মানুষ দুই রকমের। এক, যারা হিপোক্র্যাট। আর দুই, যারা হিপোক্র্যাট।
ইতিহাসের বড় সময়টা জুড়েই আমরা হিপোক্র্যাসি করে এসেছি। আর প্রায়ই সেটা এতো উঁচু লেভেলের হিপোক্র্যাসি হয় যে, আমরা যে হিপোক্র্যাট—ঐ সেন্সটুকুও আমাদের মাথায় আসে না।
১৭৭৬ সালের সংবিধানে আমেরিকানরা যখন ঘোষণা করে, সকল মানুষ সমান, তখন তারা মানুষ বলতে কেবল শাদা চামড়াদেরই বোঝাচ্ছিল। আরো স্পেসিফিক্যালী বলতে গেলে, শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের। নারীদেরও সেই সমাজে কোন বিশেষ স্থান ছিল না। ভোটাধিকারই ছিল না; রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি—এইসব বিষয়ে কোন ‘say’ থাকা তো দূরের কথা।
বলা বাহুল্য, নিগ্রো দাসেরাও ছিল সিলেবাসের বাইরের মানুষ। যারা আমেরিকার জাতির জনক ছিলেন, এই সংবিধানে যারা সাক্ষর করেছিলেন, তাদের নিজেদেরও প্রচুর দাস ছিল। দাসদেরও তো যে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে—এই চিন্তাটাই তাদের মাথায় আসেনি। কিংবা এলেও নিজেদের স্বার্থের খাতিরেই একে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছেন। নিজের স্বার্থ তো পাগলেও বোঝে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, অনেকে আবার এটাকে খোদার ইচ্ছা বা প্রক্তি মায়ের ইচ্ছা বলে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করে। । দাসপ্রথা যে ইতিহাসের পথ ধরে মানুষেরই উর্বর মস্তিষ্কের আবিষ্কার—এটা তারা মানতেই চায় না। হামুরাবি যেমন তার দেয়া বিধিবিধানকে আল্লাহর নামে চালিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি। উনি জানতেন, আল্লাহর নামে কিছু একটা চালিয়ে দিলে কেউ তা অমান্য করার সাহস পাবে না।
এরিস্টটটল ছিলেন এক ধাপ এগিয়ে। উনি মনে করতেন, অভিজাত মানুষেরা এক রকম অভিজাত মানসিকতা নিয়েই জন্মায়। আর দাসেরা জন্মই নেয় দাস মেন্টালিটি নিয়ে। কাজেই, যে দাসের ঘরে জন্মেছে, তার মেন্টালিটি অমন বলেই সে এই ঘরে জন্মেছে। মেন্টালিটি ভালো হলে কোন উঁচু বংশেই জন্মাতো।
শ্বেতাঙ্গরা তো মনেই করে, তাদের রক্তে এমন কিছু আছে যা তাদের অন্যদের চেয়ে উন্নততর মানুষে পরিণত করে। তাদের এই ভাবনাকে জ্বালানি দেয় বিশ শতকের শুরু দিকে আমেরিকায় ‘ইউজেনিক্স’ নামে একটি আন্দোলন। বিজ্ঞানের মোড়কে এর মূল বক্তব্য হচ্ছে, রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষা করে বেটার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্ম দেয়া। হরলিক্সের ভাষায়—টলার, স্ট্রংগার, শার্পার প্রজন্মের জন্ম দেয়া। বিশুদ্ধ রক্ত মানে অবশ্যই শ্বেতাঙ্গ রক্ত। আর্য রক্ত। ককেশিয়ান রক্ত।
উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার। আমেরিকায় সেই সময় ইমিগ্র্যান্টদের একটা প্রবল স্রোত ঢুকছিল। গোঁড়া আমেরিকানদের ভয় ছিল, ইমিগ্র্যান্টদের রক্তের সাথে ইউরোপীয় আমেরিকানদের রক্ত মিশে একটা দূষিত প্রজন্ম তৈরি হবে। কাজেই, এই দূষিত প্রজন্মের হাত থেকে আমেরিকাকে বাঁচাতে হবে।
কার্নেগী ফাউন্ডেশন, রকাফেলার ফাউন্ডেশনের মত বড় বড় পুঁজিপতিরা একে প্রোমোট করতে থাকে। রকাফেলার ফাউন্ডেশন তো খোদ হিটলারের জার্মানিতে একে ফান্ড করে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ নিয়ে কোর্স চালু হয়। রিসার্চ চলতে থাকে পুরোদমে। মানুষ যে বৈষন্য রীতিমত পছন্দ করে, অন্তত যেখানে নিজের স্ট্যাটাস কো ধরে রাখলে সুবিধা পাবে—এটা তার প্রমাণ।
পশ্চিম ছেড়ে এবার পূর্বে যাত্রা করি। হিন্দুরা মনে করে, ভগবান পুরুশা নামক এক প্রাচীন সত্তার শরীর থেকে মানবজাতিকে তৈরি করেছেন। পুরুশার মুখ থেকে তৈরি করেছেন ব্রাহ্মণদের (তাই তারা মন্ত্রপাঠ করে), বাহু থেকে তৈরি করেছেন ক্ষত্রিয়দের (তাই তারা যুদ্ধ করবে), বৈশ্যদের ঊরু থেকে আর শূদ্রদের পা থেকে। যে মুহুর্তে আমরা এই মিথে বিশ্বাস স্থাপন করছি, ঐ মুহূর্তে আমরা ব্রাহ্মণ আর শূদ্রদের মধ্যকার সমস্ত বৈষম্যের সোশ্যাল জাস্টিফিকেশন দিয়ে দিচ্ছি। এই ধরনের বিশ্বাস যে কেবল সনাতন ধর্মমতেই সীমাবদ্ধ ছিল— তা না। চাইনিজদের মধ্যেও এই ব্যাধি ছিল প্রবল। চাইনিজরা বিশ্বাস করতো, ঈশ্বর যখন মাটি দিয়ে মানুষ বানালেন, তখন তিনি অভিজাতদের বানালেন মিহি হলুদ মাটি দিয়ে আর আমজনতাকে বানালেন কাদামাটি দিয়ে।
হায়ারার্কি কি কেবল গায়ের রঙে হয়? কিংবা মিথের জোরে হয়? হায়ারার্কি অর্থের জোরে হয়, বিত্তের জোরে হয়, ক্ষমতার জোরে হয়। একটা সময় ছিল যখন শাদাদের স্কুলে কালোরা পড়তে পারতো না। শাদাদের জন্য আলাদা বাস, বীচ—সবই ছিল। বাসের গেটে লেখা থাকতো—Dogs and blacks are not allowed. এখন সেই অবস্থার উত্তরণ হয়েছে। আজ একটা শাদা পাড়ায় কালো লোক বাড়ি ভাড়া নিতে গেলে কেউ অবাক হয় না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, গোটা স্ট্রাকচারটাই এমন হয়ে আছে, যে শাদাদের পাড়ায় বাড়ি ভাড়া নেবার সামর্থ্যও একটা কালো লোকের থাকে না। ফলে আইনগতভাবে না থাকলেও বাস্তবে সেই বৈষম্যগুলো রয়েই গেছে।
বিত্তবানরা খুব স্থূলভাবেই নিজেদের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে আলাদা করে রেখেছে। নিজেদের ছেলেমেয়েদের জন্য পশ স্কুলের ব্যবস্থা করে রেখেছে। এমন একটা অর্থনৈতিক ব্যারিয়ার তৈরি করে রেখেছে সেখানে, একটা ক্ষকের ছেলে যতো মেধাবীই হোক না কেন, সেইসব স্কুলে পা মাড়াতে পারবে না। তাকে হয় সরকারি প্রাইমারি স্কুলে যেতে হবে নয়তো মাদ্রাসায়। আপনি একজন কালো দিনমজুরকে দেখবেন না সাউথ ইস্ট ব্যাঙ্কে টাকা তুলতে বা এ্যাপোলো হসপিটালের করিডোরে হাঁটাহাঁতি করতে। তাদের বড়জোর ইসলামী ব্যাঙ্কে টাকা গুণতে দেখা যেতে পারে বা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বারান্দায়।
কে লুঙ্গি পরে এলো আর কে জিন্স পরে এলো—এটা তাই না চাইতেও আমাদের অনেক আচরণ ঠিক করে দেয়। নিজের অজান্তেই আমরা তখন আমেরিকার ঐ জাতির পিতাদের মত হিপোক্র্যাটের দলে নাম লেখাই।
দাসপ্রথার ইতিহাস খুব নতুন নয়। রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকেই এটা প্রচলিত ছিল। এক রাজ্য আরেক রাজ্যকে যুদ্ধে হারিয়ে দিলে পরাজিত রাজ্যের নারী-পুরুষকে দাস হিসেবে খাটানোর প্রথা ছিল। গায়ের রঙের সাথে এর কোনরকম সংযোগ ছিল না তখন।
দাসপ্রথার সাথে বর্ণবাদের সংযোগ ঘটে মধ্যযুগে। ইউরোপ তখন আফ্রিকা দখল করে নিচ্ছে। এশিয়ায় অভিযান চালাচ্ছে। আমেরিকা নামে একটা নতুন মহাদেশও আবিষ্কার করেছে। ইউরোপের লোভ আর দুরন্ত শক্তিমত্তার কাছে গোটা দুনিয়া তখন অসহায়।
উপনিবেশ থেকে পাওয়া স্বর্ণ আর সম্পদে ইউরোপীয়দের অর্থনীতি ফুলে ফেঁপে উঠছে। এই অর্থনীতির জোয়াল কাঁধে নেবার জন্য তাদের প্রয়োজন ছিল শ্রমিকের। সস্তা শ্রমিকের।
আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানরা এই শ্রমের যোগান দিতে পারছিল না। রেড ইন্ডিয়ানরা ছিল অতিমাত্রায় স্বাধীনচেতা। কোন রকম ভয়ভীতি দেখিয়ে বা ধর্মীয় গ্রন্থের দোহাই দিয়ে তাদের বশে আনা যায়নি। ফলশ্রুতিতে কখনো ছলেবলেকৌশলে, কখনো বা কোনরকম ভণিতা ছাড়াই অসম যুদ্ধে তাদের লিটার্যালী মেরে ফেলতে হয়েছে। গণহারে তাদের দাস হিসেবে খাটানো সম্ভব হয়নি যেটা করা গেছে আফ্রিকার দাসদের সাথে।
জাহাজ বোঝাই করে দলে দলে দাস আমদানি করা হয়েছে ইউরোপ আর আমেরিকায়। কালোদের ন্যূনতম মানবিক অধিকারকে অস্বীকার করে তাদের খাটানো হয়েছে অমানুষিক পরিশ্রমের সব কাজে। ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যাণ্ডের মত প্রভাবশালী সব ব্যাঙ্কের জন্মই এই দাস ব্যবসাকে কেন্দ্র করে।
অথচ ইউরোপে তখন কিন্তু রেনেসাঁস শুরু হয়ে গেছে। মানুষে মানুষে সাম্য, মৈত্রী আর স্বাধীনতার বার্তা প্রবাহিত হচ্ছে দিকে দিকে। এমন একটা সময়েও ওরা কীভাবে পারলো কালোদের এরকম মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করতে?
একটা ব্যাখ্যা তো মাত্রই দিলাম। অর্থবীতির চাহিদা আর যোগানের খেল।
কস্ট মিনিমাইজ করাও ছিল একটা ফ্যাক্টর। আফ্রিকা ছিল আমেরিকার কাছের বাজার। সেনেগাল থেকে একটা দাস কিনে আনতে তার যে পরিমাণ ট্রান্সপোর্টেশন কস্ট হত, ভিয়েতনাম থেকে আনতে গেলে তার চেয়ে বেশিই হবে। শুধু শুধু কেন সে ভিয়েতনাম যাবে দাস আনতে?
তার উপর আগে থেকেই আফ্রিকা থেকে দাসের একটা সাপ্লাই চেইন গড়ে উঠেছিল মধ্যপ্রাচ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য। আরব্য রজনীর পাতায় পাতায় দেখবেন আফ্রিকানদের দাস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, খোঁজা করে হেরেমে রাখা হচ্ছে। অর্থনীতির নিয়মই হল, নতুন বাজার খোঁজার চেয়ে এগজিস্টিং বাজার থেকে কেনাকাটা করাই ভালো। আমেরিকাও সেই পথেই গেলো।
সবচেয়ে বড় কথা—আমেরিকার যে ফার্মগুলা ছিল, ভার্জিনিয়া, হাইতি আর ব্রাজিলে, সেগুলো ছিল প্লেগের আখড়া। ইউরোপীয়রা যেখানে প্লেগকে যমের মত ভয় পাইতো (আলবেয়ার কামু তো কয়েকশো পাতার উপন্যাসই ফেঁদে বসেছেন এই প্লেগকে নিয়ে), আফ্রিকানদের শরীরে সেখানে এইসব রোগবালাইয়ের বিরুদ্ধে একটা ইম্যুনিটি তৈরি হয়ে গেসিলো। ইম্যুনিটি তৈরি হওয়া শরীরের জন্য ভালো। কিন্তু সোশ্যাল পিরামিডে আপনার অবস্থানের জন্য ভালো কিনা—তা বলে দেবে ঐ সময় আর ঐ সময়ের পাওয়ার মেকানিজম। অভিজাত ইউরোপীয়রা (ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, আইরিশ) তাই গরীব ইউরোপীয়দের (ইউক্রেন, গ্রীস কিংবা বেলারুশের অধিবাসীদের) দাস না খাটিয়ে দাস খাটালো শক্ত সামর্থ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন আফ্রিকানদের।
ওহ! আসল ঘটনাই তো বলা হয়নি।
ইউরোপীয়রা যখন প্রথম আফ্রিকার কালো মানুষের সাক্ষাৎ পায়, তখন এই মানুষগুলো সত্যিই মানুষ তথা হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত কিনা—এই নিয়েই তারা সংশয়ে পড়ে গেসিলো। এই সংশয় কিন্তু তাদের ভারতীয় বা চাইনিজদের নিয়ে ছিল না। কাজেই, মানুষ যে ন্যূনতম অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়—কালোদের ক্ষেত্রে তা পূরণ করার বাধ্যবাধকতা নিয়ে তাদের মনে কোন নৈতিক দায়বদ্ধতা ছিল না।
বাইবেল ঘেঁটে ধর্মগুরুরা এই নৈতিক দায়বোধ থেকে তাদের মুক্তি দেন।
বাইবেলের গল্পটা বলি।
নূহের তিন ছেলে। হ্যাম ,শ্যাম আর জাপতেথ।
অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে নূহ একদিন বেসামাল হয়ে যান। জামাকাপড় খুলে নিজ তাঁবুতে ঘুমিয়ে পড়েন।
ছেলে হ্যাম এসে বাপকে নগ্ন অবস্থায় দেখে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে অন্য দুই ভাইকে ডেকে আনে সে।
দুই ভাই মিলে বাপকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়। ঢেকে দেবার সময় তাদের মুখ ছিল উলটো দিকে ঘোরানো। যেন বাপের নগ্ন অবস্থা তাদের দেখা না লাগে।
ঘুম থেকে উঠে নূহ পুরো ঘটনার ব্ত্তান্ত শুনলেন। তিনি হ্যামকে অভিশাপ দিলেন, হ্যামের বংশধররা যুগ যুগ ধরে অন্য দুই ভাই’র বংশধরদের দাসব্ত্তি করবে।
হ্যামের সন্তান ক্যানান। ক্যানানের বংশধরদের বলা হয় ক্যানানাইট। এই ক্যানানাইটদের পরবর্তীতে ইসরায়েলীরা দাসব্ত্তিতে বাধ্য করেছিল। আর এই ব্যাপারটাকে জাস্টিফাই করেছিল বাইবেলের এই ঘটনা দিয়ে।
পরবর্তীতে এই ব্যাখ্যা ইসরায়েলী ইহুদীদের যতোটা না পারপাস সার্ভ করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি পারপাস সার্ভ করেছে ইউরোপীয় শেতাঙ্গদের। তারা যখন জাহাজ বোঝাই করে কালোদের এনে দাস হিসেবে কাজে লাগাতো, তখন চার্চ ফাদারদের মুখ দিয়ে বলাতো যে—এই দুর্মূখ কালোরাই হচ্ছে সেই হ্যামের প্রক্ত বংশধর। আর আমরা হচ্ছি নূহের দুই ভালো ছেলের বংশধর। আর বাইবেলে বলাই আছে, এদের দাস হিসেবে খাটাতে। কাজেই, দাস ব্যবসা নৈতিক ও ধর্মীয় বৈধতা পেয়ে যায় এখান থেকে।
শেক্সপীয়ারের নাটকেও আমরা এই বর্ণবাদের দেখা পাই। শাদা প্রসপেরো সেখানে কালো ক্যালিবানকে বলছেঃ It wouldn’t be such a ghetto if you took the trouble to clean.বোঝাতে চাচ্ছে, কালো মানেই অলস আর নোংরা। এতোটাই নোংরা, যে নিজের শোবার ঘরটা পরিষ্কার করার সময়ও তার হয়ে ওঠে না।
কালোদের সম্পর্কে এটা সমাজের গড়ে ওঠা এক স্টেরিওটাইপ ধারণা। সমাজ এটা মনে রাখে না, তারা যে সুসজ্জিত ইমারতে বসবাস করছে, তার পেছনে আছে নোংরা বসত-বাড়িতে বসবাসরত এই কালোদের শ্রম। পুঁজিবাদ কখনোই চায় না, তার শ্রমিকদের জীবনের কোনরকম মান উন্নয়ন হোক। কালোদের জন্য তাই সে বরাদ্দই করেছে ঐ নোংরা ঘেটো। যেখানে কালোরা দিনরাত পরিশ্রম করে এসে কেবল মরার মত ঘুমোবে। নিজের আবাসকে সুন্দর করার জন্য, স্নিগ্ধ করার জন্য এক মুঠো সময়ও সে পাবে না।
অলস, শ্রমবিমুখ যদি কাউকে বলতেই হয়—তবে ঐ শাদারা। মানুষের স্বভাবই হচ্ছে, যে সে নিজের ত্রুটি কখনো নিজে দেখতে পায় না। দিনরাত শাদাদের বাড়িঘর আর ক্ষেতখামারে কাজ করা কালোদেরই তাই নোংরা থাকার দায় নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়।
এমনকি প্রসপেরো সন্দেহ করেন যে, কালো ক্যালিবান তার মেয়েক ধর্ষণ চেষ্টায় লিপ্ত আছে। এটাও শ্বেতাঙ্গদের স্টেরিওটাইপ ধারণারই প্রকাশ। শ্বেতাঙ্গ পুরুষ মাত্রেরই ধারণা, কালোরা তাদের সতী-সাধ্বী নারীদের নষ্ট করে দিচ্ছে। ইতিহাস কিন্তু বলে উলটোটাই ঘটেছে বেশি। যতোজন না কালো পুরুষ শ্বেতাঙ্গ নারীর সাথে সম্পর্ক তৈরি করেছেন, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি শ্বেতাঙ্গ পুরুষ কালো নারীদের ইচ্ছেমত ভোগ করেছেন। এর মধ্যে অনেকেই সমাজে যথেষ্ট ধার্মিক ও অনুসরণীয় হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
শেক্সপীয়ারের টার্গেট কনজিউমার ছিলেন শ্বেতাঙ্গ নারী-পুরুষ। তাই হয়তো তিনি তাদের মনোরঞ্জনের জন্যই ক্যালিবানকে চিত্রায়িত করেছেন। নোংরা ক্যালিবান। অলস ক্যালিবান। লম্পট ক্যালিবান।
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বর্ণবাদের যে প্রবাহ বইছিল, মহান সাহিত্যিকও তা থেকে ঠিক মুক্ত নন।
বর্ণবাদের শক্তিটা এইখানেই। কখন যে এটা আমাদের রক্তের মধ্যে মিশে যায়, আমরা টেরও পাই না। আপাত নির্দোষ ভাবনাতেও তখন সে শক্ত ঠাঁই গেড়ে বসে। শত বছরের চেষ্টাতেও সেই শেকড় পুরোপুরি ওপড়ানো যায় না।
আরবরাই যে বর্বরতার সোল এজেন্ট ছিল—তা নয়। হাঁ, আরবরা কন্যাশিশুর জন্ম হলে তাকে জীবিত পুঁতে ফেলতো। ঠিক একই কাজ কিন্তু চীনারাও করতো। কম্যুনিস্ট চীনে যখন এক সন্তান নীতি ঘোষণা করা হয়, তখন অনেকেই বংশে বাত্তি জ্বালাবার আশায় সেই কন্যাশিশুটিকে মেরে ফেলতো বা পরিত্যাক্ত করতো।
চীনাদের এই সিদ্ধান্তের পেছনে যে ‘এক সন্তান’ নীতিই দায়ী—এমনটা নয়। চীনাদের ইতিহাস সভ্যতাও খুব সুবিধার নয়। প্রাচীন চাইনিজ দলিল ঘাঁটলে চীনাদের তখনকার সাইকোলজিটা বোঝা যায়।
এক রাণীর সন্তান হবে। জ্যোতিষী মহাশয় অনেক গোণাগুনতি করে ঘোষণা দিলেন, অমুক বারে জন্ম নিলে হবে ভাগ্যবান। আর তমুক বারে জন্ম নিলে হিবে মহা ভাগ্যবান।
রাণী অমুক বা তমুক কোন বারেই সন্তান জন্ম দিলেন না। দিলেন আরেক বারে। জ্যোতিষী সন্তানের মুখ দেখে লিখে দিলেনঃ “Not lucky. It was a girl”
এটা যীশুর জন্মের ১২০০ বছর আগের ঘটনা। তারও আগে থেকেই মেয়েদের অশুভ হিসেবে দেখার একটা প্রবণতা চলে আসছে অধিকাংশ সমাজ জুড়েই। বাইবেলে তো মেয়েদের বরাবরই ‘সম্পত্তি’ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
বাইবেলের দর্শনটাই ছিল এরকম যে, কোন মেয়েকে ধর্ষণ করলে সেটা ভিকটিমের প্রতি কোন অন্যায় নয়। মেয়েটা যার সম্পত্তি, হোক সেটা তার বাপ, ভাই বা অন্য কোন আত্নীয়, তার প্রতি অন্যায়। বাইবেল তাই বলছে, কোন দুষ্টলোক যদি কোন কুমারীকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে, তবে সেই লোকের কাছ থেকে কিছু গয়নাগাটি নিয়ে মেয়েটিকে সেই লোকের কাছে বিয়ে দিয়ে দাও।
যে বাইবেল চোখের বদলা চোখ, দাঁতের বদলা দাঁত আর জানের বদলা জান ঘোষণা করে, সেই কিনা ধর্ষণের বদলা রেখেছে বিয়ে। মজার ব্যাপার হল, বাইবেলের সেই লিগ্যাসী প্থিবীর অনেক সমাজ এমনকি আমরাও জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে এখনো বহন করে চলেছি। আর যে মেয়েটা কারো সম্পত্তি নয়, তাকে ধর্ষণ করা তো রীতিমত জায়েজ। অনেকটা রাস্তায় একটা কয়েন কুড়ায়া পাইলাম। পকেটে করে নিয়ে গেলাম। এরকম একটা ব্যাপার।
আর স্বামী যদি স্ত্রীকে ধর্ষণ করতো, সেটা তো কোন অপরাধের পর্যায়েই পড়তো না। আইডিয়াটা ছিল এরকম, স্ত্রীর প্রতি তো স্বামীর সম্পূর্ণ অধিকার আছেই। বাই ডিফল্ট, স্ত্রীর সেক্সুয়ালিটি-ও স্বামীর অধিকারেই পড়ে। স্বামী স্ত্রীকে ধর্ষণ করা যা, নিজের মানিব্যাগ থেকে নিজে টাকা চুরি করা তাই।
আগেই বলেছি, এই রকম চিন্তাধারা যে কেবল মধ্যপ্রাচ্যে সীমাবদ্ধ ছিল–তা না। ২০০৬ সালে প্থিবী জোড়া ৫৩টি দেশে এই ‘অপরাধ’ এর কোন শাস্তি ছিল না। আধুনিক, মুক্তমনা দেশ যে জার্মানি, তারা তাদের আইনে এই ক্যাটাগরীকে নিয়ে এসেছে সিতো সেদিন। ৯৭ সালে।
যে এথেন্সকে আমরা প্রাচীন সভ্যতার চূড়া ধরি, সেই এথেন্সের নগর রাষ্ট্রেও নাগরিক হিসেবে নারীদের কোন অংশরহণ ছিল না। সক্রেটিস সব কিছু নিয়ে প্রশ্ন করে গেছেন, কিন্তু নারীরা কেন নাগরিক নয়, তারা কেন বিচারসভায় জুরির আসনে বসতে পারে না——এই প্রশ্নগুলো করতে বেমালুম ভুলে গেছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, নারীর প্রতি এই যে বৈষম্য, দেশ-কাল নির্বিশেষে তাদের ঊন-মানুষ হিসেবে দেখার এই যে প্রবণতা—এটা কি প্রক্তিরই কোন নিয়ম? নাকি আর দশটা বৈষম্যের মত এটাও মানুষের ইমাজিনড হায়ারার্কির ফসল?
