০৫. স্যার কেমন আছেন

‘স্যার কেমন আছেন?’

প্রশ্নের জবাব দেবার আগে মিসির আলি দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালেন। সকাল ন’টা। দেয়ালঘড়িটা আধুনিক ইলেকট্রিক্যাল ঘড়ি না হয়ে পুরোনো দিনের পেন্ডুলাম ঘড়ি হলে ঢং ঢং করে ন’টা ঘণ্টা বাজাতে শুরু করত। মিসির আলি শুকনো গলায় বললেন, ভালো আছি। প্রতিমা তুমি কেমন আছ?

‘যাক নাম তা হলে মনে আছে। আমি ভাবলাম আবার বোধহয় প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। আমার পরিচয় দিতে হবে। কেন আমার নাম প্রতিমা ব্যাখ্যা করতে হবে।

মিসির আলি মনে মনে ভাবলেন—মেয়েটা আগে এত কথা বলত না। এখন বলছে কেন?

প্রতিমা বলল, স্যার এখন বলুন আমাকে দেখে কি রাগ লাগছে?

‘না।’

‘বিরক্তি লাগছে।’

‘বুঝতে পারছি না।’

প্রতিমা বলল, আমাকে দেখে আসলে আপনি খুশি হয়েছেন। আপনি বুঝানোর চেষ্টা করছেন যে বিরক্ত হয়েছেন—আসলে তা না। স্যার ঠিক বলেছি?

আনন্দে এবং উৎসাহে প্রতিমা ঝলমল করছে। আজ তাকে আরো সুন্দর লাগছে। মিসির আলি তাকিয়ে দেখলেন। বসার ঘরে দুটা বড় বড় সুটকেস। এই সুটকেস প্রতিমাই নিয়ে এসেছে। সুটকেস কেন এনেছে কে জানে। মিসির আলি বললেন, যেদিন আসার কথা ছিল সেদিন আস নি। আস নি কেন?

প্রতিমা বলল, আপনি বলুন কেন আসি নি। আপনি হচ্ছেন দ্য গ্রেট মিসির আলি। আমার দিকে তাকিয়েই আপনার বলে দেওয়া উচিত কেন আসি নি। বসার ঘরে দুটা সুটকেস কেন এনেছি বলুন তো? দেখব আপনি আগের মিসির আলি আছেন না বয়স হবার কারণে আপনার আগের ডিটেকটিভ ক্ষমতা কমে গেছে।

মিসির আলি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি ছটফট করছ কেন? বস।

প্রতিমা বলল, আপনিইবা আমাকে দেখে এত অস্থির হচ্ছেন কেন? আপনি বসুন।

মিসির আলি বসলেন। প্রতিমা বলল—আমি বলেছিলাম ন’টার সময় আসব। আমি ঠিকই এসেছিলাম। ন’টা বাজার আগেই গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। ঠিক ন’টার সময় ঢুকব এই হচ্ছে আমার প্ল্যান। ন’টা বাজতেই প্ল্যান বদলালাম। ঠিক করলাম— আপনার কাছে যাব না, যাতে সারা দিন আপনি মনে মনে অপেক্ষা করেন। তাই করেছিলেন না?

‘হ্যাঁ।’

‘তার পরদিন এলাম না। তার পরদিনও না। এটা করলাম—যাতে অপেক্ষা করতে করতে আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। বলুন আপনি ক্লান্ত হয়েছেন না?’

‘খানিকটা হয়েছি।’

‘এবং একসময় আপনার নিশ্চয়ই মনে হওয়া শুরু হয়েছে—আচ্ছা মেয়েটা আসছে না কেন—ওর কী হয়েছে। বলুন এ রকম হয়েছে না?

‘হ্যাঁ হয়েছে।’

‘আমি এই অবস্থাটা আপনার ভেতর তৈরি করার চেষ্টা করেছি। সত্যি করে বলুন, পেরেছি কি না।’

‘হ্যাঁ পেরেছ।’

প্রতিমা হাসি হাসি মুখে বলল—ঐ দিন আমার ওপর আপনি খুবই বিরক্ত হচ্ছিলেন আমি আপনাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব এটা ভেবে আপনি আতঙ্কে অস্থির হয়েছিলেন। আমার খুবই খারাপ লেগেছিল। তখনই ঠিক করেছিলাম আমি এমন অবস্থা তৈরি করব যাতে আপনি খুব আগ্রহ নিয়েই আমার সঙ্গে থাকতে আসেন।

‘তোমার কি ধারণা সে রকম অবস্থা তৈরি করতে পেরেছ?’

‘না এখনো পারি নি। তবে এখন আর আপনি আমাকে আগের মতো অপছন্দ করছেন না।’

‘সুটকেসে কী?’

সুটকেসে কিছু না। খালি সুটকেস। আপনার বইগুলি আজ আমি সুটকেসে ভরে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। প্রথম দিন বই, তারপর জামাকাপড়, তারপর বাসনকোসন এইভাবে ঘর খালি করব। সব শেষের দিন আপনি যাবেন। আমি আপনাকে নিয়ে যাব না, আপনি নিজ থেকে যাবেন।

‘বল কী?’

প্রতিমা খিলখিল করে হাসছে। মনে হচ্ছে সে খুবই মজা পাচ্ছে। মেয়েটার হাসি শুনে মিসির আলির বুক ধড়ফড় করতে লাগল। এই মেয়ে হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে সে যা করবে বলছে তা সে করবে।

প্রতিমা গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, স্যার শুনুন—আপনার শোবার ঘরে যেখানে আপনার বিছানা করেছি সেখানে বিশাল একটা জানালা আছে। আপনি সারাক্ষণ আকাশ দেখতে পারবেন।

‘আমি সারাক্ষণ আকাশ দেখতে চাই এটা তোমাকে কে বলল?’

‘কেউ বলে নি। আমি জানি। আপনার একটা ইচ্ছা হল—মৃত্যুর সময় আপনি আকাশ দেখতে দেখতে মারা যাবেন।

‘আমি আকাশ দেখে মরতে চাই তোমাকে কে বলল?’

‘কেউ বলে নি। আমি বুঝতে পেরেছি।’

মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, কীভাবে বুঝতে পেরেছ?

প্রতিমা হতাশ গলায় বলল, স্যার আপনার হয়েছে কী? আমি যে মনের কথা বুঝতে পারি আপনি তো সেটা জানেন। খুব ভালো করে জানেন। এই নিয়ে আপনি অনেক পরীক্ষাটরীক্ষাও করেছেন—এখন মনে করতে পারছেন না কেন?

‘বুঝতে পারছি না, কেন মনে করতে পারছি না।’

‘আপনার কি আলজেমিয়ারস ডিজিজ হয়েছে? আমার ধারণা তাই হয়েছে। নেপাল থেকে আমি আপনাকে পশমি চাদর এনে দিলাম। আপনাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলাম—সব সময় এই চাদর ব্যবহার করবেন। আপনি ঠিকই এই চাদর ব্যবহার করছেন। কিন্তু আমি যে চাদরটা দিয়েছি এটা ভুল মেরে বসে আছেন। কেন স্যার?’

মিসির আলি জবাব দিলেন না। মেয়েটা সত্যি কথাই বলছে—এর বিষয়ে তাঁর কিছুই মনে নেই। মেয়েটি সম্পর্কে যাবতীয় স্মৃতি মস্তিষ্ক মুছে ফেলেছে। ব্যাপারটা রহস্যময়। প্রতিমা সম্পর্কে জানার জন্যে তিনি তাঁর পুরোনো ফাইল ঘেঁটেছেন। প্রতিটি কেইস হিস্ট্রির ফাইল তাঁর আলাদা করা। সেখানে প্রতিমার কেইস হিস্ট্রি থাকার কথা অথচ নেই। পাঁচটি পাতা ফাইল থেকে ছেঁড়া হয়েছে। যে ছিঁড়েছে সে যে খুব সাবধানে গুছিয়ে ছিঁড়েছে তাও না—টেনে ছিঁড়েছে।

প্রতিমা বলল, স্যার এই মুহূর্তে আপনি কী ভাবছেন বলি?

‘বল।’

‘এই মুহূর্তে আপনি ভাবছেন—পাতাগুলি কে ছিঁড়ল?’

মিসির আলি চমকে উঠলেন। প্রতিমা হাসতে হাসতে বলল, আপনি এত চমকে গেলেন কেন? আমি যে মনের কথা ধরতে পারি তার প্রমাণ অনেকবার আপনাকে দিয়েছি। অথচ আপনি এমনভাবে চমকেছেন যেন প্রথমবার দেখলেন।

ইয়াসিন দু কাপ চা নিয়ে ঢুকেছে। প্রতিমা তার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, তুমি চা বানিয়ে নিয়ে এসেছ কেন? আমি না তোমাকে বললাম তুমি পানি গরম করে আমাকে খবর দেবে আমি চা বানিয়ে দেব। কি বলি নি?

‘বলছেন।’

‘আর কখনো এই ভুল করবে না।’

ইয়াসিন মুখ ভোঁতা করে দাঁড়িয়ে রইল। প্রতিমা কড়া গলায় বলল, যা হাঁদারামের মতো দাঁড়িয়ে থাকবি না।

ইয়াসিন চলে গেল। প্রতিমা এমনভাবে কথা বলছে যেন সে এ বাড়ির কর্ত্রী। বাড়ির দেখাশোনা, সংসার চালানোর সব দায়িত্ব তার একার। মিসির আলি চায়ে চুমুক দিলেন। প্রতিমা বলল, স্যার আপনি কি নিজের হাতের লেখা চিনতে পারবেন? নাকি নিজের হাতের লেখাও ভুলে গেছেন।

মিসির আলি বললেন, হাতের লেখা চিনব।

পঞ্চাশ টাকার স্ট্যাম্পে আপনাকে দিয়ে কিছু কথা লিখিয়ে নিয়েছিলাম। মনে আছে?

না।

দলিল সঙ্গে নিয়ে এসেছি। চা শেষ করে দলিলটা দেখুন। চা খেতে খেতে দলিল দেখলে সমস্যা আছে।

‘কী সমস্যা?’

‘আপনি বিষম খাবেন। চা শ্বাসনালি দিয়ে ঢুকে সমস্যা তৈরি করবে।’

‘ভয়ঙ্কর কিছু কি লিখেছি?’

‘আপনার কাছে ভয়ঙ্কর মনে হতে পারে। নিন দেখুন। শুধু পড়ার সময় চায়ে চুমুক দেবেন না।’

মিসির আলি দলিল পড়ছেন। হাতের লেখা তার। কালির কলমে লেখা। লেখা দেখে কোন কলমটা ব্যবহার করেছেন সেটাও মনে পড়েছে। ওয়াটারম্যান কলম। ইয়াসিনের আগে যে ছেলেটা কাজ করত সে অনেক জিনিসপত্রের সঙ্গে তার এই শখের কলমটাও চুরি করে নিয়ে যায়। দলিলে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা—

আমি মিসির আলি

সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে নিম্নলিখিত অঙ্গীকার করছি।

ক. আমার চিকিৎসাধীন রোগী প্রতিমার (ভালো নাম আফরোজা বানু) সঙ্গে জীবনের একটি অংশ কাটবে। সে যখন আমাকে তার সঙ্গে থাকতে ডাকবে তখনই আমি তাতে রাজি হব।

খ. প্রতিমার (আফরোজা বানু) সঙ্গে বিবাহ নামক সামাজিক প্রথার ভেতর দিয়ে যেতেও আমার কোনো আপত্তি নেই।

অঙ্গীকারনামার শেষে ইংরেজি ও বাংলায় মিসির আলির দস্তখত। তারিখ দেওয়া আছে। ছ’বছর আগের একটা তারিখ।

প্রতিমা দলিলটা মিসির আলির হাত থেকে নিয়ে তার হ্যান্ডব্যাগে রাখতে রাখতে বলল—দলিল পড়ে আপনি কি চমকেছেন?

মিসির আলি জবাব দিলেন না।

প্রতিমা বলল, দলিলটা যে আপনার হাতেই লেখা, এ বিষয়ে কি আপনার কোনো সন্দেহ আছে?

মিসির আলি বললেন, সন্দেহ নেই।

প্রতিমা মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলল, তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে—আপনি আমার সঙ্গে যাচ্ছেন? এই মুহূর্তে আমি আপনাকে বিয়ের জন্যে চাপ দেব না। একসঙ্গে এতটা টেনশন আপনার সহ্য হবে না। আপাতত আমার সঙ্গে থাকলেই হবে।

মিসির আলি চুপ করে রইলেন।

প্রতিমা বলল—কথা বলুন। মুখ পুরোপুরি সিল করে রাখলে হবে কীভাবে? বইগুলি বের করে দিন, আমি ব্যাগে গুছাতে থাকি।

মিসির আলি বললেন, আমাকে কিছু দিন সময় দাও।

প্রতিমা শান্ত গলায় বলল, কতদিন সময় চান?

‘সাত দিন।’

‘সাত দিন সময় চাচ্ছেন কী জন্যে?’

‘চিন্তা করার জন্যে।’

‘কী চিন্তা করবেন?’

‘আমি আমার মতো করে চিন্তা করব।’

‘ঠিক আছে সাত দিন চিন্তা করুন। সাত দিন পর আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাব।’

‘তোমাকে নিয়ে যেতে হবে না। তুমি তোমার ঠিকানা রেখে যাও। সাত দিন পর আমি নিজেই উপস্থিত হব।’

প্রতিমা শান্ত গলায় বলল, ‘না আমি আপনাকে নিয়ে যাব। ব্যাগ থাকল, আমি উঠলাম। ভুলে যাবেন না, আগামী সোমবার।’

.

ইয়াসিন দরজা ধরে চোখ গোল করে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি মিসির আলির দিকে। মানুষটা ছটফট করছে। কেন ছটফট করছে সে বুঝতে পারছে না, তবে তার ধারণা একটু আগে যে মেয়েটা এসেছিল তার সঙ্গে এর কোনো যোগ আছে। ব্যাপারটা ইয়াসিনের ভালো লাগছে না। সে তার ছোট জীবনে লক্ষ করেছে নিরিবিলি সংসারে কোনো একটা মেয়ে উপস্থিত হলেই সব লণ্ডভণ্ড হতে শুরু করে। তার নিজের বাবার সংসারেও একই ঘটনা ঘটেছে। সে এবং তার বাবা সুখেই ছিল। একসঙ্গে ভিক্ষা করত। রাতে ঘুমানোর জন্যে সুন্দর একটা জায়গাও তাদের ছিল। বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে ঘুমাত। বাবা গুটুর গুটুর করে কত মজার গল্প করত। তার বাবার ভিক্ষুক জীবন বড়ই রোমাঞ্চকর। হঠাৎ তাদের সংসারে এক কমবয়সী ভিখারিনি উপস্থিত হল। সেও তাদের সঙ্গে ভিক্ষা করা শুরু করল। এরপর থেকে বাবা আর তার ছেলেকে দেখতে পারে না। কারণে-অকারণে ধমক। একদিন তাকে এমন এক ধাক্কা দিল যে সে একটু হলেই ট্রাকের নিচে পড়ত।

এই সংসারেও একই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। মেয়েটা ঢুকে পড়েছে। এখনই কেমন মাতবরি শুরু করেছে—’পানি গরম করে আমাকে ডাকবি। চা বানাবি না। চা আমি এসে বানাব।’ শখ কত। তুমি চা বানাবে কেন? আমি কি বানাতে পারি না? এই মেয়েকে শিক্ষা দেবার ক্ষমতা ইয়াসিনের আছে। মেয়েকে শিক্ষা দেবার জিনিস তার ব্যাগেই আছে। শিক্ষা দেবার ভয়ঙ্কর জিনিসটা সে আসলে যোগাড় করেছিল তার বাবার সঙ্গে যে মেয়েটা ঘোরে তাকে শিক্ষা দেবার জন্যে। সেই সুযোগ তার খুব ভালোই আছে। বাবা মনে কষ্ট পাবে এমন কাজ ইয়াসিন কোনোদিন করবে না। আসমান থেকে ফেরেশতা নেমেও যদি বলে—’ইয়াসিনরে কাজটা কর। তোর আখেরে মঙ্গল হবে।’ তবু সে কাজটা করবে না। তার বাবার মনে কষ্ট হয় এমন কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব না।

মিসির আলি নামের মানুষটার মনে কষ্ট হয় এমন কিছুও সে করতে পারবে না। এই মানুষটাও পেয়ারা মানুষ। তবে প্রতিমা নামের মেয়েটার কিছু হলে মিসির আলির যাবে আসবে না। কারণ উনি মেয়েটাকে পছন্দ করেন না। উনি যে ছটফট করছেন- মেয়েটার কারণেই ছটফট করছেন। মেয়েটা উনাকে নিয়ে চলে যেতে চাচ্ছে। উনি যেতে চাচ্ছেন না। মেয়েটার ক্ষতি হলে উনি খুশিই হবেন।

ইয়াসিনের ট্র্যাংকে একটা বোতল আছে। বোতলে ভয়ঙ্কর জিনিস আছে। ভয়ঙ্কর জিনিসটা দেখতে পানির মতো। গ্লাসে ঢাললে মনে হবে পানি ঢালা হয়েছে। সেই পানি মুখে দিলে জ্বলেপুড়ে সব ছারখার হয়ে যাবে। জিনিসটার নাম এসিড। এর আরেকটা নাম আছে—ভোম্বল। ভোম্বল নামটা ফিসফিস করে বললেই—যার বোঝার সে বুঝে নেবে।

ইয়াসিন বলল, স্যার চা খাইবেন?

মিসির আলি কিছু বললেন না। ইয়াসিন আবার বলল, স্যার চা খাইবেন?

মিসির আলি সেই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। ইয়াসিনের মনটা খারাপ হয়ে গেল— আহারে লোকটা কী কষ্টে পড়েছে! দুনিয়াদারিই তার মাথায় নাই। লোকটার মাথায় মেয়েটা ঘুরছে। লোকটাকে মেয়ের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। বাঁচানোর সরঞ্জাম তার হাতেই আছে—এক নম্বুরি ভোম্বল। এই ভোম্বল লোহা হজম করে ফেলে। এই ভোম্বল সহজ ভোম্বল না।

ইয়াসিন চা বানাতে গেল। মিসির আলি না চাইলেও সে সুন্দর করে চা বানিয়ে সামনে রাখবে। মনে মনে বলবে—’এত চিন্তার কিছু নাই। আমি আছি না। আমি একবার যারে ভালো পাই তারে জন্মের মতো ভালো পাই।

.

মিসির আলি বেতের চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর হাতে সিগারেট। সামনে চায়ের কাপ। চায়ের কাপের চা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে—তিনি খালি কাপেই চুমুক দিচ্ছেন। হাতের সিগারেটের ছাইও সেইখানেই ফেলছেন। তাঁর মুখের কাঠিন্য কমে আসছে। দলিলের রহস্য পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। তিনি এগুচ্ছেন সহজ লজিক দিয়ে। সহজ লজিক তাঁকে যেখানে পৌঁছে দিচ্ছে সেই জায়গাটা তাঁর পছন্দ না। তিনি এই জায়গাটায় পৌঁছতে চাচ্ছেন না।

মিসির আলি লজিকের সিঁড়িগুলি এইভাবে দাঁড়া করিয়েছেন—

১. দলিলের লেখাগুলি তার হাতের। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

২. কোনো নেশার বস্তু খাইয়ে ঘোরের মধ্যে এই লেখা আদায় করা হয় নি। কারণ লেখা স্পষ্ট, পরিষ্কার

৩. মানুষকে হিপনোটাইজ করে কিছু লেখা লেখানো যায়—সেই লেখাও হবে নেশাগ্রস্ত মানুষের হাতের লেখার মতো। ছোট কোনো বাক্যও সম্পূর্ণ করা প্রায় অসম্ভব। নেশাগ্রস্ত এবং হিপনোটিক ইনফ্লুয়েন্সের লেখা হবে কাঁপা কাঁপা। এই সময় ভিশন ডিসর্টটেড হয় বলে কেউ সরলরেখা টানতে পারে না, এবং সরলরেখায় লিখতেও পারে না।

কাজেই তিনি দলিলের লেখাগুলি ঠাণ্ডা মাথায় এবং অবশ্যই সূক্ষ্ম মস্তিষ্কে লিখেছেন।

৪. প্রতিমা তাকে দলিল দেখাবার সময় খুব মজা পাচ্ছিল এবং হাসাহাসি করছিল। কাজেই দলিলের ব্যাপারটা মেয়েটার কাছে সিরিয়াস কোনো ব্যাপার না—মজার কোনো খেলা। এই খেলা সে প্রথম খেলছে না। আগেও খেলেছে।

তা হলে ব্যাপার এই দাঁড়াচ্ছে যে মেয়েটি মজা করার জন্যে মিসির আলিকে দিয়ে লেখাগুলি লিখিয়ে নিয়েছে। এবং মেয়েটি জানে এই লেখার বিষয় মিসির আলির মনে নেই। মনে থাকলে তো খেলাটার মজা থাকত না।

তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে মেয়েটা মিসির আলিকে দিয়ে কাগজে লেখার মতো জটিল কাজটি করিয়ে নিয়েছে এমনভাবে যে মিসির আলি কিছু বুঝতেই পারেন নি। যার স্মৃতি পর্যন্ত মস্তিষ্কে নেই। অর্থাৎ মিসির আলির মস্তিষ্কের পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল মেয়েটির কাছে। মেয়েটি কোনো এক অস্বাভাবিক ক্ষমতায় মানুষের মাথার ভেতর সরাসরি ঢুকে যেতে পারছে। এই ক্ষমতা বিজ্ঞান স্বীকার করে না। তবে এ ধরনের ক্ষমতার উল্লেখ বারবারই প্রাচীন সাহিত্যে পাওয়া যায়। পৌরাণিক কাহিনীতে পাওয়া যায়। আমেরিকার ডিউক ইউনিভার্সিটি এই বিষয়ের ওপর দীর্ঘ গবেষণা চালিয়ে প্রমাণ করেছে যে, এই ক্ষমতার কোনো অস্তিত্ব নেই। এটি শুধুমাত্রই লোকজ বিশ্বাস।

মিসির আলি আরেকটা সিগারেট ধরালেন। বুক শেলফ থেকে সাইকোপ্যাথিক মাইন্ড বইটি হাতে নিলেন—কিন্তু পাতা উল্টালেন না। তাঁর স্মৃতিশক্তি আগের মতো নেই—তার পরেও এই বইটির প্রতিটি পাতা তার প্রায় মুখস্থ।

পৃথিবীর ভয়ঙ্কর সব খুনিদের মানসিক ছবি বা সাইকোলজিক্যাল প্রফাইল এই বইটিতে দেওয়া আছে। প্রতিটি ভয়ঙ্কর অপরাধীর ক্ষেত্রেই বলা হচ্ছে—অপরাধীর একটি অস্বাভাবিক ক্ষমতার কথা—অন্যকে বশীভূত করার ক্ষমতা।

এই ক্ষমতার উৎস কী? অপরাধী কি অন্যের মাথার ভেতর ঢুকে পড়ছে? তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে?

এই ক্ষমতা শুধু যে ভয়ঙ্কর অপরাধীদের আছে তা না—মহান সাধুসন্তদেরও আছে বলে বলা হয়ে থাকে। তারাও মানুষের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারতেন। একজনের নিয়ন্ত্রণ আলোর দিকে—অন্যজনের নিয়ন্ত্রণ অন্ধকারের দিকে।

‘স্যার চা খাইবেন?’

মিসির আলি চমকে তাকালেন। ইয়াসিন তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের দৃষ্টিটা যেন কেমন। যেন অশুভ কিছু সেখানে আছে।

মিসির আলি বললেন, না চা খাব না। আমি রাস্তায় কিছুক্ষণ হাঁটব।

‘স্যার আপনের শইল কি খারাপ?’

‘না আমার শরীর ভালো।

.

ফজলু খুব লজ্জিত বোধ করছে। ফতে নামের এমন একজন ভালো মানুষের ব্যাপারে সে এত খারাপ ধারণা করেছিল। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। প্রথম থেকেই তার মনে হয়েছিল—লোকটা খারাপ। লোকটার ভেতর মতলব আছে। লোকটার নজর দিলজানের দিকে। লোকটা যখন তাকে সিগারেট দিত—তার কাছে মনে হত সে কোনো মতলবে সিগারেটটা দিচ্ছে। তার নিতে ইচ্ছা করত না, লোভে পড়ে নিত। লোভ খুব খারাপ জিনিস।

ফজলু দিলজানকে বলে দিয়েছে যেন কখনো ফতের কাছে না যায়। ফতে যদি তাকে ডাকে সে যেন ঘরে ঢুকে পড়ে। ফজলু নিশ্চিত ছিল—ফতে দিলজানকে ডাকবে। ফতে ডাকে নি। কোনোদিনও ডাকে নি। তার পরেও ফজলুর সন্দেহ দূর হয় নি। আজ সন্দেহ পুরোপুরি দূর হয়েছে। ফতে তাকে নার্সারিতে কাজ যোগাড় করে দিয়েছে। প্রতিদিন তিন ঘণ্টা কাজ করবে। গাছে পানি দেবে—গোবর আর মাটি মিশিয়ে মশলা তৈরি করবে। বিনিময়ে পঞ্চাশ টাকা পাবে।

কাজটা শেখা হয়ে গেলে সে নিজেই একটা নার্সারি দিবে। কোনো একটা রাস্তার ফুটপাত দখল করে বসে পড়বে। সে টাকা জমাতে শুরু করেছে। বন্ধকি বসতবাড়ি ছাড়িয়ে এনে স্ত্রী-কন্যাকে গ্রামে পাঠিয়ে দেবে। মেয়ের বিয়ে দেবে

ফজলু গাঢ় স্বরে বলল, আপনি আমার বড় একটা উপকার করলেন।

ফতে বলল, এটা কোনো উপকার হল নাকি। এটা কোনো উপকারই না। নাও একটা সিগারেট নাও।

ফজলু আনন্দে অভিভূত হয়ে সিগারেট নিল। এমন একটা ভালোমানুষের বিষয়ে সে কী খারাপ ধারণাই না করেছিল। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।

ফতে বলল, চা খাবে নাকি? চল এক কাপ চা খাই।

ফজলু বলল, চলেন। চায়ের দাম কিন্তু আমি দিমু। এইটা আমার একটা আবদার।

.

ফতে চা খাচ্ছে। রাস্তার পাশের দোকানের টুলের উপর সে একা বসে আছে। ফতের এটা দ্বিতীয় কাপ। প্রথম কাপের দাম ফজলু দিয়ে চলে গেছে। দ্বিতীয় কাপে সে একা বসে চুমুক দিচ্ছে।

তার হাতে সময় বেশি নেই। বড় ঘটনা আজ রাতেই ঘটবে। এই ভেবে তার মনে আলাদা কোনো উত্তেজনা নেই বরং শান্তি শান্তি লাগছে। ঘটনাগুলি সে সাজিয়ে রেখেছে। সাজানোর কোনো ভুল নেই। তার পরেও প্রতিটি ঘটনায় একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া দরকার। ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা করা।

ফতের মাথা ঠাণ্ডাই আছে। যে কোনো বড় ঘটনা ঘটাবার আগে তার মাথা ঠাণ্ডা থাকে। বড় ঘটনা এর আগে সে চারবার ঘটিয়েছে—তিনবার গ্রামে, একবার শহরে। কোনোবারই তার মাথা এলোমেলো ছিল না। চারটা বড় ঘটনার বিষয়ে কেউই কিছু জানে না। এবারো কেউ কিছু জানবে না। এবারেরটা আরো বেশি গোছানো।

আজ বুধবার তার মামি গিয়েছেন তার আদরের বুড়ো ভাইয়ার কাছে। সেই ভাইয়া মনের সুখে পুটুরানী পুটুরানী করে আদর করছে। আদরটাদর খেয়ে মামি বাসায় ফিরবে। তার আগেই বাড়ির গেটের কাছে ফতে বসে থাকবে লুনাকে নিয়ে। লুনা তার মাকে দেখে আনন্দে হাততালি দিয়ে বলবে–পুটুরানী পুটুরানী। এটা লুনা বলবে কারণ ফতে তাকে শিখিয়ে দেবে। এই ঘটনার ফলাফল কী হবে ফতে জানে না। হয়তো মা মেয়েকে চড়থাপ্পড় দেবে। কিংবা হাত ধরে মেয়েকে ঘরে নিয়ে যাবে। যাই করুক না কেন ফতের কিছু যায় আসে না। সে জানে মামি তাকে অকারণে কিছুক্ষণ ধমকাধমকি করবে। তারপর পাঠাবে কোনো একটা কিছু দোকান থেকে কিনে আনতে। কাপড় ধোয়ার সাবান, সয়াবিন তেল, কিংবা কাঁচা মরিচ বা ধনেপাতা।

ফতে গায়ে চাদর জড়িয়ে বাজার আনতে যাবে। চাদরের নিচে গুটিসুটি মেরে লুকিয়ে থাকবে লুনা। গেট দিয়ে যখন ফতে বের হবে তখন কেউ বুঝতেও পারবে না, ফতের চাদরের নিচে কী আছে।

ফতে কিছুক্ষণের জন্যে লুনাকে রাখবে ফজলুর কাছে। লুনা খুব স্বাভাবিকভাবেই থাকবে—হইচই করবে না, কান্নাকাটি করবে না। নিজের মনে মুঠি বন্ধ করা এবং মুঠি খোলার খেলা খেলতে থাকবে। লুনাকে রেখে ফতে অতিদ্রুত বাজার শেষ করে বাড়ি ফিরবে। তখন ফতের মামি আতঙ্কিত গলায় ফতেকে জিজ্ঞেস করবেন—লুনা কোথায়। ওকে পাচ্ছি না। ফতে বলবে, আপনার সঙ্গেই তো ছিল। মামি তখন কাঁদো কাঁদো গলায় বলবেন, দেখছি নাতো। ফতে তৎক্ষণাৎ লুনার খোঁজে রাস্তায় বের হবে। চলে যাবে ফজলুর কাছে। সেখান থেকে লুনাকে নিয়ে যাবে বুড়িগঙ্গায়। যে নৌকাটা সে থাকার জন্যে ভাড়া করেছে সেই নৌকায়। আসল ঘটনা নৌকায় ঘটানো হবে।

তারপর সে আবার বাড়ি ফিরে আসবে। ততক্ষণে পুলিশ চলে এসেছে। বাড়িতে কান্নাকাটি হচ্ছে। ফতে আবারো লুনার খোঁজে বের হবে। এবার বের হবে বেবিট্যাক্সি নিয়ে। তার চাদরের নিচে বড় কালো পলিথিনের ব্যাগে সযত্নে রাখা মাথাটা বের করে সে যাত্রীদের সিটের এক কোনায় রেখে দেবে। আসল খেলা শুরু হবে তখন।

লুনা মেয়েটাকে নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই। এই মেয়েটা বড় হয়ে বাবা- মার জন্যে যন্ত্রণা ছাড়া কিছু নিয়ে আসবে না। সব যন্ত্রণার সমাধান। এক অর্থে ফতে তার মামা-মামির উপকারই করছে।

পুরো ব্যাপারটা ভাবতে ফতের খুব মজা লাগছে। হাসি চাপতে পারছে না। চায়ের দোকানি অবাক হয়ে বলল, ভাইজান একলা একলা হাসেন ক্যান?

ফতে হাসি না থামিয়েই বলল, আমার মাথা খারাপ এই জন্যে একা একা হাসি। দেখি আরেক কাপ চা দেন। চিনি বেশি করে দেবেন। সব পাগল চিনি বেশি খায়।

ফতে শরীর দুলিয়ে শব্দ করে হাসবে। তার কাছে মনে হচ্ছে কালো পলিথিনের ব্যাগে মোড়া জিনিসটা একবার এই দোকানদারকে দেখিয়ে দিলে হয়। এই সব চায়ের দোকান অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। রাত একটা দেড়টার দিকে দোকান খোলা থাকার কথা। বেবিট্যাক্সি দোকানের সামনে রেখে সে চা খেতে আসতে পারে। তখন দোকানিকে বলতে পারে—ভাইসাব আমার বেবিট্যাক্সির সিটে একটা জিনিস আছে। দেখলে মজা পাবেন। দেখে আসেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *