০৫. সামথিং রটেন

০৫. সামথিং রটেন

সন্ধ্যা ৬টা ১২ মিনিট।
কোপেনহাগেন, ডেনমার্ক।

ইউরোপে কোনো কিছুই কী সঠিক সময়ে শুরু হয় না?

হাতঘড়ি দেখল গ্রে।

 নিলাম শুরু হওয়ার কথা ৫ টায়।

এখানে বাস, ট্রেন বেশ ভালই পাওয়া যায় কিন্তু যদি ঠিক সময়ে কোনো অনুষ্ঠানের প্রসঙ্গ আসে তখন ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। এক ঘণ্টা লেট। ৬টারও বেশি বাজে এখন। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, অনুষ্ঠান শুরু হবে সাড়ে ৬টায়। উত্তর সাগরে ঝড় হওয়ার কারণে অনেকে দেরি করে আসছে। সাগরের বৈরি আবহাওয়ার কারণে কোপেনহ্যাগেনে আসতে দেরি হয়েছে প্লেনগুলোর।

 নিলামে অংশগ্রহণকারী বিডাররা (ক্রেতা) এখনও আসছে ধীরে ধীরে।

 সূর্য কোপেনহ্যাগেনের আকাশ থেকে বিদেয় নিতেই স্ক্যানডিক হোটেল ওয়েবারস-এর তিনতলার বারান্দায় এসে দাঁড়াল গ্রে। Ergenschein Auction House এর রাস্তার অপর পাশেই এটার অবস্থান। চার তলা ভবনের এই নিলাম অফিসটিকে আর্ট গ্যালারি বলে মনে হয়। আধুনিক ডেনিশ ছিমছাম স্টাইল, সবকিছু গ্লাস আর সাদা রঙের কাঠ দিয়ে সাজানো। চার তলা ভবনের নিচতলায় নিলাম অনুষ্ঠিত হবে।

শীঘ্রি শুরু হবে, আশা করা যায়।

হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙল গ্রে।

কিছুক্ষণ আগে ওর আগের হোটেলে গিয়ে নজরদারির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছে। আসার সময় চেক-আউট করেছে হোটেল থেকে। তারপর নতুন নাম আর মাস্টারকার্ড নিয়ে এই হোটেলে রুম বুক করেছে ও। এই রুম থেকে কোপেনহ্যাগেনের সিটি স্কয়ারের বিস্তৃত দৃশ্য দেখা যায়। পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো পার্কগুলোর মধ্যে অন্যতম টিভলি গার্ডেনস এই হোটেল থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ওখান থেকে ভেসে আসা গান ও হাসাহাসি শোনা যায় ওর বারান্দা থেকে।

রাস্তার পাশের দোকান থেকে একটি হট ডগ কিনে এনেছিল গ্রে। খোলা ল্যাপটপের পাশে ওটা আধ-খাওয়া অবস্থায় পড়ে আছে। সারাদিনে এই হট ডগ ছাড়া আর কিছু খায়নি ও। মানুষ মনে করে, ওর মতো এজেন্টরা বিভিন্ন অভিজাত ক্যাসিনো ঘুরে বেড়ায় আর রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া করে। ভুল। ওগুলো স্রেফ গুজব। হট ডগ কিনতে গিয়ে আমেরিকান ডলারে ওর খরচ হয়েছে ৫ ডলার। গলা কাটা দাম নিলেও খেতে ভালই ছিল।

মোশন সেনসেটিভ ক্যামেরা দ্রুত কয়েকটি ছবি তুলতেই ল্যাপটপের স্ক্রিন কেঁপে উঠল। নিলামে অংশগ্রহণকারী প্রায় দুই ডজন ব্যক্তির ছবি ও ইতোমধ্যে তুলে ফেলেছে। যেমন : ব্যাংকার, হাস্যউজ্জ্বল ইউরোপীয়, চকচকে স্যুট পরা তিন জন ভদ্রলোক–দেখেই বোঝা গেল এরা মাফিয়া, এক বেটে-খাটো মহিলা-অধ্যাপিকা হবে হয়তো এবং সাদা রঙের দামি পোশাক পরা চার জোড়া ব্যক্তি–ওদের প্রত্যেকের মাথায় নাবিকদের মতো ক্যাপ আছে। শেষের কয়েকজন আমেরিকান ভাষায় কথা বলল। বেশ উচ্চস্বরে।

গ্রে মাথা নাড়ল।

সম্ভবত লোকজন যা আসার এসে পড়েছে। আর খুব একটা বাকি নেই।

নিলাম ভবনের সামনে একটি লম্বা লিমুজিন এসে থামল। নামল দুজন। দুজনই হালকা-পাতলা, বেশ লম্বা। ম্যাচিং করে দুজন আরমানি কালো স্যুট পরেছে। একজন পুরুষ অন্যজন নারী। পুরুষটি রবিন পাখির ডিমের ছবিঅলা নীল টাই পরে আছে। অন্যদিকে তার সঙ্গিণীর পরনে আছে সিল্কের রাউজ, ওটাও নীল। দুজনের বয়সই কম, ঊর্ধ্বে ২৫ বছর হবে। কিন্তু তাদের হাবভাব দেখে মনে হলো তারা নিজেদেরকে তারচেয়েও বেশি বয়স্ক হিসেবে উপস্থাপন করতে চাচ্ছে। ওদের দেখতে নির্বাক যুগের সিনেমার তারকার মতো লাগল। টগবগে বয়স। মুখে কোনো হাসি নেই, আবার গম্ভীর করেও রাখেনি। ছবিতে দেখা গেল তাদের চোখে স্বাভাবিক সৌহার্দ্যপূর্ণ ছাপ আছে।

ডোরম্যান ওদের জন্য দরজা টেনে ধরল।

ডোরম্যানকে মাথা ঝাঁকিয়ে ধন্যবাদ দিল ওরা… পরিমিত ভঙ্গিতে, কোনোরকম আদিখ্যেতা ছাড়া। ভেতরে ঢুকল ওরা। ওদের পেছন পেছন ডোরম্যানও ঢুকে পড়ল। বোঝা গেল, এই দম্পতির পর আর কেউ আসবে না। এমনও হতে পারে, এদের জন্যই নিলাম অনুষ্ঠান এতক্ষণ দেরি করা হয়েছে।

এরা কারা?

কৌতূহল দমন করল গ্রে। লোগান গ্রেগরি মানা করেছেন।

গ্রে ভোলা ছবিগুলো আবার চেক করল। দেখে নিল অংশগ্রহণকারী সবার চেহারা স্পষ্টভাবে উঠেছে কি-না। সন্তুষ্ট হয়ে ফাইলগুলো একটি পেন-ড্রাইভে নিয়ে ওটা পকেটে রেখে দিল। এখন ওকে এই নিলাম অনুষ্ঠান শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। যেসব জিনিস বিক্রি হয়ে যাবে সেগুলোর নাম ও ক্রেতার তালিকা যোগাড় করার ব্যবস্থা লোগান করে রেখেছেন। ওর মধ্যে কয়েকটি ছদ্মনাম থাকবে, বলাই বাহুল্য। তবে এই তথ্যগুলো ইউ.এস টাস্ক ফোর্স ও প্রয়োজনে ইউরোপোল ও ইন্টারপোলকে দেয়া হবে। এখানকার আসল ঘটনা হয়তো গ্রের আর কখনও জানা হবে না।

যেমন : কেন ওকে আক্রমণ করা হয়েছিল? গ্রিট্টি নেয়াল কেন খুন হয়ে গেলেন?

নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিল গ্রে। পুরো বিকেল লেগে গেল এই কাজে, কিন্তু মনের অস্থিরতা কমল। লোগান ওকে শান্ত থাকতে বলেছেন, বিষয়টি মেনে নিতে শুরু করল ও। এখানে কী হতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে ওর কোনো ধারণা নেই। অন্ধের মতো কিছু করতে গেলে হয়তো আরও লোকজন মারা পড়বে।

কিন্তু তবুও একটা অপরাধবোধ ওকে ভোগাচ্ছে, শান্ত-স্থির হতে দিচ্ছে না। বিকেলের অধিকাংশ সময় নিজের রুমে হাঁটাহাঁটি করে কাটিয়েছে ও। বিগত দিনগুলো বারবার ওর মানসপটে ফুটে উঠেছে। শুরু থেকেই আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল… আর সাবধানতা অবলম্বন…।

পকেটে গ্রের সেল ফোন কেঁপে উঠল। বের করে নাম্বার চেক করল ও। বাঁচা গেল। ফোন রিসিভ করে বারান্দার রেইলিঙের কাছে গেল ও।

র‍্যাচেল… তুমি ফোন করেছ দেখে খুশি হয়েছি।

তোমার মেসেজ দেখলাম। তুমি ঠিক আছে তো?

র‍্যাচেলের কণ্ঠে ব্যক্তিগত ও পেশাদার দুটো বিষয় নিয়েই আগ্রহের সুর পেল ও। মেসেজে লিখেছিল, ওদের হয়তো সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য দেখা হবে। বিস্তারিত কিছু লেখেনি। যতই প্রেম করুক, পেশাদারিত্বের খাতিরে নিরাপত্তাজনিত কিছু জিনিস মেনে চলতেই হয়।

আমি ভাল আছি। কিন্তু কথা হলো, মনক আসছে। মাঝরাতের পর পর এখানে এসে পৌঁছুবে।

আমি এইমাত্র ফ্রান্কফ্রুটে এলাম, বলল র‍্যাচেল। কোপেনহ্যাগেনে ল্যান্ড করেই মেসেজ চেক করেছি।

আমি সত্যিই দুঃখিত…।

 তাহলে আমি ফিরে যাব?

র‍্যাচেলকে কোনোভাবেই এখানে জড়ানো যাবে না। সেটাই ভাল হবে। আমরা নাহয় অন্য কোনো সময় দেখা করব। এখানকার পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হোক। আচ্ছা, ফেরার পথে আমিই নাহয় একবার রোমে নামব। তোমার সাথে দেখা করব তখন।

খুশি হব।

 র‍্যাচেলের কণ্ঠে হতাশার সুর পরিষ্কার টের পেল গ্রে।

কথা দিলাম… দেখা করব, গ্রে বলল। মনে মনে আশা করল, এই প্রতিজ্ঞা যেন, সে রাখতে পারে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল র‍্যাচেল, বিরক্তিতে নয়, পরিস্থিতি মেনে নিয়ে। ওদের সম্পর্কটা বেশ দূরের। দুজন দুই দেশে থাকে, দুটো ভিন্ন ক্যারিয়ার। কিন্তু তবুও ওরা সম্পর্কটা চালিয়ে যেতে চায়। দেখতে চায়… এই সম্পর্ক কোথায় নিয়ে যায় ওদের।

আমি ভেবেছিলাম আমরা একটু কথা বলার সুযোগ পাব, র‍্যাচেল বলল।

র‍্যাচেলের এই শব্দগুলোর পেছনে থাকা গভীর অর্থ গ্রে অনুধাবন করতে পারল। ওরা দুজন একে অন্যের বেশ কাছাকাছি সময় কাটিয়েছে, দুজন দুজনার ভাল দিক, মন্দ দিক সম্পর্কে জানে। তবে দূরতুযুক্ত এই রোমান্টিক সম্পর্কে কেউ আগবাড়িয়ে নিজের মনের আসল কথা বলতে রাজি নয়। ওরা দুজনই জানে পরবর্তী ধাপ নিয়ে ওদের আলোচনা করা উচিত।

আলোচনা ওদের এই দূরত্ব কমিয়ে আনতে পারে।

ওদের সর্বশেষ দেখা হয়েছে অনেক দিন আগে, মাঝের এতদিনের দেখা না হওয়াটাই হয়তো এই ধরনের আড়ষ্টতার জন্য দায়ী। কিছু না বলা কথা নিয়ে ওরা দুজনই ভেবেছে। এখন সময় এসেছে, এগুলো জানাতে হবে।

আরও সামনে এগোবে নাকি এগোবে না।

আচ্ছা, গ্রে নিজের উত্তর জানে তো? র‍্যাচেলও ভালবাসে। ওকে নিয়ে জীবন শুরু করতে একদম প্রস্তুত। এমনকী ওরা বাচ্চা নিয়েও কথা বলেছে। কিন্তু তবুও… কী যেন ওকে বাগড়া দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, ওদের আর এসবের সময় নেই, দেরি হয়েছে। অনুভূতিটা কেমন যেন অদ্ভুত, আলাদা। পার্থিব অন্য অনুভূতির সাথে একদমই মেলে না।

হয়তো ওদের দুজনের কথা বলা উচিত।

 রোমে আসব, বলল গ্রে। প্রমিস করলাম।

ঠিক আছে, আমি কিন্তু তোমার জন্য চুলোয় রান্না তুলে দিয়ে অপেক্ষা করব! গ্রে টের পেল র‍্যাচেলের কণ্ঠ থেকে দুশ্চিন্তার সুর মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি তোমাকে মিস করি গ্রে। আমরা…।

 গাড়ির কর্কশ হর্নের কারণে ওর কথার বাকি অংশ গ্রে শুনতে পেল না।

 নিচের রাস্তার দিকে তাকাল গ্রে। একজন নারী চলমান গাড়ির ভেতর দিয়ে দুই লেন দৌড়ে পার হচ্ছে। পরনে কাশিরী জ্যাকেট ও পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঝুলে থাকা পোশাক। চুল খোঁপা করা। গ্রে প্রায় চিনতেই পারছিল না। কিন্তু হর্ন বাজানো ড্রাইভারের দিকে ঘুরে তাকাতেই চিনতে পারল।

ফিওনা।

এই মেয়ে এখানে কী করছে?

গ্রে…? র‍্যাচেল ফোনে বলল।

 হড়বড় করে জবাব দিল গ্রে। আমি দুঃখিত… র‍্যাচেল… আমাকে যেতে হচ্ছে।

 ফোন কেটে দিয়ে পকেটে ভরল।

নিচে ফিওনা নিলাম ভবনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। নিজের ল্যাপটপের কাছে ফিরল গ্রে। ওর ক্যামেরা মেয়েটির ছবি তুলে নিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ভেতরে ডোরম্যানের সাথে তর্ক করছে ফিওনা। ডোরম্যানের হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিল সে। লোকটি কাগজ পরীক্ষা করল, উঁকুটি করে ভেতরে যাওয়ার জন্য ইশারা করল ওকে।

ডোরম্যানকে পেরিয়ে ঝড়ের বেগে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল ফিওনা। তারপর ক্যামেরায় সব অন্ধকার।

একবার ল্যাপটপ আরেকবার রাস্তার দিকে তাকাল গ্রে।

ধেৎ..

আচ্ছা, পেইন্টার ক্রো হলে কী করতেন?

ভেতরে ঢুকে নিজের পোশাক বের করল ও। ওর স্যুট জ্যাকেট বিছানায় রাখা আছে। জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য রেখে দিয়েছিল।

এরকম পরিস্থিতিতে পেইন্টার নিশ্চয়ই চুপচাপ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতেন না।

.

সকাল ১০টা ২২ মিনিট।
 হিমালয়।

আমাদেরকে শান্ত থাকতে হবে, বলল পেইন্টার। চুপ করে বসে থাকো।

 ওদের সামনে ভূতুড়ে আলো উদয় হলো… আবার নিভে গেল। জমাট বাঁধা ঝরনাধারাকে প্রবল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আবার ঢেকে দিল ঘন কালো অন্ধকারে। চারদিকে ঠাণ্ডা, সুনসান নীরবতা।

 পেইন্টারের আরও কাছে ঘেঁষল লিসা। হাত ধরল ক্রোর। এতটাই শক্ত করে ধরল যে ক্রোর হাতের তালুতে রক্ত চলাচলে বিঘ্ন ঘটল।

 ভাবনার কিছু নেই, আমাদেরকে ওরা খুঁজবে না, ভয়ে ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছে না লিসা। ফিসফিস করে বলল, এই ঝড়ের ভেতরে কেন আমাদের খুঁজতে আসবে? ওই ভয়ঙ্কর আলো দিয়েই তো আমাদেরকে শেষ করে দিতে পারবে। আলো থেকে তো আর আমরা বাঁচতে পারব না।

পেইন্টার বুঝল, লিসা ঠিকই বলেছে। ওরা কোনোভাবেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না। আর এরকম বিরান অঞ্চলে চাপ আর প্রাণঘাতী ঠাণ্ডায় ওরা এমনিতেও মারা যাবে। স্নাইপারের গুলি খেলেও মরতো, এখানেও মরবে।

কিন্তু পেইন্টার আশা ছাড়তে রাজি নয়।

 পাগলামো শুরু হতে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। যদি ও সেই দুই ঘণ্টা নষ্ট না করতো। যদি সময়মতো সাহায্যের ব্যবস্থা করা যেত তাহলে হয়তো কাজ হতো।

আমরা এটার ভেতর দিয়ে যাব। হালকা স্বরে বলল পেইন্টার।

লিসা বিরক্ত হলো।

কীভাবে?

ভূতুড়ে আলো আবার উদয় হতেই ক্রোর দিকে তাকাল ও। আলোর উজ্জ্বলতায় গুহা একদম হীরের মতো জ্বলে উঠল। ক্রো যতটা আংশকা করেছিল লিসার চোখে ঠিক ততটা ভয়ের ছাপ ছিল না। তবে লিসা ভয় পেয়েছে কোনো সন্দেহ নেই… বেশ ভালই ভয় পেয়েছে… শক্ত করে তাকিয়ে আছে।

আমাকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে কথা বলবে না, বলে দিলাম। ক্রোর হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিল লিসা।

ক্রো মাথা নাড়ল। যদি তাদের বিশ্বাস মতে, এই আলো আমাদের না মেরে ফেলে… তাহলে হয়তো আশা আছে। আর ওরা হয়তো ওই দেয়াল থেকে এই পাহাড়ের ওপর নজর রাখছে না। ঝড় শেষ হয়ে গেলে আমরা হয়তো…

হঠাৎ বন্দুকের শব্দে শীতের সুনসান নীরবতা খান খান হয়ে গেল।

লিসার চোখে চোখ পড়ল ওর।

শব্দটা বেশ কাছ থেকেই এসেছে।

সেটার প্রমাণস্বরূপ কয়েকটি গুলি এসে বরফের দেয়ালে হুমড়ি খেল। কম্বল ছেড়ে পিছু হটল ওরা। গুহার পেছন দিকে এগোল। কিন্তু পালানোর কোনো রাস্তা নেই।

এবার পেইন্টার একটি জিনিস খেয়াল করল।

অন্যবারের মতো ভূতুড়ে আলো এবার আর নিভে যায়নি। চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বলতা নিয়ে জমাট বাঁধা ঝরনাধারা দীপ্তি ছড়াচ্ছে। স্থির করে আলো ধরা আছে ওদের দিকে।

বুলহর্ন (হ্যান্ড মাইক) থেকে আওয়াজ ভেসে এলো। পেইন্টার ক্রো! আমরা জানি আপনি আর সেই মহিলা ওখানে লুকিয়ে আছেন! নারীকণ্ঠ থেকে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। উচ্চারণে বিদেশি টান।

হাত উঁচু করে বেরিয়ে আসুন।

লিসার কাঁধে চাপ দিয়ে যতটুকু সম্ভব ভরসা দেয়ার চেষ্টা করল পেইন্টার এখানেই থাকো।

খুলে রাখা পোশাকের দিকে ইশারা করে দেখাল ও, পোশাক পরে নিতে বলল লিসাকে। ক্রো নিজের জুতো পরে বরফের দেয়ালের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে মাথা বের করল।

পাহাড়ি অঞ্চলে যেমনটা হয়ে থাকে, ঝড় এই হামলে পড়ে আবার এই নেই! এখানেও একই অবস্থা। কালো আকাশে যেন তারার হাট বসেছে।

 রাতের অন্ধকারকে ঝেটিয়ে বিদেয় করেছে হাতের কাছে থাকা একটি স্পটলাইট। জমাট বাঁধা বরফের দেয়ালের ঠিক মাঝ বরাবর ওটাকে তাক করে রাখা হয়েছে। ১৫০ ফুট দূরে একটি নিচু উপত্যকায় স্নোয়মাবাইলের (বরফের ওপর দিয়ে চলাচলের জন্য বিশেষ বাহন, অনেকটা জেট স্কির মতো) উপরে একটি অবয়ব বসে আছে। সার্চলাইট চালাচ্ছে সে। একদম সাধারণ লাইট। তবে এর তীব্রতা আর আভা দেখে মনে হয় গ্যাস ব্যবহার করে এটাকে জ্বালানো হয়।

এটা কোনো রহস্যময় ভূতুড়ে আলো নয়।

স্বস্তির পরশ পেল পেইন্টার। এই আলোই তো জ্বলত সবসময়, বাহনগুলো আসার জন্য সংকেত দিন? ৫টি বাহন আছে, গুনল ও। সাদা পারকা পরা লোকজনগুলোকেও শুনে ফেলল। দুপাশেই ছড়িয়ে সবাই। সবার হাতে রাইফেল।

 কোনো উপায় না দেখে… নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও পেইন্টার গুহা থেকে হাত উঁচু করে বেরিয়ে এলো। কাছে থাকা রাইফেলধারী লোকটি রীতিমতো দৈত্যাকার। অস্ত্র তাক করে ওর দিকে এগিয়ে এলো। আলোর ছোট্ট বিম এসে পড়ল পেইন্টারের বুকে। লেজার লাইট, গুলি ছুড়লে ওখানে এসেই লাগবে।

পেইন্টার নিরস্ত্র অবস্থায় এদের সাথে পেরে উঠতে পারবে না। রাইফেলধারী ব্যক্তিকে মনে মনে মেপে নিল ও।

না, সুবিধে হলো না।

 লোকটির চোখে চোখ পড়ল ওর।

এক চোখ বরফ নীল, অন্য চোখ ধবধবে সাদা।

মঠের সেই আক্রমণকারী!

এই লোকের গায়ে অসুরিক শক্তি আছে, ওর মনে পড়ল। না, এরকম অস্বাভাবিক ঘটনা তো ভাল নয়। তার ওপর এরা সংখ্যায় অনেক বেশি। সফল হওয়া তো দূরে থাক পেইন্টারের কিছু করারই সুযোগ নেই।

লোকটির পেছন থেকে একজন সামনে এগিয়ে এল। মহিলা। হয়তো ইনিই একটু আগে বুলহর্নে কথা বলেছিলেন। সামনে এগিয়ে মাত্র এক আঙুল ব্যবহার করে রাইফেলকে নিচু করে দিলেন তিনি। মহিলার এরকম ক্ষমতা দেখে পেইন্টার অবাক হলো।

তিনি সামনে এগিয়ে এলেন, পেইন্টার তাকে স্পটলাইটের তীব্র আলোতেই দেখে নিল। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। কালো চুল, বব-কাট দেয়া, চোখগুলো সবুজ। পশমি হুডঅলা ভারী পারকা পরে আছেন তিনি। পোশাকের কারণে তার শারীরিক অবয়ব ঢাকা পড়ে গেছে তবে তার চলন দেখে মনে হলো তিনি বেশ সুতী ও সাবলীল।

 ডক্টর অ্যানা স্পোরেনবার্গ, এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে পরিচয় দিলেন তিনি। তাঁর গ্লোভস পরা হাতের দিকে তাকাল ক্রো। এই মহিলাকে টান দিয়ে এর যদি গলায় হাত প্যাচিয়ে ধরি, একে জিম্মি করে ফায়দা,…

কিন্তু মহিলার পেছনে দাঁড়ানো আততায়ীর চোখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু ভাবল না ও। মহিলার সাথে হাত মেলাল। যত যা-ই হোক, ওরা এখনও তো ওকে গুলি করেনি, ভদ্রতা করা যেতেই পারে। যতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারবে এই খেলা চালিয়ে যাবে ও। শুধু তাই নয়, লিসার কথাও ওকে ভাবতে হবে।

ডিরেক্টর ক্রো, বললেন অ্যানা। আপনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন এটা নিয়ে বিগত কয়েক ঘণ্টায় সেটা নিয়ে আন্তর্জাতিক ইন্টেলিজেন্স চ্যানেলগুলোতে বেশ হইচই হয়ে গেছে।

 নিজের চেহারা যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক রাখল ক্রো। নিজের পরিচয় অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই ওর। হয়তো এই পরিচয়কে ব্যবহার করে সুবিধা আদায় করা যাবে। তাহলে তো আপনি জানেন, আমাকে ওরা কীভাবে খুঁজে বের করবে।

Natiarlich, মাথা নাড়লেন তিনি। ভুলে জার্মান বলে ফেলেছেন। কিন্তু তারা সফল হবে বলে আমি মনে করি না। আমি বলব, আপনি আর সেই মহিলা যেন আমার সাথে যোগ দেন।

পেইন্টার এক পা পিছু হটল। ডক্টর কামিংসের সাথে আমার কোনো লেনদেন নেই। তিনি এখানকার অসুস্থতার চিকিৎসা করতে এসেছিলেন, ব্যস। এর বাইরে আর কিছুই জানেন না।

ওটা সত্য নাকি মিথ্যা সেটা আমরা খুব শীঘ্রি বের করে ফেলব।

ও আচ্ছা, তাহলে এই ব্যাপার। ওদেরকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে ওদের সন্দেহজনক জ্ঞানের কারণে। হয়তো রক্ত আর কষ্টের মাধ্যমে সেই জ্ঞান বের করে নেয়া হবে। পেইন্টার এই মুহূর্তে কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করল। ধুকে ধুকে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর চেয়ে তাৎক্ষণিক মৃত্যু ভাল। টর্চার সহ্য করার ব্যাপারে ও খুব স্পর্শকাতর।

কিন্তু ও তো এখানে একা নয়। লিসার কথা মনে পড়ল, ওর হাতের সাথে লিসার হাত লেগে উষ্ণ হওয়ার কথা মনে পড়ল। যতক্ষণ ওরা বাঁচবে ততক্ষণ আশাও থাকবে।

আরও গার্ড যোগ হয়ে গুহা থেকে লিসাকে অস্ত্রের মুখে জোরপূর্বক বের করে নিয়ে এলো। স্নোমোবাইলের দিকে এগোল ওরা।

ক্রোর চোখে চোখ পড়ল লিসার, ওর চোখ ভয়ে জ্বলজ্বল করছে।

 পেইন্টার সিদ্ধান্ত নিল, নিজের ক্ষমতার সর্বোচ্চটা দিয়ে লিসাকে রক্ষা করবে।

রওনা হওয়ার আগমুহূর্তে অ্যানা পোরেনবার্গ এলো ওদের কাছে। রওনা হওয়ার আগে কিছু কথা বলে রাখি। আমরা কিন্তু আপনাদেরকে ছেড়ে দেব না। আশা করি, আপনার বিষয়টা বুঝতে পারবেন। আমি কোনো মিথ্যা আশ্বাস দিতে পারব না। তবে আমি এতটুকু কথা দিতে পারি ব্যথাহীন, শান্তিতে আপনাদেরকে পরপারে পাঠানো হবে।

সন্ন্যাসীদের মতে, কর্কশ কণ্ঠে বলল লিসা। আপনাদের দয়ার নমুনা আমরা দেখেছি।

লিসার চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করল পেইন্টার। এখন এদের সাথে দ্বন্দ্ব করা ঠিক হবে না। মানুষ মারতে এই হারামিদের কোনো বিবেকবোধ হয় নাকি। এখন ওদের দুজনকে বাধ্য বন্দীর মতো আচরণ করে যেতে হবে।

কিন্তু দেরি হয়ে গেছে।

অ্যানা এই প্রথম লিসাকে সামনাসামনি দেখলেন। ওর দিকে ঘুরলেন তিনি। তার কণ্ঠে উত্তাপের আঁচ সুস্পষ্ট। হ্যাঁ, দয়াই করা হয়েছে, ড. কামিংস। রাইফেলধারী লোকটির দিকে এক পলক তাকালেন। মঠে কীরকম রোগ হয়েছিল সেসম্পর্কে আপনি কিছুই জানেন না। সন্ন্যাসীদের জন্য যে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছিল সেটাও জানেন না। কিন্তু আমরা জানি। ওদের মৃত্যুকে খুন বলা যাবে না। ওগুলো স্রেফ যন্ত্রণাহীন মৃত্যু।

আপনাকে সেটা করার অধিকার কে দিয়েছে? লিসা প্রশ্ন ছুড়ল।

 লিসার কাছে এগোল পেইন্টার। লিসা, হয়তো…।

না, মিস্টার ক্রো। অ্যানাও লিসার কাছে এগোল। কীসের অধিকার, তাই না? অভিজ্ঞতা, ড. কামিংস, অভিজ্ঞতা। বিশ্বাস করুন, যখন আমি আপনাকে বলব… তখন বুঝবেন ওখানকার মৃত্যুগুলো দয়া ছিল, নিষ্ঠুরতা নয়।

 হেলিকপ্টারে চড়ে আমার সাথে যে সন্ন্যাসী এসেছিলেন, তাঁর বেলায়? ওটাও দয়া ছিল নাকি?

শ্বাস ফেললেন অ্যানা, শব্দ গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেন। সিদ্ধান্তটা কঠিন ছিল তবুও নিতে হয়েছে। আমাদের কাজটা বেশি জরুরি ছিল।

 আর আমরা? অ্যানা পিঠ ফিরিয়ে ঘুরতেই লিসা প্রশ্ন করল। আমরা চুপচাপ সব মেনে নিয়ে আপনার সাথে গেলে যন্ত্রণাহীন মৃত্যু। আচ্ছা, যদি আমরা না যেতে চাই, আপস না করি তাহলে?

স্নোমোবাইলের দিকে এগোলেন অ্যানা। আপনি যেমনটা ভাবছেন, আমরা আপনাদের কোনো নির্যাতন করব না। স্রেফ ড্রাগ দেব। আমরা বারবারিয়ানদের মতো নিষ্ঠুর নই, ড. কামিংস।

না, আপনারা তো নাৎসি! হিসিয়ে উঠল লিসা। আমরা স্বস্তিকা দেখেছি!

বোকার মতো কথা বলবেন না। আমরা নাৎসি নয়। সোমোবাইলে পা তুলে দিয়ে শান্ত চোখে তাকালেন তিনি। আমরা আর নাৎসি নই।

.

সন্ধ্যা ৬টা ৩৮ মিনিট।
কোপেনহ্যাগেন, ডেনমার্ক।

রাস্তা পার হয়ে দ্রুত নিলাম ভবনের দিকে এগোল গ্রে।

ফিওনা এখানে কী মনে এসেছে? ডোরম্যানের সাথে রফা করার পর কী হলো?

মেয়েটির নিরাপত্তা নিয়ে ভাবল ও। অবশ্য এটাও স্বীকার করতে হবে ফিওনার কারণেই ও এখানে সশরীরে ঢোকার একটি অজুহাত পেয়েছে। দোকানে বোমা হামলা, গ্রিট্টি নেয়ালকে খুন এবং গ্রেকে খুন করার চেষ্টা যে বা যারা করে থাকুক না কেন… সূত্র ধরে তারা এখানেও আসবে।

 ফুটপাতে পৌঁছে গতি কমাল গ্রে। সূর্যের তির্যকরশ্মি নিলাম ভবনের দরজায় পড়ে ওটাকে রুপোলি আয়নায় পরিণত করেছে। সেই আয়নায় গ্রে নিজের সুন্দর পরিপাটি পোশাক আরেকবার দেখে নিল। ওকে সরু লম্বা চেকঅলা আরমানি স্যুটে বেশ ভাল মানিয়েছে। কিন্তু কলারের কাছে আঁটোসাঁটো হয়ে আছে সাদা শার্ট। গ্রে ওর হালকা হলুদ রঙের টাই-টা একটু ঠিক করে নিল।

নিজেকে লুকিয়ে রাখা চলবে না। ওকে একজন বিত্তশালী আমেরিকান ধনী ব্যক্তির চরিত্রে অভিনয় করতে হবে।

ও নিলাম ভবনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। লবির পুরোটা স্ক্যান্ডেনেভিয়ান ডিজাইনে সাজানো। এখানে সাদা রঙের কাঠ, গ্লাস দেয়া পার্টিশনসহ বিভিন্ন জিনিসের ঘাটতি আছে। লবির ভেতরে আসবাবপত্র বলতে ভাস্কর্য সাইজের একটি টেবিলের পাশে ডাকটিকেট সাইজের এই চেয়ার! ব্যস, এতটুকুই। টেবিলের ওপরে একটি অচিড় গাছের পট রাখা আছে।

হাতে থাকা সিগারেটটিকে পটে ঠেসে ধরে নিভাল ডোরম্যান, মুখ বেজার করে গ্রের দিকে এগোল। ওতে উল্লেখ করা হয়েছে ভবনের ফান্ডে ২.৫ মিলিয়ন ডলার পাঠিয়ে নিশ্চিত করা হয়েছে–এরকম একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে এই ক্রেতা উপস্থিত হওয়ার মতো সামর্থ্য রাখেন।

আমন্ত্রণপত্র পরীক্ষা করে মাথা নাড়ল ডোরম্যান। লম্বা লম্বা পা ফেলে মখমলের ফিতার দিকে এগোল। ওই ফিতা নিচ তলায় যাওয়ার জন্য চওড়া সিঁড়িকে বন্ধ করে রেখেছে। ডোরম্যান ফিতা সরিয়ে গ্রেকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ইশারা করল।

সিঁড়ির নিচে এক সেট সুইংভোর ওকে নিলাম অনুষ্ঠানের মূল ফ্লোরে পৌঁছে দিল। দুজন গার্ড প্রবেশমুখের দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে। একজনের হাতে মেটাল ডিটেকটর। হাত উঁচু করে নিজেকে সার্চ করতে দিল গ্রে। ও খেয়াল করল দরজার দুপাশে ভিডিও ক্যামেরা সংযুক্ত আছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ ভাল। ওকে সার্চ করা শেষ হতেই সুইচ টিপে সামনের দরজা খুলে দিল অন্য গার্ডটি।

বিভিন্ন রকম গুঞ্জন শুনতে পেল ও। ভাষাগুলো চিনতেও পারল : ইটালিয়ান, ডাচ, ফ্রেন্স, আরবি ও ইংলিশ। দেখে মনে হচ্ছে এই নিলামে অংশ নিতে পুরো দুনিয়া হাজির হয়ে গেছে।

ভেতরে ঢুকল গ্রে। ওর দিকে তাকাল কয়েকজন। তবে অধিকাংশেরই নজর দেয়ালের পাশে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা কাঁচের কেসগুলোর দিকে। নিলাম ভবনের স্টাফরা সবাই কালো রঙের পোশাক পরে জুয়েলারি দোকানের মতো কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের হাতে সাদা গ্লোভস পরা। নিলামের জন্য ভোলা বিভিন্ন জিনিসকে ভাল করে ধরে ক্রেতাদের সামনে উপস্থাপন করছে।

এক কোণায় দুটো বেহালা বাজছে আলতো সুরে। কয়েকজন স্টাফ ঘুরে ঘুরে অতিথির মাঝে লম্বা গ্লাসে করে শ্যাম্পেন পরিবেশন করছে।

পাশে থাকা ডেস্কের দিকে তাকাল গ্রে। ওখানে বিভিন্ন সংখ্যাযুক্ত প্যাডেল রাখা আছে। আরও ভেতরে এগোল ও আগতদের অনেকই আসগ্রহণ করেছে। নিলাম অনুষ্ঠানকে থামিয়ে রেখে দেরি করে আসা নির্বাক সিনেমার সেই দুই সুপারস্টারকে দেখল গ্রে। একদম প্রথম সারিতে বসে আছে তারা। ওই মহিলার কোলে একটি প্যাডেল পড়ে আছে। সঙ্গিণীর দিকে ঝুঁকে কানে কানে কী যেন বলছে পুরুষটি। দৃশ্যটি দেখতে কেমন যেন একটু অন্তরঙ্গ অশালীন বলে মনে হলো। হয়তো মহিলার ঘাড় বাঁকা থাকার কারণেই এমন লাগছে। দেখে মনে হচ্ছে, বোধহয় একটি চুমো পাওয়ার আশা করছে সে।

গ্রে আসনগুলোর মাঝখানের সারির দিকে এগোতেই মহিলাটি ওর দিকে তাকাল। তার চোখ ওর ওপর দিয়ে দৃষ্টি বুলিয়ে সরে গেল অন্যদিকে।

চিনতে পারেনি।

গ্রে নিজের অনুসন্ধান চালিয়ে গেল। মঞ্চের সামনের রুমে পৌঁছে গেল ও। ঘুরতে লাগল আস্তে আস্তে। কোনো বাহ্যিক হুমকির আশংকা দেখল না ও।

ফিওনারও দেখা পেল না।

মেয়েটি গেল কোথায়?

কাঁচের কেসের পাশ দিয়ে এগোল ও। অপরপ্রান্তের নিচের অংশে চোখ রাখল। আশেপাশে হওয়া কথাবার্তার জন্য ও কানে স্বাভাবিকের চেয়ে অর্ধেক কম শুনতে পারছে। এক স্টাফের পাশ দিয়ে এগোল ও। এক ভদ্রলোককে একটি চামড়ায় মোড়া বই দেখাচ্ছে সে। ভদ্রলোক নাকের ওপর চশমা রেখে সামনে ঝুঁকলেন।

বইটি খেয়াল করল গ্রে। প্রজাপতির ওপর হাতে লেখা ১৮৮৮ সালের একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ।

আসনের সারির নিচের অংশের দিকে এগোল ও। দরজার সামনে আবার হাজির হতেই সেই বেঁটে-খাটো মহিলার মুখোমুখি হলো। এই মহিলার ছবি সে ল্যাপটপে দেখে এসেছে। মহিলার হাতে একটি ছোট খাম। ওটা গ্রের দিকে এগিয়ে দিল। খাম হাতে নিয়ে গ্ৰে ভাবল, কী আছে এর ভেতর? মহিলার এই বিষয়ে কোনো আগ্রহই নেই, সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।

খামের সাথে একধরনের সুগন্ধীর ঘ্রাণ পেল গ্রে।

 আজব।

বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে খামের সিল ভেঙে একটি ভাঁজ করা জিনিস বের করে আনল। এর ওয়াটারমার্ক বেশ মূল্যবান। পরিষ্কার হস্তাক্ষরে একটি ছোট্ট নোট লেখা আছে।

 এমনকি গিলড পর্যন্ত জানে এই আগুনের ধারে কাছে না এসে ঘুরে ঘুরে দেখা উত্তম। সাবধানে থেকো।

চুমো রইল।

নোটে কোনো স্বাক্ষর নেই। তবে একদম নিচে গাঢ় টকটকে লাল কালি দিয়ে একটি ছোট কোঁকড়ানো ড্রাগনের প্রতীক আঁকা আছে। গ্রের আরেক হাত ওর গলায় চলে গেল। এই একইরকম দেখতে একটি রুপোলি ড্রাগন ঝুলছে ওখানে। ওর এক প্রতিযোগীর কাছ থেকে পাওয়া উপহার।

শিচ্যান।

মেয়েটি গিলড-এর হয়ে কাজ করে। সন্ত্রাসীদের মদদ যোগায় গিলড; একটি ছায়াময় সংগঠন। অতীতে সিগমা ফোর্সের সাথে ওর মোকাবেলা হয়েছিল। গ্রে টের পেল ওর ঘাড়ের চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে পুরো রুম খুঁজল ও। সেই মহিলা ওকে নোট ধরিয়ে উধাও হয়ে গেছে।

গ্রে আবার নোটটির ওপর চোখ বুলাল।

সতর্কবাণী।

 দেরিতে হলেও এই-ই বেশি…

গিলড অন্তত এখানে আছে। তারমানে, যদি শিচ্যান বিশ্বাস করে…

আসলে শিচ্যানের কথা মেনে নিতে গ্রে রাজি।

যেহেতু ওরা দুজনই এখানে চোর, তাই চোর হয়ে চোরকে সম্মান দেখানো যেতেই পারে।

একটু হৈচৈ হওয়ায় রুমের পেছন দিকে তাকাল গ্রে।

পেছনের দরজা দিয়ে একজন লম্বা ব্যক্তি নিলাম অনুষ্ঠানে প্রবেশ করলেন। ডিনার জ্যাকেটে তাঁকে দারুণ দেখাচ্ছে। ইনি মিস্টার ইরগেনচেইন, নিলামদার। তেল দেয়া কালো চুলে হাত বুলালেন তিনি, কলপ দেয়া চুল, বোঝাই যাচ্ছে। একটি বইয়ের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার শুকনো মুখে ছোট্ট করে হাসি ফুটল।

মুখ শুকনো থাকার কারণ তার পিছু পিছু উদয় হলো। গার্ড একটি মেয়ের হাতের উপরের অংশ ধরে এদিকে নিয়ে আসছে।

ফিওনা।

 ওর চেহারায় রাগ ফুটে উঠেছে। চেপে ধরেছে ঠোঁট, লাল হয়ে গেছে ওগুলো।

বেশ ক্ষিপ্ত।

গ্রে ওদের দিকে এগোল।

একদিকে সরে গেলেন ইরগেনচেইন। নরম কাপড়ে প্যাচিয়ে কী যেন নিচ্ছেন তিনি। প্রধান ডিসপ্লে কেসের সামনে গেলেন তিনি। এই কেস এতক্ষণ খালি ছিল। একজন স্টাফ কেবিনেটের লক খুলে ফেলল। ইরগেনচেইন খুব আলতোভাবে প্যাচানো কাপড় খুলে জিনিসটিকে কেসে রাখলেন।

গ্রেকে এগোতে দেখে দুহাত একসাথে করে সামনে এগোলেন তিনি। গ্রের সামনে এসেও হাত জড়ো করে রইলেন, যেন প্রার্থনা করছেন। স্টাফ তার পেছনের কেসটিকে তালাবন্ধ করে দিল।

কেসের বস্তুটিকে খেয়াল করল গ্রে।

 দ্য ডারউইন বাইবেল।

 গ্রেকে দেখতে পেয়ে ফিওনার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।

ওকে না দেখার ভান করে নিলামদারের সাথে কথা বলল গ্রে। কোনো সমস্যা?

না, স্যার, একদমই না। এই তুরুণীকে বাইরে রেখে আসা হচ্ছে, এই আরকী। ওর কাছে কোনো নিমন্ত্রণপত্র নেই তো, তাই।

নিজের কার্ড বের করে দেখাল গ্রে। আশা করি, আমি এখানে একজন গেস্টকে সাথে রাখতে পারব। আরেক হাত ফিওনার দিকে বাড়িয়ে দিল ও। ও এখানে আগেভাগে চলে এসেছে দেখে আমি খুশি হয়েছি। আমার এক ক্রেতার সাথে কনফারেন্স কল করতে গিয়ে আটকে পড়েছিলাম। আমি এই মিস, নেয়ালের সাথে আজ একটি জিনিস ব্যক্তিগতভাবে কেনা-বেচার ব্যাপারে কথা বলে এসেছি।

গ্রে মাথা নেড়ে ডারউইন বাইবেল দেখাল।

পুরো শরীর দিয়ে নিজের হতাশা প্রকাশ করলেন ইরগেনচেইন, ঠিক প্রকাশ নয়, বলা যায় প্রকাশের ভান করলেন। দুঃখজনক ঘটনা। আগুন লেগে গিয়েছিল। তবে গ্রিট্টি নেয়াল তার নিজের লটের জন্য নিলাম ভবনের সাথে চুক্তি করেছিলেন। তাঁর পক্ষের ব্যারিস্টার যদি না আসে তাহলে এই বাইবেল নিলামে উঠবেই উঠবে, আইন তো সেটাই বলে।

গার্ডের হাতে ধরা থাকা অবস্থায় হেঁচকা টান মারল ফিওনা, খুনের নেশা ওর চোখে।

ইরগেনচেইন যেন ফিওনাকে দেখতেই পাচ্ছেন না। স্যার, ওটা কিনতে হলে আপনাকে নিলামে অংশগ্রহণ করতে হবে, দুঃখিত, আমার হাত বাধা।

তাহলে সেক্ষেত্রে মিস, নেয়াল যদি আমার সাথে থেকে নিলামে অংশগ্রহণ করেন তাহলে নিশ্চয়ই আপনার আপত্তি থাকবে না?

আপনার যেমন মর্জি। ফাটা হাসি দিলেন নিলামদার। ইশারা করে গার্ডকে ছেড়ে দিতে বললেন। তবে সে যেন সবসময় আপনার সাথে থাকে। যেহেতু সে আপনার গেস্ট, সেহেতু তার দায়-দায়িত্ব আপনার।

 ফিওনাকে ছেড়ে দেয়া হলো। গ্রে ওকে নিয়ে পেছনে ফিরতে গিয়ে খেয়াল করল গার্ডটিও ওদের সাথে আসছে। দেখে মনে হলো ওরা যেন ব্যক্তিগত বডিগার্ড পেয়ে গেছে!

শেষ সারিতে গিয়ে বসল ওরা। এমন সময় ঘোষণা এলো, আর এক মিনিটের মধ্যে নিলাম অনুষ্ঠান শুরু হতে যাচ্ছে। আসনগুলোতে লোকজন বসতে শুরু করল, অধিকাংশই বসল সামনের অংশের কাছাকাছি। গ্রে আর ফিওনা পেছনের সারিতেই বসে রইল।

তুমি এখানে কী করছ? ফিসফিস করে বলল গ্রে।

আমার বাইবেল ফেরত নিতে এসেছি, তাচ্ছিল্যের সাথে ফিওনা জবাব দিল। কিংবা অন্তত চেষ্টা করে দেখছি।

সিটের পেছনে ধপ করে হেলান দিল ও, চামড়ার পার্সের ওপরে ওর হাত দুটো আড়াআড়ি করে রাখা।

সামনে থাকা মঞ্চে উঠে কিছু সাধারণ নিয়মাবলি ঘোষণা করছেন ইরগেনচেইন। পুরো নিলাম অনুষ্ঠান ইংরেজিতে পরিচালিত হবে। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা উপস্থিত আছেন তাই সবার সুবিধার্থে ইংরেজি ভাষা ব্যবহৃত হবে। নিলামে দর হাঁকার নিয়ম বর্ণনা করলেন তিনি। নিলাম ভবনের বিভিন্ন চার্জ থেকে শুরু করে কিছু আদব-কায়দাও শিখিয়ে দিলেন। নিলামে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়মটি হলো একজন। ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বার দর হাঁকতে পারবে। আর ভবনের ডিপোজিটে যে পরিমাণ অর্থ। জমা রেখেছে সেটাই হবে তাঁর দর হাঁকার সর্বোচ্চ সীমা, অর্থাৎ এর ওপরে আর সে কোনো দর হাঁকতে পারবে না।

 এত নিয়ম-কানুন শোনায় কান দিল না গ্রে। ফিওনার সাথে কথা বলতে লাগল, সামনের সারি থেকে কয়েকজন অসন্তুষ্টি নিয়ে তাকাল ওদের দিকে।

তুমি বাইবেলের জন্য এখানে এসেছ? কেন?

 জবাব না দিয়ে ফিওনা হাত শক্ত করল।

 ফিওনা…

রাগে চোখ-মুখ শক্ত করে গ্রের দিকে তাকাল ফিওনা। কারণ ওটা মাট্টির জিনিস! ওর চোখ ছলছল করতে লাগল। এটার জন্য ওরা ওকে খুন করেছে। আমি ওটা ওদের হাতে যেতে দেব না।

কারা খুন করেছে?

হাত নাড়ল ও। যারাই খুন করে থাকুক, আমি ওটা নেব এবং পুড়িয়ে ফেলব।

শ্বাস ফেলে পেছনে হেলান দিল গ্রে। ফিওনা ওর নিজের সাধ্যমতো প্রতিশোধ নেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। ও তাদেরকে আঘাত করতে চায়। অবশ্য গ্রে ফিওনাকে দোষও দিতে পারছে না… কিন্তু এভাবে বেপরোয়া আচরণ করলে তো এই বেচারিও মারা পড়বে।

বাইবেল আমাদের। আমি ওটা নিয়ে নেব। বলতে বলতে গলা ভেঙে গেল ওর। মাথা নেড়ে নাক মুছল।

গ্রে ওকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল।

ফিওনা একটু সংকোচ করলেও গ্রের হাত সরিয়ে দিল না।

সামনে নিলাম শুরু হয়ে গেছে। প্যাডেল উঠছে, নামছে। যে সেরা দাম হাঁকবে সেই জিতবে। গ্রে খেয়াল করে রাখল কে কোন জিনিস কিনে নিচ্ছে। বিশেষ করে ওর নোটবুকে যে জিনিসগুলোর কথা লেখা আছে ওগুলো কারা কিনে নিচ্ছে সেদিকে বাড়তি নজর রাখল। মেন্ডেল-এর জেনেটিক্স পেপার, ফিজিক্সের ওপর লেখা ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কসের বই এবং হিউগো ডি ভ্রিসেস-এর উদ্ভিদ রূপান্তরের ওপর লেখা ডায়েরি।

এইসব জিনিসের ক্রেতা হলো সেই নির্বাক যুগের দুই জন তারকা।

তাদের পরিচয় এখনও অজানা। আশেপাশে বসা অংশগ্রহণকারীদের ফিসফিসানি শুনল গ্রে। না, কেউ-ই তাদের পরিচয় জানে না। প্যাডেল নাম্বার দিয়েই তাদের পরিচয়।

নাম্বার ০০২।

ফিওনার দিকে ঝুঁকল গ্রে। তুমি ওই দুইজনকে চেনো? তোমাদের দোকানে কখনো গিয়েছিল?

নিজের সিটে সোজা হয়ে বসে পুরো মিনিট ধরে পর্যবেক্ষণ করল ফিওনা, তারপর আবার হেলান দিল। না।

এখানকার অন্য কাউকে চেনো?

শ্রাগ করল ও।

 তুমি শিওর তো?

হ্যাঁ, কটমট করে বলল ও। শিওর, শিওর, ধেৎ!

ওদের আওয়াজ শুনে সামনে থেকে কয়েকজন পেছনের দিকে ফিরে তাকাল।

অবশেষে সর্বশেষ জিনিসটি নিলামে উঠল। তালাবন্ধ কেস থেকে ডারউইন বাইবেলটিকে রীতিমতো ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যের সাথে বিশেষ হ্যালোজেন স্পটের নিচে রাখা হলো।

 ঢাউস সাইজের গ্রন্থটি দেখতে মোটেও ভাল নয়। কভার হিসেবে থাকা কালো চামড়ার অংশটুকু কীরকম ছিঁড়ে, মলিন হয়ে গেছে। এতে কোনো কিছু লেখাও নেই। এটা যেকোন পুরাতন জার্নালও হতে পারে।

 ফিওনা সোজা হয়ে বসল। এই জিনিসের জন্যই তো ও এতক্ষণ বসে আছে। গ্রের কব্জি ধরল ও। তুমি কী ওটার জন্য সত্যিই নিলামে অংশগ্রহণ করবে? প্রশ্ন করল, ওর চোখে আশা।

 ভ্রু কুঁচকে তাকাল গ্রে… আইডিয়া তো অত খারাপ নয়। যদি অন্য কেউ এটাকে হাতিয়ে নিতে চায় তাহলে হয়তো কিছু সূত্র পাওয়া যাবে। অন্যদিকে, এই বাইবেলে চোখ বুলানোর জন্য গ্ৰে খুব মুখিয়ে আছে। এছাড়া, সিগমা ফোর্স এই ভবনের ডিপোজিটে ২.৫ মিলিয়ন ডলার দিয়ে রেখেছে, যার মানে গ্রে সর্বোচ্চ ২.৫ মিলিয়ন পর্যন্ত দর হাঁকতে পারবে। ২.৫ মিলিয়ন; বাইবেলের সর্বোচ্চ মূল্যের চেয়েও দ্বিগুণ। যদি ও জেতে তাহলে জিনিসটিকে হাতে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারবে।

লোগান গ্রেগরির হুঁশিয়ারি আদেশ ওর এখনও মনে আছে। কিন্তু ফিওনাকে অনুসরণ করে এখানে ঢুকে সেই আদেশ অনেক আগেই ভঙ্গ করেছে ও। গ্রে এরচেয়ে আর বেশি বাড়াবাড়ি করার দুঃসাহস দেখাতে চায় না।

ও বুঝতে পারল ফিওনা ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

দর হাঁকতে শুরু করলেই ওদের জীবন হুমকির মধ্যে পড়ে যাবে। নিজেদের কপালে নিজেরাই ওয়ান্টেড সিল মারা হবে। আর যদি হেরে যায়? তাহলে এই ঝুঁকি নেয়া সম্পূর্ণ বৃথা। গ্রে আজ যথেষ্ট বোকামি করেছে, আরও করবে নাকি?

সুধীবৃন্দ, আজকের এই সর্বশেষ আইটেমের জন্য কত দাম দিয়ে নিলাম শুরু করা যায় বলুন তো? চমৎকারভাবে বললেন ইরগেনচেইন। এক লাখ ডলার দিয়েই শুরু করি? হ্যাঁ, শুরু হয়ে গেছে… নতুন একজন দর হেঁকেছেন। নাম্বার ১৪৪।

প্যাডেল নামাল গ্রে, সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে, কী যেন বলাবলি করছে ওরা।

 ওর পাশে বসে চওড়া হাসি দিল ফিওনা।

 দ্বিগুণ দর, বললেন ইরগেনচেইন। দুই লাখ ডলার, নাম্বার ০০২!

এবার তারকা যুগল দর হেঁকেছে।

গ্ৰে অনুভব করল ওই দুইজনসহ পুরো রুমসুদ্ধ লোক এবার ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এখন আর পিছিয়ে আসা চলবে না, দেরি হয়েছে গেছে। গ্রে প্যাডেল উঁচু করল।

পরবর্তী আরও ১০ মিনিট ধরে টানটান উত্তেজনাপূর্ণভাবে দর হাঁকা-হাকি চলল। নিলাম রুম থেকে কেউ চলে যায়নি। সবাই বসে আছে। ডারউইন বাইবেল কে নেয় সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। গ্রের জন্য কিছু অপ্রত্যাশিত সাহায্য চলে এলো। দর হাঁকতে যাওয়া আরও বেশ কয়েকজনকে হারিয়ে বীরদর্পে নিলামে টিকে রইল ০০২ ধারী দুজন। অর্থের পরিমাণ ইতোমধ্যে ২০ লাখ অর্থাৎ ২ মিলিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বাইবেলের সর্বোচ্চ মূল্যকে ছাপিয়ে দর বেড়ে যাওয়া গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল রুমের মধ্যে।

মাঝখানে হঠাৎ করে একজন দর হেঁকে বাজিমাৎ করার চেষ্টা করলেও নাম্বার ০০২ তাকেও উড়িয়ে দেয়। মজার ব্যাপার হলো, সেই ব্যক্তি আর দর হাঁকার সাহস করেনি।

তবে গ্রে হাঁকল। ২.৩ মিলিয়ন। ওর হাতের তালু ঘেমে যাচ্ছে।

২.৪ মিলিয়ন হাঁকলেন… নাম্বার ০০২! সুধীবৃন্দ সবাই যার যার আসনে বসে থাকুন।

 আবার প্যাডেল তুলল গ্রে।

২.৫ মিলিয়ন।

গ্রে জানে ওর দম শেষ। এবার ০০২ আবার প্যাডেল তুলবে আর ও সেটা চেয়ে চেয়ে দেখবে। ০০২ একদম অপ্রতিরোধ্য।

 তিন মিলিয়ন, যুগল থেকে পুরুষটি ঘোষণা করল, উঠে দাঁড়িয়ে গ্রের দিকে তাকাল সে। যেন চ্যালেঞ্জ করছে।

নিজেও সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছে গ্রে। চাইলেও আর দর হাঁকতে পারবে না। প্যাডেল নিচু রেখে মাথা নাড়ল ও। হার স্বীকার করে নিল।

বাউ করল অপরজন, প্রতিপক্ষের প্রতি সৌজন্যতা আরকী। একটি কাল্পনিক হ্যাঁটে হাত ছোঁয়াল সে। গ্রে খেয়াল করল তার ডান হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর মাঝখানে জালের মতো জড়িয়ে থাকা নীল রঙের একটি দাগ আছে। ট্যাটু। এখন পুরুষের সাথে সাথা সঙ্গিণীটির সম্পর্কেও গ্রে ধারণা পেল। হয়তো এরা দুই ভাই-বোন, এমনকী যমজও হতে পারে, এই একই চিহ্ন মেয়েটির বাম হাতে আছে।

গ্রে ট্যাটুটি মনের মধ্যে গেঁথে নিল। হয়তো তাদের পরিচয়ের ব্যাপারে এটা একটা সূত্র হিসেবে কাজে আসবে।

নিলামদারের কথায় ওর মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হলো।

 দেখা যাচ্ছে নাম্বার ১৪৪-এর দৌড় শেষ! বললেন ইরগেনচেইন। আর কেউ দর হাঁকবেন? এক, দুই, তিন। হাতুড়ি তুলে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত ধরে রাখার পর বাড়ি মারলেন তিনি। নিলাম শেষ!

সৌজন্যবশত হাততালি দিলো সবাই।

গ্রে জানে, ও যদি জিততো তাহলে হাততালি আরও জোরে হতো। তবে পাশ থেকে একজনকে হাততালি দিতে দেখে যারপরনাই অবাক হলো ও।

ফিওনা।

দাঁত বের করে হাসল মেয়েটি। চলো, এখান থেকে বের হই।

অন্য সবার সাথে দরজার দিকে পা বাড়াল ওরা। বেরোতে বেরোতে কয়েকজন ব্যর্থ ক্রেতা ওকে সান্তনা দিল। রাস্তায় পৌঁছে গেল সবাই। যে যার গন্তব্যে রওনা হলো।

ফিওনা ওকে টেনে নিয়ে কয়েক দোকান পেছনে থাকা একটি পেস্ট্রি শপে গেল। এখানে লোহার টেবিল আর পর্দার সুব্যবস্থা আছে। গ্রেকে নিয়ে সুস্বাদু লোভনীয় চকলেটের ডিসপ্লের সামনে দাঁড়াল ফিওনা। চকলেটের পাশাপাশি এখানে ডেনিশ স্যান্ডউইচও আছে।

তবে ফিওনা এসবের দিকে কোনো নজর দিল না। ওর ভেতরে অদ্ভুত উল্লাস খেলা করছে।

 তুমি এত খুশি কেন? গ্রে অবশেষে প্রশ্ন করল। আমরা তো নিলামে হেরে গেছি।

জানালার দিকে তাকিয়ে আছে গ্রে। নিজের পেছন দিকটার প্রতি নজর রাখা দরকার। তবে যেহেতু বাইবেল বিক্রি হয়ে গেছে সে হিসেবে বিপদ হয়তো আগের মতো নেই, গ্রে ভাবল।

আমরা ওদেরকে ভুগিয়েছি! বলল ফিওনা। দাম তুলে দিয়েছি ৩ মিলিয়ন পর্যন্ত। ফাটাফাটি!

আমার তো মনে হয়, টাকা-পয়সা ওদের কাছে তেমন কোনো ব্যাপার না।

ফিওনা খোঁপা থেকে পিন বের করে চুলগুলো ছেড়ে দিল। ঝপ করে অনেকখানি বয়স কমে গেল ওর। চোখগুলো উজ্জ্বল, খুব খুশি, তবে ওই উজ্জ্বলতার মাঝে একটু বিদ্বেষেরও ছাপ দেখা গেল।

 ওর এরকম আচরণ দেখতে দেখতে হঠাৎ পেটের ভেতরে কী যেন মোচড় দিয়ে উঠল গ্রের।

ফিওনা, কী কাণ্ড করেছ তুমি?

নিজের পার্স খুলে গ্রের দিকে কাত করে ধরল। উঁকি দিল গ্রে।

 ও খোদা! ফিওনা… তুমি…

চামড়ায় মোড়ানো পুরোনো একটি গ্রন্থ ওর পার্সে জায়গা করে নিয়েছে।

 ঠিক একই রকম দেখতে একটি ডারউইন বাইবেল মাত্র বিক্রি হয়ে গেল।

 এটা আসলটা? প্রশ্ন করল গ্রে।

যখন পেছনের রুমে ছিলাম তখন ওই ব্যাটা কানা নিলামদারের নাকের নিচ দিয়ে এটা নিয়ে নিয়েছি।

কীভাবে…?

টোপ ফেলে মাছ ধরার মতো ব্যাপার। বাইবেলের সঠিক মাপ ঠিক করে নিতে আমার প্রায় সারাদিন লেগেছিল। পরে অবশ্য ওটাকে একটু ঘষা-মাজা করেছি। তারপর কেঁদে বুক ভাসিয়ে, চিৎকার চেঁচামেচি আর একটু আনাড়িপনা দেখিয়েছি… শ্রাগ করল ও। ব্যস, কাজ হয়ে গেল।

 তোমার কাছে যেহেতু বাইবেল ছিলই তাহলে কেন আমাকে দিয়ে দর হাঁকালে…? গ্রে ব্যাপারটা অনুধাবন করল। তুমি আমাকে ব্যবহার করেছ। খেলেছ আমার সাথে।

আরে না। দুই পেন্স দামের ভুয়া জিনিসের জন্য ওই বেজন্মাগুলোর পকেট থেকে তিন মিলিয়ন ডলার খসিয়ে দেয়ার জন্য করেছি!

 খুব শীঘ্রি ওরা টের পাবে ওটা আসল জিনিস নয়, বলল গ্রে, কণ্ঠে ভয়।

জানি। কিন্তু ততক্ষণে আমিও পগার পার হয়ে যাব।

কোথায়?

 তোমার সাথে। ফিওনা পার্স বন্ধ করল।

 জ্বী, না।

তোমার মনে আছে, মাটি তোমাকে একটা ভেঙ্গে দেয়া লাইব্রেরির কথা বলেছিল?

গ্রে জানে ফিওনা কী বলতে চাইছে। গ্রিট্টি নেয়াল ওকে আভাস দিয়েছিলেন কে বা কারা যেন পুরো বিজ্ঞানীদের লাইব্রেরিকে নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। তিনি ওকে বিলের আসল কপি দেখাতে যাবেন এমন সময় হামলাটা হলো, সব নষ্ট হয়ে গেল

কপালে হাত দিল ফিওনা। আমার কাছে সব ঠিকানা লিখে রাখা আছে। ও এক হাত সামনে বাড়িয়ে দিল। তাহলে?

ভ্রু কুঁচকে হ্যান্ডশেক করতে যাচ্ছিল গ্রে।

মুখ হাঁড়ি করে ফিওনা হাত সরিয়ে নিল। তার আগে, আবার হাত বাড়িয়ে দিল ও, হাতের তালু পেতে দিয়েছে। আমি তোমার আসল পাসপোর্ট দেখতে চাই। তোমার কী মনে হয়, ভুয়া পাসপোর্ট আমি চিনি না?

ওর দিকে তাকাল গ্রে। এই মেয়ে এর আগে ওর পাসপোর্ট চুরি করেছিল। এখন হাবভাব দেখে সুবিধের মনে হচ্ছে না, একদম নাছোড়বান্দা। ভ্রু কুঁচকে স্যুটের গোপন পকেট থেকে আসল পাসপোর্ট বের করল গ্রে।

ফিওনা পড়ল। গ্রেসন পিয়ার্স। রেখে দিল টেবিলে। অবশেষে… নাইস টু মিট

পাসপোর্ট ফেরত নিল গ্রে। এখন বলল, বাইবেলটা এলো কোথা থেকে?

বলব, যদি তুমি আমাকে তোমার সাথে নাও।

 ঠাট্টা কোরো না। তুমি একটা বাচ্চা মেয়ে, আমার সাথে আসতে পারো না।

 বাচ্চা মেয়ে, সাথে কিন্তু ডারউইনের বাইবেলও আছে।

ফিওনার ব্ল্যাকমেইল দেখে গ্রে বিরক্ত হলো। ওর কাছ থেকে এই বাইবেল ছিনিয়ে নেয়া গ্রের বাঁ হাতের খেলা কিন্তু তথ্য তো আর ওভাবে আদায় করা যাবে না।

ফিওনা, এটা কিন্তু কোনো ছেলেখেলা নয়।

শক্ত করে ওর দিকে তাকাল ফিওনা। তুমি কি ভেবেছ, আমি সেটা বুঝি না? শীতল গলায় বলল ও। আমার মাট্টিকে যখন ব্যাগে করে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তুমি কোথায় ছিলে? ব্যাগে করে নিচ্ছিল ওরা।

চোখ বন্ধ করল গ্রে। মেয়েটা ওর নার্ডে আঘাত করেছে তবে ও নরম হলো না। ফিওনা, আমি দুঃখিত। টানটান গলায় বলল ও। কিন্তু তুমি যেটা বলছ সেটা সম্ভব নয়। আমি পারব না…।

বিস্ফোরণের ধাক্কায় ভূমিকম্পের মতো দোকান দুলে উঠল। ঝনঝন করে উঠল সামনের গ্লাসগুলো। গ্রে আর ফিওনা উঠে গিয়ে দাঁড়াল জানালার কাছে। রাস্তা ধোয়ায় ছেয়ে গেছে। ধোয়ার কিছু অংশ যাত্রা শুরু করেছে ঝাপসা আকাশের দিকে।

গ্রের দিকে তাকাল ফিওনা। দাঁড়াও আমি আন্দাজ করে বলছি, কোথায় হয়েছে।

আমার হোটেল রুম, গ্রে স্বীকার করল।

শুরু হিসেবে ধাক্কাটা একটু বেশিই হয়ে গেছে।

.

রাত ১১টা ৪৭ মিনিট।
 হিমালয়।

জার্মানদের হাতে বন্দি হয়েছে লিসা ও পেইন্টার। ওদের দুজনকে একটি স্লেজে বসিয়ে সেটাকে আরেক সোমোবাইল দিয়ে টেনে নেয়া হচ্ছে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলছে ওরা। প্লাস্টিক স্ট্রীপ দিয়ে ওদের দুজনকে একসাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। পেছনে পেইন্টার, সামনে লিসা।

এরকম অবস্থাতেও লিসার দিকে কুঁজো হয়ে ঝুঁকে আছে পেইন্টার, নিজের শরীর দিয়ে যতদূর সম্ভব লিসাকে সাহায্য করছে। ওর দিকে পিঠ দিয়ে হেলান দিয়ে রয়েছে লিসা। দুপাশের দণ্ডে সাথে ওদের দুই জোড়া হাত বাঁধা।

সামনে থাকা সোমোবাইলের পেছনের সিটে বসেছে সেই আক্রমণকারী। ওদের দিকে মুখ করে আছে, হাতে রাইফেল, ওটাও ওদের দিকে তাক করা। তার ভিন্ন চোখ দুটো একবারও ওদের ওপর থেকে সরছে না। ওই সোমোবাইল চালাচ্ছেন অ্যানা স্পোরেনবার্গ, এই দলের নেত্রী।

এই দলটি সাবেক নাৎসি।

কিংবা নাসির সংস্কার ভার্শন।

অথবা যা-ই হোক…

এই প্রসঙ্গ একপাশে সরিয়ে রাখল পেইন্টার। এই মুহূর্তে এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ওকে মাথা ঘামাতে হবে।

বাঁচতে হবে।

পথে যেতে যেতে পেইন্টার বুঝতে পারল, গুহায় লুকিয়ে থাকা সত্ত্বেও কীভাবে ধরা পড়েছিল ওরা। সব ইনফ্রারেডের কেরামতি। এরকম ঠাণ্ডা অঞ্চলে ওদের শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া তাপমাত্রার চিহ্ন দেখে দেখে সহজেই গুহা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে।

ওই পদ্ধতি ব্যবহার করলে এই অঞ্চলের কোথাও লুকিয়ে থাকা প্রায় অসম্ভব।

চিন্তা-ভাবনা চালিয়ে যেতে থাকল ও। মনকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির করে রেখেছে।

পালাতে হবে।

গত এক ঘণ্টা যাবত শীতের রাত কেটে স্নোমোবাইলের এই কাফেলা সুন্দরভাবে ছুটে চলেছে। ইলেকট্রিক মোটর দিয়ে চলছে এগুলো, প্রায় নিঃশব্দে এগোচ্ছে। এই ৫টি স্নোমোবাইল এই গোলকধাঁধার মতো অঞ্চল দেদারছে পাড়ি দিয়ে সামনে এগোচ্ছে, একদম নীরবে। কখনও খাড়া পাহাড় থেকে পিছলে নামছে, কখনও নেমে যাচ্ছে গভীর উপত্যকায়, আবার কখনও বরফের সেতু পার হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, সবকিছু এই দলের চেনা পরিচিত।

পেইন্টার এই রাস্তা মনে গেঁথে নেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করল। কিন্তু শান্তি আর গোলকধাঁধাময় রাস্তার জটিলতার কাছে হার স্বীকার করতে ব্যর্থ হলো ও। মাথা আবার দপদপ করছে, ঝিমঝিম করছে। মাথা ঘোরাচ্ছে। পেইন্টার মেনে নিল, সেই লক্ষণগুলো এখনও ওর শরীর থেকে চলে যায়নি। এটাও স্বীকার করে নিল, ও একদম হেরে গেছে।

ঘাড় বাঁকিয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকাল ও।

আকাশে তারাগুলো ঠাণ্ডা আলো ছড়াচ্ছে।

হয়তো তাঁর অবস্থান নির্ণয় করে ও কোন জায়গায় আছে সে-সম্পর্কে ধারণা করতে পারবে।

 ওপরের দিকে তাকিয়ে তারাগুলোকে ভাল করে লক্ষ করতে যাবে এমন সময় চোখ সরিয়ে নিল ও। চোখের পেছন দিকটা প্রচণ্ড ব্যথা করছে।

তুমি ঠিক আছে তো? ওর দিকে পেছন ফিরে ফিসফিস করল লিসা।

বিড়বিড় করে অসন্তোষ প্রকাশ করল পেইন্টার। কথা বলতে গেলে বমি হয়ে যেতে পারে।

তোমার চোখ ব্যথা করছে? লিসা অনুমান করল।

কর্কশভাবে ঘোঁতঘোঁত করে চোখ সাদা লোকটি ওদেরকে চুপ করিয়ে দিল। খুশি হলো পেইন্টার। চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে দম নিল ও। এই মুহূর্তটুকু কেটে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে।

সময় কেটে গেল একসময়।

একটি পাথুরে পাহাড়ের চূড়োয় উঠে যখন স্নোমোবাইলগুলো আস্তে আস্তে থামছে, এমন সময় চোখ খুলল ও। চারিদিকে চোখ বুলাল পেইন্টার ক্রো। এখানে তো কিছুই নেই। একটি বরফআচ্ছাদিত পাহাড়ের খাড়া অংশ পাথুরে পাহাড়ের ডান দিকে ভেঙ্গে পড়ে আছে। এতক্ষণ তুষার পড়ছিল না, এখন পড়তে শুরু করল।

এরা এখানে থামল কেন?

সামনের স্নোমোবাইল থেকে নামল আক্রমণকারী।

অ্যানাও নামলেন। বিশালদেহী লোকটি অ্যানার সাথে জার্মান ভাষায় কথা বলছে।

সোজা হয়ে কথাগুলো শোনার চেষ্টা করতেই লোকটির শেষ কয়েকটি শব্দ শুনতে পেল ক্রো।

… ওদের মেরে ফেললেই তো হয়।

রাগ কিংবা প্রতিহিংসা নিয়ে বলেনি, একদম ঠাণ্ডা মাথায় শব্দগুলো উচ্চারণ করেছে।

অ্যানা ভ্রু কুঁচকালেন। গানথার, আমাদেরকে আরও কিছু জেনে নিতে হবে। পেইন্টারের দিকে তাকালেন তিনি। তুমি ভো জানোই, আমাদের এখানে বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে। যদি তাকে এখানে পাঠানো হয়ে থাকে… যদি সে এমন কিছু জানে যেটা এই ব্যাপারগুলো বন্ধ করতে পারে?

ওরা কী নিয়ে কথা বলছে পেইন্টার সেটার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝল না। তবে ওদেরকে ওদের মতো করে উল্টাপাল্টা ভাবতে দিল। উল্টাপাল্টা ভাবতে দিয়ে যদি বেঁচে থাকা যায় তাহলে ওটাই ভাল।

মাথা নাড়ল গানথার। ও একটা সমস্যা। আমি বুঝতে পারছি। অন্যদিকে ঘুরল ও। আর কথা বলবে না।

 অ্যানা ওর গালে আলতো করে হাত দিয়ে থামালেন। স্নেহ, মমতা, কৃতজ্ঞতা নাকি তারচে বেশি কিছু…? Danke, গানথার।

মানল না সে। পেইন্টার ওর চোখে একধরনের যন্ত্রণার ছাপ দেখতে পেল। পা টেনে টেনে খাড়া ভাঙ্গা পাহাড়ের দিকে গেল সে। দেয়ালের একটি ফাটলের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। একটু পর ওদিক দিয়ে বেরিয়ে মিলিয়ে গেল ধোয়ার মেঘ।

একটা দরজা খুলে আবার বন্ধ হলো।

 বিড়বিড় করে উপহাসমূলক একটি শব্দ উচ্চারণ করল পেছনে থাকা একজন গার্ড। অপমানজনক শব্দটা ওই গার্ডের কাছে যারা আছে তারা ছাড়া আরও কেউ শুনতে পায়নি।

Leprakonige

কুষ্ঠরোগী। পেইন্টার খেয়াল করল বিশালদেহী গানথার যতক্ষণ পর্যন্ত দৃষ্টিসীমার ভেতরে ছিল ততক্ষণ গার্ড কিছু বলেনি। গানথারের মুখের ওপর বলার সাহস নেই ওর। তবে গানখারের ঝুলে যাওয়া কাঁধ আর বদমেজাজি স্বভাব দেখে ক্রো আন্দাজ করল, সে এই কথা এর আগেও শুনেছে।

 স্নোমোবাইলে চড়ে বসলেন অ্যানা। গানখারের সিটে এক নতুন গার্ড বসল। এর হাতেও রাইফেল আছে, ওদের দিকে তাক করা। আবার রওনা হলো সবাই।

একটু ঘুরে উঠে আরও গভীর গিরিসঙ্কটের দিকে যাত্রা করল ওরা। সামনের রাস্তা জুড়ে বরফ আচ্ছাদিত কুয়াশায় ভরা, নিচে কী আছে ঠিকমতো দেখা যায় না। কুয়াশার উপরে একটি পাহাড়ের ভারী শৃঙ্গ এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে দেখে মনে হচ্ছে, এই কুয়াশাকে আগুন ভেবে হাত সেঁকছে কেউ।

কুয়াশার সমুদ্রে ডুব দিল ওরা। হেডলাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে।

কয়েক ফুটে নেমে এসেছে দৃষ্টিসীমা। তারাগুলো আর দেখা যাচ্ছে না।

তারপর হঠাৎ করে ওরা গভীর অন্ধকারে তলিয়ে গেল। মনে হলো, ওদের মাথার উপরে ছায়ার সামিয়ানা ঝুলছে। কিন্তু মজার বিষয় হলো, এরকম অবস্থায় ঠাণ্ডার প্রকোপ না বেড়ে বরং কমতে শুরু করল। সামনে এগোতে গিয়ে দেখা গেল পাথুরে পাহাড়ের গায়ে আর বরফ নেই। বড় বড় পাথরের পাশ দিয়ে বরফগলা পানি গড়াচ্ছে।

পেইন্টার বুঝতে পারল ওরা কোনো এক প্রাকৃতিক উষ্ণ এলাকায় চলে এসেছে। উত্তাপের প্রাকৃতিক উৎস আছে এখানে। হিমালয়ের ভেতরে থাকা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বসন্তের কথা এখানকার খুব কম মানুষই জানে। ভারতীয় উপমহাদেশের ভূখণ্ডের নিচে থাকা প্লেটের চাপে এরকম প্রাকৃতিক উষ্ণ অঞ্চল তৈরি হয়ে থাকে। মনে করা হয়, এরকম অঞ্চল থেকেই সাংরি-লা পৌরাণিক কাহিনির জন্ম।

 তুষার কমে যেতে থাকায় সোমোবাইল রেখে দিতে বাধ্য হলো ওরা। ওগুলো পার্ক করার পর লিসা আর পেইন্টারকে স্লেজ গাড়ি থেকে মুক্ত করে কব্জিতে হাতকড়া পরিয়ে দেয়া হলো। হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো ওদের। লিসার কাছাকাছি থাকল ক্রো। দুজনের চোখেই দুশ্চিন্তা।

কোথায় ওরা? এটা কোন জায়গা?

রাইফেল আর পারকাঅলা গার্ড দ্বারা বেষ্টিত হয়ে বাকি পথ এগোল ওরা। তুষারের বদলে ওদের পায়ের নিচে ভেজা পাথর উদয় হলো। পাথর কেটে সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে, বরফ গলা পানি গড়াচ্ছে এখানে। সামনে আর আগের মতো পুরু কুয়াশার চাদর নেই।

কয়েক পা এগোতেই সামনের আঘো অন্ধকারে একটি খাড়া পাহাড়ের মুখ দেখা গেল। পর্বতের আশ্রয়ে ওটার অবস্থান। প্রাকৃতিকভাবে তৈরি একটি গভীর গুহা। এটা কোনো স্বর্গউদ্যান নয়… জায়গাটি কালো গ্রানাইটে ভরপুর, গরমে ঘামছে ওগুলো।

সাংরি-লার চেয়েও বেশি গরম এখানে।

ক্রোর পাশে হোঁচট খেল লিসা। হাত বাঁধা থাকার পরও ক্রো যতদূর সম্ভব ওকে ধরে রাখার চেষ্টা করল। তবে ও বুঝতে পারল লিসা দুর্বলভাবে পা ফেলছে।

সামনে জলীয় বাষ্পের পর্দা ফুড়ে একটি ক্যাসলের (অট্টালিকা) উদয় হলো।

 ঠিক পুরো না, তবে আধা ক্যাসল বলা যায়।

কাছে এগোতেই পেইন্টার বুঝতে পারল এটা অট্টলিকার সম্মুখভাগ। চলে গেছে একদম গুহার শেষ অংশ পর্যন্ত। কামান-গোলা নিক্ষেপের জন্য ছিদ্রবিশিষ্ট দুটো বড় টাওয়ার দাঁড়িয়ে আছে দুপাশে। মোটা কাঁচের জানালার পেছন থেকে আলো আসছে।

GranitschloB, ঘোষণা করলেন আনা। ওদের সবাইকে নিয়ে প্রবেশ পথের দিকে এগোলেন। তার চেয়ে দ্বিগুণ উচ্চতার গ্রানাইট বীরগণ প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে আছে।

কালো লোহার পাত দিয়ে মোড়ানো ভারী ওক কাঠের একটি দরজা প্রবেশপথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে। দলটি এগোতেই কপিকল উপরে উঠতে শুরু করে প্রবেশদ্বার খুলে দিল।

বড় বড় পা ফেলে এগোলেন অ্যানা। চলো সবাই। অনেক রাত হয়ে গেল।

অস্ত্রের মুখে প্রবেশদ্বারে ঢুকল লিসা ও ক্রো। গুহার ছাদ, কিনারা, পাঁচিল ও ধনুকাকৃতির জানালাগুলো পর্যবেক্ষণ করল পেইন্টার। পুরো মেঝেতে থাকা গ্রানাইট ঘেমে ভিজে উঠেছে। কালো তেলের মতো পানি গড়াচ্ছে। মনে হলো, এই ক্যাসল বোধহয় চোখের সামনে গলে কালো পাথুরে চেহারায় ফিরে যাচ্ছে।

কয়েকটি জানালা থেকে বের হওয়া আলো ক্যাসলের মেঝেকে নরকের মতো উজ্জ্বল করে তুলেছে। এই দৃশ্য দেখে ক্রোর হিরনিমাস বস-এর পেইন্টিঙের কথা মনে পড়ে গেল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে এই শিল্পী নরকের বিভিন্ন ছবি আঁকার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। যদি বসক-কে আন্ডারওয়ার্ল্ডের গেইটের ভাস্কর্য করতে দেয়া হতো তাহলে এই ক্যাসলের মতো করতেন তিনি।

অ্যানার পিছু পিছু ক্রো বাধ্য হয়ে এগোল। ক্যাসলের ধনুকাকৃতির প্রবেশদ্বারের নিচ দিয়ে প্রবেশ করল ওরা। উপরের দিকে তাকাল ক্রো। আন্ডারওয়ার্ল্ডের গেইটে থাকা দান্তের কথাগুলো হয়তো এখানে লেখা থাকতে পারে।

এখানে যে ঢুকবে তার আর কোনো আশা নেই।

কিন্তু কথাগুলো লেখা নেই এখানে… তবে এখানে কোনো আশাও নেই।

কোনো আশা নেই…

এই ক্যাসলে যে ঢুকবে তাদের আর কোনো আশা নেই।

.

রাত ৮টা ১৫ মিনিট।
কোপেনহ্যাগেন, ডেনমার্ক।

হোটেলে বিস্ফোরণের শব্দ মিলিয়ে যেতেই ফিওনার হাত ধরে দোকানের বাইরে বেরিয়ে এলো গ্রে। উৎসাহী জনতার ভিড় ঠেলে পাশের গলির দিকে রওনা হলো।

সাইরেনের আওয়াজ ভেসে এলো দূর থেকে।

আজ সারাদিনে কোপেনহ্যাগেনের দমকল কর্মীদের অনেক দৌড়াতে হলো।

গলির কোণায় গিয়ে পৌঁছাল গ্রে। ধোঁয়া আর মানুষের হল্লা থেকে দূরে চলে এসেছে। ফিওনাকেও টেনে নিয়ে এসেছে সাথে করে। অস্ত্রধারীকে খুঁজছে।

পেয়েও গেল। একজন নারী।

 কাছেই আছে। রাস্তার ওপাশে আধ-ব্লক পেছনে।

এই সাদা চুলঅলি মহিলা নিলাম অনুষ্ঠানেও ছিল। তার পরনে শোভা পাচ্ছে আঁটোসাটো কালো স্যুট, দৌড়-ঝাঁপের জন্য এরকম পোশাক খুবই উপযোগী। হাতে সাইলেন্সর লাগানো পিস্তল। হাঁটুর কাছে ওটা নামিয়ে ওদের দিকে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে আসছে। এক হাত রেখেছে কানে, ঠোঁট নড়ছে।

রেডিও।

ল্যাম্পপোস্টের নিচ দিয়ে তাকে এগোতে দেখেই গ্রে বুঝতে পারল, ও ভুল করেছে। এই মহিলা নিলাম অনুষ্ঠানে ছিল না। সেই মহিলার চুল আরও বড় ছিল, চেহারা আরেকটু রোগা ছিল।

হয়তো তার বড় বোন।

অন্যদিকে ঘুরল গ্রে।

ও আশা করছিল ফিওনা এতক্ষণে দৌড়ে গলির অর্ধেকে চলে গেছে। কিন্তু দেখা গেল, মাত্র ১৫ ফুট দূরে একটি মরচে ধরা সবুজ রঙের ভেসপা স্কুটারের দুপাশে পা দিয়ে কী যেন করছে সে।

কী করছ তু…?

দেখি চড়া যায় কি-না। পার্স খুলে একটি ক্রু-ড্রাইভার বের করে স্কুটারের পেছনে রাখল।

জলদি ওর পাশে গেল গ্রে। এটার ওপর চুরিবিদ্যা ফলানোর মতো সময় নেই। কিন্তু।

কাঁধের ওপর দিয়ে গ্রের দিকে তাকাল ফিওনা। স্কুটারকে স্টার্ট দেয়ার জন্য অন্ধের মতো বিভিন্ন তারের মধ্যে ওর আঙুলগুলো হাতড়ে বেড়াচ্ছে। দুটো তার দিয়ে চেষ্টা করল। কেশে উঠে, চিৎকার দিয়ে থেমে গেল ইঞ্জিন।

ধেৎ…

 ফিওনা বেশ ভালই চেষ্টা করছিল…. কিন্তু ওর ওপরে আর ভরসা করা যাচ্ছে না।

গ্রে ওকে পেছনে যাওয়ার ইশারা করল। আমি চালাব।

শ্রাগ করে পেছনের সিটে গেল ফিওনা। স্কুটারে চড়ে গ্রে ওটার স্টার্টারে লাথি মেরে ইঞ্জিন চালু করার চেষ্টা করল। হেডলাইট অফ করে অন্ধকার গলিতে নেমে গেল ও। ঠিক নেমে যাওয়া বলা যায় না, স্কুটারকে টেনে-টুনে নিয়ে গেল আরকী।

চালু হ রে বাবা, বলল গ্রে।

দুই নম্বর গিয়ারে তুলে দাও, ফিওনা বলল। এই বুড়ো জিনিসের ভেতর থেকে শক্তি বের করতে হলে কৌশল খাটাতে হবে।

 পেছনের সিটে বসা কোনো মাতব্বরকে আমার প্রয়োজন নেই।

মুখে বললেও গ্রে ঠিকই ফিওনার কথা শুনে ক্লাস চেপে গিয়ার বদলাল। চমকে ওঠা বাচ্চা ঘোড়ার মতো লাফ দিল স্কুটার। গলির ভেতর দিয়ে দ্রুত এগোল ওরা। স্তূপ আর ডাস্টবিনের বিভিন্ন ময়লার ওপর দিয়ে ঝাঁকি খেতে খেতে এগোল।

সাইরেনের আওয়াজ হলো ওদের পেছনে। গ্রে পেছনে তাকাল। দমকলের গাড়ি গলিমুখে এসে দাঁড়িয়েছে, ওটার আলো ঝিকমিক ঝিকমিক করছে, বিস্ফোরণের আগুন নেভাতে হাজির হয়েছে। ঘাড় ফেরাবার আগেই ল্যাম্পপোস্টের আলোতে একটি শরীরে অবয়ব দেখল গ্রে।

শুটার।

গ্রে গতি বাড়িয়ে দিল। স্কুটারকে একটি লম্বা কন্সট্রাকশন বিমের পাশে নিয়ে শুটারের কাছ থেকে নিজেদের আড়াল করল ও। দেয়ালের পাশ ঘেঁষে এগোলে গলির মাথা থেকে সোজা গুলি খেতে হতো।

ওদের সামনে বড় রাস্তার আলো দেখা যাচ্ছে। ওটাই ওদের একমাত্র ভরসা।

 সামনে খেয়াল রাখতে রাখতে গ্ৰে দেখল দ্বিতীয় আরেকটি অবয়ব হাজির। পাশ দিয়ে একটি গাড়ি যেতেই ওটার হেডলাইটের আলোতে তার সাদা চুলগুলো রুপোলি দেখাল। পুরুষ। পরনে কালো লম্বা ডাস্টার জ্যাকেট। পেছনের জনের জাত ভাই হাজির। কোট সরিয়ে একটি শটগান বের করল সে।

ওই মহিলা নিশ্চয়ই একে রেডিওতে বলে অ্যামবুশ করার জন্য সেট করেছে।

 শক্ত করে ধরে থাকো! গ্রে হাঁক ছাড়ল।

এক হাত শটগান উঁচিয়ে ধরতেই গ্রে খেয়াল করল এই ব্যক্তির অন্য হাত ব্যান্ডেজ করা। কব্জি থেকে কনুই পর্যন্ত। যদিও তার চেহারায় ছায়া ঢাকা রয়েছে, তবুও গ্রে বুঝতে পারল লোকটা কে।

এই ব্যক্তি গ্রিট্টি নেয়ালকে খুন করেছিল।

বারটেলের আক্রমণের স্বীকার হওয়ার পর সেগুলোর জঘমে এখন ব্যান্ডেজ করে এসেছে।

শটগান গ্রের দিকে তাক করা হলো।

হাতে সময় নেই।

হাতল ঘুরিয়ে স্কুটারটিকে লোকটার দিকে হেঁচড়ে স্কিড করাল গ্রে।

 ঝলসে উঠল শটগান। পাশের বাড়ির দরজায় ছররা গুলি হামলে পড়ল।

 প্রচণ্ড ভয়ে চিৎকার করে উঠল ফিওনা।

তবে গুলি ছোঁড়া হয়েছে ওই একবারই। স্কুটারকে ছুটে আসতে দেখে শুটার একপাশে সরে গেছে। গলির সামনের অংশ ফাঁকা হওয়ার পর স্কুটার তুলল গ্রে। সিমেন্টের রাস্তার ওপর রাবারের টায়ার আর্তনাদ করে উঠল। রাস্তায় ওঠার সময় একটি অডি গাড়ির ড্রাইভার কয়েকবার হর্ন দিয়ে সতর্ক করল ওকে।

গ্রে রওনা হলো।

 হাতের মুঠো ঢিলা দিল ফিওনা।

ধীর গতিতে এগোনো গাড়ির ভেতর দিয়ে চলল ওরা, রাস্তা ঢালু হয়ে নেমে যেতেই ওদের গতি বাড়তে শুরু করল। নিচে এই রাস্তা দিয়ে একটি ক্রসরোডের সাথে গিয়ে শেষ হয়েছে। তীক্ষ্ণ বাঁক নেয়ার জন্য ব্রেক চাপল গ্রে। একটি ক্যাবল স্কুটারের পেছনের টায়ারের পাশ থেকে লাফিয়ে উঠল।

ব্রেকের ক্যাবল।

স্কুটার যখন হেঁচড়ে যাচ্ছিল তখন নিশ্চয়ই এটা খুলে গেছে।

গতি কমাও? গ্রের কানের কাছে চিৎকার করল ফিওনা।

 ব্রেক নেই! গ্রে জবাব দিল। সাবধান!

ইঞ্জিন বন্ধ করে স্কুটারকে এদিক-ওদিক দুলিয়ে, ঘুরিয়ে গতি কমানোর চেষ্টা করল ও। পেছনের চাকাটিকে একটু ঘষটে নিয়ে আসার চেষ্টা করতেই রাবার থেকে ধোঁয়া বেরোল।

ক্রসরোডের মাথায় পৌঁছে গেছে, খুব দ্রুত এগোচ্ছে ওরা।

একপাশে কাত করে স্কুটারের গতি কমানোর চেষ্টা করল গ্রে। ওটার ধাতব শরীর থেকে স্ফুলিঙ্গ বেরোল। রাস্তাগুলোর সংযোগস্থল পর্যন্ত হেঁচড়ে এগোল ওরা। একটি ট্রাকের সামনে দিয়ে অপর রাস্তায় গিয়ে উঠল। গর্জে উঠল হর্ন। ব্রেক কষার তীব্র আওয়াজ শোনা গেল।

রাস্তার এক পাশে গিয়ে ধাক্কা লাগল ওদের স্কুটার। ছিটকে গেল গ্রে ও ফিওনা।

রাস্তার পাশে থাকা একটি বেড়া ওদের এই সংঘর্ষের ফলে ভেঙ্গে গেল। তবে গড়ানি খেয়ে কোনোমতে ফুটপাটে উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হলো ওরা। গ্রে উঠে দাঁড়িয়ে ফিওনার কাছে গিয়ে বলল, তুমি ঠিক আছে তো?

 ফিওনাও উঠে দাঁড়িয়েছে। ব্যথা কম ওর রাগ হচ্ছে বেশি। দুই শ ইউরো দিয়ে এই স্কার্ট কিনেছিলাম। ওর পোশাকের একপাশ লম্বালম্বি আকারে ছিঁড়ে গেছে। এক হাত দিয়ে ছিঁড়ে যাওয়া ফাঁকা অংশটুকু বন্ধ করতে করতে আরেক হাত বাড়িয়ে নিজের পার্স তুলে নিল।

 গ্রের আরমানি স্যুটের অবস্থা আরও খারাপ। ওর এক হাঁটু বেরিয়ে পড়েছে, জ্যাকেটের এক হাতা দেখে মনে হচ্ছে ঝামা দিয়ে ঘষা হয়েছে ওটাকে। তবে এসব কাটাছেঁড়া আর সামান্য আঘাত ছাড়া ওরা প্রায় অক্ষত আছে।

অন্যান্য গাড়িঘোড়া চলে যাচ্ছে দুর্ঘটনাস্থলের পাশ দিয়ে।

হাঁটা ধরল ফিওনা। এখানে ভ্যাসপার দুর্ঘটনা প্রায়ই হয়। যখন তখন চুরিও হয় এগুলো। কোপেনহ্যাগেনের সকল স্কুটার হলো অনেকটা সরকারি জিনিসের মতো। দরকার পড়েছে? হাতের কাছে যেটা আছে নিয়ে ছুট লাগাও। কাজ শেষে? যেখানে খুশি ফেলে যাও। ওটা আবার অন্য কেউ ব্যবহার করবে। ভ্যাসপা নিয়ে এখানে কেউ মাথা ঘামায় না।

কিন্তু এবার ঘামাল।

একজোড়া নতুন চাকা দৃষ্টি আকর্ষণ করল ওদের। দুই ব্লক পেছনে একটি ব্ল্যাক সেডান রাস্তা দিয়ে ওদের দিকে ধেয়ে আসছে। হেডলাইটের উজ্জ্বল আলো থাকায় ভেতরে থাকা আরোহীদেরকে চেনা গেল না।

ফিওনাকে নিয়ে ফুটপাতে হাঁটতে শুরু করল গ্রে, গভীর ছায়া খুঁজছে। এখানকার একপাশে ইটের লম্বা দেয়াল ছাড়া আর কিছু নেই। কোনো গলি, বিল্ডিং, কিছু নেই। স্রেফ একটি উঁচু দেয়াল। দেয়ালের পেছন থেকে হালকা সুরে বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসছে।

ওদের পেছনে থাকা স্কুটারের পেছনে এসে সেডানের গতি কমল।

বোঝাই যাচ্ছে ওদের স্কুটারে পালানোর খবর রিপোর্ট করা হয়েছে।

এদিকে! বলল ফিওনা।

কাঁধে পার্স ঝুলিয়ে ছায়ায় থাকা একটি পার্ক বেঞ্চের ওপর চড়ল ও। তারপর ওটার হেলান দেয়া অংশটুকু ব্যবহার করে লাফিয়ে উঠে উপরে ঝুলতে থাকা একটি গাছের ডাল ধরল। গাছের ডালের ওপর তুলে দিল দুই পা।

কী করছ?

 রাস্তার ছেলেরা এই কাজ সবসময়ই করে। ফ্রি প্রবেশ।

কী?

আরে আসো।

হাতের সাহায্যে গাছের মোটা ডাল ধরে এগোল ফিওনা। ইটের দেয়ালের ওপাশে লাফ দিয়ে নামল।

ধেৎ।

 সেডান আবার রাস্তায় চলতে শুরু করেছে।

কোনো উপায় না দেখে গ্রে-ও ফিওনার পথ অনুসরণ করল। বেঞ্চে লাফিয়ে উঠল। গ্রে। দেয়ালের ওপাশ থেকে আলতো করে সুর ভেসে আসছে। মাথা নিচ দিকে ঝুলিয়ে দেয়ালের ওপর দিয়ে কিছু অংশ গেল ও।

ওপাশে জ্বলজ্বলে হারিকেনে সুন্দর একটি ওয়ান্ডারল্যান্ড দেখা যাচ্ছে, খুদে অট্টালিকা আর রাইডের জন্য বিভিন্ন পাকানো রেল।

টিভোলি গার্ডেনস।

এই পার্ক কোপেনহ্যাগেনের কেন্দ্রে অবস্থিত। দেয়ালের এই উচ্চতায় দাঁড়িয়ে গ্রে পার্কের সেন্ট্রাল লেকটা দেখতে পেল। লেকের পানিতে হাজার হাজার হারিকেন আর লাইটের উজ্জ্বল আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। দুপাশে ফুল দিয়ে সাজানো পথ কাঠের রোলার কোস্টার, পানোৎসব আর ফেরিস হুইলের দিকে চলে গেছে। তথ্য-প্রযুক্তির দিক দিয়ে ডিজনির চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও এই পুরোনো পার্কটি বেশ জীবন ঘনিষ্ঠ।

ওয়ালের ওপর দিয়ে গাছের ডাল ধরে পার্কের আরও একটু ভেতরে এগোল গ্রে।

একটু দূরে, ফিওনা ওর জন্য অপেক্ষা করছিল, ওকে দেখে ইশারা করল। বাগানের শেডের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল ও।

এখন পা ছেড়ে দিয়ে গাছের ডাল ধরে ঝুলছে গ্রে।

ডান হাতের পাশে কীসের যেন শব্দ হওয়ায় গ্রে একদম চমকে উঠল। গাছের ডাল ছেড়ে দিল ও। হাত ছুঁড়ে নিজের ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করল। অনেক ফুলের ওপর বেশ সজোরে আছড়ে পড়ল গ্রে। এক হাঁটুত বেশি চাপ লেগেছে। তবে বাগানের দো আঁশ মাটি ওকে একটু আরাম দিল। দেয়ালের পেছনে গর্জে উঠল ইঞ্জিন, দরজা বন্ধ করার আওয়াজ পাওয়া গেল।

ওদেরকে দেখে ফেলেছে।

মুখবিকৃত করে ফিওনার সাথে যোগ দিল গ্রে। বেচারির চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। গুলি হওয়ার আওয়াজ শুনেছে ও। কোনো কথা না বলে টিভোলি গার্ডেনস-এর ভেতরে ছুটল ওরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *