হ্যালো ছন্দা।
হুঁ।
কেমন আছিস?
ভালো কে?
গলা চিনতে পারছিস না?
ও আচ্ছা মৃন্ময়ী! তুই একেক সময় একেক স্বরে কথা বলিস চিনব কীভাবে?
মোবাইলের যুগে গলা চিনতে হয় না। কে টেলিফোন করেছে এম্নিতেই টের পাওয়া যায়। তার নাম উঠে। নাম্বার উঠে।
খেয়াল করি নি।
ঠিকই খেয়াল করেছিস। মাঝখান থেকে একটা ঢং করলি।
বিশ্বাস কর। খেয়াল করি নি। গড প্রমিজ।
কথায় কথায় গড় নিয়ে আসিস কেন? উনাকে শান্তিতে থাকতে দিবি না। উনাকে মিথ্যা কথার সাক্ষীও হতে হবে?
মৃন্ময়ী কী বলতে চাস বলে ফেল।
তোর পোট্রেট করা হবে।
কী করা হবে?
পোট্রেট। একজন আর্টিস্ট প্রতিদিন তোর বাসায় যাবেন। তুই এক ঘণ্টা করে সিটিং দিবি। তোর একটা পোট্রেট হবে। আমার একটা হবে। এই দুইটা ছবি আমি আমার ঘরে টানিয়ে রাখব। রোববার পরীক্ষা শেষ হচ্ছে। সোমবার থেকে আর্টিস্ট যাবে।
ছন্দা বলল, কোনো আর্টিস্ট আমার বাসায় আসবে, আমি সিটিং দেব, এটা কখনও হবে না। বাবা আমাকে বাসা থেকে বের করে নেবেন।
কেন?
মৃন্ময়ী তুই একটা জিনিস ভুলে যাচ্ছিস, আমি লোয়ার-মিডিল ক্লাসের মেয়ে। আমাদের বাসার ধ্যান-ধারণও লোয়ার-মিডিল ক্লাস টাইপ।
লোয়ার-মিডিল ক্লাসের ধ্যান-ধারণা কী?
এরা সব কিছু সন্দেহের চোখে দেখে। সন্দেহ এবং অবিশ্বাস। আর্টিস্ট বাসায় এসে ঢুকলেই বাবা ভাববেন প্রেমের কোনো ব্যাপার। তার মুখ গম্ভীর হয়ে যাবে।
তাহলে তুই এক কাজ কর, আমার বাড়িতে সিটিং দে।
তোর নতুন পাগলামীর মানে কী?
মানে হচ্ছে একজন বিখ্যাত আটিস্টকে দিয়ে তার ছবি আঁকানো।
বিখ্যাত না কি!
অবশ্যই বিখ্যাত।
ম্যারিড?
মৃন্ময়ী বলল, ম্যারিড না আনম্যারিড এটা জেনে কী হবে? তুই তো তাকে বিয়ে করতে যাচ্ছিস না।
ছন্দা বলল, এমি জিজ্ঞেস করলাম।
তোর বাবা যে তোকে কোথায় বিয়ে দেবার চেষ্টা করছে তার কী হলো?
