০৫. হামিদার গলায় কৌতূহল, বিস্ময় এবং কিছুটা ঘেন্না

হামিদা বলল, তোমার নাম কুটু মিয়া।

হামিদার গলায় কৌতূহল, বিস্ময় এবং কিছুটা ঘেন্না। কুটু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি মেঝের দিকে। হঠাৎ জেরার মুখোমুখি হবে এই প্রস্তুতি হয়তো তার ছিল না।

কুটু আজ সকালে তার বিছানাপত্র নিয়ে হামিদা বানুর বাড়িতে উঠেছে। আলাউদ্দিন সঙ্গে ছিলেন। তিনি কিছু কেনাকাটার জন্যে নিউ মার্কেটে গেছেন। স্ত্রীর সঙ্গে বাস করতে আসার প্রস্তুতি হিসেবে এইসব কেনাকাটা। কুটু বলে দিয়েছে কী কী লাগবে। কেনাকাটার লিস্টে আছে—

স্পঞ্জের স্যান্ডেল

গেঞ্জি

পায়জামা-পাঞ্জাবি

রুমাল

তোয়ালে

টুথপেস্ট

টুথব্রাশ…

রুমাল ছাড়া লিস্টের সব জিনিসই আলাউদ্দিনের আছে। তারপরেও কুটু বলে দিয়েছে এই জিনিসগুলি নতুন হলে ভালো হয়। কেন ভালো হয় আলাউদ্দিন জিজ্ঞেস করেন নি। কুটুর বিবেচনার উপর তার গভীর আস্থা।

ব্যবহারের জিনিসপত্র ছাড়া অন্য কিছু জিনিসের লিস্টও কুটু করে দিয়েছে— তার মধ্যে আছুে পনেরোটা বেলি ফুল, এক কেজি গরম জিলাপি, আধা কেজি নেসাস্তার হালুয়া। এই জিনিসগুলি হামিদা বানুর জন্যে এবং আনতেই হবে। এর ভেতরেও কুটুর হয়তো কোনো বিবেচনা আছে।

স্ত্রীর সঙ্গে বাস করতে আসার ব্যাপারে আলাউদ্দিন সাহেবের গভীর শংকা ছিল। অভ্যস্থ জীবন যাপনের বাইরে কিছু করার অর্থই ভীতি। কুটু এই ভীতি দূর করেছে। কুটুর কথাবার্তায় তিনি ভরসা পেয়েছেন। তবে একা একা টিভি দেখা, চ্যানেল বদলাতে বদলাতে ইয়ে মেশানো টমেটো জুস খাওয়া কীভাবে হবে তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না। কুটু বলেছে, মানুষ যেমন চায় তার দুনিয়া তেমন হয়। আপনের চিন্তার কিছু নাই। কুটুর কথার অর্থ তার কাছে পরিষ্কার হয় নি, তবু তিনি। ভরসা পেয়েছেন। কারণ কুটু ভরসা দিয়ে কথা বলেছে। সান্ত্বনার কথা বলে নি।

 

কুটু এখন দাঁড়িয়ে আছে হামিদা বানুর বসার ঘরের মাঝখানে। হামিদা তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। হামিদার ভুরু কুঁচকে আছে। যে সব মেয়ে শুয়োপোকা ভয় পায় তাদের সামনে বিশাল আকৃতির শুয়োপোকা দাঁড়িয়ে থাকলে তাদের মুখের ভাব যেমন হয় হামিদার মুখের ভাব ঠিক সে-রকম।

কী ব্যাপার, তোমাকে প্রশ্ন করছি তুমি জবাব দিচ্ছ না কেন? তোমার নাম কুটু?

জ্বি আপা।

প্রথমবার যখন প্রশ্ন করলাম তখনই তো জবাব দিতে পারতে। দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করতে হলো কেন?

কুটু বিনীত ভঙ্গিতে বলল, আমার নাম তো আপা জানেন। জাইনাও জিজ্ঞাস করছেন এই জন্যে চুপ কইরাছিলাম।

ভবিষ্যতে কিছু জিজ্ঞেস করলে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেবে। চুপ করে থাকবে না।

জি আচ্ছা।

তুমি কি জানো তোমার মতো নোংরা মানুষ আমি আমার দীর্ঘ জীবনে দেখি নি? তোমার গা থেকে পচা গন্ধ আসছে— এটা তুমি জানো?

কুটু জবাব দিল না। হামিদার রাগ ক্রমেই বাড়ছে। সে রাগটা সামলাবার চেষ্টা করছে। সামলাতে পারছে না। আজকের দিনে সে রাগতে চায় না।

তুমি তো হাতের নখও কাট না। নখ বড় হয়ে পাখির নখের মত বেঁকে গেছে। হাতের নখ কাট না কেন?

একটু অসুবিধা আইে আপা।

বলো কী অসুবিধা।

আমার নখ শক্ত, ব্লেড দিয়া কাটে না। সারাদিন পানিতে ডুবাইয়া রাইখা নখ। নরম কইরা কাটতে হয়।

তোমার মাথার চুলও কি শক্ত? লম্বা চুল ঘাড় পর্যন্ত চলে এসেছে। আমি নিশ্চিত তোমার মাথা ভর্তি উকুন। তুমি যখন রান্না করতে লাসা তোমার মাথার উকুন এসে হাঁড়িতে পড়ে। বলো মাথার চুল কাট না কেন?

আমার মাথার তালুতেওঁ অসুখ আছে আপা। চুলে টান পড়লে ব্যথা লাগে।

হামিদা কঠিন গলায় বলল, তোমাকে আমি এই বাড়িতে রাখ না। অবশ্যই না। আমার রান্নাঘরের ত্রি-সীমানায় তোমার মতো কেউ ঘুরঘুর করছে ভাবতেই যেনা লাগছে। তুমি চলে যাও।

চইলা যাব?

অবশ্যই চলে যাবে। তোমার বেন যদি কিছু পাওনা থাকে, উনার কাছ থেকে এসে নিয়ে যাবে।

এখন চইলা যা আপা।

হ্যাঁ এখন চলে যাবে। পাঁচ মিনিটের মাথায় বিদায় হবে।

কুটু বিনীত ভঙ্গিতে বলল, আপা একটা ছোট্ট কথা… যদি অনুমতি দেন বলি।

বলো। সংক্ষেপে বলো।

স্যারের সঙ্গে যদি দেখা না কইরা চইলা যাই স্যরি মনে খুব কষ্ট পাইবেন। উনি আমার স্নেহ করেন। স্যারের মানে মায়া মমতা বেশি।

মায়া মমতা যে বেশি তা তো দেখতেই পাচ্ছি। মায়া মমতা বেশি না হলে তোমার মতো কোনো জিনিসকে ঘরে রাখতে পারে না। তোমাকে ঘরে মানায় না। তোমাকে ম্যানহোলের নিচে মানায়।

কুটু প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল, স্যারের খুব শখ ছিল আমার হাতের একটা রান্না আপনেরে খাওয়াইবেন। ইলিশ মাছের ডিমের ঝোল।

তুমি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শেফ হলেও আমি তোমার হাতের রান্না খাব না। আমার ঘেন্না খুব বেশি।

গোসল কইরা পরিষ্কার হইয়া নিব। নাপিতের কাছে গিয়া চুল কাটব। কাঠমিস্ত্রির কাছে গেলে ওরা নখ কাইটা দিব। ওদের কাছে যন্ত্রপাতি আছে।

ওরা করাত দিয়ে তোমার নখ কাটবে?

জ্বি।

আমি আমার জীবনে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত কথাবার্তা শুনেছি, তোমার মতো অদ্ভুত কথা শুনি নি। আমার সামনে থেকে যাও।

জ্বি আচ্ছা।

এখনই তোমাকে বিদায় হতে হবে না। তোমার স্যার আসুক। তার কাছে বিদায় নিয়ে তারপর যাবে।

চুলটা কাটায়ে আসব আপা?

হামিদা জবাব দিল না। সোফা থেকে উঠে চলে গেল। তার মন প্রচণ্ড খারাপ। মন খারাপটা এই পর্যায়ে গিয়েছে যে এখন শরীর খারাপ লাগছে। বিয়েতে রাজি হওয়াটা ভুল হয়েছিল এটা সে জানত। সেই ভুল যে এত বড় ভুল তা জানত না। আলাউদ্দিন নামের অজানা অচেনা লোক চলে এসেছে। হামিদা যে খাটে দীর্ঘ। জীবন একা শুয়েছে, সেই খাটের একটা অংশ দখল করে এই লোকটা পড়ে। থাকবে। সবচে বড় কথা তার দুই মেয়ের বাবার স্মৃতি এই খাটের সঙ্গে জড়িত। সে এবং শহীদ দুজনে মিলে গুলশানের কাঠের দোকান থেকে খাট কিনে এনেছিল। আর যাই হোক তাদের দুজনের খাটে বাইরের একজন মানুষকে শোয়ানো যায় না। হামিদার নিজেকে প্রসটিটিউটের মতো লাগছে। যে মেয়ে একেকবার একেকজনের সঙ্গে বিছানায় যায় সে প্রসটিটিউট ছাড়া আর কী। হামিদার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কান্না আসছে না। সে দরজা ভেজিয়ে নিজের ঘরের খাটে শুয়ে

আছে। তার ভাবতেই অদ্ভুত লাগছে এই ঘরটা তার নিজের ঘর আর নেই।

দরজায় টোকা পড়ল। হামিদার কাজের বুয়া আসিয়া মাথা বের করে ভীত গলায় বলল, চা দিমু আফা? হামিদা বলল, না। আসিয়া চলে গেল না, আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল। হামিদা বলল, আরো কিছু বলবে?

আসিয়া ক্ষীণ গলায় বলল, উনি আসছেন।

উনিটা কে?

আসিয়া বিড়বিড় করে বলল, নতুন ভাইজান।

হামিদার খুব বিরক্তি লাগছে। একজন মানুষ এসে দীর্ঘদিনের সুশৃঙ্খল অবস্থাটা জল করে দিয়েছে। মিয়ার মতো প্রাণবন্ত মেয়ে ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। কথা ফিসফিস করে বলছে। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করছে। এই অবস্থার পরিবর্তন কখন হবে?

হামিদা বলল, তুমি উনাকে জিজ্ঞেস কর চা-টা কিছু খাবেন কি-না। আর শোন, বিড়বিড় করছ কেন? বিড়বিড় করার মতো কিছু কি হয়েছে? এখন দরজার সামনে থেকে যাও। দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে যাও।

হামিদা চিন্তিত মুখে বসে আছে। বসার ঘরের দরজা ভেজানো। যে-কোনো মুহূর্তে আলাউদ্দিন নামের মানুষটা ঘরে ঢুকতে পারে। এই অধিকার নিয়েই সে এ বাড়িতে এসেছে। তার অধিকার শুধু ঘরে ঢোকাতেই সীমাবদ্ধ না, সে ইচ্ছা করলে গায়েও হাত দিতে পারে। ভাবতেই শরীর ঘিনঘিন করছে।

টেলিফোন বাজছে। হামিদা টেলিফোন ধরল। হাজী সাহেব টেলিফোন করেছেন। তাঁর গলা আনন্দময়।

কেমন আছ গো মা?

হামিদা বলল, ভালো না।

আবার নতুন করে কিছু হয়েছে?

হামিল কঠিন গলায় বলল, মামা নতুন কিছু হয় নি। পুরনোটাই সামলাতে পারছি না।

আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমার অসহ্য লাগছে মামা। আমার ইচ্ছা করছে ছাদে উঠে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে যাই।

আলাউদ্দিনের সঙ্গে তার কি কোনো ঘটনা ঘটেছে।

কোনো ঘটনাই ঘটে নি। সে আজ সকালে বিছানা, বালিশ, বাবুর্চি নিয়ে উঠেছে।

সে-রকমই তো কথা ছিল।

হ্যাঁ সে-রকম কথাই ছিল। কিন্তু মামা, আমি ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছি। মনে হচ্ছে আমার গা দিয়ে আগুনের হলকা বের হচ্ছে।

একটা কাজ করি। আলাউদ্দিনকে বলি আরো সপ্তাহখানিক পরে এসে যেন সে এ বাড়িতে উঠে। এই এক সপ্তাহ চিন্তা-ভাবনা করে নিজেকে গুছিয়ে নে।

এসব কিছু করতে হবে না। আমি তোমাদের কাছে চলে আসছি। তোমাদের সঙ্গে থাকব। তোমাদের সঙ্গে কথা বলব। ভাবব।

এটা মন্দ না। চলে আয়।

আমার জন্যে একটা ঘর খালি করে রাখ মামা। আমি কাউকে সঙ্গে নিয়ে ঘুমুতে পারি না।

তুই তোর মামির সঙ্গে কথা বলবি? সে তোকে বোঝাতে পারত। মেয়েদের সমস্যা মেয়েরাই ভালো বুঝে।

আমি এখন কারো সঙ্গেই কথা বলব না। মামা শোন, তোমার লেখক সঙ্গে করে একজন বাবুর্চি নিয়ে এসেছে। কালা মিয়া না কী যেন নাম। দেখে মনে হয় কবর খুঁড়ে কবরের ভেতর থেকে নিয়ে এনেছে।

বিদেয় করে দে।

বিদেয় করে দিয়েছি। সে এখনো যায় নি, তবে চলে যাবে। মামা শোন, যে লোক কবরের নিচ থেকে একজনকে ধরে এনে বাবুর্চির চাকরি দেয় তার সঙ্গে কি। জীবন যাপন সম্ভব?

মা শোন, এইসব তো ছোট সমস্যা।

সমস্যা সমস্যাই। সমস্যার কোনো ছোট বড় নেই।

তুই কি কাঁদছিস না-কি?

আমি কাঁদছি না। রাগে আমার শরীর জ্বলছে মামা।

তুই হাত মুখ ধুয়ে ঠাণ্ডা হ। তারপর চলে আয় আমার এখানে। না-কি আরেকটা কাজ করব। আমি তোর মামিকে নিয়ে চলে আসি। তোর সঙ্গে কথা। বলি, আলাউদ্দিনের সঙ্গেও কথা বলি।

তোমাদের আসতে হবে না মামা, আমি আসছি।

টেলিফোন রেখে হামিদী বাথরুমে ঢুকল। তার শরীর আসলেই জ্বলছে। সে দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করল। শরীরের জ্বলুনি সামান্য কমল। পুরোপুরি গেল না। পুরোপুরি যাবার কথাও না। আলাউদ্দিনকে কী কথা বলবে সেগুলি গুছিয়ে নেয়া দরকার। হামিদা কোনো কিছুই গোছাতে পারছে না।

আলাউদ্দিন বসার ঘরে বসে আছে। শান্ত ভঙ্গিতেই বসে আছে। বসার ঘরের সোফাটা আরামদায়ক। শুধু সামনের টেবিলের উপর পা তুলে দিতে পারলে অনেক আরাম হতো। এই কাজটা করা যাচ্ছে না। অন্যের বাড়িতে এসে সোফায় বসে টেবিলে পা তোলা যায় না। তার স্ত্রীর বাড়ি। সেই অর্থে নিজেরই বাড়ি। এই বোধ এখনো হচ্ছে না। আলাউদ্দিনের ঘুম ঘুম পাচ্ছে। কিছুক্ষণ ঘুমুতে পারলে ভালো লাগত। ঘুমানো ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছেন না। সকাল এগারটা বাজে। এগারোটার সময় কেউ ঘুমুতে যায় না। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর লম্বা একটা ঘুম দিতে হবে। আজ দুপুরের খাবার ব্যবস্থা কুট কী করেছে তিনি জানেন না। নতুন বাড়িতে প্রবেশ উপলক্ষে নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু করেছে। মেনু আগেভাগে জানা থাকলে সারপ্রাইজ নষ্ট হয়ে যাবে।

আলাউদ্দিন সিগারেট ধরালেন। প্রথমবার হাজী সাহেবের সঙ্গে যখন এ বাড়িতে এসেছিলেন তখন সিগারেট ধরাতে সংকোচ লাগছিল, এখন লাগছে না। এটা একটা ভালো দিক। সিগারেটে দুটা টান দিতেই হামিদা এসে ঘরে ঢুকল। আলাউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সম্মান দেখানো হলো। নিজের স্ত্রীকে এইভাবে সম্মান দেখানোর কোনো নিয়ম আছে কি-না তিনি জানেন না। আস্তে আস্তে সব নিয়মকানুন শিখে নিতে হবে। শিক্ষার কোনো শেষ নাই। করে যাবার আগের মুহূর্তেও মানুষ শিখতে পারে।

হামিদা বলল, বসুন।

আলাউদ্দিন ধপ করে বসে পড়লেন। হামিদা তার সামনে বসল। তার মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। চোখ ইষৎ লাল। মনে হচ্ছে তার জ্বর আসবে। গা শির শির করছে। আলাউদ্দিন বললেন, আপনার জন্য জিলাপি এনেছি। হামিদা চমকে উঠল। মনে হলো সে একটা ধাক্কার মতো খেয়েছে। ধাক্কা খাওয়ার কারণ আছে। শহীদের জিলাপি খুব পছন্দ ছিল। যখন তখন জিলাপি নিয়ে আসত। জিলাপি না পেলে নেসাস্তার হালুয়া। দুটা খাদ্যদ্রব্যই হামিদার অপছন্দ। শহীদের আরেকটা পছন্দের জিনিস ছিল বেলি ফুল। হামিদা কোনো পুরুষ মানুষকে বেলি ফুলের জন্য এত পাগল হতে দেখে নি। তার আনন্দময় গলা এখনো কানে বাজে হামিদা শোন, আর মাত্র কয়েকটা দিন, তারপরই শুরু হবে বেলির সিজন। শহীদের মৃত্যুর পর দীর্ঘ দিন কেটে গেছে হামিদা বাড়িতে বেলি ফুল ঢুকতে দেয় নি। বেলি ফুলের গন্ধ কেমন হামিদা ভুলে গেছে।

জিলাপি এনেছেন কেন?

আলাউদ্দিন জবাব দিলেন না। কুটু মিয়া তাকে জিলাপি আনতে বলেছে বলে তিনি জিলাপি এনেছেন এটা বলতে ইচ্ছা করছে না। তার মন বলছে এই সত্যি কথাটা শুনলে হামিদা পছন্দ করবে না। নেসাস্তার হালুয়াও আনতে বলেছিল, হালুয়া খুঁজে পান নি।

হামিদা বলল, শুধু জিলাপি এনেছেন আর কিছু আনেন নি?

আলাউদ্দিন বলল, বেলি ফুল এনেছি।

বেলি ফুল এনেছেন?

জ্বি।

কই দেখি।

আলাউদ্দিন পাঞ্জাবির পকেট থেকে বেলি ফুল বের করলেন। হামিদা বলল, বেলি ফুল, জিলাপি আপনি কি নিজ থেকে এনেছেন না কেউ আপনাকে আনতে বলেছে?

আলাউদ্দিন ব্রিত ভঙ্গিতে বললেন, নিজ থেকে এনেছি।

হামিদা বলল, জিলাপি আমি খাই না, আর বেলি আমার পছন্দের ফুল না। তারপরেও আপনাকে ধন্যবাদ।

আলাউদ্দিন পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট বের করলেন। কিছুক্ষণ আগেই তিনি সিগারেট শেষ করেছেন। সেই সিগারেটের ধোঁয়া এখনো ঘরে আছে। এর মধ্যে আরেকটা সিগারেট ধরানো ঠিক হচ্ছে না। হামিদা নাক মুখ কুঁচকে আছে। যারা সিগারেট খায় না তারা সিগারেটের গন্ধ সহ্যই করতে পারে না। আলাউদ্দিন হামিদার চোখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে সিগারেট ঠোঁটে নিলেন। ধরালেন না। কাজটা পরীক্ষামূলক। তিনি যদি দেখেন হামিদা রেগে যাচ্ছে তাহলে আর সিগারেট ধরাবেন না। আর যদি দেখেন সে রাগছে না তাহলে ধরাবেন। তিনি লাইটার হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছেন। হামিদা বলল, আপনাকে কিছু জরুরি কথা বলা দরকার।

অত্যন্ত জরুরি।

জ্বি বলুন।

আজ আর বলব না। আমার শরীরটা খারাপ, মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলব বুঝতে পারছি না।

তাহলে আরেক দিন বলুন।

হ্যাঁ তাই করব। আমি এখন চলে যাব মামার কাছে। সেখানে কয়েক দিন থাকব। মনটা ঠিক করব।

আলাউদ্দিন অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বলল, অবশ্যই অবশাই। মন ঠিক করা অত্যন্ত জরুরি। প্রয়োজনে দশ বার দিন থাকবেন। আমার ব্যাপারে কিছু চিন্তা করতে হবে না। সঙ্গে বাবুর্চি আছে। সে আবার অত্যন্ত দক্ষ।

আপনার বাবুর্চির বিষয়েও কিছু কথা আছে।

বলুন কী কথা। আপনার সঙ্গে বেয়াদবী করলে সেটাও বলুন। ওকে সাইজ করা দরকার আছে। প্রায়ই ভাবি সাইজ করব। শেষে সাইজ করা হয় না।

বাবুর্চির বিষয়ে যে কথাগুলি বলতে চাচ্ছি সেগুলিও আজ না বলে অন্যদিন বলব। অনেকক্ষণ ধরে দেখছি আপনি সিগারেট ধরাচ্ছেন না। একবার ঠোঁটে নিচ্ছেন একবার হাতে নিচ্ছেন। সিগারেট ধরান।

আলাউদ্দিন আনন্দের সঙ্গে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আপনি কখন যাবেন?

হামিদ বলল, এখনই যাব।

হামিদার কথা শেষ হবার আগেই কুটু ঢুকল। তার হাতে চায়ের কাপ। হামিদা কুটুকে দেখে আবারো ধাক্কার মতো খেল। এই কুটু মিয়া আগের কুটু মিয়া না। অতি অল্প সময়ে সে চুল কেটে এসেছে। হাতের নখ কেটেছে। গোসল করে ইস্ত্রি করা সার্ট প্যান্ট পরেছে। নোংরা ভাব তার শরীরে এখন একেবারেই নেই। তার গা থেকে লেবুর হালকা সুবাস আসছে। লেবুর গন্ধ হামিদার খুবই পছন্দ।

কুটু হামিদার দিকে তাকিয়ে বলল, আপা আপনের জন্য চা আনছি।

হামিদা বলল, আমি তো তোমার কাছে চা চাই নি।

কুটু বিনীত ভঙ্গিতে বলল, একটু খাইয়া দেখেন আপা। আপনের ভালো লাগব। এইটা মশলা আছে। ঘন কইরা দুধ চা বানাইয়া তার মধ্যে গরম মশলা দেওয়া হয়। নেপালীরা এই চা খুব পছন্দ করে। একটা চুমুক দেন।

হামিদা খুব অনাগ্রহের সঙ্গে চায়ে চুমুক দিল। শান্ত গলায় বলল, আমি চা খাচ্ছি। এখন দাঁড়িয়ে থেকো না। সামনে থেকে যাও।

কুটু বলল, চা-টা কি আপনার মন মতো হইছে আপা?

হামিদা বলল, চা ভালো হয়েছে।

কুটু বলল, শুকরিয়া।

বলেই সে সরে গেল। আলাউদ্দিন সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন, জামিলা শোন— কুটু অসাধারণ এক প্রতিভা।

হামিদা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আপনি আমাকে কী নামে ডাকলেন?

আলাউদ্দিন গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন, জামিলা বলেছি। দয়া করে রাগ করবেন না। আর বলব না।

জামিলা বলেছেন কেন? আমার নাম হামিদা, জামিল না।

জ্বি আমি জানি। হামিদ স্যার আমাদের অংক করাতেন। উনাকে খুবই ভয় পেতাম। হামিদা নামটা শুনলেই স্যারের কথা মনে হয়। এই জন্যই আপনাকে দামিলা বলেছি। আর বলব না। তবে জামিলা নামের অর্থ ভালো। জামিলা নামের অর্থ সুন্দরী।

হামিদা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমি এখন চলে যাচ্ছি। আপনার সঙ্গে। পরে কথা বলব। দু তিন দিন পরে যে-কোনো এক সময় কথা হবে।

আলাউদ্দিন বলেন, জ্বি আচ্ছা।

আমার কাজের মেয়েটিকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। আপনার বাবুর্চি আছে। আপনার অসুবিধা হবার কথা না।

কোনো অসুবিধা হবে না। আমাকে নিয়ে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।

হামিদা ক্লান্ত গলায় বলল, আমি আপনাকে নিয়ে চিন্তা করছি না। আমি নিজেকে নিয়ে চিন্তা করছি। আচ্ছা আমি এখন যাচ্ছি।

 

আলাউদ্দিন বাথটাবের পানিতে শুয়ে আছেন। তার মাথাটা শুধু ভেসে আছে। পুরো শরীর পানির নিচে। বাথটাব ভর্তি ফেনা। আলাউদ্দিনের মনে হচ্ছে এরচে সুন্দর সময় তিনি তাঁর জীবনে পার করেন নি। হামিদার বাড়িতে বাথটাব আছে এটাই তিনি কল্পনা করেন নি। বাথটাবে নামার সময় শুরুতে তার একটু ঠাণ্ডা লাগছিল। এখন আর লাগছে না। এখন মনে হচ্ছে পানির তাপমাত্রা এরচে বেশি হলে ভালো। লাগত না।

তিনি একাই আছেন। কুটু আশেপাশে নেই। একটু আগে হাতের কাছে একটা ট্রে নামিয়ে দিয়ে গেছে। ট্রেতে একটা জপ এবং একটা গ্লাস। জগে যে বস্তু আছে তার রঙ টমেটো জুসের লাল রঙ না, হালকা সোনালি রঙ। এটা নিশ্চয়ই অন্য কোনো জিনিস। যে জিনিসই হোক, অমৃতসম। এই জিনিস এক জগ খেলে তৃষ্ণা মিটবে না। এই জিনিস খেতে হবে এক বালতি। আলাউদ্দিন সিগারেট ধরালেন। পানিতে ভিজতে ভিজতে সিগারেট টানার একটাই সমস্যা। সিগারেট ভিজে যায়। পানিতে সিগারেট খাবার জন্য অন্যরকম সিগারেট থাকার দরকার ছিল। যে সিগারেট পার্টিতে ভিজবে না। কুটুাকে বললো একটা ব্যবস্থা সে নিশ্চয়ই করবে। অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন মানুষ। দরিদ্র দেশে পড়ে আছে বলে তার প্রতিভার কদর হলো না। কটু ইউরোপ আমেরিকায় জন্মালে তাকে নিয়ে। কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। আলাউদ্দিন ডাকলেন, কুটু! কুটু কোথায়?

কুটু সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে বাথরুমে ঢুকল। আলাউদ্দিন স্নেহের স্বরে বললেন, কেমন আছি কুটু?

কুটু বলল, ভালো।

আলাউদ্দিন বললেন, জীবনে এই প্রথম বাথটাবে গোসল করছি, এর আগে কখনো করি নি। বিয়েটা আমার জন্য শুভ হয়েছে কী বলা কুটু?

অবশ্যই শুভ হয়েছে।

আজকের দিনটা নিয়ে খুবই দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। দিনটা কীভাবে কাটবে এই নিয়ে দুঃশ্চিন্তা। দিনটা তো মনে হয় ভালোই কাটবে।

অবশ্যই ভালো কাটবে।

আগামীকালও ভালো কাটবে। জামিলা আগামীকালও আসবে না। আমাকে বলে গেছে।

এইটা তো স্যার সুসংবাদ।

আলাউদ্দিন গ্রামে লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন, শুধু সুসংবাদ বললে কম বলা হয়। এটা হচ্ছে মহা সুসংবাদ।

জ্বি স্যার, মহা সুসংবাদ।

নিজের স্ত্রীর সঙ্গে আপনি আপনি করে কথা বললাম এর জন্যে সামান্য খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছিল কি জানো? মনে হচ্ছিল, আমি যে কলেজের শিক্ষক,

জামিলা সেই কলেজেরই প্রিন্সিপ্যাল।

স্যার আপনি খুব দ্রুত খাইতেছেন। আস্তে আস্তে খাওয়ার নিয়ম।

পাইলট সাহেব কি আস্তে আস্তে খেতেন?

জি।

উনি ছিলেন পাইলট, আর আমি দরিদ্র ঘরের সন্তান। উনার সঙ্গে আমাকে মিলালে তো হবে না। দুই জন দুই প্রান্তে।

তারপরেও আপনেদের মধ্যে মিল আছে।

এটা ঠিক বলেছ–আমাদের মধ্যে মিল আছে। উনি বাথটাবে শুয়ে থাকতেন। আমিও বাথটাবে শুয়ে আছি। উনি বাথটাবে শুয়ে জগ ভর্তি জিনিস খেতেন, আমিও বাথটাবে শুয়ে জগ ভর্তি জিনিস খাই। আমি উনার চেয়ে দ্রুত খাই। সামান্য একটু অমিল— তাই না?

জ্বি স্যার।

আলাউদ্দিন আরেক গ্লাস নিলেন। লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন, আরো মিল আছে উনার বাবুর্চির নাম ছিল কুটু মিয়া, আমার বাবুর্চির নামও কুটু মিয়া। ঠিক বলছি কি-না বল।

অবশ্যই ঠিক বলছেন।

শোন কুটু, আজ আমি বাথটাব থেকে উঠব না। এখানেই খাওয়া দাওয়া করব। অসুবিধা আছে?

কোনো অসুবিধা নাই স্যার।

তোমার পাইলট স্যার কি কখনো বাথটাবে শুয়ে খাওয়া দাওয়া করতেন? জ্বি করতেন। উনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাথটাবে থাকতেন। বই পড়তেন। কী বই পড়তেন? কী বই পড়তেন তা বলতে পারব না স্যার। আমি লেখাপড়া জানি না।

আমি ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি লেখাপড়া জানো না। তোমাকে একবার বলেছিলাম বাংলাবাজার থেকে অ আ বই কিনে আনব, ভুলে গেছি।

এই বয়সে আর লেখাপড়া শিখা কী হইব!

জ্ঞান অর্জনের কোনো বয়স নাই কুটু। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন করা যায়। তুমি এখন যাও তো কুটু, খুঁজে পেতে দেখ এই বাড়িতে কোনো বই টই আছে কি না। থাকলে নিয়ে এসো। শুয়ে শুয়ে পাইলট সাহেবের মতো বই পড়ব।

বাংলা বই আনব না ইংরাজি বই আনব? একটা আনলেই হবে। হাতের কাছে যা পাও নিয়ে এসো।

কুটু কিছুক্ষণের মধ্যেই বই নিয়ে ফিরে এলো। ইংরেজি বই। বই- এর লেখকের নাম উইলিয়াম গোল্ডিং। বই-এর নাম লর্ড অব দা হাইস। আলাউদ্দিন বই পড়তে শুরু করলেন। প্রথম চ্যাপ্টারের নাম The sound of the shaell.

দশ মিনিটের মতো পড়েই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। লর্ড অব দ্যা ফ্লাইস কিছুক্ষণ বাথটাবের পানিতে ভেসে রইল। তারপর পানিতে ডুবে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *