০৫. স্বাতীর ঘরের দরজা জানালা বন্ধ

স্বাতীর ঘরের দরজা জানালা বন্ধ। পর্দা টানানো। ঘর অন্ধকার, যে সন্ধ্যার পর বাতি জ্বালায় নি। নাজমুল সাহেব ব্যাপারটা লক্ষ করলেন। তিনি স্বাতীর ঘরের বান্দারার সামনে দিয়ে কয়েকবার হাঁটাহাঁটি করলেন। একবার ডাকলেন, স্বাতী কী করছিস মা?

স্বাতী জবাব দিল না। নাজমুল সাহেব জবাবে জবাবের জন্য কান পেতে ছিলেন। তিনি শুনলেন ভেতরে মিউজিক হচ্ছে। ট্রাম্পেট। স্বাতীর প্রিয় বাজনা। ট্রাম্পেট আনন্দময় সঙ্গীত। মার্শাল মিউজিক, যে মিউজিক উৎসবের কথা মনে করিয়ে দেয়। দরজা জানালা বন্ধ করে, বাতি নিভিয়ে আনন্দময় বাজনা শুনতে হবে কেন? নাজমুল সাহেব চিন্তিত মুখে একতলায় নামলেন।

রওশন আরা রান্নাঘরে। তিনি বই দেখে একটা চাইনিজ স্যুপ তৈরি করছেন। তী বিকেলে বলেছে তার শরীর ভালো লাগছে না, রাতে কিছু খাবে না। দুপুরেও ভালোমতো খায় নি। ভাত নাড়াচাড়া করে উঠে পড়েছে। নাজমুল সাহেবকে রান্নাঘরে দেখে তিনি চোখ তুলে তাকালেন। ব্লেন্ডারে হাড় ছড়ানো মুরগির মাংস দেয়া হয়েছে। ব্লেন্ড করতে হবে। কড়াইয়ে সয়া সস মেশানো সবজি ফুটছে। ব্লেড করা মাংস কড়াইয়ে ছেড়ে দিতে হবে। তাঁর হাতে সময় নেই। তিনি বিরক্ত চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন।

নাজমুল সাহেব বললেন, স্বাতীর কী হয়েছে বলো তো?

কেন?

সন্ধ্যা থেকে দেখছি ঘরের দরজা জানালা বন্ধ। ঘরে বাতি জ্বলে নি।

রওশন আরা বললেন, মাথা-টাথা ধরেছে। শুয়ে আছে।

কিছুদিন থেকেই তার মধ্যে অস্থির ভাবটা লক্ষ করছি।

এই বয়সে অস্থির ভাব আসে। আবার চলে যায়। এটা কিছু না।

নাজমুল সাহেব চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। রওশন আরা বললেন, তুমি রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থেক না। আমি কাজ করছি।

কাজ করো। তোমার কাজ তো আমি নষ্ট করছি না।

করছ। কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে আমি রান্নাবান্না করতে পারি না।

নাজমুল সাহেব বের হয়ে এলেন। আবার দোতলায় গেলেন। সন্ধ্যা থেকে তার নিজেরও খুব একা একা লাগছে। স্বাতীর সঙ্গে গল্প করতে পারলে ভালো লাগত। সবচেয়ে ভালো হতো স্বাতীকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে গেলে। বেড়ানোর জায়গা তেমন নেই। তাঁর বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা সীমিত। আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গেও যোগাযোগ নেই। তিনি কোথাও যান না। কেউ এলে আনন্দিত হন না। বিরক্তবোধ করেন। সারাজীবন কোর্টে বিচারকের চেয়ারে বসার এই হলো কুফল। এই চেয়ার মানুষের ভেতর থেকে মানবিক গুণ আস্তেআস্তে শুষে নিয়ে যায়। মানুষটা আর পুরোপুরি মানুষ থাকে না। মানুষের ছায়া হয়ে যায়।

তিনি স্বাতীর ঘরের দরজায় হাত রেখে ডাকলেন, স্বাতী মা, কী করছিস?

