০৫. স্বর্ণকুমারীর বোম্বাইবাস
স্বর্ণকুমারীর বয়স এখন পনেরো। ঠাকুরবাড়ির বিখ্যাত রংরূপের সঙ্গে তেজি চালচলনে তাকে যেন আগুনের হলকা মনে হয়। জ্যোতিদাদার সঙ্গে দু একটি সভায় গিয়ে কবিতাপাঠ করেছেন ইতিমধ্যেই আর তাতেই যেন হইচই পড়ে গেছে কলকাতার তরুণ কাব্যপ্রেমী মহলে। ছিপছিপে কনকবর্ণা তরুণী কবিটিকে একটু দেখার জন্য ভিড় জমে যায় সভায় সভায়।
শোভাবাজারের এক বনেদি বাড়ির কবিতার আসরে স্বর্ণ সেদিন এলেন কমলা রঙের পাটোলা সিল্ক পরে, সঙ্গে তিনলহরী মুক্তোর হার। সবচেয়ে চোখে পড়ে মাথার ঘোট্ট টুপি ও কপালে চুলের গুচ্ছে জড়ানো মুক্তোর টায়রা। তাকে দেখেই গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। স্বর্ণ নিজেও শুনতে পান নানারকম ফিসফাস আলোচনা।
কেউ বলছে, আরে বাবা, মেয়ের সাজ দেখব না পদ্য শুনব! শুনেছি ইনি নাকি একটি কন্যার জননী। আবার কবিতাও লেখেন।
উত্তরে আর-একজন বলে, আমি অবশ্য বিশ্বাস করি না এ-সব পদ্য ওই সাজুনি মেয়ের লেখা, নিশ্চয় দাদারা লিখে দেয় বোনের নামে। মেয়েদের আবার সাহিত্যচর্চা! কলি কালে কত কী দেখব।
প্রথমজন বলে, তালে বোধহয় রূপের জোরে লেখা ছাপাচ্ছে, সম্পাদকেরা অমন চেহারা দেখেই কুপোকাৎ।
আরে সম্পাদকেরা তো সব ঠাকুরবাড়ির প্রসাদ পাওয়ার জন্য বসে আছে। বিদ্যেসাগর ফিমেল এডুকেশন করেছেন, তাই দেখে দেবেনঠাকুর মেয়েকে সাহিত্যিক বানাচ্ছেন। ভাবছেন তরু দত্ত, জেন অস্টেন যদি পারে, তার ঘরের মেয়েই বা পারবে না কেন!
স্বর্ণর এ-সব শুনে কান্না পায়, তার এত সাধনার কি কোনও দাম নেই এদের কাছে? অন্য সবাই যখন তাঁকে ধন্য ধন্য করছে তখনও এ-সব নিন্দুকদের কুকথা ভুলতে পারেন না তিনি।
সভার মাঝখানে একবার জ্যোতিদাদার হাত চেপে ধরে বলেন, এখানে অনেকে বোধহয় আমাকে পছন্দ করছেন না, চলো আমরা ফিরে যাই।
জ্যোতি অবাক হন, সেকী রে, সবাই যে তোর কবিতার কথাই বলছে। এ-সব বাজে কথা কে তোর মাথায় ঢোকাল?
সবাই হাঁ হাঁ করে জ্যোতিকে সমর্থন করে। এমনকী যারা এতক্ষণ বাজে কথা বলছিল তারাও সামনে এসে স্বর্ণকুমারীকে বলে, সেকী আপনি চলে গেলে এই সভা যে অন্ধকার হয়ে যাবে! বিলেতের যেমন জর্জ এলিয়ট আছেন, আমাদের তেমন আপনি। অন্য মহিলারা যাঁরা বামাবোধিনীর পাতায় লেখার চেষ্টা করেন তারা কি লেখক নাকি?
লোকের ভণ্ডামি সইতে পারেন না স্বর্ণ। প্রতিবাদ করে বলেন, ওভাবে বলবেন না, ওঁরা অনেক অসুবিধের মধ্যে দিয়ে চেষ্টা করছেন, অনেকেই ভাল লেখেন। আমি তো ওঁদেরই মতো, সবে শুরু করেছি।
একজন তাচ্ছিল্য করে বলে ওঠে, আহা কীসে আর কীসে…
এবার জ্যোতি ঠাকুর বিরক্তি প্রকাশ করলে আসরের কর্তাব্যক্তিরা গোলমেলে লোকদের কয়েকজনকে সরিয়ে নিয়ে যান। আবার কবিতাপাঠ শুরু হয়।
.
ঠাকুরবাড়িতে ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে স্বর্ণকুমারী ও জানকীনাথের মেয়ের নামকরণ অনুষ্ঠান আর বর্ণকুমারীর বিয়ের তোড়জোড়। পরপর দুটি উৎসব তাই সবার মনেই সাজো সাজো রব। দেবেন ঠাকুর প্রত্যেক বাচ্চার জন্মের ছমাস থেকে একবছরের মধ্যে সুবিধেমতো দিনে মুখেভাত ও নামকরণ করার নিয়ম করেছেন। তিনি হিন্দুদের মতো অন্নপ্রাশন বলেন না, কিন্তু সেরেস্তার কর্মচারীরা ওই অন্নপ্রাশন বলেই হিসেব লেখেন।
স্বর্ণর মেয়ের নামকরণ অনুষ্ঠানটি পেনেটির বাগানবাড়িতে বেশ ধুমধাম করে সম্পন্ন হল। রবির জন্মের পর থেকেই এ-বাড়ির অন্নপ্রাশন ব্রাহ্মমতে হয়ে আসছে। এ ব্যাপারে দেবেন ঠাকুর একটি সুন্দর প্রথা চালু করেছেন। নামকরণ উপলক্ষে একটি পিঁড়িতে শিশুর নাম লেখা হল হিরন্ময়ী। তার চারদিকে আলপনা এঁকে বাচ্চারা মহর্ষির নির্দেশমতো পিঁড়ির চারদিকে মোমবাতি লাগিয়ে দিল। নামের চারদিকে মোমের আলো জ্বলে ওঠার পর স্বর্ণর মনে হয় তার মেয়ের নামের ওপর যেন বাবামশায়ের আশীর্বাদ ঝরে পড়ছে।
জানকীনাথের অবশ্য একটু মনখারাপ তার বাবামায়ের অনুপস্থিতির কথা ভেবে। তার মনে হয়, স্বর্ণর মতো পুত্রবধু পাওয়া যে কত ভাগ্যের ব্যাপার তা তো আমার বাবামশায় বুঝলেন না, এখন কি নাতনিকেও দেখতে আসবেন না!
গোঁড়া হিন্দুরা না এলেও বাড়িতে লোকজন অনেক। দেবেন ঠাকুর যথারীতি সারদার হাত দিয়ে নাতনির জন্য সোনার বিছেহার আশীর্বাদী পাঠিয়েছেন। জয়পুরি সাদা পাথরের থালা বাটি গেলাসের পারিবারিক উপহার তো আছেই। মামা-মাসিরা মেয়ের গা ভরে গয়না দিলেন আর জড়ো হয়েছে মেয়ের জামা সেলাই করার জন্য রাশিকৃত রেশমি ছিট কাপড়। সবাই হিরণকে কোলে নিয়ে মাতামাতি করছে, এত সুন্দরী মেয়ে হয়েছে বলে।
সব অতিথি চলে গেলে বিকেলের মরা আলোয় স্বর্ণ ও জানকীনাথ ঘাটে এসে বসলেন, জানকীর কোলে হিরন্ময়ী।
আমি যে আজ কত খুশি তা তুমি ভাবতেও পারছ না স্বর্ণ, গর্বিত বাবা জানকীনাথ বললেন। শুধু বাবামশায়ের অভাবটা মনে আসছে এত আনন্দের মধ্যেও।
স্বর্ণ আদুরে গলায় বলে ওঠেন, তুমি কি এখন শুধু মেয়েকেই ভালবাসবে, আমার আদর ফুরিয়ে গেল!
স্বর্ণ, তোমার জন্য আমি জননী জন্মভূমি ছেড়েছি, এখন যদি বলো মেয়েকে ছাড়তে, তা পারব না। কৌতুক করে জানকী বলেন, অত পরীক্ষা নিয়ো না সখী।
আহা কত ভালবাসা জানা আছে, এই তো সেদিন বলছিলে বোম্বাইতে মেজোদাদার কাছে পাঠিয়ে দেবে আমাকে। আর ভাল লাগছে না বুঝি?
স্বর্ণ, স্বর্ণ, সে দু-তিন বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে। তুমি তো সেখানে আরামে থাকবে, আমিই একা একা কষ্ট পাব। কিন্তু তুমি যখন দু’বছর পর ঘষে মেজে ঝকঝকে কেতাদুরস্ত হয়ে ফিরে আসবে, সেদিনটা ভেবে গর্বে আমার বুক ভরে যাচ্ছে।
মেজোবউঠানের সঙ্গে বসে বসে এ-সব ষড়যন্ত্র করেছ তাইনা? স্বর্ণ বলেন। কিন্তু তোমরা যা ভাবছ তা কী করে হবে? মেয়েকে সেখানে দেখাশোনা করতে হবে, অত পড়াশোনা কখন করব?
সেটা তুমি মেজোবউঠানের ওপর ছেড়ে দাও স্বর্ণ, তিনি যখন তোমার দায়িত্ব নিয়েছেন তখন আমি নিশ্চিন্ত, সব ব্যবস্থা তিনি ঠিকঠাক করবেন, জানকীনাথ আশ্বস্ত করেন।
মেজোবউঠানকে তোমার খুব পছন্দ তাই না, তুমি চাও আমি অবিকল তাঁর মতো হই। স্বর্ণ বললেন একটু অভিমানের স্বরে, আমার লেখার টেবিলে আমি যে সবার চেয়ে আলাদা তা বুঝি তোমার চোখে পড়ে না?
জানকী মেয়ে সমেত পঞ্চদশী স্ত্রীকে কাছে টেনে হেসে ওঠেন, স্বর্ণ তুমি বড় ছেলেমানুষ। বাবামশায়ের আর দাদাদের স্নেহের পুতলি হয়েই আছ, এখনও বড় হলে না। অবশ্য সেটাই তোমার দুর্নিবার আকর্ষণ।
তা হলে দূরে পাঠাচ্ছ কেন, আমার যে তোমাকে ছেড়ে থাকতে একদম ভাল লাগে না, স্বর্ণ ঠোঁট ফোলান।
জানকী বলেন, তুমি এখন খনি থেকে তোলা কয়লা-চাপা হিরে, কিন্তু বোম্বাইয়ে মেজদাদা মেজোবউঠানের শিক্ষায় ডায়মন্ড কাটিঙে তুমি হয়ে উঠবে দুষ্প্রাপ্য কোহিনূর।
আর সেই কোহিনূর শুধু তোমার মুকুটে শোভা পাবে? স্বর্ণ হেসে বলেন, সেটি হচ্ছে না মশায়, তখন দেখবে আমি প্রেমের স্বয়ম্বর ডাকব।
আর আমি হব তোমার স্বয়ম্বরের দারোয়ান। হা হা করে হেসে ওঠেন জানকী। তার হাসির আওয়াজে ভয় পেয়ে হিরন্ময়ী কাঁদতে শুরু করে। কান্না কিছুতে থামাতে না পেরে শেষে দাইকে ডেকে বাচ্চা হস্তান্তর করেন নতুন বাবা-মা। সন্ধ্যার গঙ্গার হাওয়ায় পাশাপাশি ঘনিষ্ঠ হয়ে আরও কিছুক্ষণ ঘাটে বসে থাকেন স্বর্ণকুমারী ও জানকীনাথ, দূরে বয়ে যাওয়া নৌকোয় এক এক করে রেড়ির তেলের কুপির আলো জ্বলে ওঠে।
অক্টোবরে হিরন্ময়ীর নামকরণের রেশ কাটতে না কাটতেই নভেম্বরে বর্ণকুমারীর বিয়ে লাগল। এবার মেডিকেল কলেজের একটি মেধাবী ছাত্রকে জামাই করতে পেরে দেবেন ঠাকুর বেশ খুশি। সতীশচন্দ্র ব্রাহ্মণ সন্তান, বাড়ি গোস্বামী-দুর্গাপুরে। পিরালি বংশে বিয়ে করায় ইনিও ত্যাজ্যপুত্র হয়ে দেবেন ঠাকুরের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিলেন। বিয়ের পর থেকেই তার মেডিকেল কলেজের খরচ জোগানো হতে থাকল ঠাকুরবাড়ি থেকে। এমনকী বিলেতে পাঠিয়ে ডিগ্রি অর্জন করানোর পরিকল্পনা ভেবে ফেললেন মহর্ষি। নববিবাহিত বর্ণ ও সতীশের জন্য ঠাকুরবাড়িতে একটি আলো হাওয়াযুক্ত বড় ঘর বরাদ্দ হল।
এইসময়, ১৮৭০ সালের এক আশ্চর্য দিনে দেবেন্দ্রনাথের স্নানঘরে কলের জল লাগানো হল। তখন কলকাতার বাড়িতে বাড়িতে পাইপের সাহায্যে পলতা থেকে হুগলি নদীর পরিশ্রুত জল পাঠানো শুরু হয়েছে। সে এক বিস্ময়, তেতলার ওপরে এত অনায়াসে কল খুললেই জল পাওয়া যাচ্ছে দেখে বাড়ির ছোটবড় সকলেই মুগ্ধ।
বালক রবির বড় ইচ্ছে একদিন বাবামশায়ের ওই অবিরল জলধারায় স্নান করেন। কিন্তু তিনি বাড়ি থাকলে তা সম্ভব নয়, চাকরদের নজর এড়িয়ে কী করে চান করা যায় তার মতলব করতে থাকেন রবি ও সমবয়সি ভাগনে সত্য।
একদিন কুস্তির আসরের পর দুই বালক সবার নজর এড়িয়ে গুটিগুটি ঢুকে পড়ল বাবামশায়ের চানঘরে। কাদামাটি মাখা ঘোট দেহদুটি জলধারার নীচে পেতে দিয়ে কী অনির্বচনীয় আনন্দ! কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্যামা চাকর এসে হাজির। দুই অপরাধীকে নিয়ে যাওয়া হল সারদার দরবারে।
সারদাদেবী কিছুক্ষণ বালকদের আপাদমস্তক দেখে বলেন, কেন গেছিলি কত্তার চানঘরে?
কাঁচুমাচু বালকরা উত্তর দেন, বড় কাদা লেগে গেছিল কুস্তি করতে গিয়ে। ওরা জানে মা কুস্তি পছন্দ করেন না।
সারদা যথারীতি বললেন, কী দরকার ও-সব বাজে খেলার? গায়ে ময়লা লাগে। একে তো শ্যামলা ছেলে, তায় আবার কাদা মেখে ভূত সাজছিস কেন রবি?
কী করব, হেমদাদা গণাদাদারা যে ডেকে নিয়ে যান, আমার কি ভাল লাগে নাকি তেল মেখে কাদা মেখে কুস্তি করতে? রবি জবাব দেন সাহস করে।
সারদাদেবী মানদা দাসীকে ডেকে বলেন, ওরে, আমার সামনে সর-ময়দা দিয়ে ছেলেদুটোকে আচ্ছা করে দলাইমলাই করার ব্যবস্থা কর। রোজ মাখাবি। আমার এই ছোট ছেলেটাই ময়লা, দেখি রং ফেরে কিনা!
রবির কাছে এ এক নতুন শাস্তি। কিন্তু ছাড় পাওয়ার কোনও উপায় নেই। মায়ের সামনে চলল ছেলেদের কষে রূপটান মাখানোর আসর।
একদিন হঠাৎ সারদার কাছে ছুটে এসে কাঁদতে শুরু করেন প্রফুল্লময়ী। মা, মা গো, আপনার ছেলের পাগলামি আর সামলাতে পারছি না। দেখুন আমাকে কীরকম মেরেছে! ঘরের জিনিস সব ভেঙে ফেলছে।
সারদা বিচলিত হয়ে দাসীদের ডাকেন। দেখ তো হেমেন আছে কি না, বীরেনের পাগলামি এত বেড়ে গেছে বউ তুমি আগে বলনি কেন, তা হলে তোমাকে মার খেতে হত না।
শান্ত দুঃখী এই বউমাটির জন্য সারদার মায়া হয়। বিয়ের পর থেকে বীরেনের পাগলামি ক্রমশ বাড়ছে। সারানোর সব চেষ্টাই বিফলে গেছে। এত দুঃখের মধ্যেও একটাই ভাল ঘটনা ঘটেছে প্রফুল্লময়ীর জীবনে, সম্প্রতি তার একটি ছেলে হয়েছে। দেবেন্দ্র নাতির নাম দিয়েছেন বলেন্দ্রনাথ। শিশু বলেন্দ্র তার বাবার পাগলামি দেখে খিলখিল করে হাসে।
পরিবারে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। হেমেন্দ্রনাথ ভাইকে সামলাতে না পেরে সাহেব ডাক্তার ডেকে পাঠালেন।
ডাক্তারের হাত ঝাঁকুনি দিয়ে বীরেন বলতে থাকেন, আমার কলাবউ কই, কলাবউ?
হেমেন ধমক দিয়ে বলে ওঠেন, কী পাগলামো করছ বীরেন, ওই তো তোমার বউ প্রফুল্লময়ী, কলাবউ আবার কে?
বিয়ের আগে থেকেই বীরেন দিদিদের কাছে বায়না ধরেছিলেন কলাবউ বিয়ে করার। এখনও মাঝে মাঝে সেটা মনে পড়ে যায় বোধহয়। প্রফুল্লর ঘোমটা সরিয়ে ভাল করে মুখটা দেখে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন বীরেন, যাঃ তুমি আমার কলাবউ না।
প্রফুল্লময়ী জোরে কেঁদে ওঠেন। দিদি এবং বড় জা নীপময়ী তাকে সরিয়ে নিয়ে যান। বড় শখ করে বোনের সঙ্গে দেওরের বিয়ে দিয়েছিলেন, এখন ওর কষ্ট চোখে দেখা যায় না।
ডাক্তারের পরামর্শে লুনাটিক অ্যাসাইলামে পাঠানো হল বীরেনকে। ঠাকুরবাড়ির পুরুষদের কম বেশি সকলেরই চন্দ্রদোষ আছে কিন্তু বীরেনই প্রথম ক্লিনিকালি লুনাটিক। বীরেনের জন্য শোকের ছায়া নেমে আসে সারা বাড়িতে।
এর ওপর হঠাৎই একদিন কলেরা হয়ে মাত্র আটাশ বছর বয়সে ও-বাড়ির গণেন্দ্র মারা গেলেন। লম্বা ফরসা উদ্যোগী দায়িত্ববান এই যুবকের মৃত্যুর জন্য কেউই তৈরি ছিলেন না। দুবাড়ির বিরোধের মধ্যে তিনি সেতুবন্ধন করেছিলেন, তাঁরই উদ্যোগে দুবাড়ির ছেলেরা মিলে নবনাটক করেছেন। চৈত্রমেলার আয়োজন করে সবাইকে মাতিয়ে রেখেছিলেন। বাড়ির সবাইকে একসুতোয় বাঁধার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তার। এখন দেবেন ঠাকুরের স্নেহধন্য এই ভাইপো চলে যেতে পুরনো ফাটলটা যেন আরও বড় হাঁ করে গিলে খেতে আসে পরিবারটাকে। দেওয়ালের একদিকে গণেনের মৃত্যুর জন্য শোক। করেন সারদা, আর অন্যদিকে যোগমায়ার চোখের জল পড়ে বীরেনের কথা ভেবে। কত্তাও এখন প্রবাসে, সারদার মনে হয়, এতবড় সংসারের সব ভার তিনি আর বইতে পারছেন না। একসঙ্গে থাকলে তাও তো দুই জা মিলে এই শোক ভাগ করে নিতে পারতেন!
মহর্ষি এখন আর কলকাতার বাড়িতে থাকতে ভালবাসেন না। আগে দুর্গাপূজা এড়ানোর জন্য ওইসময়ে বেড়াতে যেতেন, আজকাল প্রায় সারাবছরই পাহাড়ে পাহাড়ে কাটান। দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর বিশাল দেনার দায় তার ওপর চেপেছিল। এক পাওনাদার দেনার দায়ে দেবেনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করিয়েছিল। কিন্তু নানারকম ব্যয়সংকোচ ও কৃচ্ছসাধনের মধ্য দিয়ে কিছুদিনের মধ্যে সেই দুর্দিন কাটিয়ে উঠেছেন দেবেন।
ওইসময়ের একটা মজার ঘটনার কথা সারদার মনে পড়ে। ঠাকুরদের সেই দুর্দিনে একবার শোভাবাজার রাজবাড়িতে গানের জলসায় নিমন্ত্রণ এল দেবেনের কাছে। সব ধনী অভিজাত পুরুষেরা উৎসুক হয়ে আছেন, অভাবের দিনে দ্বারকানাথের ছেলে কী পোশাক কেমন অলংকার পরে আসবেন। সভা গমগম করছে হিরে জহরতের গয়না, জরি কিংখাবের পোশাক পরা বাবুদের ঝলকানিতে, দেবেন প্রবেশ করতেই সবাই স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে। তার পরনে সাদা ধবধবে আচকান-জোড়া, সাদা পাগড়ি, কোথাও সোনা রুপো জরি কিংখাবের লেশমাত্র নেই। তাকিয়ায় গা এলিয়ে বসে পা দুটো একটু বাড়িয়ে রাখলেন দেবেন, পায়ে সাদা মখমলের জুতোয় বিরাট দুটো মুক্তো বসানো। শ বাজারের রাজামশায় ছিলেন তার বন্ধু। ছেলে ছোকরাদের ইশারা করে তিনি নাকি বলেছিলেন, দেখ, তোরা দেখ… একেই বলে বড়লোক। আমরা যা গলায় মাথায় ঝুলিয়েছি–ইনি তা পায়ে রেখেছেন।
দেবেন্দ্র হিমালয়ে ঘুরে বেড়ান প্রিয় দু-একটি শিষ্য নিয়ে। ঘরে বসে দুশ্চিন্তায় অধীর হয়ে ওঠেন সারদা। একদিন রবিকে অন্তঃপুরে ডেকে পাঠালেন তিনি। যে কোনও সুযোগে অন্দরে যেতে পারলেই খুশিতে মেতে ওঠেন রবি, নীরস চাকরমহলের কঠিন অনুশাসন থেকে সাময়িক মুক্তির আশায়। মা এমনিতে ডাকখোঁজ বেশি করেন না, না ডাকলে ভেতরে ঢোকাও বারণ বাচ্চা ছেলেদের, রবির মন তবু উৎসুক হয়ে থাকে সুদূরচারী জননীর এমন একটি ডাকের অপেক্ষায়।
রবি আসতেই সারদা তাকে হুকুম দেন, কত্তামশায় অনেকদিন হল পাহাড়ে গেছেন, তার কোনও খবর পাচ্ছিনে, আমার হয়ে তাকে একটি চিঠি লিখে দে তো বাবা।
রবির মন অজানা পুলকে নেচে ওঠে, দাদাদের না ডেকে তাকেই যে মা ডেকেছেন এই কাজের জন্য এ-কথা ভেবে তার বুক ভরে যায়। তাড়াতাড়ি ছুটে কাগজ কলম নিয়ে মায়ের চৌকির পাশে বসে পড়ে বলেন, কী লিখতে হবে মা?
আসলে এবার সারদা অনেক ভেবেচিন্তেই রবিকে ডেকেছেন। এর পেছনে একটা কাহিনি আছে। এক হিতৈষিণী আত্মীয়া দুদিন আগে সারদাকে জানিয়েছেন যে রাশিয়া ভারত আক্রমণ করেছে। কোথায় কোন রাজ্যে সেই যুদ্ধ লেগেছে সারদা জানেন না, আত্মীয়াও বলতে পারেননি। হেমেন ও জ্যোতিকে জিজ্ঞেস করেও জানতে পারেননি। তাঁরা এরকম কোনও যুদ্ধের খবর শোনেননি। কিন্তু খবর না পেয়ে দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকা স্বামীর জন্য সারদার উদ্বেগ তাতে বেড়েছে বই কমেনি। আবার জ্যোতি জানিয়েছেন শ্রাবণের সোমপ্রকাশ পত্রিকায় একটি সংবাদে লিখেছে, বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সংসার ত্যাগ করিয়া হিমালয়ের নিকটস্থ ধর্মশালায় জীবন যাপন করিবার মানস করিয়াছেন। জ্যোতি যদিও বলেছে এ-সব গুজবে কান না দিতে, সারদা সন্দেহ নিরসনের জন্য কত্তামশায়কে পত্র দিতে চান। জ্যোতি হেমেনরা তাঁর চিন্তাকে গুরুত্ব না দেওয়ায় তিনি রবিকে ডেকেছেন।
কিন্তু মা ও ছেলে কেউই জানেন না চিঠির ভাষা ঠিক কীরকম হওয়া উচিত। জমিদারি সেরেস্তার মহানন্দ মুনশির শরণ নিয়ে রবি চিঠি রচনা করলেন। সারদাকে পড়ে শুনিয়ে চিঠি ডাকে দেওয়া হল।
মহর্ষি জবাবে লিখলেন, ভয়ের কিছু নেই, রাশিয়ানদের তিনিই তাড়িয়ে দেবেন। এতে সারদা আশ্বস্ত হলেন কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা যে, বালক রবীন্দ্রনাথ বাবাকে প্রথম চিঠি লিখে এবং জবাব পেয়ে উত্তেজিত হয়ে প্রায়ই মহানন্দের দপ্তরে হাজির হতে লাগলেন। রোজ তিনি বাবামশায়কে চিঠি পাঠাতে চান। মহানন্দবাবু বালকের আবদারে মাঝে মাঝে চিঠি লেখার ভান করেন ঠিকই, কিন্তু সে-চিঠি আর হিমালয়ে পৌঁছয় না। তখন রবি তাকে নিয়ে একটি ছড়া লিখে ফেললেন নিজের খাতায়,
মহানন্দ নামে এ কাছারিধামে
আছেন এক কর্মচারী,
ধরিয়া লেখনী লেখেন পত্রখানি
সদা ঘাড় হেঁট করি।…
হস্তেতে ব্যজনী ন্যস্ত,
মশা মাছি ব্যতিব্যস্ত
তাকিয়াতে দিয়ে ঠেস…
হেমেনের খুব ঘোড়ায় চড়ার শখ, তার একটা ঘোড়া বারবাড়ির আস্তাবলে বাঁধা থাকে। সেই অশ্ব বাড়ির অনেকের মনে পক্ষীরাজের স্বপ্ন উসকে দেয়। জ্যোতি আর কাদম্বরীর ঘরেও এমন এক স্বপ্নবোনা চলছিল।
কাদম্বরী আদুরে গলায় স্বামীকে বলেন, আমাকে ময়দানে হাওয়া খেতে নিয়ে চলোনা একদিন, তোমার সঙ্গে খোলা হাওয়ায় বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করে খুব।
জ্যোতি ভয় পান, তোমাকে নিয়ে হাওয়া খেতে গেলে মা তোমার ওপর রাগ করবেন, অশান্তি হবে, না হলে আমার তো ইচ্ছে করে সেজদাদার ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে তোমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাই। রূপকথার রাজকন্যে, দাঁড়াও না, একদিন ঠিক নিয়ে যাব।
কাদম্বরী ঠোঁট ফোলান, মেজোবউঠান যে স্টিমার পাড়ি দিয়ে ঘনঘন যাতায়াত করছেন, তখন তো ধন্য ধন্য কর। নিজের বউকে নিয়ে বাইরে বেরুতে এত ভয়?
সে যাচ্ছেন ঠিক, কিন্তু খাস কলকাতার বুকে হাওয়া খেতে তিনিও এখনও বেরোননি। আগে তিনি পথ দেখান, তারপর তুমি।
জ্যোতির কথায় অভিমান হয় কাদম্বরীর, কেন সবসময়ে তিনি আগে আর আমি পরে? তুমি ভেবেছ আমি আগে কিছু করতে পারি না? আসলে আমার সাহস আছে, তোমার নেই।
দমকা হাওয়ার মতো ঘরে ঢুকে পড়ে রূপকুমারী। সে জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে কয়েকটা কথা শুনতে পেয়েছে। সে বলল, জ্যোতিদাদা, আমিও ঘোড়ায় চড়ব, নতুনবউঠানের সঙ্গে আমিও যাব হাওয়া খেতে।
এই রে পাগলিটা এসে গেছে, জ্যোতি বলে ওঠেন। তুই সবসময় আমার কাছে ঘুরঘুর করিস কেন রে? জানো নতুনবউ, যেখানে যাব, ও এসে পথে দাঁড়িয়ে সঙ্গে যাওয়ার বায়না ধরবে।
ও মুখ ফুটে বলতে পারে আর আমি মনের ইচ্ছে চেপে রাখি। কাদম্বরী বলেন, ও যেমন ছটফট করে বেড়ায় আমার হৃদয়টাও তেমনি ছটফটে। খাঁচায় থাকতে চায় না।
জ্যোতি বলেন, সেজদাদার ঘোড়াটা তো আচ্ছা জ্বালালে! কথায় বলে লোকে ঘোড়া দেখলে খোঁড়া হয়, আর তোমরা যে পক্ষীরাজের ডানা চাইছ! চলো, তোমাদের আমার নতুন নাটক পড়ে শোনাই।
জ্যোতি এখন যে নাটকটা লিখছেন তার নাম দিয়েছেন সরোজিনী। কাদম্বরী নাট্যরসে মজে যান, তাঁর মনে অপূর্ব আনন্দের সৃষ্টি হয়। কিন্তু রূপা কিছুক্ষণ পরেই কোথায় যেন চলে গেল।
আরও কিছুক্ষণ পরে বারবাড়িতে হইচই চেঁচামেচি শুনে জ্যোতি বাইরে বেরিয়ে এসে শুনলেন সেজদাদার ঘোড়ায় চড়ে রূপকুমারী উধাও হয়ে গেছে।
সারদার বারান্দায় এসে কাদম্বরী দেখলেন সেখানেও হুলুস্থুল কাণ্ড।
মানদা দাসী লাফাচ্ছে, আরও আশকারা দাও কামা, আরও মেয়ে মেয়ে করে মাথায় তোলো। কী দস্যি দজ্জাল বিটিরে বাবা! ওই বেটি তোমার মুণ্ডু ঘুরিয়ে দেবে।
সারদা ঠান্ডা থাকার চেষ্টা করেন, আঃ চুপ কর মানদা, গোল করিস না। আরে মেয়েটা তো মরে যাবে, ওই বিচ্ছু ঘোড়া নির্ঘাত পিঠ থেকে ফেলে দেবে ওকে, কেউ কি বাঁচাতে গেছে? যা, খবর নে।
কাদম্বরী বললেন, মা আপনার ছেলে তো দেখতে গেছেন, কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় করবেন।
সারদা অকূলে কূল পান যেন, গেছে জ্যোতি? দেখো যদি শেষরক্ষা হয়। মনে মনে গৃহদেবতার নাম জপ করতে থাকেন তিনি।
বড় মেয়ে সৌদামিনী সারদাকে সাবধান করতে চান, মা, এবার তুমি রাশ টানো। হয় ওকে থামাও নয় নিজে থামো। মেয়েটা বড্ড অবাধ্য, তোমাকে। তিষ্ঠোতে দেবে না।
তাড়াও কত্তামা, ওকে এবার তাড়াও। মানদা আবার ফুঁসে ওঠে, আমরা কত কষ্ট করে চাট্টি ভাত খাচ্ছি আর ওকে তুমি আমাদের সবার মাথায় নেত্য করতে বসিয়ে দিলে।
এবার কাদম্বরী মানদাকে বকেন, আঃ মানদা, তোর কি কোনও আক্কেল নেই। বাচ্চা মেয়েটা না হয় না বুঝে একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে, তাই বলে তুই মায়ের মুখের ওপর এরকম কথা বলবি?
সারদাও জোর পান নতুনবউয়ের কথায়, মানদা তোর বড় বাড় বেড়েছে দেখছি আমি। যত অলক্ষুনে কথা বলিস। দূর হয়ে যা এখান থেকে। যতক্ষণ না মেয়েটা ভালয় ভালয় ফিরে আসে ততক্ষণ আমার সামনে আসবি না।
ঘণ্টাখানেক বাদে বহু কসরত করে দারোয়ান বেহারার দল রূপকুমারীকে ঘোড়াসহ ধরতে পারল। ঝোঁকের মাথায় ঘোড়ার পিঠে চেপে বসলেও ঘোড়সোয়ারির কোনও কিছুই তার জানা নেই, তাই ঘোড়া ছুটতেই নিজের বিপদ আঁচ করেছে রূপা কিন্তু তখন ঘোড়াই তার চালক। থামানোর কোনও উপায়ই সে জানে না। জ্যোতি চারদিকে লোক পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। রূপার আর্ত চিৎকারেও পেছন পেছন মজা দেখার অনেক লোক জড়ো হয়েছে। ভিড় থেকে নানারকম মন্তব্যও উড়ে আসছে রূপাকে লক্ষ্য করে।
কেউ বলছে, ঘোড়ার ওপর ডবকা মাগীর খেল দেখে যা আয়। আবার কেউ বলছে দেবীর কি এবার অশ্বে আগমন? ইনি দেবী না মানবী? গায়ে তো গয়নাগাটিও বেশ।
ভদ্দরলোকের বেটি তো খোলামেলা রাস্তায় নামবে না, এ নিশ্চয় কোনও বেশ্যামাগীর বাবু ধরার ছলাকলা।
একে ঘোড়া থামে না তারপর এ-সব নোংরা নোংরা কথা। বাইরের জগৎটা এত খারাপ, লোকেরা এত ইতর হতে পারে জানত না রূপা। এসব শোনার জন্যই সে বাইরে বেরতে চেয়েছিল, হায় রে! ক্ষোভে, ভয়ে তার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে।
কোনওক্রমে রাস্তার লোকেরা ও বাড়ির দারোয়ান বেহারারা মিলে ঘোড়ার দড়ি ধরে থামায় শেষপর্যন্ত। ঘোড়া থামামাত্র উৎসাহী কিছু বদমাশ লোক রূপার গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করে। একটি বিচ্ছিরি ঢ্যাঙা লোক রূপার বাহু ধরে টানতেই রূপা তাকে ঠাসিয়ে চড় কষায়। বেহারারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই এতসব ঘটে গেল কিন্তু এবার কী হবে?
চোয়াড়েমার্কা কয়েকটি লোক রূপাকে জাপটে ধরার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু করল, এ মাগীটা তো বেশ সরেস মাল, আবার গায়ে হাত তোলে। দেখি এবার কে তোকে বাঁচায়!
ঘটনা আরও খারাপ দিকে যেতে পারত, কিন্তু ঠিক সময়ে জ্যোতিরিন্দ্র পালকি চেপে এসে উপস্থিত হলেন। তাকে দেখে লোকগুলো পালাল বটে তবে তেড়ে খিস্তি দিতে ছাড়ল না। পরের দিন বিখ্যাত জ্যোতি ঠাকুরকে ঘটনার নায়ক করে দুটি সংবাদপত্রেও এই মুখরোচক খবর ছাপা হল।