জানি না। মৃন্ময়ী আমি এখন রাখি, পরে টেলিফোন করব। একটু আগে বাবা সামনে দিয়ে গিয়েছেন। বেশিক্ষণ টেলিফোনে কথা বলতে দেখলে তিনি রেগে যান।
বেশিক্ষণ তো হয় নি।
ছন্দা লাইন কেটে দিয়ে সেট অফ করে দিলো।
মৃন্ময়ীর স্বভাব হচ্ছে একবার টেলিফোন করে থামে না। পর পর কয়েক বার করে। আবার টেলিফোনে কথা বলতে দেখলে বাসায় ভূমিকম্প হবে।
ছন্দার বাবা ইয়াকুব আলি একটা বীমা কোম্পানির হেড ক্লার্ক। বাড়ি ভাড়া এবং বেতন হিসেবে যা পান তা দিয়ে তার সংসার চলে না। সন্ধ্যার পর তিনি দুটা টিউশনি করেন। চার মেয়ের মধ্যে তিন জনেরই বিয়ে হয়েছে। ছন্দা বাকি আছে। বড় মেয়েটির ভালো বিয়ে হয়েছে। স্বামী ব্যবসা করে। বড় মেয়ে প্রতিমাসে বাবাকে তিন হাজার টাকা পাঠায়। ছন্দা ইউনিভার্সিটির খরচ নিজেই চালায়। বাসার কাছে একটা কোচিং সেন্টারের সে পার্ট টাইম টিচার।
ইয়াকুব আলির বয়স পঞ্চান কিন্তু তাকে সত্তুর বছরের বৃদ্ধের মতো দেখায়। ইদানীং কোমরে ব্যাথা হয়েছে বলে সোজা হয়ে বসতে পারেন না। হাঁটার সময়েও সামান্য কুঁজো হয়ে হাঁটেন। তার দাড়ি রাখার বাতিক আছে। আয়োজন করে দাড়ি রাখেন। দাড়ি সামান্য বড় হলে কেটে ফেলে দেন। আর রাখেন। এখন তাঁর দাড়ি রাখার কাল চলছে। মুখ ভর্তি শাদা দাড়ি। তিনি বসে আছেন ইজিচেয়ারে। ঢাকা শহরে আজকাল ইজিচেয়ার পাওয়া যায় না। পুরানো আসবাবের দোকান থেকে ইয়াকুব এই ইজিচেয়ার কিনেছেন। কাপড় ছিঁড়ে গিয়েছিল। নতুন কাপড় লাগিয়েছেন। ইজিচেয়ারটা তাঁর পছন্দের জিনিস।
ইয়াকুব আলি হাত ইশারায় ছন্দাকে ডাকলেন। বিরক্ত গলায় বললেন, তোর মা কই?
ছন্দা বলল, বড় আপার বাসায় গেছেন।
একা গেছে?
বাবুল নিয়ে গেছে।
ইয়াকুব আলির সর্বশেষ সন্তানটি ছেলে। তার নাম বাবুল। সে দুবার ইন্টারমিডিয়েটে ফেল করে ঘরে বসে আছে। কিছু দিন কোনো এক কম্পিউটার স্কুলে যাওয়া-আসা করেছে, এখন সেটাও বন্ধ।
ছন্দা বলল, চা খাবে বাবা।
ইয়াকুব বললেন, চা খাব না। তোর মা যে হুট করে চলে গেল আমাকে বলে যাবে না? সংসারে কোনো শৃঙ্খলা থাকবে না? ইচ্ছা হলো চলে গেলাম, ইচ্ছা হলো ফিরলাম।
বড় আপার ছেলের জ্বর, এই শুনে মা গেছেন।
জ্বর শুনেই তোর মা দৌড় দিয়ে চলে গেল। সে কি সিভিল সার্জন, জুরের চিকিত্সা করবে? তুই মোবাইল কিনেছিস কবে?
ছন্দা ভীত গলায় বলল, গত মাসে।
পয়সা খরচ করতে মায়া লাগে না? ইচ্ছা হলো কিনে ফেললাম?
নিজের জমানো টাকা দিয়ে কিনেছি।
নিজের টাকা আবার কী? সবই সংসারের টাকা। নিজের টাকা, নিজের মোবাইল এই সব শুনতে ভালো লাগে না। এই সব ক্ষুদ্র মনের পরিচয়। মনটাকে বড় করতে শেখ। তোর মা আসবে কখন?
দুপুরের আগেই আসবেন। বাবা আজ বাজার করবে না। ঘরে তেল নাই। মা বলে গেছেন তেল লাগবে।
এই মাসের চার তারিখ তেল কিনেছি, আজ বাইশ। আঠারো দিনে তেল শেষ হয়ে গেল? তোর মা কি তেল দিয়ে গোসল করে?
ছন্দা চুপ করে আছে। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেও পারছে না আবার চলে যেতেও পারছে না।
ইয়াকুব আলি বললেন, ঘরে পোলাওর চাল আছে?
মনে হয় না।
মনে হওয়া-হওয়ি কিছু না, যা বলার সিওর হয়ে বলবি। রাতে দুজন গেস্ট খাবে। তোর সঙ্গে যে ছেলের বিয়ের আলাপ করছি তার বড় মামা আর মেজো মামা সন্ধ্যার পর আসবেন। পছন্দ হলে সম্ভাবনা আছে যে আজই আংটি পরিয়ে দেবে। পেত্নী সেজে ওদের সামনে পড়বি না। আবার রাজকন্যাও সাজবি না। মুখে হালকা পাউডার আর ঠোঁটে লিপস্টিক। বুঝতে পারছিস?
পারছি।
মোবাইল কত দিয়ে কিনলি। দেখি জিনিসটা।
ছন্দা বাবার হাতে মোবাইল দিতে দিতে বলল, চার হাজার।
ইয়াকুব আলি বললেন, এত দাম! চার হাজারেও তো শেষ না। প্রতি মাসে চার্জ আছে, অমুক আছে, তমুক আছে। এটা অন করে কীভাবে?
ছন্দা অন করে দিল।
টেলিফোন করতে হয় কীভাবে?
ছন্দা দেখাচ্ছে। ইয়াকুব আলি আগ্রহ নিয়ে দেখছেন। ছন্দা বলল, বাবা এই মোবাইলটা তুমি রেখে দাও।
আমি এইসব দিয়ে কী করব? কাকে টেলিফোন করব? হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? পোলাওয়ের চাল আছে কি-না দেখতে বললাম না?
ইয়াকুব আলি মেয়ের টেলিফোন পকেটে রেখে দিলেন। তিনি যখন কাঁচা বাজারে আলু কিনছেন তখন তার পকেটের টেলিফোন বেজে উঠল। মৃন্ময়ী বলল, হ্যালো ছন্দা।
ইয়াকুব আলি বললেন, আমি ছন্দার বাবা।
মৃন্ময়ী বলল, চাচা স্নামালিকুম।
ইয়াকুব আলি বললেন, ওয়ালাইকুম সালাম।
চাচা কেমন আছেন?
ভালো আছি। মা তোমার পরিচয়?
আমি আর ছন্দা এক সঙ্গে পড়ি। আমার নাম মৃন্ময়ী।
ইয়াকুব আলি বললেন, ওর টেলিফোনটা আমি ভুল করে পকেটে নিয়ে বাজারে চলে এসেছি।
মৃন্ময়ী বলল, ভালো করেছেন। মোবাইল নিয়ে এসেছেন বলেই আপনার সঙ্গে পরিচয় হলো। কথা হলো।
ইয়াকুব আলি মৃন্ময়ী নামের মেয়েটার কথা বলার ভঙ্গিতে মোহিত হয়ে গেলেন। কী ভদ্র ব্যবহার! তিনি বললেন, ছন্দার যে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে তুমি নিশ্চয়ই জান।
জি জানি।
ছেলে ব্যাংকে কাজ করে। ম্যানেজার। চেহারা ভালো। বংশ ভালো।
পুরোনা ঢাকায় তাদের পৈতৃক দোতলা বাড়ি আছে।
বাহ ভালো তো।
ছেলের দুই মামা আজ দেখতে আসবেন। তার জন্যেই বাজারে এসেছি। মেয়ে পছন্দ হলে তারা আজই আংটি পরিয়ে দেবেন। সে রকম কিছু অবশ্যি তারা বলেন নাই। এটা আমার অনুমান। দেখি আল্লাহ কি ঠিক করে রেখেছেন। মা একটু দোয়া করবে।
অবশ্যই করব। চাচা আজ রাতে যে ওদের খাওয়াবেন তার মেনু কী?
গরীব মানুষের মেনু। শাদা পোলাও, মুরগির কোরমা আর খাসির মাংসের রেজালা।
দই মিষ্টি থাকবে না?
ভালো কথা মনে করেছ। দই-মিষ্টির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। দুটা রাখা যাবে না। হয় দই কিংবা মিষ্টি।
তাহলে বরং দই রাখুন। রিচ ফুড খাওয়ার পর দই খেতে ভালো লাগে।
মা শোন, তুমিও চলে আস। রাতে ছন্দার সঙ্গে বসে খাবে।
মৃন্ময়ী বলল, অবশ্যই আসব। চাচা আমি কি সঙ্গে করে দু-একটা আইটেম নিয়ে আসতে পারি? যদি অনুমতি দেন।
ইয়াকুব আলি ছন্দার এই বান্ধবীর ভদ্রতায় মুগ্ধ হলেন। আজ-কালকার মেয়েদের ভেতর থেকে এ ধরনের ভদ্রতা উঠেই গেছে।
ছন্দা নিজের ঘরে বসে আছে। একটু আগে বাথরুমে ঢুকে কিছুক্ষণ কেঁদেছে। চোখের পানিতে কাজল লেপ্টে গেছে। আবার কাজল দিবে। মুখে হালকা পাউডার দিতে হবে। বাবার কথামতো ঠোঁটে লিপস্টিক। পেত্নী সাজা যাবে না। আবার রাজকন্যাও সাজা যাবে না।
বরের দুই মামার আগমন উপলক্ষে ছন্দার বোনরা চলে এসেছে। বাড়ি ভর্তি মানুষ। ইয়াকুব আলি স্ত্রীর উপর যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছেন। খবর দিয়ে দুনিয়ার মানুষ আনার দরকার কি! এরা সবাই খেয়ে যাবে। সেই আয়োজন কি আছে। না-কি সেই আয়োজন করা সম্ভব? একটা মুরগির কোরনা। খাসির মাংস এক কেজি। পোলাওয়ের চাল অবশ্যি বেশি এনেছেন। পোলাও রান্না করা যাবে। পোলাও খাবে কী দিয়ে? আলু ভর্তা দিয়ে?
ছন্দার বড় বোনের নাম শিউলী। বিয়ের আগে রোগা-পাতলা ছিল। এখন প্রতিদিন প্রস্থ বাড়ছে। সে ছন্দার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। গলা খাদে নামিয়ে বলল, এই তোর সঙ্গে যে ছেলের বিয়ে হচ্ছে তার না-কি আগে একটা বউ ছিল?
ছন্দা চমকে উঠে বলল, জানি না তো। কে বলেছে?
তোর দুলাভাই বলল, সে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল।
ছন্দা বলল, বাবা কী বললেন?
বাবা হ্যাঁ-না কিছুই বলেন নি। চুপ করে ছিলেন। বাবা ঐ ছেলের মধ্যে কি দেখেছেন কে জানে। কুস্তগিরের মতো ছেলে।
ছন্দা বলল, বাবা মেয়ে পার করতে চাচ্ছেন। আর কিছু না।
শিউলী বলল, ইউনিভার্সিটিতে এত ছেলে, একজনকে খুঁজে বের করতে পারলি না, যাকে বিয়ে করা যায়?
ছন্দার চোখে আবার পানি এসে গেছে।
হইচই শুনা যাচ্ছে। দুই মামা এসেছে। মামার সঙ্গে ছেলেও এসেছে। ছেলের এক বন্ধুও সঙ্গে আছে। তার আসার কথা ছিল না। সঙ্গে মিষ্টির প্যাকেট আছে। মিষ্টির প্যাকেট ছাড়া আরও কি সব প্যাকেট দেখা যাচ্ছে।
দুই মামাই ছন্দার জন্যে শাড়ি এনেছেন। দুটা শাড়িই ভালো। একটা রাজশাহী সিল্ক আরেকটা জামদানী। বড় মামা ছন্দার হাতে আংটি পরিয়ে দিতে দিতে বিড় বিড় করে অনেক কথাই বললেন। কোনো কথা হুন্দার কানে ঢুকল না। তার ইচ্ছা করছে দাঁত দিয়ে কেটে শাড়ি দুটা ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে।
ইয়াকুব আলি তার ইজিচেয়ারে হতাশ হয়ে শুয়ে আছেন। বাবুলকে আরেকটা মুরগি এবং খাসির মাংস আনতে পাঠানো হয়েছে। এতেও হবে কি-না কে জানে।
অতিথিদের খাবার দেয়ার আগে আগে মৃন্ময়ী চলে এল। তার গাড়ি থেকে প্যাকেটের পর প্যাকেট খাবার নামছে। খাবার এসেছে হোটেল সোনারগাঁও থেকে। ইয়াকুব আলি একবার অবাক হয়ে মৃন্ময়ীকে দেখছেন একবার খাবার দেখছেন।
বরের বড় মামা ইয়াকুবকে বললেন, বেয়াই সাহেব!
এই মেয়ে কে? ইয়াকুব বললেন, ছন্দার বান্ধবী।
ঘনিষ্ট বান্ধবী।
ছন্দা মৃন্ময়ীকে দেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। ছন্দা হাউমাউ করে কাঁদছে। মৃন্ময়ী বলল, কী সমস্যা বল দেখি?
ছন্দা সমস্যা বলছে না, কেঁদেই যাচ্ছে।