কিছু করছি না বাবা। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছি।

কেন?

এম্নি।

তোর সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করা যাবে?

হ্যাঁ যাবে।

স্বাতী দরজা খুলে দিল। মিউজিক সেন্টারের নব ঘুরিয়ে শব্দ কমিয়ে দিয়ে হাল্কা গলায় বলল, তোমাকে গল্প করতে হবে অন্ধকারে বসে। অসুবিধা হবে না তো বাবা?

না। ঘর অন্ধকার কেন?

কেন জানি আলো চোখে লাগছে। বাবা তুমি খাটে এসে পা তুলে বসো। কী নিয়ে গল্প করতে চাও?

তোর পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?

মোটামুটি। ভালো না।

ভালো না কেন?

স্যাররা ইন্টারেস্টিং করে পড়াতে পারেন না। একঘেয়ে বক্তৃতা দেন। শুনতে ভালো লাগে না। ক্লাসে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতেই আমার বেশি ভালো লাগে। স্যার বক্তৃতা করেন, আমরা মজার মজার নোট নিজেদের মধ্যে চালাচালি করি।

তোর কি অনেক বন্ধু-বান্ধব?

আমার একজনই বন্ধু?

লিলি?

হ্যাঁ লিলি।

ওকে তোর এত পছন্দ কেন?”

বাবা ও খুব বিশ্রী পরিবেশে বড় হচ্ছে–তারপরেও সে বড় হচ্ছে নিজের মতো করে। ও হচ্ছে এমন একটা মেয়ে যে জীবনে কোনো দিন মিথ্যা কথা বলে নি।

তাই নাকি?

হ্যাঁ তাই। ও কেমন মেয়ে তোমাকে বুঝিয়ে বলি বাবা ধরো, আমি ভয়ঙ্কর কোনো অন্যায় করলাম, তোমরা সবাই আমাকে ত্যাগ করলে। ও তা করবে না। ও আমার পাশে থাকবে।

তুই কি কোনো অন্যায় করেছিস?

না।

তোর কি কোনো সমস্যা হয়েছে? তুই কি কোনো সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিস?

হুঁ।

সমস্যাটা কী?

আমার সমস্যা আমি নিজেই মিটাতে চাচ্ছি। এইজন্য তোমাদের বলতে চাচ্ছি। তেমন বড় কিছু সমস্যা না। সমস্যা যদি খুব বড় হয়ে দেখা দেয় তখন তোমাদের বলব।

নাজমুল সাহেব অত্যন্ত চিন্তিতবোধ করছেন। স্বাতীর ব্যাপারটা তিনি ধরতে পারছেন না। তিনি অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে মেয়েকে টেনে নিয়ে কোমল গলায় বললেন, মা শোন! আমি তো পুরনো দিনের মানুষ। তোদের এ-কালের সমস্যার ধরন-ধারণ আমি জানি না। তারপরেও বলছি, তোর সমস্যা মেটানোর চেষ্টার ত্রুটি আমার দিক থেকে কখনও হবে না। মনে করা যাক তুই একটি ছেলেকে পছন্দ করেছিস, যাকে আমাদের পছন্দ না। যাকে কিছুতেই আমরা গ্রহণ করতে পারছি না–তারপরেও আমরা তোর মুখের দিকেই তাকাব।

সেটা আমি জানি।

তাহলে তুই এমন ঘর-দুয়ার অন্ধকার করে বসে আছিস কেন?

বাতি জ্বালাব?

হুঁ।

স্বাতী বাতি জ্বালাল। বাবার দিকে তাকিয়ে হাসল। নাজমুল সাহেব হাসিমুখে বললেন, তোর কালেকশনে কোনো নাচের মিউজিক আছে?

আছে।

তাহলে সুন্দর একটা নাচের মিউজিক দে তো মা। ছোটবেলার ঐ নাচটা দেখাবি? মাই লিটল ড্যান্সার–ছোট্ট নর্তকী। স্বাতী হাসছে। নাজমুল সাহেব হাসছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *