০৫. স্টেশনে আমার পরিচিত

০৫.

স্টেশনে আমার পরিচিত দু চারজনের সঙ্গে দেখা। সবাই এক কামরায় উঠলুম– যদিও আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলুম, শহর-ইয়ারের এ ব্যবস্থাটা আদৌ মনঃপূত হয়নি। তাই আমি আরও বিশেষ করে ওদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলুম না।

শহর-ইয়ারকে অপূর্ব সুন্দরী বলা চলে না কিন্তু তার সৌন্দর্যে অপূর্বর্ত আছে। সে সৌন্দর্য তিনি ধারণ করেছেন অতিশয় সহজে, এমনকি অবহেলা-ভরে বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। পুরুষানুক্রমে বিত্তশালীজন যেরকম তার বৈভব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন হয়ে ধনী-দরিদ্রের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে মেলামেশা করে। আমার মনে হচ্ছিল, একে একটুখানি লক্ষ করলেই বোঝা যাবে, ইনি সুন্দরী-কুলে জন্ম নিয়েছেন, সুন্দরীদের ভিতর বড় হয়েছেন, তাঁর সৌন্দর্য নিয়ে ছেলেবেলায় কেউ আদিখ্যেতা করেনি বলে তিনি এ বিষয়ে এমনই সহজ-সরল যে সৌন্দর্যহীনারা তার সৌন্দর্যকে ঈর্ষা করবে না, সুন্দরীরা তাকে প্রতিদ্বন্দিনীরূপে দেখবে না। তার সৌন্দর্যের অপূর্বতা কিছুটা তার বর্ণে। বংশানুক্রমে পর্দার আড়ালে বাস করার ফলে তাঁর শান্ত গৌর বর্ণকে অসূর্যম্পশ্যা বর্ণ নাম দেওয়া যেতে পারে। এ বর্ণ সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করবে অতি অবশ্য কিন্তু সকলেরই চিত্ত আকর্ষণ করবে সে-কথা বলা যায় না। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে এ রঙের প্রতি আমার নাড়ির টান আছে আমার মা-বোন সকলেরই এই ধরনের রঙ- কেউ একটু বেশি গৌরী, কেউ-বা কম। তদুপরি শহর-ইয়ার এখন পূর্ণ যৌবনা অনুমান করলুম তাঁর বয়স পঁচিশ থেকে আটাশের কোনও জায়গায় হবে। মাথায় সিঁদুর থাকার কথা নয়, এবং যদিও বেশভূষা হুবহু বিবাহিতা বাঙালি হিন্দু মেয়ের মতো তবু কোথায় যেন, কেমন যেন একটা পার্থক্য রয়েছে। আমি কিছুতেই সে-পার্থক্যটা খুঁজে বের করতে পারলুম না। আমার এক অসাধারণ গুণী চিত্রকর বন্ধু আছেন এবং অদ্ভুত তাঁর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ শক্তি। তিনি থাকলে আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারতেন। পর্দানশিন খানদানি মুসলমান গৌরীদের রঙ তিনি লক্ষ করে আমার সামনে একদিন ওই প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন।

পরিচিতেরা দু একবার তার দিকে আড়নয়নে তাকিয়েছিলেন– এ মেয়ে যে আর পাঁচটি সুন্দরী থেকে ভিন্ন সেটা হয়তো ওঁদের চোখেও ধরা পড়েছিল। শহর-ইয়ার কিন্তু সে সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নির্বিকার। কে বলবে, এঁর মা-দিদিমা যুগ যুগ ধরে পর্দার আড়ালে জীবন কাটানোর পর ইনিই প্রথম বেগানা পুরুষদের সামনে আত্মপ্রকাশ করেছেন।

কামরাটা সবচেয়ে বড় সাইজের যা হয়। তিনি কিন্তু আমার পাশে না বসে আসন নিলেন সুদূরতম প্রান্তে। বেঞ্চির উপর পা তুলে মুড়ে বসে, কিন্তু আমার দিকে মুখোমুখি হয়ে। আমাদের পাঁচজনের ভিতর নানারকম আলাপ-আলোচনা আরম্ভ হল। সকলেই বুদ্ধিজীবী বিষয়বস্তুর অনটন হওয়ার কথা নয়। শহর-ইয়ার সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছেন কি না, বুঝতে পারলুম না।

কবে হয়ে গিয়েছে এঁর বিয়ে, কিন্তু বাপের বাড়িতে বিয়ের পূর্বে মেয়েকে যে তালিম দেওয়া হয়– শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সে কীভাবে বসবে-চলবে এবং বিশেষ করে অঙ্গসঞ্চালন নিরোধ করে থাকবে সেটা মোটেই অনভ্যাসবশত বিস্মৃত হয়নি। সেই যে বোলপুরে যেভাবে আসন নিয়েছিল বর্ধমান পর্যন্ত তার সামান্যতম নড়চড় হল না।

বর্ধমানে প্রায় সবাই চায়ের সন্ধানে প্ল্যাটফর্মে নামলেন। এঁরা হিন্দু না, এঁরা অপটিমিস্ট।

শহর-ইয়ারের পাশে গিয়ে বসে বললুম, শহর-ইয়ার, এখানে কিন্তু আপনি একমাত্র আমার ইয়ার।

মুখে স্মিতহাস্য ফুটিয়ে বললে, হ্যাঁ, এইখানেই আমাদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল। কিন্তু শুধু এখানে কেন, আপনি তো সর্বত্রই আমার একমাত্র ইয়ার।

আমি বললুম,

ঘোড়ায় আমার জুটিবে সওয়ার, ইয়ার পাইবে সাকি।

 মানে?

আমি আপনার চেয়ে বয়সে ডবল না হলেও তারই কাছাকাছি। আমার পালে ওপার যাবার হাওয়া লাগে-লাগে। তখন আপনি, হে আমার সাকি, নতুন ইয়ার পাবেন।

রীতিমতো বেদনা-ভরা কণ্ঠে বললে, ছিঃ, আপনি এসব কথা বলেন কেন? ভাষার ওপর আপনার বিধিদত্ত অধিকার আছে। সেটা আপনার হাতে ধারালো তলওয়ার, সাবধানে ব্যবহার না করলে আমার মতো সরল জন, যে বিশ্বাস করে আপনার অতি কাছে এসেছে তার বুকের ভিতর তার ফলাটা হঠাৎ ঢুকে গিয়ে খামোকা রক্ত বওয়াবে না? আপনার কাছ থেকে আমার বহুৎ আশা, বহু বহু বৎসর আপনার সাহায্য আমি পাব বলে নিশ্চিত ধরে নিয়েছি।

আচ্ছা, শহর-ইয়ার, আপনি স্কুল-কলেজ গিয়েছেন, সে সূত্রে নিশ্চয়ই দু পাঁচজনের সঙ্গে আপনার আলাপ-পরিচয় হয়েছে। অন্তত কোনও কোনও অধ্যাপকের স্নেহ আপনি অতি অবশ্যই পেয়েছেন, কারণ আমি জানি আপনি পড়াশুনায় অসাধারণ ভালো ছিলেন, আপনার আদব-কায়দা মানুষকে নিশ্চিন্ত মনে মেলামেশার সুযোগ করে দেয়, এবং তদুপরি মুসলমান ছাত্রী এই দশ বছর আগে এতই বিরল ছিল যে হিন্দু অধ্যাপকরা তাদের বিশেষ আদরের চোখে দেখতেন– হয়তো-বা তাতে নতুনের প্রতি খানিকটে কৌতূহলও মেশানো থাকত। বিয়ের পরে আপনার স্বামীর ইয়ার-দোস্তের সঙ্গেও আপনার কিছুটা ঘনিষ্ঠতা না হয়ে যায় না। এদের ভিতর কেউ নেই যার সঙ্গ পেলে, যার সঙ্গে কথা বলে আপনি আনন্দ পান?

না। ব্যস, ওই একটি শব্দ। এত ক্ষুদ্র পরিষ্কার উত্তর আমাকে রীতিমতো হকচকিয়ে দিল।

কিন্তু– আমার আর কথা বলা হল না। প্রায় চিৎকার করে উঠলুম, এ আমি কী দেখছি! মরীচিকা, মরুতৃষা, মিরাজ? ভানুমতী, ইন্দ্রজাল? না, না, এসব কিছুই নয়। আমার চোখদুটো বিলকুল বরবাদ হয়ে গিয়েছে। ভাই শহর-ইয়ার, কলকাতায় নেমেই সোজা চশমার দোকান।

আমার উত্তেজনার কারণ সরল নয়, অতি কুটিল। বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি। সরকারি হুকুমে যখন সর্ব রেলওয়ে স্টেশনের মদের বার বন্ধ হয়ে গেল, তখন এই পুণ্যভূমি বর্ধমান স্টেশনের কেনার হয় ভেবেছিলেন চা, বিয়ার, হুইস্কি একই জিনিস, সবকটাই পৈশাচিক মাদকদ্রব্য, কিংবা চা মদ্য না হলেও উত্তেজক দ্রব্য তো বটে। অতএব কংগ্রেসের অকৃত্রিম সদস্য হিসেবে কংগ্রেস ধর্মানুযায়ী তারা মদ্যজাতীয় সর্বউত্তেজক আবর্জনার সঙ্গে চা-কেও কুলোর বাতাস দিয়ে তাড়িয়ে দেন। এ তত্ত্বটি আমি সাতিশয় বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হয়েছি। কেউ যদি সন্দেহ প্রকাশ করে, আমি তা হলে তাকে দেখে নেব– কী কী করব, এখন বলছিনে, কিন্তু সর্বপ্রথমেই যে আমি তার বিরুদ্ধে মানহানির মোকদ্দমা আনব সে-বিষয়ে আমি স্থিরনিশ্চয়।

এহেন দৃঢ় প্রত্যয় যখন আমার হৃদয়মনে দড় থানা গড়ে টাইট বসে আছে, তখন যদি বর্ধমান রেলকামরায় কেলনারের লোক স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মনে রাখবেন, আমরা তাকে অর্ধেক রাজত্ব ও রাজকন্যা, কিংবা তার চেয়েও ভালো, বাস্-ট্যাক্সি পারমিটের প্রলোভন দেখাইনি আবার বলছি আপন খেয়াল-খুশি, মর্জিমোতাবেক, মেহেরবানি মাফিক একখানা ট্রেতে ঢাউস পট চা, রুটি-মমলেট সামনে ধরে সবিনয় বলে, মেমসায়েব, আপকি চা তবে কি আপনার নলেজ বাই ইনফারেন্স্ এই হবে না, যে আপনার চোখ আল্লার গজবে বিলকুল বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে? এ তো মাতালের সিঙ্গল বস্তু ডবল দেখা নয়। এ যে যা নেই তা দেখা, আকাশকুসুম শোঁকা, গাড়ির কামরার মধ্যিখানে রাজার পিসি কুমড়ো দিয়ে ক্রিকেট খেলতে খেলতে ফ্রেম থেকে খুলে আমসত্ত্ব ভাজা খাচ্ছেন তাই দেখা!

না, না, না। ইয়ার শহর-ইয়ার, এ সেই আরব্য রজনীর অন্-নশারের কাল্পনিক ডিনার! আমি এসব জিনিস স্পর্শ করার চেষ্টা করে হাওয়ার কোমরে রশি বাঁধনেওয়ালার মতো সমুখের বঙ্গীয় উন্মাদ আশ্রমের ওয়েটিং লিস্টে নাম লিখিয়ে বাদবাকি জীবন ঝুলে থাকতে চাইনে।

শহর-ইয়ার বললেন, আপনার হুঁশিয়ারি অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। তবে এ সম্পর্কে সামান্য একটি কথা আছে। আপনি যখন কাটুকে টাকা দিয়ে বাড়িঘর খবরদারির কথা বলছিলেন তখন আমি স্টেশনের লোককে বিশেষ করে অনুরোধ জানিয়ে ব্যবস্থাটা করিয়েছিলুম। এবারে খান।

ওহ্! এ খাওয়াতে ডবল সুখ! আর সবাই জান পানি করে পেয়েছে ভাড়ের পানি—না চা? সে একই কথা। আমি আগের সিটে ফিরে গেলুম না।

এবারে ডাক্তার গাফিলি করেননি কিংবা ভুলেও যাননি। তাঁর পিতার আমলের সেই ঢাউস পালকিগাড়ির মতো মোটর নিয়ে স্টেশনে হাজির। লক্ষ করলুম, ডাক্তারদের সামাজিক আচরণ যদিও আর পাঁচজন হিন্দুদেরই মতো, তবু বাড়ির বাইরে বিশেষ করে যেটাকে বলা হয় পাবলিক প্লেস সেখানে স্ত্রীর সামনে এখনও একটু আড়ষ্ট, যেন সবে পরশুদিন তাদের শাদি হয়েছে।

প্রথমটায় রাস্তার উপরকার দোকানপাট, দুটো-একটা গারাজ দেখে সেগুলোর পিছনে কী বস্তু আছে ঠিক অনুমান করতে পারিনি। মোড় নিয়ে খোলা গেটের ভিতর দিয়ে গাড়ি তখন সংকীর্ণ একটা গলিপানা প্যাসেজের ভিতর দিয়ে ঢুকছে।

গাড়ি থেকে নেমে আগাপাশতলা তাকিয়ে দেখি বিরাট প্রকাণ্ড প্রাচীন যুগের একটা বাড়ি- বরঞ্চ ফরাসিতে বলা উচিত শাটো। ক্ষীণ আলোকিত আকাশের অনেকখানি ঢেকে রেখেছে বাড়িটা তার থেকেই অনুমান করলুম সেটার সাইজ। কারণ সমস্ত বাড়িটা অন্ধকার, অপ্রদীপ। শুধু দোতলার বৃহৎ একটা অংশের সারিবাধা অনেকগুলো জানালা দিয়ে বেরুচ্ছে যেন আলোর বন্যা। এ যুগেও যে কলকাতায় এরকম অতিকায় বসত-বাটি আছে সে ধারণা আমার ছিল না। বাড়িটা কিন্তু রাজামহারাজাদের কলকাতার ফ্যান্সি প্যালেস প্যাটার্নে তৈরি করা হয়নি। গাড়িবারান্দায় যে একটি আলো জ্বলছিল তারই আলোকে দেখলুম, অলঙ্কারবর্জিত সাদামাটা কিন্তু খুবই টেকসই দড় মাল-মশলা দিয়ে বাড়িটা তৈরি। পরিষ্কার বোঝা গেল যে যিনি বাড়িটা তৈরি করান তাঁর অসংখ্য ঘরকামরার দরকার ছিল বলে সেটাকে যতদূর সম্ভব বড় আকারের করে তৈরি করিয়েছিলেন এবং সেই সময় এটাও স্থির করেছিলেন যে তাঁর বংশধরগণকে যেন অন্তত দুশো বছর ধরে অন্য বাড়ি বানাবার প্রয়োজন না হয়।

দারওয়ানসহ জনা পাঁচেক লোক এগিয়ে এল। হঠাৎ নবাবদের উর্দি পরা লোকজনের হাফ মিলিটারি সেলুটাদির আশঙ্কা আমি করিনি। তারাও মুসলমানি কায়দায় অল্প ঝুঁকে সালাম জানাল। কোনও জায়গায় কোনও কৃত্রিমতা নেই। ডাক্তার কথা বলে যাচ্ছেন, ম্যাডাম মনে হল যেন ক্রমেই গম্ভীর হতে গম্ভীরতর হয়ে যাচ্ছেন। মুসাফিরির ক্লান্তিও হতে পারে।

বাড়ির বিপুল আকারের তুলনায় দোতলা যাবার সিঁড়ি যতখানি প্রশস্ত হওয়ার কথা ততখানি নয়, যদিও প্রয়োজনের চেয়েও বেশি।

কিন্তু আশ্চর্য হয়ে গেলুম যখন দোতলার একটা অতি দীর্ঘ বারান্দার উপর দিয়ে যেতে যেতে খোলা দরজা দিয়ে ডাইনের দিকে দেখি, একটার পর একটা মাঝারি সাইজের বেডরুম-ড্রইংরুম, মাঝে মাঝে ডাইনিংরুম– কখনও দিশি ধরনের, কখনও-বা বিলিতি স্টাইলের। দু একটা কামরা মনে হল যেন বাচ্চাদের পড়াশুনোর ঘর। বেডরুমগুলোর কোনওটাতে প্রাচীন দিনের জোড়া পালঙ্ক, কোনওটাতে ছোট ছোট তিনখানা তক্তপোশ। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য কোনও ঘরে একটিমাত্র জনপ্রাণী নেই, বিছানাপত্র কিন্তু ছিমছাম তৈরি আর প্রায় প্রত্যেকটি কামরায় বিজলিবাতি জ্বলছে। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে ডান দিকে মোড় নেবার সময় আমি আবার লক্ষ করেছিলুম, বাঁ দিকে এটারই মতো একটা দীর্ঘ উইঙ, রাইট এঙ্গেলে এটার সঙ্গে লেগে ইংরিজি এল শেপ তৈরি করেছে। সেটা কিন্তু অন্ধকার।

অবশেষে দীর্ঘ অভিযান শেষ করে আমরা একটা বড় সাইজের ড্রইংরুমে ঢুকলুম। আমাকে বসিয়ে বললেন, আমার বন্ধু-বান্ধবরা দেখা করতে এলে এখানেই বসেন; তারাই পছন্দ করে এটা বেছে নিয়েছেন। একটু পরেই আপনার ঘর দেখাচ্ছি– শহর-ইয়ার সেটা চেক-আপ করে নি। ঘরটা ভালো না লাগলে কাল আপনার খুশিমতো যে কোনও একটা পছন্দ করে নেবেন। বাঁ দিকে মাদামের বুদোওয়ার সমস্তটা দিন তিনি ওইখানেই কাটান। আর এই ডান দিকে আপনার ঘর–অন্তত এ রাত্রিটার মতো। চলুন, দেখি, কদ্দূর কী হল। শহর-ইয়ার আবার একটু অতিরিক্ত পিটপিটে, তায় আবার আপনার প্রতি তার হিমালয়ান ভক্তি।

অ। মাদাম একেবারে ন-সিকে বিলিতি। একটা চেয়ারে বসে তদারকি করছেন– বেয়ারাটা আমার দুটো সুটকেস থেকে জিনিসপত্র, জামাকাপড় বের করে ঠিক ঠিক জায়গায় রাখছে কি না। আমার দিকে তাকিয়ে প্রসন্ন হাসি হেসে বললেন, বসুন, বসুন। আপনার বইপত্র, কাগজকলম পাশের ঘরে আপনার স্টাডিতে। অন্তরঙ্গ বন্ধু এবারে মুখে কৌতুকের হাসি, কিংবা বান্ধবী দেখা করতে এলে ওই স্টাডিতে নিরিবিলিতে তাঁকে এনটারটেন করতে পারবেন। আর এই এখানে বাথরুমের দরজা। হাতমুখ ধোবেন, না গোসল করবেন? আমি ছুট লাগাচ্ছি এখন, ডালভাতের তদারকি করতে। বেয়ারা এসে আপনাকে নিয়ে যাবে আমি বাসনবর্তন থেকে ফুৎ না পেলে। ডাক্তারকে শুধোলেন, হা গা, তুমি খেয়েদেয়ে পেটটান করে ফেলনি তো? ফের আমাকে বললেন, লেবরেটরি থেকে ফেরা মাত্রই উনি খাবার টেবিলের দিকে যে স্পিডে ধাওয়া করেন যে দেখে মনে হয়, বহু শত বৎসরের বিরহ কাটানোর পর মজনু প্রিয়া লাইলিকে দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু ভদ্রলোকের একটি অতিশয় মহৎ সদ্‌গুণ আছে– যেটি প্রতি যুগে প্রতি দেশে বিবাহিতা রমণী মাত্রই আপন পরম সৌভাগ্য বলে মনে করবে। হিন্দু হলে বলবে, না জানি কত শত যুগ তপস্যা করে এ-হেন বর পেলুম, আর আমি বলি আমার বহু মুরুব্বির বহু দিল্-এর দোওয়ার ফলে এ-হেন কর্তা পেয়েছি। সেই মহৎ সদ্গুণটি কী? খানা-টেবিলের পানে ধাওয়া করে সেখানে যদি দেখেন সে প্লেন একধামা মুড়ি, কিংবা পক্ষান্তরে যদি দেখেন কোর্মা-কালিয়া-মুসল্লম-কাবাব-পোলাও গয়রহ তখন এই সহৃদয় মহাজনের কাছে দুই পক্ষই বরাবর! আর না– আমি চললুম।

ডাক্তার খাটের বাজুতে বসে লাজুক হাসি হাসতে হাসতে বললেন, একেই তো বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলেন একখানা উয়েল-লুব্রিকেটেড রসনা ডাক্তার হিসেবে নিতান্ত হিউমেন এনাটমি জানি বলে একখানা রসনাই বললুম, ইতরজন বলবে শতাধিক তদুপরি আপনার সঙ্গে পরিচয়ের খুশকিম্মৎ নেক্‌-নসিব হওয়ার পর থেকে তার ওপর ভর করেছে একটা আস্ত সাহিত্যিক জলজ্যান্ত মামদো। আপনার সাহিত্যিক গুণটা পেলেও না হয় সেটা সয়ে নিতুম। তা নয়। রামকে না পেয়ে পেয়েছে তার খড়ম। এখন আমার ব্রহ্মতালুর উপর শুকনো সুপুরি রেখে অষ্টপ্রহর দমাদম পিটুনি সেই আপনি, রামচন্দ্রজি, আপনার খড়ম যে বরায়ে মেহেরবানি এনাম দিয়েছিলেন তাই দিয়ে। ওফ।

আমি বললুম, শত যুগের তপস্যা-ফপস্যা জানিনে, ডাক্তার, কিন্তু আপনি যে রত্নটি পেয়েছেন সেটি অতিশয় কপালি লোকেও পায় কি না-পায় সন্দেহ। আর আমার জান্-কলিজা-দিল থেকে দোওয়া আসছে, আপনারা যেন একে অন্যের অক্লান্ত কদর দিতে দিতে দীর্ঘ, অতি দীর্ঘ, দরাজের চেয়েও দরাজ জীবনযাপন করেন। আমেন!

ডাক্তার বললেন, আমার সব মুরুব্বিজন ওপারে। এপারে মাত্র একজন– আপনি। আল্লা যেন আপনাকে একশো বছরের জিন্দেগি দেন। আমেন, আমেন।

.

রুচিশ্রী অনাড়ম্বর খানা-খাওয়া শেষ হলে পর একটুখানি ইতিউতি করে ডাক্তার বললেন, আজকের মতো আমাকে মাফ করে দেবেন, স্যর? দিনভর বেদম খাটুনি গিয়েছে। আমার চোখ জড়িয়ে আসছে– ওদিকে আবার এশার নমাজ এখনও পড়া হয়নি।

আমি বললুম, নিশ্চয়, নিশ্চয়। কাল সকালে দেখা হবে তো? না আপনি লেবরেটরিতে গিয়ে সেখানে ফজরের নমাজ পড়েন? গুডনাইট, ডাক্তার। খুদা-হাফিজ!

ডাক্তার মাথা নিচু করে বললেন, গুডনাইট, স্যর। তার পর একটু থেমে বললেন, আপনি আসাতে আমি যে কী আনন্দ পেয়েছি

শহর-ইয়ার উঠে বললেন, আমি ঠিক দু মিনিটের ভিতর ফিরে আসছি।

 ডাক্তার তারস্বরে প্রতিবাদ জানালেন। শহর-ইয়ার সেদিকে কান না দিয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলেন।

আমি শোবার ঘরে এসে ধীরেসুস্থে কাপড় ছেড়ে সবে একখানা বই নিয়ে বসেছি এমন সময় ম্যাডাম এসে উপস্থিত। যেন মাফ চেয়ে বললেন, ওঁর নামাজের ব্যবস্থাটা আমি নিজের হাতে করে দিই। ওই একটি ব্যাপারে, সত্যি বলছি ওই একটি মাত্র ব্যাপারে উনি সহজে সন্তুষ্ট হন না। আর-সবাই তো বছরের পর বছর একই জায়নামাজে নামাজ সেরে সেটি ভাজ করে রেখে দেয়, পরের বারের জন্য? উনি বললেন, উঁহু কত ধুলোবালি ময়লা জমে তার উপরে। তাই তার প্লেন লংক্লথের তিনখানা জায়নামাজ আমি পালাক্রমে রোজ রাত্রে কেচে রাখি। উনি অবশ্য বলেছিলেন, বেয়ারা কাচুক না। কিন্তু আমি জানি, আমার হাতে কাঁচা জায়নামাজে তিনি প্রসন্নতর চিত্তে নামাজ পড়েন।

আমি ঈষৎ বিস্মিত হয়েছিলুম, সেই এশার নামাজের কথা শুনে। এবারে পুরো মাত্রায়। শুধালুম, উনি কি নামাজ-রোজাতে খুব আসক্ত? তাই তো মনে হচ্ছে।

শহর-ইয়ার বললেন, আসক্ত! ওই দুটি মাত্র ধাতু দিয়েই তো তাঁর জীবন গড়া। নামাজ-রোজা আর রিসার্চ।

আমি হাসতে হাসতে মাথা দোলাতে দোলাতে বললুম, আমি সব জানি, আমার কোনও জিনিস অজানা নেই। আমি পয়গম্বর হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ওয়া আলাইহি সাল্লাম-এর বংশধর, তদুপরি আমি সাতিশয় সম্মানিত পীর খানদানের ছাওয়াল, তদুপরি আমার ঠাকুরদা দাদামশাই দু জনাই ছিলেন আঁহাবাজ মৌলানা। আমি জানব না তো কে জানবে? আপনি? ডাক্তার? আবাদ! হরগিজ নহি। বলে তিনটি আঙুল তুলে ঘন ঘন আন্দোলন করতে করতে বললুম, ট্রিনিটি, ট্রিনিটি- পিতা পরমেশ্বর, পুত্র ঈশ্বর এবং পবিত্র আত্মা। আপনি সেই পবিত্র আত্মা। আপনি সেই পবিত্র আত্মা– রূপকার্থে ও শব্দার্থে। কিংবা, ভদ্রে বেগমসাহেবা, কাছে এসে অম্মদ্দেশীয় গীতাটি স্মরণ করুন। জ্ঞানযোগ– সে ডাক্তারের রিসার্চ। কর্মযোগ– সে তাঁর আরাধনা ক্রিয়া-কর্ম। ভক্তিযোগ– সে আপনার প্রতি তাঁর অবিচল ভালোবাসা। আপনাদের উভয়ের এ জীবনে সুখ আছে এবং অন্যলোকে মোক্ষ-নজাৎ! অবশ্য দ্বিতীয়টা যেন একশো বছর পরে আসে। কারণ ফারসিতে বলে, দের আএদ, দুরুস্ত আদ– যেটা দের-এ অর্থাৎ দেরিতে আসে সেটাই দুরুস্ত–পরিপাটি হয়ে আসে।

আমার উৎসাহের বন্যায় শহর-ইয়ার ডুবু ডুবু। সাদা-মাটা ভাষায় বললেন, আপনার মুখে মধু, কানে মধু– এই যেন চিরকাল আপনার কিস্মতে থাকে। আর আপনার শুভেচ্ছা-দোয়ার জন্য আমার যা কর্তব্য কাল, শুক্রবার, সেটি করব। আপনার সলাম-কল্যাণের জন্য মহল্লার মসজিদে শিরনি পাঠাব। নমাজান্তে জমায়েত ধর্মনিষ্ঠজন আপনার আত্মার জন্য দোয়া করবেন।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললুম, বে-ফায়দা, বে-কার, ইয়ার! বে-ফায়দা, বেকার। আমার মতো পাষণ্ড পাপির জন্য শিরনি পাঠানো তপ্তকটাহে বিন্দুমাত্র বারিসিঞ্চনতুল্য। তা সে যাক আল্লাহ মেহেরবান, তাঁর কাছ থেকে শেষ বিচারের দিনে মাফের আশা রাখি। এবারে বলুন তো, নামাজ-রোজার প্রতি আপনার কীরকম টান?

দুঃখ করে বললেন, আমার বন্-নসিব। আল্লা আমাকে সেদিকে মতিগতি দেননি।

কর্তা অনুযোগ করেন না?

একদম না। ভদ্রলোক কখনও কাউকে কোনও জিনিস করতে বলেন না– ভালোও না, মন্দও না। এমনকি তার মডার্ন বন্ধুবান্ধবদের কেউ কেউ তাঁর আচারনিষ্ঠতা নিয়ে অল্পস্বল্প মেহসিক্ত কৌতুকের ইঙ্গিত করলে তিনি শুধু মিটমিটিয়ে হাসেন। শুধু তাই নয়, মাঝে মধ্যে ধর্ম নিয়ে তাদের ভিতর আলোচনা আরম্ভ হলে তিনি সবকিছু শোনেন মন দিয়ে, কিন্তু আজ পর্যন্ত তাঁরা তাঁকে কখনও সে আলোচনায় যোগ দেওয়াতে পারেননি। বিশ্বাস করবেন না, আমার সঙ্গে তো সব বিষয়েই কথাবার্তা হয়– আমার সঙ্গে পর্যন্ত তিনি কখনও ওই একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেননি, আমি সূত্রপাত করলেও না। এই দেখুন, রোববারে কাজে বেরোন না বলে ফজরের নামাজ পড়ে প্রথম এক ঘণ্টা কুরান পড়েন সুর করে কারীদের মতো। তার পর খানতিনেক ইংরেজি-বাংলা অনুবাদ আর একখানা আরবি টীকা নিয়ে আরেক ঘণ্টা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটি শব্দের গভীরে গিয়ে, সঙ্গে সঙ্গে নোট করে টোকেন। আমি তাকে একদিন ওই অধ্যয়নের দিকটা আমার সঙ্গে করতে অনুরোধ জানিয়েছিলুম। তিনি বললেন, আমি নিজে এতই অল্প জানি যে তোমাকে কপিটেন্টলি সাহায্য করার শক্তি আমার মধ্যে নেই। আমি বরং তোমার জন্য একজন ভালো মৌলানা যোগাড় করে দিচ্ছি। আমি বললুম, থাক। আপনিই তো কবি ওমর খৈয়ামের একটি চতুষ্পদী অনুবাদ করেছেন–

তব সাথে, প্রিয়ে মরুভূমি গিয়ে
পথ ভুলে তবু মরি,
তোমারে ছাড়িয়া মসজিদে গিয়া
কী হবে মন্ত্র স্মরি!

আমি বললুম, এটা কি ডাক্তারের উচিত হল? পরিপূর্ণ সত্য একমাত্র আল্লার হাতে; আমাদের শুধু চেষ্টা তার কতখানি কাছে আসতে পারি। ডাক্তার কি ভাবছেন, তিনি যে মৌলানা এনে দেবেন কুরান শরিফ সম্বন্ধে তাঁর পরিপূর্ণ জ্ঞান আছে? আমি ডাক্তার হলে বলতুম, মোস্ট ওয়েলকাম্! তার পর একসঙ্গে পড়তে গিয়ে যদি আপনি দেখতেন যে ব্যাপারটা থ্রি-লেগড রেস হয়ে যাচ্ছে তখন চিন্তা করতুম, এখন তা হলে কী করা যায়? তার বদলে মৌলানা এনে লাভ? তিনি তো প্রথম ঝাড়া পাঁচটি বৎসর আপনাকে ব্যাকরণ কণ্ঠস্থ করাবেন, এবং তার পর? আপনি, ডাক্তার, আমি– আমরা কুরানে যা খুঁজি, মৌলানা তো সেটা খোঁজেন না। তাই দাঁড়াবে :

তৃষ্ণায় চাহিনু মোরা এক ঘটি জল
মৌলানা এনে দিল আধখানা বেল!

আপনি ডাক্তারের প্রস্তাব না মেনে বেশ করেছেন। কিন্তু ডাক্তারের কথা ওঠাতে মনে পড়লো, বেচারী সমস্ত দিন খেটেছে, আপনার সঙ্গে দু চারটে কথা বললে তার শরীর-মন জুড়োবে। আপনি যান না।

শহর-ইয়ারের সে কী খিলখিল হাসি। হাসতে হাসতে যেন চোখে জল দেখা গেল। বললে, ইয়া আল্লা! আপনি আছেন কোন ভবে। এশার নামাজ সেরে বালিশের উপর ভালো করে মাথাটি রাখার আগেই তো তার আগের থেকে তৈরি পরিপাটি নিদ্রাটি আরম্ভ হয়ে যায়। যেন যন্ত্রটি হাতে নিয়েই সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বাজনা- আলাপ না, বিলম্বিত না, আর যন্ত্রটা বাধার তো কথাই ওঠে না। আর হপ্তায় কদিন আল্লায় মালুম, শুতে গিয়ে দেখি তিনি নামাজ সেরে জায়নামাজেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। খাটে উঠবার আর তর সয়নি। আর সে কী ঘুম, কী ঘুম! অত্যন্ত নিষ্পাপ মানুষ ভিন্ন অন্য লোক বোধ হয় আল্লার কাছ থেকে এ ইনামটি পায় না।

আমি শুধালুম, এ বাড়িতে আপনার সঙ্গীসাথী কেউ আছে?

 অবাক হয়ে বললেন, এ বাড়িতে?

হ্যাঁ।

বললেন, এ বাড়িতে তো আমরা দু জন থাকি। সঙ্গীসাথী আসবে কোত্থেকে?

এবার আমার আশ্চর্য হবার পালা। শুধালুম, এই যে গণ্ডায় গণ্ডায় সাজানো গোছানো। ঘর পেরিয়ে এলুম।

কেউ থাকে না তো।

ওই যে উইংটা– এল শেপের মতো এসে লেগেছে?

সেখানেই-বা থাকবে কে? ওখানে তো আলোই জ্বালানো হয় না।

নিচের তলায়, তেতলায়?

 সেগুলোও তো অন্ধকার দেখলেন। কেউ থাকে না উপরে নিচে। থাকি আমরা দু জনে আর যে কটি লোক দেখলেন, আমরা যখন গাড়ি থেকে নামলুম।

আমি বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললুম, এই বিরাট বাড়িতে মাত্র দু জন লোক!

শহর-ইয়ার একটু বিষণ্ণ হাসি হেসে বললেন, আপনার ভয় করছে? কিন্তু এটা ভুতুড়ে বাড়ি নয়, রহস্য উপন্যাসের অভিশপ্ত পুরীও নয়। যিনি এ বাড়ি বানিয়েছিলেন সে ক যুগের কথা আমি জানিনে– তার পরিবার, ইষ্টকুটুমগুষ্টি নিয়ে এ বাড়িটাও নাকি যথেষ্ট বড় ছিল না। কিন্তু আমি সত্যি বিশেষ কিছু জানিনে। উনিও যে খুব বেশি কিছু জানেন, তা-ও তো মনে হয় না! ওঁকে জিগ্যেস করবেন নিঃসঙ্কোচে। এ বংশের, এ বাড়ির কোনও গোপন রহস্য নেই, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। তার পর একটু ভেবে বললেন, আর উনিই-বা বলবেন কী? সেই খুদায় মালুম কশ লোকের পরিবার কমতে কমতে মাত্র একজনাতে এসে ঠেকল তারই তো ইতিহাস? আমার মনে হয় না, তিনি খুব বেশি কিছু একটা জানেন আর এ বাবদে তার কোনও কৌতূহলও নেই। তাতেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কত বিরাট বিরাট পরিবার প্রতিদিন বল ক্ষীণ আয়ুহীন হয়ে ক্ষয় পেয়ে যাচ্ছে, অতীতে গেছে, ভবিষ্যতেও যাবে। এতে বৈচিত্রই-বা কী, আর রোমান্সই-বা কোথায়? আর, এ তো শুধু একটা পরিবার। কত জাতকে জাত কত নেশনকে নেশন পৃথিবীর উপর থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে মুছে গেছে, তারই-বা খবর রাখে কে?

আমি বললুম, থাক্ এসব দুঃখের কথা। আমি এখানে রোমান্সের সন্ধানে আসিনি সে তো আপনি জানেন। এবারে বেশ মোলায়েম, মধুর, দিল-চসপ কোনও একটি বিষয়বস্তুর অবতারণা করুন। আপনার নামের মিতা বাগদাদের শহর-ইয়ার শহর-জাদী এক হাজার এক রাত্রি গল্প বলেছিলেন। আপনি নাহয় হাজারের শেষের এক রাত্রি সেইটে আরম্ভ করুন, বা শেষ করুন।

শহর-ইয়ার বললেন, যবে থেকে এখানে এসেছেন, সেই থেকে তো আমি সুযোগ খুঁজছি।

আমি বললুম, মাফ করে দেবেন।

 তিনি বললেন, আপনার দোষ কে বলল? বলছিলুম কী, আমারও রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ডের একটি মামুলি সঞ্চয়ন আছে। দু একখানা শুনবেন?

নিশ্চয়ই, একশো বার এবং ধরে নিচ্ছি ডাক্তারের বিধিদত্ত যোগনিদ্রা তাতে ব্যাহত হবে না।

আশ্চর্য, আমার শোবারঘরের দেয়ালে শহর-ইয়ার বোতাম টিপে একটা ঢাকনা চিত করালেন। ভিতরের ক্যাবিনেট বা কুলুঙ্গি থেকে যেন রেললাইনের উপর দিয়ে প্লাইড় করে বেরোল একটি রেডিয়োগ্রাম। এ না-হয় বুঝলুম, কিন্তু ঘরের পশ্চিম প্রান্তের এসপারউসপার জোড়া দেয়ালে বিল্ট-ইন্ দেরাজের স্লাইডিং দরজাগুলো যখন এদিক ওদিক সরাতে আরম্ভ করলেন তখন তার মামুলি সঞ্চয়ন দেখে আমি বাঙাল– জীবনে এই দ্বিতীয়বার হাইকোর্ট দেখলুম। দশবিশ বছর ধরে প্রত্যেকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড না কিনলে তো এ রকম বিরাট সঞ্চয়ন হয় না। এবং খাস মার্কিন স্টাইলে সেগুলো কার্ড ইনডেকসিং পদ্ধতিতে সাজানো। গোটা ছয় কার্ডশেল আমার সামনের টেবিলে রেখে বললেন, ক্যাটালগ দেখতে চান তো এই রইল। আমার নিজের দরকার নেই। আমার মুখস্থ আছে। আরেকটা কথা, এ সঞ্চয়নের অনেক out of print রেকর্ড কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে পুরনো রেকর্ড নতুনের দামে কেনা। তার পর আমাকে কিছু জিগ্যেস না করেই লাগালেন, কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশকুসুম চয়নে– এ গানটা যেন আমাদের উভয় পক্ষের সম্মিলিত বিসমিল্লা আল্লার নামে আরম্ভ করি-র মতো।

শহর-ইয়ার দেখলুম গান শোনার সময় চোখ বন্ধ করে পাষাণ-মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন।

এখানেও সেই বোলপুর পদ্ধতি। দুটো গানের মাঝখানে দীর্ঘ অবকাশ দেন।

আমাকে শুধোলেন, এবারে আপনার পছন্দ কী?

আমি আমার কণ্ঠে পরিপূর্ণ আন্তরিকতা প্রকাশ করে বললুম, আমি এই রবীন্দ্রসঙ্গীতের শপথ নিয়ে বলছি, আপনার-আমার রুচি একই। আমার বাড়িতে আপনি বাছাই করে যেসব গান বাজিয়েছিলেন তার থেকেই আমার এ দৃঢ় প্রত্যয় হয়েছে।

বললেন, মুশকিলে ফেললেন। আমি যখন নিতান্ত নিজের জন্যও বাছাই করি তখনও আমার এক যুগ কেটে যায় একটা রেকর্ড বাছাই করতে। তার পর রেডিয়োগ্রামের দিকে যেতে যেতে আপন মনে বললেন, হুঃ! তারও দাওয়াই বের করেছি। কাল আমি শুয়ে থাকব পাটরানির মতো আর এই পীরের সন্তানকে বলব রেকর্ড বাজিয়ে গানের সূত্রপাত করে পাপ সঞ্চয় করুন তিনি।

এবার বাজালেন, তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে কত আর সেতু বাঁধি।

তার মোহভঙ্গ হওয়ার পর যখন আমার কাছে এসে বসলেন তখন আমি তাকে শুধালুম, আপনার আত্মার খাদ্য কী?

আরও বুঝিয়ে বলুন।

দেহ ছাড়া আছে মানুষের মন, হৃদয়, আত্মা। আপনার বেলা এঁরা পরিতৃপ্ত হন কী পেলে? যেমন মনে করুন, সাহিত্যচর্চা, নাট্যদর্শন, সঙ্গীতশ্রবণ– এমনকি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিরীক্ষণ, বা যেমন আপনার স্বামীর বেলা সৃষ্টিকর্তার আরাধনা, কিংবা

বাধা দিয়ে বললেন, এবারে বুঝেছি এবং তার পর উত্তর দিতে আমাকে আদপেই বাছ-বিচার করতে হবে না, একলহমা চিন্তা করতে হবে না। আমার জীবন-রস রবীন্দ্রসঙ্গীত। ওই একটিমাত্র জিনিস।

আমি বললুম, ব্যস্?

ব্যস।

এবারে বাজালেন, আমার নয়ন—

কাছে এলে ফের শুধালুম, রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া আর কী?

বললেন, এর অনেক, অনেক পরে আসে যেসব জিনিস সেগুলোর মধ্যে একাধিক জিনিস আমাকে আনন্দ দেয়, মুগ্ধ করে, সম্মোহিত করে, আত্মবিস্মৃত করে, কিন্তু এরা আমার প্রাণরস নয়।

সেগুলো কী?

যেমন ধরুন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা, শরচ্চাটুয্যের বড় গল্প, আপনার শবৃন–

আমি বললুম, থাক্‌, থাক্। এ নামগুলো আর কখনও এক নিশ্বাসে করবেন না। লোকে বলবে, আপনার বসবোধ অদ্ভুত, বিজারু, গ্রেটেস্ক।

বলুক। আমি কুমারস্বামী নই, স্টেলা ক্ৰামরিশও হতে চাইনে।

 এবারে বাজালেন আরও একটা আমার প্রিয় গান।

ফিরে এসে আমার পায়ের কাছে বসলেন। আমি লম্বা হয়ে শুয়ে উত্তম যন্ত্রে, সমঝদার কর্তৃক সযত্নে বাজানো বে-জখমি রেকর্ড শুনছিলুম- পরম পরিতৃপ্তি ও শান্তিলাভ করে আমি যেন আমার সর্ব দেহ-মন কোনও এক মন্দাকিনী ধারায় ভাসিয়ে দিয়েছি। মৃদুকণ্ঠে বললে, আপনার পা টিপে দিই?

আমি সর্পাহতবৎ লাফ দিয়ে উঠে খাড়া হয়ে বসে বললুম, এ আবার কী?

দেখি, তাঁর মুখ থেকে সর্বশেষ রক্তবিন্দু অন্তর্ধান করেছে। আমার দিকে তাকালেন না, দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে চুপ করে বসে আছেন।

আমি তখন আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি, ভুল আমারই, উত্তেজিত হওয়াটা আমার গাইয়া বেকুবি হয়েছে। সেটা ঢাকবার জন্য রেডিয়োগ্রামের কাছে গিয়ে না দেখে-চেয়ে আগের রেকর্ডটার উল্টো পিঠটা বাজাবার চেষ্টা করলুম কিন্তু মেসিনটা এমনই নতুন মডেলের যে কোন বোতাম টিপলে কী হয়, কোন সুর কী ফানকশন অনুমান না করতে পেরে ভ্যাবাচ্যাকার মতো দাঁড়িয়ে রইলুম। শহর-ইয়ার বুঝতে পেরে কাছে এসে বললেন– আল্লাকে শুক্র, ভঁর গলায় কণামাত্র উত্তাপ বা অভিমান নেই- এখন আমি বাজাই। কাল আপনাকে দেখিয়ে দেব। তা হলে আপনার ইচ্ছেমতো যখন খুশি তখন বাজাতে পারবেন। তাই এই ঘরটাতেই আপনার থাকার ব্যবস্থা করেছিলুম। কথাগুলো শুনে লজ্জায় আমার যেন মাথাকাটা গেল। এ মেয়ের অনেক গুণ প্রথম পরিচয়ের দিন থেকেই লক্ষ করেছি কিন্তু সে যে এতখানি দয়ালু আর ক্ষমাশীলা সেটা লক্ষ করে যেমন লজ্জা পেলুম তেমনি আনন্দও হল যে এমন সদ্গুণ শুধু যে পৃথিবী থেকে অন্তর্ধান করেনি তাই নয়, আমারই এক পরিচিতার ভিতর পরিপূর্ণ মাত্রায় রয়েছে।

রেকর্ড চালু করে দিয়ে এবারে শহর-ইয়ার চেয়ারে বসলেন। আমি ততক্ষণে বিছানায় আবার লম্বা হয়েছি।

বললুম, শহর-ইয়ার।

 জি?

আগে যেখানে বসেছিলেন সেইখানেই এসে বসুন।

জি, বলে এসে বসল।

আমি বললুম, টিপতে হবে না, হাত বুলিয়ে দিন। এবারে তাঁর মুখ আগের মতোই উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

আমি বললুম, আমি বড়ই মূৰ্থ। মনে আছে আপনারা দু জনা যখন বোলপুরে আসেন তখন প্রথম পাঁচ মিনিটের ভিতরই আমি বলেছিলুম, এদেশে আমার আত্মজন নেই? তখন লক্ষ করেছিলুম, আপনার চোখ ছলছল করেছিল। তার পরও দেখুন দেখি, আমি কত বড় বেকুব।

শহর-ইয়ার হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, থা না। এই সামান্য জিনিস নিয়ে

আমি বাধা দিয়ে বললুম, আমি কত বেকুব দেখুন। আচ্ছা, কাল যদি আমার শক্ত ব্যামো হয়, তা হলে আপনিই তো আমার দেহমনের সম্পূর্ণ ভার নেবেন এবং নার্স যা করে তার চেয়েও বেশি করবেন। নয় কি? তবে আজ আমার এত লজ্জা কেন?

এবারে শহর-ইয়ার শিশিরবিন্দুটির মতো ঝলমল করে উঠল।

উঠে এসে আমার মুখের উপর তার হাত রেখে আদরে ভরা দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, আপনাকে বলিনি আর কথা না বলতে। এই আপনার মুখ বন্ধ করলুম। দেখি, কী করে ফের কথা বলেন। আসলে আপনার যাতে এখানে কোনও অসুবিধা না হয় তাই কাটুকে আমি আপনার কী কী দরকার, আপনার ডেলি রুটিন কী এসব অনেক প্রশ্ন শুধিয়েছিলুম। কথায় কথায় সে বলল, আপনি গা টেপাতে ভালোবাসেন তাই। এবার সব ভুলে যান। হাত মুখ থেকে সরালেন।

বললুম, ভুলে গিয়েছি!

হাসলেন। শুধালেন, এবারে কী বাজাব?

 ক্ষণমাত্র চিন্তা না করে বললুম, ঐ মরণের সাগর পারে, চুপেচুপে তুমি এলে।

সঙ্গে সঙ্গে একদম ডেড় স্টপ। তার পর আমার হাতের কাছে খাটের বাজুতে বসে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার পর অতি ধীরে ধীরে বললেন, এই বারে আমার মনের অন্ধকারতম কোণেও আর কোনও সন্দেহ রইল না যে আপনার-আমার রুচি এমনই অস্বাভাবিক ধরনের এক যে, আর কেউ জানতে পারলে বলবে, আমি আপনার অন্ধ ভক্ত বলে আমার রুচি আপনার রুচির কার্বনকপি মাত্র। অথচ কী আর বলব, এ গান আমাকে যেরকম আত্মহারা করে দেয় অন্য কোনও গান সে-রকম পারে না। জানেন, এ গান কিন্তু এখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত সমঝদারদের ভিতরও অতি, অতি দৈবে-সৈবে গাওয়া হয়। এবং যে দু বার শুনেছি সে-ও একদম বাইরের অজানা অচেনা গাওয়াইয়া গেয়েছে– অর্থাৎ সমঝদারদের চেলাচেলির কেউ না। আমার তো বিস্ময় বোধ হয়, রেকর্ড কোম্পানি কোন সাহসে এ গানটি বাছাই করল! দিনু বাবুর চাপের দরুন না কি?

আর কী অদ্ভুত সাহস দেখিয়েছেন আপনার গুরুদেব এই গানে।

 ভুবন-মোহন স্বপন রূপে– কী বস্তাপচা সমাস এই ভুবনমোহন-টা। কোনও মেয়ের নাম ভুবনমোহিনী শুনলেই তো আমার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে জগদম্বা, রক্ষাকালী, ক্ষান্তমণি! না? অথচ এই গানের ঠিক এ জায়গাটায় সমাসটা শুনে নিজের কানটাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না যে, এই ঝুলি-ঝাড়া, সাতান্ন ঘাটের জল খাওয়া, হেকর্নিড়, ক্লিশে সমাসটি এত মধু ধরে, তার এত বৈভব, এত গৌরব! সঙ্গে সঙ্গে আমার বন্ধ চোখের তারা দুটি যেন আকাশের দিকে ধাওয়া করে– নইলে সমস্ত ভুবন কীভাবে মোহন হল সেটা দেখবে কী করে অনেকখানি উঁচুতে না উঠে, সেখান থেকে নিচের দিকে, ভুবনের দিকে না তাকিয়ে! আর তার পর? ওই ঊর্ধ্বলোক থেকে যখন বিশ্বভুবনের মোহনীয়া রূপ বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে আস্বাদন করছি তখন অকস্মাৎ কী নিদারুণ গভীর গহ্বরে পতন! শুনি,

বন্ধ ছিলাম এই জীবনের অন্ধকূপে—

 আমার চোখের সামনে তখন কী বীভত্স দৃশ্য ভেসে ওঠে, জানেন! আমাদের গ্রামাঞ্চলের লোক এখনও বিশ্বাস করে, কোনও কোনও বিরাট ধনের মালিক তার সমস্ত ধন কোনও এক গভীর অন্ধকার গহ্বরে পুঁতে রেখে যায়, এবং সেটাকে পাহারা দেবার জন্য চুরি-করে-আনা একটি আট বছরের শিশুকে জন্মের মতো শেষবার তাকে ভালো করে খাইয়েদাইয়ে, সাজিয়েগুজিয়ে সেই ধনের পাশে বসিয়ে গুহা-গহ্বর বাইরের থেকে সিল করে দেয়। আমি যেন চোখের সামনে দেখতে পাই, সেই ক্ষুদ্র বালকটি যেন অন্ধভাবে ধীরে ধীরে আপনার অবস্থা হৃদয়ঙ্গম করছে। তার পর অনুনয়-বিনয়, তার পর রোদন; সর্বশেষে তার ক্ষুদ্র মুষ্টি দিয়ে চতুর্দিকের দেয়ালে আঘাতের পর আঘাত

আমি বললুম, দয়া করে ক্ষান্ত দিন, আমি আর শুনতে চাইনে।

বললেন, তবে থাক! ওই যে বন্ধ ছিলাম অন্ধকূপে–আমাদের প্রত্যেকের জীবন কি তাই নয়? অন্ধকূপের দেয়ালে জীবনভর করে যাচ্ছি মুষ্ট্যাঘাত আর আর্তনাদ, ওগো খোলো খোলো, আমাকে আলোবাতাসে বেরুতে দাও।

তার পর ভুবনমোহন রূপ নিয়ে মৃত্যু এসে দেয় নিষ্কৃতি– সে শ্যামসমান মোহনীয়া। এ কী ভ্রান্ত ধারণা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে যে মৃত্যু বিকট বীভৎস! সে আসা মাত্রই ঊর্ধ্বপানে তাকিয়ে দেখি, আকাশে স্তরে স্তরে সন্ধ্যাদীপের প্রদীপ জ্বালা –কত না নক্ষত্র স্তরে স্তরে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রতীক্ষা করছে আমাকে অমর্ত্যলোকের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে বলে, আর পদপ্রান্তে যে মর্ত্যভূমি থেকে বিদায় নিচ্ছি সেখানে ঝিল্লি-সঙ্গীতের সঙ্গে পুষ্পবনের গন্ধরূপে সৌরভ।

আপনাকে শুধোই, আপনি বয়সে বড়, অনেক কিছু পড়বার, শোনবার সুযোগ পেয়েছেন– এরকম আরেকখানা গান কেউ কখনও রচতে পেরেছে।

আমি বললুম, না, কিন্তু আপনি যেরকম গানটিকে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছেন, কজন বাঙালি পারে সেটা?

শহর-ইয়ার অনেকক্ষণ ধরে সমুখপানে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন। শেষটায় বললেন, ঠিক কোনদিক দিয়ে আরম্ভ করব বুঝতে পারছিনে। আমি যে গানটিকে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছি তার জন্য আমার হৃদয় ছিল প্রস্তুত। কিন্তু সে প্রতিটি নির্মিত হল কী প্রকারে? রবীন্দ্রনাথের গানে গানে। ভিলেজ ইডিয়টেরও হৃদয় আছে কিন্তু সেই আকারহীন পিণ্ড সারাজীবন ধরে একই পিণ্ড থেকে যায়। আমার হৃদয় প্রতি নতুন গানের সামনে নতুন আকার ধরেছে, যেন সে শিল্পীর হাতের কাদা। ওই চিন্ময় গান শুনতে শুনতে আমার হৃদয় যেন ওই গানেরই মৃন্ময় রূপ ধারণ করে একটি মূর্তিরূপ ধারণ করে। গানটি যেন শিল্পী। গানের প্রতিটি সুর প্রতিটি শব্দ তার আঙুলের চাপ। সুরে সুরে শব্দে শব্দে অর্থাৎ গান-শিল্পীর আঙুলের চাপে চাপে মূর্তিটি সম্পূর্ণ হয়েছে। তার পর শুনলুম আরেকটি গান। আগের মূর্তিটি তনুহূর্তেই আবার শিল্পীর হাতে কাদাতে পরিবর্তিত হয়েছে। সুরে সুরে শব্দে শব্দে আবার সে এক নবীন মৃন্ময় মূর্তিতে পরিণত হল। এভাবে আমার হৃদয় কতশত মূর্তিতে পরিণত হয়েছে কতশত গানে গানে। আর এখন? এখন চেনা গানের দুটি শব্দ শোনা মাত্রই সম্পূর্ণ মূর্তি আপনার থেকেই তার আকার, তার রূপ নিয়ে নেয়। অথবা অন্য তুলনা দিয়ে বলব, রবীন্দ্রনাথের প্রত্যেকটি গান যেন ভিন্ন আকারের রঙিন এক পানপাত্র, আর আমার হৃদয় বর্ণহীন তরল দ্রব্য। ওই গানের পাত্রে প্রবেশ করে সে নেয় তার আকার, তার রঙ।

আমার সুখ-দুঃখের অনুভূতি, আমার মান-অভিমান, বিরহ-মিলনের অশ্রুপাত, আনন্দোল্লাস, আমার সর্বপ্রকারে সূক্ষ্মানুভূতি, স্পর্শকাতরতা– সব, সব নির্মাণ করেছে, প্রাণবন্ত করেছে রবীন্দ্রনাথের গান; সেই শত শত গানই শিল্পী– স্রষ্টা!

আমি চুপ করে, কোনও বাধা না দিয়ে প্রত্যেকটি শব্দ হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করছিলুম। বললুম, আমরা হিন্দু আর মুসলমান মেয়ের হৃদয়বৃত্তি নিয়ে আলোচনা করছিলুম। সেই সুবাদে আপনাকে একটি প্রশ্ন জিগ্যেস করি। রবীন্দ্রনাথ তার ধর্মসঙ্গীতে যে চরম সত্তার কাছে আত্মনিবেদন করেছেন তিনি তো মুসলমান সুফিদের অল-হ পরম সত্য সত্তাস্বরূপ। এ গানগুলো আরবি বা ফারসিতে অনুবাদ করলে কারও সাধ্য নেই যে বলতে পারে এগুলো রচেছে এমন এক কবি যে মুসলমান নয়। আপনি মুসলমান। এ গানগুলো শুনে আপনার হৃদয় কি রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গানের চেয়ে বেশি সাড়া দেয়?

গভীর দুঃখ প্রকাশ করে বললে, ওইখানেই তো ট্র্যাজেডি। কয়েকটি ব্যত্যয় বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ ধর্মসঙ্গীতই আমার বুকে তুফান তোলে না। তুললে তো আমার সব সমস্যা ঘুচে যেত। আমার দেহমন সেই চরম সত্তার কাছে নিবেদন করে পরমা শান্তি পেতুম। একেই তো বলে ধর্মানুরাগ। বরঞ্চ দেখুন, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করব না, আল্লা মানুষের রূপ ধারণ করে অবতাররূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন এবং তৎসত্ত্বেও যে ধর্মসঙ্গীতটি আমার হৃদয়ের ভিতর দুরন্ত তুফান তোলে, সেটি–

মেরে তো গিরিধর গোপাল
দোসরা তো কোঈ নহি রে—

চরম অসহায় অবস্থায় এ ভজনটি যে আমি কত সহস্র বার কখনও চিৎকার করে এই নির্জন বাড়িতে গেয়েছি, কখনও গাড়িতে বসে গুনগুনিয়ে, আর সবচেয়ে বেশি জনসমাজে বস্তৃত সেখানেই আমি সবচেয়ে বেশি একা, বর্জিতা, অসহায় শক্তিহীনা বলে নিজেকে অনুভব করি– নিঃশব্দে শুধু হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন নিয়ে।

***

নিঝুম নীরব সে গহ, বিরাট ভবন স্তব্ধ, বাইরের ভুবন তন্দ্রামগ্ন।

হয়তো এস্থলে আমার উচিত ছিল সহানুভূতি প্রকাশ করে জিগ্যেস করা শহর-ইয়ার কেন নিজেকে বর্জিতা অসহায় বলে মনে করেন। কিন্তু করলুম না।

সর্বনাশ! হঠাৎ বলে উঠলেন শহর-ইয়ার। তিনটে বেজে গেছে, আপনি ঘুমুন, আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। ছি ছি, আমার একেবারে কোনও কাণ্ডজ্ঞানই নেই!

.

০৬.

আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই, সৃষ্টিকর্তা নারী-পুরুষ ভিন্ন ভিন্ন ধাতু দিয়ে গড়েছেন। শহর-ইয়ার ঘুমিয়েছে ক ঘণ্টা? তিন ঘণ্টা? সাড়ে তিন ঘণ্টার বেশি নিশ্চয়ই নয়। সাড়ে সাতটায় খাবার ঘরে চা খেতে এসে দেখি, তার চেহারা যেন শিশির-ধোয়া শিউলি ফুলটি। কোনও সন্দেহ নেই, সৃষ্টিকর্তা তাদের প্রতি বেশি মেহেরবান।

শহর-ইয়ার ডাক্তারের ব্রেকফাস্টের তদারকি করছে, সঙ্গে সঙ্গে তার লাঞ্চের জন্য স্যান্ডউইচ-সন্দেশ এটা-সেটা ছোট্ট টিফিনবক্সে সাজাচ্ছে এবং তারই ফাঁকে ফাঁকে বাজার-সরকারকে হাটের ফিরিস্তি বলে যাচ্ছে। আমাকে এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে বললে, আপনি দুপুরে, রাত্রে কী খাবেন যদি বলেন তবে এই বেলাই হাটের সঙ্গে সেগুলো এসে যাবে।

আমি বললাম, দোহাই আপনার! আমাকে নিষ্কৃতি দিন। আপনি তো দেখেছেন, আমি আমার বাড়িতে একেবারে একা। দিনের পর দিন কাঁচা, পাকা –সব বাজারের ফিরিস্তি বানানোর মতো একঘেয়ে মেয়েলি কাজ করতে হয় আমাকে। আমি ছুটি চাই।

কাজে বেরুবার পোশাক পরে ডাক্তার এলেন। ভালো ঘুম হয়েছে কি না শুধোলেন, সকালবেলা যে শুধু চা না খেয়ে এটা-সেটা খাওয়া উচিত সেটা শোনালেন এবং তার পর দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, আমার কপাল, তাছাড়া আর কী বলব। এশার নামাজ যেই না শেষ হয় অমনি সুলেমান বাদশার দুই জিন্ আমার দুই চোখের পাতার উপর তাদের আড়াইশো মণ ওজন নিয়ে হয় সওয়ার। আপ্রাণ চেষ্টা করে তখন পাঁচটি মিনিটও জেগে থাকতে পারিনে। সকালবেলা উঠেই বুকে পাপ-হিংসার উদয় হল– আপনারা দু জনাতে যে মজলিস জমালেন আমি তার হিস্যেদার হতে পারলুম না বলে।

আমি বললুম, আপনি বিশ্বাস করবেন যে আমি আপনাকে বার বার মিস্ করেছি।

ডাক্তার বললেন, কোথায় না সান্তনা পাব, শোকটা আমার আরও উথলে উঠছে।

শহর-ইয়ার সঙ্কোচের সঙ্গেই ডাক্তারকে বললেন, তা হলে আজ একটু বেলাবেলি বাড়ি ফিরলেই তো ওঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্য খানিকক্ষণ সময় পাবে।

ডাক্তার সোৎসাহে বললেন, ঠিক বলেছ। আজ তা হলে গাড়ি সাতটার সময়ই পাঠিয়ে দিয়ো। আমাকে বললেন, গাড়ি আমাকে পৌঁছে দিয়েই ফেরত আসবে। আপনি যদি কোথাও যেতে চান তো কোনও অসুবিধে হবে না। এমনকি সাতটার সময় গাড়ি না পাঠাতে পারলেও আমার কোনও হাঙ্গামা হবে না। আমাদের দফতরে একটি হর-ফ-মৌলা, সকল-কাজের কাজি চাপরাসি আছে– জিনিয়াস লোকটা। এই কলকাতা শহরের একশো মাইল রেডিয়াসের ভিতরও যদি কুল্লে একখানা ট্যাসি খালি থাকে তবে সে সেটা পাবেই পাবে– যেন ব্লাডহাউন্ডের মতো সে ট্যাসির বদ বো শুঁকতে পায়।

আমি বললুম, আমি বাড়ি থেকে বেরুচ্ছিই না; আমার কোনওপ্রকারের এনগেজমেন্ট নেই।

ডাক্তার বললেন, তা হলে তো আরও ভালো। শহর-ইয়ার আপনাকে নিয়ে যাবে এখানে-সেখানে, সর্বশেষে তার প্যারা প্যারা বইয়ের দোকানে। আর ইতোমধ্যে যদি ইচ্ছে হয়, তবে আমাদের পাঁচ-পুরুষের জমানো আরবি-ফারসি কেতাব ঘটতে পারেন আমাদের লাইব্রেরিতে– একপাশে আছে, আমার কেনা কিছু ইংরেজি আর বাঙলা বই। না, না, না। তওবা! ডাক্তারি বই এখানে থাকবে কেন?

হঠাৎ যেন নতুন অনুপ্রেরণা পেয়ে বললেন, আপনার বাগচী, ভটচা, চাটুয্যে চেলাদের একদিন ডাকুন না এখানে, কলকাত্তাই মোগলাই খানা খেতে? দোস্ত আপনাদের? না, তা হলে বোধ হয় ঠিক জমবে না। আলাদা আলাদা করে দাওয়াত করলেই ভালো। কী বলেন আপনি?

আমি নষ্টামির চোখে বললুম, তার চেয়ে শহর-ইয়ার তার বান্ধবীদের স্মরণ করুন। তাঁদের সঙ্গে দু দণ্ড রসালাপ করে সেই গোলাপজলে শুকনো জানটাকে ভিজিয়ে নেব।

ডাক্তার যেন সন্মুখে ভূত দেখতে পেয়ে বললেন, ওরে বাপরে! ওর মতো জেলাস আর পজেসিভ রমণী আপনি ত্রিসংসারে পাবেন না। বরঞ্চ আপনাকে-আমাকে দু জনাকে চিরজন্মের মতো যমের হাতে ছেড়ে দেবে, তবু তার বান্ধবীর হাতে এক মিনিটের তরেও ছাড়বে না হোক না সে বান্ধবীর বয়েস নব্বই।

টেবিল ছেড়ে উঠে বললেন, তা হলে স্যর, খুদা হাফিজ টিল উই মিট এগেন।

 বউয়ের দিকে তাকিয়ে একটু লাজুক হাসি হেসে বুলেট-বেগে বেরিয়ে গেলেন।

অনেকক্ষণ পরে ম্লান হাসি হেসে শহর-ইয়ার বললেন, আপনি সত্যি বিশ্বাস করেন, তিনি আজ সাতটায় ফিরবেন? সময়মতো ফেরা, না-ফেরা কি ওঁর এখতেয়ারে? সেটা তো সম্পূর্ণ তাঁর কাজের নেশার হাতে। নেশা না কাটা পর্যন্ত কি মাতাল দাঁড়িয়ে উঠে চলতে পারে? আজ যদি সাতটায় কাটে তো ভালো। আর যদি তার বদলে দশটায় কাটে, তবে সেটা কাটার পর, ওই মাতালেরই মতো আপনার পা ধরে মাফ চাইবেন একশো বার, হাজার বার। আপনাকে উনি যা শ্রদ্ধা করেন তাতে আপনাকে অবহেলা করা তাঁর স্বপ্নেরও বাইরে। কিন্তু নেশা জিনিসটা নেশা। কাজের নেশা, ঘোড়ার নেশা, প্রেমের নেশা।

একটু ভেবে নিয়ে দুঃখের সুরে বলেন, আমার যদি কোনও একটা নেশা থাকত তা হলে এই জীবনের অন্ধকূপের তলায় দিব্য মাতাল হয়ে পড়ে রইতুম।

আমি বললুম, আপনি না-হক পেসিমিস্ট।

আমি পেসিমিস্ট নই। আমি ইমোশনাল– বড্ড বেশি স্পর্শকাতর– মাত্রাধিক অনুভূতিশীল। এবং তার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী আপনার গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ। তাঁর শত শত গানের শত শত মেশিনের ভিতর দিয়ে আমার কলিজাটাকে এপার-উস্পার করে কিমা-কিমা বানিয়ে ছেড়েছেন। তবে এখন আর এসব কথা বলব না। এ প্রসঙ্গের জন্য পুণ্যলগ্ন রাত্রে, গান শোনার মাঝে মাঝে। আর ওই আমার কর্তাটি যে বললেন, আমি জেলাস, আমি পজেসিভ, সেটা উনি চিন্তা না করে বলেছেন–

আমি বললুম, কী বলছেন! উনি মশকরা করেছেন।

না, উনি চিন্তা না করেও একদম খাঁটি সত্য কথা বলেছেন। আমি খুব ভালো করেই জানি আমি জেলা এবং আমার হক্ক আমার সম্পদ সম্বন্ধে সর্বক্ষণ সচেতন। তবে হ্যাঁ, আমি লড়নেওয়ালি নই। কেউ হামলা করলে আমি তখন আমার চোখের জলের সঙ্গ খুঁজি।

আমি বললুম, খাঁটি মুসলমান বঙ্গরমণী! কোথায় গেল মুসলমান পাঠান রমণীর দৃপ্তকণ্ঠের জঙ্গি জবাব, না, কবুল না।

গুনগুন করে গান ধরল, কেন চোখের জলে ভাসিয়ে দিলাম না রে। সঙ্গে সঙ্গে দিব্য লাঞ্চের টেবিল সাজানো, ব্রেকফাস্টের জিনিস সরিয়ে নিয়ে যথাস্থানে রাখা, ফাঁকে ফাঁকে রান্নাঘরের তদারকি করা, বাঙলা কথায় পুরো গেরস্থালির কাজ করে যেতে লাগল– গান গাওয়াতে কোনও খিরকিচ না লাগিয়ে। বাইরে থেকে যে কেউ সে গাওয়া শুনে নিঃসন্দেহে ভাবত, চোখ বন্ধ করে প্রাণমন ঢেলে তন্ময় হয়ে কেউ গানটি গাইছে।

শেষ হলে আমি বললুম, আমার মতের মূল্য অনেকেই দেয়, তাই বলছি, আপনি বড় সুন্দর গাইতে পারেন। কিন্তু বাইরে, মজলিসে কোথাও গেয়েছেন বলে শুনিনি, কাগজেও দেখিনি।

বললে, একই বিষয়বস্তু কেউ লেকচাররূপে সভাস্থলে প্রকাশ করে, অন্যে ঘরের ভিতর পাঁচ-কথার মাঝখানে বলে। আমার গান যদি সত্যিই সেটা গানের স্তরে ওঠে– দ্বিতীয় পর্যায়ের। বাড়িতে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে, এ গান তার জায়গা খুঁজে নিয়েছে। সভাস্থলে গাইলে নিশ্চয়ই আমার গান আড়ষ্ট শুষ্ক কাষ্ঠ হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে একটি গানের মাঝখান থেকে গেয়ে উঠলেন–

সভায় তোমার ও কেহ নয়,
 ওর সাথে নেই ঘরের প্রণয়
 যাওয়া-আসার আভাস নিয়ে
রয়েছে এক পাশে।

এ গানের ঘরের প্রণয়ীও নেই। নিতান্ত আমার কাজকর্মের নিরালা দিনের, নির্জন অবসরের একপাশে পড়ে থেকে বেচারী আমাকে সঙ্গ দেয়।

নজরুল ইসলামের গানে শখ নেই? আর কিছু না হোক, মুসলমান হিসেবে, অন্তত যেগুলোর যোগ আমাদের ধর্মের সঙ্গে আছে?

আছে, কিন্তু মুশকিল স্বরলিপি যোগাড় করা। আর যেভাবে সচরাচর গাওয়া হয় সেটা আমার পছন্দ নয়। কুক্ষণে তিনি বিদ্রোহী রচেছিলেন। গাওয়াইয়ারা এখন তাঁর শান্ত লিরিক গানেও ওই বিদ্রোহী সুর লাগান। বিলকুল বেখাপ্পা। এমনকি বিশ্বাস করবেন না, তাঁর ঝিঙে ফুলের মতো লক্ষে গোটেক, ধরা-ছোঁয়ার বাইরের নাজুক কবিতাটিও আবৃত্তি করা হয় মোশন ঢুকিয়ে, জোশ লাগিয়ে! বদখদ বরবাদ! চলুন, আমার কাজ উপস্থিত এখানে খতম। বাজার আসুক; তখন দোসরা কিস্তি।

আমি বেরুতে বেরুতে বললুম, একটি রেওয়াজ আমি পৃথিবীর সর্বত্রই লক্ষ করেছি। স্বামী স্ত্রী ভিন্ন অন্য তৃতীয় প্রাণী যে বাড়িতে নেই, এবং স্বামী লাঞ্চ খেতে বাড়ি আসেন না, সেখানে স্ত্রী লাঞ্চ ব্লাঁধে না। কী খায় সে অবশ্য দেশভেদে খাদ্য ভেদ। জানিনে লাঞ্চের পরিবর্তে আপনি কী খান। বিশ্বাস করুন আমি সেই খেয়েই সন্তুষ্ট হব। সে আমার জন্য আসমান-জমিন স্থানচ্যুত করে আগা খানের খাওয়ার মতো লাঞ্চ তৈরি করতে হবে না।

চলতে চলতে বললেন, আপনার লোক দিলজান শেখও বলছিল আপনি লাঞ্চের তোয়াক্কা করেন না। ডিনারও নাকি প্রায়ই মিটসে থেকে বের করে রাতদুপুরে খান। কিন্তু এ বাড়িতে আমি বে-চারা, নিরুপায়। ইসলামি অনুশাসন অনুসারে এ বাড়িতে শতাধিক বর্ষ ধরে অলঘ্য ঐতিহ্য, প্রভু-ভৃত্য খাবেন একই খানা। চাকররা সরু চাল খেতে পছন্দ করে না এই আর্জি পেশ করায় কর্তা সরু চাল ছেড়ে দিয়ে মোটা ধরেছেন! আমার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে ওরা মোড় থেকে মাঝে-মধ্যে ফুচকা নিয়ে আসে– জানেন তো কীরকম ধুলোবালির সঙ্গে মিলেমিশে সে-ফুচকার মাটির শরীর। কোনওদিন যদি দৈবাৎ ওঁর চোখের সামনে পড়ে যায় তবে সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে লম্ফ দিয়ে ঠোঙা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে চিৎকার, দে, দে আমায় দে। একা একা খাসনি। গুনাহু হবে। শুনুন, মশাই, শরিয়তের অভিনব ব্যাখ্যা! চাকরকে না দিয়ে মুনিব যদি একা একা খুশ খানা খায় তবে সেটা অশোভন (মকরূহ) বলা হয়েছে, গুনাহ্ (পাপ) কি না জানিনে, কিন্তু মুনিবকে বাদ দিয়ে চাকর যদি- এবং সেটা মুনিবেরই পয়সায়– মামুলিই কিছু একটা খায় তবে নাকি সেটা চাকরের গুনাহ্। আবার ফুচকা খেতে খেতে গম্ভীর কণ্ঠে সদুপদেশ বিতরণ : দ্যাখ, রাস্তার ফুচকা খানি। জার্মটার্ম থাকে। অসুখ-বিসুখ করে। তার পর আবার বিড়বিড় করে বলেন, বাড়ির ফুচকা কিন্তু অখাদ্য রদ্দি। এই তো এখানকার হাল। অতএব আপনি খান আর না খান, আমি খাই আর না খাই, দুপুরের রান্না হবে ঠিক ঠিক। কাল সন্ধ্যায় দেখলেন না, ঘরের পর ঘর সাজানো– জনপ্রাণী নেই? এটাও ঐতিহ্য!

আমি বললুম, আরেকটা কথা। আজ বিকেলে সাড়ে ছ টায় আপনাকে নিয়ে আমার প্রয়োজন। অবশ্য আপনার যদি ওই সময় অন্য কোনও কাজ না থাকে।

কী ব্যাপার? আমার তো ভয় করছে।

আমি হাসতে হাসতে বললুম, রত্তিভর ভয়ের কারণ নেই। বঙ্গবালাদের অবশ্য সবই হিন্দু– লাজুক তবিয়ৎ বাবদে আমি ওয়াকিফহাল।

উনি গান গাইতে গাইতে বিদায় নিলেন,

জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না,
হায় ভীরু প্রেম, হায় রে।

দুপুরে খেতে বসার সঙ্গে সঙ্গে শহর-ইয়ার বললেন, ক বার যে গিয়েছি আপনার বন্ধ দরজার কাছে! দোরে কান পেতে না দেখেও স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি আপনি পড়ছেন। তাই দোরে টোকা দিইনি।

আমি বললুম, সর্বনাশ করেছেন। আমি জাগ্রত অবস্থায় কিছু-একটা না পড়ে থাকতে পারিনে। আর সর্বক্ষণ পড়ি বলে যে কোনও সময়ে যত ঘণ্টার জন্য চান আমি সে পড়া মুলতুবি রাখতে পারি। তাই আপনি যে সময় খুশি যত ঘণ্টার তরে খুশি আমার কাছে এসে গল্প করতে পারেন, রেকর্ড বাজাতে পারেন যা খুশি তাই। ও! অত প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন কেন? বিস্তর পড়ি বলে? হায়, হায়, হায়! জানেন, মাথা থাবড়াতে ইচ্ছে করে যখন কেউ বলে, কিংবা তার মুখের ভাব থেকে বুঝতে পারি যে, সে ভাবছে, আমি পড়ে পড়ে জ্ঞানসমুদ্রের গভীর থেকে গভীরতর স্তরে ডুব দিচ্ছি। বিশ্বাস করুন, কসম খেয়ে বলছি, জ্ঞান যৎসামান্য একটু-আধটু হয়তো মাঝে-সাঝে বাড়ে, আসলে কিন্তু আমি পড়ি ওটা আমার নেশা, নেশা, নেশা। এক্কেবারে নেশার মতো। মাতালকে শুধোবেন, সে বলবে, প্রথম দু তিন পাত্তর তার দেহমনের জড়তা কাটে, সে সময় মনে ফুর্তিও লাগে কিন্তু তার পর যে সে খেয়ে যায় সেটা নিতান্তই মেকানিকেলি। সর্বশেষে সে নিস্তেজ হয়ে আসে, তবু খাওয়া বন্ধ করে না। তাই তো ওটার নাম নেশা। যতক্ষণ মদ তাকে আনন্দ দিচ্ছে ততক্ষণ তো সেটা কাজের জিনিস খুব বেশি গালাগাল দিতে চাইলে হয়তো বলতে পারেন বিলাসিতা কিন্তু যখন সেটা আর আনন্দ না দিয়ে তাকে নিস্তেজ থেকে নিস্তেজতর স্তরে নামিয়ে নিয়ে যায় তখন সেটা রীতিমতো নিন্দনীয় নেশা। আমার পড়া ওই ধরনের। আপনার চোখ থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারছি আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেননি। আরেক দিন না হয় আরও গভীরে গিয়ে আপনাকে বোঝাব। আপনিও যদি না বোঝেন তবে আমার শেষ নোঙর ভাঙল।

কিন্তু আপনার কর্তার বেলা ব্যাপারটা অন্যরকম। প্রথমত তার বয়েস কম বলে এখনও বহু বৎসর ধরে তাকে নানারকম তথ্য ও তত্ত্ব সঞ্চয় করে জ্ঞানবৈভব বাড়াতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, তারই সাহায্যে তাঁর জীবনদর্শন– জর্মনরা বলে ভেন্টআনশাউউঙ, গড়ে উঠবে। সব জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার আদর্শ এই জীবনদর্শন নির্মাণ করা। কিন্তু আজ এখানেই ফুলস্টপ না, ফুলেস্ট স্টপ!

শহর-ইয়ার বললেন, আচ্ছা। এখনকার মতো না হয় বিশ্বাসই করে নিলুম।

বললুম, শাবাশ! এই জন্যই তো আপনাকে এত ভালোবাসি। তর্কাতর্কি অত্যুত্তম প্রতিষ্ঠান কিন্তু সেটা সময়মতো, কিছু সময়ের জন্য, মুলতুবি রাখার মতো সহিষ্ণুতা আর বদান্যতা যেন দিলের ভিতর থাকে। গায়ের মেয়েরা অবশ্য কোঁদল মুলতুবি রাখে অন্য কারণে। সংসারের কাজে ফিরে যেতে হবে বলে দুই লড়নেওয়ালি তখন জিহ্বা সংবরণ করে অদৃশ্য কাগজকালিতে টেম্পরারি আর্মিস্টিস সই করে; এবং তার প্রতীক, দু জনা দুই শূন্য ধামা ধপ্ করে মাটিতে উবু করে কোদলটা ধামাচাপা দিয়ে রেখে যার যার ঘরে চলে যায়। কাজকর্ম শেষ হলে উভয় পক্ষ রণাঙ্গনে ফিরে এসে ধামাদুটো তুলে নিয়ে কোদলকে দেয় নিষ্কৃতি। তার পর ফিন্ গুরুসে।

কিন্তু, মাদাম, বললে পেত্যয় যাবেন না, এই যে রেজালা নামক সরেস জিনিসটি খাচ্ছি, এটা যে তৈরি করেছে সে মাইকেল এঞ্জেলো রান্নার কলাসৃষ্টিতে।

মাদাম আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, আপনার বাড়ি সবদিক দিয়ে আমার অনেক বেশি ভালো লাগে। সেখানে আমার দেহমনে এক অপূর্ব নিরবচ্ছিন্ন শান্তি নেমে আসে। ওই একটিমাত্র জায়গা যেখানে আল্লাকে শুকর দেবার জন্য তসবি জপতে ইচ্ছে করে।

আমি বললুম, হুঃ! দিলজান শেখের রান্না– তা-ও বোলপুর হাটে যা পাওয়া যায় সেই আড়াইখানা শুকনো পটোল, চিমসে উচ্ছে আর সজনের ডাটা, সুপিচ্ছিল কলাইয়ের ডাল, ঝিঙে-পোস্ত তদাভাবে বড়িপোস্ত দিয়ে, কুকুরের জিভের মতো যে রুটিকে টেনে-টেনে খাবার টেবিলের এসপার-ওসপার করা যায় তাই দিয়ে ব্রেকফাস্ট। তার পর শোবার জন্য শক্ত কাঠের তক্তপোশ এবং বাথরুমে কলের জল নেই। এমনকি সেই আদ্যিযুগের গ্রামোফোনটা বাজাতে গেলে দম দিতে দিতে হঠাৎ বেবাক হাতখানা ধড় থেকে আলাদা হয়ে যায়। রাত্রে, হয় এমনি নিষুতি নিঝঝুম যে বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়, নয় শেয়ালের কনসার্ট ঘণ্টার পর ঘণ্টা নাগাড়ে।

আবার বলি, হুঁ! রমণীর রুচি যে কত বিদকুটে, বদখৎ হতে পারে এই তার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ?

হঠাৎ মুখ তুলে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে দেখি, শহর-ইয়ারের দু গাল বেয়ে জল পড়ছে।

আমি হতবুদ্ধি হয়ে মাফ চাইতে গিয়ে কী যে অসংলগ্ন কথা তোতলাতে তোতলাতে বলেছিলুম সেটা তখনও নিজেই বুঝতে পারিনি এবং এখন স্মরণে আনা তো সম্পূর্ণ অসম্ভব।

কিন্তু আল্লার কী আপন হাতে গড়া এই মেয়ে শহর-ইয়ার! আমার বিহ্বল অবস্থা দেখে সঙ্গে সঙ্গে সে তার সম্পূর্ণ আত্মকর্তৃত্ব কব্জায় এনে দু চারটি কথা দিয়ে আমাকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবার মতো অবস্থার সৃষ্টি করে দিল। বললে, আমার রসিকতাবোধ ইদানীং বড্ড কমে গেছে কতকগুলি আকস্মিক অপ্রিয় ঘটনা ঘটে যাওয়ায়। এই যা সব এখনি বললেন, তার সবকটি কথা সত্য, কিন্তু আপনার কাছে মিথ্যা, আমার কাছে আরও মিথ্যা। যদি সত্যই হবে, তবে আমি আপনার বাড়িতে প্রতিবার আসামাত্রই এত প্রাণভরা আনন্দে আমার দিকে এগিয়ে আসেন কেন, আপনার বুকের ভিতর থেকে উচ্ছ্বসিত হয়ে বেরিয়ে আসে না আপনার মহব্বৎ, আপনার প্যার, আপনার হাঁক-ডাক, চেল্লা-চেল্লিতে? কই, আপনি যেসব অনটন-অসুবিধার লিস্টি দিলেন তার দুর্ভাবনায় তো ক্ষণতরেও আপনাকে প্রকুঞ্চন করতে দেখিনি। মনে আছে, একদিন রুটি খারাপ ছিল বলে টোস্টগুলো মিইয়ে যায়- কই, আপনি তো একবারও আমাদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করেননি বা ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেননি। তবে আজ হঠাৎ এসব কেন? দেখুন সিতারা সাহেব–

এবারে আমি বিস্ময়ের যেন বিজলি শক খেয়ে শুধালুম, আমার ডাকনামটা আপনাকে বললে কে?

মোনালিজার মতো রহস্যভরা নয়নে তাকিয়ে বললে, যদি বলি এটাও ওই তর্কের মতো উপস্থিত ধামাচাপা দিয়ে মুলতবি রাখা যা, তবে আপনার আপত্তি আছে?

আমি বললুম, হরগিজ নহি। যে কোনও একদিন বললেই হল।

এতক্ষণ খাচ্ছিল বলে শহর-ইয়ার কোনও গান ধরতে পারেনি। সে-কর্ম সমাধান হতেই সিতারা (তারা) তাকে টুইয়ে দিল ওই কর্মে ফিরে যেতে। শুরু করল,

নিবিড় ঘন আঁধারে
জ্বলিছে ধ্রুবতারা
 মন রে মোর পাথারে
হোসনে দিশেহারা!

অনেকক্ষণ ধরে চোখ বন্ধ করে গাইল। বুঝলুম, এটি তার বিশেষ প্রিয় গান।

আমি বললুম, ভুলবেন না অখণ্ড সৌভাগ্যবতী শহর-ইয়ার, এই গানের মূলমন্ত্রটি– শোভন এই ভুবনে রাখিয়ো ভালোবাসা। আর কাজের কথা শুনুন– অবশ্য গানের মূলমন্ত্রটি সর্বকাজের চেয়েও মহান আজ সাড়ে ছ টার সময় আপনার সঙ্গে আমার রাঁদেভু কয়েক মিনিট আগে এলেই ভালো এবং বাইরে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে আসবেন, প্লিজ। পটের বিবি সাজতে পারেন, না-ও পারেন। সাজবার সময়কার মুড়মাফিক। আচ্ছা, গাড়িটা পাওয়া যাবে তো?

নিশ্চয়ই। কিন্তু বলুন তো, আমায় কোথায় নিয়ে যাবেন?

এমনই সাদামাটা সর্ব রোমান্স বিবর্জিত স্থলে যে সেটা সত্যি বলার মতো নয়। কাজেই সর্ব সারপ্রাইজের ভয়-ভরসা বর্জন করে দিন এই বেলাই।

শহর-ইয়ার

নিশিদিন ভরসা রাখিস
ওরে মন হবেই হবে

গুনগুন করতে করতে চলে গেল।

.

০৭.

‘হা। । । জির!’ হাটার উচ্চারণ আরবি কায়দায় যতদূর সম্ভব দীর্ঘ এবং জিরটি সেই অনুপাতে হ্রম্বের চেয়েও হ্রস্ব।

আমি বললুম, এ কী! এ যে একেবারে রাজরাজেশ্বরীর বেশে সেজেছেন? সঙ্গে সঙ্গে গান ধরল,

তোমায় সাজাবো যতনে কুসুমে রতনে
কেয়ূরে কঙ্কণে কুঙ্কুমে চন্দনে।

 পূর্বেই বলেছি, পুরোপাক্কা বঙ্গ হিন্দুরমণীর বেশ পরলেও শহর-ইয়ারের সঙ্গে হিন্দুরমণীর কোথায় যেন একটা পার্থক্য থেকে যায়। উঁহু! মাথায় এক থাবড়া সিঁদুর বসিয়ে দিলেও সে পার্থক্য ঘোচবার নয়। এতদিন তাকে প্রতিবারেই দেখেছি সাদামাটা বেশে; আজকের এ বেশেও সেই পার্থক্য, বরঞ্চ একটু বেশি।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললে, কেন? আমার কি সাজতে সাধ যায় না?

আমি বললুম, এর অনেক বেশি ঘন ঘন যাওয়া উচিত। সাজসজ্জা করলে সকলেরই যে সৌন্দর্যবৃদ্ধি হয় তা নয়। এবং কারও কারও বেলা মনে হয় এ যেন ভিন্ন, অচেনা জন। আপনার বেলা দুটোর একটাও নয়। আর সবচেয়ে বড় কথা আপনি আপনার সৌন্দর্য সম্বন্ধে যেরকম সম্পূর্ণ অচেতন থেকে সেটিকে অবহেলে ধারণ করেন, আপনার সাজসজ্জা প্রসাধনও আপনি ঠিক সেইভাবে দেহে তুলে নিয়েছেন। মনে হয়, আপনি এই বেশেই নিত্যদিনের গৃহকর্ম করেন, ঘৃতলবণতৈলতবস্ত্রইন্ধন সমস্যা সমাধান করেন। যে কথাগুলো বললুম তার সবকটি আমি শেষবিচারের দিনের সৃষ্টিকর্তার সামনে, ডাক পড়া মাত্র, আপনারি মতো হা। । । জির বলে কসম খেয়ে বলতে রাজি আছি অবশ্য যদি এইবেলা এই বেশে আপনি আপনার একটি ছবি তুলিয়ে দেন– কারণ তসবিরে জার্না সে সময় দর-বগল না হলে চলবে না।

সে আবার কী? মনে হচ্ছে ফারসি। বুঝিয়ে বলুন।

আমি বললুম, সমূহ মুশকিলে আমাকে ফাসালেন। দোহাটি শুনেছি গুরুর কাছে ওস্তাদ বললুম না, কারণ তিনি ছিলেন কনৌজের কট্টর গোড়া ব্রাহ্মণ এবং জানতেন উৎকৃষ্টতম ফারসি–আমার বয়েস যখন তেরো-চোদ্দো। তার পর এটি আমি অন্য কারও মুখে শুনিনি, ছাপাতেও দেখিনি। কাজেই আমার পাঠে ছন্দপতন ও যাবতীয় গলদ থাকার প্রভূত সম্ভাবনা। অর্থ হচ্ছে এই, শেষবিচারের দিন (দর কিয়ামৎ) প্রত্যেককেই (হর কস) সে সমস্ত জীবন ধরে যা যা পাপকর্ম, পুণ্যকর্ম করেছে এবং করেনি তারই একটি পুরো রিপোর্ট (আমলনামা বা শুধু নামা বা নাম) আপন আপন হাতে ধরে (দস্তু গির) দাঁড়াবে। আমিও নিজে (মন্ নিজ) হাজির হব (হাজির মিশওম) বগলদাবায় (দ বগল) প্রিয়ার তসবিরটি (তসবিরে জানা) নিয়ে।

অর্থাৎ ওই লোকটি সেই শেষ বিচারের সর্বমান্য পাক-পবিত্র বিচারপতিকে বলবে, অন্যেরা আপন আপন কৃতকর্মের পুরো বয়ানের আমলনামা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে, কিন্তু হুজুর, আমার কোনও আমলনামা নেই। তার কারণও সাতিশয় সরল। আমি সমস্ত জীবন ধরে আর-কিছু করিনি– জীবনভর শুধু আমার প্রিয়ার ছবিটি এঁকেছি আর দেখেছি, দেখেছি আর একেছি। সেইটিই আমার কৃতকর্মের আমলনামা। এই নিন, হুজুর, দেখে নিন! তাই বলছিলুম, অষ্ট-অলঙ্কার-পরা আপনার এখনকার একটি ছবি আমাকে দিন। নইলে শেষ বিচারের আদালতে জেরার চোটে আমার জেরবার হয়ে যাবে– একসিবিট নাম্বার ওয়ান অ্যান্ড লাস্ট না থাকলে।

শহর-ইয়ার বললেন, আমার অল্প বয়সে আমাদের বাড়িতে প্রায়ই মৌলবি-মৌলানা আসতেন। তখন এরকম কল্পনাতীত, অসম্ভব অসম্ভব প্রেমের দোহা অনেকগুলো শুনেছি। এসবেতে অতিশয়োক্তি নিশ্চয়ই, তবু কেমন যেন মনে হয়, ওই যুগে ওরা বোধ হয় আমাদের তুলনায় প্রেমের মূল্য দিত ঢের ঢের বেশি। আচ্ছা, সে তত্ত্ব বাদ দিয়ে আপনার বর্তমান সমস্যা সমাধানের জন্য পরামর্শ দিই; আপনি আমার ছবি আঁকুন!

আমি ভীত রুদ্ধ কণ্ঠে বললুম, আর হঠাৎ যদি শবৃনম্ এসে পড়ে ছবিটা দেখে? ও তো আসবে অতি অবশ্যই। ও যাবার সময় যখন বলে গিয়েছিল সে ফিরে আসছে তখন সে আসবে নিশ্চয়, দৃঢ় নিশ্চয়।

তাচ্ছিল্যভরে শহর-ইয়ার বললে, এখন এলে আপনি তাকে চিনতেই পারবেন না।

রীতিমতো তাজ্জব বনে বললুম, আপনার মুখে এই কথা! আপনার অনুভূতির কলিজাটা না রবিঠাকুরের কিমা-মেশিনে তুলো-পেঁজা হয়ে গিয়েছে! শবনমের অনন্ত তারুণ্য তো কখনও পরিবর্তিত হতে পারে না তাকে তো আমি গড়েছি আমার জিগর কলিজার বিন্দু বিন্দু খুন দিয়ে এবং সে নির্মাণ বহু শত যোজন পেরিয়ে এখনও পূর্ণোদ্যমে অগ্রগামী। আচ্ছা, এ যুক্তিটা না হয় বাদই দিন। ধরুন, একশ বছর পরে নিতান্ত দৈবদুর্ঘটনাবশত কিংবা কোনও ছোকরা লাইব্রেরি-অ্যাসিসটেন্ট শন সম্বন্ধে লিখিত আমার আর পাঁচখানা নগণ্য পুস্তকের মতো এই পুস্তকখানি পড়ল, নিতান্ত অনিচ্ছায়, সুদ্ধমাত্র বইটা ক্যাটালগের কোন কোঠে পড়বে সেইটেই ঠাহর করার জন্য। একশো বছর পরে পড়ছে বলে কি আপনার ধারণা শবৃনম্ তখন একশো বছর বয়সের জরাজীর্ণা বৃদ্ধা হয়ে সে ছোকরার সামনে আবির্ভূত হবে?

রসভঙ্গ করে ড্রাইভার বিনয় কণ্ঠে শুধালে, সরকার, যাব কোথায়?

সাহেব যেখানে কাজ করেন।

ককিয়ে উঠে শহর-ইয়ার বললে, ওই রসকসহীন জায়গায় যাবার জন্য আমি এই বেশভূষা সর্বাঙ্গে চড়ালুম! হা আমার কপাল! এ কপাল কি আর কখনও বদলাবে না? আপনার সঙ্গ পেয়েও না? আরেকটু হলে কেঁদে ফেলত আর কি!

আমি দৃঢ় কণ্ঠে বললুম, আপনি আমাদের ইসলামের কিছুই জানেন না। তা হলে অবহিতচিত্তে শ্রবণ করুন একটি হদিস। জ্ঞানসঞ্চয় এবং পুণ্যলাভ দুই-ই হবে। অবশ্য আমি ঘটনাটি শব্দে শব্দে টায় টায় বলতে পারব না, কিন্তু প্রতিপাদ্য বিষয় বর্ণনে যে কোনওপ্রকারে উনিশ-বিশ হবে না তার জিম্মাদারি আমি নিচ্ছি– যদিও আল্লাই সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বজ্ঞ (ওয়াল্লাহু আলম!)

একদা এক অভিযানান্তে আল্লার পয়গম্বর যখন তাঁর সঙ্গীসাথীসহ তাদের বাসভূমি মদিনা শহরে প্রত্যাবর্তন করছেন, তখন তিনি লক্ষ করলেন, দলের এক আরব যুবা বড় অসহিষ্ণুভাবে তার উটকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সক্কলের আগে আগে যাবার চেষ্টা করছে। আরবরা বড়ই সাম্যবাদী– এরকম অবস্থায় দলের মুরুব্বিরাই যে দলের পুরোভাগে থাকবেন এমন কোনও বাধা-ধরা নিয়ম নেই। তৎসত্ত্বেও ওই যুবাটির অসহিষ্ণুতা হজরতের চোখে পড়ল। তিনি তাঁর পাশের উট-সওয়ারকে শুধালেন, ব্যাপার কী? লোকটার অত তাড়া কিসের? সে বলল, হে আল্লার প্রেরিত পুরুষ! এ যুবা অতিসম্প্রতি বিবাহ করেছে। তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছতে চায়। হজরত বললেন, আচ্ছা, ওকে আমার কাছে একবার ডেকে নিয়ে এসো তো। হজরতের আহ্বান শুনে যুবা শ্লাঘা অনুভব করে তাঁর কাছে এল। হজরত বললেন, বৎস, শোনো। তুমি যদি সক্কলের পয়লা পয়লা উট চালিয়ে সক্কলের পয়লা আপন বাড়িতে পৌঁছে যাও তবে খুবসম্ভব দেখতে পাবে তোমার নববিবাহিতা বধূ এই আকস্মিক প্রত্যাবর্তনের সংবাদ জানত না বলে বিরহিণী হয়তো তার আটপৌরে অতিশয় মামুলি বেশভূষা অযত্নে অবহেলায় পরিধান করে বিষণ্ণ বদনে বসে আছে। সে দৃশ্য তোমার মনঃপূত না-ও হতে পারে, তুমি পুলকিত না-ও হতে পারো। পক্ষান্তরে তুমি যদি দলের সকলের পিছনে থাক তবে যে-মুহূর্তে মদিনাবাসী দলের পুরোভাগ দেখতে পাবে তনুহূর্তেই শহরের সর্বত্র আনন্দ-দামামা বেজে উঠবে, এবং যেহেতু তুমি দলের সর্বপশ্চাতে আছ তাই বাড়ি পৌঁছতে তোমার সময় লাগবে বেশি ইতোমধ্যে তোমার বধূ সেই অবসরে উত্তম প্রসাধন করে, উৎকৃষ্ট বেশভূষা ধারণ করে তোমাকে প্রসন্ন অভ্যর্থনা জানাবার জন্য প্রফুল্ল বদনে তোমার জন্য অপেক্ষা করার সুযোগ পাবে। তাই বলি, শর-ইয়ার আপনার সর্বোৎকৃষ্ট অলঙ্কার, আপনার মধুরতম মৃদুহাস্য কার জন্য? অপরিচিতজনের জন্য, পথগামী জনতার জন্য সেখানেও মনে রাখবেন রাস্তাঘাটে স্বেচ্ছায় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ-অলঙ্কার প্রদর্শন ইসলামে নিন্দনীয়। অতএব আপনার বেশভূষা নিশ্চয়ই অপরিচিতজনের জন্যে নয়। আপনি যখনই স্বামীর কাছে যাবেন তখন আপনার বেশভূষা হবে রাজরানির মতো, তাঁর সঙ্গে কথা বলবেন যেন তিনিও আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষের রাজাধিরাজ, এবং তিনিও যখন আপনার কাছে আসবেন তখন আসবেন সম্রাটের বেশে এবং আপনার সঙ্গে কথা বলবেন যেন আপনি রাজরাজেশ্বরী।

হঠাৎ গলা নামিয়ে ঘরোয়া সুরে বললুম, জানেন, শহর-ইয়ার, তাই আমার তাজ্জব লাগে যখন দেখি আমাদের মেয়েরা কি হিন্দু কি মুসলমান বাড়িতে ত্যানা পরে মেলছের মতো স্বামীর চোখের সামনে আনাগোনা করছে, আর যত পাউডার যত অলঙ্কার বাড়ি থেকে বেরোবার সময়! যেন ওই হতভাগা স্বামীটাই এসেছে বানের জলে ভেসে।

শহর-ইয়ার চিন্তিত হয়ে শুধালেন, আমি কি বাড়িতে সত্যি মেলছের মতো থাকি।

আমি হেসে বললুম, আদপেই না। আপনি জেনে-না-জেনে সৌন্দর্যের এতই কদর দেন যে আপনার পক্ষে অসুন্দর বেশ পরা অসম্ভব, অসুন্দর আচরণ অসম্ভব, অসুন্দর

ব্যস, ব্যস, হয়েছে। কিন্তু বাড়িতে সাজতেগুজতে কীরকম যেন শরম শরম লাগে। লোকে কী ভাববে?

আমি প্রায় হুঙ্কার দিয়ে বললুম, আমার যত রাগ তো ঠিক ওইখানেই। লোক বলতে আপনি কাদের মিন করছেন? চাকর-বাকর এবং যে দু একটা উটকো লোক যারা বিন-নোটিশে কাজে-অকাজে বাড়িতে আসে। আমার প্রশ্ন, আপনি তাদের বিয়ে করেছেন, না ডাক্তারকে? তারা কী ভাবল, আপসে কী বলাবলি করল তাতে কী যায়-আসে? আচ্ছা, এখন তবে এ আলোচনা আজ থাক। আমরা মোকামে পৌঁছে গিয়েছি? আপনি ড্রাইভারকে বলুন না, সে যেন ডাক্তারকে গিয়ে বলে আমি গাড়িতে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছি। ড্রাইভার চলে গেলে বললুম, এইবারে দেখি, আমার সোনার চাঁদটি কী করেন। শহর-ইয়ার, আমিও একদা রিসার্চ করেছি এবং কেউ এসে এভাবে উৎপাত করলে বড়ই বিরক্ত হয়েছি। কিন্তু আমার আপনার অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, সেটা পাঁচ-সাত মিনিটের ভিতরই অন্তর্ধান করে। বিশেষ করে যারা ডিস্টার্ব করল তারা যদি তার আপনজন হয়– যাদের সঙ্গলাভে সে আনন্দ পায়। দু পাঁচ মিনিট তাদের সঙ্গে কথা বলতে না বলতেই রিসার্চের ভানুমতী কেটে যায়।

জোর পাঁচ মিনিট, দেখি ডাক্তার টাটু ঘোড়ার মতো ছুটে আসছেন। শহর-ইয়ারকে দেখে সামান্য বিস্মিত হলেন বটে কিন্তু তাঁর নিজের ভিতরকার কী এক উত্তেজনা সব-কিছু ছাপিয়ে যেন উপচে পড়ছে। মেশিনগানের চাইতেও দ্রুততর বেগে আমাকে বলে যেতে লাগলেন, ওঃ! আমার কিস্মটা আজ সত্যই বড় ভালো, বড়ই ভালো। এই দশ মিনিট আগে আমি আপনাদের ফোন করে পেলুম না। মহা বিপদে পড়লুম, করি কী? হয়েছে কী জানেন, আমার এক ভেরি ডিয়ার ফ্রেন্ড বউকে নিয়ে দিল্লি থেকে এসেছে। কাল ভোরের প্লেনে ফের দিল্লি চলে যাবে। আপনাকে সে চেনে, দিল্লিতে আপনার লেকচার শুনেছে, দু একবার আপনার সঙ্গে সামান্য কথাবার্তাও বলেছে। আপনার গ্রেট এডমায়ারার। আর তার বউ যখন এসেছে তখন শহর-ইয়ারকে নিয়ে যেতে হয়, নইলে বড় অভদ্রত হয়। দিল্লির খানদানি ঘরের ছেলে– ভাববে কলকাত্তার লোক তমিজ-তহজিব কিছুই জানে না। আপনারা এসে আমায় বাঁচালেন। চলুন, চলুন, আর দেরি না। আমি ওকে কথা দিয়েছি, আপনাদের দিয়ে গ্রেট ইস্টার্নে সাতটা সাড়ে সাতটার ভিতর পৌঁছব! আহ। বাঁচলুম, আল্লার কী মেহেরবানি।

আমি বললুম, এত নামাজ-রোজা করার পর আল্লা আপনাকে মেহেরবানি দেখাবে না তো দেখাবে কাকে? ওদিকে গাড়ির ভিতরকার আলো-অন্ধকারে না দেখেও যেন গাঢ় অন্ধকারেই বিদ্যুল্লেখার মতো উজ্জ্বলতম জ্যোতিতে দেখলুম, শহর-ইয়ারের গ্রেট ইস্টার্নে যাবার উৎসাহ ফ্রিজিং পয়েন্টেরও নিচে; আমারও তদ্বৎ। কিন্তু উপায় কী? ডাক্তারের বাবুলিং সফেন উত্তেজনা, তার অবিমিশ্র আনন্দ বরবাদ করতে পারে নিতান্ত পাষণ্ডজন। তদুপরি বেচারী ডাক্তার তো বারো মাস শুধু লেবরেটরি আর বাড়ি, এরই ভিতর মাকু চালায়। করুক না বেচারী একটুখানি ফুর্তি! আমরা দু জনা না হয় সারেঙ্গি-তবলার সঙ্গতই দেব।

হোটেলের সব কজন রেসেপসনিস্ট ওরকম লম্ফ দিয়ে উঠে ডাক্তারকে অতখানি সম অভ্যর্থনা জানায় কেন– ডাক্তার তো এখানে আসে অতিশয় কালেভদ্রে? লিফটের দিকে যেতে যেতে অনুমান করলুম, ডাক্তারের বাপ-ঠাকুর্দা এঁরা কলকাতার প্রাচীন খানদানি বিত্তশালী লোক; এ হোটেলে আসুন আর না-ই আসুন এরকম একটা হোটেল নিশ্চয়ই কোনও না কোনও সময়ে এঁদের আনুকূল্য পেয়েছে।

শহর-ইয়ার ও আমি দু জনাই চুপ। ডাক্তার কিন্তু সেটা আদৌ লক্ষ করেনি। এমনিতে মুখচোরা, লাজুক– এখন– এখন কেন, যবে থেকে আমাদের সঙ্গে দেখা সেই থেকে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। অনুমান করলুম, দিল্লি-আগত জনের সঙ্গে একদা নিশ্চয়ই বন্ধুত্ব তার সুগভীর ছিল। নইলে এত উৎসাহ, এত উত্তেজনা!

ভালো বড় ঘরই পেয়েছেন দিল্লির মেহমানদ্বয়।

ভদ্রলোকের পরনে অতি দামি কাপড়ের অত্যুত্তম দর্জির হাতে বানানো সুট। শার্ট, টাই একটু যেন বেশি আত্মপ্রকাশ করছে। সুপুরুষ না হলেও দ্র চেহারা। আর অতিথিকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তার আরামের ব্যবস্থা করাতে দিল্লির লোক পাকা, এটিকেট-দুরস্ত।

ম্যাডামটি কিন্তু কনট সার্কলের খাঁটি চক্রবর্তিনীদের একজন। সর্বপ্রথমই চোখে পড়ে এর ব্লাউজটি। সেটির নাম ব্লাউজ দেব, না কাঁচুলির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ বলে উল্লেখ করব? এই পেটকাটা ব্লাউজ যে তাঁর শরীরের উত্তমার্ধ আচ্ছাদিত করার জন্য নির্মিত হয়নি সেটা দেখামাত্রই বোঝা যায়। সেটা যেন সে চিৎকার করে প্রচার করছে। আমরা ঘরে ঢোকার সময় তিনি তার শাড়ির ক্ষুদ্রতম অঞ্চলাংশ একবারের তরে তাঁর কাঁধে আলতোভাবে রেখেছিলেন। আমরা ভালো করে আসন নেবার পূর্বেই সেটি স্থানচ্যুত হয়ে ঊরুতে স্থূপীকৃত হল। এর পর সেটি আর প্রমোটেড হয়নি। আমি ভাবলুম, শাড়ি ছেড়ে ইনি রাজপুতানিদের মতো ঘাগরা পরলে তো অনেকখানি কাপড়ের সাশ্রয় হয়। কিন্তু এই বাহ্য। আসল দেখতে হয় তাঁর মেক আপ। এরকম চুলের ঢপ আমি ইতোপূর্বে কখনও দেখিনি– খুব সম্ভব প্যারিসের ফ্যাশান পত্রিকা দেখে দেখে হেয়ার ড্রেসার তাঁর মাথার উপরকার ওই তাজমহলটি নির্মাণ করেছে। ঠোঁটে যে রঙ মেখেছেন সেটা লাল তো নিশ্চয়ই নয়, হয়তো ব্রোজ বলা যেতে পারে। নখের রঙ অলিভ গ্রিন। কিন্তু সংস্কৃত কবিকুলের মতো আমি যদি তার দেহ এবং প্রসাধন এস্থলে দফে দফে বর্ণাতে যাই তবে সর্বপ্রথমই আমাকে বৎসরাধিক কাল তার প্রসাধন নির্মাণে যে-সব গূঢ় রহস্যাবৃত রসায়নাদি সাহায্য করেছে তাদের নিয়ে একাগ্রমনে গবেষণা করতে হবে। ঐতিহাসিক ঔপন্যাসিকগণ অবহেলে থার্মোমিটার দিয়ে শরশয্যায় শায়িত ভীমের টেম্পারেচার অর্জুনকে দিয়ে নিতে পারেন, কিন্তু এ যুগের বর্ণনাতে আমি ব্রা-র নম্বর নিয়ে গুবলেট করলে কেউ তো আমায় ছেড়ে কথা কইবে না।

হোটেলের সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় একবার সামান্য একটু মোকা পেয়ে শহর-ইয়ার ফিসফিস করে আমাকে বলেছিল, আপনার জন্যই আজ আমার এই লাঞ্ছনা। এরা ভাববে আমি মারোয়াড়িদের মতো আমার গয়নার দেমাক করতে এসেছি। আমি বললুম, কিন্তু ডাক্তার তো আপনার এই অ্যাকসিডেন্টাল গয়না পরা দেখে খুশি হয়েছেন। তাঁর বন্ধুর কাছে বউকে তো আর বিধবার বেশে নিয়ে যেতে পারেন না।

আমরা কেউ ড্রিঙ্ক করি না শুনে মহফিলের পয়লা রাগিণীটিই সামান্য কমসুরা হয়ে শুরু হল। দিল্লি নগরীর মনসুর মুহম্মদ সাহেব বিড়বিড় করে যা বললেন তার মোটামুটি অর্থ, বিংশ শতাব্দীর সঙ্গে মানিয়ে চলতে হলে তেরোশো বছরের প্রাচীন বিধি-বিধান একটু-আধটু, এদিক-ওদিক উনিশ-বিশ করতে হয়। বেগম মনসুর এক ঢোঁক শেরি গিলে মাথা নেড়ে সায় দিলেন। ডাক্তার তেরোশো বছরের পুরনো কায়দায় এখনও নামাজ পড়েন, উপোস করেন; তবু তিনি কোনও আপত্তি জানালেন না। ওদিকে এ বাবদে উদাসীন শহর-ইয়ারের মুখ দেখি লাল হয়ে উঠেছে।

তার পর বিশেষ কোনও সূত্র ধরে বাক্যালাপ এগোলো না। আমরা যাকে বলি আশকথা পাশকথা। কথার ফাঁকে ফাঁকে মালুম হল, মনসুর সাহেব একদা এই কলকাতার কারমাইকেল হস্টেলে বাসা বেঁধে বছর দুত্তিন পড়াশুনা করেছিলেন এবং সে সময়ে ডাক্তারের সঙ্গে দোস্তি হয়। আমার তাই মনে হচ্ছিল, শ্রেষ্ঠতম ব্যবস্থা হত যদি দুই ইয়ারে দোকলা-দোকলি বসে দুহঁ দুহু কুহু কুহু করতেন– শহর-ইয়ার আর আমার তো কথাই নেই। মাদাম মনসুর পর্যন্ত দ্য এ–ওয়ান টু মেনি। অর্থাৎ সাকুল্যে থ্রি টু মেনি।

মনসুর এবং তার বিবি মাঝে-মধ্যে যে দু একটি ইংরেজি কথা কইলেন সেগুলো শুদ্ধ এবং ভালো উচ্চারণে, অথচ কেন যে তারা অধিকাংশ সময়ই উর্দু চালিয়ে যেতে লাগলেন সেটা বুঝতে পারলুম না। ওঁরা তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন ডাক্তারের যা উর্দু জ্ঞান সেটা দিয়ে বহুৎ ব-তকলি ব-মুশকিল কাজ চালানো যায় কি না-যায় সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে, আমার ভাঙাচোরা উর্দু আমি সভাস্থলে পেশ না করে, যে কটি বাক্য বলেছি সে সবই ইংরেজিতে এবং শহর-ইয়ার যে উর্দুর প্রতি পরিপূর্ণ ঔদাসীন্য দেখিয়ে এ পর্যন্ত তার জীবন কাটিয়ে দিয়েছে সেটা আমি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলুম তার সঙ্গে বোলপুর থেকে কলকাতা একসঙ্গে আসার সময়। কি মুটে, কি চা-ওলা, কি রেস্তোরাঁ-বয় কারও সঙ্গে সে ভুলেও বিশুদ্ধ বাঙলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষার সাহায্য নেবার প্রয়োজন বোধ করেনি। এস্থলেও সে ব্যত্যয় করেনি তবে বাঙলা না বলে বলেছে ইংরেজি অবশ্য মুখ খুলেছে সামান্য দু একবার মাত্র। এসব দেখেশুনেও দেব-দেবী দু জনা যে উর্দু কপচাচ্ছিলেন তার থেকে যে কোনও লোকের মনে সন্দেহ জাগা নিতান্ত খামখেয়ালি নয় যে, এঁরা যেন একান্তই উর্দু আনজুমনের মিশনারিরূপে এই বর্বর বাঙলা দেশে বিসুর্দ উর্দু ফলাতে এসেছেন!

এ অভিজ্ঞতা আমার একাধিকবার ইতোপূর্বেও হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ তথা দিল্লিবাসিন্দা কলকাতার মুসলমানদের মাঝখানে বসে উর্দু তড়পাবার সময় ভাবখানা করেন যে ওনারাই একমাত্র খানদানি মনিষি, খাস বেহেশতে জিব্রাইল গয়রহ দেবদূতরা উর্দুতেই বাৎচিৎ করেন– অবশ্য তারা সকলেই বাল্যকালে মনুষ্যরূপ ধারণ করে নিদেন বছর দশ দিল্লি-লক্ষ্ণৌয়ে উর্দুটা রপ্ত করে যান। উত্তরপ্রদেশ-দিল্লির উর্দুওলাদের এই হ-বড়াইর জন্য অবশ্য বেশকিছুটা দায়ী কলকাতার মুসলমানই। সে-বেচারী হিন্দু-প্রধান কলকাতায় যেখানে উর্দুসহ আগত মুসলমান কল্কে পায় না– তার জাতভাইকে যতখানি পারে সৌজন্য দেখাতে চায় এবং তার চেয়েও বড় কথা, তার মনের কোণে আছে উর্দুর প্রতি একটা সপ্রশংস মোহ। কিন্তু তার অর্থ অবশ্য নিশ্চয়ই এ নয় যে, সে তার মাইকেল-কবি-কাজী নিয়ে গর্ব অনুভব করে না। সে রকম কোনও বাগ-বিতণ্ডা উপস্থিত হলে সে ওঁদের জন্য জোর লড়াই দেয়। তবে লক্ষ করেছি, উর্দুওলারা এরকম তর্কযুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে চান না; তাঁদের ভিতর যারা চালাক তারা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে জানেন, বরঞ্চ কলকাত্তাই মুসলমান কিছু কিছু গালিব-ইব্রাল পড়েছে, এরা টেগোরের নাম শুনেছেন– বাদবাকি ব্লাঙ্কো।

দুর্ভাগ্যক্রমে ডাক্তারের বন্ধু তাঁর উর্দুর ঝাণ্ডা ব্যোমলোকের এমনই উচ্চ থেকে উচ্চতর স্তরে হয়েস্ট করতে লাগলেন যে, আমার তো ভয় হল ওটা না এভারেস্টের চুড়ো ছাড়িয়ে বেহেশতের লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড দফতরে গিয়ে পৌঁছয়। ডাক্তার নিরীহ মানুষ–হুঁ করে যাচ্ছিলেন সঙ্গে সঙ্গে। শহর-ইয়ারের মুখে কোনও পরিবর্তন লক্ষ করলুম না। আর আমি যে অনারোগ্য, গোরস্তানগমনোৎসাহী কঠিন ব্যাধিতে কাতর তারই নিষ্পেষণে নিশ্চুপ– সে ব্যামোর নাম সুপেরিয়রিটি কমপ্লেক্স। আমি আমার মাতৃভাষা নিয়ে এমনই শশব্যস্ত যে অন্য ভাষা তার চেয়ে উচ্চ পর্যায়ের কি না সে চিন্তা আমার পুরু নিরেট খুলিটা ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকতে পারে না।

কথায় কথায় মনসুর সাহেব বললেন, উর্দুর প্রচার ও প্রসারের জন্য কলকাতা মাদ্রাসার ব্যাপকতর ব্যবস্থা করা উচিত যাতে করে তাবৎ কলকাতার মুসলমান ছেলেমেয়ে সেখানে গিয়ে উর্দু শিখতে পারে।

আশ্চর্য! এতক্ষণ যে শহর-ইয়ার বিলকুল চুপসে বসে আড়াই ফোঁটা নিন্ধু-পানি চোষাতে সবচৈতন্য নিয়োজিত করে সময় কাটাচ্ছিল সে হঠাৎ বলে বসল, কলকাতা মাদ্রাসা ইসলাম ধর্মশাস্ত্রের চর্চা করে; কুরান, হদিস, ফিকাহ এবং তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি। সেগুলো এ টু জেড আরবিতে। তাই সেখানে আরবি ভাষা শেখানো হয় এবং নিতান্তই যখন সাহিত্যও ব্যতিরেকে ভাষা শেখানো যায় না তাই কিছুটা আরবি সাহিত্যও শেখায়। ফারসি শেখায় অতিশয় নগণ্য পরিমাণে এবং গভীর অনিচ্ছায় তার কারণ ফারসি সাতশো বছর ধরে এদেশের রাষ্ট্রভাষা ও বিদগ্ধ জনের ভাষা ছিল বলে সেটা চট করে ঝেড়ে ফেলা যায় না। যেসব কাচ্চাবাচ্চাদের মাতৃভাষা উর্দু, তাদের হয়তো যৎসামান্য উর্দুও শেখায়। কিন্তু মাদ্রাসার একমাত্র ও সর্বপ্রধান কর্ম হচ্ছে ইসলামশাস্ত্র চর্চা, ইসলামিক থিয়োলজি। সে হঠাৎ ব্যাপকভাবে– এবং নিতান্ত মিনিমাম প্রয়োজনের বাড়া যে কোনওভাবে উর্দু পড়াবার ব্যবস্থা করবে কেন?

বিস্ময়ে আমি হতচৈতন্য! ঠাকুর্দার নাম স্মরণ করতে পারছিনে!

কিন্তু মোক্ষম তাজ্জব মেনেছেন মৌলানা মনসুর।

বাজারে যতখানি গাম্ভীর্য সেদিন বেচা হচ্ছিল তার সাকুল্যে স্টক কিনে, সর্ব মুখে মেখে বললেন, উর্দু ভাষা ও সাহিত্য এদেশে ইসলামের প্রতিভূ!

শহর-ইয়ার বিস্ময় প্রকাশ করে বললে, তাই নাকি? তা হলে বিবেচনা করি, প্রত্যেক মুসলিমের যেটা প্রথম কর্তব্য অর্থাৎ ইসলাম-ধর্ম-তত্ত্ব-শিক্ষা, সে সম্বন্ধে কি উর্দুতে ভূরি ভূরি কেতাবপত্র রয়েছে? কিন্তু আমি তো শুনেছি অবশ্য আমার সংবাদদাতা ভুল করে থাকতে পারেন আপনারা কুরান শরিফের উর্দু অনুবাদ ছাপিয়েছেন মাত্র পঞ্চাশ-ষাট বৎসর পূর্বে। তারও ত্রিশ বৎসর পূর্বে হিন্দু গিরিশবাবু বাঙলাতে কুরান অনুবাদ ছাপিয়েছিলেন।

তার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই মনসুর বললেন, আরবির সঙ্গে উর্দুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।

আমি জানি শহর-ইয়ার আগের পয়েন্টে আরও অনেক-কিছু বলতে পারতেন, কিন্তু প্রতিপক্ষ যখন ভিন্ন রণাঙ্গনে চলে গেলেন তখন শহু-ইয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে উপস্থিত। বললেন, সে আবার কী করে হল? আরবি ভাষা হিব্রুর মতো সেমেটিক; উর্দু ভাষা বাঙলারই মতো আর্য-গোষ্ঠীর ভাষা। সম্বন্ধটা নিবিড়তর হল কী করে?

মনসুরের মুখ ক্রমেই লাল হতে আরও লাল হচ্ছে। ডাক্তার নীরব, কিন্তু ঈষৎ অপ্রতিভ। মাদাম মনসুর পানপ্রসাদাৎ ইতোমধ্যেই ঈষৎ বে-এখতেয়ার। আমি চুপ। কারণ শহর-ইয়ার তার তলওয়ার চালাচ্ছে পাকা ওস্তাদের মতো। তার মুখে রত্তিভর উত্তেজনা নেই।

মনসুর বললেন, উর্দু তার শব্দসম্পদ আহরণ করে আরবি থেকে।

শহর-ইয়ার বললেন, So what? উর্দু কেন, বাঙলার তুলনায়ও ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়ের ভাষা নিয়েছে অতি সামান্য পরিমাণ আরবি শব্দ এবং এগুলো যে আরবির মতো সেমেটিক গোষ্ঠীর ভাষা নয় সে-ও তো জানা কথা। কিন্তু ইন্দোনেশিয়েরা যেরকম ইসলামি ঝাণ্ডা খাড়া করেছে, পেরেছে সেরকম এদেশের উর্দুওলারা? আমি তো শুনতে পাই, দিল্লি-আগ্রা-লক্ষ্ণৌ-এলাহাবাদের স্কুলে স্কুলে উর্দু সরিয়ে হিন্দি শেখানো হচ্ছে। উর্দুওলারা কী লড়াই দিচ্ছেন তার বিরুদ্ধেঃ আকাশবাণী স্বরাজের পর থেকে আর উর্দুতে নিউজ বুলেটিন দেয় না, শুনছি শিগগিরই দেবে। তবে সেটা পণ্ডিতজির চাপে। আপনাদের আন্দোলনের ফলে নয়।

মনসুর ফেটে যাওয়ার উপক্রম। বললেন, আমরা পাকিস্তান নির্মাণ করেছি।

এই প্রথম শহর-ইয়ারের কণ্ঠে ঈষৎ ব্যঙ্গের পরশ লাগল। বললে, তাই নাকি? আমি তো শুনেছি বাঙলার মুসলমান যাদের অধিকাংশ এখন পূর্ব পাকিস্তানে বাস করে, এবং সংখ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে বেশি তাদেরই ক্রেডিট বেশি। তা উর্দু যদি এতই ইসলামি ভাষা হবে তবে পূর্ব পাকিস্তানিরা উর্দুকে তাদের অঞ্চলে রাষ্ট্রভাষা করছে না কেন? শুনেছি, তাদের মাতৃভাষা বাঙলার জন্য লড়তে গিয়ে কেউ কেউ প্রাণ দেওয়াতে শহিদরূপে আজও পরিচিত হচ্ছে। আর পশ্চিম পাকিস্তানেই-বা উর্দু কোথায়? সিন্ধিরা বলে সিন্ধি ভাষা, বেলুচরা বেলুচি, পাঠানরা পশতু রইল বাকি পাঞ্জাব। তারা তো বলে পাঞ্জাবি, শেখে উর্দু। কিন্তু ইতোমধ্যেই তো সেখানে আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছে, পাঞ্জাবি কথ্যভাষা, শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যম করার জন্য সেটাকে লিখিত রূপ দিয়ে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার ইজ্জত দেওয়া। এ জাতীয় সম্মান পাঞ্জাবি কথ্যভাষা তো আগেও পেয়েছে। গুরু নানকের গ্রন্থসাহেব তো পাঞ্জাবি কথ্যভাষায় রচিত। কিন্তু এসব বিবরণ থাক্‌– আমি পশ্চিম পাকিস্তান সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নই। কিন্তু এ সম্পর্কে আমার একটি শেষ নিবেদন আছে। আপনি বললেন, আপনারা, অর্থাৎ উর্দুভাষীরা পাকিস্তান নির্মাণ করেছেন। উত্তম প্রস্তাব। আজকের দিনের পাকিস্তানিরা যে কায়েদ-ই-আজম মরহুম মুহম্মদ আলি জিন্নাহ সাহেবকে তাদের জাতির পিতা বলে সর্বোচ্চ সম্মান দেয়, তার মাতৃভাষা কি উর্দু ছিল?

মনসুর চুপ করে রইলেন। তর্ক যে আরও চালাতে পারতেন না তা নয়। কারণ যুক্তির অভাবই যদি তর্কের সমাপ্তি ঘটাবার কারণ হত, তবে পৃথিবীর শতকরা নিরানব্বই ভাগ এই মুহূর্তেই মুখ বন্ধ করে গোরের নীরবতার আশ্রয় নিত।

ডাক্তার কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় মনসুর বললেন, বাঙলা হিন্দু ভাষা– তার প্রভাব বাঙালি মুসলমানকে হিন্দু-মনোবৃত্তির দাস করে দেয়।

দাস কথাটা বোধ হয় শহর-ইয়ারকে বলদের সামনে লাল পতাকা দেখানোর মতো হল। স্পষ্ট দেখলুম, তার মুখে সামান্যতম কাঠিন্য দেখা গেল। তার পরিমাণ এতই সামান্য যে শুধু আমিই সেটা লক্ষ করলুম। কারণ এতদিন ধরে তাঁর নয়নে-বদনে বহু ভাবের খেলা আমি দেখেছি। বেশিরভাগ সময় তাঁর মুখ শান্ত। দ্র পরিবারের বধূর মতো। কিন্তু সামান্যতম রসের সন্ধান পেলেই মুচকি হাসে কিংবা খলখলিয়ে। বিষণ্ণ, চিন্তিত, বিল আরও বহু ভাবের খেলা তার চোখেমুখে আমি দেখেছি, কিন্তু ওই ভদ্রবধূর শান্তিমাখা মুখে সবচেয়ে বেশি দেখেছি তার রহস্য-ভরা আঁখি। কঠিনতা কখনও দেখিনি।

বলল, বাঙলার শ্রেষ্ঠ ধর্মসঙ্গীত টেগোরের। সেগুলোতে হনুমানজি, রামচন্দ্রজি কেউ নেই। আছেন যিনি, তিনি সুফিদের অল-লক, অল-জমিল– টুথ অ্যান্ড বিউটি। আপনি যখন এদেশে বাঙালি হোস্টেলে বাঙালি-মুসলমানদের ভিতর তিন বছর বাস করে বিস্তর বাঙলা শুনেছেন, তখন আশা করতে পারি এসব টেগোর-সং-এর কিছু কিছু সে যুগে আপনার কানে পৌঁছেছিল এবং তার কিঞ্চিৎ রসগ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন– বাঙালি বন্ধুবান্ধবদের শুধিয়ে অন্তত মোটামুটি অর্থটা জেনে নিয়েছিলেন।

যেন গৌরীশঙ্করের চুড়ো থেকে গুরুগম্ভীর ঐশী বাণী নেমে এল :

না, বাঙলা শেখার কোনও জরুরত আমার ছিল না।

শহর-ইয়ার হঠাৎ কীরকম যেন বদলে গিয়ে একেবারে ভিন্ন কণ্ঠে বলল, সে তো ঠিকই করেছেন। এদেশে কত ইংরেজ বওলা দশ-বিশ বছর কাটিয়ে যায়, এক বর্ণ বাঙলা না শিখে। আপনারই-বা কী জরুরত।

বকসওলা কথাটা আমি স্বরাজলাভের পর আদৌ শুনিনি। ইংরেজ চাকুরে সিভিলিয়ান মবরা চা-বাগিচার অশিক্ষিত– এমনকি বর্বর বললেও অত্যুক্তি হয় না– সায়েবদের এই পিসূচক নাম দিয়েছিল চায়ের পেটি বা বক্স নিয়ে তাদের কারবার করতে হয় বলে। মনসুর সাহেব হয়তো কথাটা পূর্বে কখনও শোনেননি তাই অর্থটা ধরতে পারেননি। জিগ্যেস করলেন, বকসওলা কী?

শহর-ইয়ার যেন প্রশ্নটা শুনতেই পায়নি এরকম ভাব করে মিসিস মনসুরের দিকে কুঁকে দরদভরা কণ্ঠে কী যেন শুধাল।

তর্ক থেমে গেছে কিন্তু তবু মনসুর থামতে চান না। তিনি উর্দু সাহিত্যের ঐশ্বর্য ও প্রসাদগুণ সম্বন্ধে দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে চললেন। তার অধিকাংশই খাঁটি সত্য কথা, কিন্তু বলার ভঙ্গিতে ভঙ্গিতে কেমন যেন একটা কর্কশ কর্কশ ইঙ্গিত, তোমার বাঙলায় এরকম আছে? ওই গোছ। কিন্তু শহর-ইয়ার সেই যে মুখ বন্ধ করেছিল আর একবারের তরেও খুলল না। এই অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে ইরানিরা বলেন, তখন আলোচনার কার্পেট রোল করে তুলে নিয়ে খাড়া করে একপাশে রেখে দেওয়া হল। উপস্থিত তারও বাড়া কিছু যেন চোখের সামনে দেখতে পেলুম। যেই শহর-ইয়ার সামান্যতম আভাস পেল যে দ্রব্যগুণেই হোক আর যে কোনও কারণেই হোক, মনসুর আবার সেই কার্পেটটা গড়গড়িয়ে খুলতে চান, ধুরন্ধরী সঙ্গে সঙ্গে এক লম্ফে যেন টাইট হয়ে গিয়ে বসল সেই রোল করা কার্পেটটার উপর।

আল্লায় মালুম, মনসুর সাহেবের লেকচার কখন শেষ হবে। আমার প্রিয় বান্ধব ডাক্তার সাহেব আবার কারও কথা মাঝখানে কেটে দিয়ে আপন কথা বলতে একেবারেই অসমর্থ। ওদিকে আমি যেন আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় দিয়ে একটা দুর্গন্ধ পেলুম যে ডাক্তারের ইচ্ছে আমাদের সকলকে বাইরে কোনও মোগলাই রেস্তোরাঁতে খাওয়াতে চান এবং এখানে আসবার সময় সেটা বলতে ভুলে গেছেন। সর্বনাশ! তা হলেই হয়েছে! কী করি, কী করি! মনে পড়ল, স্কুলের পণ্ডিতমশাই আমাকে একদিন বলেছিলেন, সাহিত্যিক হতে হলে যে কটি গুণের প্রয়োজন, যেমন ভাষার ওপর দখল, কল্পনাশক্তি এবং আরও বহুবিধ কলাকৌশল তার মাত্র একটি তোর আছে- নির্জলা মিথ্যে বলার নির্লজ্জ চতুরতা। জয় গুরু, জয় গুরু! তোমার মহিমা অপার। তোমাকে স্মরণ করা মাত্রই অজ্ঞান-তিমির-অন্ধকার দূরীভূত হয়ে গেল : সম্মুখে দেখি দিব্য জ্যোতি, সত্য জ্যোতি।

যেই মনসুর সাহেব দিতে গেছেন গেলাসে আরেকটি চুমুক অমনি আমি সবাইকে না শুনিয়ে আবার শুনিয়েও শহর-ইয়ারকে বললুম, আমি তা হলে উঠি। আপনি বাবুর্চিকে বলে এসেছেন তো কীভাবে আমার পথ্যিটা তৈরি করবে? তার পর লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে মনসুর সাহেবকে বললুম, আপনার বন্ধু ডাক্তার সাহেবের আপন হাতের চিকিৎসার জন্যই আমার মফঃস্বল থেকে শহরে আসা। পাছে অপথ্য-কুপথ্য করি তাই আমাকে প্রায় তালাবন্ধ করে রেখেছেন আপন বাড়িতে, হেঁ হেঁ হেঁ। আপনার সঙ্গে আবার পরিচয় হওয়ায় বড় আনন্দ হল, হেঁ হেঁ। ডাক্তার গোবেচারা ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকাল। শহর-ইয়ার আমার কথা শেষ হওয়ার বহু পূর্বেই আমার মতলবটা ভালো করেই বুঝে নিয়েছে– আমি নিঃসন্দেহ, সে-ও এখান থেকে পালাবার পথ খুঁজছিল, কিন্তু বেচারী মেয়েছেলে হয়েও না পারে অশিক্ষিত পটুত্বের অভিনয় করতে, না পারে নির্জলা মিছে কথা কইতে। এবারে আমি একটা পথ করে দেওয়া মাত্রই সে চেয়ার ছেড়ে এমনভাবে ঘাড় নাড়াল যে তার থেকে এ-ও হয় ও-ও হয়। ডাক্তার বিশেষ মনঃক্ষুণ্ণ হলেন বলে মনে হল না– কারও কোনও ইচ্ছাতে বাধা দেওয়া তার ধাতেই নেই। এরকম মহামানব সংসারে বড়ই বিরল।

বিস্তর শেকহ্যান্ড, খুদা হাফিজ, ফি আমানিল্লাহ, বঁ ভওয়াইয়াজ বলার পর শহর-ইয়ার শুধু মনসুর সাহেবকে দুটি অনুরোধ জানাল, আসছেবার কলকাতায় এলে যেন তাদের ওখানে ওঠেন এবং আজ রাত্রের মতো যেন ডাক্তারকে একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেন। মাদাম মনসুরকে শহর-ইয়ার এ অনুরোধ আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন।

ঘর থেকে বেরিয়ে করিডরে পৌঁছনো মাত্রই শহর-ইয়ার গান ধরল, আর বেশ উচ্চকণ্ঠেই, অবশ্য এসময় কেউ যদি আদপেই কাছে-পিঠে থাকে তবে সে সে-ব্লকের বেয়ারা–

হাটের ধুলা সয় না যে আর, কাতর করে প্রাণ।
তোমার সুরসুরধুনীর ধারায় করাও আমায় স্নান।

.

০৮.

ড্রাইভার শুধালে, কোথায় যাব, আম্মা?

শহর-ইয়ার ক্ষণমাত্র চিন্তা না করে বললে, বেহেশত কিংবা দোজখৃ– যেটা এ জায়গা থেকে বেশি দূরে।

বেচারী ড্রাইভার বুঝতে পারেনি। আমি বললুম, উপস্থিত গঙ্গা-পারে চল। পরে দেখা যাবে।

একটা জায়গায় ভিড় সামান্য কম। আমি বললুম, শহর-ইয়ার, এখানে ওই গাছতলায় একটু বসবেন?

বললে, নিশ্চয়ই বসব, একটুখানি তাজা হাওয়া বুকের ভিতর ভরে নিই। গ্রেট ইস্টার্ন তবু পদে আছে, অন্য হোটেলগুলোতে যেন আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। গঙ্গার হাওয়া গঙ্গাজলের চেয়ে ঢের ভালো। তাই হিন্দুরা গঙ্গাস্নানের পরিবর্তে এখন গঙ্গার হাওয়া খেয়ে পাপমুক্ত হয়। এ হাওয়ার বহু গুণ। সঙ্গে সঙ্গে প্রথম আবৃত্তি করল,

নমো নমো সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গীর তীর, স্নিগ্ধসমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।

 তার পর গান ধরল, হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান–

তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান—

হঠাৎ গান বন্ধ করে বলল, মিস্টার মনসুর কিন্তু লোক খারাপ নয়– কী বলেন আপনি? আসলে কী জানেন, ওঁরা থাকেন এক ভুবনে, আমাদের বাস সম্পূর্ণ অন্য ভুবনে। বিপদ শুধু এই ওঁরা আমাদের কনভার্ট করতে চান।

আমি বললুম, কনভার্ট করাটা কি দোষের? ওইটেই তো মুসলমানদের স্ট্রং পয়েন্ট। কাইরোর অজহর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বিষয় সবাইকে পড়তে হয়। কী করে অমুসলমানকে মুসলমান করা যায়! মনসুর মিশনারির দোষ বিশ্বসুদ্ধ লোককে উর্দুতে কনভার্ট করার চেষ্টাতে গলদ নয়– গলদ তার পদ্ধতিতে, মেথডে, মডুস্ অপেরাভিতে। দম্ভ নিয়ে প্রচার আরম্ভ করলে যাকে কনভার্ট করতে চাও, সে সঙ্গে সঙ্গে ভাববে, আমি যত ভালো উর্দুই শিখি না কেন, এর সঙ্গে তো কখনও কাঁধ মেলাতে পারব না, কারণ উর্দু এঁর মাতৃভাষা। অতএব বাকি জীবন ধরে ওঁর মুখের দম্ভোগীরণ আমাকে সয়েই যেতে হবে। কী দরকার গায়ে পড়ে করুণার পাত্র হওয়ার! তার চেয়ে থাকি আমি আমার বাঙলা নিয়ে। দু পাঁচটা ভুল সে ভাষাতে করলে কীই-বা এমন দুশ্চিন্তা পাড়া-প্রতিবেশীরাও করে। আমরা সবাই বরাবর। ওই উর্দুর গোসাঁইও নিশ্চয় দু পাঁচটা ভুল করেন তাঁর চোস্ত উর্দুতে মানুষ তো আর আল্লা নয় কিন্তু সে ভুল তো আমার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখাব কী করে? কিন্তু এসব নিয়ে এখন আর চিন্তা করেন কেন? এ তো অতি সাধারণ, স্থূল দৈনন্দিন ঘটনা। দেখলেন না, আমি আলোচনায় মোটেই যোগ দিলুম না।

সে তো স্পষ্ট দেখলুম। এবারে বলুন, কাইরোতে ইসলাম-প্রচার-পদ্ধতি সুচারুরূপে শেখার পর কজন অমুসলমানকে মুসলমান করেছেন?

আমি বললুম, প্রথম তো নিজেকেই সামলাই। আমার মতো গুনাহগার পাপী মুসলমান এ সংসারে খুব বেশি নেই। আগে তো একটা মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ডে পৌঁছই, তবে না প্রচারকার্য আরম্ভ করার হক জন্মাবে।

শহর-ইয়ারের চেহারা দেখে মনে হল আমি যুক্তি দেখিয়ে তাকে আমার সঙ্গে একমত করাতে পারিনি। সো ভি আচ্ছা। শেষবিচারের দিনে তিনি যদি সাক্ষ্য দেন যে আমি খুব খারাপ মুসলমান ছিলুম না– অন্তত আমি নিজের সম্বন্ধে যতটা ভেবেছিলুম তার চেয়ে কম– সে-ও একটা ভরসার কথা।

বললুম, একটু সরে এসে এই গাছটার তলায় ওই শিকড় দুটোর মাঝখানে বসুন। এখানে বসলে তদ্দণ্ডেই মেয়ে মাত্রেরই একটি বিশেষ শক্তিলাভ হয়। নির্ভয়ে নির্বিচারে মিথ্যে কথা বলতে যখন তার আর কোনও বাধাবন্ধ থাকে না। পরের দিন বিকেলে আর একটি ছেলের সঙ্গে তার লীলাখেলার এপয়েন্টমেন্ট– আজ সন্ধ্যায় এখানে বসলে সে অকুণ্ঠ ভাষায় নির্ঘ বিবেক নিয়ে গদগদ হয়ে অন্যজনকে বলতে পারে, আই লাফ ইউ, আই লাফ ইউ।

লাফ কেন, লাভই তো উচ্চারণ। ভাষাটা তো আর জর্মন নয় যে ভি এফ হবে?

এটা সর্বাধুনিক, chic উচ্চারণ।

না। আমার মনে হয় তা নয়। মেয়েটা আই লা এট ইউ, আই লাফ এট ইউ। এট-টা উহ্য রেখেছিল, ভদ্রতার খাতিরে। সঙ্গে সঙ্গে শহর-ইয়ার হেসে ওঠাতে সাদা দাঁতগুলো ঝিলমিল করে উঠল কিন্তু মুখের রঙটি অন্দরমহলের বংশানুক্রমিক ধবলের চূড়ান্তে পৌঁছে গেছে বলে কন্ট্রাস্টটার খোলতাই জুৎসই হল না– মুখের রঙ কালো হলে যেরকম হত।

শহর-ইয়ার মুচকি হেসে হেসে বললে, আচ্ছা, বলুন তো, একটা মেয়ের যদি দু জন প্রেমিক থাকে, এবং সে যদি দু জনকেই পরিতৃপ্ত করতে পারে, তাতে সমাজেরই-বা কী, আর আপনি শিক্ষিত লোক, আপনারই-বা কী মরেল অবজেকশন থাকতে পারে?

আমি বললুম, সমাজের আপত্তি বা আমার মরেল অবজেক্শন এগুলো পরের কথা। আসলে কি জানেন, জিনিসটা ঠিক স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে না। মেয়েটাকে সর্বক্ষণ লুকোচুরি খেলতে হয়, সর্বক্ষণ ভয়, দু জনার একজন কখন না অন্যজনের গন্ধ পেয়ে যায়– বিবাহিতা রমণী উপপতি রাখলে তাকে যেরকম অষ্টপ্রহর আশঙ্কায় আশঙ্কায় কাটাতে হয়। একে তো মেয়েটার স্বাভাবিক সুস্থ জীবন বরবাদ– তদুপরি ব্যাপারটা খুব বেশিদিন গোপন থাকে না, জানাজানি হয়ে যায়। জানাজানি হয়ে যাওয়ার পূর্বেই যদি মেয়েটা এই দোটানার স্ট্রেন সইতে না পেরে একজনকে বিদায় দেয় তখন তার এবং ছেলেটার বন্ধুমহলে সে জি রূপে মশহুর হয়ে যায়, কারণ, তারা তো আর জানে না যে মেয়েটা দুটো ভিন্ন লোকের সঙ্গে একই সময়ে লীলাখেলা চালাচ্ছিল এবং সে স্ট্রেন সইতে না পেরে একজনকে বিদেয় দিয়েছে। আর আসল তত্ত্ব জানাজানি হয়ে গেলে তো আরও চিত্তির। তখন রাস্তা দিয়ে যাবার সময় পাড়ার নটবররা তার গায়ে পড়ে প্রেম নিবেদন করে। ভাবখানা এই, দু জন যখন ছিলই তখন তিনজনেই-বা কী দোষ? আর সর্বশেষে বলি, মেয়েটার পক্ষে ছেলেটাকে বিদায় দেওয়ার জিলটিং কর্মটি কি অতই সহজ! চিন্তা করুন, ছেলেটার মোহ যদি তখনও কেটে না গিয়ে থাকে তবে সে চোখের জল ফেলবে, প্রাচীন দিনের প্রণয় স্মরণ করিয়ে দিয়ে তার শপথ কাড়বে! না জিলটিং কর্মটি শুধু জিলুটেড হতভাগার পক্ষেই অপমানজনক তাই নয়, যে জিলটু করে তার পক্ষেও পীড়াদায়ক!

শহু-ইয়ার বললে, এ যুগের অবিবাহিতা তরুণী যুবতীদের চেয়ে আমার বয়স খুব বেশি নয়, তবু এদের সঙ্গে আমার যোগসূত্র সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। তাই জানতে ইচ্ছে করে এদেশে আমাদের অল্প বয়সে শেখা একনিষ্ঠ প্রেমের আদর্শ কি ধীরে ধীরে কিংবা দ্রুতবেগে জিটিং নামক নয়া মালের জন্য জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে, কিংবা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে?

আমার চিত্তে কৌতুকরসের সঞ্চার হল। বললুম, আমার বয়সটি কি নিতান্তই প্রেমে পড়-পড় তরুণদের বয়স, যে তাদের সঙ্গে আপনার চেয়ে আমার দহরম-মহরম শ-দুই লিটার বেশি! এবং আমি বাস করি মফঃস্বলে!

কী জ্বালা! আপনার যে গণ্ডায় গণ্ডায় চ্যাংড়া চেলা রয়েছে। আর আমার বিশ্বাস পুরুষমানুষ নিজের থেকে নিতান্ত না চাইলে সহজে বুড়ো হয় না। সে কথা থাক, আমার প্রশ্নটার উত্তর দিন।

দেখুন এ প্রশ্নের উত্তর ঠিক ঠিক কেউ দিতে পারে না। সবাই শুধু আপন আপন একটা খসড়া গোছ, একচোখা ধারণা প্রকাশ করতে পারে। আমার ধারণাটা প্রকাশ করার পূর্বে একটি অতি হ্রস্ব ভূমিকা দিই। এক অতিশয় সহৃদয় বাঙালি সমস্ত জীবন জেলের বড়কর্তারূপে কাজ করে পেনশন নেওয়ার পর কী একটা ঘটনা উপলক্ষে বলেন, তার জেলে একবার একজন গুণী পণ্ডিত আসেন যার অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার বিষয় ছিল মনস্তত্ত্ব এবং বিশেষ করে অপরাধীদের মনস্তত্ত্ব। দেশ-বিদেশের জেলে তিনি তাঁর অধ্যয়ন-রিসার্চ করেন সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের নিয়ে এবং তাঁর একটি অতিশয় বিরল গুণ ছিল এই যে, যত হাড়-পাকা, মুখ-চাপা কয়েদিই হোক না কেন, তাঁর বাক্য, তাঁর আচরণ, এককথায় তার ব্যক্তিত্বের সামনে সে তার হৃদয়ের গোপনতম কথা প্রকাশ না করে থাকতে পারত না। মাসখানেক কাজ করার পর তিনি আমাদের এই বাঙালি জেলারটিকে বলেন, ভারতবর্ষের একাধিক জেলে রিসার্চ করার পরও তিনি এযাবৎ একটিমাত্র জাত-ক্রিমিনাল, অর্থাৎ যে নিরুদ্বেগে, বিবেক নামক প্রতিবন্ধকের নুইসেন্স সম্বন্ধে অষ্টপ্রহর সম্পূর্ণ অচেতন থেকে ক্রাইমের পর ক্রাইম করে যায়, জাস্ট ফর ইট ওন সেক– এরকম প্রাণী এদেশে পাননি, তার মানে এদেশে জাত-ক্রিমিনাল নেই। আমারও মনে হয় এদেশে জাত-জিট নেই। সুদ্ধমাত্র ফুলে ফুলে মধু পান করার জন্য একটার পর একটা পুরুষ জিটু করে করে যৌবনটা কাটাচ্ছে এ রকম রমণী এদেশে বোধ হয় বিরল। এই যে আপনি হিন্দু নারীর পতিব্রতা হওয়ার আদর্শের কথা একাধিকবার তুলেছেন, সেই সংস্কারটা এদেশের তরুণীর ভিতর আবির্ভূত হয়– যেই সে প্রথম প্রেমে পড়ে। আর আপনার যে উদাহরণ;- একটি তরুণী দুটো প্রেমিকের সঙ্গে একই সময়ে প্রেম চালিয়ে যাচ্ছে, সেটাও এদেশে হয় অন্য কারণে। আমার মনে হয়, একটু অনুসন্ধান করলেই ধরা পড়বে, বেচারী মনস্থির করতে পারছে না, দুটোর কোনটাকে বিয়ে করলে সে আখেরে সুখী হবে, এবং তাই কোনওটাকেই হাতছাড়া করতে পারছে না।

আপনার প্রশ্নের উত্তর খানিকটে তো দিলুম, কিন্তু আমার প্রশ্ন জিল্টিং নামক অতি প্রাচীন অথচ নিত্যনবীন কর্মটির প্রতি আপনার এ কৌতূহল কেন? আমি নির্ভয়ে, নিঃসন্দেহে দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করতে পারি আপনি কখনই জিল্টিং রহস্যের মর্মস্থলে পৌঁছতে পারবেন না। আপনি হিন্দু হলে বলতুম, এ জন্মে না, জন্ম-জন্মান্তরেও না।

কেন, আমি কি এতই ইডিয়ট?

আমি বললুম, তওবা তওবা!! আপনি ইডিয়ট হতে যাবেন কেন? আপনি অতিশয় বুদ্ধিমতী একথা আমি কেন, আমার গুরুর গুরুও বলবেন। কিন্তু, কল্যাণী, এ তো বুদ্ধি দিয়ে বোঝবার বস্তু নয়। এটা সম্পূর্ণ অনুভূতির ব্যাপার, এবং মনে রাখবেন, আপনি আমাকে অতি উত্তমরূপে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝিয়েছেন আপনার অনুভূতি, আপনার স্পর্শকাতরতা এর সব-কিছু গড়ে উঠেছে, আকার নিয়েছে, আর্দ্রতা পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানের ভিতর দিয়ে। এবং সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলেছেন, আপনি আপনার হৃদয়ের খাদ্য আহরণ করেন ওই একমাত্র রবীন্দ্রসংগীত থেকে।

কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতে জিল্টিং নিয়ে গান কই? জিন্টেড় হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা কি কস্মিনকালেও তার হয়েছিল? শুধু প্রভাত মুখো কেন, ঠাকুরবাড়ির প্রাচীনতম বৃদ্ধবৃদ্ধা এবং সে বাড়ির সঙ্গে বাল্যকাল থেকে সংশ্লিষ্ট জন কেউই তো কখনও সামান্যতম ইঙ্গিত দেননি যে রবীন্দ্রনাথ কখনও কাউকে ভালোবেসে জিড়ে হয়েছেন। তার প্রেমের গানের মূল সুর মূল বক্তব্য কী? আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলুম, তুমিও আমাকে বেসেছিলে। তার পর তুমি হঠাৎ অকালে চলে গেলে। তাই

এখন আমার বেলা নাহি আর
বহিব একাকী বিরহের ভার?

কিংবা

তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে
কত আর সেতু বাঁধি।

এটা অবশ্যই তার দুর্ভাগ্য যে, তাঁর প্রিয়া অকালে অন্যলোকে চলে গেলেন। এই দুর্ভাগ্য নিয়েই তিনি রূপ দিয়েছেন শত শত গানে– দু দশ বছর ধরে নয়, সমস্ত জীবন ধরে– কিন্তু মোতিফ এক্ : তুমি চলে গেলে আমি আর কতকাল ধরে তোমার বিরহ-ব্যথা সইব?

শহর-ইয়ার বললে, মাফ করবেন– হঠাৎ আমার মনে একটা প্রশ্ন এল। আমার অনুভূতি আমার ইমোশান যেমন রবীন্দ্রনাথের গান গড়ে দিয়েছে, আপনার ক্ষেত্রেও কি তাই নয়? আপনি তো তাঁকে কাছের থেকে দেখেছেন, তাঁর বহু বহু গান আপনি এবং আপনার সতীর্থরাই সর্বপ্রথম শুনেছেন।

আমি বললুম, গুরু যেন অপরাধ না নেন! আমার অনুভূতি-জগৎ নির্মিত হয়েছে অন্য বস্তু দিয়ে। গুরুর কাছ থেকে সিকি পরিমাণও নিয়েছি কি না সন্দেহ।

শহর-ইয়ার বিস্মিত হয়ে শুধাল, তবে কোথা থেকে?

বৈষ্ণব পদাবলি থেকে।

আপনি নিশ্চয়ই জানেন বাঙলা দেশের সর্বত্রই যে মোতিফ নিয়ে সবচেয়ে বেশি গান গাওয়া হয় সেটি রাধাকৃষ্ণের। এবং আরও পরিষ্কার হয়, আরও সংকীর্ণ পরিসরে সেটা জাজ্বল্যমান হয় যদি বলি আসলে মোতিফটা শ্রীরাধার বিরহ। সেই বিরহের গান গাওয়া হয়, নিত্য নব রচা হয় বাংলা দেশের নানা অঞ্চলে নানা সুরে। কথার দিকে শ্রীরাধার বিরহ-যন্ত্রণার সর্বোত্তম অতুলনীয় প্রকাশ এই আমাদের বীরভূমের চণ্ডীদাসে। এর পরে আসেন বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস ইত্যাদি। মুসলমান কবিও বিস্তর আছেন তবে একমাত্র সৈয়দ মর্তুজা ছাড়া আর কেউই খুব উচ্চস্তরে উঠতে পারেননি– যদিও তাদের সহৃদয়তা, শ্রীরাধার প্রতি তাদের অনুরাগ ও সহানুভূতি হিন্দু কবিদের চেয়ে কণামাত্র কম নয়।

আর সুরের দিক দিয়ে শ্রীরাধার বিহসঙ্গীতের সর্বোত্তম অতুলনীয় বিকাশ ফুটে উঠেছে কীর্তনীয়াদের কণ্ঠে, সুরে।

আমি ঐতিহাসিক নই, তাই বলতে পারব না, কত শত বৎসর ধরে কত হাজার বৈষ্ণব কবি তাদের আপন আপন বিরহবেদনার নিদারুণ অভিজ্ঞতা শ্রীরাধার কণ্ঠে শ্রদ্ধাঞ্জলি স্বরূপ রেখে গেছেন। অর্থাৎ তারা নবীন কাব্য রচনা করে, নতুন নতুন নায়ক-নায়িকা নির্মাণ করে, যেমন মনে করুন, নল-দময়ন্তী কিংবা লায়লি-মজনুন, তাঁদের কণ্ঠ দিয়ে আপন আপন বিরহযন্ত্রণার অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেননি। তাবৎ বৈষ্ণব কবিদের বিরহবেদনা শ্রীরাধার বিরহবেদনা, আর যুগ যুগ ধরে শ্রীরাধার কণ্ঠে সঞ্চিত তাবৎ বিরহগাথা সর্ব বৈষ্ণব কবির গৌরব-সম্পদ!

নিজেকে নিশ্চিহ্ন করে, এমনকি আপন প্রিয়াকে রঙ্গমঞ্চ থেকে নির্বাসিত করে দু জনারই নিষ্ঠুরতম বিরহজ্বালার অভিজ্ঞতা ব্রজসুন্দরীর কণ্ঠে সমর্পণ– এই যে প্রক্রিয়াটি এর সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ পরিপূর্ণ সচেতন ছিলেন। আপনার মনে আছে, বোলপুরে পারুল বনে যেতে যেতে এক সকালে আমি একটি কবিতা আবৃত্তি করে আপনাকে শোনাই– কোনও টীকাটিপ্পনী না করে?–

সত্য করে কহ মোরে হে বৈষ্ণব কবি,
কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি,
কোথা তুমি শিখেছিলে এই-প্রেমগান
বিরহ-তাপিত। হেরি কাহার নয়ান
রাধিকার অশ্রু-আঁখি পড়েছিল মনে
বিরহ-তাপিত?

 অবশ্য আমারও ইচ্ছে করে গুরুকে সবিনয় জিগ্যেস করতে, তার বেলা, যার, বিরহ-তাপিত অশ্রু তাঁকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল, যার মুখ যার আঁখি হতে

–এত প্রেমকথা
রাধিকার চিত্তদীর্ণ তীব্র ব্যাকুলতা
চুরি—-

করেছিলেন তিনিও, তাঁর প্রতি তিনি তাঁর কাব্যে সুবিচার করেছেন তো?

ঠিক ওই একই প্রক্রিয়ায়ই ইয়োরোপের বহু বহু কবি ত্ৰিস্তান আর ইজলদের প্রেমগাথায় আপন আপন নিজস্ব প্রেম, বিরহ, মিলন– অবশ্য মিলন অংশ সর্ব কাব্যেই অতি ক্ষুদ্র অংশ পায়– অকাতরে ঢেলে দিয়েছেন। কিন্তু বাঙলা দেশের বিরাট বৈষ্ণবগাথার তুলনায় তিস্তানগাথা সূচ্যগ্র পরিমাণ।

শহর-ইয়ার এতক্ষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। এবারে শুধল, কই, আমি তো ত্রিস্তান ইজলদে কাহিনীর নাম পর্যন্ত শুনিনি।

বড় বেদনার গাথা। আর ইয়োরোপীয় এজাতীয় যত গাথা আছে তাদের মধ্যে আমি এটাকেই সর্বোচ্চ আসন দিই। আপনি যে শোনেননি সেটাও খুব বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে ইয়োরোপের লোক ক্রমেই এসব গাথার প্রতি উদাসীন হয়ে যাচ্ছে। তাই দেখে ফ্রেঞ্চ একাডেমি– এবং জানেন তো পৃথিবীর আর কোনও একাডেমি এর একশো যোজন কাছে আসতে পারে না– প্রায় চল্লিশ বৎসর পূর্বে তাদেরই এক সদস্যের স্কন্ধে গুরুভারটি দেন তিনি যেন লিস্তান সম্বন্ধে যে কটি ব্যালাড পাওয়া যায় তারই ওপর নির্ভর করে কালোপযোগী একখানা নবীন ত্রিস্তান রচনা করেন। সে বিস্তান আমাকে মুগ্ধ করে, এবং তার বাঙলা অনুবাদ আমি আরম্ভ করি কিন্তু শেষ করতে পারিনি।

মূল কথায় ফিরে আসি। এবং যদি অনুমতি দেন, তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়েই আরম্ভ করি। আপনার খুব খারাপ লাগবে না, কারণ আপনি-আমি দু জনাই মুসলমান; ওদিকে রাধাকৃষ্ণের কাব্যরূপ রসস্বরূপ বাদ দিলে তারা হিন্দুদের বিশেষ করে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের উপাস্য দেব-দেবী এবং শ্রীকৃষ্ণ শুধু বৃন্দাবনের রসরাজ নন, তিনি গীতিকাররূপে বিষ্ণুর অবতার। আমি মানুষ হয়েছি আচারনিষ্ঠ মুসলমান পরিবারে। অথচ যে গানটি আমার আট বৎসর বয়সে মনে অদ্ভুত এক নবীন অনুভূতির সঞ্চার করেছিল সেটি

 –দেখা হইল না রে শ্যাম,
আমার এই নতুন বয়সের কালে—

 এ বিষয় নিয়ে ব্যক্তিগত অংশটা যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি সারি, যদিও আমার অভিজ্ঞতাটার কিঞ্চিৎ– অতি সামান্য– মূল্যও আছে।

শহর-ইয়ার দৃঢ় অথচ সবিনয় মধুর কন্ঠে বললেন, আপনি দয়া করে কোনও বস্তু বাদ দেবেন না। কীর্তন গান রেকর্ডে, বেতার থেকে আমি শুনেছি কিন্তু ওর গভীরে আমি কখনও প্রবেশ করিনি।

আমি বললুম, তার কারণও আমি জানি। জানতে চাইলে পরে বুঝিয়ে বলব।

হ্যাঁ। আমি পানির দেশের লোক, চতুর্দিকে জল আর জল। সঙ্গে সঙ্গে ভোরে, সন্ধ্যায়, রাত্রি দ্বিপ্রহরের অনেক পরেও ভাটিয়ালি গীত। নিশ্চয়ই প্রথম শুনেছি মায়ের কোলে শুয়ে শুয়ে। সামান্যতম বোধশক্তি হওয়ার পর থেকেই শুনেছি কান পেতে এবং অতি শীঘ্রই সেটা আমার রক্তের সঙ্গে মিশে যায়, যেরকম আমার দেশের দানাপানি আমার রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। কিন্তু ওই দেখা হইল না রে শ্যাম-এর আগেকার কোনও গানই আমার মনে নেই।

আমাদের পরিবার আচারনিষ্ঠ, তার ঐতিহ্যে কট্টর প্যুরিটান। গান-বাজনা আমাদের পরিবারে বরাহমাংসবৎ ঘৃণ্য। কিন্তু সে কোন নিয়তি আমাকে ওই গানের দিকে আকৃষ্ট করল জানিনে। আট বছর বয়সে নতুন বয়সের কালে দেখা না হওয়ার ট্র্যাজেডি হৃদয়ঙ্গম করার কথা নয়। তবে আকর্ষণ করল কী? জানিনে, সত্যি জানিনে।

তার পর বহু গান শুনতে শুনতে পরিচিত হলুম রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে। আমাদের দু জনারই প্রিয় গান কেটেছে একেলা বিরহের বেলা-র নূতন ভুবন নূতন দ্যুলোকে যেন অকস্মাৎ আমার মতো দীন অকিঞ্চনজন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত প্রবেশাধিকার পেল। আপনারই মতো যখন আমার হৃদয়ানুভূতি রবীন্দ্রসঙ্গীতের রসগন্ধবৈভবে নির্মিত হচ্ছে তখন হঠাৎ পরিচয় হল চণ্ডীদাসের সঙ্গে। তার তাবৎ গানের সংকলন ঘণ্টা তিনেকের ভিতর পড়ে শেষ করা যায়। আমার লেগেছিল পূর্ণ একটি বৎসর। ইতোমধ্যে জানতে পারলুম চণ্ডীদাসের জন্মস্থল নানুর আমাদের বোলপুর থেকে মাত্র মাইল আষ্টেক দূরে। এক বন্ধুকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে গেলুম সেখানে পয়দল। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, জমিদার অনাদিবাবুর ছোটভাই শোনালেন কীর্তন গান। তিনি আমাকে ফরমাইশ করতে বললে আমি চণ্ডীদাস থেকে বেছে বেছে আমার আদরের গানগুলো পেশ করলুম। মাত্র কয়েক বছর হল শুনলুম, তিনি গত হয়েছেন, তার সদ্গতি হোক!

তার পর বহুবার শুনেছি সন্ধ্যা আটটা-দশটা থেকে ভোর অবধি কীর্তন গান। তার বর্ণনা আপনাকে আরেকদিন দেব। এদেশ থেকে বহু উত্তম উত্তম প্রথা প্রতিদিন লোপ পাচ্ছে; আমার গভীরতম শোক, দুর্নিবার হাহাকার– যার কোনও সান্ত্বনা নেই যে সমস্ত রাত ধরে কীর্তন গান গাওয়ার প্রথা প্রায় সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে। আমার মতামতের কী মূল্য? তবু যাবার পূর্বে নিবেদন করে যাই, ওইটেই ছিল বাঙলার সর্বাপেক্ষা মূল্যবান ঐতিহ্যগত সম্পদ- এর লক্ষ যোজন কাছে আর কোনও সম্পদ কোনও বৈভব আসতে পারে না।

বিবেকানন্দ কুমড়ো গড়াগড়ি কথাটা একাধিকবার ব্যবহার করেছেন– কারণ ছবিটা যেন চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে ওঠে।

কীর্তনের আসরে ছেলে-বুড়ো রাধার বিরহবেদনা শুনে কুমড়ো গড়াগড়ি দেয়। আমি দিইনি কিন্তু দুই চোখ বেয়ে অবিরল অশ্রুধারা বয়ে গেছে।

গুরু ক্ষমা করবেন, আপনিও অপরাধ নেবেন না, শহর-ইয়ার, কারণ আপনার অনুভূতি-ভুবন গড়ে তুলেছে আমার গুরুর শতাধিক গান, কিন্তু যদি বলি, রবীন্দ্রসঙ্গীতের সর্বোত্তম সম্মেলনেও আমি কাউকে কাঁদতে দেখিনি, কমড়ো গড়াগড়ির কথা বাদ দাও।

ব্যস্! আমি অন্য আর কোনও তুলনা করব না, নিতান্ত প্রয়োজন না হলে। ইতোমধ্যে বলে রাখি, রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশ্ববৈভবে অতুলনীয়। যে জর্মন লিডার ইয়োরোপে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত, রবীন্দ্রসঙ্গীত তার চেয়ে অনেক বেশি সূক্ষ্ম, তার বৈচিত্র্য এবং বহুমুখী বিকাশ কাব্যলোকে বল্লোক ছাড়িয়ে চলে গেছে বহু ঊর্ধ্বে।

কিন্তু প্রশ্ন, কীর্তন শুনে বালবৃদ্ধ (আমি যখন প্রথম শুনে দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্নার শব্দ চাপতে চেয়েছিলুম তখন আমার বয়স ষোল) কুমড়ো গড়াগড়ি দেয় কেন? আমি অবশ্যই এখানে আড়াইখানা কীর্তনের রেকর্ড বা বেতারে আধঘণ্টা কীর্তন প্রোগ্রাম শোনার কথা ভাবছিনে– দ্বিতীয়টা তো বহুবিধ যন্ত্রের খচখচানি এবং অংশত সেই কারণে কীর্তনীয়ার অবোধ্য শব্দোচ্চারণ সমস্ত ব্যাপারটাকে সত্যকার কীর্তনের এক হাস্যস্পদ ব্যঙ্গরূপে আধঘণ্টা ধরে মুখ ভ্যাংচায়। আজকের দিনে তাই শতগুণে শ্রেয় নিভৃতে নির্জনে চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাসাদি সশ্রদ্ধ বারবার পঠন–প্রহরের পর প্রহরব্যাপী। সে সময়ে গানগুলো যে সুরবর্জিত হয়ে দীনদরিদ্ররূপে হৃদয়ে প্রবেশ করছে। সেটা আমার দুর্দৈব কিন্তু তবু সেটাকেও নমস্কার– সে-ও লক্ষগুণে শ্রেয়, প্রাগুক্ত ওই অর্ধঘণ্টাব্যাপী নির্মম লাঞ্ছনার চেয়ে। সাহস নেই কলকাতা আকাশবাণীর সূর্যাস্ত থেকে রাত্রি দ্বিপ্রহর অবধি জনতিনেক কীর্তনীয়া– মূল গায়েন উত্তম হওয়া চাই- এনে একটানা, অবিশ্রান্ত সুদ্ধমাত্র কীর্তন শোনাবারঃ

বিরক্ত হয়ো না, শহর-ইয়ার, এ নিয়ে আমার ক্ষোভ কোনও সান্ত্বনা মানে না, তাই তোমাকে বললুম।

আরেকটা কথা। জানো বোধ হয়, পাঁচমেশালি গানের মজলিসে কারও যদি কীর্তন গাইবার প্রোগ্রাম থাকে বেশিক্ষণ না, ধরো আধঘণ্টাটাক–তবে সেটা আসে পুরো প্রোগ্রামের একবারে সর্বশেষে। কেন জানো? এই উটকো কীর্তনটাও যদি মোটামুটি রসের পর্যায়ে উঠে যায় তবে তার পর আর কেউ অন্য কোনও গান জমাতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথও কীর্তন সুরের ম্যাজিক জানতেন– কীর্তনের কথার তো কথাই নেই- তাই তিনি এ যুগে যে গান সর্বপ্রথম রেকর্ডে দিলেন সেটি কীর্তন সুরে।

এ সবই বাহ্য। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, কীর্তনে আছে কী যে শ্রোতা কুমড়ো গড়াগড়ি দেবে?

আছে অবহেলিত, অপমানিত, পদদলিত প্রেম। শ্রীরাধার মুখ দিয়ে সহস্র সহস্র কবি শত শত বৎসর ধরে যা বলিয়েছেন তার সারাংশ দেওয়া কি সহজ, না আমার বাদবাকি জীবনটাতে কুলোবে!

রাধা বেচারী বিবাহিতা কন্যা। ওদিকে কৃষ্ণ অতি শিবয়েস থেকেই করেছেন একাধিক অলৌকিক কর্ম–মিরাকল– বৃন্দাবনের সর্বত্র তার যশ প্রচারিত হয়ে গিয়েছে। বৃন্দাবনে সুন্দরী কুমারী গোপিনীরও অভাব নেই। সেই বালক কৃষ্ণকে ভালোবাসে সর্ব গোপিনী, তাদের মাতা, পিতামহী, বৃন্দাবনের সর্ব নরনারী। যে কোনও কুমারী কৃষ্ণের অনুরাগ পেলে জীবন ধন্য মনে করবে কিন্তু তিনি স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে মুগ্ধ করলেন, আকর্ষণ করলেন, সম্মোহিত করলেন, আত্মহারা হিতাহিত জ্ঞানশূন্যা করলেন বিবাহিতা শ্রীরাধাকে। একদিকে তার আনন্দ-গরবের অন্ত নেই, অন্যদিকে তার শাশুড়ি-ননদী করে তুলল তার জীবন বিষময়। অলঙ্ঘ্য বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে পাগলিনী শ্রীরাধা ছুটে আসতেন কৃষ্ণের বংশীধ্বনি শোনামাত্রই। শত দুঃখ শত যন্ত্রণার মাঝখানেও শ্রীরাধা আনন্দে আত্মহারা আর হবেই-বা না কেন? শ্রীকৃষ্ণের মতো প্রেমিক এই ভারতবর্ষে জন্মেছে কটি!

তার পর একদিন শ্রীকৃষ্ণ সেই সর্বত্যাগিনী রাধার প্রেম অকাতরে অবহেলা করে– আমি বলি অপমানিত পদদলিত করে চলে গেলেন মথুরা।

শহর-ইয়ার, তুমি মথুরা-বৃন্দাবন দেখেছ?

 মোটরে দিল্লি থেকে আগ্রা যাওয়ার সময় দেখেছি। ও দুটো তো খুব কাছাকাছি। দুটোর শেষপ্রান্ত তো প্রায় মিলে গেছে।

ঠিক বলেছ। সেই মথুরা থেকে তিনি একদিনের তরে, এক মিনিটের তরে বৃন্দাবনে আসেননি শ্রীরাধাকে দেখতে। উল্টো বৃন্দাবনের ওই অতি পাশের মথুরায়, বলতে গেলে শ্রীরাধার কানের পাশে তিনি ঢাকঢোল বাজিয়ে করতে লাগলেন একটার পর একটা বিয়ে– রুক্মিণী, সত্যভামা, আরও কে কে আমি ভুলে গিয়েছি, মনে রাখবার কোনও সদিচ্ছাও আমার কোনওকালে হয়নি।

বুঝলে শহর-ইয়ার, একেই বলে টায়-টায় জিল্টে লাভ। তামাম বিশ্বসাহিত্য তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও এই হতভাগিনী জিল্টে শ্রীরাধার শত যোজন কাছে আসতে পারে এমন রিক্তা হৃতসর্বস্ব তুমি পাবে না।

তাই আকারে, গাম্ভীর্যে, মহিমায় হিমালয়ের মতো বিরাট কলেবর বৈষ্ণব সাহিত্যের মূল সুর- লাইট-মোতিফ- জিল্টে লাভ, পদদলিত প্রেম।

সে সাহিত্যে দুঃখিনী শ্রীরাধার হৃদয়-বেদনা যে কত কবি কত দিক দিয়ে দেখেছেন, কত ভাবে বর্ণনা করেছেন, তার সামান্যতম অংশ কেউ অন্যের হৃদয়ে সঞ্চারিত করতে পারবে না। শ্রীরামকৃষ্ণ ঠিক ঠিক কী বলেছেন বই না খুলে বলা যায় না, তবে যা বলেছেন তার সারাংশ এই, মদ দেখলে নেশা হয় না, শুঁকলেও না, চাখলেও না, এমনকি সর্বাঙ্গে মাখলেও না। মদ গিলতে হয়।

পদাবলিরস আকণ্ঠ গিলতে হয়।

.

০৯.

আজ রোববার। সপ্তাহে মাত্র এই একটি দিন ডাক্তার আর শহর-ইয়ার একে অন্যকে নিরবচ্ছিন্নরূপে পায়। এ দিনটায় আমি দ্য ত্রো– ওয়ান টু মেনি হতে চাইনে। তাই ব্রেকফাস্টে পর্যন্ত গেলুম না। খাই তো কুল্লে দু কাপ চা সে কর্মটি শুয়ে শুয়ে দিব্যি করা যায়। মোগলাই কণ্ঠে বেয়ারাকে চা আনতে হুকুম দিলুম। কিন্তু উল্টা বুঝলি রাম। চায়ের সঙ্গে সঙ্গে এলেন কপোত-কপোতী। ডাক্তারের মুখে পুরো উদ্বেগ। ঢুকেই নার্ভাস কণ্ঠে দ্রুতগতিতে বলতে লাগলেন, আপনার কী হয়েছে? শরীর খারাপ? জ্বর? ব্যথাট্যথা? শহর-ইয়ার খাটের পৈথানে কাঠের বাজু ধরে শুধু তাকিয়ে আছে। তার মুখে উদ্বেগের কোনও চিহ্ন নেই।

আমি ভালো করে কিছু বলার পূর্বেই ডাক্তার খাটের বাজুতে বসে আমার হাতখানা আপন হাতে তুলে নিয়ে বললেন, আমি প্রথম দিনই স্থির করেছিলুম সুযোগমতো আপনার শরীরটা একটু দেখে নেব। এইবেলা সেটা করা যাক। আজ রোববার, বেশ আহিন্তা আহিস্তা রতা রফতা।

আমি দ্রুতগতিতে বোঝাতে চেষ্টা করলুম, আমার স্বাস্থ্যটা পুরুষ্টু পাঁঠার মতো, হজম করতে পারি ভেজালতম তেল, নিদ্রা ভিলেজ ইডিয়টের চেয়ে গভীরতর ভুল বললুম, বলা উচিত ছিল রোদের পুলিশের চেয়েও। ডাক্তার কোনওপ্রকারের আপত্তি না জানিয়ে, প্রশান্ত নিঃশব্দ হাসি মারফত প্রসন্নতা প্রকাশ করে আমার দেহটি বদখলে এনে তাঁর ইচ্ছামতো উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলেন, যেন ঘড়েল ক্যাশিয়ার হাজার টাকার নোটের কোনও না কোনও জালের চিহ্ন খুঁজে বের করবেই করবে– কারণ ইতোমধ্যে, স্বামীর আদেশ হওয়ার পূর্বেই শহর-ইয়ার স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ব্লাডপ্রেশারের যন্ত্র, স্টিতস্কোপ এবং আরও কিছু আমার অচেনা যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছেন।

সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার একাধিকবার বললেন, আমি ডাক্তারি ভুলে গিয়েছি সেকথা তো আপনাকে বলেছি। এটা নিছক, প্রাথমিক আনাড়ি পরীক্ষা। পরে আমার এক বন্ধু এসে পাকাভাবে দেখে যাবেন।

আমি বললুম, আমি কী হিন্দুসমাজের অরক্ষণীয়া যে আমাকে কাঁচা-দেখা-পাকা দেখা সব জুলুমই সইতে হবে?

ডাক্তার খুশিমুখে বললেন, ভালোই হল, ওই কনে-দেখার কথাটা উঠল। আপনার কাছে আমার একটা সবিনয় আরজ আছে। কিন্তু আপনার যদি কণামাত্র আপত্তি থাকে তবে আপনি দয়া করে অসঙ্কোচে আপনার অসম্মতি জানিয়ে দেবেন। আমি কথা দিচ্ছি, আমি নিরাশ হব না।

আমি বললুম, অত তকলুফ করেন কেন? বলুন না খুলে।

খোঁড়াদের চলার মতো ইনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কথা বললেন। মানে, অর্থাৎ, ব্যাপারটা হচ্ছে এই; আমার অতি দূরসম্পর্কের একটি ভাগ্নি আছে। বাপ-মা নেই- অরক্ষণীয়া বলা যেতে পারে। আপনাদের অঞ্চলে বিয়ের প্রাথমিক আলাপ-আলোচনা কী পদ্ধতিতে হয় আমার জানা নেই। এ অঞ্চলে কিন্তু কনেপক্ষ কখনওই বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় না– সে বড় শরমের কথা। হিন্দুদের মতো প্রোফেশনাল ঘটকও আমাদের নেই। তাই চতুর্দিকে আটঘাট বেঁধে কনের মামার ভায়রা-ভাইয়ের ভগ্নীপতি, পারলে তার চেয়েও দূরসম্পর্কের কেউ তার কোনও বন্ধুকে আত্মীয়কে নয়– বরের ভগ্নীপতির মেসোমশায়ের বেয়াইয়ের কোনও বন্ধুকে যেন ইঙ্গিত দেয় এই বিয়েটা সম্বন্ধে। তার পর স্টেপ বাই স্টেপ সেটা এগোয়। সেগুলো না হয় না-ই বললুম। এক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। আজ সকালে বরের এক নিকটআত্মীয় এখানে আসছেন– ভদ্রলোক আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত নন- কথাবার্তা আরেকটুখানি পাকাপাকি করার জন্য। আপনি তো জানেন, এসব দুনিয়াদারি বাদে আমি একটি আস্ত গাধা। তাই আপনি যদি সেখানে।

আমি বললুম, আমি সানন্দে উপস্থিত থেকে আপনাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত, কিন্তু বিপদ কী জানেন, আমি এসব ক্ষেত্রে অত্যন্ত অভিমানী। আলোচনার সময় যদি আমার কখনও মনে হয়, বরপক্ষ আমাদের কনেকে যেন নিতান্ত মেহেরবানি করে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন কিংবা থাক্‌, অর্থাৎ বাংলা কথায়, কনে কিংবা তার আর্থিক অবস্থা অথবা তার বংশমর্যাদা সম্বন্ধে কোনওপ্রকারের সামান্যতম কটাক্ষ যদি বরপক্ষ করে তবে লেগে যাবে ফৌজদারি। আমি খুব ভালো করেই জানি, সেক্ষেত্রে আমার সভাস্থল পরিত্যাগ করা উচিত, কারণ আলোচনা চালু রাখার জন্যে তো অন্য মুরুব্বিরাও রয়েছেন, কিন্তু আমি পারি না, আমি ত্রিভুবন অন্ধকার দেখি ও আমার ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে যেন ধুয়ো বেরুতে থাকে। অতএব বড়ই প্রয়োজনীয় প্রশ্ন, আলোচনায় আমার যোগদান করাটা কি আপনাদের পক্ষে বাঞ্ছনীয়?

আমার কথা শুনে দু জনাই এমন হাসি লাগালেন যে তার আর শেষই হয় না। ডাক্তার তার বউকে সঙ্গে সঙ্গে কী যে বলছেন সেটা আমার ঠাহর হল না। পরে শুনলুম বলছেন, ঠিক আমার আপন মামুর মতো, হুবহু যেন আমার আপন মামু এ কথাগুলো কইলেন। তুমি তাকে দেখোনি শহর-ইয়ার তিনি চলে যান আমি যখন ম্যাট্রিকে। কী দম্ভ, কী দেমাক ছিল ভদ্রলোকের! কিন্তু ওই একমাত্র বিয়ের আলাপের সময়। অন্য সময় মাটির মানুষ বললেও কমিয়ে বলা হয়। আর তার দোস্তি ছিল কাদের সঙ্গে, জানো? দুনিয়ার যত মুটেমজুর, গাড়োয়ান-বিড়িওলার সঙ্গে। তিনি গত হলে পর আমরা তো বেশ জাঁকজমক করে তার ফাতিহা (শ্রাদ্ধ) করলুম, আর বিশ্বাস করবে না, শহর-ইয়ার, আরেকটা আলাদা করল তার টাঙাওলা-বিড়িওলা দোস্তরা– দু পয়সা, চার পয়সা করে চাঁদা তুলে তুলে।

আমি বললুম, নিশ্চয়ই অত্যন্ত খানদানি ঘরের শরিফ আদমি ছিলেন।

 ডাক্তার বললেন, দি বেস্ট না হলেও ওয়ান অব দি ভেরি বেস্ট ইন মুর্শিদাবাদ। কিন্তু আপনি আঁচলেন কী করে।

উচ্চতম স্তরের লোক ভিন্ন অন্য কেউ নিম্নতম স্তরের সঙ্গে মেশবার হিম্মত কলিজায় ধরে না।

ডাক্তার বললেন, সে তো বুঝলুম, কিন্তু আপনি, স্যার, কি এখনও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাস করেন?

আমি বললুম, ঠিক তার উল্টো। আমি বিংশ শতাব্দীও পেরিয়ে গিয়েছি। যে কোনওপ্রকারেই হোক মেয়েকে বিয়ে দিতেই হবে এই মান্ধাতার আমলের কুসংস্কার আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু এ নিয়ে আলোচনা পরে হবে। ওনারা আসবেন কখন?

দেরি নেই, এনি মিনিট।

তা হলে তাড়াতাড়ি জেনে নিই। কনের মার মহর (স্ত্রীধন) কত ছিল?

ডাক্তার ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে বললেন, তাই-তো। ওদের আবার ফোন নেই যে শুধব।

শহর-ইয়ার বললে, দশ হাজার।

 সঙ্গে সেকুরিটি হিসেবে জমি-জমা, কলকাতার কোনও স্থাবর সম্পত্তি?

না।

 মুহম্মদি চার শর্ত ছাড়া অন্য কোনও শর্ত ছিল যেটা বর ভাঙলে মেয়ে তালাক চাইতে পারবে।

না।

 কনের কোনও ভাই-বোন আছে?

একটি দিদি ছিল। বিয়ের অল্পদিন পরেই মারা যায়।

কাবিন্-নামায় (ম্যারেজ কন্ট্রাক্টে) ওর স্ত্রীধন (মহর) কত ছিল?

হাজার পনেরো।

ওরা কত গয়না দিয়েছিল?

 হাজার তিনেকের।

আর আমরা?

 ওই হাজার তিনেক। তবে জেহজের খাটতোশক, ড্রেসিং টেবিল, পেতলের কলসিটলসি নিয়ে হাজার পাঁচেক হবে।

শহর-ইয়ারই সবকটা উত্তর দিল।

ডাক্তার সত্যই একটা নিষ্কর্মা খোদার খাসি। ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু আমাদের কথাবার্তা শোনে আর তাকানোর ভাব থেকে অতি স্পষ্ট বোঝা যায়, এসব প্রশ্নোত্তরের তাৎপর্য তার মস্তকে আদৌ প্রবেশ করেনি।

শহর-ইয়ারকে শুধালুম, বরের বাড়ির মেয়েরা হরেদরে কত স্ত্রীধন পেয়েছে এবং বরেরা আপন আপন দুহিনকে (কনেকে) কত টাকার গয়নাগাটি দিয়েছে সেটা বোধ হয় জানেন না এবং আমাদের সুচতুর ডাক্তারও সে খবর গোপনে গোপনে সংগ্রহ করেননি। না?

আমার অনুমান সত্য।

ডাক্তার মেয়েটি কী কী পাস দিয়েছে, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারে কি না এসব খবর দিতে আরম্ভ করেছেন। আমি বললুম, ওসব জেনে কী হবে? তার জোরে স্ত্রীধন বাড়াবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বরপক্ষ তাদের অন্যান্য ছেলের বিয়েতে কাবিন্-নামায় কনেপক্ষের প্যাঁচের টাইটে কী কী দিয়েছে সেটা জানতে পারলে, বেটার স্টিল ওদের দু চারখানা কাবিন্-নামার কপি যদি গোপনে গোপনে যোগাড় করে রাখতেন তবে সেগুলো হত আমার অ্যাট বম্। এখন যা অবস্থা, মনে হচ্ছে, গাদা বন্দুকটি পর্যন্ত হাতে নেই।

প্রাইজ-ইডিয়ট আর কারে কয়! ডাক্তার বলে কি না, বরপক্ষকে শুধোলেই তো সব জানা যাবে।

আমার কান্না পাবার উপক্রম। বললুম, ওরা জলজ্যান্ত মিথ্যে খবর দেবে। আর আমিও কনেপক্ষের সুবিধের জন্যে যে থান্ডারিং মিথ্যে বলব না, সে প্রতিজ্ঞাও করছিনে।

শহর-ইয়ারকে শুধালুম, আপনি আমাদের সঙ্গে বসবেন?

না।

একসেলেন্ট! কিন্তু আপনি কোথাও পালাবেন না। কোনও খবরের দরকার হলে আপনার কাছে কোনও অছিলায় চলে আসব।

আমি ওঁদের জন্যে খাবার-দাবার তৈরি করার তদারকিতে থাকব।

বেয়ারা খবর দিল ওঁরা এসেছেন। ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুতগতিতে এগিয়ে গেলেন। আমি পা বাড়াতেই শহর-ইয়ার দুষ্টু মুচকি হাসি হেসে বললে, আপনাকে যে কত রূপেই না দেখব! এখন দেখছি ঘটকরূপে। এ-ও এক নব রূপ।

গুনগুন করে গান ধরল–

তুমি নব নব রূপে এস প্রাণে

ডাক্তার মহা সাড়ম্বরে বরপক্ষের দুই ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন এবং বললেন, আমি যে কনেপক্ষের হয়ে এই আলোচনায় যোগ দিতে রাজি হয়েছি তার জন্য তিনি এবং তার পরিবার নিজেকে অত্যন্ত গর্বিত অনুভব করছেন। কনেপক্ষের দু জনও তাদের আনন্দ প্রকাশ করলেন এবং বললেন, আমার নাম তাদের গোষ্ঠীতে অজানা নয়।

 ডাক্তার বললেন, ইনি আছেন বলে আমার আর কোনও দুশ্চিন্তা নেই যে, আমরা অতি সহজেই সব বিষয়েই একমত হয়ে যেতে পারব।

আমি এ জাতীয় অদৃশ্য সশস্ত্র সংগ্রাম- অজ্ঞজন যাকে বলে বিবাহের শর্তগুলো স্থির করার জন্য বর ও কনে পক্ষের মধ্যে আলোচনা শেষবারের মতো দেখেছি দেশে। তার পর দু একটি বিয়ে-শাদিতে আনুষ্ঠানিকভাবে পেট ভরে খেয়ে এসেছি– ব্যস্।

আমি সেই ত্রিশ বৎসর পূর্বেকার শেষ অদৃশ্য সশস্ত্র সগ্রামে আমার অদৃশ্য তলওয়ারটাতে শান দিতে লাগলুম।

কিন্তু হা কপাল! সব বেকার, সব বরবাদ, সব ভণ্ডল।

এ জাতীয় আলোচনা সবসময়ই আরম্ভ হয় মহর বা স্ত্রীধনের পরিমাণ নিয়ে। কনের দিদির স্ত্রীধন পনেরো হাজার ছিল, তারই স্মরণে গুনগুন করলুম, কুড়ি হাজার।

আমি ছিলুম তৈরি যে তাঁরা মৃদুহাস্য করে অতিশয় ভদ্রতা সহকারে দশ হাজার দিয়ে দর-কষাকষি আরম্ভ করবেন। ইয়া আল্লা! কোথায় কী? দু জনাই অতি প্রসন্ন বদনে সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করে নিলেন! আমি তো সাত হাত পানিমে!

মৃদুকণ্ঠে বললুম, আপনারা তো সবই জানেন, কনের বাড়ির হালও জানেন; গয়নাগাটি আমরা আর কী দেব! আপনারাই বরঞ্চ একটা আন্দাজ দিন!

ফের ফাটল বম্-শেল! দু জনাই সাততাড়াতাড়ি বললেন, এ কী বলছেন, সাহেব। না, না, না। আপনারা যা খুশ দিলে দেবেন আমাদের পক্ষে সেইটেই গণিমত (বৈভব, সৌভাগ্য)।

তার পর ওঁরা নিজের থেকে যা বললেন তা শুনে, বিশেষ করে থার্টি ইয়ারস উয়োরের স্মরণে, আমি আমার কানদুটোকে বিশ্বাস করতে পারলুম না। ওঁরা কনেকে কী গয়নাগাটি দেবেন সে প্রশ্ন ইতিউতি করে আমি শুধোবার পূর্বেই তারাই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বললেন, মাফ করবেন, আর আমাদের পক্ষ থেকে তো বলার কিছুই নেই। আপনারা জানেন দুলহার (বরের) ভাইবোন নেই। কাজেই দুলুহিনই শাড়ির সবকিছু পাবেন এ তো জানা কথা, আর আমরাও সেই কথাই দিচ্ছি। তার দাম ভদ্রলোক সঙ্গীকে শুধোলেন, কত হবে ভায়া? সঙ্গী বললেন, হালে যাচাই করা হয়েছিল। কুড়ি হাজারের কম না। তিন পুরুষের পুরনো গয়ন, নতুন করে গড়াতে হবে।

কুড়ি হাজার বলে কী! কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তড়িঘড়ি বললুম, অমন কম্মটি করতে যাবেন না। আল্লার মেহেরবানিতে ভালোয় ভালোয় আকৃৎ-রসুমাৎ (পরিপূর্ণ শাদি) হয়ে যাক তখন না হয় দুলহিন তার শাশুড়ির সঙ্গে পরামর্শ করে যা করার করবেন। কী বলেন ডাক্তার? আর আপনারা?

দু জনেই সানন্দে সায় দিয়ে, একজন বললেন, আমার মেয়ে বলছিল, পুরনো ফ্যাশান নাকি আবার হালফ্যাশান হচ্ছে। এখন ভেঙে গড়ালে পরে হয়তো দুলহিনই– কথাটা তিনি আর শেষ করলেন না।

ইতোমধ্যে নাশতা আসতে আরম্ভ করেছে। সে আসা আর শেষ হয় না। নাশতা না বলে এটাকে হক-মাফিক ব্যানকুয়েট বলা উচিত। বরপক্ষ ক্রমাগত আমাদের শুনিয়ে একে অন্যকে বলে চলেছেন, হবে না কেন? চিরকালই হয়ে আসছে এরকম। এঁয়ার ওয়ালেদের (পিতার) আমলে আমি কতবার খেয়েছি এরকম। আমার দাদাকে (ঠাকুদ্দা) কতশত বার বলতে শুনেছি, এঁয়ার ঠাকুরদ্দার শাদির দাওয়াত! তিন রকমের খানা তাইয়ার হয়েছিল। তিন বাবুর্চির একজন এসেছিল পাটনা থেকে, অন্যজন দিল্লি থেকে আর তিসরা হায়দ্রাবাদ নিজামের খাস বাবুর্চি-খানা থেকে। আর চলল তো চলল– তার যেন শেষ নেই।

নাশতার বাসন-বর্তন খাওয়াদাওয়ার পর যখন সরিয়ে নেওয়া হল তখন আমি অতিশয় মোলায়েম সুরে বললুম, আমার একটি আরজ আছে; যদি অভয় দেন

উভয়ে সমস্বরে বললেন, আপনি আরজ না, হুক করুন।

আমি বললাম, আমি যা বলতে যাচ্ছি সেটা বোধ হয় আদালতে টেকে না। কুরান শরিফের কানুন মোতাবেক যে কোনও মুসলমান চারিটি বিবি একই সময়ে রাখতে পারে। এখন আমরা যদি কাবি-নামায় দুলহার কাছে শর্ত নিই অর্থাৎ আপনারা যদি মেহেরবানি করে সে শর্ত কবুল করেন যে তিনি দুলহিনের বিনা অনুমতিতে দুসরি শাদি করবেন না, তবে আইনত সেটা বোধ হয় আস্ট্রা ভাইরে। আদালত খুব সম্ভব বলবে, কুরান শরিফ মুসলিমকে যে হক দিয়েছেন, মানুষ একে অন্যের কাছ থেকে শর্ত আদায় করে সে হক খর্ব করতে পারে না। আমি এতক্ষণ ধরে এই সমস্যাটা নিয়ে চিন্তা করছিলুম।

কন্যাপক্ষ বললেন, আমরা খুশির সঙ্গে সে শর্ত দেব। সে শর্ত আপনাদের তরফ থেকে নিতে তো কোনও দোষ নেই। তার মূল্য শেষ পর্যন্ত যদি না থাকে তো নেই। এখন নিতে আপত্তি কী?

সমস্ত বাক্যালাপটা আমার কাছে অত্যন্ত অবাস্তব ঠেকছিল। কোথায় গেল সেই ত্রিশ বৎসর পূর্বেকার লড়াই? আলোচনার নামে চিৎকার, রাগারাগি, নাশতা স্পর্শ না করে বরপক্ষের সত্যাগ; এমনকি বিয়ের রাত্রেও উভয় পক্ষ ততদিনে বিয়ের প্রস্তুতির জন্য হাজার হাজার টাকা খরচ করে ফেলেছেন– কাবিন্-নামা লেখার সময় সামান্য একটা শর্ত নিয়ে বচসা, তার পর মারামারি, সর্বশেষে বিয়ে ভণ্ডুল করে বরপক্ষ বাড়ি যাবার পথে অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে বিবাহ-পর্ব সমাধান করে মুখরক্ষা করল– এ ব্যাপারও মাঝে মাঝে হয়েছে।

আর আজ দেখি ঠিক তার উল্টো! আমি যা শর্ত চাই সেটাতেই তারা রাজি! যেন সমস্ত কলকাতা শহরে আর কোনও বিবাহযোগ্যা কুমারী নেই! এই ত্রিশ বছরে দুনিয়াটা কি আগাপাশতলা বদলে গেল?

এ অবস্থায় আর খাই বাড়ানো চামারের আচরণ হবে। শুধু বললুম, আর বাকি যেসব ছোটখাটো শর্ত আছে, যেমন আমাদের মেয়ে যদি আল্লা না করুক– শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে মনোমালিন্য হেতু বাপের বাড়িতে এসে কিছুকাল বা দীর্ঘকাল বাস করে তবে সে শ্বশুরবাড়ি থেকে কত টাকা মাসোহারা পাবে, আপনারা যে স্ত্রীধন দেবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবেন তার জিম্মাদার কে কে হবেন, এ সবের জন্য আর চিন্তা করতে হবে না। বিয়ের পূর্বে আমাদের উকিলের সঙ্গে আপনাদের উকিল বসে এসব ফর্মালিটিগুলো দুরস্ত করে নেবেন। আজ আমি এতই খুশি যে বিনা তর্কে বিনা বাধায় বড় বড় শর্তগুলো সম্বন্ধে একমত হতে পেরেছি যে অন্য আর কোনও ছোট শর্ত স্পর্শ করতে চাইনে।

সবাই সমস্বরে তখন আমাকে অনুরোধ করলেন আমি যেন আল্লার কাছে শুকরিয়া জানিয়ে একটি মোনাজাত (প্রার্থনা) করি। এসব মোল্লাদের (পুরুদের) কাজ,- তারা দু পয়সা পায়ও এসব আমাদের (অর্থাৎ স্মৃতি-রত্নদের) কাজ নয়। তবু অতিশয় প্রসন্ন চিত্তে আল্লাকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রার্থনা সমাপ্ত করলুম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *