০৫. সেনকর্তা ডেকে পাঠালেন লখাইকে

সেদিন সন্ধ্যাবেলা সেনকর্তা ডেকে পাঠালেন লখাইকে তাঁর খাস কামরায়।

 লখাই বুঝল এ ডাক কীসের। কর্তার কামরার বাইরে বন্দুকটা রেখে ঢুকে গড় করল সে।

ঘর না বলে এটাকে ইন্দ্রের কক্ষ বলাই ভাল। গঙ্গার পশ্চিমপাড়ের উন্মুক্ত ভোলা আকাশের ড়ুবন্ত সুর্যের লাল শেষ রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত ঘরের মধ্যে। বিচিত্র ছাঁদের বিশাল নানান বর্ণের সংমিশ্রিত বেলোয়ারি কাচের ঝাড়লণ্ঠন মৃদু মৃদু দুলছে। থেকে থেকে কখনও বা হঠাৎ হাওয়ায় টুংটাং করে উঠছে বেজে। ঘরের দেওয়ালের প্রায় অর্ধেকখানি তেলাভ নীল পাথরে বাঁধানো, তাতে রেখায় রেখায় ফোটানো পেখম-ভোলা ময়ুরের ছবি। খানকয়েক বিদেশি ছবি দেওয়ালের গায়ে লটকানো রয়েছে রূপোর ফ্রেমে আটকানো। ছবিরই বা কী বাহার। সে বাহার দেখলে মানুষের লজ্জা হয়। কোম্পানির সাহেবরা নাকি এ-সব ছবি কর্তাদের উপহার দিয়েছেন।

কত তাকিয়ে দেখলেন লখাইয়ের মুখ। না, তিনি রাগ করলেন না। বরং লখাইয়ের বিরাট  বলিষ্ঠ মূর্তি প্রশংসাভরে তাকিয়ে দেখলেন। বললেন, নারানের বউকে তুই নষ্ট করেছিস ব্যাটা, অ্যাঁ? যার শিল তার নোড়া, তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া, নাকি রে?

লখাই অভয় প্রার্থনা করে সব কথা বলল কতাকে। বলল, তার আর কাঞ্চনের কথা, তার প্রাণের কথা। শুনতে শুনতে কর্তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বললেন, তোকে আমি জমি দেব, ভিটে কর নিজের, ওই বউকে নিয়ে ঘর কর তুই।

কিন্তু লখাই বলল, হুজুর অনুমতি দেন, এখান থেকে চলে যাব আমি। শ্যামদাদা কালীবউকে নিয়ে ঘর ছেড়েছে। এখানে আমি আর থাকতে পারব না। থাকতে হলে, শ্যামবাগদীর ভিটাই হল লখাইয়ের ভিটা। বলতে বলতে তার চোখে জল এল।

বেশ তো। কর্তা বললেন, সেখানেই থাক। চলে যাবি কেন? শ্যাম দেখিস আবার ফিরে আসবে।

এ আশার কথায় শান্তি পেল লখাই। বড় ইচ্ছা করল এই মুহূর্তে একবার কাঞ্চীবউয়ের কাছে ঘুরে আসবার। কিন্তু রাতের পাহারা রয়েছে তার।

তারপর কর্তা হঠাৎ দুখানি মোহর লখাইকে দিয়ে বললেন, তোর মেয়েমানুষকে যা খুশি গড়িয়ে দিস। আর, শিরি-ফরহাদের গল্প শুনেছিস কোনওদিন?

আজ্ঞে না।

শুনে নিস একদিন মেরজা ওস্তাদের কাছ থেকে।

এমন সময় মেজ কর্তা ঘরে ঢুকে বললেন, দাদা, তা হলে মহারানীর উপাধি গ্রহণের দিল্লি-দরবারের তো আর বেশি দিন বাকি দেখি না। অনেকেই রওনা হয়ে গেছে। আমরাই বা আর দেরি করি কেন?

কর্তা গম্ভীর হয়ে বললেন, ভাবছি, আমরা কীসে দরবারে যাওয়ার উপযুক্ত লোক? সেখানে সব রাজরাজড়াদের ব্যাপার।

মেজকর্তা কিছুটা বিরক্ত ও আফসোসে বলে উঠলে, কী যে বলল, তার ঠিক নেই। বলে, কোম্পানির আস্তাবল সাফ করে যে জমিদারি কিনল, সেও দেখি দিল্লির দিকে বজরা ভাসিয়েছে। আমরা কি তাদের থেকেও ছোট? তা ছাড়া, এ-সব ব্যাপারে একটু নড়াচড়া না করলে কর্তা ব্যক্তিরাও খুশি হয় না। ঘরে বাইরের সম্মানটাও দেখতে হবে তো।

কর্তা একটু চুপ থেকে বললেন, ভাল কথা। তবে যাওয়া সম্ভব নয়, মনে হয়। মহীগড় মৌজা বিক্রির সব টাকাটা পেলে একটা উৎসবের আয়োজন করো আর হুগলির বড়সাহেবকে বলে এসো, আমরা লাটসাহেব লিটনকে কিছু উপটৌকন পাঠাতে চাই, তিনি যেন দয়া করে একটু ব্যবস্থা ও দিন তারিখ সময়টা ঠিক করে দেন।

মেজকর্তা মহীগড় বিক্রির দুর্দশার ইঙ্গিত বুঝেও বললেন, কিন্তু মহারানীর রাজত্ব বলে সকলেই খুব খুশি হয়েছে।

আমিও হয়েছি। কোম্পানির দৌলতেই আমরা ঐশ্বর্য পেয়েছি, কিন্তু কত হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলেন। একটা বিচিত্র অশান্তির রেখা ফুটে উঠল তাঁর মুখে। তার মনে যে কথা রেখাপাত করেছে তা হয় তো দেশের সাম্প্রতিক নানান কথার জন্যই। এক এক মহলে এক এক শ্রেণীর আলোচনা চলছে তখন। কেউ ভিক্টোরিয়ার ভারতের মহারানীর উপাধিগ্রহণ সম্পর্কে বিরুদ্ধ মতামত পোষণ করছিল, কোনও কোনও মহলে লিটনের সম্পর্কে নানান বাদানুবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। কোম্পানির রাজ্যে দেশিয় লোকের ঐশ্বর্য আহরণের যে সুযোগ ছিল, তা খুব হওয়ার আশঙ্কা করছিল কেউ কেউ।

লখাই কিছুই সঠিক বুঝতে পারেনি। সে হঠাৎ বলল, হুজুর মাপ করবেন। এ কোন্ মহারানী? ঝান্সির রানী লক্ষ্মীবাঈ?

মেজকর্তা বললেন, তুমি একটি মেড়াকান্ত। তোমার ওসব লক্ষ্মী-পক্ষী কেউ নয়, ইনি হলেন মহারানী ভিকটোরিয়া। লন্ডনেশ্বরী। এখন হলেন ভারতেশ্বরী, বুঝেছ?

লখাই ঘাড় কাত করে বলল, বুঝেছি হুজুর, কিন্তু কোথাকার মহারানী, বুঝলাম না।

বড়কর্তা ঠোঁট ঈষৎ বেঁকিয়ে বললেন, এ-দেশের আর রানীটানি নেই রে। এ হিন্দুস্থানের ভার নিয়েছেন এখন গোরা কোম্পানির বিলাতের মহারানী। তিনি এখন ভারতেশ্বরী।

ভারতেশ্বরী! গোরাদের ফিরিঙ্গিরানী ভারতের অধিশ্বরী। হায় মহাদেব! এ কী শুনছে লখাই! তার ওষ্ঠাগ্রে উথলে উঠল কেটা প্রশ্ন, তবে সেই বীর রানী লক্ষ্মীবাঈয়ের কী হল? কিন্তু চকিতে চেপে গিয়ে হাত-পা যেন অবশ হয়ে এল তার। শিথিল হাত থেকে পাথরের মেঝেতে মোহর পড়ে গিয়ে ঝনঝন করে উঠল।

কর্তা বললেন, কী হল রে?

রুদ্ধশ্বাস বিপজ্জনক মুহূর্ত। মনে মনে বলল লখাই, সাবধান, সাবধান পলাতক সিপাহি। শান্ত হও, অধীর হয়ে এমন করে বিপদ ডেকে এনো না।…তাড়াতাড়ি গড় করে মেঝে থেকে মোহর তুলে হাসবার চেষ্টা করে বলল, কিছু লয় হুজুর, কিছু লয়, মাথাটা যেন কেমন ঘুরে গেল।

এ মিছে কথা বলার সুযোগ তার ছিল। শত হলেও জলে ভাসা মরা মানুষ, বেঁচে উঠেছে সে, আর তা ছাড়া, কর্তা জানতেন তার মনের অবস্থা খারাপ। তার মনের গতি তো আর দশজনের মতো স্বাভাবিক নয়।

কর্তা যেচেই বললেন, ঘরে যাবি?

আশীর্বাদ প্রাপ্তির মতো বলল লখাই, যদি অনুমতি দেন।

মেজকর্তা বলে উঠলেন, খোট্টা হয়ে শুধু বাংলা কথাই শিখিসনি বিনয়বাক্যও বেশ রপ্ত করেছিস দেখছি।

হুজুরদের দয়া।

কর্তারা দুভাই-ই হেসে উঠলেন। বড়কর্তা বললেন, আচ্ছা যা। কয়েদখানার বাবুকে বলিস, বাইরের দালানে যেন রাতে কেউ থাকে।

বাইরে এসে বন্দুকটা ছুঁতেই হাত দুটো সাঁড়াশির মতো মুঠি পাকিয়ে উঠল লখাগর। দাঁতে দাঁত চেপে বসল। সে ভুলে গেল কাঞ্চনের কথা, ভুলল শ্যামকালীবউয়ের কথা, অশান্তির কথা ঘরের। আচমকা এক অসময়ের ঝড় উঠল তার বুকের মধ্যে। আবার তার জীবনে যেন সেই যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে এসেছে। ফিরিঙ্গিরানী ভারতেশ্বরী! তা হলে কি সব শেষ হয়ে গিয়েছে, সব আশা ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছে!

কয়েদখানার বাবুর কাছে এসে বন্দুক ফিরিয়ে দিল সে। কয়েদখানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীকে কয়েদবাবু বলা নিয়ম এবং কয়েদবাবু বলেই তিনি এ এলাকায় পরিচিত। কুটবুদ্ধি ও নিষ্ঠুর নীচ প্রকৃতির মানুষ বলে তাঁর খ্যাতি আছে। কয়েদখানার বাইরে সামান্য খোলা জমির পরেই কাছারিবাড়ির পেছনের পাঁচিল সংলগ্ন কয়েদি-দপ্তর, এ ঘরটি শুধু শ্রীহীন নয়, সমস্ত সেনবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে এ ঘরখানিই বোধ হয় সবচেয়ে অন্ধকার (কয়েদখানা বাদে) পুরনো এবং অল্পদামি আসবাবপত্রে ভরা। আলো মাত্র একটি, তাও প্রায় সবসময়েই জ্বালানো থাকে। দরজা মাত্র দুখানি। একটি কাছারি অপরটি কয়েদঘরে যাওয়ার। কত্তারা এ ঘরটিকে বোধ করি ইচ্ছা করেই সংস্কার করবার প্রয়োজন বোধ করেন না কয়েদিদপ্তর বলে। তাতে কয়েদি-দপ্তরের সামঞ্জস্য নষ্ট হবার সম্ভাবনা আছে। সে ঘরে কয়েদবাবু ও যমদুতের মতো সিদ্ধিপানে লাল চোখ নিয়ে কয়েকজন সেপাই সব সময়ই বসে থাকে।

কয়েদবাবু তাঁর বকের মতো নাকটা আরও খানিকটা ঠুলো করে জিজ্ঞেস করলেন লখাইকে, কী বৃত্তান্ত বাবা লক্ষীন্দর, ছুটি নাকি?

লখাইয়ের হাতে হঠাৎ সোনার চকমকানি দেখে কয়েদবাবুর সন্দেহপ্রবণ লুব্ধ কুটিল চোখজোড়া চকচক করে উঠল। তোমার হাতে কী হ্যা?

মোহর। কত দিয়েছেন।

বাঃ! তুই তো বেটা জাদু জানিস দেখছি। কুটিল হাসিতে মুখ তবে তিনি বললেন, পরের বউ, পরের ঘর সবই লুটলি, আবার তার কাছে বকশিশও পেয়ে গেলি? হা হা হা। বেশ বেশ! তো তোর কেরামতিটা বাইকে শিখিয়ে দে না রে।

অন্য যে কয়জন সেপাই সেই গুহার মতো অন্ধকার ঘরে বসে ঝিমুচ্ছিল, তারা সকলেই চোখ ঘষে লখাইয়ের দিকে তাকাল। তাদেরই মতো একজন নগণ্য সেপাইয়ের এতখানি সৌভাগ্য দেখে ঠিক হিংসা নয়, এক বিচিত্র আশাবোধ তাদের প্রাণের মধ্যে জেগে ওঠে। সেই সঙ্গে তাদের দানের মহিমাতে বিস্ময়ে চোখ জ্বলে ওঠে তাদের।

একজন বলে উঠল তাদের মধ্যে থেকে, আমার ঠাকুদ্দারে কত্তারা একবার অনেক সোনা দিইছেল, কিন্তু কপালে সইল না।

এবং সব কজন সেপাই-ই লখাইয়ের কাছে এসে বিস্মিত প্রশংসার লক্ষ করতে লাগল তাকে। একজন বলল, কী বলে দিলেন কত?

সে জবাব দেওয়ার মতো মনের অবস্থা তখন লখাইয়ের নয়। তার সমস্ত মনের মধ্যে তখন তোলপাড় করছে ফেলে-আসা অতীতের কাহিনীর সমস্ত পরিণতি জানবার জন্য। তার সমস্ত প্রাণমন ফিরে গেছে ফেলে-আসা সেই সেপাই ব্যারাকে, মনে পড়ছে প্রতিটি দিনের নিরন্তর ফিসফাস, জাত মান খোয়ানোর আতঙ্ক, আর প্রতিমুহূর্তে শ্বেত দানবের হুকুম অমান্যের সাংঘাতিক উত্তেজনা।

সে বলল কয়েদবাবুকে, কিত্তা বাইরের দালানে একজন পাহারাদার পাঠাতে বলে দেছেন। আমি যাই আজ্ঞে।

কয়েদবাবু বললেন, আরে শোন শোন। হঠাৎ ঘরে চললি কেন? ময়াল খেলাতে না রাত করে মেয়েমানুষকে পাহারা দিতে?

একজন সেপাই বলল, তা নারানও বড় কম জোয়ান নয়। সে কি ছেড়ে কথা কইবে? লখাই বলল, না ভাই, শরীলটা বড় বেভাব লাগছে। কয়েদবাবু হেসে উঠলেন হো হো করে। বললেন, সে তো কর্তা বুঝেছেন, আমরা কি আর বুঝেছি? তারপর হঠাৎ গলার স্বর পরিবর্তন করে ভ্রূ কুঁচকে বললেন, তা তুই এত ঘামছিস কেন, হাঁপাচ্ছিস কেন! ভয় পেয়েছিস নারানের জন্য?

কথাটা শুনে মাথা নাড়া দেওয়া সিংহের মতো সোজা হয়ে উঠল লখাই। পরমুহূর্তেই আবার মাথা নামিয়ে চাপা একটু উত্তেজিত গলায় বলে, তা বাবু, নারানের না হোক, ভয় পেয়েছি একটা। ভয় এ পানের লয়, সে ভয়… বলতে বলতে হঠাৎ থেমে আর একটি কথাও না বলে সে বেরিয়ে পড়ল।

ঘরের সবাই হতবাক হয়ে তার চলার পথের দিকে তাকিয়ে রইল। কেবল কয়েদবাবুর মুখের সমস্ত রেখাগুলো বার বার নানান ভঙ্গিতে বেঁকেচুরে উঠতে উঠতে লাগল নানান চিন্তায়।

.

লখাই বেরিয়ে এসে পথের উপর পড়ল।

সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে। উত্তর-দক্ষিণে বিলম্বিত পথ নির্জন নিস্তব্ধ। চক্রবর্তী বাগানের উলটো দিকে পথের উপর ঘোষের মুদিখানায় বাতি জ্বলছে একটা টিমটিম করে। দু-একজনের নিচু গলার কথা শোনা যাচ্ছে সেখানে।

কোথায় যাবে লখাই? বাড়িতে, কাঞ্চনের কাছে? না, নারীর প্রেমালিঙ্গন আদর-সোহাগ আচমকা তার জীবন এক উদ্দাম ঝড়ে ঝরে গিয়েছে। বুঝি চকিতে দুদিনের জন্য তার জীবনে নারীর উদ্দাম সোহাগ এসেছিল এবং যে দুর্বিপাকে পড়ে ভাসন্ত জীবনকে যে তুলে দিয়েছিল কাঞ্চনের হাতে, পুনর্বার সেই দুর্বিপাকই দারুণ আবর্তে পাক খেয়ে ফিরে এসে ছত্রখান করে দিল সমস্ত! কোম্পানির ফিরিঙ্গি রানী ভারতের মহারানী! এ কী করে সম্ভব হল। তা হলে চোখে না-দেখা যে ঝাঁসির রানীর যুদ্ধ ঘোষণার কথা শুনেছিল, শুনেছিল বীর নানাসাহেবের কথা, তাঁরাও কি এ নগণ্য সিপাহির মতো লাঞ্ছিত পলাতক জীবন যাপন করছেন? হিন্দুস্থানে কি তাঁদের আর কোনও পাত্তা নেই, বিলাত থেকে ফিরিঙ্গিরানীর শাসন-ক্ষমতার অধিকারের কথা শোনা সত্ত্বেও কি যুদ্ধের অবসান হয়ে গেছে? তা হলে গুরুশূকরের চর্বিতে ভাজা হাড়চূর্ণের ময়দার রুটি-পরোটাতে হিন্দুস্থানের মানুষকে পেট ভরাতে হবে? কোথায় বীর সেনাপতি তাঁতিয়া। আজও যে লখাই, ঝড়ো হাওয়ায় মেঘ গর্জনের মধ্যে তোমার সেই অমোঘবাণী শুনতে পায়, প্রতিটি ফিরিঙ্গির রক্তে হিন্দুস্থানকে স্নান করিয়ে শুদ্ধ করে নিতে হবে।

বুকের মধ্যে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল তার। সারা গায়ে ঘাম ছুটছে। কোথায়, কোথায় তাঁতিয়া! তার মনে পড়ল, মজুমদারদের সেজবাবুর কথা। সারা সেনপাড়ার মধ্যে এমন দুটি তোক আর সে দেখেনি। বাবু সারাদিন বসে বসে মস্ত মোটা মোটা কেতাব পড়েন। পড়ায় এতই তন্ময় থাকেন যে, তাঁর বেশবাসের ঠিক থাকে না, ঠিক থাকে না নাওয়া-খাওয়ার; একদিন তিনি নিজেই ডেকে লখাইকে অনেক কথা বলেছিলেন এবং লখাইকে ওঁর কী যে ভাল লেগেছিল। বলেছিলেন, আমি তোমার প্রেমে পড়েছি হে, বুঝলে? মাঝে মাঝে এসে আমাকে দেখা দিয়ে যেয়ো। তুমি একটা ইতিহাস সৃষ্টি করেছ সারা হালশহর পরগনার মধ্যে।

স্থানীয় অধিবাসীরা তাকে কিন্তু পাগলই মনে করে। কোনও বাকবিতণ্ডা তো দূরের কথা, হেসে ছাড়া তাঁকে কেউ কোনও দিন কথা বলতে দেখেনি। বলেন, তাও দুবোধ। কখনও সংস্কৃত, কখনও ইংরেজি কখনও ফারসি বা ফরাসি। কেতাব পড়েই মাথাটি অমন গোলমেলে হয়ে গেছে, শোনা যায় শীঘ্রই কলকাতায় কোম্পানির প্রতিষ্ঠিত কোন বিদ্যালয়ে নাকি শিক্ষকতা করতে যাবেন এবং সাহেবরা তাঁকে বিলাত নিয়ে যাওয়ার জন্যও খুব অনুরোধ করেছেন।

তিনি যেমন লখাইয়ের প্রেমে পড়েছিলেন, লখাইও তেমনি পড়েছিল এ মানুষটির প্রেমে। অনেক কথা শুধু নয়, অনেক দেশের অনেক ব্যাপার সে জেনেছে এ লোকটির কাছ থেকে। এত কথাও তিনি জানতেন! আর এ দেশের কোনও কথা বলতে গেলেই তাঁর সারা মুখে এক অদ্ভুত ব্যঙ্গের হাসি ফুটে ওঠে। বলেন, আমরা কীসের জাত তুমি জানো?

লখাই বলে, আজ্ঞে হিন্দুর বটে।

তিনি বলেন, সে তো বটেই, তা ছাড়াও আমরা হলাম নিধিরামের জাত।

নিধিরামটা কে বাবু?

যার ঢাল-তলোয়ার নেই।

বজ্রকণ্ঠে সে কথার প্রতিবাদ করতে চেয়েছে লখাই। ঢালতলোয়ারহীন নিধিরাম হলাম আমরা। তুমি কি জানো না বাবু, এ দেশের সেপাইদের লড়ায়ের কথা, তুমি কি জানো না, ফিরিঙ্গির রক্তে ভাগীরথী লাল করে দেওয়ার কথা। কিন্তু বলতে পারিনে ভয়ে। এত কথা জিজ্ঞেস করেছে, তবু প্রকাশ হয়ে পড়ার ভয়ে কোনও দিন জিজ্ঞেস করেনি সে যুদ্ধের পরিণতির কথা। মনগড়া কল্পনা করেছে, যুদ্ধ থেমেছে সাময়িকভাবে, দিন আবার আসবে।

কিন্তু আজ সে কল্পনার সৌধ হয়ে গেছে চূর্ণবিচুর্ণ। সাময়িকভাবে যে পরাজয়ের জ্বালা স্তব্ধ হয়ে ছিল স্বকল্পিত চিন্তায়, আজ সেই জ্বালা নিদারুণ সত্য হয়ে পুড়িয়ে দিল বুকটা।

না, বাড়ি নয়, কাঞ্চন নয়, নয় অন্য কোনও দুশ্চিন্তা। ভয় নয়, আজ সে সোজা চলল মজুমদারবাড়ির দিকে, সেজবাবুর কাছে সমস্ত কথা জানতে। ও হে। বিদ্যুতের মতো ঝলকে উঠল তার মনের মধ্যে, তাই বুঝি সেজবাবু অমন ঠোঁট বাঁকিয়ে বলেন, আমরা হলাম নিধিরামের জাত। আর লখাই অপোগণ্ড মুখ সিপাহি, সে কোনও অর্থই বুঝতে পারেনি। সব কথাই জানেন তা হলে সেজবাবু! নিশ্চয়! সেজবাবু যে কথা জানেন না, সে কথা জানে না তা হলে কেউ।

মজুমদারবাড়ির দেউড়ি দিয়ে ঢুকতেই চাকর হরি জিজ্ঞেস করল, লখাই না কি গো?

লখাই বলল, হ্যাঁ, সেজবাবুর সঙ্গে এটু দেখা করব। কোথায় আছেন?

হরির খানিক ভক্তি আছে লখাইয়ের উপর মনসার ছেলে বলে। তবু বলল বিস্মিত হয়ে, রাত করে যে?

লখাই বলল, বড় দরকার ভাই। বাইরের ঘরে আলো রয়েছে, বাবু ওখানেই নাকি?

হরি নির্বিকারভাবে বলল, তা ছাড়া আর কোথায় থাকবেন বলে? তুমি হলে মনসার ছেলে, উনি হলেন মা সরস্বতীর। যাও।

লখাই ঢুকতে গিয়ে হঠাৎ থমকে পেছিয়ে এল তাড়াতাড়ি। হরি বোধ হয় নজর করেনি। বাবুর পাশে সুন্দরী যুবতী একজন ঘোমটা খুলে বিহুলভাবে শূন্যে তাকিয়ে আছেন আর বাবু কী যেন পড়ছেন তাঁর মিষ্টি গলায় দুহাত নেড়ে। মানুষ দেখে যুবতী ঘোমটা টেনে দিলেন। ছায়া দেখে সেজবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কে ওখানে?

তাড়াতাড়ি চৌকাটের উপর গড় করে লখাই বলল, আপনার লক্ষীন্দর।

সেজবাবু কেতাব মুড়তেই যুবতী উঠে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। সেজবাবু তাড়াতাড়ি তাঁর আঁচল ধরে বললেন, যাচ্ছ কোথায়? ও আমাদের লখাই, তোমার এত গোপনতার কোনও কারণ নেই।

যুবতী ঘোমটা ঈষৎ তুলে বললেন, জানি। তুমি ওর সঙ্গে কথা বলে, আমি ভিতরে যাই।

লখাই তাড়াতাড়ি বলে উঠল, থাক বাবু, আমি এখন যাই।

সেজবাবু বাধা দিয়ে বললেন, যাবে কী হে! গৃহস্থের গিন্নির দেখা পাওয়া যায়, কিন্তু তুমি হলে চাঁদরাজার ছেলে, রাজপুতুর লক্ষীন্দর, এসেছ আবার সন্ধ্যার পর, তোমাকে কি এখন ছেড়ে দিতে পারি! এসো, ভিতরে এসো। স্ত্রীকে বললেন, তুমি তো কতদিন লখাইয়ের কথা শুনতে চেয়েছ, চলে যাবে কেন?

বারবাড়িতে বসে এ ভাবে কথা শোনা যায় বুঝি? বলে স্ত্রী চলে গেলেন।

সেজবাবু একটু হেসে বললেন, তা বটে। তারপর লক্ষীন্দর তুমি কি মনে কর? শুনলাম তুমি আর এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছ সেনপাড়াতে। সেই সম্বন্ধে কিছু বলবে নাকি?

লখাই বলল, না। কিন্তু যা বলতে এসেছে, বলতে গিয়ে সে কথা আটকে গেল তার মুখে। নানান সংশয়, সন্দেহ চেপে আসতে লাগল তার মনে। না জানি কী মনে করবেন বাবু, না জানি কী ভাববেন। হয়তো কিছু জিজ্ঞেস করে বসবেন, যে কথার জবাব দিতে পারবে না সে। আর নিজের মন-মেজাজেরই কি তার কিছু ঠিক আছে? কী বলতে কী বলবে সে। বলতে গিয়ে তার এতদিনের আত্মগোপনের কাহিনীই যদি ফাঁস হয়ে যায়।

তার মুখ দেখে সেজবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার লখাই? কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি তো? কাজে যাওনি আজ?

যেন কথাচ্ছলে একটু হাসল লখাই। তাড়াতাড়ি মনের ভাব গোপন করার চেষ্টা করল। এ কী করছে সে! আর কোনওদিন কি লখাই সেজবাবুর কাছে আসেনি? আর আর দিনের মতোই স্বাভাবিকভাবে নানান কথা বলে তার কথাটি জেনে নিতে হবে, উত্তেজনার মধ্যে সে কথা ভুলে যায় কেন সে? বলল, না, তেমন কিছু নয়। শরীরটা একটু বেভাব হয়েছে, তাই চলে এলাম। কী কেতাব পড়ছিলেন বাবু?

সেজবাবু খানিকটা যেন ভাবের ঘোরে তন্ময় হয়ে গেলেন। লখাইয়ের ছলনা তিনি বুঝতে পারলেন না। বললেন, কেতাব বড় সাংঘাতিক হে। কেতাবের নাম হল দুর্গেশনন্দিনী। লিখেছেন কে জানো? কাঁটালপাড়ার এক চাটুজ্যে হাকিম। আমাদের বাড়িতে দেখলে আমি আমার বউকে পড়িয়ে শোনাচ্ছি, কেন-না, রেওয়াজ আছে। আমার ভাঁটাপাড়ার বন্ধু বনমালী টোলের ফিরতি পথে রোজ এ কেতাবের পাতা ছিঁড়ে পাচন নিয়ে যেত আর সেই পাতা পড়ে শোনাত তার নববধুকে। বলে তিনি ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে সেই কেতাবের পাতা ওলটাতে লাগলেন। লখাই সে সব কিছুই বুঝতে পারল না। বলল, কেন কিছু খারাপ কথাটথা লেখা আছে বুঝি?

খারাপ বলে খারাপ! সেজবাবু ভ্রূ তুলে কপট গাম্ভীর্যে বললেন, রীতিমতো চিত্ত বিক্ষিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। অর্থাৎ হৃদরোগে ঘটতে পারে, বুঝলে? শুনবে নাকি একটু?

লখাই জোড়হাতে বলল, না বাবু, যাব এখন, তা বাবু কেতাবে এত কথা লেখা থাকে, সেপাইদের যে সেই লড়াই হয়েছিল কোম্পানির সঙ্গে তার কিছু লেখা নেই?

সেজবাবু বললেন, ইংরেজি কেতাবে আছে।

আছে? আবার যেন লখাইয়ের সারা মুখ জ্বরের ঘোরে মতমিয়ে উঠতে চায়। মুখে তার আলো ফুটল। বলল :সে লড়ায়ের কী হল বাবু?

সে তো শেষ হয়ে গেছে হে।

অ! যারা লড়েছিল, তাদের কী হল?

তারা তো অনেকেই মরে গেছে।

মরে গেছে?

লখাইয়ের অবিশ্বাস অথচ তীব্র কণ্ঠ শুনে সেজবাবু ফিরে তাকালেন। বললেন, হ্যাঁ। ঝাঁসির রানী তো যুদ্ধ করতে করতেই মারা গেলেন। নানা সাহেব তো গ্রেপ্তার হয়ে বোধ হয় বহরমপুরে। জেলে ছিলেন, মরে গেছেন কি-না জানি না। কেন বলল তো?

কেন? কেন, সে কথা আজ আর কেউ বুঝবে না। ছদ্মবেশী জীবনের সব আশা ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে, সে মরেছে জীবন্তে। বলল, কেন আর, এমনি। গপ্পো শুনেছি কি-না। আর একজন ছিল বাবু, কী নাম তার, হ্যাঁ, তাঁতিয়া? সেজবাবু বললেন, সে মারহাট্টিকে ফাঁসি দিয়েছে।

আচমকা লখাইয়ের বুকে যেন তীক্ষ্ণ তলোয়ার আমূল বিদ্ধ করে কেটে ফেলল হৃদপিণ্ড। কিন্তু কোনও শব্দ করার উপায় নেই। যন্ত্রণায় আর্তনাদ দূরের কথা, মুখে তার চিহ্ন পর্যন্ত ফুটতে দেওয়া চলবে না। সে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ করে আবার বলল, কার হুকুমে ফাঁসি হয়েছে বাবু? কোম্পানির মহারানীর? এবার আর সব চেষ্টাতেও লখাই তার বিকৃত উত্তেজিত মুখভাব গোপন করতে পারল না, সেজবাবু বললেন, কী হয়েছে তোমার লখাই। তোমার স্যানকর্তারা মহারানীর উৎসব করতে দিল্লি যাচ্ছেন, তাতে কি তোমার মন খারাপ হয়ে গেছে?

লখাই প্রাণপণ চেষ্টায় আত্মসম্বরণ করে বলল, না, কিন্তু বাবু, বলতে ভরসা পাইনে, ফিরিঙ্গি রানী এ-দেশের মহারানী হবে, ফাঁসির হুকুম দেবে—এ যেন আমার পানে সয় না।

সেজবাবু তক্তাপোশ ছেড়ে নেমে লখাইয়ের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, ঠিক বলেছ লক্ষীন্দর—ঠিক বলেছ। সাধ করে কী তোমার বন্ধু হয়েছি। কিন্তু কোনও উপায় নেই। আমরা যে নিধিরামের জাত হয়েছি।

সেজবাবুর এ আকস্মিক আত্মপ্রকাশ লখাইয়ের হৃদয়ের বদ্ধ দুয়ার যেন প্রচণ্ড ধাক্কায় ঠেলে খুলে ফেলতে চাইল। দামামা বেজে উঠল তার বুকের মধ্যে, কামানের গোলা ফাটার শব্দ এল যেন তার কানে। তাড়াতাড়ি সেজবাবুর পায়ে হাত দিয়ে ব্যাকুল গলায় বলল সে, বাবু, এর কোনও বিহিত কি হবে না। আপনারা কিছু করবেন না?

সেজবাবু লখাইয়ের হাত ধরে তুলে বললেন, বলেছি তো লখাই, আমাদের কিছু নেই। ঈশ্বর আজ ওদের সহায়, শক্তিতে ওরা আজ সিংহবাহিনী। পৃথিবীর কেউই আজ ওদের সঙ্গে পারবে না। তার উপর আমাদের দেশের বড় বড় মাথারা আজ সব ওদেরই সহায়।

না–না এ আর শুনতে পারে না লখাই। কোম্পানির প্রতি ঈশ্বরের আশীর্বাদ, ওর প্রতি প্রচণ্ড অভিশাপ! হায়, কী পাপে, কোন পাপে। ঈশ্বর কখনও অবিচার করেন না, কিন্তু এই নাকি তাঁর বিচার!

রাত হল, আমি যাই বাবু–বলে লখাই প্রস্থানোদ্যত হল।

সেজবাবু একটু এগিয়ে বললেন, এসব কথা কাউকে যেন বলো না।

না বাবু না। বলে সে বেরিয়ে এল। একথা কি বলার মতো, না, এ লজ্জার, এ পরাজয়ের কথা ফলাও করে কাউকে বলা যায় না।

কিন্তু ঈশ্বরের অভিশাপেই যেন অভিশপ্ত ক্রুদ্ধ বন্দি সিংহের মতো অন্ধকার পথের উপর এসে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল লখাই। তাঁতীয়াটোপীর উদ্দীপ্ত মুখমণ্ডল তার সমস্ত সুপ্ত স্মৃতিকে হিংস্র করে তুলেছে, দুই মুষ্টিবদ্ধ হাতে অন্ধকারকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য যেন সে ঝাপটা মারতে লাগল। না, বোধ করি সেনাপতির ফাঁসির দড়িকে সে দুহাতে টেনে ছিড়তে চাইছে। তার ঘন ঘন নিশ্বাসের সঙ্গে মনে হল, মণিহারা অজগর ফুঁসছে অন্ধকারে, ধকধক করে জ্বলছে দুই রক্ত চোখ। ফাঁসি দিয়েছে তার সেই বীর সেনাপতিকে! সারা হিন্দুস্থানের কোম্পানির সমস্ত গোরাকে কি সেই ফাঁসিরও কাঠে ঝোলানো যায় না?

.

অন্ধকারে গাছের মাথার উপর দিয়ে পাখি একটা পাখা ঝাপটা দিয়ে উড়ে গেল বিচিত্র শব্দ করতে করতে। লখাই যেন শুনল সে পাখি বলে যাচ্ছে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ…।

উপরের দিকে ফিরে তাকাল সে। অন্ধকার। গাছের ফাঁকে ফাঁকে তারা ভরা আকাশ। সেই অসীম শূন্য থেকে ক্রমবিলীয়মান দৈববাণীর মতো সেই শব্দ ভেসে আসতে লাগল, হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ…

অন্ধকারে দানবের মতো লখাই চলল বাড়ির দিকে। কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে মাথার মধ্যে। চিন্তা করবার ক্ষমতা নেই। যা ভাবতে চায়, সে ভাবনার কোনও ধারাবাহিক গতি নেই তার। কেমন করে সে ভাবনা ভাবা যায় বুঝি তাও তার জানা নেই। কেবল এক অশান্ত বোবা ক্রোধে মনে মনে বার বার প্রশ্ন উঠল, কেমন করে, কেমন করে, কেমন করে?

অন্ধকার উঠোন পেরিয়ে দাওয়ায় উঠে দরজায় ধাক্কা দিল সে।

কাঞ্চন জেগেই ছিল। জিজ্ঞেস করল, কে?

আমি লখাই।

পরিচিত গলার স্বর শুনেও বেড়া কাটা জানালা দিয়ে অন্ধকারে ঠাওর করে একবার দেখে নিল। তারপর দিল দরজা খুলে।

ঘরে তখনও টিটি করে একটা প্রদীপ জ্বলছে। লখাইয়ের খাওয়া এঁটো বাসন দুখানা পড়ে রয়েছে, অগোছাল ছড়ানো জিনিসপত্র কালকের মতোই পড়ে রয়েছে এখনও। বিস্ত বিছানার কাঁথা গুটানো, মাদুর পড়ে আছে মেঝেয়।

কাঞ্চনের দুই চোখ ফোলা, মুখ ভার, ক্লান্তিমাখা! বোঝা যায় সে খায়নি, ওঠেনি সারাদিন, পড়েই ছিল। অসময়ে লখাইকে ফিরতে দেখে বলল, চলে এলে যে?

লখাই কোনও জবাব দিল না। চুপ করে বসে রইল সে এক পাশে। স্তব্ধ, ক্রুদ্ধ। জ্বলন্ত চোখ, ঘন নিশ্বাসে মস্ত বুক বিরাট পাথরের মতো দুলে দুলে উঠছে।

সে মূর্তি দেখে চমকে উঠল কাঞ্চন। শিউরে উঠল ভয়ে। তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিয়ে বলল, কী হয়েছে, কী করে এসেছ?

কিছু না।

সেকথা বিশ্বাস করল না কাঞ্চন। আরও খানিক ঝুঁকে পড়ে ভাল করে লখাইয়ের মুখ দেখে বলল, কিছু নয় কি? তবে তোমার চোখ মুখ এমন জ্বলছে কেন! অমন জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছ কেন? কী হয়েছে বলে! তুমি কত্তাদের বাড়ি থেকে চলে এলে কেন?

বলে সে লখাইয়ের সর্বাঙ্গ আতিপাতি করে দেখল। তার স্থির বিশ্বাস হয়েছে মারামারি না হলেও নারানের সঙ্গে নিশ্চয় তার কিছু ঘটেছে। হয় তো সেখানে অধরা এবং আরও কেউ কেউ ছিল। তারা সকলে মিলে অপমান করেছে লখাইকে হয় তো। নয় তো বুঝি কত্তারাই কোনওরকম অপমান করেছে, ব্যবস্থা করেছে হয় তো কোনও শাস্তির।

অস্থির গলায় বলল সে, মরণ সেই আমার, বলল না কেন মিনসে, কী হয়েছে? এত রাগ কেন তোমার! কার পরে!

কার পরে? বলে জলন্ত দৃষ্টিতে শুন্যে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে আবার বলল, যার পরে, তার নাগাল আমি পাব না, বুঝি কোনওদিন না।

শুধু আতঙ্ক নয়, কৌতূহল ফেটে পড়ার জোগাড় হল কাঞ্চনের। দুহাতে লখাইয়ের কাঁধে ঝাঁকানি দিয়ে বলল, কেন! কে সে! কার নাগাল খুঁজছ তুমি?

লখাই স্থির দৃষ্টিতে তাকাল কাঞ্চনের দিকে। কাঞ্চনও তাকাল। একি চোখ। খুন করবার সময় মানুষের চোখ কি এমনই হয়? শত্রুকে না পেলে মানুষের সারা মুখ এমনি জ্বলে।

লখাই হঠাৎ কাঞ্চনের হাত ধরে বলল, কাঞ্চীবউ, সেপাইদের লড়াইয়ের কথা তুমি শুনেছ কোনও দিন? গোরা কোম্পানির সঙ্গে যারা লড়েছিল?

কাঞ্চন বলল, শুনব না কেন। তখন তো আমার বে হওয়ার কথা হচ্ছে।

কঠিন চাপা গলায় বলল লখাই, সে যুদ্ধের সেনাপতিদের ফাঁসি দিয়েছে কোম্পানির গোরারা। এ হিন্দুস্থানের তখতে আজ ওরা ফিরিঙ্গিরানীকে বসিয়েছে। ওই সাদা শয়তানেরা নাকি ঈশ্বরের আশীর্বাদ পেয়েছে, ওদের নাগাল আর কেউ পাবে না।

এ কথার অর্থ বুঝতে পারল না কাঞ্চন। লখাই যে দ্বিগুণ দুর্বোধ্য হয়ে উঠল তার কাছে। অজানা এক নতুন ভয় দানা বাঁধল তার বুকে। এসব কথা বলে কেন মানুষটা, আর এসব কী কথা? বলল, তাতে তোমার কী?

তাতে আমার কী! বেকুফ আওরত! হাতের ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিল সে কাঞ্চনকে।

সত্যি, তাতে লখাইয়ের কী! কেউ বুঝবে না তার কথা, পুনর্জীবিত মনসার ছেলের এ বিচিত্র প্রশ্নে সবাই শুধু চমকাবে, নয় তো এক দারুণ সর্বনাশের সন্ধান পেয়ে খিল আঁটবে ঘরে ঢুকে। আপন মনে সে বিড় বিড় করতে লাগল।..সিপাহি ব্যারাকের কথাই তার আবার মনে পড়ল। একেবারে শেষের দিকে যেদিন শোনা গেল চপাটি ঘুম গিয়া সেদিন ব্যারাকে এক দারুণ উত্তেজনা। ওই চপাটি যুদ্ধ শুরু হবার প্রথম সঙ্কেত ছিল। ওই চপাটিতে লেখা ছিল গোরা কোম্পানির অনাচারের কথা, অত্যাচারের কথা, অস্পৃশ্য টোটা টুপি ময়দার কথা আর ছিল গোরা কোম্পানিকে এ-দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করার কথা। কেমন দেখতে ছিল সেই চপাটি, কে ছেড়েছে সেই চপাটি, কোত্থেকে আসছে; কেউ জানত না। শুধু মাত্র শোনা গেল, এ জনপদের উপর দিয়ে ঘুরে গেছে সেই চপাটি।…পারি বন্ধ, গোরা কানিল মাজের সাহাবের দল অশরীরী প্রেতের আতঙ্কে যেন টিপে টিপে পা ঝেলছে। তারপরই আচমকা বোম্ ফাটার মতো যুদ্ধ শুরু হল। কী সাংঘাতিক তার শেষ।

কাঞ্চন এতক্ষণ অপলক উল্কণ্ঠিত চোখে লখাইয়ের ভাব লক্ষ করছিল। তারপর সারা মুখে এক বিশ্রী আলো ফুটে উঠল। তাড়াতাড়ি কাছে এসে বলল, তবে কী তোমার–

বলতে গিয়ে কথা আটকে গেল তার গলায়। হায় ভগবান, যদি তাই হয়, যদি তাই হয়, তবে হয় তো এ জীবনের তার সবই শেষ।

কাঞ্চনের মুখ দেখে লখাইয়ের চৈতন্য হল। শান্ত গলায় বলল, তবে কী, বলো?

কাঞ্চন ফিস ফিস করে বলল, তবে কি তোমার আগের জন্মের কথা মনে এসেছে?

আগের জন্মের? ওহো! সে যে তার আগের জন্সেরই কাহিনী, যে জীবন তার শেষ হয়ে গিয়েছে। সে যে তার গত জন্মের কথা, এখন যে সে লখাই বাগদী, মা মনসার বর-পাওয়া জলে-ভাসা ছেলে। তার দুচোখ ফেটে জল এল। দুহাতে কাঞ্চনের মুখটি সামনে এনে সে বলল,

যদি তাই হয় কাঞ্চীবউ, যদি তাই মনে আসে?

হতবাক বিহুল কাঞ্চনের ঠোঁটে একটি কথা জোগাল না। প্রাণহীন নিস্পন্দ কাঠের মূর্তির মতো আড়ষ্ট হয়ে রইল, দুচোখে ভরা বিস্ময় নিয়ে লখাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল সে।

কাঞ্চনকে আরও কাছে টেনে লখাই ফিসফিস করে বলল, কোন্ জীবনের কথা তা তো জানি না, কাঞ্চীবউ, মনে পড়ে এক লড়ায়ের কথা, সেনাপতির কথা। সে কথা মনে হলে, আমার প্রাণ পুড়ে যায় কাঞ্চীবউ। কাউকে বলি না, তোমাকে বললুম। কিন্তু সে আর আমি মনে আনতে চাই না, না না।

কাঞ্চন বলল, সেপাইদের সে লড়ায়ে তুমি ছিলে?

হয় তো ছিলাম।

কী হল সে লড়ায়ে?

হার হয়েছে।

তারপর?

তারপর তো কিছু নেই।

সাপে কামড়াবার কথা তোমার মনে নেই?

না।

তবে এতদিন তো তুমি এ পান পোড়ানোর কথা বলোনি?

আজ তো বললাম। কিন্তু কাউকে আর বলল না এ কথা।

তোমার বাড়ি কোথায়?

লখাই তীক্ষ্ণ চোখে কাঞ্চনের দিকে ফিরে তাকাল। উৎকণ্ঠা কাঞ্চনের চোখে। প্রশ্ন যেন ভীত সন্ত্রস্ত।

সে বলল, অত কথা তো মনে নেই কাঞ্চীবউ। শুধু ওই কথাই মনে পড়ে মাঝে মাঝে।

কাঞ্চনের দুই চোখের কোণে বড় বড় ফোঁটায় জল জমে উঠল। ভাঙা গলায় বলল, আর যত যন্তনা হয় তোমার সে কথা মনে এলে? এমন কান্না পায়?

হ্যাঁ।

তুমি একদিন কড়ি ফকিরের কাছে যাও কাঁকনাড়ায়। আজ যে যন্তন্ন তোমার দেখলুম, মাগো! কোনদিন তুমি এ যন্তন্নায় অপঘাতে মরবে।

এবার লখাই হাসল, বিষণ্ণ ক্লান্ত হাসি, না, কড়ি ফকির টকির নয়, যন্তনা হলে তোমার কাছেই ছুটে আসব। এ পানের ভার তোমাকে দিইছি যে?

কাঞ্চনের বুক ভরে উঠল। লখাইয়ের ভেজা চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল, তুমি চলে এলে যে কত্তাদের বাড়ি থেকে?

কত্তা অনুমতি দিলেন, তাই। বলে হঠাৎ কোমরের গাঁট থেকে মোহর কখানি নিয়ে কাঞ্চনের। হাতে দিয়ে বলল, কত্তা দিয়েছে তোমাকে।

আমাকে?

হ্যাঁ। বললেন, তোর মেয়েমানুষকে যা খুশি গড়িয়ে দি।

সত্যি? অমা গো! খিলখিল করে হেসে উঠে সুখে সোহাগে ঢলে পড়ল কাঞ্চন লখাইয়ের বুকে। বলল, রাগমাগ করল না?

মনে তো হল না। আমি যে সব বললুম!

অমা গো! বলে আবার খিলখিল করে হেসে উঠল কাঞ্চন।

সে হাসিতে রাত্রিও যেন মোহিনীময়ী হয়ে উঠল। নিস্তব্ধ অন্ধকার হাওয়া-ভাসা রাত্রি, সে হাসির দমকে নূপুরের তালে যেন নেচে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *