সৃষ্টি জগতের সূচনা
‘সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর যিনি আদি-অন্ত, ব্যক্ত ও গুপ্ত এবং যিনি সর্ববিষয়ে সম্যক অবহিত। তিনি আদি, তাই তাঁর আগে কিছু নেই। তিনি অন্ত, তাই তার পরে কিছু নেই। তিনি ব্যক্ত, তাই তার উপরে কিছু নেই। তিনি গুপ্ত, তাই তাঁর পেছনে কিছু নেই। তিনি আপন কামালিয়াতের যাবতীয় গুণাবলী অনাদি সহ অনন্ত, অক্ষয়, অব্যয়, চিরন্তন সত্তা। আঁধার রাতে নিরেট পাথরের উপর কালো পিঁপড়ের পদচারণা এবং ক্ষুদ্র বালু-কণার সংখ্যা সম্পর্কেও তিনি সম্যক অবহিত। তিনি উন্নত, মহান ও মহিমান্বিত। তিনি মহা উন্নত। সব কিছু তিনি সৃষ্টি করেছেন নিখুঁত পরিকল্পনা অনুসারে।’
আকাশমণ্ডলীকে তিনি উধৰ্ব্বদেশে স্থাপন করেছেন স্তম্ভ ছাড়াই এবং সেগুলোকে সুশোভিত। করেছেন উজ্জ্বল নক্ষত্রমালা দ্বারা, তাতে স্থাপন করেছেন প্ৰদীপ্ত সূর্য এবং জ্যোতির্ময় চন্দ্র এবং তার উপরে তৈরি করেছেন সুউচ্চ, প্রশস্ত ও গোলাকার সিংহাসন। তাহলো মহান আবৃশ। যার আছে বিরাট বিরাট স্তম্ভ যা বহন করেন সম্মানিত ফেরেশতাগণ, যা ঘিরে আছেন নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাগণ, তাদের প্রতি আল্লাহর রহমত বৰ্ষিত হোক। আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা গাওয়াই যাদের একমাত্র কাজ। অনুরূপভাবে আকাশসমূহ পরিপূর্ণ রয়েছে ফেরেশতাকুলের দ্বারা। প্রতিদিন তাঁদের মধ্য থেকে সত্তর হাজার চতুর্থ আসমানে অবস্থিত বায়তুল মামুরে হাযির হন। দ্বিতীয়বার আর সেখানে তাদের আগমন ঘটে না। তাসবীহ, তাহমীদ, তাকবীর এবং সালাত ও তাসলীমই তাদের একমাত্র ব্ৰত।
সৃষ্ট জীবের জন্য পানির তরঙ্গের উপর সৃজন করেছেন তিনি পৃথিবী, তার উপরে স্থাপন করেছেন সুদৃঢ় পর্বতমালা, আর আকাশ সৃষ্টিরও আগে চার দিনে তাতে ব্যবস্থা করেছেন তার জীবিকার এবং তাতে জোড়ায়-জোড়ায়, সব কিছু সৃষ্টির বিষয়টি স্থির করেছেন। শীত-গ্ৰীষ্মে সৰ্বক্ষণ মানুষের যা কিছু প্রয়োজন, বুদ্ধিমানদের জন্য পথ-নির্দেশ স্বরূপ এবং তাদের প্রয়ােজনীয় ও মালিকানাধীন জীবজন্তু। মাটি থেকে তিনি মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন এবং নিরাপদ আধারে তুচ্ছ পানির নির্যাস থেকে তার বংশধর সৃষ্টি করে উল্লেখযোগ্য কিছু না থাকার পর তাকে শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন, আর শিক্ষা দান করে তাকে করেছেন সম্মানিত। আদি পিতা আদম (আ:)-কে নিজের পবিত্র হাতে সৃষ্টি করেছেন তিনি, গঠন করেছেন তাঁর অবয়ব। নিজের পক্ষ থেকে তার মধ্যে সঞ্চার করেছেন আত্মা এবং ফেরেশতাদেরকে তার সামনে করিয়েছেন সিজদাবনত। তারপর তার থেকে তাঁর সহধর্মিনী আদি মাতা হাওয়া (আ:)-কে সৃষ্টি করে দূর করে দিয়েছেন তাঁর নিঃসঙ্গতা এবং তাদেরকে বাস করতে দিয়েছেন তাঁর জান্নাতে এবং পূর্ণ মাত্রায় দান করেছেন অফুরন্ত নিয়ামত।
তারপর তাঁর মহাপ্রজ্ঞাময় পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদেরকে নামিয়ে দেন। পৃথিবীর মাটিতে এবং তাদের থেকে বিস্তার ঘটিয়েছেন অসংখ্য নর-নারীর। তাদেরকে বিভক্ত করেছেন রাজা-প্ৰজা, গরীব-ধনী, স্বাধীন ও অধীন নর-নারীতে এবং তাদেরকে বসবাস করতে দিয়েছেন পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। বংশ পরম্পরায় বিচার দিনে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত তাদের অধীন করে দিয়েছেন ছোট-বড় নদ-নদী উৎসারিত করে দিয়েছেন প্রয়োজন অনুসারে কূপ ও ঝর্ণারাজি এবং বারি বর্ষণ করে উৎপন্ন করেছেন রকমারী শস্য ও ফলমূল। সর্বোপরি তাদেরকে দান করেছেন, তিনি তুদের প্রয়োজন ও যাচ্ঞা, অনুসারে সবকিছু। ‘তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা করলে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। মানুষ অবশ্যই অতিমাত্রায় জালিম, অকৃতজ্ঞ। (১৪ : ৩৪) অতএব পবিত্রতা ঘোষণা করছি সে সত্তার, যিনি মহানুভব, মহান ও পরম সহনশীল।
মানব সৃষ্টি, তাদের জীবিকা প্রদান, তাদের পথ সুগম করে দেয়া এবং তাদেরকে বাকশক্তি দান করার পর তাদের প্রতি মহান আল্লাহর বিশেষ একটি নিয়ামত ও অনুগ্রহ হলো এই যে, তিনি তাদের নিকট প্রেরণ করেছেন তাঁর নবী-রাসূলগণকে এবং নাযিল করেছেন তার হালাল-হারাম, যাবতীয় সমাচার ও বিধি-বিধান এবং সৃষ্টির সূচনা ও পুনরুত্থান সহ কিয়ামত পর্যন্ত সংঘটিতব্য সব কিছুর বিশদ বিবরণ সম্বলিত কিতাবসমূহ।
সুতরাং ভাগ্যবান সে ব্যক্তি, যে সমাচারসমূহকে সত্য বলে মেনে নেয়, সাথে সাথে আদেশসমূহকে বশ্যতা ও নিষেধসমূহকে শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নিয়ে স্থায়ী নিয়ামতরাজি লাভে ধন্য হলো এবং যাককুম, ফুটন্ত পানি ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি বিশিষ্ট জাহান্নামে মিথ্যাবাদীদের অবস্থান থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকল।
আমি মহান আল্লাহর বিপুল উত্তম ও বরকতময় প্রশংসা বর্ণনা করছি—যা ভরে দেবে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীসমূহের প্রান্তরমালা কিয়ামত পর্যন্ত, অনন্তকাল ধরে। তার মাহাত্ম্য, ক্ষমতা ও মহান সত্তার জন্য যেমন শোভনীয়। আর সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই, যার নেই কোন অংশীদার। নেই কোন সন্তান, জনক, অর্থ বা সঙ্গিনী। নেই তার কোন সমকক্ষ এবং নেই কোন মন্ত্রণাদাতা বা উপদেষ্টা।
আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সা) তাঁর বান্দা ও রাসূল, তার হাবীব ও খলীল। আরবের বিশিষ্ট লোকদের যিনি সেরা, নির্বাচিত সর্বশেষ নবী, তৃষ্ণা নিবারণকারী সর্ববৃহৎ হাউজের যিনি অধিপতি, কিয়ামতের দিন শ্ৰেষ্ঠ শাফাআতের যিনি একচ্ছত্র মালিক ও পতাকা বহনকারী, যাকে আল্লাহ তা’আলা অধিষ্ঠিত করবেন এমন এক প্রশংসিত স্থানে, যার আকাঙ্ক্ষা করবে সৃষ্টিকুল, এমনকি আল্লাহর খলীল ইবরাহীমসহ সকল নবী-রাসূল পর্যন্ত। তাঁর প্রতি ও অন্য সকল নবী-রাসূলের প্রতি সালাত ও সালাম।
আর আল্লাহ সন্তুষ্ট হোন তাঁর সাহাবাগণের প্রতি যাঁরা মহা সম্মানিত, নেতৃস্থানীয় ও নবীদের পরে জগতের সেরা ব্যক্তিত্ব।। যতক্ষণ আলো আর আঁধারের অস্তিত্ব থাকবে, আহবানকারীর আহবান ধ্বনি উচ্চারিত হবে এবং দিন-রাতের আবর্তন অব্যাহত থাকবে।
হামদ ও সালাতের পর-এ কিতাবে আমরা আল্লাহর সাহায্য ও তার প্রদত্ত তাওফীক বলে সৃষ্টি জগতের সূচনা তথা আরশ-কুরসী, আসমান-যমীন ও এসবের মধ্যে যা কিছু রয়েছে সেই ফেরেশতা, জিন ও শয়তান যা কিছু আছে তাঁর সৃষ্টি, আদম (আ:)-এর সৃষ্টির ধরন, বনী ইসরাঈল ও জাহেলী যুগ পর্যন্ত নবীগণের কাহিনী এবং আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা)-এর সীরাত যথাযথভাবে আলোচনা করব।
তারপর আলোচনা করব আমাদের যুগ পর্যন্ত সংঘটিত কাহিনী, যুগে যুগে সংঘটিতব্য বিপর্যয়, ও সংঘাতসমূহ, কিয়ামতের আলামতসমূহ এবং পুনরুত্থান ও কিয়ামতের বিভীষিকাসমূহ। তারপর কিয়ামতের বিবরণ এবং সে দিনকার ভয়াবহ ঘটনাবলী। তারপর জাহান্নামের বিবরণ। তারপর জান্নাতসমূহ ও জান্নাতের সুশীলা সুন্দরী রমণীগণের বিবরণ এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি।
আমাদের এসব আলোচনার উৎস হবে কুরআন, সুন্নাহ ও নবুওতে মুহাম্মদীর দীপাধার থেকে সংগৃহীত উলামা ও ওরা ছাতুল আম্বিয়ার বর্ণিত আছার ও আখবার তথা ইতিহাস ও বিবরণ। ইসরাঈলী বিবরণসমূহ থেকে আমরা কোন তথ্য উল্লেখ করব না। তবে শরীয়ত প্রবর্তক মহানবী (সা), আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহর পরিপন্থী নয় এমন যা কিছু উদ্ধৃত করতে অনুমতি দিয়েছেন তার কথা স্বতন্ত্র। আর তাহলো সে সব ইসরাঈলী বিবরণ, শরীয়ত যার সত্যাসত্য সম্পর্কে নিরব। যাতে রয়েছে সংক্ষিপ্ত তথ্যের বিশদ ব্যাখ্যা কিংবা শরীয়তে বর্ণিত অস্পষ্ট তথ্যকে নির্দিষ্টকরণ, যাতে আমাদের বিশেষ কোন ফায়দা নেই। কেবল শোভাবর্ধনের উদ্দেশ্যে আমরা তা উল্লেখ করব-প্রয়োজনের তাগিদে, যা তার উপর নির্ভর করার উদ্দেশ্যে নয়। নির্ভর তো করব। শুধু আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূল (সা)-এর সহীহ কিংবা হাসান সনদে বর্ণিত সুন্নাহর উপর। আর কোন বর্ণনার দুর্বলতা থাকলে তাও আমরা উল্লেখ করব। আল্লাহরই নিকট আমাদের সাহায্য প্রার্থীনা এবং তারই উপর আমাদের ভরসা। ক্ষমতা তো একমাত্ৰ মহান আল্লাহর হাতে।
আল্লাহ তা’আলা তাঁর পবিত্র গ্রন্থে বলেন :
পূর্বে যা ঘটেছে তার সংবাদ এভাবে আমি তোমার নিকট বিবৃত করি এবং আমি আমার নিকট থেকে তোমাকে দান করেছি উপদেশ। (২০ : ৯৯)
আল্লাহ তা’আলা তাঁর নবী (সা)-এর নিকট সৃষ্টির সূচনা, পূর্ববতী জাতিসমূহের প্রসঙ্গ, অনুগতদের প্রতি তাঁর আনুকুল্য এবং অবাধ্যদের প্রতি শাস্তি ইত্যাদির বিবরণ দিয়েছেন। আবার রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর উম্মতের উদ্দেশে তার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। প্রতিটি পরিচ্ছেদে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বর্ণিত আয়াতসমূহের পাশাপাশি আমরা রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে এমন বর্ণনাসমূহ উপস্থাপন করব। উল্লেখ্য যে, মহানবী (সা) আমাদের প্রয়োজনীয় বিষয়াবলী জানিয়ে দিয়েছেন আর যাতে আমাদের কোন উপকার নেই তা বর্জন করেছেন। তবে ইহুদী-খৃস্টান পণ্ডিতদের বেশ কিছু লোক তা জানা ও বুঝার জন্যে গলদঘর্ম হয়েছেন, যাতে আমাদের অধিকাংশ লোকেরই কোন ফায়দা নেই। আমাদের একদল আলিমও সেগুলো আদ্যোপোন্ত উদ্ধৃত করেছেন। আমরা তাদের পথ অনুসরণ করবো না। তবে আমরা সংক্ষিপ্তভাবে তা কিঞ্চিত উল্লেখ করব এবং আমাদের নিকট যা সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে, তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয়াদি এবং যা তার বিপরীত বলে সমালোচিত হয়েছে তা আমরা বর্ণনা করবো। তবে ইমাম বুখারী (র) তাঁর সহীহ বুখারীতে আমর ইব্ন আস (রা) সূত্রে এ মর্মে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন :
‘আমার পক্ষ থেকে একটি বাক্য হলেও তোমরা তা আমার পক্ষ থেকে পৌঁছিয়ে দাও, বনী ইসরাঈল সূত্র থেকেও বর্ণনা করতে পোর তাতে কোন অসুবিধা নেই এবং আমার পক্ষ থেকে বর্ণনা কর, তবে আমার নামে মিথ্যা রটনা করো না। ইচ্ছাকৃতভাবে যে ব্যক্তি আমার নামে মিথ্যা রটনা করবে, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়।’ তা আমাদের মতে ঐ সব ইসরাঈলী রেওয়ায়েত সম্পর্কে প্রযোজ্য, যার পক্ষে বা বিপক্ষে কোন বক্তব্য নেই। সুতরাং সেগুলোকে সত্য বা মিথ্যা প্ৰতিপন্ন করার মত কিছু আমাদের কাছে নেই। তাই শিক্ষণীয় বিষয় হিসাবে এসব রেওয়ায়ত বৰ্ণনা করা জায়েয আছে। এ জাতীয় বর্ণনাই আমরা আমাদের এ কিতাবে ব্যবহার করব।
পক্ষান্তরে আমাদের শরীয়ত যার সত্যতার সাক্ষ্য দিয়েছে; আমাদের তা বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই-আমাদের কাছে যা আছে তা-ই আমাদের জন্য যথেষ্ট। আর আমাদের শরীয়ত যাকে বাতিল বলে সাক্ষ্য দিয়েছে তা প্ৰত্যাখ্যাত এবং প্রত্যাখ্যান বাতিল ঘোষণা করার উদ্দেশ্যে বর্ণনা করা না জায়েয। যা হোক, মহান আল্লাহ যখন আমাদের ও রাসূল (সা) দ্বারা অন্য সব শরীয়ত থেকে এবং তার কিতাব দ্বারা অন্য সব কিতাব থেকে আমাদেরকে অমুখাপেক্ষী করেছেন; তখন আমরা বনী ইসরাঈলদের সে সব বর্ণনা নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না, যেগুলোতে রয়েছে প্ৰক্ষেপ ও মিশ্রণ, মিথ্যা ও বানোয়াট, বিকৃতি ও পরিবর্তন এবং সর্বোপরি সেগুলো রহিত হয়ে গেছে। মোটকথা, যা প্রয়োজনীয়, রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের জন্য তা স্পষ্ট ও বিশদভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন। কেউ তা অনুধাবন করতে পেরেছে, কেউ বা পারেনি। যেমন আলী ইব্ন আবু তালিব (রা) বলেন :
‘আল্লাহর কিতাবে তোমাদের পূর্বকালীন সমাচার, পরবর্তী কালের ঘটনাবলী এবং তোমাদের বর্তমানের বিধি-বিধান রয়েছে। এটাই চূড়ান্ত ফয়সালা এটা কোন হেলা-ফেলার ব্যাপার নয়। যে মদমত্ত ব্যক্তি তা বর্জন করবে, আল্লাহ তাকে ধ্বংস করবেন। আর যে কেউ তা ছেড়ে অন্য কোথাও হিদায়ত অনুসন্ধান করবে। আল্লাহ তাকে পথভ্রষ্ট করবেন।
আবু যর (রা) বলেন :
রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর ওফাতের পূর্বেই দু’ডানায় ভর করে উড়ে যাওয়া পাখি থেকেও আমাদেরকে শিক্ষা দান করেছেন।
ইমান বুখারী (র) সৃষ্টির সূচনা অধ্যায়ে বলেন ৪ তারিক ইব্ন মূসা (র) সূত্রে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, : আমি উমর ইব্ন খাত্তাব (রা)-কে বলতে শুনেছি যে, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) একস্থানে আমাদের মাঝে দাঁড়িয়ে সৃষ্টির সূচনা থেকে জান্নাতীদের তাদের মনযিলে এবং জাহান্নামীদের তাদের মনযিলে প্রবেশ করা পর্যন্ত অবস্থার সংবাদ প্ৰদান করেন। কেউ তা মুখস্থ রাখতে পেরেছে, কেউ বা তা ভুলে গিয়েছে।
ইমাম আহমদ ইব্ন হাম্বল (র) তাঁর মুসনাদে আবু যায়দ আনসারী (র) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদেরকে নিয়ে ফজরের নামায আদায় করে মিম্বরে আরোহণ করেন এবং জোহর পর্যন্ত আমাদের উদ্দেশে খুতবা দান করেন। তারপর মিম্বর থেকে নেমে জোহরের নামায আদায় করে আবার মিম্বরে আরোহণ করেন এবং আসরের ওয়াক্ত পর্যন্ত আমাদেরকে খুতবা দান করেন। তারপর মিম্বর থেকে নেমে আসর নামায আদায় করেন। তারপর আবার মিম্বরে আরোহণ করে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত খুতবা দান করেন। তাতে তিনি অতীতে যা ঘটেছিল এবং ভবিষ্যতে যা ঘটবে তার বিশদ বিবরণ দেন। আমাদের মধ্যকার শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী তা বেশি স্মরণ রাখতে পেরেছেন।’ কেবল ইমাম মুসলিম তাঁর সহীহ’-এর ‘কিতাবুল ফিতানে’ এ হাদীসখানা বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ তা’আলা তার মহান গ্রন্থে বলেন :
‘আল্লাহ সমস্ত কিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সমস্ত কিছুর কর্ম বিধায়ক। (৩৯ : ৬২) মােটকথা, আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত যা কিছু আছে সবই তাঁর সৃষ্ট, পোষ্য, নিয়ন্ত্রণাধীন, নাস্তি থেকে অস্তিত্ব প্রাপ্ত। অতএব, গোটা সৃষ্টি জগতের ছাদস্বরূপ আরশ থেকে আরম্ভ করে পাতাল পর্যন্ত এবং এ দু’টির মধ্যকার জড় ও জীব নির্বিশেষে সবই তাঁর সৃষ্ট, তার কর্তৃত্বাধীন তাঁর আজ্ঞাবহ এবং তাঁর নিয়ন্ত্রণ, কুদরত ও ইচ্ছার অধীন। আল্লাহ তা’আলা বলেন :
‘তিনিই ছ’দিনে (ছয়টি সময়কালে) আকাশরাজি ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তারপর আরশে সমাসীন হয়েছেন। যা কিছু ভূমিতে প্রবেশ করে ও যা কিছু তা থেকে বের হয় এবং আকাশ থেকে যা কিছু নামে ও আকাশে যা উখিত হয় সে সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত। তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন; তোমরা যা কিছু করা আল্লাহ তা দেখেন। (৫৭ : ৪)
শাস্ত্রবিদগণ এ ব্যাপারে এমন অভিন্ন অভিমত পোষণ করেন, যাতে কোন মুসলিমের তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, আল্লাহ তা’আলা আকাশসমূহ, পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যবতী সব কিছু ছ’দিনে সৃষ্টি করেছেন, যেমন কুরআনে করীমে বর্ণিত হয়েছে। তবে এদিন কি আমাদের পৃথিবীর দিনের ন্যায়, নাকি তার প্রতিটি দিন হাজার বছরের সমান? এ ব্যাপারে দু’টি অভিমত রয়েছে। আমি আমার তাফসীর গ্রন্থে এ বিষয়টি আলোচনা করেছি এবং এ কিতাবেও যথাস্থানে তার আলোচনা করব। আকাশসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির পূর্বে কোন সৃষ্টির অস্তিত্ব ছিল কি না-এ ব্যাপারেও মতভেদ রয়েছে। কালাম শাস্ত্রবিদগণের একদলের মতে আকাশসমূহ ও পৃথিবীর পূর্বে কিছুই ছিল না। নিতান্ত নাস্তি থেকেই এগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্যরা বলেন। বরং আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির পূর্বে অন্য মাখলুকের অস্তিত্ব ছিল। তাঁর প্রমাণ আল্লাহ তা’আলার বাণীঃ
‘তিনিই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ছ’দিনে (ছয়টি সময়কালে) সৃষ্টি করেন, তখন তাঁর আরশ ছিল পানির উপর। (১১ : ৭)
ইমরান ইব্ন হুসায়ন (রা) বর্ণিত হাদীসে আছে :
‘আল্লাহ ছিলেন, তার আগে কিছুই ছিল না, তখন তাঁর আরশ ছিল পানির উপর। আর স্মারকলিপিতে সব কিছু লিপিবদ্ধ করে পরে তিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেন।
ইমাম আহমদ (র) আবু রায়ীন লাকীত ইব্ন আমির আকীলী (র) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করার আগে আমাদের প্রতিপালক কোথায় ছিলেন? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ মেঘমালার দেশে-যার উপরেও শূন্য, নিচেও শূন্য, তারপর পানির উপর তিনি তাঁর আরশ সৃষ্টি করেন।
ইমাম আহমদ (র) য়ায়ীদ ইব্ন হারূন ও হাম্মাদ ইব্ন সালামা (র) সূত্রেও হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। তবে তার প্রথমাংশের শব্দ হলো মাখলুক সৃষ্টি করার আগে আমাদের প্রতিপালক কোথায় ছিলেন? অবশিষ্টাংশ একই রকম।
ইমাম তিরমিয়ী ও ইব্ন মাজাহ (র) ভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিয়ী (র) হাদীসটি হাসান বলে মন্তব্য করেছেন।
আবার এসবের মধ্যে কোনটা সর্বপ্রথম সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ব্যাপারেও আলিমগণের মতভেদ রয়েছে। একদল বলেন, সব কিছুর আগে কলম সৃষ্টি করা হয়েছে। এটা ইব্ন জারীর ও ইব্ন জাওয়ী (র) প্রমুখের অভিমত। ইব্ন জারীর বলেন, : আর কলমের পর সৃষ্টি করা হয়েছে হালকা মেঘ। তাদের দলিল হলো, সে হাদীস যা ইমাম আহমদ, আবু দাউদ ও তিরমিয়ী (র) উবাদা ইব্ন সামিত (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন :
‘আল্লাহ সর্বপ্রথম যা সৃষ্টি করেছেন তা হলো, কলম। তারপর তাকে বললেন, লিখ–তৎক্ষণাৎ সে কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে, তা লিখে চলল।’ হাদীসে এ পাঠটি ইমাম আহমদের। ইমাম তিরমিয়ী (র) হাদীসটি হাসান সহীহ গরীব বলে মন্তব্য করেছেন।
পক্ষান্তরে হাফিজ আবুল আলী হামদানী (র) প্রমুখ। এর বর্ণিত তথ্য মোতাবেক জমহুর আলেমগণের অভিমত হলো সর্বপ্রথম মাখলুক হলো, ‘আরশ’। ইব্ন জারীর যাহাহাক সূত্রে ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে এটিই বর্ণনা করেছেন। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত ইমাম মুসলিমের হাদীসটিও এর প্রমাণ বহন করে। তাহলো : ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ ইব্ন আমর ইব্ন আস (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছি!
‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগেই আল্লাহ সৃষ্টি জগতের তাকদীর লিপিবদ্ধ করে রাখেন। তখন তার আরশ ছিল পানির উপর।’
আলিমগণ বলেন, : আল্লাহ তা’আলার কলম দ্বারা মাকাদীর লিপিবদ্ধ করাই হলো, এ তাকদীর।
এ হাদীস প্রমাণ করে যে, এ কাজটি আরশ সৃষ্টির পরে হয়েছে। এতে আল্লাহ যে কলম দ্বারা মাকাদীর লিপিবদ্ধ করেছেন, আরশ তার আগে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে প্রমাণিত হয় যা জামহুর-এর অভিমত। আর যে হাদীসে সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করার কথা বলা হয়েছে তার অর্থ হলো, কলম এ জগতের সৃষ্টিসমূহের প্রথম। ইমরান ইব্ন হুসায়ন (র) থেকে ইমাম বুখারীর (র) বর্ণিত হাদীসটি এ মতের পরিপূরক। ইমরান ইব্ন হুসায়ন (রা) বলেনঃ ইয়ামানের কতিপয় লোক রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলল, দীন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন এবং এ সৃষ্টি জগতের সূচনা সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞেস করার উদ্দেশ্যে আমরা আপনার কাছে এসেছি। জবাবে তিনি বললেন, :
‘আল্লাহ ছিলেন, তার আগে কিছুই ছিল না এবং তাঁর আরশ ছিল পানির উপর। স্মরকলিপিতে তিনি সবকিছু লিপিবদ্ধ করে পরে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেন।‘
মোটকথা, তাঁরা নবী করীম (সা)-কে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির সূচনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিল। আর এ জন্য তারা বলেছিল, আপনাকে এ সৃষ্টি জগতের প্রথমটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে আমরা আপনার নিকট এসেছি। ফলে রাসূলুল্লাহ (সা) ঠিক ততটুকুই জবাব দেন যতটুকু তারা জানতে চেয়েছিল। এ কারণেই তিনি তাদেরকে আরশ সৃষ্টির সংবাদ দেননি, যেমন পূৰ্ববতী আবু রাষীনের হাদীসে দিয়েছেন। ইব্ন জারীর (র) বলেন, আর অন্যদের মতে আল্লাহ তা’আলা আরাশের আগে পানি সৃষ্টি করেছেন।
সুদ্দী আবু মালিক ও আবু সালিহা (র) সূত্রে ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে, মুররা সূত্রে ইব্ন মাসউদ (রা) থেকে এবং আরো কতিপয় সাহাবা থেকে বর্ণনা করেন যে, তারা বলেন : আল্লাহর আরশ পানির উপর ছিল আর পানির আগে তিনি কিছুই সৃষ্টি করেননি।
ইব্ন জারীর মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক (র) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন : আল্লাহ তা’আলা সর্বপ্রথম যা সৃষ্টি করেছেন, তাহলো-আলো ও অন্ধকার। তারপর দু’য়ের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করে তিনি অন্ধকারকে কালো আঁধার রাতে এবং আলোকে উজ্জ্বল দিবসে পরিণত করেন।
ইব্ন জারীর (র) আরো বলেন যে, কেউ কেউ বলেছেন, আমাদের প্রতিপালক কলমের পর যা সৃষ্টি করেছেন তাহলে কুরসী। তারপর কুরসীর পরে তিনি ‘আরশ সৃষ্টি করেন। তারপর মহাশূন্য ও আঁধার এবং তারপর পানি সৃষ্টি করে তার উপর নিজের আরশ স্থাপন করেন। বাকি আল্লাহ তা’আলা ভালো জানেন।
ইনশাল্লাহ আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া সম্পূর্ণটাই পড়ব।