবার বলেন। স্পষ্ট করে বলেন। গলায় জোর নাই?
আজিজ মাস্টার বলল, আজিজুর রহমান মল্লিক।
আপনি বসুন।
কোথায় বসতে বলছে? বসার দ্বিতীয় কোনো চেয়ার নেই। মাটিতে বসতে বলছে নাকি? আজিজ মাস্টারের গলা শুকিয়ে গেল। রোগা লোকটি স্কুলঘর থেকে একটি চেয়ার নিয়ে এল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, বসেন। স্যার বসতে বলেছেন, বসেন। আজিজ মাস্টার সঙ্কুচিত ভঙ্গিতে বসল। মেজর সাহেব দীর্ঘ সময় কোনো কথাবার্তা বললেন না। সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন আজিজ মাষ্টারের দিকে। আজিজ মাস্টার কাঁপা গলায় বলল, স্যার, ভালো আছেন? রোগা লোকটি বলল, শুনেন ভাই, আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাবেন না। যা জিজ্ঞেস করবে শুধু তার জবাব দিবেন। ইনি লোক ভালো, ভয়ের কিছু নাই। স্যার বাংলা বলতে পারেন না, কিন্তু ভালো বুঝেন।
জ্বি আচ্ছা।
আপনার ভয়ের কিছু নাই। আরাম করে বসেন।
আজিজ মাস্টার আরাম করে বসার একটা ভঙ্গি করল। মেজর সাহেব একটা। সিগারেট ধরালেন। প্যাকেটটি বাড়িয়ে দিলেন আজিজ মাস্টারের দিকে। আণ্ডিও মাস্টার ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। রোগা লোকটি বলল, স্যার দিচ্ছেন যখন নেন। বললাম না—ইনি লোক ভালো। আজিজ মাস্টার একটা সিগারেট নিল। কী আশ্চর্য! মেজর সাহেব নিজে সিগারেটটি ধরিয়ে দিলেন। আজিজ মাস্টার তার ভদ্রতায় মুগ্ধ হয়ে গেল। অত্যন্ত শরিফ আদমি।
পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত কথাবার্তা হল। মেজর সাহেব প্রশ্ন করলেন ইংরেজিতে, আজিজ মাস্টার জবাব দিল বাংলায়। কিছু প্রশ্ন আজিজ মাস্টার বুঝতে পারল না। নীল শার্ট পরা লোকটি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিল।
তোমার নাম আজিজুর রহমান মল্লিক?
জ্বি স্যার।
মল্লিক মানে কি?
জানি না স্যার।
এই গ্রামে কত জন মানষ?
জানি না স্যার।
কত জন হিন্দু আছে?
জানি না স্যার।
তুমি দেখি কিছুই জান না!
স্যার, আমি বিদেশি মানুষ।
বিদেশি মানুষ মানে? তুমি পাকিস্তানি না?
জ্বি স্যার।
তাহলে তুমি বিদেশি হলে কীভাবে?
মেজর সাহেব চোখ বন্ধ করে জবাবের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। আজিজ মাস্টারের মাথায় কোনো জবাব এল না।
তুমি ইকবাল জিন্দাবাদ বলছিলে, ইকবাল কে?
কবি স্যার। বড়ো কবি। মহাকবি।
তুমি তার কবিতা পড়েছ? জ্বি-না স্যার।
পড় নাই—চীন ও আরব হামারা সারা জাঁহা হ্যায় হামরা?
জ্বি-না স্যার।
মেজর সাহেব আরেকটি সিগারেট ধরালেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন। আজিজ মাস্টার লক্ষ করল লোকটিকে দূর থেকে যত অল্পবয়স্ক মনে হচ্ছিল আসলে তার বয়স তত অল্প নয়। চোখের নিচে কালি। কপালের চামড়ায় সূক্ষ্ম ভাঁজ। কত বয়স হতে পারে? পঁয়ত্রিশের কম নয়। আজিজ মাস্টারের বয়স আটত্রিশ। এই লোকটি তার য়ে তিন বছরের ছোট। অথচ এই লোকটির সামনে নিজেকে কেমন কেঁচোর মতো লাগছে।
মেজর সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। পা থেকে মোজা জোড়া টেনে খুলে ফেললেন। আবার প্রশ্ন-উত্তর শুরু হল।
এ-গ্রামে কোনো দুষ্ট লোক আছে?
জ্বি-না স্যার।
মুক্তিবাহিনী আছে?
জ্বি-না স্যার।
তুমি ঠিক জান?
জ্বি স্যার।
এই গ্রামের সবাইকে আমি চিনি।
তোমার ধারণা এই গ্রামে মুক্তিবাহিনী নেই?
জ্বি-না।
মেজর সাহেব মৃদু হাসলেন। কেন হাসলেন কে জানে। তিনি কি বিশ্বাস করছেন? আজিজ মাস্টার আবার বলল, মুক্তিবাহিনী নাই স্যার।
শেখ মুজিবের লোকজন আছে?
জ্বি-না স্যার।
তুমি জ্বি-না স্যার ছাড়া অন্য কিছু বলছ না কেন? তুমি কি ভয় পাচ্ছ? ভয় পাচ্ছি তুমি?
জ্বি-না স্যার।
গুড। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমার দিকে ভালো করে তাকাও। কাও ভালো করে।
আজিজ মাষ্টার তাকাল। মেজর সাহেবের চোখ দুটি তার কাছে একটু নীলচে মনে হল। বিড়ালচোখো নাকি?
আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি খারাপ লোক?
জ্বি-না স্যার।
কফি খাবে?
আজিজ মাস্টার চোখ তুলে তাকাল। রোগা লোকটি বলল, খেতে চাইলে বলেন—খাব! আমার দিকে তাকান কেন? অভ্যাস না থাকলে বলেন—খাব না। ব্যস। বারবার আমার দিকে তাকাবেন না।
কি, কফি খাবে?
জি–না স্যার।
না কেন, খাও। কফি তৈরি হচ্ছে। তুমি কি কফির সঙ্গে ক্রীম খাও?
আজিজ মাষ্টার না-বুঝেই মাথা নাড়ল। কফি এসে পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যে। অতি বিস্বাদ ডিনিস। আজিজ মাস্টার চুকচুক করে কফি খেতে লাগল। কাপ নামিয়ে রাখার সাহস হল না।
বুঝলে আজিজ, পাকিস্তানি মিলিটারির নামে আজগুবি সব গল্প ছড়ানো হচ্ছে। আমরা নাকি কোথায় কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে দুটি মুক্তিবাহিনীর ছেলেকে মেরেছি। গল্পটা তোমার বিশ্বাস হয়?
আজিজ মাস্টার জবাব দিল না। মেজর সাহেব অনেকটা সময় নিয়ে সিগারেট ধরালেন। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আমরা কাঠুরে হলে সেটা করতাম। কিন্তু, আমরা কাঠুরে নই, আমরা সৈনিক। আমরা গুলি করে মারব। ঠিক না?
জ্বি স্যার।
হিন্দুস্থান বেতারে এসব প্রচার চালাচ্ছে, এবং অনেকেই এ-সব শুনছে। ঠিক? বল, ঠিক বলছি কি না।
জি-স্যার, ঠিক।
আচ্ছা, এ-গ্রামে ট্রানজিষ্টার আছে কার কার? তোমার আছে?
আজিজ মাস্টারের গলায় কফি আটকে গেল। তার আছে এবং সে স্বাধীন বাংলা বেতার শোনে।
কি, আছে?
জ্বি স্যার।
কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই শোন না।
মাঝে মাঝে শুনি স্যার।
শুনলেও নিশ্চয়ই বিশ্বাস কর না। ঠিক না?
মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয়।
আজিজ।
জ্বি স্যার।
তুমি একজন সৎলোক। অন্য কেউ হলে বলত বিশ্বাস হয় না। আমার মনে হয়। তুমি মিথ্যা একেবারেই বলতে পার না। আচ্ছা এখন বল, আর কার ট্রানজিস্টার আছে?
নীলু সেনের আছে। জয়নাল মিয়ার আছে।
ওরা কেমন লোক?
ভালো লোক স্যার। নির্বিরোধী মানুষ। এই গ্রামে খারাপ মানুষ কেউ নাই।
তাই নাকি?
জ্বি স্যার।
আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি যাও। ভয়ের কিছু নেই।
আজিজ মাস্টার উঠে দাঁড়াল। তার মনে হল, মেজর সাহেব একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক।
স্নামালিকুম স্যার।
ওয়ালাইকুম সালাম।
আজিজ মাস্টারের কেন যেন মনে হল এক্ষুণি তাকে আবার ডাকা হবে। সে এগোতে লাগল খুব সাবধানে। কিন্তু কেউ তাকে ডাকল না। প্রায় ত্রিশ গজের মতো যাওয়ার পর সে ভয়েভয়ে এক বার পেছনে তাকাল—মেজর সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার সঙ্গের রোগা লোকটিও চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছে। আজিজ মাস্টারের বুক ধক করে উঠল। কেন উঠল কে জানে। এক বার পেছন ফিরে আবার মুখ ফিরিয়ে চলে যাওয়া যায় না। আজিজ মাস্টার দ্বিতীয় বার বলল, স্লমালিকুম।
মেজর সাহেব তখন তাকে হাত ইশারা করে ডাকলেন। নীল শার্ট পরা লোকটি বলল, এই যে মাস্টার সাহেব, এদিকে আসেন ভাই। স্যার ডাকেন। আজিজ মাস্টার ফিরে এল। মেজর সাহেব হাসিমুখে বললেন, শুনলাম তুমি কবিতা লেখ। আজিজ মাস্টার বেকুবের মতো তাকাল। সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
এখানকার মসজিদের যে ইমাম সাহেব আছে, তার কাছে শুনলাম। তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তুমি কি সত্যি কবিতা লেখ?
জ্বি স্যার।
বেশ। একটা কবিতা শোনাও। কবিতা আমি পছন্দ করি। শোনাও একটা কবিতা।
আজিজ মাস্টার তাকাল নীল শার্ট পরা লোকটির দিকে। সে শুকনো গলায় বলল, স্যার শোনাতে বলছে শোনান। চেয়ারে বসেন। বসে শোনান। ভয়ের কিছু নাই।
আজিজ মাস্টার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। মেজর সাহেব বললেন, বল, বল, সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। লেটেস্ট কবিতাটি বল। আজিজ মাস্টার যন্ত্রের মতো চার লাইন বলে গেল :
আজি এ নিশিথে তোমারে
পড়িছে মনে
হৃদয়ে যাতনা উঠিছে জাগিয়া ক্ষণে
ক্ষণে,
তুমি সুন্দর চেয়ে থাকি তাই কল্পলোকের চোখে
ভালবাসা ছাড়া নাই কিছু আর মোর মরুময় বুকে।
নীল শার্ট সেটি অনুবাদ করে দিল। মেজর সাহেব বললেন, এটিই তোমরা লেটেস্ট?
জ্বি স্যার।
ভালো হয়েছে। বেশ ভালো। তা মেয়েটি কে।
জ্বি স্যার?
কবিতার মেয়েটি কে? ওর নাম কি?
মালা।
মেয়েটি এখানেই থাকে?
আজিজ মাস্টার কপালের ঘাম মুছল। শুকনো গলায় বলল, এইখানেই থাকে।
তোমার স্ত্রী নাকি?।
জ্বি না স্যার। আমি বিয়ে করি নি।
এই মেয়েটিকে বিয়ে করতে চাও?
আজিজ মাস্টার ঢোক গিলল। বলে কী এই লোক!
কী, বল। চুপ করে আছ কেন? নাকি মেয়ের বাবা তোমার মতো বুড়োর কাছে। বিয়ে দিতে চায় না?
আজিজ মাস্টার খুকখুক করে কাশতে লাগল। নীল শার্ট তীক্ষ্ণ গলায় বলল, স্যারের কথার জবাব দেন। স্যার রেগে যাচ্ছেন।
মেজর সাহেব কৌতূহলী হয়ে তাকালেন। তাঁর চোখ দুটি খুশি-খুশি। বল, মেয়েটির বয়স কত?
বয়স কম।
কত?
তের-চোদ্দ।
তের-চোদ্দ বছরের মেয়েই তো ভালো। যত কম বয়স তত মজা।
আজিজ মাস্টার স্তম্ভিত হয়ে গেল। কী বলছে এসব।
মেয়েটির সঙ্গে তোমার যৌন সম্পর্ক আছে?
না।
মাথা নিচু করে আছ কেন?
মাথা তোল।
আজিজ মাস্টার মাথা তুলল।
মেয়েটির বুক কেমন আমাকে বল। আমি শুনেছি বাঙালি মেয়েদের বুক খুব সুন্দর, কথাটা কি ঠিক?
আমি জানি না।
জান না! বল কী! তুমি এখনো কোনো মেয়ের বুক দেখ নি?
আমি বিয়ে করি নি।
তাতে কী?
আজিজ মাষ্টারের কান ঝাঁ-ঝাঁ করতে লাগল। বমি-বমি ভাব হল। মেজর সাহেব হঠাৎ সুর পাল্টে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটি কার? আই মিন ওর বাবার নাম কি? আজিজ মাস্টার জবাব দিল না! মেজর সাহেব অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললেন, শুধু শুধু দেরি করছ, বলে ফেল। নীল শার্ট বলল, কেন শুধু শুধু রাগাচ্ছেন? বলে দেন না!
জয়নাল মিয়ার মেয়ে। উনার বড় মেয়ে।
যার বাড়িতে ট্রানজিস্টার আছে?
আজিজ মাস্টার বেশ অবাক হল। এই লোকটির স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো। মনে রেখেছে।
তুমি এখন আর আগের মতো স্বতস্ফূর্তভাবে কথা বলছ না। প্রতিটি প্রশ্ন দু বার করে করতে হচ্ছে। কারণ কি?
আজিজ মাস্টার জবাব দিল না।
তুমি কি আমার উপর রাগ করেছ! বল, রাগ করেছ?
না।
এখন তুমি আর স্যার বলছ না। কেন? নিশ্চয়ই তুমি আমার উপর রাগ করেছ।
জ্বি-না স্যার।
মেজর সাহেব অনেকখানি ঝুঁকে এলেন আজিজ মাস্টারের দিকে। গলার স্বর নিচে নামিয়ে বললেন, শোন, ঐ মেয়েটির সঙ্গে আমি তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আজ রাতে সম্ভব হবে না। আজ রাতে আমরা ব্যস্ত। কাল ভোরে। কি, তুমি খুশি তো?
আজিজ মাস্টার তাকিয়ে রইল।
কি, কথা বলছ না যে? বল, শুকরিয়া।
শুকরিয়া।
আমি কথার খেলাফ করি না। যা বলেছি তা করব। এখন তুমি আমার কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দাও।
মেজর সাহেব সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিলেন। নিজে একটি ধরালেন। তাঁর চোখে এখন আর হাসি ঝিকমিক করছে না।
তোমাদের এই জঙ্গলা-মাঠে কী আছে?
কিছু নাই। জঙ্গল।
আমরা জানি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বেশ কিছু জোয়ান এবং কয়েক জন। অফিসার এখানে লুকিয়ে আছে।
আজিজ মাস্টারের চোখ বড়-বড় হয়ে গেল।
ওরা আমাদের দু জন অফিসারকেও নিয়ে গেছে। এক জন হচ্ছে আমার বন্ধু মেজর বখতিয়ার। ফুটবল প্লেয়ার।
আমি কিছুই জানি না স্যার।
কিছুই জান না?
জ্বি-না স্যার।
আমি যত দূর জানি, এ-গ্রাম থেকেই তো ওদের খাবার যাচ্ছে।
আমি স্যার, কিছুই জানি না।
আমি ভাবছিলাম জান।
জানি না স্যার।
মেজর সাহেব চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানতে লাগলেন। প্রচণ্ড প্রস্রাবের বেগ হয়েছে আজিজ মাস্টারের। সে ভয়েভয়ে বলল, স্যার, আমি যাই?
মেজর সাহেব চোখ না-খুলেই বললেন, সেটা কি ঠিক হবে? আমরা ওদের ধরতে এসেছি। এখন তোমাকে যেতে দিলে খবরটা ওদের কাছে পৌঁছে যেতে পারে। পারে না?
আজিজ মাস্টার ঢোক গিলল।
তুমি ঐ ঘরে আজ রাতটা কাটাও। আমরা অপারেশন শুরু করব বিকেলের দিকে। আরেকটি বড় কোম্পানি আসবে আমাকে সাহায্য করতে। ওদের জন্যেই অপেক্ষা। করছি।
আজিজ মাস্টারের হাঁপানির টান উঠে গেল। টেনে-টেনে শ্বাস নিতে লাগল। মেজর সাহেব হালকা গলায় বললেন, তোমাকে অনেক গোপন খবর দিয়ে দিলাম। তবে অসুবিধা নেই, তুমি বন্ধু-মানুষ। যাও, ঐ ঘরে চলে যাও।
স্যার, আমি কিছুই জানি না।
জান না—সে তো আগেই বলেছ। সবাই কি আর সব কিছু জানে? জানে না। যাও, ঐ ঘরে গিয়ে বসে থাক।
রোদ থেকে এসেছে বলেই কি না কে জানে, এত পরিচিত ঘরও আজিজ মাস্টারের কাছে অচেনা লাগতে লাগল। অথচ এটা টীচার্স রুম। আজিজ মাস্টার রোজ এখানে বসে।
মাস্টার সাব।
কে?
আজিজ মাস্টার অবাক হয়ে দেখল, একটা চেয়ারে ইমাম সাহেব জড়সড় হয়ে বসে আছেন। ইমাম সাহেবের নাক-মুখ ফুলে গেছে। নিচের ঠোঁটটি কেটে গেছে। তাঁর সাদা পাঞ্জাবিতে রক্তের ছোপ। কাটা ঠোঁট দিয়ে হলুদ রঙের রস বেরুচ্ছে। আজিজ মাস্টার দীর্ঘ সময় তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল এবং নিজের অজান্তেই এক সময় তার প্রস্রাব হয়ে গেল।
ইমাম সাহেব তাকিয়ে দেখলেন। মেঝেতে প্রস্রাব গড়াচ্ছে। তার কোনো ভাবান্তর হল না।
০৭.
দিনের বেলা মীর আলির কাজ হচ্ছে পরীবানুকে কোলে নিয়ে বারান্দায় বসে থাকা। পরীবানুর বয়স তিন। দাদাকে সে খুবই পছন্দ করে। মীর আলিও জগতের অনেক জটিল বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলে। মীর আলির কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হওয়া। অস্বাভাবিক নয় যে সে পরীবানুর মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়।
আজ ভোরবেলাও সে নাতনীকে কোলে নিয়ে মুড়ি খেতে বসেছিল। দাঁত না থাকায় মুড়ি চিবোতে পারে না। একগাল মুড়ি নিয়ে তাকে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয়। ঘরে আম আছে। একটা পাকা আমের রস মুড়ির বাটিতে ঢেলে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়। অনুফা সেটা করবে না। যদি বাড়িতে না-থাকলে সে তার শ্বশুরের খাওয়াদাওয়ার দিকে তেমন নজর দেয় না।
আজ তার চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। ঘরে চায়ের পাতা আছে, গুড় আছে। বদি এনে রেখেছে। তার বাবার জন্যেই এনেছে। তিনি নিজের কানে শুনেছেন–বদি বলছে, বাজানরে মাঝেমধ্যে দিও। বুড়া মানুষ। চা-য় কাশির আরাম হয়।
মীর আলি প্রতিদিন ভোরেই বেশ সাড়ম্বরে খানিকক্ষণ কাশে, যাতে অনুফার চায়ের কথাটা মনে পড়ে। বেশির ভাগ দিনই তার মনে পড়ে না। আজও হয়তো পড়বে না। তবু সে কাশতে লাগল। কাশতে-কাশতেই পরীবানুকে বলল, চা হইল সর্দিকাশের বড়ো অষুধ। বুঝছস পরী?
পরী উত্তর দিল না।
বড় জামবাটির এক বাটি চা যদি সকালে খায় কেউ, তা হইলে সর্দিকাশি, বাত। সব যায়। চাটা খুব বড় অষুধ।
মীর আলির জন্যে আজ দিনটি সম্ভবত খুব শুভ। কারণ অনুফা তাকে এক বাটি চা এনে দিল। সেই চায়ে তেজপাতা দেওয়ায় বেশ সুন্দর একটা গন্ধ। অভিভূত হয়ে পড়ল মীর আলি।
মিষ্টি হইছে কি না দেখেন।
হইছে গো বেটি, হইছে। জবর বালা হইছে।
অনুফাকে দু-একটা সুন্দর-সুন্দর কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কী বললে সে। খুশি হয় তা মীর আলির জানা নেই।
মুড়ি চায়ের মইধ্যে ভিজাইয়া চামুচ দিয়া খান। চামুচ দিতাছি।
মীর আলি অনুফার প্রতি বড় মমতা বোধ করল। সংসারের আয়-উন্নতি যা হচ্ছে। এই মেয়েটির কারণেই হচ্ছে। ঘরে এখন চামচ আছে। নতুন সাইকেল আছে। গত বৎসর বদি তাকে লেপ বানিয়ে দিয়েছে। বলতে গেলে গত শীত কোন দিকে গিয়েছে বুঝতেই পারা যায় নি। অথচ বদিকে বিয়ে করানোর আগে কী হাল ছিল সংসারের। সব ভাগ্য। একেক জনের একেক রকম ভাগ্য। অনুফা এ-সংসারে ভাগ্য নিয়ে এসেছে। মীর আলি ভাবতে চেষ্টা করল, অনুফা এ-বাড়িতে আসার পর তারা কি কখনো এক বেলা না-খেয়ে থেকেছে? না। নীলগঞ্জের এ-রকম ভাগ্য কয় জনের আছে? অথচ কত ঝামেলা বদির বিয়েতে। শেষ মুহূর্তে বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার অবস্থা। বদির মামা বলল, এই মেয়ের মা নাই। জামাইয়ের কোনো আদর হইত না। কথা খুবই সত্য। কিন্তু বিয়ের কথা ঠিকঠাক হবার পর বিয়ে ভেঙে দেওয়াটা ঠিক না। মনে খুতখুতানি নিয়ে সে ছেলে নিয়ে গেল। কী ঝড় বিয়ের রাত্রে! লণ্ডভণ্ড অবস্থা। দুপুররাতে ছেলে-বৌ নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখল ঝড়ে গ্রামে কারোর কোনো ক্ষতি হয় নি, শুধু তার ঘরটি পড়ে গেছে। কী অলক্ষণ!
দাদা, চা দেও।
পুলাপান মাইনষের চা খাওন নাই।
চা দেও, দাদা।
মীর আলি হাঁক দিল, বৌমা, আরেকটা বাটি দেও। এই সময় এক ঝাঁক গুলি হল। হালকা মেশিনগানের কানে তালা-ধরানো ক্যাটক্যাট শব্দ। পরীবানু আকাশ ফাটিয়ে কাঁদতে লাগল। মীর আলি উঠে দাঁড়াতে গিয়ে চায়ের বাটি উল্টে ফেলল পরীবানুর পায়ে।
নীলগঞ্জ গ্রামে ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। দ্বিতীয় একটা সৈন্যদল এসে ঢুকল। তারা ঢুকল মার্চ করে। গর্বিত ভঙ্গিতে। তাদের সঙ্গে আছে চল্লিশ জন রাজাকারের একটি দল। তালে-তালে পা ফেলবার একটা প্রাণান্ত চেষ্টা করছে তারা। দলটি অনেক দূর থেকে আসছে। এদের চোখেমুখে ক্লান্তি। হয়তো সারা রাত ধরেই হাঁটছে, কোথাও বিশ্রাম করে নি।
বদিউজ্জামান হনহন করে হাঁটছিল। হাঁটা না-বলে একে দৌড়ানো বলাই ঠিক হবে। কয়েক দিন বৃষ্টি না-হওয়ায় রাস্তাঘাট শুকনো। দ্রুত হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে না। তার একমাত্র চেষ্টা কত তাড়াতাড়ি মধুবন বাজারে গিয়ে পৌঁছানো যায়। মাঝমাঝি পথে সে মত বদলাল—ফিরে চলল নীলগঞ্জের দিকে। যা হবার হোক, এই সময় বাড়ি ছেড়ে বের হওয়া ঠিক না। জঙ্গলা-মাঠের কাছাকাছি আসতেই সে দ্বিতীয় মিলিটারি দলটিকে দেখতে পেল। ওরা আসছে উত্তর দিক থেকে। বদিউজ্জামান উর্ধ্বশ্বাসে ছুটল জঙ্গল মাঠের দিকে। হুমড়ি খেয়ে পড়ল নিচ একটা গর্তে। সেখানে একুকোমর পানি। তাকে কেউ সম্ভবত দেখতে পায় নি। বদিউজ্জামান এককোমর পানিতে ঘণ্টাখানেক বসে রইল। মিলিটারিদের এই সময়ের মধ্যে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু এরা যাচ্ছে না কেন? কিছুক্ষণ পর খুব কাছেই ওদের কথাবার্তা শোনা যেতে লাগল। এর মানে কী?
বদিউজ্জামান মাথা উঁচু করে দেখতে চেষ্টা করল। চোখের ভুল কি না কে জানে, তার মনে হল মিলিটারিরা জঙ্গলা-মাঠ ঘিরে বসে আছে। বদিউজ্জামান গলা পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে একটা মোরতা ঝোপের আড়ালে মাথা ঢেকে রাখল। মাথার উপর ঝা ঝাঁ করছে রোদ। কিন্তু পানি বেশ ঠাণ্ডা। বদিউজ্জামানের শীত-শীত করতে লাগল। কতক্ষণ বসে থাকতে হবে? গা কুটকুট করছে। সবুজ রঙের একটা গিরগিটি চোখ বড়-বড় করে তাকে দেখছে। বদিউজ্জামান হাত ইশারা করে তাকে সরে যেতে বলল। রোদ বাড়ছে। ক্রমেই বাড়ছে। পচা গন্ধ আসছে পানি থেকে। পাট পচানোর গন্ধের মতো গন্ধ। গিরগিটিটা পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। বদিউজ্জামান মদ স্বরে বলল—যা হোস। আর তখনি নীলগঞ্জের দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির শব্দ আসতে লাগল। কী ব্যাপার?
জয়নাল মিয়া তার দলবল নিয়ে দীর্ঘ সময় ছাতিম গাছের নিচে অপেক্ষা করল— আজিজ মাস্টার ফিরে এল না। কতক্ষণ এভাবে বসে থাকা যায়? রাসমোহন কয়েক বার বাঁশঝোপের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখে এসেছে। আজিজ মাস্টার চেয়ারে বসে। কথাবার্তা বলছে। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে সে এসে বলল—আজিজ মাস্টারকে আর দেখা যাচ্ছে না। এর মানেটা কী? জয়নাল মিয়া বলল, বিষয়টা কি, রাসমোহন? রাসমোহন শুকনো মুখে বসে রইল।
মাইরা ফেলছে নাকি?
মারলে গুলির শব্দ হইত! গুলি তো হয় নাই।
তাও ঠিক।
জয়নাল মিয়া মতি মিয়ার কাছ থেকে একটা বিড়ি নিয়ে ধরাল। তার সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। আর তখন মতি মিয়ার পাগল শালা নিজামকে আসতে দেখা গেল। তার মুখ হাসি-হাসি। পাগলামির অন্য কোনো লক্ষণ নেই। মতি মিয়া ধমকে উঠল, কই গেছিলা?
নিজামের হাসি আকর্ণ বিস্তৃত হল। সে হাত নেড়ে নেড়ে বলল, ইস্কুলঘরের পিছনের দিক দিয়া আইতেছিলাম, একটা মজার জিনিস দেখলাম, দুলাভাই।
কী দেখলা?
দেখলাম দুইটা মিলিটারি হাগতে বসছে। লজ্জাশরম নাই। হাগে আর কথা কয়। আবার হাগে, আবার কথা কয়।
নিজাম হাসতে-হাসতে ভেঙে পড়ল। ঠিক তখন গুলি ছুঁড়তে-ছুঁড়তে মিলিটারি ও রাজাকারের দ্বিতীয় দলটি গ্রামে উঠে এল। জয়নাল মিয়া উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াল দক্ষিণ দিকে। বাকিরাও তাকে অনুসরণ করল। নিজাম শুধু মুখটি হাসি-হাসি করে দাঁড়িয়ে রইল। সমস্তু ব্যাপারটিতে সে বড় মজা পাচ্ছে।
০৮.
ইমাম সাহেব এক সময় বললেন, দোয়া ইউনুসটা দমে দমে পড়েন মাস্টার সাব। আজিজ মাস্টার তাকাল তার দিকে তাকানোর ভঙ্গিতে মনে হয় সে কিছুই বুঝতে পারছে না। গত তিন ঘণ্টা যাবৎ এই দুটি মানুষ একসঙ্গে আছে। এই তিন ঘণ্টায় তাদের কথাবার্তা বিশেষ কিছু হয় নি। আজিজ মাস্টার তার পায়জামা ভিজিয়ে ফেলার পর থেকে কেমন অন্য রকম হয়ে গেছে। কোনো কিছুতে মন দিতে পারছে না।
হযরত ইউনুস আলায়হেস-সালাম মাছের পেটে এই দোয়া পড়তেন। এর মতবাই অন্য। দোয়াটা জানেন?
আজিজ মাস্টার মাথা নাড়ল। সে জানে। কিন্তু ইমাম সাহেবের মনে হল সে কিছু পড়ছে-টড়ছে না। বসে আছে নির্বোধের মতো।
মাস্টার সাব।
জ্বি।
আমাদের সামনে খুব বড় বিপদ।
কেন?
বুঝতে পারতেছেন না?
না।
এরা কি জন্যে আসছে সেটা বলেছে?
না।
তবু বুঝতে পারতেছেন না?
না।
ইমাম সাহেব চুপ করে গেলেন। আজিজ মাস্টার খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। এখান থেকে সৈন্যদলের একটা অংশ দেখা যায়। কয়েক জনকে দেখা যাচ্ছে কাগজের একটা বল বানিয়ে ছুড়ে-ছুঁড়ে মারছে। এবং ক্রমাগত হাসছে। কাগজের একটা বল ছুঁড়ে মারার মধ্যে এত আনন্দের কী আছে কে জানে?
স্কুলঘরটি টিনের। রোদে টিন তেতে উঠেছে। ঘরের ভেতর অসহ্য গরম। আজিজ মাস্টারের পানির তৃষ্ণা পেয়ে গেল। শুধু তৃষ্ণা নয়, ক্ষুধাও বোধ হচ্ছে। বেলা অনেক হয়েছে। ক্ষুধা হওয়ারই কথা। অন্য সময় এত দেরি হলে মালা খোঁজ নিত, মামা, ভাত বাড়ছে। আসেন। বলেই সে চলে যেত না। দরজা ধরে এঁকেবেঁকে দাঁড়াত। যেন সঙ্গে করে নিয়ে যাবে।
গতবার ময়মনসিংহ থেকে মালার জন্যে একটা আয়না কিনেছিল আজিজ মাস্টার। খুব বাহারি জিনিস। দুটা আয়না পাশাপাশি। একটি সাধারণ আয়না, অন্যটি একটু অন্য রকম। সেটায় মুখ অনেক বড়ো দেখা যায়।
আয়নাটা দেওয়া ঠিক হবে কি না তা নিয়ে আজিজ মাস্টার প্রায় এক সপ্তাহ ভাবল। কেউ কিছু মনে করে বসতে পারে। তাহলে খুব লজ্জার ব্যাপার হবে।
কেউ কিছু মনে করল না। মালা অভিভূত হয়ে পড়ল। একটা আয়নায় মুখ বড় দেখায় কেন—এই প্রশ্ন বেশ কয়েক বার করা হল। এমনকি মালার মা একদিন পর্দার আড়াল থেকে জিজ্ঞেস করে ফেলল, মখ বড় দেখালে কী লাভ? আজিজ মাস্টার লাজুক স্বরে বলেছিল, সাজগোজের সুবিধা হয়, ভাবী।
কী সুবিধা?
কি সুবিধা সেটি আর ব্যাখ্যা করতে পারে নি। কারণ এটা আজিজ মাস্টারেরও জানা ছিল না।
ইমাম সাহেব নড়েচড়ে বসলেন।
মাস্টার সাব।
বলেন।
জোহর নামাজের ওয়াক্ত হইছে না?
জানি না।
নামাজটা পড়া দরকার। বের হয়ে ওদের কাছে পানি চাব? ওজু নাই আমার।
দেখেন আপনি চিন্তা করে।
আপনি তো আর নামাজ পড়তে পারবেন না, শরীর নাপাক। গোসল লাগবে। পেশাব করে দিয়েছেন তো!
আজিজ মাস্টার জবাব দিল না। ইজি চেয়ারটিতে চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে পড়ে রইল। ইজি চেয়ারটি নীলু সেনের। শুয়ে থাকতে বড় আরাম।
মাস্টার সাব। পানি চাইব নাকি, বলেন?
আপনার ইচ্ছা হলে চান।
এর মধ্যে তো দোষের কিছু নেই। এরাও মুসলমান।
হুঁ।
নামাজের পানি চাইলে এরা খুশিই হবে। পাক্কা মুসলমানদের এরা খুব পেয়ার করে। এরাও তো সাচ্চা মুসলমান।
যান না। গিয়ে চান।
ভয় লাগে।
ভয়ের কী আছে?
ইমাম সাহেব নড়েন না। জড়সড় হয়ে চেয়ারেই বসে থাকেন। চোখ বন্ধ করে ইজি চেয়ারে শুয়ে থাকতে থাকতে আজিজ মাষ্টারের ঝিমুনি আসে। ঝিমুতে-ঝিমুতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। এর মধ্যেই ছাড়া-ছাড়া বেশ কয়েকটি স্বপ্ন দেখে। ঘুমের মধ্যেই বুঝতে পারে—এগুলি স্বপ্ন। তবু তার ভালোই লাগে।
ইমাম সাহেব বিরক্ত মুখে তাকিয়ে থাকেন তার দিকে। এ কেমন মানুষ—ঘুমিয়ে পড়েছে! তিনি মৃদু স্বরে ডাকেন, এই যে মাস্টার সাব। এই! আজিজ মাষ্টার নড়েচড়ে—কিন্তু তার ঘুম ভাঙে না।
নীলু সেন গত রাতে এক পলকের জন্যেও ঘুমুতে পারেন নি। দোতলার যে-ঘরটিতে তাঁর বিছানা, সে-ঘরের বারান্দায় গড়াগড়ি করেছেন। নীলু সেনের বোন-পো বলাই চোখ বড়-বড় করে মামার অবস্থা দেখেছে। রাত দুটোর দিকে বলাই ঠিক করল, মামার জন্যে ডাক্তার আনতে সরাইল বাজারে যাবে। পথঘাট এখন শুকনো। বদিউজ্জামানের সাইকেল নিয়ে যাওয়া যাবে। নীলু সেন হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, এতক্ষণ বাঁচব নারে বলাই, এতক্ষণ বাঁচব না। বলাইয়েরও তাই ধারণা হল। এত কষ্ট সহ্য করে কেউ দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারে না। থাকা উচিতও নয়।
ব্যথাটা কোথায়?
তলপেটে।
বলাই দ্বিতীয় প্রশ্নের সময় পেল না। নীলু সেনের মুখ দিয়ে গাঁজলা বেরুতে লাগল। সময় শেষ হয়েছে বোধহয়। এত বড় বাড়িতে দুটিমাত্র প্রাণী। বলাইয়ের ভয় করতে লাগল। কী সর্বনাশ! এ কী বিপদ।
মামা, গ্রামের দুই-এক জন মানুষরে ডাক দিয়া আনি?
তুই নড়িস না। আমার সময় শেষ।
বলাই মামার হাত ধরে বসে রইল। তার কাছে মনে হল মামার গা হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। বলাই ঘামতে লাগল।
কিন্তু শেষরাত্রে হঠাৎ ব্যথা কমে গেল। নীলু সেন শান্ত স্বরে বললেন, ব্যথা নাই। বলাই, ঠাণ্ডা পানি দে এক গ্লাস।
বলাই পানি এনে দেখে মামা মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
নিশ্চিন্ত আরামের ঘুম। বড় মায়া লাগে দেখে।
গ্রামে মিলিটারি আসার এত বড় একটা খবরেও বলাই তাঁর ঘুম ভাঙল না। আহা বেচারা, ঘুমাক।
নীলু সেনের ঘুম ভাঙল মিলিটারিরা। ডাকাডাকি হৈচৈ শুনে নীলু সেন দোতলার জানালা দিয়ে মুখ বের করলো। কী ব্যাপার? নীল শার্ট পরা একটি লোক বলল, আপনার নাম কি নীলু? নীলু সেন?
জ্বে আজ্ঞে।
আপনার বাড়িতে আর কে আছে?
বলাই। আমার বোন–পো বলাই। আপনারা কে?
বলাইকে নিয়ে নিচে নেমে আসেন।
নীলু সেন বলাইকে কোথাও খুঁজে পেলেন না। গায়ে একটা পাতলা সুজনি চড়িয়ে নিচে নেমে এলেন। ভারি দরজা খুলতে সময় লাগল। বাইরে থেকে অসহিষ্ণু কণ্ঠে কে যেন বলল, এত সময় লাগছে কেন?
নীলু সেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। তাঁর ঘুমের ঘোরও বোধহয় ভালোমতো কাটে নি। তিনি দরজা খুলে বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, আদাব।
তাঁর কথা শেষ হবার আগেই চার-পাঁচটি গুলির শব্দ হল। নীলু সেন কাত হয়ে পড়ে গেলেন দরজার পাশে। কোনো চিৎকার না—নিঃশব্দ মৃত্যু। নীল শার্ট পরা লোকটি ডাকল, বলাই! বলাই!