সাহিত্যপুরস্কার
অনেক উন্নত দেশেই সাহিত্য একাডেমি, একাডেমি অব লেটার্স, একাডেমি অব সায়েন্সেস প্রভৃতি রয়েছে। সেগুলো সেসব দেশের কবি-সাহিত্যিক, বিজ্ঞানীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠান। পাকিস্তান সরকার শিল্প-সাহিত্যের উন্নয়নের লক্ষ্যে লেখক-বিজ্ঞানী-বুদ্ধিজীবীদের জন্য ওই জাতীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৫৪-র সাধারণ নির্বাচনের আগে এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট যে ২১ দফা অঙ্গীকার করে, তার ১৬ নম্বর দফায় বলা হয়েছিল : ‘যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম বিলাসের বাড়িতে বাসস্থান নির্দিষ্ট করিবেন এবং বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাত্রাবাস এবং পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হইবে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলা একাডেমির পুরোনো যে তিনতলা ভবন, যার নাম ‘বর্ধমান হাউস’, সেটি ছিল পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর (তখন বলা হতো প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী) সরকারি বাসভবন। তিনতলাটি তখন ছিল না। ওটি করা হয়েছে আশির দশকে, যখন ভবনটির সংস্কার করা হয়। ওটি মোটেই কোনো বিলাসবহুল বাড়ি নয়; কিন্তু রাজনীতির স্বার্থে বিরোধী নেতারা সেটাকেই ‘বিলাসের বাড়ি’ আখ্যা। দেন। যা হোক, যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। ১৯৫৬ র ডিসেম্বরে যুক্তফ্রন্টের অন্যতম শরিক কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতা মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার বাংলা একাডেমি উদ্বোধন করেন। ওই বছর একুশে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন যৌথভাবে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার ও শহীদ বরকতের মা।
একালে অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হবে, বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নেই; জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদদের দ্বারাই এটি প্রতিষ্ঠিত। বিশেষ করে, তখনকার প্রধান বিরোধী দল বাঙালি জাতীয়তাবাদী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অবদান সবচেয়ে বেশি। তার সঙ্গে ছিলেন বাম-প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর নেতারা।
বাঙালি জাতীয়তাবাদী যুক্তফ্রন্টের উত্থানে মুসলিম জাতীয়তাবাদী ওরফে পাকিস্তানবাদীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য মহফিল’ নামের একটি সংগঠন ১৯৫৮-র মে মাসে চার-দিনব্যাপী একটি সাহিত্য-সম্মেলনের আয়োজন করে চট্টগ্রামে। তার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন। ওই সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন জনৈক মৌলভী আবদুর রহমান এবং সম্পাদক মৌলভী নূরুল ইসলাম চৌধুরী।
[সাঈদ-উর রহমান, পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলন, পৃ. ৪২-৪৬]
পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী যুক্তফ্রন্টের অভ্যুদয় ও প্রভাব বিস্তারের ফলে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পাকিস্তানি আদর্শ দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে এবং বৃহত্তর বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির আদর্শের প্রসার ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। তা থেকে জাতিকে রক্ষা করার প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়। অধ্যক্ষ ইবরাহীম খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন ও শিল্পী জয়নুল আবেদিন বিভিন্ন অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। এক প্রস্তাবে বাংলা একাডেমির মাধ্যমে উপযুক্ত সাহিত্য গ্রন্থের জন্য প্রতিবছর পুরস্কার প্রবর্তনের দাবি জানানো হয়।
বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রবর্তনের দাবিরক্ষণশীল ও মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের থেকে হলেও ওই দাবি বাস্তবায়নে উপকৃত হয়েছেন আধুনিক কবি-সাহিত্যিকেরাই বেশি। ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রবর্তিত হয়। তখন মুহাম্মদ এনামুল হক ছিলেন পরিচালক। সামগ্রিক সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ছয়টি শাখায় পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। প্রতিটি শাখায় দুই হাজার টাকা ছিল পুরস্কারের মান। এ জন্য বাংলা একাডেমিকে ১২ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। সেকালের বাজারদর। হিসেবে দুই হাজার টাকা সামান্য নয়। ওই টাকায় ৩০ ভরি সোনা অথবা ১৩৫ মণ চাল কেনা যেত। প্রথম বছর কবিতায় ফররুখ আহমদ, ছোটগল্পে আবুল মনসুর আহমদ, নাটকে আশকার ইবনে শাইখ ও প্রবন্ধে মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ পুরস্কার পান। উপন্যাসে এমন একজন পুরস্কার পান, যাঁকে বাংলা সাহিত্যের পাঠকেরা চিনতেন না। তার নাম আবুল হাসেম খান। কেন তিনি পুরস্কার পেয়েছিলেন, তা বোধগম্য নয়। শিশুসাহিত্যে পুরস্কার পেয়েছিলেন খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন ও গবেষণায় আবদুল্লাহেল কাফী।
বাংলা একাডেমি পুরস্কার শুরুতেই অসন্তোষ ও বিতর্কের জন্ম দেয়। জসীমউদ্দীন সংগত কারণেই ক্ষুব্ধ হন। একাডেমি থেকে বলা হয়েছিল তিনি পুরস্কারের উর্ধ্বে, কিন্তু যুক্তিটি সমর্থনযোগ্য ছিল না। আরও বলা হয়েছিল তাঁর বয়স বেশি, অপেক্ষাকৃত তরুণদেরই এ পুরস্কার প্রাপ্য। এ যুক্তিও একেবারেই খোঁড়া। আবুল মনসুর আহমদ ও মোহাম্মদ বরকতউল্লাহর বয়স ছিল তার চেয়ে বেশি। জসীমউদ্দীন বাংলা একাডেমির ওপর সেই যে ক্ষুব্ধ হলেন, আমৃত্যু তাঁর সেই ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। তিনি বাংলা একাডেমিকে তার কোনো বই বা রচনাবলি প্রকাশের অনুমতি দেননি।
১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান কবিতায় আহসান হাবীব,উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,ছোটগল্পে মবিনউদ্দীন আহমদ,নাটকে নূরুল মোমেন,গবেষণায় মুহম্মদ আবদুল হাই ও শিশুসাহিত্যে হোসনে আরা। ১৯৬২-তে পেয়েছেন কবিতায় সুফিয়া কামাল, উপন্যাসে আবুল ফজল, ছোটগল্পে শওকত ওসমান, নাটকে মুনীর চৌধুরী, প্রবন্ধে আকবর আলী ও শিশুসাহিত্যে বন্দে আলী মিয়া। ১৯৭১ পর্যন্ত দেখা যায়, বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্তিতে প্রগতিশীল শিবিরের প্রায় কেউই বাদ যাননি। এবং প্রবীণ ও তরুণ মিলিয়েই দেওয়া হতো। প্রবীণদের মধ্যে পেয়েছেন। মুহাম্মদ এনামুল হক (১৯৬৪), মাহবুব-উল আলম (১৯৬৫), কাজী মোতাহার হোসেন (১৯৬৬), আ ন ম বজলুর রশীদ (১৯৬৭) প্রমুখ। অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যে শামসুদ্দীন আবুল কালাম (১৯৬৪), আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৬৫), সৈয়দ শামসুল হক (১৯৬৬), সৈয়দ আলী আহসান ও আবদুল গাফফার চৌধুরী (১৯৬৭), আল মাহমুদ ও শওকত আলী (১৯৬৮), শামসুর রাহমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও নীলিমা ইব্রাহীম (১৯৬৯), সত্যেন সেন, হাসান আজিজুল হক ও আনিসুজ্জামান (১৯৭০) এবং হাসান হাফিজুর রহমান, জহির রায়হান, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, আনোয়ার পাশা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (১৯৭১) প্রমুখ।
ষাটের দশকে মাত্র একটি-দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে এমন অনেকে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। যত দিন জীবিত ছিলেন, ষাটের দশকের সব পুরস্কার মনোনয়ন কমিটির প্রধান ছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ইসলাম, মুসলমান, পাকিস্তান,কায়েদে আজম প্রভৃতি বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো, তবে সাধারণ বিষয়ের মানসম্মত বইয়ের লেখকেরাও পুরস্কার পেয়েছেন। একটি উপন্যাস সূর্য দীর্ঘল বাড়ী লিখেই আবু ইসহাক পুরস্কার পান (১৯৬৩)। আনিসুজ্জামানের দুটি গবেষণামূলক বই বেরিয়েছিল স্বাধীনতার আগে, দুটিই মুসলমানদের নিয়ে, তা হলো মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৬৪) এবং মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র (১৯৬৯)। শওকত আলী ও হাসান আজিজুল হকও একটি-দুটি বই প্রকাশ করেই পুরস্কার পান। অপেক্ষাকৃত তরুণ ও আধুনিকদের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজন ছিল।
বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়ার পেছনে যে সরকারি নীতির প্রভাব ছিল, তা বোঝা যায় একটি ঘটনায়। ষাটের দশকে বদরুদ্দীন উমরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চারটি বই প্রকাশিত হয়। পাকিস্তানি শাসনামলের সাম্প্রদায়িক পরিবেশে তাঁর বইগুলোর ভূমিকা ছিল অসামান্য। বইগুলো হলো সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৬),সংস্কৃতির সংকট (১৯৬৭), সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৮) এবং পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তঙ্কালীন রাজনীতি (১৯৭০)। ষাটের দশকে স্বায়ত্তশাসনের জন্য উত্তাল বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে বদরুদ্দীন উমরের এই গ্রন্থগুলো ছিল অসামান্য প্রেরণা। আজ বাংলাদেশ ভাষাসৈনিকে ভরে গেছে, একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতিরোমন্থনে ক্লান্তি নেই একদল ভাষা আন্দোলন ব্যবসায়ীর এবং তাদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। অথচ বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত তাঁরা কী ভূমিকা পালন করেছেন, তার কোনো রেকর্ড নেই। বদরুদ্দীন উমরের পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তকালীন রাজনীতি প্রকাশের পর ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণার দিগন্ত উন্মুক্ত হয়। তিনি ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণার পথিকৃৎ।
চারটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশের পরও বাংলা একাডেমি অথবা অন্য কোনো পুরস্কার কমিটির দৃষ্টি এড়িয়ে যান তিনি। এখন ‘সাম্প্রদায়িকতা’ শব্দটি উচ্চারণ না করে যারা দিন শুরু করেন না, একাত্তরের আগে তারা ওই শব্দ এড়িয়ে যেতেন। বদরুদ্দীন উমরের মতো একজন পণ্ডিত যদি ইসলাম ও মুসলমান বা পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ নিয়ে একখানা বই লিখতেন, ষাটের দশকে তিনিও একাধিক পুরস্কার পেতেন। ১৯৭২ সালে তাকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়; কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। উপযুক্ত কাজটিই তিনি করেছিলেন। তিনি অবিচল প্রতিষ্ঠানবিরোধী।
পাকিস্তানি শাসনামলে পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ-কৃষক, শ্রমিক, ছোট চাকুরে, স্কুলশিক্ষক, তাঁতি, কামার, কুমার, জেলে প্রভৃতি শোষণের শিকার হয়েছেন। কিন্তু সরকারের সঙ্গে সদ্ভাব ছিল যেসব কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পীর, তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ যা-ই হোক, তারা রাষ্ট্রীয় পদক-পুরস্কার যথেষ্টই পেয়েছেন। তারা সরকারি আনুকূল্যে অথবা সরকারি ডেলিগেশনের সদস্য হয়ে শুধু পশ্চিম পাকিস্তান নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। অধ্যাপক-লেখকেরা পাঠ্যপুস্তক লিখে উপার্জন করেছেন প্রচুর। পাঠ্যপুস্তক রচনায় মুনীর চৌধুরী ছিলেন শীর্ষে। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বাংলা অনেকগুলো পাঠ্য সংকলনের তিনি সম্পাদক।
আইয়ুব সরকারের সাংস্কৃতিক নীতির যারা রচয়িতা ছিলেন, তাঁদের দু’একজন বাদে সবাই ছিলেন অবাঙালি উর্দুভাষী। তাঁদের কেউ কেউ ছিলেন উচচপদস্থ সরকারি আমলা। তারা অনেকে পাকিস্তানে এসেছিলেন ভারতের পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ বা মধ্যপ্রদেশের সংস্কৃতিবান পরিবার থেকে। সংগীত, শিল্পকর্ম, সাহিত্যের কদর তারা বুঝতেন। তাঁরা উঠতি বাঙালি কবি-সাহিত্যিক শিল্পীদের পদক-পুরস্কার দিয়ে মর্যাদা দিতে চাইতেন। সেই সুযোগের ষোলো আনা সদ্ব্যবহার করেছেন পূর্ব বাংলার কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা।
পুরস্কারের ক্ষেত্রে ষাটের দশক ছিল বাঙালি কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের জন্য স্বর্ণকাল। শুধু বাংলা একাডেমি পুরস্কার নয়, সরকারি আনুকূল্যে প্রবর্তিত হয়েছিল আরও কয়েকটি মর্যাদাবান পুরস্কার, যেমন আদমজী পুরস্কার, দাউদ পুরস্কার, ন্যাশনাল বুক সেন্টার অব পাকিস্তান পুরস্কার, জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থা পুরস্কার, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান পুরস্কার, ইউনেসকো সাহিত্য পুরস্কার প্রভৃতি। এসব পুরস্কারের কারণে উন্নতমানের সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা পান লেখকেরা।