এটা বুঝতে হলে আমাদের কোনটা প্রাক্তিক আর কোনোটা প্রক্তিবিরুদ্ধ—সেটা বুঝতে হবে।
এইখানেও ভেজাল আছে।
আপনি যদি ছেলে হয়ে এক ছেলেকে কিংবা মেয়ে হয়ে আরেক মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তোলেন, আপনার আম্মু হয়তো শকে বা শোকে অজ্ঞান হয়ে যাবেন। ন্যাচার আম্মু কিন্তু অজ্ঞান হবে না। সে অনেক কুল। তার কাছে সবই স্বাভাবিক।
আপনি যে মুখ দিয়ে চুমু খান, সে মুখ কিন্তু বেসিক্যালী তৈরি হয়েছিল খাবার খাওয়ার জন্য। খাবার খাওয়াটাই স্বাভাবিক, চুমু খাওয়াটাই অস্বাভাবিক। কিন্তু হাজার বছরের বিবর্তনে মুখ দিয়ে চুমু খাওয়াটাকে আমাদের কাছে এখন আর অস্বাভাবিক বা প্রক্তিবিরুদ্ধ মনে হয় না।
মশা-মাছির যেমন এককালে পাখা ছিল না। আকস্মিক মিউটেশনের কারণে পতঙ্গের শরীরে একটা এক্সটেনশন তৈরি হয়। এতে করে তাদের শরীরের ক্ষেত্রফল বেড়ে যাওয়ায় তারা বেশি বেশি করে সূর্যালোক তথা এনার্জি সংগ্রহ করতে পারে। বেশি ক্ষেত্রফলওয়ালা এই পতঙ্গরা খুব স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের চেয়ে এ্যাডভাণ্টেজ পেয়ে যায়। তারপর হঠাৎই একদিন এই এক্সটেনশন দিয়ে তারা গ্র্যাভিটিকে পরাভূত করতে সক্ষম হয়। অবশ্যই তারা এক লাফে আকাশে ওড়া শিখে যায় না। প্রথমে হয়তো মাটি ছেড়ে এক ধাপ উপরে উঠা শিখে। তার বাচ্চা আরেক ধাপ, তার বাচ্চা আরেক ধাপ। এই করে করে মশা-মাছি আজ আমাদের কানের কাছে এসে গুণগুণ করার ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে।
এখন আপনি যদি সেই মশাকে ডেকে বলেন, এই ব্যাটা। তোর পূর্বপুরুষ তো উড়তে পারতো না। তুই প্রক্তির নিয়ম ভেঙে আমার কানের কাছে ওড়াওড়ি করছিস কেন? মশা সুন্দর করে আপনার কানের নিচে ঠাটিয়ে দুটো চুমু দিয়ে বিদায় নিবে।
কাজেই, ন্যাচারাল বা আনন্যাচারাল বলে আসলে কিছু নেই। সবই আমাদের ডিফাইন করে দেয়া কতগুলো ফ্রেম বা কাঠামো। প্রক্তিই নারীদের এমন করে তৈরি করেছে—এই ধারণারও তাই কোন ভিত্তি নেই। প্রক্তি আমাদের চয়েস দেয় কেবল। সেখান থেকে যে যার মত অপশন বেছে নেয়।
ইতিহাস জুড়ে নারীদের তবে এই দুর্দশা কেন? এই নিয়ে আরেক দিন আলাপ হবে। আজ এইটুকুই।
শারীরিক দুর্বলতার কারণেই মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে পিছিয়ে আছে—এটা আসলে ছোটবেলার পরীক্ষার খাতার ১ নং প্রশ্নের মুখস্থ উত্তর হয়ে যায়। সেটাই যদি হত, তবে ষাট বছরের বুড়োরা তিরিশ বছরর ছুড়োদের উপর ছড়ি ঘোরাতো না। কিংবা তুলনামূলক দুর্বল শাদারাও শক্তিশালী কালোদের শত শত বছর ধরে পায়ে শিকল পরিয়ে রাবার বাগানে কাজ করতে বাধ্য করতে পারতো না।
হাঁ, অন এভারেজ, ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে শক্ত—এটা ঠিক। কিন্তু ইন্ডিভিজুয়ালি, প্রতিটা পুরুষই যে প্রতিটা নারীর ছেয়ে শক্তিশালী–তা কিন্তু নয়। তার চেয়েও বড় কথা, ক্ষুধা-ত্ষ্ণায়, অসুখ-বিসুখে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি রেজিস্টান্ট। একটা ছোট্ট সার্ভে করেন। মনে করে দেখেন তো, আপনার বাবা সারা জীবনে কয়বার অসুখে পড়েছেন আর আপনার মা ক’বার পড়েছেন? তাহলেই বুঝবেন মেয়েদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কতো বেশি।
এজন্যই হয়তো যুগে যুগে আরামের যতো কাজ আছে, যেখানে শারীরিক পরিশ্রমের বালাই নাই, সেইগুলা সব ছেলেরাই করসে। যতো রকমের গুটিবাজি আছে, রাজনীতি, আইন প্রণয়ন কিংবা রাজ-রাজড়ার স্তুতি গেয়ে সাহিত্য রচনা—সবগুলাতেই মেয়েদের এ্যাক্সেস এক রকম বন্ধ করে রাখা হইসে। মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেয়া হইসে ফসলের কাজ, ঘরদোরের কাজ আর বাচ্চা মানুষ করার কাজ। সবগুলাতেই যেখানে প্রচণ্ড শারীরিক শ্রমের প্রয়োজন হয়। কাজেই, মেয়েরা শারীরিকভাবে দুর্বল—এই দাবি আসলে কোন ধোপেই টেকে না।
ইতিহাস বরং আমাদের এই সূত্রই দেয় যে, শারীরিক ক্ষমতা আর সামাজিক ক্ষমতা পরস্পর ব্যস্তানুপাতিক। মাফিয়া গ্রুপগুলোতে প্রায়ই দেখবেন, ছোটোখাট এক লোক হয়তো ডন হিসেবে আবির্ভূত হয়ে বসে আছে। যাকে হয়তো কানের নিচে একটা দিয়েই শোয়ায়ে দেয়া যায়। কিন্তু যার মাথায় ঘুণাক্ষরেও এই চিন্তা আসবে, সে হয়তো এই মহৎ কাজ করার জন্য প্থিবীর বুকে বেশিদিন বেঁচেও থাকবে না। জিয়াউর রহমান কিংবা মইন ইউ আহমেদ যেমন তাদের সময়ে আর্মির সবচেয়ে লম্বাচওড়া লোক ছিলেন না।
শারীরিক সামর্থ্যই যদি সব কিছু হত,তাহলে এতোদিনে বাঘ-সিংহ বা ট-রেক্স আমাদের খেয়ে হয় নির্বংশ করে ছাড়তো নয় গুহার তলায় আশ্রয় নিতে বাধ্য করতো। সেটা যেহেতু হয়নি, তারে মানে বুঝতে হবে, শারীরিক সামর্থ নয়, অন্য কিছু এখানে কী রোল প্লে করছে।
সেই অন্য কিছুটা কী?
অনেকে বলেন, সেই অন্য কিছুটা হচ্ছে পুরুষের এ্যাগ্রেসিভ মনোভাব। হাজার-লক্ষ বছরের বিবর্তন পুরুষকে হিংস্র করে গড়ে তুলেছে। তার মানে এই না যে, লোভ, পাপ, হিংসা—এইসব ব্যাপারে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে কোন অংশে পিছিয়ে আছে। কিন্তু যখনই শারীরিক ভায়োলেন্সের প্রয়োজন হয়েছে, ছেলেরা তাদের আগেপিছে চিন্তা না করে এগিয়ে গেছে। আর এটাই তাদের লং রানে এগিয়ে দিয়েছে।
যখনই কোথাও যুদ্ধ হয়েছে, আর্মড ফোর্সের দায়িত্বে ছিলে পুরুষ। যুদ্ধ শেষে শান্তিকালীন সময়ের ভারও তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের কাঁধে চলে এসেছে। নিজেদের অথরিটি প্রতিষ্ঠায় এরা আবার যুদ্ধের দামামা বাজিয়েছে। যতো যুদ্ধ হয়েছে, পুরুষের স্কিল ততো বেড়েছে। সেই সাথে সমাজের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ।
তার মানে কি এই যে, যে বেশি এ্যাগ্রেসিভ, তার হাতেই সমাজের চাবি উঠে আসবে? তাহলে রোমান সাম্রাজ্যের চাবি অভিজাতদের হাতে থাকতো না। থাকতো ম্যাক্সিমাসদের মত সৈনিকদের হাতে। ব্রিটিশ সৈন্যদলের নেতা কোন ডিউক অফ ওয়েলিংটন হতেন না। হত আইরিশ ক্যাথলিক ঘরে জন্ম নেয়া কোন সাধারণ সৈন্য। আফ্রিকান সাম্রাজ্যের অধিপতি ঠাণ্ডা মাথার কোন ফ্রেঞ্চ অভিজাত হত না। হত অনেক বেশি এ্যাগ্রেসিভ, হয়তো মাঠের লড়াইয়েও অনেক বেশি স্কিলড কোন আলজেরীয় বা সেনেগালিজ।
লোকে বলে, মেয়েদের শরীরে টেস্টোস্টেরণ কম। তাই তারা ভালো আর্মি, জেনারেল বা পলিটিশিয়ান হতে পারে না। কিন্তু যুগে যুগে আমরা দেখেছি, যুদ্ধ জয়ে টেস্টোস্টেরণ লাগে না। যুদ্ধ কোন টেস্টোস্টেরণের খেলা না। যুদ্ধ অনেক কমপ্লেক্স একটা প্রজেক্ট যেখানে আপনাকে ভয়াবহ রকমের অর্গানাইজড হতে হবে,, স্ট্রাকচারড হতে হবে। নিজেদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া থাকতে হবে, পারলে নতুন নতুন বন্ধু জোটাতে হবে। শত্রুপক্ষের মনের ভেতর কী খেলা চলছে, সেটাও আপনাকে বুঝতে হবে।
এ্যাগ্রেসিভ কারো চেয়ে ম্যানিপুলেটিভ কারোরই এই খেলায় জেতার সম্ভাবনা বেশি। আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট আর জুলিয়াস সীজার তাই যা করে দেখাতে পারেননি, তাই করে দেখিয়েছেন সম্রাট অগাস্টাস। তিনি এদের মত ভালো জেনারেল ছিলেন না, কিন্তু ছিলেন মাস্টার অফ ম্যানিপুলেশন। তার সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব তাই ছিল এদের চেয়ে অনেক বেশি।
মেয়েরা কিন্তু গড়ের উপর ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি ম্যানিপুলেটিভ। শত্রুপক্ষের মনের খবরাখবর এরা ভালো রাখে। এই সূত্র অনুযায়ী সাম্রাজ্য তো তবে মেয়েদের হাতেই তৈরি হোওয়া উচিত ছিল। মেয়েরা আদেশ দেবে আর পুরুষ সৈন্যরা সেই আদেশ পালন করবে। অনেকটা মৌমাছি সমাজের মত। বাস্তবে সেটা হয়নি যদিও। কেন—সেটা একটা রহস্য।
আরেকটা থিওরি বলে, নারীজাতির সারভাইভাল স্ট্রাটেজিই এদের পুরুষের চেয়ে দুর্বল করে বিকশিত করেছে।
একটা মেয়ের জন্য তার সাথে সেক্স করতে ইচ্ছুক—এমন গোটা দশেক ছেলে পাওয়া কোন সমস্যাই না। কিন্তু একটা ছেলের জন্য এটা মহা সমস্যা। একে তো তার মেয়েটাকে কনভিন্স করতে হয়েছে, তার উপর পছন্দের মেয়েটাকে অন্য কোন ছেলে যেন জোর করে নিয়ে না যায়, সেজন্য তাকে স্বজাতির বিরুদ্ধে বহুৎ লড়তে হয়েছে। লোহায় যতো ঘষা দিবেন, তার ধার ততো বাড়বে। ফলে, বাঁটে পড়ে হলেও, পুরুষের ধার ও ভার—দুটোই বেড়েছে। তার জিনগুলোও দিন দিন আরো এ্যাগ্রেসিভ হয়েছে, হয়েছে আরো কম্পিটিটিভ। আর মেয়েটা যেহেতু না চাইতেই অনেক কিছু পেয়ে যাচ্ছে, তার জিনেও তার প্রভাব পড়ছে। তার জিন হয়ে উঠছে আরো প্যাসিভ, আরো সাবমিসিভ।
গর্ভাবস্থা একটা বিরাট ফ্যাক্টর এইখানে। একটা মেয়ের পেটে যখন বাচ্চা থাকে, সেই নয় মাস সে ফলমূল খাদ্য সংগ্রহের জন্য কোথাও যেতে পারতো না। এই কঠিন সময়টা সে একজন পুরুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সেই পুরুষের সাথে ভাল সম্পর্ক রাখাটাও, যাকে আমরা ভালবাসার সম্পর্ক বলি—এই স্ট্রাটেজিরই ফলাফল। শুধু ঐ নয় মাস নয়, বাচ্চা হবার পর প্রথম দু-তিন বছরও সে ঐ বাচ্চার দেখভালের পেছনে কাটিয়ে দেয়। এই সময়টা তার ও তার বাচ্চার ফুড সিকিউরিটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব পড়ে তার পছন্দের পুরুষটির উপর। ফলাফল, সেই নারীর উপর পুরুষটির আধিপত্য।
এই থিওরিও ফুলপ্রুফ কিছু না। হাতি আর বোনোবো সমাজেও তো মেয়েদের প্রেগন্যান্ট অবস্থায় অন্যের সাহায্য নিয়ে চলতে হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে তারা অন্য পুরুষের সাহায্য না নিয়ে তাদের বান্ধবীদের সাহায্য নেয়। ফলে সমাজে ডমিন্যান্সের জন্য যে সোশ্যাল কানেকশানের প্রয়োজন হয়, সেটা মেয়েদের মধ্যে ডেভেলপ করেছে বেশি। হাতি আর বোনোবো সমাজ তাই মাত্তান্ত্রিক। পুরুষেরা এখানে নিজেরা নিজেরা মারামারি করে জীবন পার করে দেয়। পুরুষ বনোবো তো স্ত্রী বনোবোদের এলাকায় ট্রেসপাস করতে গেলে গণধোলাই খাওয়ার রেকর্ডও আছে।
মানুষের ক্ষেত্রে কি ঠিক সেইম ঘটনাটা ঘটতে পারতো না? কিছু ট্রাইবাল গোষ্ঠীতে যে এমনটা হয় না—তা না। কিন্তু ব্যতিক্রমকে তো আর উদাহরণ বলা যাবে না।
বোঝা গেল, পুরুষের তুলনায় মেয়েদের পিছিয়ে থাকার কোন কারণই নেই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কি তবে পুরুষের তৈরি মিথ ছাড়া আর কিছুই নয়? তাই যদি হয়, তবে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দিকে দিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই জয়জয়কার কেন?