সুকুমারী থেকে সুচিত্রা
১৮১৯ সালে রামমোহন লিখেছিলেন যে, মহিলাদের মেধা বা বুদ্ধি আছে, পুরুষরা তার কোনো পরীক্ষা নেননি। তা সত্ত্বেও তাদের তারা নির্বোধ বলে সাব্যস্ত করেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখার এই প্রবণতা অবাঞ্ছিত হলেও অপ্রত্যাশিত ছিলো না–বিশেষ করে যে-সমাজে নিন্দার্থে “স্ত্রীবুদ্ধি” বলে একটা কথা চালু ছিলো। সে জন্যে মেয়েরা অভিনয় করতে পারেন, এ ধারণাই কারো মাথায় আসেনি। চৈতন্যদেব মেয়েদের কিছু অধিকার এবং সম্মান দিয়েছিলেন। তাঁর অনেক মহিলা শিষ্যও ছিলেন। কিন্তু তবু ‘নাটক’ অভিনয়ের সময়ে তিনি নিজে স্ত্রীচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, মেয়েদের অভিনয় করতে ডাকেননি। তার প্রায় তিন শতাব্দী পরে গেরেশিম লেবেদেফ যখন ১৭৯৫ সালে বাংলায় কাল্পনিক সংবদল” নামে একটি নাটক লিখে তার অভিনয় করানোর উদ্যোগ নেন, তখন তাঁর বাংলার শিক্ষক গোলোকনাথ দাস এই অভিনয়ের জন্যে তাকে কেবল অভিনেতা নয়, একাধিক অভিনেত্রীও জোগাড় করে দিয়েছিলেন। এই নাটক প্রথম বার অভিনীত হয় ১৭৯৫ সালের ২৭শে নভেম্বর তারিখে আর দ্বিতীয় বার পরের বছর ২১শে মার্চ তারিখে। দুবারই তাঁর থিয়েটার দর্শকে ভরে গিয়েছিলো। এ থেকে বোঝা যায় যে, এই নাটকের অভিনয় বেশ সফল হয়েছিলো। মহিলারাও হয়তো ভালো অভিনয় করেছিলেন। এতে যে-মহিলারা অংশ নিয়েছিলেন, তারা ছিলেন বাইজি অথবা ঐ শ্রেণীর মহিলা। তথাকথিত ভদ্রমহিলা নন।
আঠারো শতকের শেষ দিকে কলকাতায় থিয়েটার অপরিচিত ছিলো না, কারণ ততোদিনে সেখানে একাধিক ইংরেজি থিয়েটার চালু হয়েছিলো। সেই পরিবেশে লেবেদেফ যে-উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা ছিলো ভোর রাতে যে-পাখি ডাকে, তার মতো। তারপর বহু বছর কোনো স্বদেশী অথবা বিদেশী বাংলা ভাষায় নাটক অভিনয় করানোর কোনো উদ্যোগ না-নিলেও বাঙালি সমাজ চিরকাল ঘুমিয়ে থাকতে পারেনি। প্রসন্নকুমার ঠাকুর অভিনয় করানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৮৩১ সালের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু তখন নারীচরিত্রে কোনো মহিলা অভিনয় করেছিলেন বলে জানা যায় না। অপর পক্ষে, ১৮৩৫ সালের অক্টোবর মাসে নবীনচন্দ্ৰ বসু নামে একজন ধনীর উদ্যোগে শ্যামবাজারে বিদ্যাসুন্দরের যে-অভিনয় হয়েছিলো, তাতে একাধিক মহিলা অভিনয় করেছিলেন। এঁদের মধ্যে দুজনের নামও জানা গেছে–রাধামণি আর জয়দুর্গা। রাধামণি অভিনয় করেছিলেন বিদ্যার ভূমিকায়। ষোলো-সতেরো বছর বয়সী এই মেয়েটি অভিনয় এবং গানে এতো পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন যে, সমসাময়িক পত্রিকায় তাঁর খুব প্রশংসা করা হয়েছিলো। তাঁর দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে একটি পত্রিকায় এও লেখা হয়েছিলো যে, তাঁর অভিনয় থেকে প্রমাণিত হয় যে, মহিলারা যথেষ্ট মেধার অধিকারী।
১৮২০ এবং ৩০-এর দশক পর্যন্ত যৌনকর্মীদের প্রতি সমাজের মনোভাব আদৌ কঠোর হয়নি। কিন্তু ১৮৫০-এর দশক নাগাদ তা কঠোর হতে আরম্ভ করেছিলো। সে জন্যেই রাধামণির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও ১৮৫০-এর দশক থেকে যেসব অভিনয় হতে আরম্ভ করে, তাতে নারীদের ডাক পড়েনি। তখন কুলীনকুলসর্বত্ব, বিধবাবিবাহ, শকুন্তলা, বিক্রমোর্বিশী ইত্যাদি নাটকের নারীচরিত্রে অভিনয় করেছেন পুরুষরা। এমন কি, সাহেব মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন ১৮৫৮ সালে নাটক লিখতে শুরু করলেন, তখনো তিনি নারীদের নিয়ে আসতে পারলেন না। আশ্চর্য নয়, বাংলা নাটককে তিনি অলীক কুনাট্য বলে নিন্দা করেছিলেন।
নারীচরিত্রে অভিনয়ের জন্যে মহিলাদের তো পাওয়া যেতোই না, এমন কি এসব চরিত্র অভিনয় করার উপযোগী পুরুষ পাওয়াও সহজ ব্যাপার ছিলো না। সে জন্যে নাট্যকারীদের এমনভাবে নাটক লিখতে হতো, যাতে নারীচরিত্র কম থাকে। কৃষ্ণকুমারী লেখার সময়ে মাইকেল নানা রকম যোগবিয়ােগ করে শেষ পর্যন্ত চারটি নারীচরিত্র রেখেছিলেন। কারণ তিনি চারজন অভিনেতাকে চিনতেন, যারা এই চরিত্রে অভিনয় করতে পারবেন বলে তিনি মনে করেছিলেন। কিন্তু জীবদ্দশায় তিনি অভিনেত্রী জোগাড় করতে সক্ষম হননি, অথবা বাংলা রঙ্গমঞ্চে নারীচরিত্রে মহিলাদের অভিনয় করতেও দেখেননি। তা সত্ত্বেও মৃত্যুর ঠিক আগে সামান্য টাকার জন্যে তিনি যখন বেঙ্গল থিয়েটারের ফরমায়শে মায়াকানন নাটকের ডিকটেশান দেন, তখনো শরৎচন্দ্র ঘোষকে বলেছিলেন যে, অভিনেত্রী ছাড়া নাটকের সফল অভিনয় হতে পারে না, অথবা অভিনয়ের উন্নতিও নয়। অনেকটা তার উৎসাহে শরৎচন্দ্ৰ অভিনেত্রী নিয়ে এসেছিলেন বাংলা রঙ্গমঞ্চে। কিন্তু তার মাস দেড়েক আগেই— ১৮৭৩ সালের ২৯শে জুন–মাইকেল শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
আসলে, বাঙালি সমাজে নারীদের প্রতি একটি দ্বৈত মনোভাব আগাগোড়াই লক্ষ্য করা যায়। নারীদের দু ভাগে ভাগ করে দেখেছে। এ সমাজ।। ঘরের নারী আর বাইরের নারী। পুরুষরা আশা করতেন ঘরের নারীরা হবেন পিঞ্জরাবদ্ধ বিহঙ্গীর মতো। সতীসাধ্বী হবেন। বন্দী থাকবেন অন্তঃপুরে। সন্তান জন্ম দেবেন, তাদের লালনপালন করবেন। ঘরের কাজ করবেন। আর, রাতের বেলা স্বামী বাড়িতে থাকলে মুখ বুজে তাঁকে শারীরিক সুখ দেবেন। শীৎকার কথাটা প্রযোজ্য ছিলো বেশ্যাদের জন্যে, ভদ্রমহিলাদের জন্যে নয়। তাঁরা লাজনম হবেন। যৌনসুখও নীরবে উপভোগ করবেন। তাঁরা প্রিয়া নন, তারা সন্তানের জননী।
ফুর্তি করার জন্যে পুরুষরা যেতেন বাইরের নারীদের কাছে। তাঁরা আশা করতেন এই নারীরা হবেন নাচ-গান জানা, খানিকটা লেখাপড়া জানা, চালাক-চতুর, বেশভূষায় স্মার্ট, যৌনকর্মে নানা কৌশলের অধিকারী। সবচেয়ে বড়ো কথা, এঁরা হবেন অসতী। এই নারীদের মধ্যে অনেকেই প্ৰচিলত অর্থে যৌনকামী ছিলেন না। তারা ছিলেন রক্ষিতা। বাবুরা রক্ষিতা রাখতেন। রক্ষিতা রেখে গর্ব করতেন। প্ৰেমভালোবাসাও করতেন এই রক্ষিতাদের সঙ্গে। রামমোহন রায়ের জীবদ্দশায় সবচেয়ে নাম-করা বাইজী ছিলেন নিকি। সাহেব-মেম সাহেবরাও তার সৌন্দর্য এবং গুণের ংসা করেছেন। এক লাখ টাকা দিয়ে এক বাবু তাঁকে রক্ষিতা রেখেছিলেন। ভাৰ্যার সঙ্গে প্রেম হতো না, ভাৰ্যা ছিলেন কেবল পুত্র জন্ম দেওয়ার জন্যে। যৌনতার ব্যাপারে এক আশ্চর্য রকমের দ্বৈতমান এবং ভণ্ডামি ছিলো পুরুষ সমাজের। তাঁরা স্ত্রী ছাড়া অন্য মেয়েদের উপভোগ করলে, অসৎ বলে তাদের অখ্যাতি হতো না, কিন্তু মেয়েরা অন্যের ছায়া মাড়ালেও অসতী বলে কুখ্যাত হতেন। অভিনয়ের জন্যে যখন নারীদের প্রয়োজন হলো তখন তাই ঘরের মেয়েরা নন, বাইরের মেয়েদের, “খারাপ মেয়েমানুষ”দের ডাক পড়লো।
বেঙ্গল থিয়েটার মহিলাদের মঞ্চে নিয়ে এসে বাংলা নাটক বিকাশ লাভের পথ প্রশস্ত করেছিলো। কিন্তু তখন মহিলাদের অভিনয়ে মস্ত দুটি বাধা ছিলো। একদিকে, অভিনয় করতে জানতেন, এমন মহিলা ছিলেন না–তারা তো সাত জন্মে অভিনয় করেননি! অন্য দিকে, দর্শকরা মঞ্চে মহিলাদের দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন না। অনেকে দেখতে চাইতেনও না। ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর এবং শিবনাথ শাস্ত্রী কেবল সমাজসংস্কারক ছিলেন না। তারা ছিলেন নারীদরদী এবং মহিলাদের উন্নতি চাইতেন আন্তরিকভাবে। দুজনই অভিনয় দেখতেও ভালোবাসতেন। কিন্তু বেঙ্গল থিয়েটার অভিনেত্রীদের নিয়ে আসার পর এরা আর কোনোদিন সাধারণ রঙ্গমঞ্চে অভিনয় দেখতে যাননি। সে যুগের বিখ্যাত ব্ৰাহ্ম নেতা কেশব সেনও ছিলেন এঁদের মতো। তিনিও মহিলাদের উন্নতি চাইতেন। মেয়েদের ব্যাপারে বেশ আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিও ছিলো তাঁর। এমন কি, নিজে নাটকের অভিনয়ও করেছেন। কিন্তু ১৮৭৯ সালে তিনি সাধারণ রঙ্গমঞ্চে মহিলাদের নিয়ে অভিনয় করার বিরুদ্ধে সমালোচনা করেছিলেন। তাঁর সুলভ সমাচার পত্রিকায়। এঁদের মতো অন্য অনেক দর্শকেরও মহিলাদের অভিনয়ের ব্যাপারে বিরূপ মনোভাব ছিলো।
নারীদের দিয়ে স্ত্রীভূমিকায় অভিনয় করানোর উদ্যোগ নিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার রীতিমতো অভিনয়ের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিলো। গোড়াতে যে-চারজন অভিনেত্রী এসেছিলেন, তারা ছিলেন জগত্তারিণী, গোলাপসুন্দরী, এলোকেশী এবং শ্যামা। এঁদের অভিনয়ের কোনোই অভিজ্ঞতা ছিলো না। সবাই লেখাপড়াও জানতেন না। কিন্তু সবাই কমবেশি নাচ-গান জানতেন। জীবিকার প্রয়োজনেই এঁরা ছেলেবেলা (অথবা মেয়েবেলা) থেকে নাচ-গান শিখতেন, কারণ এঁরা ছিলেন রূপজীবিনী। একে মহিলাদের মঞ্চে নিয়ে আসা, তদুপরি সেই মহিলারা আবার রূপজীবিনী–এই দুই কারণে পুরুষ-পরিচালিত অনেক পত্রপত্রিকাই বেঙ্গল থিয়েটারের তীব্র সমালোচনা করেছিলো। কিন্তু সমালোচনা সত্ত্বেও বেঙ্গল থিয়েটার যে তুলনামূলকভাবে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিলো তার অন্যতম কারণ হয়তো অভিনেত্রীদের নিয়োগ।
একটি পত্রিকা বেঙ্গল থিয়েটারের সমালোচনা করে বলেছিলো যে, এঁরা “বেশ্যা”দের মঞ্চে এনে নাটককে যাত্রার স্তরে নামিয়েছেন। তার মানে তখন নাটক এবং যাত্রারও বড়ো রকমের পার্থক্য ছিলো। নাটক ছিলো শিক্ষিত ভদ্রলোকদের, ধনী বাবুদের। আর, যাত্রা ছিলো সাধারণ মানুষদের। আশা করা হতো পাশ্চাত্য প্রভাবিত নাটকের রুচি হবে যাত্রার চেয়ে উন্নত মানের। ভদ্রলোকদের মঞ্চে তাই অভিনেত্রীদের ডাক পড়েনি। কিন্তু যাত্রায় তারা অংশ নিতেন। সমাজের এই মূল্যবোধকে প্রশ্ন করে অভিনেত্রীদের নিয়ে এসে শরৎচন্দ্র ঘোষ যে-ভূমিকা পালন করেছিলেন তা কতো গুরুত্বপূর্ণ এবং যে-সৎসাহস দেখিয়েছিলেন, তা কতো অসাধারণ, তা বোঝা যায় আরও ৪০ বছর পরের একটি ঘটনা থেকে। ১৯১৩ সালে যখন দাদাসােহবে ফালকে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তখনো নায়িকার ভূমিকায় তাঁকে নিতে হয়েছিলো রেস্টুরেন্টের এক পুরুষ রাধুনিকে। আর, ঢাকায় পূর্ববঙ্গ সরকার ১৯৫৮ সালেও ‘বেদের মেয়ে’ নাটক করার অনুমতি দিয়েছিলো। এই শর্তে যে, তাতে কোনো মহিলা অভিনয় করতে পারবেন না। এ দিক দিয়ে বিচার করলে শরৎচন্দ্র ঘোষ রীতিমতো ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
তবে স্বীকার না-করে উপায় নেই যে, ১৮৭২ সালে সাধারণ রঙ্গমঞ্চ স্থাপিত হওয়ার পর নারীচরিত্রে মহিলাদের অভিনয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিলো। আগে হোক পরে হোক, মহিলারা আসতেনই! তাই একবার সমাজের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে শরৎচন্দ্র মহিলাদের মঞ্চে নিয়ে আসার পর অন্য সব থিয়েটারই তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেছিলো। এমন কি, ১৮৮০-এর দশকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের উদ্যোগে তাদের বাড়ির নিজস্ব মঞ্চে যেসব অভিনয় হয়, তাতেও পরিবারের মহিলারা অংশ গ্রহণ করেন, যদিও সাধারণ রঙ্গমঞ্চে “ভদ্রমহিলাদের” অভিনয় পরবর্তী কয়েক দশকের মধ্যেও হয়নি।
মহিলারা অভিনয় করার শিক্ষা সেকালে পাননি, কিন্তু তাদের অনেকের যে অভিনয় করার স্বাভাবিক ক্ষমতা ছিলো, তা অচিরেই প্রমাণিত হয়। বেঙ্গলের দ্বিতীয় অভিনয়ে–২৩শে আগস্ট ১৮৭৩ তারিখে–যোগ দিয়েছিলেন গোলাপসুন্দরী। তিনি ভালো গান জানতেন, বিশেষ করে কীর্তন গান। তা ছাড়া, অল্পকালের মধ্যেই অভিনয়ে বিশেষ পারদর্শিতা দেখান। নানা ধরনের ভূমিকায় খ্যাতির সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। তিনি। বেঙ্গল থিয়েটারে তখন কাজ করতেন সেকালের বিখ্যাত অভিনেতা অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফী। তিনি গোলাপসুন্দরীকে অভিনয় শিখিয়ে ভালো অভিনেত্রীতে পরিণত করেন।
গোলাপ যেসব নাটকে অংশ নেন, তার মধ্যে একটি ছিলো গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে উপেন্দ্রনাথ দাসের শরৎ-সরোজিনী। ১৮৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে অভিনীত এই নাটকে তিনি সুকুমারী নামে একটি চরিত্রে অভিনয় করেন। তার অভিনয় এতো সুন্দর হয়েছিলো যে, দর্শকরা তাঁর নামই দেন সুকুমারী। অতঃপর এই নামেই তিনি বেশি পূরিচিত হয়েছিলেন। উপেন্দ্রনাথ দাস তখন এই থিয়েটারের পরিচালক ছিলেন। তখন সেখানে গোষ্ঠবিহারী দত্ত নামে এক তরুণ অভিনেতা ছিলেন। গোলাপসুন্দরীর সঙ্গে তার ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয় এবং উপেন্দ্রনাথের উদ্যোগে তিনি তাঁকে বিয়ে করেন। তারপর থেকে গোলাপসুন্দরীর নাম হয় সুকুমারী দত্ত। ভদ্রলোকের ছেলে বিয়ে করেছেন এক প্রাক্তন রূপজীবিনীকে–এই ঘটনাকে ঘিরে সমাজে গোষ্ঠবিহারীর এতো সমালোচনা হয়েছিলো যে, তিনি সুকুমারীকে ফেলে রেখে কেবল কলকাতা থেকে নয়, দেশ থেকেই পালিয়ে যান। জাহাজের খালাশি হয়ে তিনি চলে যান বিলেতে। ওদিকে, সুকুমারী কেবল এই থিয়েটারে থেকে যাননি, অভিনয়ও চালিয়ে যান। তিনি। বস্তৃত, আর্থিক কারণেই দীর্ঘদিন অভিনয় চালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
স্বামী পালিয়ে যাওয়ার অল্পদিনের মধ্যে (অগস্ট ১৮৭৫) তাঁর নামে ‘অপূর্ব সতী’ নামে একটি নাটক প্ৰকাশিত হয় এবং তার পর-পরই তা সফলভাবে অভিনীত হয়। দর্শকরা প্রচুর প্রশংসাও করেছিলেন এ নাটকের। কিন্তু সুকুমার সেনের মতে, এ নাটক সুকুমারীর রচনা নয়। এ বই-এর নামপত্রে রচয়িতা হিশেবে নাম আছে দুটিআশুতোষ দাস এবং সুকুমারী দত্ত। সুকুমার সেনের মতে, আশুতোষ দাস নামটিও ছদ্মনাম, এর আসল লেখক উপেন্দ্ৰনাথ দাস। এ নাটকের ভাষা এতো আড়ষ্ট এবং সংস্কৃতপ্রভাবিত যে, এটি অশিক্ষিতা অথবা সামান্য শিক্ষিতা সুকুমারীর পক্ষে লেখা সম্ভব ছিলো বলে মনে হয় না। তবে এর কাহিনীর সঙ্গে সুকুমারীর নিজের প্রথম জীবনের অনেকটাই মিল ছিলো। সুকুমারীর মতোই এর নায়িকা নলিনী সামান্য লেখাপড়া জানে, তার মা বারবণিতা। সেও সুকুমারীর মতো প্রেমে পড়ে বিয়ে করতে চায়, কিন্তু বাধার মুখোমুখী হয়। নায়িকা নলিনী আত্মহত্যা করে প্রাণ জুড়ায়, অপর পক্ষে, সুকুমারী স্বামীপরিত্যাক্ত হয়ে প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকেন। অভিনয় করতে করতে ১৮৮৩ সালে সুকুমারী শুধুমাত্র মেয়েদের নিয়ে হিন্দু ফিমেল থিয়েটার নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন এবং সেখানে ‘শুম্ভ সংহার’ নামে একটি নাটক অভিনয় করান। ১৮৯৮ সালেও তিনি বেঙ্গল এবং মিনার্ভা থিয়েটারে একাধিক নাটকে অভিনয় করেছিলেন। দুর্গেশনন্দিনীতে বিমলা, পুরুবিক্রমে রাণী ঐলবালা, সরোজিনীতে সরোজিনী, সুরেন্দ্র-বিনোদিনীতে বিরাজমোহিনী, মৃণালিনীতে গিরিজায়া, অশ্রুমতীতে মলিনা, বিষবৃক্ষে সূর্যমুখী ইত্যাদি চরিত্রে তাঁর অভিনয় সমালোচকদের প্রশংসা লাভ করেছিলো।
গোলাপসুন্দরী বেশ খ্যাতি লাভ করলেও বাংলা রঙ্গমঞ্চের আদিপর্বের সবচেয়ে বিখ্যাত অভিনেত্রী ছিলেন বিনোদিনী। সুকুমারীর সঙ্গে একত্রে তিনি কিছুকাল গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে কাজ করেছেন। দিদি ডাকতেন তাঁকে। অভিনয় ছাড়া তিনি খুব ভালো গান জানতেন। তদুপরি, তাঁর যথেষ্ট সাহিত্যিক গুণও ছিলো। বাঙালি মহিলারা যেসব আত্মজীবনী লিখেছিলেন, তাদের মধ্যে বিনোদিনীর ‘আমার কথা’ সত্যকথন এবং ভাষার সরলতার জন্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। উল্লেখযোগ্য পুরুষ চরিত্র বিশ্লেষণেও। আত্মজীবনী ছাড়া তিনি কিছু কবিতাও প্রকাশ করেছিলেন। ১৮৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে দ্ৰৌপদীর সখীর ভূমিকায় প্রথমবারের মতো মঞ্চে আত্মপ্রকাশ করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্ৰ তেরো-চোদ্দো বছর। বেতন ঠিক হয় দশ টাকা। তাঁর বংশ পরিচয় সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে তিনি সাধারণ গৃহস্থ পরিবারের সন্তান ছিলেন বলে মনে করার কারণ নেই। তাদের বাড়ির খোলাঘরে যেসব ভাড়াটে ছিলেন, তারা স্বামীস্ট্রীর মতো থাকলেও বিবাহিত ছিলেন না–বিনোদিনী নিজেই আত্মজীবনীতে এ কথা লিখেছেন। তা ছাড়া, নিজেকে তিনি সবিনয়ে অনেকবারই বারনারী ও বারাঙ্গনা বলেছেন।
অল্পকালের মধ্যে এই থিয়েটারের সঙ্গে তিনি উত্তর ভারতের বহু জায়গায় ভ্ৰমণ করেন। দুবছর পরে তিনি ন মাসের জন্যে বেঙ্গল থিয়েটারে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু গিরিশ ঘোষের কথায় তিনি ১৮৭৭ সালে সেপ্টেম্বরে বেঙ্গল ছেড়ে ন্যাশনাল থিয়েটারে ফিরে আসেন। গিরিশ ঘোষের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ তার নিজের জন্যে খুবই কাজে লেগেছিলো, কারণ গিরিশই তাকে উন্নত মানের অভিনয় শিক্ষা দিয়েছিলেন। গিরিশকে তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে গুরু এবং দেবতা বলে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু এই দেবতা যে কতোটা স্বার্থপর ছিলেন এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে বিনোদিনীকে কতোটা ব্যবহার করেছিলেন, পরের ঘটনাবলী থেকে সেটা গোপন থাকে না।
১৮৮৩ সালের গোড়ার দিকে বিনোদিনীকে নিয়ে গিরিশ ঘোষ স্টার থিয়েটার গড়ে তুলেছিলেন। এই থিয়েটার করার ব্যাপারে তাঁদের আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী— গুরমুখরায়। আসলে থিয়েটার নয়, এই ভদ্রলোকের লক্ষ্য ছিলো বিনোদিনীকে পাওয়া। বারবণিতা ছিলেন বটে, তবু বিনোদিনীর পক্ষে গুরমুখরায়ের কাছে নিজেকে তুলে দেওয়া সহজ ছিলো না। কারণ তার আগে থেকেই তিনি একজন ধনী জমিদারের রক্ষিতা ছিলেন। তাকে আন্তরিকভাবে ভালোওবাসতেন তিনি। আর এই জমিদারও তাঁকে নিজের প্রেমিকা বলে গণ্য করতেন। বিনোদিনী অভিনয় করবেন–এতে তাঁর আপত্তি ছিলো না। বাধা দেখা দেয়। অন্য দিক থেকে। গিরিশ ঘোষ এবং বিনোদিনী যে-ন্যাশনাল থিয়েটারে কাজ করতেন, তার মালিক ছিলেন প্রতাপচাদ জহুরী নামে এক অবাঙালি ব্যবসায়ী। শখ হিশেবে নয়, থিয়েটারকে তিনি ব্যবসা হিশেবেই দেখতেন। তাঁর অধীনে স্বাধীনভাবে কাজ করা গিরিশ ঘোষ এবং তার সহযোগী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তখন গিরিশ ঘোষ একটি নতুন থিয়েটার গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
থিয়েটার গড়ে তোলার জন্যে যে-টাকা পয়সার দরকার ছিলো, তা গিরিশ জোগাড় করতে পারেননি। সেই পরিস্থিতিতে বিশ-একুশ বছরের যুবক গুরমুখরায় থিয়েটার গঠনে সাহায্য দিতে এগিয়ে আসেন। আগেই বলেছি, থিয়েটারের চেয়ে বিনোদিনীর দিকেই ছিলো তার বেশি আকর্ষণ। তিনি তাই বিনোদিনীকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নগদ দিয়ে তাকে থিয়েটার গঠনের উদ্যোগ ছেড়ে দেওয়ার জন্যেও অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু থিয়েটার ছিলো বিনোদিনীর প্রাণ। একমাত্র থিয়েটার গঠনের শর্তেই তিনি নিজের প্রেমিককে ত্যাগ করে গুরমুখরায়কে গ্রহণ করতে রাজি হন। ওদিকে, তার প্রেমিক-জমিদার। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে হত্যা করতে উদ্যত হন। লাঠিয়াল নিয়ে এসে নতুন থিয়েটার ভেঙে ফেলতেও চেষ্টা করেন। তিনি। সাময়িকভাবে আত্মগোপন করেও বিনোদিনী তার হাত থেকে রক্ষা পাননি। একদিন তলোয়ার হাতে জমিদার ঢুকে পড়েন বিনোদিনীর শোবার ঘরে। খুন করার জন্যে চেষ্টাও করেন। কিন্তু ভাগ্য এবং উপস্থিত বুদ্ধির জোরে বিনোদিনী তলোয়ারের কোপ থেকে রক্ষা পান। বস্তৃত, তিনি থিয়েটার গড়ে তোলার জন্যে যে-আত্মত্যাগ স্বীকার করেছিলেন তা অতি অসাধারণ। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, এই বিরাট আত্মত্যাগ সত্ত্বেও কারো কারো বিরোধিতার কারণে স্টারে তিনি সাড়ে তিন বছরও কাজ করতে পারেননি। গুরমুখরায়ও তাকে সমর্থন দিতে পারেননি। কারণ থিয়েটার শুরু করার পর তিনি বেঁচেছিলেন মাত্র বছরখানেক। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার তাঁকে যারা সরিয়ে দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে গিরিশ ঘোষও ছিলেন।
স্টার থিয়েটারে অভিনয়ের সময়েই তিনি খ্যাতির শিখরে পৌঁছেছিলেন। একশো বছর পরেও তাঁর নাম টিকে আছে, যদিও মাত্র চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সে তিনি অবসর নিতে বাধ্য হন। সন্দেহ হয়, তিনি যখন অবসর নেন, তখনো তার প্রতিভার চরম বিকাশ হয়েছিলো কিনা।
স্টারের আমলে গিরিশ ঘোষ পুরোদমে নাটক লিখতে আরম্ভ করেছিলেন। তিনি পৌরাণিক এবং ধর্মীয় নাটকসহ বিভিন্ন ধরনের নাটকই লিখেছিলেন। এমন কি, শেক্সপীয়রের অনুবাদও শুরু করেছিলেন। এই থিয়েটার স্থাপিত হওয়ার পর বছর দুই পরে তাঁর লেখা চৈতন্যলীলা নাটকে চৈতন্যের ভূমিকায় নেমেছিলেন বিনোদিনী। ১৮৮৫ সালের ৭ই অক্টোবর সেই নাটকের অভিনয় দেখতে এসেছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংস। তিনি তার ভাববিহবল অসাধারণ অভিনয় দেখে এতো মুগ্ধ হন যে, অভিনয় শেষ হবার পর তাঁকে আশীৰ্বাদ করে যান। যে-কালে বিদ্যাসাগর মঞ্চে নারীদের আগমনে অভিনয় দেখাই বন্ধ করেছিলেন, সেই সময়ে রামকৃষ্ণের মতো একজন ধর্মগুরু। তাঁর অভিনয় দেখায় এবং তাকে আশীৰ্বাদ করায় মঞ্চে মেয়েদের অভিনয় হিন্দু সমাজের এক ধরনের স্বীকৃতি লাভ করেছিলো। এর পরেও রামকৃষ্ণ দুবার স্টারে অভিনয় দেখতে এসেছিলেন। নরেন্দ্রনাথ দত্ত তখনো স্বামী বিবেকানন্দ হননি। কিন্তু তিনিও একাধিকবার স্টারে অভিনয় দেখতে আসেন। আর আসেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর নিজের লেখা মৃণালিনীর অভিনয় তিনি দেখেছিলেন ১৮৮৫ সালের ২৫শে মার্চ তারিখে। সেই নাটকের মনোরমার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিনোদিনী। এই অভিনয় দেখে বঙ্কিমচন্দ্ৰ মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, তিনি মনোরমার চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন কাগজে-কলমে। কিন্তু সেই মনোরমাকে তিনি যে নিজের চোখের সামনে দেখতে পাবেন এটা আশা করেননি। বিনোদিনী আসলে মনোরমাকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন।
৫০টিরও বেশি নাটকে প্রায় ৯০টি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিনোদিনী। তার মধ্যে পৌরাণিক এবং ধর্মীয় নাটকে তাঁর অভিনয় ছিলো বিশেষ করে স্মরণীয়। এসব অভিনয় কেবল রক্ষণশীল হিন্দুরা দেখেননি, বরং তাঁরা উপভোগও করেছিলেন। এভাবে বিনোদিনী মহিলাদের অভিনয়কে বাঙালি দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্য করার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। অভিনয় ছাড়া গানেও তাঁর অবদান কম নয়। বিশ শতকের গোড়ায় যখন বঙ্গদেশে গ্রামোফোন চালু হয়, তখন তিনি এগিয়ে আসেন গান গাইবার জন্যে। তার রেকর্ড করা অনেকগুলোর গানের মধ্যে কয়েকটি রক্ষা পেয়েছে। এ গান থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, তিনি কতো উচুমানের গায়িকা ছিলেন।
ব্যক্তি বিনোদিনীর নামে-মাত্র বিয়ে হয়েছিলো তাঁর বয়স যখন বছর পাঁচেক। কিন্তু ঐ পর্যন্ত। সে স্বামীর সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ ছিলো না। পরে তিনি একেএকে তিনজন ধনীর রক্ষিতা হন। এর মধ্যে শেষজনের সঙ্গে তার কেটেছে একত্রিশ বছর। তিনি বিনোদিনীর জন্যে বাড়িসহ কিছু সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন। সেই দিয়েই জীবনের শেষ ২৯ বছর বেঁচে ছিলেন। নয়তো তার অবস্থা হতো পারতো সুকুমারীর মতো নিঃস্ব, রিক্ত। শেষ জীবনে সুকুমারী কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন, কেউ তার খোজ রাখে না। কিন্তু বিনোদিনী শেষ পর্যন্ত সচ্ছল অবস্থায় থেকে বিদায় নিতে পেরেছিলেন। ১৯৪১ সালে।
বিনোদিনীর বছর পাচেকের ছোটো ছিলেন। কিরণবালা। তিনিও জন্মেছিলেন। কলকাতায় নিষিদ্ধ পাড়ায় এক বারবণিতার ঘরে। তাঁর পিতৃপরিচয় জানা যায় না। কখন থেকে তিনি অভিনয় শুরু করেন তাও নয়। তবে বিনোদিনীর সঙ্গে স্টার থিয়েটারে অভিনয় করার সময় থেকে তিনি পরিচিতি লাভ করতে থাকেন। গিরিশ ঘোষই তাঁকে অভিনয় করতে শিখিয়েছিলেন। যতোদিন বিনোদিনী স্টারে ছিলেন, ততোদিন নিজের যোগ্যতার কারণেই তিনি সব সময়ে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করতেন। কিন্তু ১৮৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে বিনোদিনী যখন মঞ্চ ছেড়ে স্থায়ীভাবে রক্ষিতার ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হন, তখন যেসব ভূমিকায় তিনি অভিনয়। করতেন, সেসব ভূমিকায় নামেন কিরণবালা। এসব চরিত্রে অভিনয়ে বিনোদিনী যেআদর্শ রেখে গিয়েছিলেন, কিরণবালা তা যোগ্যতার সঙ্গে বজায় রাখতে পেরেছিলেন। এ দিয়ে প্রমাণিত হয় যে, অত্যন্ত উঁচুদরের অভিনয় ক্ষমতা ছিলো তাঁর। তবে তা সত্ত্বেও রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে তিনি যে খুব বড়ো নায়িকা হিশেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করতে পারেননি, তার কারণ তাঁর অকাল মৃত্যু। মাত্র বাইশ বছর বয়সে তিনি বসন্ত রোগে মারা যান।
বিনোদিনীর পরে সে যুগের সবচেয়ে নাম-করা অভিনেত্রী ছিলেন তিনকড়ি দাসী। তারও মা ছিলেন বারবণিতা। তিনিও অভিনয়ের দিকে এসেছিলেন টাকার অভাবে। পরবর্তী কালে যিনি এতো বড়ো অভিনেত্রী হয়েছিলেন, ১৮৮৬ সালের জুন মাসে তিনি যখন গিরিশ ঘোষের বিম্বমঙ্গল নাটকে অভিনয় আরম্ভ করেন, তখন সে ভূমিকা ছিলো নির্বােক সখীর। সত্যিকারভাবে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। মীরাবাঈ নাটকে, মীরার ভূমিকায়। বিনোদিনীর মতো তিনিও ভালো অভিনয় শিখেছিলেন গিরিশ ঘোষের কাছে। ১৮৯৩ সালে তারই নাটক ম্যাকবেথে লেভী ম্যাকবেথের ভূমিকায় অভিনয় করে তিনকড়ি সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ান। গিরিশ ঘোষের আরও কয়েকটি নাটকে তিনি প্রধান ভূমিকায় নেমেছিলেন। তাঁর অভিনয় পারদর্শিতায় মুগ্ধ হয়ে গিরিশ ঘোষ বলেছিলেন যে, বাংলার রঙ্গমঞ্চে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী। আসলে অভিনয়ে তাঁর আকর্ষণ এতো আন্তরিক ছিলো যে, তিনি এর জন্যে অন্য লোভ ত্যাগ করেছিলেন। যেমন, প্রথম দিকে তাঁকে মাসে দু শো টাকা দিয়ে একজন ধনী রক্ষিতা রাখতে চাইলেও তিনি চল্লিশ টাকা বেতনের অভিনেত্রীর কাজ ছাড়তে রাজি হননি। দুশো টাকা তখন অনেক টাকা। স্বেচ্ছায় তা ত্যাগ করায় তাঁর মা তাঁকে প্রহার করেছিলেন। টাকার প্রতি তাঁর মমতা বস্তৃত কমই ছিলো। তাই ১৯১৭ সালে মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর দুটি বাড়ি হাসপাতালের জন্যে দান করে গিয়েছিলেন।
থিয়েটারে কাজ শুরু করার পর একাধিক পুরুষের সঙ্গে তাঁর প্রণয়ের সম্পর্ক হয়েছিলো। এমন কি, স্বয়ং গিরিশ ঘোষের সঙ্গেও তার প্রণয় ছিলো বলে লোকজন বলতো। তবে জীবনের শেষ দিকের বছর বিশেক তিনি এক বাবুর রক্ষিতা ছিলেন। নিজের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই বাবু তাঁকে যত্নের সঙ্গেই রেখেছিলেন বলে মনে হয়। তিনকড়ি তাঁর তৃতীয় বাড়িটি দান করে গিয়েছিলেন এই বাবুর পুত্ৰকে।
তিনকড়ির কয়েক বছরের ছোটো ছিলেন কুসুমকুমারী (১৮৭৬৫-১৯৪৮)। নাচের পথ ধরে মিনার্ভা থিয়েটারে প্রবেশ করেছিলেন তিনি। তারপর গ্র্যান্ড, ক্লাসিক, কোহিনুর, স্টার ইত্যাদি অনেক থিয়েটারেই যোগ্যতার সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। আলিবাবা নাটকে মার্জিনার ভূমিকায় তাঁর অভিনয় খুবই জনপ্রিয় হয়েছিলো। তিনিই প্ৰথম অভিনেত্রী যিনি অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের নাচ শেখাতেন। ভালো গানও জানতেন তিনি।
কুসুমকুমারীর মোটামুটি একই বয়সী ছিলেন নরীসুন্দরী। তিনিও তাঁর আগেকার অভিনেত্রীদের মতো বারবণিতার সন্তান ছিলেন। সঙ্গীতশিল্পী হিশেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। অন্যদের তুলনায় একটু বেশি বয়সে–প্রায় ষোলো-সতেরো বছর বয়সে— ১৮৯২ সালে তিনি স্টার থিয়েটারের মঞ্চে উঠেছিলেন–ঋষ্যশৃঙ্গ নাটকের প্রধান চরিত্রে। বছর দুয়েক পরে চন্দ্ৰশেখর নাটকে তিনি দলনীর ভূমিকায় সত্যিকার খ্যাতি লাভ করেন। তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি নানা চরিত্রে দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করে বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে স্থায়ী নাম রেখে গেছেন। ১৯১১ সাল পর্যন্ত তিনি একটানা স্টারের অভিনেত্রী ছিলেন। তারপর কখনো মির্নাভা, কখনো স্টার, কখনো অন্য কোনো থিয়েটারে কাজ করে শেষ পর্যন্ত ১৯২৬ সালে মঞ্চ থেকে সরে যান। তিনি মারা যান ১৯৩৯ সালে।
নরীসুন্দরীর সমবয়সী ছিলেন তারাসুন্দরী। তিনিও বারবণিতার সন্তান। ১৮৮৪ সালে বছর সাতেক বয়সে তিনি বিনোদিনীর সাহায্যে স্টার থিয়েটারের মঞ্চে প্রবেশ করেন। গিরিশ ঘোষের চৈতন্যলীলা নাটকে বিনোদিনী নিমাই-এর ভূমিকায় অভিনয় করতেন। তারাসুন্দরী সেই নাটকেই একটি ছেলের ভূমিকায় নামেন। তিনি গিরিশ ঘোষের আরও কয়েকটি নাটকে অংশ নিয়েছিলেন। প্রথম বালিকা চরিত্রে অভিনয় করেন হারানিধি নাটকে। ১৮৯১ থেকে তিনি অভিনয় করতেন নায়িকার ভূমিকায়। তবে তাঁর খ্যাতি আসে ১৮৯৪ সালে চন্দ্ৰশেখর নাটকে শৈবলিনীর ভূমিকায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। অভিনয়ে তিনি এতো পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন যে, এক সময়ে সবাই তাকে বলতেন নাট্যসমাজ্ঞী।
স্টারের পর ১৮৯৭ সাল থেকে তারাসুন্দরী ক্লাসিক থিয়েটারে প্রধান অভিনেত্রীতে পরিণত হন। প্রথমে অমৃতলাল মিত্রের কাছে অভিনয় শিখলেও, ক্লাসিকে এসে তিনি অমরেন্দ্রনাথ দত্তের সাহচর্যে অভিনয়ে রীতিমতো পরিণতি লাভ করেন। এখানে তিনি অনেকগুলো নাটকের নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন এবং তাঁর খ্যাতি দীর্ঘস্থায়ী হয়। ১৯২২ সাল পর্যন্ত তিনি থিয়েটারের জগতে নিয়মিত কাজ করেছেন। কিন্তু একবার অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার পরও শিশির ভাদুড়ীর সঙ্গে অভিনয় করেছেন জনা এবং রিজিয়ার ভূমিকায়। তাঁর সে অভিনয় কিংবদন্তীতে পরিণত হয়। অভিনয় ছাড়া তারাসুন্দরী গল্প-কবিতাও লিখতেন বিনোদিনীর মতো।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনিও তাঁর পূর্ববর্তী অভিনেত্রীদের মতো একাধিক ‘বাবুর রক্ষিতা ছিলেন। যিনি নাটকের জগতে ছিলেন অমন সম্মানের পাত্রী, ব্যক্তিগত জীবনে তিনিই সম্মান, সম্রাম অথবা স্বীকৃতি পাননি, অথবা বলা যেতে পারে, সামান্যই পেয়েছিলেন। যে-পুরুষসমাজ ভেঙে পড়তো তাঁর অভিনয় দেখতে, সেই পুরুষসমাজই ব্যক্তি তারাসুন্দরীকে শ্রদ্ধা দূরে থাক, সাধারণ স্বীকৃতি দিতেও তৈরি ছিল না।
তিনকড়ি, নরীসুন্দরী, তারাসুন্দরীদের যুগের আরও একজন সুপরিচিত অভিনেত্রী ছিলেন নীরদাসুন্দরী। তাঁর জন্ম বস্তিতে, মা কাজ করতেন ঝিয়ের। নীহারবালা, প্ৰভা দেবী, রমা বসু ইত্যাদি সবারই পরিচয় ছিলো কমবেশি একই রকমের।
মোট কথা, বাংলা থিয়েটারের আদি যুগের নাম-করা অভিনেত্রীরা সবাই এসেছিলেন বারবণিতাদের ঘর থেকে, অথবা সমাজের একেবারে নিচের তলা থেকে। কেউ কেউ অভিনেত্রী হয়ে নিজেরা বারনারী হয়েছিলেন। এরা সবাই কমবেশি গান জানতেন। নাচও জানতেন বেশির ভাগই। এমন কি, অল্পবিস্তর লেখাপড়াও তাঁরা শিখেছিলেন। প্রধানত দারিদ্র্যের কারণে তারা অভিনয়ে এসেছিলেন। কেউ কেউ এসেছিলেন পতিতাবৃত্তি থেকে রক্ষা পেতে, অথবা আর-একটু সম্মানজনক কাজের জন্যে। সুকুমারী, বিনোদিনী, তিনকড়ি, তারাসুন্দরী প্রমুখ অভিনেত্রী তা পেয়েওছিলেন। কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে, একবার রূপজীবিনীর ভূমিকা ত্যাগ করার পর তাঁরা বৃহত্তর সমাজে গৃহীত হয়েছিলেন অথবা বিয়ে-থা করে সংসার করেছিলেন। বরং দেখতে পাই, তারা অভিনয় থেকে অর্থকড়ি উপার্জন করলেও সমাজে টিকে থাকার জন্যেই কারো না কারো রক্ষিতায় পরিণত হয়েছিলেন। নিজেরা গ্রানির মধ্যে থেকেও অন্যদের আনন্দ দিয়েছেন। দেহ এবং রূপ দিয়ে উপার্জন করার পাপবোধ থেকে শেষ বয়সে এই খারাপ মেয়েমানুষরা’ ধর্মের দিকেও একটু বেশি করেই বুকে পড়তেন। কেউ কেউ দারুণ দারিদ্র্যের মধ্যে ভিক্ষা করেও জীবনের শেষ বছরগুলো কাটিয়েছেন।
আমরা পরের আলোচনা থেকে দেখবো বাংলা রঙ্গমঞ্চের আদি পর্ব শেষ হবার অনেক কাল পরেও অভিনেত্রীরা আসতেন সমাজের নিচের তলা থেকে। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ–যারা অভিনয় করতেন সমাজ তাদের গণ্য করতো দেহজীবী বলে। তাদের অভিনয় এবং রূপের প্রশংসা হলো পত্রপত্রিকায় এবং বাড়িতে বাড়িতে, কিন্তু ব্যক্তি হিশেবে তাঁরা বিবেচিত হতেন। কুলটা নারী বলে। এই অভিনেত্রীদের সমাজের অভিজাতরা কতোটা ঘূণা করতেন, তা বোঝা যায় হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের একটি গল্প থেকে। তাকে নাকি এক পথচারী থিয়েটারের পথ জিজ্ঞেস করেছিলেন। তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন যে, তিনি সে পথ চেনেন না। কিন্তু একটু পরে তাঁর যখন মনে হলো যে, পথ চিনেও চেনেন না বলায় সেটা মিথ্যে বলা হলো, তখন তিনি ফিরে গিয়ে সেই পথচারীকে বললেন যে, তিনি পথ চেনেন, কিন্তু বলবেন না। তিনি ব্ৰাহ্ম ছিলেন। এবং তার রুচিও ছিলো ষোলো আনা ব্ৰাহ্ম অথবা পিউরিটানা-রুচি। এতোটা নাহলেও বিশ শতকে এসেও অনেকে তারই মতো থিয়েটারকে অপবিত্র জায়গা বলে বিবেচনা করতেন, অভিনেত্রীদের কারণে।
বাইরের নারীদের নিয়ে ফুর্তি করলেও ঘরের নারীদের সে যুগের পুরুষরা মঞ্চে নিয়ে আসা দূরে থাক, মঞ্চে আনার কথা ভাবেনওনি। সমাজকে চটিয়ে দিয়ে এ রকম পদক্ষেপ নেওয়ার সাহসই কারো ছিলো না। বস্তৃত, আমরা আগেই লক্ষ্য করেছি, অভিনেত্রীদের রক্ষিতা রাখলে সমাজ তা মেনে নিতো; কিন্তু অভিনেত্রীদের বিয়ে করলে সমাজ-সংসার তা স্বীকার করে নিতো না। সমাজের এই তীব্র নিষেধ অমান্য করে বাড়ির বউ অথবা কন্যাদের অভিনয়ে আসার জন্যে উৎসাহ দিয়েছিলো জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার। ১৮৮১ সালে এই পরিবার এ রকমের দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নিতে পেরেছিলো প্রধানত একাধিক কারণে। সমাজে এ পরিবারের যে-স্থান ছিলো, তাতে তাঁরা সমাজের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করতে পারতেন। ধর্ম বিশ্বাসের দিক থেকেও এঁরা ছিলেন মূলধারা হিন্দুদের থেকে খানিকটা আলাদা এবং অনেকটাই প্রগতিশীল। সর্বোপরি, যে-মঞ্চে এই মহিলারা অভিনয় করেছিলেন, তা ছিলো তাদের বাড়ির মঞ্চ। সে মঞ্চ সাধারণ মানুষের জন্যে খোলা ছিলো না।
জনসাধারণের প্রবেশাধিকার না-থাকলেও, ঠাকুর পরিবার নিজেদের বাড়ির মহিলাদের মঞ্চে উঠিয়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। প্রথমত, এটা পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে দৃষ্টান্ত হিশেবে কাজ করেছিলো। এই দৃষ্টান্তকে অনুসরণ করে সিকি শতাব্দী পরে ভদ্রলোক পরিবারের মহিলারা মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, অবতীর্ণ হবার সাহস পেয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, ঠাকুরবাড়ির মহিলারা যাত্রার মতো অতিনাটকীয় এবং অস্বাভাবিক অভিনয়ের বদলে স্বাভাবিক অভিনয় করেছিলেন। তাও পরবর্তীদের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছিলো। থিয়েটারের অভিনেতারা (হয়তো অভিনেত্রীরাও) গোপনে ঠাকুরবাড়ির অভিনয় দেখে গিয়ে সে রকম অভিনয় করেছিলেন বলে সমসাময়িক লেখা থেকে জানা যায়। এমন কি, তারা নাকি ঠাকুরবাড়ির মহিলাদের মতো অঙ্গভঙ্গিও শিখেছিলেন।
নাটকের ব্যাপারে ঠাকুরবাড়ির আগ্রহের একটি কারণ ছিলো এই যে, সে বাড়িতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ–দুজনই অনেকগুলো নাটক লিখেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের একাধিক নাটক ১৮৭০-এর দশকে সাধারণ রঙ্গমঞ্চে সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হয়েছিলো। এ রকমের একটি অভিনয় দেখার জন্যে মহিলাদের নিয়ে ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা বেঙ্গল থিয়েটারে গিয়েছিলেন। সেখানে বাইরের দর্শকদের সেদিন আসতে দেওয়া হয়নি। আর, রবীন্দ্রনাথ প্রথমে গীতিনাট্য দিয়ে শুরু করলেও ১৮৮০-এর দশক থেকে আরম্ভ করে পরে অনেকগুলো উৎকৃষ্ট নাটক লিখেছিলেন।
ঠাকুরবাড়ির নিজস্ব মঞ্চে প্রথম অভিনয় শুরু হয় বাল্মীকি-প্রতিভা দিয়ে, ১৮৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তাতে রবীন্দ্রনাথ নিজে সেজেছিলেন বালীকি, আর তার ভ্রাতুষ্পপুত্রী প্রতিভা সেজেছিলেন সরস্বতী। লক্ষ্মী সেজেছিলেন শরৎকুমারী দেবীর কন্যা সুশীলা। তারপর গোটা ১৮৮০-এর দশক ধরে আরও কয়েকবার এই গীতিনাট্যের অভিনয় হয়েছিলো। প্রতিবারেরি তাতে ঠাকুর পরিবারের অথবা তাঁদের আত্মীয় পরিবারের মেয়েরা অংশ নিয়েছিলেন। ১৮৮২ সালে কালমৃগয়ার অভিনয়ে ইন্দিরা দেবীসহ আরও কয়েকটি মেয়ে অংশগ্রহণ করেন। ১৮৮৮ সালে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের উদ্যোগে বেথুন কলেজে মায়ার খেলা অভিনীত হয়। এতে অংশ নিয়েছিলেন শুধু মেয়েরাই। তাঁদের মধ্যে ঠাকুর বাড়ির বাইরেরও দু-একজন ছিলেন। ১৮৯০ সালের অক্টোবরে রাজা ও রানীর যে-অভিনয় হয়, তাতে কেবল কমবয়সী। মেয়েরা নন, জ্ঞানদা দেবী এবং মৃণালিনী দেবীও অংশ নিয়েছিলেন। মোট কথা, অন্য বহু ব্যাপারের মতো ভদ্রঘরের মেয়েদের অভিনয়ে যোগ দেওয়ার ব্যাপারেও ঠাকুরবাড়ির পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছিলো। তখনোই ভদ্রঘরের মেয়েরা নাটক করতে এগিয়ে না-এলেও, ঠাকুরবাড়ির দৃষ্টান্ত সিকি-শতাব্দীর মধ্যে অন্য ভদ্রমহিলাদের অভিনয় করার প্রেরণা জুগিয়েছিলো।
ভদ্রঘরের মেয়েদের অভিনয়ে আনার ব্যাপারে ঠাকুরবাড়ির পরে যাঁর ভূমিকা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, তিনি হলেন ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়–সিনেমার জগতে সংক্ষেপে যিনি ডিজি নামে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গেও ঠাকুরবাড়ির সম্পর্ক ছিলো। তাঁর মেজভাই নগেন্দ্ৰনাথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের জামাতা। তা ছাড়া, ধীরেন্দ্রনাথ নিজেও ঠাকুর পরিবারের এক আত্মীয়াকে বিয়ে করেছিলেন। এঁর নাম প্ৰেমিকা দেবী।
নির্বাক ছবি বিলেত ফেরতের জন্যে ধীরেন্দ্রনাথ অ্যাডভোকেট বিধুভুষণ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা সুশীলাকে নিয়ে এসেছিলেন। তা ছাড়া এনেছিলেন শ্ৰীীরামপুরের গোসাই পরিবারের একটি মেয়েকে। ভদ্রপরিবারের মেয়েদের জন্যে অভিনয় করা তখনো এতো নিষিদ্ধ ছিলো যে, গোসাঁই পরিবারের এই মেয়েটি প্রমীলা ছদ্মনামে অভিনয় করতে রাজি হন। ধীরেন্দ্রনাথ এর থেকেও সাহসী যে-পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তা হলো: তিনি নিজের স্ত্রী প্ৰেমিকা দেবীকেও সিনেমায় অভিনয় করাতে রাজি করান। ১৯২১ সালে বিয়ের পর থেকে ১৯৩০ সালে মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত প্রেমিকা দেবী বেশ কয়েটি ছবিতে অভিনয় করেন। তার প্রথম ছবির নাম ছিলো। ফ্লেইমস অব ফ্লেশ। আসল নাম প্রেমিকা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর জনপ্রিয় নাম হয়েছিলো প্রেমালতিকা। প্রেমিকা দেবী মারা যাওয়ার পর ধীরেন্দ্রনাথ তাঁর দুই কন্যা পারুল এবং মণিকাকেও পর্দায় নিয়ে এসেছিলেন। মণিকার স্বামী পি গুহঠাকুরতা ছিলেন রীতিমতো গণ্যমান্য লোক। তিনিও তাঁকে অভিনয় করতে অনুমতি দিয়েছিলেন। ধীরেন্দ্রনাথের আর-এক কৃতিত্ব তিনি কয়েকজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান তরুণীকে অভিনয় করতে রাজি করিয়েছিলেন। তারা সবাই বাংলা নামে পরিচিত হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে নাম করেছিলেন সবিতা। বাংলায় কবিতা লিখতেন। তিনি এবং বাঙালি বলে নিজের পরিচয় দিতেন।
ভদ্রঘরের তরুণীদের অভিনয়ের জগতে আনার ভূমিকা শিশিরকুমার ভাদুড়ীও পালন করেছিলেন। তিনি যাদের রাজি করিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে খুব খ্যাতি অর্জন করেছিলেন দুই বোন–কঙ্কাবতী এবং চন্দ্রাবতী। তারা ছিলেন এক ব্ৰাহ্ম জমিদার এবং অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটের কন্ন্যা এবং জন্মেছিলেন মুজাফফরপুরে। কঙ্কাবতী বেথুন কলেজ থেকে বিএ পাশ করেছিলেন। তা ছাড়া, রবীন্দ্রনাথের কাছে তার অভিনয়ের হাতেখড়ি হয়েছিলো। ১৯২৮ সালে পঁচিশ বছর বয়সে তিনি শিশির ভাদুড়ীর আমন্ত্রণে মঞ্চে প্ৰবেশ করেন। পরে তাঁর সঙ্গে নিউ ইয়র্কে গিয়ে অভিনয় করেছিলেন। চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন তিনি। চন্দ্রাবতী ছিলেন কঙ্কাবতীর চেয়ে ছ। বছরের ছোটো। তিনিও রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে এসেছিলেন এবং দীনেন্দ্রনাথের কাছে গান শিখেছিলেন। ১৯২৯ সালে নির্বাক চলচ্চিত্রে তিনি প্ৰথম আত্মপ্ৰকাশ করেন। পরে তিনি বহু নাম-করা ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৪০-এর দশকে তিনি তিনবার শ্ৰেষ্ঠ অভিনেত্রী হিশেবে পুরস্কার পেয়েছিলেন।
সুপ্ৰভা মুখোপাধ্যায়ের জন্মও চন্দ্রাবতীর মতো। ১৯০৯ সালে। তিনিও ছিলেন ভদ্রঘরের কন্যা এবং বধূ। সেকালে আইএ পাশ করেছিলেন। তাঁর স্বামীর সঙ্গে পরিচালক মধু বসুর পরিচয় ছিলো। সেই সূত্র ধরে এবং স্বামীর উৎসাহে তিনি অভিনয়ের জগতে প্ৰবেশ করেন। মধু বসু নিজের স্ত্রী সাধনা বসুকেও সিনেমায় নামিয়েছিলেন। নামিয়েছিলেন বললে কম বলা হয়। কারণ সাধনা রীতিমতো খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। মর্জিনা চরিত্রে তার অভিনয় কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলো। নাচ এবং গান উভয় বিষয়ে তিনি নৈপুণ্য লাভ করেছিলেন। কেবল ওস্তাদদের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নয়, তিনি শচীন দেববর্মণ এবং হিমাংশু দত্তের কাছে বাংলা গানও শিখেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন কেশব সেনের পুত্র এবং পেশায় ব্যারিস্টার।
পরিচালক অথবা অভিনেতাদের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে বিশ শতকের প্রথম তিন দশকে আরও কয়েকজন মহিলা অভিনয় করার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন। জ্যোৎস্না গুপ্ত যেমন। তাঁর পিতা ছিলেন প্ৰথম চলচ্চিত্র নির্মাতা হীরালাল সেনের ছাত্র এবং আত্মীয়। প্রতিমা দাশগুপ্তের পিতা ছিলেন পদস্থ কর্মকর্তা এবং এনজিনিয়ার। এ রকম অভিজাত ঘরের মেয়ের অভিনয় করার কথা নয়। কিন্তু তাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
পারিবারিক পটভূমি এবং পরিবারের সদস্যদের উৎসাহও অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের অভিনয়ে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দেবিকারানীর (জন্ম ১৯০৮) পিতা কর্নেল চৌধুরী ছিলেন মাদ্রাসের সার্জন জেনারেল। আর দেবিকা নিজে লেখাপড়া আর অভিনয় শিখেছিলেন ইংল্যান্ডে। পরিচালক হিমাংশু রায়ের আহবানে তিনি ভারতে ফিরে নির্বাক ছায়াছবিতে অংশ নেন। তারপরই ১৯২৯ সালে তিনি হিমাংশু রায়কে বিয়ে করেন। বিয়ের পর থেকে ১৯৪০ সালে হিমাংশু রায় মারা না-যাওয়া পর্যন্ত তিনি তাঁর সঙ্গে একযোগে বহু ছবিতে কাজ করেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি নিজেই চলচ্চিত্ৰ প্ৰযোজনা এবং পরিচালনা করেন। তিনিই ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা পরিচালক।
তরু ও অরু দত্তের বংশের মেয়ে দেবযানী দত্ত বিএ বিটি পাশ। তার স্বামী ছিলেন আইসিএস কর্মকর্তা। একে নিজের খৃস্টান পটভূমি, তার ওপর স্বামীর উৎসাহে তিনি অভিনয়ে এসেছিলেন। প্রতিমা দাশগুপ্তও অভিনয় জগতে ঢুকেছিলেন অনেকটা রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণায়। পরে তিনি চিত্র পরিচালনাও করেছিলেন। শোভা সেনগুপ্ত জন্মেছিলেন ১৯২৩ সালে আর তৃপ্তি মিত্র ১৯২৫ সালে। দুজনই উচ্চবংশের মেয়ে। শোভা সেনগুপ্তের পিতা ছিলেন ডাক্তার। তিনি নিজে বেথুন থেকে বিএ পাশ করেছিলেন। কলেজে অভিনয় করে খানিকটা অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন আর স্বামীর উৎসাহে যোগ দিয়েছিলেন আইপিিটএ-র সঙ্গে। তৃপ্তি মিত্ৰও যোগ দিয়েছিলেন আইপিটিএ-র সঙ্গে। তার পিতা ছিলেন উকিল আর মা বিপ্লবী রাজনীতিতে অংশ নিয়েছিলেন।
প্রথম মুসলমান অভিনেত্রী বনানী চৌধুরীও (জন্ম ১৯২৪) স্বামীর উৎসাহে এ পথে এসেছিলেন। তার জন্যে এ পথ ছিলো দ্বিগুণ কঠিন। ইসলাম ধর্মে অভিনয় নিষিদ্ধ এবং পর্দাপ্রথাও কঠোর। তখনকার দর্শকরাও মুসলমানদের প্রতি খুব সহানুভূতিশীল ছিলেন না। সে জন্যে তাঁর মূল নাম আনোয়ারা গোপন রেখে বনানী নাম নিয়ে তাকে অভিনয় করতে হয়েছিলো। প্ৰসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন ভদ্রঘরের অন্য মহিলারাও কেউ কেউ সত্যিকার নাম গোপন রেখে অভিনয়ে নেমেছিলেন। ভদ্রঘরের কোনো কোনো মহিলা অভাবে পড়েও অভিনয় করতে বাধ্য হয়েছিলেন। যেমন, সুনন্দা দেবী (জন্ম ১৯২১), সরযুবালা দেবী (জন্ম ১৯১২) এবং মলিনা দেবী (জন্ম ১৯১৪)। প্ৰভা দেবী, শিশুবালা এবং রমা বসুও–দারিদ্র্যের কারণে অভিনয় করেছিলেন। ভদ্রঘরের মহিলাদের মধ্যে মলিনা দেবী অথবা আঙুরবালার মতো কেউ কেউ মঞ্চে প্রবেশ করেছিলেন নৃত্যশিল্পী হিশেবে গোড়াতে তারা অভিনয় করতেন না। পরে অভিনেত্রী হন। ইন্দুবালার মতো কেউ কেউ এসেছিলেন গায়িকা হিশেবে। মোট কথা, বিশ শতকের প্রথম ৩০ বছর বিশেষ বিশেষ কারণেই ভদ্রঘরের স্বল্পসংখ্যক মহিলা অভিনয়-জগতে এসেছিলেন। নয়তো তখনো বেশির ভাগ অভিনেত্রী আসতেন যাদের কুলশীলের পরিচয় নেই, এমনসব পরিবার থেকে।
অভিনয় করেছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু তার পরবর্তী তিন বছরের তিনি কোনো বিবরণ দেননি। হয়তো নিতান্ত গ্ৰানির মধ্যে কেটেছিলো বলে।
তাঁর সত্যিকারের অভিনয়-জীবন শুরু হয়। ১৯৩০ সালে ৷ ততোদিনে চলচ্চিত্র নির্বাক থেকে সবাকে পরিণত হয়েছিলো। তাঁর এ পর্বের প্রথম ছবি জোর বরাত। এ ছবি মুক্তি পেয়েছিলো। ১৯৩১ সালে। এর পরের তিন বছর তিনি বসে থাকেননি। তবে সিনেমার-জগতে তিনি নিজের আসন পাকা করেন যে-ছায়াছবি দিয়ে তা হলো: ১৯৩৫ সালের মানময়ী গার্লস স্কুল। ততোদিনে তিনি ভরা যৌবনে পৌঁছেছিলেন। চলচ্চিত্রের ইতিহাসকার রবি বসু লিখেছেন যে, এ সময়ে কাননীবালাকে দেখে যুবক এবং প্রৌঢ় অনেকেই হৃৎস্পন্দন বেড়ে যেতো। রূপবাণী সিনেমায় এই ছবির একটি রোম্যান্টিক দৃশ্যে কাননের অভিনয় দেখে একদিন এক উদ্রান্ত যুবক নাকি পর্দার দিকে ছুটে গিয়েছিলেন একবার কাননবালাকে একটু স্পর্শ করার জন্যে। কলকাতার রাস্তায় ধারে চট বিছিয়ে কাননের আলোকচিত্র বিক্রি হতো। এ সময়ে। সৌন্দর্যে এবং ফ্যাশনে কানন এ সময়ে আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। মহিলারা তার ফ্যাশনের শাড়িব্লাউজ পরতে আরম্ভ করেন। তার ফ্যাশনের কানের দুল তৈরি করান।
তাঁকে প্রথম জীবনে সবচেয়ে খ্যাতি এনে দিয়েছিলো মুক্তি (১৯৩৭)। পরের বছর বিদ্যাপতি এবং সাথীও জনপ্রিয় হয়েছিলো। ৪০-এর দশকের গোড়ায় তিনি পরিচয় এবং শেষ উত্তর ছবির জন্যে তিনি পর-পর দুবার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পান। বস্তৃত, ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৪— এই সময়টাই নায়িকা হিশেবে তাঁর সবচেয়ে খ্যাতির পর্ব। এ সময়ে কাননীবালা থেকে তিনি সন্ত্রান্ত কানন দেবীতে পরিণত হন। তার বয়সও হয় বছর তিরিশ।
অতঃপর তিনি রোম্যান্টিক নায়িকার বদলে স্ত্রী এবং মায়ের ভূমিকায় বেশি মানানসই হন। তিনি অভিনয়ে শান্ত সৌম্য সৌন্দর্য দিয়ে মায়ের যে-আদর্শ স্থাপন করেন, তা ছিলো অসাধারণ। মুক্তি ছবিতে তাঁর রোম্যান্টিক নায়িকার অভিনয় সাত দশক পরে এখন মনকে আন্দোলিত করবে। কিনা, সন্দেহ হয়। কিন্তু তাঁর মেজদিদির অভিনয় এখনো দর্শকের কাছে আদর্শ অভিনয় বলেই গণ্য হবে। কেবল মেজদিদি নয়, আলোচ্য কালে তিনি শরৎচন্দ্রের কাহিনী অবলম্বনে তৈরি বেশ কয়েকয়েকটি ছায়াছবিতে তিনি অভিনয় করেন। পাঠকরা যেভাবে শরৎচন্দ্রের নায়িকাদের মানস দৃষ্টিতে কল্পনা করে নিয়েছিলেন, কানন দেবীর মধ্যে তাঁরা সেই চরিত্রগুলোকে যেন বাস্তবে দেখতে পেলেন।
তিনি নিজেও তার এই শক্তির কথা জানতেন। সে জন্যে ১৯৪৮ সালে তিনি যখন নিজেই শ্ৰীমতী পিকচার্স নামে চলচ্চিত্রের কম্পোনি গড়ে তোলেন, তখন বেশির ভাগ ছবিই করেছিলেন শরৎচন্দ্রের কাহিনী অবলম্বনে। সেসব ছবিতে তিনি নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এই কম্পোনিতে এসে তিনি কেবল অভিনয় এবং প্রযোজনাই করেননি, তিনি পরিচালকের ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
কাননের আর-একটি পরিচয় তিনি অভিনয় করতে করতে বিখ্যাত গায়িকায় পরিণত হন। বাড়ির কাছের একজন সাধারণ গায়কের কাছে হাতেখড়ি হলেও, পরে তিনি ওস্তাদ আল্লারাখার কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শেখেন। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, রাইচাঁদ বড়াল, নজরুল ইসলাম, অনাদি দস্তিদার, পঙ্কজ মল্লিক প্রমুখের কাছেও তিনি নানা ধরনের গান শিখেছিলেন। কেবল বহু আধুনিক গান নয়, বহু রবীন্দ্রসঙ্গীতও তিনি জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গান–আজি সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে–গেয়ে তিনি যে কেবল রবীন্দ্রনাথকেই খুশি করেছিলেন, তাই নয়, এ গানকে তিনি ভদ্রলোকের বসার ঘর থেকে বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তার গাওয়া আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ, যদি ভালো না লাগে তবে দিও না মন, আমি বনফুল গো, অনাদি কালের স্রোতে ভাসা ইত্যাদি গান ছিলো সেকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান।
কানন দেবীই সম্ভবত সমাজের নিচের তলা থেকে আসা শেষ বড়ো অভিনেত্রী। ১৯৪০-এর দশক থেকে পরিবার এবং সমাজ ভদ্রঘরের মহিলাদের অভিনয় মোটামুটি গ্রহণ করে নেয়। আমরা এর আগেই প্রেমিকা দেবী, দেবিকারাণী, সাধনা বসু, কঙ্কাবতী, তৃপ্তি মিত্র এবং শোভা সেনগুপ্তের মতো এই শ্রেণীর কয়েকজন অভিনেত্রীর নাম উল্লেখ করেছি। শিক্ষার বিকাশ, অভিনয় থেকে খ্যাতি এবং আর্থিক লাভ ইত্যাদি। অনেক মহিলা এবং পরিবারকে এ দিকে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করে থাকবে। কোনো কোনো সিনেমার পরিচালক যে তাদের আত্মীয়াদের সিনেমায় নামিয়েছিলেন, তাও ভদ্রমহিলাদের অভিনয়ের পথ সুগম করেছিলো। এমন কি, অভিনেত্রীরা যে-ঘর থেকেই আসুন না কেন, কোনো সিনেমা-পরিচালক এবং সমাজের ওপর তলার পুরুষরা যে তাঁদের বিয়ে করছিলেন, তাও অভিনেত্রীদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিলো। তবে তখনো থিয়েটারে অভিনয় যতোটা গ্রহণযোগ্য ছিলো, সিনেমায় অভিনয় অতোটা নয়। সিনেমার পর্দায় যতোটা শরীর এবং নায়ক-নায়িকার ঘনিষ্ঠতা দেখানো হয়, চোখের সামনে মঞ্চে ততোটা দেখানো হয় না। এ হয়তো এর একটা কারণ। এখনো সিনেমা এবং মঞ্চে এই পার্থক্য এবং সে সম্পর্কে সমাজের মনোভাব বজায় আছে।
কানন দেবী তার আত্মজীবনীতে বর্ণনা দিয়েছেন কিভাবে কিশোর বয়স থেকেই তাঁকে পর্দায় নগ্নতার অভিনয় করতে হয়েছে। তা ছাড়া, পর্দার বাইরেও কখনো নায়ক, কখনো পরিচালকের লোলুপতার শিকার হতে হয়েছে। কেউ হাত ধরে টানাটানি করেছেন, কেউ পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করেছেন, কেউ হাতে টাকা গুঁজে দিয়েছেন ইত্যাদি। তাদের বাসনার যথাযথ উত্তর না-দেওয়ায় তারা পরে কিভাবে তার প্রতিশোধ নিয়েছেন, সে কথাও কানন লিখেছেন। জোরবরাত (১৯৩১) ছবির একটি দৃশ্যে সংলাপের পর হঠাৎ নায়ক তাঁকে জড়িয়ে ধরে ইংরেজি কায়দায় ঠোঁটে চুমু খান। কাননের বয়স তখন বছর ষোলো। এতে তিনি এতো হকচাকিয়ে যান যে, ধাক্কা দিয়ে নায়ককে সরিয়ে দেন। পরে এ জন্যে পরিচালক আর এ দৃশ্য দেখাতে পারেননি। কানন দেবী, বলা বাহুল্য, দারুণ ব্যথিত এবং অপমানিত হয়েছিলেন। পরিচালক তাকে জানান যে, নায়ক যা করেছিলেন, তা তারই নির্দেশে করেছিলেন। কিন্তু কাননকে আগে থেকে কিছুই জানানো হয়নি। অভিভাবকহীন নিচুঘরের মেয়ে হওয়ায় টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে অথবা অভাবের সুযোগ নিয়েও নগ্নতা প্রদর্শনের জন্যে বাধ্য করা হয়েছে। এ রকমের একটি ছবি ছিলো বাসবদত্তা। তিনি এ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন নিতান্ত অনিচ্ছায়। হয়তো সে জন্যেই নগ্নতা সত্ত্বেও এ ছবি জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। তাঁর অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে প্রযোজকরা কিভাবে তাঁকে টাকা পয়সার ব্যাপারে ঠকিয়েছেন, তাঁর আত্মজীবনীতে সে সম্পর্কেও বর্ণনা আছে।
১৯৫০-এর দশকে সমাজের নিষেধ এতোটাই দুর্বল হয়ে এসেছিলো যে, অভিজাত ঘরের বাইশ-তেইশ বছরের একজন স্ত্রী এবং সন্তানের জননী–সুচিত্রা সেনও সিনেমার অভিনয় করতে এগিয়ে আসেন। তার শ্বশুর আদিনাথ সেন এবং স্বামী দিবানাথ তাঁকে অনুমতি দিয়েছিলেন। স্বামীর কাছ থেকে সুচিত্রা কেবল অনুমতি আদায় করেননি, তিনি স্বামীকে সঙ্গে নিয়েই ছবির জগৎ খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। স্বামীকে তিনি বর্ম হিশেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। অসম্ভব নয় যে, তার স্বামী এবং শ্বশুর মনে করেছিলেন যে, কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেই সুচিত্রার শখ মিটে যাবে এবং ঘরের বৌ ঘরে ফিরে আসবেন। কিন্তু অভিনয়ের জগতে এসে সুচিত্রা খুঁজে পেয়েছিলেন নিজের প্রতিভার যথার্থ জায়গা। তার অভিনয়ের যদি বা সীমাবদ্ধতা থাকেও, যা অসীম পরিমাণে পেয়েছিলেন তিনি, তা হলো খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তা। থিয়েটারে তাঁর চেয়ে যোগ্য অভিনেত্রী তাঁর আগে এবং পরে আরও এসেছিলেন, কিন্তু বাংলা সিনেমার জগতে তার চেয়ে কোনো অভিনেত্রীই বেশি খ্যাতি লাভ করেননি। তিনি ৫৩টি বাংলা এবং অন্য ভাষায় ৭টি ছবি করেছিলেন। এর বেশির ভাগই দর্শকদের মন কেড়েছিলো।
রোম্যান্টিক নায়িকার অভিনয়ের নতুন আদর্শ স্থাপন করেছিলেন সুচিত্রা। তাঁর অসামান্য সৌন্দর্য, কথা বলার ভঙ্গি, স্মার্ট পােশাক, প্ৰেমবিহবল মুগ্ধ দৃষ্টি, নায়কের সঙ্গে সংকোচহীন ঘনিষ্ঠতা তরুণ-তরুণীদের মনে প্রেমিক-প্রেমিকার আদর্শ তুলে ধরেছিলো। মধ্যবিত্ত পরিবারে নিজেদের জীবনে যা ছিলো না, কিন্তু মনে মনে যে-জীবন তাঁরা কল্পনা করতেন, তারই প্রতিফলন তাঁরা লক্ষ্য করেছিলেন সুচিত্রা-উত্তমের অভিনয়ে। এমন কি, সুচিত্রা যখন বসন্ত চৌধুরী, অশোককুমার অথবা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিনয় করেছেন, তখন তাও খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। রোম্যান্টিক ভূমিকার সঙ্গে তাঁর নাম এমন সমাৰ্থক হয়ে গিয়েছিলো যে, যখন তিনি চল্লিশের কোঠার শেষ দিকে পৌঁছলেন, যখন আর তাঁর পক্ষে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করা সম্ভব ছিলো না, তখন তিনি পর্দা থেকে একেবারে পুরোপুরি সরে গেলেন, কানন দেবী অথবা অন্য সবার মতো মায়ের ভূমিকায় অথবা পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হলেন না। আমার ধারণা, এ থেকে একদিকে তার অত্যুজ্জ্বল পেশাদারী মনোভাব এবং সেই সঙ্গে আত্মমর্যাদা প্ৰকাশ পায়। তিনি সিকি শতাব্দী ধরে নিজের যে-ভাবমূর্তি দর্শকদের মনে তৈরি করেছিলেন, কোনো কিছুর বিনিময়ে তা বিসর্জন দিতে প্ৰস্তৃত ছিলেন না। সুযোগ পেলে বিনোদিনী কী করতেন, বলা শক্ত। কিন্তু কাৰ্যকারণে তিনিও আজীবন নায়িকাই থেকে গিয়েছিলেন।
বস্তুত, সুচিত্রার জনপ্রিয়তা কেবল তাকে বড়ো করেনি, বাংলা সিনেমারও অসাধারণ উপকার করেছিলো। বিশেষ করে তিনি উত্তমকুমারের সঙ্গে যে-তিরিশটি ছবি করেছিলেন, তা দর্শকদের হিন্দী ছবির দিক থেকে বাংলা ছবির দিকে নিয়ে এসেছিলো। নায়ক-নায়িকার ভূমিকায় সুচিত্রা-উত্তমের জুটি বাংলা সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি। শুধু সিনেমাকে নয়, এই জুটি তাদের অভিনয় দিয়ে বাংলা গানকেও শ্রোতাদের অন্তরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বহু গান রেকর্ডে শ্রোতাদের কাছে আবেদন সৃষ্টি করতো। কিনা সন্দেহ আছে, কিন্তু সিনেমার পর্দায় সুচিত্রা এবং উত্তম ঐ গান গাওয়ার অভিনয় করে সেসব গানকে অসাধারণ জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।
পেশাদারী ও ব্যক্তিগত জীবনে কানন এবং সুচিত্রার সফলতা-নিস্ফলতা থেকে আরও একবার নারী এবং অভিনয় সম্পর্কে বাঙালি সমাজের দ্বৈতমানদণ্ডের প্রমাণ পাওয়া যায়। কানন দেবী এবং সুচিত্রা দুজনেই খুব সুন্দরী ছিলেন। যতো নিচুঘরের কন্যা হন না কেন, অভিনেত্রী কাননকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন অনেকেই। যে-হেরম্ব মৈত্র থিয়েটারের পথ কোনদিকে পথচারীকে তা বলে দেননি, সেই হেরম্ব মৈত্রের পুত্ৰ ব্যারিস্টার অশোক মৈত্র আভিজাত্যের পঙক্তি এবং জাত ভেঙে তাকে বিয়ে করেন। তবে যে-পারিবারিক পিউরিটান মূল্যবোধের মধ্যে অশোক বড়ো হয়েছিলেন, হয়তো সে কারণেই কাননের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক স্থায়ী হয়নি। কানন তাকে কতোটা ভালোবেসেছিলেন জানিনে, কিন্তু ১৯৪৮ সালে তিনি রাজ্যপালের একজন উচ্চকর্মকর্তার প্রেমে পড়েন। এই প্ৰণয়ের গভীরতা অনুভব করা যায়। তাঁর আত্মজীবনী থেকে। এই কর্মকর্তা–হরিদাস ভট্টাচাৰ্য ছিলেন। অশোক মৈত্রের মতোই ব্ৰাহ্মণ। তাঁর সঙ্গে কাননের বিয়ে হয় এবং বাকি জীবন তারা যদ্দুর মনে হয় সুখেই বাস করেন। হরিদাস অল্পদিনের মধ্যে কাননের মতোই প্ৰবেশ করেন চলচ্চিত্র জগতে, তবে অভিনেতা হিশেবে নয়, পরিচালক এবং প্রযোজক হিশেবে।।
সুচিত্রার বিয়েও সুখের অথবা খুব দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। তিনি যখন সিনেমাজগতে প্ৰবেশ করেন, তখনও তিনি তা করেছিলেন ছদ্মনামে। তাঁর আসল নাম ছিলো রমা। অসম্ভব নয় যে, এই নামের আড়ালে তিনি এবং তাঁর পরিবার তাঁর সত্যিকার পরিচয় খানিকটা ঢেকে রাখতে চেয়েছিলেন। তারপর একের পর এক রোম্যান্টিক নায়িকার চরিত্রে সুচিত্রার প্রাণবস্ত এবং অন্তরঙ্গ অভিনয়কে তাঁর স্বামী এবং স্বামীর পরিবারের অন্য সদস্যরা সম্ভবত বাস্তব বলেই গণ্য করেছিলেন। ফলে বিয়ের পনেরো-ষোলো বছর পরে–১৯৬৩ সালে–তাদের বিয়ে ভেঙে যায়। কানন বিয়ে ভেঙে যাবার পর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন; সুচিত্রা তা করেননি। মাত্র ৩৪-৩৫ বছর বয়স থেকে এই অসাধারণ সুন্দরী এবং গুণী মহিলা বস্তৃত নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন। আর তার স্বামী ক্ষোভে, দুঃখে, পরনিন্দার ভয়ে দেশ থেকে চলে যান অনেক দূরে–অ্যামেরিকায়। সেখানেই তিনি মারা যান। ১৯৬৯ সালে। সুচিত্রা নিজেও ১৯৭৮ সালে চলচ্চিত্র থেকে অবসর নেন। এবং নিজেকে একেবারে গুটিয়ে বন্দী করেন চার দেওয়ালের মধ্যে। সুকুমারী থেকে আরম্ভ করে অন্যসব অভিনেত্রীর মতোই গুরুর কাছে দীক্ষা নেন। তিনি এবং ধর্মকর্মে আত্মনিয়োগ করেন। অভিনেত্রী জীবনে অন্য পুরুষদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং রূপ ও দেহকে দেখিয়ে দর্শকচিত্তকে আকৃষ্ট করা যে পাপের–এ কথা রক্ষণশীল সমাজের মতো তারা নিজেরাও বিশ্বাস করেছেন। সে জন্যেই সম্ভবত সুকুমারী থেকে সুচিত্রা পর্যন্ত সবাই পাপবোধ থেকেই শেষ জীবনে ধৰ্মকর্মে মন দিয়েছিলেন। আর সমাজের সমালোচনা এড়ানোর জন্যেই বোধহয় অনেক অভিনেত্রী সত্যিকারের নাম গোপন করে মঞ্চে নেমেছিলেন নকল নামের আড়ালে—সুকুমারী থেকে সুচিত্রা পর্যন্ত।
তবে বাংলা অভিনয়ের এই এক শো বছরের ইতিহাসে কতোগুলো ইতিবাচক দিকও ছিলো। প্রথমে অভিনেত্রীদের আগমনে রুচিবান ভদ্রলোকেরা থিয়েটার দেখাই বন্ধ করেছিলেন। কিন্তু এ মনোভাব স্থায়ী হয়নি। ধীরে ধীরে তাঁরা মঞ্চে যেতে আরম্ভ করেছেন। এমন কি, শেষে নিজেদের কন্যা এবং স্ত্রীদের মঞ্চে উঠতে দিয়েছেন, রূপালি পর্দায় হাজির হতে উৎসাহিত করেছেন। কেউ বা অভিনেত্রীদের ঘরের বেঁী করে এনেছেন। নারীদের প্রতি পুরুষপ্রধান বাঙালি সমাজে যেটুকু শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়েছে, তার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। শিক্ষাবিস্তার তার মধ্যে সবার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাবিস্তার থেকে অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ। রাজনীতিতে অংশগ্রহণ। কিন্তু সেই সঙ্গে খানিকটা কৃতিত্ব এই অভিনেত্রীদেরও প্রাপ্য। তাঁরা নিজেরা সমাজের কাছে গৃহীত হয়েছেন। এবং সামগ্রিকভাবে নারীদের সম্মান বৃদ্ধি করেছেন।
অভিনেত্রীদের দেখে দর্শকরা এখন আর ঘূণা করেন না, বরং তাদের দেখতে ভিড় জমান। তাদের সঙ্গে একবার কথা বলতে পারলেও নিজেদের ধন্য মনে করেন। তাদের বিয়ে করতে পারলে অনেক ভদ্রলোক এখন ধন্য মনে করবেন। আর, যেবীরপুরুষরা তাদের বিয়ে করতে সংকোচ বোধ করবেন, তারা তাদের ফাও উপভোগ করার সুযোগ পেলে বর্তে যাবেন।
অভিনেত্রী হওয়ার সুযোগ পেলে এখন অনেক ভদ্রমহিলাই জীবনকে সফল মনে করবেন। সবচেয়ে বেশি যা লক্ষণীয়, তা হলো: অভিনেত্রীরা নিজেরাও এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসের অধিকারী হয়েছেন। তাঁরা বিনোদিনীর মতো বিনয় প্রকাশ করবেন না। বস্তৃত, একটা সামাজিক এবং জাতীয় সমস্যা নিয়ে তাঁরা যে শাবানা আজমী অথবা অপর্ণা সেনের মতো একটা বলিষ্ঠ প্রতিবাদী অবস্থান নিতে পারছেন, তা একদিনে সম্ভব হয়নি। তার পেছনে রয়েছে। শতবর্ষের অর্জনের ইতিহাস।
সত্যি বলতে কি, বাংলা থিয়েটার ও সিনেমার ইতিহাসে পরিচালক এবং প্রযোজকরা চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যেমন ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন, তেমনি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন বহু অভিনেত্রী। তাঁরা কেবল বাংলা থিয়েটার এবং চলচ্চিত্ৰকে এগিয়ে দেননি এবং তাকে জনপ্রিয় করেননি, বরং বাঙালির প্রাত্যহিক জীবন, চলাফেরা, পোশাক ইত্যাদিতেও প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। এ রকম প্রভাবশালী অভিনেত্রীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন। বিশেষ করে যাদের নাম মনে
সুচিত্রা। তাঁরা যে-গান মঞ্চে এবং পর্দায় গেয়েছেন, সে গান জনপ্রিয় হয়েছে। যেভঙ্গিতে শাড়ি পরেছেন, সেই ভঙ্গি ভদ্রমহিলারা অনুকরণ করেছেন। তাদের ভঙ্গিতে কথা বলা রপ্ত করেছেন। খোপা বেঁধেছেন। এমন কি, সুচিত্রার মতো চুলও ছোটছেন অনেকে। বাঙালি মহিলাদের রুচি গঠনে এবং আত্মমর্যাদা অর্জনে এই অভিনেত্রীদের ভূমিকা তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
(অন্যদিন, নববর্ষ সংখ্যা, ১৪১৩)