সামনের বাগানে ছোট ছোট নিচু টেবিলের পাশে রাখা চারটে করে হালকা চেয়ার। বাইরের বারান্দায় ডান দিকে বিছানো দামি কার্পেটের ওপর ধবধবে রেশমের চাদর। আর বসবার ঘরটাও আজ নতুন করে সাজানো হয়েছে। লিলির আজ দশম জন্মতিথি। তাহমিনা আর মালেকাবাণু নিজ হাতে সাজিয়েছেন সব। ফুলদানিতে বিরাট তোড়া বেঁধেছে তাহমিনা মধুমল্লিকা আর গোলাপের। জানালা দরজার পর্দাগুলো বদলে দিয়েছে। কামাল সাহেব সময় পান না মোটে। এদিকে চোখ দেবার মত অবসর তার নেই। তবু আজ বিকেলে কোথাও বেরুবেন না তিনি। বিকেলেই পাটি হবে। মালেকাবাণুই ঘুরে ঘুরে সব ব্যবস্থা করছেন। আর এই সময় কাজে লাগছে লাবলুকে। মরিস নিয়ে হৈচৈ করে সব আনতে কুড়োতে ঠিকঠাক করতে লেগে গেছে সে।
সব কিছু সাজিয়ে গুছিয়ে, লিলিকে দর্জির কাছ থেকে আনা নতুন ফ্রক পরিয়ে চুল বেঁধে প্রসাধন করিয়ে যখন ছেড়ে দিল তখন তাহমিনা বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আর বিকেল প্রায় হয়ে এলো, একটু পরেই সবাই আসতে শুরু করবে। মালেকাবাণু বললো, এবার একটু নিজকে দেখগে তুই। খেটে খেটে যে একেবারে হয়রান হয়ে গেলি।
তাহমিনা হাসতে চাইল, কিন্তু দেখাল ম্লান।
যা তুই এখন মুখ ধুয়ে চট করে কাপড় পরে নে। দেরি করিস নে। সকলে এলো বলে। তাহমিনা বাথরুমে গিয়ে ঢুকলো। আস্তে আস্তে সাবান দিয়ে ঘষে উজ্জ্বল করে তুলল মুখশ্রী। অলস একক বেণি বেঁধে চক্রাকারে সাজিয়ে দিল মাথার পেছনে। আয়নায় তাকিয়ে রইল একটুক্ষণ। তারপর সরে এসে শাড়ি পড়ল অনেকক্ষণ ধরে। ছাই–ছাই–নীলাভ রঙের শাড়ি। রূপোলি বর্ডার দেয়া। তার সাথে মানিয়ে পরল বাহুতে সোনালি রঙের কাজ করা সাদা সাটিনের উন্নত চায়না কলার চোলি।
অলস, কিছুটা উদাস পায়ে বাথরুমের দরোজা ভেজিয়ে ভেত, বারান্দা ঘুরে বাইরের বারান্দায় এসে যখন দাঁড়ালো, তখন মুখোমুখি পড়ে গেল ফার র। চোখ নামিয়ে নিচু গলায় শুধালো, কখন এলে তুমি?
এই তো এখুনি।
বোসো কোথাও।
তোমাকে আজ ভারি সুন্দর লাগছে তাহমিনা। মনে হচ্ছে দেখিনি এর আগে।
যাও। কেউ শুনবে।
ফারুক হাসল। একটু পর শুধালো, লিলি কই?
ভেতরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি বোসো।
তাহমিনা চলে গেল। আর একটু পরেই প্রায় ছুটতে ছুটতে এলো লিলি। বলল, আপনি সক্কলের আগে এসেছেন কিন্তু।
তাই নাকি? বলো তো কি এনেছি?
ফারুক তার হাতের প্যাকেট পেছনে লুকিয়ে শুধালো। লিলি প্রায় গোড়ালিতে ভর করে উদগ্রীব হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। প্রেজেন্টশন টেবিলের দিকে এগিয়ে ফারুক রাখলো তার হাতের বই কখানা। তারপর লিলিকে কাছে ডাকলো। পকেট থেকে বের করলো একটা নীল কেস। উজ্জ্বল একটা লাল পাথর বসানো ছোট্ট তারার লকেট। ওপরে কালো সিল্কের চওড়া টেপ পরানো! লিলির গলায় পে বেঁধে, তারাটা ঠিক মত বসিয়ে ফারুক ফিসফিস করে বলল, কেমন হয়েছে লিলি?
ভালো।
শুধু ভালো? খুশি হওনি?
লিলি দৌড়ে চলে গেল ভেতরে। একটু পরে কামাল সাহেব ফিরলেন। জাকি ফিরলো অফিস থেকে ছুটি নিয়ে। লাবলু ফিরল মরিস নিয়ে। মালেকাবাণুর সাথে ছোট্ট দেখা হলো ফারুকের। আস্তে আস্তে বাইরের সবাই এসে গেলেন। বিকেল হলো পাঁচটা। ভরে উঠলো প্রেজেন্টশনের ছোট টেবিল।
শেষ হলো লিলির ছোট্ট জন্ম–উৎসব। বেলা এখনো পড়ে নি। ফারুক চলে যাচ্ছিল, তাহমিনা ভেতর থেকে এসে আড়ালে বলল, দাঁড়াও, আমিও বেরুবো।
আজ ওর জন্মদিন গেলো। নাইবা বেরুলে।
বড্ড বিশ্রী লাগছে ফারুক। না বেরুলে মরে যাবো। এক কাজ করো, তুমি জাপান কনসুলেটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকো, আমি আসছি।
মালেকাবাণুর সাথে আরেকবার দেখা করে এলো ফারুক।
কিছুক্ষণ পরেই এলো তাহমিনা।
এসো রিকশা করি।
কোথায়?
চলো না যেখানে বেরিয়ে আসা যায়। একটু নিরিবিলি।
অবশেষে মতিঝিলের জন্য রিকশা নেয়া হলো। রিকশায় উঠে তাহমিনা গলা ফিরিয়ে বলল, তোমাকে আগে আসতে বলেছি কেন জানো? ওরা বেরুতে দিত না এখন। বলে এলাম ক্লাশের এক মেয়ের কাছে যাচ্ছি। খুব দরকার আছে। বাবা বলে দিলেন, তাড়াতাড়ি ফিরিস।
তুমি কী বললে?
বললুম আর ফিরব না। তাহমিনা মিষ্টি হাসল।
ফারুক একটু পর বলল, হেঁটে গেলেই পারতুম। বেশ হতো।
দূর, রিকশাই ভালো। ঢাকা শহরটা দিন দিন এমন হয়ে যাচ্ছে যে পথ চলা ভার। শুধু ভিড় আর ভিড়। রিকশাওয়ালাকে সে ভিড় সরাবার ভার দিয়ে তবু নিশ্চিন্ত মনে গল্প করা যায়। ফারুক কিন্তু এর উত্তরে কিছুই বলল না। তাহমিনা একটুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে তারপর চিবুকে ভাঁজ তুলে শুধালো, কি হলো তোমার, কথা বলছ না যে বড়?
না কই। কী যে বলো।
তাহমিনা ভ্যানিটি ব্যাগ খুললো। তুলে নিল একটা মধুমল্লিকা সেখান থেকে। বলল, নাও সন্ধি করলাম।
কিসের?
যদি কোন অপরাধ করে থাকি, তার। এই আমার সন্ধির পতাকা।
একবার কপোলে সেই ফুল বুলোলো তাহমিনা। তারপর ফারুককে দিয়ে হেসে বলল, আশা করি পতাকার অমর্যাদা হবে না।
সে ভয় নেই তাহমিনা।
ওরা গিয়ে থামল মতিঝিলের মাঠে। সবুজ ঘাসের ওপরে এক কোণে গিয়ে পা ছড়িয়ে বসলো দুজনে। সন্ধ্যে নামছে আস্তে আস্তে; পথে এখনো বাতি জ্বলে নি। দূরে দুএকটা ফ্ল্যাটে শুধু আলো দেখা যাচ্ছে। আর একটা অস্পষ্ট কোলাহল মানুষ আর যানবাহনের সুদূর ঢেউয়ের মত এসে তাদের চারধারে ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ তারা বলছে না কোন কথা। যেন চুপ করে থাকাই ভালো এখন। ভায়োলেট রংয়ে আঁকা সারাটা সুনীল এখন। ফারুক বলল, জানো তাহমিনা, এই সন্ধ্যের মন–কেমন–করা এক আবছা গান আছে। কী যেন শুধু বলতে ইচ্ছে করে। করতে সাধ হয়।
কী? মৃদু কম্পিত গলায় বুঝি তাহমিনা উত্তর করল।
ঠিক কী যে বলতে চাই তা নিজেও জানিনে।
ও হাসল। মিষ্টি করে হাসল। নিস্তব্ধ দুজনে। অনেকক্ষণ পরে ফারুক উচ্চারণ করল, দেড় বছর ধরে আমরা আলাপিত। এমনি কতদিন আমরা বেরিয়েছি বেড়াতে। হেঁটে গেছি অনেক দূর অবধি। কোনদিন রমনায়। কোনদিন সেই দয়াগঞ্জের রেল লাইন ধরে, পায়ের নিচে শহরতলির বাজার রেখে অনেক দূরে। কথা বলেছি। আমার সব কথা বলেছি তোমাকে। তাহমিনা ভ্যানিটি ব্যাগের স্ট্র্যাপ নাড়তে নাড়তে জমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি চাও ফারুক?
আমি তোমাকে ভালবাসি তাহমিনা।
আর সে কথা বলল না। কিছুই বলল না। শুধু তার বুকের ভেতরে যেন ছড়িয়ে পড়ল মিঠে ব্যথার মত একটা অনুভূতি। ফারুক চুপ করে থেকে তাহমিনার নীরবতাকে অনুভব করতে চাইল। অনেকক্ষণ পর মুখ ফিরিয়ে বলল, জানো তাহমিনা, আজ আমার অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কেন যেন মেলা বকতে ভালো লাগছে।
তুমি বলো ফারুক! আমি কোনদিন তো না করিনি।
দেড় বছর কেটেছে আমাদের স্বপ্নের মত। কিন্তু জানো কথাও একদিন ফুরিয়ে যায়। বলবার শোনবার কিছুই আর বাকি থাকে না। তখন মুখোমুখি শুধু। আর কী জানো এমন একটা দাবি গড়ে ওঠে, আরো কাছে তাকে পাবার জন্য। তোমাকে আমি আরো ঘনিষ্ঠ করে একান্তভাবে চাই তাহমিনা। আর কতদিন কাটবে?
কী জানি!
কিন্তু তুমি আমার হও তাহমিনা। তোমাকে আমি পরিপূর্ণ করে পেতে চাই মিনু।
এই প্রথম তাকে ও ডাকল মিনু বলে।
দূরে বাঁশের বেড়া দেয়া ছোট ছোট রেস্তোরাঁয় বাজছে গ্রামোফোন। মিহি আবছা সুর আসছে ভেসে। দুপুরে আকাশ ছিল সিলভার গ্রীন। একটু আগেই কোমল ভায়োলেট। আর এখন সেখানে প্রুসিয়ান ব্লু। দুএকটা সোনালি ৩রার ডট। ফারুক আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো তার পাশে। অনুভব করতে চাইল তার দেহের উত্তাপ। নান্নিধ্য। অনেকদূরে ইঞ্জিনের বাজল সিটি। নারায়ণগঞ্জ থেকে বুঝি ছটা চল্লিশের লোকাল আসছে। তাহমিনা আবছা গলায় উচ্চারণ করল, আমি বড় নিঃসঙ্গ ফারুক। তুমি আমাকে একেলা থাকতে দিও না।
আরো অনেকক্ষণ তারা বসে রইল সেই অন্ধকারে সবুজ ঘাসের ভিতরে। একসময়ে উঠে এলো দুজনে। কলোনির ভিতরে সোজা র্জিন পথের পাশ দিয়ে আমিনবাগের দিকে হাঁটতে হাঁটতে তাহমিনা বলল, এত একেলা নিজেকে আর কোনদিন মনে হয়নি। আজ সারা দুপুর আমার কেটেছে কী নিঃসঙ্গতায়।
আমার ও মিনু। বিকেলে তোমার সাথে দেখা হবে, তবু মনে মনে উনুন এসে ভর করছিল আমার।
আমার এই নিঃসঙ্গতা তুমি মুছে দিও!
আমি তোমাকে পরিপূর্ণভাবে পেতে চাই তাহমিনা। আমাকে বড় হতে হবে। তোমাকে পেয়ে আমি বড় হবো।
তাহমিনা তার উত্তরে বলল, তুমি এমনিই বড়। তোমাকে আমি বড় করব সে সাধ্য আমার নেই। সে ভার আমাকে তুমি দিও না।
কিছুক্ষণ আবার চুপচাপ হাঁটল তারা। উঠলো রাস্তায়। হুহু করে বাতাস বইছে। বাতাসে কপালের কাছে চূর্ণচুল উড়ছে তাহমিনার। বাঁ হাতে আনমনা সে সরিয়ে দিল। ফারুক বলল, শেষ পরীক্ষা তো হয়ে গেল। এবার জীবনের মুখোমুখি এসে দাঁড়াতে হবে। তুমি পাশে এসে না দাঁড়ালে, আমি জানি, হেরে যাব।
দূর, কী যে বলো।
হঠাৎ ফারুক বলল, সুর বদলিয়ে, এক কাজ করি কী বলে?
কী?
খালাআম্মাকে বলি।
কী বলবে?
তাহমিনা গতি শ্লথ করে তাকে শুধালো আয়ত চোখ দীর্ঘতর করে।
বাঃ, কী বলব জানো না বুঝি?
বলতে পারবে?
কেন পারব না? তুমি বললেই পারব। বলো না তুমি।
তাহমিনা সলাজ হেসে বলল, যাঃ ফাজিল কোথাকার! আমার লজ্জা করবে না বুঝি? তুমি যে কী।
ফারুক একথার উত্তরে তাহমিনার হাত তুলে নিল তার মুঠোয়। হাসল। প্রথমে আস্তে। তারপর একটু জোরে। আর তার মুঠোর ভিতরে জড়িয়ে রইল তাহমিনার দীর্ঘ আঙুলের উষ্ণ কোমলতা।